হকির পরিচিত মুখ শামসুল বারী/ দুলাল মাহমুদ

বাংলাদেশের হকি অঙ্গনে সুপরিচিত মুখ শামসুল বারী। সবাই তাকে চেনেন হকি সংগঠক হিসেবে। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় তাকে সংগঠক হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। যে কারণে তার খেলোয়াড়ী জীবন অনেকটাই আড়াল পড়ে গেছে। অথচ একসময় তিনি খেলোয়াড় হিসেবে ছিলেন সমীহ জাগানো নাম। হকির ফুলব্যাক হিসেবে খেলেছেন দাপটের সঙ্গে। খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে টানা প্রায় সাড়ে চার দশক হকির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছেন। এমনটি সাধারণত দেখা যায় না। এ দেশের হকির নাড়ী-নক্ষত্র তার জানা। কাছ থেকে দেখেছেন হকির উত্থান-পতন। দুই ক্ষেত্রেই তার ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না।
হকির সঙ্গে শামসুল বারীর সম্পর্ক আরমানিটোলা স্কুলের সুবাদে। থাকতেন বেচারাম দেউরীতে। বাসা থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে ছিল স্কুল। স্কুল সময় বটেই, অন্য সময়ও ছুটে আসতেন আরমানিটোলা স্কুলে। খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে স্কুলের অবদানই বেশি। খেলাধুলায় স্কুলের সাফল্য ও ঐতিহ্য, সার্বিক পরিবেশ তাকে টেনে নেয় খেলার মাঠে। তবে তার শুরুটা ছিল ক্রিকেটে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘স্কুলে ক্রিকেট ও হকি দুই-ই খেলতাম। তবে ক্রিকেটে আকর্ষণটা ছিল বেশি। স্কুল টিমে প্রতিনিধিত্ব করেছি ক্রিকেটে। ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ও কলেজের হয়ে ক্রিকেট খেলেছি। তারপর আর ক্রিকেটে সম্পর্ক রাখিনি। ক্রিকেট হলো সারা দিনের খেলা। আসলে পুরো দিন একটা খেলায় কাটিয়ে দেয়ার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনি। এ কারণে হকির প্রতি বেশি মনোযোগী হই। হকিতে আমার সমসাময়িক খেলোয়াড় ছিলেন আবদুস সাদেক, ইব্রাহীম সাবের। আর সিনিয়র ছিলেন বশীর আহমেদ, প্রতাপ শংকর হাজরা, সাবের আলী প্রমুখ। আসলে স্কুলে হকিময় একটা পরিবেশ ছিল।’
প্রতিযোগিতামূলক হকি খেলায় শামসুল বারীর অভিষেক হয় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আরমানিটোলা স্কুল সংলগ্ন তারা মসজিদের কাছে থাকতেন শামসুদ্দীন আহমেদ নামে এক ভদ্রলোক। ক্রীড়াপ্রেমী হিসেবে সবাই তাকে একনামে চিনতেন। ক্রীড়াঙ্গনের সর্বত্রই ছিল তার অবাধ বিচরণ। তিনি আমার খেলা দেখে আমাকে মোহামেডান ক্লাবে নিয়ে যান। ১৯৬৪ সালে মোহামেডানের হয়ে প্রথম বিভাগে হকি খেলি। পরের বছর যোগ দেই মাহুতটুলি ক্লাবে। এর কারণ, মাহুতটুলি ছিল পাড়ার ক্লাব। এ দেশের হকির ইতিহাসে এই ক্লাবটির অনেক অবদান রয়েছে। একটা পর্যায়ে ক্লাবটি তার গৌরব হারিয়ে ফেলে। ১৯৬৫ সালে আমরা বন্ধুরা মিলে ক্লাবটিকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেই। সঙ্গত কারণে নিজেও ক্লাবে নাম লেখাই। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত টানা এই ক্লাবের হয়ে খেলি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও এক বছর এই ক্লাবের হয়েই খেলেছি।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে প্রথম বিভাগ হকি লীগে প্রথম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় মাহুতটুলি ক্লাব। এই ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। পরের বছর যোগ দেন আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। সে বছর আবাহনী লীগ ও স্বাধীনতা দিবস হকিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। আবাহনীতে খেলেন ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে আবাহনী ১৯৭৬ ও ১৯৭৮ সালে লীগ, ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা দিবস হকি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়। তিনি ছিলেন পয়মন্ত খেলোয়াড়। যখন যে ক্লাবে খেলেছেন, সেই ক্লাব পেয়েছে শিরোপার সান্নিধ্য। ১৯৭৯ সালে তিনি যোগ দেন ঢাকা মোহামেডানে। সে বছর মোহামেডান লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। মোহামেডানের হয়ে লীগ শুরু করেছিলেন। মোহামেডানের হয়ে খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টানেন। ১৯৮০ সালে মোহামেডানে খেলেই অবসর নেন তিনি। বিদায়ী বছরে মোহামেডান লীগ ও শহীদ স্মৃতি হকি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়। স্বাধীনতার পর ঢাকা লীগ খেলেছেন সাত মৌসুম। এর মধ্যে ছয়বারই তার দল লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়া ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম লীগে চ্যাম্পিয়ন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৭৬ সালে ফরিদপুর লীগে চ্যাম্পিয়ন ইয়াসিন কলেজের হয়ে খেলেন।
