শারীরিক দক্ষতার খেলায় অনন্য ফারুকউদ্দিন আহমদ/ দুলাল মাহমুদ

অল্প বয়সেই কুস্তিটা ফারুকউদ্দিন আহমদের নেশায় পরিণত হয়। একের পর এক প্রতিটি বাধা অতিক্রম করে তিনি এগিয়েছেন সামনের দিকে। সদিচ্ছা, চেষ্টা ও আন্তরিকতা থাকায় তিনি প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে আয়োজিত হয় পাকিস্তান সিভিলিয়ান রেসলিং কোচিং ক্যাম্প। ৬ সপ্তাহের এই ট্রেনিংয়ে দুই পাকিস্তানের প্রতিভাবান কুস্তিগীররা অংশ নেন। সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট বোর্ড পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে চারজনকে নির্বাচিত করে, তিনি তাদের অন্যতম। অন্য তিনজন হলেন আলী ইমাম, ফজলুর রহমান ও নূর মোহাম্মদ। সরকারিভাবে পরিচালিত এই ট্রেনিং কোর্স পরিচালনা করেন চৌধুরী মোহাম্মদ আশরাফ। এই ট্রেনিং নেয়ার পর প্রতিযোগিতামূলক কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকেন তিনি। ১৯৬২ ও ১৯৬৩ সালে জাতীয় কুস্তি প্রতিযোগিতায় তিনি দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় হয়েছেন। ১৯৬৪ সালে ইস্ট পাকিস্তান প্রভিনশিয়াল রেসলিং চ্যাম্পিয়নশীপে লাইট ওয়েট বিভাগে তিনি চ্যাম্পিয়ন হন। জাপানে কি একটা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে ছয় মাসের দীর্ঘমেয়াদী একটি জাতীয় কুস্তি কোচিং ক্যাম্প করা হয়। এই ক্যাম্পের জন্য তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হন ফারুক উদ্দিন আহমদ ও আখতার হোসেন। লাহোরের গাদ্দাফী স্টেডিয়ামে এই ক্যাম্প পরিচালনা করেন তুরস্কের কামাল আসকানি। ক্যাম্পে তিনি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করায় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেননি। সে বছর ঢাকায় আয়োজিত নবম পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে কুস্তি চ্যাম্পিয়নশীপে ওয়াল্টার য়েট ক্যাটাগরিতে তিনি ব্রোঞ্জ পদক লাভের গৌরব অর্জন করেন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র প্রতিযোগী হিসেবে তিনি এই কৃতিত্ব দেখান। এরপর অবশ্য ১৯৬৬ সালে লাহোরে ফেদারওয়েটে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন মঙ্গল ঘোষ। ১৯৬৬ সালে তিনি লাহোরে পাকিস্তান অলিম্পিক গেমস, ১৯৬৮ সালে ঢাকায় পাকিস্তান অলিম্পিক গেমস এবং ১৯৭০ সালে করাচীতে পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে অংশ নেন। একই বছর যোগ দেন অ্যাবোটাবাদে কমনওয়েলথ গেমস কুস্তি কোচিং ক্যাম্পে। মেজর মুশতাকের অধীনে ছয় সপ্তাহের এই ক্যাম্পে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে তিনি ছাড়াও অংশ নেন আবদুর রহমান, জব্বার মোল্লা, দাউদ, ইসরার হোসেন। এই ট্রেনিং ক্যাম্প খুবই কঠিন হওয়ায় তিনি ও জব্বার মোল্লা ছাড়া কেউই বেশিদিন টিকতে পারেননি। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি কিউএপিটিআই এবং নবযুগ পিটিসির হয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে জাতীয় কুস্তি চ্যাম্পিয়নশীপে লাইট ওয়েটে ১৪৯ দশমিক ৫ পাউন্ডে চ্যাম্পিয়ন হন।
কুস্তির পাশাপাশি বডিবিল্ডিংয়েও তিনি কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। শরীর গঠনের শারীরিক সৌন্দর্য ও কসরত তাকে আকৃষ্ট করে। এ প্রসঙ্গে ফারুক উদ্দিন আহমদ বলেন,‘ষাট দশক শুরুর আগেই হারকিউলিস, টারজানের বই পড়তাম। বডিবিল্ডারদের নিয়ে বিভিন্ন সিনেমা দেখতাম। তাছাড়া মিঃ ওয়ার্ল্ড, মিঃ ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের ছবি দেখে বুকের মধ্যে তোলপাড় হয়। মানুষ এত সুন্দর ও সুগঠিত হতে পারে- এটা আমাকে মুগ্ধ করে। এতে আমি অনুপ্রাণিত হয়ে বডিবিল্ডার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।’ ১৯৫৯ সালে তিনি প্রথম অংশ নেন জুনিয়র ‘মিঃ ইস্ট পাকিস্তান’ বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতায়। ১৯৬১ সালে তিনি ‘জুনিয়র মিঃ ঢাকা’ প্রতিযোগিতায় তৃতীয় এবং ‘জুনিয়র মিঃ ইস্ট পাকিস্তান’ প্রতিযোগিতায় চতুর্থ হন। ১৯৬৪ সালে তিনি ‘জুনিয়র মিঃ ঢাকা’ প্রতিযোগিতায় প্রথম এবং ‘জুনিয়র মিঃ ইস্ট পাকিস্তান’ প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছেন। ১৯৬৭ সালে ‘সিনিয়র মিঃ ঢাকা’ এবং ‘সিনিয়র মিঃ ইস্ট পাকিস্তান’ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হন। ১৯৭৪ সালে বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতায় ‘শ্রেষ্ঠ পা’ হন। একই বছর ‘সিনিয়র মিঃ ঢাকা’ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হন। ১৯৭৮ সালে ‘মিঃ ঢাকা’ এবং ‘মিঃ বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছেন। ‘প্রবীণ বডিবিল্ডিং প্রতিযোগিতা’য় তিনি হয়েছিলেন দ্বিতীয়।
ভারোত্তোলনেও ফারুক উদ্দিন আহমদ সাফল্য দেখিয়েছেন। ১৯৬৪ সালে তিনি জাতীয় ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশীপে লাইট ওয়েট বিভাগে তৃতীয় হন। ১৯৬৬ ও ১৯৬৮ সালে জাতীয় ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হন।
জাতীয় পর্যায়ে বক্সিং প্রতিযোগিতায় তিনি অংশ নিয়েছেন। শুরুতে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নেন। এরপর ক্লাব, স্বাধীনতা দিবস প্রতিযোগিতায় কৃতিত্ব দেখান। ১৯৬৪ সালে ন্যাশনাল বক্সিং চ্যাম্পিয়নশীপে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হয়ে রানারআপ হন। ফাইনালে তিনি ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের এজাজ আহমেদের কাছে হেরে যান।
তিনি ফুটবলও খেলেছেন। ১৯৬৪ সালে তৃতীয় বিভাগের দল আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে খেলেন। রহমতগঞ্জের সঙ্গে খেলায় আজাদ বয়েজ ক্লাব ৯-০ গোলে এগিয়ে থাকাবস্থায় মারপিট হলে তিনি ফুটবলে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ক্রিকেট খেলার সময় ফুলটস একটি বল তার হাঁটুতে লেগে আঘাত পেলে ক্রিকেটের প্রতিও তার অনীহা জন্মে।
খেলোয়াড়ী জীবন শেষে ১৯৭৫ সালে তিনি ভারতের পাতিয়ালার নেতাজী সুভাষ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টস (এনআইএস) থেকে কুস্তিতে ডিপ্লোমা কোর্স করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে কুস্তি কোচ হিসেবে যোগ দেন। একই সঙ্গে তিনি ঢাকা শহরের বিভিন্ন কাবকে ট্রেনিং দেন। ১৯৭৭ সালে বিডিআরের সিলেট সেক্টরকে কোচিং দেন এবং তারা ইন্টার সেক্টর প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৭৮ সালে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়ে ১৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়নকে ট্রেনিং দিলে তারা পর পর তিনবার ইন্টার সেক্টর প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়। একই বছর ইন্টার সেক্টর কুস্তি থেকে বিডিআরের ৪২ জনকে বাছাই করে সাতক্ষীরায় তিন মাসের ট্রেনিং দেন। এরপর থেকে এই কুস্তিগীররা নিয়মিত সাফল্য দেখিয়েছেন। ১৯৭৮ সালে জাতীয় কুস্তি চ্যাম্পিয়নশীপে বিডিআর চ্যাম্পিয়ন হলে বিডিআরের মহাপরিচালক তাকে একটি টেলিভিশন পুরস্কার দেন।
জাতীয় কুস্তি কোচ হিসেবে ফারুক উদ্দিন আহমদের পথচলা শুরু হয় ১৯৮৫ সাল থেকে। সে বছর ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে তার প্রশিক্ষণে বাংলাদেশ ১০টি ব্রোঞ্জ পদক পায়। ১৯৮৭ সালে ভারতের কলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমসে তিনি বাংলাদেশের কোচ ছিলেন। সেবার বাংলাদেশ ২টি রৌপ্য ও ৬টি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে চতুর্থ সাফ গেমসেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কোচ। বাংলাদেশ পায় একটি রৌপ্য ও পাঁচটি ব্রোঞ্জ। ১৯৯৩ সালে উচ্চতর প্রশিক্ষণে চার মাসের জন্য বাংলাদেশ দল নিয়ে পাকিস্তান যান। ঢাকা সাফ গেমসে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ দলের সহকারী কোচ। সেবার বাংলাদেশ পায় ২টি রৌপ্য ও ৩টি ব্রোঞ্জ। ১৯৯৮ সালে তিনি সাফ গেমসগামী বাংলাদেশ দলকে দু’মাস প্রশিক্ষণ দেন। এরপর ফেডারেশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় জাতীয় দলকে আর প্রশিক্ষণ দিতে পারেননি।
