তার নাগাল পাওয়া হলো না/ দুলাল মাহমুদ

ইন্টারভিউ নেয়া তো দূরে থাক, শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে দেখাটুকু পর্যন্ত হলো না। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে তিনি চলে গেলেন এমন এক জগতে, যেখানে তার দেখা পাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। এমনিতেই তিনি ছিলেন সবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। যখন ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে দুরন্ত হরিণের মতো ছুটতেন, তখন তাকে অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না। আবার যখন এলোমেলো হয়ে যায় তার মনোজগত, তখনও তিনি ছিলেন সবার নাগালের বাইরে। সত্যি সত্যি তাকে ধরার জন্য অনেক দিন ধরে সুযোগ খুঁজছিলাম। আমি যেহেতু তাকে চিনতাম না, লোকমুখে জানতাম তার কীর্তির টুকটাক কথা, এ কারণে তার কাছে পৌঁছানোর জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম। তাকে চিনতেন এবং তার সঙ্গে একই সময়ে অ্যাথলেটিকস করতেন অ্যাথলেট কাজী আলমগীর। দু’জনের বসবাস ছিল অনেকটা কাছাকাছি। ঢাকার মগবাজার এলাকায়। ষাট দশকের খ্যাতিমান ক্রীড়াবিদ কাজী আলমগীরকে অনুরোধ করেছিলাম, কোনোভাবে তাকে ম্যানেজ করতে পারলে আমাকে যে কোনো সময় যেন খবর দেয়া হয়। একমাত্র তিনিই তার কিছুটা খোঁজ-খবর রাখতেন। আলমগীর ভাই নিজেই শারীরিকভাবে অসুস্থ। মুক্তিযুদ্ধের সময় হারিয়েছেন এক হাত। জীবন থেকে বিয়োগ হয়েছে প্রিয়তমা স্ত্রী। এক পুত্রকে নিয়ে কষ্টকর জীবন। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় দায়ভার তার কাঁধে। জীবন তাকে এক মুহূর্তের জন্যও স্বস্তি দেয় না। ক্লান্তি, জরা ও বয়সও তাকে অনেকটাই কাবু করে ফেলেছে। তবুও মনের জোরে ছুটে চলেন। আমার কথাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রায়শই ছুটে যেতেন তার খোঁজে। অধিকাংশ সময়ই তার দেখা পেতেন না। আর যখন পেতেন, তখন তিনি যেন হয়ে যেতেন দুরন্ত ঘোড়া, ছুটে যেতেন অনির্দিষ্ট কোনো গন্তব্যে। যেন অনেক কাজের তাড়া। সময়মত সম্পন্ন না করতে পারলে ক্ষতি হয়ে যাবে এই জগত-সংসারের। কারো সঙ্গে দু’দন্ড কথা বলার অবকাশ নেই। অথচ তার কোনো জগত-সংসার ছিল না। আলমগীর ভাই কোনোক্রমেই তাকে যুৎসইভাবে পাচ্ছিলেন না। প্রায়ই তার ব্যর্থ প্রচেষ্টার কথা আমাকে জানিয়ে যেতেন। আমি হতোদ্যম হলেও তাকে ফের চাঙ্গা করতাম। যদিও আমি জানতাম, আলমগীর ভাই যেহেতু আমাকে কথা দিয়েছেন, তিনি আমাকে হতাশ করতে চাইবেন না। বরং আমি এক ধরনের অপরাধবোধে ভুগতাম, বেচারাকে এমন একটা হয়রানিমূলক কাজে জড়িয়ে ফেলায়। আলমগীর ভাই অবশ্য একমুখ হাসি নিয়ে আমার কথা উড়িয়ে দিতে চাইতেন। এভাবে পেরিয়ে যায় অনেকগুলো দিন।
