শেখ মুহাম্মদ রুস্তম আলী : নিষ্ঠাবান ক্রীড়াবিদ/ দুলাল মাহমুদ

ক্রীড়াঙ্গনের সব ক্ষেত্রেই ছিল তার অবাধ বিচরণ। ক্রীড়াবিদ হিসেবে কত রকম খেলা যে খেলেছেন, কত যে পদক পেয়েছেন, তা নিজেও জানেন না। প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি যে কতজনকে দীক্ষা দিয়েছেন, তার কোনো সঠিক সংখ্যা নেই। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে তার পরিচয়ের ব্যাপ্তি অনেক দূর বিস্তৃত। এদেশের ক্রীড়াঙ্গনের মৌলিক ভিত যাদের হাতে রচিত হয়েছে, তিনি তাদের একজন। আপাদমস্তক এই ক্রীড়াবিদ হলেন অবসরপ্রাপ্ত ফাইট লেফটেন্যান্ট শেখ মুহাম্মদ রুস্তম আলী। সময়ের পলেস্তরায় এখন তিনি অনেকটা আড়াল পড়ে গেছেন। নতুন প্রজন্ম তাকে খুব একটা চেনেন না। ক্রীড়াঙ্গনেও তার উপস্থিতি এখন চোখে পড়ে না। কিন্তু ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে তার রয়ে গেছে আত্মীক ও মানসিক সম্পর্ক। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি যখন কথার মালা গাঁথেন, আদ্যোপান্ত তাতে থাকে ক্রীড়াঙ্গন। ক্রীড়াঙ্গনের নিটোল ছবি তার বুকের মধ্যে সযতনে সাজানো। একটুখানি টোকা পড়লেই বিরর থেকে বেরিয়ে আসে ক্রীড়াঙ্গনের নানা ইতিহাস।
শেখ মুহাম্মদ রুস্তম আলীকে ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি আকৃষ্ট করেছে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। বাড়ি থেকে পা বাড়ালেই পেতেন খেলাধুলার উষ্ণ সান্নিধ্য। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে তিনি বলেন, ‘বাড়ি থেকে বের হলেই মাঠ আর মাঠ। কাছেই ছিল রাজশাহী কলেজ এবং কলেজিয়েট স্কুল। মাঠ ছাড়াও কলেজ এবং স্কুলের ছিল আলাদা জিমনেসিয়াম। কলেজের হোস্টেলের ছিল আলাদা মাঠ। রাজশাহী কলেজ মাঠে কত রকম খেলা যে হত। ফুটবল, হকি, ক্রিকেট, ভলিবল, লন টেনিস, বাস্কেটবল, অ্যাথলেটিকস। এমনকি কলেজের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীতে আয়োজিত হতো নৌকাবাইচ। এ কারণে সেই শৈশবেই সব রকম খেলাধুলায় আকৃষ্ট হই। কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র হিসেবে শুরু করি খেলাধুলা। অল্প বয়সেই প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়ায় অংশ নিতে থাকি। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত আমি স্কুল এবং আন্তঃস্কুল অ্যাথলেটিকসে চ্যাম্পিয়ন হই। প্রথমদিকে হাইজাম্প, লংজাম্প, হপস্টেপ জাম্প, পোলভল্ট করতাম। আমাদের গাইড করার কেউ ছিল না। নিজের মত করে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতাম। অনুশীলনের অংশ হিসেবে পদ্মা নদীর ঢালু দিয়ে দৌড়াতাম। তবে খেলাধুলার নিয়ম-কানুন ও শৃংখলা মেনে চলতাম। পরের দিকে ১০০, ৮০০, ১৫০০ মিটার দৌড়, ডিসকাস থ্রো, শটপুট এবং সাইকিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার পেতাম। পারিবারিকভাবে চলে আসা লাঠি খেলা, কুস্তিও করতাম। ইন্টার স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জাম্প ইভেন্টতে প্রথম হই। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে দ্বিতীয় হওয়ায় তা বাদ দিয়ে দেই। ৪গুণন১০০, ৪গুণন৪০০ মিটার রিলে দৌড়, ১১০ মিটার হার্ডলস, পোলভল্ট, ৮০০, ১৫০০ মিটার প্রথম হলেও পরবর্তীতে বুঝতে পারি, অনেক বেশি খেলায় অংশ নেয়ার কারণে কান্তি এসে ভর করতো। এ কারণে কিছু কিছু খেলা বাদ দিয়ে দেই। স্কুলে বেসবল, ভলিবল, ক্রিকেট, হকি, ফুটবল খেলায় অংশ নিয়েছি। এছাড়া আমাদের স্কুলে একটি লন-টেনিস কোর্ট ছিল। সেখানে টেনিস খেলেছি।’
সাঁতারু হিসেবেও তিনি দক্ষতা প্রদর্শন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্কুল পর্যায়ে সাঁতারে অংশ নিয়ে সাফল্য অর্জন করি। আমার ইভেন্ট ছিল ব্যাক স্ট্রোক ও ফ্রিস্টাইল। ১৯৫৫ সালে চালু করা হয় ঢাকা স্টেডিয়ামের সুইমিংপুল। সেবার রাজশাহী বিভাগের হয়ে প্রাদেশিক সাঁতারে অংশ নেই ৫০ ও ১০০ মিটার ব্যাক স্ট্রোকে। ৫০ মিটারে আমি প্রথম হই। দ্বিতীয় হই ১০০ মিটারে। এই ইভেন্টের শেষ পর্যায়ে আমার বাঁ পায়ের কাফ মাসলে পুল করলেও আমি মনের জোরে সাঁতার সম্পন্ন করি। বগুড়ার কামরুল হুদা এতে প্রথম হন।’
