লিফটার কানুর হাতে ছিল ম্যাজিক-টাচ/ দুলাল মাহমুদ

ভলিবল মাঠকে কেন্দ্র করে আবর্তিত তার জীবন। জীবন ধারণের প্রয়োজনে একটা কর্মজীবন বেছে নিতে হলেও তার মন পড়ে থাকে ভলিবল মাঠে। মাঠে না এলে তিনি স্বস্তি পান না। স্টেডিয়াম পাড়ায় যাদের নিয়মিত আসা-যাওয়া, তাদের কাছে দৃশ্যমান হয় তার সরব উপস্থিতি। সংগঠক হিসেবে তিনি ভলিবলের কোনো না কোনো কর্মকান্ডে জড়িয়ে থাকেন। হয় ফেডারেশন নতুবা ক্লাবকেন্দ্রিক। ভলিবলের গন্ডির বাইরে যাওয়ার কথা তিনি কখনো চিন্তা করেননি। খেলোয়াড় হিসেবেও তিনি ছিলেন তুখোড়। তার ক্রীড়াশৈলী এখনও অনেককে আপ্লুত করে। তবে তাকে দেখলে মনে হবে না খেলার মাঠকে তিনি আলোকিত করে রাখতেন। ছোটখাট গড়ন। এমন দৈহিক কাঠামো নিয়েও যে ভলিবল কোর্ট মাতিয়ে রাখা যায়, তার চমৎকার দৃষ্টান্ত মোঃ খায়রুল ইসলাম মোল্লা। এই নামে তিনি খুব বেশি পরিচিত নন। খেলার মাঠে সবাই তাকে চেনেন কানু নামে।
নিয়তি যেন কানুকে ভলিবল খেলার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে। একদম শৈশবে তিনি ভলিবলে আকৃষ্ট হন। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামটাই ছিল ভলিবল গ্রাম। গ্রামের শেষ মাথায় ছিল খালি জায়গা। আর ছিল বাঁশের খুঁটি, নেট ও মুখ সেলাই করা চামড়ার বল। ব্যস, আর কি চাই। তাই দিয়েই গ্রামে নিয়মিত হতো ভলিবল খেলা। শুধু আমাদের গ্রাম কেন, আশপাশ এলাকায়ও ভলিবল খেলার চর্চা ছিল। আমাদের গ্রামের ভলিবল দলটি ছিল বেশ বিখ্যাত। এই গ্রামেরই ছেলে জাতীয় কোচ সাইদুজ্জামান বাদশাহ। যে কোনো প্রতিযোগিতায় আমাদের গ্রাম চ্যাম্পিয়ন হতো কিংবা ফাইট দিত। একবার প্রতিবেশী গ্রামের সঙ্গে আমাদের গ্রামের মর্যাদার লড়াই। এ উপলক্ষে আমার বড় ভাই নজরুল ইসলাম ঢাকায় যান। খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারেন, ওয়ারী ক্লাবে ভলিবল খেলা হয়। তিনি ওয়ারী ক্লাবে গিয়ে আজিজুর রহমান ও মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু নামে দু’জন খেলোয়াড়কে সঙ্গে করে গ্রামে নিয়ে আসেন। এই দু’জন ছিলেন সহোদর। তারা সকালে আমাদের বাড়িতে ওঠেন। বিকেলে খেলা। সকালে ওয়ার্মআপ করার জন্য আমাকে নিয়ে মাঠে আসেন। আজিজ ও মিন্টু ভাই আমাকে বলেন, বল লিফট করতে পারবো কিনা। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, গ্রামে যে বলটি দিয়ে খেলা হতো, তা থাকতো আমাদের বাড়িতে। তা দিয়ে আমি একা একা প্র্যাকটিস করতাম। ফিঙ্গারিং করতাম। এর ফলে আমার বলকে ফিঙ্গারিং করার দক্ষতা অর্জিত হয়। আমি যেহেতু বেশি লম্বা ছিলাম না, গ্রামের মাঠে যখন খেলা হতো, আমাকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হতো। বল আসলে আমি লিফটিং করতাম। সেই অল্প বয়সে এটা করতে করতে বল আমার হাতে সেট হয়ে যায়। আজিজ ও মিন্টু ভাই যখন আমাকে বল লিফট করতে বলেন, আমি তা অনায়াসে করতে সক্ষম হই। আজিজ ভাই আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ ফিঙ্গারিং করেন। তিনি আমার খেলা দেখে অবাক ও মুগ্ধ হন। সেটা সম্ভবত ১৯৬২ সাল। খেলা শেষে আজিজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার বড় ভাইয়ের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বড় ভাইকে আজিজ ভাই