সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

সব্যসাচী ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে উজ্জ্বল হয়ে আছেন যে ক’জন, তাদের অন্যতম হলেন বশীর আহমেদ। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন অলরাউন্ডার ক্রীড়াবিদ। তার ক্যারিয়ার ছিল বর্ণাঢ্য ও স্বর্ণোজ্জ্বল। সেই পঞ্চাশ ও ষাট দশকে হকি, ফুটবল, অ্যাথলেটিকস, ক্রিকেটে ফুটিয়েছেন সাফল্যের ফুল। সে সময়ে বিশ্বসেরা পাকিস্তান জাতীয় হকি দলে হাতেগোনা মুষ্টিমেয় যে ক’জন বাঙালি খেলোয়াড় খেলার বিরল গৌরব অর্জন করেন, তিনি তাদের একজন এবং প্রথম। রাইট বা লেফট ইন পজিশনে চোখ ধাঁধানো স্টিক ওয়ার্ক, চমৎকার পজিশনাল প্লে ও ছন্দোময় ড্রিবলিং দিয়ে ছড়িয়েছেন মুগ্ধতা। অসম্ভব প্রিগতিসম্পন্ন ছিলেন। অধিনায়ক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের। ফুটবলেও তার পায়ে ছিল শিল্পীত ঝিলিক। ইনসাইড ফরোয়ার্ড হিসেবে তিনি ছিলেন অধিকাংশ আক্রমণের উৎস। আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হিসেবে গোল করার েেত্র দেখিয়েছেন চমৎকার দতা। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান দলের অপরিহার্য খেলোয়াড়। নিয়মিত খেলেছেন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব ও ঢাকা মোহামেডানের শিরোপাজয়ী দলে। দুরন্ত অ্যাথলেট হিসেবেও তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। ছুটতেন বল্গা হরিণের মতো। ¯িপ্রন্ট, জাম্প, ডিসকাস থ্রোতে তার সাফল্যের আলোতে উদ্ভাসিত হয়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, পূর্ব পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস মিট। ক্রিকেটার হিসেবেও দেখিয়েছেন তার প্রতিভার দীপ্তি। এছাড়াও নানা খেলায় ছিল তার সদর্প বিচরণ। এরমধ্যে ছিল বেসবল, টেবিল টেনিস, বাস্কেটবল। খেলাটা ছিল তার কাছে নেশার মতো। খেলার মাঠের কিংবদন্তির এই নায়ক প্রশিক ও সংগঠক হিসেবেও ছিলেন সফল। ছিলেন প্রথম শ্রেণীর হকি ও ফুটবল রেফারী। ১৯৮০ সালে পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। হয়েছেন বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব। বর্তমানে তিনি সোনালী অতীত কাবের সভাপতি। এমন বিশাল, বিপুল ও দেদীপ্যমান ক্রীড়াজীবনের অধিকারী বশির আহমেদের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার এ সংখ্যা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে তার ধারাবাহিকভাবে জীবনকাহিনী “সোনালী অতীতের দিনগুলো”।  সম্পাদক, ক্রীড়াজগত

সোনালী অতীতের দিনগুলো
মানুষ তো প্রকৃতিরই সন্তান। যে কোনো মানুষেরই বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটা বড় অবদান থাকে তার জন্মস্থান, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার। কে যে কোথায়, কোন পরিবেশে জন্ম নেবেন, তা কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। এ তো সৃষ্টির এক অপার রহস্য। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের তার তল পাওয়া কঠিন। তবে আমার জীবনে আমার জন্মস্থানের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আমাকে বেধে রেখেছে সারা জীবনের ঋণে। এ কারণে আমার পক্ষে তাকে কখনো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। আমার একান্তের নিভৃত জীবনে প্রায়শই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আমার জন্মের স্থানটি।
আমার জন্ম ঢাকার মাহুতটুলির ৫ নম্বর পদ্মলোচন রায় লেনে। বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ঢাকা শহরের অন্যতম জনপদ মাহুতটুলি। অনেক পুরনো এই এলাকা। মুগল আমলে জমিদাররা পিলখানায় রাখতেন ব্যক্তিগত হাতি। ঢাকার মাহুতটুলিতে থাকতেন পিলখানায় রক্ষিত হাতির মাহুতরা। এসব কথা শুনলেও সেসব আমি দেখিনি। আমার বাবা নাসের আলী তার আট বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে মাহুতটুলিতে এসে থিতু হন। তার আগে বসবাস ছিল সূত্রাপুর এলাকায়, লোহারপুলে। আমার মায়ের বসবাস ছিল ঢাকার সাত রওজায়। সে মতে আমাকে ‘ঢাকাইয়া’ বললে অত্যুক্তি হবে না। মাহুতটুলীকে আমার জন্মস্থান আর নিজেকে ঢাকাইয়া পরিচয় দিতে আমি গর্ব অনুভব করি। তবে মনে-প্রাণে নিজেকে আমি বাংলাদেশী বলেই মনে করি। তাই কবির ভাষায় বলতে পারি, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’। আমার জন্মের সময় তো জন্মের দিন-ক্ষণ রাখার তেমন প্রচলন ছিল না। খুব একটা থাকতোও না। এ কারণে আমার জন্মেরও সঠিক সাল-তারিখ নির্ণয় করা কঠিন। যদিও সনদপত্র অনুযায়ী, ১৯৪৩ সালের ১ জানুয়ারি আমার জন্ম। এ প্রসঙ্গে ভারতের রেলমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের একটি কথা মনে পড়ে যায়। নিজের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘এ হামার অরজিনাল জনম তারিখ নাহি হ্যায়। ইয়ে তো ইনলোগ বানালিয়া হ্যায়।’ তার কথার রেশ ধরে আমিও বলতে পারি, ১ জানুয়ারি আমার অরজিনাল জন্ম তারিখ নয়। আমাদের প্রজন্মের অনেকেরই জন্ম তারিখ ১ জানুয়ারি। সুবিধার জন্যই এটা করা হতো। আমার মায়ের কাছে জেনেছি, আমার যেদিন জন্ম হয়Ñ সেদিন ছিল জামাইষষ্ঠী। এটি ছিল হিন্দুদের একটি পূজানুষ্ঠান। জামাইয়ের কল্যাণ কামনায় পালন করা হতো এই ব্রত। মায়ের কাছে আরো শুনেছি, জন্মের সময় আমি দেখতে যেমন ফর্সা হয়েছিলাম, তেমনি ছিলাম সুন্দর। আমাদের বাসা সংলগ্ন ছিল জমিদার ভারতচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাসাদ। সংবাদ পেয়ে জমিদার বাড়ি থেকে জমিদার গিন্নি সহ মহিলারা এসে আমাকে দেখে খুশিতে উলুধ্বনি দেন এবং বলেন, এ ছেলে ভাগ্যবান হবে। সেসব দিনে কোনো কিছু মনে রাখার জন্য মুরব্বীদের স্মৃতিতে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলতো আবহাওয়া, ঋতু কিংবা বড় কোনো ঘটনা। আমার মায়ের ভাষ্য মতে, আমার জন্মের সময় ছিল জ্যৈষ্ঠ মাস। গরম তো ছিলই। ছিল গাছে গাছে আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, লিচু ইত্যাদি ফল। পরে মিলিয়ে দেখেছি, মায়ের এই হিসাব ঠিকই আছে। গ্রীষ্মকালেই হিন্দুরা জামাইষষ্ঠীসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। তাতে থাকে ফল-ফলারির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাছাড়া আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন খ্যাতিমান লেখক, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আ ন ম বজলুর রশীদ। তার ¯ত্রী হাশমত রশীদও ছিলেন লেখিকা। তিনি আমাকে বলতেন, ‘আমি যখন এ বাসায় আসি, তখন আমার মেয়ে রিনি কয়েক মাসের কোলে। ঠিক তোরই মত বয়সের ছিল।’ তাতে অনেক যোগ-বিয়োগ করে আমার মনে হয়েছে, আমার জন্ম ১৯৪১ কিংবা ১৯৪২ সালের মে-জুন মাসে।
আমি ছিলাম বাবা-মায়ের চতুর্থ ও সবার ছোট সন্তান। আমার আগে দুই বোন ও এক ভাইয়ের জন্ম হয়। আমাদের সঙ্গেই থাকতেন আমার খালা-খালু। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। তারাই আমাকে সন্তান হিসেবে গড়ে-পিটে তোলেন। এ কারণে আমি ছোটবেলা থেকেই তাদেরই জানতাম বাবা-মা হিসেবে। খালা-খালুর আদর-যত্মে কেটেছে আমার র্দুন্ত শৈশব। আমার খালু আব্রার আহমেদ আনসারী। হেকেমি পেশায় তিনি পরিচিতি পান। তিনি ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির। পুঁথিগতভাবে হয়তঃ উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না, কিšত্ত তার মধ্যে ছিল শিক্ষার আলো। উর্দু গানের প্রতি তার ছিল দারুণ আগ্রহ। বাসায় থরে থরে সাজানো ছিল গজল আর কাওয়ালির বই। তার চাল-চলনে ছিল আভিজাত্যের ছাপ। আমাদের পাড়াটায় ছিল নানা রকম মানুষের মিশ্রণ। তাতে একটা বৈচিত্র্য পাওয়া যেত। সামনে ছিল জমিদার বাড়িসহ তিনটি হিন্দু বাড়ি। তাদের বাসার সঙ্গেই ছিল ছোটখাট মাঠ। সেই মাঠে ছিল বিশাল আকারের তেঁতুল গাছ। আরো ছিল তাল গাছ, বেল গাছ, গাব গাছ। সেখানে হিন্দুরা পূজা-অচর্ণা করতেন। হাঁটতে শেখার পর থেকেই এই মাঠ দেখে দেখেই আমি বড় হই। ছোট থেকেই এ মাঠেই খেলাধুলা করতাম। আমি বসতে শেখার পর আমার খালু আমার হাতে কি মনে করে ধরিয়ে দেন একটা ফুটবল। আমি বসে বসেই ফুটবলে লাথি মারতাম। দেখে তিনি খুশী হতেন। এ কারণে খেলাধুলাটা বুকের মধ্যে স্থায়ীভাবে ছাপ ফেলেছে কিনাÑ তা বলতে পারবো না। তখন ঢাকার স্থানীয় ছেলেরা ঘুড়ি ওড়ানো, পায়রা ওড়ানো, লাটিম ঘুরানোÑ এ ধরনের খেলায় মেতে থাকতেন। আমার খালু এসব পছন্দ করতেন না। তিনি চাইতেন না যে, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিশে ঘুড়ি উড়াই, লাটিম ঘুরাই, মার্বেল খেলি কিংবা আড্ডা মারি। তিনি চাইতেন, আমি যেন ভদ্র পরিবেশে বেড়ে উঠি। লেখাপড়া ও খেলাধুলা- দুটোর প্রতিই ছিল তার ঝোঁক। তিনি চাইতেন, আমি পড়ালেখা ও খেলাধুলা করে বড় হই। খালু চেষ্টা করতেন, পরিবারের অন্যদের থেকে আমাকে আলাদা করে রাখতে এবং পাড়ার বখাটে ছেলেদের সংস্পর্শে মিশতে না দিতে। একটা সুন্দর পরিবেশে আমাকে গড়ে তোলার জন্য তার চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। তিনি আমাকে বিভিন্ন খেলাধুলার সরঞ্জাম এনে দিতেন। আমাকে তিনি ফুটবল, হকি, ক্রিকেট খেলায় উদ্বুদ্ধ করতেন। সে সময় নবাব বাড়ির নিচে ক্রীড়া সরঞ্জাম বিক্রির অনেক দোকান ছিল। তার মধ্যে ছিল শাহী স্পোর্টস নামে একটি দোকান। এ দোকানের মালিক খলিল সাহেবের সঙ্গে খালুর ছিল বন্ধুত্ব। সেই সুবাদে ক্রীড়া সরঞ্জাম যখন যা যা প্রয়োজন হত, আমি তা দোকান থেকে নিয়ে আসতাম। ক্রীড়া সরঞ্জাম নিয়ে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। কিšত্ত পারিপার্শ্বিকতাকে এড়িয়ে বেড়ে ওঠা খুবই কঠিন। তাই আমিও এগুলোকে এড়াতে পারিনি। ছোটবেলা থেকে যেমন হকি, ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিকস খেলেছি, তেমনি পাড়ার ছেলেদের সাথে ঘুড়ি ওড়ানো, লাট্টু খেলা, মার্বেল খেলা, দাঁড়িয়াবান্ধা, লম্বা কাবাডি, নদীতে সাঁতরানো, আম চুরি, কলা চুরি একসাথে চালিয়ে যাই।
আসলে আমার শৈশব থেকেই পারিপার্শ্বিকতা ছিল খেলাধুলার অনুকূলে। ক্রীড়া সরঞ্জাম দিয়ে খালুর উৎসাহ প্রদান ছাড়াও বাড়ির সাথে জমিদারদের মাঠ, আরমানিটোলা স্কুলের কালো পিচ ঢালা রাস্তা, তিনটি মাঠ আর ছেলেদের উৎসবমুখর খেলাধুলা প্রচ ভাবে আকৃষ্ট করে আমাকে। তাছাড়া স্কুলের খেলোয়াড় সঙ্গীদের সঙ্গ আমাকে ভীষণভাবে আনন্দ দিত, উৎসাহ যোগাত খেলার প্রতি। পরবর্তীকালে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব আমাকে শুধু খেলোয়াড় হওয়ার উৎসাহ যোগায়নি, বরং তাদের অভিভাবকসুলভ আচরণ আমার চারিত্রিক ও মানসিক বিকাশেও প্রভাব ফেলেছে। সন্ধ্যা হলেই কর্মকর্তারা কাবে থাকা পছন্দ করতেন না। তারা ধমক দিয়ে পড়ালেখার জন্য বাসায় পাঠিয়ে দিতেন। কাবের সাধারণ সম্পাদক রেজা ভাই আমাকে অ্যালজেব্রা শিখিয়ে সহযোগিতা করতেন। বড় দা, জামান সাহেব, কচি ভাই, জব্বর সাহেবদের কাছ থেকে আমি বড় ভাইয়ের আদর-যত্ম পেয়েছি। আমিও কাবের জন্য মন-প্রাণ উজাড় করে খেলার চেষ্টা করেছি। একাধারে হকি, ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিকসে তাদের হয়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে অংশ নিয়েছি। বিনা পারিশ্রমিকে খেলেছি বছরের পর বছর।   
আগেই বলেছি, আমাদের পাড়ায় বসবাস করতেন শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক আ ন ম বজলুর রশীদ। তিনি সে সময়েই খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত ছিলেন। আমাদের পাড়াটা তখন ঘন-বসতি ছিল না। বেশ খোলামেলা। চারপাশে ছিল সবুজের ছোঁয়া। গাছ-গাছালি ছাড়া তখন তো বাড়ি-ঘর চিন্তাই করা যেত না। আমাদের বাড়িটা ছিল কাঁচা-পাকা বাড়ি। বাড়ির আঙিনায় ছিল বরুই, পেয়ারা গাছ। আরমানিটোলা স্কুল ছিল আমাদের বাড়ির কাছেই। খুব বেশি হলে ১০০ গজের দূরত্ব। শিক্ষাবিদ আ ন ম বজলুর রশীদ আমাকে পড়ালেখার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেন। আসলে আমাদের বাড়ির ছোট্ট গলিটা পার হলেই আরমানিটোলা স্কুল, তারা মসজিদ ও মাহুতটুলি ফ্রি প্রাইমারি স্কুল। একই বৃত্তের মধ্যে অবস্থান। বেবি কাসে আমাকে ভর্তি করা হয় মাহুতটুিল ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই আমি ফুটবল, হকি, ক্রিকেট খেলায় জড়িয়ে পড়ি। মনে পড়ে, যখন প্রাইমারী স্কুলের টু-থ্রীতে পড়ি, ছুটির পর বাসায় এসে হকি স্টিক নিয়ে আরমানিটোলা স্কুলের মাঠে ক্রীড়া সরজ্ঞাম নিয়ে ছুট দিতাম। মাঠটি ছিল পূর্ব-পশ্চিম লম্বা। পশ্চিম পাশের গোলপোষ্টের পাশে বিরাট একটি হলুদ ফুলের গাছ ছিল- যা বছরের পর বছর মাথা উঁচু করে স্কুলের খেলাধুলার কীর্তিকে সুরভিত করতে থাকে। সেই গাছের নীচে ষ্টিক হাতে দাঁড়িয়ে থাকতাম, কখন আমার ডাক পড়ে।


(দুই)
সে সময় আমি তো আরমানিটোলা স্কুলের ছাত্র নই। সঙ্গত কারণে খেলার সুযোগ সব সময় পেতাম না, তদুপরি আমি ছোট বলে আমাকে নিতেও চাইতো না।
হকি স্টিক হাতে মাঠের বাইরে খেলার জন্য অপেক্ষা করা ছিল খুব কষ্টকর। সে বয়সে আরো বেশি বেশি খারাপ লাগতো। খেলতে না পারার জন্য দুঃখ হতো, সে কষ্টের কথা বলে বোঝানো যাবে না।
ওই বয়সে কি চুপ করে অপেক্ষা করা যায়Ñ নাকি এক জায়গায় স্থির থাকা যায়? তাই পিচঢালা কালো রাস্তায়, যা স্কুলের ফটক থেকে সোজা চলে গেছে স্কুল দালানের সিঁড়ি পর্যন্ত, ওই রাস্তায় একা একা ড্রিবলিং করতাম। এ ধার থেকে ও ধার, আবার ওই ধার থেকে ফটক পর্যন্ত। এভাবেই বল কন্ট্রোল শিখতাম। এরই মধ্যে আরও একজন এসে পড়লে দু’জনে মিলে হিটিং প্র্যাকটিস করতাম ওই পিচঢালা রাস্তায়। সজোরে করা হিটগুলো সমান রাস্তায় স্টপিং করতে খুব মজা লাগতো। আরো কেউ এসে পড়লে দু’জন কিংবা তিনজন করে ম্যাচ খেলতাম। রাস্তার দু’ধারে ইট দিয়ে ছোট ছোট দুটি গোলপোস্ট বানিয়ে খেলা শুরু হতো।
এ খেলায় দক্ষতার সাথে গ্যাপ সৃষ্টি করতে হয়, ফাঁকা জায়গায় স্থান নিতে হয়, যাতে সতীর্থ খেলোয়াড়কে পাস দিতে কোনো অসুবিধা না হয়। তাছাড়া বল আদান-প্রদান করতে যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং দু’জন খেলোয়াড়ের মধ্যে হওয়া প্রয়োজন, তার প্র্যাকটিসটাও এ খেলায় রপ্ত হয়ে যায়। পাকা রাস্তায় খেলাও বেশ দ্রুত হয়। অনেক বেশি দৌড়াতে হয়। ফলে স্ট্যামিনা বাড়ানোর কাজটাও সাথে সাথে হয়ে যায়। স্কুলের রাস্তায় এমনি আনন্দ ও উপভোগ্য খেলার মাধ্যমে হকি খেলার স্কিলগুলো ছোটবেলা থেকেই স্কুলের আশপাশের এলাকার খেলোয়াড়রা শিখে ফেলতাম। পরবর্তীতে এর সুফল আমরা পেয়েছি। আমার মনে একটা কৌতূহল প্রায়শই বুদ্বুদের মত ভেসে ওঠে, আরমানিটোলা স্কুলের রাস্তাটা তৈরি করার সময় নির্মাতারা কি জানতেন এই রাস্তায় প্র্যাকটিস করা এ স্কুলের নয়জন ছাত্র হকিতে একদিন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাবেন? রাষ্ট্রীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেনÑ মাহমুদুর রহমান মোমিন (১৯৭৭), খাজা ইউসুফ রেজা (১৯৭৯), আব্দুস সালাম (মরণোত্তর-১৯৮০), বশীর আহমেদ (১৯৮০), আব্দুস সাদেক (১৯৯৬), সাব্বির ইউসুফ (২০০০), প্রতাপ শংকর হাজরা (২০০১), হোসেন ইমাম চৌধুরী শান্টা (২০০১), আজিজ উল্লাহ হায়দার জামাল (২০০২) ও আব্দুল মালেক চুন্নু (২০০৪)।
স্কুলের এই রাস্তা শুধু যে হকি খেলায় অবদান রেখেছে, তা নয়। বরং কিছুটা সুযোগ করে দিয়েছে ক্রিকেটকেও। আমাদের অবসর সময়ের প্রিয় এবং আনন্দময় খেলা ছিল এটি। পশ্চিম দিকে রাস্তা ঘেঁষে সীমানা প্রাচীর। দেয়ালে স্ট্যাম্প এঁকে আর পিচঢালা রাস্তাটাকে পিচ বানিয়ে খেলতাম। হকি বা টেনিস বল আর হকি স্টিককে ক্রিকেট ব্যাট বানিয়ে, আবার কখনও কাঠ দিয়ে তৈরি ব্যাট দিয়ে ম্যাচ খেলতাম। ওই খেলাগুলো বেশ উপভোগ করতাম। এ খেলা নিয়ে একজনের সাথে প্রায়ই ঝগড়া হতো। তিনি হলেন মোঃ সাইফুল্লা। ১৯৫৫ সালের ব্যাচের। ‘আউট’ মেনে নিতে চাইতেন না। বিশেষ করে দেয়ালে যে স্ট্যাম্প আঁকা হতো, তার ভাষায় সে স্ট্যাম্পে বল লাগতেই পারে না। কখনও বল এক ইঞ্চি বাইরে কিংবা ওপরে লাগলে শুধুমাত্র কিন ক্যাচ হলে বাধ্য হয়ে মেনে নিত। হকি-ফুটবল খেলাতেও তার এরূপ ‘খাইস্টামি’র জ্বালায় অস্থির থাকতাম। একসময় কম্বাইন্ড স্পোর্টিং কাবে তিনি হকি খেলতেন। পরবর্তীকালে তিনি ইঞ্জিনিয়ার হন।  আরমানিটোলা স্কুলে খেলার জন্য অপেক্ষার পালা একদিন শেষ হয়। যেদিন এ স্কুলের কাস থ্রিতে ভর্তি ভর্তি হলাম, সেদিন আমি ছিলাম পৃথিবীর সৌভাগ্যবানদের একজন। আমাকে ভর্তির ব্যাপারে সাহায্য-সহযোগিতা করেন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ আ ন ম বজলুর রশীদ স্যার। তিনি ছিলেন এই স্কুলেরই শিক্ষক।
মাহুৎটুলী ফ্রি প্রাইমারি স্কুলেরও সে সময় নাম-ডাক ছিল। ভালো পড়ালেখা হতো। তারপরও সেখান থেকে চলে আসার সময় আমার একটুও কষ্ট হয়নি। কারণ, হাঁটতে শেখার পর থেকেই আরমানিটোলা স্কুলের সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শৈশবে মাঠে ছোটাছুটি, দৌড়াদৌড়ি আর একটু বড় হয়ে এ মাঠে খেলা নিয়ে পড়ে থাকা এবং বুঝতে শেখার পর স্কুলে পড়াশোনা করার ইচ্ছা এলাকার প্রায় সব ছেলের কাছেই ছিল একটা স্বপ্নের মতো। সঙ্গত কারণেই ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের স্মৃতি মনে সেভাবে রেখাপাত করেনি। লেখাপড়ায় বেশ কড়া হলেও খেলাধুলার স্কুলটিতে সে রকম চর্চা ছিল না। স্কুলের ভেতরে ছোট্ট মাঠ, মাঠ না বলে খোলা জায়গা বলাই শ্রেয়। মাঝখানে আবার একটা কবর ছিল। চারদিকে লোহার রড দিয়ে ঘেরা। টিফিনের সময় ছেলেরা গোল্লাছুট খেলতো। কবরের চারপাশে দৌড়াতো, যাতে ধরা না পড়ে। তবে দু’একটি ঘটনা আজো ভুলতে পারিনি।
‘আজান দে’- দ্বিনিয়াত স্যার আমাকে আদেশ করলেন। আমি সিট থেকে উঠে জানালার কাছে তারা মসজিদের দিকে মুখ করে আজান দিচ্ছি, হাইয়া আলাস সালাহ্ দু’বার উচ্চারণ করে। তারপর কি বলবো ভাবতে একটু সময় নিচ্ছিলাম, শপাং করে কোমরের নিচে বেতের বাড়িÑ সাথে সাথে মনে পড়ে গেল হাইয়া আলাল ফালাহ...।
প্রাইমারি স্কুলে তাহাবুদ্দিন নামে একজন স্যার ছিলেন। দেখতে একটু কালো, খুব রাগী, তাকে সবাই ‘সাবুন আলা’ স্যার বলতো। কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি, বাবুবাজার পুলের ওপর তার একটা সাবানের দোকান ছিলÑ সে জন্য তার নাম ‘সাবুন আলা’ স্যার! তার বেতের মার না খেয়ে ওই স্কুল থেকে বোধহয় কেউ বের হতে পারেনি। দ্বিতীয় শ্রেণীতে তিনি আমাদের অংক করাতেন। তার বেতের মার আমাকেও যে কতবার হজম করতে হয়েছে, তা আজ আর মনে নেই।
আরমানিটোলা স্কুলের খেলার মাঠের সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেই ছোটবেলা থেকেই। ফেলে আসা দিনগুলোর মধ্যে আরমানিটোলা স্কুলের সময়টাই হয়ে আছে জীবনের অবিস্মরণীয় স্মৃতি। আরমানিটোলা স্কুল আমার আবাল্য গৌরব। বাল্যকাল থেকে কৈশোর পর্যন্ত দীর্ঘ আটটি স্মরণীয় বছর স্কুলের শ্রেণীকক্ষে কাটলেও আমার খেলোয়াড়ী জীবনের বেশিরভাগ সময় এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় স্কুলের মাঠকে ঘিরে। অতীতের দিকে ফিরে তাকালে আরমানিটোলা স্কুল আমাকে নস্টালজিক করে তোলে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার জীবনের অনেক মূল্যবান স্মৃতি। এই স্কুলকে বাদ দিলে আমার জীবন কখনোই পরিপূর্ণ হবে না।
১৯০৪ সালে শিক্ষক-প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়ের এক্সপেরিমেন্টাল স্কুল হিসেবে ‘গভর্নমেন্ট প্র্যাকটিসিং হাইস্কুল আরমানিটোলা’ নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে এটিকে রূপান্তরিত করা হয় আরমানিটোলা গভর্নমেন্ট হাইস্কুল নামে। স্কুলের সামনেই মুসলিম স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের নিদর্শন ও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণকারী ঐতিহ্যবাহী তারা মসজিদ। এটি ঢাকার অন্যতম একটি আকর্ষণ।
লাল ইটে গাঁথা বিশাল আরমানিটোলা স্কুল ভবন, সবুজ ঘাসে ঢাকা সম্মুখে দুটি মাঠ। পেছনে আরও একটি ছোট মাঠ আর ছায়া-সুশীতল উঁচু দেবদারু গাছের সারিÑ সব মিলে বিদ্যালয়টির সুদৃশ্য ও মনোরম পরিবেশ সবাইকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে।
দ্বিতল ভবনের ওপর তলায় ছিল টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। টিচার্স ট্রেনিং কলেজ নামটি উচ্চারণ হলেই আমাদের কাসের খেলোয়াড় বন্ধুদের গায়ে যেন জ্বালা ধরে যেত। আমাদেরকে বিটি ফিল্ডে খেলতে দিত না। এর মূল কারণ হলো, কলেজের প্রিন্সিপালের ছেলে আমাদের কাসে পড়তো এবং ভাইস প্রিন্সিপালের ছেলে আমাদের এক কাস নিচে পড়তো। দু’পরিবারের ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনরা ওই মাঠে খেলাধুলা করতেন, যা আমরা পছন্দ করতাম না। প্রায়ই বল নিয়ে কিংবা যে কোনো খেলার ছুতা ধরে ওই মাঠে চলে যেতাম। তারা খুব রাগ করতেন। আর আমরা খুব মজা পেতাম। এক সময় স্কুলের ছেলেদের ওই মাঠে না যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা নোটিশ জারি করা হয়।
কুদ্দুস আমাদের কাসমেট। খুব ডানপিটে আর সাহসী ছেলে ছিলো। রমজানের সন্ধ্যা রাত। সবাই তারাবি পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কুদ্দুস, ডাব্লু, বুলবান, শফি আর আমি আড্ডা মারছি স্কুলের বারান্দায় বসে। কুদ্দুস আড্ডা থেকে উঠে গেল। সাথে সাথে ফিরে এল। মাথার ওপর উল্টো করা একটা চেয়ার। কোনো কথা না বলে সোজা গেটের দিকে হাঁটতে লাগলো। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে গেট পার হয়ে গেছে। পেছনে পেছনে আমরা ছুটলাম। শুনলাম, টিচার্স ট্রেনিং কলেজের কেরানি স্কুলের পেছনে একটি একতলা ঘরে থাকতেন। বড্ড খিটখিটে ছিলেন। তিনি আমাদের বিটি ফিল্ডে খেলতে বাধা দিতেন। আমাদের বিরুদ্ধে নালিশ করতেন। তার বসার চেয়ার সেটা। ওটি মাথায় করে ছোট কাট্রায় শফিকের বাসায় দিয়ে আসলো। এই ছিল টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সাথে আমাদের সম্পর্ক। শুনেছি, প্রিন্সিপাল সাহেবের ছেলে যে আমাদের কাস-মেট ছিল, পরবর্তীকালে সে ইউরোপের একটি দেশের রাষ্ট্রদূত এবং ভাইস প্রিন্সিপাল সাহেবের ছেলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আফ্রিকার কোনো একটি দেশে কর্মরত আছেন।


(তিন)
১৯৫৫ সালে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ধানমন্ডিতে নিজস্ব ভবনে চলে যায়। আমরা বন্ধুরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচি। তবে এক কলেজের পরিবর্তে আর এক কলেজ স্কুলের দোতলায় ঘাঁটি গাড়ে। সেটার নাম ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ। খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ত শুনে ভালোই লাগলো। কিন্তু গোল বাধালেন এর ভাইস প্রিন্সিপাল খান মজলিস স্যার। তারা তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। আমিও আমার অ্যাথলেটিক্স প্র্যাকটিস করি সব সময়ের মতো। সে সময় আমাদের দেশে ঘুরে ডিসকাস থ্রো করার প্রচলন সবে শুরু হয়েছে। সালটা আমার ঠিক মনে নেই। আমাদের দেশে অলিম্পিক স্বর্ণ বিজয়ী অ্যাথলেট বব ম্যাথিয়াস এসেছিলেন। তাকে দেখেছি ঘুরে থ্রো করতে আর দেখেছি মুক্তা ভাইকে। তা দেখে দেখেই শিখেছি এবং জাম্প, রানিং-এর সাথে থ্রোটাও করতে ভালো লাগতো।
শীতের এক সকালে অন্যান্য ইভেন্ট প্র্যাকটিস শেষে ডিসকাস থ্রো প্র্যাকটিস করছি। এমন সময় ফিজিক্যাল কলেজের কালো, সুঠামদেহী একজন শিক্ষার্থী আমার কাছে এগিয়ে এলেন এবং ডিসকাস থ্রো শেখার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। নিজেকে ওস্তাদ ভেবে ভাল লাগলো। প্রায়ই সকাল বেলা এসে থ্রোটা শিখে যেতেন। ভাইস প্রিন্সিপাল বিদেশ থেকে সদ্য ট্রেনিং নিয়ে ফিরেছেন। সাদা হাফ প্যান্ট, সাদা গেঞ্জি, সাদা হ্যাট। মুখে হুইসেল নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিক্যাল কাস প্রত্যক্ষ করতেন। আমি আমার মতো করে প্র্যাকটিস করতাম। একদিন ডিসকাস থ্রো করছি, সেই শিক্ষার্থী আমার কাছে এসে থ্রোটা দেখে শিখছেন। ভাইস প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছে দৃশ্যটা মনঃপুত হয়নি। তার আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে হয়তো! তিনি  কাছে এসে আমাকেই বকা দিলেন, কেন আমি ওই শিক্ষার্থীকে শেখাচ্ছি। আর কোনোদিন যেন শিক্ষার্থীদের সাথে প্র্যাকটিস না করিÑ ধমকের সুরে বলে গেলেন। আমার সামনে ওই শিক্ষার্থীকেও ওয়ার্নিং দিলেন যেন ভবিষ্যতে কলেজের টিচার ছাড়া অন্য কারো সাথে প্র্যাকটিস ট্রেনিং করা না হয়। ঐ শিক্ষার্থী হলেন এ টি এম মোস্তফা স্যার। যিনি পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল ডাইরেক্টর হয়েছিলেন। 
শুধু সৌন্দর্য আর বিশালত্বে নয়, বরং শিক্ষা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, খেলাধুলা, সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে আরমানিটোলা স্কুল ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। এ স্কুলের বহু ছাত্র দেশে- বিদেশে তাদের অবদান রেখেছেন। অর্জন করেছেন অনেক খ্যাতি। স্কুলের কৃতী ছাত্রদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করতে চাই। ১৯২২ সালে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন জনাব শফিকুল আমিন। ১৯৪৭ সালে ড্রইং টিচার হিসেবে টিচার্স ট্রেনিং কলেজে যোগদান করেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি ক্যালকাটা জিমখানা কাবের ফুটবল ক্যাপ্টেন ছিলেন। ‘স্বাস্থ্যই সব সুখের মূল’Ñ এ মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে ১৯৭৮ সাল থেকে ৫-৬ বছর টিভিতে ব্যায়াম  শেখাতেন। ২০০৪ সালে স্কুলের শতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে ৯৩ বছর বয়সেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন ১৯৩৭ ব্যাচের। কবি, গবেষক ও জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। মনযূর-উল-করীম ছিলেন ১৯৫২ ব্যাচের। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে রেকর্ড নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে তিনি স্কুলের জন্য দুর্লভ সম্মান বয়ে আনেন। স্কাউটের সাবেক জাতীয় কমিশনার, সচিব হিসেবে সরকারের বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন। তিনি বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। ড. মোহাম্মদ শাহজাহান ১৯৫৪ ব্যাচের। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর।
১৯৪১ ব্যাচে ছিলেন জাস্টিস ড. এফ কে এম এ মুনীম, ১৯৪৮ ব্যাচে মেজর জেনারেল (অব.) মোহাব্বত জান চৌধুরী, ১৯৪৯ ব্যাচে জেনারেল এম এ মুনীম, ব্যারিস্টার এ আর ইউসুফ, রাজনীতিবিদ জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল, নেভির ক্যাপ্টেন নূরুল হক, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ড. রফিকুল ইসলাম, ১৯৫০ ব্যাচের লে: কর্ণেল (অব:) মাহতাবউদ্দিন আহমেদ, পরবর্তীকালে প্রাণের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ১৯৫২ ব্যাচের এফ এ হামিদুর রশীদ পাসপোর্টের ডিজি হন, ১৯৫৪ ব্যাচে লে. জেনারেল (অব.) মীর শওকত আলী, মেজর জেনারেল মনজুর, প্রফেসর ড: নূরুদ্দিন আহমেদ ১৯৫৫ ব্যাচের। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। ১৯৫৫ ব্যাচে সরকারের সাবেক সচিব নুরুদ্দিন কামাল, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা দিলীপ বিশ্বাস, ১৯৫৭ ব্যাচে কবি আসাদ চৌধুরী, ১৯৫৮ ব্যাচে এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) সুলতান মাহমুদ, ১৯৫৭ ব্যাচের বাংলাদেশ সরকারের সচিব ও বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সভাপতি এনামুল হক, ১৯৪৮ ব্যাচের আগরতলা মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আসামি ছিলেন কর্নেল (অব.) ড: শামসুল আলম, ১৯৬৬ ব্যাচে সাবেক সাংসদ লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, ১৯৬৭ সালের ব্যাচে ছিলেন দৈনিক জনকন্ঠ সম্পাদক মোঃ আতিকুল্লাহ খান মাসুদ, রাজনীতিবিদ মোঃ বরকত উল্লাহ (বুলু)। এছাড়া ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অর্থ- পরিকল্পনামন্ত্রী ও বিশিষ্ট লেখক অশোক মিত্র, এক সময়ের বিশ্বভারতীয় উপাচার্য অম্লান দত্তসহ আরও অনেকে। যাদের নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী আতিকুল ইসলামের গলা ছিল খুব চমৎকার। তার গান আজও আমার কানে বাজে। খেলোয়াড়দের মধ্যে যাদের আমি দেখেছি, যাদের সান্নিধ্য পেয়েছি কিংবা যাদের খেলতে দেখেছি, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন খাজা ইউসুফ রেজা, নূরুল ইসলাম নান্না, বাহরাম, ফখরুল আলম, ইসমাইল আনোয়ার, রেজা আলী ভুলু, মাহমুদুর রহমান মোমিন, বাচ্চু, আলমগীর আদেল, আবদুস সালাম, নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন মুজিবুর রহমান সিজার।
টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষার্থীরা কাস নিতেন এবং কলেজের স্যাররা তাদের কাস নেয়া প্রত্যক্ষ করতেন। কলেজের শিক্ষার্থীরা থাকতেন স্কুলের পেছনে দোতলা দুটো হোস্টেল ভবনে। সাথে ছিল একটি মাঠ। আমরা যাকে বিটি ফিল্ড নামে জানতাম। উঁচু উঁচু দেবদারু গাছ ছিল দু’পাশে। সুন্দর পরিবেশ। শীতল আবহাওয়া। বিশেষ করে গরমের দিনে ফুটবল খেলতে ভালো লাগতো। ফুটবল মৌসুমে বিকাল তিনটায় প্রতাপ, আব্দুল হক ও আমি বিটি ফিল্ডে হাজির হতাম, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ সরিয়ে নেয়ার পর। বল কন্ট্রোল, কিকিং, রিসিভিং, রানিং উইথ দ্য বল অনুশীলনগুলো করতাম। পাঁচটার দিকে স্কুলের বড় মাঠে অন্যান্য খেলোয়াড়কে নিয়ে ম্যাচ খেলতাম। প্রতিদিনের প্র্যাকটিস ম্যাচ খুব জমজমাট এবং হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো। আমাদের খেলা দেখতে পাড়ার মানুষ ভিড় জমাতেন।
মাগরিবের আজানের সাথে খেলা শেষ। যে যার বাসায় চলে যায়। আমি মাঠে পড়ে থাকি ফুটবল মৌসুমে ফুটবল নিয়ে আর হকি মৌসুমে হকি। বল নিয়ে নয়তো বা মাঠে চক্করের পর চক্কর দিচ্ছি। ১০, ২০ কখনোবা ৩০ চক্কর। বল নিয়ে এক গোল লাইন থেকে অন্য গোল লাইন করতে করতে কখন যে ২০/৩০ বার আসা-যাওয়া হয়ে যেত টেরই পেতাম না। হকির সাথে বলকে আঠার –মতো লাগিয়ে নিয়ে মাঠের এধার থেকে অন্য ধারে ছুটে যাওয়া, কখনোবা ড্রিবল করতে করতে গিয়ে সজোরে টার্গেটে হিট করা। খেলার পর এটাই ছিল আমার নিত্যদিনের রুটিন। এই রুটিনমাফিক চলতে গিয়ে কখনো সন্ধ্যা ছাপিয়ে অন্ধকার হয়ে যেত মাঠেÑ আমার ফেকু মামা এসে কান ধরে টানতে টানতে বাসায় নিয়ে গিয়ে দু’এক ঘা বসিয়ে দিয়ে কিংবা পড়ার টেবিল দেখিয়ে বলতেন, পড়তে বস। আমার ওই একটাই মামা। বাসায় শুধু তাকেই ভয় পেতাম। আর কাউকে না। সেই মামা একদিন হঠাৎ করেই মারা যান। তখন তার বয়স ৩০/৩২ বছর হবে। রেখে যান দুই মেয়ে। একটি ছিল মাত্র কয়েক মাসের। মারা যাওয়ার সংবাদটা পাটুয়াটুলি চাচির বাসায় (শাহী স্পোর্টস-এর চাচার বাসা)  দিতে রওনা হই। স্কুলের সামনের গেট দিয়ে ঢুকে বিটি ফিল্ডের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হয়। তাছাড়া যাওয়ার সময় দেখেও গেলাম স্কুলের মাঠে কে কে খেলছে। একটু দাঁড়িয়েও যাই। ফুটবল খেলছিল বন্ধুরা। মনে হলো কে যেন ডাকছেÑ একটু খেলে যা, ব্যাস নেমে পড়লাম। কোন ফাঁকে যে সন্ধ্যা নেমে এলো টেরই পেলাম না। দৌড়ে বাসায় গেলাম। মা জিজ্ঞেস করলেন খবর দিয়েছিস? মাথা নেড়ে জবাব দিলাম, হ্যাঁ। মামা নেই, কেউ কিছু বলতে পারবে না। স্বাধীনভাবে যতক্ষণ ইচ্ছে খেলতে পারবো। এখন বুঝতে পারিÑ মামার শাসনটা যদি আরো বহুদিন আমার ওপর চলতো, হয়তো আমার জীবনটা আরো গোছালো, আরো সুন্দর হতো।
গড়ে ওঠার সময় থেকেই আরমানিটোল স্কুলে আধিপত্য ছিল ব্রিটিশদের। সম্ভবত চার ইংরেজ প্রিন্সিপাল কিংবা হেডমাস্টারের নামানুসারে স্কুলটিকে ৪টি হাউজে ভাগ করা হয়। কলিন্স হাউজ, ওয়েস্ট হাউজ, বিজ হাউজ এবং স্টার্ক হাউজ। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরপরই প্রত্যেক ছাত্রের ভাগ্যে এই চার হাউজের যে কোনো একটি হাউজ জুটে যায় এবং স্কুল শেষ করা পর্যন্ত তাকে সেই হাউজেই থাকতে হয়। আমি ছিলাম ওয়েস্ট হাউজে। স্কুলের সব খেলাধুলা, কম্পিটিশন হয় এই চারটি দলের মধ্যে। আমাদের সময় স্কুলের শোভা বর্ধনের জন্য চারটি বাগান করা হয়, এই চারটি হাউজের নামে। যে হাউজের বাগান সবচেয়ে বেশি সুন্দর ও আকর্ষণীয় হতো, তার জন্য দেয়া হয় প্রাইজ।
বাসার খুব কাছেই স্কুল ও স্কুলের মাঠ হওয়ায় পড়ালেখার চেয়ে খেলাধুলাটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। তখন খেলাধুলা ছিল সিজনাল। খেলাধুলার প্রতি এতোটাই নেশা ছিল যে, যখন যে খেলার সুযোগ পেতাম, তখন তাতেই মেতে উঠতাম। সারাক্ষণই মাঠে থাকতাম।
কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্কুলের মাঠে চলে যেতাম। মাঠ ছোট হওয়ায় চারপাশে দৌড়াতাম, এক, দুই, তিন, চার করে কোনদিন ২০, কোনদিন ৩০ চক্কর দিতাম। সে সময় ওয়ার্ম-আপ কিংবা স্ট্রেচিং- এগুলো সম্পর্কে সে রকম জ্ঞান আমাদের হয়নি। হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে কিছু ব্যায়াম করতাম। তারপর শুরু হয়ে যেত খেলা। বেশিরভাগ খেলা আয়োজিত হতো শীতকালে। অ্যাথলেটিক্স কম্পিটিশন কাছে থাকলে সেটারই প্র্যাকটিস করতাম। স্কুলের বড় মাঠের পশ্চিম দিকের সীমানা দেয়াল ঘেঁষে জাম্পিং পিট বানানো হতো। সেখানে আমরা হাইজাম্প, লংজাম্প, হপ-স্টেপ জাম্প অনুশীলন করতাম। আমার কাছে আকর্ষণীয় ইভেন্ট ছিল হাইজাম্প। খুব ভালো লাগতো। আকাশে ভেসে থাকার ছিল অন্যরকম আনন্দ। প্রথমদিকে আমরা ‘সিজার’ স্টাইলে জাম্প দিতাম অর্থাৎ দৌড়ে এসে জাম্প করে প্রথমে এক পা, তারপর দ্বিতীয় পাসহ পুরো শরীরটাকে ক্রসবারের ওপর দিয়ে পার হতে হতো। অনেকটা ক্রসবারের ওপর বসে পার হওয়ার মতো। নিজের শরীরের ভারি ওজন নিয়ে বেশি ওপরে ওঠা যায় না। এরপর আসে ‘বেইলী স্টাইল’। এ পদ্ধতিতে জাম্প করে পুরো শরীরটাকে সমান্তরালভাবে ক্রসবারের ওপর স্থাপন করতে হয়। ক্রসবারের ওপর অনেকটা উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ার মতো করে। তারপর ক্রসবার টপকানো। আমান, লেবুও (মরহুম ব্রিগেডিয়ার মহসিন) ভালো হাইজাম্প দিত। আমান আমার কাসফ্রেন্ড। থাকতো রহমতগঞ্জে। ওর ছোট ভাই সামাদ রেলওয়েতে ফুটবল খেলতো। তার ছোট আরেক ভাই জিন্নাহ, কমিশনার হিসেবে বেশ নামডাক ছিল। আমান যখন হাইজাম্প দিত, মনে হতো সে যেন শূন্যে ভাসছে। মনে হতো ওর শরীরটা কী হালকা! আমাদের তিনজনের মধ্যে খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো।


(চার)
আমাদের শৈশবে ঢাকা শহরের গন্ডি ছিল সীমিত।
রেললাইন ছিল শহরের সীমানা। লোকসংখ্যা ছিল কম। ঘোড়ার গাড়ি ছিল প্রধান বাহন। রিকশা তখন রাস্তায় গিজগিজ করতো না। মোমিন কোম্পানির বাস সবে রাস্তায় নেমেছে। আজিমপুরে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশেই ছিল মোমিন কোম্পানি এবং এর গ্যারেজ বা ওয়ার্কশপ। সবে শুরু হয়েছে নতুন ঢাকা গড়ে ওঠা। নতুন নতুন অফিস-আদালত হচ্ছে এবং এগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীর থাকার জন্য তৈরি হচ্ছে আজিমপুর কলোনি। ইউনিভার্সিটির হলগুলো সে সময় তৈরি হচ্ছিল। এসব এলাকায় ছোট ছোট অনেক মাঠ ছিল। সেসব মাঠে নাইন এ সাইড, সেভেন এ সাইড এবং হাইটের ফুটবল খেলা হতো। ৪ ফুট ৮ ইঞ্চি, ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি, ৫ ফুট হাইটের খেলা। আমরা ‘বাইলা’র সাথে আসতাম। মাহুতটুলী-আরমানিটোলা এরকম নাম দিয়ে এন্ট্রি করা হতো আর আমরা যারা ঐ হাইটের, তাদের নিয়ে দল গঠন করে অংশগ্রহণ করা হতো। কখনো কখনো আমাদের ভাড়ায় খাটাতো অর্থাৎ অন্য দলের হয়ে খেলাতো। হাইট অনুযায়ী ভাল খেলোয়াড় জোগাড় করা ছিল কঠিন ব্যাপার। মনে পড়ে, খেলোয়াড়দের হাইট মাপতে অনেক সময় খেলোয়াড়দেরকে কোমরে গামছা বেঁধে, দম আটকিয়ে (বন্ধ করে) ঘাড়টাকে যতদূর সম্ভব খাটো করে দাঁড় করানো হতো। হয়তো তারা হাইটের চেয়ে একটু লম্বা হবে, তাই এমন করা হতো। অনেক সময় শাড়ি কোমর এবং কাঁধের সাথে পেঁচিয়ে খাটো করার চেষ্টা করা হতো। যারা মাপতেন, তারাও কম যেতেন না। পেটে একটা গুঁতো দিতেন। যারা দম বন্ধ করে ঘাড় খাটো করে দাঁড়িয়ে আছে, তারা নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে তাদের স্বাভাবিক উচ্চতায় ফিরে যেত। খেলোয়াড়দের মাপ-ঝোঁকের সময় আয়োজক এবং দু’দলের কর্মকর্তাদের মধ্যে তর্কবিতর্ক, ঝগড়া, এখনকি মারামারি পর্যন্ত লেগে যেত। আমি কোনোদিন এরকম ঝামেলায় পড়িনি। এসব ব্যাপারে বাইলা ছিল মাস্টার। বাইলার আসল নাম শামসুদ্দিন। তারা মসজিদের মুয়াজ্জিন সাহেবের ছেলে। ছোটখাটো মানুষ। উচ্চতা ৫ ফুটের মতো। বয়স আমার দ্বিগুণ হবে। নান্না ভাই, আলমগীর আদেল ভাই, মোমিন ভাই, আমাদের ব্যাচ এবং আমাদের পরের ব্যাচ, তার পরের ব্যাচ- পর্যায়ক্রমে সবার সঙ্গে তার সখ্য ছিল। ফুটবল খেলতেন রাইট আউট পজিশনে। ছোট ছোট পায়ে ছোট ছোট স্টেপে তার দৌড়ানোটা আজও আমার চোখে ভাসে। ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম প্রবেশ আমার জীবনের একটি স্মরণীয় স্মৃতি আর সেটির রূপকার হলো বাইলা। টিনের ঘেরা স্টেডিয়াম। ভাঙ্গা টিন খুঁজতে খুঁজতে উত্তর-পূর্ব কোণÑ বর্তমানে শিল্প ব্যাংক যেদিকে, সেদিকে পাওয়া গেল। বাইলা টিন টেনে উঁচু করে ধরলে আমি হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলাম। কাঠের গ্যালারী। এটুকুই মনে আছে।
হাইটের খেলার একটি মজার ঘটনার কথা বলি। তখন আজিমপুর কলোনি নির্মাণের প্রস্তুতি চলছি। প্রচুর ফাঁকা জায়গায় মাঝে মাঝে ইটের স্তূপ। ফাঁকা জায়গাগুলোকে মাঠ বানিয়ে স্থানীয় ছেলেরা ফুটবল ও অন্যান্য খেলাধুলা করতো। এরকম একটি মাঠে ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি হাইটের ফুটবল টুর্নামেন্ট। ফাইনাল খেলা। মাঠের ধারে একটি টেবিলে সাদা চাদরের ওপর দুটি কাপ। একটি বড় ও একটি ছোট। ছোট ছোট অনেকগুলো মেডেল সাজানো। খেলায় আমরা জয়ী হলাম। এবার প্রাইজ নেয়ার পালা। হঠাৎ করে দেখা গেল একজন দাড়িওয়ালা লোক, পরনে লুঙ্গি। তিনি চিৎকার করে টেবিলের কাছে আসতেই দেখিÑ যারা এই টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছিলেন, তারা দে ছুট! সেই লুঙ্গিপরা লোকটি চাদরের ভেতর কাপ-মেডেলগুলো পোটলা করে নিয়ে টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে জোরে জোরে আয়োজকদের গালাগাল দিতে থাকেন। আয়োজকদের একজন তার ছেলে। সে বাসা থেকে টাকা চুরি করে এ টুর্নামেন্টের জন্য কাপ-মেডেল কিনেছিল। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দটা মাটি হয়ে গেল। মন খারাপ করে হাঁটতে হাঁটতে চকবাজার এসে লাচ্ছি খেয়ে যে যার বাসায় চলে গেলাম।
হাইটের খেলা আজিমপুর এবং ইউনিভার্সিটি এলাকায় বহু খেলেছি। আজিমপুর এতিমখানায়ও খেলা হতো, সেখানেও খেলেছি।
এফএইচ হলের ছোট মাঠে ছোটদের ফুটবল ম্যাচ। মাঠটি হলো বঙ্গবাজার থেকে কার্জন হলের দিকে যেতে হাতের বাম দিকে এফএইচ হলের গেট, সেটা দিয়ে ভেতরে ঢুকলে হাতের বাম দিকের মাঠ। খেলার আগে দু’চারটা বল মেরে গোলরক্ষককে ওয়ার্মআপ করানো আর নিজের কিক করাটাকে ঝালাই করে নেয়া, আমি মেরেছিলাম আর গোলরক্ষক শফিক। আমারই সহপাঠী। বুক বরাবর আসা বলটাকে দু’হাত দিয়ে ঠেকিয়েছিল। বলটা তার পায়ের কাছেই ছিল। শফিক উপুড় হয়ে তুলতে গিয়ে অনুভব করে যে, সে বল তুলতে হাতে কোন শক্তি পাচ্ছে না। ঐ অবস্থাতেই সে চিৎকার করে ডাকলো, ‘বশীর তাড়াতাড়ি আস, দেখতো, বলটা আমি তুলতে পারছি না।’ দৌড়ে গিয়ে তার ডান হাতটা ধরে বুঝতে পারলামÑ সেখানে কোন হাড় নেই, ভেঙ্গে দু’টুকরো হয়ে গেছে। মাঝখানে ফাঁকা শুধু চামড়া। ওর হাতটা চেপে ধরে রিকশা নিয়ে ছুটলাম মেডিক্যাল হাসপাতালে। হাতটা প্লাস্টার করতে হলো। সেদিনের খেলা আর হলো না। শফিক আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে চিরদিনের জন্য। কিন্তু ওর ভাঙ্গা ঝুলানো হাতটার কথা মনে হলে নিজেকে আজও অপরাধী মনে হয়।
আরমানিটোলা স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বেশ জমজমাট হতো। স্কুলে সাজ সাজ রব পড়ে যেত। স্কুল চত্বরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হতো। দক্ষিণদিকের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে লম্বা প্যান্ডেল করা হতো। স্কুলের ব্যান্ড দলের বাজনার তালে তালে  মাঠের মাঝখানে শামসুদ্দিন স্যার (হেডমাস্টার) জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতেন। অ্যানাউন্সমেন্ট টেন্ট থেকে অ্যানাউন্সম্যান্টের ফাঁকে ফাঁকে মাইকে গান পুরো এলাকাকে জানিয়ে দিত আজ আরমানিটোলা স্কুলের একটি বিশেষ দিন। ২৩-১-১৯৫৫ তারিখও আমার জন্য একটি বিশেষ দিন ছিল। হাইজাম্প, লংজাম্পে প্রথম এবং ৮৮০ গজ দৌড়ে দ্বিতীয় হয়ে ইন্টারমিডিয়েট গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম সেদিন। প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়ায় সেদিন ছিল আমার প্রথম সাফল্য। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। হকি-ফুটবল খেলার পাশাপাশি আমি অ্যাথলেটিক্সও করতে পারবোÑ এ আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল সেদিন থেকে।
স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রতি ছোটবেলা থেকেই আমার খুব আগ্রহ ছিল। ভর্তির পরপর যাদের অ্যাথলেটিক্স করতে দেখেছি, তাদের কথা খুব সামান্য মনে পড়ে। ১৯৫০ ব্যাচের আলমগীর আদেল দৌড়াতেন এবং জাম্পও দিতেন। পরবর্তীতে তিনি হকি ও ফুটবলের কৃতী খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯৫৩ ব্যাচের মীর শওকত আলী ভালো হাইজাম্প দিতেন। পরবর্তীতে তিনি আজাদ স্পোর্টিং কাবে ফুটবল খেলেন। লে. জেনারেল মীর শওকত আলী বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯৫৩ ব্যাচের সদরউদ্দিন সিদ্দিকী গ্যাদা ১০০ গজ দৌড়ে প্রথম হতেন। তিনি আজাদ স্পোর্টিং কাবের ফুটবল খেলোয়াড়। তার বাবা এ এ সিদ্দিকী আজাদ স্পোর্টিং কাবের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫৪ ব্যাচের আকবর আলী, আমীর আলী দু’ভাই-ই ভালো অ্যাথলেট ছিলেন। লংজাম্প দিতে গিয়ে আকবর আলীর ডান হাতের কনুই ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে এই দু’ভাইয়ের সাথে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবে হকি খেলি। ১৯৫৬ সালের সিরাজুল ইসলাম এবং ১৯৫৭ ব্যাচের ইনামুল হক ভালো অ্যাথলেট ছিলেন। ইনামুল হক পরবর্তী বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের  সভাপতি হয়েছিলেন।
সে সময় আরও দুটো রোমাঞ্চকর ইভেন্টের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। একটি  হলো ঘোড়া চালানো, অন্যটি হলো নৌকা চালানো। অ্যাথলেটিক্স-এর ভাষায় একটি হলো ইকইস্টিং, অন্যটি হলো রোয়িং। এর শুরুটা বেশ মনে পড়ে। আমান আমার সহপাঠী। শান্ত প্রকৃতির। এক সাথে হাইজাম্প প্র্যাকটিস করতাম। সে আমাকে দোস্ত বলতো। দোস্ত মানে বন্ধু কিন্তু ‘ত’ উচ্চারণ করতো না। একদিন বললো, দোস, ঘোড়া চালাইবা। সাথে সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠলো মাত্র কিছুদিন আগে দেখা ‘আন’ ছবিতে দিলীপ কুমার ঘোড়া ছুটিয়ে রাজকুমারীকে ছোঁ মেরে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। মনে মনে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি। আমি কোনদিন ঘোড়া ধরেও দেখিনি। ভাল-মন্দ কোন কিছু ভাববার আগেই বলে দিলাম যাব। এক ছুটির দিনে গিয়ে উঠলাম আমানের রহমতগঞ্জের বাসায়। অজানা এক আশঙ্কায় দুরু দুরু বুকে আমানের সাথে চললাম। যেন দেশ জয় করতে যাচ্ছি!
বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে গিয়ে পৌঁছালাম। ঢাকা শহরে পানি সরবরাহ করার লক্ষ্যে নদীর প্রায় মাঝখানে পাম্প বসানো হয়েছে। চান্নিঘাট ওয়াটার সাপ্লাই নামে সবাই চেনে। পাইপের উপর মাটি ফেলে পাম্প পর্যন্ত রাস্তা হয়েছে- যা নদীর পাড় থেকে কিছু উঁচু। এলাকার আস্তাবলের ঘোড়াগুলো নদীর ধারে মনের আনন্দে চরে বেড়াতো। কাছে গিয়ে একটি ঘোড়ার গলায় হাত বুলালো আমান। ছোট ঘোড়া, খুব উঁচু নয়। ঘোড়ার গলা ধরে একটা জাম্প দিল। বেইলি স্টাইলে যেভাবে হাইজাম্প দেয়, ঠিক সেরকম। হঠাৎ দেখি, আমান ঘোড়ার পিঠে আর ঘোড়া ছুটছে পাম্পের রাস্তা দিয়ে। কিছুদূর গিয়েই ফিরে এলো। আরেকটা ঘোড়া দেখিয়ে আমান বললো, দোস, ওটাতে চড়ো। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে গেছে। আমান বলছে- মারো মারো, একটা হাইজাম্প মারো। কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। তা দেখে ঘোড়ার পিঠ থেকে নিজেই নেমে আসলো। নাহ্, তুমি মিয়া বড়ই ডররু। তাহলে চলো যাই, নাও লইয়া হেপার থেইকা ঘুইরা আহি। আমি তো সব চাঞ্চল্যকর খেলায় রাজি। ওর কথায় রাজি হয়ে গেলাম। ঘাটেই বাঁধা ছোট ডিঙ্গি নৌকা। ধোপারা নদীর ঘাটে কাপড় ধোয়, তাদের।
ধোপারা কাপড় কাচতে ব্যস্ত। আর এই ফাঁকে আমান চুপি চুপি নৌকার বাঁধন খুলতে থাকে। নৌকা বাঁধা থাকতো কোনো বাঁশের খুঁটিতে কিংবা বড় কোন ইটের সাথে। আমি কোনদিন নৌকা বাইনি (চালাইনি)। কী করে বাইতে হয়, তাও জানি না। ভাগ্য ভালো যে, মিডফোর্ড ঘাটে পাড়ার ছেলেদের সাথে এসে এসে সাঁতার শিখেছিলাম। তাই নৌকা ডুবলেও আমার ডোবার সম্ভাবনা কম বলে সাহস করে নৌকায় চড়ি। আমান বলে দিচ্ছে, এবার বাম দিক দিয়া বৈঠা মার, এবার ডান দিক দিয়া...। কিছুক্ষণ কসরত করতেই চরে গিয়ে পৌঁছালাম।
এটাই হলো কামরাঙ্গীরচর। তখনও কামরাঙ্গীরচর এত পরিচিতি পায়নি। এটাকে নিয়ে মারামারি-কাটাকাটি শুরু হয়নি। শুধুই গাছগাছালিতে ভরা একটা চর মাত্র। আর বেশি কিছু মনে নেই। কিছু ওল বড়ই পেড়ে আবার নৌকায় এসে বসলাম। একই রকম কসরত করে এপারে নদীর ঘাটে ফিরে এলাম। তবে ধোপাদের থেকে একটু দূরে, যাতে ধরা পড়ে মার না খেতে হয়। ছুটির দিনগুলোতে রহমতগঞ্জ যাই। অল্প অল্প করে ঘোড়া চালনা শিখে ফেলেছি। দু’জনে মিলে নদীর পারে এদিক-সেদিক ঘোড়া নিয়ে ছোটাছুটি করি। নদীতে গোসল করি। আমানের বাসায় এসে দুপুরের ভাত খাই। আবার চলে আসি নিজের আস্তানা আরমানিটোলা স্কুলের মাঠে।
১৯৫৬ সালটি আমার খেলোয়াড়ী জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি সাল। ক্রিকেটের সাথে সাথে হকি-ফুটবল খেলার সূত্রপাত ঘটে এবছর থেকে। ১৯৫৪ ব্যাচের সালাম ভাই পরবর্তীতে যিনি হকি খেলায় অবদানের জন্য (মরণোত্তর) রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ছিলেন ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের ক্রিকেট, হকি, ফুটবল খেলোয়াড়। তিনি আমাদের ক্রিকেট খেলতে উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ দিতেন। তাদের বংশালে দোতলা বাসার উপরতলায় একটি বড় ঘরে তিনি থাকতেন। ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতো খেলাধুলার সরঞ্জাম- যার বেশিরভাগই থাকতো ক্রিকেটের। তিনি ক্রিকেটের ভক্ত ছিলেন এবং একজন স্টাইলিস ব্যাটসম্যান ছিলেন। ফ্যানের রডের সাথে দড়িতে একটা বল বাঁধা অবস্থায় ঝোলানো থাকতো। তার বাসায় আড্ডা মারার সাথে সাথে চলতো টকটক করে ঝোলানো বলের সাহায্যে ব্যাটিং প্র্যাকটিস। তার একটা সাইকেল ছিল। সকালবেলা আমাদের ঘুম থেকে তুলে মাঠে যাওয়ার তাগিদ দিতেন। স্কুলের মাঠ, নতুবা পল্টন ময়দানে (আউটার স্টেডিয়াম) জড়ো হতাম। দু’চারটা চক্কর, কিছুটা ব্যাম, কিছুক্ষণ বোলিং-ব্যাটিংÑ এই ছিল আমাদের অনুশীলন। অনুশীলন শেষে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসতাম বাসায়। প্রায়দিনই সালাম ভাই ধার্য করে দিতেন একজনকে, যে সকালে নাস্তা খাওয়াবে। সালাম ভাইয়ের বাসার ঠিক উল্টোদিকে সালাম পালওয়ানের হোটেল (আজও সে হোটেল ওখানেই আছে)। নান রুটি-পায়া কিংবা পরোটা-বুন্দিয়া আর এক কাপ চা- এই ছিল নাস্তা। এমনি করেই একদিন সালাম ভাইয়ের পেছনে পেছনে এসে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবে ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলাম। ক্রিকেট দিয়েই শুরু হলো ক্রীড়াঙ্গনে আমার পথচলা।


(পাঁচ)
১৯৬৩-৬৪ সাল পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের হয়ে ক্রিকেট খেলেছি। একটি লীগ ডিসাইডিং ক্রিকেট ম্যাচের কথা আজও মনে পড়ে। তারিখটা ছিল ৩ মার্চ ১৯৬৩।
ঢাকা স্টেডিয়ামে ওয়ারী-ভিক্টোরিয়া মুখোমুখি। ওয়ারী কাবে তখন দেশের নামকরা সব ক্রিকেটার খেলেন। তাদের মধ্যে সুকুমার, মঈনু, বকুল, জাভেদ মাসুদ, ইব্রাহিমের কথা মনে আছে। সালাম ভাইয়ের নেতৃত্বে রফিক, মন্টু, মেহদি, হাসনাত, নূর মোহাম্মদ। প্রখ্যাত সাংবাদিক দৈনিক প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ভিক্টোরিয়ার ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন। সে ম্যাচে তিনি খেলেছেন কিনা মনে নেই। রফিক পরবর্তীতে হার্টের ডাক্তার, মন্টু পরবর্তীতে ক্রিকেট কোচ (সদ্য প্রয়াত) প্রথমে ওয়ারী কাব ব্যাটিং করতে নেমে তাদের দুই ওপেনার এরফান ও হেলালকে মাত্র ৪ রানে হারায়। ওয়ারী কাব সে ম্যাচে জাভেদ সুকুমারের দৃঢ়তাপূর্ণ ব্যাটিং-এর উপর ভর করে ১১৬ করতে সক্ষম হয়েছিল। রফিক ৩৬ রানে ওয়ারীর ৫ উইকেট এবং মন্টু ২৭ রানে ৩ উইকেট নিয়েছিল। ভিক্টোরিয়া ব্যাটিং করতে নেমে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এর মূল কারণ ছিল দৌলতের বিধ্বংসী বোলিং। সে ২৫ রানে ৫ উইকেট নেয় আর বকুল ২৩ রানে ৪ উইকেট। ভিক্টোরিয়া মাত্র ৫৩ রানে অলআউট হয়।
তিনটি চারসহ আমি ১৭ রান করে রানআউট হয়ে যাই, যে আউটটির জন্য আজও নিজের অজ্ঞতার জন্য নিজেকে দোষারোপ করি । সেটি ছিল এই রকম, দৌলত বল করছে, আমি ব্যাটিং। একটি বল বাউন্স করে বুক বরাবর এলে ফুটবল যেমন বুক দিয়ে রিসিভ করে থাকি, তেমনি দম বন্ধ করে বুক দিয়ে বলটা ঠেকালাম। পরের বল পুশ করে রান নিতে যাব, বলটা বোলারের হাতে বিধায় আমি ব্যাটটা ক্রিজে প্লেস করেছি কিন্তু শরীরটা তখনও লাইনের বাইরে।  দৌলত আমার দিকে বলটা থ্রো করলে আমি শূন্যে লাফ দিয়েছি। বল সোজা গিয়ে উইকেট ভেঙ্গে দিল আর অমনি আম্পায়ার আঙ্গুলটা উপরে উঠিয়ে দিলেন। আমি আউট। আমরা ৬৩ রানে পরাজিত। ১৯৬২ সালের প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগ চ্যাম্পিয়ন ওয়ারী কাব।
পরবর্তীতে পাড়ায় বন্ধু-বান্ধব মিলে ‘সিনথিয়া স্পোর্টিং কাব’ নামে নতুন কাব গঠন করে শুধু ক্রিকেট খেলতাম। সানু ভাই এর সেক্রেটারি। সানু ভাই পরবর্তীতে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবেরও জেনারেল সেক্রেটারি হয়েছিলেন।
বিবিসি (বকশিবাজার কাব) আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দল। মনে মনে একটা রেষারেষি  চলতো তাদের সাথে। প্রায় ছুটির দিনই হতো আমাদের সাথে ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক, ফুটবল ও ক্রিকেটের চৌকস খেলোয়াড় কামরুজ্জামান, মনজুর হাসান মিন্টু, আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলোয়াড় এবং রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ, মনি (মিন্টু ভাইয়ের ছোট ভাই), পি. ঘোষ বকশিবাজার দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম আর আমরা স্কুলের এবং এলাকার বন্ধুরা যাদের মধ্যে রয়েছে হাসান ইমাম, বুলবান, মীর আজাদ সবার কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। পি. ঘোষ ছিল ফাস্ট বোলার। মনে আছে তিনি অনেক লম্বা রানআপ নিয়ে বল করতেন। তার দৌড়ে এলাকার ছেলেপেলেরা চিৎকার দিত। যতদূর মনে পড়ে, হ্যান্ড্রিও সেদলে খেলতেন। তার স্টেন্স (ব্যাট করার জন্য দাঁড়ানো) ছিল অদ্ভুত ধরনেরÑ সে ভঙ্গি দেখে সবাই হাসতো। একবার আমাদের স্কুল মাঠে তাদের সাথে ম্যাচ। পি. ঘোষকে বেধড়ক পিটিয়েছিলাম। একাই করেছিলাম ৯৬ রান। কামরুজ্জামান সপ্তাহ দুই আগেও আমার সে ব্যাটিং-এর প্রশংসা করে বলেন, ‘তোর লেখায় সে ব্যাটিং-এর কথাটাও লিখিস, আমি সাক্ষী দেব, এত সুন্দর ব্যাটিং করতি তুই।’
লালবাগ কেল্লা মাঠেও আমরা অনেক ক্রিকেট ম্যাচ খেলেছি। এইতো সেদিন, ১৯৭৬ সালে সোনালী ব্যাংকে নিজের সিটে বসে কাজ করছি, দেখি মীর মনোয়ার আলী (হকি খেলোয়াড় ও হকি আম্পায়ার), তার মামা এনু এসে একপ্রকার জোর করেই ক্রিকেট খেলার জন্য আউটার স্টেডিয়ামে নিয়ে এলো এবং কেডস এবং সাদা গেঞ্জি পরিয়ে মাঠে ব্যাট করার জন্য পাঠিয়ে দিল শান্তিনগরের বিপরীতে ইগলেটস-এর পক্ষে। শান্তিনগর কাবের ফারুক, প্রতাপের কথা মনে আছে। সেদিন ভালই ব্যাটিং করেছিল। সঠিক রানটার কথা মনে নেই, তবে পঞ্চাশের এদিক-সেদিক হবে। বাউন্ডারী লাইন থেকে প্রতাপ ক্যাচ ধরে আমাকে আউট করেছিল, সেটা স্পষ্ট মনে আছে। এর সাথেই বোধ হয় শুধু ক্রিকেট খেলা নয়, আমার এ্যাকটিভ খেলোয়াড়ী জীবনেরও সমাপ্তি ঘটে।
১৯৫৬ সালের এই দিনটি আমার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিন। বিশেষ করে হকি ক্যারিয়ারে। অভিষেক হয়েছিল হকি খেলার। তখন শীতকাল, ক্রিকেট-হকির সিজন। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবে ক্রিকেট খেলি, সেদিন সামার ক্রিকেটের খেলা ছিল। পরবর্তীতে ‘দামাল সামার’ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট নামে পরিচিত হয়েছিল। রমনা গ্রীনে খেলা অর্থাৎ রমনা পার্কের ভেতর একটা মাঠ ছিল, সেখানেই খেলা হতো। সকাল ৯টায় আরম্ভ, বিকাল ৩টায় শেষ। সালাম ভাইয়ের নেতৃত্বে সেদিন খেলা শেষ করে হাঁটতে হাঁটতে পল্টন ময়দানে আসলাম। উদ্দেশ্য হকি খেলা দেখা। লীগ আরম্ভ হয়েছে আগেই। ফিরোজ বুলবান, আর আমি সালাম ভাইয়ের সাথে সম্ভবত ওয়ারী টেন্টে দাঁড়িয়ে খেলা আরম্ভের অপেক্ষা করছি। পল্টন বিশাল চত্বর। যেখানে প্রায় ৪টি মাঠ। গুলিস্তানের কাছে দেয়াল ঘেঁষে যে মাঠ, সেটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। বাকি ৩টি মাঠ উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। যতটুকু মনে পড়ে, মাঠগুলোর মাঝেই ওয়ারী এবং ওয়ান্ডারার্স-এর কাঠের পেভেলিয়ন ছিল। মাঠের চেয়ে একটু উঁচুতে। হকি লীগে সেদিনের খেলা ব্রাদার্স এবং ইপিআর-এর। এরই মধ্যে ব্রাদার্স কাবের হকি অধিনায়ক বিধু (পরবর্তীতে দাঁতের ডাক্তার), সালাম ভাইয়ের কাছে ছুটে এলো। বললো, আমাদের কয়েকজন খেলোয়াড় আসেনি, টিম নামানো যাচ্ছে না। দু’একজন খেলোয়াড় যদি থাকে দিন। দলটা মাঠে নামাই।
ফিরোজ হকি-ফুটবল-ক্রিকেট সবই খেলতো। খুব বেশি নাম করতে পারেনি, তবে চাপাতি হিসেবে সে পরিচিতি লাভ করে। তার আসল নাম খুব বেশি লোক জানে না কিন্তু চাপাতি বললে প্রায় অনেকে চেনে। আমার চার কাস উপরে লেঃ জেনারেল মীর শওকত আলীর কাসমেট ও বন্ধু। একবার যশোর ক্যান্টনমেন্টে দেখা করতে গেলে গেট থেকে বাসায় ফোন করে অনুমতি চাইলো গেটের নিরাপত্তারক্ষী। ফিরোজ সাহেব এসেছেন, কিন্তু বাসায় কেউ চিনতে পারছে না। তখন ফিরোজ টেলিফোন নিয়ে বলছে, ‘আবে, আমি চাপাতি বলছি।’ ওধার থেকে জেনারেল সাহেবের স্ত্রী হেসেই খুন। ফিরোজ তারকা ফুটবল খেলোয়াড় সাব্বিরের আপন চাচা। বর্তমানে মারা গেছেন। ছোটখাটো সুন্দর মানুষটি সবারই বন্ধু ছিলেন। 
বুলবান হকি-ফুটবল ভাল খেললেও হকিতে বেশ নাম করে। ইস্ট পাকিস্তান হকি দলের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিল একসময়।
ফিরোজ, বুলবান, আমি তিনজনই হকি খেলি, তবে ঐ স্কুল মাঠ পর্যন্ত ।
একজন হকি খেলোয়াড়ের (বিধূ) ওরকম করুণ আবেদনে সাড়া না দিয়ে সালাম ভাই পারলো না। সাথে দাড়িয়ে থাকা আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, হকি খেলবে নাকি? প্রস্তাবটা শোনার সাথে সাথে মনটা নেচে উঠলো। আমরা তিনজনই হকি খেলি, তবে ঐ স্কুল মাঠ পর্যন্তই। জীবনের প্রথম হকি লীগ খেলবো খুশিতে আমরা আটখানা। যতদূর মনে পড়ে, মাঝের মাঠে অর্থাৎ বর্তমান হকি স্টেডিয়ামের পূর্বদিকের গ্যালারি এবং মাঠের মসজিদের উত্তর পাশে খালি জায়গা নিয়ে ছিল সে মাঠ। ব্রাদার্সের জার্সি পরে নেমে পড়লাম।  উত্তেজনা বুকে নিয়ে হকি লীগে জীবনের প্রথম খেলা আরম্ভ করলাম। আমরা সাত গোলে পরাজিত হলাম। ইপিআর-এর অবাঙ্গালী খেলোয়াড়রা আমাদের উদ্দেশে বলাবলি করছিল যে, ‘বাচ্চা লোগ আচ্ছা খেলতা হায়’। বিশেষ করে আমাকে বলে, ‘বাচ্চা তুম বহুৎ আচ্ছা খেলতে হো’। তাদের ঐ কথাগুলো আমাদের হকি খেলতে উৎসনাহ ও সাহস জুগিয়েছিল। দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম সেদিন।
ব্রাদার্স কাব বর্তমানে যেখানে আছে, সম্ভবত তখনও সেখানে ছিল। ঠিক মনে নেই, তবে খেলা শেষে দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডারে এসে পরাটা-ভাজি আর মিষ্টি খাওয়ার কথা ঠিক মনে আছে। বর্তমানে দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডার যেখানে, সেটা বোধহয় সেখানে ছিল না। ব্রাদার্স কাবের উল্টোদিকে যে গলিটা দক্ষিণ দিকে গেছে, গলিটার মাথায় কোণায় একতলা একটা ঘরে ছিল। ম্যাচ শেষে আট আনা রিকশা ভাড়া পেতাম, যা জীবনের প্রথম রোজগার। মাহুতটুলী থেকে তিনজন রিকশায় চার আনা দিয়ে গুলিস্তান আসতাম। মাঝেমধ্যে পাকিস্তান মাঠ-আগামাসী লেন হয়ে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের উপর দিয়ে গুলিস্তান হয়ে মাঠে হেঁটেই চলে আসতাম। এতে আমাদের বেশ কিছু পয়সা বাঁচতো, সে পয়সা দিয়ে আমরা সিনেমা দেখতাম। দিনেমা দেখার নেশা ছিল। বাড়ির কাছেই ছিল নিউ পিকচার হাউস, পরবর্তীতে শাবিস্তান, তাজমহল, লায়ন, প্যারাডাইস সিনেমা হলে বেশিরভাগ চলতো ইংরেজি  ছবি। মারামারির ছবি দেখার আকর্ষণটা ছিল বেশি আর টারজানের ছবি হলে তো কথাই নেইÑ সেটা দেখা চাই-ই চাই।
মাসুদুর রহমান ভাই (এককালের কৃতী ফুটবল রেফারি) ব্রাদার্সের হকির দায়িত্বে ছিলেন। তিনিও হকির গোলকিপার পজিশনে  খেলতেন। শুনেছি তিনি মোহামেডানের খেলোয়াড় ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি হকি কোচও ছিলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, ব্রাদার্স কাবের যে হকি দল ছিলÑ তা ঐ কাবের কেউ জানে না; এমন কি মরহুম মানিক ভাই, খোকা ভাই এবং অন্যান্য কর্মকর্তারাও বলতে পারেন না যে, কোন কালে ব্রাদার্সের হকি দল ছিল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ছানা ভাই (ব্রাদার্সের সে সময়ের একজন কর্মকর্তা) নিশ্চিত করলেন যে, সত্যিই একসময় ব্রাদার্সের হকি দল ছিল। আমার হকি ক্যারিয়ার ব্রাদার্স কাবের মাধ্যমে এবং সাত গোল খাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হলো। ব্রাদার্সের পক্ষে তাদের বাকি কয়েকটা ম্যাচ খেলে সেবার হকি মৌসুম শেষ করেছিলাম।


(ছয়)
আরমানিটোলা স্কুল এবং মাহুৎটুলী কাব হকির ঐতিহ্য বহন করে আসছে বহুযুগ ধরে। এটা ক্রীড়াঙ্গনে সর্বজনস্বীকৃত। তাই বলে ফুটবলের উন্মাদনা দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে কখনও পিছিয়ে থাকেনি আমাদের এলাকা। মাহুৎটুলী কাব সেই দেশ বিভাগের (১৯৪৭ সাল) সময় থেকে মহল্লাবাসীর এবং আশপাশে বিরাট এলাকার ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে আসন করে নিয়েছিল তাদের প্রাণবন্ত ফুটবল খেলার মাধ্যমে। যার প্রমাণ পাওয়া যেত যেদিন লীগে মাহুৎটুলীর খেলা থাকতো। পাড়া-মহল্লার ঘোড়াগাড়ি আর রিকশার কাফেলা ছুটতো পল্টন মাঠের দিকে। তাদের ফুটবলের প্রতি আকর্ষণটা স্কুল মাঠেও আমরা পেতাম যখন আমরা যে কোন টুর্নামেন্ট খেলতাম। হোক না সেটা স্কুলের অভ্যন্তরীণ ‘ইন্টার হাউজ’ কম্পিটিশন কিংবা প্র্যাকটিস ম্যাচ, স্কুল মাঠ ঘিরে এলাকার মানুষজন ভিড় করবেই। পাড়ার মুরুব্বীরাও মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা উপভোগ করতেন।
ছোটবেলায় বি. টিমের মাঠে ছোটদের সাথে খেলতাম। সুযোগ না পেলে বড় মাঠের গোলপোস্টের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট হলুদ ফুলের গাছের শিকড়ে বসে বসে বড়দের খেলা দেখতাম। বড়দের মধ্যে নান্না ভাই, বাহরাম ভাই, ইসমাই ভাই, আলমগীর ভাইÑ এঁদের খেলা খুব অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে। নান্না দা খুব রাগী খেলোয়াড় ছিলেন, খেলায় ভুল-ত্রুটি সহজভাবে নিতেন না, বকাবকি করতেন। স্কুল মাঠে প্র্যাকটিসের সময় ছোটরা সব সময় আতঙ্কে থাকতোÑ এই বুঝি কানমলা খেতে হবে, এই বুঝি খেতে হবে একটা ধমক! তবে নান্না দা’র খেলার পড়ন্ত বেলায় তার সাথে খেলার সুযোগ হয়েছিল আমার। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে (ঢাকায়) চাকরি করার সুবাদে ব্যাংক টিমের হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে আমরা একসাথে খেলেছি।
পরের ব্যাচে খেলোয়াড়রা আমরা বড় হলেও তাদের সাথে খেলার সুযোগ পেতাম। বড় মাঠে খেলার একটা আত্মতৃপ্তি পাওয়া যেত, নিজেকে বড় বড় মনে হতো। সালাম ভাই, মোমিন ভাই, আনোয়ার ভাই, গেদা, আলতামাস, বাদল, আকবর আলী, আমির আলী, দেলোয়ার, আজাদÑ এসব বড়দের সাথে আমার কাসমেট হাসান ইমাম, বুলবানও যোগ দিত। আনোয়ার ভাইয়ের পাওয়ারফুল শটগুলো আজও কানে বাজে। ছোটখাটো গড়ন, সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলতেন। তার মারা শটগুলোর গুমগুম আওয়াজ মনে হতো এক একটা কামানের গোলা! পরবর্তীতে তিনি আজাদ স্পোর্টিং কাবে খেলেছেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচও হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি মৃত। সালাম ভাই, লম্বা মোটাসোটা শরীর নিয়ে খুব পরিশ্রম করে খেলতেন। ফুল ব্যাক ছিল তার পজিশন। তিনি হকি, ফুটবল, ক্রিকেট সব খেলাই খেলতেন। পরবর্তীতে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবে খেলেছেন। তিনটি খেলাতেই ছিল তার মুরুব্বিয়ানার ছাপ। খেলাধুলাকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন, হয়তো এ জন্যই তার মৃত্যুটা হয়েছে খেলার মাঠে। সরকার তাকে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দিয়েছে হকি খেলায় অবদান রাখার জন্য। বাদল ভাইরা তিন ভাইÑ বাঘা ভাই, হিমু ভাই আর বাদল ভাই। স্কুলের কাছেই তারা মসজিদের সাথে তাদের বাসা। বাদল ভাইয়ের স্টাইলিস খেলা আমাকে আকর্ষণ করতো। একজনের লম্বা লম্বা শট মারার কথা মনে পড়ে। তিনি হলেন আলতামাস। বেশ লম্বা শরীর। খেলতেন  ফুল ব্যাকে। নিজ গোলপোস্ট থেকে মারা বল প্রায়ই সীমানা পেরিয়ে মসজিদে চলে যেত। এর জন্য মুসল্লিরা মাঝেমধ্যে রাগও করতেন। তার এমন লাগামহীন বল মারার জন্য পাড়ার দর্শকরা ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত বলে চিৎকার করতো। আলতামাস পরবর্তী সময়ে নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। বর্তমানে তিনি মৃত। মোমিন ভাই ফুটবল খেলতেন হাফব্যাক পজিশনে। কখনও রাইট হাফ, কখনও সেন্টার হাফ। হকিতেও তিনি হাফেই খেলতেন এবং দুটোই সমানভাবে ভাল খেলতেন। খুব হার্ডি প্লেয়ার ছিলেন। পরবর্তীতে আমরা ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবে এক সাথে খেলেছি। একবার কোলকাতা থেকে ইস্টবেঙ্গল কাব ঢাকায় এসেছিল। মোমিন ভাই এবং আমি ওই কাবের বিরুদ্ধে খেলেছিলাম। মোমিন ভাই আমাকে জীবনের প্রথম ক্ষ্যাপ খেলার জন্য শুভাড্যা নিয়ে যান। তখন আমি স্কুলের সেভেন বা এইটের ছাত্র। সালাম ভাই, আকবর আলী আর কে কে ছিল মনে নেই। সবাই স্কুল মাঠে জমা হয়ে একসাথে বিটি ফিল্ড পার হয়ে আরমানিটোলা মাঠের পাশ দিয়ে বাবুবাজার পুলের উপর দিয়ে বাদামতলী ঘাটে পৌঁছলাম; তারপর নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই চলে এলাম সদরঘাট। এখান থেকে নৌকায় উঠে চললাম। কিছুক্ষণ পর নদীর ওপারে গিয়ে নামলাম। বলতে পারবো না কোন ঘাটে। নেমে কিছুদূর হাঁটলাম। তারপরই শুভাড্যা মাঠ। খেলার কথা কিছুই মনে পড়ছে না। জীবনের প্রথম ক্ষ্যাপের দুটো জিনিস স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রথমটি সদরঘাটে ফিরে একটি হোটেলে পরাটা আর ভুনা গোস্ত খাওয়া আর সন্ধ্যায় অনেক দেরিতে বাসায় ফিরে মামার হাতের দু’ঘা খাওয়া!  জীবনের প্রথম ঢাকার বাইরে খেলতে যাওয়াÑ সেটাও মোমিন ভাইয়ের বদৌলতে। স্থানটি হলো গজারিয়া। আশরাফ ভাইয়ের (মোহামেডান কাবের কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড) আত্মীয় বাড়ি। পাশের গ্রামের  সাথে তাদের খেলা। মান-সম্মানের ব্যাপার। স্টিমারে গিয়েছিলাম। গজারিয়া ঘাটে যারা আমাদের আনতে গিয়েছিলেন, মনে হলো তারা আমাদের দেখে খুশী হতে পারেননি। আমাদের মধ্যে নামকরা সেরকম খেলোয়াড় ছিল না। তাছাড়া আমরা প্রায় সবাই স্কুল-কলেজের ছাত্র। মোমিন ভাইয়ের সাথে সালাম ভাই, আকবর আলী, জোশ মোহাম্মদ (বংশালের) এবং জাম্বুর কথা মনে আছে। অন্যদের কথা মনে নেই। আমাদের প্রতিপক্ষ দলে ঢাকেশ্বরী কটন মিল দলের খেলোয়াড়রা। কালিপদ, গদাধর রথিন, প্রকাশদের মত লীগের প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়রা। আমাদেরকে যারা নিয়ে গেছেন, তাদের হতাশার ভাবটা তাদের ব্যবহার ও আপ্যায়নেও প্রকাশ পেল। খেলার সময় হলো। মাঠে প্রচুর দর্শক। খেলা আরম্ভ হলো। খেলার কথা সেরকম মনে পড়ছে না; তবে জাম্বু একটা গোল করেছিল আর একটি পেনাল্টিতে মোমিন ভাই গোল করলে শেষ পর্যন্ত আমরা ২-০ গোলে জয়ী হলাম। রাতারাতি পরিবেশটাই বদলে গেল, আনন্দ-পূর্তিতে সবাই মেতে উঠলো। নৈশভোজেও এর প্রভাব পড়লো। বড় বড় মুরগী-জবাই হলো, পোলাও রান্না হলো, মিষ্টি-দই খাওয়ার ধুম পড়ে গেল।
জাম্বুর একটা কথা লিখতে গিয়ে হাসি আর চেপে রাখতে পারছি না। প্রাণবন্ত একটি খেলোয়াড় জাম্বু। আমার সাথে তার কোন পরিচয় ছিল না। থাকবেই বা কেমন করে? আমি তো মাত্র সেভেন/এইটের ছাত্র। বাইরে কোথাও খেলতে যাইনি। জাম্বুকে অনেক বড় মনে হতো। খেলায় জেতার পর সে দুষ্টুমি করে আমাকে বলেছিল, ‘রাতে ঘুমালে তোমাকে নেংটু করে দেব’। ভয়ে মোমিন ভাইকে এ কথাটা বললে সবাই হেসে খুন। আমার ভয় আর কাটে না। রাতে দেয়াল ঘেঁষে এক কোণায় ঘুমালাম। ল্যাংগোট পরে ওপরে খেলার হাফ প্যান্ট, তার ওপর লুঙ্গি পরে ঘুমিয়েছিলাম। ল্যাংগোট পরে খেলতাম। সেদিনে সাপোর্টার বের হয়নি। হলেও আমি জানতাম না। পরবর্তী সময়ে জাম্বু ও আমি ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবে খেলেছি। পাশাপাশি বেডে ঘুমিয়েছি। একসাথে হকি খেলেছি। বর্তমানে জাম্বু বেঁচে নেই। জীবনের প্রথম ঢাকার বাইরে খেলতে যাওয়া, প্রথম স্টিমারে চড়া, বাসার বাইরে প্রথম রাত কাটানোÑ সব মিলিয়ে আমার ভাল লেগেছিল, বেশ উপভোগও করেছিলাম। সুন্দর একটি ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে সেটা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
স্কুল ফুটবল মাঠের আরো একজনের কাহিনী বলার জন্য মনের ভেতর থেকে তাগিদ আসছে, সে হলো গনেশ। আমার উপরের কাসে পড়তো। পরে আমার কাসমেট, কাস ফ্রেন্ড। সাহসী ও প্রাণবন্ত ছেলে। সে আমাদের চেয়ে লম্বা ছিল, লম্বা লম্বা স্টেপে দৌড়াতো, খেলতো রাইট আউট পজিশনে। বল পাওয়ার পর দিত ছুট। কখন যে মাঠের সীমানা শেষ হয়ে যেত টেরই পেত না। প্রায় সময়ই দেখা যেত যে, সে বল ধরে সেন্টার বা মাঠের ভেতর বল পাস দেয়ার পরিবর্তে দৌড়ে গোল লাইন অতিক্রম করে দেয়ালের কাছে পৌঁছে গেছে। এলাকার লোকজন যারা প্রায় প্রতিদিন আমাদের প্র্যাকটিস ম্যাচ দেখার জন্য জমায়েত হতো, তারা গনেশ বল ধরে দৌড়াতে গেলেই চিৎকার শুরু করে দিতÑ আবে, ব্রেক মার আর দৌড় মারিস না, সেন্টার মার, লব মার... আরে হালা এইবার বি দাগ শেষ কইরা ফেলাইলি। কথাগুলো আজও মনে পড়লে সেদিনের খেলা, খেলার সাথীদের খুব বেশি মনে পড়ে যায়। আমরা যেবার ম্যাট্রিক দেই, সে বছরই সে কোলকাতা চলে যায়।
আমাদেরই এক কাসমেট সাঈদ, কোলকাতা গিয়েছিল ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের কোন এক ফাইনাল খেলা দেখার জন্য। এরই এক ছুটির দিনে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। ছবিটির নাম ‘মেরে বিবি কি শাদী’। কোন টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না। টিকিট না পেয়ে টিকিট পাওয়ার আশায় এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিল। এমন সময় খাকি হাফ প্যান্ট, মাথায় খাকি টুপি, মুখে হুইসেল, এক ট্রাফিক পুলিশ এসে সাঈদকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি খন্দকার না!’ সাঈদ তার অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলছে, বিশ্বাস কর বশীর, মনে হলো বহুদিনের হারিয়ে যাওয়া এক আত্মীয়কে যেন আমি খুঁজে পেয়েছি। গনেশই টিকিটের ব্যবস্থা করে দিল। সিনেমা শেষে সাঈদকে নিজ বাসায় নিয়ে গিয়েছিল, পোলাও-মাংস রান্না করে খাইয়েছিল।
মৌলভীবাজারের জমিদার বাড়ি থেকে দু’জন জমিদার পুত্র স্কুল মাঠে ফুটবল খেলতে আসতো। বড় ভাই নেপু, ছোট ভাই দাবির। বড় ভাই ছোটখাট, সুন্দর। ছোটজন বড়সড়, মোটা। মাঠে আসার সময় পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরা তাদের পেছনে পেছনে দল বেঁধে মাঠে ঢুকতো। জমিদারের ছেলেদের জন্য নয়। জমিদারের ছেলেদের পেছনে যে দেহরক্ষী আসতো, তার জন্য এত কৌতূহল, এত ভিড় করা। খাকি ঢোলা হাফ প্যান্ট পরা, মাথায় নেপালী টুপি, কোমরে ইয়া বড় এক ভোজালী ঝোলানো আর বাচ্চাদের যে আকর্ষণে পেছনে পেছনে ছুটে আসা, তা হলোÑ নেপালী দারোয়ানের মস্ত বড় মোচজোড়া।
নেপু আমাদের সাথে খেলতো, দাবির বি. টিমের সাথে খেলতো, নইলে স্কুলের সিঁড়িতে বসে অন্যদের নিয়ে আড্ডা দিত। নেপু যেমন দেখতে সুন্দর ছিল, তার খেলাতেও আভিজাত্যের ছাপ পড়তো। পরিচ্ছন্ন খেলা খেলতো সে।
নেপু একদিন আমাকে পল্টন মাঠে লীগে খেলার জন্য বললো। আমার আনন্দ আর ধরে না। কবে রাত শেষ হবে, কবে আসবে আগামীকালের বিকাল! উত্তেজনায় রাত-সকাল-দুপুর কাটিয়ে বিকালে হাজির হলাম পল্টন ময়দানে। সম্ভবত সেটি ওয়ান্ডারার্স কাবের টেন্ট। নেপু আমাকে অপেক্ষা করতে বললো। অপেক্ষা করছি তো করছি। খেলার সময় হলো, টিকাটুলী টিম আমারই সামনে দিয়ে মাঠে যাচ্ছে। নেপুও সে দলে আছে। আমাকে বললো আগামী খেলায় চান্স দেয়া হবে।
রাগে-দুঃখে-অপমানে টেন্টেই দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় ফ্রান্সিস আমাকে বললো, তুমি আগামীকাল এখানে আসবে। আমাদের সাথে আমাদের টিমে খেলবে। ফ্রান্সিস সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের ফুটবল খেলোয়াড়। দুঃখটা কিছুটা কমলেও সেরকম আস্থা পেলাম না। পরদিন ঠিক সময়ই ঐ টেন্টে আসলাম। টিমটি হলো ঢাকা স্পোর্টিং। ফ্রান্সিস কাব কর্মকর্তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। খেলার সময় হলো। জার্সি দেয়া হলো। আমাকে ব্যাকে খেলতে বলা হলো। বল নিয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি, ড্রিবলিং আর গোলে মেরে এসেছি এতদিন, হঠাৎ করেই ব্যাকে খেলা! কি আর করা। তখনও তো খেলাটা সেরকম রপ্ত করিনি আর পজিশনমত খেলা নিয়েও অতটা জ্ঞান হয়নি। নেমে পড়লাম। পল্টন মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে গুলিস্তানের দিকের মাঠ। যতদূর মনে পড়ে, মাঠটি ছিল পূর্ব-পশ্চিম দিক করা। বর্তমান হকি স্টেডিয়ামের দক্ষিণ দিকের গ্যালারি যেখানে, সেখানে ছিল সেই মাঠ। খেলা শুরু হলো। যতদূর মনে পড়ে, ফুল ব্যাকের কাজ যেটা, লম্বা লম্বা কিক করা, সেটা ভালোভাবেই পালন করছিলাম। তবে আমি বল ধরলে কিংবা কিক করলেই ইপিআর ইপিআর বলে দর্শকরা চিৎকার করতো। সে সময় আমার মাথার চুলটা খুব ছোট করে কাটা ছিল, ‘আর্মি ছাঁট’। হয়তো সে কারণেই হবেÑ আমি বল মারলেই ইপিআর ইপিআর বলে চিৎকার করতো মানুষ। যাই হোক, পরবর্তী ম্যাচগুলো আমি ‘ইন’-এর পজিশনে খেলে কাবের সবার প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। স্কুলের মাঠে আমরা যারা খেলি, তাদের ড্রিবলিংটা এবং সুন্দর-সঠিক পাস দেয়াটা নিখুঁত হয়; কারণ হলো স্কুলের মাঠটি ছোট। ঢাকা স্পোর্টিং কাব ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের বি. টিম। গাফফার সাহেবরাই ঐ কাবের কর্মকর্তা বা মালিক। তারা আমার খেলা এবং আমাকে খুব পছন্দ করতেন। ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় বিভাগে ঢাকা স্পোর্টিং-এর মাধ্যমে আমার ফুটবল অঙ্গনে শুরু হলো পদচারণা।
নেপুর আসল নাম তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী। বলিয়াদী জমিদারের ছেলে। বর্তমানে রাজনীতিবিদ। দাবির সিদ্দিকী হলো বলিয়াদী জমিদারের ছোট ছেলে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ বডিবিল্ডিং ফেডারেশনের সভাপতি হয়েছিলেন। কম্বাইন্ড স্পোর্টিং কাবেরও তিনি সভাপতি ছিলেন। ঢাকা কাবেরও সভাপতি হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি মৃত।


