ভলিবলের প্রাণপুরুষ গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী/ দুলাল মাহমুদ

বাংলাদেশের ভলিবল বললে অল্প যে ক’জনের প্রতিকৃতি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তাদের অন্যতম হলেন গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বাবু নামে পরিচিত। উচ্চতা, দৈহিক গড়ন, সুদর্শন চেহারা, স্মার্টনেস, সর্বোপরি ঝলমলে ব্যক্তিত্ব দিয়ে তিনি আলাদাভাবে সবার নজর কেড়ে নেন। ক্রীড়া অনুরাগী হিসেবে তার রয়েছে আলাদা পরিচিতি। তিনি যে ভলিবলের একজন কুশলী খেলোয়াড় ছিলেন, সেটাও তার অবয়ব দেখে অনায়াসে অনুধাবন করা যায়। বর্তমানে তার খেলোয়াড় পরিচিতিটা কিছুটা ধূসর হয়ে গেলেও উজ্জ্বল হয়ে আছে ভলিবলের প্রতি তার আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। কিশোর বেলায় সেই যে ভলিবলের মায়াবী টানে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, সেই মোহ আর কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীল পদে কর্মরত থাকলেও ভলিবলের প্রতি তার ভালোবাসা একবিন্দুও টাল খায়নি। তার বুকের মধ্যে জমে আছে ভলিবলকে নিয়ে অনেক অনেক স্বপ্ন, অনেক পরিকল্পনা।
ট্রান্সকম বেভারেজ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক ও সিইও হিসেবে অসম্ভব কর্মব্যস্ত জীবন গোলাম কুদ্দুস চৌধুরীর। এক মুহূর্তও পলক ফেলার সময় নেই। এর মাঝেও সেদিন গুলশানে তার অফিক কক্ষে দীর্ঘক্ষণ আলাপচারিতায় একটু একটু করে তিনি মেলে ধরেন ফেলে আসা রঙিন জীবন আর ভলিবল নিয়ে তার স্বপ্নচারিতার কথা। নস্টালজিয়ার তরী বেয়ে তিনি ফিরে যান সুদূর শৈশবে :‘আমার বাবা ছিলেন জেলা জজ। ১৯৫২ সালে তার পোস্টিং হয় ফরিদপুরে। আমরা তিনি ভাই ভর্তি হই ফরিদপুর জিলা স্কুলে। ওই স্কুলেই শুরু করি ফুটবল খেলা। মূলত সেখানেই খেলাধুলায় হাতেখড়ি। ১৯৫৩ সালে বাবা পুনরায় বদলি হন কুষ্টিয়ায়। আমি কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল স্কুলে ভর্তি হই অষ্টম শ্রেণীতে। এই স্কুলের মাঠেই সিরিয়াসলি ফুটবল ও ভলিবল খেলা শুরু করি। ফুটবলে আমি ছিলাম গোলকিপার। সে সময় যাযাবর টিমে ফুটবল খেলতেন খন্দকার আবুল হাসান। মোহিনী মিল স্কুল থেকে ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করি। এরপর ঢাকায় বদলি হন বাবা। আমাদের বাসা দেয়া হয় আজিমপুর কলোনিতে। আজিমপুর কলোনিতে ছিল খেলাধুলার চমৎকার পরিবেশ। ১৯৫৬ সালে আমি ভর্তি হই ঢাকার নটরডেম কলেজে। সে সময় আমার উচ্চতা ছিল ৬ ফুট। ফিজিক্যালি স্লিম ও ফিট ছিলাম। আমার শারীরিক গড়ন ও বডি ফিটনেসের কারণে সবাই আমাকে কেবল ভলিবল খেলতে উৎসাহিত করেন। তাছাড়া তখন ভলিবল খেলা ছিল তুমুলভাবে জনপ্রিয়। সে সময় আমি ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়ে ভলিবল খেলায় মনোনিবেশ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল ও ফায়ার ব্রিগেডে ভলিবল প্র্যাকটিস করতাম। এ সময়ই ওয়ারী কাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। আমি ও আমার মেঝ ভাই খেলা দেখতে দেখতে ওয়ারী কাবে খেলা শুরু করি। ওয়ারী তখন নামকরা ভলিবল টিম। আমার মেঝ ভাই গোলাম মাবুদ চৌধুরী বাবু মূলত ওয়ারী কাবে খেলতেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতাম। তখন ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের সেক্রেটারি ছিলেন মহসীন ভাই। একদিন তিনি আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলেন, ‘এই বাবু, তুমি খেলতে নামছো না কেন?’ বাবু আমার ভাইয়ের নাম হলেও তখন থেকেই ক্রীড়াঙ্গনে আমি বাবু নামে পরিচিত হয়ে যাই।’
গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী স্ম্যাশার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন মডেল স্ম্যাশার। এক্ষেত্রে তার নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল। হাই পয়েন্ট থেকে অ্যাটাক করতে পারতেন। যে কোনো প্রান্ত থেকে বল হিট করলে নেটের কাছাকাছি বল পড়তো। যত খারাপ বলই হোক না কেন, সেটাকে অ্যাডজাস্ট করে ভালো ফিনিশিং দিতেন তিনি। তার ব্লকও ছিল উঁচুমানের। খুবই ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড় ছিলেন। কখনোই মাথা গরম করতেন না। কারো সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার প্রশ্নই আসে না। ভলিবলে ওয়ারী ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ লীগে সেই যে খেলা শুরু করেন, তারপর আর ক্লাব পরিবর্তনের কথা কখনোই চিন্তা করেননি। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি ওয়ারীতে খেলেন। তার সময় ওয়ারী বেশ কয়েকবার লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। অন্যান্য প্রতিযোগিতায়ও সাফল্য অর্জন করে। সে সময় ওয়ারী ক্লাবের প্রতিপক্ষ ছিল ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ইস্টএন্ড, ফায়ার ব্রিগেড, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব প্রভৃতি। এক কথায় বলতে গেলে তখন কাবগুলোরই প্রাধান্য ছিল। তার সমসাময়িক খেলোয়াড়দের মধ্যে আলোচিত ছিলেন মোহাম্মদ উল্লাহ, আজিজ, খন্দকার আবুল হাসান, ফরিদ চৌধুরী, আইয়ুব, আমিন, বাদশা প্রমুখ।
গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী ১৯৫৮ সালে প্রথমবারের মত ইস্ট পাকিস্তান ভলিবল দলে খেলেন। তিনি লাহোরে পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে অংশ নেন। ১৯৬০ সালে তিনি ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান দলের অধিনায়ক। খেলোয়াড়ী জীবনের তুঙ্গে থাকাবস্থায় তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়তে ১৯৬২ সালে মার্চে ইংল্যান্ড যান। সেখানে গিয়েও তিনি ভলিবল থেকে দূরে থাকতে পারেননি। জড়িয়ে পড়েন ঘনিষ্ঠভাবে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘লন্ডন গিয়ে আমি PUTNEY KESTRELS ভলিবল ক্লাবে নিয়মিত অনুশীলন শুরু করি। এই ক্লাবটি ভলিবলের একটি বিখ্যাত ক্লাব। এক বছর টানা অনুশীলন করার পর ওই কাবের হয়ে দ্বিতীয় বছরে দ্বিতীয় বিভাগ ভলিবল লীগের খেলার সুযোগ পাই। ১৯৬৭ সালে দ্বিতীয় বিভাগ লীগে ওই ক্লাবের অধিনায়ক হই এবং ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে উন্নীত হয়। এক বছর প্রথম বিভাগ ভলিবল লীগে খেলে দেশে ফিরে আসি। ওই কাবের হয়ে আমি ভলিবলে দু’বার ইউরোপীয় কাব চ্যাম্পিয়ন্স লীগ খেলেছি। এর মধ্যে একবার প্যারিসে এবং একবার জার্মানিতে খেলি। ইংল্যান্ডে ভলিবল খেলতাম উডেন ফোরে। ডাইভিং, ব্লক, উন্নতমানের ফিজিক্যাল ও জিম ট্রেনিং দেয়া হতো। যা আমাদের দেশে চিন্তা করা যায় না।’
১৯৬৯ সালে দেশে ফিরে আসার পর গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী ১৯৭০ সাল থেকে ঢাকা প্রথম বিভাগ ভলিবল লীগে ওয়ারীর হয়ে খেলা শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেশে এসে প্রথমে একটু অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। অসুবিধাটা হলো, ইংল্যান্ডে খেলেছি উডেন ফোরে। দেশে এসে ফের খেলতে হয় কে গ্রাউন্ডে। মানিয়ে নিতে একটু সমস্যা তো হয়েছেই।’ ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে দশম ন্যাশনাল ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ইস্ট পাকিস্তান দলের হয়ে অংশ নেন। এই টিমে আরো ছিলেন খন্দকার আবুল হাসান, মোস্তফা কামাল, সাইদুজ্জামান বাদশা, শামসুদ্দিন, কানু, সুভাষ, আজম, হাবিব।