বলেন, আমাকে ঢাকা নিয়ে যেতে এবং ওয়ারী ক্লাবে যোগাযোগ করতে। সেই অনুযায়ী বড় ভাই আমাকে ওয়ারী ক্লাবে নিয়ে যান। ক্লাব তখন গুলিস্তান পার্কের কাছে। সুন্দর ক্লাব ঘর, সুন্দর মাঠ, ভলিবলের নেট টানানো আর বল দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। সেই বয়সেই ওয়ারী ক্লাব আমার বুকে স্থায়ী ছাপ ফেলে দেয়। সেই মোহ আর কখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ক্লাবের পরিবেশে নিজের পোশাক-আশাকে লজ্জা পেয়ে যাই। গ্রামের ছেলে আমি। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। গ্রামের দরজি দিয়ে বানানো হাফ প্যান্ট। যা হোক, বিকেলে ক্লাবের প্র্যাকটিসে আমাকে নামানো হয়। এত ছোট ছিলাম, নেটের নিচ দিয়ে কোনো বাধা ছাড়াই অনায়াসে চলাচল করতে পারতাম। আজিজ ভাই আমাকে লিফটার হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন। এ সময় আসেন ক্লাব কর্মকর্তা খবিরউদ্দিন আহমেদ। তিনি আমাকে বলেন, এই ছেলে, তুমি সরে যাও। বল লাগলে তোমার হাত ভেঙ্গে যাবে। তখন আজিজ ভাই তাকে বলেন, ও কিন্তু ভালো খেলতে পারে। আপনি ওর খেলা দেখলে বুঝতে পারবেন। তা শুনে খবির ভাই বললেন, ঠিক আছে খেল। তবে সাবধানে খেলবে। ওই বয়সে যতটুকু খেলার কথা, তারচেয়েও বোধকরি ভালো খেললাম। আমার খেলা দেখে সবাই খুব খুশী হয়। সেই যে ওয়ারী ক্লাবে পা রাখি, তারপর আর কোথাও যাবার কথা চিন্তা করিনি। ওয়ারী ক্লাব হয়ে ওঠে আমার দ্বিতীয় নিকেতন।’
ছোটখাট গড়ন আর অল্প বয়সের কারণে কানুর জীবনের প্রথম ধাপে মন খারাপ করা ঘটনাও ঘটে। সেই ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একদিন ওয়ারী ক্লাবে প্র্যাকটিস করছি। সে সময় নামকরা লিফটার ছিলেন আলমগীর। তিনি চাকরি করতেন পিআইএতে। তবে বিভিন্ন ক্লাবে খেলতেন। তার দাপটই ছিল আলাদা। একদিন তিনি এসে কথা নেই-বার্তা নেই, আমাকে মাঠ থেকে বের করে দিয়ে নিজে খেলতে শুরু করেন। ওইটুকু বয়সে আমি তাতে অপমান বোধ করি। আমার কষ্টটা আজিজ ভাই বুঝতে পেরেছিলেন। এই ঘটনা আমাকে জেদী করে তোলে। পরবর্তী এক/দু’বছরের মধ্যে আমি নিজেকে পরিপক্ব করে তুলি। আমার সঙ্গে কেউ আর পারেনি। আমি তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। সে সময়ে সেরা লিফটার আখলাকুর রহমানের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আজিজ ভাই। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ছেলেটাকে একটু পরীক্ষা করে দেখেন। এ কথার পর আমার সঙ্গে তিনি অনেকক্ষণ ফিঙ্গারিং করেন। আখলাক ছিলেন বিহারী। আমার সঙ্গে ফিঙ্গারিং করার পর তিনি আজিজ ভাইকে বলেন, ‘ইয়ে লাড়কা আচ্ছা খেলে গা।’ আমি ছিলাম ঢাকা লীগের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়। আমি ছোট ছিলাম বলে অনেকেই আমার খেলা দেখতে আসতেন।’
কানু ভলিবল খেলায় নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করতে সক্ষম হন। তিনি সহজাত ক্ষমতা নিয়ে ভলিবল খেলতেন। ম্যাজিক-টাচ দিয়ে বলকে তিনি ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। তার হাতে যখন বল আসতো, তখন নিজস্ব একটা আঙ্গিক তৈরি হতো। বলটা ছুঁড়ে দেয়ার সময়টা দেখার একটা বিষয় ছিল। তিনি ছিলেন খুবই নিখুঁত। সারা লীগে তার একটি কি দুটি ভুল হতো। খেলার সময় তার যদি কোনো ভুল হতো, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হাতটা উঠে যেত। রেফারি তাতে বুঝে নিতে পারতেন। এমনকি দল হারার উপক্রম হওয়ার সময়ও ভুল করলে তার হাত উঠে যেত। কোনো কিছু গোপন করতেন না। এমনকি হাত ওঠানো সত্ত্বেও অনেক সময় রেফারি তা উপেক্ষা করতেন। তিনি যে ভুলের কারণে হাত ওঠাতেন, রেফারির দৃষ্টিতে তা ভুল ছিল না।
