অনন্য এক স্টিকশিল্পী কায়েস/ দুলাল মাহমুদ

বাংলাদেশের হকি আন্তর্জাতিকভাবে বড় সাফল্য না পেলেও বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের মান ছিল আন্তর্জাতিক মাপের। তাদের ক্রীড়াশৈলী প্রশংসিত হয়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়েও। এদেশের হকি তাদের নিয়ে অনায়াসে গর্ব করতে পারে। গর্বিত ও দেশবরেণ্য এই খেলোয়াড়দের অন্যতম একজন হলেন মোহাম্মদ আশিক উল্লাহ। এই নামটি খুব বেশি পরিচিত না হলেও কায়েস নামটি উচ্চারিত হলে হকি অনুরাগীদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুরন্ত এক খেলোয়াড়ের প্রতিকৃতি। একটা সময় তার সহজাত প্রতিভা ধাঁধিয়ে দিয়েছে দেশের হকি অঙ্গনকে। মুগ্ধ করেছে হকিপ্রেমীদের।
বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে সেরা লেফট আউট হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন কায়েস। ঘাষের মাঠে তিনি ছিলেন নিপুণ এক শিল্পী। তার স্টিকের তুলিতে আঁকা হয়েছে মনকাড়া সব দৃশ্যপট। তিনি ছিলেন রীতিমত ঐন্দ্রজালিক। স্টিকের জাদু দিয়ে বলটাকে নিয়ে তিনি যেভাবে ছুটতেন, ড্রিবলিং করতেন এবং ডজ দিয়ে প্রতিপরে রণভাগ ছিন্নভিন্ন করে দিতেন, তেমনটি খুব একটা দেখা যায় না। বল কন্ট্রোলেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। এই স্টিক শিল্পী তার পজিশনে ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ।
সেদিন মহাখালীতে তার কর্মস্থলে একত্রিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের হকির আক্রমণভাগের তিন তারকা ও আপন তিন সহোদর কায়েস, মোহাম্মদ মাসেক উল্লাহ আয়েস ও জামিল পারভেজ লুলু। সঙ্গে ছিলেন হকি অন্তপ্রাণ মোঃ ইউসুফ আলী। তারা মেতে ওঠেন তুমুল এক আড্ডায়। এ আড্ডায় উঠে আসে বাংলাদেশের হকির অতীত ও বর্তমান। তবে আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন কায়েস।
বাংলাদেশের হকির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে আরমানিটোলা স্কুলের নাম। এদেশের হকিকে গৌরবান্বিত করেছে এই স্কুল। জাতীয় পর্যায়ে সুখ্যাতি অর্জনকারী খেলোয়াড়দের বড় একটি অংশই উঠে এসেছেন এই স্কুলের মাধ্যমে। কায়েসও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। আরমানিটোলা স্কুলের রাস্তার উল্টো পাশেই ছিল কায়েসদের বাসা। বলা যায়, হকিময় একটি পরিবেশেই তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি যে এলাকায় থাকতাম, তার চারপাশটা ছিল হকির আলাদা এক জগত। বলা যায়, এ এলাকায় হাঁটতে শেখার আগেই ছেলেরা হকি স্টিক নিয়ে ছুটতো। রাস্তায় বের হলেই কোনো না কোনো হকি খেলোয়াড়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে যেত। বাসার সামনেই ছিল আরমানিটোলা স্কুল। এই স্কুলে রীতিমত খেলাধুলার হাট বসতো। বিশেষ করে হকির জন্য স্কুলটির সুনাম ও সুখ্যাতি ছিল। বাংলাদেশের হকি ইতিহাসের সেরা সেরা খেলোয়াড় উঠে এসেছেন এই স্কুল থেকে। স্বাভাবিক নিয়মে এই স্কুলের ছাত্র হওয়ার পর হকির সঙ্গে আমার গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক। স্কুলের রশিদ ও হাওলাদার স্যার আমাদের গড়ে উঠতে সহায়তা করেন। আরমানিটোলা