অ্যাথলেটিকসের উজ্জ্বল মুখ মীর শরীফ হাসান/ দুলাল মাহমুদ

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির শহর হিসেবে সুখ্যাতি কুষ্টিয়ার। এ নামটি উচ্চারিত হলেই বুকের মধ্যে বেজে ওঠে লালনগীতি। শুধু সাংস্কৃতিক দিক দিয়েই নয়, ক্রীড়াক্ষেত্রেও একটা সময় কুষ্টিয়ার ছিল গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বিশেষ করে অ্যাথলেটিক্স অঙ্গনে কুষ্টিয়া থেকে উঠে এসেছেন জাতীয় পর্যায়ের দেশবরেণ্য অনেক অ্যাথলেট। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ঝলমল করেছে তাদের পারফরম্যান্সে। এই কৃতী অ্যাথলেটদের একজন হলেন মীর শরীফ হাসান। ষাট ও সত্তর দশকের অ্যাথলেটিকসের উজ্জ্বল এক মুখ। অ্যাথলেটিকসের সঙ্গে তার মেলবন্ধন সেই শৈশবে। গতির মধ্যেই ছিল তার আনন্দ। লাফ-ঝাঁপ কিংবা দুরন্ত গতিতে ছুটে চলার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন জীবনের স্পন্দন। অল্প বয়সেই অ্যাথলেটিকসের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। প্রথম জীবনের স্মৃতি এখনও আপ্লুত করে তাকে, ‘আমি ছিলাম কুষ্টিয়া মুসলিম স্কুলের ছাত্র। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই জড়িয়ে পড়ি খেলাধুলায়। শুরুতেই অ্যাথলেটিকসের প্রেমে পড়ে যাই। এর কারণ, কুষ্টিয়া স্কুলের পরিবেশ। এই স্কুলটি ছিল অ্যাথলেটিকস গড়ার নন্দনকানন। খন্দকার আবুল হাসান, কাজী আলমগীর, জেমস জয় মল্লিকের মতো খ্যাতিমান অ্যাথলেটদের দেখে আমি দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হই। তারা ছিলেন সে সময়কার অ্যাথলেটিকসের জ্যোর্তিময় তারকা। সব সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেন। বালক মনে তাদের সম্পর্কে একটা প্রভাব পড়ে। তাদের মতো হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে অ্যাথলেটিকসে ঝুঁকে পড়ি।’
জাম্পিং ইভেন্ট দিয়ে শুরু হয় মীর শরীফ হাসানের অ্যাথলেটিকস জীবন। পোলভল্ট, লংজাম্প ও হাইজাম্প ছিল তার প্রিয়। স্কুল পর্যায়ে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি চ্যাম্পিয়ন হন ইন্টার স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়। ১৯৬৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বদলে যায় তার অ্যাথলেটিকস জীবন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কলেজে ওঠার পর আমার ঝোঁক চাপে স্প্রিন্টের প্রতি। দূরপাল্লার দৌড়ে ঐতিহ্য ছিল কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের। সেই ঐতিহ্যের অংশীদার হওয়ার জন্য আমিও পাল্টে ফেলি আমার ট্র্যাক। বেছে নেই ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটার স্প্রিন্ট। দূরপাল্লার দৌড় হয়ে ওঠে আমার এগিয়ে চলার ট্র্যাক।’
ইন্টার স্কুল অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় তিনি ছুটেছেন দুরন্ত ঘোড়ার মতো। তার ইভেন্টে কেউই তাকে টেক্কা দিতে পারেনি। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সালে তিনি ইন্টার কলেজ চ্যাম্পিয়ন হন। এরমধ্যে একবার প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয় যশোরে। সে সময় কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিযোগিতা হতো ইন্টার-কলেজ নামে। ১৯৬৯ সালে তিনি ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরও তার বিজয়রথ অব্যাহত থাকে। ডিগ্রি লেভেলে তিনি চ্যাম্পিয়ন হন ইন্টার কলেজে। ইন্টার ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে তিনি তিনটি ইভেন্টেই চ্যাম্পিয়ন হন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করার পর খেলাধুলা অব্যাহত রাখার জন্য ফের ল’তে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তার সাফল্যের ধারা অব্যাহত থাকে।