আমাদের ফুটবলাররা-২

দুর্দান্ত লেফট-ব্যাক জনি

রক্ষণভাগের একজন সজাগ ও সতর্ক প্রহরী হিসেবে ফুটবল মাঠে জনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তাঁকে ফাঁকি দিয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের গোল করাটা ছিল কঠিন ব্যাপার। নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের পাশাপাশি সুঠামদেহী ও শক্ত-সামর্থ্য গড়নের এই লেফ্ট-ব্যাক ওভারল্যাপিং করে আক্রমণ গড়ে তুলতেন। ঠাণ্ডা মেজাজের এই ডিফেন্ডার সাইড লাইন ধরে ছুটতে ছুটতে আউট ইন ডজ দিয়ে এবং প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের ফাঁকি দিয়ে ওপরে উঠে আক্রমণভাগকে সাহায্য করতেন। কখনো কখনো বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিপুণভাবে বলের জোগান দিয়ে তৈরি করে দিতেন গোলের উৎস। স্পিড, টেকনিক ও ফুটবল সেন্সের প্রয়োগ ঘটিয়ে ফুটবল ক্যারিয়ারের পুরো সময়টা খেলেছেন বড় ক্লাবের হয়ে। এমনটি সম্ভব হয়েছে ফুটবলের প্রতি তাঁর ধৈর্য, নিষ্ঠা ও একাগ্রতার কারণে।
১৯৬১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ইমতিয়াজ সুলতান জনির জন্ম। ঢাকার নীমতলিতে থাকতেই ফুটবল খেলায় জড়িয়ে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে নিয়মিত খেলতেন। এরপর মিরপুর চলে যাওয়ায় বাড়ির পাশের পল্লবী সিটি ক্লাব মাঠে তাঁর জন্য হয়ে ওঠে সোনায় সোহাগা। সিটি ক্লাবের হয়ে কৈশোরে ফুটবল খেলে পরিপক্ব হয়ে উঠতে থাকেন। একই সঙ্গে মিরপুর আদর্শ স্কুল এবং বাংলা কলেজের হয়ে স্কুল ও কলেজ ফুটবল টুর্নামেন্টে সবার নজর কেড়ে নেন। তবে ফুটবলে আকৃষ্ট ও উত্তরণের পেছনে বড় ভাই হকি এবং ফুটবলে জাতীয় দলের খেলোয়াড় ও কোচ এহতেশাম সুলতানের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুলের হয়ে খেলার সময় রহমতগঞ্জের কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ১৯৭৯ সাল থেকে তিন বছর প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে রহমতগঞ্জের হয়ে খেলেন। রহমতগঞ্জের হয়ে খেলা শুরু করেছিলেন লিঙ্কম্যান হিসেবে। এক খেলায় লেফট-ব্যাক আহত হওয়ায় তার জায়গায় খেলতে নেমে জনির পরিচয় হয়ে ওঠে লেফট ব্যাক। ১৯৮২ সালে যোগ দেন আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। আবাহনীর হয়ে চারটি বছর ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। প্রথম বছরেই ফেডারেশন কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন ও লীগে রানার্সআপ হয় তাঁর দল। এরপর ফুটবল লীগে হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন (১৯৮৩, ১৯৮৪, ১৯৮৫) হয় আবাহনী। ১৯৮৫ সালে তিনি ছিলেন আবাহনীর অধিনায়ক। তাঁর নেতৃত্বে আবাহনী লীগ ও ফেডারেশন কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। এমন সাফল্যের পরও তাঁকে দলত্যাগ করতে হয়। ১৯৮৬ সাল থেকে তাঁর ঠিকানা হয়ে ওঠে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। মোহামেডানও হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন (১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৮) হয়। টানা ৬ মৌসুম লীগ চ্যাম্পিয়ন দলে খেলার বিরল গৌরব অর্জন করেন জনি। ১৯৯৩ সালে ফুটবল ক্যারিয়ারের শেষ বছর মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হলে তিনি সপ্তমবারের মতো লীগ শিরোপার স্বাদ পান। আবাহনী ও মোহামেডানের হয়ে ১২ বছরে ১০ মৌসুম ফুটবল লীগ খেলে ৭ বার লীগ চ্যাম্পিয়ন এবং ৩ বার রানার্সআপ দলে খেলা তাঁর কৃতিত্ব ও সাফল্যের পরিচায়ক। ফেডারেশন কাপ ফুটবলে আবাহনীর হয়ে ২ বার (১৯৮২, ১৯৮৫) ও মোহামেডানের হয়ে ২ বার (১৯৮৭, ১৯৮৯) চ্যাম্পিয়ন এবং ৩ বার রানার্সআপ (১৯৮৩, ১৯৮৮ ও ১৯৯১) দলের খেলোয়াড় ছিলেন। ১৯৮২ সালে আবাহনীর খেলোয়াড় হলেও মোহামেডানের আমন্ত্রণে ভারতের আশীষ জব্বার স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে যান। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের কোনো দলের প্রথম শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে তিনিও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
১৯৮২ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হওয়ার পর দীর্ঘ এক দশক ৫ ফুট সাড়ে ৮ ইঞ্চি উচ্চতার জনি ছিলেন জাতীয় দলের অপরিহার্য সদস্য। ১৯৮২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। এরপর দিল্লিতে নবম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৩ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, মালয়েশিয়ায় ২৭তম মারদেকা ফুটবল, ১৯৮৪ সালে নেপালে প্রথম সাফ গেমস, ইন্দোনেশিয়ায় ৮ম এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমস, পেশোয়ারে কায়েদে আজম স্মৃতি ফুটবল, বিশ্বকাপ ফুটবলের গ্র“প-৩ কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮৬ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দল, সিউলে দশম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৭ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ ব্লু দল, কোলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমস, ১৯৮৮ সালে আবুধাবিতে নবম এশিয়া কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮৯ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, ইসলামাবাদে চতুর্থ সাফ গেমস এবং ১৯৯০ সালে বেইজিংয়ে একাদশ এশিয়ান গেমসে তিনি খেলেছেন। ইনজুরির কারণে ১৯৯১ সালে কলম্বো সাফ গেমস ও ব্যাংকক এশিয়ান কাপে খেলতে পারেননি। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট কাপ দিয়ে দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক দলেও তাঁকে না ডাকায় তাঁর সেই আশা পূর্ণ হয়নি।
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সর্বাধিকবার অধিনায়ক হয়েছেন জনি। ১৯৮৫ সালে তিনি ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে জাতীয় ফুটবল দল, ১৯৮৬ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, ১৯৮৭ সালে কোলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমস এবং ১৯৮৮ সালে আবুধাবিতে নবম এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলের ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ লাল দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ম্যাচটি জনির ফুটবল ক্যারিয়ারে স্মরণীয় হয়ে আছে। উজ্জ্বল হয়ে আছে মা ও মণি গোল্ডকাপের ফাইনালে মোহামেডানের হয়ে আবাহনীকে ১-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্মৃতি। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি জনিকে ১৯৮৭ সালের সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। ১৯৮৮ সালে তিনি পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে মোহামেডানের কোচের দায়িত্ব পালন করেন। জনির মতো বুদ্ধিদীপ্ত পরিণত ফুটবলার আজ বিরল।

দুর্ভেদ্য গোলরক্ষক মহসিন

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ফুটবলে সেরা গোলরক্ষকদের একজন মহসিন। একাগ্রতা, অধ্যবসায় ও দৃঢ়তা দেখিয়ে প্রায় দেড় দশক ফুটবল মাঠে রাজত্ব করেছেন। তাঁর গ্রিপিং, পজিশন জ্ঞান ও গেম রিডিং ছিল চমৎকার। বডি ফিটনেস, অসীম সাহস, ক্ষিপ্রতা ও নিখুঁত অনুমান ক্ষমতার কারণে প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারদের পক্ষে তাকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে জড়ানো ছিল খুবই কঠিন কাজ। প্রচণ্ড গতির শটের সামনে বুক চিতিয়ে দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে যেমন দাঁড়াতেন, তেমনি গোল বাঁচাতে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের পায়ের ওপর অবলীলায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন। উচ্চতায় একটু খাটো হলেও তা পুষিয়ে দিতেন তীক্ষè বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দিয়ে। কোনো কিছুতেই বিচলিত হতেন না। ওপরের বল গ্রিপ করতে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতেন।
মোহাম্মদ মহসিনের জন্ম ১৯৬৫ সালের ১ আগস্ট ঢাকার মানিকগঞ্জে। খুব শৈশবেই ফুটবলে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় বিভাগে খেলেন রেলওয়ে ব্লুজের হয়ে। একই বছর রেলওয়ে দলের হয়ে শের-এ-বাংলা কাপে অংশ নেন। ওই বছর আবাহনীর আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নুও জাতীয় ফুটবলে রেলওয়ের হয়ে খেলেন। মহসিনের খেলায় মুগ্ধ হয়ে মহসিনকে চুন্নু আবাহনীতে নিয়ে আসেন। আবাহনীর মতো দলে তিনি ছিলেন তৃতীয় গোলরক্ষক। কিন্তু একাগ্রতা ও অধ্যবসায় দিয়ে ১৯৮১ সালে তিনি ক্রমান¦য়ে প্রথম একাদশে স্থান করে নেন। তিন বছর আবাহনীর হয়ে খেলার পর এক ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়েই ১৯৮২ সালে যোগ দেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। মোহামেডানে তখন দেশসেরা গোলরক্ষক লাল মোহাম্মদ। এই চ্যালেঞ্জে জয়ী হয় মহসিন। দৃঢ়তা ও একাগ্রতা দিয়ে তিনি প্রথম একাদশে স্থান করে দেন। মোহামেডানে যোগ দেয়ার পর মহসিন নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরেন। টানা ৫ বছর মোহামেডানের গোলপোস্ট আগলিয়েছেন পরম মমতায়। ১৯৮৫ সালে তিনি মোহামেডানের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সাল থেকে আবারো তাঁর ঠিকানা হয়ে ওঠে আবাহনী ক্রীড়াচক্র। টানা ৭ বছর তিনি হয়ে ওঠেন আবাহনীর রক্ষণভাগের প্রাণপুরুষ। ১৯৯১ সালে তাঁর নেতৃত্বে আবাহনী অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। তিনিই একমাত্র ফুটবলার যিনি মোহামেডান ও আবাহনীর অধিনায়ক হওয়ার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। আবাহনীর হয়ে তিনবার (১৯৮১, ১৯৮৯-৯০, ১৯৯১) এবং মোহামেডানের হয়ে ২ বার (১৯৮২ ও ১৯৮৬) লীগ চ্যাম্পিয়ন এবং মোহামেডানের হয়ে ২ বার (১৯৮২ ও ১৯৮৩) ও আবাহনীর হয়ে ১ বার (১৯৮৮) ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন দলের হয়ে খেলেছেন। এছাড়া ১৯৮২ সালে ভারতের কোলকাতায় আশীষ জব্বার স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৯০ সালে স্বাধীনতা দিবস ফুটবল চ্যাম্পিয়ন, ভারতের নাগজি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন, ১৯৯১ সালে বিটিসি কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৯৪ সালে কোলকাতার চার্মস কাপে চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর হয়ে তিনি দুর্দান্ত ক্রীড়াশৈলী উপহার দেন। ১৯৯৪ সালে পুল ভেঙে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্রে। তাঁর অধিনায়কত্বে মুক্তিযোদ্ধা ফেডারেশন কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৯৫ সালে অবসান ঘটে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারের।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের হয়ে দীর্ঘ এক যুগ ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি উচ্চতার মহসিন বিশ্বস্ততার সঙ্গে আগলিয়েছেন গোলপোস্ট। ১৯৮২ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দলে প্রথম অন্তর্ভুক্ত হলেও খেলার সুযোগ মেলেনি। ওই বছর দিল্লি এশিয়ান গেমসে তাঁর অভিষেক হয়। প্রথম ম্যাচে অধিনায়ক মোতালেব ভারতের সঙ্গে খুব বেশি সুবিধা করতে না পারায় চীনের সঙ্গে মহসিন খেলতে নামেন। এটি তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা ম্যাচ হয়ে আছে। এদিন শক্তিশালী চীন বাংলাদেশের রক্ষণব্যুহ ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয়। বাংলাদেশ ০-১ গোলে হারলেও মহসিন ৪/৫টি নিশ্চিত গোল থেকে দলকে রক্ষা করেন। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় তৃতীয় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, মালয়েশিয়ায় ২৭তম মারদেকা ফুটবল, ১৯৮৪ সালে ঢাকায় ২৪তম এশীয় যুব ফুটবলের গ্র“প ২-এর বাছাই পর্ব, ইন্দোনেশিয়ায় অষ্টম এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের পেশোয়ারে কায়েদে আজম ট্রফি, ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমস, বিশ্বকাপ ফুটবল গ্র“প ৩-এর কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮৬ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দল, সিউলে দশম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৭ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সাদা দল, ১৯৯১ সালে সিউল ও কুয়ালালামপুরে প্রি-অলিম্পিক, কলম্বোয় পঞ্চম সাফ গেমস, ১৯৯২ সালে ব্যাংকক এশিয়া কাপ, ১৯৯৩ সালে সপ্তম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল এবং জাপান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে অংশ নেন। ১৯৮৪ সালে ঢাকায় ২৪তম এশিয়ান যুব ফুটবলের গ্র“প ২-এর খেলা, ১৯৯১ সালে কলম্বোয় পঞ্চম সাফ গেমসে এবং ১৯৯৩ সালে ঢাকায় সপ্তম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। মহসিন অসংখ্য স্মরণীয় খেলা উপহার দিয়েছেন। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালে ফেডারেশন কাপ ফুটবলে আবাহনীর হয়ে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পান। ১৯৮৩ সালে মারদেকা ফুটবলে স্বাগতিক মালয়েশিয়ার স্ট্রাইকার জয়নাল আবেদিনের প্রচণ্ড শট অভাবনীয়ভাবে ফিরিয়ে দেন। এছাড়া ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, আরব আমিরাত ও আলজেরিয়ার মতো শক্তিশালী দলের পেনাল্টি শট রুখে দেয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি তাঁকে সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে।
সহজাত দক্ষতার অধিকারী মহসিন নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক হিসেবে।