১৯৭৩ সালে ভলিবলের কোচ হিসেবে বাংলাদেশে আসেন রাশিয়ার ভ্যালেরি প্যাট্রেনকো। তার কাছে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সফরে আসে সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ ডায়নামো দল। সেই দলের সঙ্গে খেলায় তিনি অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেন। সে সময়কার খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাসখন্দের সঙ্গে আমি তিনটি ম্যাচ খেলেছি। প্রতিটি ম্যাচই বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়। তখন ভলিবল ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় খেলা। দর্শকরা টিকিট কেটে খেলা দেখতে আসতেন। ভলিবলের সেই সুদিন এখন আর নেই।’
আন্তঃজেলা এবং ন্যাশনাল ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি খেলেছেন ঢাকা জেলার হয়ে। ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে পরপর তিনবার জাতীয় ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপে ঢাকা জেলা দলের অধিনায়ক ছিলেন এবং তিনবারই চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা জেলা।
সফিস্টিকেটেড একটা জীবনযাপন করার পরও ভলিবলের সঙ্গে নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘কোনো একটা অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম, ভলিবল আমার ফার্স্ট ওয়াইফ। প্রথম জীবনে এর সঙ্গে যে প্রেম হয়, তার মুগ্ধতা আর কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আসলে খেলাধুলার প্রতি আমার একটা দুর্বলতা রয়েছে। তরুণ প্রজন্মকে মোটিভেট করে খেলাধুলা। ফিজিক্যালি ফিট রাখে। মাদকদ্রব্যসহ বাজে অভ্যাস থেকে দূরে রাখে। জাতি গঠনে খেলাধুলার ভূমিকা অপরিসীম। খেলাধুলাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যাতে সুস্থ ও সুন্দর জাতি গঠন করা যায়। কিছু খেলা আছে যাতে পদক পাওয়া যেতে পারে। যেমন শুটিং, সাঁতার, অ্যাথলেটিকস। এ ধরনের খেলা থেকে এশিয়ান পর্যায়ে পদক আনার উদ্যোগ নেয়া দরকার। আবার কিছু খেলা আছে জননন্দিত। যেমন ভলিবল, ফুটবল, কাবাডি। সাম্প্রতিক সময়ে হ্যান্ডবলও দ্রুত জনপ্রিয়তার দিকে এগুচ্ছে। এ খেলাগুলোকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। খেলাধুলায় ভালো করতে না পারলে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না। খেলার সাফল্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্রুত পরিচিত হওয়া যায়। ’
খেলোয়াড়ী জীবন শেষে গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী জড়িয়ে পড়েন সংগঠক হিসেবে। ওয়ারী ক্লাবের সদস্য, সহ-সভাপতি ও ভলিবল কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ওয়ারী ক্লাবকে সেরা ভলিবল ক্লাব হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে তার রয়েছে অপরিসীম অবদান। তিনিই প্রথম কোনো ভলিবল ক্লাবকে বিদেশে সফরে নিয়ে যান। ১৯৮৩ সালে ব্যাংককের একটি টুর্নামেন্টে অংশ নেয় ওয়ারী ক্লাব। সেই টুর্নামেন্টে রানার্সআপ হয় ওয়ারী। এক্ষেত্রে তার অবদান সবচেয়ে বেশি। ১৯৮৪ সালে তার উদ্যোগে দ্বিতীয়বারের