বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

খেলাধুলাটা এক ধরনের নেশার মতো। কেউ ঘনিষ্ঠভাবে এর সংস্পর্শে এলে তার বন্ধন কাটানো সহজে সম্ভব হয় না। দূরে সরে গেলেও বুকের মধ্যে কোথাও না কোথাও তার রেশ থেকেই যায়। আবার কেউ কেউ জীবনটাই কাটিয়ে দেন খেলার মাঠে। ক্রীড়াঙ্গন থেকে সরে থাকতে পারেন না। এটা তাদের জীবনযাপনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। কখনো খেলোয়াড় হিসেবে, কখনো রেফারি হিসেবে, কখনো কোচ হিসেবে কিংবা কখনো সংগঠক হিসেবে জড়িয়ে থাকেন খেলাধুলার সঙ্গে। কোনো না কোনোভাবে মাঠের সঙ্গে সম্পর্কটা অটুট রয়েই যায়। যে কারণে ক্রীড়াঙ্গনে কিছু মুখ আছেন, যারা চিরপরিচিত। ক্রীড়াঙ্গনে একটুখানি ঢুঁ মারলে তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েই যায়। ক্রীড়াপ্রেমী এই মানুষগুলো আছেন বলেই ক্রীড়াঙ্গন সরগরম থাকে। ক্রীড়ায় নিবেদিতপ্রাণদের এমন একজন মোঃ মনিরুল হক।
ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে মনিরুল হকের সম্পর্ক অর্ধশতাব্দী কালেরও বেশি। জীবনের শুরুতেই সেই যে খেলাধুলার সঙ্গে নিবিড় বন্ধন গড়ে তুলেছিলেন, তা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। যতই দিন গেছে, ঘনিষ্ঠতা ততই বেড়েছে। আসলে সেই শৈশবে তার বুকে খেলাধুলার বীজ বপন করে দেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের গেমটিচার কামিনী বাবু। সেই বীজ তিনি নিষ্ঠা ও ভালোবাসার সঙ্গে প্রতিপালন করে আসছেন।
মনিরুল হকের জন্ম চাঁদপুরে। সনদপত্র অনুয়ায়ী জন্ম তারিখ ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি। ১৯৫০ সালে ঢাকায় এসে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। সে সময় এই স্কুলের খেলাধুলায় বেশ সুখ্যাতি ছিল। আর এর রূপকার ছিলেন ফিজিক্যাল টিচার কামিনী বাবু। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘খেলাধুলার প্রতি কামিনী স্যারের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আন্তরিকতা ছিল অপরিসীম। অসম্ভব প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন তিনি। পুরো স্কুলকে খেলাধুলায় মাতিয়ে রাখতেন। তিনি লেবেলটা ঠিক রাখতেন। জুনিয়রদের সঙ্গে একরকম। আবার সিনিয়রদের সঙ্গে আরেক রকম। স্কুলের ক্রীড়াময় পরিবেশে আমি মঞ্জুর হাসান মিন্টু, মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের মত সিনিয়রদের সংস্পর্শে আসি। বলা যায়, তাদের দেখাদেখি ফুটবল খেলায় আকৃষ্ট হই। আসলে সে সময়টা ছিল একটা পালাবদলের সময়। দেশভাগের পর সবকিছুতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, খেলাধুলায় বিরাট পরিবর্তন আসে। কলকাতা থেকে অনেক খেলোয়াড় ঢাকা আসেন। সেই সঙ্গে আসেন সংগঠকরাও। তাদের কর্মকান্ডে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গনে প্রালচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পল্টন ময়দান, গেন্ডারিয়া, আজিমপুর কলোনি, শান্তিনগর, মালিবাগ এলাকায় খেলাধুলার প্রসার ঘটতে থাকে। বিভিন্ন এলাকায় উচ্চতার ভিত্তিতে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজিত হতো। তাতে আমরা সহজাতভাবেই অংশ নিতাম। এছাড়া ইন্টার স্কুল তো ছিলই। ১৯৫৩ সালে চাঁদপুরের মতলবে ফিরে যাই। সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হই মতলব স্কুলে। এই স্কুলেও ছিল খেলাধুলার পরিবেশ। মাঠ ছিল। শিক্ষকরা খেলাধুলায় আগ্রহী ছিলেন। আমি ছিলাম স্কুল ফুটবল দলের অধিনায়ক। তখন তো আর কোনো পজিশন নির্ধারিত ছিল না। তবে আমি মূলত লেফট ইন, রাইট ইনে খেলতাম।’