(সাত)
সামার ভেকেশন, স্কুল বন্ধ। গ্রীষ্মের গরমে মানুষ যখন অতিষ্ঠ, তখন আমরা কারো বাসা থেকে পাটি এনে স্কুল বারান্দায় শুয়ে-বসে আড্ডা মারতাম। বন্ধুদের বাসা স্কুলের কাছাকাছি থাকায় আমরা এ সুযোগ পেতাম। কুদ্দুস আসতো স্কুলের পূর্ব পাশের গলি কেপি ঘোষ স্ট্রিট থেকে, ডাব্লু ও বুলবান আসতো মাহুতটুলীর শেষ মাথা আবুল হাসনাত রোড ও বংশাল রোডের আরম্ভ বলিয়াদী প্রিন্টিং প্রেস থেকেÑ যেখান থেকে ইনসাফ পত্রিকা বের হতো, মীর আসতো বেগমবাজার থেকে, শফিক থাকতো একটু দূরে ছোট কাটরায়, গনেশ থাকতো তার কাকা অবনীর মিষ্টির দোকানের উপর কাঠের দোতলায় (অবনী আমাদের স্কুলের টিফিন সরবরাহ করতেন) আর আমি তো স্কুল গেটের উল্টোদিকের গলি, পদ্মলোচন রায় লেন থেকে। বলা যেতে পারে, সে সময় আমাদের বন্ধুদের দ্বিতীয় ঠিকানা ছিল স্কুল মাঠ। মাঝে মাঝে আড্ডায় যোগ দিত বেচারাম দেউড়ীর বটগাছের কাছে থাকা আখতার হোসেন খান, আরমানিটোলা বটগাছের কাছে থাকা মহসীন উদ্দিন আহমেদ। এদের দু’জনের ডাকনামই লেবু। স্কুল মাঠের উত্তর দিকের বাসায় থাকতো আজাদ।  আমাদের তিন কাস উপরে পড়লেও আমাদের আড্ডার সঙ্গী ছিল। আর একজন মাঠ সংলগ্ন তাদের দোতলা বাসায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কর্মকান্ড দেখতো আর হুট করে এসে দু’একটা চাপা মেরে চলে যেতÑ সে হলো আসাদ চৌধুরী, আজকের কবি আসাদ চৌধুরী। আমার এক কাস উপরে পড়তো।
দুপুরের প্রচন্ড রৌদ্রের তাপে মাঠে নামা সম্ভব হতো না; আবার বেশিক্ষণ ধরে বসে বসে আড্ডা দেয়াও সম্ভব হতো না। তাই কোন কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠতাম। টেনিস বল আর হকিস্টিক দিয়ে ক্রিকেট খেলাই চলুক। কাস ফোরের বন্ধ দরজার এক পার্টকে উইকেট বানিয়ে খেলা হতো। এ খেলায় মূল বিষয় হলো ব্যাটিং এবং ক্যাচ ধরা। জোরে বল করা যাবে না, হিট করা যাবে না। শুধু পুশ এবং ব্লক করা। ব্যাটসম্যানের চতুর্দিকে  ঘিরে থাকা ফিল্ডারদের ফাঁকি দিয়ে আউট না হয়ে কতক্ষণ টিকে থাকা যায়Ñ সেটারই হয় প্রতিযোগিতা। বেশ উপভোগ করতাম তা।
কখনও প্রতিযোগিতা হতো টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলার। বারান্দার দু’ধারে কাস থ্রি এবং কাস ফোর। দু’কাসের বন্ধ দরজাকে গোলপোস্ট বানিয়ে আর হকি ডি’র মত দাগ এঁকে দিয়ে গোল করার সীমানা (এর ভেতর থেকে গোল করতে হবে) নির্ধারণ করে দু’জন কিংবা তিনজনের দলের মধ্যে হতো জমজমাট ফুটবল খেলা। কখনো আবার ফুটবল দিয়েও হতো এরকম খেলা।
মার্বেল খেলার জন্য পাকা স্কুল বারান্দায় ছোট গর্ত করাতো যেত না, তাই গর্তের বিকল্প চক দিয়ে কিংবা ভাঙ্গা ইটের টুকরার সাহায্যে গোল করে দাগ দেয়া হতো। যে ক’জন খেলবে, প্রত্যেকে এক বা দুটি মার্বেল জমা দেবে। একজন নির্দিষ্ট স্থান থেকে গোলাকার দাগ লক্ষ্য করে মার্বেলগুলো চালবে (মাটিতে গড়ায়ে)। গোলদাগের ভেতর যে ক’টা মার্বেল ঢুকবে, সবগুলো তার। যে মার্বেলগুলো বাইরে, সেগুলোর ভেতর যে কোন একটি মার্বেলকে মারার জন্য বলা হয়। শর্ত হলো, নির্দিষ্ট মার্বেলকে টাচ্ করার আগে কিংবা টাচ্ করার পর অন্য কোন মার্বেলে লাগতে পারবে না। হাতের যে মার্বেল দিয়ে নিশানা করা হয়, সেটাকে ডা¹ি বলে। নির্দিষ্ট মার্বেলে লাগাতে না পারলে অন্যজন চাল  দেবে। একই খেলা মাটিতেও ছোট্ট গর্ত করে খেলতাম। স্কুল বিল্ডিং-এর ছায়ায় অল্প জায়গায় খেলা যেত। এ খেলাটাই হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে নিজের মার্বেল দ্বারা নির্দিষ্ট মার্বেলকে মারার মাধ্যমে জেতা-হারা সাব্যস্ত হতো।
মাঝেমধ্যে সাত চাড়া খেলেও দুপুরটা কাটিয়ে দিয়েছি বন্ধের দিনে।
আড্ডার মাঝে কেউ বলে উঠলো, আজকে ভীষণ গরম, চল যাই নদীতে গা ভিজিয়ে ঠান্ডা হয়ে আসি। ব্যস, যেই কথা সেই কাজ। হাঁটা শুরু। বিটি ফিল্ড পার হয়ে বামদিকে গেলেই চৌরাস্তা, আনন্দময়ী গার্লস স্কুল,গায়িকা উৎপলা সেনের বাবা রায় বাহাদুরের বাসা, আরমানিটোলা খেলার মাঠ, প্রতাপদের বাসা। চার রাস্তার চার কোণের বাসা। ডানদিকে প্রতাপদের বাসা পার হলে শামসুদ্দিন হেড স্যারের বাসা, একটু এগুলে হাতের ডানদিকে সাধনা ঔষধালয়ের বিরাট বিল্ডিং, তার সাথে লাগানো নিউ পিকচার হাউস (পরবর্তীতে শাবিস্তান সিনেমা হল, বর্তমানে সেটা মার্কেট)। সোজা কয়েক কদম এগিয়ে গেলেই আরমেনিয়ান চার্চ হাতের ডানদিকে পড়বে। ৩০/৪০ গজের ছোট গলি পার হলেই বাবুবাজার পুলের ঢালে বড় রাস্তায় (যে রাস্তা মিটফোর্ড, ইমামগঞ্জ ও চকবাজারে গিয়ে মিশেছে) উঠে ডান দিকে হাঁটতে শুরু করতাম। মাত্র কয়েক গজ গেলেই হাতের বামদিকে মিডফোর্ড হাসপাতাল ও মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজ। মাঝে একটি সরু রাস্তা (হাসপাতালের নিজস্ব রাস্তা) চলে গেছে দক্ষিণদিকে সোজা বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে। এটাই মিটফোর্ড ঘাট।
মিটফোর্ড ঘাট আমাদের প্রিয় ঘাট। খুব সুন্দর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘাট। পাকা সিঁড়ি। উঁচু রাস্তা থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি নিচে নেমে নদীতে গিয়ে মিশেছে। সিঁড়ির দু’পাশে বড় বড় ধাপের কয়েকটা সিঁড়ির বেষ্টনী দিয়ে সিঁড়িগুলোকে ভাঙ্গার হাত থেকে যেমন রক্ষা করা হয়েছে, তেমনি ঘাটের সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। নদীর পাড় থেকে ১৫/২০  ফুট উঁচু মিটফোর্ড হাসপাতালের পাকা সীমানা প্রাচীর নদীর পাড়কে নোংরা ময়লা-আবর্জনা থেকে রক্ষা করেছে। সীমানা প্রাচীরটি রাস্তা থেকেও এক-দেড় ফুট উঁচু এবং পাকা হওয়ায় মানুষজন ওটার উপর বসে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারতো; সাথে নদীর ঠান্ডা বাতাসে গা জুড়াতে পারতো। প্রতিদিন হাজারো মানুষ এ ঘাটে গোসল করতো, ছেলেপেলেরা পানিতে দাপাদাপি করতো। তারপরও  মনে হতো শান্ত ঘাট! গ্রাম-গঞ্জে জমিদার বাড়ির নিজস্ব পুকুর ঘাট যেমন হয়, তেমনি ছিল সে সময় মিটফোর্ড ঘাটের পরিবেশ।
এ ঘাটেই পাড়ার ছেলেদের সাথে এসে সাঁতার শিখেছিলাম। একদিন তো ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাই। নারায়ণগঞ্জ থেকে আমার খালাতো ভাই ওহাব ভাই এলেন। আমার চেয়ে ২/৩ বছরের বড় হলেও আমরা বন্ধুর মতো ছিলাম। সেদিন সেও আমাদের সাথে গিয়েছিল মিটফোর্ড ঘাটে। বর্ষাকাল, নদী ফুলে-ফেঁপে অনেক বড় হয়েছে। অনেকগুলো সিঁড়ি ছাপিয়ে পানি বড় ধাপের ১টির উপরে চলে এসেছে। ওহাব ভাইকে দেখাতে চেয়েছি যে, আমি সাঁতার শিখেছি। বড় ধাপের ডানদিকে যেই পানিতে নেমেছি, ঠাঁই পাচ্ছিলাম না, হাবুডুবু খেতে থাকি। এরকম অবস্থা দেখে ওহাব ভাই হাত ধরে তুলে ফেললো। এরই মধ্যে পানিও খেয়ে ফেলেছি। অল্প কিছুটা হলেও মৃত্যু যন্ত্রণার  স্বাদও পেয়ে যাই।
নদীর পানি কি পরিষ্কার টলটলে! সেদিনের বুড়িগঙ্গা নদীকে ঘিরে কতই না স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। লিখতে বসে সেগুলোকে মন্থন করার চেষ্টা করছি কিন্তু চোখের সামনে ভেসে উঠছে কয়েকটি নিষ্পাপ শিশুর করুণ মুখ। দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্যানার হাতে ‘বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাও’ লেখা নিয়ে। কয়েকদিন আগে বুড়িগঙ্গা ২য় সেতুর (যে সেতু আমার বাসার কাছে নয়াবাজার-বাবুবাজারের ওপর নির্মিত) ওপর মানববন্ধনের সংবাদ ও ছবি ছাপা হয়েছিল পত্রিকায়। মনে করিয়ে দিল এ বছরের ১ মার্চ বাংলাদেশ রোয়িং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আওয়াল মজনুর মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম জিনজিরায় এই সেতুর ওপর দিয়ে। গাড়ি যখন সেতুর ওপর, তখন নাকে প্রচন্ড ঝাঝালো একটি দুর্গন্ধ পেলাম। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করায় সে বললো, নদীর পানির গন্ধ। আমি আঁৎকে উঠলাম। কেমন করে হলো নদীর এমন দুর্দশা? কারা করলো নদীর এমন সর্বনাশ? মনে পড়ে গেল সেদিনের কথাÑ যেদিন এই নদীতে সাঁতার শিখতে গিয়ে হাবুডুবু খেয়ে অনেক পানি খেয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম, নদীতে বন্ধুদের সাথে মিলে দাপাদাপির কথা, নদীর এপার-ওপার সাঁতরানো। এটাই কি সেই আমাদের প্রিয় বুড়িগঙ্গা! তাহলে এখনকার ছেলেপেলেরা কি সে আনন্দ থেকে বঞ্চিত?
বেশ কিছুদিন আগে বেগমবাজারের ওপর দিয়ে হেঁটে চকবাজার  যাচ্ছিলাম। আমাদের আরমানিটোলা স্কুলের ’৭২ ব্যাচের ছাত্র আজিজুল্লাহ কমিশনারের কার্যালয় ও কমিউনিটি সেন্টারের কাছে যেতেই স্কুলেরই এক জুনিয়র ছাত্র আমাকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে সেন্টারের ভেতর নিয়ে গিয়ে বসালো। স্টেজে তখন বসা গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে প্রফেসর মোজাফফর আহমেদও আছেন। চোখে পড়লো ব্যানারে লেখা ‘বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাও’। হঠাৎ করে মাইকে আমার নাম শুনতে পেয়ে চমকে উঠলাম। আমাকে ‘বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাও’Ñ এ সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতে হবে। এ ব্যাপারে কোনদিন চিন্তা করিনি। যা হোক, নদীর সাথে ছোটবেলার কিছু স্মৃতি আর বিদেশে নদীকে দেখা কিছু কথা বলে হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। তখনও ভাবিনি নদীর এ করুণ অবস্থার কথা। আজকে যারা বুড়িগঙ্গা নদী বাঁচাও আন্দোলন করছেন, তাদের প্রতি জানাই আমার শ্রদ্ধা এবং পূর্ণ সমর্থন। এ আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারলে ভাগ্যবান বলে মনে করবো।
সেই ছোটবেলায় মিটফোর্ড ঘাটে গোসল করতে এসে দেখেছিলাম এক দম্পতিকে। সেই স্মৃতি এ মুহূর্তে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। স্মৃতির পুরুষটি হচ্ছেন আতাউর রহমান খান আর মহিলাটি হচ্ছেন তার বিদেশিনী স্ত্রী। আমার বন্ধু হাসান ইমামের কাছে তাদের সম্বন্ধে শুনেছিলাম বলে আগ্রহ হলো লেখার। হাসান ইমামের বড় ভাই আলী ইমাম, ভাল ফুটবল খেলতেন। একদিন উধাও হয়ে গেলেন। কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার বন্ধু আতাউর রহমানকেও কোথায়ও দেখা যাচ্ছে না। বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। হঠাৎ করেই খবর পাঠালেন আলী ইমাম যে, তিনি লন্ডনে আছেন। পরে ডাব্লু বলেছিল যে, তারা দু’বন্ধু জাহাজে চেপে লন্ডনে চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করছেন।
আতাউর রহমান খান তার বিদেশী স্ত্রীসহ ঢাকায় আসলেও আলী ইমাম সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে গেলেন। আর এদেশে আসেননি। এসবই হাসান ইমাম ডাব্লুর কাছে শোনা। আতাউর রহমান খান পরবর্তীতে আমাদের দেশের চিত্রজগত এবং মিউজিক গানের জগতে তারকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি খান আতা নামে সবার কাছে পরিচিত।
ঘাটে পৌঁছেই সবাই হৈহৈ করে নদীতে নেমে পড়তাম। গায়ের শুকনো কাপড়গুলো বড় ধাপওয়ালা সিঁড়িতে ফেলে রাখতাম। নিশ্চিন্ত থাকতাম যে, কাপড়গুলো চুরি হবে না। নদীতে নেমেই গনেশ সাঁতার দিয়ে বামদিকে বাদামতলী ঘাটে চলে যেত। বাতামতলী ঘাট সে সময় অত্যন্ত ব্যস্ত ঘাট ছিল। হাজার হাজার মানুষ এ ঘাট দিয়ে পারাপার হতো। জিনজিরা ঘাট আর বাদামতলী ঘাট দিয়ে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছেলেমেয়েদের একমাত্র যাতায়াতের সহজ পথ ছিল বুড়িগঙ্গা নদী। আহমেদ বাওয়ানী একাডেমি, আনন্দময়ী গার্লস স্কুল, আরমানিটোলা গভঃ হাইস্কুল, হাম্মাদিয়া হাইস্কুলের বহু ছাত্রছাত্রী এ পথেই আসা-যাওয়া করতো। পুরান ঢাকার বৃহৎ অংশের ময়লা পানি ড্রেনের মাধ্যমে এ ঘাটের পাশের বড় একটি বড় নালা দিয়ে এসে নদীতে মিশে যেতো- যা এখনো একইভাবে অব্যাহত আছে। সে ঘাটে বরিশাল-খুলনাগামী বড় বড় স্টিমার নোঙর করা থাকতো। সময়মত সেগুলো সদরঘাট টারমিনালে চলে যেত। গনেশ স্টিমারের ছাদে উঠে আমাদের দেখিয়ে উপর থেকে ডাইভ দিত। চিলের মত দু’খানা হাতের ডানা মেলে আকাশে ভেসে থাকা এবং ছোঁ মেরে নদীর গভীরে চলে যাওয়াÑ সে দৃশ্য আমার স্মৃতিতে জাগরুক হয়ে আছে। এশিয়ান গেমস, অলিম্পিক গেমসে ডাইভিং দেখেছি কিন্তু গনেশের ডাইভিং দেয়ার দৃশ্যটি মনে হলে আজও আমাকে রোমাঞ্চিত করে তোলে।
সবাই মিলে ঠিক করতাম সাঁতরে নদীর ওপার জিনজিরা যাওয়ার। ডাব্লু আর বুলবান সাঁতার জানে না। তারা নৌকায় যাবে। গনেশ, কুদ্দুস, শফিক ও আমি তো আছি। পাড়ার দু’তিনজন বন্ধুও জুটে যেত। তারা কলাগাছও সাথে নিয়ে যেত; কারণ সাঁতারে সেরকম ভাল না বলে কলাগাছে ভর করে নদী পাড়ি দেয়া। নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে, তবে শান্ত। নির্ধারিত দিনে মিটফোর্ড ঘাট দিয়ে শুরু করতাম জিনজিরা মিশন। আম-কাঁঠালের মৌসুম। নৌকা বোঝাই ফল নিয়ে জিনজিরা যেসব নৌকা যেত, আমরাও সেসব নৌকা ধরে সাঁতরাতাম। সুযোগ বুঝে কাঁঠাল, আম কিংবা কালো তরমুজ নৌকা থেকে তুলে নিতাম। ওপারে পৌঁছে সবাই মিলে মাঠে গোল হয়ে বসে মজা করে খেতাম। সেদিনের ঐ পরিবেশে সবাই একসাথে বসে খাওয়ার কথা মনে হলে আজও সেদিনের তৃপ্তিটা অনুভব করি। একইভাবে সাঁতার দিয়ে কিংবা সবাই মিলে নৌকায় চড়ে মিটফোর্ড ঘাটে ফিরে আসতাম।

(আট)
কোনোদিন আকাশটা যদি কালো মেঘে ছেয়ে যেতো, আমাদের চিন্তার শেষ থাকতো না। ছুটির দুপুরটা কি করে কাটবে! এরই মধ্যে ঝড় বইতে শুরু করলে বন্ধুদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠতোÑ ‘চল, আজকে আম-জাম কুড়াতে যাই।’ সবাই মিলে হৈহৈ করে দৌড় শুরু করে দিতাম। স্কুল গেট পার হয়ে বামে মোড় নিয়ে তারা মসজিদ, মাহুতটুলী ফ্রি প্রাইমারি স্কুল, বেচারাম দেওড়ী, নান্না (বাবুর্চি) মিয়ার বিরিয়ানীর দোকান, সামনে এগুলে আনসার রেস্টুরেন্ট (তিন আনায় পরাটা-গরুর গোস্ত দিয়ে নাস্তা খাওয়া যেত এ রেস্টুরেন্টে), তারপরই বেগমবাজার, জেলখানার মেইন গেট, জেলখানার উঁচু দেয়াল ঘেঁষে সামনে এগিয়ে যেতাম। ডানদিকে আনোয়ারা বেগম মুসলিম গার্লস স্কুল, আরও একটু এগিয়ে বাম মোড় নিলেই বকশিবাজার রাস্তা পার হয়ে ডানদিকে হোসেনী দালাল রেখে সোজা যেতে যেতে চৌরাস্তা। ডানদিকে ঘুরেই সামনে ইডেন কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ)। তারপরই রেললাইন। ঢাকার সীমানা শেষ। রেললাইন পার হয়ে সোজা এগুলেই বর্তমান বুয়েটের মাঠ এবং মেডিক্যাল কলেজের পেছনের গেটের মাঝ দিয়ে উত্তর দিকে যে রাস্তা শহীদ মিনারের দিকে গেছে, সে রাস্তার দু’ধারে বড় বড় আম-জাম গাছের সারি ছিল। সে রাস্তা বর্তমান জগন্নাথ হলের মাঠের পাশ দিয়ে ইউওটিসি, রোকেয়া হল, টিএসসি হয়ে রেসকোর্স ময়দানে মিশেছেÑ যার চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল আম-জাম গাছ। রেললাইন পার হয়েই চলতো আমাদের আম-জাম কুড়াবার প্রতিযোগিতা। শেষ হতো রেসকোর্স ময়দানে। কে কতগুলো ফল পকেটে পুরেছে, কার পকেট কত ফুলে বড় হয়ে উঠেছে তা নিয়ে আমরা কানাঘুষা করতাম। একসময় পকেটভর্তি আম-জাম নিয়ে ফিরতাম।
রেসকোর্স ময়দান থেকে বের হয়ে চৌরাস্তায় (বর্তমান দোয়েল চত্বর) এসে কার্জন হলের পশ্চিম পাশ দিয়ে জগিং করার ঢং-এ রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছাতাম। নাজিমুদ্দিন রোড রেলক্রসিং হাতের ডান দিকে তেকুইনা পুকুর আর বাম কোণে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য দ ায়মান একটি ছোট প্লেন। ইউনিভার্সিটির খেলার মাঠের আকার দক্ষিণ-পূর্ব সীমানা ছিল কোনাকুণি এবং এ কোণাতেই ছিল বেশ বড় একটি পুকুর। এ জন্য এলাকার লোকজন বলতো ‘তেকুইনা মাঠ’ এবং ‘তেকুইনা পুকুর’। বর্তমানে এফএইচ হলের পশ্চিম দিকের গেটের দক্ষিণ দিকে রাস্তার মোড়েই দাঁড়ানো এই যুদ্ধবিমানটিতে ছোটবেলায় কৌতূহল মেটাতে বন্ধুদের সাথে এসে চড়েছি, পাইলট সেজেছি, কল্পনার আকাশে উড়ে বেড়িয়েছি। পরবর্তীতে সেখানে এয়ারফোর্স রিক্রুটিং অফিস নির্মিত হয়েছিল এবং প্লেনটি ট্রেনিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হতো।
প্লেনের প্রতি আমাদের আগ্রহ না থাকায় আমরা দৌড়ের মধ্যে বাম মোড়ে ঘুড়ে যেতাম এবং কিছুদূর গেলেই জাদুঘর। ডানদিকে ঘুরলেই নিমতলী রেল ক্রসিং। রেললাইন পার হয়ে বাম দিক ঘেঁষে কয়েক গজ গেলেই দুটি পথ। ডান দিকে ঢুকে কায়েতটুল চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের বাড়ি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বাড়ি (তার ছোট ভাই মনসুর আমাদের সহপাঠী)। আমাদের আর এক কাসমেট বজলুর রহমানের বাড়ির পাশ দিয়ে সাতরওজা হয়ে বংশাল ফাঁড়ি। আবার কখনও বামদিকের আগামাসি লেনের পথে ঢুকে পড়তাম। সাবেক রাষ্ট্রপতি মোস্তাক আহমদের বাড়ির সামনে দিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে অতিপরিচিত মরহুম মনাদের বাসার গলি পার হলেই ধাঙ্গড় পট্টি অর্থাৎ সুইপার কলোনি (বর্তমানে কাঁচাবাজার এবং বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বিদ্যালয়)। সুইপার কলোনি আর পাকিস্তান মাঠের (বর্তমান বাংলাদেশ মাঠ) মাঝের রাস্তা দিয়ে নাজিমুদ্দিনের বাগিচার ভেতর দিয়ে বংশালের বড় রাস্তায় উঠতাম। নাজিমুদ্দিনের বাগিচায় অনেক ফলফলারির গাছ ছিল। বাগিচার মাঝখানে ছিল একটি পুকুর। এলাকার মানুষজন গরমের দিনে পুকুরে গোসল করে এবং গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিয়ে প্রাণটা জুড়িয়ে নিত। বর্তমানে নাজিমুদ্দিনের বাগিচার একটি গাছেরও দেখা পাওয়া যাবে না কিংবা ওখানে যে পুকুর ছিল, সে হদিসও কেউ দিতে পারবে না। শত শত ঘরবাড়ি-দোকানপাট দ্বারা পুরো বাগিচাটা ঘিঞ্জি এলাকায় পরিণত হয়েছে। মাজেদ সরদার কমিউনিটি সেন্টার এখানে তৈরি হয়েছে। বংশাল রোডে উঠে ডানদিকে চলে যেতাম। সামনেই বংশাল ফাঁড়ি। ফাঁড়ির পরই মাহুতটুলী এবং আমাদের পদ্মলোচন রায় লেনের গলি দিয়ে স্কুল মাঠে ফিরে আসতাম।
একটা কথা বলি, ‘পদ্মলোচন রায় লেন’ এত সুন্দর নামটা কিন্তু এলাকাবাসী ব্যবহার করতেন না। সবাই এ গলিকে ধুপীগলি (ধোপা গলি) বলতো। এ নামেই বেশি পরিচিত ছিল। ধোপারা কয়েকটি পরিবার বহুদিন ধরে এ গলিতে বসবাস করে আসছিল বলে তাদের নামেই এ গলি পরিচিতি পেয়েছিল। দীনেস ও যোগেশ নামে এ পরিবারের দুজন আমার সমবয়সী। ছোটবেলায় আমার সাথে খেলাধুলাও করতো। তারা এ এলাকা ছেড়ে চলে গেলেও পরবর্তীতে দীনেশের সাথে আমার অল্প যোগাযোগ ছিল। তার এক ছেলে ব্যাংকে চাকরি করে।
অনেক পথ দৌড়ে এসে স্কুলের সিঁড়িতে বসে হাঁপাতাম। এখানেও থাকতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কে ক’টা আম কুড়াতে পেরেছে। স্কুল গেটের পাশেই ছিল হাশেম ভাইয়ের আব্বার মুদি দোকান (হাশেম ভাই পরবর্তীতে এমপি হয়েছিলেন)। সেখান থেকে লবণ এনে মজা করে আম খেতাম। মাত্র কয়েকটা আমের সদ্ব্যবহার হতো। বাকি আমগুলো কাউকে  দিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু আম কুড়াবার যে আনন্দ, সেটা শুধু আমরা ক’জন বন্ধুই উপভোগ করতাম।
ঝমঝম বৃষ্টি আমাদের জন্য বয়ে আনতো অনাবিল আনন্দ। বর্ষণমুখর এমনি দিনে স্কুল বারান্দায় আমরা আড্ডা, গান আর চিনাবাদাম নিয়ে মশগুল থাকতাম। এই আনন্দঘন পরিবেশে শুধু আমরা কাসমেট বন্ধুরাই থাকতাম না, ওপরের কাসের বন্ধুরাও এসে জুটতো। আকবর আলী, আজাদ, দিলীপ, কমল, এমনকি বাদল ভাই হাজির হতেন। সবাই আমরা স্কুলের আশপাশে থাকতাম। ডাব্লুর সৌরজগত নিয়ে অদ্ভুত আর কাল্পনিক গল্প, মঙ্গল গ্রহের ‘সসার’ আমাদের আকাশে ঘুড়ে বেড়ানো এবং রাত জেগে সেগুলো দেখার তার গল্প মন না চাইলেও শুনতে হতো।
আকবর আলীর ‘পাগলা কবি কদু খায়, নাচতে নাচতে বাড়ি যায়’ ধরনের কবিতাগুচ্ছ আর ঢাকাইয়া মজার মজার চুটকি আড্ডাকে চাঙ্গা করে রাখতো। আজাদের চাপা সবার কাছেই ছিল পরিচিত। দিলীপ আমার ওপরের কাসে পড়লেও আমার সাথে তার তুই তুই সম্পর্ক ছিল। থাকতো বেগমবাজার, কবরস্থানের উল্টোদিকে বিরাট দোতলা বাসায়। দুষ্টুমী আর চটুল কথাবার্তায় আড্ডাকে জমিয়ে রাখতে দিলীপের অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। পরবর্তীতে চিত্রজগতের সাথে জড়িত হয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। হঠাৎ করেই একদিন টিভিতে তার সাক্ষাৎ দেখছিলাম। গুলিস্তান এলাকায় ফিল্ম আর্কাইভের বিল্ডিংয়ে আগুন লেগে সেখানে রক্ষিত অনেক ছবির প্রিন্ট পুড়ে যায়। যার মধ্যে দিলীপের সব ছবির প্রিন্ট ছিল। দুঃখে-কষ্টে সেদিন টিভি সাক্ষাৎকারে কেঁদে ফেলেছিল সে। স্কুলের প্রাণবন্ত সেই দিলীপ কোনদিন কাঁদবে ভাবিনি। ভেবেছিলাম এ কান্নাটা বুঝি তার রসিকতা। আমার সাথে তার শেষ দেখা হয়েছিল স্কুলের শতবর্ষ পূর্তিতে প্রাক্তন ছাত্রদের মিলনমেলায় (এলামনাই-২০০৪)। সে একা বসেছিল। কাছে গিয়ে পুরনো স্বভাবমতে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ঐ ব্যাটা, টিভিতে কাঁদছিলি কেন্?’ আমার কথা শুনে সে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, কোন কথা  বলেনি। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম আমার ওভাবে বলা উচিত হয়নি। নিজের কাছেই লজ্জা পেয়েছিলাম সে সময়। পরে একসময় তার সাথে দেখা করে স্যরি বলে ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক করে নেয়ারও চিন্তা করে রেখেছিলাম মনে মনে। কিন্তু দিলীপ সে সুযোগটা আমাকে আর দিল না। আমাদের ছেড়ে সে চলে গেছে অন্য এক জগতে।
আমাদের জমজমাট আড্ডার কথা লিখতে লিখতে শেষ করতো হলো একটি দুঃখজনক ঘটনার কথা লিখে। তাই মনটা ভারাক্রান্ত। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে আমার আর এক বন্ধুর কথা। ’৭১-এ তার মর্মান্তিক ঘটনার কথা। মনটা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। মন থেকে তাগিদ আসছে তার সম্বন্ধে লেখার। লেখার মাধ্যমে তাকে শ্রদ্ধা জানাবার। তার নাম আলমগীর। আমার কাসফ্রেন্ড। ক্যাপ্টেন আলমগীর, ক্যাপ্টেন শাহজাহানের ছেলে। আলমগীর পিআইএ’র ক্যাপ্টেন এবং তার বাবা (অবসরপ্রাপ্ত) আর্মির ক্যাপ্টেন। আমাদের গলিতেই তাদের দোতলা বাসা, নূরজাহান বিল্ডিং। বিরাট দুটি অ্যালসেসিয়ান কুকুর ছিল বাসায়। তার বড় দুই বোন শিপ্রা আর রেখা সন্ধ্যাবেলায় গান শিখতো। তারা মসজিদে মাগরেবের নামাজ আদায় করার জন্য মাহুতটুলীর মুসল্লিরা আমাদের গলি দিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে উদ্দেশ করে বকাবকি করতো। আলমগীর তার বাবাকে খুব ভয় পেত। যার জন্য সবার সাথে মিশতো না। মাত্র কয়েকজনের সাথে ওর সখ্য গড়ে ওঠে। আমি ছিলাম তাদের একজন। ওর বাসায় গিয়ে গল্প-গুজব করতাম। কিছুদিন পর তারা ঐ বাসা বিক্রি করে জিন্দাবাহার ২য় লেনে চলে যায়। বাড়িটি কিনলেন জাহাঙ্গীর আদেল আলমগীর আদেলের আব্বা শরফুদ্দিন সাহেব। বাড়ির নাম বদল হয়ে শরফুদ্দিন হাউস হলো। আলমগীর পরবর্তীতে পাইলট হয়েছিল। একবার খুলনায় ফুটবল ক্ষ্যাপ খেলতে যাওয়ার পথে যশোরগামী প্লেনে তার সাথে দেখা হয়েছিল। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী নির্ভীক এই পাইলট পূর্ব পাকিস্তান পাইলট এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিল। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সেটাই তার কাল হয়েছিল। অফিস থেকেই একদিন সে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। লোকমুখে শোনা যায় যে, ’৭১-এর মে মাসে বাঙ্গালী আরো ৩/৪ জন পাইলটকে বর্তমান পর্যটন অফিসে (ঐ সময় সেটা ছিল সিভিল এভিয়েশনের ব্যাচেলর কোয়ার্টার) নিয়ে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল হানাদার বাহিনী। আলমগীরের স্ত্রী নাদেরা আলমগীর (বর্তমানে বিমানে চাকরিরত) আজও অপেক্ষা করে আছেন, তার স্বামী হয়তো একদিন ফিরে আসবে।
আড্ডার বন্ধুদের যে যার মত করে বকে যাওয়া দেখে কেউ একজন ইউসুফকে উদ্দেশ করে বলে উঠতোÑ আবে, দিলীপ কুমারের নাতি, একটা গান গা। ইউসুফ তার দরাজ গলায় গাইতে শুরু করে দিত। ‘জিন্দা হু ইস তারাহ কে জিন্দাগী নাহি, জ্বালতা হুয়া জিরাগ হু মাগার রওশনি নাহি’। মুকেশের গাওয়া গান। ইউসুফ আমার কাসমেট। বুলবানের (হকি খেলোয়াড়) ছোট ভাই। দুই ভাই একই কাসে পড়তো। বুলবান যেমন খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, তেমনি ইউসুফ থাকতো গান-বাজনা আর সাজগোছ নিয়ে। সে খুব সৌখিন ছিল। বোম্বের নায়ক দিলীপ কুমারের খুব ভক্ত ছিল। চুল আঁচরাতো দিলীপ কুমারের স্টাইলে এবং এর জন্য স্কুলে পরিচিত ছিল। একদিন কাসে আমাদের এসিস্টেন্ট হেডমাস্টার বাসেত স্যার তার চুলের গোছা মুঠিতে ধরে বলেছিলেন, ‘এ চুল সাজাতে যত সময় দিস, সে সময়টা যদি পড়াশোনায় দিতি, তাহলে লেখাপড়ায় অনেক ভাল করতে পারতি।’
গানের আসরকে জমাবার জন্য ডেকে আনা হতো নাইমিয়াকে। কবি শামসুর রাহমান মাহুতটুলীর যে গলিতে থাকতেন, সেই ‘ভগতের গাড়া’ থেকে। গরীব, অশিক্ষিত বিড়ি বানাবার কারিগর, শুনে শুনে গায়ক নাইমিয়া। তার গলা খুব সুন্দর; গাইতোও ভাল। মোহাম্মদ রফির ভক্ত এবং তার গাওয়া গানই সে গাইতো বেশিরভাগ সময়। গান শুনে মানুষ পয়সা দিত। ঢাকার আশপাশে গিয়ে গান করে কিছু টাকাও রোজগার করতো সে। খেলাধুলার নেশাও তার ছিল। ছুটির দিনে পাড়ার ছেলেদের সাথে ফুটবল, কাবাডি খেলতো। আমার খেলা সে পছন্দ করতো। বৃষ্টির তালে তালে ইউসুফ-নাইমিয়ার গানের কম্পিটিশনের মধ্য দিয়ে গানের আসর জমে উঠতো। ইউসুফকে সে আসরের বিজয়ী ঘোষণা করে, নাইমিয়াকে কিছু টাকা পুরস্কার দিয়ে গানের আসর শেষ হতো।
চিনাবাদামওয়ালা পয়সার জন্য তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে সেই সকাল থেকে। পয়সা চাইলেই ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়া হতো। তার ধারণা, সে পয়সা পাবে না। সে অনুনয়-বিনয় করে বলতে শুরু করে, ভাই আমার পয়সা দেন, আমি চলে যাব। সেই সকাল থেইক্যা বইসা আছি। এদিকে চিনাবাদামওয়ালার টুকরি খালি প্রায়। দুপুর গড়িয়ে গেছে, সবার বাসায় যাওয়ার তাড়া, বৃষ্টিও কমে আসছে। বাদামওয়ালা তার পয়সা নিয়ে চলে গেছে। একসময় আমাদের এই আনন্দঘন মাহফিলেরও সমাপ্তি টানতে হতো।


(নয়)
স্কুল মাঠের পরিবেশ ছিল ক্রীড়াময়। যে কোন খেলাতে মেতে উঠতে পারাটাই ছিল আনন্দ। ঝড়-বৃষ্টি কোন কিছুই বাধা হয়ে উঠতে পারেনি কখনও। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। ছুটির দিন। স্কুল মাঠে নেমে পড়তাম পাড়ার ছেলেদের সাথে কাবাডি খেলতে। স্থানীয় ছেলেরা বলতো ‘খাড়া কাবাডি’। তাদের কথায় কোর্ট কেটে যে কাবাডি খেলা হয়, সেটা বায়ঠা কাবাডি। স্কুল মাঠের পূর্বদিকের গোলপোস্টের ডানদিকের গোল লাইন বরাবর একদল দাঁড়াতো, গোললাইনের প্রায় ১ গজ দূরত্বে আর একটি ছোট লাইন টেনে সেখানে রাইডার দাঁড়াতো (যে কাবাডি  কাবাডি ডাক দেবে)। রাইডার কাবাডি কাবাডি ডাকতে ডাকতে পেছন দিকে অর্থাৎ ব্যাক রানিং করে আরেক এক গোল লাইন পর্যন্ত যাবে। তাকে আটকাবার জন্য বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা চেষ্টা করবে। রাইডার বিপক্ষ খেলোয়াড়/খেলোয়াড়দের টাচ্ করার পর সোজা হয়ে দৌড়ে তার সীমানা পার হতে পারবে। রাইডার যে ক’জন খেলোয়াড়কে টাচ্ করবে, তারা আউট হয়ে যাবে। বিপক্ষ খেলোয়াড়কে টাচ করা ব্যতীত রাইডার যদি সোজা দৌড়ায় এবং সীমানা অতিক্রম করার পূর্বে যদি কোন বিপক্ষ খেলোয়াড় ছুঁয়ে দেয়, তাহলে রাইডার আউট হয়ে যাবে। রাইডারকে  যে কোন উপায়ে ধরা যাবে। ফাইং কিক দিয়ে ফেলে দিয়ে ধরা যাবে। ফাই করে দু’পায়ের ফাঁকে জড়িয়ে ফেলে দিয়ে ধরা যাবে। ফাই করে (ফুটবল গোলরক্ষক যেমন ফাই করে বল ধরে) রাইডারকে ধরা যাবে। মোট কথা, ধরার জন্য সব রকম পন্থা অবলম্বন করা যাবে। রাইডারের ছোঁয়ায় বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় বাদ পড়বে আর রাইডার ধরা পড়লে রাইডার বাদ হবে- অনেকটা বর্তমান কাবাডি খেলার মতো। এ খেলায় বড় ধরনের আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে খুব বেশি। 
সামার ভেকেশনের দিনগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে একদিন কাসের বন্ধু আমান খবর নিয়ে এলো। বললো, ‘দোস (দোস্ত), চরের সব আম-জাম শেষ। কাইলই চলো হেপার। গিয়া দেখি, আমাগো জন্য কিছু ছাইরা গেছে না চোরেরা; সব সাবার কইরা লইয়া গ্যাছে!’ পরদিনই সকাল সকাল আমানের রহমতগঞ্জের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। ডালপুরি আর ছোট ছোট টুকরো করা গরুর গোস্তের ঝোল। কি যে মজার নাস্তা! মুখে যেন লেগে রয়েছে।
দুজনে নদীর ঘাটে পৌঁছালাম। চান্নিঘাট ওয়াটার পাম্পের কাজেই ধোপাদের ঘাট। সেখানেই বাঁধা থাকতো তাদের ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা। নৌকা চুরি করার ওস্তাদ আমান। তার নিজের কৌশলে নৌকার বাঁধন খুলে, পার ঘেঁষে কিছুদূর নিয়ে গেল যেখানে  আমি দাঁড়িয়েছিলাম। নদীতে নৌকা ঠেলে দিয়ে দু’জনে লাফিয়ে উঠলাম। ডিঙ্গিটা নদীর কিছুদূর  যেতেই বুঝতে পারলাম নদীতে স্রোত। পানি বেড়েছে কিন্তু এত স্রোত বুঝতে পারিনি। দুজনে মিলে বৈঠা মারছি- যেতে হবে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কামরাঙ্গীর চরে। নৌকা একটু এগোয় তো বেশি যায় পেছনে- পূর্ব দিকে। কিছুতেই সামনের দিকে নিতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে নৌকা সওয়ারী ঘাটে চলে যায়। নদীর ধার ঘেঁষেই সওয়ারী ঘাটের মাছের আড়ত। আমাদের কাসমেট হাসনাত ও জাহাঙ্গীরের বাবা এ ঘাটের মাছের আড়তদার। ঘাটের পাশেই তাদের দোতলা বাড়িটি দেখা যাচ্ছিল। এখানে নৌকা ভেড়াতে চেষ্টা করলাম। নৌকা এ ঘাটে ফেলেই চলে যাবো কিন্তু দেখতে দেখতে নৌকা ইমামগঞ্জ বালুঘাটের কাছে চলে গেছে।
দেখা যাচ্ছিল বগু ভাইদের কুস্তির আখড়া। কৃতী কুস্তিগীর বগু ভাই সবার প্রিয়। ঘাটের পাশেই তাদের অনেকদিনের পুরনো কুস্তির আখড়া। ঢাকায় তখন পাড়ায় পাড়ায় কুস্তির আখড়া গড়ে উঠতো এবং কুস্তির প্রতিযোগিতাও হতো। আমাদের মাহুতটুলীতেও ছিল এরকম একটি আখড়া। বংশাল পুলিশ ফাঁড়ির উল্টোদিকে। মনে আছে, চার কোণা একটি ঘরের মেঝেতে লাল সুড়কির গুঁড়ো পুরু করে দেয়া। কুস্তিগীররা কুস্তির সময় পড়ে গেলে যাতে ব্যথা না পায় (বর্তমানে ফোমের ব্যবহার করা হয়)। ছোটবেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুস্তিগীরদের ব্যায়াম, কুস্তির অনুশীলন দেখতাম। আরো মনে আছে, শবেবরাতের সিন্নি (পরদিন সকালে) এ আখড়াতে চাটাই বিছিয়ে তার উপর দস্তরখানে পাড়ার মানুষদের খাওয়ানো হতো। আমাদের এই আখড়াতে আবার বিচার-আচার হতো। বর্তমানে সেই আখড়া আর নেই। সেখানে মাহুতটুলী রেঁনেসা ফ্রি প্রাইমারি স্কুল হয়েছে।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ সাফ গেমসে বগু ভাই মশাল দৌড়ে অংশগ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেটা রক্ষা করা সম্ভবপর হয়নি। সাফ গেমস ’৯৩ চলাকালীন বগু ভাই হার্টফেল করে আমাদের ক্রীড়াঙ্গন থেকে চিরবিদায় নিয়ে গেলেন। অলিম্পিক এসোসিয়েশনের মহাসচিব হিসেবে বগু ভাইয়ের আবদারটা সে সময় রাখতে পারিনি বলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল।
ছোট ডিঙ্গীটা স্রোতের টানে শোঁ শোঁ করে পূবদিকে চলে যাচ্ছিল। কিছুতেই সামলাতে পারছিলাম না। নদীর তীরে ভেড়াতেও পারছিলাম না। ভয় পেয়ে গেলাম। এই ছোট হাল্কা ডিঙ্গী নৌকা কখন যে লঞ্চ বা বড় নৌকার সাথে লেগে ঢুবে যায়! বালু ঘাট থেকে চোখের পলকে মিডফোর্ড হাসপাতালে চলে এসেছে নৌকাটি। দুজনে মিলে নৌকাটিকে হাসপাতালের সীমানা প্রাচীরে কোনরকমে এনে ঠেকালাম এবং নৌকা সেখানে ফেলে রেখেই কষ্ট করে দেয়াল টপকে যে যার বাড়ি চলে গেলাম।
আমাদের একটুখানি মজা করার কারণে সেদিন গরিব ধোপাদের নিশ্চয়ই অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও নৌকা চুরির অপরাধবোধ এক অনুভূতি হয়ে আছে এবং সেটা এখনো আমার বুকের মধ্যে রয়েছে অনুশোচনা হয়ে।
বৃষ্টির মধ্যে প্রাণের উচ্ছ্বাসে আমরা ফুটবল নিয়ে মেতে উঠতাম। স্লিপ মেরে অন্যকে ফেলে দিয়ে বল নিজের আয়ত্তে নেয়া, মাঠে জমে থাকা পানি লাথি দিয়ে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়ের চোখে-মুখে ছিটিয়ে বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, গোলপোস্টে কিক করে গোল গোল বলে চিৎকার করলেও বল গোলপোস্টের কাছে পানিতে আটকে যাওয়ায় হা-হুতাশ করাÑ এসব হরদম চলতো।
খেলতে খেলতে ফুটবলটা কখনো পরিবর্তিত হয়ে রাগবি খেলা হয়ে যেত। কখনো আবার চোর চোর খেলা হতো। দু’দলের মধ্যে ফুটবল ছুঁড়ে মেড়ে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়ের গায়ে লাগিয়ে আউট করা। আউট হয়ে যাওয়া দল তৎক্ষণাৎ বল নিয়ে বিপক্ষ দলের দিকে দৌড়ে যাওয়া এবং সে দল বাঁচার জন্য সমগ্র মাঠ, বিটিমের মাঠ, এমনকি স্কুল বারান্দায় গিয়েও আত্মরক্ষা করতে পারতো। যে দল বেশিবার চোর হবে, তাদেরই হবে হার।
এরকম খেলার তুলনা অন্য খেলার সাথে করা যায় না। এ খেলা শুধুই আমাদের আনন্দ পাওয়ার আর উপভোগ করার খেলা।
আনন্দ আর উল্লাসের ভেতর দিয়ে কখন যে শেষ হয়ে যেত সামার ভেকেশনÑ টেরই পেতাম না।
এরই মধ্যে ঝিরঝির মিষ্টি-বাতাস আগামী শীত মৌসুমের আগমনী বার্তা জানান দিয়ে যেত। শীত মৌসুম মানেই তো অনেকগুলো খেলা এক সাথে। হকি, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিক্স-এর সাথে রয়েছে ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, দাড়িয়াবান্দা। কাস এইটের রুম থেকে মাঠ দেখা যেতো। মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর আগামী মৌসুমের খেলাধুলার পরিকল্পনা মনে মনে আঁকতাম। এদিকে পরীক্ষার চিন্তাও মাথায় রাখতে হতো। এ সময়গুলো আমার খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটতো। সকাল-বিকাল খেলা নিয়ে মেতে থাকলেও গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে পরীক্ষার জন্য তৈরি করতে হতো নিজেকে।
মহসীন উদ্দিন আহমেদ, আমার সহপাঠী। অ্যাথলেটিক্স, হকি, ফুটবল ভাল খেলতো। তার পায়ের হাড় ছিল খুব শক্ত। যার সাথে একবার লেগেছে, সেই বুঝতে পেরেছে। তাই ফুটবল খেলতে গিয়ে সহজে কেউ তার সাথে বল কাড়াকাড়িতে যেতো না। সবাই বলতো, ‘বিলাই হাড্ডি’। মহসীন খেলাধুলায় ভাল হলেও উর্দুতে ছিল ভীষণ কাঁচা। উর্দু পরীক্ষার দিনে সে ইউওটিসি’র মোটা মোজা পায়ে পরতো। তার ভেতরে গুঁজে রাখতো উর্দুর বাংলা অনুবাদ, সারমর্ম, ব্যাখ্যা- যেসব বাংলায় লিখতে হতো। পেছনের সামনের বেঞ্চে বসা কাসমেটদের বলে রাখতো কোন পায়ে কোন উত্তরটা লিখে রেখেছে। পরীক্ষা আরম্ভ হলে শুরু হয়ে যেতো মহসীনের ফিসফাস আওয়াজ। ‘বল্ না, কোন পায়েÑ বাম পা না ডান পা’। পরবর্তীতে মহসীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হয়েছিল। তার অস্বাভাবিক মৃত্যুতে আমরা বন্ধুরা খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।
উর্দু পরীক্ষার আরও একটি মজার ঘটনা মনে পড়ে গেল। প্রখ্যাত ফুটবল, হকি খেলোয়াড় এবং রাষ্ট্রীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ প্রতাপ শংকর হাজরা আমার এক কাস নিচে পড়তো। ঐ সময় কাস ফাইভ থেকে এইট পর্যন্ত উর্দু ছিল কম্পলসারী। কাস নাইন থেকে উর্দু, আরবী, সংস্কৃতিÑ এর মধ্যে যে কোন একটি বিষয় নিতে হতো। ওর পরীক্ষার সিট পড়েছিল আমার সাথে। আমাদের স্কুলের বেঞ্চগুলো দুজন করে বসার। প্রতাপ হিন্দু, উর্দু না পারাটাই স্বাভাবিক।
আমি উর্দুতে মোটামুটি ভাল। বলেছিলাম, বাংলায় যেগুলো পারিস লিখে যা। আমার পরীক্ষা শেষ করে ওর প্রশ্নের যতদূর আমার পক্ষে সম্ভব ছিল বলে দিলাম। ফাঁকে ফাঁকে ওর পরীক্ষার খাতায়ও উর্দুতে যেগুলো উত্তর দেয়ার লিখে দিয়ে বলেছিলাম উর্দু লেখাগুলোর উপর হাত ঘোরাতে। লেখাটা মোটা হলোও দেখতে সুন্দর হলো। রেজাল্ট বেরুলে দেখা গেল কাসের সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে উর্দুতে ৬০ পেয়েছে। উর্দু টিচারও আশ্চর্য হয়েছিলেন এবং ভবিষ্যতে আরো ভাল করার জন্য প্রতাপকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এসবই প্রতাপের কাছ থেকে শোনা।
পরীক্ষা শেষে আমার একটাই চিন্তা থাকতো আগামী খেলার মৌসুমের জন্য নিজেকে তৈরি করা। অ্যাথলেটিক্স, ক্রিকেট, না কি হকি দিয়ে প্রস্তুতি শুরু করবো। সব খেলাই উপভোগ করতাম, সব খেলাতেই ভাল করার প্রবল ইচ্ছে হতো। আমার নিষ্ঠা এবং একাগ্রতার উপরই নির্ভর করতো আগামী দিনগুলোর খেলাধুলার সফলতা। তাই নিজের সর্বাত্মক চেষ্টা দিয়ে অনুশীলন চালিয়ে যেতাম।

(দশ)
১৯৫৭ আমার খেলোয়াড়ী জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য বছর। এবছর ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনে হকি-ফুটবল খেলায় ভিক্টোরিয়া কাবের মাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরার সুযোগ হয়েছিল। সে সময় দেশের খেলাধুলাগুলো দুটি মৌসুমে অনুষ্ঠিত হতো। শীত মৌসুম এবং বর্ষা মৌসুম। বাৎসরিক খেলাধুলা শুরু হতো শীত মৌসুম দিয়ে, সেপ্টেম্বর মাস থেকে চলতো মার্চ/এপ্রিল পর্যন্ত আর বর্ষা মৌসুম এপ্রিল থেকে আগস্ট/সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। শীতের খেলা হকি, ক্রিকেট ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, কাবাডি এবং অ্যাথলেটিক্স আর ফুটবল খেলাকে ধরা হতো বর্ষা মৌসুমের খেলা হিসেবে।
সাধারণত খেলাধুলার সিজন আরম্ভ হতো শীতকালে এবং হকি খেলার মাধ্যমে। শীতকালের অন্যান্য খেলার চেয়ে দীর্ঘ সময় মাঠে থাকতো হকি খেলা। ঢাকায় হকি লীগ চলতো অনেক দিন ধরে, তারপর আতিকুল্লা কাপ টুর্নামেন্ট। চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে হকি খেলা হতো। সেখানকার হকি টুর্নামেন্টে ঢাকার টিমও অংশ নিতো। তারপর জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপ, বিভিন্ন প্রভিন্সে বসতো এজাতীয় হকির বৃহৎ আসর। এমনকি ঢাকার ওয়ারী কাব এবং ব্যাচেলর কাব কোলকাতার ‘বাইটন কাপে’ অংশগ্রহণ করতো।
‘এ বছর অন্য কোথাও হকি খেলার দরকার নাই, এ বছর এখানেই খেলবি’Ñ অনেকটা হুকুমের সুরেই মোমিন ভাই আর সালাম ভাই বললেন। ব্যাস, ভিক্টোরিয়ার হকি খেলোয়াড় হয়ে গেলাম! গত বছর থেকে ভিক্টোরিয়া কাবে ক্রিকেট খেলে আসছিলাম; সুতরাং ভিক্টোরিয়া কাব আমার কাছে নতুন কাব মনে হয়নি। তাছাড়া খেলোয়াড়দের তালিকা দেখে মনে হলো এটা কোনো কাব দল নয় বরং আরমানিটোলা স্কুল হকি টিম। সবাই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র; একমাত্র আমি বর্তমানে স্কুলের ছাত্র। শুধু তাই নয়, আমরা প্রায় সবাই মাহুৎটুলী এলাকার এবং স্কুল মাঠের খেলোয়াড়। যেমন- গোলরক্ষক জাকের, ফুলব্যাক নীলু, হাফ ব্যাক : জ্যাকি, সালাম, মোমিন আকবর আলী, আমির আলী (দুই ভাই), ফরোয়ার্ড : আলমগীর ও আমি। রুমা, খুরশীদ, সগির, কাইভ, নুরু, দুলুÑ এরা স্কুলের নয়, তবে রুমা আমাদের পাড়ার।
ঢাকা হকি লীগে মাত্র কয়েকটা ম্যাচ খেলেছিলাম ব্রাদার্সের পক্ষে আগের সিজনে, উল্লেখযোগ্য ঘটনা তেমন মনে পড়ে না। এ বছর ভিক্টোরিয়া কাবের পক্ষে খেলতে প্রথম থেকে খেলাটা উপভোগ করতাম। দলে বড় ভাইরা থাকায় খেলতে সাহস পেতাম, কোন প্রকার চাপ অনুভব করতাম না, নিজের মনের মত করে খেলতাম। সে সময় ঢাকা হকি লীগে অংশগ্রহণকারী দলগুলোÑ ইপিআর, সিগন্যাল, রেলওয়ে, পিডব্লিউডি, ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স, ব্রাদার্স, আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, আর্মি, ব্যাচেলর কাব। ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া, ওয়ান্ডারার্স ও ব্রাদার্স কাব বাঙ্গালী খেলোয়াড়দের দ্বারা গঠিত হতো। ব্যাচেলর হতো নবাব পরিবারের সদস্যদের দ্বারা, আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ দল স্থানীয় কলেজের ছাত্র এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন যায়গা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসা অবাঙ্গালী ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত হতো। বাকি দলগুলোর প্রায় সব খেলোয়াড় অবাঙ্গালী। দলগুলোর মধ্যে ইপিআর, সিগন্যাল, রেলওয়ে, পিডব্লিউডি শক্তিশালী দল ছিল। আর্মি দলও বেশ শক্তিশালী ছিল, তবে আর্মি দল নিয়মিত লীগে অংশগ্রহণ করতো না। উপরোক্ত দলগুলোর খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেকের খেলা আমার খুব ভাল লাগতো। এদের দলগত এবং ব্যক্তিগত নৈপুণ্য আমাকে মুগ্ধ করতো। পরবর্তীতে এদের সম্বন্ধে লেখার চেষ্টা করবো।
ভিক্টোরিয়ার কাবের কর্মকর্তাদের উৎসাহ এবং দলের খেলোয়াড়দের সহযোগিতা আমাকে ভাল খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছিল।  আরও ভাল খেলার জন্য মনোযোগ দিতাম, অনুশীলন করতাম এবং বেশি বেশি খেলতাম। 
পরীক্ষার ফল বেরুলো। আমরা খেলোয়াড় বন্ধুরা সবাই পাস করেছিলাম। আমরা এখন স্কুলের সিনিয়র স্টুডেন্ট। কুদ্দুস স্কুল ক্যাপ্টেন মনোনীত হয়েছিল। এতে আমাদের মাতব্বরী আরও বেড়ে গিয়েছিল। স্কুলের খেলাধুলায় আমাদের মতামতের গুরুত্ব দেয়া হতো।
৫৭ সালের ২৭ জানুয়ারি স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। লংজাম্প, হাইজাম্প, হপস্টেপ এন্ড জাম্প এবং ডিসকাস থ্রো ইভেন্টগুলোতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। উন্মুক্ত ৮৮০ গজ দৌড়ে সেবার প্রথম স্থান অধিকার করতে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়নি। স্কুলের সবচাইতে আকর্ষণীয় ইভেন্ট ছিল ৪ী১০০ রিলে রেস। একমাত্র এই ইভেন্ট জয়ী হলে প্রাইজ দেয়া হতো। বাকি যত ইভেন্ট, সবগুলো বিজয়ীদেরকে স্কুলের সার্টিফিকেট দেয়া হতো। আমার বাসায় কয়েক ডজন সার্টিফিকেট সযতেœ তুলে রেখেছি। এগুলোর পরিবর্তে যদি প্রাইজ দেয়া হতো, তাহলো আমার বাসায় শোকেস বোঝাই হয়ে যেত। ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হলে একটা কাপ দেয়ার প্রচলন ছিল। রিলে রেস হতো আমাদের ৪টি হাউজের মধ্যে। প্রায় সময়ই বিজ হাউজ চ্যাম্পিয়ন হতো। এ বছর প্রাইজ ছিল ৪টি সুন্দর জগ। এ ইভেন্টে সব দলই (হাউজ) জয়ী হতে চাচ্ছিল। আমার ইভেন্ট জাম্প, ¯িপ্রন্ট ইভেন্টে অংশ না নিলেও দৌড়াতাম ভালই। আমাদের ওয়েস্ট হাউজ অংশ নিয়েছিল। আমি সবার শেষে দৌড়াবো। স্কুলের মাঠে এক চক্কর ১০০ গজ, সুতরাং ৪০০ গজ মানে ৪টি চক্কর দিতে হবে। তিন চক্কর পর্যন্ত আমাদের হাউজ তৃতীয়জনের সমান সমান দৌড়ে এসে আমাকে ব্যাটন দিলে আমি দৌড় শুরু করে দ্বিতীয় স্থানে চলে এলাম। টেপটা প্রথমে আমার বুকে টাচ করেছিল। এরই মধ্যে ওয়েস্ট হাউজের ছাত্ররা আনন্দ করতে শুরু করে দিয়েছিল। এবারও ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।
স্কুলের গেম টিচার আব্দুর রশিদ স্যারের প্রেরণায় এবং বন্ধুবান্ধবের উৎসাহে ৩১-১-৫৭ তারিখে আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ মাঠে উপস্থিত হয়েছিলাম ঢাকা সিটি আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে। সে সময় গেন্ডারিয়া স্কুল, নবকুমার, কলেজিয়েট, সুভাড্ডা স্কুলসমূহের বেশ নামডাক। তাদের ক্রীড়াবিদদের খুব সুনাম ছিল স্কুল অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায়। আমার প্রথম ইভেন্ট লংজাম্প। বুকটা দুরু দুরু করছিলো। আল্লার নাম নিয়ে শুরু করেছিলাম। আমার সেরা জাম্পটাই দিয়েছিলাম। তিনটি জাম্প শেষ। দ্বিতীয় হয়েছিলাম। মনটা একটু খারাপ হলেও নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম এই বলে যে, প্রথমবারের মত আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয়Ñ কম কিসের! শূন্য হাতে তো ফিরতে হবে না, অন্ততপক্ষে একটা পদক নিয়ে যাওয়া যাবে। দ্বিতীয় ইভেন্ট হাইজাম্প শুরু হলো। এ ইভেন্ট শেষ হতে বেশ সময় লাগে। ঐদিকে ডিসকাস থ্রো’র জন্য কল করা হচ্ছিল। একটা জাম্প দিয়ে দৌড়ে গিয়ে একটা থ্রো করে আসছিলাম। এমনি করে তিনটি থ্রো শেষ করলেও জাম্প তখনও শেষ হয়নি। ডিসকাস থ্রোর রেজাল্ট সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গিয়েছিলাম। সে ইভেন্টেও দ্বিতীয়। মনটা খুব একটা খুশী হতে পারেনি, দুটো পদকই দ্বিতীয় স্থানের, কি আর করার! দেখা যাক যদি হাইজাম্পে প্রথম স্থান অধিকার করতে পারি, তাহলে সবাইকে বলতে পারবো। অনেক মনোযোগ সহকারে হাইজাম্প দিচ্ছিলাম কিন্তু এখানেও ভাগ্য আমার সঙ্গে থাকেনি। এ ইভেন্টেও দ্বিতীয়! ভাবলাম হপ স্টেপ এন্ড জাম্প আমার প্রিয় ইভেন্ট। প্রথম হলে ফলাফলটা খুব একটা খারাপ হবে না। অনেক আশা নিয়ে জাম্প আরম্ভ করেছিলাম। স্কুলের চেয়ে ভাল জাম্প করেছিলাম কিন্তু ভাগ্যের সহযোগিতা না পেলে জোর করে কিছু পাওয়া যায় না। রশীদ স্যারসহ যারা স্কুল থেকে গিয়েছিলেন, সবারই মন খারাপ। প্রতিযোগিতা শেষ। পুরস্কার দেয়ার পালা। আমার ইভেন্টের প্রথম স্থান অধিকারীর নাম যখন ডাকা হয়েছিল, সবাই হাততালি দিচ্ছিল, তখন আমার বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা কষ্ট অনুভব করেছিলাম। পরমুহূর্তে ২য় স্থান অধিকারী ‘বশীর আহমেদ’ নামটা শুনে সেরকম উৎসাহ বোধ করিনি। এক এক করে চারটি ইভেন্টে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করায় উপস্থিত সবার কাছে আমার নামটা বেশ পরিচিতি পায়। অনেকের কৌতূহল হয়। সব ইভেন্টের পুরস্কার দেয়া শেষ।
সেদিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ মাঠে উপস্থিত সবাইকে অবাক করে যে এনাউন্সমেন্টটি করা হয়েছিল, সেটি আমাকে শুধু অবাক করেনিÑ রোমাঞ্চিত এবং আনন্দিত করেছিল। সে এনাউন্সমেন্টটি ছিল এরকম, ‘ঢাকা সিটি আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পয়েন্ট তালিকায় শীর্ষে থাকায় আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র বশীর আহমেদ ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।’ বন্ধুদের চিৎকার আর সবার হাততালির মধ্য দিয়ে পুরস্কার নেয়ার সাথে সাথে বন্দুরা আমাকে মাথায় তুলে নিয়ে আনন্দ উল্লাসে মাঠ মাতিয়ে তুলেছিল। গেম টিচার রশিদ স্যারকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলে স্যার আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।
হৈচৈ করতে করতে, হাঁটতে হাঁটতে স্কুল মাঠে ফিরে এসেছিলাম এবং সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে আমরা যে যার বাসায় চলে গিয়েছিলাম।
পরদিন স্কুলে গেমস টিচারের সাথে হেডমাস্টার শামসুদ্দিন স্যারের রুমে গিয়ে সংবাদটা দিয়েছিলাম কিন্তু স্যারের কাছ থেকে কোন প্রকার অভিনন্দন বা প্রশংসা পাইনি বরং ভালো করে পড়াশোনা করার নসিহত-বাক্য শুনতে পেয়েছিলাম। অন্যান্য স্যার খুশী হয়েছিলেন, অভিনন্দন জানিয়েছিলেন আগামীতে আরও ভাল করার উৎসাহ দিয়েছিলেন।
এদিকে শীতকালীন খেলা এক এক করে শুরু হচ্ছিল। আর আমার ব্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছিলো। কোন খেলা খেলবো, কোন খেলার অনুশীলন করবোÑ মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে উঠতাম। ক্রিকেট লীগ এরই মধ্যে আরম্ভ হয়েছে। সালাম ভাইয়ের পেছনে পেছনে থাকতাম, কখন তিনি কোন খেলার তাগিদ দেন। ভিক্টোরিয়ার তিনি ক্রিকেট খেলোয়াড়, আবার হকি খেলোয়াড়ও। সুতরাং তার পেছনে দুটো খেলা চালিয়ে যেতাম। কখন প্র্যাকটিস করতে হবে আর কখন ম্যাচ খেলতে হবেÑ সবই তার নির্দেশে চলতে লাগলো। অ্যাথলেটিক্স অনুশীলন সকালবেলাতেই সারতে হতো।
শীতকালের আরো একটি খেলার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। ভাল লাগতো খেলতে, বেশ ভদ্র ভদ্র  খেলাÑ সেটা ছিল ব্যাডমিন্টন, গোল বাধতো এ খেলার কোট কাটা নিয়ে। আমাদের হেডমাস্টার শামসুদ্দিন স্যার মাঠে কোট কাটতে দিতেন না। মাঠ নষ্ট হয়ে যায়, হকি খেলতে অসুবিধা হতো। তিনি কোট কাটার পারমিশন কখনও দিতেন না। কিন্তু আমাদের খেলতেই হবে। বাধ্য হয়ে স্যারকে লুকিয়ে বি. টিমের মাঠে কোর্ট কাটতাম এবং খেলা শুরু করে দিতাম। প্রথম প্রথম স্যার আমাদের ডেকে বকাঝকা করতেন, আমরা মাথানত করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তিনি শান্ত হয়ে যেতেন। পরে আবার আমরা খেলা চালিয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্যার আমাদের খেলা দেখতেন। কিছু বলতেন না। ব্যাডমিন্টন খেলা হতো একেবারে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়, স্কুল থেকে কোন কিছুই দেয়া হতো না।
এই ব্যাডমিন্টন কোটে আরও একটি মজার খেলা খেলতামÑ দাড়িয়াবান্দা। ভোরবেলা শিশির পড়া পিচ্ছিল কোটে এ খেলার আনন্দ ভিন্ন। ব্যাডমিন্টন কোটের দুটি থার্ড কোটে দুজন এবং মাঝে দুটি দাগে দুজন দাঁড়াবে। বিপক্ষ দলের চারজন খেলোয়াড়কে এই চারটি দাগে দাঁড়ানো চারজনকে ফাঁকি দিয়ে এক এক করে শেষ থার্ড কোট অতিক্রম করতে হবে। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড় হাতের (ছোঁয়ার) নাগালের বাইরে থেকে কোটের ভেতর এদিক-সেদিক দৌড়িয়ে দাগে দাঁড়ানো খেলোয়াড়কে ফাঁকি দিয়ে পরবর্তী কোটে প্রবেশ করবে এবং ঐ কোটে দাঁড়ানো খেলোয়াড়কে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করবে। এভাবে সবকটি দাগ অতিক্রম করলে ১ পয়েন্ট হবে। যে ক’জন অতিক্রম করবে, সে দলের তত পয়েন্ট হবে। একবার এ দল, একবার অন্য দল দাগ অতিক্রম করবে। ৫ বার (সেট) বা পূর্বনির্ধারিত সেটে খেলা চলবে। যে দলের অধিকসংখ্যক খেলোয়াড় সবকটি দাগ অতিক্রম করবে, তারাই এ খেলায় জয়ী হবে।
এই দাড়িয়াবান্দা খেলায় চান্স পাওয়ার লক্ষ্যে আমাদের খেলাপাগল বন্ধুদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা চলতোÑ কে কার আগে মাঠে উপস্থিত হবে। অবশ্যই তা কাকডাকা ভোরবেলা। যে মাঠে প্রথম উপস্থিত হবে, সে মুখ দিয়ে একটা সিগন্যাল দেবে, অনেকটা টারজানের ডাকের মত। কেউ এর উত্তর দিতে না পারলে বুঝতে হবে সেই প্রথম। দ্বিতীয়জন এসে একইভাবে ডাক দেবে, প্রথমজন তার ডাকের উত্তর দেবে সেরকম (টারজানের ডাকের মত) ডাকের মাধ্যমে- এভাবেই নির্ধারিত হতো কে প্রথম মাঠে উপস্থিত হয়েছিল। এতে প্রথমজন বেশ গর্ববোধ করতো।
ভোরে মাঠে উপস্থিত হওয়ার একটি রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা মনে পড়ছে। জ্যোৎস্না রাত ছিল সেদিন। কাক ডাকছিল। মনে করেছিলাম, ভোর হয়ে গেছে; তাই তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে মাঠের দিকে ছুটছিলাম। গলিটা পার হলেই বড় রাস্তা। রাস্তায় উঠতেই দু’জন পুলিশ আমাকে আটকালো। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে আমি বললাম, মাঠে খেলতে যাবো, আমাকে সবার আগে পৌঁছাতে হবে। আমার কথা শুনে পুলিশ দুজন হেসে বললো, রাতে আবার কোন খেলা! এখন গভীর রাত। ঘড়িতে এখন রাত তিনটা, বাসায় ফিরে যাও- অনেকটা ধমকের সুরে বললো। পুলিশের কাছে রাত তিনটা শুনে গলি দিয়ে বাসায় ফিরে যেতে অজানা ভূতের ভয়ে গাটা ছমছম করে উঠেছিল। সেদিনে গলিটা নীরব থাকতো, এতটা মানুষজনের ভিড় ছিল না। জমিদার বাড়ির মাঠের খালি জায়গা জুড়ে বড় বড় গাছ। রাতে গলি দিয়ে চলাচলকারীদের গায়ে সামান্য হলেও কাঁটা দিয়ে যেত। বিশেষ করে গলির দিকে যে বিরাট বেলগাছ, সেদিকে তাকালেই ভয় করতো। ঐ গাছের নিচ দিয়েই যেতে হয় সবাইকে। একদিকে ভূতের ভয়, অন্যদিকে পুলিশের ভয়। ভূতের ভয়টাকে বুকের ভেতর চেপে রেখেই চোখ বুজে দিয়েছিলাম এক দৌড়। আজও সে কথা মনে হলে কেমন জানি এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি অনুভব করি নিজের মধ্যে। আসলে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাবার একটা তাড়না বা চাঞ্চল্যকর মজার প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কাজ করতো।
ভলিবল শীতকালের খেলা। আমাদের স্কুলের ছাত্রদের মাঝে এ খেলার প্রতি আকর্ষণ লক্ষ্য করা যেত না। হকি সিজনে হকি নিয়ে মেতে থাকতেই স্কুলের ছাত্রদের দেখা যেত। আমরা ক’জন ভলিবল সিজনাল খেলা হিসেবে কয়েকদিন বিটিম মাঠে নেট টাঙ্গিয়ে খেলতাম। সময়ের স্বল্পতা এবং হাইট ছোট বলে ভলিবলের প্রতি আমার আগ্রহটা সেরকম ছিল না। আমার জাম্প ভাল বলে মাঝে মাঝে খেলতে উৎসাহ পেতাম। স্কুল টিমে খেলতাম। ঢাকার বাইরের কোন একটি স্কুলের (নাম মনে পড়ছে না) সাথে আমাদের স্কুলের ম্যাচ হয়েছিল। বি টিমের মাঠে সে খেলাতে আমি খেলেছিলাম। প্রথম সেট আমরা জয়ী হয়েছিলাম কিন্তু দ্বিতীয় সেটে আমরা কোন পয়েন্টই সংগ্রহ করতে পারিনি। অর্থাৎ শূন্য পয়েন্টে আমাদেরকে তারা হারায় এবং তৃতীয় সেটেও আমরা হেরে যাই। শূন্য পয়েন্টে হেরে যাওয়া নিয়ে আমাদেরকে অনেক সমালোচনা শুনতে হয়েছিল।

(এগার)
‘ভিক্টোরিয়া কাবে ফুটবল খেললে কাব তোকে দুইশত টাকা দিবে’Ñ মোমিন ভাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন। মার জন্য একটা শাড়ি, নিজের জন্য দুটো মাখন, জিন্সের প্যান্ট, বন্ধুবান্ধব নিয়ে সিনেমা দেখা-খাওয়া এক সেকেন্ডেই তালিকা তৈরি করে ফেলেছিলাম সেদিন। দিনটি ছিল স্কুল ছুটির দিন। আর রায়হান ও লেবু, মহসিন, রফু আর আমি ক্যারম খেলছিলাম। একটি ছেলে এসে খবর দিয়ে গেল, কে একজন আমাকে খোঁজ করছেন। খেলা রেখে বের হয়ে দেখেছিলাম, মোমিন ভাই সাইকেল নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, তার কাছে যেতেই তিনি উপরোক্ত ফুটবল খেলার প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন। প্রথম বিভাগে ফুটবল খেলার স্বাদ প্রত্যেক উঠতি ফুটবলারের থাকে, আমার ভেতরেও এরকম স্বাদ থাকাটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমার মত একজন স্কুল ছাত্রের জন্য ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম বিভাগে খেলা অনেক বড় ব্যাপার। যদিও ইতোমধ্যে আমি ভিক্টোরিয়া কাবের পক্ষে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট এবং হকিতে অংশগ্রহণ করে আসছিলাম। ফুটবল ছিল সে সময়ের সবচাইতে জনপ্রিয় খেলা। প্রথম বিভাগে খেলার গুরুত্ব এবং মর্যাদা ছিল ভিন্নতর। ভিক্টোরিয়া কাব আমার পরিচিত কাব। এ কাবের পক্ষে খেলতে চাপমুক্ত এবং স্বচ্ছন্দে খেলা যাবে। তারপরও মোমিন ভাই, সালাম ভাই মাঠে থাকবেন। সুতরাং নির্ভয়ে নিজের মত করে খেলতে পারবো। এতসব চিন্তা-ভাবনা এক মুহূর্তে শেষ। মোমিন ভাইয়ের সামনে আমার সম্মতিটা মাথা নিচু করে এভাবে জানিয়েছিলাম সেদিনÑ ‘আপনারা যা ভাল মনে করেন, সেটাই হবে।’ ১৯৫৭ সালে আমার প্রথম বিভাগে ফুটবল খেলার সুযোগটা এসেছিল এমনি করে।
মোমিন ভাই সাইকেলে চলে গেলেন, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেদিকে দেখছিলাম, সে সময় আমার ভেতর কেমন জানি একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি অনুভব করছিলাম। একটা অজানা আশংকায় বুকটা দুরু দুরু করছিল, অস্থির হয়ে ‘আর-রায়হানে’ ফিরে এসেছিলাম।
আর রায়হান তারা মসজিদের পাশে প্রাইমারী স্কুল ঘেঁষে একটি দোতলা বাড়ির নাম। যার সিঁড়িঘর বেশ উঁচু করে নির্মিত, তার দেয়ালে সিমেন্ট দিয়ে আরবীতে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘আর-রায়হান’। যা আজও বিদ্যমান। এটি একটি অনাথ আশ্রম বা এতিমখানা। আমার বন্ধু রফিকউদ্দিন সিদ্দিকীর (রফু) বাবা খান বাহাদুর ফরিদউদ্দিন সিদ্দিকী ছিলেন এই এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা। তার অনুদানে ১৯৩৯ সালে আজিমপুরস্থ স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা বর্ধিতকরণ করা হয়েছিল। এতিমখানায় তিনি নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ফরিদউদ্দিন সিদ্দিকী হাইস্কুল’। জমি সংগ্রহ করে তিনি এতিমদের জন্য খেলার মাঠ তৈরি করে দিয়েছিলেন। আমার মনে পড়ে, ছোটবেলায় বয়সভিত্তিক হাইটের একটি টুর্নামেন্টে ঐ মাঠে খেলার সুযোগ আমার হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর আর রায়হান পুরোপুরি এতিমখানাকে দিয়ে দেয়া হয়। রফুরা চলে যায় মৌলভীবাজারে নিজেদের বাড়িতে।
রফু পরবর্তীতে পাকিস্তানের সুন্দরী নায়িকা সাবিহাকে পাওয়ার নেশায় উন্মাদ হয়ে যায়। বাড়ির সমস্ত টাকা-পয়সা নষ্ট করে ঘন ঘন লাহোর যেত সাবিহাকে দেখার জন্য। এমনি যাওয়া-আসা করতে করতে একদিন সে স্থায়ীভাবে লাহোরে থেকে যায়। কিছুদিন আগে লাহোরেই তার মৃত্যু হয়।
সে সময় ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে, ব্যান্ড পার্টির বাজনা বাজিয়ে মিছিল করে কোন কাবের পক্ষে খেলার ঘোষণা দিতে হতো না, ট্রান্সফার পদ্ধতি ছিল খুবই সহজ, চব্বিশ ঘন্টা পূর্বে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের লিখিতভাবে জানিয়ে দিলেই হতো যে, সে কোন কাবের পক্ষে চলতি মৌসুমে ফুটবল খেলবে। মোমিন ভাই যেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেদিনই আমি ভিক্টোরিয়া কাবের খেলোয়াড় বনে গিয়েছিলাম। ইদানীংকালের মত দিনক্ষণ জানিয়ে, ঢাকঢোল পিটিয়ে কাবের অনুশীলন করতে দেখা যেত না, বিশেষ করে ভিক্টোরিয়া কাবে ফুটবল অনুশীলন বা ফুটবল ক্যাম্প ১৯৬১ সালের আগে হয়নি। অনুশীলন বা প্র্যাকটিস সেটা ছিল একেবারে নিজস্ব ব্যাপার। যে যার মত করে প্র্যাকটিস করে খেলার মাধ্যমে প্রত্যেক খেলোয়াড়কে নিজ নিজ দক্ষতা অনুযায়ী মাঠে পারফর্ম করতে হতো। ব্যক্তিগত স্কিল-এর পারদর্শিতা ম্যাচের মধ্যে দেখাতে হতো। দম থাকতে হবে, বল কাটাবার কৌশল জানা থাকতে হবে, সঠিক পাস দেয়ার, গোল করার, বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে বাধা প্রদান করা এবং কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে এবং গোলরক্ষককে নিজ নিজ পজিশনের দায়িত্বের প্রমাণ ম্যাচের ভেতরই দিতে হতো। মোট কথা, প্রত্যেকটি ম্যাচ হতো কাবের পরবর্তী ম্যাচের খেলোয়াড় নির্বাচন। দলগত সমঝোতা ম্যাচ খেলতে খেলতে তৈরি হতো। যে খেলোয়াড় দলের সাথে মানিয়ে নিয়ে ব্যক্তিগত ও দলগত নৈপুণ্য দেখাতে সক্ষম হতো, সেই কাবে নিয়মিত খেলার চান্স পেতো। কাব কর্তৃপক্ষ ভাল ফলাফলের আশা করতো সব সময়ই কিন্তু খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধা সে রকম দেয়া হতো না। এরই মধ্যে খেলতে হতো।
হকির মতো ফুটবলেও আমার অভিষেক হয়েছিল ইপিআর দলের বিপক্ষে খেলে এবং ৩-১ গোলে পরাজিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। প্রথম দিন ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রথম বিভাগে ফুটবল খেলতে নেমে খুব একটা চাপ অনুভব করিনি বরং খেলতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছিলাম। নিজের মত করে ড্রিবলিং করা, পাস দেয়া, বিপক্ষ খেলোয়াড়দের বাধা দিতে গিয়ে সারা মাঠে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করা। সবকিছুই দক্ষতার সাথে করার চেষ্টা করেছিলাম, মোটামুটি ভালই খেলেছিলাম। আমাদের পক্ষে সেদিন কে গোল করেছিল মনে নেই। বন্ধুরা যারা মাঠে খেলা দেখতে গিয়েছিল, তারা বলেছিলো, ‘ভালই খেলেছিস।’ কাব কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকজন প্রশংসাও করেছিলেন, আমি নিজেও বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি খেলতে পারবো, নিজের মধ্যে একটা আস্থা তৈরি হয়েছিল প্রথমদিনই।
সে বছর ভিক্টোরিয়া কাবে স্থানীয় এবং নিয়মিত খেলোয়াড় বলতে মোমিন ভাই, সালাম ভাই আর আমি ছাড়া কারও কথা মনে নেই। ময়মনসিংহের মর্তুজা, ফেনীর মঞ্জু, কুমিল্লা থেকে সুনীল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে খান, চট্টগ্রাম থেকে আইজ্যাক, ববি, উইলকিংসনÑ এদের নিয়ে ভিক্টোরিয়া কাব দল গঠন করে মাঠে নামতো প্রতিটি খেলায়। বেশিরভাগ খেলোয়াড় ছিল ঢাকার বাইরের। আমার মনে আছে, আমাদের যেদিন খেলা থাকতো, সেদিন কাবের সেক্রেটারি রেজা ভাই তিনটা বাজলেই অস্থির হয়ে কাব প্যাভেলিয়নে হাঁটাহাঁটি শুরু করে দিতেন, তার লম্বা গলা উঁচু করে তাকিয়ে থাকতেন দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের দিকে। কখন চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন এসে পৌঁছাবে! ভিক্টোরিয়া কাবের কাঠের প্যাভিলিয়নটি সে সময় ছিল বর্তমানে ডিআইটির দিকে যে স্টেডিয়াম গেট, তার পাশে ফাডলাইটের টাওয়ারের (পোলের) কাছে। ভিক্টোরিয়া কাবের ঠিক পূর্বদিকে বর্তমানে হ্যান্ডবল মাঠে ছিল ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের প্যাভেলিয়ন। আউটার স্টেডিয়াম ছিল শুধু ফাঁকা কয়েকটা মাঠ, পল্টন ময়দান নামে পরিচিতি হলেও সে সময় মোহামেডান মাঠ (ডিআইটির উল্টোদিকের মাঠ) ওয়ারী, ওয়ান্ডারার্স-এর নামে মাঠগুলো পরিচিতি পেয়েছিল। গুলিস্তান বিল্ডিং ছিল একটি সিনেমা ঘর মাত্র। ধারেকাছে বিরাট বিরাট বিল্ডিং তখনও গড়ে উঠেনি, তাই তো ভিক্টোরিয়া কাবের উঁচু প্যাভেলিয়ন থেকে লম্বা গড়নের রেজা ভাই দেখতে পেতেন ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন। রেজা ভাইয়ের মুখে হাসি হাসি ভাব ফুটে উঠতেই আমরা বুঝতে পারতাম যে, চট্টগ্রামের ট্রেনটি দেখা দিয়েছে, এখনই স্টেশনে ঢুকবে।
স্টেশনে নেমেই খেলোয়াড়রা তাড়াহুড়ো করে উত্তর-পূর্ব দিকে কোণাকুনি হাঁটা শুরু করতো, রেললাইন ডিঙ্গিয়ে গুলিস্তানের পাশ দিয়ে পল্টন মাঠে ঢুুকতো, তারপর কাব টেন্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে খেলার সময় হয়ে যেত। কখনও আমরা মাঠে যাওয়ার পর ঢাকার বাইরের খেলোয়াড়রা মাঠে উপস্থিত হতো। এমনও হয়েছে, আমরা মাঠে উপস্থিত হয়েছি মাত্র ৬/৭ জন খেলোয়াড় নিয়ে, তখন রেফারির কাছে সময় নিয়ে অপেক্ষা করে থাকতাম। সে সময় রেফারি ৫/১০ মিনিট পর্যন্ত সময় দিতে পারতেন। সে সময় খেলোয়াড় পরিবর্তন করার আইন ছিল না। যে এগারজন খেলোয়াড় খেলা শুরু করতো, তারাই খেলা শেষ করতো, আঘাত পেলেও কোন সাবস্টিটিউশন-এর সুযোগ ছিল না।
কাবের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে আমাকে সবাই স্নেহের চোখে দেখতেন। মাঠে আমার সতীর্থ খেলোয়াড়দের যেমন সহযোগিতা পেতাম, তেমনি কাবের কর্মকর্তারাও আমাকে আদর করতেন, অভিভাবকসুলভ আচরণ করতেন। সব খেলোয়াড়ের কথা, তাদের খেলার কথা আমার সেরকম মনে নেই; তবে এ্যাংলো খেলোয়াড় ববি, আইজ্যাক খুব লম্বা-চওড়া ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খান ফুলব্যাকে খেলতো এবং খানের মতই লম্বা ছিল। তার খেলা এবং ব্যবহার আমার ভাল লাগতো। ফেনীর মঞ্জু লেফট আউটে খেলতো, খুব দ্রুতগতির খেলোয়াড় ছিল। মুর্তজা সেন্টার হাফের খেলোয়াড়, খুব শক্ত-সামর্থ্য মোমিন ভাই খুব ‘ডানপিটে’ খেলোয়াড়, রাইট হাফে মোটামুটি ভালই খেলতেন। সালাম ভাই অনিয়মিতভাবে ফুলব্যাকে খেলতেন। প্রথম বিভাগের নতুন সদস্য হওয়ায় অন্যান্য কাবের খেলোয়াড়দের সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি তখনও বলে ঢাকার ভাল ভাল খেলোয়াড়দেরকে চিনতাম না, সুতরাং কারও খেলা আমাকে সেরকম আকৃষ্ট করেনি বা তাদের খেলা সম্বন্ধে কিছু লিখতেও পারছি না। সেসময় ঢাকায় শক্তিশালী দলগুলোর মধ্যে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ঢাকা মোহামেডান, বিজি প্রেস, ইপিআর, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, আজাদ স্পোর্টিং, ভিক্টোরিয়ায় খেলার পর পরিষ্কার হয়ে সবাই একত্রে জিন্নাহ এভিনিউতে (বর্তমান বিবি এভিনিউ) ঢাকা হোটেলে গিয়ে পরোটা-কাবাব খাওয়াটা আমার নিকট খুব আনন্দদায়ক ছিল। মজাদার পরোটা-কাবাবের কথা মনে হলে আজও সেটা খাওয়ার স্বাদ জাগে।
এরই মধ্যে আমার কিছু সমর্থকও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তারা সব সময় আমার খেলার প্রশংসা করতো, ভাল খেলার জন্য উৎসাহ দিত। কাবের কর্মকর্তারাও আমার খেলা দেখে খুশী হয়েছিলেন বলে মনে হয়েছে। তাদের অনেকেই খেলার প্রশংসা করে আগামী বছর খেলার জন্য আগাম প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এক এক করে সবগুলো ম্যাচ খেলে ১৯৫৭ সালের লীগ পর্ব শেষ করেছিলাম।