শামসুল বারী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের নিয়মিত খেলোয়াড়। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের ভাওয়ালপুরে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপ, ১৯৬৯ সালে ঢাকায় ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপ এবং ১৯৭০ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপে খেলেন। ১৯৭২ সালে ভারতের নয়াদিল্লীতে জওহরলাল নেহরু হকি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ জাতীয় দল অংশ নেয়‘ঢাকা একাদশ’নামে। সেই দলের তিনি ছিলেন সহ-অধিনায়ক। এছাড়া আতিকুল্লাহ টুর্নামেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। আতিকুল্লাহ টুর্নামেন্টে তার দল মাহুতটুলি একবার ইস্পাহানী কাবের সঙ্গে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়। জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশীপে ১৯৭৪ সালে প্রথম বছর তিনি খেলেন কুমিল্লার হয়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশীপ। তখন হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহমুদুর রহমান মোমিন। তিনি সে বছর খেলোয়াড়দের উন্মুক্ত থাকার ঘোষণা দেন। এর ফলে খেলোয়াড়রা যে কোনো দলের হয়ে খেলার সুযোগ লাভ করেন। বন্ধুবর আবদুস সাদেকের অনুরোধে আমি কুমিল্লার হয়ে খেলি। সে বছর জাতীয় হকিতে চ্যাম্পিয়ন হয় কুমিল্লা। এরপর ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত খেলেছি ঢাকা জেলার হয়ে। এর মধ্যে ১৯৭৫, ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা জেলা।’ ১৯৭৮ সালে তিনি আন্তর্জাতিক হকি খেলা থেকে অবসর নেন। এ কারণে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে তার খেলা হয়নি।
শামসুল বারী পেনাল্টি কর্নার স্পেশালিস্ট হিসেবে সুখ্যাত ছিলেন। তাছাড়া ফুলব্যাক হিসেবে তার কভারিং ছিল দেখার মত। সে সময় কোনো খেলোয়াড়ই স্ব-স্ব পজিশনের বাইরে যেতে চাইতেন না। তিনি তার পজিশন আগলে রাখার পাশাপাশি পুরো রক্ষণভাগে বিচরণ করতেন।
শামসুল বারী স্মরণীয় খেলা প্রসঙ্গে বলেন,‘খুব সম্ভবত ১৯৬৭ সালে হকি লীগে মাহুতটুলির সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির খেলা। খেলার মাত্র ১৫ মিনিট রয়েছে। কোনো দলই গোল করতে পারেনি। এ সময় আমি সেন্টার ফরোয়ার্ড আলমগীর আদেলকে বললাম, আপনি আমার পজিশনে নেমে আসেন। আমি যাই আপনার পজিশনে। তিনি রাজি হলেন। খেলার তখন আর পাঁচ মিনিট বাকি। সবাই ধরে নেন খেলা অমীমাংসিতভাবে শেষ হচ্ছে। ঠিক সেই সময় সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে আমি গোল দেই। সেই গোলেই আমাদের দল জয়ী হয়। এটা এখনো আমাকে আপ্লুত করে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় হকি দল ঢাকায় আসে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে। পাকিস্তান দল তখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন ও এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন। অপ্রতিদ্বন্দ্বী দল। সে সময় ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন (ইপিএসএফ)-এর সেক্রেটারী ছিলেন জনাব সাফদার। তিনি জানান, ১৮ সদস্যের পাকিস্তান দল ঢাকা আসবে। ১১ জন একপক্ষে খেলবে। বাকি ৭ জন পাকিস্তানী খেলোয়াড় ও ৪ জন বাঙালি খেলোয়াড় নিয়ে আরেকটি দল গঠন করা হবে। তাহলে খেলাটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। আমরা তার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাই। আমরা বললাম, খেললে আমরা ১১ জনই বাঙালি খেলোয়াড় খেলবো। তখন সাফদার সাহেব বললেন, তোমরা আমার মুখে চুনকালি দেবে। কত গোল খাবে কে জানে? তার কথা শুনে আমাদের জেদ চেপে যায়। আমরা ১১ জন বাঙালি খেলোয়াড়ই পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলতে নামি। সবাই ভেবেছিলেন, আমরা মান-ইজ্জত ধুলোয় লুটিয়ে দেব। কিন্তু সেদিন আমরা জানবাজি রেখে খেলেছিলাম। প্রতিটি খেলোয়াড়ই খেলেছিলেন নিজেদের নিংড়ে দিয়ে। আমার কাজ ছিল পাকিস্তানের রাইট-ইন ইসলাহউদ্দীনকে প্রতিহত করা। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমাকে কাটিয়ে ইসলা যাবে, তবে বল যাবে না। আর বল গেলে ইসলা যেতে পারবে না। এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে খেলতে নেমে আমরা শক্তিশালী পাকিস্তানকে প্রায় রুখেই দিয়েছিলাম। অবশ্য শেষ মুহূর্তে এক গোল খেয়ে যাই। ওই এক গোলে আমরা হেরে যাই। তবে আমাদের খেলা দারুণভাবে প্রশংসিত হয়। পাকিস্তান দল আমাদের খেলায় অবাক হয়ে যায়। এই স্মৃতি মনে পড়লে এখনও শিহরণ জাগে। ১৯৭৮ সালে জাতীয় হকি চ্যাম্পিয়নশীপে আমি ছিলাম ঢাকা জেলার অধিনায়ক। আমার ক্যারিয়ারের শেষ জাতীয় প্রতিযোগিতা। সে প্রতিযোগিতায় আমি নিজেকে উজাড় করে দিয়ে খেলেছিলাম। রাজশাহীর সঙ্গে প্রথম ম্যাচে গোল দিয়ে শুরু করি। ফাইনালে ফরিদপুরের বিপক্ষেও গোল করি। আমরাই চ্যাম্পিয়ন হই।’
শামসুল বারী বলেন, ‘আগে হকি খেলা হত গ্রাস কোটে। খেলা ছিল আর্টিস্টিক। তাতে ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দেখানোর সুযোগ থাকতো। তবে খেলতে হত সাবধানতার সঙ্গে। বর্তমানে খেলা হয় টার্ফে। এজন্য পর্যাপ্ত স্ট্রেন্থ, স্ট্যামিনা ও স্পিড প্রয়োজন পড়ে। তবে খেলায় সেই সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায় না।’
তদানীন্তন পাকিস্তান জাতীয় দলে পূর্ব পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের সুযোগ না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানী খেলোয়াড়রা ছিলেন ফিজিক্যালি সুপিরিয়র। তারা সারা বছর খেলা ও ট্রেনিংয়ের মধ্যে থাকতেন। আর আমরা খেলতাম সিজনাল। শীতকালে খেলতাম। তারপর আর খেলার সঙ্গে সম্পর্ক থাকতো না।’
পাকিস্তানী খেলোয়াড়দের মধ্যে সেন্টার-হাফ আনোয়ার আহমেদ খান, হাসান সরদার, হানিফ খানের খেলা তার ভালো লাগতো। আর বাঙালিদের মধ্যে তার প্রিয় খেলোয়াড় আবদুস সাদেক। তিনি বলেন, আবদুস সাদেকের ছিল আলাদা স্টাইল। বাঙালি খেলোয়াড়দের মধ্যে ঘাসের কোটে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তারপর আছেন হারুন। সেন্টার-হাফ হিসেবে তিনিও দুর্দান্ত খেলেন।’
খেলোয়াড়ী জীবনের শেষদিকে শামসুল বারী ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৮৪ এবং ২০০১ সালে তিনি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে জুনিয়র বাংলাদেশ জাতীয় হকি দলের ম্যানেজার, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় এশিয়া কাপ হকিতে সহকারী টেকনিক্যাল ডেলিগেট, ১৯৮৬ সালে সাউথ কোরিয়ার সিউলে এশিয়ান গেমস এবং ১৯৯৪ সালে জাপানের হিরোশিমায় এশিয়ান গেমসে জাজ, ১৯৮৯ সালে ভারতের নয়াদিল্লী তৃতীয় এশিয়ান গেমসে জুরি বোর্ডের সদস্য, ১৯৮৮ সালে সাউথ কোরিয়ার সিউল, ১৯৯৮ সালে হল্যান্ডের উটরেখট, ২০০০ সালে ফ্রান্সের প্যারিস এবং ২০০১ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশনের কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে ইতালির কাগলিয়ারিতে বিশ্বকাপের প্রি-কোয়ালিফাইং টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ জাতীয় হকি দলের ম্যানেজার ছিলেন। ২০০৪ সালে গ্রীসের অ্যাথেন্সে বাংলাদেশ কন্টিনজেন্টের ম্যানেজার, ১৯৯৭ সালের দিল্লীতে এবং ২০০৩ সালের কুয়েতে অলিম্পিক কমিটি অব এশিয়া (ওসিএ)-এর সাধারণ পরিষদে তিনি যোগ দেন।
খেলোয়াড় থাকাবস্থায় শামসুল বারী ১৯৭৮ সালে সদস্য হন বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন লীগ এবং টুর্নামেন্ট কমিটির সম্পাদক। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮৮ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে তিনি ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে উপ-মহাসচিব। ২০০২ সাল থেকে তিনি এশিয়ান হকি ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য। আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশনের ডেভলপমেন্ট কমিটিরও সদস্য তিনি।
বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে দীর্ঘকালীন সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে সাফল্য ও ব্যর্থতার ভাগিদার হয়েছেন শামসুল বারী। ব্যর্থতার কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে তিনি বলেন,‘২০০০ সাল পর্যন্ত হকিতে এশিয়ায় আমাদের অবস্থান ছিল ৬ নম্বরে। এরপর আমরা নেমে এসেছি ৭ নম্বরে। এটা বিচার করলে আমার সাফল্য নেই। তবে আধুনিক হকিতে পা রাখার যে সোপান, সেটা আমার সময় অর্জিত হয়েছে। টার্ফ হয়েছে। নতুন স্টেডিয়াম হয়েছে। বিশ্বকাপ হকির কোয়ালিফাইং রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জিত হয়েছে। ২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক হকি ফেডারেশন প্রতিশ্রুতিশীল যে সাতটি দেশকে বাছাই করে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশ। আমার সময় ২০০১ সালে ঢাকায় ৯টি আন্তর্জাতিক দল নিয়ে প্রাইম মিনিস্টার গোল্ডকাপ হকি টুর্নামেন্ট, ২০০৪ সালে অনূর্ধ্ব-২১ চ্যালেঞ্জ কাপ টুর্নামেন্ট এবং ২০০৬ সালে এশিয়ান গেমস কোয়ালিফাইং রাউন্ড আয়োজিত হয়।’
দীর্ঘদিন হকির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে তার অভিমত হচ্ছে,‘হকিতে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। এখন আর ঘাসের কোটে খেলা হয় না। সত্যি কথা বলতে কি, ২/১টি টার্ফ দিয়ে হকির উন্নতি হবে না। প্রয়োজন পর্যাপ্ত টার্ফ। তবে হকির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অর্থনৈতিক। অর্থের কারণে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না। বয়সভিত্তিক খেলাতে বাংলাদেশের রেজাল্ট ভালো। জাতীয় দলে সেই রেজাল্ট পাওয়া যায় না। বয়সভিত্তিক খেলার সময় খেলোয়াড়দের ধ্যান-জ্ঞান থাকে খেলাতে। বয়স বেড়ে গেলে অন্য চিন্তা এসে যায়। পরিবার, সংসার, সর্বোপরি অর্থনৈতিক চিন্তা তাদের মনোযোগ কেড়ে নেয়। খেলোয়াড়দের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারলে হকিতে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। খেলোয়াড়দের চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়।’
শামসুল বারী ১৯৪৬ সালের ৮ জুলাই রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। রসায়নে মাস্টার্স করে তিনি ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বেক্সিমকো গ্রুপের হেড অব ডিপার্টমেন্ট, ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ইমপ্রেশন লিমিটেড অ্যাডভার্টাইজিং ফার্মের চেয়ারম্যান এবং ১৯৯৯ থেকে সানরাইজ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর উপদেষ্টা (প্রশাসন) হিসেবে আছেন। ১৯৬৯ সালে তিনি ফজলুল হক মুসলিম হল এবং ১৯৭২ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হকিতে ব্লু হন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা হকি খেলোয়াড়, ১৯৯৩ সালে বিএসজেএ’র সেরা হকি সংগঠক, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা হকি সংগঠক এবং জিসাসের সেরা ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে‘জিয়া গোল্ড রাইটার্স মেডেল’লাভ করেন।
খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে জীবনের ৪৫টি বছর হকি অঙ্গনে কাটিয়ে দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। শামসুল বারী সেটা পেরেছেন। হকির প্রতি আন্তরিকতা ও অপরিসীম ভালোবাসার কারণে এমনটি সম্ভব হয়েছে। এখনও তিনি হকির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছেন। যখনই প্রয়োজন পড়ে, স্টেডিয়াম এলাকায় ঢুঁ মেরে যান। স্টেডিয়াম না এলে তিনি যেন স্বস্তি খুঁজে পান না। যতদিন সম্ভব, তিনি হকির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চান। হকিই যে তার প্রধান পরিচয়। #
১৬-১০-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ

অ্যাথলেটিকসের উজ্জ্বল মুখ মীর শরীফ হাসান/ দুলাল মাহমুদ

বাস্কেটবলের বুলবুল/ দুলাল মাহমুদ