প্রতিরোধের সেই দুই ম্যাচ / দুলাল মাহমুদ
হকিতে তখন অপ্রতিরোধ্য পাকিস্তান। ১৯৬৮ সালের মেক্সিকো অলিম্পিক হকি চ্যাম্পিয়ন। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে হকিতেও মাত্রই চ্যাম্পিয়ন। প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক থাইল্যান্ডের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করে। এই ধাক্কা খাওয়ার পর তাদের আর থমকে যেতে হয়নি। এগিয়ে যায় অপ্রতিহত গতিতে। দ্বিতীয় ম্যাচে হংকংকে ১০-০ গোলে বিধ্বস্ত করে। জাপানকে ৩-০ গোলে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়। সেমি-ফাইনালে মালয়েশিয়াকে হারায় ৫-০ গোলে। ১৯ ডিসেম্বর ফাইনালে চির-প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে ১-০ গোলে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো এশিয়ান গেমসের শিরোপা জয় করে। বিশ্ব হকির সেরা এই দলটি শিরোপা জয় করে দেশে ফেরার পথে ঢাকায় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হকি দলের বিপক্ষে একটি ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভোলায় ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গতদের সাহায্য করাই ছিল এ ম্যাচের লক্ষ্য। তখন পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের সভাপতি লে. জেনারেল খাজা মোহাম্মদ আজহার খান। ম্যাচটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য তিনি প্রস্তাব দেন, পাকিস্তান জাতীয় দলের অতিরিক্ত খেলোয়াড়দের পূর্ব পাকিস্তান দলের হয়ে খেলার। তাঁর কারণ, তিনি মনে করেছিলেন, দুর্বল পূর্ব পাকিস্তান দলের সঙ্গে পাকিস্তানে ম্যাচটি মোটেও জমবে না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কর্মকর্তা ও খেলোয়াড়রা সেই প্রস্তাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। তাঁরা জানান, ম্যাচের ফল যা-ই হোক না কেন, তাঁরা নিজেরাই খেলবেন। তখন সবাই মনে করতে থাকেন, খেলায় পূর্ব পাকিস্তান দল হালি হালি গোল হজম করবে। সেটা মনে করা অস্বাভাবিক ছিল না। সে সময় পাকিস্তানের মতো দলের সঙ্গে লড়াই করার অবস্থানে ছিল না পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তানের কথাই বলি কেন, বিশ্বের কোনো দেশই তখন তাদের সামনে দাঁড়াতে পারছে না। কিন্তু আত্মবিশ্বাসী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের দামাল ছেলেরা। সংকল্পে বলীয়ান, হারার আগে হারবেন না। জানবাজি রেখে খেলবেন। বুঝিয়ে দেবেন, বাঙালিরাও হকি খেলতে জানে। তাছাড়া সে সময়কার উত্তপ্ত রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রভাব খেলোয়াড়দের দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করে। গণআন্দোলনের টেউয়ে তখন উথালপাতাল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা। সবার বুকেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। হকি মাঠে পশ্চিম পাকিস্তানিদের যেভাবেই হোক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ইস্পাতদৃঢ় এই মনোভাব নিয়ে তাঁরা মুখোমুখি হয় পাকিস্তানের। ২৪ ডিসেম্বর এ ম্যাচ দেখার জন্য ঢাকা স্টেডিয়ামে উপস্থিত হন হাজার হাজার দর্শক। খেলা শুরুর পর দেখা গেল অমিততেজী পূর্ব পাকিস্তান দলকে। গড়ে তোলে তীব্র প্রতিরোধ। যেন এক একজন নির্ভীক বীর তিতুমীর। নিজেদের নিংড়ে দিয়ে প্রতিপক্ষকে রুখে দেয়। দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তান দল। এমন প্রতিরোধের মুখে পড়বে, সেটা তাদের কল্পনায়ও ছিল না। তারা বিশ্বসেরা দল। তাদের কিনা এমন একটি দলের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আত্মসন্মানে লাগারই কথা। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও ম্যাচে তাঁরা গোল করতে পারছিল না। প্রথমার্ধ ছিল গোলশূন্য। পাকিস্তান দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের মুখ শুকিয়ে যায়। নিজেদের সন্মানহানির আশঙ্কা। দ্বিতীয়ার্ধেও গোলের জন্য মরিয়া পাকিস্তান। কিন্তু কিছুতেই পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষণব্যুহ ভেদ করা সম্ভব হচ্ছিল না। বাঙালি খেলোয়াড়রা যেন প্রতিরোধের দেওয়াল গড়ে তোলেন। আর যা-ই হোক, গোল খাওয়া যাবে না। যখন গোলের দেখা পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে, তখন বোধকরি খেলায় পূর্ব পাকিস্তানের দুই আম্পায়ারের একজনের পাকিস্তান দলের প্রতি সহানুভূতি জাগে। তিনি পাকিস্তান দলকে অন্যায্যভাবে একটি পেনাল্টি কর্নার দেন। তা থেকে খেলার একমাত্র গোলটি করেন পেনাল্টি কর্নার স্পেশ্যালিস্ট ফুলব্যাক তানভীর আহমেদ দার। ম্যাচে হারলেও সেদিন জিতেছিল বাঙালিরা। সেটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের হকির ইতিহাসের সেরা ম্যাচ।
এ ম্যাচটি নিয়ে পরের দিন ইংরেজি ‘দৈনিক মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে লড়াই করে ন্যূনতম ব্যবধানে হারলো পূর্ব পাকিস্তান একাদশ’ শিরোনামে রিপোর্ট করেন আনিস-উল-মওলা :
‘কে বলে পূর্ব পাকিস্তানের ছেলেরা হকি খেলতে পারেন না? গতকাল ঢাকা স্টেডিয়ামে দুর্ভাগ্যক্রমে একটি গোল হজম না করলে তাঁরা প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল। ঘূর্ণিঝড়ে দুর্গতদের সাহায্যার্থে আয়োজিত একটি প্রদর্শনী হকি ম্যাচে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে লড়াই করে ন্যূনতম ব্যবধানে হারলো তারা। দেশের এই অংশে ফুটবলের মতো হকি জনপ্রিয় না। তরপরও প্রায় ১০ হাজার দর্শকের উপস্থিতি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। দর্শকরা প্রত্যক্ষ করেন, এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ পদক জিতে ব্যাংকক থেকে সবে আসা পাকিস্তান জাতীয় হকি দল পূর্ব পাকিস্তান একাদশকে হারানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। জয়ের জন্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ‘শর্ট-কর্নার কিং’ পাকিস্তানের খ্যাতিমান রাইট ফুলব্যাক তানভীর দারের সহায়তা নিতে হয়। দ্বিতীয়ার্ধের ১৮ মিনিটে শর্ট কর্নারে জয়সূচক একমাত্র গোলটি করেন তিনি। এমনকি শর্ট কর্নারে তিনবার ব্যর্থ হন তানভীর দার এবং চতুর্থ ও শেষ শর্ট কর্নারে পাকিস্তান দল সফল হয়। পাকিস্তান দলের এটাই ছিল দুর্বলতা। যদি তারা বিশ্ব হকিতে শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণœ রাখতে চায়, তাহলে তাদের শর্ট কর্নার শিল্পের অবশ্যই উন্নতি ঘটাতে হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, এ মাসে কঠিন ও শ্রমসাধ্য এশিয়ান গেমস খেলে পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়রা ছিল কান্ত। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, স্থানীয় খেলোয়াড়দের প্রশংসনীয় নৈপুণ্যকে খাটো করে দেখা হচ্ছে। দ্রুততা ও চমৎকার স্টিকওয়ার্ক দিয়ে তাঁরা সংঘবদ্ধ দল হিসেবে খেলেছে। রক্ষণভাগে রাইট ফুলব্যাক সাব্বির ও সেন্টার হাফ সাদেক অসাধারণ খেলেন। তাঁরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারসেপশন করেন এবং দ্রুত ও নিখুঁতভাবে বল কিয়ার করেন। তাঁদেরকে দারুণভাবে সহায়তা করেন লেফট ফুলব্যাক শামসুল বারী।
ম্যাচের নায়ক