১৯৫৬ সাল থেকে রাজশাহী কলেজের হয়ে ইন্টার কলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি সাঁতার, জিমন্যাস্টিকস, বক্সিং, ফুটবল, হকি, ভলিবল, ক্রিকেট এবং অ্যাথলেটিক্সের ১১০ মিটার হার্ডলস, শটপুট, ডিসকাস থ্রো, হাইজাম্প, লংজাম্প, হপস্টেপ জাম্প, পোলভল্ট, ২০০, ৪০০, ৮০০ ও ১৫০০ মিটার স্প্রিন্ট, রিলেতে অংশ নেন। ১৯৫৭ সালে প্রাদেশিক অ্যাথলেটিকসে তিনি পোলভল্টে প্রথম এবং ১৯৫৯ সালে দ্বিতীয় হন। তিনি জানান, ১৯৫৭ সালে ঢাকায় প্রাদেশিক অ্যাথলেটিকসের পোলভল্টে তিনি প্রথম হলেও তাকে ও এসএ জামান মুক্তাকে যুগ্মভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন আন্তঃকলেজ অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়ন। রাজশাহী কলেজে জিমন্যাস্টিকস, শরীরগঠন ও মুষ্টিযুদ্ধ প্রতিযোগিতায় তিনি বহুবার চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় চ্যাম্পিয়ন। একই সময় তিনি জিন্নাহ হল, বর্তমানের শের-এ-বাংলা ফজলুল হক হল এবং আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ন্যাশনাল অ্যাথলেটিকস কোচিং ক্যাম্পে তিনি অংশ নেন। সেখানে তিনি ১১০ মিটার হার্ডলস, পোলভল্ট, ডিসকাস থ্রো, শটপুট, হাইজাম্প, লংজাম্প ইভেন্টে প্রশিক্ষণ ও সনদ পান। এই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে তার সঙ্গে ছিলেন কুষ্টিয়ার খন্দকার আবুল হাসান, পাবনার প্রশান্ত কুমার, রাজশাহীর মতিন খান, কামরুল ইসলাম, মকবুল, আনসারের কোরাইশি, এনামুল হক। সে সময় পাকিস্তানের অ্যাথলেটিকসের দুই কোচ মেজর হামিদ ও মেজর রাজা তাকে হার্ডলস ও পোলভল্টে অংশ নেয়ার পরামর্শ দেন। এরপর থেকে তিনি হার্ডলসকে বেশি গুরুত্ব দেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত আন্তঃকলেজ হকি প্রতিযোগিতায় তিনি অংশ নেন। ১৯৬০ সালে তার দল রাজশাহী কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দলের দলনায়ক হিসেবে অংশ নিয়ে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিকসে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৬৩ সালে ১১০ মিটার হার্ডলস, ৪গুণন১০০ মিটার রিলে, ৪গুণন৪০০ মিটার রিলে, ডিসকাস থ্রোতে প্রথম, শটপুটে দ্বিতীয় হন। ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় হকি প্রতিযোগিতায় তিনি চ্যাম্পিয়ন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি লেফট ব্যাক এবং সেন্টার হাফে খেলতেন। এ সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় হকি খেলোয়াড় বশির আহমেদ, আবদুস সাদেক, প্রতাপ শংকর হাজরার সঙ্গে। রাজশাহীর স্থানীয় লীগ ও টুর্নামেন্টে তিনি ফুটবল, হকি, ভলিবল, সাঁতার, অ্যাথলেটিকসে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। ভলিবল ও ফুটবল খেলেন এলাইড স্পোর্টিং এবং হকি খেলেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। এলাইড স্পোর্টিং ক্লাব আয়োজিত অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন ইভেন্টে সাফল্য অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিকস দলের দলনায়ক হিসেবে প্রাদেশিক ও জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় প্রতিনিধিত্ব করেন। একই বছর পূর্ব পাকিস্তান বক্সিং প্রতিযোগিতার ব্যান্টম ওয়েটের ফাইনালে তিনি রহমত আলীর কাছে হেরে যান।
১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের রিসালপুরে ন্যাশনাল সুইমিং চ্যাম্পিয়নশীপে বিমানবাহিনীর হয়ে ৪গুণন১০০ মিডলেতে প্রথম হন। তিনি অংশ নেন ব্যাক স্ট্রোকে। ১৯৬৬ সালে লাহোরে ন্যাশনাল বক্সিংয়ে তিনি ব্যান্টম ওয়েটে চ্যাম্পিয়ন হন।
১৯৬১ ও ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে দু’বার অ্যাথলেটিকসে ব্লু প্রদান করা হয়। দু’বারই আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিকসে চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬২ সালে তাকে হকিতে ব্লু দেয়া হয়।