রক্ষণভাগের অতন্দ্রপ্রহরী কায়সার হামিদ

রক্ষণভাগের অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন কায়সার হামিদ। দীর্ঘকায়, সুঠামদেহী ও প্রাণোচ্ছ্বল এই ফুটবলার তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত ক্রীড়াশৈলী দিয়ে দর্শকদের মন জয় করে নেন। বুদ্ধি খাটিয়ে বিচক্ষণতার সঙ্গে খেলে তিনি বিপক্ষ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে সমীহ আদায় করে নিতেন। তাঁর বল ডিস্ট্রিবিউশন, ট্যাকলিং, ওভারল্যাপিং, হেডিং ও ড্রিবলিং ছিল সুন্দর। তাঁকে পাশ কাটিয়ে বিপদ সীমানায় ঢুকে যুৎসই আক্রমণ রচনা করা প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের পক্ষে অনেকটা কঠিন হয়ে পড়তো। রক্ষণ সীমানায় তাঁর কাছ থেকে উঁচুতে বল কেড়ে নেয়া হয়ে পড়তো দুস্কর। রক্ষণ কাজে সহায়তা ছাড়াও প্রায়ই দ্রুতবেগে উপরে উঠে এসে আক্রমণ চালাতেন। বল নিয়ে উপরে উঠে তাঁর ঠেলে দেয়া ক্রস, থ্র“ পাস বা উঁচু মাপা লবগুলো প্রায়শই উৎস হয়ে উঠতো গোলের। এ কারণেই রক্ষণভাগে খেললেও তাঁর কাছ থেকে এসেছে অসংখ্য গোল। এছাড়াও কায়সারের দূরপাল্লার আচমকা তীব্র শট কিংবা উঁচু লব থেকে নিখুঁত হেড অনেক সময় বিপক্ষ দলের কাছে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়াতো। তবে রাইট ব্যাক কিংবা স্টপার হিসেবে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ¡ী।
কায়সার হামিদের জন্ম ১৯৬৪ সালের ১ ডিসেম্বর সিলেটে। শৈশব থেকেই তিনি খেলাধুলার অনুকূল পারিবারিক পরিবেশ পেয়েছেন। পরিবারের সবাই খেলাধুলার সঙ্গে কম-বেশি জড়িত। মা রানী হামিদ দাবায় নতুন মাইলফলক গড়েছেন। বাবা লে. কর্নেল (অব:) এম এ হামিদ, ভাই সোহেল হামিদ ও ববি হামিদ খেলোয়াড় ও সংগঠক হিসেবে সুপরিচিত। সঙ্গত কারণে পরিবারের কাছ থেকে খেলাধুলায় উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। ছোট বেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট হন। খুব কম সময়ের মধ্যে তিনি লাইমলাইটে উঠে আসেন। ১৯৮১ সালে বড় ফুটবলের আসরে প্রথম আÍপ্রকাশ। দ্বিতীয় বিভাগে কামাল স্পোর্টিং-এ খেললেও অনূর্ধ্ব-১৮ বছর বয়সের জাতীয় জুনিয়র ফুটবলে তিনি ঢাকার হয়ে খেলেন। টুর্নামেন্টে শ্রেষ্ঠ উদীয়মান ডিফেন্ডার হিসেবে সবার নজর কেড়ে নেন। এ টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলায় ১৯৮২ সালে রহমতগঞ্জের হয়ে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে সরাসরি খেলার সুযোগ পান। রাইট সুইপার ব্যাক হিসেবে ঠাণ্ডা মাথায় তাঁর শুটিং, হেডিং, কাভারিং, স্পিড, স্ট্যামিনা, স্পট জাম্প এবং খেলার প্রতি একাগ্রতা ও নিষ্ঠার কারণে তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরের বছর বিজেএমসি এবং ১৯৮৪ সালে দ্বিতীয় দফায় রহমতগঞ্জের হয়ে খেলেন। রহমতগঞ্জের হয়ে দাপট ও নির্ভরতার সঙ্গে খেলে তিনি রক্ষণভাগের শক্ত খুঁটি হিসেবে পরিগণিত হন। চমৎকার ফুটবল সেন্স, ধীর-স্থির, শক্ত ও নিপুণ ট্যাকলিং, অফুরন্ত দম, সুন্দর ও নির্ভুল রিসিভিং এবং আক্রমণ তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর মুন্সিয়ানা দিয়ে সে বছর তিনি হয়ে ওঠেন রক্ষণভাগের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। তাঁর অসাধারণ নৈপুণ্যে সেবার রহমতগঞ্জ লীগে তৃতীয় হয়। পরের বছরই তিনি আমন্ত্রণ পান মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের। সেই যে মোহামেডানে এলেন, তারপর মোহামেডানই হয়ে ওঠে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা। মোহামেডান তাঁর সুখ-দুঃখের সহচর। মোহামেডানের জন্য নিজেকে মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়ে খেলেছেন। কায়সার হামিদকে পেয়ে মোহামেডানের স্টপার পজিশনও পূর্ণতা পায়। ঠাণ্ডা মাথায় বিপক্ষ আক্রমণগুলোকে রুখে দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালানো, রক্ষণদুর্গ আগলে রেখে ওভারল্যাপ করে বিপক্ষ গোল সীমানায় আঘাত হানা, কখনো কখনো গোল আদায় করে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পারদর্শী। হেডওয়ার্ক ছিল ভালো। ছয় ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতার কায়সারকে এয়ারে বিট করা সহজ ব্যাপার ছিলো না।
মোহামেডানকে যেমন অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন, তেমনি হয়েছেন অনেক জয়ের নায়ক। মোহামেডানের হয়ে ফুটবল ক্যারিয়ারে কায়সার পাঁচবার (১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৩ ও ১৯৯৬) লীগ এবং তিনবার ফেডারেশন কাপের (১৯৮৭, ১৯৮৯ ও ১৯৯৫) শিরোপার স্বাদ পেয়েছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি ছিলেন সেরা ফুটবলার। ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে তিনি মোহামেডানের অধিনায়ক ছিলেন। সেবার লীগে রানার্সআপ হয় মোহামেডান।
চমৎকার ট্যাকলিং, ইন্টারসেপশন ও প্রতিপক্ষের উইং থেকে সেন্টারের সময় যুৎসই অবস্থান নেয়ার জন্য তাকে সলিড খাম্বা বা চীনের প্রাচীর নামে অভিহিত করা হতো। কায়সার খুব বেশি ফাইনাল চার্জে যেতেন না। পেছনে সহযোগী ডিফেন্ডার না থাকলে ফাইনাল চার্জে যাবার কথা চিন্তাই করতেন না। প্রতিপক্ষের কোনো ফরোয়ার্ড বল নিয়ে অগ্রসর হতে থাকলে তাঁর ওপর চাপ রেখে এমনভাবে পিছিয়ে যেতেন যে, ফরোয়ার্ডটি ডজ করার মত মোক্ষম সময় খুঁজে পেতেন না। তারপরও কোনো ফরোয়ার্ড ডজ করার চেষ্টা করলে ট্যাকল করে বল কেড়ে নিতেন। চমৎকার স্লাইডিং ট্যাকল করতে পারতেন। কুইক স্পট জাম্পে দুর্বলতা থাকলেও তা অন্যভাবে পূরণ করতেন। থ্রো ইন ও কর্নার কিকের সময় প্রতিপক্ষের গোলমুখে গিয়ে নিজেই গোল করেছেন কিংবা সহযোগী খেলোয়াড়দের গোলের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে অবসর নেয়া পর্যন্ত ১২ বছরে মোহামেডানের হয়ে তিনি গোল করেছেন ৩০টিরও বেশি। ১৯৯৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর আবাহনীর সঙ্গে লীগের শেষ ম্যাচ খেলেন।
আন্তর্জাতিক ফুটবলেও কায়সার হামিদ দেশের হয়ে সর্বোচ্চ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। ১৯৮৪ সালটি ছিল তাঁর জীবনের মাইলফলক। ওই বছর তাঁর চমকপ্রদ নৈপুণ্যে মোহামেডানে আমন্ত্রণ পাবার পাশাপাশি অভিষেক হয় আন্তর্জাতিক ফুটবলে। নেপালে অনুষ্ঠিত প্রথম সাফ গেমসে তিনি খেলেন। ১৯৮৫ সালে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে তিনি প্রথম গোল করেন। একই বছর পাকিস্তানের পেশোয়ারে কায়েদে আজম ফুটবল এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে খেলেছেন। সাফ গেমসে মালদ্বীপের সঙ্গে দুটি গোল দেন। ফাইনালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ টাইব্রেকারে ১-৪ গোলে হারলেও টাইব্রেকার থেকে একমাত্র গোলটি করেন কায়সার হামিদ।
১৯৮৬ সালে ঢাকার প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দল ও করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে খেলেছেন। পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট একাদশের সঙ্গে ১-৪ গোলে হারলেও একমাত্র গোলটি তাঁর। ১৯৮৬ সালে সিউলে দশম এশিয়ান গেমস, ১৯৮৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সাদা দল ও কোলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমসে অংশ নেন। ১৯৮৮ সালে আবুধাবিতে নবম এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে, ১৯৮৯ সালে ঢাকায় ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ লাল দলের সদস্য ছিলেন। একই বছর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে চতুর্থ সাফ গেমস, ১৯৯০ সালে চীনের বেইজিংয়ে একাদশ এশিয়ান গেমস, ১৯৯১ সালে কলম্বোয় পঞ্চম সাফ গেমস, ১৯৯২ সালে ব্যাংককে এশিয়া কাপে, ১৯৯৩ সালে সপ্তম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, ১৯৯৩ সালে জাপান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে, একই বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল এবং ১৯৯৩ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে তিনি বাংলাদেশের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এক দশকের আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ারে বেশ কয়েকটি নজরকাড়া গোল করেছেন। তবে ১৯৮৫ সালে ঢাকায় বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ম্যাচটিতে তাঁর ক্রীড়ানৈপুণ্য সবার প্রশংসা অর্জন করে। এ ম্যাচে বাংলাদেশ ২-১ গোলে জয়ী হয়। প্রথম গোলটি আসে তাঁর হেড থেকে। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে তিনি অসাধারণ ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন।
টাইব্রেকার ও পেনাল্টি থেকে গোল করার ক্ষেত্রেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। ম্যাচ টেম্পারামেন্ট, স্কিল, বডি ফিটনেস, টেকনিক্যাল জ্ঞান, সাহস, নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা ও গোল করার ক্ষেত্রে পারদর্শিতার কারণে একজন পরিপূর্ণ স্টপার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন কায়সার হামিদ। তিনি ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯০ ও ১৯৯১ সালে কোলকাতা লীগে কোলকাতা মোহামেডানের হয়েও খেলেছেন।
বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ১৯৮৮ সালে ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ১৯৯০ সালে কায়সার হামিদকে সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। তিনি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৩ সালে। ১৯৯৭ সালে রজতজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সেরা একাদশ নির্বাচন করে এবং ২০০৫ সালে ১০ জন ফুটবলারকে সম্মানিত করে। দুটি তালিকায় স্থান করে নেন কায়সার হামিদ।
একজন ডিফেন্ডারের যাবতীয় গুণাবলী পুরোমাত্রায় বিদ্যমান থাকায় কায়সার হামিদ ছিলেন সফল, আছেন জনপ্রিয়।