মনিরুল হক ১৯৫৮ সালে ঢাকার কায়দে আজম কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে পড়ার সময় খেলেন ইন্টার কলেজ ফুটবলে। সে সময় ইন্টার কলেজে কলেজগুলোর পাশাপাশি অংশ নিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় দল। ১৯৬২ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে বছর ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের ক্যাম্প হয়। ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের একটি প্র্যাকটিস ম্যাচ হয়। ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এ ম্যাচে তিনি খেলেন। বিশ্ববিদ্যালয় দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন মঞ্জুর হাসান মিন্টু, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, ওবাইদুল্লাহ খান প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা হলের হয়ে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ফুটবল খেলেন। এরমধ্যে রয়েছে এফ রহমান শীল্ড, ইন্টার ইউনিভার্সিটি, ইন্টার হল প্রতিযোগিতা। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সমসাময়িক ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন গোলাম সারওয়ার টিপু, মাহমুদুল হাসান, ওবাইদুল্লাহ খান, মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, মাহমুদ হোসেন প্রমুখ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময় আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে খেলাটাকে বেশি গুরুত্ব দিতাম। তখন তো আর খেলে আয়-রোজগারের ব্যাপার ছিল না। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলাটাকে গৌরবজনক মনে হতো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলার আগে মনিরুল হক ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে খেলেছেন। এ বিষয়ে তিনি জানান, ‘কামাল স্পোর্টিং ক্লাবের প্রাণভোমরা ছিলেন কোচ বজলুর রহমান। তিনি ফায়ার সার্ভিস ফুটবল দলেরও অন্যতম নীতিনির্ধারক ছিলেন। তিনি আমার খেলায় মুগ্ধ হয়ে ১৯৫৮ সালে নিয়ে যান ফায়ার সার্ভিসে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান। তিনি দলের খেলোয়াড়দের খোঁজ-খবর রাখতেন। কার কি প্রয়োজন- সে বিষয়ে খেয়াল রাখতেন। ছাত্র-খেলোয়াড়দের প্রতি তার ছিল বিশেষ নজর। আমি ছিলাম একটু অলস প্রকৃতির। সিদ্দিকুর রহমান নিজে হলে এসে আমাদের প্র্যাকটিসে নিয়ে যেতেন। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তার সহযোগিতা আর সহমর্মিতার কারণে ফায়ার সার্ভিসকে ভালোবেসে ফেলি। তাছাড়া সদরঘাটে অবস্থিত ক্লাবের পরিবেশ ছিল দারুণ। সব খেলোয়াড়ই এই ক্লাবে আড্ডা দিতে আসতেন। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত আমি ফায়ার সার্ভিসে খেলি। ১৯৬৫ সালে আমি যোগ দিতে বাধ্য হই রহমতগঞ্জ ক্লাবে। আমি একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে চা খাচ্ছিলাম। এমন সময় ফুটবলার দীপু ও রহমতগঞ্জের কর্মকর্তা আমিন সাহেব মোটরসাইকেলে আমার কাছে আসেন। তারা আমাকে এক হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে তাদের ক্লাবে দলভুক্ত করেন। সেই প্রথম এক সঙ্গে এত টাকা পাই। ফায়ার সার্ভিসে পেতাম অল্প কিছু হাতখরচা। সেবার রহমতগঞ্জ বেশ ভালো দল গড়ে। সে দলের খেলোয়াড় ছিলেন গোলাম সারওয়ার টিপু, দীপু, শাহজাহান প্রমুখ। রহমতগঞ্জের পরিবেশও বেশ ভালো ছিল। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এই ক্লাবে খেলি। ১৯৬৭ সালে পুনরায় যোগ দেই ফায়ার সার্ভিসে। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত খেলে অবসর নেই।’