(বার)
ফুটবল লীগ শেষ। ভিক্টোরিয়া কাব সে সময় অন্য কোন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতো না। হয়তো সীমিতসংখ্যক স্থানীয় খেলোয়াড় নিয়ে ভাল দল গঠন করা সম্ভব হতো না; কিংবা অর্থনৈতিক কারণও হতে পারে। সুতরাং আমারও সেখানকার (স্টেডিয়ামে) খেলা শেষ। অগত্যা ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাওয়া অর্থাৎ আবার সেই স্কুল মাঠে সকাল-বিকাল খেলাধুলা নিয়ে মেতে থাকা আর নিয়মিত স্কুল করা। এরই মধ্যে একদিন সংবাদ পেলাম ফুটবল খেলার সরঞ্জাম নিয়ে স্টেডিয়ামে যেতে হবে। ঢাকা জেলা ফুটবল দল গঠন করার জন্য ট্রায়াল দিতে হবে। নির্দিষ্ট দিনে সময়মতো মাঠে উপস্থিত হয়েছিলাম। তখনও কারো কারো সাথে আমার তেমন জানাশোনা হয়ে ওঠেনি। একা একাই মনে হচ্ছিল নিজেকে। এমন সময় একজন ছোটখাটো ভদ্রলোক একটা ফাইল বগলদাবা করে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছিলেন আর হাঁকডাক করে সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিলেন। কে যেন একজন বলেছিল, উনিই সব। তিনি হলেন ওয়াদুদ চৌধুরী, নাটা চৌধুরী নামে যিনি অধিক পরিচিত ছিলেন। দু’দিন ট্রায়াল ম্যাচ খেলে ঢাকা দলে চান্স পেয়েছিলাম। জীবনের প্রথম টুর্নামেন্ট খেলা, তাও আবার ঢাকা জেলার পক্ষে। কারো সাথে এর আগে খেলিনি, তাই বুক কাঁপছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা। বিস্তারিতভাবে খেলার বর্ণনা দেয়া সম্ভব হবে না; তবে এটুকু মনে আছে। 
আমার স্বভাবমতো মাঠে বল নিয়ে বেশি বেশি ড্রিবলিং করছিলাম, ধরাও পড়ছিলাম, এ জন্য খেলার মাঝে নিজেদের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে বকাঝকাও শুনছিলাম। তারপরও মনে হয়েছিল আমি ভাল খেলছিলাম। হাফটাইম হলে আমরা মাঠের বাইরে এলাম। সেই ওয়াদুদ চৌধুরী সাহেব ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘বল এত হেড করলে, এত বেশি ড্রিবলিং করলে মাঠ থেকে বের করে দেব।’ খেলোয়াড়দের সামনে এমন অপমানজনক কথায় আমার খুব কান্না পাচ্ছিল তখন। আমার মন খারাপ দেখে ইউজিন দা, ছোটখাটো নাদুস-নুদুস চৌকস ফুল-ব্যাক আমাকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি তো ভাল খেলতেছো, খালি বলটা ছাইরা ছাইরা খেলবা, নিজের কাছে বল বেশি রাখবা না, বল দিয়া-নিয়া খেলবা, দেখবা আমাগো টিম অনেক ভাল খেলবো।’ কথাগুলো আজও মনে আছে। এর বেশি ঘটনা মনে করতে পারছি না।
পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলে খেলার স্বপ্ন এদেশের সব খেলোয়াড়ই দেখতো। পূর্ব পাকিস্তান দলে সুযোগ পাওয়া মনে হতো জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া। পাকিস্তান জাতীয় দলে চান্স পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ছিল সে সময়। আমার মতো একজন স্কুল ছাত্র, যে প্রথমবার ফার্স্ট ডিভিশনে খেলা শুরু করেছে, তার কাছে পূর্ব পাকিস্তান দলের ট্রায়ালে খেলার সুযোগটা ছিল অনেক বড় পাওয়া।
১৯৫৭ সালে ঢাকায় বসেছিল ন্যাশনাল ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের আসর। তখন স্টেডিয়ামপাড়ায় বেশ সাজ সাজ রব পড়ে গিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান স্বাগতিক প্রভিন্স হওয়ার সুবাদে দুটি দল গঠন করার সুযোগ পেয়েছিল। ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইট এবং ইস্ট পাকিস্তান গ্রীন দুটো টিম গঠন করা হয়েছিল সে বছর।
ঢাকা স্টেডিয়ামে সে সময় দুটি মাঠ তৈরি করা হয়েছিল, পশ্চিমদিকের গ্যালারি ঘেঁষে একটি মাঠ তৈরি করা হয়েছিল, সেটি ছিল মেইন ভেন্যু, যেখানে চ্যাম্পিয়নশীপের ম্যাচগুলোর খেলা হয়েছিল। পূর্বদিকের গ্যালারি ঘেঁষে মাঠটি তৈরি হয়েছিল অনুশীলনের জন্য। সেখানেই গ্রীন টিমের ট্রায়াল ম্যাচ হয়েছিল। তিনদিনের ট্রায়াল ম্যাচের প্রথম দিন আমি ভালই খেলেছিলাম। অনেকের কাছ থেকে প্রশংসাও পেয়েছিলাম। দ্বিতীয় দিনেও আস্থার সাথে খেলছিলাম। একটি বল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলামÑ এমন সময় সার্জেন্ট রহমান ছুটে এসে আমার বাম হাঁটুতে আঘাত করলে আমি পড়ে যাই। সার্জেন্ট রহমানের ‘মারু প্লেয়ার’ হিসেবে বেশ নামডাক ছিল, এটা আমি পরে শুনেছিলাম। মনে আছে, চুন্না রশিদ ভাই আমাকে হাত ধরে উঠিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয় করো না, আমি শালাকে মজা দেখাচ্ছি, তুমি খেলে যাও।’ কিন্তু আমার পক্ষে খেলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পায়ে ভীষণ ব্যথা হচ্ছিল, খেলতে না পারার দুঃখটা আরও বেশি হচ্ছিল। হতাশ হয়ে সেদিন বাসায় ফিরেছিলাম। পরদিন সকালেই আলু বাজার মান্ডার কাছে পৌঁছে তাকে অনুরোধ করে বলেছিলাম, আজই আমার পা ভাল করে দেন, বিকেলে আমাকে ফুটবল খেলতে হবে। মান্ডা আমার পা দেখে ওষুধ লাগিয়ে পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বললেন, সাতদিন বিশ্রাম নিয়ে তার কাছে যেতে। আমার গ্রীন টিমে খেলার স্বপ্ন মান্ডার দোকানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
দর্শক হিসেবেই ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপের খেলাগুলো দেখেছিলাম। ইস্ট পাকিস্তান গ্রীন টিমে আজাদ স্পোর্টিং কাবের হাবিব লেফট-ইন পজিশনে চান্স পেয়েছিলেন। ভাইস ক্যাপ্টেনও মনোনীত হয়েছিলেন। তার টিমে চান্স পাওয়াটা কেন জানি সহজভাবে নিতে পারিনি সে সময়। মনে হয়েছিল, যদি আমি পায়ে ব্যথা না পেতাম, তাহলে লেফট-ইন পজিশনে আমি চান্স পেতাম। আমি হয়তো খেলার সুযোগ পেতাম। নিজের অজান্তেই মনের ভেতর এমন একটা ঈর্ষার ভাব জন্মেছিল।
ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন সাহেব আলী ভাই। গোলরক্ষক (পাগলা) সাদেক, ফুলব্যাক জহির ভাই আর সাহেব আলী ভাই। হাফে কাশেম, তমিজ, গদাধর, ফরোয়ার্ড লাইনে সিগন্যাল দলের সগীর, ইপিআর-এর রফিক। পূর্ব পাকিস্তান গ্রীন টিমের প্রথম খেলা ভাওয়ালপুরের বিরুদ্ধে। ভাওয়ালপুর পাঞ্জাবের অংশ। এর খেলোয়াড়রা বেশ লম্বা-চওড়া, শক্ত-সামর্থ্য। গ্রীন টিম সেদিন ভাল খেলেছিল, বিশেষ করে জহির ভাই, তমিজ, হাবিব, রফিক ভাল খেলা প্রদর্শন করেছিল। শেষ পর্যন্ত ইস্ট পাকিস্তান গ্রীন টিম ১-২ গোলে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিল। 
ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইট টিম পূর্ব পাকিস্তানের এক নম্বর টিম। দেশের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত হয়েছিল এই টিম। প্রতিটি খেলোয়াড় নিজ নিজ পজিশনে ছিলেন দক্ষ ও চৌকস। গোলরক্ষকের দায়িত্ব ছিল দেশের সেরা দু’জন গোলরক্ষকের উপর রঞ্জিত দাস এবং মঞ্জুর হাসান মিন্টু। ফুলব্যাকে গজনবী এবং ইউজিন। এক হাফে আরজু, অন্য হাফে বগুড়ার শামছু এবং সেন্টার হাফে কৃতী খেলোয়াড় নবী চৌধুরী। রাইট আউটে মুক্তা ও লেফট আউটে শাহ আলম এবং দেশের বিখ্যাত ট্রায়ো কবির, আশরাফ, মারি ফরোয়ার্ড লাইনের প্রাণশক্তি হিসেবে ছিলেন। মুক্তা ভাই আজাদ স্পোর্টিং কাবে বরাবর রাইট ইন পজিশনে খেলতেন এবং ভাল খেলতেন কিন্তু এই চ্যাম্পিয়নশীপে তাকে রাইট-আউট পজিশনে খেলানো হয়েছিল হয়তো দলের শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তবে তিনি তার মান অনুসারে খেলতে পারেননি। দেশের বরেণ্য ফুটবলার মারি দা এই টিমের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই অনন্য ফুটবল খেলোয়াড়কে আমি অনুকরণ করতাম, তার মত খেলোয়াড় হতে চাইতাম। পরবর্তীতে সে সম্বন্ধে লেখার ইচ্ছে রয়েছে।
ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইট টিম ফাইনাল পর্যন্ত উঠেছিল এবং ফাইনালে পাঞ্জাব টিমের মুখোমুখি হয়েছিল। ফাইনাল খেলা দেখার জন্য এত দর্শক হয়েছিল যে, স্টেডিয়াম ভর্তি হয়ে মাঠে ঢুকে পড়েছিল দর্শক। কর্মকর্তারা হাত জোড় করে দর্শকদের মাঠের চারদিকের সীমানা দাগের (সাইড লাইন এবং গোললাইন) দূরে গিয়ে বসার অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু দর্শকরা কাছ থেকে খেলা দেখা এবং খেলোয়াড়দের দেখার সুযোগটা হারাতে রাজি ছিলেন না। এ পরিস্থিতিতে পাঞ্জাব দল নিরাপত্তার জন্য সেদিন খেলতে রাজি হয়নি। বাধ্য হয়ে কর্মকর্তারা সেদিনের ফাইনাল খেলা বাতিল করে পরদিন ফাইনাল খেলার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরদিনও স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। হোয়াইট টিম দুর্দান্ত খেলেছিল, প্রতিটি খেলোয়াড় প্রাণপণ দিয়ে এক অসাধারণ খেলা দর্শকদের উপহার দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাব দল ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইট টিমকে ১-০ গোলে পরাজিত করে স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শককে হতাশায় ডুবিয়ে ন্যাশনাল ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।
মান্ডার কথামত সাতদিন পরপর পায়ের ব্যান্ডেজ বদলাতে যেতে হতো। এভাবে পায়ের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। খেলাধুলা, দৌড়-ঝাঁপ বন্ধ। আড্ডা মারা এবং অন্যসব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়নি। রমজানের ছুটি। বিকেলে খেলাধুলার ছুটি হতো না, ফুটবল খেলা হতো। ইফতারের পর তারাবির আগে স্কুল বারান্দায় আড্ডাটা খুব জমতো। এই আড্ডাতেই অনেকের সিগারেট খাওয়ার হাতেখড়ি হয়েছিল। আমরা এখন সেয়ানা হয়েছি, ক’দিন পর মেট্রিক পরীক্ষা দেব, কলেজে পড়বো; সুতরাং আমাদের চালচলনেও পরিবর্তন আসছিল। আমার জীবনের প্রথম ও শেষ সিগারেট মুখে ছোঁয়াবার ঘটনাটিও ঘটেছিল এই স্কুল বারান্দায় এবং রোজার রাতে। আজাদ আমার হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলÑ টান দে। প্রথমদিকে গলা খুশখুশ করবে, পরে ঠিক হয়ে যাবে। আমি যেই না মুখে সিগারেটটা ঠেকিয়েছি, কেমন জানি একটা বিদঘুটে দুর্গন্ধ আমার নাকে এসে ঢুকেছিল। সাথে সাথে আমার ভেতর থেকে বমি উঠে আসছিল, দমটা বন্ধ হয়ে আসছিল। তাড়াতাড়ি হাতটা মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে দমটা ফিরে পেয়েছিলাম সেদিন। সিগারেট খাওয়ার  কথা উঠলেই নাকে সেই দুর্গন্ধটা পাই, যার জন্য সিগারেট খাওয়া আমার আর কোনদিন হয়নি, কোনদিন ইচ্ছেও হয়নি।
আমাদের গলিতে ইয়াসিন উকিল সাহেবের বাসার চম্পা কলাগাছের কলাগুলো বেশ নাদুস-নুদুস হয়েছিল, পাকবে পাকবে ভাব। কথাটা আড্ডায় পাড়তেই ঠিক হয়ে গেল ইয়াসিন উকিল সাহেব তারাবি পড়তে গেলে কলা চুরি করা হবে। যে-ই উকিল সাহেব বাসা থেকে বের হয়েছিলেন, অমনি ডাব্লুর ঘাড়ে কুদ্দুস চড়ে দেয়ালে উঠে পড়ল এবং কলার কাদিটা কেটে শফিকের হাতে ফেলে দিয়ে লাফিয়ে পড়লো রাস্তায়। মুশকিল হলো কলার কাঁদি নিয়ে। এটা কি করা হবে আগে ভাবা হয়নি। পাকা কলা হলে কিছু খাওয়া হতো আর বাকিগুলো বিলানো যেতো। কিন্তু কলাগুলো কাঁচা। তাড়াতাড়ি কলার কাঁদি নিয়ে আমার বাসার পাশে মাঠে ঢুকে পড়েছিলাম। মাঠে তখন গাছের ঝোপঝাড় ছিল, ওরই এক ঝোপের ফাঁকে কলার কাঁদি রেখে বেরিয়ে এসে হাঁফ ছেড়ে যেন বেঁচে ছিলাম সে রাতে। প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার পথে মাঠে ঢুকে, গাছের ঝোপের ফাঁকে কলাগুলো টিপে দেখতাম পেকেছে কিনা। যেদিন হাত দিয়ে বুঝতাম কলা পেকেছে, পটাপট ছিঁড়ে ফেলতাম আর মাঠে নিয়ে যেতাম। মনে হয় দু’একদিন কলা খেয়েছিলাম; বাকিগুলো সেখানে থেকে পচে গিয়েছিল। 
১৯৫৭ সালটা আমার জন্য যেমন বয়ে এনেছিল উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ, তেমনি আবার পায়ের আঘাতটা আমার খেলোয়াড়ী জীবনকে ঠেলে দিয়ে নিয়েছিল অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে।

(তের)
খেলাধুলার এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। যদিও ঘিরে থাকা বন্ধু-বান্ধবদের জন্য নিজেকে একেবারে একা মনে হতো না, তারপরও তাদের সাথে খেলায় অংশ নিতে না পারাটা আমাকে ভীষণ কষ্ট দিত। কখনও যদি খেলতে না পারি, খেলা যদি শেষ হয়ে যায়Ñ এমন কথা মনে হলেই অস্থির লাগতো, ছুটে মাঠে চলে যেতে ইচ্ছে হতো। খেলা নিয়ে যেতে থাকা যার নেশা, খেলা ছেড়ে বসে থাকা তার পক্ষে যে কত দুঃখের-কষ্টের, সেটা আমার চেয়ে বেশি কেউ বুঝতে পারবে না। সে সময় খেলার বিনিময়ে টাকা-পয়সা পাওয়া যেত না; তবে মনের যে আনন্দ পাওয়া যেত, সেটা কোন কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না। শুধু অন্তরের ুধা মেটাবার জন্য আমাদের এত পরিশ্রম করা। খেলার প্রতি এত ভালবাসা।
সকাল-বিকাল স্কুল মাঠের সিঁড়িতে বসে বসে খেলা দেখে আর স্কুলের সময় কাস করে দিনটা কাটিয়ে দিলেও সন্ধ্যার সময় কাটানো মুশকিল হতো। সন্ধ্যায় নিয়মিত স্কুলের পড়াশোনা করার অভ্যাস ছিল না। শুধুমাত্র পরীক্ষার আগে রাত জেগে পড়াটা নিয়মে দাঁড়িয়েছিল। মনটা খারাপ থাকলে সে সন্ধ্যায় বসে বসে পুরস্কার পাওয়া কাপ, শিল্ড আর সার্টিফিকেটগুলো নাড়াচাড়া করে দেখতাম, খেলতে না পারার কষ্টটা ভোলার চেষ্টা করতাম।
১৮-৪-৫৫ তারিখের সার্টিফিকেটটি ছিল ১৯৫৪-৫৫ সালে আরমানিটোলা গভঃ হাইস্কুলের বেস্ট হকি প্লেয়ার হিসেবে পাওয়া। ২-২-৫৬ তারিখের সার্টিফিকেট পাই জুনিয়র ক্যাডেট হিসেবে। ২১-৫-৫৭ তারিখের দুটি স্কুলের সার্টিফিকেট একটি ছিল ১৯৫৭ সালের বেস্ট হকি খেলোয়াড়, অন্যটি বেস্ট ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে পাওয়া। ১৪-৮-৫৭ তারিখের ইপিএসএফ (ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন) থেকে যে সার্টিফিকেটটি পেয়েছিলাম, সেটি ১৯৫৭ সালে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের পক্ষে ঢাকা হকি লীগ খেলায় অংশগ্রহণ করার সুবাদে। তখন ইপিএসএফ-এর সভাপতি ছিলেন আতাউর রহমান খান এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এস এ মহসিন। হকি সেকশনের চেয়ারম্যান ছিলেন লেঃ কর্নেল টি. ইসলাম এবং সম্পাদক এস এম দীন। তাদের সবার স্বাক্ষরযুক্ত সুন্দর একটি সার্টিফিকেট। ১৪-৮-৫৭ তারিখে ইপিএসএফ থেকে আরও একটি সার্টিফিকেট যা ১৯৫৭ সালে ‘পাকিস্তান ডে ফুটবল টুর্নামেন্টে’ অংশগ্রহণ করার জন্য পেয়েছিলাম।
আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী যে, আমার হাঁটুর আঘাতটা খুব গুরুতর ছিল না। দু’মাসের মত মান্ডার মালিশ করে আর ব্যান্ডেজ বদলানোর মাধ্যমে আঘাতটা সেরে উঠছিল। এদিকে শীত মৌসুম কাছাকাছি চলে আসছিল, মনটাও মাঠে নামার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। স্কুল মাঠ ভরে উঠতে শুরু করেছিল খেলোয়াড়দের ভিড়ে। আল্লাহর নাম নিয়ে একদিন আমিও মাঠে নেমে পড়েছিলাম। 
প্রথম প্রথম বেশ ভয় হতো স্লো রানিং করতাম, ধীরে ধীরে ফিজিক্যাল ফিটনেসের জন্য ব্যায়াম করতাম। এরই ভেতর দিয়ে শুরু করেছিলাম অ্যাথলেটিক্স অনুশীলন এবং নিজেকে তৈরি করেছিলাম আসন্ন স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার মত করে। সকালে প্র্যাকটিস করার পর চলে যেতাম অবনীর মিষ্টির দোকানে। অবনী আমাদের স্কুলে টিফিন সাপ্লাই দিতেন। গত বছর আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমি ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আমাদের গেম টিচার আবদুর রশীদ স্যার আমার জন্য অবনীর দোকানে সকালে প্র্যাকটিসের পর নাস্তা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। অবনীর মিষ্টির দোকান বিটিফিল্ডের দক্ষিণ দিকে আরমানিটোলা বটগাছের কাছে, বর্তমানে জগন্নাথ কলেজের ছাত্রাবাস আব্দুর রহমান হলের গেট ঘেঁষে কাঠের একটি দোতলা। নিচে দোকান, উপরে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা। ঐ দোতলাতে থাকতো গনেশ, অবনীর ভাইপো, আমাদের কাসফ্রেন্ড। লুচি আর মালাই (দুধের সর) আজও যেন আমার জিহ্বায় লেগে রয়েছে- এটা ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় নাস্তা। তাছাড়া ছিল লুচি,  মোহনভোগ, হালুয়া, লুচি পানতোয়া, পরোটা ভাজি। অবনীর দোকানের নাস্তা। স্কুলের তরফ থেকে আমার মত এরকম সুযোগ অন্য কোন ছাত্র কোনদিন পেয়েছিল কিনা আমার জানা নেই।
আরমানিটোলা স্কুলে আমার শেষবারের মত ক্রীড়াপ্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার তারিখটি ছিল ১৯/১/১৯৫৮। আমার মূল ইভেন্ট ছিল তিনটি জাম্প। হাঁটুতে আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা এতে বেশি, তাই প্রতিটি ইভেন্টে ভয় হতো, বিশেষ করে হপ-স্টেপ এন্ড জাম্প, শরীরের সমস্ত ভার এবং শক্তি হাঁটুকে সামলাতে হয়। এ জন্য একটু বেশি ঘাবড়েছিলাম সেদিন। আল্লাহতালা অনেক বড় মেহেরবান, তিনটি জাম্প, ডিসকাস থ্রো এবং ৮৮০ গজ দৌড় প্রত্যেকটিতে প্রথম হয়ে আরও একবার (পরপর তিনবার) ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম।
আরমানিটোলা স্কুলের একটি ছোটখাটো দল নিয়ে ১৯৫৮ সালের ২৭ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ মাঠে জড়ো হয়েছিলাম। এবার শুধু আমি একা ক্রীড়া প্রতিযোগী ছিলাম না। স্কুলের আরো কয়েকজন অ্যাথলেট আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার উদ্দেশ্যে হাজির হয়েছিল। তাছাড়া বন্ধুবান্ধব, স্কুলের ছাত্র, কয়েকজন স্যার মিলে মাঠে একটা দল হিসেবেই মনে হচ্ছিল। গত বছর এই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় আমার দায়িত্ব যেমন বেড়ে গিয়েছিল, তেমনি বুকের ডিপ্ডিপিটাও বেড়ে গিয়েছিলÑ এবার কি চ্যাম্পিয়নশীপের মর্যাদা রক্ষা করতে পারবো?
আমার প্রথম ইভেন্ট লংজাম্পে প্রথম স্থান অধিকার করলে দলের সবাই আনন্দ-উল্লাস করে। আমার দ্বিতীয় ইভেন্ট হাইজাম্প শেষ হওয়ার আগেই ডিসকাস থ্রো শুরু হয়ে যায়। যার দরুন আমাকে একবার থ্রো দিয়ে আবার হাইজাম্পে ফিরে আসতে হতো। হাইজাম্পের আগেই ডিসকাস থ্রোর রেজাল্ট পেয়েছিলাম, সেটাতেও প্রথম। এবার আমি কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম, হাইজাম্পে প্রথম হতে না পারলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। প্রত্যেকটা জাম্প আল্লার নাম নিয়ে দিচ্ছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ আমার মান রেখেছিলেন আর এরই সাথে আমি চ্যাম্পিয়নশীপের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম। হপস্টেপ এন্ড জাম্প আমার প্রিয় ইভেন্ট এবং সেটাতেও প্রথম হয়ে ঢাকা সিটি আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয়বারের মত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। স্কুলের যারা সেদিন মাঠে উপস্থিত ছিল, সবাই খুশীতে হৈহুল্লোড় করতে আরম্ভ করে দিয়েছিল কিন্তু আমাদের গেম টিচার রশীদ স্যারকে দেখা যাচ্ছিলো না। তিনি তখন ব্যস্ত, ছুটোছুটি করছিলেন। তার ব্যস্ততার মর্ম  বোঝা গিয়েছিল পুরস্কার বিতরণীতে। ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশীপ, আমার নাম ঘোষণার পরপরই ঘোষণা করা হলোÑ সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পেয়ে সব স্কুলের মধ্যে আরমানিটোলা গভঃ হাইস্কুল  চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।
এই এনাউন্সমেন্টের সাথে সাথে সেদিন মাঠে উপস্থিত স্কুলের সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়ে নাচতে শুরু করে দিয়েছিল। এরই মধ্যে নিজেকে এক বন্ধুর কাঁধে আবিষ্কার করেছিলাম। চেয়ে দেখি আমাদের গেম টিচার রশীদ স্যারকে কয়েকজন ছাত্র মিলে উপরে তুলে ধরে জয়োধ্বনি দিচ্ছিলÑ ‘আরমানিটোলা স্কুল জিন্দাবাদ, রশীদ স্যার জিন্দাবাদ’।
আনন্দ আর হৈচৈ করতে করতে সদলবলে আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ মাঠ থেকে আরমানিটোলা মাঠের পাশে হেডমাস্টার শামসুদ্দিন স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম সুসংবাদটা জানাবার উদ্দেশ্যে। আমাদের গেম টিচার রশীদ স্যারই দিয়েছিলেন সংবাদটা এভাবে যেÑ স্যার, এবারও বশীর ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং আমাদের স্কুল সব স্কুলের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
ভেবেছিলাম এমন একটা আনন্দের সংবাদ শুনে হেড স্যার উল্লসিত হয়ে উঠবেন, কিন্তু হেড স্যারের মধ্যে খুশির কোনো ভাব দেখা যায়নি সেদিন শেষ বিকালে। উপরন্তু আমাদের অবাক করে তিনি বলেছিলেন, ‘সন্ধ্যা হচ্ছে, বাসায় যাও, পড়তে বসো’। আমাকে দেখিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ও তো পাস করবে না’। এমন একটা সুন্দর মুহূর্তে হেড স্যারের এরকম বিরূপ মন্তব্য আমাদের সবার আনন্দটাকে মাটি করে দিয়েছিল। আমরা হতাশ হয়ে যে যার বাসায় ফিরে গিয়েছিলাম। হেড স্যারের অভিনন্দন পাওয়ার আশায় গিয়ে পেয়েছিলাম তার অভিশাপ! তার এ মন্তব্য আমি আজও ভুলতে পারিনি। আমাদের শামসুদ্দিন আহমেদ হেড স্যার শিক্ষাঙ্গনে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন, আর আরমানিটোলা গভ. হাইস্কুলে ছিলেন পূজনীয়! কিন্তু আমি কোনোদিন তাঁকে আমার অন্তরের সম্মানিত স্থানে বসাতে পারিনি।
হকি ও ক্রিকেট এরই মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিল। খেলা দুটোর সাথে নিজেকে দ্রুত খাপ খাওয়াতে পেরেছিলাম; কারণ আমার গৎবাঁধা অনুশীলন। সারাবছর সকাল বেলা দৌড়ানো, পিটি করা আর বিকেলে সিজনের যে খেলা, সেটা খেলা। শুধু অ্যাথলেটিক্স কমপিটিশনের সময় অতিরিক্ত অ্যাথলেটিক্স প্র্যাকটিস করা। সে সময় বড়দের কাছে শুনতামÑ দম থাকলে যে কোন খেলা খেলতে পারা যায়। তখন আমরা বুঝতাম দৌড়ের মাধ্যমে দম বাড়ানো যায়, তাই বেশি বেশি দৌড়াতাম। পিটি করে ফিট থাকা যায়, তাই পিটি করতাম। বর্তমানেও ফিজিক্যাল ফিটনেসকে সব খেলার ভিত হিসেবে ধরা হয়ে থাকে আর এই ফিটনেস কয়েকটি ট্রেনিং-এর মিলিত অর্থে বোঝালেও আমরা সে সময় ব্যায়ামের মাধ্যমে ফিজিক্যাল ফিট রাখা যায়Ñ এটাই বুঝতাম। সে জন্য হকি এবং ক্রিকেট দুটো খেলা চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম সে সময়।
১৯৫৮ সালের হকি লীগেও আমি ভিক্টোরিয়া কাবের পক্ষে অংশগ্রহণ করেছিলাম আর এটা ছিল আমার দ্বিতীয় বছর। গত বছরের খেলোয়াড়দের সাথে নতুন কয়েকজনকে নিয়ে দল গঠন করা হয়েছিল। বরাবরের মত এবারও মধ্যম সারির দল হয়েছিল আমাদের। বেশিরভাগ খেলোয়াড় তরুণ। খুব স্পিরিটেড দল। লীগের প্রতিটি দল আমাদের সমীহ করতো মাঠে; কারণ প্রত্যেকটি দলের সাথে আমরা জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতাম, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেই শক্তিশালী দলগুলোকে জয়ী হতে হতো। আমাদের দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে গোলরক্ষক নূরুল ইসলাম, ফুলব্যাক নীলু ও হক। রাইট হাফ মোমেন, সেন্টার হাফ সালাম এবং লেফট হাফ জামাল, রাইট আউট মোদাশ্বের, রাইট ইন নূরুল হাসান, সেন্টার ফরোয়ার্ড আলমগীর, লেফট-ইন বশীর ও লেফট আউট রুমা। আমাদের রাইট ইন নূরুল হাসান সম্বন্ধে কিছু না বললেই নয়। সে নবাব বাড়ির ছেলে, খুবই বিনয়ী, নম্রভদ্র এবং ধিরস্থির। তার এক চোখ নষ্ট ছিল কিন্তু তার স্টিক ওয়ার্ক ছিল দেখার মত। খেলার সেন্স ছিল অদ্ভুত। শুধুমাত্র নরম স্বভাব এবং ভীতু হওয়ায় সে বেশিদূর যেতে পারেনি।
আমাদের ফুলব্যাক খাজা ফজলুল হক, তিনিও নবাব বাড়ির, দাড়িওয়ালা মৌলভী সাহেব, কোনদিন তাকে হাফপ্যান্ট পরানো যায়নি। যতনি খেলেছেন পায়জামা পরে খেলেছেন। পজিশন জ্ঞান এবং রিকভারিং ছিল দুর্দান্ত, সাউন্ড ফুলব্যাক ছিলেন। তার একটা পুরাতন সাইকেলে চড়ে মাঠে আসতেন, আল্লাওয়ালা একজন ভদ্রলোক। সবার সাথে কি মিষ্টি ব্যবহার ছিল তার! আরমানিটোলা স্কুলের প্রাক্তন তিন ছাত্র নীলু, মোমেন আর সালাম। তাদের টাফ খেলা আমাদের ডিফেন্সকে দুর্গ বানিয়ে রাখতেন, যার দরুন আমরা উপরে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে পারতাম।


(চৌদ্দ)
রেমন্ড এবং ডোনাল্ড (ডনি) দুই ভাই সে সময় আমাদের  সাথে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবে খেলতো। বাঙালি এ্যাংলো। রেমন্ড লম্বা-চওড়া, কালো; মুখে বসন্তের দাগ। ফুলব্যাকে দাঁড়ালে তাকে মানানসই একজন খেলোয়াড় হিসেবে মনে হতো। ডনি একটু নাদুস-নুদুস সেন্টার ফরোয়ার্ডের খেলোয়াড়। খুব আমুদে, প্রাণবন্ত, কাব মাতিয়ে রাখতো। আমাদের রাইট আউট খেলোয়াড়ও ছিল নবাববাড়ির, নাম মোদাশ্বার। বিপক্ষ দলের লেফট হাফকে ফাঁকি দিয়ে লাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে মাপা ক্রস করতো। তার স্টিকের কারুকাজ করার  চেয়ে শরীরের মুভমেন্ট দিয়ে বিপক্ষ খেলোয়াড়দের ভেলকি দিতে দক্ষ ছিল বেশি। রুমা ছিল আমাদের লেফট আউট। পাঁচ ফিটের বেশি হবে না, গুল্লির মত দৌড়াতো। সে সময় লেফট আউট পজিশনের দক্ষ খেলোয়াড়ের অভাব ছিল। যারা একটু দ্রুতগতির খেলোয়াড়, তাদেরকে লেফট আউটে খেলিয়ে ঐ পজিশনটা পূরণ করা হতো। রুমা তার গতির সদ্ব্যবহার করতো ঐ পজিশনে খেলে।
হকি অঙ্গনে আমার বিচরণ খুব বেশিদিনের না হওয়ায় সব দল এবং তাদের খেলোয়াড়দের সম্বন্ধে লেখার মত অভিজ্ঞতা তখনও আমার হয়ে ওঠেনি। মূলত দু’বছরে কয়েকটি কাব সম্বন্ধে যতটুকু জেনেছিলাম এবং তাদের খেলোয়াড়দের যতটুকু দেখার সুযোগ হয়েছিল, তারই আলোকে কিছু তথ্য এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সে সময় অনেকের খেলা আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল, অনেকের খেলা আমাকে ভাল খেলার জন্য প্রভাবিত করেছিল, অনেক খেলোয়াড়/কাব কর্মকর্তা আমাকে প্রেরণা জুগিয়েছিল আবার খেলোয়াড়দের মাঝে অনেকের আচার-ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
পাড়াভিত্তিক দল হিসেবে পাকিস্তান স্পোর্টিং কাব বেশ শক্তিশালী হকি দল ছিল। পাকিস্তান মাঠকে (বর্তমান বাংলাদেশ মাঠ) কেন্দ্র করে এলাকার ক্রীড়ামোদী মানুষ এবং খেলোয়াড়দের দ্বারা গঠিত কাবটি হকি ফুটবল ক্রিকেট সব ধরনের খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। আমার যতদূর মনে পড়ে, তারা ১৯৫৭ সালে হকি লীগে রানার্সআপ হয়েছিল। তাদের হকির গোলরক্ষক মোমতাজ খুব ডেয়ারিং গোলকিপার ছিল। গোল বাঁচাতে গিয়ে একবার তার সামনের সারির কয়েকটা দাঁত হারিয়েছিল। নাসির ভাই হাফের খেলোয়াড়, স্টিক ওয়ার্ক ভালো, গোছানো খেলা, শান্তশিষ্ট মানুষ, দলকে নেতৃত্ব দিতেন, দলকে আগলে রাখতেন। মজিদ হকি এবং ফুটবল দু’খেলাতেই সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে সুনামের সাথে খেলতো। কানু এবং মোমতাজ ফুলব্যাক, মারু প্লেয়ার। মোমতাজ পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তান হকি দলের নির্ভরশীল ফুলব্যাক হিসেবে স্থান করে নিয়েছিল। বর্তমানে সে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে।
চ্যাম্পিয়নশীপ ফাইট দেয়ার মত শক্তিশালী দল পিডব্লিউডি। তাদের প্রায় সব খেলোয়াড়ই ছিল অবাঙালি। তাদের নির্ভরযোগ্য ফুলব্যাক ছিল আইয়ুব। স্টিক যেমন চলতো সমানে, মুখও চলতো তেমনি। খাজা হাবিবুল্লাহ রাইট হাফে খেলতো, স্টেডি খেলোয়াড়Ñ মুখে তার হাসি লেগেই থাকতো। পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তান হকি দলে স্থান করে নিয়েছিল। সিরাজী নামে একজন ইঞ্জিনিয়ার খেলতেন সেন্টার হাফ পজিশনে। তার খেলায় তার পেশার প্রভাব লক্ষ্য করা যেত। সোলেমান খেলতো লেফট হাফ পজিশনে, খুব গোঁয়ার টাইপের খেলোয়াড়। গায়ের জোরে যেমন খেলতো, তেমনি মুখেও খেলতো। শের খান ও কুতুব যত না খেলতো, তারচেয়ে বেশি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের উত্ত্যক্ত করতো। তাদের রাইট আউটে খেলতেন নেওয়াজ। ভদ্রলোক মানুষ, চুপচাপ খেলতেন, সুন্দর খেলতেন। তার সুন্দর ব্যবহার ছিল সবার কাছে প্রশংসনীয়। ১৯৭১ সালে তিনি নিহত হন।
আমি ভিক্টোরিয়া কাবে অংশগ্রহণ করার পর থেকে পিডব্লিউডি কাবের সাথে একটা বৈরী সম্পর্ক লক্ষ্য করে আসছিলাম। এই দুই কাবের যখনই খেলা হতো, মাঠে একটা অঘটন ঘটতোই। ঝগড়া-মারামারি-খেলা পন্ড এটা বোধহয় নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। খেলার সাথে মাঠে অনবরত তর্কবিতর্ক, গালাগাল চলতে থাকতো। এ ব্যাপারে পিডব্লিউডি কাবের আইয়ুব, সোলেমান আর আমাদের সালাম ভাই প্রধান ভূমিকা পালন করতেন। আমরা যারা এগুলোর মধ্যে থাকতাম না, আমাদের হতো বিপদ; সারাক্ষণ আতংকের মধ্যে খেলতে হতোÑ এই বুঝি স্টিকটা পায়ে এসে পড়লো। ভিক্টোরিয়া এবং পিডব্লিউডি কাবের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল তা আমার একটা খেলার ঘটনা উল্লেখ করলেই সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সেদিন স্টেডিয়ামে আমাদের খেলা ছিল। বিপক্ষ দল মাঠে উপস্থিত না হওয়াতে আমরা ওয়াকওভার পেয়ে নিজেদের মধ্যে প্র্যাকটিস করছিলাম। ঐদিন আউটার স্টেডিয়ামের খেলায় পিডব্লিউডিও ওয়াকওভার পেয়েছিল। কর্মকর্তারা স্টেডিয়ামে এই দু’টিমের মধ্যে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলার আয়োজন করেছিলেন। এ দু’টিমের খেলা মানেই উত্তেজনা। প্রথম থেকেই খেলা জোর প্রতিদ্বদ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। একটু পরই শুরু হয়ে গিয়েছিল মুখে মুখে খেলা; তারপর স্টিকে স্টিকে খেলা, এরপরই দু’টিমই তাদের স্বরূপে নেমে এসেছিল। শেষ পর্যন্ত মারামারিতে খেলা পন্ড। ফ্রেন্ডলি ম্যাচেও সেদিন উপস্থিত কর্মকর্তা এবং দর্শক খুঁজে পায়নি এই দু’টিমের ফ্রেন্ডলি আচরণ।
গায়ের শক্তি প্রয়োগ করে খেলার বদনাম সব নিরাপত্তাবাহিনীর। হকি খেলাতে ইপিআর দলও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বেশ শক্তিশালী দল ছিল, লীগ চ্যাম্পিয়নশীপের লড়াই প্রতিবছর করতো। তাদের ফুলব্যাক সাঈদ খুবই রাফ খেলতো। তার সম্বন্ধে বলা হতো, সাঈদ মানুষের ছায়া দেখলেই স্টিক চালাতো। তার স্টিকের আঘাত পায়নিÑ এমন হকি খেলোয়াড় সে সময় খুব কম ছিল। এর থেকে আমিও রেহাই পাইনি। যেই না তাকে কাটিয়ে বল নিয়ে এগিয়েছিÑ ব্যস, সাইড থেকে স্টিক এসে পড়লো দুই হাঁটুর একটু নিচে, সাথে সাথে বসে পড়লাম। সেই আঘাতের চিহ্ন আজও বহন করে চলেছি। হাত দিলেই অনুভব করি সিন বোনে একটু উঁচু হয়ে থাকা আঘাতটা। হাফিজ, তাদের সেন্টার হাফ, যাকে সম্মান করে সবাই বলতো হাফেজী। অনেকে বলতো তিনি কোরানে হাফেজ। ইয়া ঢোলা খাকী হাফ প্যান্ট পরে খেলতেন। ধীরে ধীরে খেলতেন। তার এন্টিসিপেশন জ্ঞান খুব চমৎকার ছিল, ডিস্ট্রিবিউশনও ভাল ছিল। তার একটি ভঙ্গি আজও চোখে ভাসে, ট্যাকলিং করার পূর্বে তিনি স্টিক দিয়ে এমন একটি ভঙ্গি করতেন যাতে বিপক্ষ খেলোয়াড় বল তাড়াতাড়ি রিলিজ করতে গিয়ে ভুল করে ফেলতো আর সে ভুলের ফায়দা নিতেন হাফেজী। ইপিআর দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড ওসমান এবং লেফটআউট আখতার অনেক উঁচু মানের খেলোয়াড় ছিল। ইস্ট পাকিস্তান দলে দুজনেই সুনামের সাথে খেলেছে।
রেলওয়ে দল খুব ব্যালেন্স টিম ছিল। সব পজিশনের খেলোয়াড় ভাল ছিল। বেশ কম্বাইন্ড দল। নবী তাদের গোলরক্ষক, দীর্ঘদিন খেলেছে। ফুলব্যাক কুদ্দুস, খাটো গড়ন, খুব স্টেডি, ক্ষিপ্রতার সাথে ট্যাকলিং করা, খেলা ছিল বেশ পরিচ্ছন্ন। সেন্টার হাফ নিয়াজ, পাতলা গড়ন, স্টিকওয়ার্ক ছিল দেখার মত, সারামাঠ ছুটাছুটি করে খেলতো। কলিম এবং আবিদ হাফের নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় ছিল। আক্রমণভাগের প্রাণশক্তি ছিল তাদের ট্রায়ো। লেফট ইন জহির সেন্টার ফরোয়ার্ড মুঈদ, রাইট ইন কাইফুলÑ এদের সম্মিলিত আক্রমণই তাদের শিরোপা জয়ের প্রধান উৎস ছিল। মনে আছে, এদের রাইট আউট খুরশীদকে নিয়ে সবাই হাসি-তামাশা করতো, তোতা বলে ডাকতো; কারণ খুরশীদের নাক ছিল লম্বা এবং আগাটা একটু বাঁকানো, অনেকটা টিয়া পাখীর মত। সে নিজেও ছিল খুব রসিক।
অন্যান্য কাবেরও বেশ কিছু খেলোয়াড় সে সময় আমার কাছে ভাল লেগেছিল। তাদের কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করছি। ফ্রান্সিস ওয়ারীর গোলরক্ষক। ফ্রান্সিস ও আমি ঢাকা স্পোর্টিং কাবে ফুটবল খেলেছিলাম। খুব স্টাইলিশ ফুটবলের সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিল। পিডব্লিউডি দলের গোলরক্ষক ইলিয়াস, পুলিশের মান্নান, ফুলব্যাক খাজা ফরিদ, হাফে জিয়া।
লীগের শেষ ম্যাচ ভিক্টোরিয়া বনাম ইপিআর। তারিখটা ছিল ১৫-৫-৫৮। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং উত্তেজনাপূর্ণ খেলা ঢাকা স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকরা উপভোগ করেছিল সেদিন। শেষ পর্যন্ত আমরা ০-১ গোলে পরাজিত হয়েছিলাম। ইপিআর টিম ১৯৫৮ সালের হকি লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।   


(পনের)
‘আতিক উল্লাহ কাপ’ একটি ঐতিহ্যবাহী হকি নকআউট টুর্নামেন্ট। ফুটবলে যেমন ‘আগাখান গোল্ডকাপ’। ঢাকার একমাত্র হকি টুর্নামেন্ট যার পৃষ্ঠপোষক ছিলো ঢাকার নবাব পরিবার। বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে রমণীয় নবাববাড়ি ‘আহসান মঞ্জিল’ ছাড়াও ঢাকার আশপাশে নবাবদের অনেক কুঠিবাড়ি, বাগানবাড়ি ছিল। দিলকুশায় তেমনি একটি কুঠিবাড়ি ছিল। বঙ্গভবনের উত্তর দিকের সীমানা ঘেঁষে বর্তমানে ডিআইটি বিল্ডিং, জীবন বীমা ভবন, সোনালী ব্যাংক বৈদেশিক শাখা, কৃষি ভবন, আরও কিছু বর্তমানের বিল্ডিং নিয়ে বিশাল জায়গা জুড়ে ছিল দিলকুশার কুঠিবাড়ি। ভেতরে বিরাট বিরাট গাছপালা দিয়ে ঘেরা ছিল, বড় একটি পুকুর ছিল যাতে একটি কুমিরও ছিল। পশু-পাখি পোষা ছিল নবাবদের সখ। একসময়ের ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ছিলেন খাজা মোহাম্মদ আজম। তিনি ঐ দিলকুশার কুঠিতে বসবাস করতেন। তাই জনসাধারণের নিকট সেই কুঠি ‘আজম মিয়ার কুঠি’ বলে পরিচিতি পেয়েছিল। নবাবজাদা আতিকুল্লাহ দিলকুশার কুঠিতে থাকতেন। তারই নামে হকির এই টুর্নামেন্ট। তারই নিকটাত্মীয় হকির সংগঠক খাজা মোহাম্মদ আজমলের উদ্যোগে আতিকউল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্ট প্রবর্তন হয়েছিল ১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে।
১৯৫৮ সালের ‘আতিক উল্লাহ কাপ’ হকি টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা। ঢাকা স্টেডিয়ামে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব মুখোমুখি হয়েছিল শক্তিশালী ইপিআর হকি টিমের। মাত্র একদিন পূর্বে লীগের শেষ খেলায় ইপিআর হকি টিম আমাদের ভিক্টোরিয়া কাবকে এক গোলে পরাজিত করে লীগ শিরোপা অর্জন করেছিল। স্বাভাবিক কারণেই তারা মানসিকভাবে অনেক চাঙ্গা ছিল, তার উপর তাদের দলের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল লীগে অংশগ্রহণকারী তাদেরই অন্য একটি টিম ‘সিগন্যাল উইংস’-এর ভাল ভাল খেলোয়াড়কে দলে ভিড়িয়ে। অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে আমাদের টিম কিছুটা দুর্বল, তাছাড়া গতদিন লীগের খেলায় হেরে মানসিক দিক দিয়েও ছিলাম চাপের মধ্যে। তার উপর আমাদের নিয়মিত লেফট আউট রুমা অসুস্থ, খেলতে পারবে না। এ সংবাদটা আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলেছিল। মূলত কাবের হকির ব্যাপার বরাবর মোমিন ভাই দেখতেন। সেদিনের এমনি একটি পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি অস্থির হয়ে এদিক-সেদিক খেলোয়াড়ের খোঁজ নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ডিএনফা মটরস-এ চাকরিরত জালাল নামে একজন খেলোয়াড়ের সংবাদ পেতে তিনি কাব থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন সেই দুপুরে। জালাল লাঞ্চে বেরুচ্ছিল, মোমিন ভাই তাকে খেলার জন্য অনুরোধ জানালে সে রাজি হয়েছিল কিন্তু খেলার ‘কিট’ তার ছিল না। মোমিন ভাই জালালকে  ‘লা-সানি’ রেস্টুরেন্টে স্যান্ডউইচ খাওয়ালেন এবং পাশেই ছিল ‘ইপরোয়া টেন্ট (ইস্ট পাকিস্তান রেফারি এন্ড আম্পায়ার এসোসিয়েশন)। সেখানে নিয়ে গিয়ে একটি হাফ প্যান্ট (তার মাপের) জোগাড় করেছিলেন আর সে প্যান্টটি ছিল ক্রিকেট আম্পায়ার বাদশা সিরাজীর। এদিকে খেলার সময় ঘনিয়ে আসছিল, তার সাথে কাবে উপস্থিত সবার হার্টবিটও বাড়ছিল। কারণ তখনও মোমিন ভাইয়ের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর জালালের লাল রঙের মোটরসাইকেলে চড়ে কাব টেন্টে তারা ফিরে এলে সবাই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। মাঠে যাওয়ার আগে আরও একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল জালালের কেডস নিয়ে। কাবে উপস্থিত কারও খেলার কেডস তার পায়ে লাগছিল না। জালাল ছিল বেশ লম্বা-চওড়া একজন সুদর্শন পুরুষ কেডস ক্রয় করে আনারও সময় ছিল না। অগত্যা তাকে খালি পায়েই ফাইনাল খেলা খেলতে হয়েছিল। সে সময় খেলার জুতা পরে খেলা বাধ্যতামূলক ছিল না। খেলার আইন অনেকটা শিথিল ছিল।
এ মুহূর্তে জালালের জড়িত থাকা একটি মারাত্মক দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলÑ যার বর্ণনা সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরছি। জালালের আসল নাম  জালাল আল কারিমী, আগা-খানী। পরবর্তীতে পিআইএতে (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স) স্টুয়ার্ট হিসেবে চাকরিতে যোগ দিয়েছিল। ঢাকা-কায়রো সরাসরি (পিআইএ) বিমান চলাচলের লক্ষ্যে ১৯৬৫ সালের ২০ মে উদ্বোধনী ফাইটটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। সে প্লেনে জালাল কর্মরত ছিল। পাকিস্তানের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খানের জ্যেষ্ঠ পুত্র আখতারুজ্জামান বাচ্চু ঐ প্লেন-ক্র্যাশে নিহত হয়েছিলেন। প্রায় আড়াইশ’ যাত্রী এবং ক্রু’র মধ্যে মাত্র আঠারোজন বেঁচেছিলেন। জালালও বেঁচে যাওয়া সৌভাগ্যবানদের একজন। জালাল বিধ্বস্ত বিমান থেকে বের হয়ে অন্য দু’জন যাত্রীকে মুমূর্ষু অবস্থায় প্লেন থেকে টেনে বের করে বাঁচিয়েছিল। তার সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার প্রশংসা ছাপা হয়েছিল। জালাল আমাদেরই একজন হকি খেলোয়াড়, তার এরূপ মহৎ এবং প্রশংসনীয় কাজের জন্য সেদিন আমরাও গর্ব অনুভব করেছিলাম। ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রচুর দর্শক এসেছিলেন আতিক উল্লাহ কাপ হকি টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা দেখার জন্য। ইপিআর এবং সিগন্যাল উইংস-এর অফিসার এবং জোয়ানরা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মাঠে উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের দলকে উৎসাহ জোগাতে। আমাদের সমর্থকও নেহায়েত কম ছিল না। খেলা শুরু হলে সবার উৎসাহ আর চিৎকারে প্রথম থেকেই উত্তেজনা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খেলা জমে উঠেছিল। মাঠে দর্শকদের মাঝে দুটো ভাগ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। ইপিআর জোয়ান এবং সাধারণ দর্শক। ইপিআর দল বল ধরলে জোয়ানরা গ্যালারি থেকে চিৎকার করে মাঠ মাথায় তুলে দলকে সমর্থন জোগাচ্ছিল। মাঠে অবশিষ্ট দর্শকরা আমাদেরকে সমর্থন জানাচ্ছিলেন। ইপিআর টিমের সাথে আমরাও আস্থার সাথে সমানতালে খেলছিলাম। বিপক্ষ দলের রক্ষণব্যুহ ছিল খুবই মজবুত, বিশেষ করে ফুলব্যাকদ্বয় খুবই হার্ডহিটার এবং রাফ স্টিক চালিয়ে আমাদেরকে কাছে ভিড়তে দিচ্ছিল না। এ পরিস্থিতিতেও নূরুল হাসান এবং আমি, দুই ইন সুন্দর সুন্দর পাস আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড আলমগীর ভাইকে সরবরাহ করে যাচ্ছিলাম কিন্তু তিনি সেগুলোর কোনটারই সদ্ব্যবহার করতে পারছিলেন না। উল্টো ইপিআর দল একটি সম্মিলিত আক্রমণের মাধ্যমে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ওসমান দক্ষতার সাথে একটি গোল করে দলকে প্রথমার্ধে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। গোল  করার পর ইপিআর দলের খেলার ধারা বদলে যায়। অনেকটা গায়ের জোরে রাফ এবং টাফ খেলা শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু নূরুল হাসান এবং আমি বল কন্ট্রোলিং ও স্টিক ওয়ার্কের সাহায্যে নিজেদের মধ্যে বল আদান-প্রদান করে খেলে তাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলাম। ইপিআর দলের রাফ খেলাকে উপেক্ষা করে সেদিন আমরা দু’জন বল নিয়ে দ্রুত গতিতে তাদের সীমানায় ঢুকে ডিফেন্সকে তছনছ করে দিচ্ছিলাম। পত্রিকার ভাষায় যা ছিল অবাক করার মত আক্রমণ। একের পর এক আক্রমণকে দীর্ঘ সময়ের জন্য আটকানো তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এরই মধ্যে আমাদের রাইট আউট মোদাশ্বের বল নিয়ে ক্ষিপ্রতার সাথে রাইন ফ্যাংকে গিয়ে ক্রস করলে আমি ডি-এর ভেতর বল রিসিভ করেই গোলপোস্টে স্কুপ করেছিলাম। তাদের গোলরক্ষক রেজা বল প্রতিহত করার কোন সুযোগ পায়নি। খেলা ১-১ গোলে ড্র। গোল করার পর আমাদের টিম আস্থার সাথে খেলতে থাকে। আমাদের সমর্থকরাও বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠে। আমাদের কাছে বল আসলেই মাঠের চারদিক থেকে সমর্থকদের উচ্চস্বরে চিৎকার আমাদের উৎসাহ জোগাতো। আবার ইপিআর দল বল ধরলেই জোয়ানরা সাবাস সাবাস বলে তাদের দলকে উৎসাহ দিত। খেলার মাঝে একটি ব্যাপার লক্ষ্য করছিলাম যে, দু’দলের সাপোর্টাররা আমাকে সাপোর্ট করছেন, আমার নাম ধরে উৎসাহ দিচ্ছেন। পরে তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, আমি বল ধরলে বশীর বশীর বলে চিৎকার করে উৎসাহ জোগাচ্ছিল আমাদের সমর্থকরা এবং ইপিআর দলের রাইট-ইন বল ধরলেও একইভাবে বশীর বশীর বলে জোয়ানরা চিৎকার জুড়ে দিত। ভিক্টোরিয়া দলের লেফট-ইন বশীর এবং ইপিআর দলের রাইট-ইন বশীরÑ এ কারণেই মাঠে বশীর নামটা বেশি বেশি উচ্চারিত হচ্ছিল সেই ফাইনাল খেলায়। মাঠে তখন চরম উত্তেজনা, ‘ড্র’টা বেশি সময় পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারেনি। কয়েক মিনিট পরই আলমগীর ভাই রিভার্স ফিক করে জালালের উদ্দেশে একটি পাস দিয়েছিলেন। জালাল তার লেফট-আউট পজিশন থেকে ছুটে ডি-এর ভেতর ঢুকে রানিং-এর উপর সজোরে হিট চালিয়ে দিয়েছিল, বল গোলপোস্টের ভেতর বোর্ডে আঘাত করে বিরাট আওয়াজ তুলে সবাইকে জানিয়ে দিলÑ গোল। আমরা ২-১ গোলে এগিয়ে গেলাম। তবে ভীষণ চাপের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। ইপিআর দল ভীষণ রাফ খেলতে শুরু করলে মোদাশ্বের, নুরাল এবং
আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পারছিলাম না। মোমিন ভাই, নীলু ও সালাম ভাইয়ের দৃঢ়তাপূর্ণ খেলা আমাদের ডিফেন্সকে আগলে রেখেছিল। হার্ড হিটিং করে মাঠের চারপাশের সীমানার ওপারে বল পাঠানো, সময় নষ্ট করা- এ কাজে সালাম ভাই ছিলেন ওস্তাদ। খেলার স্বাভাবিক সৌন্দর্যটা তখন মাঠ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে একসময় আম্পায়ারের শেষ বাঁশি বেজে উঠেছিল। জালালের উইনিং গোলের সুবাদে আমরা শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে জয়লাভ করেছিলাম। তারিখটি ছিল ১৬ মে ’৫৮। আমার খেলোয়াড়ী জীবনের একটি বিশেষ দিন, যে দিনটিতে আমি হকি খেলায় প্রথম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম। আর সে জন্যই এ অনন্য সাফল্যটি আমার অন্তরে সুখস্মৃতি হিসেবে আজও জেগে রয়েছে। ফাইনাল খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণ করেছিলেন ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি জনাব এ এ সিদ্দিকী (আজাদ স্পোর্টিং কাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি)।
ভিক্টোরিয়া দল ঃ নূরুল ইসলাম (গোলকিপার), নীলু ও ফজলুল হক (ফুলব্যাক), মোমিন, সালাম, জামাল (হাফ), মোদাশ্বের, নুরাল হাসান, আলমগীর, বশীর এবং জালাল (ফরোয়ার্ড)।
ইপিআর দল ঃ গোলরক্ষক রেজা, ফুলব্যাক নকভী ও সাঈদ, হাফে আখতার, হাফেজী ও মকসুদ, ফরোয়ার্ড নেওয়াজ, বশীর, ওসমান, মুন্নাফ ও রশীদ। আম্পায়ার ছিলেন তৌফিক এবং মাসুদুর রহমান।
ট্রফি নিয়ে হৈহুল্লোড় করতে করতে স্টেডিয়ামের পাশে ভিক্টোরিয়া কাব টেন্টে ঢুকেছিলাম সেদিন। কাব কর্মকর্তারা যারা মাঠে যেতে পারেননি, তারা আমাদের আনন্দ-উল্লাসে যোগ দিয়েছিলেন। কাব প্যাভিলিয়নের পূর্ব পাশে টেনিস কোটে, একটা টেবিলের উপর ট্রফি রেখে দেয়া হয়েছিল। খুশী হয়ে ঐ কাপের ভেতর কর্মকর্তারা টাকা দিয়েছিলেন। অনেক টাকা জমেছিল। সে রাতে আমরা মজা করে ডিনার খেয়েছিলাম। ১৯৫৮ সালের ‘আতিক উল্লাহ কাপ’ হকি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়নশীপই ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের হকির ইতিহাসে একমাত্র সাফল্য, একমাত্র অর্জন। এই ফাইনাল খেলার সাথে শেষ হয়েছিল হকি মৌসুম।


(ষোল)
আমাদের এলাকার খেলোয়াড়রা ফুটবলের উন্মাদনাকে ধরে রাখতে না পেরে আগেভাগেই ১৯৫৮ সালের ফুটবল মৌসুমটাকে স্কুল মাঠে নামিয়ে এনেছিল। অথচ ঢাকার হকি খেলা তখনও চলছিল। এ পরিস্থিতিতে নিজেকে শুধু হকির প্রতি মনোযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। বন্ধুদের সাথে ফুটবলে সামিল হয়ে যেতাম। হকি লীগ ও টুর্নামেন্টের খেলা বাকি ছিল বিধায় সকাল-বিকাল ভাগ করে হকি-ফুটবল অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে দুটো খেলার জন্য তৈরি রাখতাম, দুটো খেলায়ই ভাল খেলার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম।
স্কুল, স্কুল মাঠ, মাহুতটুলী হকি খেলার ঐতিহ্যের সাথে যতই জড়িয়ে থাকুক, আমরা আরমানিটোলা স্কুলের ছাত্র এবং মাহুতটুলীবাসী হিসেবে হকির ঐতিহ্যকে বহনকারী মনেকরে যতই গর্ববোধ করি না কেন, এলাকাবাসীর কিন্তু ফুটবল-প্রীতি হকির তুলনায় অনেক বেশি ছিল। তার প্রমাণ পাওয়া যেত বিকেলে স্কুল মাঠে আমাদের ফুটবল প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলার জন্য। দর্শক হিসেবে এলাকাবাসীর  মাঠে উপস্থিতি জানিয়ে দিত ফুটবলের প্রতি তাদের ভালবাসা। এমনকি পথচারীরা ফুটবল খেলা (আমাদের খেলা) দেখার জন্য স্কুলের লোহার গেটে দাঁড়িয়ে একনজর দেখে তাদের মনের স্বাদ মিটিয়ে যেতেন, অনেকে আবার গেটের ভেতর ঢুকে মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে বেল গাছতলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা উপভোগ করে চলে যেতেন। দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় আমাদের পাড়া-এলাকাতেও ফুটবলের মাদকতা কোন অংশে কম ছিল না।
ভিক্টোরিয়া কাব কর্মকর্তাদের আমার প্রতি টান ছিল সন্তানতুল্য। ভ্রাতৃতুল্য ব্যবহার, স্নেহ-ভালবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধও ছিল অপরিসীম। এরই মধ্যে কাব-প্রীতিটাও জন্মে গিয়েছিল। হয়তো এ কারণেই অন্য কাবের পক্ষে ফুটবল খেলার কোন প্রকার চিন্তা সে সময় মাথায় আসেনি। তাছাড়া প্রথম বিভাগে খেলার বয়স মাত্র এক বছর। গত বছর নিশ্চয়ই চোখে পড়ার মত এমন কোন খেলা খেলতে পারিনি, যার জন্য কোন কাব আমাকে তাদের হয়ে খেলার প্রস্তাব দেয়নি। সুতরাং কাব পরিবর্তনের চিন্তা করার সুযোগও হয়নি। অগত্যা ঘরের ছেলে ঘরেই থেকে গিয়েছিলাম।
১৯৫৮ সালের ভিক্টোরিয়া ক“াব ফুটবল দল গঠন করা হয়েছিল গত মৌসুমের পুরনো খেলোয়াড়দের দ্বারা। সেই গোলরক্ষক তারা, চট্টগ্রামের আইজ্যাক, ববি, রনি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহমেদ খান, নোয়াখালীর মনজুর আর মোমিন ভাই, সালাম ভাই আর আমি তো রয়েছি। মোতালেব, মধু, মাহতাবÑ এরাও পুরাতন খেলোয়াড়। আজ অন্য সবার কথা মনে নেই।
শক্তিশালী দলগুলোর মধ্যে মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স, আজাদ স্পোর্টিং, বিজি প্রেস, সেন্ট্রাল স্টেশনারী ছিল অন্যতম আড়াই রেলওয়ে, ইপিআর, দলগুলো ছিল মধ্যম সারির এবং ওয়ারী, ভিক্টোরিয়া, তেজগাঁও ফ্রেন্ডস, কামাল স্পোর্টিংসহ (কয়েকটি দল যাদের নাম মনে নেই) মোট বিশটি দল নিয়ে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ যা রিটার্ন লীগ পদ্ধতিতে খেলা হয়েছিল।
মোহামেডান এবং ভিক্টোরিয়া কাব টেন্ট ছিল কাছাকাছি। বর্তমানে ঢাকা স্টেডিয়ামের পূর্বদিকের গেট সংলগ্ন ফাডলাইট টাওয়ার যেখানে, সেখানে ছিল ভিক্টোরিয়া টেন্ট। আমাদের পূর্বদিকে, হ্যান্ডবল মাঠ যেখানে, আউটার স্টেডিয়ামের সীমানা ঘেঁষে ছিল মোহামেডান টেন্ট।
মোহামেডান স্পোর্টিং কাব একটি ঐতিহ্যবাহী কাব। বেশ নামি-দামি এবং দক্ষ খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী দল। তাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে গজনবী, কবির, আশরাফ, মারীর খেলা আমার ভাল লাগতো। বিশেষ করে মারী দা’র যাদুকরী খেলা আমাকে খুব বেশি আকর্ষণ করতো। এত সুন্দর ড্রিবলিং, নিখুঁত পাস, ক্ষিপ্রগতিতে বল নিয়ে ছুটে যাওয়া, তার গোলপোস্টে বল মারার কৌশল আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতাম। তার খেলা আমাকে ভাল খেলার প্রেরণা জোগাতো। দলগত খেলায় মোহামেডান সব সময় আস্থার সাথে না খেলতে পারলেও তাদের ফরোয়ার্ড লাইনের ‘ট্রায়োর’ সমঝোতা মানুষের আস্থা এবং সুনাম অর্জন করেছিল। কবির-আশরাফ-মারী ট্রায়ো ঢাকার মাঠে খুব সুনাম কুড়িয়েছিল। মোহামেডানের যেদিন খেলা থাকতো, আমি ভিক্টোরিয়া কাব থেকে এক ফাঁকে ঐ কাবে চলে যেতাম এবং দূর থেকে আমার প্রিয় খেলোয়াড়দের দেখতাম আর ভাবতামÑ আমি যদি এদের মতো ভাল খেলতে পারতাম, তাহলে আমিও মোহামেডান কাবের পক্ষে খেলতাম। খেলোয়াড়ী জীবনের শুরু থেকে মোহামেডান কাবের প্রতি আমার মনে একটা টান অনুভব করতাম। আর এই দুর্বলতার জন্য মোহামেডান স্পোর্টিং কাবে ফুটবল খেলার স্বাদ জেগেছিল।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাব সে সময় দুর্ধর্ষ একটি ফুটবল দল। ভাওয়াল তাদের গোলরক্ষক, দেশজোড়া যার সুনাম ছিল। আর ছিলেন কুদরত উল্লাহ ভূঁইয়া, যিনি পরবর্তীতে ফুটবল এবং টেনিসের জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। নোয়াখালীর কৃতী ফুটবল খেলোয়াড় কচি, কুমিল্লার মদন এবং কান্তি। ঢাকা লীগে চ্যাম্পিয়নশীপের হ্যাটট্রিক যে টিমের রয়েছে, ১৯৫৮ সালেও তারা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মত দল গঠন করেছিল।
আজাদ স্পোর্টিং কাব সে সময় ছাত্রদের কাব বলে পরিচিতি পেয়েছিল তরুণ, এনার্জেটিক। অধিকাংশ ছাত্র দ্বারা গঠিত ১৯৫৮ সালের আজাদ স্পোর্টিং দল চ্যাম্পিয়নশীপ ফাইট দেয়ার মতো করে করেছিল। কৃতী গোলরক্ষক রঞ্জিত দাস, মালেক চৌধুরী ফুলব্যাক, মুক্তা-আনোয়ার-হাবীব-আনজাম তুখোড় ফরোয়ার্ড লাইন।
সেন্ট্রাল স্টেশনারীর গোলরক্ষক আনোয়ার, ফুলব্যাকদ্বয় ইউনিজ, জহির; হাফে ছিলেন কাশেম, শামস, লুৎফর, বাদশা রাইটআউট, কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড সুজাসহ অন্যান্যের নিয়ে মোটামুটি ব্যালেন্সড টিম তৈরি করা হয়েছিল লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার উদ্দেশ্য করে।
বিজি প্রেস দলে ঢাকায় যতগুলো গোলরক্ষক খেলেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুপুরুষ ছিলেন নবী খান, হাফে ছিলেন সোলেমান (তিনি হকিও খেলতেন), নেওয়াজ (যিনি সাইকিং কিক মারার জন্য সুপরিচিত), নুরু মিয়া (যিনি মাউছা নুরু নামে অধিক পরিচিত ছিলেন)। ফরোয়ার্ড লাইনে চুন্না রশীদ, রাজ্জাক এবং মল্লিক সুনামের সাথে ১৯৫৮ সালের ফুটবল লীগ খেলেছিলেন।
পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে দলটি বরাবরের মতো ঢাকার লীগ খেলায় ‘ফেয়ার প্লে’-এর প্রতীক রূপে খেললেও নিজেদের এলাকায় অর্থাৎ চট্টগ্রামে স্বরূপ ধারণ করে খেলার বদনাম তাদের ছিল। রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার হলো চট্টগ্রাম। দলটি তৈরি করা হয়েছিল চট্টগ্রামে। তাদের প্রায় সব খেলোয়াড় রেলওয়েতে চাকরি করে এবং সেখানেই তারা থাকে। সুতরাং তাদের খেলোয়াড়রা এক সাথে বহুদিন ধরে খেলে আসছে। সবাই তারা অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। ১৯৫৮ সালে তাদের খেলোয়াড়রা হলেনÑ ইয়ার মোহাম্মদ, আখতার, রব, কালীপদ, নীরঞ্জন ও বিমল, আজাদ, নাসিম, মানিক, মেকওয়া ও মুকুল।
কামাল স্পোর্টিং কাবের হয়ে খেলেছেন দেশের বরেণ্য অর্থোপেটিক ডাক্তার ডা. সালেক তালুকদার। প্রতিটি শক্তিশালী টিমের সাথে আমরা ভাল খেলে পরাজিত হয়েছি। ১৯৫৮ সালের ফুটবল লীগের প্রতিটি খেলায় আমরা ভাল খেলার চেষ্টা করেছি। দর্শকরাও আমাদের খেলা দেখে প্রশংসা করতো। কাব কর্মকর্তারা আমাদের খেলা দেখে খুশী। কিন্তু ফলাফলের বেলায় সবাই হতাশ হতেন। আমাদের মতো  মধ্যম সারির দলগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকতো খুবই সামান্য। এখানে স্কোর-এর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। যে দল স্কোর করতে পারবে, সে দল শুধু জয়লাভ করবে না বরং রেলিগেশনের খড়গ থেকে কিছুটা দূরে সরে যাবে। দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যাওয়ার দুশ্চিন্তা থেকে কিছু সময়ের জন্য মুক্তি পাবে।
১৯৫৮ সালের ফুটবল লীগের প্রতিটি খেলায় আমরা ভালো খেলার চেষ্টা করেছি, প্রতিটি শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে আমরা জোর লড়াই করে পরাজিত হয়েছি। দর্শকরা আমাদের প্রশংসা করেছে, আমরা উৎসাহিত হয়েছি। আমার ব্যক্তিগত খেলা ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে এগুচ্ছিল, নিজের প্রতি আস্থা বাড়ছিল। বন্ধু-বান্ধব, দর্শক-সমর্থক সবার কাছে আমার খেলা আকর্ষণীয় হয়ে উঠছিল। আমার ড্রিবলিং, পাসিং সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল অথচ কাব সভাপতি বড় দা আমাকে নিরুৎসাহিত করতেন। খেলা শেষে কাব টেন্টে ঢোকার সাথে সাথে বলতেন, ‘এত প্যাঁচাস কেন?’ কথাটা আমাকে ভীষণ পীড়া দিত। আমার ভীষণ রাগ হতো। ভাবতাম, আমি যতই ড্রিবলিং করি, যতই প্যাঁচাই, বল তো আমার কন্ট্রোলে থাকে, বল অন্য কেউ কেড়ে নিতে পারে না। সে বলটাই তো আমি আমার টিমমেটকে পাসের মাধ্যমে সুন্দর সমাপ্তি দিয়ে থাকি, এতে দোষের কি? বর্তমানে যখন কথাগুলো মনে হয়, তখন বুঝতে পারি, বল বেশি ড্রিবল করলে, বল বেশি সময় নিজের কাছে রাখলে খেলার গতি স্লো হয়ে যায়, খেলোয়াড় কভার হয়ে যায়, এতে খেলার ছন্দ নষ্ট হয়ে যায়। যা হোক, বড় দা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
লীগের শেষ পর্যায় এসে ভিক্টোরিয়াকে রেলিগেশন ম্যাচ খেলতে হয়েছিল তেজগাঁও ফ্রেন্ডস-এর বিরুদ্ধে। হারলেই দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যাবে টিম। আমারই দেয়া একটি গোলের সুবাদে ভিক্টোরিয়া ১৯৫৮ সালে বেঁচে গিয়েছিল। সে বছর তেজগাঁও টিম দ্বিতীয় বিভাগে নেমে গিয়েছিল।
লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বেলায়ও এরকম ডিসাইডিং ম্যাচ খেলতে হয়েছিল আজাদ স্পোর্টিং কাব এবং সেন্ট্রাল স্টেশনারী কাবকে। দু’দলের পয়েন্ট সমান হওয়ায় এই নির্ধারণী ম্যাচের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আজাদ স্পোর্টিং কাব ৩-২ গোলে সেন্ট্রাল স্টেশনারী টিমকে পরাজিত করে ১৯৫৮ সালের ফুটবল লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। আজাদের ২টি গোল মান্না করেছিল এবং স্টেশনারী দলের সুজা ২টি গোল ও উইনিং গোলটি এসেছিল আজাদের হাবিবের পা থেকে।
প্রিন্স আগাখানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৫৮ সালে ঢাকায় আগা খান গোল্ডকাপ নামে ফুটবল টুর্নামেন্ট প্রবর্তন করা হয়েছিল। অল পাকিস্তান টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করার জন্য করাচি থেকে কিয়ামারী কাব, কেএমসি (করাচী মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন) এসেছিল।
ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবও অংশ নিয়েছিল। আমরা শক্তিশালী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের সাথে তিনদিন ম্যাচ খেলেছিলাম। প্রথম ম্যাচ ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ তারিখে ২-২ গোলে ড্র, পরদিন আবার খেলতে হয়েছিল; কারণ ম্যাচ ডিসাইড করার জন্য অতিরিক্ত সময়, কিংবা টাইব্রেকারের পদ্ধতি তখন প্রচলন হয়নি। পরদিনও গোলশূন্য ড্র হয়েছিল এবং শেষে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ১-০ গোলে আমাদের পরাজিত করেছিল। 
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স দলে মনজুর হাসান মিন্টু (গোলরক্ষক নুরু মিয়াÑ যাকে সবাই মাউছা নুরু বলে চিনতো), সাহেব আলী, শাহজাহান, মোদাসসের, জিয়া, মেসবাহ উদ্দিন, প্যাট্রিক, রশীদ চুন্না, রেমন্ড এবং মান্নান। আমরা যারা সেদিন খেলেছিলামÑ গোলরক্ষক সাত্তার, সাইফুদ্দিন জব্বর, আশরাফ, মাহমুদ, আমিন, রিয়াজ, বশীর, নওয়াব, মিলন এবং মাহবুব।
করাচির কিয়ামারী কাব প্রথম আগাখান গোল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল করাচিরই আর একটি দল  কেএমসিকে ২-১ গোলে পরাজিত করে। ঢাকায় প্রথমবারের মতো করাচির টিমগুলো আসাতে তাদের খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য এবং দলগত খেলার পদ্ধতি লক্ষ্য করার সুযোগ আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের হয়েছিল। তারপর থেকেই আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের খেলার মান-পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। সে সময় পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের অনেকে এসেছিলÑ আবিদ, মুসা, গফুর, গফুর বেলুচ, হাসান কিলার প্রমুখ।


(সতের)
ফুলবাড়িয়া টু মুলতান বাই ট্রেন।
দূরের একটা ছবি আমি এখনও স্পষ্ট দেখতে পাই। স্কুলের একটা কিশোর ছেলে স্টেডিয়াম থেকে ছুটতে ছুটতে বাড়ি আসছে মাকে তার স্বপ্নপূরণের খবরটা দিতে। সে সুযোগ পেয়েছে পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলে। ট্রেনে চেপে সে যাবে মুলতান খেলতে। ফুলবাড়িয়া থেকে মুলতান।
এখনকার তরুণ প্রজন্মের অবাক হবার এখানে যথেষ্ট কারণ আছে। ফুলবাড়িয়ায় আবার রেলস্টেশন কোথায়? হ্যাঁ, ফুলবাড়িয়ায় এখন রেললাইনের চিহ্নমাত্র নেই। এখন বাসস্টেশন। বাসে বাসে একাকার। কিন্তু এই বিরাট এলাকাজুড়ে একসময় ছিল ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন বা ঢাকা রেল স্টেশন, সে একই কথা।
পূর্বদিকে নবাবপুর ক্রসিং চৌরাস্তা, পশ্চিমে নাজিমুদ্দিন রোড ক্রসিং চৌরাস্তা, উত্তরে বঙ্গবাজার, পুলিশ ভবন, নগর ভবন, টিএন্ডটি অফিস, দক্ষিণে নাজিমুদ্দিন রোড এবং নবাবপুর রোডকে সংযুক্তকারী সরু রাস্তা, যে রাস্তা ছিল রেল স্টেশনে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা। বর্তমানে ফুলবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিসের সম্মুখ দিয়ে আজও সে রাস্তা নবাবপুর রোডের সাথে সংযুক্ত রয়েছে।
বঙ্গবাজার, পুলিশ ভবন, টিএন্ডটি অফিস এবং এর সাথে লাগানো দক্ষিণ দিকে মার্কেট ছিল রেলওয়ের সান্টিং করার জন্য অনেকগুলো রেললাইন, ওয়ার্কশপ এবং বঙ্গবাজারের ঐ জায়গাটি ছিল রেলের ইঞ্জিন ঘুরাবার অর্থাৎ ইঞ্জিনের সম্মুখ দিক পরিবর্তন করার জন্য একটা অগভীর গোলাকার পাকা বড় চৌবাচ্চার মত, যার উপর দিয়ে রেললাইন বসানো ছিল এবং সে রেললাইনের নিচে ঢাকা লাগানো ছিল, যার দ্বারা রেললাইনটি চৌবাচ্চার সব দিকে ঘুরানো যেত। ইঞ্জিনকে ঐ গোলাকার চৌবাচ্চার উপর দাঁড় করালে শ্রমিকগণ ঠেলা দিয়ে ইঞ্জিনের সম্মুখ দিকটা ঘুরিয়ে পরিবর্তন করে দিতো।
শীতলক্ষ্যা নদীর পারে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন, জংশন। এখান থেকে শুরু হয় রেলপথে দেশের অন্য স্থানের রেলস্টেশনে যাত্রা। নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা সব ট্রেনকে ঢাকা রেলস্টেশনে যাত্রাবিরতি করতেই হতো। কারণ ঢাকা থেকে বেশি যাত্রী দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে থাকে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে প্রথমে চাষাড়া, তারপর ফতুল্লা, গেন্ডারিয়া রেলস্টেশন হয়ে ট্রেন ঢাকা রেলস্টেশনের উদ্দেশে সায়দাবাদ এসে পশ্চিম দিকে চলতে শুরু করতো (বর্তমানে সায়দাবাদ থেকে উত্তর দিকে কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে যায়)। হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরিতে (বর্তমান রাজধানী সুপার মার্কেট), ডানদিকে টিকাটুলী হয়ে গভর্নর হাউসের (বঙ্গভবন) পাশ দিয়ে নবাবপুর রেলক্রসিং (বর্তমান নবাবপুর চৌরাস্তা) পার হয়ে ধীরে ধীরে এসে থাকতো ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে।
সেদিন ছুটতে ছুটতে আমি মাহুৎটুলীর সেই ৫নং পদ্মলোচন রায় লেনের বাসায় এসে মাকে বলেছিলাম, ‘মা আমি চান্স পেয়েছি টিমে, আমি ফুটবল খেলতে মুলতান যাচ্ছি।’ মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, এটা কোথায়? বলেছিলাম  ‘পশ্চিম পাকিস্তানে, অনেক দূর।’ মা আবারও জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হ্যাঁরে, এটা কি চিটাগাং থেকে দূরে।’ হায় কপাল, দেশভাগের ১১/১২ বছর হয়ে গেল, এখনো মা জানেন না পাকিস্তান কতদূর। আসলে মার সামাজিক, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এমনি ছিল যে, তিনি তার গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাছাড়াও মা খুবই সরল-সোজা একজন মহিলা ছিলেন। মার দৌড় চিটাগাং পর্যন্ত, তাই তিনি তুলনা করে বুঝতে চেয়েছিলেন চিটাগাং না মুলতানÑ কোনটা বেশি দূরে? দুলাভাই ইবি রেলওয়েতে চাকরী করতেন, নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া স্টেশন ছিল কর্মস্থল, থাকতেন চাষাড়ার মজিদপুর, দুলাভাই বছরে একবার ফ্যামিলি পাস পেতেন। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ছাড়া আমাদের আর কোথায়ও কোন আত্মীয়স্বজন ছিল না। তাই চিটাগাং এবং সিলেটের মাজার জিয়ারত করাটাই ছিল আমাদের ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য। সারাবছর আমাদের পরিবার অপেক্ষা করে থাকতো এমনি একটি ট্রেন ভ্রমণের জন্য। মা, বড় আপা, ছোট আপা, দুলাভাই, ভাই আর আমিÑ এ ছয়জনই হতাম ভ্রমণসঙ্গী। বাবা কোথায়ও যেতে চাইতেন না, ঘর পাহারায় থাকতেন তিনি। দু’রাত এক দিনের ব্যাপার মাত্র। রাতে রেলগাড়িতে উঠে ভোরে চিটাগাং। মাজার জিয়ারত আর ঘুরেফিরে সারাদিন কাটিয়ে রাতে আবার রেলগাড়িতে উঠলেই সকালে ঢাকা ফিরে আসা। এই তো ছিল আমাদের ভ্রমণ কাহিনী। আমার শৈশবের রেল ভ্রমণ।
মাকে যখন বলেছিলাম যে, মুলতান চট্টগ্রাম থেকে অনেক দূরে। তিন/চারদিন একনাগাড়ে রেলগাড়িতেই থাকতে হবে। আকাশ থেকে যে পড়েছিলেন মা। বলেছিলেন, ‘এতদূরে যাওয়ার দরকার কি?’ স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে ট্রেনে করে অজানা মুল্লুকে যেতে দিতে কোন মা চান?
মা কি করে বুঝবেন এ যাওয়াতে আমার কত আনন্দ। প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছি (যদিও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান তখন একই দেশ)। পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলে চান্স পাওয়া কত সাধনার ফল। কিশোর বয়সের একটি ছেলের এই রোমাঞ্চকর ভ্রমণের জন্য মনটা কত উতলা হয়ে রয়েছে, সেটা কেমন করে বোঝাবো মাকে। মাকে বলেছিলাম, কোন চিন্তা করো না। আমরা এক সাথে অনেক খেলোয়াড় যাচ্ছি, কোন অসুবিধা হবে না। আমার কথায় মা হয়তো কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলেন, আর কোন কথা বলেনি। সংবাদটা শুনে বাবা খুবই খুশী হয়েছিলেন। ছেলে খেলতে বিদেশে যাবেÑ বাবার এটাই গর্ব। বরাবরের মত আল্লাহর উদ্দেশে হাত তুলে দোয়া করেছিলেন সেদিন।
১৯৫৮ সালের অষ্টম পাকিস্তান ন্যাশনাল ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের (কায়দে আজম ট্রফি) ভেন্যু পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রভিন্সের মুলতান শহরে। গত বছরে ট্রায়ালে সার্জেন্ট রহমানের দেয়া হাঁটুর আঘাত পূর্ব পাকিস্তান গ্রীন টিমের হয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের খেলার স্বাধ ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। স্কুলপড়ুয়া একটি ছেলের জন্য পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল টিমে চান্স পাওয়া ছিল স্বপ্ন, তাই এবার চান্স পেয়ে আমি ছিলাম আত্মহারা। অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম মুলতান রওনা হওয়ার দিনটির জন্য।
উক্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক দল নির্বাচিত করেছিলেন ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন কর্মকর্তাবৃন্দ (ইপিএসএফ)।
কর্মকর্তা ও খেলোয়াড়দের তালিকা ঃ কর্মকর্তা- ১। সিদ্দিক দেওয়ান, পুলিশ সুপার (অবঃ)- টিম ম্যানেজার। ২। মোঃ আমিন, সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তা-সহকারী টিম ম্যানেজার। গোলরক্ষক- ১। রণজিৎ দাস (আজাদ স্পোর্টিং কাব), সহ-অধিনায়ক, ২। মনজুর হাসান মিন্টু (ঢাকা ওয়ান্ডারার্স)। ফুলব্যাক- ১। ইউজিন গোমেজ (সেন্ট্রাল স্টেশনারী এন্ড প্রিন্টিং এসসি), ২। হাবিব (ইপিআর), ৩। জহিরুল হক (সেন্ট্রাল স্টেশনারী এন্ড প্রিন্টিং এসসি)। হাফ-১। নবী চৌধুরী (পিডব্লিউডি)-অধিনায়ক, ২। সামাদ (সেন্ট্রাল সেন্ট্রাল স্টেশনারী এন্ড প্রিন্টিং এসসি), ৩। কাশেম (সেন্ট্রাল স্টেশনারী এন্ড প্রিন্টিং এসসি), ৪। মনে নেই। ফরোয়ার্ড-১। আমান চৌধুরী (মোহামেডান স্পোর্টিং কাব, ঢাকা), ২। কবির আহমেদ-মোহামেডান, ৩। আশরাফ চৌধুরী-মোহামেডান, ৪। চিংহ্ণা মং চৌধুরী মারী-মোহামেডান, ৫। শাহ আলম মোহামেডান,  ৬। বশীর আহমেদ (ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব), ৭। হাবিব আহমেদ (আজাদ এসসি)।
সে সময় পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দল ২ ফুলব্যাক, ৩ হাফ এবং ৫ ফরোয়ার্ড পদ্ধতিতে খেলতো। খেলোয়াড় পরিবর্তনের নিয়ম ছিল না। নক-আউট টুর্নামেন্ট হিসেবে এ প্রতিযোগিতা হয়েছিল।
অবশেষে আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দিনটি এলো, ৯টি নভেম্বর ১৯৫৮। রাত ১১টায় ট্রেন ছাড়বে। সবাইকে ১০টার মধ্যে স্টেশনে উপস্থিত থাকতে হবে, ম্যানেজারের নির্দেশ। মাহুৎটুলী থেকে ফুলবাড়িয়া রিকশায় ১৫ মিনিটের পথ। স্টেশনে যাওয়ার সময় মা আমাকে ছাড়তে চাচ্ছিলেন না; কান্নাকাটি, উপদেশ, পরামর্শ যেন শেষ হবে নাÑ ‘একা একা কোথাও যাবি না, কারো সাথে ঝগড়া করিব না।’ রাতে ট্রেনে ুধা লাগলে কোন পিঠাটা খাব, সেটাও বলে দিচ্ছেন। ময়দা শুকনা পিঠা বানিয়ে বেতের সুটকেসে গুঁজে দিয়েছিলেন। চামড়ার সুটকেস ছিল না। সিলেট মাজারে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে কেনা বেতের সুটকেসটা সম্বল করে এত লম্বা ভ্রমণে বেড়িয়েছিলাম। আমার একমাত্র বড় ভাই, কারো সামনে যেতো না, বিশেষ করে আমার বন্ধু-বান্ধব বা খেলার লোকজনের সামনে। আমি একাই স্টেশনে গেলাম। আমি সময়মত পৌঁছালেও অনেকেই আসেনি তখনও। ধীরে ধীরে পুরো টিম প্লাটফর্মে লাইনআপ হলো।
১৬ জনের দল। ২ জন কর্মকর্তা, ১৪ জন খেলোয়াড়, ম্যানেজার সিদ্দিক দেওয়ান, বয়স্ক, স্থূলকায়, এজমার ভাব ছিল বলে চলতে-ফিরতে কষ্ট হতো। তার সহকারী ম্যানেজার আমিন ছিলেন ম্যানেজার সাহেবের বিপরীত, খুব শুকনা-পাতলা।
নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেন আসবে, প্লাটফর্মে দাঁড়ানো যাত্রীরা ডানদিকে তাকিয়ে আছে কখন ইঞ্জিনের হেডলাইটের আলো দেখা যায়, তখন বোঝা যায় ট্রেন কাছে চলে এসেছে। অল্প সময়ের মধ্যে পাটফর্মে এসে হাজির হবে। যাত্রীরা সব ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে অনেক দূরে ট্রেনের আলোর রশ্মি দেখে। পরক্ষণেই ট্রেনটি বামদিকে বাঁক ঘুরে পশ্চিম দিকে মুখ করতেই হেডলাইটের আলো স্পষ্ট দেখা গেল। বলধা গার্ডেন এবং হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরী ছেড়ে গভর্নর হাউসের কাছে চলে এসেছে, ট্রেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ করে ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠলো, নবাবপুর রেলক্রসিং আসলেই ট্রেন জানান দেয় যে, সে প্লাটফর্মে ঢোকার জন্য রেডি।
নবাবপুর রেলক্রসিং-এর গেট বন্ধ, গাড়িঘোড়া চলাচল বন্ধ, কিন্তু মানুষজন ট্রেন আসছে দেখেও থেমে থাকতে চায় না, তাদের উদ্দেশ্যেই হয়তো ট্রেনের বিকট হুইসেল বেজে উঠে সাবধান করে দেয়; সেই সাথে প্লাটফর্মে এলোমেলোভাবে যারা ছুটাছুটি করছে, তাদের জন্যও এই হুইসেলটি সতর্কীকরণ। ধীরে ধীরে ট্রেনটি প্লাটফর্মে ঢুকছিল। এরই মধ্যে যাত্রীরা হাঁকডাক, চেচামেচি, ছুটাছুটি করতে শুরু করেছে এবং কে কার আগে ভাল সিট দখল করতে পারবেÑ তারই যুদ্ধে নেমে পড়ছে।
সিট দখলের যুদ্ধে আমরাও পিছিয়ে ছিলাম না। আশরাফ ভাইয়ের নেতৃত্বে চার/পাঁচজন খেলোয়াড়কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তারা ট্রেন আসার আগে প্লাটফর্মের ডান প্রান্তের সীমানায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, চলন্ত ট্রেনে উঠেই সিট দখল করতে হবে।
১৬ সদস্যবিশিষ্ট টিমের বিছানা, মালপত্র প্লাটফর্মে এক যায়গায় স্তূপ আকারে রেখে আমাকে সামলে রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, আমি যেন সেখান থেকে একমুহূর্তের জন্য সরে না যাই। দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য বলেই হয়তো পাহারা দেয়ার কাজটা আমার জুটেছিল। প্লাটফর্মে গাড়ি ঢুকছে, আশরাফ ভাইয়ের দল চলন্ত ট্রেনে টপাটপ উঠে পড়ছিল। দরজায় দাঁড়িয়ে বলছিল, ‘রিজার্ভ’ রিজার্ভ’, কাউকে উঠতে দিচ্ছিল না। বগির বাইরে কাগজে রিজার্ভ লিখে সেঁটে দেয়া হয়েছিল। একসময় ট্রেনটি প্লাটফর্মে নিস্তেজ হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সহকারী ম্যানেজার সাহেব যার যার মালপত্র নিয়ে ট্রেনে ওঠার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। এক এক করে নিজ নিজ মালপত্র নিয়ে ট্রেনে উঠছিল কিন্তু আমি পাহারায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। যারা ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে যাত্রী আটকাচ্ছিলেন, তাদের মালপত্র দেখার দায়িত্ব তখনও শেষ হয়নি। কুলির মাথায় সবার বিছানা-হোলডোল চাপিয়ে নিজেও গিয়ে ট্রেনের কামরায় উঠেছিলাম। জীবনের প্রথম সিঙ্গেল একটা হোলডোল কিনেছিলাম, তা ভেতর ঘুমাবার জন্য চাদর, বালিশÑ মোট কথা হালকা বিছানা ছিল, যাতে সহজে বহন করা  দু’চারটে  শার্ট-প্যান্ট, গেঞ্জি-টাওয়েল এবং কিছু টুকটাক জিনিস ভরে দিয়েছিল আমার ছোট আপা।
হ্যান্ডব্যাগে রামসুন্দরের মাঝারী শক্ত যুটোওয়ালা একজোড়া বুট, একজোড়া কেডস, একজোড়া মোটা সবুজ লোমওয়ালা হুজ (মোজা), এ্যাংকেট একজোড়া, চামড়া ও বেতের তৈরি সিনগার্ড, সাপোর্টার, দুটো হাফ প্যান্ট, প্র্যাকটিস গেঞ্জিÑ মোট কথা খেলার সব সরঞ্জাম। আরো তাতে টুথব্রাশ ও টুথপেস্ট, লাইফবয় সাবান, ছোট একটি টাওয়েল রেখেছিলামÑ যা সবসময় কাজে লাগে।
তৃতীয় শ্রেণীর বিরাট কামরা ফাঁকা, শুধু আমাদের প্রাদেশিক ফুটবল টিম। আগে কোনদিন এরকম ফাঁকা বগিতে চড়ে ভ্রমণ করিনি। ট্রেনে মানুষজনের ভিড় আর ঠেলাঠেলি দেখেই অভ্যস্ত। ট্রেনে এত লম্বা সফরে পথের বিড়ম্বনার অজানা আশংকা মন থেকে দূর হলো। আরামে শুয়ে-বসে যাওয়া যাবে ভেবে ভালই লাগছিল। তৃতীয় শ্রেণীর আসন কাঠের। যে যার সুবিধামত সিট নিয়ে তাতে বিছানা করে নিয়েছিল। যেহেতু দলে আমি ছোট স্কুলছাত্র, সবাই মিলে আমাকে বাংকারে তুলে দিল। সেখানেই হোলডোল খুলে বিছানা পেতে ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম।
রাত ১১টায় ‘বাহাদুরাবাদ মেইল’ ছাড়বে। মানুষের ছোটাছুটি, চেচামেচি ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। একসময় প্লাটফর্ম ফাঁকা এবং চুপচাপ হয়ে পড়লো অর্থাৎ ট্রেন ছাড়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। বিদায় জানাতে যারা এসেছেন, তারা শেষবারের মত শুভেচ্ছা বিনিময় করে ফিরে যাচ্ছেন। আমি বাংকার থেকে নেমে একটা জানালার ধারে বসে বসে ভাবতে শুরু করি। আমার বাসা থেকেও যদি কেউ আসতো, খুব ভাল লাগতো, বাড়ির লোকজনকে যাবার সময় দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। মা-বোনদের অত রাতে স্টেশনে আসা আমাদের সমাজ ভাল চোখে দেখে না। আমার বড় ভাইতো আসতে পারতো? ভাইটা আমার খুবই সাদাসিধা মানুষ, খুব অল্প বয়সেই সংসারের বোঝা কাঁধে পড়েছে। আমার বন্ধু-বান্ধবের সামনে আসতে চায় না। বাবা বয়স্ক মানুষ, তাকে এত রাতে স্টেশনে আশা করি না। তারপরও আমার চোখ দুটো জানালা দিয়ে তাকিয়ে কি যেন খুঁজছিল। ঢংঢং করে রেলের ঘন্টা বেজে উঠলো আর বুকের ভেতর ধুকধুক করতে শুরু করলো অজানা এক আশংকায়।
হুইসেল দিয়ে ট্রেনটি নড়ে উঠলো এবং ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে চলতে শুরু করলো। রোমাঞ্চকর ভ্রমণের আনন্দ মনে যতই থাকুক, এই মুহূর্তে এই প্ল্যাটফর্ম, ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন এবং এর আশপাশের সবকিছুকে আপন মনে হতে লাগলো আর এগুলো ছেড়ে যেতে মনের ভেতর কোথায় যেন কষ্ট অনুভব করছিলাম।
ট্রেন প্লাটফর্ম ছাড়ার পরপরই নাজিরাবাজার রেলক্রসিং, ঐ তো, হাজীর বিরিয়ানির দোকান। এতক্ষণে বিরিয়ানী সব বিক্রি হয়ে গেছে। লাইন ধরে কেনে, চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, মানুষ একজন উঠলে অন্যজন বসে পড়ে হাজীর বিরিয়ানী খাওয়ার জন্য। হঠাৎ করে বাসায় মেহমান আসরে দৌড়ে এসে হাজির বিরিয়ানী কিনে নিয়ে যাই, সেটা দিয়ে মেহমান আপ্যায়ন করি। আমাদের জন্য সহজ হয় এবং মেহমানরাও খুশী হন। আমরা গর্ববোধ করি। এরই মধ্যে ডানদিকে জাদুঘর ছেড়ে ট্রেন চাঁনখারপুল রেলক্রসিং-এর কাছে চলে এসেছে। দন্ডায়মান বিমানবাহিনীর ট্রেনিং প্লেনটি রাতের অল্প আলোতেও চিকচিক করছিল। ইউনিভার্সিটির মাঠ রাতের অন্ধকারে চেয়ে আছে। বামদিকে চাঁনখারপুল রাস্তা। একটু এগিয়ে গেলেই ঢাকা জেলখানা। বাম মোড় নিয়ে কিছুদূর গেলেই মাহুৎটুলী আমার বাসা। মা হয়তো এখনও বসে বসে আমার কথাই ভাবছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালকে ডানদিকে রেখে ট্রেন বকশিবাজার রেলক্রসিং অতিক্রম করছে। এর বামদিকে ইডেন কলেজ, ডানদিকের রাস্তায় শহীদ মিনার। ধীরে ধীরে ট্রেনটি ডানদিকে বাঁক নিচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের খেলার মাঠের ধার ঘেঁষে ট্রেনটি চলেছে। মনে পড়ে গেল, গত ২৭ জানুয়ারি ’৫৮ তারিখে আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমি ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম এবং আমাদের আরমানিটোলা গভঃ হাইস্কুল সব স্কুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পেয়ে স্কুল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল।