কিং ব্যাক মোনেম মুন্না

মৃত্যুটা নিয়তি নির্ধারিত হলেও ফুটবলার মোনেম মুন্নার আকস্মিক চলে যাওয়াটা ছিল হৃদয়বিদারক। ১৮ দিন জীবন-মৃত্যুর দোলায় দুলতে দুলতে শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালের ১২ ফেব্র“য়ারি পরাভব মানতে হয় ফুটবল মাঠের অপ্রতিদ্বন্দ¡ী এই কিং ব্যাককে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই ফুটবলারের অকাল মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে দেশের ফুটবলের। রক্ষণভাগে খেলে ফুটবলে তারকা হওয়া কঠিন ব্যাপার। একটা ভুলের কারণে সমালোচিত হতে হয়। কিন্তু মুন্না ছিলেন ব্যতিক্রম। অসাধারণ এই ফুটবল প্রতিভা রক্ষণভাগের দুর্গ আগলিয়ে হয়ে ওঠেন মহাতারকা।
মোনেম মুন্নার জীবনটা ফুটবলময়। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় ১৯৬৮ সালে ৯ জুন মুন্নার জন্ম। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় এ দেশের ফুটবলের যখন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা, তখন আর দশজন কিশোরের মতো মুন্নার ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন হয়ে ওঠে ফুটবল। তবে তাঁর বুকে ফুটবলের চারা রোপণ করে ১৯৭৫ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত লীগ চ্যাম্পিয়ন আবাহনী ও নবাগত ব্রাদার্স ইউনিয়নের মধ্যকার খেলা। তারুণ্যের প্রতিনিধি এ দু’দলের প্রাণবন্ত ফুটবল তাঁর চোখে এঁকে দেয় স্বপ্নের অঞ্জন। ১৯৭৬-এ কিশোর ফুটবলার হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হয়, হাতে-খড়ি হয় নারায়ণগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময়। স্কুলের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লার ফুটবল নিয়ে ছুটতে থাকেন দুরন্ত গতিতে। তারপর আর কোথাও থেমে থাকেননি। অমিত প্রতিভাবান এই ফুটবলার অল্প সময়ের মধ্যে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেন। আলাউদ্দিন খান, আশরাফউদ্দিন খান চুন্নুর মতো কিংবদন্তি ফুটবলারের উত্তরসূরি পেয়ে যায় বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জ। কিশোর ফুটবল, আন্তঃজেলা ও তোলারাম কলেজের হয়ে আন্তঃকলেজ ফুটবল খেলে দারুণভাবে সাড়া জাগাতে সক্ষম হন। বন্দরের নবীগঞ্জ মাঠে ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলেন। মুন্নার নৈপুণ্যে চ্যাম্পিয়ন হয় টাইগার স্পোর্টিং। বন্দরের সিরাজউদ্দৌলার হয়ে শুরু করেন প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল। রক্ষণভাগের অতন্দ্র প্রহরী মুন্না নারায়ণগঞ্জকে মাতিয়ে দিয়ে ১৯৮০ সালে পা রাখেন রাজধানী ঢাকায়। ফুটবলের সূতিকাগার পাইওনিয়ার ফুটবল লীগে বাংলাদেশ পোস্ট অফিসের হয়ে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত খেলেন। হাজারো ফুটবলারের মাঝে প্রতিভার দ্যুতি দিয়ে ঝলসে ওঠেন তিনি। যে কারণে ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় বিভাগের দল শান্তিনগর এবং ১৯৮৩ সালে লেফট ব্যাক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রে স্থান করে নেন। চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি ১৯৮৪ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অভিষেক হয় মুন্নার। প্রথম বিভাগে খেলার পর এই ডিফেন্ডারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। গেম রিডিং, ম্যাচ টেম্পারামেন্ট, স্ট্যামিনা ছিল অসাধারণ। মেধাবী, পরিশ্রমী, নির্ভরযোগ্য ও সুঠামদেহী এই লড়াকু ফুটবলার রক্ষণভাগে খেললেও দলকে সবসময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একাই দলকে উজ্জীবিত করার বিরল গুণের অধিকারী ছিলেন। প্রয়োজনে সামনে গিয়ে শুটিংয়ের মাধ্যমে গোল করেছেন। প্রথম বছর থেকেই তাকে নিয়ে শুরু হয়ে যায় রশি টানাটানি। দু’মৌসুম মুক্তিযোদ্ধার হয়ে খেলে ১৯৮৬ সালে পাড়ি জমান ব্রাদার্স ইউনিয়নে। ১৯৮৭ সালে যোগ দেন কৈশোরের প্রিয় দল আবাহনীতে। এরপর আর কোথাও চলে যাবার কথা তিনি ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেননি। টানা ১১ বছর আবাহনীর হয়ে মন-প্রাণ উজাড় করে দিয়ে খেলেন। আবাহনী ও মুন্না যেন একাকার হয়ে যায়। আবাহনীতে ফেডারেশন কাপ ফুটবলে লেফট ব্যাক হিসেবে খেললেও লীগে খেলেন রাইট ব্যাক হিসেবে। এরপর দলের প্রয়োজনে বিভিন্ন পজিশনে খেলেছেন। দুটো সাইডেই খেলেছেন সাবলীলভাবে। তবে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেছেন লেফট্ ব্যাকে। একজন অলরাউন্ডার ফুটবলার হিসেবে গড়ে ওঠে তাঁর পরিচিতি। তাঁর শারীরিক দক্ষতার কারণে তিনি এই বাড়তি সুবিধাটুকু আদায় করে নিতে পেরেছেন। পরিশ্রম, দৃঢ়তা, আÍবিশ্বাস ও শারীরিক সক্ষমতার পাশাপাশি অসম্ভব সাহস ও আক্রমণাÍক ফুটবলার হিসেবে তিনি হয়ে ওঠেন অপ্রতিদ্বন্দ¡ী। এছাড়া তাঁর সহজাত ওভারল্যাপিং দলের আক্রমণকে জোরদার করেছে। বল কন্ট্রোল, ইন্টারসেপশন, ট্যাকলিং ও দুর্দান্ত হেডিং তাঁকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। কোনো ফরোয়ার্ডের পক্ষে তাঁকে ডজ দিয়ে ডিফেন্সে ঢোকা সহজ ছিল না। তাঁর অসাধারণ ট্যাকলিং ক্ষমতার কারণে প্রতিপক্ষের কোনো ফরোয়ার্ড তাঁর মুখোমুখি হতে সাহসী হতে চাইতেন না। তিনি হয়ে ওঠেন আবাহনীর আস্থা, অনুপ্রেরণা ও নির্ভরতার প্রতীক।
দায়িত্ববোধ মোনেম মুন্নাকে দারুণভাবে জাগিয়ে তোলে। খেলোয়াড়ী জীবনের শেষ বছরগুলো আবাহনীর পুরো দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে খেলেছেন। খেলোয়াড়দের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তরুণদের ওপর ছিল তাঁর অসম্ভব প্রভাব। ১৯৯৪ সালে আবাহনীর অধিনায়ক হওয়ার পর মুন্নাকে দেখা যায় অন্য রূপে। একদম তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে তিনি যেভাবে আবাহনীকে ডামফা কাপ ও লীগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন এবং ফেডারেশন কাপে রানার্সআপ করেন, তা উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ১৯৯৫ সালেও মুন্নার নেতৃত্বে আবাহনী লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। একই অধিনায়কের নেতৃত্বে আবাহনীকে দু’বার লীগ চ্যাম্পিয়ন করার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। মৌসুমের মাঝামাঝি সময় মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতে নেমে ঝলসে ওঠেন মুন্না। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গোল করে দলকে এগিয়ে নেন। দলের প্রয়োজনে তাঁকে নানারকম দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। গোল না পেলে রক্ষণভাগ সামাল দিয়ে ওপরে উঠে আক্রমণের উৎস তৈরি করেছেন। গোল সামাল দিয়েছেন। প্রচণ্ড চাপ নিয়ে তাকে খেলতে হয়েছে। দলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। ইনজুরি সত্ত্বেও পেইন কিলার নিয়ে খেলেছেন। এটাই তাঁর জীবনের জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আপাদমস্তক এই জাত ফুটবলার ছিলেন জেদী, স্পষ্টভাষী ও আপোষহীন। নিজে যেটা ভালো মনে করতেন, সেটা করতে পিছপা হতেন না। কখনো-সখনো রাফ চার্জ করে ও ওভারল্যাপিং করে দলের জন্য সমস্যা তৈরি করেছেন। এটুকু খুঁত ছাড়া রাফ অ্যান্ড টাফ ফুটবলার মুন্নার কোনো বিকল্প ছিল না। দু’বার লীগ শিরোপা জয়ে নেতৃত্ব দেয়া ছাড়াও আরো দু’বার লীগ শিরোপার (১৯৮৯-৯০ ও ১৯৯৯) স্বাদ পেয়েছেন। ১৯৯৬ সালেও তিনি আবাহনীর নেতৃত্ব দেন। টানা তিন মৌসুম আবাহনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পালনের নতুন মাইলফলক গড়েন। সেবার লীগে রানার্সআপ হয় আবাহনী। ১৯৯১ সালে মুন্নাকে নিয়ে রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তাঁকে দলভুক্ত করার জন্য শীর্ষ ক্লাবগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও ব্রাদার্স ইউনিয়ন এক মৌসুমের জন্য মুন্নার দর হাঁকে ৩০ লাখ টাকা। কিন্তু দলের প্রতি আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কারণে মুন্না ২০ লাখ টাকা পারিশ্রমিকে থেকে যান আবাহনী ক্লাবে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত ফুটবলার হিসেবে নতুন মাইলফলক গড়েন মুন্না। যা আজ অবধি কেউ ম্লান করতে পারেননি। দলের জন্য ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন দিলেও সেবার আবাহনীর কাছ থেকে জীবনের বড় আঘাত পেয়েছিলেন মুন্না। তাঁকে তুচ্ছ কারণে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠান চলাকালে তাঁকে সাসপেনশন লেটার ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দলের প্রতি আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কারণে তিনি আবাহনী ত্যাগ করেননি। ১৯৯০ সালে ভারতের নাগজি ট্রফি, ১৯৯১ সালে বিটিসি কাপ ও ১৯৯৪ সালে কোলকাতার চার্মস কাপে চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর তিনি ছিলেন অন্যতম কাণ্ডারী। ১৯৯৭ সালে তাঁর নেতৃত্বে আবাহনী ফেডারেশন কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তিনি আর খেলতে নামেননি।
আন্তর্জাতিক ফুটবলেও দাপটের সঙ্গে খেলেছেন মুন্না। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সাফ গেমসে তাকে স্ট্যান্ড-বাই রাখা হয়। ১৯৮৬ সালে ঢাকায় চতুর্থ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ লাল দলের সঙ্গে স্টপার ব্যাক পজিশনে খেলেন। তবে করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে তিনি পরিপূর্ণভাবে খেলেন। তিনি খেলেন রাইট-ব্যাক পজিশনে। ১৯৮৬ সালের সিউলের দশম এশিয়ান গেমসে তিনি ছিলেন বাংলাদেশ দলের কনিষ্ঠতম সদস্য। ১৯৮৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ ‘ব্লু’ দলে, কোলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমসে, ১৯৮৮ সালে আবুধাবিতে নবম এশিয়ান কাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে, ১৯৮৯ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচে, ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে অংশ নেন। টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ লাল দল। এরপর অংশ নেন ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সাফ গেমসে। ১৯৯০ সালে চীনে অনুষ্ঠিত একাদশ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৯২ সালে ব্যাংককের এশিয়া কাপ, ১৯৯৩ সালে ঢাকায় সপ্তম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাফ গেমসে খেলেন। ১৯৯৫ সালে মায়ানমারে চার জাতি, মাদ্রাজ সাফ গেমসে ও ১৯৯৭ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রথম রাউন্ডে তিনি বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন। ইনজুরির কারণে প্রথম দুটি ম্যাচ খেলতে পারেননি। সৌদি আরবের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফুটবলে তিনি শেষ ম্যাচ খেলেন। দীর্ঘ এক যুগ জাতীয় দলের হয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সুনাম ও সুখ্যাতির সঙ্গে ফুটবল খেলেছেন। দূর থেকে কামানের গোলার মতো প্রচণ্ড জোরে শট মেরে বেশ কয়েকটি গোলও করেছেন। তবে ১৯৮৬ সালে পাকিস্তানের করাচিতে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে জীবনের স্মরণীয় গোল করেছেন তিনি। টুর্নামেন্টে ইরানের সঙ্গে তাকে প্রথম একাদশে রাখা হয়। পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দলে সেটাই ছিল তাঁর অভিষেক ম্যাচ। মাঝ মাঠের বাঁ দিক থেকে মোসাদ্দেক বল তুলে দেন প্রতিপক্ষের বক্সের ওপরে। এমিলি দৌড়ে আসেন। মুন্নাও ছুটে যান। তিনি এমিলিকে বলটা ছেড়ে দিতে বলেন। বলটা মাটিতে পড়ে সামান্য উঠেছিল। বাঁ পায়ের আলতো শটে মুন্না গোল করেন। এই গোলেই বাংলাদেশ ইরানের সঙ্গে জয়ী হয়। এরপর আর মুন্নাকে সাইড লাইনে বসে থাকতে হয়নি।
দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে মুন্নার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিদেশেও। ১৯৭৬ সালে হংকংয়ের পেশাদার ফুটবল লীগে ‘কেরোলিন হিল’ ক্লাবের হয়ে খেলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন প্রবাদপ্রতীম ফুটবলার সালাহউদ্দিন। তারপর বিদেশের মাটিতে ফুটবলশৈলী দিয়ে দর্শক-হৃদয় জয় করে নেন মুন্না। ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালে কোলকাতা ফুটবল লীগে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেন উপমহাদেশের অন্যতম একজন সেরা ফুটবলার হিসেবে। ১৯৯১ সালে মুন্নার অসাধারণ ক্রীড়া নৈপুণ্যে চ্যাম্পিয়ন হয় ইস্টবেঙ্গল। স্টপার হিসেবে শক্ত ট্যাকলিং, হেডওয়ার্ক, দূর থেকে কামানের গোলার মতো শট, দুর্দান্ত পাস ও দু’পায়ের সাবলীল ক্রীড়াশৈলী দিয়ে মুন্না ইস্টবেঙ্গলে ঠাঁই করে নেন। তাঁর সঙ্গে আবাহনী থেকে গিয়েছিলেন আসলাম, রুমী, গাউস। কিন্তু মুন্নার দূরপাল্লার নিখুঁত পাস বাড়ানোর ক্ষমতা দেখে ইস্টবেঙ্গলের কোচ নাইমুদ্দিন তাঁকে স্টপার থেকে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে খেলান। কোলকাতার শক্ত ট্যাকেলসমৃদ্ধ লীগে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে আÍবিশ্বাস ও সাহসের সঙ্গে খেলে যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করেন, তা কিংবদন্তি হয়ে আছে। তিনি যেন রীতিমত বিপ্লব ঘটান। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ক্রীড়াশৈলী দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালে লীগের মাঝামাঝি সময় ইস্টবেঙ্গল যখন লীগ টেবিলে পিছিয়ে পড়ে, তখন তারা পুনরায় দ্বারস্থ হয় মুন্নার। যথারীতি সেবারও চ্যাম্পিয়ন হয় ইস্টবেঙ্গল। ১৯৯৫ সালে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলেন ফেডারেশন কাপ ফুটবল। মুন্না মূলত রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হলেও ইস্টবেঙ্গলের হয়ে তিনি খেলেন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে। নতুন পজিশনে খেলতে নেমে মুন্না বুঝিয়ে দেনÑ তিনি জাত ফুটবলার। মুন্না তাঁর নান্দনিক ক্রীড়াশৈলী দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন ‘ফুটবল-ঈশ্বর’। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের আর কোনো ক্রীড়াবিদ মুন্নার মতো খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি। অধিনায়ক হিসেবেও মুন্না ছিলেন একজন সফল ফুটবলার। ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে তাঁর নেতৃত্বে ফুটবল লীগে চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম ফুটবল লীগেও দাপটের সঙ্গে খেলেন মুন্না। তাঁর নেতৃত্বে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব চট্টগ্রাম লীগে বেশ ক’বার চ্যাম্পিয়ন হয়। তবে ১৯৯৪ সালে তরুণদের নিয়ে তিনি যেভাবে আবাহনীকে চ্যাম্পিয়ন করেন, তাতে তাঁর নেতৃত্বগুণ স্মরণীয় হয়ে আছে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা এসেছে মুন্নার সুযোগ্য নেতৃত্বে। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে মায়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতির ফুটবল টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
১৯৯৭ সালে ফুটবল খেলা ছেড়ে দিলেও তিনি ফুটবল থেকে দূরে সরে থাকেননি। ১৯৯৯ সাল থেকে আবাহনীর ফুটবল ম্যানেজার হিসেবে তিনি নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে তাঁকে করা হয় ফুটবল কমিটির টেকনিক্যাল উপদেষ্টা। কিন্তু অসুস্থ শরীরে আবাহনীর মতো একটি জনপ্রিয় ক্লাবের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে অসম্ভব চাপ, পরিশ্রম ও মানসিক দুশ্চিন্তা তাঁর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু আবেগপ্রবণ ও মেজাজী এই ফুটবলার কোনো কিছুকে আমলে নেননি। ফুটবলই ছিল তাঁর আবেগ-উচ্ছ্বাস-ভালোবাসা। ফুটবল থেকে দূরে থাকার কথা তিনি ভাবতে পারতেন না। যে কারণে কষ্ট-দুঃখ, ব্যথা-বেদনায় নীলকণ্ঠ হয়ে তিনি নিজেকে সঁপে দেন ফুটবলে।
অনবদ্য ফুটবল নৈপুণ্য প্রদর্শন করে অগণিত ফুটবল পিপাসুর হৃদয় জয় করে নিয়ে কিংবদন্তীতে পরিণত হলেও মুন্না নিজের প্রতি তেমনভাবে যতœবান ছিলেন না। যে কারণে তাঁর দেহটা আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যেতে থাকে। ১৯৯৯ সালে মারাÍক কিডনি সমস্যায় ভোগার পর বোনের কিডনি নিয়ে সে যাত্রায় বেঁচে যান। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর মৃত্যুকে পরাস্ত করতে পারেননি মাঠ কাঁপানো এই ফুটবলার। ১২ বছরের সংসার জীবন যেদিন পূর্ণ হয়, সেদিনই তিনি স্ত্রী, এক কন্যা ও এক পুত্র রেখে যাত্রা করেন পরলোকে।
ফুটবলে বর্ণাঢ্য ও গৌরবোজ্জ্বল জীবনের অধিকারী ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার মোনেম মুন্না কখনো লেফট ব্যাক, কখনো রাইট ব্যাক, কখনো স্টপার এবং কখনো মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেছেন। শক্ত ট্যাকলিং, হেডওয়ার্ক ও দূর থেকে প্রচণ্ড জোরে শট করে গোল করার ক্ষেত্রে মুন্না ছিলেন অদ্বিতীয়। তবে রক্ষণভাগে তিনি ছিলেন গ্লাডিয়েটর। ভারতের প্রথিতযশা ক্রীড়া সাংবাদিক রূপক সাহার অভিমত হচ্ছে : ‘মুন্নার ফুটবল টেকনিক সম্পর্কে যে কথাটা সব থেকে আগে আসে, সেটি হলো তাঁর লম্বা পাস বাড়ানোর ক্ষমতা। ডান ও বাঁÑ দু’পায়েই স্বচ্ছন্দে তিনি ত্রিশ-চল্লিশ গজের নিখুঁত পাস বাড়াতে পারতেন। একেবারে ইউরোপিয়ান ফুটবলারদের মতো। মাঝ মাঠ থেকে বাড়ানো ওর সেই পাস বিপক্ষ ডিফেন্সকে এক একটা সময় মারাÍক বিপদের মধ্যে ফেলে দিত।’ অসম্ভব সাহস, দৃঢ়চেতা মনোবল আর শেষ পর্যন্ত লড়াই করার অনমনীয় মনোভাবের কারণে মুন্না অন্যদের চেয়ে আলাদা। পাওয়ার ফুটবলের যথাযথ প্রতিনিধি ছিলেন মুন্না। প্রতিবাদী ও রাগী এই ফুটবলার কোনো অন্যায় মেনে নিতে পারতেন না। মাঠে ও মাঠের বাইরে তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী, অনুভূতিপ্রবণ ও আÍমর্যাদাবোধসম্পন্ন। এ দেশের নতুন প্রজন্মের ফুটবলারদের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ ও প্রেরণার উৎস। ১৯৮৯ সালে তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার লাভ করেন ১৯৯১ সালে। ২০০৫ সালে মরণোত্তর জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পান।
মোনেম মুন্না পরাজিত হতে ভালোবাসতেন না। ফুটবল মাঠে বরাবরই জয়ী হতেন। অথচ জীবনের খেলায় হেরে গেছেন তিনি। কিন্তু দেশের ফুটবলে মুন্নার যে কীর্তি ও গৌরবগাথা, তাতে তিনি অবিনশ্বর হয়ে আছেন। মুন্না যেন এদেশের ফুটবলের প্রতিভূ।



