কোরানের ব্যাটে ছিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ/ দুলাল মাহমুদ

ক্রিকেটার হিসেবে তার মধ্যে ছিল দ্বৈতসত্তা। কখনো তিনি ছিলেন আগ্রাসী ব্যাটসম্যান, কখনো তিনি সৌন্দর্যের উপাসক। ব্যাট হাতে নামার পর তিনি হয়ে উঠতেন অপ্রতিরোধ্য ও বেপরোয়া। তার ব্যাটে ছিল আগুনের স্ফুলিঙ্গ। যে কোনো বলকেই সীমানার বাইরে আছড়ে ফেলতেন অনায়াস ও সাবলীল দক্ষতায়। আবার তার মধ্যেই ছিল শিল্পীত একটি মন। তার কভার ড্রাইভ ছিল চেয়ে দেখার মতো। যেন শিল্পীর তুলির নিখুঁত আঁচড়। স্কোয়ার কাট, অন ড্রাইভগুলো ছিল চমৎকার। তবে আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান হিসেবেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। সেই পঞ্চাশ ও ষাট দশকে ক্রিকেট ছিল ক্ল্যাসিকাল ঘরানার। তাতে ছিল বনেদীয়ানার ছাপ। একটু মন্থর। আর এই মন্থরতার বিপক্ষে ক্রিকেটে গতি নিয়ে আসেন সৈয়দ আবদুল মজিদ কোরান। তিনি তার দীপ্তি দিয়ে, সৌন্দর্য দিয়ে ক্রিকেটে আলাদা স্থান করে নেন।
হাল আমলের টোয়েন্টি টোয়েন্টি এবং ওয়ানডে ক্রিকেটে যখন রানের ফুলঝুরি ছোটে, তখন কোরানের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে তার সময়ের দিনগুলো। টেস্ট ক্রিকেটের সেই দিনগুলোতে তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রগামী। তার ব্যাটে ছিল টোয়েন্টি টোয়েন্টি কিংবা ওয়ানডে ক্রিকেটের দুরন্ত ঝড়। তিনি যখন খেলতে নামতেন, দর্শকরা তখন নড়েচড়ে বসতেন। তার ব্যাটিং মানেই ছিল উইকেটের চারপাশে রানের ফোয়ারা। কব্জির মোচড়ে দ্রুতগতিতে স্কোরবোর্ডকে সচল করে তুলতেন। সেই পাকিস্তান আমলে অল্প যে ক’জন বাঙালি ক্রিকেট মাঠে স্বপ্নের আল্পনা এঁকেছিলেন, তিনি তাদের একজন।
ক্রিকেটের রাজপুত্র কোরানকে দেখলে এখন আর চেনা যায় না। এখন তিনি গতির কাছে অনেকখানি পরাজিত ও মন্থর। বয়স তো আছেই, শারীরিক অসুস্থতা কেড়ে নিয়েছে তার ঔজ্জ্বল্য, তার প্রাণোচ্ছ্বলতা। চলাফেরায় যেমন কিছুটা সমস্যা হয়, কথা বলতেও বেশ কষ্ট হয়। স্মৃতিও অনেকটা হারিয়ে গেছে। তারপরও পুরনো দিনের কথা বলতে গেলে এখনও তিনি রোমাঞ্চিত হন। তার বুকের মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে যে স্পন্দন, তা সহজেই অনুভব করা যায়। তবে নিজের জীবন নিয়ে তার মধ্যে কোনো লুকোছাপা নেই। যা সত্যি, তা অবলীলায় বলতে একটুও দ্বিধান্বিত হন না। এ কারণে নিজের দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতার কথা কোনো রাখঢাক না করে অনায়াসে বলে ফেলেন।
সৈয়দ আবদুল মজিদ কোরান মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের সন্তান। তবে বাবার চাকরিসূত্রে তার জন্ম ভারতের কলকাতায়। ১৯৪১ সালের ২ মার্চ তার জন্মতারিখ। দেশভাগের পরপরই তার পরিবার ঢাকায় ফিরে আসে। বাবা ছিলেন পুলিশের কর্মকর্তা। পুরান ঢাকার কিশোরীলাল জুবিলি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর খেলাধুলায় তার হাতেখড়ি। শুরুটা হয় ফুটবল দিয়ে। এরপর ক্রিকেটের সংস্পর্শে আসেন। ইন্টার স্কুলে খেলেছেন ফুটবল ও ক্রিকেটে। তবে ক্রিকেট হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ফুটবল ও ক্রিকেট চুটিয়ে খেললেও ক্রিকেটটা আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। আমার অস্থি-মজ্জা-রক্তে ঢুকে যায় ক্রিকেট। এই খেলাটার মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পেতাম। ব্যাট হাতে যখন মাঠে নামতাম, তখন আমার নিজেকে মনে হতো ক্রিকেটের বরপুত্র। মাঠের সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতাম আমি। কোনো বোলারের দর্প চূর্ণ করে দিয়ে যখন বাউন্ডারি হাঁকাতাম, হৃদয়ে বয়ে যেত সুখের পরশ। আর যদি গ্যালারি থেকে ভেসে আসতো হাততালি কিংবা উল্লাসধ্বনি, তখন বুকটা ফুলে যেতো আনন্দ ও গৌরবে। ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে বড় কিছু মনে হতো।’