স্কুলের খেলাধুলার ক্ষেত্রে এই দুই ক্রীড়া শিক্ষকের রয়েছে নিঃস্বার্থ অবদান। এছাড়া আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই শামসু ভাই, আবদুস সালাম ভাই, শ্রদ্ধেয় ইউসুফ রেজা, নূরুল ইসলাম নান্নার কথা। তাঁরা আমার গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মাহমুদুর রহমান মোমিন, বশীর আহমেদ, আবদুস সাদেক, প্রতাপ শংকর হাজরা, ইব্রাহীম সাবের, সাবের আলী, শামসুল বারী, মমতাজ, বুলবান, সোনা মিঞার মতো সিনিয়র খেলোয়াড়দের খেলা দেখেছি। তাদের খেলা দেখে উৎসাহিত হয়েছি। বিশেষভাবে প্রতাপ শংকর হাজরার খেলা আমাকে মুগ্ধ করেছে।’
অল্প বয়সেই প্রতিভার দীপ্তি দিয়ে সবার নজর কেড়ে নেন কায়েস। ১৯৬৭ সালে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস্থায় তিনি আরমানিটোলা স্কুল টিমে হকি খেলার সুযোগ পান। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় আরমানিটোলা স্কুল হকি টিমে খেলতে পারাটা ছিল গৌরবময় ব্যাপার। আশপাশের সবাই সমীহের চোখে দেখতেন। স্কুল টিমে সুযোগ পাওয়াটা সহজ ছিল না। স্কুলে তো হকি খেলোয়াড়ের অভাব ছিল না। অনেকের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সুযোগ পেতে হতো। স্কুল টিমে আমাকে দেখে অনেকেই অবাক হয়ে যান। মনোভাবটা ছিল এমন, এই বাচ্চা ছেলেকে সুযোগ দেয়া ঠিক হবে কিনা! তাদের এই সংশয় একদম অমূলক ছিল না। আমার দৈহিক গড়ন ও উচ্চতা দেখে যে কেউ এমনটি ভাবতে পারতেন। কিন্তু মাঠে আমার স্টিকের ঝিলিক দেখে তাদের সেই ভুল ভাঙ্গতে বেশি সময় লাগেনি। সেই যে আমার পথ চলা শুরু হয়, তারপর আর আমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’
স্কুল টিমের হয়ে চমকপ্রদ নৈপুণ্য দেখানোর পর জাতীয় পর্যায়ে স্থান করে নিতে কায়েসকে একদমই বেগ পেতে হয়নি। ১৯৬৮ সালে হকির দ্বিতীয় বিভাগ লীগে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলার প্রস্তাব পান তিনি। আজাদে খেলার পেছনে তাদের এলাকার শামসু ভাইয়ের অবদান রয়েছে। সে বছর চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগ হকি লীগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে আজাদ। সেই সুবাদে ১৯৬৯ সালে তিনি আজাদের হয়ে প্রথম বিভাগ লীগে খেলেন। তার খেলা দেখে হকি অনুরাগীরা বিমোহিত হন। এরপর একটার পর একটা সিঁড়ি টপকে এগিয়ে যেতে থাকেন। একই বছর জাতীয় জুনিয়র এবং জাতীয় সিনিয়র দলের হয়ে খেলার কৃতিত্ব দেখান তিনি। লাহোরে পাকিস্তান ন্যাশনাল জুনিয়র হকি চ্যাম্পিয়নশীপে ইস্ট পাকিস্তান জুনিয়র দল এবং ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশীপে ইস্ট পাকিস্তান সিনিয়র টিমের হয়ে খেলেন। ১৯৭০ সালে প্রথম বিভাগ হকি লীগে তিনি খেলেন সোনালী ব্যাংকের হয়ে। সে বছর সফরকারী বিশ্ব ও এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান জাতীয় দলের বিপক্ষে ইস্ট পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেন।