ছান্দসিক ফুটবলার রুমী

নব্বই দশক থেকে বাংলাদেশের ফুটবলে শিল্পী ফুটবলারদের দেখা নেই বললেই চলে। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝিলিক দিয়ে যেসব ফুটবলার সবার মন জয় করে নেন, সেই ঘরানার সর্বশেষ প্রজন্মের একজন হলেন রুমী। স্টাইলিশ এই ফুটবলারের বল কন্ট্রোল, বল ড্রিবলিং, দুরন্ত গতিতে ছুটে চলার মধ্যে একটা ছন্দ থাকতো। থাকতো মুগ্ধতার ছোঁয়া। আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় মাঝ মাঠ থেকে বল পেয়ে যেভাবে ঢুকে পড়তেন, তাতে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে ত্রাসের সৃষ্টি হতো। গোল করার ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানার পাশাপাশি অসংখ্য গোলের উৎস ছিলেন তিনি। তাঁর খেলায় দেখা যেত সূক্ষ্ম বুদ্ধি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও কৌশলের চমৎকার প্রয়োগ।
খুলনার সন্তান মোঃ রিজভী করিম রুমীর জন্ম ১৯৬৮ সালের ১৮ মে কুষ্টিয়ায়। ছোটবেলা থেকেই ছিল ফুটবলের প্রতি তাঁর দুর্বলতা। খুব অল্প বয়সেই তিনি ফুটবলের কলাকৌশলগুলো রপ্ত করে নেন। যে কারণে ফুটবলের উঁচু পর্যায়ে সহজেই স্থান করে নেন। ১৯৮৪ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে সাধারণ বীমার হয়ে রুমীর অভিষেক হয়। প্রথম বছরেই তিনি তাঁর চমকপ্রদ ক্রীড়াশৈলী দিয়ে সবার দৃষ্টি কেড়ে নেন। আজাদ স্পোর্টিং-এর সঙ্গে হ্যাটট্রিকসহ ডামফা কাপ ফুটবলে ৬ গোল দিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন। টানা তিন বছর সাধারণ বীমাতে খেলার পর ১৯৮৭ সালে যোগ দেন বিআরটিসিতে। লীগে আবাহনী ক্রীড়াচক্রের সঙ্গে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। তাঁর অসাধারণ ক্রীড়া নৈপুণ্যের জন্য বিআরটিসি ২-১ গোলে হারায় আবাহনীকে। সেই সঙ্গে পরের বছর রুমীর ঠিকানা হয়ে যায় আবাহনী। আবাহনীতে যোগ দিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরার সুযোগ পেয়ে যান রুমী। হয়ে ওঠেন আবাহনীর অনেক সাফল্যের নায়ক। ১৯৯০ সালে ভারতের নাগজি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন, ঢাকার স্বাধীনতা দিবস ফুটবল চ্যাম্পিয়ন, ফুটবল লীগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন, ১৯৯১ সালে ঢাকায় বিটিসি কাপ চ্যাম্পিয়ন, ফুটবল লীগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৯৪ সালে কোলকাতার চার্মস কাপ চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর সাফল্যের পেছনে তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। প্লে-মেকার রুমীর দু’গোলে ১৯৯০ সালের স্বাধীনতা দিবস ফুটবলের ফাইনালে আবাহনী ২-১ গোলে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। ফুটবল লীগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন আবাহনীর হয়ে ১০ গোল করেন। এক গোল বেশি দিয়ে লীগে সর্বাধিক গোলদাতা হন আসলাম। ১৯৯১ সালে ভারতের কেরালায় ৩৩তম নাগজি ট্রফিতে আবাহনী রাউন্ড রবিন লীগে ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে হারায় ৪-০ গোলে। দুটি গোল দেন রুমী। তাঁর দেয়া গোলে আবাহনী ত্রিবান্দ্রাম টাইটানিয়ামকে ১-০ গোলে হারায়। ১৯৯১ সালে ঢাকায় বিটিসি কাপের সেমিফাইনালে আবাহনী ২-১ গোলে পরাজিত করে কোলকাতার ইস্টবেঙ্গলকে। একটি গোল আসে রুমীর পা থেকে। ১৯৯২ সালে রুমীর গোলে আবাহনী সফরকারী ইংল্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ফুটবল দলকে হারায়। ভারতের স্বাধীনতা কাপে আবাহনী সেমিফাইনালে বিদায় নিলেও রুমী ৩ ম্যাচে ৩ গোল করেন। ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয় ডামফা কাপ ফুটবলে ৮ গোল দিয়ে সর্বাধিক গোলদাতা হন। এর মধ্যে রয়েছে রহমতগঞ্জের সঙ্গে হ্যাটট্রিক। লীগেও সর্বাধিক গোলদাতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। ১৯৯৩ সালে রুমী ছিলেন আবাহনীর অধিনায়ক। ১৯৯৪ সালে কোলকাতার চার্মস কাপ ফুটবলে তাঁর নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। ৬ মৌসুম আবাহনীর হয়ে খেলে ১৯৯৪ সালে যোগ দেন নবাগত শক্তি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রে। সেবার মোহামেডান, আবাহনী ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের জেন্টেলম্যান এগ্রিমেন্টের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কয়েকজন তারকা ফুটবলার মুক্তিযোদ্ধায় যোগ দিয়ে নতুন ধারার সূচনা করেছিলেন। সেবার মুক্তিযোদ্ধা ফেডারেশন কাপে চ্যাম্পিয়ন ও লীগে রানার্সআপ হয়ে চমক সৃষ্টি করে। দু’বছর মুক্তিযোদ্ধায় খেলার পর ১৯৯৬ সালে ফিরে আসেন আবাহনীতে। ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার এই ফুটবলার ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি লীগে খেলেন।
ঘরোয়া ফুটবলের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফুটবলেও ঝলক দেখিয়েছেন রুমী তাঁর পায়ের কারুকাজের। ১৯৮৭ সালের সাফ গেমসের জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত ৪০ জনের মধ্যে তিনি আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি হয়ে ওঠেন জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য। অভিষেক হয় আবুধাবিতে নবম এশিয়া কাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের খেলা দিয়ে। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ লাল দলের খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। একই বছর ইসলামাবাদে চতুর্থ সাফ গেমস, ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমস, ১৯৯২ সালে ব্যাংককে এশিয়া কাপে, ১৯৯৩ সালে ঢাকায় সপ্তম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলে, জাপান ও আরব আমিরাতে বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে, ১৯৯৩ সালে ঢাকায় সাফ গেমসে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। রুমী ইসলামাবাদ সাফ গেমসে শ্রীলংকার সঙ্গে ২টি, কলম্বো সাফ গেমসে ভারতের সঙ্গে ২টি, বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে শ্রীলংকা ও জাপানের সঙ্গে একটি করে গোল করেন। ১৯৯২ সালে ব্যাংকক এশিয়া কাপে বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন রুমী। ১৯৯১ সালে কোলকাতা ফুটবল লীগে মোনেম মুন্না ও আসলামের সঙ্গে তিনি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলেন।
রুমীর পা থেকে এসেছে অসংখ্য স্মরণীয় গোল। ১৯৯০ সালে স্বাধীনতা দিবস ফুটবলের ফাইনালে আবাহনীর হয়ে মোহামেডানের সঙ্গে মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে একক নৈপুণ্যে দুটি চোখ ঝলসানো গোল করেন। ১৯৯১ সালে বিটিসি কাপের সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে আবাহনীর নির্ধারিত সময়ের খেলা ১-১ গোলে ড্র হয়। অতিরিক্ত সময়ের ১৪ মিনিটে মাঝ মাঠের সাইড লাইনের কাছাকাছি থেকে নেয়া বরুনের শটটি ধরে রুমী এগিয়ে যান। প্রতিপক্ষের সীমানায় ২/৩ জনকে কাটিয়ে গোলবারের কাছাকাছি যেয়ে মাটি কামড়ানো শটে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে গোল করেন। ইসলামাবাদ সাফ গেমসে শ্রীলংকা ও কলম্বো সাফ গেমসে ভারতের সঙ্গে দর্শনীয় গোল করেন। ১৯৯২ সালে রুমী বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন।
শৈল্পিক ফুটবল ও ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে যেসব ফুটবলার দর্শকদের মুগ্ধতা অর্জন করেছেন, রুমী তাঁদের অন্যতম।



