মোহাম্মদ আলী আর ফ্ল্যাশবিহীন ছবি / দুলাল মাহমুদ



বক্সিংয়ের প্রতি আমার কখনই ভালোবাসা ছিল না। এখনও নেই। প্রতিপক্ষকে নির্মমভাবে আঘাত ও রক্তাক্ত করার জান্তব দৃশ্য আমি দেখতেই চাই না। উপভোগ করার তো প্রশ্নই আসে না। বৈসাদৃশ্য হলেও সত্য, সেই স্কুল বয়সে এমন একজনকে মনের কোঠায় ঠাঁই দিয়েছিলাম, বক্সিং ছাড়া তিনি অন্য কিছু ভাবতেও পারতেন না। বক্সিংই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। ভালোবাসা তো বটেই। তাহলে কেন তিনি আমার হৃদয়ে স্থান করে নিলেন? সে এক রহস্য বটে। তবে এটা হতে পারে, তখন এমন ব্যক্তিত্ব খুব কম ছিলেন, যাঁকে বা যাঁদের নিয়ে নিয়ে গর্ব করা যায়। সে সময় মিডিয়ার তো এমন জয়জয়কার ছিল না। সাদা-কালো বাংলাদেশ টেলিভিশন আর গমের লালচে আটার মতো নিউজপ্রিন্টের সংবাদপত্রই ছিল ভরসা। কোনোটাই খুব বেশি সুলভ ছিল না। তারপরও এই দুই মাধ্যমে যাঁরা আমাদের মন জয় করে নেন, তিনি তাঁদের একজন। তিনি কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলী।
সেই কিশোর বয়সে কত বিচিত্র বিষয়ে যে আকর্ষণ করতো। বক্সিংয়ের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলীর জীবন তো কম বর্ণাঢ্য ও বর্ণিল নয়। তা আকর্ষণ না করার তো কোনও কারণ নেই। স্কুলের পাঠ্য বইয়ে কি তিনি ছিলেন? স্মৃতি থেকে উদ্ধার করতে পারছি না। তবে যেভাবেই হোক, ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ না দিয়ে আমেরিকান সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে জেল খাটা,‘ক্যাসিয়াস মার্কাস ক্লে’ ধর্মান্তরিত হয়ে মোহাম্মদ আলী হওয়া, কালো মানুষ হওয়ায় তাঁর যত অপমান, জ্বালা, যন্ত্রণা সর্বোপরি বক্সিংয়ের মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গদের বিজয়রথ ছুটিয়ে ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ হওয়া, এমন সব বিষয় একজন কিশোরের অন্তকরণে ছাপ ফেলার জন্য ছিল যথেষ্ট। বাংলাদেশ টেলিভিশনে তখন যা কিছু দেখানো হতো, দেখার সুযোগ পেলে হা করে গোগ্রাসে গিলতাম। বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত একটি লড়াই। সালটাও ঠিক মনে নেই। লড়াইটা কি ছিল জো ফ্রেজিয়ার নাকি লিওন স্পিংকসের সঙ্গে? আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। কিন্তু বক্সিং রিংয়ে তাঁর প্রজাপতি নৃত্য আর মৌমাছির মতো প্রতিপক্ষকে হুল ফুটানোর ভঙ্গিমা স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
এর পর পরই মোহাম্মদ আলী এসেছিলেন বাংলাদেশ সফরে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর তৃতীয় স্ত্রী অভিনেত্রী ও মডেল ভেরোনিকা আলী। সেটা ছিল ১৯৭৮ সাল। সেই সফরে তিনি জয় করে নেন বাংলাদেশের হৃদয়। তিনি যে কেবল তুখোড় মুষ্টিযোদ্ধা নন, তাঁর বুকের মধ্যে বাস করে একটি রসিক মন, সেটা তিনি বেশ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ক্ষুদে বক্সার গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে বক্সিং রিংয়ে তাঁর দুষ্টুমি, তাঁর হাসি-তামাশায় দর্শকরা দারুণ মজা পেয়েছিলেন। তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য কেউ একজন তাঁকে চট্টগ্রাম কিংবা কক্সবাজারে জমি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই সফরে তাঁকে কাছ থেকে দেখা হওয়ার মতো সৌভাগ্যবান ছিলাম না।
তবে মোহাম্মদ আলীকে কাছ থেকে দেখবো, এমনটি কখনও ভাবনায়ও ছিল না। কিন্তু কখনও কখনও কল্পনাও সত্য হয়ে যায়। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে আয়োজিত সাফ গেমস সাংবাদিক হিসেবে কাভার করতে যাই। তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর বিশেষ আমন্ত্রণে সাফ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদ আলী। খানিকটা দূর থেকেই তাঁকে দেখতে পাই। এর বেশি তো দেখতে পাওয়ার কথা নয়। তেমনটি আশাও করিনি। একদিন কী কারণে যেন আমি আর ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার ফটোগ্রাফার খন্দকার তারেক গেমসের অতিথি নিবাস ‘ম্যারিয়ট হোটেল’-এ যাই। হোটেলের লবিতে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখি মোহাম্মদ আলীকে। স্যুটেড-ব্যুটেড হয়ে তিনি হোটেল থেকে বের হয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। আমি চিৎকার করে তারেক ভাইকে ডেকে মোহাম্মদ আলীর দিকে এগিয়ে যাই। যেহেতু গলায় অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ঝুলানো ছিল, নিরাপত্তা রক্ষীরা তাঁর কাছে যেতে বাঁধা দেননি। আমি গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার অনুরোধ করি। তিনি তাতে সম্মতি জানান। আমি বিলম্ব না করে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে যাই। তিনিও হাসিমুখে পোজ দেন। আমি প্রস্তুত হওয়ার আগেই তারেক ভাই ক্যামেরায় ক্লিক করেন। তখন তো আর এক পলকে অসংখ্য ছবি তোলা যেত না। একটি ছবি তুললে সেটাই হয়ে যেত মহার্ঘ বস্তু। মোহাম্মদ আলীর মতো একজন কিংবদন্তিকে কাছে পেয়ে হোক কিংবা অন্য কারণও হতে পারে, পেশাদার ফটোগ্রাফার তারেক ভাই ক্যামেরায় ক্লিক করলেও ফ্ল্যাশ জ্বলেনি। আর তখন তো ফ্ল্যাশ ছাড়া ছবি তোলার কথা চিন্তাও করা যেত না। তাৎক্ষণিকভাবে এ ব্যাপারে তারেক ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জানালেন, ফ্ল্যাশ না জ্বললেও ছবি ওঠেছে। সে কথা শোনার পরও বুকের মধ্যে রয়ে যায় অস্বস্তির কাঁটা। তখন তো আর সেটা যাচাই করার সুযোগ ছিল না। দেশে ফিরে নেগেটিভ ওয়াশ করার পর বুঝতে পারবো, আমি ভাগ্যবান কিনা। যাহোক, এরপর মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে তারেক ভাইয়ের ছবি তুলেছিলাম আমি। ফটোগ্রাফার না হয়েও ছবিটা ঠিকমতোই তুলেছিলাম। তবে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে তারেক ভাইয়ের তোলা ফ্ল্যাশবিহীন সেই ছবিটা আমার জীবনের স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে আছে।
( ৩ জুন ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত।)      

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

এশিয়ানরা কি কেবলই শোভাবর্ধন করবে? দুলাল মাহমুদ