(আঠার)
ট্রেন তখন পলাশীতে। রেল ক্রসিং। ডানদিকের রাস্তা অন্ধকারে ডুবে থাকলেও অনুমান করতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে, একটু এগিয়ে গেলেই শহীদ মিনার চত্বরে ওঠা যাবে। আর বামদিকের রাস্তার শেষ মাথায় ঐ যে লাইটপোস্টের আগায় টিম টিম করে ইলেট্রিক বাতিটি জ্বলছে, সেটি আজিমপুর গোরস্থানের। সামনেই এসএম হলের সুন্দর বিল্ডিংটি মাঠের মত খালি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন যখনই এ এলাকায় ঢুকছিল, তখনই আমি যেন আমার ছেলেবেলায় ফিরে গিয়েছিলাম। এখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্মৃতি নিয়ে হাতড়াচ্ছিলাম। নিমিষেই ট্রেনটি নীলক্ষেত রেলক্রসিং অতিক্রম করে গিয়েছিল।
ঢাকা শহর সে সময় গড়ে উঠছিল। ইউনিভার্সিটিসহ আজিমপুরের বিরাট অঞ্চলের নির্মাণ কাজের প্রস্তুতি চলছিল। ইতোমধ্যে আজিমপুর নিউমার্কেট তৈরি হয়েছে, উদ্বোধনও হয়েছে; তবে সেরকম ব্যবসা/বাণিজ্য/বিকিকিনি জমে উঠেনি। কারণ পুরান ঢাকার মানুষ এতদূর গিয়ে কেনাকাটা করার চেয়ে ঘরের কাছের সদরঘাট, চকবাজারই ছিল তাদের পছন্দের। গাছপালা কেটে সাফ করা হলেও রেললাইনের দু’ধারে নালা, আজেবাজে কাঁটাওয়ালা বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। মাঝে মাঝে মনে হতো ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে ট্রেনটি চলে যাচ্ছে। ডোবা-পুকুরে আর ধানক্ষেতের বিস্তীর্ণ এলাকায় যখন ট্রেনটি যাচ্ছিল, তখন দু’একটি বাতির দেখা পাওয়া যাচ্ছিলÑ সেটাই হলো শাহাবাগ এলাকা। বর্তমানে এলিফ্যান্ট রোড ও পিজি হাসপাতাল এবং কাঁটাবন ও হাতিরপুল রাস্তার সংযোগ স্থানটি (মাসকো সু চৌরাস্তা) ছিল সে সময় শাহবাগ রেলক্রসিং। ডানদিকে দেখা যাচ্ছিল একটি সাদা চারতলা বাড়ি, সেটি ছিল শাহবাগ হোটেল। ঢাকার একমাত্র আন্তর্জাতিক হোটেল।
তারকা হোটেল সম্বন্ধে আমার সে রকম ধারণা ছিল না বলে শাহবাগ হোটেল কত তারার হোটেল ছিলÑ তা এখানে উল্লেখ করতে পারছি না। তাছাড়া ঐ সময় পর্যন্ত সে হোটেলে প্রবেশ করার সুযোগও হয়নি; তবে দেশের সবচেয়ে বড় হোটেল ছিল। শাহবাগ হোটেল বর্তমানে শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। ট্রেনটি সোজা উত্তর দিকে চলছিল, ইঞ্জিনের লাইটে হাতিরপুলের উপর দিকে দু’একটা রিকশা পারাপার হতে দেখা যাচ্ছিল। এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যালের চৌরাস্তায় যে রাস্তা উত্তর দিকে গেছে, সেটা ধরে কিছুদূর গিয়ে ডানদিকে একটু বাঁক নিয়ে হাতিরপুল বাজারের দিকে যাওয়ার পথটি ছিল হাতিরপুলের আরম্ভÑ যা ট্রেনলাইনের উপর দিয়ে ঐ পারে পরিবাগে শেষ হয়েছিল। বর্তমানে হাতিরপুল বাজার সংলগ্ন যে চৌরাস্তা, তারই উপর ছিল পুল, পুলের নিচ দিয়ে ট্রেন চলাচল করতো। ছোট পুল, অথচ বেশ খাড়া (উঁচু)। প্রথমদিকে এই পুলটি ছিল মাটির এবং কাঁচারাস্তা, পরবর্তীতে পিচঢালা পাকা রাস্তা করা হয়েছে। সাধারণত রিকশাই এই পুল দিয়ে যাতায়াত করতো, তাও আবার আরেকজন মানুষকে রিকশার পেছন থেকে ধাক্কা দিতে হতো, রিকশাওয়ালা একা যাত্রীসহ রিকশা টেনে পুলের উপর নিতে পারতো না। পুলটি খাড়া হওয়ার জন্য ভারি যানবাহন চলাচল করতো না।
শোনা যায় যে, ঢাকার নবাবদের হাতিগুলো পিলখানা থেকে বের হয়ে আজিমপুর, এলিফ্যান্ট রোড (বাটা সিগন্যাল) দিয়ে এসে হাতিরপুলের উপর দিয়ে এবং পরিবাগ হয়ে হাতির ঝিলে গোসল করতে যেত এবং একই পথে ফিরে আসতো। নবাবদের হাতিকে ঘিরে ঢাকার রাস্তাঘাটের নামকরণ করা হয়েছে।
ট্রেন হাতিরপুলের নিচ দিয়ে উত্তর দিকে চলেছে বর্তমানে ইস্টার্ন প্লাজা, সুন্দরবন হোটেল এবং বসুন্ধরা সিটিকে বাম দিকে রেখে ডান দিকে বাঁক নিয়ে পূর্বদিকে, কাওরান বাজার ও ফার্মগেটের মাঝামাঝি স্থানে এসে ট্রেনটি আবার বাম দিকে ঘুরে হলিক্রস কলেজের পাস দিয়ে তেজগাঁও রেলস্টেশনের উদ্দেশে। ফুলবাড়িয়া থেকে পলাশী, নীলক্ষেত, কাটাবন, হাতিরপুল, ইস্টার্ন প্লাজা, সুন্দরবন হোটেল পর্যন্ত যে রাস্তাÑ সে রাস্তাটি ছিল একসময় ট্রেনলাইন। গেন্ডারিয়া থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত ট্রেন লাইনটি সায়দাবাদ থেকে ঘুরিয়ে কমলাপুরে নতুন রেলস্টেশন নির্মাণ করে নেয়া হয়েছে এবং সায়দাবাদ থেকে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন হয়ে কাওরান বাজারস্থ সুন্দরবন হোটেল পর্যন্ত ট্রেন লাইন তুলে দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা  হয়েছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেনটি তেজগাঁও রেলস্টেশনে পৌঁছেছিল। কিছু লোক আমাদের কম্পার্টমেন্টে ওঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অন্যত্র চলে যায়। আমাদের কয়েকজন খেলোয়াড় দরজায় দাঁড়িয়ে ‘রিজার্ভ, রিজার্ভ’ বলে তাদেরকে উঠতে দেয়নি। ঘন্টা বেজে উঠলে আমার বুকের ভেতরও ধুক করে উঠেছিল এই ভেবে যে, আমি এখনও ঢাকায় আছি, মা-বাবার কাছ থেকে এখনও খুব বেশি দূরে চলে যাইনি। একটু পরই অজানা কোন দূরদেশে চলে যাব। অল্পক্ষণের জন্য মনের ভেতর একটা ব্যথা অনুভব করেছিলাম। এরই ফাঁকে ট্রেন কখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে টেরই পাইনি। অনেকগুলো বাতি জ্বলছিল- সেদিকেই ট্রেন ছুটছিল, কাছে আসতে বুঝতে পেরেছিলাম এটা একটা বড় রেলস্টেশন, প্ল্যাটফর্মে নাম দেখা গেল টঙ্গী জনসন। রেল থামলে আমাদের কামরায় মানুষজন ওঠার জন্য হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছিল। আমাদের খেলোয়াড়রাও নাছোড়বান্দা! কিছুতেই দরজা থেকে সরবে না। দরজার বাইরে কাগজে ‘রিজার্ভ’ লেখাটা দেখিয়ে দিচ্ছিল। একসময় ট্রেন ছেড়ে দিল। গভীর রাত। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, জানালার ধারে বসে থাকতে আর ভাল লাগছিল না। অন্য কিছু চিন্তা করতেও ভাল লাগছিল না। সম্পূর্ণভাবে নিজেকে ভবিষ্যতের উপর সমর্পণ করে বাংকারের উপরে উঠে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলাম।
হঠাৎ করে কম্পার্টমেন্টে হৈ চৈ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। রাত প্রায় ২টা। ‘ঘাট চলে এসেছে, তাড়াতাড়ি মালপত্র গুছিয়ে নাও সবাই’, ম্যানেজার সাহেবের হাঁক-ডাক। বাহাদুরাবাদ রেলস্টেশনে নেমে আমরা স্টিমার ঘাটের দিকে রওনা দিলাম, কুলির মাথায় বিছানা ও মালপত্র চাপিয়ে দিয়ে পেছনে পেছনে হাঁটছিলাম। এখানেও তদারকির ভার আমার উপর। আমাদের এডভান্স পার্টি আগেই স্টিমারে চলে গিয়েছিল ভাল জায়গার দখল নেয়ার জন্য। স্টিমার ছাড়ার সময় হলে ঘন্টা বেজে উঠলো এবং স্টিমার হুইসেল দিয়ে ঘাট ছেড়ে চলতে শুরু করে দিল। চারদিকে অন্ধকার, শুধু স্টিমারের লাইটটি নদীর পানির উপর পড়ে এদিক-সেদিক  ঘোরাঘুরি করছিল। অন্ধকারের বুক চিরে স্টিমারটি কোন পথে যাচ্ছিল বোঝার উপায় ছিল না। মাঝেমধ্যে দু’একটি স্টিমার বা লঞ্চের আলো এসে পড়ছিল আমাদের স্টিমারে। নদীর খোলা বাতাস গায়ে লেগে শীতের আগমন সন্নিকটে জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। কতক্ষণ স্টিমার চলছিল মনে নেই। মানুষজনের তৎপরতা এবং আমাদের সিট দখল করার এডভান্স পার্টির প্রস্তুতি দেখে বুঝতে পেরেছিলাম যে, ওপাড়ে স্টিমার ঘাটের কাছাকাছি চলে এসেছি। ধীরে ধীরে স্টিমারটি ফুলঝুরি ঘাটে ভিড়ছিল, এরই মধ্যে মানুষজন লাফিয়ে লাফিয়ে পাড়ে উঠেই দৌড়াচ্ছিল। আমাদের সিট দখলকারী পার্টিও দ্রুত রেলস্টেশনে গিয়ে একটি কামরা দখল করার উদ্দেশ্যে স্টিমার থেকে অন্যদের মতই লাফিয়ে নেমে পড়ছিল। যে যার মালপত্র নিয়ে স্টেশনের দিকে তাড়াতাড়ি হাঁটছিলাম, সাথে ছিল কুলির মাথায় বোঝা, সেদিকে খেয়াল রাখার ভারও আমার। স্টেশনে পৌঁছে দেখা গেল পুরো রেলের কামরা দখল করা সম্ভব হয়নি, তবে এক সাইডে প্রায় অর্ধেক কামরায় আমরা আমাদের সুবিধামত বিছানাপত্র বিছিয়ে নিয়েছিলাম। তখন ভোর হতে অনেক বাকি, কান্ত ছিলাম, ঘুমিয়ে পড়লাম।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে জানালার ধারে বসে বসে ভাবছিলাম কোন অজানা দেশের উদ্দেশে ট্রেন ছুটে চলেছে। বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি, এখন আমার বাড়ির সবাই ঘুম থেকে উঠেছে, আমাকে দেখতে না পেয়ে মার হয়তো মন খারাপ করেছেÑ যেমন এ মুহূর্তে মার জন্য আমার লাগছিল। ট্রেন সামনের দিকে ছুটছিল আর স্টেশনগুলো এক এক করে অতিক্রম করছিল। জানালার ধারে বসে দূরে ঐ ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে কত কি ভাবতে ভাবতে মনটা বার বার চঞ্চল হয়ে উঠছিল। ১৯৫৮ সালের ১০ নভেম্বর সকাল প্রায় দশটা হবে, আমরা দর্শনা (পূর্ব পাকিস্তানের শেষ সীমানা)  রেলস্টেশনে পৌঁছেছিলাম। দর্শনা রেলস্টেশনের পুলিশ পোস্টে আমাদের পাসপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজপত্র চেক করা হলো। রেলের কামরাতেই কাস্টম অফিসাররা আমাদের মালপত্র চেক করলেন। যেসব যাত্রী ভারতে যাবেন, তারাই শুধু ট্রেনে বসে থাকলেন, বাকিরা সব ট্রেন থেকে আগেই নেমে পড়েছিলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক পর ট্রেন ভারতের  উদ্দেশে রওনা হলো এবং সেদিনই বেলা এগারো-বারোটার দিকে আমরা ভারতের বানপুর রেলস্টেশনে পৌঁছেছিলাম। বানপুর রেলস্টেশন ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে আমাদের পাসপোর্ট ও ভিসা চেক করা হলো। আমার ভিসা নং ছিল ৪৮৩২৪৫/ঞ, তাং ৫-১১-৫৮ এবং ভিসা ফি ছিল এক রুপি ও ভিসার মেয়াদ ৮-১১-৫৮ থেকে ৭-১২-৫৮ পর্যন্ত। কাস্টম অফিসাররা ট্রেনের বগিতেই আমাদের মালসামানের চেকিং করেছিলেন। প্রায় আধঘন্টা পর ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো। আমরা তখন ভারতের মাটিতে। ট্রেন রানাঘাট জংশন, কাচরাপাড়া, কল্যাণী প্রভৃতি স্টেশন অতিক্রম করে অবশেষে প্রায় একটার দিকে আমরা শিয়ালদাহ রেলস্টেশনে পৌঁছলাম।

(উনিশ)
শিয়ালদহ রেলস্টেশনে ট্রেন থামতেই ম্যানেজার সাহেব নিজ নিজ মালপত্র দেখে নামাবার জন্য নির্দেশ দিলেন। ‘আমরা এখন বিদেশে, সবাইকে সতর্কতার সাথে চলতে-ফিরতে হবে’ বলেও সাবধান করে দিলেন। এক রাতে কয়েকবার ট্রেনে ওঠা-নামা করে আমাদের কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তাই শিয়ালদহ স্টেশনে পটাপট করে সবার মালপত্র নামিয়ে ফ্যাটফর্মের এক জায়গাতে জড়ো করতে বেগ পেতে হয়নি। শিয়ালদহ রেলস্টেশন আমাদের চিটাগাং রেলস্টেশন থেকে অনেক বড় এবং সুন্দর। মানুষজনের ভিড়, হৈচৈ, যাত্রীদের হুড়াহুড়ি করে ওঠানামা সবই যেন আমার কাছে অনেক বেশি বলে ঠেকছিল। এরই মধ্যে আমাদের ট্যাক্সি চলে এসেছিল। বহনযোগ্য মালপত্র হাতে নিয়েছিলাম আর বিছানা, বড় বড় স্যুটকেস কুলির মাথায় চাপিয়ে লম্বা প্ল্যাটফর্ম পার হয়ে ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলাম। শুনতে পেলাম আমরা ৬৬ নং আপার সার্কুলার রোডে যাচ্ছি। পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা-কমচারীদের মেস বাড়ি, সেখানে আমরা কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নেব। রাত ৯টায় আমাদেরকে আবার ট্রেনে উঠতে হবে। ট্যাক্সি চলতে শুরু করল। কোলকাতা সম্বন্ধে অনেক শুনেছিলাম, কোলকাতায় এসে আমার কল্পনার কোলকাতা থেকে ঢের বেশি আশ্চর্যের কোলকাতা ট্যাক্সিতে বসে বসে দেখছিলাম। উঁচু উঁচু দালানকোঠা, প্রশস্ত রাস্তা, হাজার হাজার গাড়ি, রাস্তার মাঝখানে ট্রাম লাইন, ঘন্টা বাজিয়ে ট্রাম চলেছে তার নিজ গতিতে, নিজ গন্তব্যের পানে, সুবিধামত যাত্রীরা ওঠানামা করছে, সবখানে মানুষজন গিজ গিজ করছে, ফাঁকা কোথাও নেই, ছুটে চলেছে সবাই, দাঁড়াবার সময় যেন কারো নেইÑ ব্যস্ত সবাই, ব্যস্ত নগরী, সবকিছুই আমাকে অবাক করার মত। ট্যাক্সিতে চলতে চলতে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম মানুষ-টানা রিকশা। ছুটে চলা গাড়ি, ট্রাক, বাস, ট্যাক্সির সাথে তাল মিলিয়ে নিরাপদে যাত্রী নিয়ে দৌড়ে চলেছে। আমার কাছে এটাও অবাক হওয়ার মতো, তবে আমানুষিক মনে হলো। 
কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্যাক্সি আপার সার্কুলার রোডে সেই মেস বাড়িতে এসে থামলো। দুটো কামরাতে মালপত্র রেখে সবাই দুপুরের খাবারের জন্য বেরিয়ে গেল। সবার ছোট, সবাই আদর করলেও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি, তাই আমাকে একা একা থাকতে হয়। ভাবছিলাম কোথাও গিয়ে দুপুরের খাবার সারব। এমন সময় দেওয়ান চাচা (ম্যানেজার সাহেব) আমাকে চিন্তামুক্ত করে সাথে নিয়ে পাশেই একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন, সহকারী ম্যানেজার আমিন সাহেবও ছিলেন। পেটপুরে খেলাম। কি খেয়েছিলাম মনে নেই, তবে তাদের লাবড়া আর ডালটা খেতে খুব ভাল লেগেছিল। খাবার পর ঐ মেসবাড়ির আশপাশে একা একা ঘোরাফেরা করলামÑ কোলকাতা সম্বন্ধে আরও কিছু জ্ঞান অর্জন করে নিচ্ছিলাম, যাতে ঢাকায় গিয়ে বন্ধুদের কাছে গল্প করা যেতে পারে।
সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে আমরা হাজির হলাম বিশ্রামাগার মেসবাড়িতে। সেখান থেকে ট্যাক্সি করে হাওড়া রেলস্টেশনে। হুগলি নদীর উপর হাওড়া ব্রিজ। এ ব্রিজের উপর দিয়েই পৌঁছাতে হয় রেলস্টেশনে। ব্রিজের উপর দিয়ে যখন ট্যাক্সি যাচ্ছিল, তখন আমার কাছে মনে হচ্ছিল পুরনো লোহা-লক্করের ব্রিজটি কখন যে ভেঙ্গে পড়ে যায়, সেরকমই আওয়াজ হচ্ছিল। স্টেশনে ট্যাক্সি থামার সাথে সাথে কুলিদের মালপত্র নিয়ে টানাটানি! এখানেও আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতাটাকে কাজে লাগিয়ে ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আমরা পরবর্তী যাত্রার জন্য ট্রেনে চাপব। হাওড়া রেলস্টেশনে ঢুকেই আমার চু স্থির হয়ে গিয়েছিল। এত বড় আর এত সুন্দর রেলস্টেশন হতে পারেÑ তা না দেখলে বুঝতে পারতাম না। বিস্তৃত এলাকাজুড়ে হাওড়া রেলস্টেশন। বিরাট শেড দেয়া রেলস্টেশনটি যেমন তার বিশালত্ব প্রকাশ করছে, তেমনি তার ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। অনেকগুলো রেললাইন, অনেকগুলো প্ল্যাটফর্ম শেডের নিচ দিয়ে রেলস্টেশনে ঢুকে একদিকে যেমন সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে, তেমনি হাওড়া রেলস্টেশনের কর্মকান্ডের ব্যাপকতা এবং দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছে।
আমরা ফুটবল খেলোয়াড়, পশ্চিম পাকিস্তানে খেলতে যাচ্ছি জানতে পেরে হাওড়া রেলস্টেশন মাস্টার আমাদের জন্য একটি অতিরিক্ত বগি মূল রেলগাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়েছিলেনÑ যে বগিটি শুধু আমাদের জন্য রিজার্ভ থাকবে। অমৃতসর পৌঁছাবার পর এই বগি পাকিস্তানের লাহোরগামী ট্রেনের সাথে জুড়ে দেয়া হবে অর্থাৎ আমরা হাওড়া থেকে এই একই বগিতে চেপে লাহোর পৌঁছাতে পারব। এত লম্বা সফরে রিজার্ভ বগি আমাদেরকে ঝামেলামুক্ত এবং চিন্তামুক্ত করেছিল। এ ব্যবস্থায় আমাদের জার্নিকে আনন্দদায়ক করবে ভেবে প্রশান্তি বোধ করছিলাম।
আমাদের জন্য নির্ধারিত বগিতে উঠে যে যার মতো করে মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে বিছানা পেতে নিলাম। আমার ভাগ্য এবারও বদলালো না, ঐ দোতলা অর্থাৎ বাংকার। বড়দের হাসি-ঠাট্টা আর চটুল কথাবার্তা, তাসখেলাÑ এগুলো থেকে আমাকে দূরে রাখাই এর কারণ। ম্যানেজার সাহেব এবং সহকারী ম্যানেজারকে দরজার ধারে এক সাইডে পাশাপাশি দুটো সিটে বিছানা পেতে দেয়া হলো। সেদিনই অর্থাৎ ১০ নভেম্বর ১৯৫৮ রাত ৯টা, ফাইভ আপ পাঞ্জাব মেইল, আমাদেরকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। আমার জন্য ব্যাংকার বরাদ্দ থাকলেও সে সময় জানালার ধারে বসে শেষবারের মতো হাওড়া রেলস্টেশন এবং কোলকাতাকে দেখে নিচ্ছিলাম। বিদ্যুতের আলোতে কোলকাতা ঝলমল করছিল। উঁচু উঁচু দালানকোঠা ছুটে চলা গাড়ি-ঘোড়া, মানুষজনের হৈচৈÑ সব মিলিয়ে রাতের কোলকাতাকে মোহনীয় শহর মনে হচ্ছিল। ধীরে ধীরে আলোর ঝলকানি কমে আসছিল অর্থাৎ ট্রেনটি শহরের বাইরে চলে যাচ্ছিল। নতুন জায়গা, নতুন দেশ, জানালার ধারে বসে নিজ দেশের সাথে মেলাতে চেষ্টা করছিলাম। চারদিকের গাছপালা, মানুষজন সবই যেন আমাদের দেশের মতো, আমার চেনা। ট্রেনটি ছুটে চলেছে, মাঝেমধ্যে ছোট ছোট রেলস্টেশনগুলো দ্রুতবেগে পার হয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে স্টেশনের বাতিগুলো দ্রুত কাছে আসছিল এবং নিমিষেই দূরে চলে যাচ্ছিলÑ এসব দেখতে দেখতে কখন যে তিন, সাড়ে তিন ঘন্টা কেটে গেছে টের পাইনি। দূরে অনেক বাতি একসাথে দেখা যাচ্ছিল, সেটা কাছে আসলে বোঝা গেল এটা একটি বড় স্টেশন। রাত সাড়ে বারটা, আমাদের ট্রেন প্রথমবারের মতো এসে থামলো বর্ধমান রেলস্টেশনে। ট্রেন ছাড়লে আমি বাংকারে উঠে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মানুষজনের হাঁকডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল, তখন ভোর। তাড়াতাড়ি বাংকার থেকে নেমে জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম যে, এখানকার মানুষজন প্রায় সবাই সাদা বস্ত্র পরা, মাথায় পাগড়ী, হাতে পিতলের একটা লোটা (ঘটি) নিয়ে ট্রেন লাইনের ধারে বসে আছে। কিছু মানুষ হাতে লোটা নিয়ে চলে যাচ্ছে। আবার কেউ একইভাবে ট্রেন লাইনের দিকে এগিয়ে আসছে। পরবর্তীতে শুনলাম, প্রাকৃতিক কাজ সারতে মানুষগুলো (পুরুষ ও মহিলা) ট্রেন লাইনের ধারে বসেন। এরপর ট্রেনটি যেখানে যাত্রাবিরতি করলো, সেটা ভারতের অন্যতম বৃহৎ জংশন, মোগলসরাই। ভারতের যে কোন দিক অর্থাৎ পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর বা দক্ষিণে যেতে হলে এই জংশন ছুঁয়ে যেতে হবে। মোগলসরাই জংশনের পর ট্রেন থামে বেনারস ইউনির্ভার্সিটি, তারপর বেনারস সিটি। হঠাৎ করেই মনে পড়লো, বেনারসের কথা ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, দাদী সব সময় বেনারসের গল্প করতেন। আমার আপন দাদী না। আমার খালুর বন্ধু খলিল সাহেব, যার ঢাকা নবাব বাড়ীর গেটের নিচে স্পোর্টসের  দোকান ছিল শাহী স্পোর্টস। যেখান থেকে ছোটবেলায় খেলার সরঞ্জাম পেতাম, আমার খেলোয়াড় হয়ে ওঠার পেছনে যাদের অবদান রয়েছে। সেই খলিল সাহেবদের আদি বাড়ি বেনারস। তাই একটু আগ্রহভরে ট্রেনের জানালা দিয়ে বেনারস শহরকে দেখছিলাম। তারপর ট্রেন এসে পৌঁছালো কাশীধাম। হিন্দুদের তীর্থস্থান। এই সেই পুণ্যস্থান যেখানে আসার জন্য প্রত্যেক হিন্দুর মনে বাসনা থাকে। বেলা ৩টায় আমাদের ট্রেন এসে পৌছায় লèৌ। এখানকার ভদ্রতা সম্বন্ধে অনেক শুনেছিলাম, স্টেশনে তাই মানুষজনের মাঝে খুঁজছিলাম সেই ভদ্র মানুষগুলোকে। ট্রেনের জানালার ধারে বসে অল্প সময়ের মধ্যে ফেরিওয়ালা এবং যাত্রীদের চলার মাঝেও যতটুকু কথাবার্তা শুনেছি, তাতে মনে হয়েছে তাদের কথা বলার সুর, তাদের আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক ভিন্ন জাতের। একটু নরম, শান্তশিষ্ট মেজাজের। এলাহাবাদ স্টেশনের পর ট্রেন এসে পৌঁছালো আলীগড়। প্লাটফর্মে নামটা দেখেই চোখটা আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার রাহাত খান চাচা শিক্ষকতা করেন। দাদীর কাছে শুনে এসেছি তার বড় ছেলে (খলিল সাহেবে বড় ভাই) আলীগড় ইউনিভার্সিটিতে পড়ান।
তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেও শিক্ষকতা করেছেন। আমি তখন অনেক ছোট। বড় মার (বড় খালা, যার কাছে আমি বড় হয়েছি) সাথে দাদির বাসায় যেতাম। তারা তখন এফএইচ হলে থাকতেন। বর্তমানে বঙ্গ মার্কেটের দিকের গেট দিয়ে ঢুকে টেনিস কোর্ট পার হয়ে ডান দিকে ঘুরে কিছুদূর গেলেই ছোট একটি লাল রঙের দোতলা বাসা। খলিল চাচা-চাচি, তাদের দুই ছেলে ফিরোজ ও ছোটে আর ছোট চাচা সবাই মিলে থাকতেন ঐ বাসায়।
রাহাত খান চাচা এফএইচ হলে কোন দায়িত্ব নিয়ে থাকতেন, সেটা বুঝবার মত জ্ঞান তখনও আমার হয়নি। সে বাসায় একটা আমগাছ ছিল, খুব মিষ্টি আম। মিষ্টি আমের লোভে ঐ বাসায় যেতাম। আরও একটা লোভে যেতে চাইতাম, সেটা হলো সকালের নাস্তা। এই অদ্ভুত নাস্তা খাওয়ার কথা মনে হলে হাসি পায়। দাদি ছোটদের গরম গরম চায়ের সাথে ঘন দুধ, তার মধ্যে রাতের শুকনো ভাত দিয়ে নাস্তা দিতেন। এটা চায়ের সাথে ভাত নাকি দুধের সাথে ভাত- কি বলা যায়, এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি; তবে সে মজাদার নাস্তা খাওয়ার কথা আজও মনে পড়ে।
চাচা ঢাকা ইউনিভার্সিটি ছেড়ে ভারতে চলে যান। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করে ১৯৫৮ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত ছিলেন। তিনি বিয়ে করেননি, একাই থাকেন।
ট্রেনের জানালার ধারে এসে যদি কেউ আমার নাম ধরে ডেকে ওঠে, যদি চেয়ে দেখি তিনি আমার রাহাত চাচা, কতই না আনন্দ লাগবে! হঠাৎ ট্রেনের হুইসেলটা আমার কল্পনাকে ভেঙ্গে দিয়ে সামনের দিকে চলতে শুরু করে দিল।
(বিশ)
আলীগড় রেলস্টেশন ছেড়ে যেতে বুকের ভেতর কোথায় যেন একটু কষ্ট অনুভব করছিলাম। চোখটা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কি যেন খুঁজতে ব্যস্ত  হয়ে পড়ছিল বার বার। মনের অবস্থা যখন এরকম, তখন আমাদের ট্রেন এসে পৌঁছালো বক্সার রেলস্টেশনে। বক্সার নামটি আমার পূর্বপরিচিত। ইতিহাসে পড়েছিলাম। বক্সার একটি জায়গার নাম। বক্সার একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধের নাম। ১৭৬৪ খৃষ্টাব্দে স্যার হেক্টর মুনরোর নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী মীর কাশিম সুজা-উদ-দৌলা এবং দ্বিতীয় শাহ আলমের সম্মিলিত মুসলিম বাহিনীকে বক্সার নামের এই যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত করে। এই যুদ্ধের মাধ্যমে ইংরেজরা ভারতবর্ষে শক্তিশালী রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা করে।
ইতিহাস নিয়ে মাথার ভেতর যখন গবেষণা চলছিল, তখনই ট্রেনটি আর এক ঐতিহাসিক সাম্রাজ্যে ঢুকে পড়েছিল। সেটি হলো ইতিহাসখ্যাত পানিপথ। পানিপথ রেলস্টেশনে ট্রেন থামলে মনে পড়লো মাত্র ক’মাস আগে মেট্রিক পরীক্ষার পড়া। পানিপথের যুদ্ধ মুখস্ত করার জন্য পড়তে পড়তে মুখে ফেনা উঠে যেত। পানিপথ একটি স্থানের নাম। পানিপথে তিনটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। প্রথম যুদ্ধ ১৫২৬ খৃষ্টাব্দে বাবর ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ হয়েছিল ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে। মোঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি বৈরম খাঁ রাজা হিমুকে পরাজিত করেন। ১৭৬১ খৃষ্টাব্দে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ হয়েছিল আহমেদ শাহ আবদালির সাথে মারাঠাদের। এ যুদ্ধে মারাঠারা পরাজিত হয়েছিল এবং তাদের সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে ভারতে ইংরেজ শাসনের পথ সুগম হয়। পানিপথ নামক স্থানে এই যুদ্ধ হয়েছিল বলে পানিপথের যুদ্ধ নামেই ইতিহাসে পরিচিত হয়ে আছে।
ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো তখনও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন সময় ট্রেন আর একটি যুদ্ধক্ষেত্রে হাজিরÑ সেটি হিন্দু পুরাণে বর্ণিত কুরুক্ষেত্র। কুরু নামক স্থানে পঞ্চপান্ডব এবং কৌরব পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল বলে এই যুদ্ধের নাম হয়েছে কুরুক্ষেত্র আর আমাদের ট্রেনটি কুরুক্ষেত্র রেলস্টেশনেই এসে দাঁড়ালো।
আমাদের ট্রেনটি ছুটে চলেছে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে। চলতে চলতে আরো একটি দিন কেটে গেল ট্রেনে। এখন রাত ৮টা, আমরা পাঞ্জাবের গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যস্ত আম্বালা রেলস্টেশনে এসে পৌঁছেছি। এরপর ট্রেন থামলো ভারতের টেক্সটাইল সমৃদ্ধ লুধিয়ানায়। অনেক রাত, অন্ধকার চিরে ট্রেন ছুটে চলেছে। এদিকে আমার চোখ নিজেকে আর মেলে রাখতে পারছিল না, বন্ধ হয়ে পড়ছিল। অগত্যা ঘুমাবার জন্য বাংকারে উঠে গেলাম। ট্রেনের লম্বা সফরে সাইডওয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, এখন ঝাকুনিকে দোল খাওয়ার মত মনে হয়। রেলগাড়ি দোলনায় দোল খেতে খেতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
‘চা গরম’ চা-ওয়ালার ডাকে ঘুম ভাংলো। মাটির ভাড়ে চা বিক্রি করে চলেছে। ভারতে ঢুকে কোন্ এক স্টেশনে মনে পড়ছে না, সকালবেলা চা খেতে গিয়ে মাটির ভাড়ে চা দেখে অবাক হয়েছিলাম। নতুন অভিজ্ঞতা! জানালার ধারে বসে মাটির ভাড়ে চা খাওয়া, খাওয়া শেষ হলে ভাড়টা জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দাও’Ñ বেশ মজা। গাছের পাতায় মোড়ানো নাস্তা-পুরি, ভাজি খাওয়াÑ এটাও আমার কাছে নতুন। ছোট-বড় খোপওয়ালা বিচিত্র ধরনের খাওয়ার থালা যেটাতে খোপে খোপে ভাত, রুটি, ভাজি, তরকারি, দই, পাপর ভাজা, চাটনি প্রভৃতি একসাথে সাজিয়ে খেতে দেয়াÑ সবই আমার কাছে নতুন এবং অবাক করার মত। স্টেশনে গাড়ি থামলে নেমে এটা-সেটা কেনা, বিশেষ করে ফল কেনা, বিভিন্ন ধরনের ফল স্টেশনে পাওয়া যায়। সস্তা। প্ল্যাটফর্মে একা একা হেঁটে হেঁটে ফল কিনে খাওয়া, আঙুর কিনে নিয়ে বাংকারে শুয়ে শুয়ে খাওয়াÑ সব মিলিয়ে সফরের এ পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়াটা আমার কাছে যেমন নতুনত্ব ছিল, তেমনি মজাদার এবং আনন্দদায়ক ছিল।
অবশেষে আমাদের ট্রেন অমৃতসর রেলস্টেশনে সকাল ১০টায় পৌঁছালো। ট্রেন থামার সাথে সাথে একটি দুঃসংবাদ পাওয়া গেল যে, লাহোরগামী কানেক্টিং ট্রেনটি কিছুক্ষণ আগে ছেড়ে গেছে। সবাই চিন্তায় পড়ে গেলেন। এ পথে এর পূর্বে কেউ ভ্রমণ করেননি। কি করে পাকিস্তান পৌঁছানো যাবেÑ এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ম্যানেজার সাহেবসহ সিনিয়রদের ছুটোছুটি আর ব্যস্ততা দেখা গেল। কিছুক্ষণ পর ট্যাক্সি করে আমরা বর্ডারের উদ্দেশে রওনা হলাম এবং ১৪/১৫ মাইল দূরত্বে অবস্থিত ভারতের পশ্চিম সীমান্তের শেষ সীমানা অমৃতসর বর্ডারে প্রায় সাড়ে দশটায় পৌঁছালাম।
কাস্টমস চেকিং এবং ইমিগ্রেশনের (এক্সজিট) ছাড়পত্র (আমার এক্সজিট সিরিয়াল নং-২৮৩৫) পেয়ে ১২-১১-৫৮ তারিখে আমরা ভারত ত্যাগ করলাম।
আমরা মালপত্র নিয়ে হেঁটে নোম্যান্স ল্যান্ড পার হলাম। নোম্যান্স ল্যান্ড মানে ফ্রিল্যান্ড অর্থাৎ মালিকবিহীন বা নিয়ন্ত্রণহীন জমি। মাত্র ১০/১৫ গজ লম্বা রাস্তা, ভারতের সীমানা শেষ, পাকিস্তানের সীমানা শুরু, মাঝখানে এই নোম্যান্স ল্যান্ড।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ওয়াগাহ বর্ডার চেকপোস্টে প্রবেশ করলাম। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ফুটবল খেলতে পাকিস্তানে (মুলতান) এসেছি জানতে পেরে চেকপোস্টের কাস্টম এবং ইমিগ্রেশন অফিসাররা দ্রুততার সাথে সমস্ত ফরমালিটিজ শেষে আমাদেরকে পাকিস্তানে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করেন (আমার এন্ট্রি নম্বর ৪৮৯, তাং ১২-১১-৫৮ ছিল)।
ওয়াগাহ বর্ডার থেকে আমরা ট্যাক্সি করে লাহোর রওনা হলাম। লাহোর পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী। এখান থেকেই ট্রেনে মুলতান যেতে হবে। ঐতিহাসিক বহু কীর্তি এখানে রয়েছে। মোঘল আমলের শাহী কেল্লা, শাহী মসজিদ, সালিমার গার্ডেন সম্বন্ধে বইতে পড়েছি। সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজ চোখে এগুলো দেখার স্বাদ মেটাবার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে ট্যাক্সির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। শুনেছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানে নদীনালা নেই, গাছপালা নেই, বৃষ্টি হয় না, শুষ্ক মরুভূমির মত কিন্তু এখানে পা রেখে যা দেখছিÑ তাতে মনে হলো সবই ভুল শুনেছিলাম। চতুর্দিকে সবুজের মেলা। ট্যাক্সি ছুটে চলেছে। প্রথমেই দেখলাম পাকিস্তানের টাকশাল। পাকিস্তানের সব ধরনের কারেন্সি এখান থেকে বের হয়। তারপর চোখে পড়লো বাটানগর। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে, একটি ছোটখাটো শহরের মত। লাহোরের পানির প্রধান উৎস ডিআরবি খালের পাশ দিয়ে আমাদের ট্যাক্সি কিছুদূর ছুটেছে। লাহোরের উপকন্ঠে সেই বিখ্যাত সালিমার গার্ডেন চলন্ত ট্যাক্সিতে যতদূর দেখা গেল, গাড়ি থামিয়ে দেখার সুযোগ নেই। প্রায় দেড় ঘন্টা ট্যাক্সি চলার পর আড়াইটার সময় এসে থামলো লাহোর রেলস্টেশনে। এখান থেকেই মুলতানের উদ্দেশে ট্রেনে চড়তে হবে।
রাত ৯টায় মুলতানগামী ট্রেন ছাড়বে, পর্যাপ্ত সময়, স্টেশনের ওয়েটিংরুমে গোসল করে দুপুরের খাবার জন্য সবাই বেরিয়ে গেল। আমার ভাগ্য এখানেও বদলালো না, খাওয়া-দাওয়া সেরে মালপত্র দেখাশোনার কাজে লেগে গেলাম। ছোট, হারিয়ে যাওয়ার ভয়Ñ এসব বলে আমাকে মালপত্র পাহারায় বসিয়ে সবাই ঘুরে বেড়ায়। ‘তেজগাম এক্সপ্রেস’ সময়মতই মুলতানের উদ্দেশে লাহোর রেলস্টেশন ত্যাগ করেছিল। মুলতান পাঞ্জাব প্রোভিন্সের একটি শহর, যা লাহোর এবং করাচীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। রাত প্রায় ১টায় আমাদের ট্রেন ভাওয়ালপুর রেলস্টেশনে থামলো। এরপর একে একে পেরিয়ে গেলাম মন্টগোমারী, রহিমইয়ার খান রেলস্টেশন। পরদিন ১৩ নভেম্বর  ’৫৮, সকাল ৮টায় আমাদের ট্রেন এসে পৌঁছালো মুলতান রেলস্টেশনে। চার রাত পাঁচ দিনে প্রায় ২৩০০ মাইল ট্রেন সফর শেষে আমরা আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছলাম।
আয়োজক কমিটির তরফ থেকে কয়েকজন আমাদেরকে নিতে স্টেশনে এসেছিলেন। আমরা ভীষণ কান্ত ছিলাম, তাই খুব তাড়াতাড়ি তাদের কথামত মালপত্রসহ টাঙ্গাতে উঠে বসলাম। টাংগা হলো ঘোড়ার গাড়ি। আমাদের ঘোড়ার গাড়ি কাঠের বাক্সের মত বন্ধ, দুটি ঘোড়া টানে আর টাংগা উপরে ছাউনী দেয়া খোলা গাড়ি, যার সামনে-পেছনে চারজন বসতে পারে। ১টি ঘোড়া টানে।
আমাদের দেশের আবাসিক হোটেলগুলোর মত এমন একটি সাধারণ হোটেলের কাছে এসে আমাদের টাংগাগুলো থামলো। আয়োজক কমিটির কর্মকর্তারা আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। হোটেলটির সংস্কার কাজ তখনও সম্পন্ন হয়নি। দোতলার উপর নতুন তিনতলা নির্মাণ করা হয়েছে যা যেনতেনভাবে কাজ শেষ করে আমাদেরকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। নিম্নমানের বাথরুম এবং ল্যাট্রিন যা ভদ্রভাবে ব্যবহারের অনুপযুক্ত।
১৫ নভেম্বর খেলার দিন আমরা শামস-এ তাবরেজ মাজার জিয়ারত করতে গেলাম। বেশ উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় কামেল সুফি তাবরেজের মাজার। এই মাজারকে হিন্দু-মুসলমান সবাই মানেন (শ্রদ্ধা করেন)। অমৃতসর স্টেশনে এক বুড়ি রঞ্জিত দা’কে পাঁচ রুপির একটি নোট দিয়ে বলেছিলেন মুলতানে সামস-এ তাবরেজ মাজারে দিতে। তিনি মাজার সম্বন্ধে বলেছিলেন, অনেক কামেল দরবেশ ছিলেন তাবরেজ। কারো মানত পূর্ণ হলে কবুতরগুলো বৃত্তাকারে মাজারের চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে।
এই মাজার সম্বন্ধে লোকমুখে অনেক অলৌকিক ঘটনার কথা শোনা যায়। তাবরেজ ছিলেন একজন সাধক। তিনি পাহাড়ের উপর সাধনা করতেন। কিন্তু তাকে মারার জন্য পাহাড়ের উঁচু স্থান থেকে একটি বিরাট পাথর তার দিকে ঢেলে দেয়। পাথরটি গড়াতে গড়াতে তার দিকে আসলে সবাই মনে করে এবার তাবরেজ পাথরের আঘাতে এবং পাথরের নিচে পড়ে মারা যাবেন। পাথরটি যখন তার একেবারে কাছে, তখন তিনি হাত দিয়ে পাথরকে থামতে ইশারা করলে পাথর তার ইশারায় থেমে গেল। আজও সে পাথর অমনি দাঁড়িয়ে আছে, মনে হয় একটু ছোঁয়া পেলেই গড়িয়ে নিচে পড়ে যাবে। আরও একটি ঘটনা লোকমুখে খুব বেশি শোনা যায় যে, মানুষজনের অত্যাচারে তাবরেজ পাহাড়ে চলে যান এবং সেখানেই বসে ধ্যান করে পাহাড়ের গুহায় থাকতেন। মানুষ সেখানেই তাকে খাওয়া-দাওয়া দিয়ে আসতো। একজন কাঁচা মাংস নিয়ে গেলে তাবরেজ সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, রান্না করে দে। সূর্য নিচে নেমে এসেছিল। সূর্যের তাপে মাংস রান্না হয়ে গিয়েছিল। কথিত আছে, সারা বছরে সূর্য একদিন নিচে নেমে আসে। সেটা ভাদ্র-আশ্বিন মাস। সেদিন মুলতানে সবচেয়ে বেশি গরম হয়।
সামস-এ-তাবরেজ মাজারে অনেক কবুতরের বাস। মানুষ কবুতরকে খাওয়া দেয়। এত বেশি কবুতর কিন্তু মাজারে দর্শনার্থীদের উপর কখনও কবুতর পায়খানা করে না। অথচ প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে কবুতরের পায়খানা পরিষ্কার করতে হয়। 

(একুশ)
১৯৫৮ সালে টোকিও এশিয়ান গেমসে পাকিস্তান জাতীয় দলের পক্ষে পাঁচজন বাঙ্গালী ফুটবল খেলোয়াড় সুযোগ পান। তারা হলেন, মনজুর হাসান মিন্টু, গজনবী, কবির, আশরাফ এবং মারী। সঙ্গত কারণে এঁদের নিয়ে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান দলটি ছিল ৮ম পাকিস্তান জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে ফেভারিট টিম। নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ মাঠে ফুটবল ম্যাচ খেলতে গিয়ে গজনবী ভাই পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হন। যার জন্য তিনি পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। ১৯৫৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে পূর্ব পাকিস্তান গ্রীন টিম ফাইনাল খেলায় দাপটের সাথে খেলে পাঞ্জাব দলের সাথে দুর্ভাগ্যবশত ০-১ গোলে হেরে শিরোপা হাতছাড়া করেছিল; সুতরাং এবছরও পূর্ব পাকিস্তান ছিল এ টুর্নামেন্টের ফেভারিট ফুটবল দল। তাই স্বাগতিক পাঞ্জাব দলের কাছে পূর্ব পাকিস্তান টিম ছিল তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল। আর এ জন্য পূর্ব পাকিস্তান দলকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করতে পারলে তাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা সহজতর হবে। স্বাগতিক প্রভিন্স হিসেবে পাঞ্জাব দুটো দল (গঠন করার) টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিল। পাঞ্জাব রেড এবং পাঞ্জাব ব্লু। পাকিস্তান জাতীয় দলের কৃতী খেলোয়াড় রিয়াসত, বালি, রাব্বানী প্রমুখ দ্বারা শক্তিশালী পাঞ্জাব রেড গঠন করেছিল। প্রমিজিং এবং ইয়ং খেলোয়াড়দের দ্বারা গঠন করেছিল পাঞ্জাব ব্লু দল।
অন্যদিকে চার রাত পাঁচ দিন একনাগাড়ে ট্রেনে করে ২৩০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কান্ত এবং অবসন্ন অবস্থায় আমরা মুলতানে পৌঁছেছিলাম। দীর্ঘ সময়ের ট্রেনের ঝাঁকুনি তখনও আমরা অনুভব করছিলাম, একস্থানে বসে থাকলে শরীরটা হঠাৎ করে দুলে উঠতো, একদিকে হেলে পড়তো, এমনকি হাঁটতে গিয়ে স্টেপটা (কদম) এদিক-সেদিকে পড়তো। পর্যাপ্ত বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল কিন্তু আমরা একদিন পরই শরীরের এমনি অবস্থা নিয়ে মাঠে নামতে হয়েছিল।
১৫ নভেম্বর ’৫৮ আমাদের প্রথম খেলা পাঞ্জাব ব্লু দলের সাথে মুলতান স্টেডিয়ামে। পাহাড়ের উঁচুতে স্টেডিয়াম। টাংগাতে করে আমরা স্টেডিয়ামে রওনা হয়েছিলাম কিন্তু স্টেডিয়াম পর্যন্ত টাংগাতে চড়ে যাওয়া যায় না বলে একটু দূরেই নামতে হয়েছিল। উপরের দিকে কিছুদূর হাঁটতে হাঁটতে আমরা স্টেডিয়ামে পৌঁছেছিলাম।
আমাদের দলে সেদিন যারা খেলেছিল : গোলরক্ষক-রঞ্জিত দাস, ফুলব্যাক-ইউজিন ও জহির। হাফ-কাশেম, নবী চৌধুরী ও সামাদ। ফরোয়ার্ড-আমান, কবির, আশরাফ, মারী ও শাহ আলম। খেলোয়াড় বদলের নিয়ম ছিল না। যে খেলোয়াড় খেলা আরম্ভ করবে, তাকেই খেলা শেষ করতে হবে। আমাদের দলের দুই ইনসাইড খেলোয়াড় কবির এবং মারী, তাদের স্থলে অন্য কোন খেলোয়াড়ের কথা কেউ চিন্তাই করে না। সুতরাং মাঠের বাইরে সাইড বেঞ্চে বসে খেলা দেখা ছাড়া আমার উপায় ছিল না।
পশ্চিম পাকিস্তানী খেলোয়াড়রা টাফ খেলতে অভ্যস্ত। বর্তমানে যাকে ‘পাওয়ার প্লে’ বলা হয়ে থাকে। বিশেষ করে পাঞ্জাব, পেশওয়ার, বেলুচিস্তান প্রদেশের খেলোয়াড়রা গায়ের জোরে খেলে থাকে। আমাদের বিপক্ষে পাঞ্জাব ব্লু দল প্রথম থেকেই তাদের দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করে খেলতে শুরু করে। অপরপক্ষে দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমণের জন্য আমাদের দলের খেলোয়াড়দের মাঝে কান্তির ছাপ ফুটে উঠেছিল। তার উপর পাঞ্জাব ব্লু দলের নেগেটিভ খেলা অর্থাৎ অপরকে খেলতে না দেয়ার পদ্ধতি আমাদের খেলোয়াড়দের স্বাভাবিক খেলা খেলতে দিচ্ছিল না। আমাদের কোন খেলোয়াড় বল ধরলে, তখনই তাদের দু’তিনজন খেলোয়াড় ছুটে এসে রাফ ট্যাকলিং করে বল ছিনিয়ে নিচ্ছে। এ পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের আক্রমণ ছিল সংঘবদ্ধ। আমাদের ট্র্যায়ো বারবার তাদের সীমানায় হানা দিচ্ছিল কিন্তু সফল হচ্ছিল না। এরই মধ্যে আমাদের বিপক্ষে একটি কর্নার হলো, আমাদের  গোলরক্ষক রঞ্জিতকে তাদের দুজন খেলোয়াড় এমনভাবে গার্ড দিচ্ছিলÑ যার দরুন রঞ্জিত দা নড়াচড়া করতে পারছিলেন না। আমাদের ডিফেন্সকেও একইরকম করে ঘিরে রেখেছিল তারা। কর্নার কিক মারা হলো। রঞ্জিত দাকে দুজন খেলোয়াড় ঠেলেই পোস্টের ভেতর নিয়ে গেল। তাদের আর একজন খেলোয়াড় কর্নার কিকের বল ধরে অনেকটা ফাঁকা পোস্টে মেরে গোল করে দিল। আমাদের লেফট সাইড থেকে অনেকগুলো আক্রমণ পাঞ্জাব ব্লু দলের গোলরক্ষক এবং ডিফেন্স প্রতিহত করেছিল। আরও একটি গোল আমরা খেয়েছিলাম, সেটি হলো বক্সের বাইরে থেকে মারা। একটি শট রঞ্জিত দা’র ডান হাতের সামান্য উপর দিয়ে পোস্টে ঢুকেছিল। আমাদের টিম তারপরও গোল শোধ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা ০-২ গোলে পরাজিত হয়েছিলাম।
পাঞ্জাব ব্লু দল নিজস্ব মাঠ, দর্শক এবং নিজস্ব রেফারির সাহায্যে তাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী খেলে জয়ী হয়েছিল এবং আমরা প্রথম ম্যাচেই টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। পাঞ্জাব ব্লু দলের খেলোয়াড় এমএন জাহান খুব ভাল খেলেছিল এবং পরের বছরই সে পাকিস্তান জাতীয় দলে লেফট ইন পজিশনে নিজের জায়গা করে নিয়েছিল।
টিম হেরে যাওয়াতে সবাই হতাশ। মুলতানে এক মূহূর্তের জন্যও কেউ থাকতে চাচ্ছিল না। কিন্তু আমাদেরকে আরো একদিন মুলতানে থাকতে হয়েছিল। মুলতান শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, কেনাকাটা করেছি। মুলতানের বিছানার চাদর বেশ প্রসিদ্ধ। আজও একটি চাদর আমার কাছে রয়েছে। চামড়ার এবং কাঠের জিনিসপত্রেরও সুনাম আছে। আখরোট গাছের কাঠ দিয়ে কারুকার্য করা কাঠের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। বিশেষ করে জুয়েলারি বক্স, সিগার বক্স, সুন্দর সুন্দর ফটোফ্রেম।
মুলতানে আমরা মোট পাঁচদিন ছিলাম। ১৭-১১-৫৮ তারিখে তেজগাম এক্সপ্রেসে লাহোরের উদ্দেশে মুলতান ত্যাগ করেছিলাম। পরদিন অর্থাৎ ১৮-১১-৫৮ তারিখে আমরা লাহোরে পৌঁছেছিলাম। লাহোরে একটি হোটেলে আমাদের টিম উঠেছিল। লাহোরের ঐতিহাসিক স্থানসমূহের কথা ঢাকাতে অনেক শুনেছিলাম। চাুষ দেখার জন্য উন্মুখ হয়েছিলাম। সুতরাং তর সইছিল না। খাওয়া সেরে ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই লাহোরের শাহী মসজিদ দেখতে গেলাম। বিশাল মসজিদ। এত সুন্দর মসজিদ দেখার সুযোগ এর আগে কোনদিন হয়নি। মসজিদের উঁচু মিনারও আমাকে অবাক করেছিল। মসজিদের কাছেই শাহী কেল্লা। ঢাকায় লালবাগের কেল্লা দেখেছি, তবে আগ্রহ নিয়ে কেল্লা দেখার চাইতে কেল্লার মাঠে ক্রিকেট খেলেছি আগ্রহ নিয়ে। শাহী কেল্লার ফটকে শক্তিশালী দরজা, উঁচু উঁচু দেয়াল আমাকে অবাক করেছিল। লাহোর অনেক সুন্দর শহর।
পরদিন সকালের নাস্তা সেরে রওনা হলাম শহরের উপকন্ঠে বিখ্যাত সালিমার গার্ডেন দেখতে। শ্বেত পাথরের ফোয়ারা, বসার স্থান সব যেন সাজানো-গোছানো। চারদিকে ফলের বাগান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সুন্দর সাজানো ফুলের বাগান। সালিমার গার্ডেনেই প্রথম দেখেছিলাম হলুদ রং-এর গোলাপ ফুল। সালিমার গার্ডেনের সৌন্দর্য শুধু অনুভব করা যায়, লিখে বর্ণনা দেয়া যায় না। এরপর গভর্নমেন্ট কলেজ এসেম্বলি হল প্রভৃতি জায়গা ঘুরে মার্কেটে ঢুকেছিলাম কেনাকাটা করার জন্য। লাহোর তার সৌন্দর্য এবং আধুনিক ফ্যাশনের জন্য প্রসিদ্ধ। বিখ্যাত আনারকলি মার্কেটে ঢুকে চক্ষু স্থির হয়ে গিয়েছিল। মেয়েদের সাজগোজ করার সব রকম উপকরণ এই মার্কেটে। ভাইঝি আর ভাইপোর জন্য কিছু কেনাকাটা করে চলে গেলাম হোটেলে। সেদিনই বিকেলের মধ্যেই লাহোর ছেড়ে যেতে হবে।
বেলা ৩টায় আমরা ট্যাক্সি করে ওয়াগাহ বর্ডারের উদ্দেশে রওনা হলাম। ওয়াগাহ বর্ডারে ১৯/১১/৫৮ তারিখে ২৯০ নম্বর ছাড়পত্রের মাধ্যমে আমরা পাকিস্তান সীমানা ত্যাগ করেছিলাম। একই দিনে অমৃতসর বর্ডারে প্রবেশ করে ট্যাক্সিতে করে স্টেশনে পৌঁছলাম। সে রাতেই অর্থাৎ ১৯/১১/৫৮ তারিখে হাওড়ার উদ্দেশে অমৃতসর ত্যাগ করেছিলাম। যাওয়ার সময় যে আগ্রহ ছিল, তার ছিটেফোঁটাও ফেরার পথে ছিল না, তাই জানালা দিয়ে বাইরে দেখার আকর্ষণও বোধ করিনি। তবে দিনের বেলায় যেসব স্টেশনে ট্রেন থেমেছে, আমি ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফর্মে পায়চারী করেছি, এটা-সেটা কিনে খেয়েছি। ২১-১১-৫৮ তারিখে সকাল সাড়ে দশটায় আমাদের ট্রেন হাওড়া রেলস্টেশনে এসে থামলো। কোলকাতায় হোটেলে উঠেছিলাম। কোলকাতার প্রধান আকর্ষণ হলো ভারতীয় সিনেমা দেখা। গোসল করে খাওয়া-দাওয়া সেরে সিনেমা দেখতে এবং কিছু জিনিসপত্র কেনার জন্য ছুটলাম। হোটেলে ফিরতে একটু রাত হয়ে গিয়েছিল। হোটেলে ঢুকে দেখি ম্যানেজার সাহেব কয়েকজন খেলোয়াড়ের সাথে বসে আছেন। আমাকে দেখেই তিনি ডাকলেন। কাছে যেতেই চিৎকার করে আমাকে বকাবকি করতে শুরু করে দিলেন। কার সাথে আমি বাইরে গিয়েছিলাম, যদি হারিয়ে যেতাম ইত্যাদি ইত্যাদি বলে গেলেন। তার বকাবকির চোটে আমিও ভ্যাঁ করে কেঁদে দিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার সাহেব ডেকে আদর করে মিষ্টি খেতে দিয়েছিলেন। এ কথাটা আজও স্পষ্ট মনে আছে। কোলকাতার ভিসা নং ২৩৫৪২, তাং ২১/১১/৫৮-এর বলে। কোলকাতায় আমরা একদিন অবস্থান করেছিলাম।
২২-১১-৫৮ তারিখে রাত ৯টায় শিয়ালদহ রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে করে আমরা ঢাকার পথে রওনা হলাম। রাত প্রায় সাড়ে ১১টায় আমাদের ট্রেন এসে থামলো বানপুর স্টেশনে। ভারতীয় বর্ডার। রেলস্টেশনেই পাসপোর্ট-কাস্টম চেকিং হলো। তারপর ট্রেন পাকিস্তান সীমানায় দরশনা রেলস্টেশনে পৌঁছালো। এখানেও পাসপোর্ট এবং কাস্টমস চেকিং করে আমাদেরকে পাকিস্তানের মাটিতে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়েছিল। ভোর রাতের দিকে ট্রেন ফুলছুরি ঘাটে পৌঁছালো। নদী পার হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট রেলস্টেশনে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সকাল হয়ে যায়। ট্রেনে চড়ে আমরা ঢাকার পথে যাত্রা শুরু করি। অবশেষে ২৩-১১-৫৮ তারিখে সকাল ১০টায় ট্রেন ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে ফুলবাড়িয়া টু মুলতান বাই ট্রেন সফর সমাপ্ত হয়েছিল।


(বাইশ)
১৯৫৯ বছর ছিল আমার খেলোয়াড়ী জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। নিজের যোগ্যতাকে মেলে ধরার বছর। সে বছর বেশ কয়েকটি খেলায় নিজেকে তুলে ধরার সুযোগ হয়েছিল।
অষ্টম পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপ ’৫৮ শেষে মুলতান থেকে ঢাকায় ফিরে দেখলাম শীতকালীন খেলা হকি, ক্রিকেট অ্যাথলেটিক্স প্রভৃতি খেলার অনুশীলন পুরোদমে চলছে। বিশেষ করে হকি লীগ শুরু হওয়ার পথে। নেমে পড়লাম মাঠে, সকালে অ্যাথলেটিক্স, বিকেলে হকি, ছুটির দিনগুলোতে সারাদিন ক্রিকেট।  এক সকালে অনুশীলনকালে সামান্য একটি ব্যাপারে কাব কর্মকর্তাদের সাথে মোমিন ভাই এবং আলমগীর ভাইয়ের ভুল বুঝাবুঝি, মনোমালিন্য, শেষে তাদের কাব ছেড়ে চলে যাওয়া। ভিক্টোরিয়া কাব ছেড়ে তারা এসএ মহসীন ভাইয়ের অনুরোধে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবে যোগ দিয়েছিলেন এবং সে বছর সে কাবের পক্ষে হকি খেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদের সাথে আরো কয়েকজন হকি খেলোয়াড় ভিক্টোরিয়া কাব ছেড়ে চলে গিয়েছিল। নূরু ভাই, সালাম ভাই ভিক্টোরিয়া কাবে রয়ে গিয়েছিলেন। ভিক্টোরিয়া কাব ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনও মনে আসেনি; কারণ কাব কর্মকর্তাদের প্রতি ছিল আমার শ্রদ্ধাবোধ এবং কাবের প্রতি ছিল আন্তরিকতা। সুতরাং গোলপোস্ট পাহারা দেয়ার জন্য নূরু ভাই, মধ্যমাঠ সামলাতে সালাম ভাই আর অগ্রভাগে আমি আক্রমণ চালাবার জন্য ভিক্টোরিয়া কাবেই থেকে গেলাম। খোরশেদ, আনোয়ার, সগির, কাইভ নতুন-পুরাতন হকি খেলোয়াড় নিয়ে দল গঠন করা হয়েছিল। খোরশেদ আনোয়ার, সগির, কাইভ নতুন, দুলু দা ময়মনসিংহ থেকে এসেছেন। অভিজ্ঞ খেলোয়াড় আকবর আলী, আমীর আলী দুই ভাই এবং বুলবান এই তিনজন আরমানিটোলা স্কুলের হকি খেলোয়াড়। অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের এই টিম ফাইটিং টিম হিসেবে গড়ে উঠেছিল।
মোমিন ভাই এবং আলমগীর ভাই ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের শক্তিশালী হকি দল গঠন করেছিলেন। সে বছর হকি লীগের একটি মাত্র খেলার কথা খুব ভালভাবে মনে আছে। আর সেটি হলো ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের বিরুদ্ধে আমাদের ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের খেলা। খেলা হয়েছিল ওয়ারী (কাব) মাঠে। আউটার স্টেডিয়ামের মসজিদের  পশ্চিমে বর্তমানে হকি স্টেডিয়ামের পূর্ব গ্যালারি নিয়ে ছিল ওয়ারীর মাঠ। খেলার একটি স্মরণীয় ঘটনা আজও চোখে ভাসে। মোমিন ভাই এবং আলমগীর ভাইয়ের ভিক্টোরিয়া থেকে চলে যাওয়া, আমাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী দল নিয়ে মাঠে নামা সহজে আমরা মেনে নিতে পারিনি। চাপা ক্ষোভ থেকে একটা জেদ চেপে গিয়েছিল সেদিন মাঠে।
মনে পড়ে, মাঠের উত্তর দিক দিয়ে আমরা আক্রমণ চালাচ্ছিলাম। আমি লেফট-ইন পজিশনে খেলছিলাম। একটি বল ধরে দ্রুতবেগে আমি মাঝমাঠ অতিক্রম করছি, মোমিন ভাই খেলছিলেন রাইট-হাফ পজিশনে, আমাদের লেফট আউটকে গার্ড রাখছিলেন। বল নিয়ে আরো গতিতে যখন ওয়ান্ডারার্সের ‘ডি’র দিকে ছুটছিলাম, মোমিন ভাই লেফট আউটকে ছেড়ে আমাকে বাধা দিতে ছুটে এসেছিলেন। এমন সময় মোমিন ভাই তার বাম হাত বাড়িয়ে আমার জার্সি টেনে ধরার চেষ্টা করেন কিন্তু আমার জার্সির বদলে তার হাতে ধরা পড়লো আমার জার্সির পকেট। জার্সির পকেটটি মোমিন ভাইয়ের হাতেই ধরা ছিল। এরই মধ্যে আমি ওয়ান্ডারার্সের ‘ডি’তে ঢুকে সজোরে গোলপোস্টে হিট চালিয়েছিলাম। বল গোলপোস্টের ভেতর  আঘাত করলে সবাই ‘গোল’ বলে চিৎকার করে উঠেছিল। যে গোলটি আমার হকি খেলার ক্যারিয়ারের একটি স্মরণীয় গোল।
আমাদের ফুলব্যাক ময়মনসিংহের দুলু দা’র সুবাদে লীগ খেলা শেষে ভিক্টোরিয়া কাব হকি টুর্নামেন্ট খেলার জন্য ময়মনসিংহ গিয়েছিল। ঢাকার বাইরে হকি খেলতে যাওয়া এটাই প্রথম এবং ময়মনসিংহ যাওয়াটাও আমার প্রথম। ট্রেনে চড়ে গিয়েছিলাম। স্টেশনে নেমে রিকশায় দুজন করে উঠে বসলে, আট-দশটা রিকশা লাইন করে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে পথচারীরা তাকিয়ে তাকিয়ে আমাদের দেখছিল। হাতে ছিল হকি স্টিক, তাকিয়ে দেখার সেটাও একটা কারণ হতে পারে। কিছুদূর এগিয়ে গেলেই চোখে পড়েছিল ‘অলকা’ সিনেমা হল। সিনেমা দেখতে বেশি পছন্দ করি বলে আগেভাগে সিনেমা হল চোখে পড়ে যায়। রাস্তার পাশে বিরাট একটা পানির ট্যাঙ্ক। রিকশাওয়ালা বলে দিল, গাংগিনা পাড় পানির ট্যাঙ্কি। জেলা স্কুল, টাউন হল হয়ে রিকশা এসে থেমেছিল নিরিবিলি একটি দোতলা বাড়ির সামনে। সেটা ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী পন্ডিতপাড়া কাব। হাতে ব্যাগ এবং হকিস্টিক নিয়ে সরু একটা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গিয়েছিলাম। বড় একটা ঘর, ঘরজুড়ে নিচু কাঠের চৌকি, সাদা চাদরে মোড়ানো। মাঝ বরাবর কাঠের পার্টিশন দেয়া, তারই একধারে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পন্ডিতপাড়া কাবের চতুর্দিকের পরিবেশ খুব সুন্দর। আকৃষ্ট  করার মত। কাবের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা পূর্ব দিকে সোজা চলে গেছে নদীর ধারে। দু’পাশে উঁচু উঁচু ঝাউ গাছ, পাশে জমিদার বাড়ি। কাবের সামনেই বিরাট মাঠ, তারপরই সার্কিট হাউস। পরদিন খেলা, রাতে আমাদের খেলার ব্যাগ মাথায় দিয়ে ঘুমাতে হয়েছিল। পার্টিশনের ওধারে কাব কর্মকর্তাদের তাস খেলা আর চেঁচামেচিতে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। সকাল দশটার দিকে একপশলা বৃষ্টি হয়ে খেলার আগ্রহটাকে অনেকটা নির্জীব করে দিয়েছিল আর এর প্রভাবটা মাঠে আমাদের খেলায় গিয়ে পড়েছিল।
পন্ডিতপাড়া কাবের সম্মুখে সার্কিট হাউস মাঠে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পিচ্ছিল এবং উঁচু-নিচু মাঠ, স্বাভাবিক খেলাটাও আমরা খেলতে পারছিলাম না। বল না হচ্ছিল কন্ট্রোল, না করা যাচ্ছিল আদান-প্রদান। আমাদের বিপক্ষে স্থানীয় দল বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে হিটিং-এর সাহায্যে খেলছিল। শেষ পর্যন্ত তারা একটি  শট কর্নার (বর্তমানে যা পেনাল্টি কর্নার)-এর মাধ্যমে গোল করে। আমরা কিছুতেই সেই গোল শোধ করতে পারিনি। পরদিন আমরা ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম।
১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ মাঠে আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নবকুমার ইন্সটিটিউশনের পক্ষে এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আমি ব্রডজাম্প এবং হপ স্টেপ এন্ড জাম্পের পূর্ববর্তী প্রাদেশিক রেকর্ড যথাক্রমে ২০ ফুট ৮ ইঞ্চি এবং ৪০ ফুট ১০ ইঞ্চির স্থলে ২০ ফুট ১০ ইঞ্চি ও ৪২ ফুট ৫ ইঞ্চি অতিক্রম করে দুটি নতুন প্রাদেশিক রেকর্ড স্থাপন করেছিলাম। তাছাড়া এই প্রতিযোগিতায় ১৩ পয়েন্ট পেয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্মানও অর্জন করেছিলামÑ যা দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার এবং দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৫৯ সালে পাকিস্তান কাউন্সিল অব ইউথ-এর উদ্যোগে পাকিস্তানজুড়ে ইউথ ফেস্টিভ্যাল উদযাপন করা হয়েছিল। কালচারাল প্রোগ্রাম, স্পোর্টসসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ৫ মার্চ তারিখটি পালন করা হয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে ঢাকা ইউনিভার্সিটি খেলার মাঠে অ্যাথলেটিক্স কম্পিটিশনের আয়োজন করা হয়েছিল। শুধু রানিং ইভেন্টের প্রতিযোগিতা হবেÑ এই ধারণা করে আমি এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলাম না। কারণ আমার ইভেন্ট ছিল জাম্প। আমার ‘র‌্যালে’ সাইকেলে চড়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা দেখার উদ্দেশ্যে ইউনিভার্সিটি মাঠে গিয়েছিলাম। মাঠে গিয়ে জানতে পারলাম, ১০০ গজ দৌড় এবং ব্রডজাম্প এই দু’ইভেন্টের প্রতিযোগিতা হবে।
বন্ধুরা সব ধরে বলে অংশগ্রহণ করতে হবে এ প্রতিযোগিতায়। বিশেষ করে ব্রডজাম্প ইভেন্টে। বন্ধুরাই খোঁজাখুঁজি করে আমার পায়ের মাপের একজোড়া রানিং সু জোগাড় করে এনেছিল। হাফপ্যান্ট সব সময় ফুল প্যান্টের নিচে পরতাম। ব্যাস, মাঠে নেমে পড়লাম। প্রথম ইভেন্ট ১০০ গজ দৌড়। জগন্নাথ কলেজের কাদেরসহ বেশ ক’জন ¯িপ্রন্টার অংশ নিতে স্টার্টিং পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। সাহস করে আমিও তাদের সাথে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। ১০০ গজ দৌড়ে আমি কোনদিন প্রতিযোগিতা করিনি; তবে ৪ঢ১০০ গজ রিলে রেসে স্কুলে সব সময় অংশ নিতাম এবং দলগতভাবে প্রথম হতাম। দুরু দুরু বুকে হুইসেলের অপেক্ষা করছিলাম। হুইসেল হলো, দৌড় শুরু হলো এবং দৌড় শেষও হলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম নাÑ কখন ফিনিশিং টেপে বুকটা ছুঁয়েছিল। বন্ধুরা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছিল, বুঝলাম প্রথম হয়েছি। সেদিনই নিজেকে ¯িপ্রন্টার হিসেবে খুঁজে পেয়েছিলাম। দ্বিতীয় ইভেন্ট ব্রডজাম্পেও প্রথম হয়েছিলাম।  প্রতিযোগিতা শেষে পাকিস্তান কাউন্সিল অব ইউথ-এর সম্মানসূচক সার্টিফিকেট এবং পুরস্কার নিয়ে বাসায় ফিরেছিলাম। পাকিস্তান ক্রীড়াক্ষেত্রে ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম চালু হয়েছিল ১৯৫৮ সাল থেকে। পাকিস্তান স্পোর্টস কন্ট্রোল বোর্ডের স্টুডেন্টস কোচিং কোর্সের মাধ্যমে হকি, ক্রিকেট এবং ফুটবল এই তিনটি খেলায় ছাত্রদের মধ্য থেকে ট্যালেন্ট খুঁজে বের করে তাদের কোচিং-এর মাধ্যমে মানসম্পন্ন খেলোয়াড় গড়ে তোলা ছিল মূল লক্ষ্য। হকির জন্য লাহোর, ক্রিকেটের জন্য করাচি এবং ফুটবলের জন্য ঢাকাকে বাছাই করা হয়েছিল। প্রতিটি প্রভিন্স থেকে দশজন করে (স্কুল থেকে পাঁচজন এবং কলেজ থেকে পাঁচজন) সর্বমোট পাঁচ প্রভিন্সের পঞ্চাশজন বাছাইকৃত খেলোয়াড় নিয়ে মাসব্যাপী কোচিং ক্যাম্প করা হতো। ১৯৫৯ সালে এই প্রোগ্রামে হকির জন্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের স্কুল থেকে পাঁচজনকে বাছাই করা হয়েছিল। তন্মধ্যে সৈয়দ রফিক হোসেন বুলবান, মোহাম্মদ নাসিম, নাজিমউদ্দিন, সুরেশ এবং আমি।


(তেইশ)
লেখাপড়া আর খেলাধুলাÑ এ দুটোর দ্বন্দ্ব প্রতি বছরই আমাকে সমস্যায় ফেলে দিত। বিশেষ করে শীত মৌসুমে। অ্যাথলেটিক্স, হকি, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন প্রভৃতি শীতকালীন খেলা যেমন খেলতে হতো, তেমনি শীতকালেই পরীক্ষা দিতে হতো। সবকিছু সামাল দিতে বেশ কষ্ট হতো। বিশেষ করে ম্যাট্রিক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য খেলাধুলা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবার ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য অ্যাথলেটিক্স এবং হকি খেলায় ইস্ট পাকিস্তান টিমে চান্স পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলাম। ১৯৫৯ সালে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা এবং শীতকালীন খেলাধুলার মধ্যে দ্বন্দ্বের একটি চিত্র এখানে তুলে ধরছি।
১৬ ফেব্রুয়ারি, সোমবার, ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। পরীক্ষার পূর্বে জানুয়ারি মাসে হয়েছিল ঢাকা সিটি আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। সেই প্রতিযোগিতায় আমি ব্রডজাম্প এবং হপস্টেপ এন্ড জাম্পে ইস্ট পাকিস্তান রেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছিলাম এবং ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। ২০-২৩ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমি ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের পক্ষে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলা আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা রেঞ্জ আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন, ১ মার্চ ১৯৫৯ প্রভিন্সিয়াল আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতাÑ যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেদিন আমি সদরঘাটে ঢাকা কলেজিয়েট হাইস্কুলে হাইজিন পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। পরীক্ষা দেব, না ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ  নেবÑ এরকম পরিস্থিতিতে আমাকে দুটোতেই অংশ নিতে হয়েছিল। দ্রুত পরীক্ষা শেষ করে ছুটে গিয়েছিলাম সেদিন ইউনিভার্সিটি মাঠে। হ্যাঁ, পরীক্ষায় পাস করেছিলোম।
লেখাপড়ার জন্য খেলাধুলাকে বাদ দেয়া যেমন আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তেমনি খেলাধুলার জন্য লেখাপড়া করতে না পারাটাও ছিল আমার জন্য ভীষণ কষ্টকর। আবার দুটো সমানতালে চালিয়ে যাওয়াটাও ছিল কঠিন ব্যাপার। আর এ দুটোর দ্বন্দ্বে আমি চলার পতে পিছিয়ে পড়েছিলাম।
পাকিস্তান স্পোর্টস কন্ট্রোল বোর্ডের  স্টুডেন্টস কোচিং কোর্সের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুলের মোহাম্মদ নাসিম, আরমানিটোলা গভঃ হাইস্কুলের মোহাম্মদ নাজিমুদ্দিন, সুরেশ কোন স্কুলের মনে নেই, নবকুমার ইন্সটিটিউশনের সৈয়দ রফিক হোসেন বুলবান এবং আমি লাহোর যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। সে সময় প্লেনে উড়ে বেড়ানো স্কুলপড়–য়া ছাত্রদের জন্য ছিল একটি স্বপ্ন। আমাদের সবার কাছে প্লেনে ওঠা নতুন, জীবনে কোনদিন প্লেনে উঠিনি। রোমাঞ্চকর অনুভূতি সবার মনে।
অবশেষে আমাদের অপেক্ষার অবসান ঘটলো জুন (১৯৫৯) মাসের একটি তারিখে। জুন-জুলাই, দু’মাসের কোর্স। মাহুৎটুলী থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দর অনেক দূর ছিল। সাত রওজা, জেলখানা, নাজিমউদ্দিন রোড, তারপরই তেকুইনা মাঠ আর কার্জন হলের মাঝ দিয়ে এগিয়ে গেলেই রেসকোর্স মাঠ, রেসকোর্সকে ডান দিকে রেখে সামনে এগিয়ে গেলে শাহবাগ হোটেল। বর্তমানে পিজি হাসপাতাল, এর ডান পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলে পাক মটর, বর্তমানে বাংলামটর।  বর্তমান সোনারগাঁও হোটেল এবং সুন্দরবন হোটেলের মাঝামাঝি স্থানে একটি পুল ছিল। পুল পার হয়ে সোনারগাঁও হোটেলের সামনে দিয়ে উত্তর দিকে কাওরান বাজার; কাওরান বাজার হয়ে সামনে (উত্তরে) এগিয়ে গিয়ে পলিটেকনিক্যাল কলেজ এবং হলিক্রস কলেজের রাস্তা দিয়ে ফার্মগেটে উঠে বর্তমানে সেরাস্তা ফার্মগেট থেকে সোজা এয়ারপোর্টে চলে গেছে, সে রাস্তা আগেও ছিল। মাহুৎটুলী থেকে উপরোক্ত রাস্তাগুলো দিয়ে সেদিন আমরা এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম। তখন রাস্তাগুলো সরু ছিল।
শুধু প্লেনে ওঠাই আমার জন্য প্রথম ছিল না, বরং বিমানবন্দরে ঢোকাটাও আমার জন্য প্রথম ছিল। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ জারি করা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট মোঃ আইয়ুব খানের ঢাকা আগমন উপলক্ষে স্কুল থেকে আমাদেরকে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বিমানবন্দরের গেটের বাইরে আমরা লাইন করে দাঁড়িয়ে তাকে ওয়েলকাম ওয়েলকাম বলে স্বাগতম জানিয়েছিলাম। বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকার সুযোগ হয়নি।
পূর্ব পাকিস্তানে অভ্যন্তরীণ ফাইটগুলো ছোট প্লেন দ্বারা ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-যশোর, ঢাকা-সৈয়দপুর, ঢাকা-কুমিল্লা, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার যাতায়াত করত। ছোট প্লেনগুলোর নাম ছিল ডেকোডা, দুটো পাখাওয়ালা প্লেন। সে সময় প্লেনের টিকিটের মূল্য অত্যন্ত সস্তা ছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে, ঢাকা-চট্টগ্রামের ভাড়া ছিল ৪৫ রুপিজ, ঢাকা-যশোরে-৪০ রুপিজ, ঢাকা-কুমিল্লা এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার প্লেন ভাড়া ছিল মাত্র ১৫ রুপিজ। ঢাকা-করাচি এবং ঢাকা-লাহোর একই ভাড়া ২৫০ রুপিজ। ঢাকা-লাহোর দূরত্ব ১০০০ মাইল এবং ঢাকা-করাচির দূরত্ব ১২০০ মাইল।
গত বছর ট্রেনে করে ঢাকা থেকে পাকিস্তানের মুলতান গিয়েছিলাম। ফেরার পথে লাহোর একদিন অবস্থান করেছিলাম; সুতরাং ঢাকার বাইরে যাওয়া নিয়ে মা’র সেরকম দুশ্চিন্তা ছিল না, তার বড় চিন্তা প্লেন নিয়ে। ২৫০ জন মানুষ নিয়ে আকাশে কেমন করে এত বড় প্লেনটা উঠবে, যদি কোন কারণে পরে যায়Ñ তাহলে কি হবে! পাঁচ ঘন্টা সাড়ে-পাঁচ ঘন্টা আকাশে কেমন করে ভেসে থাকবে, প্লেনের ভেতর দম বন্ধ হয়ে যাবে না তো ইত্যাদি। প্লেন নিয়ে নানারকম গবেষণা আর দুশ্চিন্তা করে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আমার যাওয়ার দিন কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলেন মা। ছোটবেলার বন্ধু ও সহপাঠী বুলবান আমার সাথে যাচ্ছে- এটাই তার একমাত্র সান্ত্বনা।
এয়ারপোর্টের সব ফরমালিটিজ এবং দেখা-সাক্ষাৎ শেষ করে প্লেনে ওঠার পালা। প্লেনে নতুন চড়ার আনন্দ এবং অজানা আশংকা, মিশ্র এক অনুভূতি নিয়ে প্লেনে গিয়ে উঠলাম। প্লেনে ঢুকেই মনে হলো স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে, দম বন্ধ হয়ে যাবে। প্লেনে ওড়ার আনন্দ এতক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। একসময় প্লেনের দরজা বন্ধ হলো। বাইরে থেকে প্লেনকে যতটুকু দেখা যায়, প্লেনের ভেতরে তার চেয়ে অনেক বড়, অনেক জায়গা। জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যাচ্ছিল, প্লেনের চারটি পাখা একসঙ্গে চালু হলো, ধীরে ধীরে প্লেনটি চলতে শুরু করল। নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে প্লেনটি দাঁড়ালো, চারটি পাখা সজোরে ঘুরতে লাগল, তারপর প্লেনটি দ্রুতগতিতে ছুটতে আরম্ভ করল, দু’ধারের গাছপালাগুলোও দ্রুত পেছনে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই প্লেনটিকে শূন্যে দেখতে পেলাম, অনবরত উপরের দিকেই উঠে যাচ্ছে। একসময় মহাকাশে আমাদের প্লেনকে ভেসে থাকতে দেখা গেল। তখন মনে হচ্ছিল প্লেনটি বুঝি এক স্থানে স্থির হয়ে আছে। প্লেনে আমি চুপটি করে বসেছিলাম। প্লেনে চড়ে লাহোর যাওয়ার আনন্দ, বন্ধুদের সাথে গল্প করা, সব বন্ধ হয়ে গেল। শ্বাসকষ্ট তীব্র হতে লাগল, বমি হওয়ার উপক্রম হলো, এয়ার হোস্ট্রেস এসে সিটের উপরে বাতাসটা জোড় করে দিলেন। কাগজের মোটা ব্যাগ সিটের পেছনে ছিল, দেখিয়ে বলে গেলেন, বমি করতে হলে ঐ ব্যাগে করতে হবে। অস্বস্তি আর অসুস্থ অবস্থায় গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। প্লেন যতই নিচের দিকে নামছিল, শরীরটা বেশি খারাপ লাগছিল, বমিও করতে হয়েছিল। প্লেন যখন মাটি স্পর্শ করেছিল, তখন মনে হলো আমি প্রাণে বেঁচে গেলাম।
প্লেন থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে আগুনের ঝাপটা মুখে এসে লাগল, প্রচন্ড গরম। বোর্ডের লোকজন এসেছিলেন আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। এয়ারপোর্ট থেকে দূরে শহর। আমাদের গাড়ি একটি দোতলা বাড়ির গেট দিয়ে ভেতর ঢুকেছে; চারদিকে গাছ-গাছালি এবং ছোট ফুলের বাগান। বাড়ির দরজায় গাড়ি থামল, দরজার পাশেই বিরাট এক জামগাছ, জাম মাটিতে পড়ে আছে। আমরা স্কুলের পাঁচজন এবং কলেজ-ইউনিভার্সিটির পাঁচজন, মোট দশজন ভেতরে ঢুকলাম। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল দোতলায়। কলেজের পাঁচজনের মধ্যে একজনকেই চিনতাম, তিনি জাকির ভাই, আরমানিটোলা গভঃ হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের হকি গোলকিপার, আমরা এক সাথে ভিক্টোরিয়া কাবে খেলতাম। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তিনি দেশে যাওয়ার পথে মিরপুরে পাকিস্তানী পুলিশ এবং রাজাকারদের দ্বারা নিহত হয়েছিলেন। কোচিং শব্দটির সাথে তখনও আমাদের পরিচয় ঘটেনি। খেলাধুলায় কোচিং এবং কোচ এর ভূমিকা বা গুরুত্ব সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ছিল না। সে সময় আমার তিন বছরের কাব জীবনে অ্যাথলেটিক্স, ক্রিকেট, ফুটবল, হকি কোন খেলাতেই কোচ হিসেবে কাউকে পাইনি, সিস্টেমেটিক কোন কোচিংও পাইনি। গত বছর (১৯৫৮ সাল) পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দল ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপ খেলতে মুলতান গিয়েছিল। সেখানেও কোন কোচ ছিল না। সব সময় দলের বা কাবের সিনিয়র খেলোয়াড়রা ট্রেনিং বা প্র্যাকটিস করাতেন। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবে সালাম ভাই আমাদের ট্রেনিং করাতেন।  আমরা তখন ট্রেনিং এবং প্র্যাকটিস এ দুটো শব্দের সাথে বেশি পরিচিত ছিলাম।
লাহোরে হেইলি কলেজ অব কমার্স-এর হোস্টেলটি অল পাকিস্তান স্টুডেন্টস হকি কোচিং কোর্সের ক্যাম্প করা হয়েছিল।  সেখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। কোর্সের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন কর্নেল আইএস দারা। যিনি ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তান উভয় দেশের পক্ষে অলিম্পিকে খেলেছিলেন হকির কিংবদন্তী ধ্যানচাঁনের সহ-খেলোয়াড় হিসেবে। রাইট ইন পজিশনে খেলতেন। কোচ বা ট্রেইনার হিসেবে আরো দুজন ছিলেন যারা আইএস দারা প্রধান কোচকে সহযোগিতা করতেন।
ক্যাম্পের উল্টোদিকে বিরাট খেলার মাঠ, আমাদের আউটার স্টেডিয়ামের (হকি স্টেডিয়াম তৈরির পূর্বের) মত। সেটারই এক ধারে আমাদের অনুশীলনের মাঠ।
কোচিং ক্যাম্পের নোটিশ বোর্ডে কোর্সের প্রোগ্রাম (রুটিন) নোটিশ বোর্ডে টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছিল। সকালে দু’ঘন্টা, বিকেলে তিন ঘন্টা হকি প্রশিক্ষণ, সকাল ১১-১২ হকি সম্বন্ধে লেকচার। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার এবং রাতের ডিনারের সময় দিয়ে দেয়া হয়েছিল। বিশেষ করে রাতের ডিনারে সময়মত সবাইকে উপস্থিত থাকতে হতো। প্রতি সপ্তাহে ডিনারে একজন সম্মানিত ব্যক্তিকে নিমন্ত্রণ জানানো হতো। তার সংক্ষিপ্ত ভাষণের পরই ডিনার খাওয়া শুরু হতো। রাত দশটায় লাইট অফসহ ক্যাম্পের নিয়মকানুনও নোটিশে উল্লেখ ছিল। নির্দিষ্ট তারিখে বিকেলে আইএস দারা তার কড়া বক্তৃতার মাধ্যমে কোর্সের উদ্বোধন করেছিলেন।
পরদিন সকাল থেকে শুরু হয়েছিল হকি কোচিং। যেহেতু আমি সারাবছর খেলার মধ্যে থাকি বলে সকালে হকি প্রশিক্ষণে আমার কোন অসুবিধা হয়নি। বুলবানও হকি লীগ খেলা শেষ করে স্কুল মাঠে ফুটবল খেলতে শুরু করেছিল, তারও সেরকম অসুবিধা হয়নি। বাকি তিনজন সকালের প্রশিক্ষণেই কাহিল হয়ে পড়েছিল। সকালের অনুশীলনে দম বাড়াবার জন্য লং রানিং, শারীরিক ফিট রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করানো হতো। এ জন্য আর্মি থেকে একজন ট্রেইনারকে আনা হতো। তার কথা খুব মনে পড়ে। তিনি তার ভাষায় বলতেন, ‘ঘোড়ে কে তারাহ দৌড়ো।’ (ঘোড়ার মত দৌড়াও) কুত্তেকে তারাহ দৌড়ো। (কুত্তার মত চার হাত-পায়ে দৌড়ানো), মেন্ডাককে তারাহ চালো (ফ্রগ রেস যাকে আমরা বলি)Ñ এরকম অদ্ভুত ধরনের ব্যায়াম তিনি করাতেন। ব্যক্তিগত স্কিল বাড়াবার জন্য হিটিং, স্টপিং, ডজিং, রানিং উইথ বল পোস্টে হিটিং ইত্যাদিও সকালে করানো হতো।
সকাল ১১টা থেকে ১২টা লেকচার কাসে একজন করে কৃতী হকি খেলোয়াড়কে আনা হতো। তিনি তার সম্বন্ধে কিছু বলে তার নিজ খেলার পজিশন সম্বন্ধে আলোচনা করতেন। মাঠে সেই পজিশনের দায়িত্ব এবং কর্তব্য কি বুঝিয়ে বলতেন। বিকেলে আমরা সে অনুযায়ী খেলার চেষ্টা করতাম।
বিকেলের অনুশীলনে হকি ম্যাচ খেলা। প্রথম দিনেই বুঝতে পেরেছিলাম, পশ্চিম পাকিস্তানীদের হকি খেলার সাথে আমাদের খেলার পার্থক্যটা। সাবলীল গতি, বল কন্ট্রোল, স্টিক ওয়ার্ক, ছন্দময় খেলাÑ সবই যেন আমাদের চেয়ে ভিন্ন, উচ্চমানের। বুঝতে পারছিলাম তাদের সাথে মোকাবিলা করতে হলে আমাকে প্রচুর খাটতে হবে, বেশি বেশি অনুশীলন করতে হবে। মাঝে মাঝে অন্য টিমের সাথে আমাদের ম্যাচ হতো। ট্রেনিজদের মধ্যে অনেক ভাল খেলোয়াড় ছিল। এদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে পাকিস্তান জাতীয় দলে সুনামের সাথে খেলেছেন। এদের মধ্যে করাচির হামিদ (গোলরক্ষক), কামার আলী খান (ফুলব্যাক), মারগুব (লেফট হাফ), পাঞ্জাবের আসাদ মালিক (লেফট ইন), তারিক নিয়াজি (সেন্টার ফরোয়ার্ড) উল্লেখযোগ্য। আমাদের টিমও অন্য টিমের সাথে খেলতে যেত। সে সময় পাকিস্তানের নাসির বুন্দা, জাকাউল্লাহ মুনীর দারদের মত প্রখ্যাত হকি খেলোয়াড়দের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। এইচসিএন কলেজের জাফর মেমোরিয়াল মাঠে খেলার সুযোগ হয়েছিল। ভারত-পাকিস্তান দু’দেশেরই অলিম্পিয়ান হকি খেলোয়াড়ের স্মৃতি রক্ষার্থে এ মাঠের নামকরণ করা হয়েছিল। মাঠটি  উল্লেখ করার মত, সবুজ ঘাসে ছাওয়া মসৃণ গালিচার মত, একটিও মরা ঘাস খুঁজে পাওয়া যাবে না। হকি খেলার কেডস ছাড়া জুতা পায়ে মাঠে প্রবেশ নিষেধ ছিল। তারা মাঠের যতœ যেমন করে, সম্মানও করে।
আমাদের পুরান ঢাকার জাফরি, সাত রওজার নুর বক্স লেনের শিয়া বাড়ির ছেলে। দেখতে সুন্দর। একদিন সে নায়ক হওয়ার জন্য লাহোরে পাড়ি জমালো, আমরা লাহোর যাচ্ছি শুনে তার বাড়ির মানুষজন আমার হাতে বিরাট বিরাট সাগর কলা ধরিয়ে দিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, জাফরিকে দেয়ার জন্য, সে এসে নিয়ে যাবে। লাহোর এয়ারপোর্টে জাফরির দেখা পেলাম না। অনেকেই কলা বিক্রি করবো কিনা জিজ্ঞেসও করেছিলেন। কলা এবং পানের নাকি সেখানে বেশ চাহিদা, চড়া দামে বিক্রি হয়। ক্যাম্পে কিছুদিন রেখেছিলামও, কলাগুলো পচে যাওয়ার উপক্রম হতেই আমরা এর সদ্ব্যবহার করে ফেলেছিলাম। দেখতে দেখতে মাস কাটিয়ে দিয়েছিলাম ক্যাম্পের জীবন।
একদিন আমরা ঠিক করলাম, জাফরিকে খুঁজতে কোহিনূর স্টুডিওতে যাব, সেই সাথে সাবিহা সন্তোষকে দেখবো, পাকিস্তানী ছবির হিরো-হিরোইন, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের স্বপ্নের জুটি, সারারাত শুটিং দেখবো। সকালে ট্রেনিংয়ে এসে যোগ দেব, কেউ টের পাবে না। একদিন কল্পনার মত রাতের ডিনারের পর বেরিয়ে পড়লাম আমরা পাঁচজন। বাসে করে গেলাম, আমাদের হিরো জাফরির কথা বলে স্টুডিওতে ঢুকলাম, তার খোঁজও করলাম কিন্তু দেখা পেলাম না। এরই মধ্যে বৃষ্টি আরম্ভ হলে শুটিং বাতিল করা হলো। আমাদের সমস্ত প্ল্যান বরবাদ হয়ে গেল। অগত্যা স্টুডিও ঘুরেফিরে দেখতে লাগলাম। কোকিল কন্ঠী নুরজাহান এবং এজাজকে দেখলাম। একসময় নিরাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন গভীর রাত। বাস বন্ধ। ছয়/সাত মাইল দূর থেকে কিভাবে ফিরবো চিন্তা করতে করতে স্টুডিওর বাইরে চলে এসে জুতা হাতে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। প্রচন্ড গরমে ঝির ঝির বৃষ্টিতে দৌড়াতে বেশ আরাম লাগছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যাম্পে পৌঁছে গিয়েছিলাম এবং বাইরের লোহার গেট টপকে ভেতরে ঢুকলেও হোস্টেলে ঢুকতে ধরা পড়ার ভয় ছিল। দারোয়ানকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে সে রাতে হোস্টেলে ঢুকে যে যার বিছানায় সুবোধ বালকের মত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ধীরে ধরে ক্যাম্পের সময়ও একদিন শেষ হয়ে গিয়েছিল। শেষ ডিনারে হেইলী কলেজ অব কমার্সের প্রিন্সিপাল প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। সে ডিনারের কথা মনে আছে। প্রিন্সিপাল সাহেব তার দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে সবার বিরক্তভাজন হয়েছিলেন, তার উপর বক্তৃতাকালে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনভাবে দোলাচ্ছিলেন যে, উপস্থিত সবাই না হেসে পারছিলেন না।
পাকিস্তান স্পোর্টস কন্ট্রোল বোর্ড স্টুডেন্ট কোচিং হকি কোর্স লাহোর থেকে দু’মাসে আমি যা শিখেছিলামÑ তারই ভিতের ওপর আমার পরবর্তী হকির ক্যারিয়ার গড়ে উঠেছিল।   