শেষ অব্দি আলমগীর ভাই তার নাগাল যা-ও বা পেলেন, তখন তিনি সবকিছুর বাইরে, অচিন এক দেশে উড়ে গেছে তার প্রাণপাখি। গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাত প্রায় ১২টায় কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তিনি চলে গেলেন পরপারে। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম একজন সেরা অ্যাথলেট এতটা নীরবে, নির্লিপ্তভাবে চলে গেলেন, যা এক কথায় মর্মান্তিক, মর্মস্পর্শী ও মর্মবিদারক। সত্যি অনেক সময় বাস্তবকে হার মানায়। তিনিও মানিয়েছেন। অনাদর, অবহেলা ও অযত্মে নিভে গেছে তার প্রাণপ্রদীপ। জীবনের গতির কাছে হেরে যাওয়া দুরন্ত গতির এই দ্রুততম মানব হলেন সিরাজুল ইসলাম। এই প্রজন্ম তাকে চেনে না। চেনার কথাও নয়। স্বাধীনতার পর আর তাকে অ্যাথলেট মাঠে পঙ্খীরাজ ঘোড়ার মতো ছুটতে দেখা যায়নি। ষাট দশকে তিনি ছিলেন টগবগে ঘোড়ার মতো তেজীয়ান, উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে তার সঙ্গে পাল্লা দেয়া যে কারো জন্যই ছিল বড় এক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে তাকে পরাস্ত করা ছিল কঠিন কাজ। ৪গুণন১০০ এবং ৪গুণন৪০০ মিটার রিলেতে তার দল ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অসাধারণ এক অ্যাথলেট হয়েও তার উজ্জ্বল দিনগুলো ঢাকা পড়ে গেছে ইতিহাসের ধুলোর আড়ালে। আর আমাদের দেশ তো এমনই- আজ যে হিরো, কাল সে খুব দ্রুত অচেনা হয়ে যায়। উদ্যোগ নেই কোনো কিছু সংরক্ষণের। আর অ্যাথলেট সিরাজ তো থেকেও ছিলেন না থাকার মতো। যখন উজ্জ্বল সূর্যের নিচে ছিলেন, তখনও তিনি ছিলেন অন্য সবার চেয়ে একটু আলাদা। শান্ত, চুপচাপ, নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা স্বভাবের। যেজন্য খুব বেশি বন্ধু-বান্ধব ছিল না। কারো কাছে মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়ে হুল্লোড়ে মেতে উঠতে পারতেন না। এ কারণে তার সম্পর্কে মাঠের বন্ধুরা খুব একটা জানতেন না। কিন্তু অ্যাথলেট মাঠে তিনি তার ঔজ্জ্বল্য, দীপ্তি ও গতি দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে দিতেন। কতবার তিনি দ্রুততম মানব হয়েছেন কিংবা ২০০ মিটারে সাফল্য দেখিয়েছেন, তার কোনো তথ্য নেই। তার জন্ম রায়পুরায়, ১৯৪২ সালে।
অ্যাথলেট কাজী আলমগীর তার সম্পর্কে বলেন, ‘কুষ্টিয়া থেকে আমি যখন ঢাকা আসি, তখন সিরাজকে পাই। আমাদের সমসাময়িক অ্যাথলেট। অমায়িক ও শান্ত প্রকৃতির ছিলেন। আর ছিলেন অসম্ভব হ্যান্ডসাম ও সুঠামদেহী। তার থাই ছিল দেখার মতো। সম্ভবত তিনি ১৯৬২, ১৯৬৪ ও ১৯৬৮ সালে দ্রুততম মানব হন। একই সঙ্গে ২০০ মিটারেও তিনি কৃতিত্ব দেখান। তিনি ছিলেন ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অ্যাথলেট। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সেরা অ্যাথলেটদের একজন ছিলেন তিনি। এ কারণে তাকে পাকিস্তান ও জার্মানিতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়।’ ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান অ্যাথলেটিক্স মিটে দ্রুততম মানব হন সিরাজ। ১০ দশমিক ৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নতুন রেকর্ড গড়েন। মোহামেডানের হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীকালে মেজর ও মন্ত্রী) দ্বিতীয় ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের মজিবর রহমান তৃতীয় হন। এছাড়া ৪৪ দশমিক ২ সেকেন্ড সময় নিয়ে ৪গুণন১০০ মিটার রিলেতে পূর্ব পাকিস্তানের নতুন রেকর্ড গড়ে ঢাকা মোহামেডান। সে দলে ছিলেন সিরাজ, হাফিজ উদ্দিন,আরজান খান। সিরাজের কিছুটা সিনিয়র অ্যাথলেট ছিলেন আরজান খান। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বেশ কয়েকজন অ্যাথলেটকে পশ্চিম পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের জন্য নেয়া হয়। সেই ক্যাম্পে আমি, সিরাজ, মেরাজ, শরীফ প্রমুখ ছিলাম। সেটি ছিল চার মাসের ক্যাম্প। এই ক্যাম্প থেকে জার্মানিসহ ফার-ইস্টের পাঁচটি দেশে ছয় মাসের ট্রেনিংয়ের জন্য আমাকে নির্বাচিত করা হয়। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। এমনিতেই অনেক দিন যাবৎ বাড়িছাড়া। আমাকে নির্বাচিত করায় আমি কান্নাকাটি শুরু করে দেই। তখন আমার পরিবর্তে সিরাজকে পাঠানো হয়। ১৯৬৫ সালে লাহোরে পাঁচটি দেশকে নিয়ে হয় আমন্ত্রণমূলক মিট। তাতে হিটে ১০ দশমিক ৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে সিরাজ প্রথম হয়। সম্ভবত এশিয়ান গেমসে স্বর্ণজয়ী অ্যাথলেট আবদুল খালিককে হারিয়ে চমক দেখায়। কিন্তু ফাইনালে আবদুল খালিক প্রথম ও সিরাজ তৃতীয় হয়ে যায়। ১৯৬৫ সালে ইরানের রাজার সিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে আয়োজিত করোনেশন ডে মিটে ১০০ মিটারে আমি প্রথম, সান্টু দ্বিতীয় হলেও মাসলপুলের কারণে সিরাজ কিছুই হতে পারেনি। তবে আমার দেখা মতে সিরাজ ছিল ১০০ মিটারে ফাইনেস্ট অ্যাথলেট। ২০০ মিটারে ভালো না করলেও ১০০ মিটারে তার কোনো তুলনা হয় না।’ দেশের অন্যতম সেরা অ্যাথলেট খন্দকার আবুল হাসান স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম সেরা অ্যাথলেট ছিল সিরাজ। পশ্চিম পাকিস্তানের অ্যাথলেটদের সঙ্গে তারই কেবল টেক্কা দেয়ার ক্ষমতা ছিল। একবার তো এশিয়ার দ্রুততম মানব আবদুল খালিককে ট্রায়ালে হারিয়ে দেন। ১০০ ও ২০০ মিটারে পূর্ব পাকিস্তানে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। ১০০ মিটারে তার সেরা টাইমিং ছিল সম্ভবত ১০ দশমিক ৪। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এই টাইমিং ছিল বিস্ময়কর। সিরাজের ফিগার ছিল দুর্দান্ত। একজন অ্যাথলেটের যাবতীয় গুণাবলী তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল।’ ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের করাচীতে দ্বাদশ ন্যাশনাল গেমসে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে তৃতীয় হন সিরাজ। এই ইভেন্টে ১০ দশমিক ৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে জন পারমল প্রথম ও ইকবাল শিনওয়ারী দ্বিতীয় হন।
একসময়ের কৃতী অ্যাথলেট ফাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) শেখ মুহাম্মদ রুস্তম আলী বলেন, ‘খুবই ভালো স্প্রিন্টার ছিলেন সিরাজ। কোনো ট্রেনিং ছিল না। ছিল ন্যাচারাল অ্যাবিলিটি। তা দিয়ে তিনি ওপরে উঠে আসেন। এক কথায় তিনি ছিলেন আউটস্ট্যান্ডিং। তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায়নি। প্রশিক্ষণ ও গাইডেন্স পেলে তিনি হতে পারতেন দেশের বড় অ্যাসেট। যখন তাকে নিয়ে চিন্তা করা হয়, তখন জানা যায় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। তার ব্যবহার ছিল চমৎকার। খুবই ভদ্র ছিলেন।’