বয়সের তুলনায় খেলোয়াড় হিসেবে অনেক বেশি পরিপক্বতার পরিচয় দেন কায়েস। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার ডজ, ড্রিবলিং ও বল কন্ট্রোল দেখে সিনিয়ররা অবাক হয়ে যেতেন। আমি তাদের কাটিয়ে রক্ষণভাগে ঢুকে পড়তাম দেখে তারা অনেকেই আমার ওপর ক্ষুব্ধ হতেন। তখনকার টপ ও টাফ ডিফেন্ডাররা আমাকে চ্যালেঞ্জ করতেন। আমি তাদের চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে কসুর করতাম না। অনেকেই বলতেন, আমার মতো স্টিকের ঝলক আর দেখা যায়নি। আমি ছিলাম গড গিফটেড। ১৯৮৮ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পাকিস্তানে সার্ক হকি ফোরামে অংশ নিয়েছিলাম। সে সময় একটি প্রদর্শনী ম্যাচে আমি খেলতে নেমেছিলাম। তখন তো আমি আর হকি খেলি না। তারপরও আমার খেলা দেখে পাকিস্তানের হকির সংশ্লিষ্টরা বলতে বাধ্য হয়েছেন, আরে ইয়ার, তোমার জাগলারি কাহা থা। খেলোয়াড়ী জীবনে এরকম প্রশংসা আমি অসংখ্যবার পেয়েছি।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিত জওহরলাল ইন্টারন্যাশনাল হকি টুর্নামেন্টে অংশ নেয় ঢাকা একাদশ। ঢাকা একাদশ নামে অংশ নিলেও সেটি ছিল বাংলাদেশ জাতীয় দল। সেই টুর্নামেন্টে কায়েসের মনমাতানো ক্রীড়াশৈলী সবার হৃদয় জয় করে নেয়।
তিনি বরাবরই সেরা দলগুলোতে খেলেছেন। ঢাকা লীগে যখন যে দলে খেলেছেন, সেই দল হয় চ্যাম্পিয়ন, নতুবা রানার্সআপ হয়েছে।
১৯৭৪ সালে ঢাকা প্রথম বিভাগ হকি লীগ শুরু হলে তিনি ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দেন। ১৯৭৮ সালে তার ঠিকানা হয় আবাহনী ক্রীড়াচক্র। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে ওয়ারী এবং ১৯৮৬ ও ১৯৮৭ সালে অ্যাজাক্সের হয়ে খেলেন। ১৯৮৭ সালে তার ক্যারিয়ারের শেষ বছরে অ্যাজাক্স লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। কায়েস মোহামেডান ও আবাহনী কাবের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘খেলার মাঠে গন্ডগোল লাগলে আমি সব সময় তা থামানোর চেষ্টা করতাম। আমার মধ্যে স্পোর্টসম্যান স্পিরিট ছিল।’ জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশীপে খেলেছেন ঢাকা জেলার হয়ে। এর মধ্যে তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা জেলা। ১৯৭৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে জুনিয়র বিশ্বকাপ হকি প্রতিযোগিতায় কোয়ালিফাইং রাউন্ডে অংশ নেয় বাংলাদেশ। সে দলের সহ-অধিনায়ক ছিলেন কায়েস। ওই টুর্নামেন্ট সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘মালয়েশিয়া যাবার পর আমাদের খাটো করে দেখা হয়। তারা আমাদের জিজ্ঞেস করে আমরা কি হকি খেলতে পারি কিনা! সেবার আমরা বেশ ভালো খেলেছিলাম। প্রতিযোগিতায় আমরা পঞ্চম হই। চতুর্থ হতে পারলে ফ্রান্সে ফাইনাল রাউন্ডে খেলতে পারতাম।’
১৯৭৮ সালে ব্যাংককে অষ্টম এশিয়ান গেমস হকিতে খেলার কথা থাকলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে কায়েস যেতে পারেননি। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পুরো ফর্মে থাকা সত্ত্বেও আমি এশিয়ান গেমসে যেতে পারিনি। এটা আমার জীবনের দুঃখজনক স্মৃতি হয়ে আছে। দল গঠনের সময় আমি ছিলাম জন্ডিসে আক্রান্ত। কিন্তু দল যাওয়ার আগে জাতীয় দলের যে প্র্যাকটিস ম্যাচ হয়, অসুস্থতা সত্ত্বেও আমি সেই ম্যাচে খেলেছিলাম। আমার খেলা দেখে পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, অসুস্থ কায়েস যে খেলা খেলেছেন, সুস্থ খেলোয়াড়দের তুলনায় তার পারফরম্যান্স ভালো। তাকে দলের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিত। কুয়ালালামপুরে আমাকে না দেখে পাকিস্তানের কোচ সাঈদ আনোয়ার বিস্ময় প্রকাশ করেন।’