পঞ্চাশ ও ষাট দশকে খেলাধুলা করে অর্থকড়ি তেমন পাওয়া যেত না। তারপরও যেটুকু নাম-যশ-খ্যাতি পাওয়া যেতো, তা ফুটবলকে কেন্দ্র করেই। ফুটবলে দীক্ষা নেয়ার পরও ক্রিকেটে ঝুঁকে পড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ক্রিকেটে আমি শুনেছিলাম সুদূরের ডাক। অল্প বয়সেই ক্রিকেটকে কেন জানি মনে হয়েছিল এটিই আমারই খেলা। এই খেলায় আমি ভালো করতে পারবো। খুব শৈশবে বেতারে খেলার সম্প্রচার শুনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের প্রেমে পড়ে যাই। সে এক ভয়ানক প্রেম। এ কারণেই ক্রিকেটটা আমার হৃদয়ে স্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নেয়। তারপর ক্রিকেট ছাড়া কোনো কিছু ভাবতে পারতাম না। সে সময়ে এমসিসি দল ভারতে খেলতে এসেছিল। এটিও আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। ভারতের ভিনু মানকড়, বিজয় হাজারে, সুভাষ গুপ্তে আমার প্রিয় হয়ে ওঠেন। শুধু আমি কেন, আমার সমসাময়িক বকুল, লতিফ, সোহরাব, মাহীরাও ক্রিকেটের নেশায় উন্মাতাল ছিলেন। আমাদের একটি প্রজন্ম ক্রিকেটে নিজেদের আত্মনিবেদন করে দেই। তখন ক্রিকেটের পরিবেশ ছিল চমৎকার। নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে খেলতে আসতাম। আমাদের কোনো কিছুর প্রাপ্তির প্রত্যাশা ছিল না। শুধু ভালোবাসার কারণে ক্রিকেটের সঙ্গে গড়ে ওঠে নিবিড় আত্মিক বন্ধন।’
ক্রিকেটের বড় আসরে কোরানের পদার্পণ ঘটে পাড়ার ক্লাব রেঞ্জার্সের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘ওয়ারীর বনগ্রামে ছিল আমাদের বাসা। এ এলাকায় গড়ে ওঠে রেঞ্জার্স ক্লাব। পাড়ার ক্লাব হিসেবে এই ক্লাবের হয়ে প্র্যাকটিস করতাম। সেটা ১৯৫২ সালে কথা। বছর দুয়েক প্র্যাকটিস করার পর সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হই। শুরুতে আমি ছিলাম ডানহাতি মিডিয়াম পেস বোলার। ১৯৫৪ সালে রেঞ্জার্স ক্লাবের হয়ে ঢাকার প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে আমার অভিষেক হয়। বোলার হিসেবে প্রতিপক্ষের উইকেট ছিটকে দিয়ে খুশিতে ফেটে পড়তাম। কিন্তু একবার ব্যাটসম্যান হিসেবে ভালো স্কোর করে দলকে জিতিয়ে দেয়ার পর আমার উপলব্ধির জগত পাল্টে যায়। বোলারের চেয়ে ব্যাটসম্যানকে আমার কাছে শ্রেয়তর মনে হয়। বোলারের বলকে যেদিকে খুশি, সেদিকে পেটানোর মধ্যে একটা আনন্দ আছে। তবে ক্রিকেটের গতিকে আমি ভালোবেসেছিলাম। বোলার হিসেবে যেমন ছিলাম দ্রুতগতির, তেমনি ব্যাটসম্যান হিসেবে বলকে দ্রতলয়ে মারার মধ্যে একটা স্পন্দন ও শিহরণ অনুভব করতাম। এরপর ব্যাটসম্যান হিসেবেই নিজেকে মেলে ধরি।’
