ধবল জোছনার দিনগুলো / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud


মনে হয়, এইতো সেদিনের কথা। অথচ দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে তিন দশক। আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির সদস্য হওয়ার পর জীবনের ছক যেন উলট-পালট হয়ে যায়। কীসের কলেজ? কীসের লেখাপড়া? কীসের ‘স্বাভাবিক’ জীবন যাপন? এ সব যেন হয়ে পড়ে গুরুত্বহীন। (এখন কিন্তু ভাবনাটা ভিন্ন। কলেজ বাদ দিয়ে, লেখাপড়া না করে এবং অ-সামাজিক ছন্নছাড়া জীবন যাপন করে যে ভুল করেছি, তারজন্য এখন অনেক অনুতাপ হয়। কেন হয়, সেটা আমি পলে পলে অনুধাবন করতে পারি। তখন তো আর সেটা পারতাম না। সে সময়ের জীবনে এত হিসেব-নিকেশের ব্যাপার ছিল না।) দিনের বেশির ভাগ সময়ই কেটে যায় ষ্টেডিয়াম এলাকায়। সারাদিন খেলা দেখে কাটে। প্রিয় খেলা ফুটবল তো ছিলই। সেটা ছিল পড়ন্ত বিকেলে। দিনের বেলা ক্রিকেট থেকে শুরু করে সদ্য চালু হওয়া হ্যান্ডবল-বাদ যায় না কোনো খেলাই। যেন সব খেলা দেখতে না পারলে জীবনের কোথাও ঘাটতি থেকে যাবে। সেটা কি জেনে-শুনে হতে দিতে পারি? অসম্ভব। তা হতে পারে না। তাই কি এক প্রবল নেশায় সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি বাউন্ডুলের মতো চষে বেড়াই ঢাকা ষ্টেডিয়াম এবং সংলগ্ন পল্টন ময়দান এলাকায়। তখন তো এই গণ্ডির বাইরে খেলাধুলা খুব একটা ছিলও না। স্বল্প এই পরিসরের মধ্যে কত খেলাই না হতো। আর সে সময় যে কোনো খেলাই হোক না কেন, দর্শকের কিন্তু কোনো কমতি ছিল না। আর আমাদের মতো ভবঘুরে কিছু মানুষ তো নিয়মিতই দেখতে পাওয়া যেত। যাঁরা অভুক্ত পেটেও খেলা দেখার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতে চাইতো না। কোনো একটি খেলার জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজিত হলে ছড়িয়ে পড়তো একটা উৎসবের আমেজ। আর এই উৎসব আমাদের দারুণভাবে মজিয়ে দিত। হায়! সেইসব দিনগুলো আজ কোথায়? এখন ক্রিকেট ছাড়া জাতীয় পর্যায়ে তো দূরে থাক, আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতা হলেও দর্শক খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই উৎসাহ, সেই উদ্দীপনা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ফুটবলের সেই উন্মাদনাইবা কোথায় গেল? এখন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচকে কেন্দ্র করে যে রমরমা হয়, তারচেয়েও বেশি জমজমাট ছিল ঢাকার ঘরোয়া ফুটবল। প্রিয় দলের খেলা দেখতে আগের দিন রাতেই টিকিটের জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন ‘নেশাগ্রস্ত’ ফুটবল অনুরাগীরা। বিশেষ করে, ঐতিহ্যবাহী সাদা-কালো জার্সির ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ও তারুণ্যের প্রতীক আকাশী-নীল জার্সির আবাহনী ক্রীড়া চক্রকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, তা নতুন প্রজন্মের কাছে মনে হতে পারে অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য ও রূপকথার মতো কোনো ব্যাপার। অবশ্য সেটা এখন মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাঁরা তো আর সেই দৃশ্যপট দেখেননি। অথচ ফুটবলের জন্য কত না প্রাণ ঝরে গেছে। কত না জীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। কত না সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। তারপরও ফুটবলপিপাসুদের আকুতি ছিল, মৃত্যুমূল্যে ফুটবল চাই। অবাক করা ব্যাপার হলো, সেই ফুটবলেরই আজ মৃতদশা। ফুটবল হারিয়ে ফেলেছে তার জীবনীশক্তি। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলেরই যেখানে মরণদশা, সেখানে অন্য খেলাগুলো তো মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়বেই। মনে প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হলো? ক্রিকেট কি তাহলে অন্য সব খেলার প্রাণশক্তি কেড়ে নিয়েছে? নাকি অন্য কোনো কারণ বিদ্যমান। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থে এর যৌক্তিক কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? অবশ্য সে সময় মোহামেডান এবং আবাহনী নামের এমনই তীব্র আকর্ষণ, এই দুই দলের ক্রিকেট খেলার দেখার জন্যও ঢাকা ষ্টেডিয়াম পরিপূর্ণ হয়ে যেত। এখন কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে সেই দর্শক হয় না। যাক, সে কথা। অবশ্য দিনমান টো টো করে ঘুরলেও প্রতিদিনই যেতাম ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকা অফিসে। এটা ছিল আমাদের সঞ্জীবনী শক্তি। আমরা তো এই পত্রিকার হয়েই মজুরি (ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিকতা) খাটতাম। সারাদিন ষ্টেডিয়াম এলাকায় চক্কর মারার এটা প্রধান একটা কারণ ছিল। আমরা তরুণরা ছিলাম সব রোগের বটিকা। কত রকম খেলা, কত রকম বিষয় নিয়ে যে লিখতে হতো! দিলু-কিরণ-দুলাল (দিলু খন্দকার, নজমুল আমিন কিরণ ও দুলাল মাহমুদ) ছিল যেন পত্রিকার সার্বক্ষণিক প্রতিবেদক। ক্রীড়াঙ্গনের সবাই আমাদের মনে করতেন ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার ঘরের মানুষ। অথচ আত্মিক সম্পর্ক ছাড়া এই পত্রিকার সঙ্গে আমাদের তখন আর কোনো বন্ধন ছিল না। আমরা যখন লেখালেখি শুরু করি, তখন এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন এবং আড্ডা মারতেন কাজী শামসুল ইসলাম, ইকরামউজ্জমান, কবি সানাউল হক খান, খন্দকার সালেক সূফী, আজম মাহমুদ, মির্জা আলিম আহমেদ, খন্দকার তারেক, লতিফুর রহমান খান, শাহিনুল ইসলাম মুকুল, মাসুদ আহমেদ রুমি, মঞ্জুরুল হক, শেখ আইনুল হক, নাসিমুল কবির প্রমুখ। টাঙ্গাইল থেকে প্রায়শই আসতেন অধ্যাপক আশরাফউদ্দিন খান, ওবায়দুল হক খান। সিলেট থেকে ছুটে আসতেন টিপু মজুমদার। এছাড়া আরো অনেকেই লিখতেন। তবে তাঁরা আড্ডার নিয়মিত সদস্য ছিলেন না। তবে লিখতেন না, এমন অনেকেই কেবল আড্ডার প্রলোভনে আসতেন। তখন পত্রিকার অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন বদি-উজ-জামান। কিন্তু আড্ডাটা জমে ওঠতো পত্রিকার প্রাণ সালমা রফিককে কেন্দ্র করে।
‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় হাজিরা দিয়ে আর এদিক-সেদিক ঘোরাঘোরি করে একটু বিকেল হলেই ছুটে যেতাম বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতিতে। ক্রীড়ালেখক, ক্রীড়া সাংবাদিক, ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, ক্রীড়ানুরাগীদের অন্যতম একটি আড্ডার কেন্দ্রস্থল ছিল ক্রীড়ালেখক সমিতি। কত না প্রাণোচ্ছ্বল ছিল সেই আড্ডা। যদিও আড্ডাকে নির্দিষ্ট পরিসরে বেঁধে রাখা সহজ নয়, তারপরও সেই আড্ডার মূল বিষয় থাকতো খেলাধুলা। আর আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন সব্যসাচী ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব আতাউল হক মল্লিক। তখন তিনি সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তাঁর ব্যাগের মধ্যেই ছিল সমিতির প্রাণভোমরা। ধারা ভাষ্যকর হিসেবে তাঁর আলাদা একটি পরিচয় ছিল। এছাড়া কি ছিলেন না তিনি? ক্রীড়া সাংবাদিক, ফুটবলের ফিফা রেফারি, ক্রিকেট আম্পায়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তো ছিলেনই। এছাড়া হেন কোনো খেলা নেই, যার নিয়ম-কানুন তিনি জানতেন না। শুধু যে জানতেন, তাই নয়, সব কিছুতেই তিনি থাকতেন আপ-টু-ডেট। যে কোনো খেলারই সর্বশেষ সংযোজন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনটা তিনিই সবার আগে জানতেন। তারপর অন্যদের জানাতেন। কোথাও কেউ আটকে গেলেই সমাধানের জন্য তাঁর স্মরণাপন্ন হতেন নির্দ্বিধায়। অনেক রেফারি, আম্পায়ার, খেলোয়াড়, সংগঠক তাঁর শিষ্য। তাঁর কাছে যে কোনো বিষয়ে পরামর্শ বা তালিম নেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত ধর্ণা দিতেন। তাছাড়া কত ক্রীড়ালেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিক যে তিনি গড়ে তুলেছেন, তার কোনো হিসেব নেই। তিনি যখনই যে পত্রিকায় কাজ করতেন, তখন সে পত্রিকায় লেখার জন্য তরুণ ও নতুনদের স্বাগত জানাতেন। সব মিলিয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন অন্য এক উচ্চতায়। সঙ্গত কারণে তাঁকে ঘিরে থাকতো ক্রীড়াঙ্গনের নানার স্তরের মানুষ। আর তাঁর ‘কলকাত্ত্যাইয়া’ বাচনভঙ্গি ছিল শ্রবণসুখকর। অনায়াসেই যে কোনো আসর তিনি জমিয়ে দিতে পারতেন। আমাদের মতো তরুণরা এ থেকে শিক্ষা ও মজা দুই-ই পেতাম। সবচে’ বড় কথা, তিনি ছিলেন আমাদের গুরু। তাঁর কাছ থেকে জানতে পারতাম, বুঝতে পারতাম, শিখতে পারতাম। সেটা নিশ্চয়ই কম পাওয়া নয়। তিনি সব সময় আড্ডায় থাকতে পারতেন না। তাঁর তো ব্যস্ততার কমতি ছিল না। সাংবাদিকতা করতেন। তারপর নানান সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তবে সমিতিই ছিল তাঁর প্রাণকেন্দ্র। যতক্ষণ থাকতেন, ততক্ষণ সরগরম করতো ক্রীড়ালেখক সমিতি। তারপরও আড্ডা থেমে থাকতো না। সন্ধ্যার পর অনেক বেশি জমে ওঠতো। তখন তো সব খেলার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা স্টেডিয়াম। আশে-পাশেই হতো বিভিন্ন খেলাধুলা। আর বিকেল ও সন্ধ্যায় ষ্টেডিয়ামে চলতো ফুটবল খেলা। খেলা চলাকালে কিংবা খেলা শেষে সবারই পা পড়তো সমিতিতে। তাছাড়া সমিতির জানলা দিয়ে খেলা দেখতে পাওয়াটাও ছিল বাড়তি একটি সুবিধা। এ কারণে সমিতিতে সমাগমটা মন্দ হতো না। এক একদিন আড্ডার মেজাজ হতো ভিন্ন। সব দিন তো আর একরকম হয় না। কবি সানাউল হক খানের ‘পাগলামি’ও কম উপভোগ্য ছিল না। তিনি কি এখনও তেমনই আছেন? আড্ডায় কখনো-সখানো হালকা ধরনের খিস্তি-খেউর আর উত্তপ্ত মেজাজ তো ছিলই। সেটা অবশ্য কালেভদ্রে। তবে যাঁরা আড্ডায় আসতেন, তাঁদের সবারই ক্রীড়াঙ্গনে কম-বেশি আলাদা একটি পরিচিতি ছিল। যে কারণে আড্ডার রসদের কোনো খামতি থাকতো না। এই আড্ডার হাজিরা না দিলে পেটের ভাত অনেকেরই হজম হতো না। আড্ডার নিয়মিত মুখ ছিলেন সমিতির সদস্য কাজী শামসুল ইসলাম, জিয়াউল হক, আবদুল তৌহিদ, আতাউল হক মল্লিক, আমিনুল হায়দার চৌধুরী মালু, কবি সানাউল হক খান, শাহিনুল ইসলাম মুকুল, শেখ আইনুল হক, এ জামান কামাল, সেলিম নজরুল হক, কামরুন নাহার ডানা, নকিব আহমেদ নাদভী, মোস্তাফিজুর রহমান মামুন, মুস্তাহিদুল আলম টিপু, দিলু খন্দকার, নজমুল আমিন কিরণ, দুলাল মাহমুদ প্রমুখ। কিছু দিন পর যোগ দেন আমিনুল হক মল্লিক, হাসান মাহমুদ বাবলী, ইকবাল কবীর, জিয়াউল করিম লোটাস, আবদুল্লাহ সাঈদ, তোহা বিন হক, কাজী আলম বাবু, মোস্তাফিজুর রহমান, ফরহাদ টিটো, মঞ্জুর মিল্কী, রেজাউর রহমান সোহাগ, এস বি চৌধুরী শিশির, তালেব হোসেন ঢাকাইয়া, খন্দকার আরিফ প্রমুখ। আশির দশকের কথা। সব নাম, সব মুখ এখন আর মনে পড়ে না। দেখতে দেখতে বয়সের বেলা তো গড়িয়ে চলেছে। স্মৃতি তো এলোমেলো হবেই। তবে সমিতির সদস্যদের বাইরে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও আড্ডায় সামিল হতেন। আশে-পাশের ক্রীড়া ফেডারেশন ও সংস্থার অনেকেই আসতেন। তাছাড়া খেলা সংক্রান্ত প্রেস রিলিজ দেওয়ার জন্য ভিড় লেগেই থাকতো। তখন তো ক্রীড়া সাংবাদিকতার অনেকটাই নির্ভর করতো প্রেস রিলিজের ওপর। যে কারণে সব মিলিয়ে সমিতির আড্ডাটা অসম্ভব প্রাণবন্ত হয়ে ওঠতো। তারপর যতই দিন যেতে থাকে, আড্ডার মেজাজ ও পরিধি বাড়তে থাকে। বদলে যেতে থাকে আড্ডার ধরন-ধারণ। পৃথিবীর নিয়ম তো এমন, একদিকে যেমন গড়ে, অন্যদিকে তেমনি ভাঙে। তেমনিভাবে সমিতির আড্ডায় যোগ হতে থাকে নতুন নাম। নতুন মুখ। অন্যদিকে ঝরে পড়তে থাকে পুরনো নাম। পুরনো মুখ। এভাবে আমিও যে একদিন কখন পুরনো হয়ে গেছি, বুঝতে পারিনি। অথচ পুরনো হননি ইকরামউজ্জমান, কবি সানাউল হক খানের মতো সিনিয়ররা। তাঁরা এখনও সমিতির আড্ডা জমিয়ে তোলেন। প্রকৃতঅর্থেই তাঁদের আছে বুকভর্তি তারুণ্য। এ কারণে তাঁরা বোধকরি যে কারো কাছেই নমস্য। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বে এখন আমি আর সমিতির আড্ডায় উপস্থিত থাকতে পারি না। কিন্তু ফেলে আসা সেই দিনগুলোকে খুব খুব মিস করি। কেননা, ধবল জোছনার সেই দিনগুলো ছিল আমার জীবনের বড় পাওয়া।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়’ / দুলাল মাহমুদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

নেইমারকে নিয়ে কেন এই হাহাকার? দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

আমাদের ফুটবলাররা

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