মনিরুল হক ১৯৫৮ সাল থেকে নিয়মিত আগা খান গোল্ডকাপ, রোনাল্ড শীল্ড খেলেছেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম লীগে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের হয়ে এবং ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা লীগে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের পক্ষে নিয়মিত খেলেন। জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে খেলেন কুমিল্লার হয়ে, ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে। লেফট-ইন এই ফুটবলারের পা থেকে এসেছে অনেক গোল। তবে তিনি গোল করার চেয়ে গোল করানোর দিকে মনোযোগী ছিলেন। বলের প্রতি তার চমৎকার কন্ট্রোল ছিল। দু’পায়েই সমান দক্ষ ছিলেন। তবে তার বন্ধুদের মতে, তিনি খেলার প্রতি খুব বেশি মনোযোগী ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্টাইলিশ ফুটবলার। খেলার প্রতি সিরিয়াস হলে আরো ভালো খেলতে পারতেন।
নিজের স্মরণীয় ফুটবল ম্যাচ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘১৯৬৪ সালে ফায়ার সার্ভিসে খেলার সময় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে তিন গোলে হারাই। মুহাম্মদ কামরুজ্জামান ২টি ও আমি একটি গোল করেছিলাম। ১৯৬৭ সালেও ঢাকা মোহামেডানকে হারিয়েছিলাম। আমার দেয়া এক গোলে আমরা জয়ী হই। গোলটি করেছিলাম বাঁ পায়ে। সে সময় এটি ছিল আলোচিত ঘটনা। ১৯৬৩ সালে ফায়ার সার্ভিসের রেলিগেশনে পড়ে যাবার আশংকা দেখা দেয়। শেষ ম্যাচে হেরে গেলে রেলিগেটেড হয়ে যেত। সেই ম্যাচে আমার দেয়া গোলে জয়ী হয়ে রেলিগেশন সেভ করেছিল ফায়ার সার্ভিস।’
লেফট-ইন পজিশনে মনিরুল হকের প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু, বশীর, জহির, প্রতাপ, হাফিজ, গাজী, মাকরানি ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন মুসা, ওমর, আবিদ, কালা গফুর প্রমুখ। তিনি জানান,‘১৯৫৮ সালে ঢাকা লীগে মাকরানী ফুটবলাররা খেলা শুরু করেন। সে বছর আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। সেবার ঢাকা লীগে চ্যাম্পিয়ন ছিল আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব। আগা খান গোল্ডকাপে কলকাতা মোহামেডানের কাছে খুব বাজেভাবে হারে আজাদ। কলকাতা মোহামেডানের মাকরানী খেলোয়াড় আবেদকে প্রথম দলে ভেড়ায় ঢাকা মোহামেডান। পরের বছর ঢাকা লীগে খেলতে আসেন মাকরানী ফুটবলার কালা গফুর, মুসা, ওমর, হাসান। তবে মাকরানী ফুটবলারদের নিয়ে দলকে শক্তিশালী করে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব। এমনকি তারা পুরো দলই মাকরানীদের দিয়ে গঠন করেছে। সে সময় ঢাকার অন্যতম শক্তিশালী দল হয়ে উঠেছিল ভিক্টোরিয়া।’
মনিরুল হকের দেখা সেরা ফুটবলারদের মধ্যে আছেন জহির, মঞ্জুর হাসান মিন্টু, রণজিত, জাকারিয়া পিন্টু, গাউস, হাফিজ, প্রতাপ, বশীর, গোলাম সারওয়ার টিপু, মনোয়ার হোসেন নান্নু, সালাউদ্দিন, এনায়েত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নান্নু, সালাউদ্দিন, এনায়েতরা ছিল নতুন প্রজন্মের ফুটবলার। এই প্রজন্ম ফুটবলে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন আনেন। বদলে দেন চিরায়ত দৃষ্টিভঙ্গি। আমাদের সাথে তাদের বড় ধরনের ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। তারা নতুন ধরনের খেলা খেলেন। তাদের মাধ্যমে এ অঞ্চলের ফুটবলের আধুনিকায়ন ঘটে। ফুটবলে প্রফেশনালিজমের ছোঁয়াও আনে। ফুটবল খেলে তারা বড় অঙ্কের টাকা-পয়সাও পেতে শুরু করেন। সত্তর দশকে ফুটবল খেলা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এই প্রজন্মের অবদানই বেশি।’