এক সময়ের খ্যাতিমান অ্যাথলেটদের স্মৃতিচারণায় সিরাজুল ইসলামকে এক ঝলক চেনা গেলেও এ থেকে তাকে পুরোপুরিভাবে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। তার সম্পর্কে যা কিছু তথ্য পাওয়া যায়, তার প্রায় সবটুকুই অন্যদের স্মৃতিচারণা থেকে পাওয়া। আর কে না জানে, স্মৃতি সবচেয়ে বড় প্রতারক। অ্যাথলেট জীবনে সিরাজ চাকরি করতেন ওয়াসায়। তবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর তাকে আর সুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়নি। আসলে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর একটি নতুন দেশ, বাংলাদেশ জন্ম নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়খন্ড বদলে দিয়েছে অনেকের জীবনকে। তাদের মধ্যে অ্যাথলেট সিরাজ একজন। অবশ্য তার মনোজগত কী কারণে বদলে যায়, তার কোনো কূল-কিনারা করা যায়নি। এ বিষয়টি হয়ে আছে চির-রহস্যের এক আধার। কেউ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। কেউ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার পিতা-মাতা-বোনকে তার সামনে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। কারো মতে, প্রেম-ভালোবাসার আগুনে পুড়ে ছারখার হয়েছেন তিনি। আবার কেউবা বলেন, পারিবারিক জীবন তাকে বড় বেশি দাগা দিয়েছে। এর কোনোটির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তাকে নিয়ে যে ফানুস তৈরি হয়েছে, তা সবই শোনা কথার ভিত্তিতে। প্রকৃত অর্থে তার মানসিক পৃথিবী বদলে যাবার আসল ঘটনা এখনও হয়ে আছে অনুদ্ঘাটিত।
মনের জগত ওলোট-পালট হয়ে গেলে এই দুনিয়ার কীইবা মূল্য থাকে? সিরাজের কাছেও তার কানাকড়ি মূল্য ছিল না। তবে কখনো-সখনো তিনি নিজেকে মনে করতেন এই পৃথিবীর সম্রাট। কপর্দকহীন হলেও তখন কাছের কিংবা দূরের সবাইকে চাইতেন সবকিছু বিলিয়ে দিতে। তার নিজস্ব কোনো ঠিকানা ছিল না। রাতের বেলায় মগবাজারে ভাইয়ের বাসায় কোনো রকমে মাথা গুঁজলেও দিনের বেলায় তিনি ছিলেন এ শহরের ব্যস্ত নাগরিক। ঢাকা শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত তিনি চষে বেড়াতেন। সারাদিন অবিরাম হাঁটতেন। কাজী আলমগীর বলেন, ‘এক সময়ের সুদর্শন, সুঠাম ও সুদেহী সিরাজকে স্বাধীনতার পর চিনতে খুবই কষ্ট হয়। নিজের প্রতি তার কোনো যত্ম ও মনোযোগ ছিল না। পোশাক-আশাকে অপরিচ্ছন্ন। এলোমেলো শাদা চুল। অগোছালো শাদা বড় দাঁড়ি। এ অবস্থায় পরিচিত আঙিনায় ঘুরে বেড়ালেও পরিচিতরাই তাকে চিনতে পারতেন না। দেখলে তাকে পাগলাটে মনে হলেও তার মধ্যে কিন্তু কোনো ক্ষ্যাপামি ছিল না। তবে নিজেকে ক্ষয় করা ছাড়া অন্যের কোনো ক্ষতি করতেন না। খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। খেয়ে-না খেয়ে দিনভর টই টই করে ঘুরতেন। আর মুখে থাকতো পান-সিগারেট। যাপন করতেন খুবই দুঃসহ এক জীবন। শীতের সময় একদম কুঁকড়ে-মুকড়ে থাকতেন। দেখে বুকটা কষ্টে মোচড় দিয়ে উঠতো। আমি নিজেই অক্ষম মানুষ। তার জন্য তেমন কিছু করতে পারতাম না। একজন মানুষ খেলার মাঠকে আলোয় আলোয় ভরে দিয়েছেন, তার এই পরিণতি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। নিজে একজন খেলোয়াড় হওয়ায় এই বেদনা আরো বড় হয়ে বুকে বেজেছে। ক’দিন আগে আমি গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে এসে শুনি সিরাজ আর নেই। একজন খ্যাতিমান অ্যাথলেটের এইভাবে নিঃশব্দে, নীরবে চলে যাওয়াটা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের জন্য খুবই অমর্যাদার, গ্লানিকর ও লজ্জাজনক।’
