কমলা রঙের উৎসবের অপেক্ষায় / দুলাল মাহমুদ



যাঁরা  লাতিন ঘরানার দৃষ্টিনন্দন ‘দ্য বিউটিফুল গেম’-এর অনুরাগী, তাঁদের কাছে অনেকটা অচ্ছুৎ হয়ে আছে ইউরোপীয় ঘরানার ফুটবল। তাঁদের উপলব্ধি হলো, ফুটবল খেলায় যদি চোখের সৌন্দর্য, মনের সুখ আর অন্তরের তৃপ্তি না পাওয়া যায়, তাহলে ফুটবল খেলায় কেন মুগ্ধ হওয়া? ফুটবল খেলায় বিনোদনই প্রধান। বিনোদনের উৎস হলো সুর, ছন্দ, শিল্প, সৌন্দর্য। আর ফুটবলেই তো এসবই দেখতে চায় ফুটবল রসিকরা। এ কারণে সৌন্দর্যপিয়াসীদের কাছে ইউরোপীয় রক্ষণাত্মক ও পাওয়ারফুল ফুটবল পছন্দ না হওয়ারই কথা।
কিন্তু ইউরোপীয় ঘরানার দেশ হলেও নেদারল্যান্ডসকে কেন জানি ব্যতিক্রম মনে হয়। তাদের খেলায় ইউরোপীয় খেলার ধার ও ধারা থাকলেও তাতে দেখতে পাওয়া যায় টিউলিপ ফুলের সৌন্দর্য। তাতে হয়তো লাতিন ঘরানার ছন্দোময় ও শৈল্পিক ফুটবলের মতো মন-প্রাণ দুলে উঠে না। তবে একটা ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে বুকের মধ্যে। বিশ্ব ফুটবলে হল্যান্ড কখনোই ফেলনা কোনো দল নয়। ‘দ্য ফ্লাইং ডাচম্যান’রা কখনো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও তাদের ফুটবলশৈলী দর্শকদের মন জয় করে নিতে পেরেছে। সেরা নৈপুণ্য, সেরা ফুটবলার কম উপহার দেয়নি তারা। বিশ্বকাপ ফুটবলে তিনবার ফাইনাল, চারবার সেমি-ফাইনাল, পাঁচবার কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলাটা তাদের ফুটবল ইতিহাসে সমৃদ্ধ হয়ে আছে। ইয়োহান ক্রুইফ, ডেনিস বার্গক্যাম্প, মার্কো ফন বাস্তেন, রুড ফন নিস্টলরয়, রবিন ফন পার্সি,  রুড খুলিত, আর্জেন রোবেন, এডুইন ফন দার সার, ইয়োহান নিসকেনস, ওয়েসলি স্নেইডার, প্যাট্টিক ক্লুইভার্ট, মার্ক ফন বোমেল, ক্লারেন্স সিডর্ফ, ফ্রাঙ্ক ডি বোয়ের,  জিমি ফ্লোয়েড হাসেলবেইঙ্ক, অ্যাডগার ডেভিস, ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড, রোনাল্ড কোয়েম্যান, রব রেনসেনব্রিঙ্কের মতো জগতবিখ্যাত ফুটবলার উপহার দিয়েছেন ডাচরা। তবে সত্তর দশকে ‘টোটাল ফুটবল’ দিয়ে ফুটবল অনুরাগীদের হৃদয় রাঙিয়ে দেয় ‘অরেঞ্জ’রা। ডাচ ফুটবলার ও কোচ রাইনাস মিশেলের প্রবর্তিত এই ফুটবল দর্শনের প্রধান রূপকার ছিলেন ইয়োহান ক্রুইফ। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলে রানার্স-আপ হয় হল্যান্ড এবং সেরা ফুটবলার হন তিনি। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তাঁর অনুপস্থিতিতে ১৯৭৮ সালেও রানার্স-আপ হয় নেদারল্যান্ডস। এ কারণে সর্বকালের সেরা দলেও ক্রুইফকে স্থান দেওয়া হয়। বর্ণাঢ্য ফুটবল কারিয়ারের অধিকারী ও তিনবারের ব্যালন ডি’অর পাওয়া কিংবদন্তি এই ফুটবলারের বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করতে না পারাটা দুর্ভাগ্যজনক।
‘ওয়ান ম্যান সকার টিম’ হিসেবে পরিচিত রুড খুলিত, মার্কো ফন বাস্তেন, জান উটার্স, ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড, রোনাল্ড কোয়েম্যান, হ্যানস ফন ব্রেউকুলেনের অসাধারণ নৈপুণ্যে ১৯৮৮ সালে প্রথমবার ইউফা ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয় করে হল্যান্ড। সে সময় মনে হয়েছিল ডাচ ফুটবলের বুঝি জাগরণ হতে চলেছে। শিরোপা জিততে না পাড়ার ফাঁড়া বুঝি কেটে গেল। কিন্তু হা হতোম্মি! কোনো কিছুইতে যেন দুর্ভাগ্য তাদের পিছ ছাড়ছে না। নেদারল্যান্ডসই একমাত্র দল তিনবার (১৯৭৪, ১৯৭৮ ও ২০১০) ফাইনালে উঠার পরও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। দুইবারের