মতো শ্রীলংকায় রূপবাহিনী ভলিবল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ওয়ারী ক্লাব। একবার নিজের খরচে তিনি ওয়ারী ক্লাবের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্প করেন। সারা দেশ থেকে প্রায় ৩০ জন খেলোয়াড় বাছাই করে প্রশিক্ষণ দিয়ে ১৮ জন খেলোয়াড়কে চূড়ান্ত করা হয়। সম্পূর্ণভাবে নিজের খরচে প্রায় ১০ মাস এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এই প্রশিক্ষণের সুবাদে পরবর্তীকালে ওয়ারী ক্লাবকে ভলিবল দল গড়তে বেগ পেতে হয়নি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এমন তৎপরতা সচরাচর দেখা যায় না। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে সংগঠক হিসেবে তিনি জাতীয় পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট হন। ১৯৮৭ সালে সাধারণ সম্পাদক হন বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের। তিনি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর ভলিবলে স্পনসরশিপের সূচনা হয়। প্রায় প্রতিটি টুর্নামেন্টে স্পনসরশিপ পাওয়া যায়। এরপর তিনি এশিয়ান ভলিবল কনফেডারেশনের ডিরেক্টর হন। এক দশক সাধারণ সম্পাদক দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৯৭ সালে হন ফেডারেশনের সহ-সভাপতি। ১৯৯৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল ভলিবল ফেডারেশনের শতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশন একটি স্ট্যাম্প বের করে। সেবার ২১০টি দেশের মধ্যে পাঁচটি দেশ পুরস্কৃত হয়। তার মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। এক্ষেত্রেও তার সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালনের পর ২০০৭ সালে তিনি ভলিবল ফেডারেশনের সভাপতি হয়েছেন। ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের উপ-মহাসচিব হন। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালে জাপানের ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে ইন্টারন্যাশনাল ভলিবল ফেডারেশনের ইন্টারনাল অডিটর হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৯৮ সালে কোরিয়ায় এশিয়ান সিনিয়র পুরুষ ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ উপলক্ষে থাইল্যান্ডে এক মাস এবং জাপানে দু’সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় ভলিবল দলের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সেই সফরে তিনি স্বউদ্যোগে যোগ দেন। ২০০৮ সালে সুইজারল্যান্ডের লুজানে ইন্টারন্যাশনাল ভলিবল ফেডারেশনের ভবন উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া এশিয়ান ভলিবল ফেডারেশন এবং ইন্টারন্যাশনাল ভলিবল ফেডারেশনের সাধারণ সভা, বোর্ড মিটিংয়ে তিনি নিয়মিত অংশ নেন।
গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী ১৯৪০ সালের ২০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন।
ভলিবলে পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে ভলিবল খেলা ছিল ফিক্সড গেমস অর্থাৎ নিজ নিজ স্থান থেকে খেলতে হতো। আর খেলা ছিল ব্যক্তিগত নৈপুণ্যনির্ভর। এখন তো খেলায় অনেক পরিবর্তন। যেমন ওভার ব্লকিং, ডাবল ও ট্রিপল ব্লকিং। সার্ভিসে এসেছে জাম্প সার্ভিস, যা অনেকটা স্ম্যাশ করার মতো। এর সাথে আরো যোগ হয়েছে ব্যাক কোর্ট অ্যাটাক। আরো যুক্ত হয়েছে লিবারো খেলোয়াড়। পেছনের কোর্টে খারাপ ডিফেন্স যাদের তাদের বদলি করা যায়। এই লিবারো ১২ জনের দলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। সব মিলিয়ে খেলা একদিকে যেমন হয়েছে আধুনিক, অপরদিকে হয়েছে উপভোগ্য ও আকর্ষণীয়, সেই সাথে অত্যন্ত গতিশীল। এ তো গেল পুরুষ ভলিবলের কথা। মহিলাদের খেলা আরো আধুনিক ও আকর্ষণীয় হয়েছে।’