কোরান ১৯৫৫ সালে যোগ দেন আজাদ বয়েজ ক্লাবে। তিন বছর আজাদে খেলার পর ১৯৫৮ সালে পাড়ি জমান ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে। এই ক্লাবেই তার জীবনের স্মরণীয় সময় কেটেছে। সেই দিনগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের খ্যাতিমান ক্রিকেটার ইসমাইল গুল ওয়ান্ডারার্সের অধিনায়ক হওয়ার পর দলের খেলায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। তিনি একই সঙ্গে ছিলেন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্রিকেট সম্পাদক ও দলের অধিনায়ক। তার নেতৃত্বেই মূলত ওয়ান্ডারার্স হয়ে ওঠে অপরাজেয় দল। টানা চারবার তারা চ্যাম্পিয়ন হয়। এর মধ্যে তিন বছর আমি এই দলে খেলেছিলাম।’ ১৯৬১ সালে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলার পর ১৯৬২ থেকে তার ঠিকানা হয় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি একটানা মোহামেডানে খেলেন। কোরান ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান ক্রিকেট দলের অপরিহার্য সদস্য। এই টিমেও সুযোগ পাওয়া সহজ ছিল না। তাতে আধিপত্য ছিল অবাঙালিদের। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি কায়দে আজম ট্রফি, আইয়ুব জোনাল ট্রফিসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেন। খেলার সুবাদে পাকিস্তানের কোয়েটা, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, করাচি সফর করেছেন। ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেন ঢাকা জেলার হয়ে। পরবর্তীকালে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনাকে নিয়ে আয়োজিত হতো ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ। ১৯৫৮ সাল থেকে তিনি ছিলেন ঢাকা বিভাগের খেলোয়াড়। ১৯৫৮ ও ১৯৫৯ সালে তার দল ঢাকা বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৫৮ সালে করাচিতে পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের প্র্যাকটিসে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সুযোগ পান লতিফ, বকুল ও কোরান। তিনি জগন্নাথ কলেজের হয়ে ইন্টার কলেজ ক্রিকেটে খেলেছেন। ১৯৬২ সালে ইস্ট পাকিস্তান আন্তঃকলেজ টুর্নামেন্টে তার নেতৃত্বে জগন্নাথ কলেজ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়। নটরডেম কলেজের বিপক্ষে ফাইনালে তিনি ৭০ রানের অপরাজেয় ইনিংস খেলেন।
পঞ্চাশ ও ষাট দশকে ঢাকা মাঠে খুব একটা সেঞ্চুরি হতো না। ফিফটি করতে পারলেই কৃতিত্ব মনে করা হতো। অথচ সে সময়ে তার ব্যাট থেকে আসে চারটি সেঞ্চুরি। ১৯৫৭ সালে শাহীন ক্লাবের বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি করেন তিনি। ১৯টি বাউন্ডারির সাহায্যে সেঞ্চুরিটি ছিল ১১১ রানের। এভারগ্রিনের বিপক্ষে ১৭০, কমার্স ব্যাংকের বিপক্ষে ১১৪ এবং ফায়ার সার্ভিসের বিপক্ষে ১২৮ রান করেন। কোরান কত যে ফিফটি করেছেন, তার কোনো হিসাব নেই। টু ডাউনে ব্যাট করতে নেমে প্রায় ম্যাচেই তিনি পঞ্চাশের সীমানা পেরিয়েছেন। তার সংখ্যা ৭০-এর কম হবে না। এমনকি আগাম ঘোষণা দিয়েও তিনি ফিফটি করেছেন। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে তিনি বলেন, ‘কত রান হলো, তা চিন্তা করে ব্যাট চালাতাম না। যে অবস্থায় ব্যাট করি না কেন, আমি আমার ব্যাট করেছি সহজাত ভঙ্গিমায়। ছক্কা মারতে গিয়ে আমি আটটি সেঞ্চুরি মিস করেছি। যদি একটু দেখে-শুনে খেলতাম, তাহলে আমার নামের পাশে অনেকগুলো সেঞ্চুরি থাকতো। তাছাড়া তখন তো আমাদের কোনো কোচ কিংবা পরামর্শদাতা ছিল না। যা খেলেছি, নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা অনুযায়ী খেলেছি। ভুল করেছি। ভুল থেকে না শিখে আবারো একই ভুল করেছি। এখন মনে হয়, তখন যদি আমাদের কোচ থাকতো, তাহলে ক্রিকেটার হিসেবে অনেক বেশি খ্যাতি অর্জন করতে পারতাম।’
কোরান জানান, সীমিত ওভারের ম্যাচ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট লীগেও চালু ছিল। তখন লীগের খেলা হতো ৫০ ওভারের। ফাইনাল খেলা হতো তিনদিনে।