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস দলের অপরিহার্য সদস্য ছিলেন মীর শরীফ হাসান। এই দলের হয়ে তিনি নিয়মিত জাতীয় অ্যাথলেটিকসে অংশ নিয়েছেন। ১৯৬৬ সালে লাহোরে পাকিস্তান গেমসে প্রথমবারের মতো তিনি অংশ নেন। সেবার তার ইভেন্ট ছিল ৫০০০ মিটার স্প্রিন্ট । এরপর ১৯৬৭ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ৫০০০ ও ১৫০০ মিটার স্প্রিন্টে, ১৯৬৮ সালে ঢাকায় পাকিস্তান ন্যাশনাল গেমসে ৫০০০ ও ১০০০০ মিটার স্প্রিন্টে, ১৯৬৯ সালে পেশোয়ারে পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ৫০০০ মিটার স্প্রিন্টে, ১৯৭০ সালে করাচীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পাকিস্তান জাতীয় গেমসে অংশ নেন। করাচীতে ১৫০০ মিটার স্প্রিন্টে তিনি চতুর্থ হওয়াটাই তার সেরা সাফল্য। পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকসে বাঙালি ক্রীড়াবিদদের সাফল্য না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানী অ্যাথলেটদের বেশিরভাগই ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর। ফিজিক্যালি তারা ছিলেন অনেক বেশি শক্তিশালী। সারা বছরই তারা প্র্যাকটিসের মধ্যে থাকতেন। অ্যাথলেটিকস করাটাই ছিল তাদের চাকরির অংশ। তাছাড়া তারা অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা পেতেন। আমার ইভেন্টে আলোচিত ছিলেন হাবিলদার গোলাম রসুল, হাবিলদার আবদুল করিম, হাবিলদার আনোয়ার হোসেন, হাবিলদার সাঙ্গার খান প্রমুখ। এঁরা সবাই এশিয়ান পর্যায়ে পদক পেয়েছেন। তাদের সঙ্গে পারার কথা চিন্তাই করাই যেত না।’
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিভাবান অ্যাথলেট ছিলেন মীর শরীফ হাসান। এ কারণে অল্প যে ক’জন বাঙালি জাতীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ পান, তিনি তাদের অন্যতম। ১৯৭০ সালের জুলাইতে অ্যাবোটাবাদ এবং ডিসেম্বরে লাহোরে পাকিস্তান জাতীয় অ্যাথলেটিকস প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যোগ দেন তিনি। এই দুই ক্যাম্পেই বাঙালিদের মধ্যে তার সঙ্গে ছিলেন পোলভল্টার মিরাজ, স্প্রিন্টার সিরাজুল ইসলাম। এই ক্যাম্পে যোগ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পে বাঙালিদের পক্ষে সচরাচর সুযোগ পাওয়া সহজ ছিল না। ক্যাম্প ছিল অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন। তবে এ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মাধ্যমে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। পরবর্তীকালে তা থেকে আমি উপকৃত হয়েছি।’
স্বাধীনতার পরও মীর শরীফ হাসান অ্যাথলেটিকসে তার নৈপুণ্যের ঝিলিক দেখান। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তিনি অংশ নেন প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিকসে। তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দলের অধিনায়ক। ঢাকা স্টেডিয়ামে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় তিনি ৮০০ ও ১৫০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণ, ৪ গুণন ৪০০ মিটার রিলেতে রৌপ্য এবং ৫০০০ মিটার স্প্রিন্টে ব্রোঞ্জ পদক পান। ৮০০ মিটারে সময় নেন ২ মিনিট ২ দশমিক ৩ সেকেন্ড। ১৫০০ মিটার তার সময় ছিল ৪ মিনিট ১৪ দশমিক ২ সেকেন্ড। ১৯৭৩ সালে তিনি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা অ্যাথলেট। ১৯৭৪ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে ৮০০ ও ১৫০০ মিটার এবং ৪ গুণন ৪০০ মিটার রিলেতে তিনি রৌপ্য পদক লাভ করেন। এরপর অ্যাথলেট ক্যারিয়ার থেকে সরে দাঁড়িয়ে প্রশিক্ষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মনোযোগী হন।
পাকিস্তান আমলে তার দেখা সেরা অ্যাথলেট প্রসঙ্গে তিনি হার্ডলার গোলাম রাজিক, স্প্রিন্টার আবদুল খালেক, স্প্রিন্টার মোবারক শাহ, পোলভল্টার আল্লাদিতার নাম উল্লেখ করেন। এছাড়া তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে তার মতে সেরা অ্যাথলেট ছিলেন স্প্রিন্টার সিরাজুল ইসলাম, পোলভল্টার মিরাজউদ্দিন, হার্ডলার জাহাঙ্গীর ফয়েজ, ত্রিপল জাম্পার আলতাফ হোসেন। তবে তিনি মোবারক শাহকে অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন।