(চব্বিশ)
লাহোর থেকে দু’মাস পর স্টুডেন্টস হকি কোচিং কোর্স শেষে ফুটবলের ভরা মৌসুমে ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম। লাহোরের স্মৃতি রোমন্থন করার সুযোগ পেলাম না, দু’মাস হকি প্রশিক্ষণ কোর্সে যা শিখেছিলাম, তা নিয়ে কাজ করার বা চর্চা করারও সুযোগ হয়নি। ফুটবল লীগ খেলার জন্য নিজেকে তৈরি করতে মাঠে নেমে পড়তে হয়েছিল। আমার কাব ঠিকানা পরিবর্তনের সম্ভাবনা না থাকায় সেই ভিক্টোরিয়া কাবেই গেড়ে বসেছিলাম অনেকটা স্থায়ীভাবে। কাব এবারও অনুশীলনের ব্যবস্থা করতে পারেনি, অর্থাৎ ফুটবল ক্যাম্প পরিচালনা করা কাবের পক্ষ থেকে সম্ভব ছিল না। অগত্যা আমার স্কুল মাঠই ছিল ভরসা, আমার সব খেলার সঞ্চালন কেন্দ্র। এখানেই সকাল-বিকাল ফুটবলের অনুশীলনের মাধ্যমে ১৯৫৯ সালের লীগ খেলতে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলাম।
এর মধ্যে আমার ম্যাট্রিক পাসের খবর পেয়ে কয়েকটি সংস্থা আমাকে চাকরি দিয়ে তাদের হয়ে খেলার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। তখন সরকারি ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং আধা-সরকারি ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের মধ্যে সব বিষয়ে একটা কম্পিটিশন ভাব লক্ষ্য করা যেত এবং কর্মকর্তাদের মাঝে প্রফেশনাল  জেলাসি বিরাজ করতো, বিশেষ করে স্টেট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ঊষফবৎ ইৎড়ঃযবৎষু মানসিকতা ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তারা কখনও মেনে নিতে পারতেন না। সে সময় দু’ব্যাংকের চাকরিরত কিছু ক্রীড়ামোদী কর্মকর্তা ঢাকায় অবস্থিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় ফুটবল খেলা এবং অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেনÑ এদের মধ্যে ছিলেন স্টেট ব্যাংকের আমিনুল হক চৌধুরী (পরবর্তীতে ডেপুটি গভর্নর), মিঃ বেগ, আবদুল হামিদ (বর্তমানে সাংবাদিক ও ধারাভাষ্যকার) এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের জিএম চৌধুরী (পরবর্তীতে এ প্রতিষ্ঠানের এমডি), ফায়জুল কবির, ওয়ারী কাবের প্রাক্তন গোলরক্ষক নূরুল ইসলাম নান্না (ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের খেলোয়াড়) প্রমুখ। নিজ নিজ দলকে শক্তিশালী করে গঠন করার লক্ষ্যে ব্যাংকগুলো খেলোয়াড় নিয়োগের প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছিল। এরই অংশ হিসেবে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কর্মকর্তারা আমার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। নূরুল ইসলাম নান্না দা আমাকে ব্যাংকের পক্ষে চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
যে ছেলে সারা বছর খেলে বেড়ায়, যে ছেলে সারাদিন খেলা নিয়ে মেতে থাকে, তার পক্ষে এক স্থানে বসে চাকরি করা কি সম্ভব? রাজি হইনি। এদিকে বড় ভাই পড়ালেখা ক্ষান্ত দিয়ে সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়েছেন। বয়সের ভারে বাবা কান্ত, কিছু করা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। বিধবা খালা ও বড় বোনসহ সংসার নেহাত ছোট ছিল না। খেলাধুলা করে টাকা পাওয়া গেলে হয়তো সংসারে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারতাম কিন্তু সে সময় খেলে টাকা কামানো কল্পনার অতীত ছিল। খেলাটা ছিল শুধুই আনন্দের জন্য, খেলাকে ভালবেসে এর নেশাতেই মাঠে পড়ে থাকা। সংসারের কথা চিন্তা করেই তখন চাকরি করতে রাজি হয়েছিলাম, শর্ত ছিলÑ কাজ করতে পারব না। অফিসে গিয়ে হাজিরা দিয়েই ছুটি। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের কর্মকর্তারা তাতেই রাজি হয়েছিলেন।
একদিন ডাক পড়েছিল লিখিত পরীক্ষা দেয়ার। অনেকের সাথে পরীক্ষা দিয়েছিলাম, মৌখিক পরীক্ষাও দিতে হয়েছিল। অবশেষে রঞ্জিত দাস, (মোহামেডানের গোলরক্ষক), সিরাজউদ্দিন আহমেদ (ইস্টএন্ড কাবের রাইট-ইন, মধুসূদন বণিক (ফুলব্যাক) এবং আমাকে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, লোকাল প্রিন্সিপাল অফিস, ঢাকার পত্র নং ঊঝ/অচঐ/৪৪/৪৪৪৭৭৫-এর মাধ্যমে জুনিয়র কার্ক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, বেসিক বেতন ছিল ৮৫ রুপিজ, বেতন স্কেল ৮৫-৫-১৩০-২০০/-। আমাদের মাসিক বেতন সর্বমোট ১৮৫ রুপিজ ধার্য করা হয়েছিল। আমি ৫ আগস্ট ১৯৫৯ তারিখে আমাদের সদরঘাটস্থ লোকাল প্রিন্সিপাল অফিসে জয়েন করেছিলাম।
স্টিমার ঘাটের দিকে যেতে সদরঘাটের চৌরাস্তা পার হলেই হাতের ডানদিকে কুমিল্লা ব্যাংকিং কর্পোরেশনের হলুদ রঙের  তিনতলা বিল্ডিং, নিচতলায় ছিল ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এবং দোতলা-তিনতলায় ছিল ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের লোকাল প্রিন্সিপাল অফিস, ঢাকা (পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান কার্যালয়)।
সদরঘাটের ভিক্টোরিয়া পার্কের উল্টোদিকে ছিল স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের আঞ্চলিক প্রধান অফিস। শিবু, রেমন্ড, লিটন, সোবহান, নওশা কবির, জহির প্রমুখ খেলোয়াড়কে চাকরি দিয়ে তারাও তাদের দলকে শক্তিশালী করে গঠন করেছিল। ভিক্টোরিয়া পার্কের নাম পরবর্তীতে বাহাদুর শাহ পার্ক নামকরণ করা হয়েছে; তবে আমরা ছোটবেলা থেকে আন্টাঘর ময়দান বলে জানতাম। সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭) চলাকালে বিদ্রোহীদেরকে ইংরেজরা এ মাঠে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছিল।
১৯৫৯ সালের ফুটবল লীগ খেলার জন্য সেবারও ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের কোন পরিবর্তন হয়নি। তাদের সেই পুরনো খেলোয়াড় আইজ্যাক, রনি, ববি, খান, মধুরা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে খেলেই ফিরে যেতেন। তাদের মত আমিও যেদিন খেলা সেদিন বাসা থেকে এসে খেলেই বাসায় ফিরে যেতাম, অনেকটা ভাড়া খেলার মত। টিমওয়ার্ক এবং দলীয় সমঝোতা গড়ে তোলার সুযোগ পেতাম না। যার জন্য মাঠে ভুল পাস এবং ভুল  বোঝাবুঝির মহড়া চলত বেশি।  তবে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করতাম ভাল খেলার, দলকে একটি জয় এনে দেয়ার। ম্যাচ শেষে পরিশ্রান্ত, কান্ত এবং হতাশা নিয়ে কাব টেন্টে ফিরতাম। পরাজয়ের মাধ্যমে বেশিরভাগ ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হতো। মৌসুমে ফুটবল যে আমাদেরকে একেবারে খালি হাতে ফিরিয়ে দিত তা নয় বরং মাঝেমধ্যে এমন কিছু দুর্লভ জয় উপহার দিতÑ যা দিয়ে পরবর্তী মৌসুম পর্যন্ত ভাল খেলার প্রেরণা হিসেবে আমরা লালন করতাম। এমনি দুটো ম্যাচ আমার স্মৃতিতে বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে- যা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। একটি ম্যাচ ছিল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স-এর বিপক্ষে এবং অন্যটি ছিল কামাল স্পোর্টিং-এর বিপক্ষে।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স তখন দুর্ধর্ষ টিম, এরই মধ্যে তারা ছ’বার লীগ চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় তুলেছে; সেবারও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য দল গঠন করেছিল। লীগের প্রথমদিকের খেলা ভিক্টোরিয়া বনাম ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। ভিক্টোরিয়া বিরাট এক অঘটন ঘটিয়েছিল ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে ১-০ গোলে পরাজিত করে। পরদিন বৃহস্পতিবারের দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা আমাদের প্রশংসা করে এভাবে লিখেছিল :
‘ঠরপঃড়ৎরধং ড়ভভবহপব ষরহব ঢ়ৎড়াবফ ঃড় নব াবৎু বিষষ-পড়সনঁহবফ ধহফ ঃযব ঢ়ষধুবৎং যধফ  ধ মড়ড়ফ ংবহংব ড়ভ ঁহফবৎংঃধহফরহম’ জরমযঃ-রহ ইধংযরৎ, ংঃরষষ রহ যরং ঃববহং ধিং াবৎু ঢ়ষবধংরহম রিঃয যরং পড়ৎৎবপঃ ঢ়ধংংবং ধহফ লঁংঃরভরবফ ফরংঃৎরনঁঃরড়হং.’
দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকা এভাবে প্রশংসা করে লিখেছিল,  ‘ঞযব ুড়ঁহম ধহফ সড়ফবংঃ ারপঃড়ৎরধ শরষষবফ ধ মরধহঃ উধপপধ ধিহফবৎবৎং. ঞড়ি ড়ভ ঃযবরৎ ঢ়ষধুবৎং ংঃড়ড়ফ ড়ঁঃ ধং ধ ফবষরমযঃ ঃড় ঃযব ংঢ়বপঃবঃড়ৎং. খবভঃ রিহমবৎ গধহুড়ড়ৎ, যিড় ংপড়ৎবফ ঃযব ধষষ রসঢ়ড়ৎঃধহঃ মড়ধষ ধহফ ইধংযরৎ, ঃযব ৎরমযঃ রহহবৎ, ঃযব ষধঃঃবৎ ধ ংপযড়ড়ষ নড়ু. বীপবষষবফ রহ ঃযব বীরনরঃরড়হ ড়ভ ংঃধসরহধ, ংশরষষ ্ নৎধরহ ড়িৎশ.’
দু’দলে সেদিন যারা খেলেছিলেন
ভিক্টোরিয়া ঃ তারা, আইজ্যাক এবং আহমেদ খান, মোতালেব, মধু ও আনোয়ার, মোমেন, বশীর, রনি, ববি ও মনজুর।
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ঃ ভাওয়াল, কুদরত উল্লা ভুঁইয়া ও বিনয়, গুহ, তমিজ ও কচি, ফ্রান্সিস মোতালেব-শওকত-মদন ও কান্তি।
রেফারি ঃ মিঃ আলম।
স্মৃতিতে ধরে রাখা অপর ম্যাচটি ছিল কামাল স্পোর্টিং-এর বিপক্ষে। দু’দলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, রেলিগেশন ম্যাচ। যে দল হারবে, দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যাবে। এরকম ডু অর ডাই ম্যাচ গত বছর লীগ খেলায় তেজগাঁও ফ্রেন্ডস-এর বিরুদ্ধে খেলে জয়ী হয়েছিলাম এবং ভিক্টোরিয়া কাবকে রেলিগেশন থেকে বাঁচিয়েছিলাম।  কামাল স্পোর্টিং কাবের সব খেলোয়াড়ের কথা মনে নেই; তবে রাজশাহীর কৃতী ফুটবলার শামসু তখন সে দলের হয়ে খেলেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের সবার প্রিয় সাংবাদিক জামানও সে দলে খেলেছিলেন। সেদিনের উত্তেজনাপূর্ণ খেলার বিষদ বিবরণ এতকাল পর সঠিকভাবে দেয়া হয়তো যাবে না; তবে আমরা ৩-১ গোলে জয়ী হয়েছিলামÑ যার ২টি গোল আমি করেছিলাম। কামাল স্পোর্টিং রেলিগেশন ঠেকাতে পারেনি। ভিক্টোরিয়া কাব সে বছরও দ্বিতীয় বিভাগে অবনমিত হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিল।
দীর্ঘ খেলোয়াড়ী জীবনে বহু দুর্লভ স্মৃতি মনের ফ্রেমে বাঁধা পড়ে আছে। প্রতিটি স্মৃতি এক একটি ইতিহাস। এসব স্মৃতির দিকে ফিরে তাকালে মনটা আনন্দে ভরে যায়, গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। ১৯৫৯ সালের আগা খান গোল্ডকাপ বিজয়ের এমনি একটি দুর্লভ স্মৃতি সযতেœ মনের ভেতর সাজানো রয়েছেÑ যার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ মুহূর্তে নিজেকে একজন গর্বিত খেলোয়াড় ভাবছি, সম্মানবোধ করছি। সে স্মৃতিগুলো আমাকে নির্মল আনন্দ দেয়, ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই আনন্দঘন পরিবেশে।
১৯৫৯ সালের আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে ভিক্টোরিয়া কাব অংশ নেয়নি; সুতরাং সেবার গোল্ডকাপ খেলা হবে না বলে ধরেই নিয়েছিলাম। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কগঈ কচঞ কধৎধপযর-করপশবৎং-এর মত শক্তিশালী দলগুলো অংশ নেয়ার জন্য ঢাকায় এসেছিল। তাছাড়া ঢাকার ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, পুলিশ, আজাদ প্রভৃতি দলও এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। পাকিস্তানের জাতীয় খেলোয়াড়সহ বিভিন্ন দলের কৃতী খেলোয়াড়দের সাথে খেলার সুযোগ হবে না, তাদের নৈপুণ্য দেখা হবে না। দেখা হবে নাÑ তাই নিরাশ হয়ে স্কুলের মাঠে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলেই শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করতাম। টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার ক’দিন আগে মোহামেডান কাবের পক্ষে গোল্ডকাপ খেলার প্রস্তাব পেয়েছিলাম।  মনে হয়েছিল হাতে আকাশের চাঁদ পেলাম। মোহামেডান আমার প্রিয় কাব, এ কাবে খেলার স্বপ্ন দেখতাম। এ কাবের কৃতী খেলোয়াড়দের সাথে খেলার সুযোগ পাওয়া যাবেÑ এটা ছিল আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া।
আগা খান গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী ঢাকা আন্তর্জাতিক ফুটবল অঙ্গনে সুপরিচিতি লাভ করেছিল। এ টুর্নামেন্ট ঢাকার ফুটবলকে আকর্ষণীয় ও খেলার মানকে উন্নত করেছিল। ’৫৯ গোল্ডকাপের বিষদভাবে স্মৃতিচারণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না, আমি শুধু ফাইনালের দুর্লভ বিজয়ের মধুর স্মৃতি সবার সামনে তুলে ধরছি।
২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) ঢাকা মোহামেডান বনাম কেএমসি (করাচি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন) ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।  মেঘলা আকাশ, দর্শকপূর্ণ স্টেডিয়াম, সবাই যেন মোহামেডান তথা ইস্ট পাকিস্তান টিমের সাপোর্টার, উত্তেজনা আর হৈ চৈ-এর মধ্য দিয়ে খেলা এগিয়ে যাচ্ছিল। কোমর বরাবর শূন্যে ভেসে আসা একটি বলকে নিয়ন্ত্রণে নিতে কেএমসির পাকিস্তান জাতীয় দলের লেফট আউট ইউসুফ (বড়) ছুটে এলে আমাদের রাইট হাফ কামরু ভাই এমন একটি থাবা (টাফ চার্জ) দিয়েছিলেন যে, ইউসুফ আঘাত পেয়ে মাঠের বাইরে চলে গিয়েছিল। পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড়কে এভাবে ইনজুরড করায় কামরু ভাইয়ের অনেকে সমালোচনা করেছিলেন। সে সময় আমরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম; কারণ তাদের দলকে দশজন নিয়ে খেলতে হবে। তখন খেলোয়াড় বদলের নিয়ম ছিল না। আমারই দেয়া গোলে আমরা এক গোলে জিততে ছিলাম; এমন সময় তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো, বৃষ্টিতেই খেলা চলছিল কিছুক্ষণ, মাঠে বল ভাসছিল, খেলা সম্ভব হচ্ছিল না, রেফারি খেলা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কাকভেজা অবস্থায় আমরা অপেক্ষা করছিলাম খেলা শুরু হওয়ার কিন্তু সেদিনের খেলা পরিত্যক্ত করা হয়েছিল।  ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আমরা টেন্টে ফিরে গেলাম। শাহজাহান ভাই খেলোয়াড়দের আলাদাভাবে ডেকে চায়ের কাপে কি যেন খেতে দিয়ে বলেছিলেন, শরীরে বল পাওয়া যাবে, জ্বর থেকে বাঁচা যাবে। আমি খাইনি। বলেছিলাম, শাহজাহান ভাই, আমি সময়মত মাঠে আসব, ঠিকই খেলব। উৎকন্ঠা নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরে গিয়েছিলাম।
২৩ সেপ্টেম্বর বুধবার বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়ামে আমরা পুনরায় উপস্থিত হয়েছিলাম আগা খান গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের ওয়াশ আউট (বাতিল) হয়ে যাওয়া ফুটবল ফাইনাল খেলার জন্য। খেলার ১৪ মিনিটে শাহ আলম ভাইয়ের সাথে বল আদান-প্রদান করে বিপক্ষ গোলপোস্টের একেবারে কাছ থেকে বল পোস্টের ওপর দিয়ে মেরে সহজ চান্স মিস করেছিলাম। একইভাবে ১৮ এবং ৩৬ মিনিটে গোল করার সহজ সুযোগ নষ্ট করেছিলাম। কামরু ভাই একটি নিশ্চিত গোল ক্ষিপ্রতার সাথে, ঠান্ডা মাথায় বল কিয়ার করে বাঁচিয়েছিলেন। শাহ আলম ভাইয়ের পাশে মদন গোল করে আমাদের দলকে এগিয়ে নিয়েছিল এবং আমার দেয়া পাসে আশরাফ ভাই দ্বিতীয় গোল করলে মোহামেডান স্পোর্টিং কাব আগা খান গোল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। পত্রিকার ভাষ্যমতে, আমি সেদিন খুব পরিশ্রম করে খেলে এই জয়ে অবদান রেখেছিলাম। খেলাশেষে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মেজর জেনারেল ওমরাও খান পুরস্কার বিতরণ করেছিলেন। আমাদের ক্যাপ্টেন আশরাফ ভাই আগা খান গোল্ডকাপ গ্রহণ করার সাথে সাথে সমগ্র স্টেডিয়াম উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। মনে হয়েছিল যেন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বিজয়। মেডেলের সাথে কোহিনূর প্রোডাক্টের সামগ্রী ব্যক্তিগত পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয়েছিল।
ফাইনাল খেলায় প্লেয়ার লিস্ট  মোহামেডান ঃ রঞ্জিন দাস (গোলরক্ষক), গজনবী ও হাবিব (ফুলব্যাক), কামরু, ইমাম বক্স ও আবিদ হোসেন (হাফ ব্যাক/স্টপার), আমান চৌধুরী (রাইট আউট), মদন (রাইন ইন), আশরাফ চৌধুরী (সেন্টার ফরোয়ার্ড), বশীর (লেফট ইন) ও শাহ আলম (লেফট আউট)।
কেএমসি ঃ গোলাম হোসেন (গোলরক্ষক), আল্লা বক্স ও ইয়ার মোহাম্মদ (ফুলব্যাক), রসুল বক্স, সালেহ, গফুর (কালা, হাফ ব্যাকস), গোলাম আবদুল্লাহ, আব্বাস, হারুন ও ইউসুফ (বড়) (ফরোয়ার্ড)
রেফারি : মাসুদুর রহমান।
(পঁচিশ)
পূর্ব-পাকিস্তান প্রতি বছরই পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে লড়াই করে যাচ্ছিল কিন্তু কোনবারই জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা ঢাকায় আনতে পারছিল না। পাঠান সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার সাহেব দাদ পূর্ব-পাকিস্তান ফুটবল দলকে যোগ্যতর দল হিসেবে গড়ে ১৯৫৯ সালের জাতীয় ফুটবলের বিজয় মুকুট ছিনিয়ে আনার লক্ষ্যে  প্রয়োজনীয় সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। ব্রিগেডিয়ার সাহেব দাদ সে সময় ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের (ইপিএসএফ) সভাপতি ছিলেন।  তার বলিষ্ঠ এবং যোগ্য নেতৃত্বে এদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বেশ গতি সঞ্চার হয়েছিল। ক্রীড়ামহলে তিনি সুপরিচিত ছিলেন এবং প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়ে ছিলেন।
১৯৫৯ সালের জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী হায়দ্রাবাদে। এই টুর্নামেন্ট অংশগ্রহণের লক্ষ্যে পূর্ব-পাকিস্তান দল গঠন করা হয়েছিল। প্রায় ত্রিশজন খেলোয়াড় নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামের প্লেয়ার্স লাউঞ্জে আবাসিক ক্যাম্প করা হয়েছিল। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ১ নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে হাতের বাম এবং ডান দিকে গ্যালারির নিচে প্রচুর ফাঁকা যায়গা ছিল (এখন সেখানে ইলেকট্রনিক্স দোকান)। সেটাকে প্লেয়ার্স লাউঞ্জ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সেখানেই আবাসিক ক্যাম্প করা হয়েছিল। স্টেডিয়ামে ‘ক্যাপ্রি’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল, তার মালিক ক্রীড়ামহলে সুপরিচিত ছিলেন। তাকে ক্যাম্পের খাওয়া দাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ক্যাম্পের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন সাহেব আলী।
ট্রায়েল ম্যাচ তিনদিন খেলতে হয়েছিল। প্রথম দিন খুব ভাল খেলেছিলাম। দ্বিতীয় দিন একটি বলকে নিয়ন্ত্রণ নিতে আবিদ হোসেন জোরালো চার্জ করলে আমি মাটিতে পরে যাই এবং হাঁটু ছিলে যায়। এটা পরে ইনফেকশন হয়ে জ্বর আসে। তৃতীয় দিনের ট্রায়াল ম্যাচ খেলা সম্ভব হয়নি। আবিদ হোসেন মাকরানী খেলোয়াড়। করাচি থেকে ঢাকায় খেলতে আসেন। হাফ লাইনের দক্ষ খেলোয়াড়, জাতীয় দলের চৌকস খেলোয়াড়। সুঠাম দেহের অধিকারী। লম্বায় খাটো তবে তার জাম্প ভাল। ট্যাকলিং খুব চমৎকার।
তৃতীয় দিন ট্রায়াল শেষে সন্ধ্যায় টিম ঘোষণা করা হলো। সদ্য সমাপ্ত আগাখান গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টে ঢাকা মোহামেডানের পক্ষে আমি খুব ভাল খেলেছি। লীগেও আমার পারফর্মটা খুব ভাল ছিল, তাই পূর্ব পাকিস্তান টিমে চান্স পাওয়ার সম্ভাবনাও দেখছিলাম, আবার তৃতীয় দিন ট্রায়াল খেলিনি বলে ভয়ও পাচ্ছিলাম। সতের জন খেলোয়াড়কে নির্বাচন করা হয়েছিল এবং দুজন কর্মকর্তা, একজন ম্যানেজার এবং অপর জন কোচ সতেরজন খেলোয়াড়ের মধ্যে আমার নাম দেখতে পেয়ে খুশী হয়েছিলাম।
পূর্ব -পাকিস্তান ফুটবল দল যেভাবে সাজানো হয়েছিল ঃ
গোলরক্ষক-রঞ্জিত দাস ও মনজুর হাসান মিন্টু।
ফুল-ব্যাক- গজনবী, জহিরুল হক এবং হাবিব।
হাফব্যাক- নবী চৌধুরী, আবিদ হোসেন, কামরু, সামাদ।
ফরোয়ার্ড-ইসলাম (রাইটআউট), কবির আলম (ক্যাপ্টেন, রাইট ইন আশরাফ চৌধুরী (ভাইস ক্যাপ্টেন), সেন্টার ফরোয়ার্ড- মারী (লেফট-ইন),শাহ্ আলম (লেফট আউট), ইজাজ রসুল, গাজী এবং বশীর আহমেদ।
ম্যানেজার- এস এ ইরতেজা
কোচ- সাহেব আলী।
১২ ই অক্টোবর হায়দ্রাবাদের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তেজগাঁ বিমান বন্দর থেকে পিআইএ সুপার কনস্লেশন বিমানে পাঁচ ঘন্টা আকাশে ভেসে থেকে আমরা লাহোর বিমান বন্দরে অবতরণ করেছিলাম। ফুটবল কর্মকর্তাবৃন্দ আমাদেরকে বিমান বন্দরে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। হোটেলে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৩ই অক্টোবর লাহোর এন ডাব্লিউ ইন্সটিটিউশন দলের সাথে প্রীতি ম্যাচে ৪-২ গোলে জয়ী আমাদের যাত্রার শুভ সূচনা করেছিলাম। ১৪ই অক্টোবর বাটা নগরে বাটা স্পোর্টস-এর সাথে ২-১ গোলে জয়ী হয়েছিলাম। হাফটাইম পর্যন্ত আমরা ১ গোলে হারতে ছিলাম। হাফটাইমে আমাদের ম্যানেজার ইরতেজা  সাহেব মারীদার যায়গায় আমাকে খেলতে বললেন, কিন্তু মারী দা আমাকে চান্স না দিয়ে বললেন, ‘আমি এুণি গোলটা শোধ করে আসছি, তারপর তুমি খেলবা’। খেলোয়াড় হিসেবে তাকে আমি শ্রদ্ধা করি, তার খেলা অনুকরণ করার চেষ্টা করি। সেদিন তিনি গোল শোধ করতে পারেননি আর আমারও মাঠে খেলার সুযোগ হলো না। তবে আমরা ২-১ গোলে জয়লাভ করেছিলাম। ১৬ অক্টোবর গুজরানওয়ালা, পাঞ্জাব প্রভিন্সের একটি শহর। সে দলের সাথে আমরা ১-০ গোলে জয় লাভ করলাম। ১৭ অক্টোবর পাঞ্জাবের আরও একটি শহর মন্টোগোমারীর সাথে ২-০ গোলে জয়ী হলাম। পাঞ্জাবের শেষ সীমানায় রাহিম ইয়ার খান শহর তারপরই সিন্ধু প্রদেশ। আমরা ১৯/১০/৫৯ তারিখে ২-০ গোলে রাহিম ইয়ার খানের সাথে জয়লাভ করি। পাঞ্জাব ট্যুর শেষ করে আমরা সিন্ধ প্রদেশে ২০ তারিখে প্রবেশ করেছিলাম। টুর্নামেন্টের ৮/১০ দিন আগেই আমরা হায়দ্রাবাদ পৌছে গিয়েছিলাম। হায়দ্রাবাদে নতুন স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। তখনও নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। শুধু গ্যালারি হয়েছে।
পূর্ব-পাকিস্তান ফুটবল দলের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে এসে ব্রিগেডিয়ার সাহেব দাদ বলেছিলেন, ইস্ মারতবা তুমলোগোকো হায়দ্রাবাদ ভেজুংগা পুরা বন্দোবস্তকে সাথ। সারসে লেকার পাও তাক সাজাকে ভেজুংগা। দেখো, ইয়ে স্টেডিয়াম তুমহারা, তুম খেলতো হো তো রুপিয়া আতা হ্যায়, হামারে পাশ জো কুচ ভি হ্যায় সাব হি ইয়ে স্টেডিয়ামকে ওয়াস্তে, ইয়ে সারা পয়সা তুমহারা ইসমে তুমহারা হাক বান্তা হ্যায়।
অর্থাৎ তোমাদেরকে এবার মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাজিয়ে হায়দ্রাবাদ প্রেরণ করা হবে। এ স্টেডিয়ামের খাতে যত টাকা আছে সব তোমাদের। তোমরা খেল, এতে টাকা-পয়সা আসে, এটা তোমাদের হক।
প্রথমবারের মত পূর্ব-পাকিস্তান ফুটবল দলকে সুসজ্জিত করে এবং চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মত দক্ষ করে হায়দ্রাবাদে প্রেরণ করা হয়েছিল। ব্লেজার,প্যান্ট-শার্ট-টুপি-সবই দিয়েছিলেন, শুধু বাকি ছিল জুতা। তিনি রসিকতা করে বলেছিলেন, লাহোরসে তুমলোগোকো জুতা মিলেগা অর্থাৎ লাহোরে পৌঁছালে তোমাদের জুতা দেয়া হবে। সবাই আমরা হেসে উঠেছিলাম।
টিমের পারফরমেন্স উন্নতি করার লক্ষ্যে প্রায় ১৫ দিন আগেই দলকে পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল এবং পাঞ্জাব প্রভিন্সের বিভিন্ন শহরে ওয়ার্মআপ ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ইপিএসএফ-এর সভাপতি ব্রিগেডিয়ার সাহেব দাদ। মাঠ বলতে গ্যালারির মাঝখানে ধুধু বালি। প্রতিদিন বালিতে পানি দিয়ে রোল করা হচ্ছে। ঘাসের চিহ্ন মাত্র নাই। টুর্নামেন্ট আরম্ভ হবে ৩০ অক্টোবর। এখনও অনেক দিন বাকি। আমরা অনুশীলন করে যাচ্ছি। অবসর সময় ঘুরে বেড়াচ্ছি।
এবার আমাদের টিম খুব ব্যালেন্সড টিম। যেমন ডিফেন্স তেমনি অফেন্স। বরাবরের মত আমাদের দলের আক্রমণ ভাগের উপর নির্র্ভর করতো জয়-পরাজয়। বিশেষ করে ট্রায়ো নামে খ্যাত ছিলেন তিনজন, রাইট-ইন কবির, লেফট-ইন-মারী এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড আশরাফ। আমি লেফট ইন এবং রাইট-ইন দু’জায়গাতেই খেলতাম। কিন্তু এই ট্রায়োর প্রত্যেকের ব্যক্তিগত খেলার নৈপুণ্য, পরস্পরের সাথে সমঝোতা, দলগত পারদর্শিতা, তাদের নাম, তাদের ইমেজের দেয়াল এতো শক্ত ছিল যা ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকা খুব কষ্ট ছিল। আগাখান গোল্ডকাপ জেতার পর থেকে নিজের উপর আস্থা জন্মেছিল যে, আমি এই ট্রায়ো’কে ভাংতে পারবো। কবির ভাই নয়তো মারীদাকে সরিয়ে নিজের জায়গা করে নিতে হবেই। সেই সুযোগটাও পেয়ে গেলাম। আর্মি টিমের সাথে আমাদের ওয়ার্ম আপ ম্যাচ। কবরস্থানের পাশে মাঠ। মাঠে কোনো ঘাস নেই, শুধুই বালি। দু’ধারে  দুটি গোলপোস্ট পোতা আছে। মাঠে কোন লাইন নাই, চিহ্ন নাই। আমাদের রেগুলার ফরোয়ার্ড লাইন হলো রাইট আউট ইসলাম, রাইট-ইন কবির, সেন্টার ফরোয়ার্ড আশরাফ, লেফট ইন মারী এবং লেফট আউট শাহ আলম। আমাদের রাইট আউট ইসলাম টিমের সাথে সমান তালে খেলতে পারছিল না। বিশেষ করে ফরোয়ার্ড লাইনে আস্থার সাথে খেলা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তার খেলার মান টিমের অন্যান্য খেলোয়াড়ের মানের তুলনা খুবই দুর্বল ছিল। তার বাড়ি কক্সবাজার এবং আমাদের রাজনীতিবিদ ফরিদ আহমেদের বাড়িও কক্সবাজার। অনেককে বলতে শুনেছি যে, দেশির টানে তাকে টিমে চান্স দেয়া হয়েছিল। আর্মি টিমের সাথে খেলা আরম্ভ হলো। ইসলাম কিছুতেই কবির ভাইয়ের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছিল না। ম্যানেজার সাহেব ইসলামকে মাঠে থেকে তুলে নিলেন। আমাকে মাঠের ভেতর যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কবির ভাইকে রাইট-আউট পজিশন খেলতে নির্দেশ দিলেন। কবির ভাই রাইট আউট পজিশনে গিয়ে আমাকে তার জায়গা ছেড়ে দিলেন। খেলায় মনে হলে প্রাণ পেয়েছিল। কবির ভায়ের সাথে দ্রুত এডজাস্টমেন্ট হয়ে গিয়েছি। শুধু তাই নয় ফরোয়ার্ড লাইনে সবার সাথে সুন্দর একটা সমঝোতা গড়ে উঠেছিল সেদিনের আর্মি টিমের বিরুদ্ধে। আমরা আর্মি টিমকে ৪-০ গোলে পরাজিত করে ছিলাম। সে ম্যাচে আমার ডিস্ট্রিবিউশন ছিল নিখুঁত। ড্রিবলিং হয়েছিল চমৎকার। আমার খেলা দেখে ম্যানেজার সাহেব খুব খুশী হয়েছিলেন। তিনি মাঠেই বলে দিলেন, এ টুর্নামেন্টে বশীর রাইট-ইন পজিশনে সব কটা ম্যাচ খেলবে। দলে স্থায়ী জায়গা পেলাম, সবচাইতে বড় কথা হলো, খেলার সুযোগ পেলাম। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সে ম্যাচটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবুও আমার ফুটবল ক্যারিয়ারে এ ম্যাচটি একটি মাইল ফলক হয়ে থাকবে।

(ছাব্বিশ)
১৯৫৯ সালের ৩০ অক্টোবর নবম জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের উদ্বোধনী ম্যাচের মাধ্যমে নবনির্মিত হায়দ্রাবাদ স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করা হয়েছিল। ৩১ অক্টোবর আমাদের প্রথম ম্যাচ সিন্ধ হোয়াইটস-এর সাথে। সে ম্যাচের জন্য আমাদের টিমকে সাজানো হয়েছিল এভাবে : গোলরক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন রঞ্জিত দাস। ছোটখাটো গড়নের হলেও মাঠে অদম্য সাহসের অধিকারী ছিলেন রঞ্জিত দাস। ক্ষিপ্রতা আর এন্টিসিপেন্টস ছিল তার গোলরক্ষণের মূলমন্ত্র।
তার সাহসিকতাপূর্ণ একটি খেলার বর্ণনা এখানে তুলে ধরছি। আউটার স্টেডিয়ামে ইপিআইডিসি বনাম আজাদ স্পোর্টিং কাবের খেলা। টুলু ইপিআইডিসি দলের লেফট আউট, লম্বা-চওড়া, দ্রুতগতির একজন খেলোয়াড়, বল নিয়ে ডি-বক্সের ভেতর ঢুকে পড়ে গোলপোস্টে কিক নিতে যাচ্ছে, বলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন রঞ্জিত দাস, টুলু পা আর সামলাতে পারলো না, পা চালিয়ে দিল, কিন্তু তার পা বলের পরিবর্তে আঘাত করলো রঞ্জিত দাসের মুখে। রঞ্জিত দাস মাটিতে পড়ে আছেন, সবাই ছুটে গেল। তিনি উঠে বসলেন, চোখ তার বন্ধ। তিনি মাটিতে হাতড়ে কি যেন খুঁজছেন। সবাই অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করছে, কি হয়েছে, কি খুঁজছেন? সবাইকে অবাক করে রঞ্জিত দা বললেন, দাঁত খুঁজছি। টুলুর গোলপোস্টে নেয়া সজোরে কিকটি বলে না লেগে লেগেছিল রঞ্জিত দা’র মুখে, ফলে তার সম্মুখের চারটি দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিলÑ সেই দাঁতগুলো তিনি চোখ বন্ধ করে মাটিতে খুঁজছিলেন। মাঠ থেকে সোজা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেদিনের পর থেকে টুলুর নামের পাশে ‘ডেন্টিস’ নাম যোগ করে দিয়েছিল অতিউৎসাহী ক্রীড়ামোদীরা এবং পরবর্তীতে ক্রীড়াঙ্গনে ‘টুলু ডেন্টিস’ নামটি চালু হয়ে গিয়েছিল।
সেদিন ফুল ব্যাকে খেলেছিলেন গজনবী ও জহির। গজনবী ভাইকে মাঠের সিংহপুরুষ বলা হলে বেশি বলা হবে না। মাঠে তার চলন-বলন ছিল সিংহের মত। তার সিংহের মত হুঙ্কার ‘আইতে দে’ বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের বুক কাঁপিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমার খেলোয়াড়ী জীবনে মাঠে সিংহের মত হুঙ্কার দিতে দুজন ফুল ব্যাককে দেখেছিলামÑ একজন পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলের ফুলব্যাক গজনবী এবং অন্যজন পাকিস্তান জাতীয় হকি দলের ফুলব্যাক মুনীর দার।
১৯৬২ সালে জাকার্তা এশিয়ান গেমসে দর্শকপূর্ণ হকি স্টেডিয়ামে ভারত-পাকিস্তান হকি ফাইনাল খেলায় মুনীর দারের ‘ঐ ছাড্ দে, আন দে’ হুঙ্কার সিংহের গর্জনের মতই সেদিন শোনাচ্ছিল। সেটা আজও আমার কানে বাজে। গজনবী ভাই পেছনে থাকলে আক্রমণভাগে আমরা নির্ভয়ে-নিশ্চিন্তে খেলতে পারতাম। বাইরে থেকে তাকে কঠিন দেখালেও তিনি ছিলেন নরম মনের মানুষ। সেদিনের ম্যাচের আরেক ফুলব্যাক ছিলেন জহির ভাই। খুবই নির্ভরযোগ্য ফুলব্যাক।
রাইট হাফে খেলেছিলেন নবী  চৌধুরী। টোকিও এশিয়ান গেমসে পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন। পাকিস্তান এয়ারফোর্সের সুদর্শন একজন অফিসার, পরে পুলিশ অফিসার। সেন্টার হাফ তার পজিশন হলেও সেবার দলের প্রয়োজনে তাকে রাইট হাফে খেলতে হয়েছিল।
সেন্টার হাফের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আবিদ হোসেনকে, যার কথা আগের সংখ্যায় লিখেছি। লেফট হাফ পজিশন সামলেছিলেন কামরু ভাই। কামরু টাফ খেলোয়াড়। বিপক্ষ দলের রাইটআউটকে টাইট মার্কিং এ রাখা এবং সেদিক দিয়ে আক্রমণকে রুখে দেয়ার দায়িত্ব তিনি দক্ষতার সাথে পালন করে থাকেন। গত ২০ সেপ্টেম্বর ’৫৯ আগাখান গোল্ড কাপ টুর্ন ামেন্টের ফাইনালে কেএমসি দলের বড় ইউসুফ টের পেয়েছিল কামরু কেমন টাফ প্লেয়ার এবং ঢাকার দর্শকও সেদিন দেখেছিল কামরু তার দায়িত্ব পালনে কত টাফ হতে পারে। 
রাইট আউট কবির আলম। দলের অধিনায়ক। অসম্ভব মেধাসম্পন্ন একজন খেলোয়াড়। যিনি দীর্ঘ সময় রাইট ইন পজিশনে সুনামের সাথে খেলে আসছিলেন। তিনি রাইট আউট পজিশনেও দক্ষতার সাথে খেলে তার সুনামটাকে সে স্থানেই ধরে রেখেছিলেন।
রাইট ইন হিসেবে দলে আমি নতুন। কবির ভাইয়ের যায়গায় খেলতে হলে প্রথম থেকেই আমাকে পরিশ্রম করে খেলতে হবে এবং টিমের সাথে দ্রুত সমঝোতা গড়ে তুলতে হবে। দলের সাফল্যের জন্য আমাকে অবদান রাখতে হবে। মনে মনে এরকম একটা দায়িত্ববোধ নিয়ে সেদিন মাঠে নেমেছিলাম। সেন্টার ফরোয়ার্ড আশরাফ চৌধুরী, পাকিস্তান দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড, চৌকস খেলোয়াড়, দ্রুতগতিতে দক্ষতার সাথে গোল করায় ছিলেন পারদর্শী। এ বছর ঢাকা লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা।
লেফট-ইন : মারী বাম পায়ের ফুটবল কারিগর। যার বলে ওপর ছিল কর্তৃত্ব- অসাধারণ একজন ফুটবল খেলোয়াড়। নিখুঁত পাস যেমন দিতেন, তেমনি গোল করতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী।
লেফট-আউট শাহ আলম চৌধুরী, শান্ত-শিষ্ট, ছিমছাম একজন খেলোয়াড়। দীর্ঘদিন ধরে কবির-আশরাফ-মারীÑ এই ট্রায়োর সাথে খেলে আসছেন। তাদের সাথে সুন্দর সমঝোতা গড়ে উঠেছিল। তারই সেন্টারে/ ক্রসে বেশিরভাগ সফলতা পেয়েছে দল।
ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে আমার প্রথম খেলা। নতুন যায়গা, নতুন স্টেডিয়াম, অজানা দর্শক; তাছাড়া দেশের বরেণ্য খেলোয়াড়দের সাথে খেলতে নামছিÑ স্বভাবত কারণে একটু নার্ভাস ছিলাম। মাঠে নেমেও শংকিত ছিলাম, এ এক অ™ভুত মাঠ। সিমেন্টের মেঝের মত খটখটা, বালিতে পানি ছিটিয়ে তার ওপর রোল দিয়ে দিয়ে এমন মাঠ তৈরি করা হয়েছে। বুট পরে দৌড়ালে মাথায় মগজে গিয়ে আঘাত করে। সময় অনুযায়ী খেলা আরম্ভ হলো। প্রথমদিকে বল কন্ট্রোল করতে অসুবিধা হচ্ছিল, বল খুব দ্রুত ছোটে, একবার নাগালের বাইরে গেলে ধরা কষ্টকর হয়ে যায়। পায়ে পায়ে ছোট ছোট পাসের মাধ্যমে খেলে আমরা স্বাভাবিক খেলায় ফিরে আসি এবং ধীরে ধীরে খেলা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এদিকে সিমেন্টের মত মাঠেরও পরিবর্তন হতে থাকে, নরম বালি বালি হয়ে ওঠে। ধুলাবালির মিশ্রণ মাঠে আমরা গোলশূন্য অবস্থায় প্রথমার্ধ শেষ করেছিলাম। হাফ টাইমে মাঠে আবার পানি ছিটিয়ে রোল করা হলো। খেলার শুরুটা যেমন মাঠে হয়েছিল, তেমনি সিমেন্টেড খটখটা মাঠে দ্বিতীয়ার্ধটাও শুরু করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত সিন্ধ হোয়াইটকে ১-০ গোলে পরাজিত করে আমরা টুর্নামেন্টের শুভসূচনা করেছিলাম।
পরদিন অর্থাৎ ১লা নভেম্বর পাঞ্জাব  দলের সাথে সেমিফাইনাল খেলতে আমাদেরকে মাঠে নামতে হয়েছিল। ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে পাঞ্জাব ফুটবল দল অধিকবার শিরোপা অর্জনকারী দল। গত বছর মুলতানে অনুষ্ঠিত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপের প্রথম ম্যাচে পাঞ্জাবের সাথে হেরে আমাদেরকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। রাব্বানী, এম এন জাহানের মত জাতীয় দলের বেশ কজন কৃতি ফুটবলার নিয়ে গঠিত শক্তিশালী পাঞ্জাব দল। খেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখেছিল সেদিন হায়দ্রাবাদ স্টেডিয়ামের দর্শক। প্রচন্ড প্রতিদ্বন্দ্বিপূর্ণ খেলায় শেষ পর্যন্ত আমরা ১-০ গোলে জয়লাভ করে ফাইনালে উন্নীত হয়েছিলাম সেই সাথে পাঞ্জাবের নিকট হারের প্রতিশোধও নেয়া হয়েছিল।
ফাইনালের আগের দিন ফ্রিডে অর্থাৎ ছুটি, কোন খেলা ছিল না। কিন্তু দুটো দুঃসংবাদে টিম ম্যানেজমেন্ট চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। প্রথমটি ছিল কামরু ভাইয়ের পায়ের মাংশপেশীতে টানপরা। তিনি ফাইনাল ম্যাচ খেলতে পারবেন না। তার জায়গায় করাচি থেকে ইমাম বক্সকে এনে লেফট হাফ পজিশনের স্থান পূরণ করা হয়েছিল। ইমাম বক্স পিডব্লুডিতে চাকরি করতো। সে সুবাদে ঢাকার পিডব্লুডি ফুটবল  টিমের হয়ে ঢাকায় লীগে খেলার জন্য করাচি থেকে প্রতি বছর ঢাকায় আসত। ১৯৫৯ সালে আগা খান গোল্ডকাপ বিজয়ী ঢাকা মোহামেডান দলের সদস্য ছিল। নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলে ইমাম বক্সের নাম ছিল না। আগেই সে করাচি চলে গিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলকে আরো শক্তিশালী করার জন্য কোচ সাহেব আলী ভাইয়ের পরামর্শে তাকে করাচি থেকে আনানো হয়েছিল।
দ্বিতীয় দুঃসংবাদটি ছিল ফাইনালে আমার খেলার অনিশ্চয়তা দু’তিন ধরে আমার দাঁতে ব্যাথা অনুভব করছিলাম। যতই সময় যাচ্ছিল ব্যাথাটাও বাড়ছিল। প্রচন্ড ব্যাথা। চোখ-মুখ ফুলে গিয়েছিল, গায়ে জ্বর, সব মিলিয়ে ফাইনাল খেলার মত শারীরিক অবস্থা ছিল না। দাঁতের  অসুখটা ছোট বেলা থেকে আমার সঙ্গী। আমার খালু, শৈশবটা যার কাছে কেটেছে, তিনি প্রতি রাতে আমার জন্য মিষ্টি নিয়ে আসতেন এবং সকাল বেলা ঘুম থেকে তুলে মিষ্টি খেতে দিতেন। আমি ছোট বেলা থেকে মিষ্টি পছন্দ করতাম। দাঁত পরিস্কার করার সে রকম গরজ করতাম না। ফল যা হবার তাই হয়েছিল, দাঁতে পোকা, ব্যাথা, কান্নাকাটি, জ্বর। প্রায়ই এগুলোতে ভুগতে হতো। তখন মাহুৎটুলী থেকে হাটতে হাটতে  লালবাগ হয়ে হাজারীবাগের ভাটের মসজিদের কাছে এক মহিলার স্মরণাপন্ন হতে হতো। তিনি ঝারফুক দিয়ে দাঁতের পোকা বের করতেন। ছোট গাছের শিকড় দাঁতে ধরতেন, অমনি টপ টপ করে দাঁত থেকে পোকাগুলো নিচে বিছিয়ে রাখা সাদা কাগজে পরতো। মনে হতো ব্যাথা কমে গেছে। দাঁতের অসুখ যেন আমার চিরসঙ্গী।
দাঁতের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে একবার ছুটে গিয়েছিলাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমার স্কুলের কাশ ফ্রেন্ড দাঁতের ডাক্তার চুনীলাল দত্তের কাছে। সে আমার দাঁত তুলে দিলে খুব শান্তি পেয়েছিলাম। সেদিন চুনী মজা করে বলেছিল, তোর সবগুলো দাঁত তুলে দিলে তুই আরো শান্তি পাবি; দাঁত থাকবে না, ব্যথাও থাকবে না।
ফাইনাল খেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান মাঠে উপস্থিত থাকবেন, খেলোয়াড়দের সাথে হাত মেলাবেন, পুরস্কার দিবেন, এগুলো চিন্তা করে খুব খারাপ লাগছিল। সে সময় আইয়ুব খান ছিলেন পাকিস্তানের প্রাণপুুরুষ, তার সাথে হাত মেলানোটা ছিল স্বপ্ন। আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ম্যানেজার ইরতেজা সাহেব বলেছিলেন, ‘বশীর, আমরা তো হেরেই যাব, তুমি খেলেই ফেল, যা হবার তা হবে।’ একথায় আমার কান্না পেয়ে গিয়েছিল।
৩ নভেম্বর সময়মতো খেলা শুরু হয়েছিল। দাঁতের ব্যাথা, মুখ ফোলা মাফলার পেচিয়ে সেদিন মাঠে খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। পাকিস্তান জাতীয় দলের গোলরক্ষক সিদ্দিক, জাতীয় দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড কাইয়ুম চেঙ্গেজীর  মতো প্রখ্যাত ফুটবলারদের সাথে দ্রুতগতির সম্পন্ন রাইট আউট শেরাকে নিয়ে বেলুচিস্তান ফুটবল টিম বেশ শক্তিশালী টিম। শেরা পরবর্তীতে পাকিস্তান জাতীয় দলে চান্স পেয়েছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ছিল। হায়দ্রাবাদ স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলায় গজনবী ভাইয়ের থাবার শিকাড় হয়ে মাঠে তাকে গড়াগড়ি খেতে দেখেছিলাম। গজনবী ভাই বলেছিলেন, বেশি তিরিংবিরিং করছিল, থামিয়ে দিলাম। কমন একটি উড়ন্ত বল ধরতে দু’জন গিয়েছিল। গজনবী ভাইয়ের স্ট্রাইড বেশ লম্বা। শেরা বল আয়ত্তে নেয়ার মুহূর্তে গজনবী ভাই তার লম্বা পায়ে শেরার সিনবোনে রাফ চার্য করতেই সে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো।
বেলুচিস্তান দল দ্বিতীয়ার্ধের বেশির ভাগ সময় দশ জন নিয়ে খেলেছিল। সাবস্টিটিউট আইন ছিল না বিধায় খেলোয়াড়  নামানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমাদের টিমে সেদিন দুটো পরিবর্তন এসেছিল। কামরু ভাইয়ের জায়গায় লেফট হাফে ইমাম বক্স এবং আমার জায়গায় কবির ভাই তার অরিজিন্যাল পজিশন রাইট ইনে খেলেছিলেন এবং কক্সবাজারের ইসলাম রাইট আউটে খেলেছিল। আমাদের টিম সেদিন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ভাল খেলেছিল কিন্তু গোল পাচ্ছিল না। সেন্টার লাইন অতিক্রম করে কাইয়ুম চেঙ্গেজী আচমকা গোলপোস্ট লক্ষ্য করে একটি শট করেছিল, বলটি উঁচু হয়ে এসেছিল। রঞ্জিত দা এগিয়ে গিয়েছিলেন বলটি ধরতে কিন্তু তিনি বলের ফাইট মিস করে ফেলেছিলেন, বল ধরতে পারেনি, বলটি মাটিতে ড্রপ পরে তার মাথার ওপর দিয়ে জালে প্রবেশ করেছিল। এক গোলে পিছিয়ে পড়ে গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে আমাদের টিম। বেলুচিস্তান গোল দিয়ে ডিফেন্সকে শক্তিশালী করার জন্য কাইয়ুমকে সেন্টার ফরোয়ার্ড থেকে পেছনে নিয়ে গিয়েছিল। লম্বা লম্বা খেলোয়াড়রা পূর্ব পাকিস্তান টিমের সামনে প্রাচীরের মত দাঁড়িয়ে একের পর এক আমাদের আক্রমণকে রুখে দিচ্ছিল। আপ্রাণ চেষ্টা করেও আমাদের টিম গোল শোধ করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত  ০-১ গোলে হেরে ন্যাশনাল ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন এবারও অপূর্ণ রয়ে গেল।


(সাতাশ)
প্রায় এক মাসের মতো আমরা বাড়ি থেকে বার-তেরশ’ মাইল দূরে। ফাইনাল ম্যাচে হেরে আমাদের সমস্ত পরিশ্রম বিফল হয়ে গিয়েছিল। জাতীয় ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার এতদিনের স্বপ্নটাও সেই সাথে ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাই বাইরে বাইরে থাকতে মন আর চাচ্ছিল না, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। একেতো দাঁতের ব্যথার যন্ত্রণা, ফাইনাল ম্যাচ না খেলার কষ্ট, টিম হেরে যাওয়ার দুঃখÑ সব মিলিয়ে হায়দ্রাবাদে এক মুহূর্তের জন্যও মন টিকছিল না। এরই মধ্যে দেশে ফেরার প্রস্তুতিও মোটামুটি শেষ করে ফেলেছিলাম। বড় বোন, ভাবী, ভাইয়ের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য জামাকাপড়, হায়দ্রাবাদের স্পেশাল চুড়ি-মালা ইত্যাদি সাজগোজের জিনিসপত্র কিনে তৈরি হয়েছিলাম। এমন সময় একটি সংবাদ আমার বাড়ি ফেরার সব আনন্দকে মাটি করে দিয়েছিল সেদিন। যদিও সংবাদটি অনেকের জন্য আনন্দ বয়ে এনেছিল, সে সংবাদটি ছিল পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল টিম গঠনকল্পে ক্যাম্পের জন্য বাছাই করা খেলোয়াড়দের নামের তালিকা আর সেই তালিকায় আমার নাম। আমি বাড়ি ফিরতে পারবো নাÑ এটাকে আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। কান্নাকাটি করছিলাম। টিমের সিনিয়ররা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন সেদিন। বলেছিলেন, পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলে চান্স পাওয়া ভাগ্যের কথা, সবার ভাগ্যে জোটে না, তুমি সুযোগ পেয়েছো তা আবার ফাইনাল ম্যাচ না খেলে। এটা তোমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। ক্যাম্পে যোগ না দিলে ভবিষ্যতে তোমার জন্য খারাপ হতে পারে বলে অনেকে ভয়ও দেখালেন। এগুলো শুনে আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু আমি দাঁতের ব্যথা নিয়ে অস্থির ছিলাম, ক্যাম্পে যদি ব্যথা আরো বেড়ে যায়, চিকিৎসা করার সুবিধা না থাকে, তাহলে আমার কি হবে? এরকম অজুহাত দাঁড় করিয়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিলাম। জনাব এন এইচ খন্দকার আমার সব অসুবিধার সমাধান করে দিয়েছিলেন সেদিন। খন্দকার সাহেব পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা এবং সিলেকসন কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন সেন্ট্রাল স্টেশনারী এন্ড প্রিন্টিং প্রেসের চিফ কন্ট্রোলার। বাড়ি তার ফরিদপুর। মোটাসোটা রাসভারী মানুষ হলেও তার মন ছিল উদার-বড় মাপের। বিশেষ করে খেলাধুলার ক্ষেত্রে তার অবদান উল্লেখ করার মত। ১৯৫৮ সালে  ঢাকা লীগে আজাদ স্পোর্টিং কাবের সাথে পয়েন্ট তালিকায় শীর্ষে থাকা সেন্ট্রাল স্টেশনারী এন্ড প্রিন্টিং প্রেসকাবের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। সে সময়কার ভাল ভাল ফুটবল খেলোয়াড়দের যেমন ইউজিন লিও, জহির, লুৎফর, আনোয়ার, বাদশা, শুজা প্রমুখদের চাকরি দিয়ে শক্তিশালী দল গঠন করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘তোমাকে আমার সাথে করাচি নিয়ে যাব, চিকিৎসা করিয়ে তিন/চার দিন পর হায়দ্রাবাদ ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়ে দেব। রঞ্জিত দা বলেছিলেন, বাড়ির জন্য যেসব জিনিসপত্র পাঠাবার, আমাকে দাও, আমি পৌঁছে দেব, তুমি কোন চিন্তা করো না।
সবার কাছ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে ফুটবল ক্যাম্পে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। নভেম্বর মাসের চার তারিখে সকাল বেলা মন্ত্রমুগ্ধের মত খন্দকার সাহেবের পেছনে পেছনে তার গাড়িতে গিয়ে বসলাম। খন্দকার সাহেব কে? তাকে আমি চিনি না, তার নামও কোনদিন শুনিনি। তার ব্যক্তিত্বের কাছে হার মেনে মাথা নিচু করে তার পাশে বসেছিলাম চুপ করে। তিনি একসময় জিজ্ঞেস করলেনÑ দেশের বাড়ি কোথায়, বাবা-মায়ের কথা, ভাইবোনদের কথা, পড়াশোনার কথা, তারপর চুপচাপ।
করাচির পথে ছুটে চলেছে সাদা রং-এর গাড়িটি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি, সবই আমার কাছে আশ্চর্য মনে হচ্ছিল। কোথায় যাচ্ছি, কার সাথে যাচ্ছি, কি হবেÑ নানারকম প্রশ্ন মনে এসে ভিড় করছিল; এর কোনটারই উত্তর আমার জানা ছিল না। ভবিষ্যতের উপর নিজেকে সঁপে দিয়ে দুরু দুরু বুকে পেছনে ছুটে যাওয়া মাঠ-প্রান্তর, ঘর-বাড়ি দেখছিলাম। ৫০-৬০ মাইল বেগে গাড়ি প্রায় দু’আড়াই ঘন্টা চলার পর উঁচু উঁচু দালান, বেশি বেশি গাড়ির দেখা পাচ্ছিলাম অর্থাৎ ১২০ মাইল পথ অতিক্রম করে আমরা করাচি শহরে এসে পৌঁছে গিয়েছিলাম। গাড়িটা একসময় বিরাট একটি বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। খন্দকার সাহেব আমাকে নিয়ে বাসার ভেতর ঢুকলেন এবং ড্রইং রুমে আমাকে বসতে বলে তিনি ভেতরে গেলেন। আমারই বয়সের একটি মেয়ে ঘরে ঢুকে তার নিজ পরিচয় দিয়ে বললো, আমি খন্দকার সাহেবের মেয়ে। মেয়েদের সাথে কথা বলার অভ্যাস ছিল না, আমাদের ঢাকাইয়া সমাজেও এর প্রচলন সেসময় তেমন ছিল না বলেই চুপ করে ছিলাম। একটু পর খন্দকার সাহেব এসে আমাকে গেস্টরুম দেখিয়ে দেয়ার জন্য মেয়েকে বললেন। মেয়েটা গেস্টরুম দেখিয়ে চলে গেলে আমি ভেতরে ঢুকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। গোসল করতে গিয়ে নিজের চেহারা আয়নায় দেখে কষ্ট হচ্ছিল। দাঁতের যন্ত্রণায় মুখ ফুলে গেছে, বিশেষ করে ডান গালটা ফুলে কিম্ভুতকিমাকার দেখাচ্ছিল। ক’দিনের অসুস্থতায় চেহারাটাও কাহিল হয়ে গিয়েছিল। এরকম একটা চেহারা নিয়ে একজন সুন্দরী মেয়ের সামনে যেতে খুব অস্বস্তি লাগছিল। তারপরও যেতে হয়েছিল; কারণ তারা ডাইনিং টেবিলে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। খন্দকার সাহেব কাছে যেতেই ব্যথার কথা জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, ব্যথায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। কোন কিছুই ভাল লাগছে না। চা-নাস্তা খেয়ে তিনি অফিসে চলে গেলেন।
খন্দকার সাহেবের মেয়ে আমার সম্বন্ধে জানার উদ্দেশ্যে নাম থেকে শুরু করে পড়াশোনা, বাড়িঘর সবকিছুই এক এক করে জানতে চাইল। আগেই বলেছি যে, মেয়েদের সাথে গল্প করার অভ্যাস না থাকায় সহজ হতে পারছিলাম না, কথা জড়িয়ে আসছিল, ধীরে ধীরে সব কথারই উত্তর দিয়েছিলাম। তার নিজের সম্বন্ধেও বলেছিল। তার মা নেই, সে বাবার সাথে একাই থাকে। সে কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। কথা শেষ করে কলেজে যাওয়ার জন্য বিদায় নিয়ে চলে গেল। বাড়িতে আমি একা। ব্যথায় শুয়ে-বসেও শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই বাড়িটা ঘুরেফিরে দেখছিলাম। বড় বাড়ি, ফুলের বাগান, সবজি বাগান, ফলের গাছ সবই আছে। সবজি বাজানে লাউ, বেগুন, টমেটো, ঢেঁড়সসহ লালশাকও সেখানে দেখতে পেলাম। বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে অনুমানে করাচি শহর দেখার চেষ্টা করলাম। কান্ত হয়ে একসময় ঘরে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কাজের লোক এসে দুপুরের খাবারের জন্য ডেকে গেল। উঠে দেখি দুপুর গড়িয়ে গেছে।
খন্দকার সাহেব অফিস থেকে এবং তার মেয়ে কলেজ থেকে কখন ফিরে এসেছেন টের পাইনি। তাড়াতাড়ি হাজির হলাম। দেখি সবই বাঙালি খাওয়া। বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, করাচিতে বসে ইয়া বড় বড় কই মাছ খেতে পাব। ভাত-ডাল, শাক-সবজি সবকিছুতেই বাঙালিত্বের ছাপ পাওয়া যাচ্ছিল। ভাত-মাছের স্বাদ অনেক দিন পাইনি। পশ্চিম পাকিস্তানে রুটি-দুম্বার গোস্ত, পালং গোস্ত, মরট-গোস্ত খেতে খেতে অরুচি ধরে গিয়েছিল। তার ওপর দাঁতের ব্যথায় খেতেও পারছিলাম। সাজানো-গোছানো টেবিলে বাঙালি খানা খেতে আগ্রহ নিয়ে বসলাম। তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছিলাম। কই মাছ খেতে কাঁটার ভয়ে সাবধানে খেতে হয়, দাঁতের ব্যথায় তাড়াতাড়ি খাওয়া যাচ্ছিল না, তাই ধীরে-সুস্থে খাচ্ছিলাম। বাপ-বেটির জন্য পেট পুরে খেতে পারলাম না। তারা অল্প খায়, খেয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলে কি আর একা একা বসে খাওয়া যায়? মেয়েটাই বা কি ভাববে।  তাই পেটে ুধা রেখেই উঠে পড়েছিলাম।
খন্দকার সাহেব সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। ডাক্তারের নাম জানি না, করাচির কোন রাস্তায় তার চেম্বার, তাও জানি না। সুবোধ বালকের মতো তার পেছনে পেছনে ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ঢুকেছিলাম এবং ডাক্তারের নির্দেশে রোগীর চেয়ারে গিয়ে বসলাম। হা করতে বললে আমি হা করলাম। ডাক্তার সাহেব তার যন্ত্রপাতি মুখে ঢুকিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। তারপর তার সহকারীকে আমার মাথা চেপে ধরার নির্দেশ দিলেন এবং প্লাস জাতীয় যন্ত্র দিয়ে আমার মাঢ়ির (চোয়াল) একটি দাঁতের সাথে যুদ্ধে নেমে পড়লেন। মাঢ়ির গভীরে দাঁতের গোড়া থাকায় খুব কষ্ট করে ডাক্তার সাহেবকে দাঁতটি তুলে আনতে হয়েছিল। আমার দাঁতের ব্যথার পরিবর্তে মাঢ়ির আঘাতের ব্যথা নিয়ে কাতরাচ্ছিলাম। রক্ত আটকানো যাচ্ছিল না। একটার পর একটা তুলার গোল্লা দাঁতের ফাঁকা জায়গায় চেপে ধরছেন ডাক্তার সাহেব আর নিমিষেই তা রক্তে ভিজে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ পর রক্ত পড়া বন্ধ হলো। তবে একেবারে বন্ধ হয়নি। ফেরার পথে খন্দকার সাহেব একটি স্থানে নেমে পড়লেন। আমি ভীষণ কান্ত ও দুর্বল অনুভব করছিলাম। বাসায় ফিরে নিজ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। মা-বাবা, আত্মীয় -স্বজন থেকে দূরে বিদেশে অসুস্থ হয়ে একা একা পড়ে আছি। তখন নিজেকে খুবই অসহায় মনে হচ্ছিল। রাতে একসময় খন্দকার সাহেব ও তার মেয়ে ঘরে এসে খোঁজ নিয়ে গেলেন। বলে গেলেন রাতে শুধু পানিজাতীয় খাদ্য খেতে হবে। পাউরুটি দুধে ভিজিয়ে দেয়ার জন্য কাজের মানুষকে নির্দেশ দিয়ে আর আমাকে বিশ্রাম নিতে বলে গেলেন। দাঁতের ব্যথাটা আগের মত ছিল না, তবে জোর করে দাঁত তুলতে গিয়ে মাঢ়িতে আঘাতের জন্য নতুন করে ব্যথা অনুভব করছিলাম এবং রক্তও অল্প অল্প বের হয়ে তুলা ভিজে যাচ্ছিল আর বারবার তুলা বদলাতে হচ্ছিল। ব্যথার অসুধের সাথে হয়তো ঘুমের ওষুধও ছিল, তাই পরদিন অনেক বেলা করে ঘুম ভেঙ্গেছিল। ঘুম থেকে উঠে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। সাদা ধবধবে বালিশ রক্তে লাল হয়ে আছে। সারারাত দাঁতের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরে বালিশ ভিজে গেছে। খন্দকার সাহেব অফিসে গেছেন, তার মেয়েও হয়তো কলেজে গেছে। রক্তে ভেজা বালিশটাকে কিভাবে লুকোনো যায় বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময় মেয়েটার গলার আওয়াজ পেলাম। বুঝলাম, কলেজে সে যায়নি। তাড়াতাড়ি টাওয়েলটা বালিশের ওপর দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করলাম। ধীরে ধীরে বসার ঘরে গেলাম। ুধা পেয়েছিল, তাই এদিকে-সেদিক তাকাচ্ছিলাম। এমন সময় মেয়েটা বসার ঘরে এসে আমার দাঁতের খবর জানতে চাইল্ োবললাম, ব্যথা সেরকম  নেই; তবে সারারাত রক্ত বের হয়ে আপনাদের বালিশ-চাদর সব রক্তে লাল হয়ে গেছে। আমার ভীষণ লজ্জা করছে। সে শুধু বললো, কিছু হবে না। তারপর চুপচাপ। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, কলেজ বন্ধÑ নাকি আমার অসুস্থতার জন্য কলেজ যাননি? মুখ থেকে কোন কথা বের হলো না। আমিও চুপ করে বসে পাউরুটি আর দুধ মাথা নিচু করে খেতে লাগলাম।
প্রতিদিনের মত লাঞ্চ করতে খন্দকার সাহেব বাসায় এলেন, খাবার টেবিলে আমিও গিয়ে বসেছিলাম। ভাত-ডাল, শাক-সবজি, মুরগি, মিষ্টি সবই ছিল কিন্তু আমার বরাদ্দ দুধ-রুটি। অসহ্য, বাধ্য হয়ে সেটাই মাথা নিচু করে শেষ করতে হলো।  মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে বাড়ি ফেরার জন্য। রাতের বেলায় খাওয়ার টেবিলে খন্দকার সাহেব জানিয়ে দিলেন, আগামীকাল সকালে হায়দ্রাবাদ ফিরে যেতে হবে। মনে হলো বন্দিশিবির থেকে মুক্ত হবার সংবাদ পেলাম। আনন্দ হচ্ছিল। পরদিন সকালবেলা নাস্তার টেবিলে সবাই চুপচাপ। হাতের ব্যাগটা নিয়ে খন্দকার সাহেবের পেছনে পেছনে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম, যেমনটি হায়দ্রাবাদ থেকে করাচি আসার সময় উঠে বসেছিলাম। লজ্জা আর ভয়ে একবার খন্দকার সাহেবের মেয়ের দিয়ে তাকিয়েছিলাম, মুখে বিদায় জানাতে পারিনি। গাড়িটা স্টার্ট দেয়ার সাথে সাথে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠেছিল এবং ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা অনুভব করছিলাম কিন্তু পেছন ফিরে তাকাবার সাহস হয়নি।
কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি করাচি রেলস্টেশনে এসে থামলে খন্দকার সাহেব ট্রেনের টিকিট আমার হাতে দিয়ে হায়দ্রাবাদ নেমে যা যা করণীয়Ñ সব বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে চলে গেলেন। সময়মত ট্রেন ছেড়ে দিলে জানালার ধারে বসে করাচি শহরটাকে শেষবারের মত দেখে নিচ্ছিলাম। করাচি শহরটি ভাল লেগে গিয়েছিল। ভোজবাজির মত দু’তিনটা দিন কেটে গিয়েছিল টেরই পাইনি। আর ট্রেনে প্রায় ৪ ঘন্টা সময় চলে গেল, সেটা বুঝতে পারার আগেই হায়দ্রাবাদ রেলস্টেশনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে গেল। আমাকে নেয়ার জন্য একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন, তার সাথে টাঙ্গায় গিয়ে বসলাম। কালো চিকচিক করা ইয়া বড় ঘোড়ার গাড়িটাকে নিয়ে ছুটে চলেছে। তখন মনে হলো ঢাকার ঘোড়া গাড়ির গাড়োয়ানদের কথা, আরে সাব, আমার ঘোড়া-পঙ্খীরাজ দৌড়াইব না, উইরা যাইব। সত্যি, টাঙ্গাটা উড়ে যাওয়ার মতই ছুটে গিয়ে একটা স্কুলের হোস্টেলে থামলো। লোকটার পেছনে পেছনে দোতলায় একটি কামরায় যেতে সে বললো, ইয়ে কামরা তুমহারা হায়।
কবির ভাই, জহির ভাই, আবিদ হোসেন এবং আমি পূর্ব পাকিস্তান টিম থেকে ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। করাচি থেকে ফিরে তাদের সাথে দেখা করলে তারা আমাকে উৎসাহ এবং প্রেরণা দিলেন। ক্যাম্প কমান্ডেন্টের কাছে আমার যোগদান এবং শারীরিক অবস্থা বর্ণনা করলে তিনি বিকেলে মাঠে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দিলেন। একটি স্কুলের বিরাট কম্পাউন্ড। পেছনে ছাত্রদের হোস্টেল যা সে সময় ছুটি ছিল। হোস্টেলের চারদিক গাছপালা, ঝোপ-ঝাড়, ময়লা-আবর্জনা জমে আছে, একদিকে ধোপা কাপড় ধুচ্ছে। সে পানি হোস্টেলের পাশ দিয়ে ময়লা-আবর্জনা আর দুর্গন্ধময় একটি নর্দমার মাধ্যমে চলে যাচ্ছে। ফলে মশা-মাছিতে জায়গাটা ভরে রয়েছে। যার প্রমাণ পাওয়া গেল দুপুর বেলা খাওয়ার টেবিলে। পুরো টেবিল দখল করে রেখেছে মাছিকুল। খাওয়ার সাদা প্লেট কালো রং ধারণ করে আছে। প্লেট ধুয়ে এক হাতে মাছি তাড়াতে তাড়াতে টেবিলে বসে ভাত নিতে গিয়ে দেখা যায় ভাতের গামলায় দু’একটা মাছি আগে থেকেই দখল নিয়ে বসে আছে। তরকারির বা ডালের বাটি ঢাকা থাকে, তারপরও মাংস কিংবা ডালে দু’একটি মাছিকে সাঁতরাতে মাঝেমধ্যে দেখা যায়। বিকেলে প্র্যাকটিসের পূর্বে খাবার টেবিলে চা-বিস্কুটের সাথে মাছিও থাকে, হাত দিয়ে তাদেরকে তাড়িয়ে তারপর চায়ে চুমুক দিতে হয়। একটু অসাবধান হলে চাপের সাথে সাঁতার দিয়ে পেটে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একই রকম সকালের নাস্তাতেও সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। রাতে অন্ধ মাছিরা জ্বালাতন কম করে থাকে। সব মিলিয়ে নোংরা দুর্গন্ধময় একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছিল। সে সময় ফুটবল খেলোয়াড়রা কি করে ঐরকম জঘন্য একটা পরিবেশকে মেনে নিয়েছিল, সেটা আজও ভাবি এবং বর্তমানে আমাদের জাতীয় দলের ফুটবল ক্যাম্পের সাথে তুলনা করি, আর অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করেÑ যা বলতে পারি না।
এক মাসের ফুটবল ক্যাম্পে আমি আরও বেশি শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে দুর্বল এবং কান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ট্রায়েল ম্যাচগুলো আমার মত খেলতে পারিনি, শরীরে সেরকম বল পাচ্ছিলাম না, যা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী খেলোয়াড়দের সাথে লড়াই করে জিততে পারি। দাঁতের অসুখটা আমাকে আগেই শেষ করে দিয়েছিল। তাছাড়া বাড়ি ফেরার চিন্তাও এর সাথে যোগ হয়ে আমাকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে দেয়নি। শুধু কবির ভাই বাঙালিদের সম্মান রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।


(আটাশ)
১৯৬০ সালের ক্রীড়া মৌসুম আমার খুব ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটেছিল। জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ ’৫৯ এবং জাতীয় ফুটবল ক্যাম্প শেষ করে হায়দ্রাবাদ থেকে নভেম্বর মাসের শেষে ঢাকায় ফিরেই সংবাদ পেলাম যে, হকি লীগ কিছুদিন আগেই শুরু হয়ে গেছে। লম্বা সময় ধরে হকি লীগ চলে, তাই অক্টোবর-নভেম্বর মাসেই হকি মৌসুম আরম্ভ হয়ে যায়। ফুটবল নিয়ে দীর্ঘদিনের  সফরের কান্তি আর অসুস্থতার জন্য দুর্বলতা, সব মিলিয়ে শারীরিক এবং মানসিক বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা প্রচন্ডভাবে অনুভব করছিলাম। কিন্তু বুলবান (সহ-খেলোয়াড়) খবর দিয়ে গেল, আগামী ২ ডিসেম্বর ভিক্টোরিয়ার হকি খেলা, সালাম ভাই এবং রেজা ভাই মাঠে যেতে বলেছেন। এই ক’বছরে ভিক্টোরিয়া কাবের প্রতি আমার যেমন একটা মায়া-ভালবাসা-দায়িত্ববোধ জন্মে গিয়েছিল, তেমনি কাব কর্তৃপক্ষেরও আমার ওপর তাদের আস্থা/দাবি  জন্মেছিল। তাছাড়া খেলা আমি উপভোগ করি। খেলতে আমার ভাল লাগে আর সেটা যে কোন খেলা হোক। মাঝে মাত্র দু’দিন। পরদিন সকালে হকিস্টিক নিয়ে বাড়ির কাছে স্কুল মাঠে নিজেকে যাচাই করার জন্য গিয়েছিলাম। বুঝতে পারলাম, হকি লীগ খেলার জন্য নিজেকে আরো তৈরি করতে হবে, সময় লাগবে।
কাবে গিয়ে জানতে পারলাম যে, শক্তিশালী ইপিআর টিমের বিরুদ্ধে আমাদের খেলা। সিজনের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামছি একেবারে প্র্যাকটিস ছাড়া, তাও আবার শক্তিশালী ইপিআর টিমের সাথে। ফুটবল মাঠ থেকে সোজা হকি মাঠে। ফুটবল খেলা থেকে সরাসরি হকি খেলায় নেমে পড়া, কেমন জানি ওলটপালট লাগছিল। মাঠে হকির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে সময় লাগছিল। আমাদের ভিক্টোরিয়া টিম যদি সামনের সারির দল হতো, তাহলে ধীরে ধীরে নিজেকে টিমের সাথে মানিয়ে নেয়ার সুযোগ পাওয়া যেত কিন্তু সেদিন মাঠে নেমে টিম সামলাতেই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হচ্ছিল এবং বলের পেছনে সারাক্ষণ ছুটতে হয়েছিল। কিছুক্ষণ এলোমেলো ছোটাছুটি করার পর নিজেকে হকি খেলোয়াড় হিসেবে ফিরে পেয়েছিলাম।
বিপক্ষ দলের একের পর এক আক্রমণকে বাধা দেয়া এবং সে সাথে নিজ দলকে সাথে নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করা, তখন টিমের সমস্ত দায়িত্ব যেন আমার ওপর এসে পড়েছিল। আমাদের টিম সেদিন অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে খেলে শক্তিশালী ইপিআর দলের বিরুদ্ধে ১-৩ গোলে পরাজিত হয়েছিল। আমাদের টিমের এবং আমার খেলার প্রশংসা করে পরদিন অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর ’৫৯ তারিখে পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা যে মন্তব্য করেছিল, তার অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরছি :

ঞযব ুড়ঁহম ধহফ পড়সঢ়ধৎধঃরাবষু রহবীঢ়বৎরবহপবফ ঠরপঃড়ৎরধ ঢ়ষধুবৎং মধাব ধ ংঢ়রৎরঃবফ ফরংঢ়ষধু ধহফ বয়ঁধষরংরহম রহ ঃযব ৫ঃয সরহঁঃব ড়ভ ঃযব ংবপড়হফ যধষভ ঃযবু সধহধমবফ ঃড় ঃযধিৎঃ ঃযব ঊচজ ড়ভভবহংরাব রিঃয ফরংঃরহপঃরড়হ.

“ঠরপঃড়ৎরধ ফবভবহপব ধিং মড়ড়ফ রিঃযড়ঁঃ নবরহম নৎরষষরধহঃ পঁংঃড়ফরধহ ঘঁৎঁষ নৎড়ঁমযঃ ড়ভভ ধ হঁসনবৎ ড়ভ মড়ড়ফ ংধাবং. ঞযব নধপশং বিৎব ংঃবধফু ধহফ ঃযব যধষাবং বিৎব ধষধিুং ড়হ ঃযব মঁধৎফ ড়হ ঃযব ঊচজ ধঃঃধপশ. ঈবহঃৎব যধষভ ঝধষধস ধিং ঃযব সধরহংঃধু ড়ভ ঃযব ঃবধস. ইঁঃ ঃযব ঢ়ষধুবৎ যিড় পধঁমযঃ ঃযব বুব ধিং ষবভঃ রহ ইধংযরৎ. চবৎযধঢ়ং যব ঢ়ষধুং যড়পশবু নবঃঃবৎ ঃযধহ ভড়ড়ঃনধষষ. ইধংযরৎ ধিং ধ পড়হংঃধহঃ ংড়ঁৎপব ড়ভ ঃৎড়ঁনষব ঃড় ঃযব ঊচজ ফবভবহপব. ঞযব বহঃরৎব জরভষবং সধহ’ং ফবভবহপব ধিং ৎঁহহরহম ধষষ ড়াবৎ ঃযব ঢ়ষধপব ঃড় পযবপশ ইধংযরৎ ধহফ ধং ধ ৎবংঁষঃ যব ধিং ঃযব ঠরপঃরস ড়ভ ৎড়ঁময পযধৎমরহম য়ঁরঃব ধ হঁসনবৎ ড়ভ ঃরসবং. ঘবাবৎঃযবষবংং যব ঢ়ষধুবফ ংঁঢ়বৎনষু ধহফ ংপড়ৎবফ ঃযব ড়হষু মড়ধষং ভড়ৎ যরং ংরফব.