১৯৬৪ সাল থেকে তিনি নিয়মিতভাবে প্রাদেশিক অ্যাথলেটিকস, জিমন্যাস্টিকস, বক্সিং, কুস্তি প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে থেকে তিনি বিভিন্ন খেলায় টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। টেকনিক্যাল কমিটিতে তিনি খান মজলিশ, সৈয়দ শহীদুল ইসলাম, আবুল হাসনাত প্রমুখ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কাজ করেন। এছাড়া ফুটবলে ছিলেন সাহেব আলী, নবী চৌধুরী। ১৯৬৮ সালে ঢাকায় ন্যাশনাল গেমসের গ্রাউন্ড, প্রস্তুতি কমিটি, উদ্বোধনী ও সমাপনী কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। অ্যাথলেটিকসে তিনি ছিলেন স্কোরার ও টাইমকিপার। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
খেলাধুলার পাশাপাশি নানা কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুহাম্মদ রুস্তম আলী। স্কুল জীবন থেকেই বয়স্কাউট, ক্যাডেট হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘আমার জীবনে নানাবিধ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত থেকে অর্জিত জ্ঞান-প্রজ্ঞা নানা ক্ষেত্রে বিতরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছি। খেলাধুলা, সামরিক শিক্ষা-জুনিয়র ক্যাডেট কোর ও ইপি ইউওটিসি ব্যাটালিয়ন, কাব, বয়স্কাউট, রোভার স্কাউট-এ অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্ব দিয়েছি। স্কুল হতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্কুল ক্যাপ্টেন, কলেজের ছাত্র সংসদে সেক্রেটারি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করে রাকসু প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা এবং রাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রথম সহ-সভাপতি হয়েছি। হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব দিয়েছি। আমার নেতৃত্বে ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে রাজশাহী কলেজ ইউওটিসি কন্টিনজেন্টের জন্য একটি তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে বিচিত্রানুষ্ঠান করেছিলাম। এ অনুষ্ঠানে সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি, একাঙ্কিকা, ছড়ার পাশাপাশি আয়োজন করেছিলাম ব্যায়াম ও শারীরিক কসরত প্রদর্শনী। তা বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।’
শেখ মুহাম্মদ রুস্তম আলী ১৯৩৯ সালের ২০ জানুয়ারি রাজশাহীর দরগাহপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী কলেজ হতে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়াধীন তৎকালীন ঢাকা শারীরিক শিক্ষা কলেজ হতে প্রথম বিপিএড কোর্সে প্রথম স্থান অর্জন করেন। অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, জিমন্যাস্টিক, বক্সিং, হকিতে দক্ষতার জন্য সনদ পান। পরবর্তীকালে তিনি রাজশাহী কলেজ এবং ঢাকার শারীরিক শিক্ষা কলেজে শিক্ষকতা করেন।
১৯৬৫ সালে একমাত্র বাঙালি হিসেবে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফিজিক্যাল ফিটনেস অফিসার হিসেবে কমিশন পেয়ে যোগ দেন। তিনি বিমানবাহিনীর একাডেমিতে অ্যাথলেটিকসে চ্যাম্পিয়ন হন। একাডেমি ও বিমানবাহিনীর পক্ষে জাতীয় সাঁতারে অংশ নেন। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একাডেমি রিসালপুরে ১১০ মিটার হার্ডলস, লংজাম্প, পোলভল্ট এবং সাঁতারের ৫০ ও ১০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে অংশ নিয়ে প্রথম হন। তিনি বিমানবাহিনী দলের হয়ে অল পাকিস্তান আতিকুল্লাহ হকি টুর্নামেন্টে খেলেন।