অতীতের সঙ্গে বর্তমানের অ্যাথলেটিকস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় তো কোনো ট্রেনিং ছিল না। তখন টেকিনিক্যাল কিংবা স্পেসিফিক কোনো ট্রেনিংয়ের বালাই ছিল না। কোনো প্রতিযোগিতার আগে কোনো রকমে ১০/১২ দিনের ট্রেনিং হতো। কোনো ট্রেনার ছিল না। এখন অনেক সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। টেকনিক্যালি অনেক এগিয়ে গেছে। তবে আমাদের সময় খেলাধুলার পরিবেশ ছিল বেশ উন্নত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায় অংশ নিতো। এখন পরিবেশ অনেক বদলে গেছে। মন উচাটন করার মতো নানা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। খেলার মাঠের আকর্ষণ হ্রাস পেয়েছে। নানা কারণে নেমে গেছে বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসের মান।’ এ অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকস নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে। অ্যাথলেটদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলেই কেবল উন্নতি হতে পারে। তাছাড়া স্পোর্টস মেডিসিনকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কোনো কিছু করে লাভ হবে না। হয়তো হঠাৎ হঠাৎ কিছু সাফল্য পাওয়া যাবে, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।’
ট্র্যাক থেকে সরে দাঁড়ানোর পরও অ্যাথলেটিকসের আকর্ষণ ছাড়তে পারেননি তিনি। জড়িয়ে আছেন ওতপ্রোতভাবে। ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেন ‘কুইন অব স্পোর্টস’কে। জীবনের শুরুতে সেই যে অ্যাথলেটিকসে জড়িয়ে পড়েন, আজও তার সংস্পর্শ ত্যাগ করতে পারেননি।
১৯৭২ সালে যোগ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাথলেটিক কোচ হিসেবে। ১৯৭৩ সালে রাশিয়ার মস্কোতে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি গেমসে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। ১৯৭৬ সালে পূর্ব জার্মানীর লাইপজিগে আট মাসব্যাপী অ্যাথলেটিকস প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে সনদপত্র লাভ করেন। একই সময় তিনি আইএএএফ লেভেল ওয়ান কোর্স সম্পন্ন করেন। এ সময় তিনি ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের ট্রেনিং, বিজ্ঞান, স্পোর্টস মেডিসিন, স্পোর্টস সাইকোলজি, ফিজিক্যাল কালচার সংক্রান্ত বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ১৯৮৬ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় প্রথম এশিয়ান জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে বাংলাদেশ দলের প্রশিক্ষক ছিলেন। তাতে বাংলাদেশ একটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন। দুটি পদকই পান মিলজার হোসেন। ১৯৮৭ সালে ভারতের কলকাতায় সাফ গেমসে বাংলাদেশ জাতীয় অ্যাথলেটিকস দলের প্রশিক্ষক ছিলেন। শাহ আলম ১০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে রৌপ্য, মজিবর রহমান ৩০০০ মিটার ট্রিপল চেসে ব্রোঞ্জ, বাংলাদেশ পুরুষদের ৪ গুণন ১০০ মিটার রিলেতে রৌপ্য, মহিলাদের ৪ গুণন ১০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং ৪ গুণন ৪০০ মিটার রিলেতে ব্রোঞ্জ পদক পায়। ১৯৮৬ সালে সাউথ কোরিয়ার সিউলে দশম এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ ছিলেন। ৮০০ মিটার স্প্রিন্টে চতুর্থ হন মিলজার হোসেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় সাফ গেমসে প্রাক্কালে জাজদের কোচিংয়ে অংশ নেন। ১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডের শর্পশায়ারে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় খেলাধুলা প্রশিক্ষণে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৯৬-৯৭ সালে জার্মানীর মাইনসে ১৪ মাসব্যাপী অ্যাথলেটিকস কোর্সে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ২০০৪ সালে অস্ট্র্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস সাইন্স ফ্যাকাল্টিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক স্পোর্টস সেমিনারে অংশ নেন। ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত ১৩তম কমনওয়েলথ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। তার অর্জিত জ্ঞান তিনি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে যাচ্ছেন।