কিন্তু ম্যাচের নায়ক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তরুণ গোলরক্ষক মাজেদ। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ত্রাণকর্তা এবং কয়েকটি প্রচ- আক্রমণ ঠেকিয়ে দিয়ে হতাশ করেন পাকিস্তানকে। প্রকৃতঅর্থে বিশ্বসেরা পাকিস্তান দলের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা পূর্ব পাকিস্তান দলের গোলমুখে মৌমাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসেন এবং একের পর এক আক্রমণ চালায়। কিন্তু মাজেদকে হারাতে ব্যর্থ হয়। অ্যাটাকিং ফোর্স হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান ছিল একটি জিগসো-পাজল দল এবং উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, একজন জবরদস্তু সেন্টার ফরোয়ার্ডের অনুপস্থিতি। দুর্বল শ্যুটিং ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে পূর্ব পাকিস্তানের ফরোয়ার্ডদের গোল করার সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়। কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যায়, ম্যাচে হারলেও তাঁরা অনুজ্জ্বল ছিল না।
বিস্ময়কর ম্যাচ
পাকিস্তান দলের ম্যানেজার লে. কর্নেল আবদুল হামিদ খেলার পর আমাকে জানান, এটি ছিল একটি দারুণ খেলা, বিস্ময়কর ম্যাচ। পূর্ব পাকিস্তানের ছেলেরা ভালো খেলার কৃতিত্ব পেতে পারে। খেলোয়াড়রা তরুণ ও অভিজ্ঞতা কম। কিন্তু তাঁরা প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রেখেছে। অর্ধেক গোল হিসেবে বিবেচিত শর্ট কর্নার নেওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তান জাতীয় খেলোয়াড়রা নিখুঁত নন, এমন বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। আবদুল হামিদের নেতৃত্বে পাকিস্তান ১৯৫৮ সালে টোকিওতে এশিয়ান গেমস এবং ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে স্বর্ণ জয় করে। তিনি বলেন, ‘না, আমরা এই বিভাগে দুর্বল নই। আমাদের খেলোয়াড়রা খুব বেশি মেজাজ হারিয়েছেন।’ গতকাল পাকিস্তান দল শর্ট কর্নার পায় চারটি। খেলার প্রথমার্ধের ১২ মিনিটে একটি এবং ৬ মিনিট পর দ্বিতীয়টি। এমনকি তাঁরা বলে যথাযথভাবে কানেকটও করতে পারেননি। দ্বিতীয়ার্ধের ৭ মিনিটে তৃতীয় শর্ট কর্নার তানভীর দার নেওয়া সত্ত্বেও দারুণভাবে রক্ষা করেন মাজেদ এবং পুনরায় ইসলাহউদ্দিনের কাছে ফিরে আসা বলে শেষ অব্দি কিয়ার করেন শামসুল বারী। ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণী চতুর্থ শর্ট কর্নারে বিশ্বের যে কোনো গোলরক্ষকই হার মানবেন।
খেলা শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে একটিমাত্র শর্ট কর্নার পায় পূর্ব পাকিস্তান। তানভীর দারের কার্বন-কপি সাব্বিরের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তানভীর দার তাঁর মতোই থাকায় বাস্তবিকই পাকিস্তানের গোলরক্ষক আসলামকে কোনো দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি। যদিও লেফট ফুলব্যাক আখতারুল ইসলাম ছিলেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। মিডল ডিফেন্স লাইনে আকাঙ্খিত তেমন কিছুই ঘটেনি, যদিও সামির ছিল সতর্ক দৃষ্টি। সামনে ইসলাহউদ্দিনকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। দলের অধিনায়ক দ্রুতগামী রাইট আউট খালিদ মাহমুদের কাছ থেকে তিনি দারুণ সহযোগিতা পান। ঘন ঘন অফসাইডের ফাঁদে পড়েন জেহাঙ্গীর বাট। জাহিদ তাঁর দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেন। ‘ব্যাংকক হিরো’ সেন্টার ফরোয়ার্ড আবদুর রশিদকে কড়া মার্কিংয়ে রাখা হয় এবং তিনি মোটেও তাঁর মতো খেলতে পারেননি।