প্রতিপক্ষের ত্রাস সাব্বির

ছিপছিপে হালকা-পাতলা গড়নের দেখতে ছোটখাট ফুটবলারটি দ্রুতগতিতে ছুটে যেয়ে যেভাবে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাবে ত্রাসের সৃষ্টি করতেন, তাতে বিস্মিত না হয়ে পারা যেতো না। কখনো রাইট উইং দিয়ে, কখনো মধ্যমাঠ দিয়ে ঢুকে পড়ে তিনি দলের প্রতিটি আক্রমণের নেতৃত্ব দিতেন। অসাধারণ ড্রিবলার এই ফুটবলারের বলের ওপর দখল, ডজিং, পাসিংÑ সবই ছিল নিখুঁত। উইথ দ্য বল অসম্ভব স্পিডি ছিলেন সাব্বির। গোলের উৎস তৈরি করে দেয়ার পাশাপাশি চকিতে অসংখ্য গোল এসেছে তাঁর পা থেকে।
আক্রমণভাগের তুখোড় ফুটবলার সৈয়দ রুম্মান-বিন-ওয়ালী সাব্বিরের জন্ম ১৯৬৮ সালের ৫ জুন। ১৯৮২ সালে পাইওনিয়ার ফুটবল লীগে পাড়ার ক্লাব সোনালী স্পোর্টিং দিয়ে শুরু হয় তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার। ১৯৮৩ সালে খেলেন মোহাম্মদপুরের ইয়ং ব্রাদার্সে। ১৯৮৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগের দল মুসলিম ইন্সটিটিউটের হয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৮৫ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে ধানমন্ডি ক্লাব দিয়ে যাত্রা শুরু হয়। দু’বছর ধানমন্ডির হয়ে খেলে চমক সৃষ্টি করেন। ১৯৮৫ সালে ধানমন্ডির হয়ে মোহামেডানের সঙ্গে খেলায় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ধানমন্ডি ১-২ গোলে পিছিয়ে থাকাবস্থায় গোলরক্ষক মহসীনকে পরাস্ত করে দর্শনীয় গোলে সমতা আনেন। ১৯৮৭ সালে আমন্ত্রণ পান মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের। টপ ফর্মে থাকা মনুকে টপকে প্রথম একাদশে স্থান করে নেন। ফেডারেশন কাপ ফুটবলে ৪টি গোল দিয়ে তিনি বিআরটিসির রুমির সঙ্গে যৌথভাবে সর্বাধিক গোলদাতা হন। এরপর আর ক্লাব পরিবর্তন করার চিন্তা করেননি। মোহামেডানের হয়ে নিজেকে তিনি নিংড়ে দেন। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত একটানা ১১ বছর মোহামেডানের হয়ে খেলেন। ফর্মের তুঙ্গে থাকাবস্থায় ১৯৯৪ সালে পিডব্লিউডির সঙ্গে খেলায় মারাÍক আহত হয়ে তিনি ফর্ম হারিয়ে ফেলেন। অতীতের দ্রুতগতিসম্পন্ন সাব্বির যেন হারিয়ে যান। ১৯৯৭ সালে মহানগরী কাপে রহমতগঞ্জের হয়ে শেষ ম্যাচ খেললেও ১৯৯৮ সালে ১২ ফেব্র“য়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার ঘোষণা দেন। সাব্বির খেলাকালীন মোহামেডান চারবার (১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৩ ও ১৯৯৬) লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। ফেডারেশন কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় তিনবার (১৯৮৭, ১৯৮৯ ও ১৯৯৫)। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে মোহামেডানের নেতৃত্ব দেন সাব্বির। ১৯৯৩ সালে তাঁর অধিনায়কত্বে মোহামেডান লীগ চ্যাম্পিয়ন ও ১৯৯৪ সালে রানার্সআপ এবং ১৯৯৩ সালে দ্বিতীয় ডামফা কাপে চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে জাতীয় ফুটবলে কুমিল্লা চ্যাম্পিয়ন হলে সাব্বির সেরা খেলোয়াড় হন। তবে সাব্বিরের অতিরিক্ত ড্রিবলিং-এর পাশাপাশি কিছুটা একা খেলার প্রবণতা ছিল।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার সাব্বিরের যাত্রা শুরু হয় যুব ফুটবল দিয়ে। ১৯৮৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৬ দ্বিতীয় এশিয়ান যুব ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে তিনি অংশ নেন। এ রাউন্ডের খেলায় গ্র“প চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। কাতারে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত পর্যায়ের খেলায় তিনি দেশের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৭ সালে কোলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমস, ১৯৮৮ সালে ঢাকায় ২৬তম এশিয়ান যুব ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ড, ১৯৮৯ সালে ঢাকায় ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে খেলেন। বাংলাদেশ সবুজ দলের সঙ্গে খেলায় তাঁর গোলে জয়ী হয় লাল দল। এ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ লাল দল চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদে চতুর্থ সাফ গেমসে অংশ নেয়ার পর ১৯৯০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান অনূর্ধ্ব-১৯ যুব ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে তিনি বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন। একই বছর বেইজিং এশিয়ান গেমসে তিনি অংশ নেন। ১৯৯১ সালে প্রি-অলিম্পিক ফুটবলে সিউলে প্রথম লেগে এবং কুয়ালালামপুরে দ্বিতীয় লেগে তিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন। সিউলে প্রথম লেগে থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের সঙ্গে খেলায় সাব্বির একটি করে গোল দেন। ১৯৯১ সালে কলম্বোর পঞ্চম সাফ গেমস, ১৯৯২ সালে ব্যাংকক এশিয়ান কাপ, ১৯৯৩ সালে ঢাকায় সপ্তম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইয়ে জাপানে প্রথম পর্বে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে দ্বিতীয় পর্বে খেলেন। দ্বিতীয় পর্বে থাইল্যান্ডের সঙ্গে খেলায় বাংলাদেশ ১-৪ গোলে হারলেও একমাত্র গোলটি আসে তাঁর পা থেকে। এরপর ইনজুরির কারণে জাতীয় দলের হয়ে তাঁর আর খেলা হয়নি।
জাতীয় দলের তুলনায় ক্লাবের হয়ে দুর্দান্ত ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শনকারী সাব্বিরের অসংখ্য খেলা স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৮৬ সালে এশীয় যুব ফুটবলে কাতারের সঙ্গে ক্যারিয়ারের সেরা গোল উপহার দেন। বাংলাদেশ ১-৬ গোলে পরাজিত হলেও একমাত্র গোলটি করেন সাব্বির। ডি বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ের জোরালো শটে সেকেন্ড বার দিয়ে চমৎকার কার্ভ করে বল জালে ঢুকান। ১৯৮৮ সালে কেরালার নাগজি ট্রফি ফুটবলের ফাইনালে সালগাওকার ক্লাবের সঙ্গে সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে থাইল্যান্ডের সঙ্গে এবং ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় দলের সঙ্গে স্মরণীয় খেলা উপহার দেন। ফাইনালের দিন কোরিয়ার সঙ্গে অসাধারণ খেলেন। কখনো ডান কখনো বাম উইং নিয়ে দ্রুতগতিতে প্রতিপক্ষের সীমানায় ঢুকে চমৎকার চিপ, মাইনাস বা কাটিং করেন। মধ্যমাঠে গেম মেকার সাব্বিরকে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। ১৯৯১ সালে পান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার। দুরন্ত গতির ফুটবলার সাব্বির প্রতিপক্ষের সমীহ যেমন আদায় করেছেন, তেমনি অর্জন করেছেন অগণিত ভক্তের ভালোবাসা।

পরিপূর্ণ স্টপার জুয়েল রানা

দীর্ঘদিন রক্ষণভাগের দুর্ভেদ্য প্রাচীর হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ¦ী ছিলেন জুয়েল রানা। নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাঁর প্রতিদ্বন্দ¡ী থাকলেও এরপর তিনি হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা। প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারদের কাছে তিনি ছিলেন দুঃস্বপ্ন হয়ে। ওয়ান টু ওয়ান বডি টাসলে তার সঙ্গে কেউই পেরে উঠতেন না। প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে তরতর করে ওপরে উঠে পাল্টা আক্রমণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা ছিল চোখে পড়ার মতো। একজন পরিপূর্ণ স্টপার হিসেবে প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দেয়ার মাঝেই তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করতেন না, দলের স্ট্রাইকাররা ব্যর্থ হলে গোল করার দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিতেন। কখনো হেড, কখনো জোরালো শটে অসংখ্য গোল করেছেন তিনি। কর্নার কিকের সময় প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে তার উপস্থিতি রীতিমত আতঙ্কের সৃষ্টি করতো। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার সুঠামদেহী, দৃঢ়চেতা ও আÍবিশ্বাসী জুয়েল রানাকে এয়ারে বিট করা অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তিনি বিভিন্ন পজিশনে খেললেও সেরা ডিফেন্ডার হিসেবেই তিনি পরিচিতি পান।
বাংলাদেশের ফুটবলের অন্যতম নক্ষত্র জুয়েল রানা ১৯৬৮ সালের ২ মে সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। ফুটবলার হতে হবেÑ এমন কোনো ইচ্ছে ছিল না তাঁর। ঢাকার শংকরে বাসা হওয়ায় আবাহনী ক্লাবের মাঠ তাঁর ফুটবলার হয়ে ওঠার পেছনে একটা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে আবাহনী মাঠে নিয়মিত ফুটবল খেলতেন। খেলতেন স্রেফ আনন্দ পাবার জন্য। খেলতে খেলতে ১৯৮৪ সালে পাইওনিয়ার লীগের দল ইস্টবেঙ্গলের আমন্ত্রণ পান। দু’বছর পাইওনিয়ার লীগ খেলার পর ইস্টবেঙ্গলের সিনিয়র দলের হয়ে ১৯৮৬ সালে তৃতীয় বিভাগে এবং ১৯৮৭ সালে দ্বিতীয় বিভাগে খেলে সাড়া জাগাতে সক্ষম হন। ১৯৮৮ সালের শুরুর দিকে ব্যাংককে এশীয় যুব অনূর্ধ্ব-১৬ বাছাই ফুটবলে সুযোগ পেয়ে চমৎকার খেলেন। এরপর আর তাঁকে পেছনে তাকাতে হয়নি। ওই বছর আমন্ত্রণ পান প্রথম বিভাগের দল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রে। এরপর মুক্তিযোদ্ধা ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবেই কাটে তাঁর ক্যারিয়ারের উজ্জ্বল দিনগুলো। তিন বছর মুক্তিযোদ্ধায় খেলার পর ১৯৯১ সালে যোগ দেন মোহামেডানে। তিন মৌসুম মোহামেডানে খেলে ১৯৯৪ সালে যোগ দেন নতুন প্রজন্মের দল মুক্তিযোদ্ধা সংসদে। এক বছর পর ১৯৯৫ সালে মোহামেডানে। দু’বছর মোহামেডানে থাকার পর ১৯৯৭ সাল থেকে তিন বছরের জন্য মুক্তিযোদ্ধায় খেলেন। ২০০০ সালে যোগ দেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে। বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে পেয়েছেন শিরোপার স্বাদ। ১৯৮৮ সালে নেপালের ত্রিভুবন চ্যালেঞ্জ শিল্ডে মুক্তিযোদ্ধা যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয়। এই সাফল্য দিয়েই তার শুরু। লীগে মোহামেডান ১৯৯৩, ১৯৯৬, ২০০০, ২০০২, মুক্তিযোদ্ধা ১৯৯৭ সালে ও ব্রাদার্স ইউনিয়ন ২০০৫ সালে; ফেডারেশন কাপে মোহামেডান ১৯৯৫ ও ২০০২, মুক্তিযোদ্ধা ১৯৯৪ ও ব্রাদার্স ইউনিয়ন ২০০৫ সালে; ডামফা কাপে মোহামেডান ১৯৯৩ ও ১৯৯৫ সালে; নিটল-টাটা জাতীয় ফুটবলে মোহামেডান ২০০২ সালে এবং ১৯৯৭ সালে মহানগরী কাপে ও ১৯৯৮ সালে ভারতের ম্যাকডোয়েল কাপে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৯৬ সালে মোহামেডান, ১৯৯৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা এবং ২০০৩-০৪ মৌসুমে তিনি পুনরায় মোহামেডানের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। পরের মৌসুমে যোগ দেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে।
ধীর-স্থির-শান্ত মেজাজের জুয়েল রানা ঘরোয়া ফুটবলের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফুটবলেও দেশের জন্য সম্মান ও গৌরব বয়ে আনেন। ১৯৮৮ সালে ব্যাংককে এশীয় যুব অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাই পর্বে খেলার পর জাতীয় দলে ডাক পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। ১৯৮৯ সালে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ফুটবলে বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে, একই বছর ইসলামাবাদে চতুর্থ সাফ গেমস, ১৯৯০ সালে ঢাকায় এশিয়ান যুব (অনূর্ধ্ব-১৯) ফুটবলে, ১৯৯১ সালে সিউল ও মালয়েশিয়ায় অনূর্ধ্ব-২৩ প্রি-অলিম্পিক ফুটবল, কলম্বোয় পঞ্চম সাফ গেমস, ১৯৯২-এ ব্যাংককে এশিয়া কাপ, ১৯৯৩ সালে সপ্তম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দল, জাপান ও আরব আমিরাতে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্ব, ঢাকায় ষষ্ঠ সাফ গেমস, ১৯৯৫ সালে শ্রীলংকায় সার্ক গোল্ডকাপ ফুটবল, মায়ানমারে ৪ জাতি ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দল, মাদ্রাজে সপ্তম সাফ গেমস, ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব, নেপালে প্রথম সাফ ফুটবল, ১৯৯৯ সালে ভারতের গোয়ায় দ্বিতীয় সাফ ফুটবল, ঢাকায় বঙ্গবন্ধু কাপ, ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডুতে অষ্টম সাফ গেমসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এসব খেলায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গোলও করেছেন তিনি। ১৯৯৭ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে তাইওয়ান (১-৩) ও সৌদি আরবের (১-৪) সঙ্গে বাংলাদেশ পেনাল্টি থেকে একটি করে গোল পরিশোধ করে জুয়েল রানার কৃতিত্বে। ১৯৯৯ সালে বঙ্গবন্ধু কাপে ক্যারোলেট এফসির সঙ্গে একটি গোল করেন। ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু সাফ গেমসে বাংলাদেশ যে ৪টি গোল দেয়Ñ এর ২টিই তাঁর। মালদ্বীপের সঙ্গে (১-২) একটি এবং শ্রীলংকার সঙ্গে (১-০) তাঁর গোলে বাংলাদেশ জয়ী হয়। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে জুয়েল রানাই প্রথম টানা চারটি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন। ১৯৯৭ সালে নেপালে প্রথম সাফ ফুটবল, ১৯৯৯ সালে ভারতের গোয়ায় দ্বিতীয় সাফ ফুটবল, ১৯৯৯ সালে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু কাপ এবং কাঠমান্ডুতে ৮ম সাফ গেমসে বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের ১৫ বছরের অধরা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডুতে অষ্টম সাফ গেমসের ফুটবলে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। নেতৃত্ব প্রদান ছাড়াও তাঁর অসাধারণ ক্রীড়াশৈলীতে বাংলাদেশ সাফল্যের ঠিকানা খুঁজে পায়। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে তিনি বাংলাদেশের সহ-অধিনায়ক ছিলেন। অসংখ্য স্মরণীয় খেলা উপহার দিয়েছেন জুয়েল রানা। এর মাঝে ১৯৯৭ সালে ফেডারেশন কাপে এবং ১৯৯৯ সালে ভারতের গোয়ায় দ্বিতীয় সাফ ফুটবলে ভারতের সঙ্গে দুর্দান্ত খেলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি জুয়েল রানাকে ১৯৯৬ সালের সেরা ফুটবলার এবং ১৯৯৯ সালের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ নির্বাচিত করে।
রক্ষণভাগের যে কয়েকজন খেলোয়াড় তারকাখ্যাতি পেয়েছেন, জুয়েল রানা তাঁদের মধ্যে অন্যতম।