খেলাধুলার জন্য ঢাকায় থিতু হন কানু। এ কারণে স্কুলে ভর্তি হওয়া নিয়ে তিনি সমস্যায় পড়ে যান। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘ঢাকায় এসে খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। পুরান ঢাকার আশেক লেনে থাকতাম। আমি যখন ঢাকায় আসি, তখন প্রতিটি স্কুলের ভর্তি পরীক্ষার সময়সীমা শেষ। কী করা? ঢাকায় না থাকলে খেলাধুলা করা যাবে না। আমার বড় ভাইয়ের একজন শিক্ষক ছিলেন আরমানিটোলা স্কুলে। তিনি জানান, অষ্টম শ্রেণীতে একটি সিট খালি আছে। তবে পরীক্ষা দিতে হবে। একটি সিটের জন্য ১৮ জন পরীক্ষা দেই। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারিনি। আমার চাচার এক বন্ধু ছিলেন আরমানিটোলা স্কুলের একজন শিক্ষক। তিনি জানান, খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করা যায় কিনা- সেটা দেখা যেতে পারে। তিনি তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন। তার সঙ্গে কথা বলে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। প্রধান শিক্ষক জানান, আমি যে খেলোয়াড় তার সত্যায়িত কাগজ আনতে হবে। আমি ওয়ারী ক্লাবের খবির ভাইকে বলে সনদপত্র ম্যানেজ করতে সক্ষম হই। এটা ১৯৬৪ সালের কথা। স্কুলে আমার ভর্তি প্রক্রিয়ার সময় লাহোরের একটি ট্রেনিং ক্যাম্পের জন্য তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৬ জন খেলোয়াড়কে বাছাই করা হয়। তবে দলকে পরিচালনা করার জন্য একজন খেলোয়াড়ের পরিবর্তে একজন কর্মকর্তা ও ৫ জন খেলোয়াড় প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ম্যানেজার হন নূর হোসেন স্যার। খেলোয়াড়রা হলেন হাসান, আলিম, নয়া, সাদেক ও আমি। খেলোয়াড় হিসেবে সনদপত্র নিয়ে গেলে আমার লাহোর যাওয়া কথা জেনে প্রধান শিক্ষক খুবই খুশী হন। আমাকে বলেন, কবে ভর্তি হবে? আমি তাঁকে জানাই পরের দিন আমার লাহোর যাওয়ার কথা। এটা শুনে তিনি আমাকে বললেন, তোমার যখন খুশী তখন এসে ভর্তি হয়ে যেও। লাহোরে যাওয়ার পর আমাদের ট্রায়াল হয়। অল্প বয়সের কারণে আমাকে ট্রায়াল থেকে বাদ দেয়া হয়। বাকি ৪ জনকে সিলেক্ট করা হয়। অবশ্য কি কারণে যেন ট্রেনিং ক্যাম্পটি আর হয়নি। তবে সে বয়সে লাহোরে যাওয়াটা আমার জন্য ছিল রোমাঞ্চকর। হাজার মাইল দূরে যাওয়া, বিমানযাত্রা- এটা মনে করে আগের দিন সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। লাহোরে গিয়ে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের বিষয়টি আমার দৃষ্টিগোচর হয়।’