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভলিবলে পিছিয়ে থাকার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিদেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে আমাদের খেলোয়াড়দের হাইট ও ফিজিক্যাল সমস্যা এর অন্যতম কারণ। তারপরও আমরা চেষ্টা করলে এশিয়ান লেভেলে খেলতে পারি। এজন্য মাঠে নিয়মিত খেলা এবং নতুন খেলোয়াড় বের করার পথ থাকতে হবে। খেলোয়াড়দের ফিটনেস থাকাটা একটা ফ্যাক্টর। উচ্চতাও একটা বড় ফ্যাক্টর। আশার কথা, বর্তমানে জাতীয় দলের গড় উচ্চতা ৬ ফুট।’
ভলিবলে উন্নত দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে ভলিবল খেলা হয় টেরাফ্যাক্স ফোরে। আমাদের দেশে এটা না থাকায় আমরা ইনডোর ভলিবলে পিছিয়ে আছি। আমাদের সারা বছর ট্রেনিং করার জায়গা নেই। ইনডোরে সব সময় প্র্যাকটিস করার সুযোগ থাকে। ভলিবলের জন্য আলাদা ইনডোর কমপ্লেক্স প্রয়োজন। এটা হলে সারা বছর প্র্যাকটিস করা সম্ভব হবে। গত দু’দশকে ক্রীড়াক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সবকিছুতে পেশাদারিত্ব এসেছে। খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা দেয়া প্রয়োজন। তাদের নিরাপত্তা দেয়া না গেলে কেউ খেলাধুলায় আগ্রহী হবেন না। বাংলাদেশের ভলিবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় নিখিল। এখন অর্থনৈতিক সমস্যায় দিনাতিপাত করছেন। তার মতো অনেক খেলোয়াড়ই কষ্টকর জীবনযাপন করছেন। খেলার আগে এবং খেলার পরে, খেলোয়াড়দের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার, পৃষ্ঠপোষক, সংগঠকদের এগিয়ে আসতে হবে। ভালো হয়, যদি সম্মিলিতভাবে একটি দুস্থ খেলোয়াড় কল্যাণ তহবিল গঠন করা সম্ভব হয়। তাছাড়া খেলাধুলায় উন্নতি করতে হলে স্কুল-কলেজে খেলাধুলা বাধ্যতামূলক করতে হবে। তাহলেই দেশের ক্রীড়াঙ্গনের চেহারা বদলে যাবে। খেলাধুলা ছাড়া শিক্ষাজীবন বলা যায় অসম্পূর্ণ।’
স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৭৩ সালে লীগে সোনালী ব্যাংক ও ওয়ারীর খেলাটি এখনও স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে। পাঁচ সেটের খেলাটি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়। ২ পয়েন্টে আমরা হেরে যাই। আমরা হেরেছিলাম মূলত সোনালী ব্যাংকের সুভাষের কাছে। অসাধারণ খেলেছিলেন সুভাস। আর আমার দেখা খেলার মধ্যে মনে পড়ে ১৯৯১ সালে সাফ গেমসে বাংলাদেশ-শ্রীলংকার খেলা। সেবার বাংলাদেশের কোচ ছিল সুইডেনের ম্যাটস। বাংলাদেশে এসেছিলেন ট্যুরিস্ট হিসেবে। তার বায়োডাটা দেখে তাকে বাংলাদেশের কোচ করা হয়েছিল। প্রায় দেড় বছর তার অধীনে বাংলাদেশ প্রশিক্ষণ নেয়। গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে বাংলাদেশ ০-৩ সেটে হেরে যায়। সেমিফাইনালে পুনরায় শ্রীলংকার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। গ্রুপ ম্যাচে শ্রীলংকার খেলা পুরো ভিডিও করা হয়। বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের সেই খেলা বার বার দেখানো হয় এবং কোন খেলোয়াড়ের কোথায় দুর্বলতা তা বিশ্লেষণ করা হয়। খেলার আগের দিন শ্রীলংকার পত্র-পত্রিকায় লেখা হয়, Srilanka heading for gold. মোটামুটিভাবে শ্রীলংকা নিশ্চিত হয়ে