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে যেভাবে অ্যাথলেটিকস চলছে, সেভাবে উন্নতি করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে যেভাবে ট্রেনিং চলছে, তা পরিকল্পনাবিহীন। সিস্টেমেটিক ও সাইন্টিফিক নয়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের যে বয়সে ট্রেনিং দেয়া হয়, তা যথাযথ সময় নয়। তদুপরি ধারাবাহিকভাবে ট্রেনিং দেয়া হয় না। পশ্চিমা দেশগুলোতে অল্প বয়স থেকে ট্রেনিং দেয়া হয়। জার্মানীতে দেখেছি, পাঁচ বছরের ছেলেমেয়েদের মাল্টিপারপজ ট্রেনিং দেয়ার পর তাদের মধ্য থেকে কার কোন খেলায় প্রতিভা আছে, তাকে সেই খেলার জন্য সিলেকশন করা হয়। শরীরের গঠন অনুযায়ী সিলেকশন করা হয়। ১২-১৩ বয়স হলে তখন তাদের স্পেশালিস্ট ট্রেনিং দেয়া হয়। টানা ট্রেনিংয়ের মধ্যে থাকার পর ১৪ বছর বয়সেই তারা টপ পারফর্ম করে। এই বয়সেই তারা অলিম্পিক গেমসে স্বর্ণপদক পেয়ে থাকেন। বিশেষত সাঁতার, জিমন্যাস্টিকসে সাফল্য অর্জন করেন। অবশ্য দূরপাল্লার দৌড়ে বয়স্করা সুবিধা পান। বাংলাদেশে স্কুল পর্যায়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় টানা ট্রেনিং দেয়া উচিত। গ্রাম-গঞ্জ থেকে ছেলেমেয়েদের তুলে আনতে হবে। তাদের শিক্ষা ও পুষ্টির ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া প্রত্যেক ক্রীড়াবিদের ব্যক্তিগত ডাটা কালেকশন করে রাখতে হবে।
দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সামগ্রিক চিত্র প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘আগে স্কুলগুলোতে ড্রিল টিচার ছিল। তারা নিয়মিত খেলাধুলা করাতেন। সপ্তাহে একদিন কাস ছিল। বর্তমানে সেই ড্রিল টিচাররা অবসর নিয়েছেন। তাদের স্থলে অনেক স্কুলেই ড্রিল টিচার নিয়োগ দেয়া হয়নি। পদগুলো শূন্য রয়ে গেছে। অন্য কোনো শিক্ষককে নামকাওয়াস্তে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা খেলাধুলা করান না। স্কুলের পাশাপাশি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা। খেলাধুলা করাতে হলে মাঠ, জিমনেসিয়াম লাগে। অধিকাংশ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ নেই। নেই ক্রীড়া সরঞ্জাম। ক্রীড়া খাতে টাকা-পয়সা ব্যয় করা হয় না। বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা খুবই নাজুক। তাদের খেলার মাঠের কোনো অস্তিত্ব নেই। এ বিষয়ে সবার চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও ক্রীড়া খাতে তেমনভাবে টাকা-পয়সা দেয় না। তাহলে খেলাধুলা হবে কি করে?’
মীর শরীফ হাসান ক্রীড়াঙ্গনের বিদ্যমান পদ্ধতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘দেশের খেলাধুলা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বড় বড় সংস্থা রয়েছে। খেলাধুলায় যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তাদের এসব স্থানে দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন। যথাযোগ্য লোককে যথাযথ জায়গায় বসতে দিতে হবে। আরেকটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, আম গাছ লাগিয়ে এক মাসের মধ্যে আম খাওয়ার সুযোগ নেই। পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। সবকিছু হতে হবে নিয়মতান্ত্রিক। নতুবা দায়সারভাবে কোনো কিছু অর্জন সম্ভব নয়।’
মীর শরীফ হাসানের জন্ম কুষ্টিয়ার আমলাপাড়ায়, ১৯৪৭ সালের ২০ ডিসেম্বর। বর্তমানে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর। পেশাগত কারণে তাকে খেলার মাঠের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেই হয়। তারপরও ব্যক্তিগত আগ্রহ ও ইচ্ছেয় ক্রীড়া জাগরণে তিনি ভূমিকা রেখে চলেছেন। কখনো কাসরুমে, কখনো খেলার মাঠে, কখনো কলম হাতে। তার লেখা প্রতিবেদন ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)’র ‘অলিম্পিক রিভিউ’ নামক জার্নাল এবং দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার ভাবনায় অষ্টপ্রহর থাকে খেলাধুলা। কীভাবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, কী করলে অ্যাথলেটিকসে সাফল্য পাওয়া যাবে- তা নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের অনেক মূল্যবান সময়। প্রকৃত অর্থেই ক্রীড়া আন্দোলনের তিনি একজন নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। খেলার মাঠে জীবন কাটিয়ে দেয়ার কারণে তার কোনো খেদ নেই। তবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সার্বিক অবস্থায় বিষন্ন হয়ে যায় তার মন। তখন তার মনে হয়, কী লাভ হলো জীবনের সেরা সময়টা খেলার মাঠে কাটিয়ে দিয়ে। #
১-৯-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ

বাস্কেটবলের বুলবুল/ দুলাল মাহমুদ