ভলিবলে অনেক স্মরণীয় খেলা খেলেছেন কানুু। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি খেলা হলো- ‘১৯৭৪-৭৫ সালে ঢাকা লীগে বিডিআর এবং ওয়ারীর ফাইনাল খেলা। প্রথম দুই সেটে আমরা হেরে যাই। তৃতীয় সেটেও ২-১২ পয়েন্টে পিছিয়ে থাকি। এ অবস্থায় টিমকে সংগঠিত করে খেলি। ঠান্ডা মাথায় সাবধানতা, সতর্কতা ও কৌশল অবলম্বন করে আমরা বিডিআরকে ১২তে রেখেই ৩-২ সেটে জিতে চ্যাম্পিয়ন হই। কৌশল যতটুকু খাটানো যায়, আন্তরিকতা যতটুকু প্রয়োগ করা যায়, তার সবটুকু নিংড়ে দিয়েছিলাম। সেই সময়কালেই আরেকটি ম্যাচে ওয়াপদার সঙ্গে লীগের ফাইনালে আমরা দুই সেটে পিছিয়ে থেকে জয়ী হয়েছিলাম ৩-২ সেটে। ১৯৭৫ সালে সিলেটে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে ঢাকা ও টাঙ্গাইলের ফাইনাল খেলা। ২ সেট জয়ী হয়ে তৃতীয় সেটেও এগিয়ে যায় টাঙ্গাইল। সে সময় ভলিবল ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন আ ক ম যাকারিয়া। তিনি খেলা চলাকালে মন্তব্য করেন, বাবু, কানু যেহেতু আছে, ওরা ঢাকা জেলাকে বের করে নেবেই। উনার কথার সম্মান আমরা রাখতে পেরেছিলাম। খেলায় আমরা ৩-২ সেটে জয়ী হই। সেদিন খুব ভালো লেগেছিল। খেলা শেষে আমাকে কাঁধে নিয়ে উল্লাস করা হয়। খেলার পর কেনাকাটার জন্য দোকানে যাই। এমন সময় দেখি এক লোক আমাকে অনুসরণ করে পিছে পিছে আসছে। আমি যেখানে থামি, ওই লোকও সেখানে থামেন। একটু ঘাবড়ে যাই। অনেক লোকের ভিড়ে যাওয়ার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- আপনি আমাকে অনুসরণ করছেন কেন? তখন তিনি আমাকে বলেন, আপনার হাত দুটো একটু দেন। আমি একটু ছুঁয়ে দেখি। আপনার হাতের আঙ্গুলের যে কাজ, তা আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে।’
ভলিবল খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে সিনিয়র খেলোয়াড় আজিজুর রহমানের প্রতি কানুর অন্তহীন কৃতজ্ঞতা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার গুরু ছিলেন আজিজুর রহমান। তিনি আমাকে ধাপে ধাপে তুলে এনেছেন। আমার ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দিয়েছেন। আমাদের সময় রোটেশনে খেলা হতো। গ্রাম থেকে আসার পর তা আমি বুঝতাম না। আজিজ ভাই আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন। সে সময় এক দলে ২ জন লিফটার, ২ জন ডিফেন্ডার ও ২ জন অ্যাটাকার থাকতেন। আমাদের দলে সেটার ছিলেন আশিকুর রহমান ও আমি। অনেক দিন এই পদ্ধতিতে খেলা চলার পর আশিকুরের আঙ্গুলে সমস্যা হওয়ায় আমি একা হয়ে যাই। এ অবস্থায় খেলার কৌশল পরিবর্তন করার চিন্তা-ভাবনা করা হয়। হিসাব-নিকাশ আর ছক করে দেখা হয় আমাকে কোথায় রাখলে সুবিধা হয়। তাতে দেখা যায়, সার্ভিস করার পর মাঝখানে থাকলে আমি ফ্রি থাকি। তাতেই সুবিধা হয়। সার্ভিস হওয়ার সাথে সাথে আমি নেটে চলে আসতাম। যাকে খুশী তাকেই লিফট করতে পারতাম। সে সময় ভলিবল খেলায় এটা ছিল বড় ধরনের একটি পরিবর্তন। লিফটার একজন কম থাকলেও একজন ডিফেন্ডার বা অ্যাটাকার বেশি নিয়ে খেলার এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়। এটা তখন কারো জানা ছিল না। আজিজ ভাই এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। আমার উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। তাছাড়া দলের একমাত্র সেটার। আমাকে লিফট করা ছাড়া ফ্রি রাখা হতো। অন্য সময় আমাকে আরেকজন কভার করতেন। ফলে আমার কোনো সমস্যা হতো না। এখনও রোটেশন অনুযায়ী খেলা হয়। এখন পাঁচজন অ্যাটাকার ও একজন সেটার। খেলা অনেক বেশি আক্রমণাত্মক।’