কায়েস জানান, খেলোয়াড়ী জীবনের শুরুতে লেফট আউট হিসেবে অনুসরণ করার জন্য তিনি কাউকে পাননি। পরবর্তীকালে তার মডেল হয়ে ওঠেন পাকিস্তানের লেফট ইন শাহনেওয়াজ। তার স্টিকওয়ার্ক ও ড্রিবলিং ছিল অসাধারণ। খুব দ্রুত ছুটতে পারতেন। তাকে তিনি অনুসরণ করার চেষ্টা করেন।
জাতীয় হকি দলের হয়ে একই পরিবারের তিন ভাইয়ের খেলার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। আর বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন কায়েস-আয়েস-লুলু। এই তিন ভাই জাতীয় দলে খেলে শুধু নতুন মাইলফলকই গড়েননি, খেলেছেন দাপটের সঙ্গে। স্ব-স্ব সময়ে স্ব-স্ব পজিশনে তারা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিন ভাই-ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্লু পান। তাদের পরিবারকে বলা যেতে পারে হকি পরিবার। ফুফাতো ভাই মহসীন, এহসান নাম্মী, চাচাতো ভাই চপল, খলিলুল্লাহ টুহু, নিকট আত্মীয় নেসার আহমেদ জাতীয় দলে হকি খেলেছেন। এছাড়া বেশ কয়েকজন খেলেছেন ঢাকা লীগে।
সেরা ম্যাচ প্রসঙ্গে কায়েস পেছন ফিরে তাকিয়ে বলেন, ‘১৯৭০ সালে বিশ্বসেরা পাকিস্তান জাতীয় দল ঢাকা সফরে আসে। তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি ফুঁসে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। তাদেরকে রুখে দেয়ার একটা প্রতিজ্ঞা সবার মধ্যে কাজ করতে থাকে। তেমন এক পরিস্থিতিতে আমরা ইস্ট পাকিস্তান হকি দল মুখোমুখি হই পাকিস্তান হকি দলের। একেতো রাজনৈতিক কারণে টগবগিয়ে ফুটছিলাম, তারপর খেলার মাঠে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের একটা তাগিদ ছিল। ম্যাচটাও হয় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। যাকে বলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। তানভীর দার পাকিস্তান তথা বিশ্বের সেরা রাইট ব্যাক। তিনি ছিলেন অটল পাহাড়ের মতো। তাকে ফাঁকি নিয়ে বল নিয়ে ঢোকা ছিল এক কথায় অসম্ভব। আমি তাকে বিট করতে সক্ষম হই। তিনি খেলা দেখে আমার পিঠ চাপড়ে দেন। খেলায় আমরা এক গোলে হেরে যাই। ১৯৭২ সালে নয়াদিল্লীতে জওহরলাল ইন্টারন্যাশনাল হকি টুর্নামেন্টেও আমি বোধকরি ভালো খেলেছিলাম। আমার খেলা সবার প্রশংসা অর্জন করে। ১৯৮৪ সালে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশীপে ঢাকা জেলার হয়ে আমরা তিন ভাই আমি, আয়েস ও লুলু একসঙ্গে খেলেছিলাম। এটা আমার কাছে স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে আছে। ১৯৭৭ সালের জুনিয়র জাতীয় দলে আমি ও আয়েশ একসঙ্গে খেলেছিলাম।’