হকি নিয়ে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম; কারণ এবার আমাকে ইস্ট পাকিস্তান হকি টিমে চান্স পাওয়ার জন্য লড়তে হবে কিন্তু কলেজ এবং প্রভিন্সিয়াল অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা একেবারে কাছে থাকায় কোন বিষয়ের প্রতি একান্তভাবে মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। আমি এখন কলেজ ছাত্র। জগন্নাথ কলেজের আইকম-এর প্রথম বর্ষের ছাত্র। ম্যাট্রিক পাস করার সাথে সাথে জুন-জুলাই মাসেই নূর হোসেন স্যার আমাকে তার নিজের ঘরের ছেলের মত তার কলেজে ধরে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে আমার বাসার কোন প্রকার মতামত ছিল না। জগন্নাথ কলেজে খেলোয়াড়রা সুযোগ-সুবিধা পায়, কমার্স গ্রুপের পড়াশোনাও এখানে ভাল হয়Ñ এগুলো জেনে আমি আগে থেকেই মানসিকভাবে জগন্নাথ কলেজে ভর্তির জন্য তৈরি ছিলাম।
এর আগেও একবার আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসেবে হকি অঙ্গনে নাম লিখিয়েছিলাম। সেটি এক মজার ঘটনা। তখন আমি আরমানিটোলা স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের পক্ষে ঢাকা লীগে খেলে থাকি। সালাম ভাই এবং মোমিন ভাই কাবের দীর্ঘদিনের খেলোয়াড়। ১৯৫৬ সালে মোমিন ভাই ঢাকা কলেজের স্পোর্টস সেক্রেটারি। নির্দিষ্ট তারিখে হকি খেলার সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাঠে হাজির থাকতে বলেছিলেন। সে মতে আমিও হাজির হয়েছিলাম। খেলার আগে ঢাকা কলেজের যে জার্সিটা আমাকে দেয়া হয়েছিল, সেটা গায়ে দিয়ে দেখা গেল লম্বায় হাঁটুর নিচে পড়েছে আর হাতটা থ্রি কোয়ার্টার! গুটিয়ে সেদিন আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বিরুদ্ধে ইন্টারকলেজ হকি টুর্নামেন্ট খেলেছিলাম। ঢাকা কলেজে সেদিন যারা খেলেছিলেন, তাদের মধ্যে সালাম ভাই, মোমিন ভাইসহ ইজাজ রসুল (পরবর্তীতে আমরা ইস্ট পাকিস্তান ফুটবল টিমে এক সাথে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম), মশিহ উল করিম (পরবর্তীতে বার্জার পেইন্ট-এর এমডি) প্রমুখ। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তখন বেশ ভাল টিম। বিশেষ করে তাদের ছাত্রদের অনেকেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসতো এবং তারা হকি ভাল খেলতো। সেদিনের খেলার রেজাল্ট কি হয়েছিল মনে নেই; তবে ঢাকা কলেজের ইয়া বড় জার্সিতে আমাকে দেখে অনেকে হেসেছিলÑ এটা মনে আছে।
২৪ ডিসেম্বর ’৫৯ ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাঠে জগন্নাথ কলেজের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ¯িপ্রন্টার কাদের জাহেদসহ সে সময়কার কৃতী অ্যাথলেটরা জগন্নাথ কলেজ থেকে অংশ নিয়েছিল। বিশেষ করে কাদেরের সাথে ১০০ এবং ২০০ গজ দৌড়ে জয়লাভ করা ছিল আমার অন্যতম সফলতা। তাছাড়াও লংজাম্প (ব্রডজাম্প) এবং হপ স্টেপ এন্ড জাম্পে প্রথম হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছিলাম। আমি সৌভাগ্যবান ছাত্র যে, একই বছর (১৯৫৯, স্কুল নবকুমার ইন্সটিটিউট) এবং কলেজ (জগন্নাথ কলেজ)-এর ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম এবং ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্মান লাভ করেছিলাম।
১৫, ১৬ এবং ১৭ জানুয়ারি ’৬০ প্রভিন্সিয়াল অ্যাথলেটিক্স মিট ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন ঢাকার সব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অন্তর্ভুক্ত ছিল; সে সুবাদে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে প্রভিন্সিয়াল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। ব্রডজাম্প, ২০০ গজ ¯িপ্রন্ট এবং ৪ী১০০ গজ রিলে রেস ইভেন্টে প্রতিযোগিতা করে প্রত্যেকটি ইভেন্টে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলাম। ভালভাবে নিজেকে তৈরি না করে এত বড় একটি ক্রীড়া আসরে অংশ নিয়ে এর চেয়ে ভাল রেজাল্ট পাওয়া সম্ভব নয়, এতেই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমি একজন অ্যাথলেটÑ এটাই ছিল আমার গর্ব।
ক্রিকেট লীগ ম্যাচ খেলার জন্য সালাম ভাইয়ের ডাক উপেক্ষা করা সম্ভব হতো না, ফাঁকে ফাঁকে ভিক্টোরিয়া কাবের ক্রিকেট দলকেও সময় দিতে হতো।
অন্যান্য খেলার ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে হকির জন্য বিশেষ মনোযোগ দিতে হচ্ছিল; কারণ হকি লীগের প্রত্যেকটি ম্যাচ আমাকে খুব পরিশ্রম করে খেলতে হতো। সালাম ভাই শক্ত হাতে ডিফেন্স সামলাতেন, নরু ভাই গোলপোস্ট আগলাতেন কিন্তু দলকে জয় এনে দেয়ার মতো দক্ষ ফরোয়ার্ড লাইনের অভাব ছিল। বুলবান ভাল খেলতো কিন্তু দলের এলোমেলো খেলায় কখনও জোড়দার আক্রমণ রচনা করতে পারতো না। আমাকেই টিমকে সাথে নিয়ে আক্রমণ করা, পেছনে এসে হাফদের সাপোর্ট করা, আর এসব পারফর্ম করতে আমাকে সমস্ত মাঠজুড়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হতো। তারপর মাঝে  মাঝে গোল করে দলের সাফল্যে অবদান রাখতে হতো। বরাবরের মত সে বছরও ভিক্টোরিয়া কাব মাঝামাঝি স্থানে থেকে হকি লীগ শেষ করেছিল। লীগ শিরোপা অর্জন করেছিল রেলওয়ে টিম।
করাচি, ১৯৬০ সালের হকি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপের ভেন্যু। ইস্ট পাকিস্তান টিমকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে হকি লীগ এবং টুর্নামেন্ট থেকে ২৬ জন খেলোয়াড় বাছাই করে পাকিস্তানী (করাচী থেকে) কোচ এহসানের তত্ত্বাবধানে এক মাসের আবাসিক ক্যাম্প করা হয়েছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামের প্লেয়ার্স লাউঞ্জে বর্তমানে ১ নং গেট দিয়ে ঢুকে (গ্যালারির সিঁড়ির নিচে, যা এখন ইলেক্ট্রনিক্সের দোকান) হাতের ডান এবং বাম দিকে ছিল প্লেয়ার্স লাউন্স। ক্যাম্পে বেশিরভাগ খেলোয়াড় ছিল অবাঙ্গালি। কোচ এহসান লম্বা-পাতলা, কোটা চোখের অধিকারী একজন নরম স্বভাবের মানুষ। তার কোচিং পদ্ধতি ছিল সহজ-সরল। কিছুক্ষণ দৌড়াও, দু’চারটা এক্সারসাইজ করো, হিটিং-ড্রিবলিং, তারপর ম্যাচ খেলায় লেগে পড়ো। খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত স্কিল কিংবা শারীরিক ফিটনেসের চেয়ে ম্যাচ খেলার ওপর জোর দিতেন বেশি। গত দু’বছর আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য ইস্ট পাকিস্তান হকি দলে সুযোগ নিতে পারিনি। মার্চ মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষা হতো আর সে সময়ই ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপের আসর বসতো। এ বছর  আমি কলেজের ছাত্র; সুতরাং এ সুযোগটা আমাকে কাজে লাগাতে হবে। তখন ইস্ট পাকিস্তান হকি টিমে চান্স পাওয়া সহজ ছিল না। রেলওয়ে, ইপিআর, পিডব্লিউডি, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অবাঙ্গালি খেলোয়াড়দের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চান্স নিতে হতো। দু’দিন ট্রায়াল ম্যাচ খেলতে হয়েছিল। লেফট-ইন এবং রাইট-ইন দু’পজিশনেই আমি ট্রায়াল দিয়েছিলাম। চৌদ্দজন খেলোয়াড়, একজন কোচ এবং একজন ম্যানেজার; মোট ষোলজনের দল প্রকাশ করলে প্রথমবারের মত নিজের নাম তালিকায় দেখে খুব খুশি লেগেছিল। মোমিন ভাই এবং আমি বাঙ্গালি, হাবিব উল্লাহ নবাববাড়ীর, বাকি সবাই অবাঙ্গালি।
১৯৬০ সালের ইপিএসএফ হকি টিম
গোলরক্ষক ঃ শামি খান ও নবী খান, ফুলব্যাক ঃ কুদ্দুস ও বাবু খান, হাফ ব্যাক ঃ মোমিন, হাবিব উল্লাহ, মকবুল, নিয়াজ, রাইট আউট ঃ নিয়াজ খান, রাইট-ইন ঃ কাফুল বাররা, সেন্টার ফরোয়ার্ড ঃ ওসমান, লেফট-ইন ঃ জহির, বশীর, লেফট আউট ঃ মুয়ীদ, আখতার, কোচ ঃ এহসান, ম্যানেজার ঃ আনোয়ার আলী। বয়স্ক অত্যন্ত নরম স্বভাবের একজন ভদ্র মানুষ।


(ঊনত্রিশ)
৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬০। রাত ১১টায় আমরা ইস্ট পাকিস্তান হকি টিম (ইপিএসএফ) ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশীপ খেলার উদ্দেশ্যে ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে বাহাদুরাবাদ মেইল ট্রেনে করাচির পথে যাত্রা শুরু করেছিলাম। চৌদ্দজন খেলোয়াড় এবং একজন ম্যানেজার মোট পনেরজনের দল। কোচ এহসান সাহেব ভিসা জটিলতার জন্য আগেই প্লেনযোগে নিজ দেশ করাচি চলে গিয়েছিলেন। সাধারণত দলের ম্যানেজার দলকে সুশৃংখলভাবে পরিচালিত করেন কিন্তু আমাদের ম্যানেজার আনোয়ার আলী বয়স্ক এবং খুব দুর্বল ছিলেন। তাছাড়াও তিনি খুব শান্তশিষ্টনরম প্রকৃতির লোক ছিলেন। এই দীর্ঘপথ ট্রেন জার্নি করা তার পক্ষে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। সমগ্র ভ্রমণকালে আমাদের হকি খেলোয়াড়রাই তাকে আগলে রেখেছিল।
হকি টিমের বেলাতেও ভারতীয় ভিসা নিতে হয়েছিল। প্রতিটি ভিসা ফি এক রুপি। আমার এবারের ভিসা নং ছিল ৩৭২৩০৯/টি তাং ৮-২-১৯৬০। ১০ ফেব্রুয়ারি  আমরা দর্শনা পোস্ট দিয়ে ইস্ট পাকিস্তান বর্ডার ক্রস করে গেদে বর্ডার দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিলাম। তারপর শিয়ালদহ রেলস্টেশন। সে রাতেই হাওড়া স্টেশন থেকে পাঞ্জাব মেইল আমাদেরকে নিয়ে লাহোরের পথে যাত্রা শুরু করেছিল। ১৯৫৮ সালে ইস্ট পাকিস্তান ফুটবল টিমের মুলতান সফর ‘ফুলবাড়িয়া টু মুলতান বাই ট্রেন’ আমার সতেরতম সংখ্যায় যেভাবে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, ঢাকা-করাচির এই ভ্রমণটাও একই পথে একইভাবে হয়েছিল, শুধু সফরসঙ্গীরা ছিল ভিন্ন। ফুটবল সফরে সমগ্র পথ বাংলা ভাষায় কথাবার্তা শুনেছিলাম আর হকি সফরে শুনতে হয়েছিল উর্দুতে। ফুটবল দলে সবাই ছিল বাঙালী আর হকি দলে মোমিন ভাই ও আমি ছাড়া সবাই অবাঙ্গালী। ১৯৫৮ সালে ফুটবল দলের সফরে ট্রেনের বগিতে তিন-চারদিন একটি ভদ্র ও মার্জিত পরিবেশ বিরাজ করলেও হকি সফরে তা অনেকটাই ছিল অনুপস্থিত। সবার ছোট, স্কুল ছাত্র হিসেবে ফুটবল খেলোয়াড়দের কাছ থেকে স্নেহ-ভালবাসা পেয়ে সফরটাকে বেশ উপভোগ করলেও হকি সফরটাকে সেভাবে উপভোগ করতে পারিনি।
১২-২-১৯৬০ তারিখে পাঞ্জাব মেইল সময়মত অমৃতসর পৌঁছালে লাহোরগামী ট্রেনের সাথে আমাদের বগিটি যুক্ত করে দেয়া হয়েছিল এবং রেলস্টেশনেই ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস-এর যাবতীয় ফরমালিটিজ সম্পন্ন করে লাহোরের পথে ট্রেন যখন ছাড়লো, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ঘন্টাখানেক পর ওয়াগাহ বর্ডারে। এন্ট্রি নং এসএল-৪২২, তাং-১২.২.৬০ মাধ্যমে আমরা পাকিস্তান ভূখন্ডে  প্রবেশ করেছিলাম এবং লাহোর পৌঁছাতে সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। সে রাতেই আমরা তেজগাম এক্সপ্রেসে করাচি রওনা করে পরদিন অর্থাৎ ১৩-২-১৯৬০ তারিখে সকারবেলা করাচি রেলস্টেশনে ট্রেন এসে থামলে আমাদের পাঁচদিনের ট্রেন জার্নির অবসান হয়েছিল।
স্টেশন থেকে আয়োজকরা আমাদেরকে রিকশা করে এনে তুলেছিলেন একটি স্কুলে, পাঁচদিনের ট্রেন জার্নিতে আমরা কান্ত ছিলাম বিশ্রামের জন্য আমরা অস্থির হয়ে উঠেছিলাম; কিন্তু সেখানে ছিল ‘চারপাই’ওতে ছিল না কোন তোষক, চাদর, বালিশ। দুঃখে-কষ্টে মনটা বিগড়ে গিয়েছিল কিন্তু প্রতিবাদ করার মত কেউ ছিল না। ম্যানেজার সাহেব অত্যন্ত নরম স্বভাবের মানুষ, তার দ্বারা ঝগড়া-বিবাদ করা সম্ভব ছিল না আর ক্যাপ্টেন জহিরসহ অন্যান্য সিনিয়র প্লেয়ারের এ ব্যবস্থাতে খুব একটা অসুবিধা হবে বলে মনে হলো না। তারা  এতে অভ্যস্ত, তাই সবাই খালি চারপাইতেই কান্তি দূর করতে গা এলিয়ে দিয়েছিল। ছোট্ট একটি  মাঠ পেরিয়ে বাথরুমে যাওয়া ছিল আর একটি বিরক্তিকর ব্যাপার। রাতের বেলায় অবশ্য চারপাইতে তোষক, চাদর বালিশ পেয়েছিলাম।
১৫ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করা হয়েছিল জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশীপের। দু’দিন পর আমাদের খেলা পড়েছিল করাচি ‘বি’ টিমের সাথে। সে দলের গোলরক্ষক হামিদ, ফুলব্যাক কামার আলী খান, হাফে মরগুব। আমরা ১৯৫৯ সালে লাহোরে স্টুডেন্ট কোচিং কোর্সে অংশগ্রহণ করেছিলাম। পরবর্তীতে তারা তিনজনই পাকিস্তান জাতীয় দলে চান্স পেয়েছিল। সেদিন আমাদের দলে যারা খেলেছিল : গোলরক্ষক নবী খান, ফুলব্যাক কুদ্দুস ও বাবু খান, হাফে মুয়িদ, নিয়াজ  ও মকবুল, ফরোয়ার্ডে নিয়াজ খান, কায়ফুল, ওসমান, জহির ও বশীর।
আমাদের টিমের ক্যাপ্টেন জহির লেফট-ইনের খেলোয়াড়; সুতরাং আমার লেফট-ইনে খেলার প্রশ্ন ওঠে না। টিমের ভাইস ক্যাপ্টেন কাইফুল রাইট-ইনে খেলে, সেখানেও আমার জায়গা হয়নি কিন্তু টিমে আমাকে খেলাতে হবে, নইলে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাবে। অগত্যা আমাকে লেফট আউটে সুযোগ দেয়া হয়েছিল। মোমিন ভাইকে চান্স দেয়া হয়নি আর নবাববাড়ির হাবিব উল্লাহ সুযোগ পায়নি। লেফট আউট পজিশনে আমি কোনদিন খেলিনি, তবে ধারণা ছিল। এই প্রথম হকি ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপ খেলার জন্য মাঠে নেমেছি। সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম, হকি খেলা কত দ্রুত খেলা, হকি খেলতে কত স্ট্যামিনার প্রয়োজন। ব্যক্তিগত দক্ষতা আর দলগত নৈপুণ্য ছাড়া হকি খেলা সম্ভব নয়। ম্যাচ খেলার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো অভিজ্ঞতা আর ম্যাচ টেম্পারামেন্ট।
ঢাকার ঘরোয়া হকির অভিজ্ঞতা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের টুর্নামেন্টে বিরুদ্ধে ভাল ফল করা যাবে নাÑ সেটা সেদিনের ম্যাচেই বুঝতে পেরেছিলাম। সবচেয়ে মূল সমস্যা ছিল স্ট্যামিনা। আমি ছাড়া মাঠে যারা সেদিন খেলেছিলেন, তাদের প্রায় সবাই ছিল বয়স্ক এবং ফিজিক্যালি আনফিট। বল নিয়ে ছুটে যাওয়ার মত দম যেমন তাদের ছিল না, তেমনি বিপক্ষ দলের গতিসম্পন্ন খেলোয়াড়দের চেজ করার মতও তাদের দমের অভাব ছিল। বিশেষ করে টিমের চালিকাশক্তি ইনদ্বয়ের খেলা ছিল হতাশাজনক। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, লম্বা, হেংলা-পাতলা শরীর নিয়ে লেফট ইন জাহির মাঠে কিছুক্ষণ ছুটোছুটি করে কান্ত হয়ে কোমরে হাত দিয়ে হাঁটাহাঁটি করছিল, তখন গ্যালারি থেকে দর্শকরা ‘বুড্ডা’ বলে চিৎকার করেছিল। খেলোয়াড় বদল করার আইন ছিল না বলে ক্যাপ্টেন সাহেব মাঠ থেকে বের হওয়ার সুযোগ পাননি। ভাইস-ক্যাপ্টেন ও রাইট-ইন কাইফুল লম্বা-চওড়া শরীর নিয়ে কিছুক্ষণ সামনে-পেছনে দৌড় দিয়েই দম শেষ করে ফেলেছিল। করাচির ইয়ং খেলোয়াড়দের বাধা দেয়ার মত যেমন তার শক্তি ছিল না, তেমনি বল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ারও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। মাঠে তার দৌড়ানোর ভঙ্গিটা দর্শকদের হাস্যরসের খোরাক হয়েছিল। সেন্টার ফরোয়ার্ড ওসমান ছিল ইপিআর জোয়ান, আক্রমণভাগে পরিশ্রম করে খেলেছিল। তার কাছ থেকেই অল্প কয়েকটি বল পেয়ে খেলার সাধ কিছুটা মিটিয়েছিলাম। বল ধরে লাইন দিয়ে দু’একটা ছুট দিয়ে ক্রসও করেছিলাম। সে সময় আউটে যারা খেলতো, তারা ইনদের মুখাপেক্ষী থাকতো। ইন বল পাস দিলে তারা বল খেলার সুযোগ পেতো। আউটরা নিজ হাফের কাছ থেকে বল সরবরাহ পেয়ে নিজ খেলার নৈপুণ্য দেখাবার সুযোগ পেতো। সেদিন আমাদের টিমের রক্ষণ ভাগের খেলোয়াড়দের ইয়ানাফসি, ইয়ানাফসি অবস্থা ছিল অর্থাৎ বিপক্ষ দলের মুহুর্মুহু আক্রমণে তারা নাজেহাল অবস্থায় পড়ে গিয়েছি। দ্রুতগতিসম্পন্ন খেলোয়াড়দের কাকে ছেড়ে কাকে আটকাবে, তার ওপর গোলের পর গোল হচ্ছিল, পুরো টিমটাই তখন দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। করাচি ‘বি’ টিমের সাথে আমরা সেদিন ০-৯ গোলে লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিলাম।
টুর্নামেন্ট কমিটি প্রতিযোগিতার শেষ পর্যন্ত আমাদের করাচিতে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। যে ক’দিন আমরা করাচিতে ছিলাম, প্রতিদিন মাঠে আমাদের লজ্জা সইতে হতো; কারণ আমাদের কোচ সাহেব নির্ধারিত ম্যাচের পূর্বে আমাদেরকে মাঠে নামিয়ে কোচিং করতেন। উপস্থিত দর্শকরা এ নিয়ে তামাশা করে বলতো, ও দেখো, বাঙ্গালী খেল শিখতা হ্যায়। বাঙ্গালীকো হকি শিখাও’। বাঙ্গালীও আচ্ছি তারা হকি শিখো, আয়েন্দা, দশ গোল না খানা পারে।’ গ্যালারিতে বসে আমি এবং মোমিন ভাই মন্তব্যগুলো শুনতাম আর মাথা নিচু করে কথাগুলো হজম করতাম। কোচ সাহেব আমাকে এবং মোমিন ভাইকে  কোনদিন কোচিং করাতে মাঠে নামাতে পারেননি। সেই মন্তব্যগুলো কানে যেন লেগে আছে, আজও আমি সেগুলো ভুলতে পারিনি। হয়তো কোনদিনই ভুলতে পারবো না।


(ত্রিশ)
করাচি থেকে ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশীপ শেষ করে ঢাকায় ফিরে দেখি জগন্নাথ কলেজের ইলেকশনের তোড়জোড় চলছে। কলেজের কয়েকজন খেলোয়াড় বন্ধু চেপে ধরেছিল, আমাকে স্পোর্টস সেক্রেটারী হিসেবে ইলেকশন করার জন্য। মনের আনন্দে খেলাধুলা করি আর খেলাধুলা নিয়েই থাকতে চাই। এর মধ্যে ইলেকশনের প্রয়োজন কি? এসব ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছিলাম না কিন্তু নূর হোসেন স্যারও আমার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন, তাই আমি সম্মতি দিয়েছিলাম। ¯িপ্রন্টার কাদের অ্যাথলেটিক্স সেক্রেটারি এবং আমাকে স্পোর্টস সেক্রেটারী পদ দিয়ে একটি প্যানেল করা হয়েছিল। প্যানেলের অন্যান্য প্রার্থীর সাথে কয়েকদিন সন্ধ্যার পর কলেজের হোস্টেলগুলোতে ভোট দেয়ার অনুরোধ জানাবার জন্য যেতেও হয়েছিল। 
ভোট চাওয়ার ব্যাপারটা  ছিল আমার কাছে অস্বস্তির একটা ব্যাপার, সহজভাবে নিতে পারছিলাম না। আমাকে বেশিদিন এই পরিস্থিতি সহ্য করতে হয়নি। আমার বিরুদ্ধে কোন প্রার্থী না থাকায় আমি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্পোর্টস সেক্রেটারী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলাম। ¯িপ্রন্টার কাদেরসহ আমাদের পূর্ণ প্যানেল পাশ করলে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র পরিষদ (ক্যাবিনেট) গঠন করা হয়েছিল। খেলাধুলায়  সাংগঠনিক কর্মকান্ডে আমার পথচলা শুরু হয়েছিল সেখান থেকে।
জগন্নাথ কলেজের ইলেকশনের ব্যস্ততা শেষ করেই আসন্ন ফুটবল মৌসুমের জন্য নিজেকে তৈরি করতে মাঠে নেমে পড়েছিলাম। এরই মধ্যে একটি সংবাদ আমাদেরকে বেশ  চঞ্চল করে তুলেছিল, সে সংবাদটি ছিল, কোলকাতা মোহামেডান কাব ঢাকায় এক্সিবিশন ম্যাচ খেলার জন্য আসছে। শুনেই আমাদের অনুশীলনের মাত্রাও বেড়ে গিয়েছিল।
পঞ্চাশ-ষাট দশকে কোলকাতার ফুটবল আমাদের তাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এদেশের বাঙ্গালীরা কোলকাতার ইস্টবেঙ্গল কাব গড়েছিলেন, তাই এদেশের বাঙ্গালীদের কাছে কোলকাতা ইস্টবেঙ্গল কাবের প্রতি দুর্বলতা ছিল। ঠিক তেমনি কোলকাতা মোহামেডান কাবের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে এদেশের বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠীর। তবে মোহনবাগান কাব তাদের ক্রীড়ানৈপুণ্য দিয়ে এদেশের ফুটবলামোদীদের মন জয় করেছিল আগেই। এ তিন কাবের খেলা কিংবা তাদের খেলার সংবাদ আমাদের কাছে সবসময়ই আকর্ষণীয় এবং গল্প করার বিষয় ছিল। তাদের সাথে খেলতে পারাটা আমাদের মত ইয়াং খেলোয়াড়দের কাছে ছিল গর্বের। ট্রায়াল ম্যাচ শেষে ১৮ জন খেলোয়াড়কে বাছাই করা হয়েছিল কোলকাতা মোহামেডান কাবের সাথে এক্সিবিশন ম্যাচ খেলার জন্য।  তারা হলো :  গোলরক্ষক- রঞ্জিত দাস  ও সিদ্দিক। ফুলব্যাক-সাইফুদ্দিন, ইমাম বক্স ও হাবিব, হাফ ব্যাক-গফুর বেলুচ, রসুল বক্স, পিন্টু, কামরু ও সামাদ। ফরোয়ার্ড-লিটন, মুসা, বশীর, সগীর, নিশিথ, রব্বানী, মৃধা মারী ও প্যাট্রিক।
১০ মে ১৯৬০ ঢাকা স্টেডিয়ামে ঢাকা একাদশ বনাম কোলকাতা মোহামেডান কাবের এক্সিবিশন ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেদিন যারা প্রথম একাদশে খেলেছেন তাদের মধ্যে ছিল রঞ্জিত দাস, ইমাম  বক্স, সাইফুদ্দিন, রসুল বক্স, গফুর বেলুচ, পিন্টু, লিটন, বশীর, নিশিথ, রব্বানী, সগীর।
পরদিন অর্থাৎ ১১ মে ১৯৬০ মর্নিং নিউজ পত্রিকার খেলার বিবরণের অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরছি : ‘ঈধষপঁঃঃধ গড়যধসসবফধহ ঝঢ়ড়ৎঃরহম পঁংঃড়ফরধহ পড়সঢ়ষবঃবষু নবধঃবহ নু ইধংযরৎ, উধপপধ ংবষবপঃবফ ঢও. ষবভঃ রহ যিবহ যব ংপড়ৎবফ ঃযব ড়হষু মড়ধষ ভড়ৎ ঃযব ষড়পধষ ংরফব, যিরষব ড়ঃযবৎং ষড়ড়শ ড়হ.’
২৬-৭-১৯৬০ দর্শকপূর্ণ ঢাকা স্টেডিয়াম। ঢাকা-রাজশাহী কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটি ফুটবল একাদশ বনাম ন্যাশনাল ফুটবল কোচিং সেন্টার ট্রেনিং একাদশ-এর মধ্যে এক্সিবিউশন ফুটবল খেলা। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির পক্ষে চান্স পেয়েছিলাম। পাকিস্তানে খেলাধুলার মানোন্নয়নের  জন্য ন্যাশনাল কোচিং সেন্টার গঠন করা হয়েছিল। এরই তত্ত্বাবধানে তিনটি খেলাকে বাছাই করে তিনটি প্রভিন্সে তিনটি কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে ট্রেনিং দেয়া হতো। ক্রিকেটের জন্য করাচি, হকির জন্য লাহোর এবং ফুটবলের জন্য ঢাকা। ফুটবল ট্রেনিং শেষে একটি এক্সিবিশন ম্যাচের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান স্বয়ং উপস্থিত থেকে খেলা দেখবেন এবং সার্টিফিকেট প্রদান করবেন বলে এই খেলার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এ খেলাটি ছিল আমার জন্য বিশেষ একটি খেলা। ১৯৫৯ সালে হায়দ্রাবাদে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনাল খেলা দাঁতের ব্যথার জন্য খেলতে পারিনি বলে মনে কষ্ট পেয়েছিলাম। তাছাড়াও সে খেলায় প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান উপস্থিত থেকে খেলা দেখেছিলেন এবং পুরস্কার প্রদান করেছিলেন, সেই অতৃপ্ত বেদনা মনে চাপা ছিল, সে দুঃখ ঘুচানোর একটি সুযোগ এসেছিল বলে এই ম্যাচটি আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ ছিল।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এক্সিবিশন ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। খেলাশেষে ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের সাথে হাত মিলিয়ে তার কাছ থেকে সার্টিফিকেট গ্রহণ করে মনের অপূর্ণ সাধ পূরণ করতে পেরে খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম।
১৪-৮-১৯৬০ মোহামেডান দলের আজাদী দিবস ফুটবল শীল্ড লাভ : গভর্নর কর্তৃক পুরস্কার বিতরণ
ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের আমি রেজিস্টার্ড প্লেয়ার হলেও মোহামেডান কাবের অনেকটা ঘরের ছেলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। লীগের খেলা ছাড়া টুর্নামেন্ট হলেই আমার ডাক পড়তো, আমিও মনের আনন্দে মাঠে নেমে পড়ি। এবারও মোহামেডান কাব আজাদী দিবস ফুটবল খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।  চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের কাছে লীগ শিরোপা হারিয়ে এবার আজাদী দিবস ফুটবল শীল্ড ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল মোহামেডান কাব।  ১৪ আগস্ট বিকেলে আজাদী দিবস উপলক্ষে সাজানো-গোছানো ঢাকা স্টেডিয়ামে ২০/২৫ হাজার দর্শক সমাবেশে বিকেল ৫টায় ফাইনাল খেলা শুরু হয়েছিল। খেলাটি সারাক্ষণ তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দর্শকদের টেনশনে রেখেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে মোহামেডানের লেফট আউট টুলু বল নিয়ে গোল এরিয়ায় ঢুকে পড়লে ওয়ারান্ডার্সের ফুলব্যাক সাইফুদ্দিন তাদের আগুয়ান গোলরক্ষক ফজলুর রহমানকে বল না দিয়ে নিজ গোল ঢুকিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত ঐ একটি গোলই প্রথম বিভাগ লীগ চ্যাম্পিয়নশীপ লাভ হতে বঞ্চিত মোহামেডান কাব  যে মানসিক যাতনায় ভুগছিল, ওয়ান্ডারার্স দলকে পরাজিত করে প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। মোহামেডানের জয়লাভের মূল গজনবী ভাই এবং ইমাম বক্সের দৃঢ়তাপূর্ণ খেলা যা ওয়ান্ডারার্স দলের শক্তিশালী আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের বারবার আক্রমণকে প্রতিহত করেছিল। ফাইনাল খেলায় আমার প্রশংসা করতে গিয়ে দৈনিক আজাদ তাদের ১৬-৮-৬০ তারিখের পত্রিকায় লিখেছিল, ‘তাহাদের আক্রমণভাগে প্রশংসনীয় ক্রীড়া প্রদর্শন করে ভিক্টোরিয়া কাবের তরুণ বশীর। তাহার অপূর্ব কলাকৌশল, বল আয়ত্তে রাখার ও সময়মত পাস করার নিপুণতা দর্শকদের তাক লাগাইয়া দেয়।’
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেঃ জেনারেল আজম খান খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণ করেছিলেন।
সে ম্যাচে যারা খেলেছিল
মোহামেডান ঃ তপন, জহীর ও গজনবী, ইমাম বক্স, কামরু ও নওরোজ, আশরাফ, বশীর, আবু জান, গদাধর ও টুলু।
ওয়ান্ডারার্স ঃ ফজলুর রহমান, লিও ও সাইফুদ্দিন, রসুল বক্স, গফুর ও মোবাশ্বের, রেমন্ড, মুসা, ইয়াকুব, মারী ও বটু।
জগন্নাথ কলেজের স্পোর্টস সেক্রেটারী হওয়ার পরপরই এফএইচ হলকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে গভর্নর কাপ বিজয় ছিল কলেজ জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি সাফল্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর ন্যায় ঢাকার সব কলেজও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত/অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে খেলাধুলায় বিভিন্ন কলেজের খেলোয়াড়রা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করতো। ‘গভর্নর কাপ’ আন্তঃকলেজ ফুটবল টুর্নামেন্ট। একটি সম্মানজনক টুর্নামেন্ট। ঢাকা ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন হল, ঢাকার কলেজগুলোর ফুটবল টিম এতে অংশগ্রহণ করতো। বেশ জমজমাট প্রতিযোগিতা।
বরাবরের ন্যায় এফএইচ হল খেলাধুলায় ভাল, ফাইনাল খেলায় জগন্নাথ কলেজ তাদের মুখোমুখি হয়েছিল। ১৯৬০ সালের ৫ নভেম্বর। প্রথম মিনিট থেকেই দুই টিম জেতার মনোভাব নিয়ে খেলা শুরু করেছিল। প্রচন্ড উত্তেজনা মাঠে, দু’দলের সমর্থকও উত্তেজিত। আমাদের আক্রমণভাগের কামাইক্ষা গোলপোস্টে একটি কিক করলে তা এফএইচ হলের গোলরক্ষকের হাত ফসকে আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড মজিদের কাছে গেলে সে আলতো টোকা দিয়ে গোল করে। এফএইচ হলের খেলোয়াড়রা ইউনিভার্সিটি মাঠের এবং তাদের সমর্থকদের সাপোর্টে গোলশোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। মাঠে এবং মাঠের বাইরে টানটান উত্তেজনা, ‘ডু অর ডাই’ মনোভাব নিয়ে এফএইচ হল খেলছিল। এ অবস্থায় আমাদের লেফট আউট মুসলিমের কাছ থেকে বল পেয়ে আমি সজোরে কিক করে বিপক্ষ গোল রক্ষককে পরাস্ত করায় আমাদের দল ২-০ গোলে এগিয়ে যায়। খেলা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে কামাইক্ষা গোল করলে শেষ পর্যন্ত আমরা ৩-০ গোলে এফ এইচ হলকে পরাজিত করে গভর্নর কাপ জয়লাভের গৌরব অর্জন করেছিলাম। ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন (ডিন অব ফেকালটি অব সাইন্স, ঢাকা ইউনিভার্সিটি) খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণ করেছিলেন। জগন্নাথ কলেজের টিম ক্যাপ্টেন হিসেবে তার কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করে সম্মান বোধ করেছিলাম।

একত্রিশ)
 “ঐঊজঙ’ঝ ডঊখখ ঈঙগঊ ঋঙজ ঞঐঊ ঞঊঅগ”
দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার খেলার পাতায় সেদিন (৩০-১১-৬০) শিরোনাম করেছি এটা।
করাচিতে সেবার জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের ১১তম আসর বসেছিল। সেই চ্যাম্পিয়নশীপের একটি
বিশেষ গুরুত্ব ছিল যে, পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পূর্ব পাকিস্তান এবং করাচি (করাচিকে প্রভিন্স গণ্য করা হতো)-সহ সার্ভিসেস দল নিয়ে চলমান প্রাদেশিকভিত্তিক (ইন্টারডিভিশন) টুর্নামেন্টের এটাই  ছিল শেষ প্রতিযোগিতা। পরবর্তীতে টিম বিন্যাসের পদ্ধতিগত পরিবর্তন এনে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপ অনুষ্ঠিত হবে। পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় ফুটবলের শিরোপা কখনও অর্জন করতে পারেনি। জয়ের আশা নিয়ে শক্তিশালী দল গঠন করার চেষ্টা করেছিলেন ইপিএসএফ কর্মকর্তারা।  সেবারও প্লেয়ার্স লাউঞ্জেই ক্যাম্প করা হয়েছিল। কোচিং-এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জনাব সাহেব আলীকে। সদ্য শেষ হওয়া আগা খান গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে ঢাকা মোহামেডান এবং কেএমসি (করাচি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন)-এর মধ্যকার একটি খেলায় অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে মোহামেডান কাবের গজনবী ভাই, কবির ভাই, কামরু ভাই, আমান চৌধুরী এবং সামাদকে (নারায়ণগঞ্জের) বহিষ্কার করা হয়েছিল। এর প্রতিবাদে তারা ক্যাম্পে যোগদান করেননি। প্রায় মাসখানেক অনুশীলন এবং ট্র্যায়াল শেষে উনিশজন খেলোয়াড় ও দু’জন কর্মকর্তার নাম  ঘোষণা করা হয়েছিল।
টিম লিস্ট ঃ গোলরক্ষক রঞ্জিত দাস ও সিদ্দিক। ফুলব্যাক জহির, (ক্যাপ্টেন) সাইফুদ্দিন ও গৌরসাহা। হাফব্যাক- রসুল বক্স, নবী চৌধুরী, গফুর বেলুচ, পিন্টু, সামাদ ও নওরোজ। ফরোয়ার্ড- প্যাট্রিক, আবদুল্লাহ, ইয়াকুব, বশীর, মুসা (ছোট), রব্বানী জাম্বু ও বাটু। কোচ- জনাব সাহেব আলী, ম্যানেজার-জনাব এ.বি.এম.জি কিবরিয়া। কিবরিয়া সাহেব পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন।
ডিফেন্সকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সে সময় থ্রি ব্যাক বা স্টপার ব্যাক সিস্টেমে খেলার প্রচলন হয়েছিল। বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতি চালু হলেও আমাদের কাছে তখনও সেটা ছিল নতুন। সেন্টার হাফ পজিশনের খেলোয়াড়কে পেছনে এনে দুই ফুলব্যাকের মাঝে খেলানোটাকেই থ্রি ব্যাক বা স্টপারব্যাক বলা হতো এবং এর সাথে খেলোয়াড়দের দায়িত্বেরও পরিবর্তন আসতো। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাব সেবছর (১৯৬০) থ্রি ব্যাক সিস্টেমে খেলে সফল হয়ে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব হয়েছিল অপরাজিত রানার্সআপ। সুতরাং ইস্ট পাকিস্তান ফুটবল টিম থ্রি ব্যাক বা স্টপার সিস্টেমে খেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ  করেছিল। দেশের সেরা দু’জন সেন্টার হাফ পজিশনের খেলোয়াড় নবী চৌধুরী ও গফুর বেলুচকে স্টপার ব্যাক পজিশনে খেলানোর চিন্তা করেই টিম সিলেকশন করা হয়েছিল।
আমাদের টিম করাচি যাওয়ার পূর্বে ৫০২ ওয়ার্কশপ আর্মি টিমের সাথে ঢাকা স্টেডিয়ামে একটি ওয়ার্মআপ ম্যাচ খেলেছিল। পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা সেদিনের ম্যাচে আমাদের টিমের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরেছিল এভাবে, ‘দেশসেরা ফুলব্যাক গজনবীর অনুপস্থিতি ডিভেন্সে আস্থাহীনতা আর দুর্বলতা স্পষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। দলে আরও একটি সমস্যা ছিল, আর সেটি হলো নতুন পদ্ধতি থ্রি ব্যাক। নবী চৌধুরী ও গফুর বেলুচÑ কেউ থ্রি ব্যাক বা স্টপার ব্যাক হিসেবে ভাল খেলতে পারছিল না। অথচ দু’জনই দেশের সেরা সেন্টার হাফ। এজন্য হাফ লাইনে অতিরিক্ত খেলোয়াড় নেয়া হয়েছিল। ইমাম বক্সের বাদ পড়াটা টিমের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়েছিল। তবে প্রথমবারের মত গৌর সাহাকে ইস্ট পাকিস্তান ফুটবলের ব্লেজার পরার সুযোগ এনে দিয়েছিল। সেদিনের খেলায় প্যাট্রিক, বাটু ও আমার খেলার প্রশংসা করে পত্রিকা লিখেছিল যে, আমাদের খেলার উন্নতি হয়েছে। সে খেলায় আবদুল্লাহ দুটি এবং ইয়াকুব একটি গোল করায় আমরা ৩-১ গোলে জয়লাভ করেছিলাম।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মত কিছু খেলোয়াড় দেশে ফেলে রেখে ইস্ট পাকিস্তান টিম আগামীকাল রওনা দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছিল পত্রিকাটি। একরাশ সমালোচনা সাথে করেই আমরা ১৮ নভেম্বর করাচির উদ্দেশে ঢাকা তেজগাঁ বিমানবন্দর থেকে প্লেনে উঠেছিলাম।
আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল করাচির নিগার হোটেলে। হোটেলটি পুরাতন শহরে, রেলওয়ে স্টেডিয়ামের একেবারে কাছে। টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে আমরা নিগার হোটেলে আস্তানা গেড়েছিলাম এবং রেলওয়ে স্টেডিয়ামে কঠোর অনুশীলন করেছিলাম। নিগার হোটেলে এক কামরায় তিন/চারজন করে খেলোয়াড়ের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমাদের রুমে চারজনকে এলট করা হয়েছিল, তারা হলো নবী চৌধুরী, রঞ্জিত, দাস, গৌর সাহা এবং আমি। আমাদের রুমে ¯িপ্রং দেয়া লোহার একটি মাত্র খাট ছিল। একজন খাটে ঘুমাবে আর বাকি তিনজন ঘুমাবে গদি বিছানো মেঝেতে। খাটে কেউ ঘুমাতে চাইতো না। চারজন নিচে ঘুমাতেও পারতো না। চাপাচাপি হতো, একজনকে খাটে ঘুমাতেই হতো। খাটে ঘুমানো খুবই কষ্টকর। খাটের ¯িপ্রং খুব ঢিলা হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে মাঝখানে বেশি লুজ হয়ে যাওয়ায় ঘুমাতে গেলে গর্তের ভেতর শরীরটা ঢুকে যেত, মাথা ও পায়ের দিকটা উঁচু হয়ে থাকতো। এতে কোমরের ব্যথায় সকালে কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতো না। খাটে ঘুমাবে কে? এ জন্য আমাদের মধ্যে হতো মজার এক কুস্তি প্রতিযোগিতাÑ যে হারবে, তাকেই সে রাতে খাটে ঘুমাতে হবে।
একবার নবী ভাইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছিল আমাকে। নবী ভাই লম্বা-চওড়া একজন সুপুরুষের সামনে আমাকে হেংলা-পাতলা ছোট ছেলে লাগছিল। সবাই হৈ চৈ করে উৎসাহ দিচ্ছিল, নবীভাই কার ডাকে যেন পেছনে তাকালেন। অমনি আমি তার পা ধরে টান দিয়েছি, চাদরে স্লিপ করে তিনি গদিতে পড়ে  গেলেন আর সবাই তাকে পরাজিত বলে রায় দিলে নবী ভাই তার আঞ্চলিক (নোয়াখালী) ভাষায় এ রায় মানতে রাজি হচ্ছিলেন না, বকাবকি করছিলেন কিন্তু রায় বহাল রেখেছিল রুমের বাকি দু’জন। সুতরাং নবী ভাই ¯িপ্রং-এর খাটে ঘুমাতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমার খেলোয়াড়ী জীবনে এটি একটি স্মরণীয় আনন্দময়  ঘটনা। এমনি হাসি-খুশী আর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সপ্তাহখানেক কেটে গিয়েছিল। ২০ নভেম্বর রেলওয়ে মাঠে ১১তম ন্যাশনাল ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের উদ্বোধন হয়েছিল। উদ্বোধনী ম্যাচে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম করাচী গ্রীন টিমের বিপক্ষে। কারাচি স্বাগতিক হওয়ায় দুটো দল গঠন করার সুযোগ পেয়েছিল। তাদের অপর টিম ছিল করাচী হোয়াইট। হোয়াইট টিমটি বেশ শক্তিশালী ছিল।
প্রথম খেলাতেই আমরা ধাক্কা খেয়েছিলাম করাচি গ্রীন টিমের সাথে ড্র করে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল টিমের সাথে আমাদের খেলা ছিল হতাশাজনক। নকআউট খেলা, অতিরিক্ত সময় খেলা হয়নি। পরদিন আমরা ৪-০ গোলে জয়লাভ করে পরবর্তী রাউন্ডে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ কিংবা অন্য কোন টিমের সাথে খেলে ফাইনালে উঠেছিলামÑ তা সঠিক করে বলতে পারছি না; তবে ফাইনাল খেলাটি ছিল স্মরণীয় খেলা।
২৭ নভেম্বর। রেলওয়ে স্টেডিয়াম। করাচি হোয়াইট এবং ইস্ট পাকিস্তান টিমের মধ্যে ফুটবল ফাইনাল খেলা। গ্যালারি পরিপূর্ণ দর্শকে। ফাইনাল খেলার জন্য আমাদের টিমে বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনা হয়েছিল। রব্বানীকে বাটুর জায়গায় লেফট আউটে, আবদুল্লাহকে রাইট ইনের পরিবর্তে লেফট-ইনে, মুসাকে (ছোট) রাইট ইনে এবং আমাকে রাইট আউটে খেলানো হয়েছিল। ইয়াকুব সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবেই সেদিন খেলেছিল। করাচির দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকার মন্তব্য ছিলÑ পূর্ব পাকিস্তান দল তাদের দলে কয়েকটি পরিবর্তন এনে আক্রমণে গতি এনে দিয়েছিল। যা করাচির লেফট ফুলব্যাক তোরাব আলী এবং স্টপার ইসমাইলকে ব্যতিব্যস্ত করে দিয়েছিল।  বশীরের দেয়া পাস, লব মুসা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। ইয়াকুবের জন্য আবদুল্লাহ’র পাসগুলোরও সঠিক ব্যবহার হয়নি। খেলার ৭৫ মিনিটে মুসা (ছোট) সজোরে করাচির গোলপোস্টে কিক করলে গোলরক্ষক গোলাম হোসেন সেটা প্রতিহত করার কোন সুযোগ পায়নি। শেষ পর্যন্ত করাচি ১ গোলে পরাজিত। ইস্ট পাকিস্তান বহু কাক্সিত ন্যাশনাল ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের ১১তম ট্রফি শিরোপা জয় করেছিল। খেলা শেষে জনাব এফ এম খান, রেলওয়ে এবং যোগাযোগমন্ত্রী পুরস্কার বিতরণ করেছিলেন।
মুসা (ছোট) বাড়িতে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে রেখে মাঠে ফাইনাল খেলা খেলছিল। খেলা শেষে বাসায় গিয়ে দেখতে পেয়েছিল তার পুত্রসন্তানের মুখ। সে বলেছিল, এই ছেলে আমাদের দলের জন্য সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে।
দু’দলে যারা ফাইনাল খেলায় অংশ নিয়েছিল
ইপিএসএফ টিম : সিদ্দিক, জহীর (অধিনায়ক) ও সাইফুদ্দিন। রসুল, বক্স, গফুর বেলুচ ও সামাদ। বশীর, মুসা (ছোট), ইয়াকুব আবদুল্লাহ ও রব্বানী।
করাচী হোয়াইট : গোলাম হোসেন, খোদা বক্স ও তোরার আলী, রসু-ইসমাইল ও ইসমাইল রসু, মিরদাদ-তাকি-মাহমুদ-ইউসুফ (সিনিয়র)
মর্নিং নিউজ পত্রিকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর খাজা নূরুদ্দিন আমাদের ফুটবল টিমের সম্মানে ২৮-১১-৬০ করাচির সিজান হোটেলে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন।
২৯-১১-৬০ তারিখে আমাদের টিম ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে এসে পৌঁছালে ইপিএসএফ-এর সভাপতি ব্রিগেডিয়ার সাহেব দাদ খান, সদস্যবৃন্দ এবং বিপুলসংখ্যক ফুটবল সমর্থক আমাদের ফুলের মালা দিয়ে বীরের সম্মানে বরণ করেছিলেন। দুটি খোলা জিপে এক ঘন্টা শহর প্রদক্ষিণ করে স্টেডিয়ামে এসে শেষ হয়েছিল। খোলা জিপে শহর প্রদক্ষিণকালে নিজেকে একজন বীর খেলোয়াড় হিসেবে ভাবছিলাম, আর গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছিল। পরদিন ৩০-১১-৬০ বেলা ৩টায় ঢাকা স্টেডিয়ামে দেয়া হয়েছিল নাগরিক সংবর্ধনা। ১৯৬০ সালের ন্যাশনাল ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা অর্জন আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য একটি স্মরণীয় ও আনন্দময় ঘটনা।    


(বত্রিশ)
১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের বাঙ্গালি নেতৃত্বের মাধ্যমে অবসান হয়েছিল বরাবর নেতৃত্ব দিয়ে আসা অবাঙ্গালি নেতৃত্বের। ১৯৬০ সালে ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপে পূর্ব পাকিস্তান হকি টিমের করাচি ‘বি’ টিমের কাছে ৯-০ গোলে শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে দেশে ফিরে এলে দারুণভাবে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনকে। বিশেষ করে সংস্থার সভাপতি ব্রিগেডিয়ার সাহেব দাদ খান ভীষণ ুব্ধ হয়েছিলেন হকির সাথে সম্পৃক্ত সবার ওপর। তিনি বলেছিলেন, ব্লেজার দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে টিমকে করাচি পাঠানো হয়েছিল আর তারা আমার ঝুলিতে ৯ গোলের কলঙ্কময় পরাজয় এনে দিয়েছে। এ ব্যর্থতার অনুসন্ধান এবং দলের সার্বিক পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়েছিলেন হকি সেক্রেটারি তৌফিককে। তৌফিক সাহেব কলকাতা মোহামেডান কাবের সাবেক হকি ক্যাপ্টেন এবং সে সময় ঢাকায় পিআইএ’তে কর্মরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি মাহমুদুর রহমান মোমিনকে পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের ক্যাপ্টেন মনোনীত করে বাঙ্গালি খেলোয়াড়দের এগিয়ে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী হায়দ্রাবাদে ১৯৬১ সালের ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল জানুয়ারি মাসে। হকি মৌসুমের শুরুতেই এই টুর্নামেন্ট তাই আগেভাগেই অনুশীলন শুরু করা হয়েছিল। গতবছরের হতাশাজনক টিমের রেজাল্টকে মাথায় রেখে কর্তৃপক্ষ প্রথমবারের মত এবার একজন কোচের তত্ত্বাবধানে অনুশীলনের ব্যবস্থা করেছিলেন। স্বনামধন্য ফুটবল রেফারি এবং হকির গোলরক্ষক মাসুদুর রহমানকে আমাদের কোচের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। অনাবাসিক ক্যাম্প। হকি মাঠে চারদিকে কয়েক চক্কর দৌড়ানো, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, তারপর প্র্যাকটিস ম্যাচ। মোটামুটি সকাল-বিকাল সহজ পদ্ধতিতে অনুশীলন চলেছিল প্রায় ১৫ দিন; তারপর টিম সিলেকশন। গোলরক্ষক-মর্তুজা ও শামি খান, ফুলব্যাক- মোমতাজ , কলিম, হাফ ব্যাক- মোমিন (ক্যাপ্টেন), নিয়াজ, ইলিয়াস ও হাবিবউল্লাহ। রাইট আউট-খোরশেদ, রাইট ইন-বশীর (ভাইস ক্যাপ্টিন) সেন্টার লেফট ফরোয়ার্ড-মুয়ীদ ও ওসমান, লেফট ইন-আফজাল এবং লেফট আউট আখতার। কোচ-মাসুদুর রহমান, ম্যানেজার-এম আনোয়ার আলী।
আমাদের ম্যানেজার সাহেব গতবছরও করাচি গিয়েছিলেন। এই বয়স্ক ভদ্রলোক কোলকাতা মোহামেডান কাবের সাবেক হকি ক্যাপ্টেন ছিলেন। অমায়িক এবং অত্যন্ত ভদ্র মানুষ। এই লম্বা এবং কষ্ট সফরে কেন তাকে ম্যানেজার করা হতো আমি বুঝতে পারতাম না। আমাদের গোলরক্ষক মর্তুজা নাবিস্কো কোম্পানির ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিল। হায়দ্রাবাদ যাওয়ার পূর্বে নাবিস্কো কোম্পানিতে আমাদের চা-চক্রে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল এবং ফেরার সময় নাবিস্কো সামগ্রীর গিফট প্যাকেটও আমাদেরকে দিয়েছিল। ট্রেন জার্নিতে তাদের দেয়া চকলেটের টিন আমার বেশ কাজে এসেছিল। আমাদের লেফট হাফ ইলিয়াস ছিল বিখ্যাত গায়ক তালাত মাহমুুদের বোনজামাই।
আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে গতবারের তুলনায় অনেক সুযোগ-সুবিধা বাতিল করে ট্রেনে করেই পূর্ব পাকিস্তান হকি দলকে হায়দ্রাবাদ পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ‘ফুলবাড়িয়া টু হায়দ্রাবাদ বাই ট্রেন’ জার্নিটি শুরু হয়েছিল ২২ জানুয়ারি রাত ১১টায়। গতবছরের মতো একই পথে আমাদের বাহাদুরাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেন এগিয়ে গিয়ে ঘাটে থেমেছিল এবং আমরা ফুলবাড়ি ঘাটের ওপারে গিয়ে ট্রেনে উঠে রাত কাটিয়ে বেলা এগারটা দর্শনা (বর্ডারে) রেলস্টেশনে পৌঁছেছিলাম, সেখানেই পুলিশ চেকপোস্টে আমাদেরকে ভারতে যাওয়ার ছাড়পত্র দিলে আমরা ভারতের গেঁদে রেলস্টেশন ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের সিরিয়াল নং ২৯৪, তাং ২৩-১-৬১ তারিখে ভারতের ভূখন্ডে প্রবেশ করেছিলাম। ট্রেন কোলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে যখন থেমেছিল, তখন দুপুর ২/৩টা। স্টেশনেই মালপত্র রেখে পালা করে দুপুরের খাওয়া খেতে হয়েছিল। বিকেলের দিকে ট্যাক্সি করে আমরা হাওড়া স্টেশনে গিয়েছিলাম পরবর্তীতে আমাদের জার্সির উদ্দেশ্যে। হাওড়া থেকে ২৩ জানুয়ারি রাত ৮টায় পাকিস্তানের লাহোর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিলাম। পাঞ্জাব মেইল তার সেই স্টেশনগুলোর ওপর দিয়ে যেগুলো আমরা ১৯৫৮ এবং ১৯৬০ সালে অতিক্রম করেছিলামÑ যেমন বর্ধমান-আসানসোল-গয়া-মোঘলসরাই-বারানসি-লèৌ-আলীগড়-মিরাট-আমবালা-ঝালান্দার অমৃতসর এবং লাহোর। ২৫-১-৬১ তারিখে বেলা ২টায় অমৃতসর পৌঁছালে স্টেশনেই কাস্টম চেকিং এবং ইমিগ্রেশন ছাড়পত্র দিয়ে লাহোরগামী ট্রেনের সাথে আমাদের বগিকে লাগিয়ে দেয়া হয়েছিলÑ যা প্রায় ঘন্টাখানেক পর লাহোরের পথে যাত্রা শুরু করেছিল এবং ঘন্টা দু’তিন পর ট্রেন ছুটে শেষে লাহোর স্টেশনে থেমেছিল। স্টেশনের কাস্টম চেকিং এবং ইমিগ্রেশন অনুমতি নং ২৫-এর মাধ্যমে আমরা পাকিস্তানের প্রবেশ করেছিলাম।
লাহোর স্টেশনে মালপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়েছিলাম। ওয়েটিং রুমে বিশ্রাম নিয়েছিলাম। ১৮-২০ ঘন্টার পথ হায়দ্রাবাদ সে রাতেই রওনা দিয়ে ২৬ তারিখ বিকেলে হায়দ্রাবাদে পৌঁছেছিলাম। বরাবরের মতো স্কুলে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। হায়দ্রাবাদে থাকা-খাওয়ার মান সব সময়ই নিম্ন।
২৯ জানুয়ারি আমাদের প্রথম খেলা স্বাগতিক হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে। পাঁচদিন অনবরত ট্রেন ভ্রমণের কান্তি কিছুতেই দু’দিনের বিশ্রামে কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। কমপক্ষে এক সপ্তাহ বিশ্রামের প্রয়োজন ছিল। হায়দ্রাবাদ টিম পাঞ্জাব, করাচি কিংবা সার্ভিসেস টিমের মত অত শক্তিশালী না হলেও আমাদের তুলনায় ভালই টিম। গত বছরের ৯-০ গোলের শোচনীয় পরাজয় এবং আমাদের টিমের শক্তি সম্বন্ধে সবার জানা ছিল। সবাই ভেবেছিল আমাদের টিম হায়দ্রাবাদের কাছে ৪/৫ গোলে হেরে বিদায় নেবে। মাঠে নামার পর হায়দ্রাবাদ বুঝতে পেরেছিল যে, ইপিএসএফ টিম তত দুর্বল টিম নয়Ñ যতটা তারা ধারণা করেছিল। খেলা যত এগিয়ে যাচ্ছিল, গোল করার জন্য হায়দ্রাবাদ মরিয়া হয়ে উঠেছিল। জেতার জন্য তারা টাফ এন্ড রাফ পন্থা অবলম্বন করে। প্রথমেই তারা মোমিন ভাইয়ের মাথায় ‘টেকনিক্যালি’ স্টিকের আঘাত করলে তার মাথা ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। মাথায় ব্যান্ডেজ করে তিনি মাঠে নেমে পড়েন। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে মোমতাজ পায়ে এবং আমি হাতে বিপক্ষ দলের স্টিকে আহত হই কিন্তু আমরা মাঠ ছেড়ে যাইনি। এমন অবস্থায় তারা ১টি গোল করে এগিয়ে যায়।
হাফ টাইমের কিছু আগে আমরা একটি লং কর্নার পাই। মোমিন ভাই সেই কর্নার মারতে এগিয়ে গেলেন। মোমিন ভাই মাঠের যে কোন স্থানে ফ্রি হিট হলে তিনি মারবেন, কাউকে মারার সুযোগ দিতেন না। তিনি গোল লাইন ঘেঁষে হিটটি করেছিলেন, সোজা গোলরক্ষকের প্যাডে। গোলরক্ষক সে বল কিয়ার করতে গিয়ে ডি-এর ভেতর দাঁড়ানো আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড মূয়ীদের কাছে চলে  গেলে সে সজোরো স্টিক চালিয়ে দিয়েছিল। বল গোলপোস্টের ভেতর বোর্ডে লেগে আওয়াজ হওয়ার সাথে মাঠে উপস্থিত দর্শক চিৎকার দিয়ে উঠেছিল ‘গোল, গোল’ বলে। খেলা ১-১ গোলে ড্র। হাফ টাইমের পর খেলা ড্র হিসেবেই এগিয়ে যাচ্ছিল এবং সময় প্রায় শেষ। মাত্র ৩ মিনিট বাকি ছিল। আমাদের ডিএর ভেতর বল, বল কাড়াকাড়িতে আমাদের সেন্টার হাফ নিয়াজ বলের কাছে গেলে পড়ে যায়। সাথে সাথে পাঞ্জাবের আম্পায়ার আবরার বাঁশি বাজিয়ে দিয়ে সিগন্যাল দেখিয়ে দিয়েছিলেন পেনাল্টি স্ট্রোকের। আম্পায়ারের যুক্ত বলের ওপর পড়ে গোল করতে বাধা দিয়েছিল, হৈ চৈ করেও কোন লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমরা ২-১ গোলে পরাজিত হয়ে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। পশ্চিম পাকিস্তানিরা যারা বলতো বাঙ্গালিরা হকি খেলতে জানে না, তাদেরকে হকি শিখিয়ে দাও। তারা দেখলো বাঙ্গালিরা হকি শিখে ফেলেছে। তাদেরকে হারানো অত সহজ হবে না।
পরদিন করাচি মর্নিং নিউজ পত্রিকা লিখেছিল ‘এষড়ৎরড়ঁং ঊীরঃ ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ ভৎড়স ঘধঃরড়হধষ ঐড়পশবু,’
খেলা শেষে মোমিন ভাই, মোমতাজ এবং আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মোমিন ভাইয়ের মাথায়  শেলাই লেগেছিল আর আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।
হায়দ্রাবাদে আমাদের একদিন অবস্থান করতে হয়েছিল; কারণ আমাদের দলের অনেকের আত্মীয়স্বজন করাচিতে ছিলেন, তাদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল তারা। আমরা ৩১ তারিখে হায়দ্রাবাদ থেকে ট্রেনে লাহোর গিয়েছিলাম। ১ ফেব্রুয়ারি দেশের উদ্দেশে লাহোর থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম এবং অমৃতসরে ইমিগ্রেশন ১১/২৬৫, তাং ১/২/৬১ মাধ্যমে ভারতে প্রবেশ করেছিলাম। সেই পাঞ্জাব মেইল ট্রেন একই পথে হাওড়া স্টেশনে ফিরেছিল ৩/২/৬১ তারিখ সন্ধ্যায়। কোলকাতার ভিসা থাকায় আমরা একদিন কোলকাতায় থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি শিয়ালদহ রেলস্টেশন থেকে ঢাকার পথে রওনা দিয়েছিলাম এবং ভারতের গেঁদে চেকপোস্ট এবং পূর্ব পাকিস্তানের দর্শনা চেকপোস্টের যাবতীয় কাজ সমাধা করে রাতে নদীর ঘাটে ট্রেনটি এসে থেমেছিল। স্টিমারে নদী পার হয়ে ট্রেন উঠে পরদিন অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টশনে পৌঁছানোর মধ্যদিয়ে আমাদের হায়দ্রাবাদ সফর সম্পন্ন  হয়েছি।


(তেত্রিশ)
ফুটবল মৌসুম শুরু হওয়ার আগে থেকে শোনা যাচ্ছিল যে, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব সে বছর ভাল টিম করতে যাচ্ছে। করাচি থেকে মাকরানী খেলোয়াড়দের এনে শক্তিশালী দল গঠন করা হবে। মাকরানী খেলোয়াড়রা কোলকাতায় লীগ খেলে থাকে। তাদের মধ্যে ওমর মুসা আবিদ হাসান কিলার অন্যতম। সদ্য খেলে আসা ঐসব খেলোয়াড়ের সাথে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাব ১৯৬১ সালে ফুটবল খেলার জন্য চুক্তি করেছিল। ওমর, হাসান কিলার, মুসাসহ করাচি থেকে মুসার বড় ভাই গাজী, গোলরক্ষক, আলী মোহাম্মদ, ফুল ব্যাক খোদা বক্স, মোহাম্মদ হোসেন, আদমকে খেলার জন্য ঢাকায় আনা হয়েছিল। স্থানীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে গোলরক্ষক জাফর ইমাম, ফুলব্যাক লিও সেরা এবং জলিল, সেকান্দর আর আমি তো কাবের ঘরের ছেলের মত ছিলামই। ভিক্টোরিয়া কাবের মাধ্যমে ১ম বিভাগ ফুটবলে এবছর অভিষেক হয়েছিল প্রতাপ শংকর হাজরার (আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলোয়াড়, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক এবং  রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত (হকি) ক্রীড়াবিদ।
কাবের সাংগঠনিক পরিবর্তনও তখন এসেছিল। পিডব্লিউডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার, আজহারউদ্দিন কাবের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন; সে সাথে কিছু বিত্তবান ব্যবসায়ী এবং কন্ট্রাক্টর কাবের সদস্য হয়েছিলেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং উৎসাহে কাবের শক্তিশালী ফুটবল দল গঠন করা সম্ভব হয়েছিল।
প্রথমবারের মতো কাব আবাসিক ক্যাম্প করে অনুশীলনের ব্যবস্থা করেছিল। তবে আমরা যারা ঢাকায় থাকতাম, তাদের জন্য বাসা থেকে এসে অনুশীলন করতে হতো। দলকে সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাব কর্মকর্তারা নর্থ বেঙ্গলে কয়েকটি প্রীতি ম্যাচ খেলার আয়োজন করেছিলেন। ভিক্টোরিয়া কাবের ফুটবল সফরটা শুরু হয়েছিল এপ্রিলের প্রথম দিকে। কোন জেলায় প্রথম ম্যাচ খেলে ছিলাম মনে নেই; তবে দু’একটি স্থানে খেলে যখন আমাদের টিম বগুড়ায় পৌঁছেছিল। তখন সংবাদ পেয়েছিলাম যে, আন্তঃজেলা ফুটবল খেলার জন্য প্রতাপ এবং আমাকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় ফিরতে হবে। খেলা শেষে আমাদের পুনরায় টিমের সাথে যোগ দিতে হবে। আমরা দু’জন ঢাকা ফিরে এলাম। আমরা ঢাকায় আন্তঃজেলা ফুটবল ম্যাচ খেলেছিলাম আর ভিক্টোরিয়া টিম বগুড়ায় স্থানীয় টিমের সাথে এক্সিবিশন ফুটবল ম্যাচ খেলেছিল। পরদিন পত্রিকা দেখে চোখ ছানাবড়া! বগুড়ায় খেলার মাঠে মারামারি। জেলা প্রশাসক মাঠে লাঞ্ছিত। ভিক্টোরিয়া ফুটবল দল জেলখানায়। প্রতাপ বগুড়া গেলেও আমি আর যাইনি। পরবর্তীতে ঘটনা সম্বন্ধে যা শুনেছিলাম সত্যিই দুঃখজনক। আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলোয়াড় ওমর মুসা হাসান কিলারসহ মাকরানী খেলোয়াড় নিয়ে গঠিত ভিক্টোরিয়া কাবের খেলা দেখার জন্য মাঠে উপচে পড়া দর্শক সমাগম হয়েছিল। খোলা মাঠে খেলা, মাঠের চতুর্দিকে দর্শক, সীমানা রেখার ওপর মানুষ। এমনি অবস্থায় খেলা শুরু হয়েছিল। লেফট আউট পজিশনে খেলছিল মুসা, স্বচ্ছন্দে খেলতে পারছিল না। বল নিয়ে ছুটতে গেলেই লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে এবং বসে থাকা দর্শকদের দ্বারা বাধা পেত আর অমনি দর্শকদের বকাবকি করতে শুরু করতো। দর্শকরা এতে মজা পেয়ে হৈ চৈ করতো।
এমনি করে এগিয়ে যাচ্ছিল প্রীতি ফুটবল ম্যাচ। মুসা তার পজিশনে একটি বল ধরে দৌড় দিচ্ছিলÑ এমন সময় একজন দর্শক মুসার পায়ে বাধা দিলে সে পড়ে যায়। পরমুহূর্তে উঠে দর্শকটাকে কিল-ঘুষি মারে। অমনি দর্শকরা উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং মুসার ওপর চড়াও হয়। মাকরানী খেলোয়াড়রাও ছুটে আসে। শুরু হয় খেলোয়াড় আর দর্শকদের হাতাহাতি। প্রধান অতিথির আসন থেকে ছুটে আসেন জেলা প্রশাসক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার উদ্দেশ্যে। মুসার সেদিকে খেয়াল নেই। জেলা প্রশাসককেই দু’চারটি কিল-ঘুষি বসিয়ে দিয়ে ব্যাপারটিকে আরও জটিল করে তুলেছিল সেদিন। খেলা পন্ড। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলেও ডিসি সাহেব এ অপমানকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। আয়োজকদের সহযোগিতায় টিম হোটেলে ফিরে যায় এবং রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোর রাতে পুলিশ হোটেলটি ঘিরে ফেলে এবং সকাল বেলা টিম ম্যানেজার নুরুজ্জামানসহ পুরো টিমকে কোমরে দড়ি লাগিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে জেলে নিয়ে যায়। এসবই পরবর্তীতে জাফর ইমামসহ যারা সেদিন এ পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল, তাদের কাছে শোনা। সে সময়ে মুসার একটি মন্তব্যের কথাও শুনেছিলাম, মুসা বলেছিল, ‘এক ডিসি যায়েগা তো শও ডিসি আয়েগা, লেকিন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল ফুটবলার ইয়ে মুসা যায়েগা তো পাকিস্তানমে আর কোই মুসা পায়দা নাহি হোয়েগা।’ এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহু সমালোচনা হয়েছিল। দু’দিন পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পুরো টিম ঢাকায় ফিরে এসেছিল। কাব কর্মকর্তাসহ আমরা ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে গিয়ে ফুলের মালা দিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলাম। ঘটনাটি দেশের ফুটবল ইতিহাসে একটি কলংকময় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
২০ এপ্রিল ’৬১ ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ শুরু। উদ্বোধনী ম্যাচ ভিক্টোরিয়া কাব বনাম ডিসি মিল। ডিসি মিল টিম ভাল টিম। একই লেভেলের খেলোয়াড় দ্বারা গঠিত সমীহ করার মতো টিম।  ভিক্টোরিয়া কাব আগের তুলনায় অনেক শক্তিশালী দল। ভিক্টোরিয়া কাবের সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে আমাকে টিম ক্যাপ্টেন করা হয়েছিল। মনে হলো কাবের এ সিদ্ধান্তে মাকরানী খেলোয়াড়রা খুশী হতে পারেনি। দল মাঠে নিয়ে টস করতে গেলে বুঝতে পারলাম আমাদের টিমকে অন্য দৃষ্টিতে দেখছে সবাই, সমীহ করছে। পাকিস্তানী কৃতী খেলোয়াড়রা খেলছে। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে গর্বিত মনে হয়েছিল তখন। খেলা শুরু হলে স্পষ্ট হয়ে গেল আগের সেই ভিক্টোরিয়া কাবের তুলনায় অনেক বেশি সুসংগঠিত বর্তমান টিম। আগের মতো এলোমেলো খেলার পরিবর্তে এসেছে দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে বোঝাপড়া। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের দলের শক্তিটাও পরখ হয়ে গেল যখন মুসা দ্রুত গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়েছিল। সেদিন মুসা নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল যে, সে অনেক উঁচু মাপের ফুটবল খেলোয়াড়; সে একাই চারটি গোল করে। সেদিন মাঠে খেলতে খেলতে দেখছিলাম ওমরের সিংহের মত ক্ষিপ্রতা এবং গোল করার হাসান কিলারের ঠান্ডা মাথায় মাপা পাসগুলো। জলিল ও সিকেন্দার দুটো গোল করলে শেষ পর্যন্ত আমরা ৬-০ গোলে ডিসি মিলকে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিলাম। আমার ক্যাপ্টেন্সিতে দ্বিতীয় ম্যাচ আমরা ইস্পাহানি টিমের সাথে জয়লাভ করেছিলাম।  মুসার বিরোধিতা আমার ক্যাপ্টেনসি নিয়ে বেড়ে যাচ্ছিল। তাছাড়াও আমি বাঙ্গালি খেলোয়াড়দের পক্ষপাতিত্ব করছি বলে তার অভিযোগ। আর সে করাচির খেলোয়াড়দের বেশি চান্স দিতে চাচ্ছিল। তার বড় ভাই গাজী এবং আদম একজন দুর্বল খেলোয়াড়কে টিমে চান্স দেয়ার জন্য কর্মকর্তাদের চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি সে খেলবে না বলেও হুমকি দিয়ে যাচ্ছিল।
১ মে’তে আমাদের খেলা ফায়ার সার্ভিসের সাথে ছিল। ম্যাচের আগে তার ভাই গাজীকে চান্স দিতে হবে এবং ক্যাপ্টেন্সি তাকে দিতে হবে, নইলে সে খেলবে না বলে বেঁকে বসেছিল। অগত্যা গাজীকে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে ক্যাপ্টেন্সি বদল করেননি কাব কর্তারা। মাঠে খেলা চলছে। রাইট আউট কর্নার কিক্ করলে আমি লাফিয়ে উঠেছিলাম হেড করার উদ্দেশ্যে। মাথার ডানদিকে অনুভব করেছিলাম কে যেন আঘাত করেছে। মাথা ধরে মাটিতে বসে পড়লাম, হাত বেয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। কর্নার কিকের সময় মুসা তার লেফট আউট পজিশন ছেড়ে আমার সাথে দাঁড়িয়ে ছিল এবং হেড করতে উঠলে সে আমার মাথায় তার মাথা দিয়ে সজোরে আঘাত করলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সে খেলায় আমরা ৫-১ গোলে জয়ী হয়েছিলাম। মুসা-২, গাজী, জলিল এবং আমি গোল করেছিলাম। মুসার এরকম বিরোধিতা এবং করাচির খেলোয়াড়দের মুসাকে সমর্থনÑ সব মিলিয়ে কাবের পরিবেশ অনেকটা ঘোলাটে হয়ে পড়ল। এরকম পরিস্থিতিতে বড় দা, নূরুজ্জামান সাহেব, জব্বার সাহেব, কচি ভাই প্রমুখ কাব কর্মকর্তা আমাকে ক্যাপ্টেন্সিটা মুসাকে দিতে অনেকটা অনুরোধের মত করে বলেছিলেন। আমার এতদিনের নিঃস্বার্থ ত্যাগের মূল্যায়ন ভিক্টোরিয়া কাব এভাবে করবে ভাবতে পারিনি। এত বছর বিনা পয়সায় খেলে এসে পয়সা দিয়ে আনা একজন খেলোয়াড়ের কাছে কাব আমাকে হারিয়ে দেবেÑ এটি ছিল আমার জন্য খুবই বেদনাদায়ক। সেদিন থেকে ভিক্টোরিয়া কাব ছেড়ে দেয়ার চিন্তা মনে আসে। যা হোক, কাব কর্মকর্তাদের অনুরোধেই পরবর্তী খেলাগুলো খেলে গিয়েছিলাম।
৮-৫-৬১ তারিখে পিডব্লিউডিকে পরাজিত করি ১২-৫-৬১ তারিখে ওয়ারীকে ৩-২ গোলে হারিয়েছিলাম, যার দুটি গোল আমার এবং একটি মুসার। ১৫ তারিখে বিজি প্রেসকে ৬-০ গোলের মধ্যে আমারও ১টি গোল ছিল। মুসা ও ওমরের গোলে পুলিশ আমাদের কাছে পরাজিত (১৯-৫-৬১) হয়েছিল। সে সময় ডবল লীগ পদ্ধতিতে খেলার আয়োজন করা হতো। দ্বিতীয় লীগের খেলায় ওয়ারী কাবকে আমরা ৪-২ গোলে পরাজিত করেছিলাম। মুসা-২, প্রতাপ এবং হাসান কিলার গোল করেছিল ওয়ারীর পক্ষে প্যাট্রিক ও রেমন্ড একটি করে গোল পরিশোধ করেছিল। লীগ শেষে আমাদের স্থান রানার্সআপ এবং ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।



(চৌত্রিশ)
১৯৫৯-৬০ সালের ফুটবল খেলায় অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা ইউনিভার্সিটি আমাকে ‘ব্লু’ প্রদান করেছিল। তখন আমি জগন্নাথ কলেজের আইকম-এর ছাত্র। হকি, ফুটবল, অ্যাথলেটিক্সÑ তিন বিভাগেই তখন আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিকে রিপ্রেজেন্ট করতাম। সে সময় কলেজগুলো ইউনিভার্সিটির আওতাভুক্ত ছিলÑ যার দরুন আমরা ইউনিভার্সিটির ছাত্র না হলেও ইউনিভার্সিটির পক্ষে খেলার সুযোগ পেতাম। নির্দিষ্ট কোন ডিসিপ্লিনে (খেলায়) যেসব প্রতিভাবান খেলোয়াড় তাদের ক্রীড়ানৈপুণ্য দ্বারা ইউনিভার্সিটির সফলতায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখে, ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ সে খেলার জন্য সেসব খেলোয়াড়কে ‘ব্লু’ প্রদানের মাধ্যমে সম্মানিত করে থাকে। ১০-২-১৯৬১ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে বর্তমানে সুইমিংপুলের কাছে প্যান্ডেল খাটিয়ে ‘ব্লু’ প্রদান অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সাইফুদ্দিন, প্যাট্রিক এবং আমি এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের সার্বিক বিষয় সম্বন্ধে আমার সেরকম মনে পড়ছে না, তবে অনুষ্ঠানের এনাউন্সমেন্ট যে আমাকে সেদিন হতাশ করেছিলÑ সেটা স্পষ্ট মনে আছে।
পুরস্কার বিতরণের প্রথম এনাউন্সমেন্ট ছিল এরকমÑ নটরডেম কলেজের প্যাট্রিক, দ্বিতীয় এনাউন্সমেন্ট জগন্নাথ কলেজের বশীর আহমেদ এবং তৃতীয় বা শেষ এনাউন্সমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এফএইচ হলের কৃতী ফুটবল খেলোয়াড়, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের নির্ভরযোগ্য ফুলব্যাক এবং সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে করাচিতে অনুষ্ঠিত ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেনÑ তিনি হলেন সাইফুদ্দিন আহমেদ। অথচ আমরা তিনজনই জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ টুর্নামেন্টে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ইউনিভার্সিটি এবং কলেজের মধ্যে বৈষম্যটা সেদিন ‘ব্লু’ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে স্পষ্ট করে দিয়েছিল অন্তত আমার কাছে। সে সময় ‘ব্লু’ সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিল না। আমার ধারণাটি ছিল বড় কাপ শিল্ড পাব। ‘ব্লু’ একটি সার্টিফিকেট। স্কুল-কলেজ যেমন অ্যাথলেটিক্সে এবং অন্যান্য খেলার জন্য পাওয়াÑ সেরকমই একটি সার্টিফিকেট। তফাত হলো সেগুলোর সাথে থাকতো কাপ কিংবা শিল্ড আর ‘ব্লু’র সাথে কিছুই ছিল না। তাছাড়াও ব্লু সার্টিফিকেটটি মর্যাদা বা সম্মানের সাথে মানানসই ছিল না। কাগজটা যেমন সাধারণ, তেমনি লেখাটাও ছিল কাঁচা হাতের।  সার্বিক অর্থে সেদিন আমি হতাশই হয়েছিলাম। পরবর্তীতে শুনেছি, ‘ব্লু’র সাথে একটি ব্লেজারও দেয়া হয়। সে সময় যদি একটা ব্লেজার (‘ব্লু’) পেতাম, তাহলে আমার পাওয়া ব্লেজারগুলোর সাথে ওই ব্লেজারটি মাঝে মাঝে দেখে গর্ববোধ করতাম এই ভেবেÑ আমিও ঢাকা ইউনিভার্সিটির ব্লু পাওয়া একজন খেলোয়াড়।
১৯৬১ সালে মুলতানে ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান জাতীয় হকি দলের ক্যাম্পে যোগদানের জন্য প্রথমবারের মত পূর্ব পাকিস্তান থেকে দু’জনকে বাছাই করা হয়েছিল। মাহমুদুর রহমান মোমিন এবং আমাকে। এশিয়ান গেমস ’৬২কে লক্ষ্য রেখে লাহোর ন্যাশনাল হকি স্টেডিয়ামে সমগ্র পাকিস্তান থেকে ৩৬ জন খেলোয়াড় নিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করা হয়েছিল। ক্যাম্প কমান্ড্যান্ট ছিলেন মিঃ আইএস দারা। দারা ছিলেন ভারাত (অখন্ড ভারত) এবং পাকিস্তানের (১৯৪৮) অলিম্পিক খেলোয়াড়। তিনি কিংবদন্তি হকি খেলোয়াড় ধ্যান চাঁদের সহ-খেলোয়াড়, রাইট ইনে খেলতেন। ধ্যান চাঁদের (সেন্টার ফরোয়ার্ড) অন্য ইন ছিলেন তারই ছোট ভাই উধম সিং। ক্যাম্পে পাকিস্তানের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ হকি খেলোয়াড়দের সাথে খেলার সুযোগ পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছি। অবাক হয়ে দেখতাম তাদের ক্রীড়াশৈলী। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে ভরপুর প্রত্যেকটি খেলোয়াড়, নিজ নিজ পজিশনে অসাধারণ। সত্যি বলতে কি, ক্যাম্পে সবচেয়ে দুর্বল খেলোয়াড় মনে হতো নিজেকে। ১৯৫৯ সালে লাহোরে স্কুল কোচিং-এ অংশগ্রহণ করে হকি খেলা যতটুকু শিখেছিলাম, তারই আলোকে পাকিস্তানের কৃতী হকি খেলোয়াড়দের সাথে তাল মিলিয়ে খেলার চেষ্টা করতাম। স্কুল কোচিং ক্যাম্পে মিঃ দারা আমার দ্রুতগতি দেখে আমাকে রাইট-আউট পজিশনে খেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং এই ক্যাম্পে তিনি আমাকে রাইট আউট পজিশনের জন্য অনুশীলন করাতেন।
সকালে ফিজিক্যাল ফিটনেস ট্রেনিং এবং বিকেলে হতো গেমস প্র্যাকটিস আর বেলা এগারোটায় এক ঘন্টার লেকচার কাস। পাঞ্জাবি খেলোয়াড়দের শারীরিক ফিটনেসের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হলেও পিছিয়ে থাকতাম না। এর মূলে ছিল আমার সারা বছরের অনুশীলন। বিকালের গেম খুব ভাল লাগতো। মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করতাম। পাকিস্তানের বিখ্যাত লেফট ইন নাসির, বুন্দা, ছোটখাটো গড়ন, বল ধরেই স্টিকের ফাঁক দিয়ে ওর পায়ের ভেতর দিয়ে বল নিয়ে সুন্দর-নির্ভুল পাস দেয়া ছিল দেখার মত। পুলিশ অফিসার জাকাউদ্দিন, স্টাইলিশ রাইট ইন, পরিস্কার খেলা, বল আদান-প্রদানে পারদর্শী, বিশেষ করে উইং-এর সাথে দারুণ সমঝোতা। মাঠের বাইরে এবং ভেতরে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন খেলোয়াড় মেজর হামিদী। সেন্টার ফরোয়ার্ডের খেলোয়াড়, দলের সবচেয়ে ওজনদান হকিস্টিক হাতে ‘ডি’-এর ভেতর বল পেলেই সজোরে গোলপোস্টে হিট করাই যার প্রধান কাজ। পৃথিবীর অনেক টিমের বুক কাঁপিয়ে দেয়ার মত পাকিস্তানের এই ট্রায়োর খেলা ছিল মুগ্ধ করার মত। রাইট আউট আর্মির শাহ আলম। দ্রুতগতিসম্পন্ন না হলেও সুন্দর সুন্দর সেন্টার ক্রশ করার জন্য দলে তার চাহিদা ছিল। আর লেফট আউট মতিউল্লাহর বল নিয়ে ছুটে যাওয়া, বিপক্ষ দলের রক্ষণভাগে ঢুকে পড়া, গোলপোস্টে হিট করাতেই যেন ছিল আনন্দ। ‘ছবির মত খেলা’Ñ এ কথার বাস্তব রূপকার হলেন পাকিস্তানের সেন্টার হাফ আনোয়ার আহমেদ খান। লম্বা-চওড়া গড়ন, লম্বা লম্বা স্টেপে নিজ ‘ডি’ থেকে অন্য ‘ডি’ পর্যন্ত যার বিচরণ, মাঝ মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলাকে পরিচালিত করা যার মূল দায়িত্বÑ তিনি হলেন বিশ্বের নন্দিত খেলোয়াড় আনোয়ার আহমেদ খান। আমার দেখা সবচেয়ে ফাইনেস্ট খেলোয়াড় তিনি। রাইট হাফ গোলাম রসুল একজন শিক্ষিত এবং ভদ্র খেলোয়াড়। রাইট আউট-রাইট ইনের সাথে এমনভাবে জোটবন্ধ ছিল যে, পাকিস্তান হকি দলের বেশিরভাগ আক্রমণ হতো রাইট সাইড দিয়ে। লেফট হাফ হাবিব আলী কিডডি, নায়কের মত দেখতে হলেও তিনি নিজ রক্ষণভাগের সহযোগী হিসেবে সর্বদা সজাগ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। ফুলব্যাক কর্নেল আতিফ এবং মুনীর দার সর্বদা বিপক্ষ দলের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের কাছে টাফ খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। গোলরক্ষক জাকির আর্মির সিপাহী, গোল রক্ষা করতে জীবন দিতেও যেন প্রস্তুত। এত সাহসী গোলরক্ষক আমার জীবনে আর দেখিনি। তাছাড়াও অনেক মানসম্পন্ন খেলোয়াড় তখন পাকিস্তান ক্যাম্পে এসেছিলেন। এসব কৃতী খেলোয়াড়ের প্র্যাকটিস ম্যাচ দেখে যেমন আনন্দ পেতাম, তেমনি তাদের সাথে খেলে অনেক কিছু শিখতে পেরেছিলাম।
অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী মি. দারা। লেকচার কাসে প্রতিদিনের খেলা নিয়ে আলোচনা করতেন, ভুল-ত্রুটিগুলো তুলে ধরতেন, ত্রুটিমুক্ত করার পরামর্শ দিতেন। খেলার টেকনিক এবং ট্যাক্টিস সম্বন্ধে বিষদ আলোচনা করতেন। এসবই ইংরেজি ভাষায় বলতেন, মাঝেমধ্যে পাঞ্জাবি-উর্দুও বলতেন। ক্যাম্পে খেলোয়াড়দের মধ্যে বেশিরভাগ পাঞ্জাবি খেলোয়াড়। পাকিস্তানের অন্য অংশের খেলোয়াড়রাও কম-বেশি পাঞ্জাবি বলতে বা বুঝতে পারতো। সুতরাং ক্যাম্পে পাঞ্জাবি ভাষার ব্যবহার হতো বেশি। একদিন লেকচার কাস চলছি, দারা সাহেব ইংরেজি ভাষায় লেকচার দিতে দিতে পাঞ্জাবিতে শুরু করে দিয়েছিলেনÑ যা উপস্থিত পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের বুঝতে সুবিধা হচ্ছিল বলে মনে হয়েছিল। কারণ খেলোয়াড়দের মধ্যে সবাই ইংরেজি ভালো বুঝতে পারতো না। হঠাৎ করে মোমিন ভাই দাঁড়িয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘গজ. উধৎধ! দারা সাহেব অবাক হয়ে মোমিন ভাইয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। মোমিন ভাই তখন বলেছিলেন, ‘গৎ. উধৎধ, ও ডরষষ নব ড়নষরমবফ রভ ুড়ঁ ঢ়ষবধংব ংঢ়ববশ রহ ঊহমষরংয ংরহপব বি পধহ’ঃ ঁহফবৎংঃধহফ চঁহলধনর.’ সারা কাস স্তব্ধ, দারা সাহেব অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, ঙক. এবহঃষবসধহ. প্রায় আটচল্লিশ বছর পূর্বের ঘটনা। আজ লিখতে বসে মোমিন ভাইয়ের সেদিনের সাহসের প্রশংসা না করে পারছি না।



(পঁয়ত্রিশ)
ভিক্টোরিয়া দলের উন্নত ধরনের ক্রীড়া কৌশল প্রদর্শন ॥ তরুণ বশীরের প্রশংসনীয় ক্রীড়ানৈপুণ্য
দৈনিক আজাদ পত্রিকা ৭-১০-৬১ তারিখে তাদের খেলার পাতায় আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলায় ভিক্টোরিয়া দলের পারফরমেন্স এবং আমার খেলার প্রশংসা করতে গিয়ে উপরোক্ত শিরোনামের মাধ্যমে লিখেছিল, ‘অপূর্ব টিম ওয়ার্ক, পারস্পরিক সমঝোতা, সুচিন্তিত ও সংঘবদ্ধ হামলা এবং সর্বোপরি জয়লাভের অদম্য স্পৃহার ফলে ভিক্টোরিয়া দল গতকল্য স্টেডিয়ামে ২০ সহস্রাধিক দর্শক সমাবেশে সিংহল জাতীয় ফুটবল দলকে ৫-১ গোলে পরাজিত করিয়া আগাখান গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে উন্নীত হয়।’
‘এই বিরাট জয়লাভের মূলে বিজয়ী দলের কোন খেলোয়াড়ের কতটুকু অবদান রহিয়াছে, তাহা বলা মুস্কিল হইলেও লেফট ইন বশীরকে গতকল্যকার মাঠের সেরা খেলোয়াড় বলা চলে। এই তরুণ উদীয়মান খেলোয়াড়টি সহজ ও সাবলীল গতিতে খেলিয়া শুধুমাত্র স্বীয় দলের জয়লাভের পথ প্রশস্ত করেন নাই, বরং তাহার কায়দাকুশল ও চাতুর্যপূর্ণ খেলার ফলে বিজিত দলের রক্ষণভাগ ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠে। বশীরের বল পাস দেয়া, আয়ত্তে রাখার কৌশল ও প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের নিকট হইতে বল ছিনাইয়া লওয়ার দৃশ্য শুধুমাত্র প্রশংসনীয় ও দর্শনীয়ই নহে, এটাকে এক কথায় অপূর্ব বলা চলে। গতকল্যকার খেলাই সম্ভবত তরুণ বশীরের জীবনের উত্তম খেলা।’
‘ভিক্টোরিয়ার আক্রমণভাগ গতকল্য অপ্রতিরোধ্য ছিল, ওমর মুসা, বশীর, ইউসুফের সংঘবদ্ধ হামলাই ছিল গতকল্যকার খেলার প্রধান ও  অন্যতম দর্শনীয় বস্তু। থাইল্যান্ডের রেফারি রাংশী বম্বাবের কতিপয় ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গতকল্য খেলার স্বাভাবিক গতি ব্যাহত করে।’
সেদিনের গড়ৎহরহম হবংি পত্রিকার কিছু অংশ ‘ইঁঃ ঢ়বৎযধঢ়ং রঃ ধিং রহ ংরফব ষবভঃ ইধংযরৎ, যিড় ধিং ঃযব সধরহ যবধফধপযব ভড়ৎ পবুষড়হ ফবভবহফবৎং, ঞরসব ধহফ ধমধরহ যব নৎড়শব ঃযৎড়ঁময, নঁঃ ভড়ৎ ধ  নৎরষরধহঃ ঢ়রপবং ড়ভ ৎবধৎমঁধৎফ  ধপঃরড়হ নু ড়ংংবহ যব পড়ঁষফ যধাব পড়সঢ়ষবঃবষু ড়ঁঃ ঢ়ষধুবফ ঃযব পবুষড়হ ফবভবহপব’
হাশেম দ্বীন, সিংহল টিমের গোল রক্ষক, অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে খেলে মাঠে উপস্থিত ২০ হাজার দর্শকের প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছিল।  গড়ৎহরহম হবংি  পত্রিকা লিখেছিল, ‘উঊঊঘ ইজওখখওঅঘঞ’- ইঁঃ ঃযব সধহ যিড় বধৎহবফ রিফবংঃ ধঢ়ঢ়ষধঁংব ধিং ঐধংযবস উববহ, ঃযব বিষষ শহড়হি পবুষড়হ মড়ঁষশববঢ়বৎ, ধমধরহংঃ ধষষ ঃযব ড়ফফং যব মধাব ধ মৎধপবভঁষ ফবসড়হংঃৎধঃরড়হ ড়ভ মড়ধষশববঢ়রহম, ংধারহম ধঃ ষবধংঃ ংরী ংঁৎব মড়ধষং. ইঁঃ ভড়ৎ যরস ঃযব ারপঃড়ৎরধহং ড়িঁষফ যধাব ৎবমরংঃবৎবফ ধহ বাবহ নরমমবৎ ারপঃড়ৎু.
টিম লিস্ট
ভিক্টোরিয়া : আলী মোহাম্মদ, খোদাবক্স, মোহাম্মদ হোসেন, নওরোজ হাসান, সুলতান জান, প্রতাপ, ইউসুফ, ওমর, বশীর ও মুসা।
সিংহল : হাশেম দ্বীন, ফার্নেন্ডো, ওসেন ও আমির, আলবার্ট এবং শ্যালী, উইক রিমাসরিয়া, সিরিসেনা মো. নূর, আলুবিহারী এবং হুসাইন।
রেফারি : রাংসী বোমবাড সানকারোক (থাইল্যান্ড)।
১৯৬১ সালের আগাখান ফুটবল টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলার পত্রিকার রিপোর্ট দিয়ে আমার এবারের লেখা আরম্ভ করেছি। সেই খেলায় ওমর, মুসা ইউসুফ-২ এবং এবং প্রতাপের দেয়া ৫-১ গোলে সিংহল জাতীয় দলকে পরাজিত করে ভিক্টোরিয়া দল ইন্দোনেশিয়া টিমের বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল খেলায় উন্নীত হয়েছিল। দুটি দলের সেমিফাইনাল খেলার পূর্বে আগা খান গোল্ডকাপের পুরো চিত্রটি এখানে তুলে ধরছি।
এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্য ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং সিংহল জাতীয় দল এসেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে এবং কেএমসি (করাচি মিউনিস্যিাল কর্পোরেশন)সহ স্থানীয় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ভিক্টোরিয়া, ওয়ারী, আজাদ স্পোর্টিং, ফায়ার সার্ভিস, ইপিআর, পুলিশ ফুটবল দল এই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছিল।
২৪ সেপ্টেম্বর ’৬১ ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে বনাম ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)-এর খেলা দিয়ে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন হয়েছিল। এমএন জাহানের দুই গোল ও ইউনুসের এক গোলের সুবাদে রেল দল ৩-১ (ইসমাইল) গোলে ইপিআরকে পরাজিত করেছিল। এমএন জাহান পাকিস্তান ফুটবল দলের কৃতী লেফট ইনের খেলোয়াড়। ১৯৫৮ সালে পাঞ্জাব ‘বি’ টিমের হয়ে মুলতান স্টেডিয়ামে লম্বা লম্বা স্টেপে দৌড়ানো পরিষ্কার খেলা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। তার আসল নাম মোহাম্মদ নূর জাহান, মেয়েলি এই নামটি অনেকের কাছে অজানা। ২৭-৯-৬১ তারিখে রেলওয়ে দল দ্বিতীয় খেলায় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স টিমকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে তাদের জয়ের ধারাকে অব্যাহত রেখেছিল। তাদের পক্ষে গোল করেছিল তালেব আশিফ ও আজিজ।
২৯-৯-৬১ এবং ১-১০-৬১ দু’দিন খেলেছিল করাচির কেএমসি এবং ঢাকার ফায়ার সার্ভিস। প্রথমদিন ফায়ার সার্ভিস টিম কেএমসিকে ৩-০ গোলে পরাজিত করলে কেএমসি প্রটেস্ট করে এবং পরে কেএমসি ১-০ গোলে ফায়ার সার্ভিসকে হারিয়ে পরবর্তী খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। আমাদের ভিক্টোরিয়া দল প্রথম খেলায় (২-১০-৬১) ওমর ও মুসার দেয়া ২-০ গোলে পুলিশ দলকে পরাজিত করে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে গিয়েছিল। সিংহল জাতীয় দল তাদের প্রথম খেলায় (৩-১০-৬১) ওয়ারীকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে তারাও আমাদেরকে মোকাবিলার জন্য কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল। টুর্নামেন্টে আরও একটি অঘটন ঘটেছিল ঢাকা মোহামেডান এবং থাইল্যান্ড একাদশ দলের খেলাকে কেন্দ্র করে। ৭-১০-৬১ এবং ৯-১০-৬১ দু’দিন তাদেরকে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে হয়েছিল। প্রথম দিন ২-২ গোলে ড্র হলে দ্বিতীয় দিনের খেলায় থাইল্যান্ডের নীলকিরণের দেয়া ২ গোলের বিপরীতে মোহামেডানের আব্বাস ও গফুর গোল করলে খেলা ড্র হয় কিন্তু থাইল্যান্ড গোলের বিপক্ষে প্রতিবাদ করে খেলতে অস্বীকৃতি জানায় এবং পরবর্তীতে মোহামেডান টিম টুর্নামেন্ট বর্জন করলে (বর্জন করার সঠিক কারণ আমার মনে পড়ছে না) থাইল্যান্ড দলকে সেমিফাইনালে খেলার পক্ষে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল।
১০-১০-৬১ সেমিফাইনাল খেলা। ইন্দোনেশিয়া একাদশ বনাম ভিক্টোরিয়া। ঢাকার একমাত্র টিম, প্রচুর দর্শক মাঠে। উত্তেজনাপূর্ণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলায় ইন্দোনেশিয়া আমাদের ২-০ গোলে পরাজিত করে ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। তাদের পক্ষে দীর হামজা এবং ফ্রান্সিস গোল করেছিল। ১১-১০-৬১ পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে ৩-১ গোলে থাইল্যান্ডকে পরাজিত করে ফাইনালে ওঠে। এমএন জাহান ২টি এবং তালেব ১টি গোল করেছিল রেল দলের পক্ষে আর থাইল্যান্ডের পক্ষে অনুরাজ গোল করেছিল।
ফাইনাল খেলার পূর্বে ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে ইন্দোনেশিয়া একাদশ ঢাকা মোহামেডানের সাথে একটি এক্সিবিশন খেলায় অংশগ্রহণ করেছিল। সে খেলায় ইন্দোনেশিয়া ২-১ গোলে মোহামেডানকে পরাজিত করেছিল। ১৩ তারিখে মোহামেডান অপর একটি এক্সিবিশন ম্যাচে পোর্ট ট্রাস্ট টিমকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছিল।
১৫ অক্টোবর ফাইনাল খেলা ইন্দোনেশিয়া একাদশ বনাম পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ের মধ্যে। ফুটবল পাগল ঢাকার দর্শক, পরিপূর্ণ গ্যালারি। ইন্দোনেশিয়া দলের ছোট ছোট পাস, দলীয় সমঝোতা, সুন্দর পরিকল্পনা বিপক্ষ দলের রক্ষণভাগে একসাথে হামলায় রেল দল শুরু থেকেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে এবং নিজেদেরকে সংগঠিত করার আগেই গোল হজম করতে হয়েছিল। খেলায় তারা কোনরকম প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গড়ে তুলতে পারেনি। সবাইকে হতাশ করে রেল দল সেদিন ফাইনালে ০-৫ গোলে হেরে ফাইনাল খেলার আকর্ষণকে ম্লান করে দিয়েছিল। ইন্দোনেশিয়া দলের আগাসি ২, দীর হামজা-২ এবং এনড্রিজেক-১ গোল করে আগা খান গোল্ডকাপ শিরোপা জয়ে অবদান রেখেছিল।
প্লেয়ার লিস্ট
ইন্দোনেশিয়া : হাড্রি, পয়ের নমি, ইসাক উদ্দিন, শুনারটো, জনসিমন, রাশজিদ, ইপং, আগাসী, দীর হামজা, এন্ডিজিক হিপ্পি, এডোসিমন।
পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে : জাহাঙ্গীর আলম, আবদুল হক, রামজান, রশিদ, সাবের, তালেব আলী, আজিজ, ইউসুফ, এমএন জাহান ও আসির।
রেফারি : সাহেব আলী।