ফুটবলার হিসেবে উজ্জ্বল ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলেও মনিরুল হকের পরিচয় ভলিবলের লোক হিসেবে। এর কারণ ভলিবলে তিনি ছিলেন আরো বেশি দেদীপ্যমান। কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় ভলিবলে তার হাতেখড়ি হয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তিনি ছিলেন অপরিহার্য খেলোয়াড়। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভলিবল দলের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৫৮ সাল থেকে তিনি ঢাকা প্রথম বিভাগ ভলিবল লীগে খেলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভলিবলের খ্যাতিমান খেলোয়াড় মাহমুদউল্লাহ সাহেব আমাকে ভলিবল খেলার ব্যাপারে দারুণভাবে উৎসাহিত করেন। আমি খেলার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ছিলাম না। তিনিই আমাকে মোটিভেট করেন। আমাকে নিয়ে যান শান্তিবাগ ক্লাবে। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই ক্লাবে খেলি। এ সময় শান্তিবাগ দু’বার রানার্সআপ হয়। ১৯৬৩ সালে যোগ দেই ইস্টএন্ড ক্লাবে। ইস্টএন্ড একবার রানার্সআপ হয়। দু’বছর খেলার পর ১৯৬৫ সাল থেকে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব হয় আমার ঠিকানা। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত মোহামেডানে খেলেছি। অ্যাপেনডিসাইডিস অপারেশনের জন্য আর খেলতে পারিনি। মোহামেডান ১৯৬৫, ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে লীগে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হয়। সে সময় খেলতে খেলতে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে আবদুল হামিদ, আবদুল তৌহিদ, খন্দকার আবুল হাসান, মোস্তফা কামাল, সালাউদ্দিন আহমেদ, সিরাজ আহমেদ, ফরিদউদ্দিন প্রমুখের সঙ্গে। ১৯৬৬ সালে ইস্ট পাকিস্তান দলের হয়ে লাহোরে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে খেলেছি। এই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন খন্দকার আবুল হাসান, ফরিদ, মোস্তফা কামাল, শরীফ, সুভাস, মিলু প্রমুখ। এশিয়ান গেমস উপলক্ষে দল গড়ার জন্য লাহোরে পাকিস্তান জাতীয় দলের ক্যাম্পে খন্দকার আবুল হাসান, মোস্তফা কামাল ও আমাকে ডাকা হয়। এমএ পরীক্ষার জন্য আমি তাতে যোগ দেইনি। আসলে এটাকে আমি খুব বেশি গুরুত্ব দেইনি। খেলাধুলা করতাম মনের আনন্দে। তাকে সিরিয়াসলি নেয়ার কথা ভাবিনি।’ ভলিবল খেলায় মনিরুল হক ছিলেন অলরাউন্ডার। অ্যাটাক, রিসিভ ও সার্ভিসে তিনি ছিলেন একই রকম। এ কারণে তিনি আলাদাভাবে সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন।
খেলা ছেড়ে দিলেও খেলার মাঠের সঙ্গে সম্পর্কটা ছিন্ন হতে দেননি মনিরুল হক। সে সময় রেওয়াজ ছিল ভলিবল খেলার সময় রেফারিং করা। মূলত সিনিয়র খেলোয়াড়রাই খেলা পরিচালনা করতেন। তবে ১৯৬৯ সাল থেকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে রেফারিং করতে শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে ভারতের পাতিয়ালা যান ভলিবলে প্রশিক্ষণ নিতে। সাফল্যজনকভাবে ট্রেনিং নিয়ে ১৯৭৪ সালে দেশে আসেন। ঝুঁকে পড়েন খেলা পরিচালনার দিকে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সফর করে কিরঘিজস্তান দল। ঢাকায় বাংলাদেশ দলের সঙ্গে তাদের খেলা পরিচালনা করেন তিনি। এই খেলা পরিচালনার মাধ্যমে রেফারি হিসেবে আত্মবিশ্বাস অর্জন করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ভলিবল রেফারি বোর্ড এবং সিলেকশন ও কোচিং কমিটির সেক্রেটারি হন। সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রশংসিত হন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,‘১৯৭৮ সালের এশিয়ান গেমস উপলক্ষে জাতীয় দল গঠনের জন্য চারটি বিভাগ থেকে খেলোয়াড় বাছাই করি। তাদের সংখ্যা ছিল ২৫/৩০ জন। বাছাইকৃতদের ঢাকায় নিয়ে এসে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ১/২ জন ছাড়া ব্যাংককগামী জাতীয় দল গঠন করা হয় এই নতুনদের নিয়ে। বাকিরা পরবর্তীতে জাতীয় দলে খেলেছেন দাপটের সঙ্গে। এক্ষেত্রে আমাকে সহযোগিতা করেন খন্দকার আবুল হাসান, মোস্তফা কামাল, সাইদুজ্জামান বাদশা।’
মনিরুল হক ১৯৭৮ সালের ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে রেফারি এবং বাংলাদেশ জাতীয় ভলিবল দলের সহকারী ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। রেফারি হিসেবে তিনি পরিচালনা করেন ৬টি ম্যাচ। তার মধ্যে ছিল পুরুষদের দক্ষিণ কোরিয়া-চীন ম্যাচ এবং চীন-জাপানের মধ্যকার মেয়েদের ফাইনাল ম্যাচ। ১৯৮০ সালে ভারতের মাদ্রাজে এশিয়ান ভলিবল কনফেডারেশন আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল রেফারি কোর্স করেন তিনি। ১৯৮২ সালে দিল্লি এশিয়ান গেমসে রেফারি হিসেবে পুরুষদের সেমিফাইনাল এবং মেয়েদের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেন। এরপর তিনি ইন্টারন্যাশনাল রেফারি হিসেবে স্বীকৃতি পান। বাংলাদেশের হয়ে তিনি প্রথম এই কৃতিত্ব দেখান। তারপর আন্তর্জাতিক রেফারি হন শরীফ হোসেন, মোফাজ্জল হোসেন ও আনিসুর রহমান। ১৯৮৬ সালে ভারতের হায়দরাবাদে আন্তর্জাতিক ভলিবল প্রতিযোগিতায় তিনি খেলা পরিচালনা করেন। দেশের মাটিতে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ পরিচালনা করেন। রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। রেফারিং ছেড়ে দেয়ার পর তিনি রেফারিদের ট্রেনিং কোর্স পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ১৯৮৩ সালে তাকে সেরা রেফারি নির্বাচিত করে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি।
কোচ হিসেবেও মনিরুল হক সাফল্য অর্জন করেছেন। ১৯৭৮ সালে তার কোচিং ক্যারিয়ার শুরু। প্রথম বিভাগের দল ওয়ারির কোচ হিসেবে তার অভিষেক হয়। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ওয়াপদার কোচ। ওয়াপদা ১৯৮০ সালে ভলিবল লীগ, বিজয় দিবস, ১৯৮১ সালে জাতীয় ভলিবল, স্বাধীনতা দিবস প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৮৩ সালে হিসাবরক্ষণ, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে বিডিআর, ১৯৮৬ সালে বিমানবাহিনী এবং ১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত নৌবাহিনী দলের কোচ ছিলেন তিনি। এই দলগুলোও সাফল্য অর্জন করে। ১৯৮৬ সালে মিয়ানমারের রেঙ্গুনে বাংলাদেশ দলের কোচ ছিলেন। ১৯৯১ সালে শ্রীলংকার কলম্বোতে সাফ গেমসে বাংলাদেশ ভলিবল দলের দলনেতা ও চিফ কোচ ছিলেন তিনি।