রানার্স-আপ ব্রাজিল পাঁচবার, দুইবারের রানার্স-আপ ইতালি চারবার, চারবারের রানার্স-আপ জার্মানি তিনবার, দুইবারের রানার্স-আপ আর্জেন্টিনা দুইবার, একবারের রানার্স-আপ ফ্রান্স একবার চ্যাম্পিয়ন হয়। উরুগুয়ে দুইবার ফাইনালে উঠে দুইবারই চ্যাম্পিয়ন এবং স্পেন একবারই ফাইনালে খেলে বাজিমাত করে। চেকোশ্লোভাকিয়া দুইবার, হাঙ্গেরি দুইবার এবং সুইডেন নিজের মাঠে একবার রানার্স-আপ হলেও কখনো চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। তবে হল্যান্ডের মতো কপাল পোড়া আর কেউ নেই। গতবার যখন স্পেন চ্যাম্পিয়ন হয়, তাতে খুশিই হয়েছিলেন ফুটবলপ্রেমীরা। কেননা, বিশ্বের অন্যতম সেরা লিগ ‘লা লিগা’। দুনিয়া মাতানো এমন একটি লিগের আয়োজক হয়েও বিশ্ব শিরোপা জিততে না পারাটা ছিল স্প্যানিশদের জন্য সত্যিকার অর্থেই দুর্ভাগ্যজনক। তাছাড়া তাদের ‘টিকি-টাকা’ ফুটবলও দর্শকদের মন কেড়ে নেয়। যা হোক, স্পেনের সেই দুর্ভাগ্যের অবসান হয়েছে। কিন্তু ‘টোটাল ফুটবল’-এর প্রবর্তক নেদারল্যান্ডস তাদের আক্ষেপ দূর করতে পারেনি। ২০১০ সালে শেষ বাঁশি বাজার চার মিনিট আগে স্পেনের আন্দ্রেস ইনিয়াস্তার গোলে স্বপ্ন ভঙ্গ হয় হল্যান্ডের। তবে ডাচরা নান্দনিক ফুটবল বিসর্জন দিয়ে ফাইনালে তাদের ঐতিহ্যের পরিপন্থী গা-জোয়ারি ফুটবল খেলায় দারুণভাবে হতাশ হন ফুটবল অনুরাগীরা। ডাচদের এমন ক্রীড়াশৈলী দেখার জন্য দর্শকরা প্রস্তুত ছিলেন না। গতবারের স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে এবার নতুন মিশনে তারা প্রথম মুখোমুখি হয় স্পেনের। শক্তিশালী স্পেনকে যেভাবে তারা ৫-১ গোলে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, তাতে ডাচদের নিয়ে নতুন স্বপ্নের বীজ বুনছেন ফুটবল রোমান্টিকরা। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে ডাচরা যে ধরনের বিধ্বংসী ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেছেন, তাতে স্বপ্নের উৎসমুখ খুলে যাওয়াটা মোটেও অভাবিত নয়। তবে অনেক বাধা-বিপত্তি আর প্রতিবন্ধকতাকে উজিয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে হবে কোচ লুই ফন গল, অধিনায়ক রবিন ফন পার্সি, মিডফিল্ডার অ্যারিয়েন রোবেন, ওয়েসলি সøাইডারদের। সামনে পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। সব বাধা অতিক্রম করে খুলতে হবে ফাইনাল ম্যাচের গিট্টু। তাছাড়া ইউরোপীয় কোনো দলের লাতিন আমেরিকা থেকে বিশ্বকাপ জিততে না পারার যে ‘বদনাম’ সেটিও ঘুচাতে হবে। কখনো পারেনি বলে যে পারবে না, এমনটি বলা যাবে না। যদিও একটি ম্যাচ দেখে ডাচদের নিয়ে এতটা কল্পনাবিলাসী  হওয়া মোটেও ঠিক নয়। তারপরও ব্যতিক্রম কিছু হলে সেটার নিশ্চয়ই অন্যরকম আকর্ষণ হয়ে থাকবে। স্পেনের সঙ্গে খেলায় নেদারল্যান্ডসের খেলোয়াড়দের পরনে কমলা রঙের জার্সি ছিল না। কিন্তু গ্যালারিতে যথারীতি ছিল কমলা রঙের উচ্ছ্বাস। আর নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ড বললেই আমরা বুঝি কমলা রঙ। তাই আমরা অপেক্ষায় থাকলাম কমলা রঙের উৎসবের। কেননা, বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা এই দলটির অপ্রাপ্তি যদি ঘুচে যায়, তাতে সমৃদ্ধ হবে ফুটবল। 
রচনাকাল ১৪ জুন ২০১৪


dulalmahmud@yahoo.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

আমাদের ফুটবলাররা

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ

এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয় / দুলাল মাহমুদ