আগ্রাসী মানসিকতাই জার্মানদের চাবিকাঠি / দুলাল মাহমুদ




শ্বেত-শুভ্র জার্সিতে বোঝা যায় না, ভিতরে ভিতরে জার্মানরা কত কঠিন, কত অনমনীয়, কত নির্মম হতে পারে। যখন তাঁরা খেলতে নামে, তখন অনুধাবন করা যায় তাঁদের জাত্যাভিমান কতটা প্রবল, তাঁদের জাতীয়তাবাদ কতটা তীব্র, তাঁদের আগ্রাসী মানসিকতা কতটা ভয়ঙ্কর। আর ফুটবল মাঠটাকে বরাবরই তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবেই বিবেচনা করে এসেছে। এর পেছনে কাজ করছে তাঁদের অন্যরকম হিসেব। প্রত্যক্ষভাবে হয়তো তাঁদের এই মনোভাবের প্রতিফলন বোঝা যাবে না। কিন্তু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে তাদের এই ‘কিলার ইনসটিংকট’ বা খুনে প্রবৃত্তি স্পষ্ট হয়ে উঠে।
কেউই তো আর পরাজয়টাকে সহজে মেনে নিতে চায় না। পরাজয়ের বেদনা সারা জীবনই কুরে কুরে খায়। আর একটি জাতির পরাজয়ের বেদনা চলতে থাকে অনন্তকাল। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হার মানলেও জার্মানদের বুকের ভিতরে পরাজয়ের এই কষ্ট, এই বেদনা তুষের আগুনের মতো ধিকি ধিকি করে জ্বলে। জ্বলারই কথা। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো পথ নেই। কেননা, ইতিহাস তো আর মুছে ফেলা যায় না। তবে সাময়িক একটা উপশম যদি পাওয়া যায়, তাতে মন্দ কি, এমন একটা ভাবনা তাঁদের পেয়ে বসে। তাই ‘বিশ্বব্যাপী আধিপত্য’ প্রতিষ্ঠা আর ‘পরাজয়ের প্রতিশোধ’ নেওয়ার জন্য জার্মানরা একটা পরোক্ষ উপায় খুঁজতে থাকেন। এরই পথ বেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই বলীয়ান হয়ে উঠে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে। কিন্তু তাতে তো তাঁদের একাধিপত্য বজায় নেই। এ কারণে তাঁদের মনের জ্বালা-যন্ত্রণা ও ক্ষুধা মিটছিল না। এমন একটা পথ তাঁরা চাচ্ছিল, যেখানে বিশ্বটাকে অনায়াসেই হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা যায়। আর ফুটবল মাঠের চেয়ে এমন উত্তম সুযোগ আর কোথায় পাওয়া যাবে? ফুটবলেই একত্রিত হয় সারা দুনিয়া। ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফার যত সদস্য, আর কোনো সংস্থার তত সদস্য নেই। বিশ্ব ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারলেই তো দুনিয়াটাকে ‘দখল’ করে নেওয়া যায়। অনেক ভেবে-চিন্তে ফুটবলকেই বেছে নেয় জার্মানরা। ফুটবল মাঠেই প্রতিপক্ষ হিসেবে পাওয়া যায় তাবৎ বৃহৎ শক্তিকে। খেলায় জিততে পারলে নেওয়া যায় ‘পরাজয়ের প্রতিশোধ’। ফুটবল মাঠে জয়ের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠে পুরো জার্মান জাতি। জার্মানদের প্রতিজ্ঞা অত্যন্ত বিপদজ্জনক। এমনিতেই জার্মানরা ফুটবল খেলাটাকে অনেক পছন্দ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফুটবলে তাঁরা নতুন মিশন নিয়ে মাঠে নামেন। ফিফার নিষেধাঙ্গার কারণে ১৯৫০ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারেনি খ-িত হয়ে যাওয়া জার্মানি। এটাও তাঁদের বুকের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়। হিটলারের বৈদেশিক নীতি ‘লেবেনস্রাউম’ (জীবন্ত অঞ্চল) দখল করে নেওয়ার মিশন ব্যর্থ হলেও ফুটবল মাঠে এর প্রয়োগ করে সুফল পায় জার্মানরা। ১৯৫৪ সালে সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয় পর্শ্চিম জার্মানি। এই শিরোপা জয়ে তাঁদের বুকে বইয়ে দেয় সুখের প্রস্রবণ। বিশ্বকাপটাকে মাথার উপর তুলে অধিনায়ক ফ্রিৎজ ওয়াল্টার দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়ে সগৌরবে বলেন, ‘দেখ্, আমরা জার্মান জাতি। আমরাই দুনিয়ার সেরা।’ এই সাফল্য জার্মানদের খানিকটা হলেও ভুলিয়ে দেয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের বেদনা। যে কারণে মাঠে নামলে টগবগিয়ে ফুটতে থাকে জার্মানির ‘আর্য’ রক্ত। তখন যেন এক একজন নিজেদেরকে সত্যি সত্যিই মনে করেন অ্যাডলফ হিটলারের উত্তরসূরি। এরপর থেকে শুরু হয় ফুটবলে জার্মানির আধিপত্য। যদিও তাঁদের থেকে বেশি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ব্রাজিল (পাঁচবার) এবং ইতালি (চারবার)। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করলে এভারেজে সবচেয়ে সফল দল জার্মানি। তাঁদের মতো সাফল্য আর কোনো দলের নেই। তিনবার (১৯৫৪, ১৯৭৪ ও ১৯৯০) চ্যাম্পিয়ন হলেও সর্বাধিক চারবার রানার্স-আপ (১৯৬৬, ১৯৮২. ১৯৮৬ ও ২০০২) হয়। সর্বাধিক ১২বার (১৯৩৪, ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬৬, ১৯৭০, ১৯৭৪, ১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৯০, ২০০২, ২০০৬ ও ২০১০) সেমি-ফাইনালে খেলেছে। গত ১৫টি বিশ্বকাপে কমপক্ষে শেষ ৮টি দলের মধ্যে ছিল জার্মানরা। ১৯৩০ সালে অর্থনৈতিক এবং ১৯৫০ সালে নিষেধাঙ্গার কারণে অংশ নিতে না পারলেও বাকী সবগুলো বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার কৃতিত্ব দেখিয়েছে। এ দেখে সহজেই বোঝা যায়, ফুটবলে কীভাবে পরাশক্তি হয়ে উঠেছে জার্মানরা। জার্মানরা কখনো পরাভব মানতে চায় না। ফুটবল খেলতে নামে জয়ের জন্যই। এর বিকল্প কিছু তাঁরা ভাবতেও পারে না। এই জয়ে তাঁদের মধ্যে যে আধিপত্যের সুখ এনে দেয়, আর কোনো কিছুতে তাঁরা সেটা পায় না।      
জার্মানির ফুটবল দল সম্পর্কে ইংল্যান্ডের সাবেক ফুটবলার ও ধারাভাষ্যকার গ্যারি লিনেকারের উক্তির কোনো তুলনা হয় না,
Football is a simple game. Twenty-two men chase a ball for 90 minutes and at the Germans always win. ( ফুটবল সহজ একটি খেলা। ৯০ মিনিট এর পেছনে ধাওয়া করেন ২২ জন ফুটবলার এবং শেষ পর্যন্ত তাতে জয়ী হয় জার্মানরাই।)
ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ডের মতো দলগুলোর জার্মানিকে নিয়ে তেমন হুল্লোড় হয় না। কিন্তু সাফল্যের বাটখারায় তাঁদের পাল্লাই থাকে ভারী। জার্মানরা নীরবে, নিঃশব্দে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পছন্দ করে। এবারের বিশ্বকাপের শুরুতেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালকে যেভাবে ছিন্ন-বিছিন্ন করে দিয়েছে, তাতে প্রকাশিত হয়েছে জার্মানদের বিশ্ব জয়ের দুর্দমনীয় মানসিকতা। টমাস মুলাররা ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন সব প্রতিপক্ষকে। ফুটবল কিংবদন্তি পেলে তো আগেই এই ভয় পেয়েছেন। জার্মানির ম্যাচের আগেই তিনি বলেন, ‘এবারের বিশ্বকাপে ফেবারিট ব্রাজিল। আমরা খেলছি ঘরের মাঠে। আমাদের দলটাও বেশ ভালো। কিন্তু আমি সমীহ করি জার্মানিকে। প্রতিটি জার্মান খেলোয়াড়কে আমি ভয় পাই। বিশেষত স্ট্রাইকার টমাস মুলার ও মিডফিল্ডার মেসুত ওজিলকে। এই দুই ফুটবলার ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন।’ পেলের কথার প্রতিফলন ঘটাতে কিন্তু বেশি সময় নেয়নি জার্মানরা।

dulalmahmud@yahoo.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

আমাদের ফুটবলাররা

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ

এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয় / দুলাল মাহমুদ