সুযোগ সন্ধানী স্ট্রাইকার নকিব

গোল করাই একজন স্ট্রাইকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর এ ক্ষেত্রে চমৎকার দক্ষতা দেখিয়েছেন নকিব। হালকা-পাতলা গড়নের এই ফুটবলারকে আপাতদৃষ্টিতে স্ট্রাইকার মনে না হলেও অসংখ্য গোল করে তিনি দেশের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকারে পরিণত হন। সালাউদ্দিন ও আসলামের পর গোল করার ক্ষেত্রে তিনিই সেরা সাফল্য দেখিয়েছেন। সুযোগ সন্ধানী এই গোলদাতা কখনো পায়ের মাপা শটে, কখনো নিখুঁত হেডে বল জালে জড়িয়েছেন। তবে তাঁর বেশিরভাগ গোলই হয়েছে হেডের সাহায্যে। ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার নকিবের গোল করাটা একটা নেশার মতো।
ইমতিয়াজ আহমেদ নকিবের জন্ম ঢাকায়, ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ফুটবলে হাতেখড়ি একদম শৈশবে। ঢাকার মহাখালীতে থাকতেন। ১৯৮০ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র অবস্থায় মহল্লায় ফুটবল খেলতেন। শুরুটা হয়েছিল গোলরক্ষক হিসেবে। ঘটনাচক্রে পাড়ার দল বাড্ডা জাগরণীর হয়ে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেন। ১৯৮৫ সালে পাইওনিয়ার লীগে খেলা শুরু করেন। দু’বছর পাইওনিয়ারে খেলার পর ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালে একই দলের হয়ে খেলেন তৃতীয় বিভাগে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের প্রতিটি দলকে দু’জন তরুণ ফুটবলারকে খেলানো বাধ্যতামূলক করলে নকিব ১৯৮৯ সালে সরাসরি মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। তবে সুযোগ পেয়ে নকিব হারিয়ে যাননি। নিজের যোগ্যতা দিয়ে স্থান করে নেন মোহামেডানে। ওই বছর ফুটবল লীগে বিআরটিসির সঙ্গে হ্যাটট্রিকসহ ৭টি গোল করে চমক সৃষ্টি করেন। এরপর থেকে একের পর এক চমক দেখিয়েছেন তিনি। ১৯৯০ সালে ঢাকায় দশম এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপের ৫ নং গ্র“পে মোহামেডান গ্র“প চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে উন্নীত হয়। নকিবের ৩ গোলে মোহামেডান ৫-০ গোলে মালদ্বীপের লেগুনস ক্লাবকে এবং চমৎকার নৈপুণ্যে ভারতের সালগাওকরকে ২-১ গোলে হারায়। সালগাওকরের সঙ্গে করা একটি গোল নকিবের। ১৯৯১ সালে ঢাকায় ৬টি ক্লাবকে নিয়ে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে সাদা দল হিসেবে অংশগ্রহণকারী মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন হয়। নকিব সেমিফাইনাল ও ফাইনালে হ্যাটট্রিকসহ সর্বাধিক গোলদাতার পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিটিসি কাপে নকিবের গোলে মোহামেডান কোলকাতা ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র এবং কোলকাতা মোহনবাগানকে হারায়। ঢাকায় একাদশ এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে নকিবের ২ গোলে মোহামেডান পাকিস্তান ওয়াপদাকে ৫-০ গোলে এবং মালদ্বীপে ফিরতি ম্যাচে মালদ্বীপের নিউ রেডিয়েন্ট ক্লাবকে ২-০ গোলে হারায়। একটি গোল নকিবের। ১৯৯২ সালে স্বাধীনতা দিবস ফুটবলে মোহামেডানের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে নকিবের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ফাইনালে আবাহনীর সঙ্গে এক গোলসহ পাঁচ গোল দিয়ে সর্বাধিক গোলদাতা হন। ১৯৯৩ সালে কাতারে এশিয়ান ক্লাব কাপের ফাইনাল পর্যায়ে মোহামেডানের ৩ ম্যাচে প্রতিটিতে একটি করে গোল করেন। ১৯৯৩ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের প্রথম পর্বে ১০ গোল দিলেও দ্বিতীয় পর্বে তাকে আর নামানো হয়নি। পাঁচ বছর মোহামেডানের হয়ে খেলার পর শীর্ষ তিন ক্লাবের জেন্টেলমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্টের প্রতিবাদে ১৯৯৪ সালে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রে। ১৯৯৫ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধার হয়ে টানা চার মৌসুম লীগের সর্বাধিক গোলদাতা হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এর আগে এই কৃতিত্ব দেখান আসলাম। ১৯৯৫ সালে ১৩টি, ১৯৯৬ সালে ১৪টি, ১৯৯৭ সালে ১৩টি ও ১৯৯৯ সালে ১২টি গোল দেন। ১৯৯৮ সালে লীগ হয়নি। ১৯৯৭ সালে নকিবের নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয় মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৯ সালে বিজেএমসি লীগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মোহামেডান ও আবাহনীর বাইরে প্রথম মুক্তিযোদ্ধা চ্যাম্পিয়ন হয়। লীগের শেষ দু’ম্যাচে নকিবের গোলে আবাহনীকে ১-০ এবং মোহামেডানকে ১-০ গোলে হারালে মুক্তিযোদ্ধার শিরোপা নিশ্চিত হয়। এছাড়াও মহানগরী কাপেরও চ্যাম্পিয়ন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৯৭ সালে কোলকাতার ম্যাকডোয়েল ফুটবল টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় মুক্তিযোদ্ধা। ৩টি গোল করেন নকিব। ৬ বছর মুক্তিযোদ্ধায় খেলার পর ২০০০ সালে পুনরায় যোগ দেন মোহামেডানে। ১৯৯৯ সালে কোলকাতার হলদিয়ায় ১৫তম অল-এয়ারলাইন্স গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান দলের হয়ে তিনি ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে একটি গোল করেন। ২০০০ সালের ফুটবল লীগে মোহামেডানের হয়ে আবাহনীর সঙ্গে খেলায় হ্যাটট্রিক করার বিরল গৌরব অর্জন করেন। ফেডারেশন কাপ ফুটবলে প্রেমলাল আবাহনীর হয়ে মোহামেডানের সঙ্গে হ্যাটট্রিক করলেও ফুটবল লীগে এই কৃতিত্ব প্রথম নকিবের। ওই বছর অল্পের জন্য আসলামের পাঁচবার লীগে সর্বাধিক গোলদাতা হওয়ার রেকর্ড স্পর্শ করতে পারেননি। ১৬ গোল দিয়ে তিনি দ্বিতীয় সর্বাধিক গোলদাতা হন। ১৭টি গোল দিয়ে সর্বাধিক গোলদাতা হন আবাহনীর কেনেডি। ২০০১ সালে তিনি মোহামেডানের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে তাঁর অধিনায়কত্বে দ্বিতীয় নিটল-টাটা জাতীয় ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। ৭ গোল দিয়ে তিনি দ্বিতীয় সর্বাধিক গোলদাতা হন। ২০০২ সালের লীগে মোহামেডানের হয়ে ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে প্রথম ম্যাচে হ্যাটট্রিক করার মাধ্যমে লীগে শততম গোল করার কৃতিত্ব দেখান। তাঁর আগে এই কৃতিত্ব ছিল শুধু সালাউদ্দিন ও আসলামের।
মোহামেডানে যোগ দেয়ার পর আন্তর্জাতিক ফুটবলে স্থান করে নিতে খুব একটা সময় লাগেনি নকিবের। ১৯৯০ সালে ব্যাংকক এশিয়ান যুব ফুটবলের (অনূর্ধ্ব-১৬) কোয়ালিফাইং রাউন্ডে খেলেন তিনি। মালয়েশিয়ার সঙ্গে একটি এবং থাইল্যান্ডের সঙ্গে একটি গোল করেন। একই বছর বেইজিং এশিয়ান গেমস দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। ১৯৯১ সালে সিউল ও কুয়ালালামপুরে প্রি-অলিম্পিক ফুটবলে (অনূর্ধ্ব-২৩), কলম্বো সাফ গেমস, ১৯৯২ সালে ব্যাংকক এশিয়া কাপ, ১৯৯৩ সালে ঢাকায় সপ্তম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দল, জাপান ও আরব আমিরাতে বিশ্বকাপের বাছাই, ঢাকায় সাফ গেমস, ১৯৯৫ সালে সার্ক গোল্ডকাপ, ১৯৯৫ সালে মায়ানমারে ৪ জাতির ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দল, মাদ্রাজ সাফ গেমস, ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় বিশ্বকাপের বাছাই, নেপালে প্রথম সাফ ফুটবল এবং ১৯৯৯ সালে ভারতের গোয়ায় দ্বিতীয় সাফ ফুটবলে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৯১ সালে প্রি-অলিম্পিক ফুটবলের বাছাই পর্বের সিউলে প্রথম পর্বে বাংলাদেশ ৮-০ গোলে ফিলিপাইনকে হারায়। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয় এটি। নকিবের দেয়া পাঁচ গোল কোনো খেলোয়াড়ের এক ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড। কুয়ালালামপুরে দ্বিতীয় পর্বে বাংলাদেশ ৩-০ গোলে ফিলিপাইনকে হারায়। নকিব করেন দু’গোল। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় ৭ম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে রুমানিয়ার সঙ্গে একটি, বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে থাইল্যান্ডের সঙ্গে একটি গোল করেন। ১৯৯৫ সালে মায়ানমারে ৪ জাতি ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশ প্রথম শিরোপা লাভ করে। ফাইনালে বাংলাদেশ স্বাগতিক মায়ানমারকে ২-১ গোলে হারায় মামুন জোয়ারদার ও নকিবের গোলে। ১৯৯৭ সালে নেপালে প্রথম সাফ ফুটবলে মালদ্বীপের সঙ্গে একটি ও বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে তাইওয়ানের সঙ্গে একটি গোল করেন। তবে ১৯৯১ সালে ফিলিপাইনের সঙ্গে পাঁচ গোল এবং ২০০০ সালে ফুটবল লীগে আবাহনীর সঙ্গে হ্যাটট্রিক নকিবের স্মরণীয় গোলগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ১৯৯৭ সালে তাঁকে সেরা ফুটবলার নির্বাচন করে। ফুটবল যদি হয় গোলের খেলা, তাহলে সে বিচারে নকিব দারুণ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।



ফ্রি কিক স্পেশালিস্ট আরমান

বাংলাদেশের ফুটবলের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় ছিল সত্তর ও আশির দশক। তুঙ্গস্পর্শী সেই সময়ে অসংখ্য তারকা ফুটবলারের পায়ের জাদুতে মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়তো। কোনো কোনো ফুটবলারের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ও নৈপুণ্যের দীপ্তিতে মাঠে দর্শকদের ঢল নামতো। কিন্তু নব্বই দশকে ফুটবল তার জনপ্রিয়তা হারানোর পাশাপাশি হারিয়ে ফেলে তারকা ফুটবলারদের। ফুটবলের এই ক্ষয়িষ্ণু ও বিবর্ণ সময়ে অল্প যে ক’জন ফুটবলার নৈপুণ্যের ঝিলিক দিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছেন, তাদের একজন আরমান। মিডফিল্ডের এই গেম মেকার পুরো মাঠজুড়ে দাপটের সঙ্গে খেলেন। আক্রমণ ও রক্ষণভাগের সঙ্গে সেতুবন্ধন রচনা করে আক্রমণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কুশীলবের ভূমিকা পালন করে থাকেন। নিখুঁত পাস, চমৎকার বল ডিস্ট্রিবিউশন ও দ্রুতগতিতে ছুটতে পারেন। ফ্রি কিক স্পেশালিস্ট এই মিডফিল্ডার মাঝ মাঠ থেকে ফ্রি কিকে গোল করে প্রতিপক্ষকে চমকে দিতে ওস্তাদ। হালকা-পাতলা ও ছোটখাট গড়নের আরমানকে আপাতদৃষ্টিতে অপরিণত মনে হলেও পরিণত ফুটবল মেধা ও ক্রীড়াশৈলী দিয়ে তিনি নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে নেন।
মোঃ আরমান মিঞার জন্ম ১৯৭৭ সালের ১০ অক্টোবর পুরান ঢাকায়। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলায় আকৃষ্ট হন। ১৯৮৭ সালে পাইওনিয়ার ফুটবল লীগে নবাবকাটারা যুব সংঘের হয়ে প্রতিযোগিতামূলক আসরে খেলা শুরু করেন। পাইওনিয়ার লীগের পাশাপাশি কিশোর লীগে খেলতেন ইস্কাটন সবুজ সংঘের হয়ে। তাঁর ফুটবলার হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে ইস্কাটন সবুজ সংঘ একটি বড় প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে। ইস্কাটন সবুজ সংঘ ১৯৮৮ সালে তৃতীয় বিভাগ এবং ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১৯৯০ সালে প্রথম বিভাগে উন্নীত হয়। প্রথম বিভাগে টানা তিন বছর ইস্কাটন সবুজ সংঘের হয়ে খেলে ১৯৯৩ সালে পাড়ি জমান মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার আরমান মোহামেডানে যোগ দিয়েই লীগ শিরোপার সান্নিধ্য পান। ১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের হয়ে ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন হন। পরের বছর পুনরায় ফিরে আসেন মোহামেডানে। টানা চার বছর চুটিয়ে মোহামেডানে খেলেন। এর মধ্যে মোহামেডান ১৯৯৫ সালে ডামফা কাপ, ফেডারেশন কাপ ও ১৯৯৬ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। ডামফা কাপে ফাইনাল ও সেমিফাইনালসহ চারটি গোল দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আরমান। ১৯৯৯ সালে যোগ দেন আবাহনী লিমিটেডে। আবাহনীর হয়ে চার বছর দাপটের সঙ্গে খেলেন। ১৯৯৯ ও ২০০০ সালের ফেডারেশন কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। ২০০১ সালে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আরমানের অধিনায়কত্বে ফুটবল লীগে চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। ২০০২ সালে দ্বিতীয় নিটল-টাটা জাতীয় ফুটবল টুর্নামেন্টে তিনি সেরা খেলোয়াড় হন। ২০০২ সালে নতুন ঠিকানা হয় ব্রাদার্স ইউনিয়ন। ২০০৩-০৪ মৌসুমে জাতীয় ফুটবল লীগের পাশাপাশি ফুটবল লীগে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাদার্স। জাতীয় ফুটবলের সেরা খেলোয়াড় হবার গৌরব অর্জন করেন আরমান। আবারো চ্যাম্পিয়ন দল ত্যাগ করে ২০০৪-০৫ মৌসুমে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রে। মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতা গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়।
যুব ফুটবল দিয়ে আরমানের আন্তর্জাতিক ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৯২ সালে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত এশীয় যুব (অনূর্ধ্ব-১৬) ফুটবলে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। আরমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ গ্র“প চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরবর্তী রাউন্ডে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত রাউন্ডেও আরমান অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ সবুজ দলের হয়ে, জাপান ও আরব আমিরাতে বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব, ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাফ গেমস, ১৯৯৪ সালে সৌদি আরবে ২৯তম এশিয়ান যুব (অনূর্ধ্ব-১৯) ফুটবলে অধিনায়ক, ১৯৯৫ সালে মায়ানমারে ৪ জাতি ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলে, মাদ্রাজ সাফ গেমসে, ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব, নেপালে প্রথম সাফ ফুটবলে, ২০০২ সালে বুশান এশিয়ান গেমস, ২০০৩ সালে ভুটানের জিগমে দর্জি ওয়াংচুক স্মৃতি ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দল এবং ঢাকায় সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড় ছিলেন। সাফ ফুটবলে তিনি অসাধারণ খেলেন এবং ম্যান অব দ্য ফাইনাল হন। ২০০৫ সালে মিয়ানমারে চার জাতির গ্র্যান্ড রয়েল চ্যালেঞ্জ কাপ এবং পাকিস্তানের করাচীতে চতুর্থ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স-আপ বাংলাদেশ দলের প্লে-মেকার ছিলেন। মিয়ানমারে তাঁর অসাধারণ ক্রীড়ানৈপুণ্যে বাংলাদেশ চীনকে প্রথমবারের মত হারায়। অসম্ভব গতি, চমৎকার পায়ের কাজ ও দূরপাল্লার শটে অতুলনীয় আরমান জাতীয় দলের হয়ে বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন গোল করেছেন। ১৯৯৪ সালে সৌদি আরবে হংকং-এর সঙ্গে খেলায় মাঝ মাঠ থেকে বল নিয়ে বেশ কয়েকজনকে কাটিয়ে একাই গোল করেন। মোহামেডানের হয়ে দক্ষিণ কোরিয়ান এক ক্লাবের সঙ্গে প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে ফ্রি কিকে দুর্দান্ত একটি গোল করেন। এছাড়া মায়ানমারে ৪ জাতি ফুটবলে মালদ্বীপের সঙ্গে ফাইনালে তিনি দুর্দান্ত খেলেন। ২০০৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ ফুটবলের ফাইনালের ম্যান অব দ্য ফাইনাল হন। বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ২০০১ সালে তাকে সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। মধ্যমাঠের দুরন্ত গতির আরমান দেশের ফুটবলের ক্রান্তিকালের হাতেগোনা প্রতিভাদের একজন।