কায়েস মনে করেন, ‘আগের তুলনায় হকি খেলা অনেক বদলে গেছে। আমরা যে স্টাইলে খেলতাম, এখন আর তেমন নেই। হকিতে এসেছে অ্যাস্ট্রোটার্ফ। হকি এখন পাওয়ার গেম। এটা বড় ধরনের একটা চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য ভালো কোচ প্রয়োজন। ভালো শিক্ষক ভালো ছাত্র তৈরি করেন। অনুরূপভাবে ভালো কোচ ভালো খেলোয়াড় ও একটি দল গড়ে তুলতে পারেন। সবার আগে কোচ তৈরি করতে হবে। এজন্য কোচিং ইনস্টিটিউশন দরকার। যা বিদেশীদের দিয়ে পরিচালনা করতে হবে। আমরা যখন খেলতাম, তখন দেখেছি পাকিস্তান ও ভারতের খেলোয়াড়রা বল পুশ করলে তা মাটি কামড়ে ছুটে যায়। আর আমরা করলে তা লাফিয়ে লাফিয়ে যায়। এ বিষয়ে আমি আমাদের কোচকে জিজ্ঞেস করে সদুত্তর পাইনি। আসলে তারা এর কারণ জানতেন না। আমি বই পড়ে এটা জানতে পেরেছি। বইতে লেখা আছে, বল মাঠি কামড়ে যেতে হলে স্টিক ও বলের মধ্যে কোনো গ্যাপ থাকবে না। আমি চেষ্টা করে তা রপ্ত করতে সক্ষম হই। প্রশিক্ষকদের অনেক পড়ালেখা করা উচিত। সর্বশেষ কলাকৌশল সম্পর্কে তাদের ওয়াকিবহাল হতে হবে। অবশ্য তাদেরকে আরো ইনসেনটিভ দিতে হবে।’
খেলার মানোন্নয়নে কায়েসের অভিমত হচ্ছে, ‘প্রতিটি কাবে ৩ থেকে ৪ জন বিদেশী খেলোয়াড় খেলতে দেয়া উচিত। তাদের সঙ্গে ফাইট করলে খেলার মানের উন্নতি হবে। বিশ্বমানের খেলোয়াড় ক্লাবে আনতে পারলে তার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা যাবে। এখন তো স্পনসরের যুগ। ভালো মানের খেলোয়াড় আনা কঠিন কোনো ব্যাপার নয়। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক হকি টুর্নামেন্ট নিয়মিত হয় না। উঁচুমানের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট না হওয়ার কারণে খেলার মান বাড়ছে না। দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ৬৪টি জেলাকে ৮ কিংবা ১০ ভাগে ভাগ করে আলাদা আলাদা স্পোর্টস ডিভিশন করা যেতে পারে। তাহলে তৃণমূল পর্যায় থেকে খেলোয়াড় তুলে আনা সম্ভব হতে পারে। এটা নির্ভর করে ক্রীড়া প্রশাসনের ওপর। খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। খেলোয়াড়দের ট্যাক্স মওকুফ কিংবা কমিয়ে দিতে হবে। সবার পক্ষে একই সঙ্গে ভালো খেলোয়াড় ও ভালো ছাত্র হওয়া সম্ভব হয় না। খেলোয়াড় হতে গেলে পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটে যায় খেলার মাঠে। সেটার কমপেনসেশন থাকা উচিত। যেটা যার প্রাপ্য, তাকে তা দিতে হবে। নতুবা কেউ খেলাধুলা করতে চাইবে না। এ কারণে বাংলাদেশে খেলোয়াড়দের কোয়ালিটি নেই, নেই কোয়ানটিটিও। আরমানিটোলা স্কুল, ঢাকার নবাববাড়ী, ফরিদপুর, রাজশাহী ছিল হকি খেলোয়াড়দের উৎসভূমি। ঐতিহ্যবাহী এই জায়গাগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। প্রতিভা লুকিয়ে আছে। তাকে বের করে আনতে হবে। ঐতিহ্যকে সম্মান দিতে হবে। সিলেটের পুলিশ লাইনে আপন মনে খেলতেন রামা লুসাই। তাকে খুঁজে বের করার পর দেখা যায়, তার পরিবারের অনেকেই খেলোয়াড় হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।’