সংগঠক হিসেবেও মনিরুল হক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের সদস্য হন। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় এশিয়ান যুব ফুটবলের টিকিট ও গেট কমিটির সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৬ সালে ভারতের হায়দরাবাদে আন্তর্জাতিক ভলিবল প্রতিযোগিতায় তিনি ছিলেন বাংলাদেশ দলের সহকারী ম্যানেজার। ১৯৮৮ সালে তিনি ভলিবল ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক হন। ১৯৮৯ সালে তিনি ব্যাংকক সফরকারী বাংলাদেশ ভলিবল দলের দলনেতা ছিলেন। ১৯৯১ সালে দলনেতা ছিলেন শ্রীলংকা সাফ গেমসে বাংলাদেশ ভলিবল দলের। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় সাফ গেমসে ভলিবলের সাংগঠনিক কমিটির দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত এবং ১৯৯৮ সালে ফেডারেশনের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৯৭ সালে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় এশিয়ান ভলিবল কনফেডারেশনের জেনারেল কাউন্সিলে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে জাপানের টোকিওতে আন্তর্জাতিক ভলিবল ফেডারেশনের জেনারেল কাউন্সিলে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এবং ২০০১ সালে কোষাধ্যক্ষ হন। ২০০১ সালে তিনি ফেডারেশনের সহ-সভাপতি হন। ২০০১ সালে তিনি ছিলেন কারাতে ফেডারেশনের কোষাধ্যক্ষ। বর্তমানে ভলিবল ফেডারেশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯৯ সালে সিঙ্গাপুরে অ্যাসোসিয়েশন অব ন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির সেমিনারে অংশ নেন। একই বছর নেপালের কাঠমান্ডুতে সাফ গেমসের জুরি কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৪ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে সাফ গেমস, ২০০৬ সালে শ্রীলংকা সাফ গেমসে এনওসি ডেলিগেট হিসেবে যোগ দেন। ২০০১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে অলিম্পিক কমিটি অব এশিয়ার (ওসিএ) জেনারেল কাউন্সিল এবং ২০০২ সালে ম্যাঞ্চেস্টার কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশের ডেলিগেট ছিলেন। ঢাকায় বড় ধরনের যত ক্রীড়া আসর বসেছে, তিনি তার প্রায় প্রতিটির সাংগঠনিক কমিটিতে ছিলেন। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সাংগঠনিকভাবে তিনি কোনো না কোনোভাবে অবদান রেখেছেন।
খেলার মাঠে নানা পরিচয়ে পরিচিত মনিরুল হক। খেলোয়াড়, রেফারি, কোচ ও সংগঠক হিসেবে তার পরিচয় বিস্তৃত। তিনি মনে করেন,‘গত ২০ বছরে খেলাধুলা অনেক এগিয়ে গেছে। সবকিছুতেই লেগেছে পেশাদারিত্বের ছোঁয়া। এখন আর আগের যুগের ধ্যান-ধারণা নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বর্তমানে যেভাবে চলছে, সেভাবে হবে না। সংগঠক হিসেবে ভূমিকা রাখতে হলে নিজেকে আপ-টু-ডেট রাখতে হবে। লেখাপড়া করতে হবে। বিশ্বজনীন চেতনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। একুশ শতকের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে তাল মেলাতে হলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। দক্ষতা, যোগ্যতা ও ডেডিকেশন থাকতে হবে। যার যা কর্তব্য, তাকে তা করতে হবে। পুরো বিষয়টিকে এক সুতোয় গাঁথতে না পারলে কোনো কিছুতে সাফল্য আসবে না। পাঁচ বা দশ বছরের পরিকল্পনা নিয়ে সবাই যদি একযোগে তাদের স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে একদিন সাফল্যের দেখা পাওয়া যেতে পারে। এজন্য ভিশন, মিশন ও ডেডিকেশনের সমন্বয় ঘটাতে হবে। কাজ করতে হবে এক মত, এক পথের অনুসারী হয়ে।’
এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ভাল কিংবা মন্দ, অনেক অভিজ্ঞতাই রয়েছে বহুমাত্রিক পরিচয়ে হৃদ্য এই ক্রীড়াবিদের ভান্ডারে। তার অভিজ্ঞতাটুকু যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হলে উপকৃত হবে দেশের ক্রীড়াঙ্গন। #
১৬-৯-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ

অ্যাথলেটিকসের উজ্জ্বল মুখ মীর শরীফ হাসান/ দুলাল মাহমুদ

বাস্কেটবলের বুলবুল/ দুলাল মাহমুদ