পজিশনাল ফুটবলার আলফাজ

বাংলাদেশ যে পর্যায়ে ফুটবল খেলে, তাতে বাংলাদেশের কোনো ফুটবলারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়াটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মাঝে কাজী সালাউদ্দিনের হংকং-এর পেশাদার ফুটবল লীগ খেলা এবং মোনেম মুন্নার কোলকাতা ফুটবল লীগে মাতিয়ে আসাটাই ছিল আমাদের কাছে গর্বের ব্যাপার। কিন্তু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন আলফাজ।
এশিয়া ফুটবল কনফেডারেশনের অফিসিয়াল স্পন্সর জাপানের সানিও কোম্পানি আলফাজকে ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসের সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। এই স্বীকৃতি ছাড়াও বাংলাদেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ সাফল্যের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে আলফাজের নাম। ১৯৯৯ সালের কাঠমান্ডু সাফ গেমসে ফুটবলে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়। নেপালের সঙ্গে ফাইনালে একমাত্র গোলটি হয় আলফাজের পা থেকে। আলফাজ বল কন্ট্রোল, ড্রিবলিং ও দু’পায়ের শট মারার ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখিয়েছেন। শুটিং ভালো, স্কোরিং অ্যাবিলিটি আছে। নিজে গোল করার পাশাপাশি সতীর্থদের দিয়ে গোল করাতে পারঙ্গম। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতা আদর্শ স্ট্রাইকারের জন্য যথাযথ নয়। এ কারণে তাঁর হেডওয়ার্ক আশানুরূপ নয়। কিন্তু তাঁর পজিশনাল সেন্স ভালো। যে কোনো পজিশন থেকে তিনি গোল করতে পারেন।
আলফাজ আহমেদের জন্ম সিলেটে ১৯৭৩ সালের ৬ জুন। ঢাকার পলাশী ব্যারাকের মাঠে খুব ছোটবেলা থেকেই খেলতেন। ১৯৮৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হয়ে এরশাদ কাপ কিশোর ফুটবল দিয়ে তাঁর প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে হাতেখড়ি হয়। তিন বছর এরশাদ কাপ কিশোর ফুটবল খেলার পর ১৯৮৭ সালে পাইওনিয়ার লীগে ওরিয়েন্ট স্পোর্টিং-এ, ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয় বিভাগে লালবাগ স্পোর্র্টিং-এ খেলেন।
লালবাগের কোচ মালা ১৯৯১-৯২ মৌসুমে প্রিমিয়ারের দল রহমতগঞ্জে যোগ দিলে আলফাজকে তিনি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে রহমতগঞ্জ প্রথম বিভাগে নেমে গেলে আলফাজ আবাহনী লিমিটেডের হয়ে কোলকাতার চার্মস কাপে খেলতে যান। ১৯৯৪ সালে আরামবাগে খেলে ১৯৯৫ সালে যোগ দেন মোহামেডানে। শুরুতে লেফট আউট, এরপর মিডফিল্ডে খেললেও মোহামেডানে খেলেন স্ট্রাইকার হিসেবে। চ্যাম্পিয়ন মোহামেডানের হয়ে ডামফা ও ফেডারেশন কাপে চমৎকার নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। ফেডারেশন কাপে চারটি গোল দিয়ে নকীবের সঙ্গে যুগ্মভাবে সর্বাধিক গোলদাতা হন। তাঁর গোলে মোহামেডান হারায় আবাহনীকে। ১৯৯৬ সালের ২৪ আগস্ট এশিয়ান কাপ উইনার্স কাপের প্রাথমিক পর্বে ঢাকা মোহামেডান ৮-০ গোলে হারায় লাওসের ইলেকট্রিসিটি দলকে। আলফাজ একাই চারটি গোল করেন। এই পারফরমেন্সের সুবাদে তিনি এএফসির ‘ফুটবলার অব দ্য মানথ’ হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে লীগে ১০ গোল দিয়ে তৃতীয় সর্বাধিক গোলদাতা হন। চ্যাম্পিয়ন হয় মোহামেডান। ১৯৯৭ সালে ১১ গোল ও ১৯৯৯ সালে ১১টি গোল দিয়ে দ্বিতীয় সর্বাধিক গোলদাতা হওয়ার কৃতিত্ব দেখান। প্রতি বছরই তাঁর পা থেকে এসেছে বেশ কিছু গোল। ১৯৯৯ সালে তাঁর নেতৃত্বে মোহামেডান লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়। সাত বছর মোহামেডানে খেলার পর ২০০২ সালে যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রে।
এক বছর খেলে ফের দলবদল করে যোগ দেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে। আলফাজের নেতৃত্বে ফুটবল লীগে প্রথমবারের মতো ব্রাদার্স চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। একই সঙ্গে আসে ভারতের বরদুলই ট্রফি। এই সাফল্য অর্জনের পর তিনি পুনরায় ফিরে আসেন মোহামেডানে। ২০০৪-০৫ মৌসুমে ফুটবল লীগে মোহামেডানের অধিনায়ক হন। তাঁর নেৃতত্বে মোহামেডান নিটল-টাটা ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় ১৯৯৫ সালে। শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত সার্ক গোল্ডকাপ ফুটবলে তিনি খেলেন। অবশ্য তার আগে ১৯৯৪ সালে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ২৯তম এশিয়ান যুব (অনূর্ধ্ব-১৯) ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাই পর্বে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। হংকং-এর সঙ্গে তিনি একটি গোল করেন। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত ৪ জাতি ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব, নেপালে প্রথম সাফ ফুটবল, ১৯৯৯ সালে ভারতের গোয়ায় দ্বিতীয় সাফ ফুটবলের তিনি সহ-অধিনায়ক ছিলেন। পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গে খেলায় ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। উভয় দলের সঙ্গে একটি করে গোল করেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু কাপ ফুটবলে তিনি বাংলাদেশের সহ-অধিনায়ক ছিলেন। কাঠমান্ডু সাফ গেমসে দীর্ঘ ১৫ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে।
ফুটবলে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আলফাজ। দুবাইতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান কাপ ফুটবলের বাছাই পর্বে তিনি অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ২-২ গোলে ড্র করে। দুটি গোলই আসে আলফাজের পা থেকে। ২০০১ সালে সৌদি আরবে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে তিনি বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন। মালয়েশিয়ার সঙ্গে তিনি দুটি গোল করেন। ২০০২ সালে বুশান এশিয়ান গেমসেও আলফাজ অধিনায়ক হন।
২০০৩ সালে ভুটানের জিগমে দর্জি ওয়াংচুক স্মৃতি ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড় ছিলেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড় ছিলেন আলফাজ। প্রথম ম্যাচে নেপালের সঙ্গে তাঁর গোলে জয়ী হয় বাংলাদেশ। ২০০৫ সালে মিয়ানমারে চার জাতির গ্র্যান্ড রয়েল চ্যালেঞ্জ কাপ এবং পাকিস্তানের করাচীতে চতুর্থ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স-আপ বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের প্রতিটি সাফল্যের সঙ্গে যেন জড়িয়ে আছেন আলফাজ।
বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি ১৯৯৯ সালে আলফাজকে সেরা ফুটবলার নির্বাচিত করে। আক্রমণভাগের দক্ষ খেলোয়াড় আলফাজ নিজ কৃতিত্বে আদায় করে নিয়েছেন স্বীকৃতি আর প্রশস্তি।


সাহসী গোলরক্ষক আমিনুল

ফুটবলে গোলরক্ষক পজিশনটা সবচেয়ে নাজুক ও সংবেদনশীল। কোনোভাবে গোল হজম করলে গোলরক্ষকের দিকেই ধাবিত হয় যাবতীয় ভ্রƒকুটি। আবার অসংখ্য গোল সেভ করলেও প্রশংসাটা সেভাবে পাওয়া হয় না। যে কারণে গোলরক্ষকরা বরাবরই অনাদৃত ও অবহেলিত হয়ে এসেছেন। এর মাঝেও আলাদা ইমেজ গড়ে নিয়েছেন সান্টু ও মহসিন। তাঁরা তাঁদের নৈপুণ্য দিয়ে ফুটবল অনুরাগীদের হৃদয় জয় করে নিতে পেরেছেন। সান্টু ও মহসিনের পর গোলকিপিংয়ের ক্ষেত্রে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তাঁদের মান ও মাপের গোলরক্ষকের দেখা পাওয়াটা অন্তহীন এক অপেক্ষার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে দেখা মেলে আমিনুলের। অসম্ভব প্রতিভাবান ও মেধাবী এই গোলরক্ষকের রয়েছে সাহস, বুদ্ধি ও দক্ষতা। প্রতিপক্ষের আগুয়ান খেলোয়াড়ের মন-মেজাজ, বলের ফ্লাইট এবং পরিস্থিতি চটজলদি আঁচ করতে পেরে বলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দলকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন। ৬ ফুট উচ্চতার আমিনুল দুর্দান্ত অ্যান্টিসিপেশন, চমৎকার গ্রিপিং আর সূক্ষ্ম চাতুর্যতা দিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
মোঃ আমিনুল হকের জন্ম ভোলায় ১৯৮০ সালের ১০ অক্টোবর। অল্প বয়সেই তাঁর ফুটবলে দীক্ষা হয়। আর এ ক্ষেত্রে তাঁর পথ-প্রদর্শক ছিলেন মেঝ ভাই মঈনুল হক। মঈনুল ১৪ বছর ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশনে ফুটবল খেলেছেন। ১৯৯৩ সালে পাইওনিয়ার লীগে সিটি ক্লাবের হয়ে খেলার সময় সাবেক ফুটবলার ইমতিয়াজ সুলতান জনির দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন। জনি তাঁকে মোহামেডানের নিয়ে আসেন। যদিও দু’বছর মোহামেডানে থেকে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হলেও খেলা হয়নি। ১৯৯৬ সালে প্রিমিয়ার ফুটবল লীগে ফরাশগঞ্জের হয়ে ফুটবলের বড় আসরে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। প্রথম বছরেই তিনি অসাধারণ দক্ষতা আর সাহসের পরিচয় দেন। মাত্র ১৬ বছরে এই তরুণ আবাহনী, মোহামেডান, ব্রাদার্স ইউনিয়নের মত শক্তিশালী দলের সঙ্গে দুর্দান্ত নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রাখেন। পরের বছর আমন্ত্রণ পান মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রে। লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় মুক্তিযোদ্ধা। এরপর আর তাঁকে থেমে থাকতে হয়নি। ১৯৯৯ সালে তিনি আবাহনীতে যোগ দেন। ফেডারেশন কাপে দুর্দান্ত খেলা উপহার দেন। চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। পরের বছর পুনরায় ফিরে আসেন মুক্তিযোদ্ধায়। সেই থেকে মুক্তিযোদ্ধাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। অবশ্য মুক্তিযোদ্ধায় যোগদান করাটা স্বাভাবিক নিয়মে ঘটেনি। তাঁকে নিয়ে আবাহনী ও মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে তুমুল রশি টানাটানি হয়। এর ফলে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। এ থেকে অনুমিত হয়Ñ দেশসেরা এই গোলরক্ষক উভয় দলের কাছে কতটা অপরিহার্য হয়ে ওঠেন। ২০০০ সালে লীগ ও ম্যাকডোনাল্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন হয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। ২০০১ সালে ফেডারেশন কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা ফেডারেশন কাপ এবং জাতীয় ফুটবল লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০০৫ সালে আমিনুলের নেতৃত্বে স্বাধীনতা গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হয় মুক্তিযোদ্ধা।
মাঠে নামলে আমিনুল নিজেকে নিংড়ে দিতে একটুও কুণ্ঠিত হন না। সে ক্লাব দল হোক আর জাতীয় দল হোকÑ সব ক্ষেত্রেই তিনি নিবেদিতপ্রাণ। বরং জাতীয় দলের হয়ে খেলে বেশ কয়েকবার ইনজুরির শিকার হয়েছেন। আর এ কারণে টপ ফর্মে থাকা সত্ত্বেও একাধিকবার জাতীয় দলে তাঁর খেলা হয়নি। ফরাশগঞ্জে খেলেই তিনি জাতীয় দলে খেলার আস্থা অর্জন করেন। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ায় বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে এবং নেপালে প্রথম সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ দলে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯৯ সালে ভারতের গোয়ায় দ্বিতীয় সাফ ফুটবলে এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু কাপে খেলেন। বঙ্গবন্ধু কাপে খেলার সময় ইনজুরির শিকার হলে কাঠমান্ডুতে অষ্টম সাফ গেমস এবং দুবাইতে এশিয়া কাপের বাছাই পর্বে খেলা হয়নি। ইনজুরি থেকে ফিরে এসে ২০০১ সালে সৌদি আরবে বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে অসাধারণ খেলেন। আবারো ইনজুরির কারণে ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার বুশানে এশিয়ান গেমসে খেলা হয়নি। তবে ইনজুরি তাকে কখনোই হতোদ্যম করতে পারেনি। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত ভুটানের জিগমে দর্জি ওয়াংচুক স্মৃতি ফুটবল এবং ঢাকায় তৃতীয় সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের তিনি অন্যতম নায়ক। সাফ ফুটবলে তিনি দুর্দান্ত খেলে সবার মন জয় করে নেন। মালদ্বীপের সঙ্গে ফাইনাল টাইব্রেকারে দ্বিতীয় শট ঠেকিয়ে দিয়ে তিনি জয়ের মঞ্চ তৈরি করে দেন। এরপর থেকেই আমিনুল হয়ে উঠেছেন নির্ভরতার প্রতীক। ২০০৫ সালে মিয়ানমারে চার জাতির গ্র্যান্ড রয়েল চ্যালেঞ্জ কাপ এবং পাকিস্তানের করাচিতে চতুর্থ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্স-আপ বাংলাদেশ দলের হয়ে দুর্দান্ত খেলেন। বাংলাদেশের ফুটবলের ক্ষয়িষ্ণু সময়ে তিনি হয়ে ওঠেন ফুটবলের নায়ক।