কানুর দৃষ্টিতে ভলিবলে অ্যাটাকার হিসেবে খন্দকার আবুল হাসান, ফরিদ চৌধুরী, গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী বাবু, আমিন, সুভাষ, মিনহাজ, নিখিল, খোকন, ফিরোজ, স্বপন, মুন্নু, ইয়াদ আলী, ডিফেন্সে ফারুক, বাদশাহ, আজিজ, মাহমুদউল্লাহ, সেটারে আখলাক, মোস্তফা কামাল, আলমগীর, আলম, মতিউর রহমান ছিলেন সেরা।
খায়রুল ইসলাম কানু ১৯৫১ সালের ৬ জানুয়ারি বৈদ্যের বাজারের গোয়ালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকার আরমানিটোলা গভঃ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে ভূগোলে বিএ (সম্মান) ও ১৯৭৫ সালে একই বিষয়ে মাস্টার্স করেন। প্রথম বিভাগ ভলিবল লীগে ১৯৬২ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ওয়ারীতে খেলেন। ১৯৬৯ সালে অল পাকিস্তান বোর্ড ভলিবল টুর্নামেন্টে পূর্ব পাকিস্তান সম্মিলিত ভলিবল দলের খেলোয়াড় ছিলেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ভলিবল চ্যাম্পিয়নশীপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬৮ সালে চ্যাম্পিয়ন মেরিন ডিজেল ট্রেনিং সেন্টারের পক্ষে নারায়ণগঞ্জ সাব-ডিভিশনাল ক্রীড়া সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত ভলিবল প্রতিযোগিতায় এবং ১৯৭৪ সালে চ্যাম্পিয়ন নারায়ণগঞ্জ জনতা ব্যাংকের হয়ে খেলেন। ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে আন্তঃজেলা ভলিবল চ্যাম্পিয়নশীপে বিজয়ী ঢাকা জেলা দলের খেলোয়াড় ছিলেন। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অল-পাকিস্তান ইয়ুথ ক্যাম্পে অংশ নেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকায়, ১৯৬৯ সালে করাচীতে এবং ১৯৭০ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান জাতীয় ভলিবল চ্যাম্পিয়নশীপে পূর্ব পাকিস্তান দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬৯ সালে করাচীতে পাকিস্তান ন্যাশনাল গেমসে পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় ভলিবল চ্যাম্পিয়নশীপে ঢাকা জেলা দলের খেলোয়াড় ছিলেন। এর মধ্যে ঢাকা জেলা ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৭৫ ও ১৯৭৭ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি ছিলেন অধিনায়ক। ১৯৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশ অলিম্পিকসে ব্রোঞ্জ জয়ী ঢাকা বিভাগ দলের খেলোয়াড় ছিলেন। ১৯৭৩ সালে নয়া দিল্লীতে অল-ইন্ডিয়া গ্রামীণ ক্রীড়ায় বাংলাদেশ জাতীয় ভলিবল দলের তিনি ছিলেন অধিনায়ক। ১৯৭৪ সালে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও কুষ্টিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ ডায়নামো ভলিবল দলের সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট ম্যাচ খেলেন।
খেলোয়াড় থাকাবস্থায় কোচ হিসেবে দীক্ষা নেন কানু। ১৯৬৮ সালে ঢাকায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ভলিবল ফেডারেশন আয়োজিত মাসব্যাপী ভলিবল কোচিং ক্যাম্পে অংশ নেন। এই ক্যাম্প পরিচালনা করেন পাকিস্তানের খ্যাতিমান ভলিবল খেলোয়াড় আজিজ মির্জা। ১৯৬৯ সালে করাচীতে পাকিস্তান ভলিবল ফেডারেশন আয়োজিত ১৫ দিনব্যাপী ভলিবল কোচিং ক্যাম্পে যোগ দেন। ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খালিক খান। ১৯৭৪-৭৫ সালে বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশন আয়োজিত দু’মাসব্যাপী ভলিবল কোচিং ক্যাম্পে অংশ নেন। ক্যাম্প পরিচালনা করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের খ্যাতিমান কোচ ভেলেরি প্রেট্রোনকো।