(ছত্রিশ)
 “ঙহব ড়ভ ঃযব নবংঃ ঃবধস রহ অংরধ”-১৯৬২ সালের ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের ফুটবল টিম সম্বন্ধে অনেকের মুখে এরকম শোনা যেত। সে সময়ের দেশের সেরা টিম। তুখোড়, দারুণ দুর্ধর্ষ টিম। যেমন শক্তিশালী, তেমনি অপ্রতিরোধ্য। টিমের ছিল দারুণ গতি, ক্ষীপ্রতা, আন্ডারস্ট্যান্ডিং এবং ব্যক্তিগত ব্রিলিয়েন্সি। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে নিপুণ ক্রীড়াশৈলীতে পরিপূর্ণ একটি দল। যে দলের খেলা দেখে ফুটবলপ্রিয় দর্শকরা দারুণ উপভোগ করতেন, মনের তৃপ্তি নিয়ে স্টেডিয়াম ত্যাগ করতেন। ভিক্টোরিয়া টিমের ম্যাচের পর চোখ ধাঁধানো সাফল্য ঢাকার ফুটবল ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমিও সেই টিমের একজন সদস্য ছিলাম। খেলোয়াড় বলতে সংকোচ হচ্ছে; কারণ খেলোয়াড় হিসেবে খুব কম ম্যাচে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম।
ভিক্টোরিয়া অন্যতম সেরা টিম হওয়ার পেছনে কিছু ঘটনা এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। ১৯৬১ সালে আমার ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে মুসা কাবে অনেক সমস্য করেছিল। কাব কর্মকর্তাদের চাপের মুখে ক্যাপ্টেন্সি বদল করিয়ে নিজে ক্যাপ্টেন হয়েছিল। সেদিনই কাবের প্রতি ১৯৫৬ সাল থেকে আমার নিঃস্বার্থ ভালবাসা, দায়িত্ববোধ, আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলাম। ফুটবল সিজন শেষে ভিক্টোরিয়া কাব ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত আলী রেজা ভাইকে (ফুটবল সেক্রেটারি) জানিয়ে দিয়েছিলাম। ১৯৬১ সালে ঢাকা মোহামেডান লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, সে টিমে আবিদ (মুসার বড় ভাই) সহ মাকরানী খেলোয়াড়দের সাথে খেলার ইচ্ছা প্রকাশ করে মুসা ভিক্টোরিয়া কাবকে জানিয়ে দিয়েছিল যে, সে আগামী বছর এ কাবে ফুটবল খেলবে না।
১৯৬১ সালের ফুটবল শেষ। নতুন বছর ১৯৬২। হকি খেলার মাধ্যমে খেলোয়াড়ী মৌসুম শুরু হতে চলেছিল। বেশ কয়েকটা কাবের হাতছানি, আমাকে তাদের হয়ে হকি খেলার। সালাম ভাই, নূরু ভাই এসে হাজির, ‘আরে মিয়া, তোমার ঝগড়া ফুটবলের সাথে। আমরা কি করছি?’ নূরু ভাইয়ের (নূরুল ইসলাম ভিক্টোরিয়া কাবের হকির গোলকিপার) কথা, আব্দুস সালাম (সালাম ভাই) বললেন, ‘এ বছরটা আমাদের সাথে খেইলা লও, পরে যা হয় কইরো।’ সেই ১৯৫৬ সাল থেকে একসাথে খেলে আসছি, কি করে তাদের আবদারকে ফিরিয়ে দেই। আলমগীর ভাই, মোমিন ভাইসহ কয়েকজন যখন ১৯৫৯ সালে কাব ছেড়ে ওয়ান্ডারার্স কাবে চলে যান, তখন আমরা এই তিনজনই কাবটিকে ধরে রেখেছিলাম। ফুটবল সিজন এলে তখন কাব ছাড়ার ব্যাপারটা ভাবা যাবেÑ এ চিন্তা করে হকিতে মজে গেলাম।
হকি লীগের কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা মনে পড়ছে নাÑ যা এ মুহূর্তে এখানে তুলে ধরা যায়। সেবছর আর্মি টিম লীগে অংশ নিয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, ৫ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট হবে। নাঈম আর্মি টিমের ক্যাপ্টেন, র‌্যাংকও তার ক্যাপ্টেন। পাঞ্জাবি, দেখতে সুপুরুষ। গলায় সব কমান্ডিং। কথা কম বলে, বেশ মেজাজি। মাঝমাঠের খেলোয়াড়। আর্মি টিমের খেলায় একটা বিষয় লক্ষ্য করতাম যে, খেলোয়াড়রা বেশিরভাগ সময় তাদের ক্যাপ্টেনকে বল দিতে ব্যস্ত, যে যেখানেই বল ধরুক ক্যাপ্টেন সাহেবকে খুঁজবে বল পাস দেয়ার জন্য, নইলে ক্যাপ্টেন সাহেব ঐ খেলোয়াড়ের নাম ধরে জোরে ডাকতেন। ঐ খেলোয়াড় মাঠে ইয়েস স্যার বলে এটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে যেতো। ক্যাপ্টেন ইংরেজিতে দু’একটা গাল দিয়ে খেলায় ফিরে যেতেন। ব্যাপারটা দ্রুত ঘটতো বলে খেলায় সেরকম ব্যাঘাত ঘটতো না। একজন খেলোয়াড় বল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সাথে সাথে ক্যাপ্টেন যাচ্ছে বল পাস নেয়ার জন্য, কিন্তু বল পাস দিচ্ছে না, অমনি হাঁক ছাড়লেন খেলোয়াড়টির নাম ধরে। বেচারা খেলোয়াড় বল ছেড়ে ইয়েস স্যার বলে এটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। বল অন্য কোন খেলোয়াড় নিয়ে গেছে। এরকম দৃশ্য মাঠে উপস্থিত দর্শকদের হাসি-ব্যঙ্গ করার সুযোগ করে দিত। খেলার মাঠে দৃষ্টিকটু দেখাতো, খেলার স্পিরিটটা নষ্ট হতো।
সেই ক্যাপ্টেন নাঈম ১৯৬২ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপে ইস্ট পাকিস্তান টিমের ক্যাপ্টেন মনোনীত হয়েছিলেন। তার বাড়ি লাহোরে, তিনি আগেই চলে গিয়েছিলেন। ১৯৬০ এবং ১৯৬১ সালে করাচি এবং হায়দ্রাবাদে টিম ট্রেনযোগে ভারতের ওপর দিয়ে গিয়েছিল। এবার এমনও দেখা গেছে আমাদের জন্য প্লেনে যাওয়ার বরাদ্দ করা হয়েছিল। কোন মাস এবং কত তারিখে আমরা গিয়েছিলাম মনে নেই, তবে হাড় কাঁপানো শীতে আমরা লাহোরে গিয়েছিলামÑ তা স্পষ্ট মনে আছে। যথারীতি পূর্বের মত এবারও আমাদেরকে স্কুল হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করেছিল আয়োজকরা। কিন্তু শীতের জন্য সেরকম সুব্যবস্থা ছিল না। শীতটা বেশ জেঁকে বসেছিল আমাদের ওপর। আমরা যে ক’দিন ছিলাম, সকালের নাস্তাটা কম্বলের ভেতরেই সারতাম। কোনদিন বাইরে গিয়ে নাস্তা করিনি। রাতে হোটেল থেকে ডিনার সেরে আসার সময় পাউরুটি আর মাখন এনে চারপাইয়ের পাশেই ছোট টেবিলে রাখতাম। কম্বলের ভেতর থেকে হাতটা কোনরকম বের করে টেবিলে রাখা পাউরুটি আর মাখন ছোঁ মেরে নিয়ে আবার হাতটা কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে দিতাম। পাউরুটির স্লাইসের মাঝে মাখনের টিক্কাটা রেখে হাত দিয়ে চেপে ধরতাম, অনেকটা ছুরি দিয়ে পাউরুটিতে মাখন লাগানোর মতো। বালিশ থেকে মাথাটা উঁচু করে জানালা দিয়ে নিচে রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানিকে চিৎকার করে বলতাম, ‘গরম চায়ে ভেজ দো’। দোকানের ছোট একটা বয় এসে চা দিয়ে যেত। দোকানে আরও একটা সুস্বাদু খাদ্য পাওয়া যেত, সেটা হলো বয়েল্ড ডিম। গরম চায়ের গ্লাসের গায়ে পাউরুটির স্লাইস চেপে ধরতাম আর অমনি রুটির ভেতর মাখন গলে যেত।  কম্বলের ভেতরে থেকে ডিম-রুটি-মাখন আর গরম গরম চা, মজাদার নাস্তা। কি মজাই না লাগতো খেতে! 
হকি মাঠে আমরা ২ দিন অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। ক্যাপ্টেন নাঈম বাসা থেকে এসে যোগ দিতেন। ম্যাচের আগেরদিন ক্যাপ্টেন সাহেব নির্দেশ দিলেন, সবাই ড্রেস পরে মাঠে আসতে হবে, মাঠে সিলেকশন জানিয়ে দেয়া হবে। ম্যাচের আগে ড্রেস পরে আমরা সবাই মাঠে হাজির হয়েছিলাম। আমরা অনেকটা লাইনে করে দাঁড়িয়েছিলাম, ক্যাপ্টেন সাহেব তার ধবধবে সাদা প্যান্টের পকেট থেকে ছোট একটা কাগজ বের করে তু, তুম, তুম... আজ খেলেগা। যারা চান্স পেয়েছিল, তারা মাঠে ঢুকে ওয়ার্ম করতে লাগলো; বাকি খেলোয়াড়রা সাইড লাইনে নির্ধারিত জায়গায় বসে পড়েছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে আলমগীর ভাই সে ম্যাচে সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলেছিলেন। আমি লেফট-ইন পজিশনে খেলেছিলাম। মর্তুজা আমাদের গোলকিপার, ডি-এর ভেতর শূন্যে ওঠা একটি বলকে থাবা দিয়ে কিয়ার করায় রেফারি পেনাল্টি স্ট্রোকের নির্দেশ দেন। আমরা ০-১ গোলেই পরাজিত হয়েছিলাম এবং টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিলাম।
লাহোর থেকে ফিরে আসন্ন ফুটবল নিয়ে চিন্তা করছিলাম। দু’তিনটা কাব থেকে প্রস্তাবও পেয়েছিলাম। সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিচ্ছিলাম। স্কুল মাঠে তখন ফুটবল খেলা চালু হয়ে গিয়েছিল। আমিও স্কুল মাঠের খেলায় মেতে উঠেছিলাম। এক সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়া কাবে ডাক পড়েছিল, গিয়ে দেখলাম বড়দা, নূরুজ্জামান সাহেব, জব্বর সাহেব, কচি ভাই, আজহার সাহেব সবাই বসা। সবারই একই প্রশ্ন ছিল, তুমি নাকি কাব ছেড়ে দিচ্ছ?
সবার কাছে যেন এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মাথা নিচু করে উত্তর দিয়েছিলাম, হ্যাঁ, তুমি আমাদের ঘরের ছেলে, তুমি কেন অন্য কাবে যাবে, এটা কি করে হয়। তোমাকে আমরা সব রকম সাহায্য-সহযোগিতা দেব, তুমি কাব ছাড়বে না ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের অনুরোধগুলো সে সময় উপেক্ষা করে আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকতেও পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিলাম। শর্ত একটা দিয়েছিলাম, আমার মাহুৎটুলীর বাসায় একটা ঘর তৈরি করে দিতে হবে। সাথে সাথে তারা আমাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। তখন ঘর করতে আর কত টাকা লাগে? পাঁচ টাকা বস্তা সিমেন্ট, ১/২শ’ টাকা হাজার ইট, দেড়-দুই হাজার টাকা টন রড। তার ওপর চিন্তা করেছিলাম, আমার বিবাদের মূল হলো মুসা, সে কাব ছেড়ে মোহামেডানে চলে গেছে, এবার নিশ্চিন্তে খেলা যাবে।
ঢাকা ফুটবল লীগ আসন্ন। কাবগুলো অনুশীলন শুরু করে দিয়েছিল। মোহামেডান কাবের অনুশীলনে মুসার সাথে আব্বাসের তুমুল ঝগড়া, কি কারণে ঝগড়া বলতে পারবো না; তবে ঝগড়াকে কেন্দ্র করে ছুরি নিয়ে ছোটাছুটি পর্যন্ত হয়েছিল (এটা জহির ভাইয়ের কাছে শোনা)। শেষ পর্যন্ত আব্বাস গ্রুপ একসাথে মোহামেডান ত্যাগ করে ভিক্টোরিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিল।
ওমর, হাসান, ইউসুফ জুনিয়র, খোদা বক্স, আলী মোহাম্মদ-এর সাথে মোহামেডান থেকে আসা আব্বাস, আবদুল্লাহ, কালা গফুর, সিনিয়র ইউসুফ এবং ওয়ান্ডারার্স থেকে মুরাদ বক্স, তাছাড়া কামিসার অন্তর্ভুক্তিতে ভিক্টোরিয়া ব্যালান্সড টিম হিসেবে গড়ে উঠেছিল। প্রতাপ শংকর এবং আমিও সে টিমের সদস্য    ছিলাম।



(সাঁইত্রিশ পাওয়া যায়নি) সেপ্টেম্বর-১৬


(আটত্রিশ)
১৯৬২ সালে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় ৪র্থ এশিয়ান গেমস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার দু’বছর পর ১৯৪৯ সালে (রিপাবলিক) গণপ্রজাতন্ত্রী ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা লাভ করেছিল। ১৯,৯৯,৪৪৩ বর্গমিটার বা ৭,৪০,৯০৫ বর্গমাইল এলাকা এবং জনসংখ্যা (বর্তমান ১৯,৭৫,৯০,০০০) ১৯৬২ সালে প্রায় দশ কোটি ছিল, যার ৮৮% মুসলমান, ১০% খ্রিস্টান এবং ২% বৌদ্ধ ও হিন্দু। ইন্দোনেশিয়ার সরকারি ভাষা বাহাসা ইন্দোনেশিয়া।
পাকিস্তান অলিম্পিক এসোসিয়েশন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছয়জন তরুণ ও উদীয়মান ক্রীড়াবিদকে অবজারভার হিসেবে এশিয়ান গেমস ’৬২ দেখার জন্য সুযোগ দিয়েছিল। এই ছয়জন অবজারভারের মধ্যে আমার নামও ছিল। ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকেও অবজারভার হিসেবে আমার নাম ছিল কিন্তু যেতে না পারার তিক্ত অভিজ্ঞতাটা, সেদিনের কষ্টটা আজও আমাকে পোড়ায়। খিদিজদার (সে সময়ের ইউনিভার্সিটির গেমস ইনস্ট্রাক্টর) নিজ ভাষার কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে। ‘তোর নামটা কাইটা দিছে, আলমগীরের নাম দিছে, ওর বাপ তো ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ার’। যে দু’জন রোম অলিম্পিকে অবজারভার হিসেবে গিয়েছিল, তার মধ্যে এনামুল হক, আমরা পাশাপাশি পাড়ায় থাকতাম; ও কসাইটুলীতে আর আমি মাহুৎটুলীতে। আরমানিটোলা সরকারি হাইস্কুলের ছাত্র আমরা। আমার এক কাস উপরে পড়তো, ভাল ছাত্র ছিল। ১৯৫৬, ’৫৭ এবং ’৫৮ সালে আমি স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ছিলাম এবং ১৯৫৭ ও ৫৮ আন্তঃস্কুল চ্যাম্পিয়ন ছিলাম, ১৯৬০ সালে জগন্নাথ কলেজ চ্যাম্পিয়ন, এমনকি ১৫, ১৬, ১৭ জানুয়ারি ১৯৬০ প্রভিন্সিয়াল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা যা ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিনিধিত্ব করে পুরস্কার পেয়েছিলাম। এনামুল কিংবা আলমগীরকে তো সেদিন কোথাও দেখিনি, না মাঠে না পত্রিকায়।
তাছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল এবং হকি টিমের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলাম। তারপরও আমার নামটা কেটে দিয়েছিল। ‘স্বজনপ্রীতি’-আমাকে রোমে যেতে দেয়নি।
অ্যাথলেটিক্স, ফুটবল, হকি, বক্সিং, ভলিবল খেলাগুলোর সাথে সম্পৃক্ত মনোনীত এ ছয়জন পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়াঙ্গনে পরিচিত মুখ ছিল। এসএ জামান মুক্তা একজন চৌকস ক্রীড়াবিদ। দেশসেরা পোলভল্টার, পূর্ব পাকিস্তান ফুটবল দলের একজন স্টাইলিশ ফুটবল খেলোয়াড়। খন্দকার আবুল হাসান, অলরাউন্ডার ক্রীড়াবিদÑ যেমন বড় মাপের অ্যাথলেট, তেমনি ভলিবল খেলোয়াড়, আবার ভাল ফুটবলার। সিরাজ এবং জাহিদ, প্রথমজন ¯িপ্রন্টার এবং অপরজন লং ডিসটেন্স রানার। বক্সার হিসেবে করিম অবজারভারের সুযোগ পেলেও ক্রীড়াঙ্গনে তার সেরকম পরিচিতি ছিল না, বাবার জোড়ে সুযোগ পেয়েছিল বলে সে সময় অনেকের ধারণা ছিল।  সে সময় আমি ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের ফুটবল, হকি, ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলাম। পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল এবং হকি দলে চান্স পাওয়ার লক্ষ্যে ক্যাম্প এবং ট্রায়াল দিয়ে যাচ্ছিলাম। এশিয়ান গেমস ’৬২ উপলক্ষে লাহোরে এক মাস প্রাথমিক হকি ক্যাম্পেও অংশ নিয়েছিলাম।
প্রথম বিদেশ সফর। উত্তেজনায় দিনগুলো কাটছিল। ঢাকা থেকে আমার প্রথম আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট করেছিলাম। এর আগেও পাসপোর্ট করতে হয়েছিল, তবে সেটা ছিল শুধু ভারত-পাকিস্তান ভ্রমণের জন্য। ভারতের ওপর দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে খেলতে যাওয়ার জন্য ঐ পাসপোর্ট এবং ভিসা প্রয়োজন ৬ আগস্ট ১৯৬২ তারিখে ছয় মাস মেয়াদের জন্য ইস্যুকৃত ১৭৩৪২০ নম্বরের আমার হয়েছিল পাসপোর্টটি মাত্র ছয়টি দেশ যেমন বার্মা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ইন্ডিয়া ভ্রমণের জন্য বৈধ ছিল। ইন্দোনেশিয়ান এম্বেসি (করাচি) ছয় মাসের ভিসা (১৪/৮/৬২Ñ১৪/২/৬৩) নং ০১৩৯/সি’৬২ ইস্যু করেছিল, যার খরচ হয়েছিল ভিসা ফি ১০ রুপি+চ্যান্সেলারি ফি ১০ রুপি, মোট ২০ রুপি।
কচি ভাই ভিক্টোরিয়া কাবের কর্মকর্তা (বর্তমান ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মুন্নার পিতা) জাকার্তা যাওয়ার আগে জিন্নাহ এভিনিউ’র (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ) কাপড়ের দোকান থেকে নেভি ব্লু রঙের কর্ডের কাপড় কিনে ‘এডিপল’ টেইলারে প্যান্ট এবং সবুজ রঙের ব্লেজার বানিয়ে দিয়েছিলেন। ব্লেজারের পকেটে ছুটন্ত হরিণ সংবলিত (বর্তমানে ক্রীড়ালেখক সমিতির মনোগ্রামে যেমন ছুটন্ত হরিণ) মনোগ্রাম ছিল। ব্লু কর্ডের প্যান্টটি আমার খুব সখের ছিল, যা এশিয়ান গেমসের দিনগুলোতে পরে আনন্দ পেতাম।
পাকিস্তান হকি টিম অলিম্পিক কিংবা এশিয়ান গেমসে খেলতে যাওয়ার পথে দলের দুর্বলতাগুলোকে শুধরে নিতে, দলীয় সমঝোতা বৃদ্ধি করে দলকে আরো সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে গিয়ে এক্সিবিশন ম্যাচ খেলতো। এ উদ্দেশ্যে এশিয়ান গেমস ’৬২ শুরু হওয়ার আগেই পাকিস্তান হকি টিম দেশ ছেড়ে গিয়েছিল বলে পাক কন্টিনজেন্টের সাথে জাকার্তা সফর করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তারা বরাবরের মত আলাদাভাবে ভেন্যুতে পৌঁছেছিল।
জাকার্তার উদ্দেশে পাকিস্তান কন্টিনজেন্ট পিআইএযোগে ১৬ আগস্ট ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেছিল। আমরা ছয়জন অবজারজার ছাড়াও পাক হকি টিমের সহকারী ম্যানেজার তৌফিক আহমেদ, (ইপিএসএফ-এর হকি সেক্রেটারি ও পিআইএ’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) অ্যাথলেটিক্স টিমের সহকারী ম্যানেজার এসএস হুদা, ভলিবল টিমের ম্যানেজার মেসবাহউদ্দিন এবং আমার যতদূর মনে পড়ে শুটিং দলের ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা থেকে আমাদের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। ঘন্টা দুই ঢাকা বিমানবন্দরে অবস্থানের পর সেদিনই ব্যাংককের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের সুপার কনস্লেশন বিমানটি। প্রায় চার ঘন্টা ওড়ার পর থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক এয়ারপোর্টে আমাদের প্লেন এসে পৌঁছেছিল একই তারিখে অর্থাৎ ১৬ আগস্ট। পিআইএ’র ফাইট জাকার্তা পর্যন্ত না থাকায় আমাদেরকে ব্যাংকক এয়ারপোর্টে বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্লেন বদল করার জন্য। আমার মনে আছে, এয়ারপোর্টের ভেতর গিফটশপ ঘুরে দেখছিলাম, একটি শপে থাইল্যান্ডের কোটপিন আমাকে খুব আকৃষ্ট করেছিল। আমি একটি ইউএস ডলার বের করে দোকানিকে দিলে দোকানি আমাকে কোটপিনসহ অনেকগুলো থাইল্যান্ডের মুদ্রা ফেরত দিয়েছিল। ডলার এবং থাইল্যান্ডের বার্থ-এর বিনিময় রেস্ট কত আমি জানতাম না। আমার অভিজ্ঞতাও ছিল না; কারণ  সেটাই ছিল আমার প্রথম বিদেশ সফর।  রাত ক’টার সময় প্লেন ছেড়েছিল মনে নেই; তবে প্লেনে ওঠার একটু পরই আমাদের রাতের খাওয়া পরিবেশন করেছিল বিমানবালারা। প্রায় ৪/৫ ঘন্টা সমুদ্রের নীল জলের ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে সকালবেলা (১৭-৮৬২) জাকার্তা এয়ারপোর্টে আমাদের প্লেন অবতরণ করেছিল। গেমস কমিটির লোকজন এয়ারপোর্টে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমাদেরকে গাড়ি করে ভিলেজের পথে রওনা দিয়েছিলেন। মাত্র এক যুগ আগে স্বাধীন হওয়া বহু দ্বীপের এই দেশটিতে তখনও সেরকম উন্নতির ছোঁয়া লাগেনি। এয়ারপোর্ট থেকে ভিলেজ দীর্ঘপথেও আধুনিক শহরের চাকচিক্য চোখে পড়েনি। মাত্র গুটিকয়েক উঁচু সরকারি ভবন আর হোটেল ছাড়া সবই সাধারণ মানের বাড়িঘর। আমার ভিলেজের ধারণাটা (গ্রাম ভেবেছিলাম) ভুল ভাঙ্গিয়ে স্টেডিয়ামের বিশাল এলাকায় যেখানে পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন নির্মিত লাইনে লাইনে একতলা এবং দোতলা বাড়ি সুশৃংখলভাবে দাঁড়িয়েছিল, তারই একটি অংশে যেখানে পাকিস্তান কন্টিনজেন্টের জন্য নির্ধারিত ছিল, সেখানে আমাদের গাড়িগুলো এসে থেমেছিল। আমাদের অবজারভার ছয়জনের জন্য একটি একতলা বাসা বরাদ্দ ছিল, যার তিনটি বেডরুমে দু’জন করে থাকার ব্যবস্থা। একটি বসার ঘর, একটি গোসলখানা, একটি রান্নাঘর, ছোট্ট একটি স্টোররুম। প্রত্যেকটি বেডরুমে একটি আলমারি এবং একটি ছোট ড্রেসিং টেবিলও সেখানে ছিল। মোট কথা, একটি ছোট পরিবারের জন্য সুন্দর একটি স্বতন্ত্র বাসা। খন্দকার আবুল হাসান ও আমি একটি রুমের বাসিন্দা হয়ে প্রায় বিশ দিন (১৭-৮-৬২Ñ৫-৯-৬২) একসাথে কাটিয়েছিলাম। প্রত্যেকটি বাসার জন্য একজন করে এটেনডেন্ট (একটি ছেলে) ছিল যে আমাদের ছোটখাট ফরমায়েশ শুনতো, যেমন চা করে খাওয়ানো, ঘর গোছানো, পরিষ্কার করা ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রত্যেকটি দেশের জন্য একটি করে স্টোর, সেখান থেকে সরবরাহ করা হতো ঘরের যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। তাছাড়া ফল, জুস যখন যা প্রয়োজন, লিখে পাঠালেই পৌঁছে যেত।
বিরাট বিরাট দুটি ডাইনিং হলে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একটিতে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যটি ছিল বাকি দেশগুলোর জন্য। ডাইনিং হলের একধার থেকে অন্যধার পর্যন্ত লম্বা টেবিলে দেশ অনুযায়ী খাওয়া সাজানো থাকতো। রান্না এবং পরিবেশনের দায়িত্বে থাকতো সংশ্লিষ্ট দেশের সেফ ও সেদেশের লোকজন। আমাদের ডাইনিং হলে প্রথমে ছিল পাকিস্তানী খাওয়ার জন্য টেবিলে নির্ধারিত যায়গা, যেখানে থাকতো ইয়া বড় বড় খাসির মাংসের বিরিয়ানি, মাংসের রেজালা, খোসকা। তারপরই ছিল ভারতীয় কাউন্টার, যেখানে বিভিন্ন স্বাদের খাওয়া যা আমাদের পছন্দের যেমন ভাত, চাপতি, লাবড়া, ডাল, মাংস, রায়তা, চাটনি। আমরা বাঙ্গালিরা ভারতীয় কাউন্টার থেকে ডাল-ভাত-রায়তা (দই জাতীয়) চাটনি, লাবড়া নিয়ে পাকিস্তানী কাউন্টার থেকে মাংসের রেজালা নিয়ে খেতাম, মাঝেমধ্যে বিরিয়ানিও খেতাম।
সকালের নাস্তা নিয়ে একটি মজার ঘটনার কথা লিখছি। পাকিস্তান হকি টিম আমাদের আগেই জাকার্তায় পৌঁছে গিয়েছিল। আমি তাদের সাথে সাক্ষাৎ করলে টিমের ম্যানেজার এআইএস দারা প্রতিদিন সকালে টিমের সাথে অনুশীলন করার জন্য বলেছিলেন। সে মতে, আমি সকাল সকাল পাকিস্তান হকি টিমের সাথে অনুশীলনে বেরিয়ে পরতাম, তখন আবুল ঘুমিয়ে থাকতো।
এশিয়ান গেমস ভিলেজের বাইরে একটি ইউনিভার্সিটি কমপ্লেক্সের মাঠ বরাদ্দ ছিল হকি টিমের প্র্যাকটিসের জন্য। অনুশীলন শেষে ফিরে এসেও আবুলকে ঘুমানো অবস্থায় দেখতাম। একদিন দু’জনে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খাওয়ার জন্য যখন ডাইনিং হলে পৌঁছেছিলাম, তখন অনেক বেলা। চেয়ারগুলো টেবিলের ওপর তুলে ধোয়া-মোছা চলছিল। ডাইনিং হলে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছিলাম, প্রচন্ড ুধা কি খেয়ে  মেটাবো। এমনি যখন অবস্থা, তখন ভেতর থেকে একটি মেয়ে বের হয়ে এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করেছিল আমরা কি চাই। বলেছিলাম নাস্তা করিনি, নাস্তা খেতে এসেছি। মেয়েটি উত্তর দিয়েছিল, আর একটু সবুর কর, দুপুরের খাবার তোমাদের দেয়া হবে। মেয়েটিকে বলেছিলাম, পাকিস্তান হকি টিমের সাথে অনুশীলন করে আসতে দেরি হয়ে গেছে। মেয়েটি হেসে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে গিয়ে ইয়া বড় কলা-পাউরুটি-মাখন এনে বলেছিল, এটা খেয়ে আপাতত ুধা মেটাও, আগামীদিন থেকে তোমাদেরকে ুধায় কষ্ট পেতে হবে না। তারপর থেকে আমরা যত দেরী করেই ডাইনিং হলে নাস্তার জন্য গিয়েছি, মেয়েটি এসে হাজির হতো নাস্তার পুরোপুরি আয়োজন সহকারে। মনে হতো সে যেন আমাদের অপেক্ষায়ই আছে। মেয়েটি মেডিক্যাল কলেজের ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী, নাম ছিল দেবী।


(ঊনচল্লিশ)
পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়ায় ভীষণ জনপ্রিয় ছিল সেসময়। পাকিস্তানের ব্লেজার গায়ে বের হলেই বুঝতে পারা যেত পাকিস্তানিরা জাকার্তায় কত পপুলার। রাস্তাঘাট, মার্কেটÑ যেখানেই গিয়েছি ছেঁকে ধরেছে, স্কুল-কলেজপড়–য়া ছেলেমেয়েরা মেলে ধরেছে কাগজ-কলম অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য। সাধারণ মানুষের মাঝে পাকিস্তান সম্বন্ধে তাদের কৌতূহল কম লক্ষ্য করতাম না, ধর্ম থেকে শুরু করে সামাজিক, এমনকি রাজনৈতিক অর্থাৎ সে সময়ের মার্শাল ল’ নিয়ে তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমরা অস্থির হয়ে উঠতাম। বৃহৎ মুসলিম দেশ হিসেবে পাকিস্তানের একটি মর্যাদা ছিল ইন্দোনেশিয়ায় আর সেজন্য হয়তো পাকিস্তানিদের তারা সম্মানের চোখে দেখতো।
গেম শুরু হওয়ার প্রায় সপ্তাহখানেক আগে আমরা গেমস ভিলেজে উঠেছিলাম। সময়মত ডাইনিং হলে গিয়ে খাওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার ছিল না। ছ’জন অবজার্ভারের মধ্যে একমাত্র আমি পাকিস্তান হকি টিমের সাথে সকালবেলা প্র্যাকটিসে যেতাম; তারপর অফুরন্ত সময়। গেমস উপলক্ষে সদ্য নির্মিত স্টেডিয়ামপাড়ায় (স্পোর্টস কমপ্লেক্স) ঘুরে বেড়িয়ে দিনটি কাটতো। প্রতিদিন শত শত মানুষ বিশেষ করে অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা আসতো রাশিয়ার সাহায্য-সহযোগিতায় নবনির্মিত মেইন স্টেডিয়াম ‘সেনাজান স্টেডিয়াম’ দেখার জন্য। দর্শনীয় স্টেডিয়ামটি সত্যি দেখার মতই। এরকম সুন্দর স্টেডিয়াম পূর্বে আমি কখনও দেখিনি। লক্ষাধিক দর্শক একসাথে গ্যালারির কাঠের তৈরি বেঞ্চে বসে খেলা (অনুষ্ঠান) উপভোগ করার মত বিরাট স্টেডিয়ামটির (শুধু মাঠের অংশ ছাড়া) সম্পূর্ণ গ্যালারি ছিল ছাদ দিয়ে ঢাকা। বাইরে থেকে যেমন দর্শনীয় দেখাতো, তেমনি ভেতর থেকে আকর্ষণীয় লাগতো। বিশেষ করে রাতের বেলায় গ্যালারির উপরে উঁচু ছাদ থেকে যখন সবুজ মাঠে আলো ছড়াতো, তখন স্টেডিয়ামের ভেতর মনোমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি হতো। যা এক কথায় বলা যেতে পারে, ‘অপূর্ব’। এ ছিল আমার নতুন দেখা। হংকং-এর ফুটবল রেফারি অ্যাসেসার মি. শ্যামুয়েল চেন গত ৭ অক্টোবর ’০৯ তারিখে ঢাকায় এসেছিলেন আমাদের রেফারি মিরন এবং আজাদকে ফিফা রেফারি হিসেবে অ্যাসেস করার জন্য। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, গত আট-নয় বছর আগে তার উপস্থিতিতে একটি ফুটবল খেলায় উত্তেজিত দর্শকরা সেই সুন্দর সেনাজান স্টেডিয়াম আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলÑ যার জন্য ফিফা সে স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ করেছিল। সেদিন দুপুরবেলা ফুটবল ভবনে বসে মি. চেনের কাছ থেকে কথাটা শুনে দুঃখ লেগেছিল ঠিকই; তবে আমার দেখা সেই স্টেডিয়ামকে ঘিরে বহু স্মৃতি নতুন করে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল
আমাদের মধ্যে মুক্তা ভাই সিনিয়র ছিলেন। যে কোন ব্যাপারে তিনি এগিয়ে যেতেন। আবুল ও আমি তার সাথে থাকতাম। জাহিদ ও সিরাজকে একসাথে দেখলেও  করিমের দেখা আমরা সচরাচর পেতাম না। কোথায় যেত, কি করতো আমরা জানতাম না। পাকিস্তানি হকি খেলোয়াড়দের কাছ থেকে শুনতাম, তোমাদের করিমকে বিভিন্ন জায়গায় বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দেখা যায়। প্রতিদিন বহু লোকের সমাগম হতো স্টেডিয়াম এলাকায়, উপলক্ষ সেনাজান স্টেডিয়াম দর্শন। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ভিড় লেগেই থাকতো। তখনও সবার জন্য স্টেডিয়াম উন্মুক্ত করা হয়নি, তাই ছেলেমেয়েরা আমাদের সাহায্যে ভেতরে প্রবেশ করার জন্য আকার-ইঙ্গিতে মিনতি করতো। ইংরেজি তারা জানতো না। আকার-ইঙ্গিতে আমরাও নো নো বলে তাদের আবদারের জবাব দিতাম। আমাদের লিডার মুক্তা ভাই এ ব্যাপারগুলো সমাধান করতেন বলে অল্পদিনের মধ্যে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। মুক্তা নামটি তাদের মুখে আসতো না বলে তারা মুত্কা বলে ডাকতো। কয়েকদিনের মধ্যে ভিড় বেড়ে গিয়ে মুত্কা, মুত্কা ডাকটা অনেকটা কিচিরমিচির শোনাতো এবং আমাদের সময়টাও আনন্দে কাটতো গেমসের আগ পর্যন্ত।
বিশ্বক্রীড়াঙ্গনে এশিয়ান প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে এবং এশিয়ান ক্রীড়াবিদদের ক্রীড়া মানোন্নয়নে অধিক হারে মহাদেশীয় (এশিয়া) ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রয়োজনীয়তা  অপরিহার্য উপলব্ধি করেছিলেন ক্রীড়া সংগঠকরা। গঠিত হয়েছিল এশিয়ান গেমস ফেডারেশন এবং এই সংগঠনের মাধ্যমে এশিয়ান গেমস ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে বলে মত পোষণ করেছিলেন। ভারতের পাতিয়ালার (পাঞ্জাব রাজ্যের) মহারাজা ইয়াভিন্দ্র সিংকে অনারারি প্রেসিডেন্ট করে প্রথম এশিয়ান গেমস ফেডারেশন গঠিত হয়েছিল এবং এ সংগঠনের মাধ্যমে ১৯৫১ সালে ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লিতে এশিয়ান গেমসের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় ২য় এশিয়ান গেমস এবং জাপানের রাজধানী টোকিও শহরে এই বৃহৎ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা তৃতীয় এশিয়ান গেমস ১৯৫৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
তারই ধারাবাহিকতায় ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় ২৪ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর ’৬২ ষোলদিনব্যাপী চতুর্থ এশিয়ান গেমস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি হিজ হাইনেস সুলতান ঐধসবহমশঁ ইঁড়িহড় ওঢ ওহফড়হবংরধ এবং অর্গানাইজিং কমিটির সভাপতি ক্রীড়ামন্ত্রী  হিজ এক্সিলেন্সি আর রালাদি বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে এশিয়ান গেমস পরিচালনা করেছিলেন।
শ্রী পাকু আলম নির্বাহী সভাপতি এবং সেক্রেটারি জেনারেল কর্নেল ডি. আশহারী এশিয়ান গেমস পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন। উনিশটি দেশ আফগানিস্তান, বার্মা, উত্তর বোর্নিও, জাপান, হংকং, ইন্ডিয়া, ইসরাইল, কম্বোডিয়া দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, সেরাওয়াক, সিঙ্গাপুর, সিলোন, পাকিস্তান, ফেডারেল স্টেট অব মালয়েশিয়া, ফিলিপাইনস, তাইওয়ান, দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতিযোগীরা পনেরটি ইভেন্টে যেমন ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড, সুইমিং, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল, বক্সিং, সাইকিং, ফুটবল, হকি, শুটিং, টেনিস, টেবিল টেনিস, ভলিবল, ওয়েটলিফটিং, রেসলিং এবং আর্চারিসহ প্রায় বারটি ভেন্যুতে চৌদ্দদিন পদকের জন্য লড়েছিলেন।
পাকিস্তানের সতেরোজন ক্রীড়া কর্মকর্তা গেমসের বিভিন্ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হয়ে জাকার্তা গিয়েছিলেন। ৭৬ জন প্রতিযোগী সাতটি ইভেন্টে প্রতিযোগিতা করেছিল। পাকিস্তানের কোন মহিলা প্রতিযোগী এ গেমসে অংশ নেয়নি। আফগানিস্তানের একমাত্র প্রতিযোগী আবদুল হাদি তার দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। পাকিস্তান দলের চিফ-ডি-মিশন ছিলেন আশাফ হায়াত খান, সেক্রেটাজিনাব শাহ জাফর আলী এবং ট্রেজারার হিসেবে উইং কমান্ডার এইচএ সুফী পাকিস্তান কন্টিনজেন্টের সাথে গেমসে উপস্থিত ছিলেন।
অবজারভার হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমরা ছ’জন এশিয়ান গেমসে গেলেও প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন আমাদেরকে অ্যাথলেট হিসেবে অ্যাক্রেডিটেশন করিয়ে ছিলেন। ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড ডিসিপ্লিনে ৪ী৪০০ মিটার রিলে রেস ইভেন্টে প্রতিযোগী হিসেবে আমাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। পাকিস্তান অ্যাথলেটদের জন্য ১৬৮-১৯১ পর্যন্ত বুকের নাম্বার বরাদ্দ করা হয়েছিল যার মধ্যে আমাদের ছয়জনের নাম্বার ১৮৬-এ করিম, ১৮৭-আবুল হাসান, ১৮৮-জাহি হোসেন, ১৮৯-এসএ জামান (মুক্তা), ১৯০-সিরাজুল ইসলাম এবং আমার নাম্বার ছিল ১৯১।
বিগত এশিয়ান গেমসে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে পাকিস্তানের অ্যাথলেটদের গৌরবময় অর্জন এবারের গেমসেও সবার প্রত্যাশা ছিল অনেক। রেকর্ড গড়া পাকিস্তানি অ্যাথলেট এবং কিছু কৃতী অ্যাথলেটের কথা এখানে তুলে ধরছি।
১০০ মিটার ¯িপ্রন্ট ১০.৬ সে. আব্দুল খালিক-পাকিস্তান-ম্যানিলা ১৯৫৪
১১০ মিটার হার্ডেল ১৪.৪ সে. গোলাম রাজিক-পাকিস্তান-টোকিও-১৯৫৮
৩০০০ স্টেপল চেজ-৯.০৩.০ সে. মোবারক শাহ্-পাকিস্তান-টোকিও-১৯৫৮
জেভলিন থ্রো-৬৯.৪১ মিটার-মোহাম্মদ নাওয়াজ-পাকিস্তান-টোকিও-১৯৫৮
হ্যামার থ্রো-৬০.৯৭ মিটার-মোহাম্মদ ইকবাল-পাকিস্তান-টোকিও-১৯৫৮
তাছাড়াও কৃতী অ্যাথলেটরা হলেন পোল্টভল্টার আল্লা দিত্তা, ইফতেখার শাহ, স্প্রিন্টার হিসেবে যেমন তার সুনাম ছিল, তেমনি হকি খেলোয়াড় হিসেবেও ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। পরবর্তীতে পাকিস্তান জাতীয় দলে চান্স পেয়ে সফল ক্রীড়াবিদ হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। এশিয়ান গেমসে রেকর্ড করা ক্রীড়াবিদদের কথা উঠলে আমার খুব প্রিয় ভারতীয় এক অ্যাথলেটের কথা না বললে আমার লেখা অসম্পূর্ণ বলে মনে হবে। আর সে হলো মিলকা সিং।
২০০ মি. দৌড়-২১.৬ সে. মিলকা সিং-ইন্ডিয়া-টোকিও-১৯৫৮
৪০০ মি. দৌড়-৪৬.৬ সে. মিলকা সিং-ইন্ডিয়া-টোকিও-১৯৫৮।   

(চল্লিশ)
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং ৪র্থ এশিয়ান গেমসের পেট্রোন ঐরং ঊীপবষষবহপু উৎ. ওজ ঝড়বশধৎহড় ২৪ আগস্ট ১৯৬২ সেনাজান মেইন স্টেডিয়ামে ৪র্থ এশিয়ান গেমসের উদ্বোধন ঘোষণা করেছিলেন।
১৬টি দেশের প্রায় ১৫৪৫ জন ক্রীড়াবিদের আকর্ষণীয় মার্চপাস্ট স্টেডিয়ামকে মুখরিত করে তুলেছিল। ক্রীড়াবিদদের এই বর্ণিল মিলনমেলায় ইসরাইল এবং তাইওয়ানের খেলোয়াড়দের অনুপস্থিতি আনন্দঘন পরিবেশকে সেদিন কিছুটা বিবর্ণ করে দিয়েছিল। আরব দেশগুলোর বিরোধিতা এবং চীনের চাপে ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ ইসরাইলের দু’জন মহিলা ও দু’জন পুরুষ ক্রীড়াবিদ এবং তাইওয়ানের তিনজন মহিলা ও তিনজন পুরুষ ক্রীড়াবিদ দু’দেশের মোট ১০ জন ক্রীড়াবিদকে শেষ মুহূর্তে ভিসা প্রদানে অপারগতা জানিয়ে অলিম্পিকের ‘শান্তি  ও বন্ধুত্ব’Ñ এই মহান বাণীর ওপর কালিমা লেপে দিয়েছিল এবং ক্রীড়াঙ্গনে আন্তর্জাতিক নোংরা রাজনীতির বিষাক্ত থাবার চিহ্ন রেখে গিয়েছিল। এশিয়ান গেমস ফেডারেশনের ২১ এপ্রিল ’৬২ তারিখের সভায় ব্রুনাই সদস্যপদ লাভ করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের দল এ গেমসে অংশগ্রহণ করেনি। শেষ পর্যন্ত ১৬টি দেশ জাকার্তা এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করেছিল।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য ঘন্টা দুই স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা আমার কাছে ছিল খুবই বিরক্তিকর এবং কষ্টের। কাপড়চোপড়, ব্লেজার-টাই পরে গরমে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। এশিয়ান গেমস ফেডারেশনের ৩১ নং আইন মোতাবেক যে দেশে গেমস অনুষ্ঠিত হবে, সে দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষার বর্ণমালার ক্রমিক হিসেবে মার্চপাস্টের জন্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলোকে সাজাতে হবে অর্থাৎ এক দেশের পেছনে অন্য দেশ দাঁড়াবে এবং স্বাগতিক দেশ মার্চপাস্ট করবে সবার পেছনে। সে নিয়মে পাকিস্তানের অবস্থান এগার নম্বরে, সাত নম্বরে ইসরাইল অংশগ্রহণ না করায় পাকিস্তানের অবস্থান ছিল থাইল্যান্ডের পেছনে দশ নম্বরে। ইন্দোনেশিয়ার সুন্দরী মেয়েরা প্রতিটি দেশের সম্মুখে সেদেশের নাম লেখা প্লাকার্ড বহন করেছিল। একজন মহিলা ও একজন পুরুষ নিজ নিজ দেশের জাতীয় পোশাক পরে তাদের কালচারকে তুলে ধরার চেষ্টা করছিল মার্চপাস্টের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী কাবুলি পায়জামা ও কুর্তা তার ওপর শেরওয়ানি, মাথায় পাগড়ি একজন পুরুষের সাথে সালোয়ার-কামিজ ও মাথায় ওড়না দেয়া একজন মহিলা পাকিস্তান কালচারের প্রতীক হিসেবে মার্চপাস্টে অংশ নিয়েছিল। ক্রীড়ানুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা বহন করা একজন খেলোয়াড়ের জন্য গর্বের। প্রত্যেক দেশ তাদের কৃতী খেলোয়াড়কে এরকম অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা বহন করার দায়িত্ব দিয়ে সম্মানিত করে থাকে। ১৯৫৮ এশিয়ান গেমসে ১১০ মিটার হার্ডলসে এশিয়ান রেকর্ড অর্জনকারী গোল্ড মেডেলিস্ট গোলাম রাজিককে পাকিস্তান জাতীয় পতাকা বহন করার দায়িত্ব দিয়ে সম্মানিত করেছিল। পাকিস্তান কন্টিনজেন্ট স্টেডিয়ামে প্রবেশ করার সাথে সাথে দর্শকপূর্ণ গ্যালারি ‘পাকিস্তান পাকিস্তান’ বলে চিৎকার করে ইন্দোনেশিয়ায় পাকিস্তানের জনপ্রিয়তা কতÑ তা আবারও জানিয়ে দিয়েছিল। স্টেডিয়ামে ঢুকেই আমি কেমন জানি এক ভিন্ন অনুভূতি অনুভব করেছিলাম এবং নিজেকে বিশেষ একজন সম্মানিত ব্যক্তি ভেবে কন্টিনজেন্টের সাথে এগিয়ে যেতে যেতে হাত নেড়ে দর্শকদের শুভেচ্ছার জবাব দিচ্ছিলাম। এভাবে চলতে চলতে আমরা প্রেসিডেন্ট মঞ্চ বরাবর আসলে গ্যালারির উঁচুতে বিশেষভাবে তৈরি কাঁচ দিয়ে ঘেরা বক্স থেকে আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করছিলেন প্রেসিডেন্ট সুকর্ন এবং হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিলেন। এ অভিজ্ঞতা আমার প্রথম।
এক এক করে সব দেশের মার্চপাস্ট শেষ, নির্দিষ্ট জায়গায় সবাই স্থান নিয়েছে। এমন সময় ঘোষণা দেয়া হলোÑ এবার মহামান্য প্রেসিডেন্ট ৪র্থ এশিয়ান গেমস ’৬২-এর শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। নিশ্চুপ স্টেডিয়াম, সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে ক্রীড়াবিদরা, মহামান্য প্রেসিডেন্ট এবং গেমসের পেট্রোন ড. আইআর, সুকর্নো তার কাঁচ ঘেরা বক্স থেকে দাঁড়িয়ে এশিয়ান গেমস ফেডারেশনের চার্টার অনুযায়ী ৪র্থ এশিয়ান গেমস, জাকার্তা ১৯৬২-এর উদ্বোধন ঘোষণা করেছিলেন। সাথে সাথে শত শত পায়রা আর বেলুন ওড়ানো হয়েছিল। যেহেতু স্টেডিয়ামটি অনেক উঁচু ছাদ দ্বারা কভার্ড, পায়রাগুলো অত উঁচুতে উঠে স্টেডিয়াম ছেড়ে যেতে পারছিল না; অনেক পায়রা গ্যারারিতে বসা দর্শকদের হাতে বন্দি হয়েছিল, পরে মুক্ত হয়ে এদিক-সেদিক উড়তে উড়তে স্টেডিয়াম ছেড়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় পতাকা এবং এশিয়ান গেমস পতাকা ওড়ানো, ক্রীড়াবিদদের শপথ ও জাজদের শপথ নেয়া শেষ হওয়ার সাথে সাথে দর্শকদের হৈ চৈ বেড়ে গিয়েছিল; কারণ এরই মধ্যে স্টেডিয়ামে প্রজ্বলিত মশাল হাতে ঢুকে পড়েছিলেন মশাল বহনকারী ইন্দোনেশিয়ার নির্বাচিত এক ক্রীড়াবিদ। শুরু হয়েছিল তালে তালে হাততালি। লক্ষাধিক দর্শকের হাততালির আওয়াজ স্টেডিয়ামে অনন্য এক আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। করতালির মধ্যে টর্চ বহনকারী খেলোয়াড়ের মশাল জ্বালানোর সাথে বারদিনব্যাপী এশিয়ান গেমসের ‘মশাল প্রজ্বলন’ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়েছিল। এরপর ক্রীড়াবিদদের পরিচিতি এবং বন্ধুত্বের পালা। একে অন্যের সাথে, এক দেশ অন্য দেশের ক্রীড়াবিদদের সাথে পরিচিত হওয়াÑ পুরো খেলার মাঠ ক্রীড়াবিদদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। মাঠ ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা শোনা গেল, সব ক্রীড়াবিদকে গ্যালারির নির্দিষ্ট জায়গায় বসতে বলা হয়েছিল এবং সেমতে আমরা গ্যালারির কাঠের বেঞ্চে বসে আগামী অনুষ্ঠান দেখার অপেক্ষা করেছিলাম।
এরই মধ্যে দিনের আলো শেষে সন্ধ্যা নেমে এসেছিল, স্টেডিয়ামের উঁচু ছাদ থেকে আলো নেমে এসে মাঠের সবুজ বুকে আছড়ে পড়ছিলÑ যা স্টেডিয়ামের ভেতর আলো-আঁধারের এক মায়াবি পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। হঠাৎ শত শত ছেলেমেয়ে স্টেডিয়ামের চতুর্দিক থেকে ছুটে এসে মাঠের মাঝে অবস্থান নিয়ে শারীরিক কসরতের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিল নানারকম ডিসপ্লে; এমনকি তাদের জাতীয় পতাকা। নিমিষের মধ্যে তারা মাঠ থেকে উধাও, তাদের জায়গা দখল করে নিয়েছিল দেব-দেবী, দৈত্য-দানব, ড্রাগন, বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে পারফরমাররা। তারা ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিল। ইন্দোনেশিয়ান কালচারের সাথে হিন্দু কালচারের মিল পাওয়া যায়। বিশেষ করে হিন্দু দেব-দেবীর প্রভাবটা বেশি লক্ষ্য করেছিলাম সে সময়। যদিও ইন্দোনেশিয়া মুসলিমপ্রধান একটি দেশ। সবশেষে আতশবাজি, স্টেডিয়াম এলাকার আকাশকে মনোরম সাজে সাজিয়ে রেখেছিল কিছু সময়। প্রায় তিন ঘন্টার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছিল খুবই প্রাণবন্ত ও উপভোগ্য।
আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পূর্বেই সেদিন সকালে (২৪ আগস্ট ১৯৬২) ফুটবল ম্যাচের মাধ্যমে অলিখিত উদ্বোধন হয়ে গিয়েছিল। ৮টি ফুটবল দলকে ২ গ্রুপে ভাগ করে যে ফিকশ্চার করা হয়েছিল, তা ১২ দিনের কম সময়ে শেষ করা সম্ভব হচ্ছিল না বলেই উদ্বোধনী এবং সমাপনী দিনকেও ব্যবহার করতে হয়েছিল। গ্রুপ ‘এ’ : সাউথ কোরিয়া, জাপান, ভারত এবং থাইল্যান্ড। গ্রুপ ‘বি’ : মালয়, ইন্দোনেশিয়া, সাউথ ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন। প্রথমদিনের ‘এ’ গ্রুপের দুটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া ২-০ গোলে ভারতকে এবং জাপান ৩-১ গোলে থাইল্যান্ডকে পরাজিত করার মাধ্যমে। আর এর মধ্য দিয়েই এশিয়ান গেমস ফুটবল প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল।


(একচল্লিশ)
এশিয়ান গেমস ’৬২ ভারতের ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন চুনী গোস্বামী। যার খেলার প্রশংসা শুনে আসছিলাম ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবে ফুটবল খেলা শুরু করার পর থেকে (১৯৫৭ সাল)। কাবের সভাপতি ‘বড়দা’, মহিউদ্দিন খান সাহেব যেদিন ভিক্টোরিয়া খেলায় জয়লাভ করতো, সেদিন খুশীমনে বলতেনÑ তুই চুনীর মত খেলিস, তোর মত হালকা-পাতলা ছেলে, কি চমৎকারই না খেলে, দেখে মন জুড়িয়ে যায়। সেই তখন থেকে চুনী গোস্বামী সম্বন্ধে মনে একটা আলাদা আকর্ষণ জন্মেছিল, তার সাক্ষাৎ পাওয়ার ইচ্ছেটাও জমা ছিল মনে। জাকার্তা এশিয়ান গেমসে সে সুযোগটা এসেছিল। এক সকালে ভিলেজ ক্যান্টিন থেকে নাস্তা সেরে আবুলকে সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে উঠেছিলাম ভারতীয় শিবিরে।
চুনী গোস্বামী ভারতের জনপ্রিয় একজন ফুটবল তারকা। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি আমাদের সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন দোতলার একটি কক্ষে। পাকিস্তান কন্টিনজেন্টের সদস্য হিসেবে আমাদের পরিচয় পেয়ে প্রথমে সেরকম গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে যখন বললাম আমরা বাঙ্গালি, ঢাকা থেকে এসেছি, তখন আমাদেরকে রুমে নিয়ে বসিয়েছিলেন। তার রুমমেট পিকে ব্যানার্জির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনিও একজন খ্যাতিমান ফুটবল তারকা। ভিক্টোরিয়া কাবের বড়দার উক্তিগুলো চুনীকে বলাতে মনে হলো তিনি খুশী হয়েছেন। ভলিবল  ও হকির অবজারভার হিসেবে এশিয়ান গেমসে আসলেও আমরা দুজনই ফুটবল প্লেয়ার, ঢাকা লীগে খেলি। ঢাকা ফুটবল লীগ খুব জমজমাট হয়। মনে হলো এ ব্যাপারে তাদের কোন উৎসাহ নেই। পাকিস্তান ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন নবী চৌধুরী, মারী দা’র মত চৌকস একজন ফুটবলার, কবির, গজনবীর মত খেলোয়াড়দের সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণা আছে বলে মনে হলো না। পিকে ব্যানার্জি নিজেই তার সম্বন্ধে বলতে শুরু করে দিয়েছিলেনÑ এর পূর্বে তিনি ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন, অলিম্পিক বাছাই পর্বে ভারতীয় টিমের অধিনায়কত্ব করেছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি বলতে কি, ভারতের ফুটবল নিয়েও আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কথা প্রসঙ্গে উঠে এসেছিল পাকিস্তানী ফুটবল প্লেয়ার আবিদ, মুসা, ওমর, হাসান-এর কথা, যারা কোলকাতায় ফুটবল খেলে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেছিল। তাদের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য আর দক্ষতা ফুটবলামোদীদের কাছে সমাদৃত হয়েছিল। চুনী গোস্বামীর মন্তব্য ছিল এরকমÑ ওমর, মুসা, হাসান যদি ভারতের প্লেয়ার হতো, আমরা অনেক দলকে চ্যালেঞ্জ করতাম। ১৯৬০ সালের অলিম্পিক ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পেতাম। তাদের কথা শেষে বলেছিলাম, ওমর, মুসা, হাসান বর্তমানে ঢাকায় লীগ খেলছে এবং একই কাব ভিক্টোরিয়ায় আমরা একই সাথে খেলি। তখন মনে হয়েছিল একজন ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। 
পাকিস্তানের গর্ব করার মত সে সময় ক্রীড়াঙ্গনে অনেক ক্রীড়াবিদ ছিলেন। ১৯৫৮ সালে এশিয়ান গেমসে গোল্ড মেডেল পাওয়া এবং রেকর্ড অর্জনকারী ক্রীড়াবিদের (বিশেষ করে অ্যাথলেটিক্স) সম্বন্ধে পূর্বের সংখ্যায় লিখেছিলাম। তাছাড়াও কুস্তি, বক্সিং, শুটিং-এ
উল্লেখ করার মত ক্রীড়াবিদদের কথা বলতে হলে রেসলিং-এর মোহাম্মদ বশীরের নামটি চলে আসে। ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে ফ্রিস্টাইল রেসলিং-এ পাকিস্তানের লাহোরে জন্মগ্রহণকারী মো. বশীর ব্রোঞ্জ পদক পেয়ে একমাত্র পাকিস্তানী ক্রীড়াবিদ যে ব্যক্তিগত মেডেল লাভের গৌরব অর্জন করেছিল। হকি পাকিস্তানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ খেলা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হলো ভারত। হকির ইতিহাসে ভারতের একক আধিপত্য ছিলÑ যা দেশ বিভাগের পর (১৯৪৭-এর পর) থেকে পাকিস্তান ভাগ বসাতে সচেষ্ট ছিল এবং ১৯৫৮  সালের এশিয়ান গেমস ও ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে সফল হয়েছিল এবং ভারতকে পরাজিত করে গোল্ড মেডেল অর্জন করেছিল। প্রতিষ্ঠিত ক্রীড়াবিদদের ওপর অগাধ আস্থা নিয়ে পাকিস্তানী শিবির মূল প্রতিযোগিতার জন্য দিন গুণছিল।
২৫ আগস্ট থেকে প্রায় সব খেলাই শুরু হয়েছিল। প্রত্যেক খেলা কবে, কোথায়, কখন (সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা) অনুষ্ঠিত হবেÑ তার একটা প্রোগ্রাম তৈরি করে সে অনুযায়ী সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত প্রতিযোগিতা চলতো। এশিয়ান গেমসে ব্যাডমিন্টন খেলার অভিষেক হয়েছিল ২৫ তারিখের সকালে। বাস্কেটবল, টেনিস, কুস্তি এবং সাইকিং ও ২৫ তারিখের
সকালে শুরু হয়েছিল। গেমসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দুটি ইভেন্ট অ্যাথলেটিক্স এবং হকির প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়েছিল ২৫ তারিখ বিকেলে। অ্যাথলেটিক্সর ৮টি ইভেন্টের মধ্যে ৩টির ফাইনাল ছিল বিকেলের পর্বে। ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টের বাছাই এবং সেমিফাইনাল উৎরে ফাইনালে/চূড়ান্ত উঠেছিল পাকিস্তানের দ্রুততম মানব আবদুল খালিক। যার ওপর পাকিস্তানীদের পূর্ণ আস্থা ছিল। পাকিস্তান ১০০ মিটারে গোল্ড মেডেল পাবে অনেকটা নিশ্চিত।
হপ স্টেপ এন্ড জাম্প ফাইনালে ৯ জন প্রতিযোগী অংশ নিয়েছিল, যার মধ্যে পাকিস্তানের মোহাম্মদ খানও ছিল। এ ইভেন্টে কোজি সাকুরাই গোল্ড এবং টোমিওটা পান সিলভার। দুজনই জাপানের এবং ইন্দোনেশিয়ার এওয়াং পাপিলায়া পেয়েছিল ব্রোঞ্জ। ১৪ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছিল ডিসকাস থ্রো ইভেন্টের ফাইনালে। মো. আইয়ুব এবং হায়দার খান পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। জাপানের সিজো ইয়ানা গাওয়া গোল্ড, ভারতের বারদুমান সিং সিলভার এবং জাপানের সোহি কানিকো ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিল। অ্যাথলেটিক্সের প্রথম দিনের শেষ ফাইনাল প্রতিযোগিতা ছিল ১০,০০০ মিটার দৌড়। পাকিস্তানের কৃতী দুই লম্বা দৌড়বিদ মুবারক শাহ এবং মো. ইউসুফসহ ১২ জন লড়েছিলেন এই ইভেন্টে। শেষ পর্যন্ত পঁচিশ চক্করের লড়াইয়ে ভারতের তারলোক সিং জয়ী হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেছিল। জাপানের তেরু কিনাই জিতেছিল সিলভার এবং ভারতের গুরনাম সিং ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিল।
২৬ আগস্ট শেষ বিকেলটা ছিল পাকিস্তানের জন্য শুধুই আশাভঙ্গের, শুধুই হতাশার। ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টের (১০:৬ এশিয়ার) রেকর্ডধারী দ্রুততম মানব পাকিস্তানের আবদুল খালিক ফাইনালে জিততে পারেনি। পরাজিত হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার এক মেডিক্যাল ছাত্রের কাছে। অখ্যাত এক দৌড়বিদ মোহাম্মদ সারেংগাত সবার আগে টেপ স্পর্শ করে সেনাজান মেইন স্টেডিয়ামের ৪০/৫০ হাজার দর্শককে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, এনে দিয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার জন্য একটি গৌরবময় মুহূর্তÑ একটি গোল্ড মেডেল। মালয়ের (মালয়েশিয়া) মানিকা ভাসাঙ্গাম জেগাথেসন সিলভার আর ফিলিপাইনের রোজেলিও নেফ্রে পেয়েছিল ব্রোঞ্জ মেডেল। খালিকের এরকম ফলাফল পাকিস্তানের কেউ আশা করতে পারেনি। মোহাম্মদ নেওয়াজ যে টোকিও এশিয়ান গেমসে ৬৯.৪১ মি. দূরত্বে বর্শা ছুঁড়ে রেকর্ড গড়েছিল, সে আগের ইভেন্টে জাপানের তাকাশি মিকির কাছে হেরে গোল্ড মেডেল খুইয়ে সিলভার মেডেলের মাঝে সান্ত্বনা খুঁজছিল এবং আর এক জাপানী হিদেতা কানাই ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছিল। পুরুষদের হাইজাম্প এবং ৪০০ মিটার হার্ডলে পাকিস্তানের কোন প্রতিযোগী না থাকায় দেখার আগ্রহটাও আমাদের ছিল না। তবে হাইজাম্প ইভেন্ট বরাবরই আমার কাছে আকর্ষণীয় ইভেন্ট; কারণ স্কুলে থাকতে এই ইভেন্ট আমি করতাম এবং এ ইভেন্টে ইন্টার স্কুলেও আমি প্রতিযোগিতা করে পুরস্কার পেতাম। জাপানের কুনিওশি শেগিওকা গোল্ড, সিলেনোর (শ্রীলংকা) নাগালিংগাম ইথিরিভিরাসিংগাম সিলভার এবং ফিলিপাইনের সিরিয়াকো বারোন্দা ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছিল। ২৬ তারিখে পুরুষদের আর একটি ফাইনাল প্রতিযোগিতা ৪০০ মি. হার্ডল। এখানেও জাপানের আধিপত্য ছিল। গোল্ড পেয়েছিল কিইজিং ওগোসি এবং  সিলভার পেয়েছিল কিইকো ইজিমা এবং মালয়ের কারুসেলভারতœম ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিল। এ বিকেলে ফুটবলে মালয় রেকর্ডসংখ্যক ১৫-১ গোলে ফিলিপাইনসকে পরাজিত করেছিল এবং রাতের ফুটবল প্রতিযোগিতায় স্বাগতিক ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ কিয়েতনামকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল।
২৭ আগস্ট পাকিস্তানের জন্য আরও একটা অপয়া বিকেল। নিশ্চিত দুটো গোল্ড মেডেল হাতছাড়া হয়েছিল। বিকেল ৫.১৫ মি. আমরা বুক ভরা আশা নিয়ে বসেছিলাম গ্যালারিতে, ১৪.৪ সেকেন্ডে ১১০ মি. হার্ডলের রেকর্ড করা গোলাম রাজিক পাকিস্তানকে এবারও একটা গোল্ড মেডেল উপহার দেবে। স্টার্টিং পয়েন্টে রিভলবারের আওয়াজের সাথে সাথে স্টেডিয়ামের হাজার চল্লিশেক দর্শকের চিৎকার, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, গোলাম রাজিক জিন্দাবাদ’। অন্যদিকে সারেঙ্গাত, সারেঙ্গাত। নিমিষেই হার্ডলারদের হার্ডল টপকানো শেষ। ফিনিশিং টেপে কে আগে বুক ছুঁইয়েছে, ফিনিশিং লাইন আগে কে ক্রস করেছে? দুজনকেই মনে হয়েছে প্রথম। আমার কাছে মনে হয়েছিল গোলাম রাজিক প্রথম হয়েছে। আমরা সবাই উৎকন্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে ফাইনাল রেজাল্টের অপেক্ষা করছিলাম। বর্তমানের মত তখন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল না, তাই একটু সময় নিতে হচ্ছিল। একটু পরই মাইকে ভেসে এসেছিল রেজাল্টÑ মোহাম্মদ সারেঙ্গাত প্রথম এবং গোলাম রাজিক দ্বিতীয়, ফটো ফিনিশিং পদ্ধতি ব্যবহার করে এ রেজাল্ট দেয়া হয়েছিল, তৃতীয় হয়েছিল জাপানের হিরো কাজু ইয়ামুদা। এ বিকেলেই পাকিস্তানকে আরও একটি দুঃখজনক হার হজম করতে হয়েছিল আর সেটি ছিল হ্যামার থ্রো। বিকেল ৪টায় (স্থানীয় সময়) শুরু হওয়া হ্যামার থ্রো, যার রেকর্ড (৬০.৯৭ মি.) পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইকবাল করেছিলেন ১৯৫৮ সালে। এবার জাপানের কাছে বিলিয়ে দিতে হয়েছিল এবং ব্রোঞ্জপদক পেয়ে পাকিস্তানের মেডেল তালিকায় নিজের নাম  লেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। নবোরু ওকামোটো গোল্ড এবং তাকিও সুগারাওয়া সিলভার মেডেল অধিকার করেছিল।



(বেয়াল্লিশ)

এশিয়ান গেমস ’৬২ ভারতের ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন চুনী গোস্বামী। যার খেলার প্রশংসা শুনে আসছিলাম ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবে ফুটবল খেলা শুরু করার পর থেকে (১৯৫৭ সাল)। কাবের সভাপতি ‘বড়দা’, মহিউদ্দিন খান সাহেব যেদিন ভিক্টোরিয়া খেলায় জয়লাভ করতো, সেদিন খুশীমনে বলতেনÑ তুই চুনীর মত খেলিস, তোর মত হালকা-পাতলা ছেলে, কি চমৎকারই না খেলে, দেখে মন জুড়িয়ে যায়। সেই তখন থেকে চুনী গোস্বামী সম্বন্ধে মনে একটা আলাদা আকর্ষণ জন্মেছিল, তার সাক্ষাৎ পাওয়ার ইচ্ছেটাও জমা ছিল মনে। জাকার্তা এশিয়ান গেমসে সে সুযোগটা এসেছিল। এক সকালে ভিলেজ ক্যান্টিন থেকে নাস্তা সেরে আবুলকে সাথে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে উঠেছিলাম ভারতীয় শিবিরে।
চুনী গোস্বামী ভারতের জনপ্রিয় একজন ফুটবল তারকা। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি আমাদের সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন দোতলার একটি কক্ষে। পাকিস্তান কন্টিনজেন্টের সদস্য হিসেবে আমাদের পরিচয় পেয়ে প্রথমে সেরকম গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে যখন বললাম, আমরা বাঙ্গালি, ঢাকা থেকে এসেছি, তখন আমাদেরকে রুমে নিয়ে বসিয়েছিলেন। তার রুমমেট পিকে ব্যানার্জির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনিও একজন খ্যাতিমান ফুটবল তারকা। ভিক্টোরিয়া কাবের বড়দার উক্তিগুলো চুনীকে বলাতে মনে হলো তিনি খুশী হয়েছেন। ভলিবল  ও হকির অবজারভার হিসেবে এশিয়ান গেমসে আসলেও আমরা দুজনই ফুটবল প্লেয়ার, ঢাকা লীগে খেলি। ঢাকা ফুটবল লীগ খুব জমজমাট হয়। মনে হলো এ ব্যাপারে তাদের কোন উৎসাহ নেই। পাকিস্তান ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন নবী চৌধুরী, মারী দার মত চৌকস একজন ফুটবলার, কবির, গজনবীর মত খেলোয়াড়দের সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণা আছে বলে মনে হলো না। পিকে ব্যানার্জি নিজেই তার সম্বন্ধে বলতে শুরু করে দিয়েছিলেনÑ এর পূর্বে তিনি ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন, অলিম্পিক বাছাই পর্বে ভারতীয় টিমের অধিনায়কত্ব করেছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি বলতে কি, ভারতের ফুটবল নিয়েও আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কথা প্রসঙ্গে উঠে এসেছিল পাকিস্তানী ফুটবল প্লেয়ার আবিদ, মুসা, ওমর, হাসান-এর কথা, যারা কোলকাতায় ফুটবল খেলে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেছিল। তাদের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য আর দক্ষতা ফুটবলামোদীদের কাছে সমাদৃত হয়েছিল। চুনী গোস্বামীর মন্তব্য ছিল এরকমÑ ওমর, মুসা, হাসান যদি ভারতের প্লেয়ার হতো, আমরা অনেক দলকে চ্যালেঞ্জ করতাম। ১৯৬০ সালের অলিম্পিক ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পেতাম। তাদের কথা শেষে বলেছিলাম, ওমর, মুসা, হাসান বর্তমানে ঢাকায় লীগ খেলছে এবং একই কাব ভিক্টোরিয়ায় আমরা একই সাথে খেলি। তখন মনে হয়েছিল একজন ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। 
পাকিস্তানের গর্ব করার মত সে সময় ক্রীড়াঙ্গনে অনেক ক্রীড়াবিদ ছিলেন। ১৯৫৮ সালে এশিয়ান গেমসে গোল্ড মেডেল পাওয়া এবং রেকর্ড অর্জনকারী ক্রীড়াবিদের (বিশেষ করে অ্যাথলেটিক্স) সম্বন্ধে পূর্বের সংখ্যায় লিখেছিলাম। তাছাড়াও কুস্তি, বক্সিং, শুটিং-এ
উল্লেখ করার মত ক্রীড়াবিদদের কথা বলতে হলে রেসলিং-এর মোহাম্মদ বশীরের নামটি চলে আসে। ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে ফ্রিস্টাইল রেসলিং-এ পাকিস্তানের লাহোরে জন্মগ্রহণকারী মো. বশীর ব্রোঞ্জ পদক পেয়ে একমাত্র পাকিস্তানী ক্রীড়াবিদ যে ব্যক্তিগত মেডেল লাভের গৌরব অর্জন করেছিল। হকি পাকিস্তানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ খেলা। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হলো ভারত। হকির ইতিহাসে ভারতের একক আধিপত্য ছিলÑ যা দেশ বিভাগের পর (১৯৪৭-এর পর) থেকে পাকিস্তান ভাগ বসাতে সচেষ্ট ছিল এবং ১৯৫৮  সালের এশিয়ান গেমস ও ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে সফল হয়েছিল এবং ভারতকে পরাজিত করে গোল্ড মেডেল অর্জন করেছিল। প্রতিষ্ঠিত ক্রীড়াবিদদের ওপর অগাধ আস্থা নিয়ে পাকিস্তানী শিবির মূল প্রতিযোগিতার জন্য দিন গুণছিল।
২৫ আগস্ট থেকে প্রায় সব খেলাই শুরু হয়েছিল। প্রত্যেক খেলা কবে, কোথায়, কখন (সকাল-বিকাল-সন্ধ্যা) অনুষ্ঠিত হবেÑ তার একটা প্রোগ্রাম তৈরি করে সে অনুযায়ী সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত প্রতিযোগিতা চলতো। এশিয়ান গেমসে ব্যাডমিন্টন খেলার অভিষেক হয়েছিল ২৫ তারিখের সকালে। বাস্কেটবল, টেনিস, কুস্তি এবং সাইকিং ও ২৫ তারিখের
সকালে শুরু হয়েছিল। গেমসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দুটি ইভেন্ট অ্যাথলেটিক্স এবং হকির প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়েছিল ২৫ তারিখ বিকেলে। অ্যাথলেটিক্সর ৮টি ইভেন্টের মধ্যে ৩টির ফাইনাল ছিল বিকেলের পর্বে। ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টের বাছাই এবং সেমিফাইনাল উৎরে ফাইনালে/চূড়ান্ত উঠেছিল পাকিস্তানের দ্রুততম মানব আবদুল খালিক। যার ওপর পাকিস্তানীদের পূর্ণ আস্থা ছিল। পাকিস্তান ১০০ মিটারে গোল্ড মেডেল পাবে অনেকটা নিশ্চিত।
হপ স্টেপ এন্ড জাম্প ফাইনালে ৯ জন প্রতিযোগী অংশ নিয়েছিল, যার মধ্যে পাকিস্তানের মোহাম্মদ খানও ছিল। এ ইভেন্টে কোজি সাকুরাই গোল্ড এবং টোমিওটা পান সিলভার। দুজনই জাপানের এবং ইন্দোনেশিয়ার এওয়াং পাপিলায়া পেয়েছিল ব্রোঞ্জ। ১৪ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছিল ডিসকাস থ্রো ইভেন্টের ফাইনালে। মো.আইয়ুব এবং হায়দার খান পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। জাপানের সিজো ইয়ানা গাওয়া গোল্ড, ভারতের বারদুমান সিং সিলভার এবং জাপানের সোহি কানিকো ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিল। অ্যাথলেটিক্সের প্রথম দিনের শেষ ফাইনাল প্রতিযোগিতা ছিল ১০,০০০ মিটার দৌড়। পাকিস্তানের কৃতী দুই লম্বা দৌড়বিদ মুবারক শাহ এবং মো. ইউসুফসহ ১২ জন লড়েছিলেন এই ইভেন্টে। শেষ পর্যন্ত পঁচিশ চক্করের লড়াইয়ে ভারতের তারলোক সিং জয়ী হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেছিল। জাপানের তেরু কিনাই জিতেছিল সিলভার এবং ভারতের গুরনাম সিং ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিল।
২৬ আগস্ট শেষ বিকেলটা ছিল পাকিস্তানের জন্য শুধুই আশাভঙ্গের, শুধুই হতাশার। ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টের (১০:৬ এশিয়ার) রেকর্ডধারী দ্রুততম মানব পাকিস্তানের আবদুল খালিক ফাইনালে জিততে পারেনি। পরাজিত হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার এক মেডিক্যাল ছাত্রের কাছে। অখ্যাত এক দৌড়বিদ মোহাম্মদ সারেংগাত সবার আগে টেপ স্পর্শ করে সেনাজান মেইন স্টেডিয়ামের ৪০/৫০ হাজার দর্শককে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, এনে দিয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার জন্য একটি গৌরবময় মুহূর্তÑ একটি গোল্ড মেডেল। মালয়ের (মালয়েশিয়া) মানিকা ভাসাঙ্গাম জেগাথেসন সিলভার আর ফিলিপাইনের রোজেলিও নেফ্রে পেয়েছিল ব্রোঞ্জ মেডেল। খালিকের এরকম ফলাফল পাকিস্তানের কেউ আশা করতে পারেনি। মোহাম্মদ নেওয়াজ যে টোকিও এশিয়ান গেমসে ৬৯.৪১ মি. দূরত্বে বর্শা ছুঁড়ে রেকর্ড গড়েছিল, সে আগের ইভেন্টে জাপানের তাকাশি মিকির কাছে হেরে গোল্ড মেডেল খুইয়ে সিলভার মেডেলের মাঝে সান্ত্বনা খুঁজছিল এবং আর এক জাপানী হিদেতা কানাই ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছিল। পুরুষদের হাইজাম্প এবং ৪০০ মিটার হার্ডলে পাকিস্তানের কোন প্রতিযোগী না থাকায় দেখার আগ্রহটাও আমাদের ছিল না। তবে হাইজাম্প ইভেন্ট বরাবরই আমার কাছে আকর্ষণীয় ইভেন্ট; কারণ স্কুলে থাকতে এই ইভেন্ট আমি করতাম এবং এ ইভেন্টে ইন্টারস্কুলেও আমি প্রতিযোগিতা করে পুরস্কার পেতাম। জাপানের কুনিওশি শেগিওকা গোল্ড, সিলেনোর (শ্রীলংকা) নাগালিংগাম ইথিরিভিরাসিংগাম সিলভার এবং ফিলিপাইনের সিরিয়াকো বারোন্দা ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছিল। ২৬ তারিখে পুরুষদের আর একটি ফাইনাল প্রতিযোগিতা ৪০০ মি. হার্ডল। এখানেও জাপানের আধিপত্য ছিল। গোল্ড পেয়েছিল কিইজিং ওগোসি এবং  সিলভার পেয়েছিল কিইকো ইজিমা এবং মালয়ের কারুসেলভারতœম ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিল। এ বিকেলে ফুটবলে মালয় রেকর্ডসংখ্যক ১৫-১ গোলে ফিলিপাইনসকে পরাজিত করেছিল এবং রাতের ফুটবল প্রতিযোগিতায় স্বাগতিক ইন্দোনেশিয়া দক্ষিণ কিয়েতনামকে ১-০ গোলে পরাজিত করেছিল।
২৭ আগস্ট পাকিস্তানের জন্য আরও একটা অপয়া বিকেল। নিশ্চিত দুটো গোল্ড মেডেল হাতছাড়া হয়েছিল। বিকেল ৫.১৫ মি. আমরা বুক ভরা আশা নিয়ে বসেছিলাম গ্যালারিতে, ১৪.৪ সেকেন্ডে ১১০ মি. হার্ডলের রেকর্ড করা গোলাম রাজিক পাকিস্তানকে এবারও একটা গোল্ড মেডেল উপহার দেবে। স্টার্টিং পয়েন্টে রিভলবারের আওয়াজের সাথে সাথে স্টেডিয়ামের হাজার চল্লিশেক দর্শকের চিৎকার, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, গোলাম রাজিক জিন্দাবাদ’। অন্যদিকে সারেঙ্গাত, সারেঙ্গাত। নিমিষেই হার্ডলারদের হার্ডল টপকানো শেষ। ফিনিশিং টেপে কে আগে বুক ছুঁইয়েছে, ফিনিশিং লাইন আগে কে ক্রস করেছে? দুজনকেই মনে হয়েছে প্রথম। আমার কাছে মনে হয়েছিল গোলাম রাজিক প্রথম হয়েছে। আমরা সবাই উৎকন্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে ফাইনাল রেজাল্টের অপেক্ষা করছিলাম। বর্তমানের মত তখন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল না, তাই একটু সময় নিতে হচ্ছিল। একটু পরই মাইকে ভেসে এসেছিল রেজাল্টÑ মোহাম্মদ সারেঙ্গাত প্রথম এবং গোলাম রাজিক দ্বিতীয়, ফটো ফিনিশিং পদ্ধতি ব্যবহার করে এ রেজাল্ট দেয়া হয়েছিল, তৃতীয় হয়েছিল জাপানের হিরো কাজু ইয়ামুদা। এ বিকেলেই পাকিস্তানকে আরও একটি দুঃখজনক হার হজম করতে হয়েছিল আর সেটি ছিল হ্যামার থ্রো। বিকেল ৪টায় (স্থানীয় সময়) শুরু হওয়া হ্যামার থ্রো, যার রেকর্ড (৬০.৯৭ মি.) পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইকবাল করেছিলেন ১৯৫৮ সালে। এবার জাপানের কাছে বিলিয়ে দিতে হয়েছিল এবং ব্রোঞ্জপদক পেয়ে পাকিস্তানের মেডেল তালিকায় নিজের নাম  লেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। নবোরু ওকামোটো গোল্ড এবং তাকিও সুগারাওয়া সিলভার মেডেল অধিকার করেছিল।

(তেতাল্লিশ)
মুবারক শাহ পাকিস্তানের মান রেখেছিল সেদিন (২৭ আগস্ট ’৬২)। যখন এশিয়ান রেকর্ডধারী পাকিস্তানী কৃতী অ্যাথলেটরা একটার পর একটা তাদের স্বর্ণপদকগুলো অন্যের হাতে তুলে দিয়ে আসছিল, অ্যাথলেটদের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে পাকিস্তান শিবির যখন হতাশ, সেই শেষ বিকেলে দিনের শেষ ইভেন্টে জয়ী হয়ে মুবারক শাহ পাকিস্তানীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিল। স্বস্তি এনে দিয়েছিল।
৯টি দেশের  ১৫ জন দৌড়বিদ স্টার্টিং পয়েন্টে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে সাড়ে ১২ চক্কর দৌড় দেয়ার জন্য প্রস্তুত। মুবারক শাহ্ এবং মোহাম্মদ ইউসুফ, পাকিস্তানের দুজন লং ডিস্টেন্ট রানার, তারাও সবার সাথে প্রস্তুত। দৌড় শুরু হওয়ার সাথে সাথে প্রতিযোগীদের মধ্যে একে অন্যকে টপকে যাওয়ার লড়াই। আগে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা। চার-পাঁচ চক্কর পর্যন্ত এরকম প্রতিযোগিতা চলার পর প্রতিযোগীদের মধ্যে অনেকে ধীরে ধীরে পেছনে পড়তে শুরু করেছিল এবং অগ্রভাগে প্রতিযোগী সংখ্যা কমে যাচ্ছিল। প্রথম সারিতে জাপান, ভারত, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়ার সাথে পাকিস্তানের দুই অ্যাথলেট সমান তালে দৌড়াচ্ছিল। দশ চক্কর শেষে পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইউসুফ ধীরে ধীরে পেছনে পড়ছিল, সে সাথে আরেকটা পরাজয় দেখার জন্য আমরা তৈরি হচ্ছিলাম। মুবারক শাহ মো. ইউসুফের পথ অনুসরণ করবে কিনা লড়াই চালিয়ে যাবেÑ এমন দোদুল্যমান আমাদের মনের অবস্থা। ১১ চক্কর শেষ, তখনও জাপান, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার প্রতিযোগীদের গা ঘেঁষে মুবারক শাহ দৌড়াচ্ছে। লম্বা লম্বা স্ট্রাইডের সাথে গতিটাও একটু বাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। গ্যালারির সবাই টেনশনে দাঁড়িয়ে গিয়ে নিজ নিজ দেশের প্রতিযোগীদের উৎসাহ দিচ্ছিল। চরম উত্তেজনায় আমরাও দাঁড়িয়ে সাবাস মোবারক, সাবাস মোবারক বলে চিৎকার করে উৎসাহ যোগাচ্ছিলাম।  নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মাঠ মুখরিত হয়ে উঠেছিল। শেষ ল্যাপটা ছিল দেখার মত। জাপান, ভারত, না পাকিস্তানÑ কে সোনা জয় করবে? ট্র্যাকের শেষ বাঁকটা ঘুরতেই মুবারক শাহকে মনে হলো সে একজন ১০০ মিটারের স্প্রিন্টার। দর্শনীয় এক ফিনিশিং। টোকিও এশিয়ান গেমসে (১৯৫৮) ৩০০০ মিটার স্টেপল চেজ ইভেন্টের (৯.০৩.০ সেকেন্ড)  রেকর্ড গড়া মুবারক শাহ ৫০০০ মিটার দৌড়ে প্রথম হয়ে পাকিস্তানের জন্য প্রথম স্বর্ণপদক উপহার দিয়েছিল। জাপানের সবুরো ইউকোমিজো সিলভার এবং ভারতের তারলোক সিং ব্রোঞ্চ পদক পেয়েছিল। উহ! সেকি উত্তেজনা, সেকি আনন্দ মুহূর্ত, মনে রাখার মতই ছিল সেদিনের শেষ বিকালটা।
ফুটবল খেলা দেখাটা ছিল আমাদের জন্য আনন্দের। সারাদিন বিভিন্ন মাঠে বিভিন্ন খেলা দেখে কান্ত হয়ে রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতাম। কাপড়-চোপড় পরে ডিনার সেরে ফুটবল স্টেডিয়ামে যেতাম। যাওয়ার সময় ডাইনিং হল থেকে কলা-কমলা-সফেদা আর জুসের বোতল নিয়ে যেতাম। ইয়াং ছেলে-মেয়েদের পেছনের বেঞ্চে গিয়ে  বসতাম, সাথে নিয়ে যাওয়া ফল এবং জুসের বোতলগুলো পাশে জড়ো করে রাখতাম। আমাদের কথাবার্তা শুনে ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারতো আমরা বিদেশী এবং পাকিস্তানী খেলোয়াড়, তখন আমাদের সাথে আলাপ করতে আগ্রহী হয়ে উঠতো। এভাবেই ফুটবল খেলা দেখা আর আড্ডা মারা দুটোই চলতো। হাফ টাইমের সময় সবাই মিলে ফল-জুসের সদ্ব্যবহার করতাম। এ ব্যাপারটা অনেকটা নিয়মিত হয়ে গিয়েছিল। নতুন নতুন ছেলেমেয়েদের সাথে পরিচয়, গল্প-গুজব আড্ডা সব মিলিয়ে সময়গুলো বেশ আনন্দেই কেটে যাচ্ছিল।
সেদিন রাতে ছিল (২৭-৮-৬২) ভারত বনাম জাপান ফুটবল খেলা। বিকেলে মুবারক শাহের স্বর্ণজয়ের আনন্দ রেশ তখনও কাটেনি। খুশী খুশী মন নিয়ে খেলা দেখতে আমরা সেনাজান মেইন স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়েছিলাম। ভারতীয় ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন চুনী গোস্বামী (যার সাথে সাক্ষাতের কথা আগের সংখ্যায় উল্লেখ করেছিলাম) পিকে ব্যানার্জী তারা বাঙালী। বাঙালী হিসেবে মনের একটা টান থাকা স্বাভাবিক। ভারতীয় ফুটবল দলের সমর্থক হয়ে গিয়েছিলাম এবং ম্যাচের পুরো সময়টা গ্যালারিতে বসে তাদের উৎসাহ দিচ্ছিলাম। জাপান বেশ শক্তিশালী দল। ভারতীয় দলের পুরো লাইন-আপ আমার মনে নেই; তবে তাদের রক্ষণভাগ খুব শক্তিশালী। গোলরক্ষক ধনরাজ, লম্বা-চওড়া গোলবারের নিচে মানানসই গোলকিপার।
ফুল ব্যাক দুজন আজিজ এবং লতিফ, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং তৎপর। স্টপার জার্নাল সিং লম্বা-ছিপছিপে গড়ন, তার মাথার ওপর দিয়ে হেড করে বল নেয়া বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের জন্য খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। বল নিয়ে দ্রুতগতিতে লাইন ধরে ছোটা পিকে ব্যানার্জীর সে দৃশ্যটাই চোখে ভাসে। যার খেলা দেখার জন্য সেই ভিক্টোরিয়া কাবে খেলার সময় থেকে অপেক্ষা করে আসছিলামÑ সে হলো দলের ক্যাপ্টেন চুনী গোস্বামী। ক্যাপ্টেনের মতই মাঠে তার ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছিল। লম্বা লম্বা স্ট্রাইডে দৌড়ানো, লম্বা লম্বা পাস, ছিমছাম খেলা। আমাকে বেশ ইম্প্রেস করেছিল তার খেলা। আরও একজনের খেলার কিছু কিছু অংশ আজও আমার চোখে আটকে আছে, সে হলো ভারতের রাইট ইন বলরাম, ছোটখাট রোগা-পাতলা খেলোয়াড়টির বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ দেখে আমার খুব ভাল লেগেছিল। তাছাড়া তার বল কাটানো, ছোট ছোট নিখুঁত পাস আমাকে খুবই চমৎকৃত করেছিল সে রাতের ম্যাচে। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ খেলাকে বেশ উপভোগ্য করেছিল। উত্তেজনাপূর্ণ খেলায় শেষ পর্যন্ত ভারত ২-০ গোলে জাপানকে পরাজিত করেছিল।
২৮-৮-৬২ বিকেলে আল্লাদিত্তার পোল্ডভল্ট ইভেন্ট। অন্যান্য ডিসিপ্লিনের পাকিস্তানী খেলোয়াড়দের সাথে আমরাও যোগ দিয়েছিলাম আল্লাদিত্তীকে উৎসাহ যোগানোর জন্যে। পোল্টভল্ট খুব স্লো ইভেন্ট, অনেক সময় নিয়ে চলে।  অন্যদিকে মেয়েদের জেভলিন থ্রো ফাইনাল যার ইন্দোনেশিয়া ভাষায় লেমপার লেমবিং ওয়ানিতা, ওয়ানিতা মানে হলো মেয়ে আর ছেলে/পুরুষকে তাদের ভাষায় প্রিয়া বলা হয়। এই দুটো ভিল্ড ইভেন্ট অনেকক্ষণ ধরে চলে বিধায় ট্র্যাকে ১৫০০ মিটার দৌড়ের প্রস্তুতি।
পাকিস্তানের ফারুক খান এবং আনার খান ১৫০০ মিটার দৌড়ে অংশ নিয়েছিল। ফারুক খান এ ইভেন্টের সম্ভাবনাময় অ্যাথলেট। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারতের মহেন্দ্র সিং স্বর্ণ এবং আম্রিত পাল রৌপ্য পদক পেয়ে পাকিস্তানীদের না পাওয়ার কষ্টটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্রোঞ্চ পদক পেয়েছিল জাপানের সাতসাউ ইওয়াসহিতা। আল্লাদিত্তাকে শেষ পর্যন্ত ব্রোঞ্চ পদক পেয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। রাতের ফুটবল ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। স্বাগতিক ইন্দোনেশিয়া বনাম মালয়। মহিলা-পুরুষ এসেছিলেন তাদের দেশকে সমর্থন জোগাতে। এখানকার মহিলারা ফুটবল ভাল বোঝেন। উত্তেজনায় ভরপুর ম্যাচ খুবই উপভোগ্য হয়েছিল। কখনও ইন্দোনেশিয়া আক্রমণে তো পরমুহূর্তে মালয় আক্রমণে। দু’দলই ছোট ছোট পাশে খেলছিল। দু’দলেই চমৎকার বোঝাপড়া নিজেদের মাঝে। ইন্দোনেশিয়া গোল করে তো মালয় শোধ করে। মালয় গোল করে তো ইন্দোনেশিয়া শোধ করে। শেষ পর্যন্ত স্টেডিয়াম ভর্তি ইন্দোনেশিয়ান সমর্থকদের হতাশায় ডুবিয়ে মালয় ৩-২ গোলে জয়লাভ করেছিল। পরদিন অর্থাৎ ২৯-৮-৬২ তারিখে মালয় দক্ষিণ ভিয়েতনামের কাছে ৩-০ গোলে পরাজিত হয়েছিল এবং ইন্দোনেশিয়া ফিলিফাইনের বিরুদ্ধে ৬-০ গোলে জয়লাভ করে মালয়ের সাথে পয়েন্ট তালিকায় সমতা এনেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গোল এভারেজে মালয়কে টপকাতে পারেনি।
২৯-৮-৬২ তারিখে অ্যাথলেটিক্স  প্রোগ্রাম ছিল সারাদিনের। সকালের পর্বে ডেকাথেলন ইভেন্টগুলোর প্রতিযোগিতা হয়েছিল। বিকেলের পর্ব শুরু হয়েছিল স্থানীয় সময় বিকেল ৪টায় এবং ম্যারাথন দৌড়ের মাধ্যমে। জাপানের দুজন প্রতিযোগী মাসায়ইউকি নাগাটা ও টাকাইউকি নাকাও, ইন্দোনেশিয়ার দুজন ইসমাইল আবেদী ও গুরুনাম সিং, দক্ষিণ কোরিয়ার দুজন লী সান হুন ও কিম ইয়ান বাম, বার্মার দুজন সুমবুইগাম ও মাইটুং নাও, পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইউসুফ এবং অন্য দেশের আরও কয়েকজন প্রতিযোগী সাড়ে ১৯ মাইল বা ৪২ কিলোমিটার রোড রানিং/ম্যারাথন স্টেডিয়ামের ভেতর থেকে দৌড় শুরু করেছিল। লম্বা সময় ধরে এই দৌড় চলবে। এর ফাঁকে আরও একটি আকর্ষণীয় ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০ মিটার দৌড়। পাকিস্তানের ১০০ এবং ২০০ মিটার দৌড়ের রেকর্ডধারী (১৯৫৮ এ. গে.) ¯িপ্রন্টার মোহাম্মদ খালিক, ১০০ মিটার ¯িপ্রন্টে এবার ব্যর্থ হয়েছিল। ২০০ মিটার দৌড়ে জয়লাভ করে ব্যর্থতার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ ছিল এটা। ১০০ মিটার দৌড়ের সোনাজয়ী ইন্দোনেশিয়ার মোহাম্মদ সারেংগাতও এ ইভেন্টে অংশ নিচ্ছিল।
জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার সম্ভাবনা, চরম উত্তেজনা নিয়ে আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। এবার হয়তো খালিক মোহাম্মদ সারেংগাতকে হারিয়ে প্রতিশোধ নেবে। রিভলবারের আওয়াজ, ২০০ মি. দৌড় শুরু, গ্যালারিশুদ্ধ মানুষের চিৎকার, যে যার প্রতিযোগীকে উৎসাহ দিচ্ছেন। প্রতিযোগীরা ট্র্যাকের বাঁক ঘুরে সোজা ফিনিশিং টেপের দিকে, সবাই একই সারিতে দৌড়ে আসছিল। দৌড় শেষ। মালয়ের প্রতিযোগী মনিকাভাষাগাম জাগাথেসান স্বর্ণ বিজয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। সিলভার পেয়েছিল জাপানের হিডিও ইজিমা এবং মোহাম্মদ সারেংগাতকে ব্রোঞ্চপদক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। এ প্রতিযোগিতায় জাপানের মহিলা অ্যাথলেট কেইকো মুরাসি  স্বর্ণপদক  ও তাদেরই আর এক প্রতিযোগী সেইকো ওবোনাই সিলভার পেয়েছিল এবং ফিলিপাইনের কোসেফাইনডি লা ভিনা ব্রোঞ্চ মেডেল পেয়েছিল। তারপরই পুরুষদের শটপট যা ইন্দোনেশিয়ান ভাষা টোলাক পেলোরু অনুষ্ঠিত হয়েছিল; যাতে পাকিস্তানের প্রতিযোগী মালিক নূর এবং হায়দার খান অংশগ্রহণ করেছিল। এ ইভেন্টেও পাকিস্তান ব্যর্থ। জাপানের ইটোকাওয়া স্বর্ণপদক আর ভারত সিলভার এবং ব্রোঞ্চ দুটোই পেয়েছিল তাদের শটপুটার দিনশ ইরানী এবং জগিন্দার সিং। পুরুষদের লংজাম্প/লোমপাট ডি জাউহ, আমার প্রিয় ইভেন্ট। স্কুল, কলেজ, প্রভিন্স সব প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম । পাকিস্তানের মোহাম্মদ খান এবং ইফতেখার শাহ লং জাম্প ইভেন্টে অংশ নিয়েছিল। তারাও ব্যর্থ। পাকিস্তানীদের জন্য কোনো জায়গা থেকে কোনরকম সুসংবাদ আসছিল না, সবাই হতাশাগ্রস্ত। স্টেডিয়ামে আমরা যখন ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড প্রতিযোগিতা দেখতে ব্যস্ত, তখন রাস্তায় ম্যারাথন দৌড় চলছিল।  সে সময় আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে স্টেডিয়ামের জায়ান্ট স্ক্রিনে ম্যারাথন দৌড়ের চিত্র ফুটে উঠতো না, তবে স্কোরবোর্ডে দৌড়বিদদের অবস্থান, কত মাইল দূরত্ব অতিক্রম করেছে, কে কে দৌড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেÑ এগুলো কিছুক্ষণ পরপর স্কোরবোর্ডে দেখানো হতো। যদি কোন ম্যারাথন রানার দৌড় থেকে সরে দাঁড়াতো আর সেটা স্কোরবোর্ডে দেখানো হতো, সঙ্গে সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ান ছেলেমেয়েরা যাতুক যাতুক বলে চিৎকার করতো। স্কোরবোর্ডে যখনই ম্যারাথন সম্বন্ধে লেখা উঠতো, বুকের ভেতর কেমন জানি শংকা জেগে উঠতো। মোহাম্মদ ইউসুফের নাম সেখানে দেখতে না পেয়ে বেশ খুশী লাগতো। এরই ফাঁকে মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ের জমজমাট ফাইনাল দেখতে পেয়েছিলাম। ফিলিফাইনের মেয়ে মোনা সুলাইমান স্বর্ণপদক পেয়ে তার দেশের মান রেখেছিল। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল জাপানের ইকুকোইয়োদা এবং তাকুকো ইলোকুচি।
শেষের দিকে ম্যারাথন দৌড়, তখনও মোহাম্মদ ইউসুফ দৌড়াচ্ছে, বেশ ভাল লাগছিল, গর্বও হচ্ছিল। মাসাইউকি নাগাতী (জাপান) স্টেডিয়ামে ঢোকার সাথে সাথে স্টেডিয়ামের সব দর্শক দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত এবং অভিনন্দন জানিয়েছিল। সে সময় তালে তালে হাত তালির মিষ্টি আওয়াজ স্টেডিয়ামের পরিবেশকে মোহনীয় করে তুলেছিল।
তারপরই স্টেডিয়ামে ঢুকেছিল মোহাম্মদ ইউসুফ। যদিও দ্বিতীয় স্থান, সিলভার মেডেল; তারপরও শেষ বিকেলে তার জন্য আমরা গর্ববোধ করেছিলাম। ব্রোঞ্চ পেয়েছিল বার্মার মাইজুং নাও। ম্যারাথনের পুরস্কার বিতরণের মধ্য দিয়ে সেদিনের অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা সমাপ্ত হয়েছিল।
নাগাতি ফিনিশিং ল্যাপ দিচ্ছিল, এরই মধ্যে স্টেডিয়ামে ঢুকেছিল মোহাম্মদ ইউসুফ। পাকিস্তানী সমর্থকরা যারা এতক্ষণ হতাশ হয়ে বসেছিলেন, সবাই দাঁড়িয়ে সবার সাথে হাততালি দিয়ে তাদের খুশী প্রকাশ করছিলেন। ব্রোঞ্জ পেয়েছিল বার্মার মাইজুং নাও। মোহাম্মদ ইউসুফের সিলভার মেডেলটি সেদিন পাকিস্তানীদের প্রচুর আনন্দ দিয়েছিল। আমরা সে বিকেলে মোঃ ইউসুফের জন্য গর্ব অনুভব করেছিলাম। ম্যারাথনের পুরস্কার বিতরণের মধ্য দিয়ে সেদিনের অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা সমাপ্ত হয়েছিল।