একজন তারকা ফুটবলারের মৃত্যু এবং কিছু কথা

ফুটবলার মোনেম মুন্না এই প্রজন্মের কাছে খুব একটা অচেনা নন। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার অকালে চলে যাবার পর তাঁর জানাজায় সমবেত হয়েছিলেন অসংখ্য মুন্না-অনুরাগী। কোনো ক্রীড়াবিদের মৃত্যুতে এমনটি সচরাচর দেখা যায় না। ক্রিকেটের এই রমরমা সময়ে মুন্নার কফিন যে পরিমাণ ফুল ও ভালোবাসায় সিক্ত হতে দেখেছি, তা থেকেই অনুধাবন করা যায় তাঁর জনপ্রিয়তার মাপকাঠি। আর খেলোয়াড় হিসেবে তিনি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন রীতিমত কিংবদন্তি। এমন মাপের এক ফুটবল ব্যক্তিত্ব, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যার সঙ্গে ছিল ফুটবল মাঠের নিবিড় বন্ধন এবং যাঁর খেলোয়াড়ি জীবন সবার চোখের সামনেই ভেসে ওঠার কথাÑ সেই মুন্না জীবন-মৃত্যুর দোলায় দুলতে দুলতে যেদিন হঠাৎ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন, সেদিন থেকে তিনি যেন দূরের মানুষ হয়ে যান। তাঁকে নিয়ে যেসব লেখালেখি হয়েছে, তাতে দেখতে পাওয়া যায় তথ্যের অনেক অসঙ্গতি। ধারণা করা যায়Ñ যতই দিন যাবে, ততই তিনি অচেনা হয়ে যাবেন। তাঁর গৌরবোজ্জ্বল ফুটবল ক্যারিয়ার ভুল তথ্যের আড়ালে ক্রমান¦য়ে অনুজ্জ্বল হয়ে পড়বে। মুন্নার মতো ফুটবলারের যদি এই পরিণতি হয়, তাহলে অন্যদের ক্ষেত্রে কী হতে পারে?
আমাদের দেশে তথ্য সংগ্রহ ও সংকলন করার তেমন কোনো মাধ্যম বা উদ্যোগ নেই বললেই চলে। ক্রীড়াঙ্গনের অবস্থা আরো বেশি শোচনীয়। আমাদের উদাসীনতা ও অবহেলার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠের উজ্জ্বল-উচ্ছল দিনগুলো। ফুটবলের কথাই ধরা যাক। এ দেশের মানুষের প্রাণের এই খেলাটির বর্তমান হাল দেখলে অতীতের সেই গৌরবোজ্জ্বল ও বর্ণময় দিনগুলোকে অনুধাবন করা যাবে না। সত্তর ও আশির দশকে ফুটবল মাঠের খেলোয়াড়রাই ছিলেন আমাদের কাছে প্রকৃত সুপারস্টার। তাঁরা যেভাবে হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো মানুষকে ফুটবল মাঠে টেনে নিতেন, তা ছিল কল্পনাতীত ব্যাপার। এক একজন ফুটবলার ছিলেন রূপকথার নায়ক। অথচ সেসব ফুটবলার আজ কোথায়? যাঁরা এক সময় অসংখ্য ফুটবল অনুরাগীর বুকের ভালোবাসা আর চোখের তারা হয়ে জ্বলেছেন, তাঁরা যেন আজ মেঘে ঢাকা পড়ে গেছেন।
সেসব ফুটবল তারকাকে পাদপ্রদীপের আলোয় হয়তো আনা যাবে না; কিন্তু তাঁদের কৃতিত্বের কথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে লিপিবদ্ধ করা গেলে তাঁরা চিরঅম্লান হয়ে থাকবেন। কিন্তু চাইলেই তো আর সব ফুটবলারের কথা লেখা সম্ভব নয়। এ যাবৎ ঢাকা লীগে কত কত ফুটবলার খেলেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আকাশে কত তারাই তো জ্বলে আর নেভে। আমরা ক’টাকে আর মনে রাখি! আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে থাকে সপ্তর্ষি, কালপুরুষ, লুব্ধক। তেমনি ফুটবল মাঠে অনেক ফুটবলার খেললেও আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে আছেন কিছু কিছু ফুটবলার। যাঁরা স্বতন্ত্র ক্রীড়াশৈলী ও ক্যারিশমা দিয়ে আলাদা ইমেজ গড়ে নিয়েছেন। অবশ্য এই কীর্তিমানদের বেছে নেয়াটাও সহজ নয়। মূলত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যাঁরা ফুটবল খেলেছেন, তাঁদের মধ্য থেকেই সেরা খেলোয়াড়দের বাছাই করা হয়েছে এই গ্রন্থে। বাছাই প্রক্রিয়া যে একদম নির্ভুল, সে দাবি করা যাবে না। মানুষের ভালো লাগা-মন্দ লাগার বিষয়টি একদমই ব্যক্তিগত। কার হৃদয়ে কোন ফুটবলার দাগ কেটেছেন, সেটা পরিমাপ করা যাবে না; তবে সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন সময়ে যেসব ফুটবলারের নাম আলোচনায় উঠে এসেছে, তাঁদের মধ্য থেকেই বেছে নেয়া হয়েছে ৩৪ জন ফুটবলারকে। আরো আরো ফুটবলারের কথা বিবেচনায় আনা গেলেও যাঁদেরকে বাছাই করা হয়েছে, তাঁরা নিশ্চয়ই সবাই কম-বেশি দেদীপ্যমান। ফুটবলারদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া দুরূহ এক কাজ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, কোনো কোনো ফুটবলারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেও অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ ভুলে গেছেন নিজের অতীত গৌরব। আবার কেউ কেউ অনুমানের ওপর তথ্য দিয়েছেন। একজন ফুটবলারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাঁর জন্মতারিখ কবে? তিনি পাল্টা জানান, ‘কোন্ তারিখ দেব? একেক সময় তো একেক তারিখ দিয়েছি।’ যা হোক, অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে। অবশ্য তথ্য প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির কারণে কিছু ক্ষেত্রে লেখায় তারতম্য ঘটেছে। প্রত্যেক ফুটবলারকে নিয়েই যেখানে আলাদা গ্রন্থ হতে পারে, সেখানে এই স্বল্প পরিসরে মূলত প্রত্যেক ফুটবলারের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়েছে। এ গ্রন্থে কাঠামোর প্রতি যতটা মনোযোগ দেয়া হয়েছে, অঙ্গসজ্জার ক্ষেত্রে ততটা নয়। মূলত ফুটবলারকে চেনানোটাই ছিল মূল লক্ষ্য। পাঠকদের ভালো লাগলেই সেই লক্ষ্যটা পূরণ হবে।
এ গ্রন্থটির তথ্য ও ছবির জন্য অনেকাংশেই নির্ভর করতে হয়েছে ক্রীড়াঙ্গনের আর্কাইভ হিসেবে বিবেচিত পাক্ষিক ক্রীড়াজগত পত্রিকার ওপর। এ ছাড়াও যারা উদাত্তভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তারা হলেন তরুণ লেখক ও বিসিএস প্রশাসন কর্মকর্তা হাসান আরিফ, ক্রীড়া সাংবাদিক রঞ্জন সেন, সংশোধক ইমাম হোসেন, কম্পিউটার অপারেটর মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোঃ শাহ্ জামাল এবং পারিজাত প্রকাশনীর উদ্যমী কর্ণধার শওকত হোসেন লিটু। এঁদের সবার কাছে আমার অন্তহীন কৃতজ্ঞতা।

দুলাল মাহমুদ
ফঁষধষসধযসঁফ@ুধযড়ড়.পড়স



গৌরবময় অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু- ১১
দুরন্ত গতির উইঙ্গার প্রতাপ- ১৫
আক্রমণাত্মক স্ট্রাইকার মেজর (অবঃ) হাফিজ- ১৯
ফুটবলের ধ্যানী টিপু- ২২
সব্যসাচী ফুটবলার অমলেশ সেন- ২৬
কুশলী ডিফেন্ডার আশরাফ- ২৯
একজন প্রকৃত গোলরক্ষক সান্টু- ৩২
কিংবদন্তি ফুটবলার সালাউদ্দিন- ৩৬
প্লে-মেকার এনায়েত- ৪৫
সাইড ট্যাকলার নান্নু- ৪৮
ওভারল্যাপিং মাস্টার মঞ্জু- ৫২
ক্লান্তিহীন যোদ্ধা আবু ইউসুফ- ৫৫
ফুটবলের নিপুণ শিল্পী চুন্নু- ৫৯
হাসি মুখের ফুটবলার রকিব- ৬৪
অফুরন্ত দমের ফুটবলার বাবুল- ৬৭
দুরন্ত গতির বাবলু- ৭১
অ্যাটাকিং রাইট ব্যাক টুটুল- ৭৪
প্রচ- শুটিং পাওয়ার ছিল মোহসিনের- ৭৮
গোল বুভুক্ষু আসলাম- ৮১
বুদ্ধিদীপ্ত ফরোয়ার্ড বাদল- ৮৭
দ্রুতগতির স্ট্রাইকার সালাম মুর্শেদী- ৯০
সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডার আশীষ- ৯৩
স্টাইলিশ রাইট উইঙ্গার ওয়াসিম- ৯৬
দুর্দান্ত লেফট-ব্যাক জনি- ১০০
দুর্ভেদ্য গোলরক্ষক মহসিন- ১০৪
রক্ষণভাগের অতন্দ্রপ্রহরী কায়সার হামিদ- ১০৮
কিং ব্যাক মোনেম মুন্না- ১১২
ছান্দসিক ফুটবলার রুমী- ১১৯
প্রতিপক্ষের ত্রাস সাব্বির- ১২৩
পরিপূর্ণ স্টপার জুয়েল রানা- ১২৬
সুযোগ সন্ধানী স্ট্রাইকার নকিব- ১৩০
ফ্রি কিক স্পেশালিস্ট আরমান- ১৩৪
পজিশনাল ফুটবলার আলফাজ- ১৩৭
সাহসী গোলরক্ষক আমিনুল- ১৪১


আমাদের ফুটবলাররা


আমাদের ফুটবলাররা
দুলাল মাহমুদ



লোগো
বাতিঘর ॥ ঢাকা


লেখক

ইবটঢণর এমর্মঠটফফটররট
(অ ঈড়ষষবপঃরড়হ ড়ভ ইরড়মৎধঢ়যরবং ড়ভ ইধহমষধফবংয’ং ভধসড়ঁং ঋড়ড়ঃনধষষবৎং)
নু উঁষধষ গধযসঁফ
চঁনষরংযবফ নু


চৎরপব ঞশ.


উ ৎ স র্গ

আমার জনক
ফারুক হোসেন খান
আমার জননী
বদরুন্নেছা বেগম

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

হকি অন্তঃপ্রাণ আলমগীর মোহাম্মদ আদেল/ দুলাল মাহমুদ

‘মৃত্যুগুহা’ থেকেই উজ্জীবনের গান / দুলাল মাহমুদ

অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব

কাছের মানুষ এখন অনেক দূরে

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

নূর আহমেদ : ছিলেন ব্যাডমিন্টনে, ছিলেন ফুটবলেও/ দুলাল মাহমুদ