১৯৮৩ সালে নেপালে প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশ দলের সহকারী ম্যানেজার ছিলেন। ১৯৮৪ সালে ব্যাংককে একটি টুর্নামেন্টে এবং ১৯৮৫ সালে শ্রীলংকায় রূপাবাহিনী ভলিবল প্রতিযোগিতায় ওয়ারী দলের সহকারী ম্যানেজার ছিলেন। ১৯৯৫ সালে পাকিস্তানে বাংলাদেশ ভলিবল দলের প্রস্তুতি ম্যাচে এবং মাদ্রাজ সাফ গেমসে বাংলাদেশ ভলিবল দলের ম্যানেজার ছিলেন।
কানু ১৯৬৯-৭০ সালে ভলিবলে জহুরুল হক হল ‘ব্লু’ এবং ১৯৭৪-৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘ব্লু’ অর্জন করেন। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি তাকে সেরা ভলিবল খেলোয়াড় নির্বাচিত করে।
খেলোয়াড়ী জীবন শেষে ওয়ারী ক্লাবের ভলিবল কোচ, ভলিবলের সহকারী সম্পাদক, ঢাকা জেলা ক্রীড়া সংস্থার ভলিবল সম্পাদক ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভলিবলের জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময় অফিসিয়াল টিম আসায় খেলোয়াড়দের চাকরি, টাকা-পয়সা পাওয়ার পথ সুগম হয়। তাছাড়া নিয়মিত জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপ হওয়াতে সবক’টি জেলাকে পাওয়া যেত এক সঙ্গে। এতে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হতো। সব খেলোয়াড়কে পাওয়া যাওয়ায় সংগঠকদের সুবিধা হয়। ক্লাবগুলোও পছন্দসই খেলোয়াড় নিতে পারতো। খেলোয়াড়রা ইচ্ছেমত ক্লাবে যেতে পারতেন। সে সময় তারকা খেলোয়াড়দের মধ্যে আলোচিত ছিলেন ইয়াদ আলী, মুন্নু, খোকন, ফিরোজ, স্বপন। আমার মনে পড়ে, আমরা ৫০ হাজার টাকার সম্মানীর বিনিময়ে একজন সাড়া জাগানো খেলোয়াড়কে দলভুক্ত করেছিলাম। ফুটবল ছিল তখন সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। আলোচিত তারকা ছিলেন সালাউদ্দিন। সালাউদ্দিনও ক্লাব থেকে পেতেন ৫০ হাজার টাকা। এ থেকে বোঝা যায় ভলিবলের জনপ্রিয়তা কোন পর্যায়ে ছিল। সে সময় ওয়ারী, ওয়াপদা, বিটিএমসির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। একটা টিম গড়তে প্রয়োজন হতো এক থেকে দেড় লাখ টাকা। সার্ভিস টিমগুলোর হিসাব আলাদা। তারা চাকরির বিনিময়ে খেলোয়াড় সংগ্রহ করতো।’
ভলিবল খেলার জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ভলিবল খেলার জৌলুস ছিল। এরপর থেকে তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। সে সময় থেকে বাহিনীগুলো টিম গড়তে শুরু করে। তারা সিভিলিয়ান খেলোয়াড় নেয়া শুরু করে। বিশেষ করে নেভি, এয়ারফোর্স। যেসব খেলোয়াড় বিভিন্ন বাহিনীতে ঢুকে যায়, তাদের পক্ষে আর বেসরকারি পর্যায়ে খেলা সম্ভব হয় না। বিডিআর অবশ্য বেসরকারি পর্যায়ে খেলতে পারতো। তাদের দলে ৩০/৪০ জন ভালো খেলোয়াড় ছিল। কিন্তু সবাই খেলতে পারতেন না। এর ফলে খেলোয়াড়দের বড় একটা অংশ আটকা পড়ে যান। এই খেলোয়াড়রা যদি ওপেন থাকতেন, তাহলে খেলোয়াড়ের