সব্যসাচী ক্রীড়াবিদ হিসেবে স্বীকৃত বশীর আহমেদ বলেন, ‘আমি ও সিরাজ এক সঙ্গে অ্যাথলেটিকস করেছি। তবে তার সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমার কাছে অনেক সময় অর্থ সাহায্য চাইতে আসতেন, যতটা পেরেছি সাহায্য করেছি।’ খন্দকার আবুল হাসান জানান, ‘সিরাজ রাস্তায় রাস্তায় টো টো করে ঘুরে বেড়াতেন। চেয়ে-চিন্তে চলতেন। অনেকের কাছে টাকা-পয়সা চাইতেন। কিন্তু তার এই জীবনযাপন আমাদের খুবই লজ্জা দিত।’ শেখ মুহাম্মদ রুস্তম আলী বলেন, ‘শেষ জীবনে চরম দুঃখ-দৈন্যের মধ্য দিয়ে চলেছেন সিরাজ। অসচ্ছলতার কারণে পরিচিতদের কাছে টাকা-পয়সা চাইতেন। তবে মানসিক ভারসাম্য না থাকলেও একটা বিষয়ে তার বুদ্ধি-বিবেচনা ছিল টনটনে। সবার কাছে তিনি টাকা-পয়সা চাইতেন না।’ আরজান খান বলেন, ‘সিরাজ বসবাস করতেন পুরান ঢাকায়। শুনেছি, অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। এ কারণে এতিমখানায় মানুষ হয়েছেন। তবে তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তার সঙ্গে কখনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। তাছাড়া ভদ্র ও সোবার ছিলেন। কোনো বিষয়ে নাক গলাতেন না। বড় মাপের একজন অ্যাথলেট হয়েও তার যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। ঠিকমত সেবা-শুশ্রূষা-চিকিৎসা পেলে তিনি ভালো হয়ে যেতেন বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু তার কিছুই তিনি পাননি। পেয়েছেন মানুষ ও সমাজের অনাদর ও অবহেলা। যে কারণে তার মতো উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের একজন অ্যাথলেট অকালে হারিয়ে গেল।’
সিরাজুল ইসলাম কত বড় অ্যাথলেট ছিলেন, সে বিষয়ে বোধ করি কিছুটা হলেও আঁচ পাওয়া সম্ভব হলো। দেশের অ্যাথলেটিকস ইতিহাসের খ্যাতিমান অ্যাথলেটরাই তাকে মনে করেন সেরা অ্যাথলেটদের একজন। এঁদের অনেকের ফেবারিট অ্যাথলেট ছিলেন তিনি। এমন একজন অ্যাথলেট এই শহরে আমাদের মধ্যে বছরের পর বছর হেঁটেছেন, এক বুক ঝড়ো হাওয়া নিয়ে বিচরণ করেছেন, আমরা তার দিকে ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করিনি। গত তিন যুগে অ্যাথলেটিকসের কত বড় বড় আসর বসেছে, তার কথা কারোই মনে পড়েনি। অতীতের কীর্তিমানদের প্রতি এই যদি হয় আমাদের মূল্যায়ন, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎটাও থাকবে অন্ধকারে ঢাকা। অথচ একটা সময় সবাইকে তো অতীত হয়ে যেতে হবে। অতীতের পানে ফিরে না তাকানোর অর্থ শূন্যতায় বেড়ে ওঠা এবং নতুন করে শুরু করা। আমরা প্রতিনিয়ত যেন নতুন করে শুরু করছি। আর হারিয়ে ফেলছি অতীতের কীর্তিমানদের। সিরাজুল ইসলামের মতো একজন অ্যাথলেটের মর্মান্তিক বিদায়টা আমাদের বিষণ্ণ করে দেয়। একরাশ কষ্ট বুকের মধ্যে ঝরে কান্নার জলপ্রপাত হয়ে। তার প্রতি আমাদের রইলো অশ্রুসিক্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
হায়! এসবের কিছুই আজ তার কাছে পৌঁছাবে না। #
১-৩-২০০৯

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