স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে কোরান স্মৃতির সরোবরে ডুব দিয়ে তিনি বলেন,‘একবার শাহীন ক্লাবের বিপক্ষে খেলা। শাহীন ক্লাবে ছিলেন আলী জাফরের মতো জবরদস্ত ফাস্ট বোলার। তার বল খেলতে গিয়ে অনেক ব্যাটসম্যানের হাঁটু কেঁপে উঠতো। ঢাকা মাঠে তার বলে পরপর তিনটি চার মেরেছিলাম। এটি দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল। তখনকার দিনে এমন ঘটনা ছিল বিরল। ১৯৬০ সালে কারদার সামার ট্রফিতে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হয়ে মোহামেডানের বিপক্ষে লতিফ ২১৮ রান করেন। আমি তার সঙ্গে করেছিলাম ৮৫ রান। এছাড়া ইস্ট পাকিস্তান দলের হয়ে কায়দে আজম ট্রফিতে হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে অপরাজেয় ৫৪ রানের একটি প্রাণবন্ত ইনিংস খেলেছিলাম।’
কোরান স্পিন ও ফাস্ট বোলিং- দুটোর বিপক্ষেই ছিলেন সাবলীল। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতার এই ক্রিকেটার বলেন,‘তখন তো হেলমেট ছিল না। তা সত্ত্বেও হুক শট মারতে একটুও দ্বিধা করতাম না। দৌলতুজ্জামান বাউন্সার দিতেন। আমি তা সহজেই বাউন্ডারি মারতাম। আমার সাহসটা বোধহয় একটু বেশি ছিল। যে কোনো পরিস্থিতিকে ব্যাট চালাতে পারতাম।’
ফিল্ডার হিসেবেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতির। কভারের ফিল্ডার হিসেবে তার আলাদা সুখ্যাতি ছিল। তিনি থাকলে ব্যাটসম্যানরা খুচরো রান সহজে নিতে চাইতেন না।
কোরানের সমসাময়িক প্রিয় খেলোয়াড়দের মধ্যে আছেন লতিফ, বকুল, সুকুমার, মইনউদ্দিন মাহমুদ, লুৎফর রহমান মাখন, খাজা আতহার, খাজা ওমর, শামীম কবীর এবং পাকিস্তানিদের মধ্যে পিডব্লিউডিতে খেলা আবদুল আজিজ, মোবাশ্বেরুল হক, শাহেদ মাহমুদ, মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেন,‘লতিফ, বকুল ও আমি মোহামেডানে একসঙ্গে খেলতাম। লতিফ ছিলেন আমার অসম্ভব প্রিয় খেলোয়াড়। ওয়ান ডাউনে ব্যাট করতেন। আমার চেয়েও অনেক ভালো খেলতেন। কভার ড্রাইভ ছিল দুর্দান্ত। আমি চেয়ে থাকতাম। সুকুমার দা ছিলেন অসাধারণ ক্রিকেটার। দীর্ঘদেহী ছিলেন। অন সাইড ও অফ সাইডে মনোমুগ্ধকর ড্রাইভ মারতেন। একই পজিশনের খেলোয়াড় হওয়ায় তার কারণে আমি অনেক সময় খেলায় সুযোগ পেতাম না। আমাকে অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকতে হতো। তিনি ভারতে চলে যাবার পর আমি দলে নিয়মিত হই। আমার দেখামতে, খাজা আতহার ছিলেন সবচেয়ে সেরা বোলার। তার ইনসুইং আর আউটসুইং খেলতে আমারও সমস্যা হতো। একবার ঢাকার মাঠে পূর্ব পাকিস্তান দলের সঙ্গে পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের একটি প্রদর্শনী ম্যাচে পাকিস্তান দলের অধিনায়ক আবদুল হাফিজ কারদারকে তিনি আউটসুইং বলে বোল্ড করে দিয়েছিলেন। ফজল মাহমুদের কারণে আতহার পাকিস্তান দলে খেলার সুযোগ পাননি।’
পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিকেটারদের মধ্যে কোরানের পছন্দের তালিকায় আছেন সৈয়দ আশরাফুল হক, রকিবুল হাসান, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ, ইউসুফ রহমান বাবু, ইশতিয়াক আহমেদ। তবে কোরানের প্রিয় ক্রিকেটার ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের রোহান কানহাই। তিনি ছিলেন তার কাছে রূপকথার নায়ক। তার কথা উঠলে এখনও তিনি নস্টালজিক হয়ে ওঠেন। তিনি তার খেলা অনুসরণ করতেন। এছাড়াও তার পছন্দের তালিকায় ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এভার্টন উইকস, ইংল্যান্ডের ডেনিস কম্পটন, পাকিস্তানের ফজল মাহমুদ। তিনি অস্ট্রেলিয়ার রিচি বেনোর সান্নিধ্য পেয়েছেন। ১৯৫৯ সালে বেনোর নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া দল ঢাকা আসে পাকিস্তানের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচ খেলতে। অস্ট্রেলিয়া টিমের নেট প্র্যাকটিসে তিনি ও বকুল ব্যাট ও বল করেন। এজন্য বেনো তাকে চারটি খেলার পাস দিয়েছিলেন।
তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের সঙ্গে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল টেস্ট ক্রিকেট খেলার। কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। লতিফ, বকুল ও আমার পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমরা খেলতে পারিনি। এমনকি সব ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হয়েছি। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ছিলেন বিচারপতি কর্নওয়ালিস। তিনি বিভিন্ন স্থান ঘুরে প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের খুঁজে বের করতেন। ১৯৫৬ সালে তিনি আমাকে ইংল্যান্ডে ট্রেনিং নেয়ার জন্য মনোনীত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি যেতে পারিনি। পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি খাজা হাসান আসকরির কারণে আমার যাওয়া হয়নি। আমাদের যে স্বপ্ন ছিল, তা পূরণ না হলেও বর্তমান প্রজন্মের ক্রিকেটাররা টেস্ট খেলায় আমাদের সেই স্বপ্ল পূরণ হয়েছে। বাংলাদেশ যেদিন টেস্ট খেলার গৌরব অর্জন করে,সেদিন আমি দারুণ খুশি হই।’
ফুটবলার হিসেবে তার পরিচয়টা তিনি গড়ে উঠতে দেননি। নতুবা এক্ষেত্রেও তার সম্ভাবনা ছিল। দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে মোহামেডানের দ্বিতীয় সারির দলে খেলেছেন। একবার আগাখান গোল্ডকাপ ফুটবলে কামাল স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে খেলায় মোহামেডানের মূল দলের হয়ে একটি ম্যাচ খেলেন। অবশ্য মোহামেডানের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় আহত থাকায় তিনি খেলার সুযোগ পান।
উত্তরা ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে ১৯৯৮ সালে অবসর নেন কোরান। তিনি ২ পুত্র ও ২ কন্যার জনক। তার আপন ভাগ্নে সাবেক ফুটবলার ও বর্তমানে ব্রাদার্স ইউনিয়নের কোচ ওয়াসিম ইকবাল। একসময় তিনি ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন তার সময় কাটে বাসায় বসে। একান্তই প্রয়োজন না পড়লে খুব একটা বাড়ির বাইরে যান না। শরীর তাকে সেই অনুমতি দেয় না। একসময় ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য ছুটে যেতেন ঢাকা স্টেডিয়ামে। ক্রিকেট মিরপুরে চলে যাবার পর এখন আর মাঠে বসে খেলা দেখা হয় না। টেলিভিশনে দেশ-বিদেশের ক্রিকেট খেলা দেখে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হন। নাতি-নাতনিদের নিয়ে সময় কাটান। তবে মাঝেমধ্যে আড্ডা মারতে যান ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে।
এক বুক বেদনা নিয়ে সৈয়দ আবদুল মজিদ কোরান বলেন,‘বলতে গেলে এদেশের ক্রিকেটের শুরুটা হয় আমাদের হাতে। অথচ আমাদের কেউ খোঁজ-খবর নেয় না। ক্রিকেট খেলে জীবনে কিছু পেলাম না- এটাই আমার জীবনের বড় দুঃখ।’কোরানের এই আক্ষেপ কানের মাঝে অনবরত বাজতে থাকে। অতীতের এই কীর্তিমান ক্রিকেটারকে সম্মানিত না করাটা সত্যি দুঃখজনক। #
১৬-১১-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ

অ্যাথলেটিকসের উজ্জ্বল মুখ মীর শরীফ হাসান/ দুলাল মাহমুদ

বাস্কেটবলের বুলবুল/ দুলাল মাহমুদ