সংখ্যা বাড়তো। ঢাকা লীগের সেরা খেলোয়াড়রা বিমান ও নৌবাহিনীতে ঢুকে পড়ায় ঢাকার মাঠ শূন্য হয়ে পড়ে। জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা বিভিন্ন বাহিনীতে থাকায় তারা লীগ খেলতে পারেন না। তারা যদি খেলতে না পারে, তাহলে কারা ভালো খেলা দেখাবে? ভালো খেলোয়াড়ের লীগে এক্সপোজার না থাকায় সংকট তৈরি হয়েছে। লীগ বা কোনো প্রতিযোগিতায় বিডিআর, তিতাসের মতো দলের মোকাবিলা করার টিম ছিল না। ওয়ারী ছিল খেলোয়াড় তৈরির কারখানা। নিজের খরচে খেলোয়াড় তৈরি করতো। ওয়ারী খেলোয়াড় তৈরি করতো আর অন্যরা নিয়ে যেতো। এ কারণে ওয়ারী খেলোয়াড় তৈরি করা থেকে বিরত রয়েছে। এছাড়া আগে খেলা ছিল সীমিত। ফুটবল, হকি, ভলিবল ছিল জনপ্রিয় খেলা। ক্রিকেট ছিল নামমাত্র। এখন অনেক খেলা বেড়েছে। সবাই এখন ক্রিকেটে ঝুঁকে পড়েছে। ক্রিকেটকে কাউন্টার করার মতো ভলিবল খেলায় তেমন কিছু নেই। যে কারণে খেলোয়াড়দের আকৃষ্ট করা বা টেনে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ভলিবল খেলতে হলে লম্বা হতে হয়। এখন লম্বা ছেলেরা সব ক্রিকেট খেলে। আমরা তাদের বিকল্প প্রস্তাব দিতে পারছি না। ফেডারেশনের দায়িত্ব খেলোয়াড় তৈরি করা। যে ধরনের নিরবচ্ছিন্ন প্রোগ্রাম নেয়া দরকার, তা নেয়া হচ্ছে না। কোনো একটি প্রতিযোগিতাকে ঘিরে তাৎক্ষণিকভাবে দল গড়া হয়। এরপর আর কোনো খবর থাকে না। নির্দিষ্ট কয়েকটি টুর্নামেন্টের মধ্যে গন্ডিবদ্ধ হয়ে পড়েছে ভলিবল। তাছাড়া ফেডারেশন যেভাবে গঠিত হচ্ছে, তাতে যারা প্রকৃত সংগঠক, তারা আত্মসম্মান নিয়ে নীরবে সরে যাচ্ছেন, নতুবা তাদের সরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।’
ভলিবলের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনতে কয়েকটি প্রস্তাবের কথা জানালেন খায়রুল ইসলাম কানু। তার প্রস্তাবসমূহের মধ্যে রয়েছে- ‘ভলিবলকে আকর্ষণীয় করতে হলে খেলোয়াড়দের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। লীগসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতা জমজমাট করতে হলে জাতীয় দলের সব খেলোয়াড়কে খেলার সুযোগ দিতে হবে। গতানুগতিক প্রতিযোগিতা ছাড়া নতুন নতুন প্রতিযোগিতা প্রবর্তন করতে হবে। এক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিতে হবে। ভালো টিম গড়তে হলে প্রয়োজনে ক্লাবগুলোকে সাবসিডি দিতে হবে। ব্যক্তিসর্বস্ব টিমগুলোর মান উন্নত করা এবং ফেডারেশন থেকে কোচ দিয়ে ক্লাব পর্যায়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। তাহলে ভলিবলের জনপ্রিয়তা ফিরে পাওয়া যেতে পারে।’
ঢাকা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের বড় কর্তা (জেনারেল ম্যানেজার এবং ইনচার্জ) খায়রুল ইসলাম মোল্লা কানুর চাকরির সময়টুকু ছাড়া তার হৃদয়জুড়ে থাকে কেবল ভলিবল। ভলিবল খেলায় কীভাবে উন্নতি করা যায়, কীভাবে ভলিবলের জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনা যায়- সেটা নিয়েই তার অষ্টপ্রহরের ভাবনা। ভলিবলই তার স্বপ্ন-কল্পনা ও ভালোবাসা। #
১-১১-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ

অ্যাথলেটিকসের উজ্জ্বল মুখ মীর শরীফ হাসান/ দুলাল মাহমুদ

বাস্কেটবলের বুলবুল/ দুলাল মাহমুদ