 (তেতাল্লিশ)
৩০-৮-৬২ অ্যাথলেটিক্স কম্পিটিশনের শেষ দিন। সকালের পর্বে ডেকাথলন ইভেন্টগুলোর ফাইনাল হয়ে গেলে বিকেলের পর্ব শুরু হয়েছিল ৮০০ মিটার দৌড় দিয়ে। পাকিস্তানের আনার খান এবং ফারুক খান তাদের শেষ চেষ্টা চালিয়েছিল এই ইভেন্টে। এখানেও তারা সফল হতে পারেনি। জাপানের মামোরু মোরিমোটা স্বর্ণ পেয়েছিল এবং রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছিল ভারতের দয়ালসিং এবং আম্রিত পাল। মুবারক শাহ অ্যাথলেটিক্সের শেষ দিনে ৩০০০ মিটার স্টেপল চেজ ইভেন্টে স্বর্ণ জয় করে পাকিস্তানীদের মুখে আর একবার হাসি ফুটিয়েছিল। এই ইভেন্ট তার নিজের ইভেন্ট। ১৯৫৮ সালের এশিয়ান গেমসে সে ৯.০৩.০ সেকেন্ডে দৌড়ে রেকর্ড করেছিল এই ইভেন্টে আর এবার সে তার নিজস্ব রেকর্ড ভেঙ্গে ৮.৫৭.৯০ সেকেন্ড  দৌড়ে নতুন রেকর্ড গড়ে প্রথম স্থান অুন্ন রেখেছিল। সাবুরো ইয়াকুমিকো সিলভার ও জেনজি ওয়াকুয়া জাওয়া ব্রোঞ্জ পেয়েছিল আর এ দুজনই ছিল জাপানের। ৫০০০ মিটার দৌড়েরও গত ২৯/৮/৬২ তারিখে মুবারক শাহ জাপানের দৌড়বিদ ও. ইনোউই-এর ১৯৫৮ সালে গড়া ১৪.৩৯.৪ সেকেন্ড রেকর্ডটি ভেঙ্গে ১৪.২৭.২ সেকেন্ডে  দৌড়ে নতুন রেকর্ড গড়ে পাকিস্তানের জন্য প্রথম স্বর্ণ এনে দিয়েছিল। ১৯৬২ সালের জাকার্তা এশিয়ান গেমসে পাকিস্তানী অ্যাথলেটদের চরম ব্যর্থতায় অ্যাথলেটিক্সে পাকিস্তানের অর্জন মাত্র দুটো স্বর্ণপদক, যার দুটো পদকই এসেছিল ১৯৩০ সালের ২৪ জুন তারিখে পাঞ্জাবে জন্মগ্রহণকারী র্৫-র্৭র্  লম্বা ছিপছিপে গড়নের মুবারক শাহের একক সাফল্যে।
অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় দুটি ইভেন্টের মধ্য দিয়ে ১৯৬২ সালের এশিয়ান গেমস, অ্যাথলেটিক্স কম্পিটিশনের সমাপ্তি টানা হয়েছিল। প্রথমটি ছিল মেয়েদের ৪ী১০০ মিটার রিলে যাকে ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় লারি বেরান্টিং (ওয়ানিটা) বলে। ফিলিপাইন এ ইভেন্টে স্বর্ণপদক অর্জন করেছিল। তাদের টিমের সদস্যরা ছিল ১। মাসেলা আলোঞ্জো, ২। আইদাদ মলিনোস, ৩। নেলি রেস্টার এবং ৪। ফ্যান্সিস্কো সানোপাল।
শেষেরটিও ছিল ৪ী১০০ মিটার রিলে (পুরুষ) লারি বেরান্টিং-(প্রিয়া) এই ইভেন্টেও ফিলিপাইন স্বর্ণজয়ের মাধ্যমে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছিল। তাদের টিমের সদস্যগণ ছিল ১। এনরিক বাউ তিস্তা, ২। বিন্নি আই ই ব্রো, ৩। আইজ্যাক এম গোমেজ, ৪। আর সেনিও জাজমিন। জাপান রৌপ্য পেয়েছিল এবং মালয় পেয়েছিল ব্রোঞ্জ।
৩০ তারিখে রাতের ফুটবল খেলায় দক্ষিণ কোরিয়া জাপানকে ১-০ গোলে এবং ভারত থাইল্যান্ডকে ৪-১ গোলে পরাজিত করলে এ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ কোরিয়া, রানার্সআপ ভারত, তৃতীয় স্থানে জাপান এবং চতুর্থ স্থান পেয়েছিল থাইল্যান্ড। বি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল দক্ষিণ ভিয়েতনাম। মালয় ও ইন্দোনেশিয়ার পয়েন্ট সমান ৪ করে হলে (মালয় ৩-২-০-১-১৮-৬-৪ এবং ইন্দোনেশিয়া ৩-২-০-১-৯-৩-৪) গোল এভারেজ ১২-৬ ব্যবধানে মালয়কে রানার্সআপ এবং ইন্দোনেশিয়া তৃতীয় ও ফিলিপাইন চতুর্থ হয়েছিল।
ইন্দোনেশিয়ার প্রেক্ষাগৃহে ভারতীয় হিন্দি ছায়াছবি, অবাক হবারই কথা, আমরাও হয়েছিলাম। তবে খুশীও হয়েছিলাম; কারণ ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে মার্শাল ল’ হওয়ার পর ভারতীয় ছায়াছবি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি টিভি চ্যানেল, সিডি, ডিভিডি ইত্যাদি সে সময় এগুলো ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার । শুধুমাত্র প্রেক্ষাগৃহে ছবি প্রদর্শিত হতো। আমরা চারজন মুক্তা ভাই, আবুল, জাহিদ ও আমি একদিন দুপুরের শোতে সিনেমা হলে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। সিনেমা হলের নাম মনে নেই, তবে ছায়াছবিটি ছিল রাজকাপুর ও নার্গিস অভিনীত জোকার। যার একটি গান খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল সে সময় ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানী, প্যান্ট ইংলুস্তানী, টোপি রুমি আর দিল হ্যায় হিন্দুস্তানী’।  স্টেডিয়ামে যেমন মেয়েদের জটলা খুঁজে তাদের পেছনে বসতাম, তেমনি টিকিট করে হলে ঢুকে চার-পাঁচজন মেয়ে এক জায়গায় বসেছিল, আমরাও তাদের পেছনের সিটে গিয়ে বসেছিলাম। দর্শক খুব বেশি না হওয়ায় এভাবে বসা সম্ভব হয়েছিল। আমাদের চেহারা বিশেষ করে আমাদের নাক ইন্দোনেশিয়ানদের থেকে পৃথক করে দিত, যার দরুন আমাদেরকে বিদেশী ভেবে তারা আলাপ করতে আগ্রহী হতো। আর পাকিস্তানী জানতে পারলে একটু বেশি উৎসাহী হয়ে উঠতো। সিনেমা হলেও এমনই পরিস্থিতি হয়েছিল। আমাদের কথাবার্তা এবং গায়ের ব্লেজার দেখে মেয়েরা জেনে গিয়েছিল যে, আমরা পাকিস্তানী খেলোয়াড়, বারবার পেছন ফিরে তাকিয়ে তাদের ভাষায় কি যেন বলার চেষ্টা করছিল, নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিল। আমরাও মজা পাচ্ছিলাম।  মেয়েরা খোলা চুল তাদের সিটের পেছনে ছেড়ে বসেছিল, আমাদের মধ্যে কে যেন চুল ধরে টান দিতেই উহ্ করে উঠেছিল একটি মেয়ে আমরা ভেবেছিলাম ঝগড়া-টগড়া করবে কিন্তু মেয়েটা পেছন ফিরে আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে চুলটা টেনে নিয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আবার চুল সিটের পেছনে ছেড়ে দিয়েছিল; তার সাথে অন্য মেয়েরাও চুল সিটের পেছনে ছেড়ে বসে দুষ্টুমি করছিল আর আমরা চুল ধরে টান দিচ্ছিলাম, ওরা চুল ছাড়িয়ে নিচ্ছিল। একদিকে রাজকাপুর ও নার্গিসের রোমান্স, অন্যদিকে  মেয়েদের চুলের খেলাÑ এরই মধ্যে ‘ঞঐঊ ঊঘউ’. খুব তাড়াতাড়ি ছবিটি শেষ হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল সেদিন। হল থেকে বের হয়ে সোজা ভিলেজে। সাতচল্লিশ বছর তিন মাস পর সিনেমা হলের সেই দুষ্টুমির কথা লিখতে গিয়ে ভীষণ হাসি পাচ্ছে, ভাল লাগছে।
ফুটবলের দুটো সেমিফাইনাল একইদিনে (১-৯-৬২) অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর দুটো সেমিফাইনালই চরম উত্তেজনাপূর্ণ এবং প্রচন্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়া ২-১ গোলে মালয়কে হারাতে প্রচুর ঘাম ঝরাতে হয়েছিল;অন্যদিকে ভারতকে রীতিমত লড়াই করে ৩-২ গোলে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে হারিয়ে নিজেদেরকে ফাইনালে স্থান করে নিতে হয়েছিল।
গেমস কর্মসূচির মধ্যে ২ সেপ্টেম্বরের বিকেলে রাখা হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎকার। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ক্রীড়াবিদ এবং অফিসিয়ালদের সাথে তিনি তার প্রাসাদে সাক্ষাৎ করবেন। লাঞ্চ সেরে আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত বাসে চেপে প্রাসাদে গিয়েছিলাম।ভলেজ থেকে বেশ দূরেই প্রাসাদ; কারণ বাস অনেকক্ষণ চলার পর পৌঁছেছিল। ওপেনিং সেরিমনির পূর্বে স্টেডিয়ামের বাইরে যেরকম অপেক্ষা করতে হয়েছিল, তেমনি প্রাসাদের বাইরে আমাদেরকে বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। প্রতিটি দেশ আলাদাভাবে দাঁড়িয়েছিল, প্রাসাদে ঢোকার সময় একটি লাইনে এক এক করে ঢুকতে হচ্ছিল; কারণ দেহ তল্লাশি। তারপর বিরাট একটি হল রুম, যেখানে প্রেসিডেন্ট সুকর্ন দাঁড়িয়ে প্রত্যেকের সাথে হ্যান্ডশেক করছিলেন। তার সাথে হ্যান্ডশেক করার সাথে সাথে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার কষ্ট, বিরক্তি সব নিমিষে উধাও হয়ে গিয়েছিল, চোখের সামনে মহান এক রাষ্ট্রনায়ককে দেখছিলাম। সুঠাম দেহের অধিকারী। চেহারায় হাল্কা বসন্তের চিহ্ন, কঠিন ব্যক্তিত্বের ছাপ চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল যা আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। বেশি সময় সেখানে অবস্থান করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, চা-নাস্তা খেয়ে আমরা ভিলেজে ফিরে এসেছিলাম।
এশিয়ান গেমসের অন্যতম আকর্ষণীয় খেলা ছিল হকি। বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তানের কাছে। দেশ বিভাগের পূর্বে বিশ্ব হকির একক আধিপত্য ছিল ইন্ডিয়ার। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে হকির কর্তৃত্বের ওপর পাকিস্তান ভাগ বসাতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। অলিম্পিক কিংবা এশিয়ান গেমসÑ যেখানে হকি, সেখানেই পাকিস্তান-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বী। বারবার ভারতীয় হকির রাজত্বে হানা দিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৮ সালে টোকিও এশিয়ান গেমসে পাকিস্তান সফল হয়েছিল। ভারতকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিল। ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকেও চ্যাম্পিয়ন হয়ে পাকিস্তান তার আসনকে শক্ত করেছিল। ভারত তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে যেমন মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তেমনি পাকিস্তান তার কষ্টে অর্জিত গৌরবকে ধরে রাখতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছিল। সুতরাং এই এশিয়ান গেমস হকির স্বর্ণজয় ছিল ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের জন্য মরণপণ লড়াই।
জাকার্তা এশিয়ান গেমসে ৯টি হকি দল অংশগ্রহণ করেছিল। দুটি  গ্রুপে দলগুলোকে বিভক্ত করা হয়েছিল। এ গুপে-পাকিস্তান, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, সিলোন এবং সিঙ্গাপুর। বি গ্রুপ- ভারত, মালয় (মালয়েশিয়া), দক্ষিণ কোরিয়া এবং হংকং। ভারত মালয়কে ৩-০ গোলে, হংকংকে ৪-০ গোলে এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে ৫-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন এবং মালয় রানার্সআপ হয়েছিল। ‘এ’ গ্রুপ থেকে পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন এবং জাপান রানার্সআপ হয়েছিল। সেমিফাইনালে ভারত জাপানকে ৭-০তে পরাজিত করে ফাইনালে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিল।
৩-৯-৬২ সকালে হকির লুজিং সেমিফাইনালিস্ট মালয় এবং জাপান তৃতীয় স্থানের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মালয় ১-০ গোলে জাপানকে পরাজিত করে তৃতীয় হয়ে ব্রোঞ্জ মেডেল অর্জন করেছিল।
৩-৯-৬২ তারিখে ফুটবলের তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলায় মালয় এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম অংশগ্রহণ করেছিল। শক্তিশালী দক্ষিণ ভিয়েতনাম টিমের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল তারা সেমিফাইনালেই তাদের সেরা খেলা শেষ করে দিয়েছিল। মালয় ৪-১ গোলে দ. ভিয়েতনামকে পরাজিত করে ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছিল।

(চুয়াল্লিশ)
হকি ফাইনাল। ৩ সেপ্টেম্বর ’৬২-র বিকেল। সেনাজান হকি স্টেডিয়াম। প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি টিম,  পাকিস্তান-ইন্ডিয়া। যেখানে পাকিস্তান-ইন্ডিয়া, সেখানেই উত্তেজনা, খেলার পূর্বেই দর্শকে পরিপূর্ণ স্টেডিয়ামটি দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়েছিল সেদিন। একধার থেকে নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর ধ্বনি; অন্যধার থেকে বন্দে মাতরম ধ্বনিতে মাঠ প্রকম্পিত হচ্ছিল। এরই মধ্য দিয়ে খেলা শুরু হয়েছিল। মাঠের ভেতর খেলোয়াড়দের মাঝে যেমন টেনশন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, তেমনি গ্যালারিতে টিম অফিসিয়াল এবং সাপোর্টার সবাই টেনশনে ভুগছিল। প্রথমদিকে দুটি টিমই লম্বা লম্বা হিট করে খেলছিল, বল রিসিভ করার আগ্রহ কারো মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল না। হিটগুলো মাঠ অতিক্রম করে অন্যধারের গোললাইন পার হয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানের পক্ষে ফুলব্যাক আতিফ কিংবা মুনীর দার হিট মারছে তো অন্যদিক থেকে গোলে হিট মারছে প্রিতপাল সিং। বল ধরে খেলার কেউ চেষ্টা করছিল না। বল ফসকে বিপক্ষ দলের কাছে চলে গেলে একটি আক্রমণ হতে পারে, একটি বিপদ হতে পারেÑ এটাই ছিল শংকা। খেলা কিছুক্ষণ এভাবে এগিয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে দু’টিমই সেটেল হয়ে আসছিল এবং স্বাভাবিক খেলায় ফিরে এসেছিল। দু’দলই একই পদ্ধতি অর্থাৎ দুই ফুলব্যাক, তিন হাফ এবং পাঁচ ফরোয়ার্ড নিয়ে খেলছিল (এ পদ্ধতিতেই সে সময় খেলা হতো)। দু’দলেই ছিল হাই স্কিল্ড পৃথিবী সেরা সব হকি খেলোয়াড়। তাদের ব্যক্তিগত এবং দলগত নৈপুণ্যে সেদিনের ফাইনাল খেলাটি হয়ে উঠেছিল আকর্ষণীয় এবং সবার কাছে উপভোগ্য। নিখুঁত পাস আর দলীয় সমঝোতার ওপর ভিত্তি করে টিমের খেলোয়াড়রা যখন আক্রমণে একসাথে এগিয়ে যেতো, সেটা ছবির মত মনে হতো।
যখন ডানদিক দিয়ে কোন দল আক্রমণ চালাত, তখন সে টিমের রাইট-হাফ, রাইট-ইন এবং রাইট আউট ট্রায়ো নিজেদের মধ্যে নিখুঁত পাস এবং সমঝোতার মাধ্যমে বল দেয়া-নেয়া করে একসাথে এগিয়ে যাওয়াটাকে মনে হতো ছকে আঁকা। অনুরূপভাবে বামদিকের ট্রায়ো দিয়ে আক্রমণকে মনে হতো একটি টিমের বাম ডানা উড়ে চলেছে। সেন্টার হাফ তার ট্রায়ো রাইট-ইন, লেফট ইন এবং সেন্টার ফরোয়ার্ডকে নিয়ে মাঝ মাঠ দিয়ে যখন কোন টিম আক্রমণ চালাতে এগিয়ে যেত, তখন মনে হতো একটি রাজহাঁস তার দুই বাহু মেলে বিপক্ষ দলের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। খেলা দেখছিলাম আর মনে মনে বলছিলামÑ সত্যি, হকি একটি সুন্দর খেলা। দু’দলেই পাঞ্জাবি খেলোয়াড় বেশি থাকায় মাঠে পাঞ্জাবি ভাষায় হুংকার শোনা যাচ্ছিল, ‘আন দে, ছাট দে’ ইত্যাদি। পাকিস্তানের আতিফ কিংবা মুনীর দার, প্রখ্যাত ফুলব্যাক, শর্ট কর্নার মারার দক্ষ খেলোয়াড়, ভারতের প্রিতপাল সিং, একজন সফল শর্ট কর্নার শুটার, বিশ্ব হকিতে তার সুনাম ছিল। তাই শর্ট কর্নারের বাঁশি বাজলে মাঠে খেলোয়াড়দের চেয়ে আমরা যারা বাইরে বসে খেলা দেখছিলাম, তাদের বুকের স্পন্দন বেড়ে যেত। আল্লা-খোদার নাম জপ করতে শুরু করে দিতাম। পাকিস্তান ডানদিক দিয়ে আক্রমণ চালাতো এবং বামদিক দিয়ে ফিনিশ করতোÑ এটাই পাকিস্তানের আক্রমণ স্ট্র্যাটেজি। ছোটখাটো নাসির বুন্দা, অসাধারণ বলের ওপর তার কন্ট্রোল, মাঝে মাঝে মতিউল্লাহর উদ্দেশে যে থ্র্রু পাসগুলো দিচ্ছিলÑ তা দেখার মত। মতিউল্লাহর লম্বা লম্বা স্টেপে ছুটে গিয়ে বল ধরে ক্রশ করাও ছিল দেখার মত। মতিউল্লাহ প্রায় সময়ই বল নিয়ে তার লাইন ধরে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ কাট-ইন করে দ্রুত ডি’র কাছাকাছি এসে ওয়াহিদের উদ্দেশে বল পাস দিয়ে ভারতীয় ডিফেন্সকে হকচকিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু ভারতীয় ডিফেন্স অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সে আক্রমণগুলো মোকাবিলা করছিল এবং সেই সাথে একইরকম আক্রমণ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও শানাচ্ছিল। চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মত সব আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ, মিনিটে মিনিটে খেলার ধারা বদলাচ্ছিল, প্রতি আক্রমণে গোলের সম্ভাবনা, চরম উত্তেজনা। পাকিস্তান টিমের ডানদিক দিয়ে একটি সংঘবদ্ধ আক্রমণ, নূর আলমের রাইট ফ্যাংক থেকে সজোরে ক্রশ, সেন্টার ফরোয়ার্ড ওয়াহিদ ডি’র ভেতর দু’তিনজন ভারতীয় ডিফেন্সের ফাঁক দিয়ে ঢুকে স্টিকে আলতো প্লেসিং, গোল, গোল চিৎকার। পাকিস্তান শিবির থেকে নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর ধ্বনি, তার সাথে ‘জিতেগা ভাই জিতেগা-পাকিস্তান জিতেগা’ সুর করে পাকিস্তানী সমর্থকরা মাঠ গরম করে তুলেছিল।
পাকিস্তান ১-০ গোলে এগিয়ে গেলে মাঠের ভেতর খেলোয়াড়দের মাঝে উত্তেজনা বেড়ে গিয়ে কিছুটা রাফ খেলার দিকে চলে গিয়েছিল। একসময় পাকিস্তানের সেন্টার হাফ আনোয়ার আহমেদ খানের স্টিকের আঘাতে ভারতীয় সেন্টার ফরোয়ার্ডকে মাঠের বাইরে চলে যেতে হয়েছিল। এতে খেলার সৌন্দর্য কিছুটা নষ্ট হলেও খেলার গতি আগের মতই ছিল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের ধারাটা বজায় ছিল। খেলায় উত্তেজনা থাকলেও বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। খেলা শেষ হয়েছিল ওয়াহিদের দেয়া আরেক গোলের সুবাদে পাকিস্তান ২-০ গোলে ভারতকে পরাজিত করার মাধ্যমে।
ভারতীয় দলের গোলরক্ষক লাক্সমানের দৃঢ়তাপূর্ণ খেলা সবার দৃষ্টি কেড়েছিল। ১৯৬৬ সালে এশিয়ান গেমসে ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন হয়েছিলেন। ফুলব্যাক প্রিতপাল সিং পৃথিবীর সেরা ফুলব্যাকদের অন্যতম। ১৯৬০, ৬৪ ৬৮ অলিম্পিক খেলেছেন, অর্জুন এওয়ার্ড এবং পদ্মশ্রী পুরস্কার পেয়েছেন। ভারতের আরো কয়েকজন খেলোয়াড়ের খেলা আমার কাছে খুব ভাল লেগেছিলÑ যেমন চরণজিত সিং, গুড়দেব সিং প্রমুখ। পাকিস্তান টিমের সব খেলোয়াড়ের সাথে হকি ক্যাম্পে খেলার সুযোগ আমার আগেই হয়েছিল; তবে ফাইনাল খেলায় মুনীর দার, হাবিব আলী কিড্ডি (লেফট হাফ নায়কের মত চেহারা, কটা চোখ) আবদুল ওয়াহিদ, নাসির বুন্দা, মতিউল্লাহ এদের খেলা আমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। নৈপুণ্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, উত্তেজনা,  রোমাঞ্চ দিয়ে সাজানো ফাইনাল ম্যাচটি আমার জীবনে দেখা স্মরণীয় খেলা।
ভারত হকিতে রৌপ্য এবং মালয় ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিল। ৪। জাপান, ৫। ইন্দোনেশিয়া, ৬। সাউথ কোরিয়া, ৭। হংকং, ৮। সিলোন (শ্রীলংকা) এবং ৯। সিঙ্গাপুর।
পাকিস্তান টিমে ফাইনাল যারা খেলেছিল : জাকির হোসেন, আতিফ ও মুনীর দার, গোলাম রসুল, আনোয়ার আহমেদ খান ও হাবিব আলী কিড্ডি, নূর আলম, জাকাউদ্দিন, আবদুল ওয়াহিদ, নাসির বুন্দা ও মতিউল্লাহ।
রিজার্ভ : মাজহার হোসেন, তারিক আজিজ, বাসির আহমেদ, জ্যাকার হায়াত, মোহাম্মদ আফজাল, মোহাম্মদ আসাদ, তারিক নিয়াজি ও মোঃ হায়াত।
ম্যানেজার-এআইএস দারা ও সহকারী ম্যানেজার-এসএম তৌফিক।
ভারতীয় হকি টিম : গুরুদেব সিং (ক্যাপ্টেন) প্রিতপাল সিং, চারানজিৎ সিং, গুরুমিত সিং,শংকর লাক্সমান (গোলকিপার), ভি দেশ মুখ, এ হামিদ, মদনমোহন সিং, জোগিন্দার সিং, দারশন সি পিয়ারা সিং, রিজার্ভ- এর মান বেস্টিন, জো এন্টিক, এন নিমাল, আর এ চ্যারেস্টি ঝামাল লাল সারমা, বি, পাতিল।
ম্যানেজার- জে জেমিশন, কোচ-গুরুচারান সিং বেদী।
আব্দুল ওয়াহিদ ডবল হ্যাট্রিকসহ ১৭ গোল করলে সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং ১৯৬২ এশিয়ান গেমসের  ব্যক্তিগত সেরা ক্রীড়াবিদের সম্মান অর্জন করেছিল।
জাকার্তা গেমসের  সর্বশেষ প্রতিযোগিতা ফুটবল ফাইনাল (৪-৯-৬২)। ভারত বনাম দক্ষিণ কোরিয়া। সেনাজান মেইন স্টেডিয়ামে ফাইনাল খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ভারত তাদের খেলার স্ট্র্যাটেজি কিছুটা পরিবর্তন করে টিমের স্টপার জার্নাল সিংকে ফাইনালে সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলিয়েছিল। সেদিনের টিমের সম্পূর্ণ লাইনআপ সঠিকভাবে বলতে পারবো না; তবে গোলরক্ষক থানরাজ যে খেলা সেদিন খেলেছিলÑ তাতে তার কথা মনে না থাকার কোন কারণ নেই। চন্দ্রশেখরের সাথে ফুলব্যাকের দায়িত্ব কে পালন করেছিল তা আমার মনে নেই। কিংবা জার্নাল সিং-এর জায়গায় স্টপারের দায়িত্বে সেদিন মাঠে কে নেমেছিলÑ সেটাও আমার পক্ষে সঠিক করে বলা যাচ্ছে না। তবে রাইটআউট পিকে ব্যানার্জী, বলরাম, জার্নাল সিং, চুনী গোস্বামী (অধিনায়ক) তারা ছিল ফাইনাল খেলার মূল আকর্ষণ। দক্ষিণ কোরিয়া ফিজিক্যালি ফিট একটি টিম, স্ট্যামিনা, স্পিড, দলীয় সমঝোতা, সব দিক দিয়ে তারা উন্নত। ছোট ছোট পাস, দ্রুতগতিতে আক্রমণ। ভারতীয় রক্ষণভাগ প্রথম থেকেই কোরিয়ান আক্রমণগুলোকে দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করে যাচ্ছিল। অন্যদিকে ভারতীয় লম্বা লম্বা পাস দ্বারা আক্রমণও খেলায় উত্তেজনা সৃষ্টি করছিল, বিশেষ করে পিকে ব্যানার্জী বল নিয়ে যখন দ্রুত গতিতে ছুটে সেন্টার করছিল এবং অন্যান্য খেলোয়াড় গোল করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য করে তুলেছিল। এমনি একটি ভারতীয় আক্রমণে জার্নাল সিং হেড করে গোল করে ভারতকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিলে ভারতীয় কৌশল সফল প্রমাণিত হয়েছিল। ভারতীয় সমর্থকরা আনন্দ ফুর্তিতে গ্যালারি মাতিয়ে তুলেছিল। আমরা বাঙ্গালিরা প্রথম থেকেই ভারতীয় ফুটবল টিমের সাপোর্টার ছিলাম, আমরাও অন্যদের সাথে টিমকে উৎসাহ জোগাচ্ছিলামÑ যা পাকিস্তানী অনেকে ভালোভাবে নিতে পারেনি এবং পরবর্তীতে আমাদেরকে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মুহুর্মুহু কোরিয়ান আক্রমণ ভারতীয় রক্ষণভাগ বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারেনি, দক্ষিণ কোরিয়া গোল পরিশোধ করলে খেলায় ১-১ গোলে ড্র, তখন খেলায় বেশ উত্তেজনা বেড়ে যায়। চুনী গোস্বামী তার লম্বা লম্বা স্ট্রাইডে সারামাঠ চষে বেরিয়ে খেলাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। লম্বা লম্বা পাস দিয়ে আক্রমণকে সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন কিন্তু কোন সফলতা আসছিল না, উল্টো দলগত গতিসম্পন্ন কোরিয়ান টিম একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে ভারতীয় ডিফেন্সকে ব্যস্ত করে তুলেছিল। খেলার ধারা যখন এমনিভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল শেষের দিকে হঠাৎ করেই একটি আক্রমণের সূচনা গড়ে উঠেছিল ভারতীয় টিমের ডান দিক দিয়ে, নিজেদের মধ্যে বল আদান-প্রদানের মাধ্যমে রাইট-আউট পি কে ব্যানার্জীর উদ্দেশে পাস দিলে বলটি ধরেই তিনি ক্ষিপ্রগতিতে বিপক্ষ দলের গোলপোস্টের দিকে ছুটে বক্সের কাছাকাছি গিয়েই কোনাকোনি সজোরে কিক করলেন, ওমনিই চিৎকার... গোল। ভারতীয় শিবির আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। সাথে সাথে আমরাও তাদের আনন্দের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলাম। ভারতীয়দের বেশি সময় টেনশনে কাটাতে হয়নি। জার্নাল সিং এবং পিকে ব্যানার্জীর দেয়া গোলে ভারত ২-১ গোলে দক্ষিণ কোরিয়াকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ভারত দ্বিতীয়বারের মত এশিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক জয়ের গৌরব অর্জন করেছিল। ১৯৫১ সালে নতুন দিল্লী প্রথম এশিয়ান গেমসে ফুটবলে প্রথম স্বর্ণপদক পেয়েছিল। এশিয়ান গেমস ফুটবলে দ. কোরিয়া সিলভার এবং মালয় ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়েছিল।
ভারতীয় দলের তালিকা
পি. থানরাজ-পি, বার্মান। চন্দ্র শেখর-তারলোকসিং , জার্নাল সিং, অরুণ ঘোষ, ফ্রাঙ্কো, রামবাহাদুর, পি. সিনহা, পিকে ব্যানার্জী, ইউসুফ খান- আফজাল, চুর্নগোস্বামী (অধিনায়ক), বলরাম অরুমাগাম-ইথিরাজ।
কোচ-এসএ রহিম, ম্যানেজার-নূরুল আমিন।
১৯৬২ এশিয়ান গেমসের সমাপনী অনুষ্ঠান। সেনাজান মেইন স্টেডিয়াম দর্শকে পরিপূণ। ১২দিনের এশিয়ার বৃহৎ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং ক্রীড়াবিদদের মিলনমেলার শেষ বিকেল। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল প্রত্যেক দেশের প্ল্যাকার্ড বহনকারীদের এক লাইনে মাঠে প্রবেশের মধ্য দিয়ে। তারপর এক এক করে অংশগ্রহণকারী দলগুলো ঢুকেছিল অনেকটা রিলেক্স মুডে। কিছুক্ষণের জন্য বিরাট মাঠটি হয়ে উঠেছিল ক্রীড়াবিদদের মিলনমেলায়। ফটো তোলা, কার্ড বিনিময়, ঠিকানা বিনিময় প্রভৃতির মাধ্যমে সবাই সবাইকে ধরে রাখার চেষ্টা। অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে আয়োজক দেশের পক্ষে কিছু বক্তৃতা, পরবর্তী আয়োজক দেশের প্রতিনিধির কাছে এশিয়ান গেমস পতাকা হস্তান্তর ১৯৬৬ সালে ব্যাংককে (থাইল্যান্ড) আবার দেখা হবে এই কামনা ব্যক্ত করা হয়। শেষে প্রধান অতিথি কর্তৃক গেমসের সমাপনী ঘোষণা এবং এরই সাথে বিউগলের করুণ সুরে ১২ দিন ধরে প্রজ্বলিত মশালটি ধীরে ধীরে নিভে গিয়ে অন্ধকারে সব একাকার হয়ে যায়।
রাতে ডিনারের পর ফায়ার ওয়ার্ক শুরু হলে পুরো ক্রীড়া কমপ্লেক্স জ্বলজ্বল করে উঠেছিল। আমাদের সাথে দেবীও উপভোগ করেছিল ফায়ার ওয়ার্ক। অনেক রাত পর্যন্ত চলেছিল এই আলো-ছায়ার খেলা।
পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর ’৬২ সকালের দিকে আমরা ইন্দোনেশিয়াকে বাই বাই জানিয়ে গারুদা বিমানে করে সিঙ্গাপুর রওনা করেছিলাম এবং ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে পৌঁছেছিলাম। আমাদের একটা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হোটেলে উঠেই যে যার মতো মার্কেটিংয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। আসার আগে সিঙ্গাপুর সম্বন্ধে অনেক শুনেছিলাম। অনেক মার্কেট, সস্তা জিনিসপত্র, সুন্দর শহর। বাড়িঘর সবই যেন মার্কেট, দোকান। প্রত্যেক বাড়ির নিচেই দোকান। যে কোন রাস্তা যতদূর হাঁটা যায়, দু’ধারেই দোকান। ঢাকায় ফিরে এসে বন্ধুদের কাছে গল্প করেছিলাম সিঙ্গাপুর একটা আজব শহরÑ যার সবটাই দোকান।
ট্রানজিস্টারের খুব সখ ছিল। রঞ্জিত দা’র সনি ট্রানজিস্টার দেখেই সখ হয়েছিল, ব্যাটারিতে চালানো যায়, দেখতেও সুন্দর। আমারও যদি এরকম একটা থাকতো! বাসার সবাই মিলে খবর, গান কত কিছুই না শোনা যেত! আমাদের কোন রেডিও ছিল না তখন। রেডিও থাকবে কেমন করে? বাসায় যে তখনও ইলেস্ট্রিসিটি ছিল না। মার্কেটে গিয়ে দেখেছিলাম, অনেক সুন্দর সুন্দর মডেলের ট্রানজিস্টার এসেছে, কিন্তু সনির ঐ ব্রান্ডের ঐ রকম ট্রানজিস্টার কিনতে হবে আমারÑ ওটাই কিনেছিলাম। আজও সেই সনি ট্রানজিস্টারকে আমি সযতেœ তুলে রেখে দিয়েছি।
ঘুরতে ঘুরতে শেষ বিকেল, সন্ধ্যায় দোকান সব বন্ধ হয়ে যায়। আরও একটা সখের জিনিস কিনতে হবে, সেটা হলো ক্যামেরা। ছোটবেলার সখ। বক্স ক্যামেরা একটা ছিল, সেটা দিয়ে সখ  মেটাতাম। ভাল ক্যামেরা কেনার সামর্থ্য ছিল না, তাড়াহুড়ো করে ক্যামেরার দোকানে ঢুকলাম, সরদারজীর দোকান। দাম চূড়ান্ত। জাপানী ক্যামেরা, ইয়াসিকা ম্যাট। প্যাক করার আগে সর্দারজী বললেন, এর চেয়েও ভাল ক্যামেরা দিতে পারি একই দামে, এর সপক্ষে অনেক কথাও বললেন। আমি তাকে বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম, তিনি এবার দেখালো ‘ইয়াসিকা ডি’। দোকান বন্ধ হয়ে যাবে বিধায় তাড়াতাড়ি নিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম হোটেলে। সিঙ্গাপুর থেকে দুটো সখের জিনিস কিনতে পেরে খুশীই লেগেছিল সেদিন। পরবর্তীতে ঢাকায় ফেরার পর রামুদার কাছে (ক্যামেরাম্যান-প্যানারোমা ফটো) জানতে পারলাম যে ইয়াসিকা ম্যাট এবং  ইয়াসিকা ডি-এর মধ্যে কারিগরী যেমন তফাত, তেমনি দামেও বেশ তফাৎ। মানুষকে বিশ্বাস করে বিদেশে এভাবে প্রতারিত হবো ভাবতে পারিনি। তখন থেকে সরদারজীদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি।
৬ সেপ্টেম্বর ’৬২ থাই এয়ারযোগে সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল আমার এশিয়ান গেমস, জাকার্তা ১৯৬২ সফর।


(পঁয়তাল্লিশ) 
সদ্যসমাপ্ত জাকার্তা এশিয়ান গেমসে পাকিস্তান হকি টিম চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফেরার পরপরই কেনিয়া জাতীয় হকি দল পাঁচটি হকি টেস্ট সিরিজ খেলার জন্য ডিসেম্বর ’৬২ পাকিস্তান সফর করেছিল। জাতীয় হকি দলের প্রস্তুতি নেয়ার উদ্দেশ্যে নভেম্বর মাসের কনকনে শীতে স্বল্প সময়ের জন্য লাহোরে ক্যাম্প ডাকা হয়েছিল। পাকিস্তান জাতীয় মূল দলের সাথে আরো কয়েকজন খেলোয়াড়কে সুযোগ দেয়া হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমি সুযোগ পেয়ে ক্যাম্পে যোগ দিয়েছিলাম। ক্যাম্প কমান্ডেন্ট ছিলেন এআইএস দারা। পাঁচটি টেস্টের জন্য ভিন্ন ভিন্ন টিম গঠন করার লক্ষ্যে খেলোয়াড় বাছাই করা হয়েছিল। ঢাকায় চতুর্থ হকি টেস্ট খেলার জন্য ১৫ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তান এবং কেনিয়া উভয় দল লাহোর থেকে পিআইএ যোগে ঢাকার তেজগাঁ বিমানবন্দর অবতরণ করেছিল। বিমানবন্দরে উভয় দলকে ফুলের মালা দিয়ে স্বাগত জানানো হয়। শাহবাগ হোটেলে (পরবর্তীতে পিজি হাসপাতাল এবং বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পাকিস্তান দলের ম্যানেজার এআইএস দারা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, কেনিয়া জাতীয় হকি টিমের এ সফর এবং টেস্ট সিরিজ পাকিস্তানের উদীয়মান খেলোয়াড়দের পরখ করতে সাহায্য করবেÑ যা ১৯৬৪ টোকিও অলিম্পিকে পাকিস্তান যাতে একটি শক্তিশালী দল হিসেবে বিশ্ব হকিতে তাদের প্রাধান্য বজায় রাখতে পারে।
২২ সদস্যের কেনিয়া দলের ক্যাপ্টেন আবতার সিং এবং হিলারি ফার্নানডেজ সহকারী ক্যাপ্টেন। আব্দুল কাইফুম খান, সউদি জর্জ, হারদেও সিং, এ মেনডোনেকা, জাগান্দার সিং, এ্যানথোনিভাজ, সুরজিৎ সিং পেনেসার, সাং সিং, রেওনোল্ডস ডি সুজা, জ্যাক সিমোনিয়ন, সানতোষ সিং, রোবার্ট ফারনানডেজ কৃষাণ আগারওয়াল, আমার সিং, সিলভেস্টার ফার্নানডেজ, গুরচারান সিং এবং এগবার্ট ফার্নানডেজ। মেজর ডিএন নাত্তাল (ম্যানেজার) এবং হারদায়াল সিং (কোচ)।
১৬ ডিসেম্বর ’৬২ ঢাকা স্টেডিয়ামে সফররত কেনিয়া হকি টিম এবং পিআইএ হকি টিমের মধ্যে প্রদর্শনী ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমি পিআইএ টিমে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। পিআই দলের গোলরক্ষক হামিদ, কামার আলী খান, মারগুব মো. হায়াত, মো. আসাদ মালিক আমার পূর্বপরিচিত, আমরা ১৯৫৯ সালে লাহোরে পাকিস্তান এজুকেশন প্রোগ্রামে স্কুল ও কলেজ-এর কোচিং-এ দু’মাসের কোর্স করেছিলাম।
খেলার পূর্বে পিআইএ প্রধান এয়ার মার্শাল নূর খানের সাথে উভয় দলের খেলোয়াড়ের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। খেলার প্রথমার্ধে কেনিয়া দলের সেন্টার ফরোয়ার্ড একটি মাত্র গোল করার সুযোগ পেয়ে সেটারই সদ্ব্যবহার করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। গোল পরিশোধ করার জন্য আমরা (পিআইএ) মরিয়া হয়ে উঠি। আমাদের সংঘবদ্ধ আক্রমণগুলো একের পর এক বিফলে হয়ে যাচ্ছিল। নিঃসন্দেহে আমাদের টিম কেনিয়ার চেয়ে অনেক উন্নত মানের। আমার খেলার বর্ণনা এবং প্রশংসা করতে গিয়ে দৈনিক আজাদ লিখেছিল, ‘খেলার উল্লেখযোগ্য দিক হইতেছে পূর্ব পাকিস্তানের উদীয়মান খেলোয়াড় তরুণ বশীরের অনবদ্য ও প্রশংসনীয় ক্রীড়ানৈপুণ্য। বশীর একক প্রচেষ্টায় কয়েকবারই প্রতিপক্ষ দলের রক্ষণব্যুহ ভেদ করিয়া সহযোগীদের সুন্দরভাবে বল পাস দেয়। কিন্তু আক্রমণভাগের অন্যান্য খেলোয়াড়দের ব্যর্থতার দরুন বশীরের সৃষ্ট সুযোগসমূহ কোন কাজে আসে নাই।’ শেষ পর্যন্ত আমরা ০-১ গোলে পরাজিত হয়েছিলাম। পাকিস্তান সফরে আগমনের পর কেনিয়া দলের এটাই প্রথম বিজয়।
পিআই এ দল : হামিদ, কামার আলী খান, মুশাররত জামান, খুরশীদ আলম (অধিনায়ক), আকিল উদ্দিন, মারগুব, বশীর আহমেদ (পূর্ব পাকিস্তান), মোহাম্মদ হায়াত, তারিক নিয়াজী, মোঃ আসাদ এবং খালিদ নিয়াজী।
১৮ ডিসেম্বর ’৬২ আমার খেলোয়াড়ী জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের স্বপ্ন থাকে জাতীয় দলের হয়ে খেলা, আমার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল সে তারিখে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রথম বাঙ্গালি হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় হকি দলে চান্স পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছিলাম। ১৯৬০ সালে করাচিতে ন্যাশনাল হকি চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে গিয়ে করাচিওয়ালাদের (পশ্চিম পাকিস্তান) বিদ্রƒপ আর কটাক্ষ শুনেছিলাম, ‘বাঙ্গালি লোগ এঁহা হকি শিখনে আয়া, বাঙ্গালিতো হকি খেল শিখাদো’ ইত্যাদি। সেটারই জবাব আমি দিয়েছিলাম পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে কেনিয়ার বিরুদ্ধে ৪র্থ হকি টেস্ট ম্যাচ খেলার মাধ্যমে। বাঙ্গালিরা হকি খেলতে পারেÑ তার স্বাক্ষর আমি রেখেছিলাম সেদিন বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়ামে।
পথ তৈরি হয়েছিল পরবর্তীতে বাঙ্গালি খেলোয়াড়দের জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার।
খেলা দেখার জন্য সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে দুজন মন্ত্রী ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং খান এ সবুর উপস্থিত ছিলেন। স্পিকার আব্দুল হামিদ, প্রাদেশিক মন্ত্রী এটিএম মোস্তফা, নওয়াব খাজা হাসান আসকারী, হাফিজুর রহমান তারাও মাঠে এসেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোনেম খান খেলার পূর্বে উভয় দলের খেলোয়াড়ের সাথে পরিচিত হন এবং খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণ করেন। মুলতান এবং রাওয়ালপিন্ডিতে ১ম ও ২য় টেস্টে পাকিস্তান জয়লাভ করলেও লাহোরে তৃতীয় টেস্টে খেলা ড্র হয়েছিল। সুতরাং ঢাকায় ৪র্থ টেস্ট ম্যাচ ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তান হকি টিমের অধিনায়ক কর্নেল আতিফ ঢাকা টেস্টে অংশগ্রহণ না করায় টিমের রাইট হাফ গোলাম রসুল ক্যাপ্টেন্সি করেছিল। পাকিস্তান হকি টিম বিশ্বের এক নম্বর টিম; তবে কেনিয়া টিমকেও বিশ্বের চারটি সেরা টিমের মধ্যে গণ্য করা হতো তখন। বিশ্বসেরা পাকিস্তান দলের স্পিড স্কিল, টিমওয়ার্ক সবদিক দিয়ে কেনিয়া দলের চেয়ে উন্নত মানের হলেও খেলা শুরু হওয়ার পর কেনিয়া টিম সমান তালে পাকিস্তানকে মোকাবিলা করে যাচ্ছিল। বিশেষ করে কেনিয়া দলের সেন্টার হাফ সুরজিৎ সিং দলের নির্ভরযোগ্য এবং দক্ষ খেলোয়াড়। তার এন্টিসিপেশন, বল কন্ট্রোল এবং বল পাস দেয়া ঢাকার দর্শকদের প্রচুর প্রশংসা পেয়েছিল। কেনিয়া দলের রাইট ফুলব্যাক এনথনি ভাজ ডিফেন্সে দৃঢ়তার সাথে পাকিস্তানের আক্রমণগুলোকে ব্যর্থ করে দিচ্ছিল। রাইট হাফ সান্তোষ সিংও প্রশংসনীয় খেলা প্রদর্শন করেছিল। আক্রমণভাগে হিলারি-ফার্নেনডোজ এবং এগবার্ট ফার্নেনডোজ অন্যান্য খেলোয়াড়ের সহযোগিতায় পাকিস্তানকে মাঝে মাঝে বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছিল। সেদিন মাঠের সেরা খেলোয়াড় ছিল পাকিস্তান দলের আনোয়ার  আহমেদ খান, দলের স্তম্ভ। যেমন তার ট্যাকলিং, তেমনি এন্টিসিপেশন, ফরোয়ার্ড লাইনের সাথে মিলে আক্রমণ রচনা করা, এক কথায় অপূর্ব। নিজেকে বিশ্বসেরা সেন্টার হাফ হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল। তবে একটি দুর্ঘটনা মাঠে উপস্থিত সবাইকে হতাশ করে দিয়েছিল যখন কেনিয়ার আম্পায়ার হার দয়াল সিং আনোয়ার আহমেদকে মাঠ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছিল। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময় একটি হিট মারতে গিয়ে মিস হয়ে তার স্টিক কেনিয়ার সেন্টার ফরোয়ার্ড এগবার্ট ফার্নেনডেজের হাঁটুতে আঘাত করেছিল, সাথে সাথে আম্পায়ার বাঁশি বাজিয়ে তার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। রাইট হাফ গোলাম রসুলের ধীরস্থির এবং বুদ্ধিদীপ্ত খেলা সবার কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। আক্রমণভাগে ওয়াহিদ মূল স্কিমারের দায়িত্ব পালন করেছিল। মতিউল্লাহ মাঠে ছিল প্রাণবন্ত, বল নিয়ে দুরন্ত গতিতে বিপক্ষ দলে বার বার হামলা চালানো দর্শকদের কাছে ছিল উপভোগ্য। আমি প্রথমবারের মত পাকিস্তান জাতীয় দলে চান্স পেয়ে খুবই এক্সাইটেড ছিলাম, প্রথমদিকে কিছুটা সেকি ছিলাম। পরে স্বাভাবিক হলে টিমের সাথে এডজাস্ট হয়ে গিয়েছিল। পত্রিকার ভাষ্য মতে, ঐব ঢ়ৎড়াবফ ঃযধঃ যব যধং ঃযব সধশরহম ড়ভ ধ ভরহব ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঐড়পশবু চষধুবৎ. ঐরং ংঃরপশ ড়িৎশ রং ংরসরষধৎ ঃড় ড়ঁৎ ংবধংড়হবফ ংঃধৎং নঁঃ ষধপশ ভরহবংংব. প্রথমার্ধ খেলা গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধের বুলির পরপরই পাকিস্তান  চড়াও হয়েছিল কেনিয়ার ওপর, ওয়াহিদের গোল করার একটি সুযোগ হায়াতের অফ-সাইডের জন্য ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপরই একটি শর্ট কর্নারের হিট জাফর হায়াত বাইরে মেরে গোল পাওয়া থেকে দলকে বঞ্চিত করে। কেনিয়া দলও আক্রমণ চালিয়ে ১৮ মিনিটে তাদের মেনডোনকা গোল করার সহজ সুযোগ হারায়। এরপরই গোলাম রসুলের কাছ থেকে বল পেয়ে আমি লাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে সুন্দর একটি সেন্টার করলে আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ওয়াহিদ গোলরক্ষক জর্জকে একা পেয়েও গোল করতে পারেনি। তারেক নিয়াজির গোলপোস্টে করা একটি হিট গোলরক্ষক প্যাড করে রক্ষা করলেও শেষরক্ষা হয়নি। কাছে দাঁড়ানো ওয়াহিদের কাছে বল গেলে সে ফিক করে বল জালে জড়িয়ে দেয়। পাকিস্তান ১-০ গোলে এগিয়ে যায়। এর পাঁচ মিনিট পর আমাদের রাইট ফুল ব্যাক বাসির শর্ট কর্নারে গোল করে গোলের সংখ্যা দ্বিগুণ করে। বিপক্ষ দলের গোলরক্ষক এবং ফুলব্যাকের ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ গ্রহণ করে ওয়াহিদ তার দ্বিতীয় গোল করলে টিম ৩-০ গোলে এগিয়ে যায়। মতিউল্লাহ হাফলাইন থেকে একটি বল ধরে দ্রুত গতিতে চারজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে একক প্রচেষ্টায় গোল করলে দর্শকরা প্রচুর আনন্দ উপভোগ করে এবং হাততালির মাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানায়। এরপর তারিক, নিয়াজি একটি গোল করলে দল ৫-০ গোলে এগিয়ে যায়। গোলের সংখ্যা অর্ধডজন হতো যদি শেষ মুহূর্তে আমার সুন্দর ক্রশটি ওয়াহিদ ধরতে ব্যর্থ না হতো।
পাকিস্তান চতুর্থ টেস্টে কেনিয়াকে ৫-০ গোলে পরাজিত করে সিরিজ জয় করেছিল। পঞ্চম ও শেষ টেস্ট করাচিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ।
পাকিস্তান টিম : জাকির, বাসির ও তারিক আজিজ। গোলাম রসুল, আনোয়ার আহমেদ খান ও জাফর হায়াত। বশীর, তারিক নিয়াজি, ওয়াহিদ, হায়াত মোহাম্মদ ও মতিউল্লাহ।
কেনিয়া টিম : সাউদ জর্জ, এনথনি ভাজ ও আবতার সিং। সানতোষ সিং, সুরজিৎ সিং ও সিলভেস্টার ফার্নানডেজ, আমার সিং, হিলারি ফার্নানডেজ, এগবার্ট ফার্নানডেজ, রয়নল্ড ডি সুজা ও আলু মেনডোনকা।
আম্পায়ার : পাকিস্তানের মো. ইকবাল ও কেনিয়ার হারদয়াল সিং।

(ছেচল্লিশ)
১৯৬৩ সালে চীনা জাতীয় ফুটবল দলের সাথে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার মধ্যদিয়ে আমার ফুটবল মৌসুম শুরু হয়েছিল। চীনা ফুটবল টিম পাকিস্তান জাতীয় টিমের সাথে কয়েকটি ম্যাচ খেলার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সফর করেছিল। পূর্ব পাকিস্তান একাদশের সাথে তাদের সফরের প্রথম ম্যাচ। দৈনিক আজাদ পত্রিকার ভাষায়, পূর্ব-পাকিস্তানের নিজস্ব (আমদানীকৃত নয়) খেলোয়াড় নিয়ে গঠিত দল। পাকিস্তান জাতীয় দলের চারজন খেলোয়াড় গফুর, গফুর বেলুচ, আবদুল্লাহ এবং ওমরকে পূর্ব পাকিস্তান দলে নির্বাচন করা হলে তারা খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল অথচ তারা ন্যাশনাল ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপ টুর্নামেন্টে ঢাকা ডিভিশনের হয়ে অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের এরকম মনোভাবের জন্য ফুটবল অঙ্গনে বেশ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় খেলোয়াড় দ্বারা টিম গঠন করা হয়েছিল। ২৪ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রদর্শনী ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। খেলার পূর্বে ঢাকা ডিভিশনের কমিশনার জনাব গিয়াসউদ্দিন আহমেদের সাথে উভয় দলের খেলোয়াড়দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানের এক্সটার্নাল এফেয়ার্স মিনিস্টার জনাব মোহাম্মদ আলীর মৃত্যুতে তিন মিনিট নিরবতা পালন করা হয়েছিল। চীনা জাতীয় ফুটবল টিম খুব শক্তিশালী টিম। যেমন তাদের দক্ষতা, তেমনি তাদের পরিকল্পনা, নিজেদের মধ্যে সুন্দর সমঝোতা, ছোট ছোট পাস, সব মিলিয়ে উন্নতমানের টিম। ফুটবল মৌসুম না থাকায় আমাদের খেলোয়াড়রা অনুশীলনে ছিল না। খেলার প্রথম থেকেই চীনা দল আমাদের উপর চেপে বসে। খেলা আরম্ভ হওয়ার পরপরই কবির ভাই এবং আমার সম্মিলিত চেষ্টায় তাদের ডিফেন্সের ভেতর ঢুকে গোলপোস্টে কিক করতে যাওয়ার মুহূর্তে তাদের গোলরক্ষক চেং চু শিন নিমিষের মধ্যে ডাইভ দিয়ে আমার পা থেকে বল নিয়ে নেয়। গোলের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। এরপরই চীনা টিম তাদের রাইট উইং নি চি টে বল নিয়ে ছুটে গিয়ে বাম পায়ে সজোরে কিক সাদেকের (আমাদের গোলরক্ষক) হাতের উপর দিয়ে বল গোল পোস্টে ঢুকে যায়। সাদেক যতক্ষণ গোলপোস্টে ছিল ততক্ষণ গোল হয়নি। সাদেককে(পাগলা সাদেক) বদল করে জাফর ইমামকে গোলকিপারের দায়িত্ব দেয়ার পর থেকে চীনা দলের আক্রমণের ধার বেড়ে যায় এবং একটার পর একটা গোল করতে থাকে। জাফর ইমাম বেশ কয়েকটা সহজ গোল খেয়ে চীনা টিমের গোলের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। চং হং কেন দ্বিতীয় গোল করার পাঁচ মিনিটে চ্যাং চিন টাইন তৃতীয় গোল করে, ২২ মিনিটে ভলি মেরে দর্শনীয় চতুর্থ গোল এবং ৫ মিনিটের মধ্যে আরো একটি গোল করেছিল চৌ চিয়া লিয়াং। ২২ মিনিটের মধ্যে ষষ্ঠ গোল হলে দর্শকগণ হতাশ হয়ে পরে এবং গ্যালারিতে সমালোচনা শুরু হয়। চীনা দলের একতরফা গোলবন্যার মধ্যে ৩২ মিনিটের সময় কবির ভাইয়ের দেয়া একটি পাস ধরে চীনের ডিফেন্স দেয়াল ভেদ করে একমাত্র গোল করলে দর্শকগণ করতালি এবং চিৎকার করে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা ১১-১ গোলে পরাজিত হয়েছিলাম। পরদিন অর্থাৎ ২৫ শে জানুয়ারি ’৬৩ দৈনিক অবজারভার পত্রিকার মন্তব্য ছিল এরকম : যিরষব ঃযব ঊচঝঋ ঃবধস পড়সঢ়ড়ংবফ ধঃ ধষষ ষড়পধষ ঢ়ষধুবৎং ধভঃবৎ ংযড়রিহম ভরৎংঃ সরহঁঃব নৎরষষরধহপব যিবহ ঃযবু সরংংবফ ধ মষড়ৎরড়ঁং পযধহপব ধফবফ ধধিু পড়সঢ়ষবঃবষু ধহফ সধফব ঃযব ৯০ সরহঁঃব বহপড়ঁহঃবৎ ধ ঃধষব ড়ভ ড়হব ংরফবফ ধভভধরৎ. অষষ ঢ়ষধুবৎং ংববসবফ ঃড় নব ধনংড়ষঁঃবষু ড়ঁঃ ড়ভ ঃড়ঁপয ধহফ সধফব ড়হব ভববষ ঃযধঃ ঃযবু বিৎব ঢ়ষধুরহম ভড়ড়ঃনধষষ ভড়ৎ ঃযব ভরৎংঃ ঃরসব. ঞযবু যধফ হড় সধঃপয ঃবসঢ়বৎধসবহঃ যিধঃংড়বাবৎ. বীপবঢ়ঃ ইধংযরৎ যিড় ংপড়ৎবফ ঃযব ষড়হব মড়ধষ ভড়ৎ ঃযব ষড়ংবৎং, হড়হব ড়ভ ঃযবরৎ ড়ঃযবৎ ভড়ৎধিৎফং পড়ঁষফ ঢ়ষধু রিঃয ধহু পড়হভরফবহপব.

পত্রিকার মন্তব্যতেই সেদিনের প্রদর্শনী খেলায় আমাদের খেলার চিত্র ফুটে উঠেছিল।
চীনা ফুটবল দলে যারা খেলেছিল- চ্যাং চোন শিউ, সাং চিং ল্যাং, সান ইউ মিন, ওয়াং ফেং চু, সান পাও জুং,ওয়াং কি পিং, চ্যাং হং কেন, কাও ফেন ওয়েন, চেন চিং টাইন, চেইন চিয়ালিং, সান ইয়ান হউন, রুচ আপ হুয়া, চেন ওয়েন ফাং, কাং কি পিন এবং সান এন নু।
ইপিএসএফ একাদশ- সাদেক (জাফর ইমাম) জহির, মোবাশশার, সাইফুদ্দিন, দেবীনাশ, সামাদ, পিন্টু, কবির, বশীর, শামসু, জামিল আক্তার বাটু, এবং প্রতাপ।
১৯৬৩ সালে আমার নতুন ঠিকানা হয়েছিল ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাব। আমার প্রিয় কাাব, যে কাবে ফুটবল খেলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে মনে আশা পোষন করে আসছিলাম। খেলোয়াড়ী জীবনের শুরু থেকে খেলে আসা ভিক্টোরিয়া কাবের মায়া ভালবাসা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়াও আমার পক্ষে এতদিন সম্ভবপর হয়ে উঠেনি। কিন্তু ১৯৬২ সালে ভিক্টোরিয়া কাব তাদের কমিটমেন্ট রক্ষা করেনি। আমার মাহুৎটুলী বাসায় একটা পাকা ঘর তৈরি করে দেয়ার কথা ছিল। সেটা তারা করে দেননি। আমি ৬৬-৬৭ সাল থেকে বিনা পয়সায় কাবের হয়ে ফুটবল, হকি, ক্রিকেট  খেলেছি এমনকি ১৯৬১ সাল থেকে ফুটবলে টাকা দেয়ার প্রথা চালু হলেও আমি কোন টাকা নেইনি।
একটা পাঁকা ঘর করতে কত টাকাই বা খরচ হতো? ৫ টাকা বস্তা সিমেন্ট, ১-২ শত টাকা হাজার ইট, ১-২ হাজার টাকা রডের টন আর ২ টাকা রোজ রাজমিস্ত্রী, খুব বেশি হলে হাজার চারেক টাকা। দু বছর অপেক্ষা করেও তাদের সাড়া পাইনি। তারপরও রেজা ভাইকে (ফুটবল সেক্রেটারী) জানিয়ে ছিলাম কাব ছেড়ে যাওয়ার কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘বশীর তুমি যা ভাল মনে করো সেটা করো, কাবের পরিবেশ আগের মত নেই’। ১৯৫৯ সালে ঢাকা মোহামেডান কাবের হয়ে আগাখান গোল্ড কাপ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে কাব আমাকে তাদের কাবে খেলার জন্য বলে আসছিল। ১৯৬১ সালে গজনবী ভাই এবং কবির ভাই আমাকে লা সানি হোটেলে (বর্তমানে বিবি এভিনিউতে অগ্রণী ব্যাংক কর্পোরেট শাখা, রমনা) নিয়ে যান, সেখানে শাজাহান ভাই আগে থেকে বসা ছিলেন, বসতে বললেন, নে কত টাকা নিবি, লিখেনে, একটা চেক আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না, মাথা নিচু করে বসেছিলাম, এর মধ্যে লা সানি হোটেলের মজাদার ফালুদা দিয়ে গেল হোটেলের বেয়ারা। মাথা নিচু করে ফালুদা খেয়ে সাহস করে বলেছিলাম, কালকে বলবো। এই কাল দুবছর পর ১৯৬৩ সালে এসেছিল সেদিনও গজনবী ভাই আর কবি  ভাই এক বিকেলে মোহামেডান কাবে কাবের সভাপতি জনাব মঈনুল ইসলাম সাহেবের সামনে হাজির করেছিলেন। কাবের লনে একটি মাত্র চেয়ার, সেখানে তিনি বসেছিলেন। গজনবী  ভাই বললেন, বশীর এ বছর আমাদের কাবে খেলবে। ইসলাম সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে, মোহামেডানে খেলবি? কত টাকা চাস? ছোট বড় সব খেলোয়াড়দের সাথে তিনি সবাইকে তুই তুই করে কথা বলেন। আমি উত্তরে বলেছিলাম, টাকা আমি নেব না, আমার মাহুৎটুলী বাসায় পাকা ঘর তৈরে করে দিতে হবে। আমি ১০/১২ হাজার ইট দিব। তিনি একটু চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে। আমি সাথে সাথে বললাম, আপনি বললে হবে না, উনি (গজনবী ভাইয়ের দিকে ইশারা করে) বললে খেলবো। ইসলাম সাহেব আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলেন, কিরে গজা, ও কি বলে, এরকম উত্তর তিনি আশা করেননি। গজনবী ভাই ও বোধ হয় আমার কাছ থেকে এরকম কথা শুনবেন ভাবেননি। তিনি বলে যাচ্ছেন, চুপ কর, চুপ কর। আমি, বললাম, চুন খেয়ে মুখ পুড়েছে, দই দেখলে ভয় হয়। আজও স্পস্ট মনে আছে সে কথাগুলো। তাড়াতাড়ি গজনবী ভাই বলে উঠলেন, হ তর কথা সব শুনবো, চুপ থাক। ইসলাম সাহেব, তখনই কবির ভাইকে বলে দিলেন, প্ল্যান করে তা ডিআইটি থেকে পাস করিয়ে দেয়ার জন্য।
কাজী শামসুল ইসলামকে (ফুটবল খেলোয়াড় শাহআলমের দুলাভাই, কাজী সাহেব বলে সবার কাছে পরিচিত) ডেকে বললেন, কাজী বাড়িটা বানিয়ে দিবি! ইসলাম সাহেবের কথা শুনে আশস্ত হয়ে আমার প্রিয় কাবের পক্ষে আসন্ন ফুটবল মৌসুমে খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম সেদিন বিকেলে।   

 (সাতচল্লিশ)
আমার খেলোয়াড়ী জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ১৯৬৩ সালে ভিক্টোরিয়া কাব ছেড়ে যাওয়া। বিভিন্ন কাবের হাতছানি, প্রলোভন উপেক্ষো করে গভীর সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কাবের সাথে, দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করা ছিল আমার জন্য কষ্টের। তারপরও চলে যেতে হয়েছিল। ফুটবল খেলার জন্য যোগ দিয়েছিলাম ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবে এবং ভিক্টোরিয়ার হকি ছেড়ে গড়ে তুলেছিলাম ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান স্পোর্টস এন্ড রিক্রিয়েশন কাব ঢাকা, হকি টিম। আমরা যারা খেলোয়াড় হিসেবে ন্যাশনাল ব্যাংকে চাকরিরত ছিলাম, তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল ফুটবল খেলোয়াড়, যারা ঢাকার বিভিন্ন কাবে সুনামের সাথে খেলছিলেন। যেমন নুরুল ইসলাম নান্না, গোলরক্ষক রঞ্জিত দাস, গাউস, আব্দুর রহিম, খন্দকার আবুল হাসান, লিউসারাও, মোবাশশের মীর সাবের আলী, মাহমুদ, তোফাজ্জল হোসেন মুক্তি, মিলাল, ডল, আনোয়ার ও আমি। সে সময় ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা ফুটবল টিম বেশ শক্তিশালী ছিল। অফিস ফুটবল লীগে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতো, আমাদের টিম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবও অর্জন করেছিল। ময়মনসিংহের সূর্যকান্ত শিল্ডের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবও আমাদের ব্যাংক টিমের রয়েছে। মাইজদী কোর্ট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশাল বিভিন্ন জেলায় টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে সুনাম অর্জন করেছিল ব্যাংক টিম। আমাদের সাফল্যে সবার আস্থা বেড়ে গিয়েছিল। তখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঢাকা ফুটবল লীগে ব্যাংকের টিম এন্ট্রি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমরা যারা বিভিন্ন কাবে খেলে কিছু আর্থিক সুবিধা পেতাম, আমাদেরকে সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হতো। আমরা খেলোয়াড়রা সবাই মিলে ব্যাংক ম্যানেজমেন্টকে বুঝিয়েছিলাম, ফুটবল টিম করতে অনেক অর্থ ব্যয় হবে, বাইরে থেকে খেলোয়াড় আনতে হবে, তাছাড়া চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষিণ কারণ ঢাকা মোহামেডান, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসি টিমগুলো রয়েছে, সেখানে ব্যাংক টিম চ্যাম্পিয়ন হওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়ে হকি টিম গঠন করা সহজ এবং লীগে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমাদের মধ্যে অনেক ভাল ভাল হকি খেলোয়াড় রয়েছে যারা সুনামের সাথে বিভিন্ন কাবে খেলছে। তাদের  মধ্যে সাবের আলী, মাহমুদ, আনোয়ার, মির্জা ফরিদ, ফরিদউদ্দিন, মীর আনোয়ার করিম এবং আমি। আমাদের মধ্যে অনেকে পূর্ব পাকিস্তান হকি দলকে প্রতিনিধিত্ব করে। আমি তখন পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড়; সুতরাং চেষ্টা করলেই আমরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারবো এবং সে সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংকেরও ক্রীড়াঙ্গনে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের কথায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ব্যাংকের হকি টিম গঠন করার অনুমতি দিয়েছিল, ব্যাংক হকি টিম ১৯৬৩ সাল থেকে আজ অবধি হকি অঙ্গনে গৌরবের সাথে টিকে আছে।
লীগ খেলার জন্য ঢাকা মোহামেডান কাবে বেশ কিছু ফুটবলার প্রথমবারের মত যুক্ত হয়েছিল। পাকিস্তানের পেশাওয়ার থেকে কাইয়ুম চেঙ্গেজি, ভারত থেকে রহমত উল্লাহ ও রাফাত আলী, স্থানীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে শামসু, বলাই, আনসার, সামাদ, প্রতাপ এবং আমি। মোহামেডানের গত বছরের খেলোয়াড়দের মধ্যে জহির, দেবীনাশ, পিন্টু, কবির, আবিদ, মুসা, রসুল বক্স প্রমুখ। ভিক্টোরিয়া কাব তাদের মাকরানী একাদশ নিয়ে গতবছরের মত এবারও শক্তিশালী টিম।
১৯৬৩ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে ১২টি দল রিটার্ন লীগ পদ্ধতিতে অংশ নিয়েছিল।
১৫-৫-৬৩ তারিখে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগ শুরু হয়েছিল আজাদ স্পোর্টিং এবং পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে টিমের মধ্যে ১-১ গোলে ড্র’র মাধ্যমে। ১৮-৫-৬৩ তারিখে মোহামেডান কাবের প্রথম খেলা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল টিমের সাথে। বেশ হাড্ডি টিম ইপিআর। আশরাফ ভাইয়ের দেয়া একমাত্র গোলে আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। সেদিনের অপর খেলায় ওয়ারী কাব এবং প্রিন্টিং এন্ড স্টেশনারী কাব সামাদ এবং হোসেন আলীর দেয়া ১-১ গোলে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। ১৯-৫-৬৩ শক্তিশালী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স টিম প্রথম ম্যাচেই দুর্বল ইস্ট পাকিস্তান গভর্নমেন্ট প্রেস টিমের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে ১টি পয়েন্ট হারিয়েছিল। সেদিনের অপর খেলায় জামানের (প্রখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক) দেয়া একমাত্র গোলে আজাদ স্পোর্টিং তাদের প্রথম ম্যাচে পুলিশ টিমকে হারিয়ে পূর্ণ পয়েন্ট অর্জন করেছিল। পিডব্লিউডি টিম অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইস্পাহানী টিমের সাথে ২-১ গোলে হেরে পুরো দুটি পয়েন্ট হারিয়েছিল। ইস্পাহানীর পক্ষে নিশিথ ২ গোল করেছিল। দিনের অপর খেলায় পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে টিম ঢাকেশ্বরী কটর মিল টিমকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে শুভ সূচনা করেছিল। তাদের পক্ষে গোল করেছিল মেকওয়া, বসির ও মুকুল। ১১-৫-৬৩ তারিখে শক্তিশালী ভিক্টোরিয়া ওমর এবং ইউসুফের (সিনিয়র) দেয়া দুই গোলে দুর্বল স্টেশনারী টিমকে হারিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। আমাদের দ্বিতীয় খেলায় (২২-৫-৬৩) কাইয়ুমের দেয়া একমাত্র গোলে আমরা পুলিশকে হারিয়েছিলাম। সেদিনের অপর খেলার উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ফুটবল মৌসুমের প্রথম হ্যাটট্রিক যা আজাদ স্পোর্টিং কাবের জামানের পা থেকে এসেছিল। জামান ৪ এবং বাটু ১ গোলের সুবাদে আজাদ ৫-০ ইবিজি প্রেসকে হারিয়েছিল। পরদিনই অর্থাৎ ২৩-৫-৬৩ তারিখে ফুটবল লীগ দেখা পায় দ্বিতীয় হ্যাটট্রিকের, যা ইস্পাহানী টিমের নিশিথের করা এবং জেল টিমের বিরুদ্ধে। আমাদের তৃতীয় খেলায় (২৫-৫-৬৩) ওয়ারী কাবকে ৪-১ গোলে পরাজিত করতে কাইয়ুম ২, কবির ভাই ও আমি ১টি করে গোল করতে হয়েছিল। একটি খেলায় ৩টি হ্যাটট্রিকসহ ১২ গোলের রেকর্ড করেছিল ভিক্টোরিয়া টিম। ২৭-৫-৬৩ তারিখের সেই খেলায় দুর্ধর্ষ সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর ডবল হ্যাটট্রিক (৬ গোল), আব্বাস হ্যাটট্রিকসহ ৫ গোল এবং সিনিয়র ইউসুফ করেছিল ১ গোল। বিপক্ষে ছিল দুর্বল ইস্পাহানী টিম। বিজি প্রেস টিমের বিরুদ্ধে (২৮-৫-৬৩) কাইয়ুম হ্যাটট্রিক করলে মোহামেডানের মান রক্ষা হয়েছিল। শক্ত ইপিআর টিমকে ভিক্টোরিয়া ৬-০ গোল করে তাদের গোলমেশিন চালু রেখেছিল। ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন ৫-৬-৬৩ তারিখে ঢাকা স্টেডিয়ামে একটি প্রদর্শনী ম্যাচের আয়োজন করেছিল। ভিক্টোরিয়া একাদশ বনাম অবশিষ্ট একাদশ। অবশিষ্ট একাদশে আমি খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। টিকিট কেটে খেলা দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। টিকিটের মূল্য কত ধার্য করা হয়েছিল মনে নেই; তবে সেদিনের টিকিট বিক্রি হয়েছিল ৫,৩০০ রুপির। কারো সাহায্যার্থে এই চ্যারিটি ম্যাচ খেলা হয়েছিল। সে খেলায় ভিক্টোরিয়া ১-০ গোলে জয়লাভ করেছিল। পরবর্তীতে  মোহামেডানের খেলা (৭-৬-৬৩) রেল দলের সাথে, কাইয়ুমের দেয়া ২ গোলে আমরা জয়ী হয়েছিলাম। অপর খেলায় পুলিশ টিম ২-১ গোলে স্টেশনারীকে পরাজিত করেছিল। ৮-৩-৬৩ তারিখে ফুটবল লীগের প্রথম দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিল দুর্বল ইস্পাহানী টিম, ১-০ গোলে শক্তিশালী ঢাকা ওয়ান্ডারার্সকে হারিয়ে।
জার্মানীর ফরচুনা ফুটবল টিম পাকিস্তান সফরের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে ৯-৬-৬৩ তারিখে ঢাকা স্টেডিয়ামে ইপিএসএফ ফুটবল দলের সাথে একটি সৌজন্যমূলক ম্যাচ খেলেছিল।  ইউরোপের ফুটবল সম্বন্ধে আমার কোন ধারণাই ছিল না, সে সময় টিভি, টিভি চ্যানেলের খেলা দেখার কোন সুযোগ ছিল না। এটুকু মনে আছে সুঠাম দেহের অধিকারী খেলোয়াড়রা অনেক উঁচু মানের খেলা প্রদর্শন করেছিলÑ যা আজও মনে করলে নিজেকে একজন অতি সামান্য খেলোয়াড় মনে হয়। বন্ধুরা খেলা দেখে বলেছিল, মাঠে তো তোকে দেখাই যাচ্ছিল না। র্৫-র্৬র্  লম্বা আর ১১০ পাউন্ড ওজনের নিজেকে তাদের কাছে লিলিপুট মনে হচ্ছিল। আমরা বেশিরভাগ সময় আত্মরক্ষা করতেই ব্যস্ত ছিলাম। তারপরও ফলাফল একেবারে লজ্জাজনক হয়নি। আমরা ৪-১ গোলে হেরেছিলাম। কাইয়ুমের শোধ দেয়া গোলটি আজও আমার চোখে ভাসে। মোহামেডান গেটের দিকে অর্থাৎ উত্তর দিকের পেনাল্টি বক্সের কিছু বাইরে, গোল লাইনের কাছাকাছি একটি ফ্রি-কিক আমরা পেয়েছিলাম। কাইয়ুম সে কিক মেরেছিল। সাধারণত ওখান থেকে ফ্রি-কিক সতীর্থ খেলোয়াড়দের হেড কিংবা গোলে কিক করার জন্য ক্রস করা হয়ে থাকে। কিন্তু কাইয়ুম ন্যারো এঙ্গেল থেকে সরাসরি গোলপোস্টে কিক করেছিল। গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে বল ফাস্ট বার দিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে যায়, গোল। কাইয়ুম সেখান থেকেই মাঠের বাইরে চলে যায়। বদলি খেলোয়াড় হিসেবে কে মাঠে এসেছিল মনে নেই। শেষ পর্যন্ত ৪-১ গোলে খেলা শেষ হয়েছিল। খেলা শুরু হওয়ার পূর্বে প্রধান অতিথি প্রভিন্সিয়াল শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার এটিএম মোস্তফার সাথে দু’দলের খেলোয়াড়দের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল।
মোহামেডানের পরবর্তী খেলা (১০-৬-৬৩) ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সাথে, শামসু হ্যাটট্রিকসহ ৫ গোল এবং ১ গোল কাইয়ুম করলে আমরা ৬-০ গোলে জয়ী হয়েছিলাম। ভিক্টোরিয়াও ৭-১ গোলে রেল দলকে হারিয়ে তাদের জয়ের ধারাকে অব্যাহত রেখেছিল। ১৪-৬-৬৩ তারিখে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুটি টিম মোহামেডান এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স মুখোমুখি হয়েছিল। ঢাকা মোহামেডান কাবের জন্মলগ্ন থেকেই পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী টিম ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবের সাথে একটা বৈরিতা তৈরি হয়েছিলÑ যা বছরের পর বছর ধরে সেই মনোভাব পোষণ করে আসছে এই দুটি দল। তাদের বৈরিতার অনেক  মজার মজার গল্প ক্রীড়াঙ্গনে শোনা যায়। দু’দল যখনই খেলতে নেমেছে, মাঠে খেলোয়াড়দের মাঝেও সেটার প্রতিফলন দেখা গেছে। সেদিনের ম্যাচেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কড়া মার্র্কিং, টাফ ট্যাকলিং, উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় চলেছিল পুরো খেলায়। খেলার মান তত উঁচু না হলেও খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল আর ছিল প্রচুর উত্তেজনা। ঢাকার অধিবাসীদের মধ্যে দু’ভাগ হওয়া সমর্থকরা নিজ নিজ দলের খেলোয়াড়দের চিৎকার করে যেমন উৎসাহ দিয়ে সমর্থন জানাচ্ছিলেন, তেমনি বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের উদ্দেশে মুখ খারাপ করে গালাগাল করেছিলেন। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা এগিয়ে গিয়ে প্রথমার্ধ গোলশূন্য অবস্থায় শেষ হয়েছিল।
দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময় কাইয়ুমের জোরালো কিক পোস্টে কোনাকুনি দিয়ে ঢুকলে ওয়ান্ডারার্সের গোলরক্ষক হাকিম তা প্রতিহত করার কোন সুযোগ পায়নি। মাঠে যেমন উত্তেজনা, গ্যালারিতেও তেমনি উত্তেজনা। গোল শোধ করার জন্য ওয়ান্ডারার্স মরিয়া হয়ে ওঠে, তখন খেলা বেশ রাফ হয়ে উঠেছিল; মাঠে কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শেষ পর্যন্ত আমরা ১-০ গোলে জয়ী হয়ে মাঠ ছেড়েছিলাম।
দু’দলে যারা খেলেছিল
মোহামেডান : বলাই, জহির, আবিদ, দেবীনাশ, পিন্টু, সামাদ, কবির, বশির, কাইয়ুম, আশরাফ ও মারী।
ওয়ান্ডারার্স : হাকিম, কামরু, আমিন, মুরাদ, গফুর বালুচ, মুসা (জুনি), মহসিন, গাজী, রেমন্ড, হানিফ ও সিকেন্দার। রেফারি : জেড আলম।
লীগ প্রত্যাশী আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিক্টোরিয়া পুলিশ টিমকে ৬-০ গোলে পরাজিত করে তাদের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখলেও আমরা লীগের প্রথম পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছিলাম পিডব্লিউডি টিমের কাছে, তাদের সাইফুল ও নাজিরের ২ গোলের বিপক্ষে কাইয়ুুমের ১ গোলের ব্যবধানের মাধ্যমে। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবকে আরও শক্তিশালী করার জন্য শ্রীলংকা থেকে সেন্টার ফরোয়ার্ড সিরিসেনা এবং আমিরকে এনে যুক্ত করেছিল এবং ২০-৬-৬৩ তারিখে ওয়ারীর বিরুদ্ধে তাদের মাঠে নামিয়েছিল। সিরিসেনা যে একজন দক্ষ স্কোরার তার প্রমাণ সে রেখেছিল প্রথম ম্যাচে ১ গোল করে, তাদের পক্ষে মহসীন আরও ১ গোল করলে ওয়ারীকে ২-১ গোলে  পরাজিত করেছিল, ওয়ারীর পক্ষে সামাদ ১ গোল করেছিল। ভিক্টোরিয়া ৪-০ গোলে আজাদ স্পোর্টিংকে, ৪-০ গোলে ওয়ারীকে হারিয়ে তাদের জয়ের চাকা সচল রেখেছিল। এদিকে আমরাও ২-১ গোলে ইস্পাহানীকে, আজাদকে ৩-১ গোলে হারিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স কাবও ভিক্টোরিয়াকে রুখতে পারেনি, ওমর আব্বাস ও ইউসুফের গোলের বিপক্ষে সিরিসেনা এক গোল শোধ করলে ৩-১ গোলের  ব্যবধানে ভিক্টোরিয়া জয় পেয়েছিল।
ভিক্টোরিয়া কাবের লীগ শিরোপা ঠেকাতে ঢাকা মোহামেডান কাব কোলকাতা মোহামেডান কাবের দু’জন খেলোয়াড়কে এনে নিজ দলের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল। প্রথমজন ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় রহমত উল্লাহ, যিনি ১৯৬০ সালে আগাখান গোল্ড কাপ টুর্নামেন্টে কোলকাতা মোহামেডান কাবের খেলোয়াড় হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন এবং তার চমৎকার ক্রীড়াশৈলী দ্বারা ঢাকার দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। সেবার কোলকাতা মোহামেডান ইন্দোনেশিয়ার মাকাসার কাবকে ৪-১ গোলে পরাজিত করে গোল্ডকাপ শিরোপা অর্জন করেছিল। রহমতউল্লাহ এবং জাফর ১টি করে গোল করেছিল, ২টি গোল করেছিল ওমর। পাকিস্তান জাতীয় দলের এবং পরবর্তীতে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং কাবের দুর্ধর্ষ সেন্টার ফরোওয়ার্ড ওমর। ইন্দোনেশিয়ার পক্ষে নূর একটি গোল করেছিল। কোলকাতা থেকে আসা অপর খেলোয়াড় রাফাত আলী খান, ফুল ব্যাক পজিশনের খেলোয়াড়।
মোহামেডান কাব ৯-৭-৬৩ তারিখে ইপিআর টিমের বিরুদ্ধে তাদের কোলকাতা থেকে আগত দুজন খেলোয়াড়কে টিমে অন্তর্ভুক্ত করে দল মাঠে নামিয়েছিল। সেদিনের খেলার সার্বিক বিবরণ দিতে গিয়ে মর্নিং নিউজ পত্রিকা ছেপেছিল : ‘ঞযব ঃড়ি হবি ৎবপৎঁরঃং ভৎড়স পধষপঁঃঃধ জধযসধঃঁষষধয ধহফ ৎধভধঃ ধষর ভধরষব ঃড় ষরাব ঁঢ়ঃড় ঃযব বীঢ়বপঃধঃরড়হ ড়ভ ঃযব উধপপধ ংড়পপবৎ ভধহং. ইড়ঃয ড়ভ ঃযবস ঢ়ষধুবফ রহ ঃযব ফবভবহপব ধহফ ৎধভধঃ রহ ধিং নবধঃবহ ধ হঁসনবৎ ড়ভ  ঃরসবং নু ঃযব ংঢ়ববফু ষবভঃ. ড়ঁঃ ড়ভ ঃযব ঊচজ ঝড়নধহ ধহফ ষবভঃরহ খধঃরভ. ছধুুঁস ঃযব রিহহবৎং ষবধফরহম মড়ধষ মবঃঃবৎ ভৎড়স ইধষঁপযরংঃধহ ধিং ড়ভভ পড়ষড়ঁৎ ধহফ ভৎরঃবৎবফ ধধিু ধ হঁসনবৎ ড়ভ পযধহপবং, ওৎড়হরপধষষু ড়ভ ধ ষড়পধষ ংঃধৎ, ইধংযরৎ, যিড় যবষঢ়বফ ঃযবস ঃড় পধৎৎু ধধিু. ঃযব ঃড়ি ঢ়ড়রহঃং ধঃ ংঃধশব নু ংপড়ৎরহম নড়ঃয ঃযব মড়ধষং, ইধংযরৎ’ং ঢ়বৎভড়ৎসধহপব ধিং বীপবঢ়ঃরড়হধষষু মড়ড়ফ ধহফ ঃযৎড়ঁময যিড়ংব নৎরষষরধহঃ সধৎশসধহংযরঢ় ঃযব গড়যধসবফধহং মড়ঃ ঃযব ৎবধিৎফ.’
খেলা শুরু হওয়ার ৫ মিনিটের সময় কাইয়ুম, কবির ভাই এবং আমি সম্মিলিতভাবে রাইফেল টিমের ওপর আক্রমণ করেছিলাম, তারই ধারাবাহিকতায় বিপক্ষ দলের পেনাল্টি বক্সের ভেতর কাইয়ুুম আমাকে বল দিলে আমি সজোরে কিকের মাধ্যমে গোল করি। গোল খেয়ে রাইফেল টিম যেন জ্বলে ওঠে, বেশ কয়েকটা আক্রমণ চালিয়ে গোলের সুযোগ সৃষ্টি করলেও গোল করতে সক্ষম হয়নি। ১১ মিনিটে আমার একক প্রচেষ্টায় বিপক্ষ দুজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে বল কিক করলে সেটা সজোরে ক্রশবারে লেগে খেলায় ফিরে আসে। খেলার ২০ মিনিটে রাইফেল দলের লেফট-ইন লতিফের কিক আমাদের গোলরক্ষক নওয়াজেশ আলীকে বল সেভ করার কোন সুযোগ না দিয়ে সোজা জালে প্রবেশ করে। খেলায় ১-১ গোলে সমতা। এরপর কাইয়ুম এবং আমি কয়েটি গোলের সুযোগ নষ্ট করি। ড্র অবস্থায় খেলা একেবারে শেষের দিকে; মোহামেডানের কর্মকর্তা, সমর্থক সবাই হতাশার ভুগছেন। তখনই আমি একটি বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একক প্রচেষ্টায় রাইফেল দলের রক্ষণভাগে ঢুকে পড়ে গোলপোস্টে কিক করার সাথে সাথে সমর্থকদের চিৎকার শুনতে পেলাম। গোল।
দৈনিক আজাদ পত্রিকার সেদিনের শিরোনাম ছিল, ‘বশীরের অপূর্ব ক্রীড়ানৈপুণ্য। মোহামেডান স্পোর্টিং দলের ২-১ গোলে জয়লাভ। গতকল্য ঢাকা ফুটবল লীগের প্রথম বিভাগের খেলায় মোহামেডান কেবলমাত্র বশীরের জন্য জয়লাভ করিয়াছে। মাঠের একমাত্র আকর্ষণ ছিল বশীর। তদুপরি তদীয় দলের পক্ষে দুটি গোলই সে করিয়াছে। তাহার ক্রীড়ানৈপুণ্য দর্শকবৃন্দকে বিমোহিত করিয়াছে।’
সেদিন মোহামেডানে যারা খেলেছিল : নাওয়াজেশ আলী (গোলরক্ষক), রাফাত আলী, আবিদ, দেবীনাশ, রহমতউল্লাহ, পিন্টু, কবির, রসুল বক্স, কাইয়ুম, বশীর ও মুসা।
ইপিআর দলে যারা খেলেছেন : মান্নান (গোলরক্ষক), হাবিব ও খালেক, আবু, সাব্বির ও তাজ হোসেন, নাওয়াজেশ আনোয়ার, সাগির, লতিফ ও সোবহান।
এখানে ইপিআর দলের ফুল ব্যাক হাবিবের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। হাবিব, লম্বা-চওড়া ফুলব্যাকদের মত না হলেও ছোটখাটো শক্ত-সামর্থ্য হার্ডি এবং খুব স্টেডি ফুলব্যাক ছিল। ১৯৫৯ সালে আমরা দুজন ঢাকা মোহামেডান কাবের হয়ে আগা খান গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেই টুর্নামেন্টে জাতীয় দলের এবং দেশের প্রখ্যাত ফুলব্যাক গজনবী ভাইয়ের সাথে সমান তালে মোহামেডান কাবের রক্ষণভাগকে সামলে আমরা আগাখান গোল্ডকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম; পূর্ব পাকিস্তান দলেও  আমরা একসাথে খেলেছি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয় / দুলাল মাহমুদ

বেবি, ডোন্ট ইউ ক্রাই / দুলাল মাহমুদ

ফুটবল মাঠের অন্য এক লড়াই

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

এশিয়ানরা কি কেবলই শোভাবর্ধন করবে? দুলাল মাহমুদ

বিস্মৃতির অতলে সাঁতারু আরশাদ/ দুলাল মাহমুদ