যায়- বাংলাদেশকে তারা হারিয়ে দিচ্ছে। খেলার দিন পুরো স্টেডিয়াম কানায় কানায় ভর্তি। আমি জুরি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। আসলেই সেদিন বাংলাদেশের খেলা দেখে মন ভরে যায়। ছবির মতো খেলে বাংলাদেশ ৩-০ সেটে শ্রীলংকাকে হারিয়ে সুইট রিভেঞ্জ নেয়। এই পরাজয় শ্রীলংকানদের কাছে ছিল একদমই অভাবিত। তাদের স্বর্ণ জয়ের স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়। সফিজউদ্দিন ও আফজাল দুর্দান্ত খেলেন। এ খেলাটি আমার কাছে মিষ্টিমধুর স্মৃতি হয়ে আছে।’
গোলাম কুদ্দুস চৌধুরীর দৃষ্টিতে ভলিবলের সেরা খেলোয়াড়রা হলেন- অ্যাটাকার সুভাস, খন্দকার আবুল হাসান, আফজাল, ইয়াদ আলী, খোকন, ভুলু, সোহরাব, সফিজউদ্দিন, ডিফেন্ডার বাদশাহ, ফারুক, শামসউদ্দিন, সেট-আপার মোস্তফা কামাল, খায়রুল ইসলাম কানু, জাকির এবং বর্তমান সময়ের হাই অ্যাটাকার মামুন শেখ।
ভলিবল নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে খেলোয়াড় থেকে বর্তমানে ভলিবল ফেডারেশনের সভাপতি হয়েছেন গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী। এখন তিনি স্বপ্ন গড়ার কারিগর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি ভলিবলকে সারা দেশের গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে। কোয়ানটিটি এবং কোয়ালিটি- দু’ক্ষেত্রেই। একটি বেস তৈরি করতে পারলে পিরামিড হবে। তাতে ভলিবলের গাঁথুনিটা শক্ত হবে। গত বছর বিজ্ঞাপন দিয়ে অনূর্ধ্ব-১৮ বছর ও ৬ ফুটের ওপরের খেলোয়াড় সংগ্রহ করা হয়। প্রায় ৭০ জন খেলোয়াড়কে ট্রেনিং দেয়া হয়। এবছর প্রতিটি জেলায় লীগ চালু করার উদ্যোগ নেব। প্রথম পর্যায়ে ৩০টি জেলায় লীগ চালু করা গেলেও বড় একটি সাফল্য আসবে। এজন্য আমরা ফেডারেশন থেকে সমর্থন দেব। আসলে আমাদের প্রধান সমস্যা প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অর্থনৈতিক সমস্যা। আমি যেহেতু ট্রান্সকম বেভারেজ লিমিটেডে আছি, সে সুবাদে গত ছয় বছর ধরে পেপসি ভলিবল ও অন্যান্য খেলায় স্পনসর করে আসছে। বর্তমানে অনেকেই বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। ভলিবল পরিচালনার জন্য জেলায় জেলায় পর্যাপ্ত লোকবল নেই। সেটা আমাদের সংগঠিত করতে হবে। এশিয়ান ভলিবল কনফেডারেশনের কাছ থেকে আমরা সাহায্য পাই। প্রতিবছর তারা আমাদের ২০০ বল দেয়। এটা বেশ কাজে আসছে।’
গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী ভলিবলের একটি নির্ভরযোগ্য ও আস্থাভাজন নাম। তিনি ফেডারেশনের হাল ধরার পর দেশের ভলিবল অঙ্গনে আশার সঞ্চার হয়েছে। ক্রীড়ামোদীরা মনে করছেন, একজন যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিকে বসানো হয়েছে যথাযথ স্থানে। তার প্রতি মানুষের এই আস্থা ও ভালোবাসা একদিনে গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন যাবৎ ভলিবলের প্রতি মন-প্রাণ সঁপে দিয়ে তিনি যেভাবে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন, তাতে জয় করে নিয়েছেন সবার মন। তাকে কোনোদিন কোনো কুটিলতা, সংকীর্ণতা বা পরশ্রীকাতরতা স্পর্শ করেনি। গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী যখন স্টেডিয়াম এলাকা দিয়ে হেঁটে যান, তখন একটা বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। যারা তাকে চেনেন না, তারাও তার প্রতি অনুভব করেন এক ধরনের কৌতূহল। তিনি যে অন্য সবার চেয়ে আলাদা- এটা সহজেই অনুধাবন করা যায়। #
১-২-২০০৯

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