খেলোয়াড় তৈরি করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘খেলোয়াড় গড়ে তোলার জন্য নিজেকে নিবেদিত করে দেই। আমার লব্ধ অভিজ্ঞতা দিয়ে ক্রীড়া প্রশিক্ষণ দিয়েছি। অনুশীলন ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ক্রীড়ার মানোন্নয়ন তথা ক্রীড়াবিদের অবস্থান বুঝে উঠতে পারি। ভলিবলে আমি বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় তৈরি করেছি। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মহসীন, বাবর, রতন, এমদাদ, বজলুল, তারেক, মোরশেদ। এছাড়া আমার হাতে দীক্ষা পেয়েছেন বেশ কয়েকজন ফুটবলার।’
১৯৭০ সালে তার প্রশিক্ষণে কোহাট পাকিস্তান বিমানবাহিনী ভলিবল ও ফুটবল দল আন্তঃবেইস প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়। পেশওয়ারে থাকার সময় তিনি বিমানবাহিনীর সাঁতারুদের প্রশিক্ষণ তত্ত্বাবধান করেন। এছাড়া শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক (জিসিআই) ঘাঁটির সাঁতার প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালনের সময় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তার প্রশিক্ষণ পেয়ে সাফল্য দেখান সাঁতারু সিরাজ, আজিজ, শহীদ, জাফর, বাশার, রিয়াজ, মোজাফফর প্রমুখ।
রুস্তম আলী রাজশাহীতে দুটি ব্যায়ামাগার- দরগাহপাড়া জিমন্যাস্টিকস ও বডিবিল্ডিং কাব এবং বোসপাড়ায় লৌহ যুবক সমিতি ব্যায়ামাগারের প্রতিষ্ঠাতা। একই সঙ্গে তিনি সাধারণ সম্পাদক ও প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন।
সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তার ছিল উজ্জ্বল ভূমিকা। স্কুল হতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আবৃত্তি, নজরুল গীতি, নাটক করার পাশাপাশি মঞ্চ সজ্জার কাজও করেছেন।
বাংলাদেশ ভারোত্তোলন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ বক্সিং ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন। এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতায় প্রধান বিচারক, বডিবিল্ডিং, ভারোত্তোলন, কুস্তি, ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ‘স্কুল অব ফিজিক্যাল ফিটনেস’-এর প্রতিষ্ঠাতা অফিসার কমান্ডিং ছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালে তদানীন্তন জাতীয় ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হালের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টস (বিকেএসপি)-র প্রস্তাবক, পরিকল্পনা প্রস্তুতকারক এবং বাস্তবায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজন দক্ষ খেলোয়াড়, ক্রীড়া প্রশিক্ষক, রেফারি, আম্পায়ার ও সংগঠকের। এরজন্য প্রয়োজন শিক্ষার মধ্য দিয়ে সুপরিকল্পিত বিজ্ঞানভিত্তিক অনুশীলন, প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতার আয়োজন। বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিতকরণ ও এগুলো দূর করা এবং খেলাধুলাকে ঢাকাকেন্দ্রিক না রেখে বিকেন্দ্রীকরণ করা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টস’ অর্থাৎ বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামক একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা ১৯৭৬ সালের ৪ মে সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দেই। এই প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিয়ে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। তবে নির্দিষ্ট সরকারী প্রকল্প মূল্যায়ন ছকে বিস্তারিত বিশ্লেষণ, সমর্থনযোগ্যতা, বাজেট চাহিদাসহ প্রকল্পের পূর্ণ রূপরেখা নতুন আঙ্গিকে প্রণয়নের জন্য জনশিক্ষা দপ্তরের শারীরিক শিক্ষা পরিচালক মাহদি বিল্লাহ খান মজলিশ ও আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আমরা প্রাথমিকভাবে ১৩ কোটি ২৫ লাখ টাকার বাজেট সংবলিত প্রস্তাব প্রকল্প আকারে নির্দিষ্ট ছকে পেশ করি। অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রকল্পটির বাজেট ধরা হয় ৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ১৯৭৬ সালের ৯ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)-এর সভায় অনুমোদিত হয় ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টস’ প্রকল্পটি। অনুমোদিত প্রকল্পে সাভারে