১৯৭৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত জাতীয় কুস্তি চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি আছেন ম্যাট চেয়ারম্যান হিসেবে।
ভারোত্তোলনে প্রায় ১০ বছর তিনি ছিলেন ‘এ’ গ্রেড জাজ।
কুস্তিতে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯১ সালে তিনি বিএসজেএ পুরস্কার পান। বাংলাদেশ কুস্তি ফেডারেশন ২০০৮ সালে আবদুল হামিদ পালোয়ান, মাসুদুর রহমান মুন্না ও তাকে বিশেষ সম্মাননা দেয়।
ফারুক উদ্দিন আহমদ ১৯৪৪ সালের ২০ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তাকে অনেকে ‘ঢাকাইয়া’ মনে করলেও তার পৈতৃক নিবাস কিশোরগঞ্জে।
ফারুক উদ্দিন আহমদ আক্ষেপ করে বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুস্তিগীর হওয়ার জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। কিন্তু সেই ধারা আর অব্যাহত থাকেনি। আসলে প্রকৃত ট্রেনিং না থাকায় কুস্তিতে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। সার্ভিসেস দলগুলো ছাড়া আর কোথাও তেমনভাবে কুস্তির চল নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে কুস্তি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী ট্রেনিং ছাড়া কিছু অর্জন সম্ভব নয়। অল্প সময়ের মধ্যে ট্রেনিং দিয়ে বেশি কিছু শেখানো যায় না। শরীরের আধ্যাত্মিক শক্তির জন্য অল্প বয়স থেকে দীর্ঘমেয়াদী ট্রেনিং প্রয়োজন। সার্ভিসেস দলগুলো কুস্তি টিকিয়ে রাখলেও তাদের কুস্তিগীররা বেশি বয়সে অংশ নেন। যে কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য পাওয়া যায় না।’
তিনি মনে করেন,‘খেলাধুলার উন্নতি করতে হলে জাতীয় ক্রীড়ানীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। পিতা-মাতাকে খেলাধুলায় ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করতে হবে। গ্রাম-গঞ্জ থেকে প্রতিভা অন্বেষণ করে তাদের দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যে কোনো টিম গড়তে হবে তিনটি ক্যাটাগরিতে। খেলোয়াড়দের আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য অবশ্য খেলোয়াড়দের খেলাধুলার পাশাপাশি লেখাপড়ার প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে যাতে তারা ভালো চাকরি-বাকরি করতে পারে। অল্প বয়স থেকে খেলাধুলা চর্চা না করলে বেশি বয়সীদের দিয়ে রেজাল্ট আসবে না।’
ফারুক উদ্দিনের নিজের জীবন নিয়ে একদিকে যেমন অতৃপ্তি আছে,অন্যদিকে আছে তৃপ্তিও। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘আমাদের দেশে প্রকৃত ক্রীড়াবিদদের মূল্যায়ন নেই। নিজের জীবন নিয়ে অনেক সময় সন্তুষ্ট হতে পারিনি। অনেক ক্ষেত্রেই অতৃপ্তি রয়ে গেছে। সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। উপেক্ষিত হয়েছি। জাতীয়ভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। আবার তৃপ্তিও পেয়েছি। নেশাটাকে পেশা হিসেবে নিতে পেরে আমি আনন্দিত। এটা আমার জীবনের বড় আত্মতৃপ্তি। বর্তমানে সুস্থ ও সবল আছি। নিজেকে শক্তিশালী পুরুষ হিসেবে মনে করি। মনের দিক দিয়ে আমি ধনী।’
ফারুক উদ্দিন আহমদের মতো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এমন কথা ক’জনই বা বলতে পারেন। যা বলার তিনি বলেন স্পষ্টভাবে ও সরাসরি। কে কি ভাবল, তা নিয়ে মোটেও তোয়াক্কা করেন না। এক্ষেত্রেও তিনি অন্যদের তুলনায় আলাদা ও ব্যতিক্রমী। #
১-১-২০০৯

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