কায়েস মনে করেন, খেলাধুলা একটি ইন্ডাস্ট্রি। একটি আর্ট। খেলাধুলা নীরবে জাতিকে অনেক কিছু দেয়। খেলাধুলাটা একটি ব্যয়বহুল ব্যাপার। এজন্য খেলাধুলায় বিনিয়োগ করা দরকার। খেলাধুলাকে হালকাভাবে নিলে হবে না। হাফ-হার্টেড মন নিয়ে কিছু করলে সাফল্য পাওয়া যায় না। একটা টার্গেট নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। টার্গেট ছাড়া গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে না। এখন তো ফেডারেশন চালানো হচ্ছে। খেলা চালানো হচ্ছে না। দেশে বেসরকারি খাতের রমরমা অবস্থা। তাদেরকে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। যথাযথ ব্যক্তিকে যথাযথ জায়গায় বসানো প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘হকির সূতিকাগার আরমানিটোলা স্কুল এখন মৃত নদী। স্কুলটির সেই সুদিন আর নেই। আসলে প্রায়োরিটি বদলে গেছে। জীবন হয়ে উঠেছে যান্ত্রিক ও কঠিন। সবাই প্রথমে হিসাব করেন কি করলে কী পাওয়া যাবে। তদুপরি, আরমানিটোলা স্কুলের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি পড়েনি। স্কুলের সেই হকি পরিবেশ ধরে রাখার জন্য কারো কোনো অবদান নেই। এই স্কুল থেকে পাস করে জীবনে অনেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তারাও স্কুলটির দিকে নজর দেননি। যে কারণে আরমানিটোলা স্কুল হারিয়ে ফেলেছে হকির সেই সুনাম।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স কায়েসের জন্ম ১৯৫৫ সালের আগস্টে। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা হকি খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ১৯৭৯-৮০ সালে পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু।
১৯৮২ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে সেক্রেটারি ফেডারেশন হিসেবে যোগ দেন। কয়েক বছর চাকরি করার পর তিনি তা ছেড়ে দেন। ১৯৯১ সালে তিনি স্কলাস্টিকা স্কুলের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলে অর্থনীতির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৭ বছর সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করার পর এ বছর থেকে তিনি নিজেই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কায়েস বলেন, ‘আমার জীবন নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। অনেকের চেয়ে ভালো আছি। খেলোয়াড়ী জীবনে সম্মান পেয়েছি। শিক্ষক হিসেবেও সম্মান পাই। তবে আমি মনে করি, খেলোয়াড়দের পড়ালেখায়ও আগ্রহী হতে হবে। পড়ালেখা করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পড়ালেখা না করলে খেলোয়াড়দের আর্থিকভাবে কষ্ট পেতে হয়। সবারই আসলে কম্পিটিটিভ হওয়া উচিত। আমি যখন খেলাধুলা করতাম, সমানভাবে পড়ালেখাটাকেও গুরুত্ব দিয়েছি। এ কারণে জীবনে হোঁচট খেতে হয়নি। শিক্ষা থাকলে যে কোনো প্রতিবন্ধকতাই টপকে যাওয়া যায়।’
ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও খেলাধুলাটা মোহাম্মদ আশিক উল্লাহ কায়েসের ভাবনার অংশীদার হয়ে আছে। তিনি ক্রীড়াঙ্গন সম্পর্কে প্রতি মুহূর্তে আপ-টু-ডেট থাকতে চেষ্টা করেন। পত্র-পত্রিকায় মাঝেমধ্যে লেখালেখি করেন। ক্রীড়াঙ্গনটা আছে তার অন্তরজুড়ে। সুযোগ পেলেই ক্রীড়ান্নোয়ন বিষয়ে তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণা প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। নিজের জীবন গড়ে তোলার পেছনে খেলার মাঠ থেকে তিনি যে দীক্ষা পেয়েছেন, তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েই তিনি আনন্দ খুঁজে পান। #
১৬-১-২০০৯

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