একটি জাতীয় ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্স, শারীরিক শিক্ষা কলেজ পুরুষ শাখা, স্পোর্টস ট্যালেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল এবং চারটি বিভাগে চারটি আঞ্চলিক ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয়। এই প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে ছিল ক্রীড়া প্রশিক্ষক, রেফারি ও আম্পায়ার্সদের জন্য প্রশিক্ষণ ও গ্রেডেশন, জাতীয় দলের প্রশিক্ষণ, প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় তরুণ খেলোয়াড়দের দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য স্পোর্টস ট্যালেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত বৃত্তি বা বিনা বেতনে আবাসিক সুবিধাদি ও সাধারণ শিক্ষার সুযোগসহ ভর্তি করার ব্যবস্থা রাখা হয়। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা হবে ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ, যারা বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ক্রীড়া কৌশল শিখবে, অনুশীলন করবে এবং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দেশের গৌরব বৃদ্ধি করবে। এছাড়াও ক্রীড়া প্রশিক্ষক ও শারীরিক শিক্ষাবিদরা ল্যাবরেটরির শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করে তাদেরকে কোন খেলায় ভালো, সেই অনুসারে নির্দিষ্ট খেলায় অনুশীলন অব্যাহত রেখে আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় গড়ে তুলবেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে যে চার সদস্যের কমিটি গঠিত হয়, তার একজন সদস্য ছিলাম আমি।’
একই প্রকল্পে শারীরিক শিক্ষা কলেজ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শারীরিক শিক্ষকের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ক্রীড়া প্রশিক্ষক হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যাবার জন্য যোগ্য ও দক্ষ লোকবল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। শারীরিক শিক্ষা কলেজের সিলেবাসে কিছু রদবদল করে যুগোপযোগী এবং ‘মাস্টার্স ইন ফিজিক্যাল এডুকেশন’ চালু করার কথা বলা হয়। সাভারে ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্সের জন্য ১০০ একর জমি বরাদ্দ ও হুকুম দখলের যে প্রকল্প অনুমোদিত হয়, তার মধ্যে ১৫ দশমিক ৬১ একর ছিল শারীরিক শিক্ষা কলেজের জন্য।’
শেখ মুহাম্মদ রুস্তম আলী ১৯৭৬ সালের মন্ট্রিল অলিম্পিক গেমসে পর্যবেক্ষক হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ক্রীড়া কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি তদানীন্তন জাতীয় খেলাধুলা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে অবসর নেন।
খেলোয়াড়, প্রশিক্ষক, রেফারি ও সংগঠক হিসেবে ক্রীড়াঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি লেখালেখির মাধ্যমেও তিনি গড়ে তোলেন ক্রীড়া আন্দোলন। তিনি‘ব্যায়াম’,‘শারীরিক শিক্ষা’ও‘শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য’সংক্রান্ত গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি লিখেছেন ক্রীড়াবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ লেখা। এছাড়া রেডিওতে ‘সুস্থ থাকুন',বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘সুস্থ দেহ সুন্দর মন’, ‘এসো ব্যায়াম করি’,‘এসো খেলা করি’ইত্যাদি ক্রীড়াবিষয়ক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন।
বর্ণিল জীবনে নানা কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন শেখ মুহাম্মদ রুস্তম আলী। এক কথায় বলা যেতে পারে, সব কাজের কাজী। কিন্তু সব পরিচয়কে ছাপিয়ে তিনি নিজেকে খেলার মাঠের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। খেলার মাঠে কোথাও কোনো সাফল্য এলে এখনো তিনি উদ্বেলিত হন। অপেক্ষায় থাকেন আরো বড় কোনো সাফল্যের। #
১-১২-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