সন্ধ্যার ফ্যাইটে পশ্চিম পাকিস্তান যাবে পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়রা। ৩৫ মিনিটের পরিবর্তে প্রত্যেক অর্ধে ৩০ মিনিট করে খেলা হয়। ম্যাচ শুরুর আগে দু’দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হন প্রাদেশিক গভর্নর ভাইস-অ্যাডমিরাল এস এ আহসান। তিনি ছাড়াও খেলা উপভোগ করেন পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রী আহসানুল হক এবং নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স (এনডাব্লুউপিই)-এর গভর্নর ও পাকিস্তান হকি ফেডারেশনের সভাপতি লে. জেনারেল কে এম আজহার খান।’
পাকিস্তান দলে খেলেন : আসলাম, তানভীর দার, আখতারুল ইসলাম, রিয়াজ, গুলরাজ, খালেদ মাহমুদ, ইসলাহউদ্দিন, আবদুর রশিদ, জাহিদ ও জেহাঙ্গীর বাট।
পূর্ব পাকিস্তানের হকির ইতিহাসের সেরা দলটিতে খেলেন : গোলরক্ষক আবদুল মাজেদ, লেফট ফুলব্যাক শামসুল বারী, রাইট ফুলব্যাক সাব্বির ইউসুফ, রাইট হাফ মো. মহসিন, সেন্টার হাফ আবদুস সাদেক (অধিনায়ক), লেফট হাফ ইব্রাহীম সাবের, সেন্টার ফরোয়ার্ড আবদুর রাজ্জাক সোনা মিয়া, রাইট আউট নুরুল ইসলাম, রাইট ইন এহতেশাম সুলতান, লেফট ইন প্রতাপ শংকর হাজরা ও লেফট আউট মো. আশিক উল্লাহ কায়েস। কোচ : বশীর আহমেদ। আম্পায়ার : মাহমুদুর রহমান মোমিন ও আলমগীর মো. আদেল।
১৯৮৫ সালে দ্বিতীয় এশিয়া কাপ হকির আসর বসে ঢাকায়। এ টুর্নামেন্টে অংশ নেয় ১০টি দেশ। এরমধ্যে ছিল পাকিস্তানও। পাকিস্তান ১৯৮২ সালে ভারতের মুম্বাইয়ে বিশ্বকাপ হকির চ্যাম্পিয়ন। একই বছর দিল্লি এশিয়ান গেমসে চ্যাম্পিয়ন। করাচিতে প্রথম এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন। ১৯৮৪ সালের লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক হকি চ্যাম্পিয়ন। শক্তিমত্তার দিক দিয়ে তখন বিশ্বসেরা দল। ১৯৮৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শক্তিশালী এ দলের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। এ ম্যাচের আগে এক কালো ছায়া ঘিরে ছিল বাংলাদেশকে। দেশের মাটিতে পাকিস্তান দলের কাছে বেইজ্জত হওয়ার হুমকি। এর কারণ, ১৯৭৮ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমস হকিতে পাকিস্তানের কাছে ০-১৭ গোলে এবং ১৯৮২ সালে করাচিতে প্রথম এশিয়ান কাপ হকিতে ০-৯ গোলে হারার দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করতে থাকে বাংলাদেশকে। তারপরও উৎসাহের কমতি ছিল না ক্রীড়ানুরাগীদের। সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামের গ্যালারি গ্যালারি কানায় কানায় পরিপূর্ণ। ৩০ হাজারেরও বেশি দর্শক উপস্থিত হন। স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক দর্শক স্টেডিয়ামে ঢুকতে পারেননি। বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে এত দর্শক আর কখনো দেখা যায়নি। খেলা শুরুর পর গর্জে ওঠে দর্শকরা। গর্জে ওঠে বাংলাদেশ দলও। এ এক অন্য রকম বাংলাদেশ। স্টিকের ভেল্কি দেখাতে থাকেন বাংলার ছেলেরা। ভড়কে যায় পাকিস্তান। যদিও তাঁরা একের পর এক আক্রমণ চালাতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের গোলরক্ষক ওসমান, ডিফেন্ডার জুম্মন লুসাই ও আলমগীর চুন্নু প্রতিরোধের দেওয়াল গড়ে তোলেন। সেই দেওয়াল ভাঙা সম্ভব হয়নি পাকিস্তানের বিশ্বসেরা ফরোয়ার্ডদের। বিশেষ করে জুম্মন লুসাই যেন হয়ে ওঠেন চীনের প্রাচীর। বাংলার দুরন্ত ছেলেরা অদম্য মনোবল নিয়ে সাহসের সঙ্গে লড়াই করেন। প্রতিপক্ষের সব আক্রমণ নসাৎ করে দেয়। উপরন্ত সালাউদ্দিন তিসা সহজ সুযোগ নষ্ট না করলে বাংলাদেশ খেলার প্রথমার্ধে এগিয়ে যেতে পারতো। তাঁর গোল করার প্রচেষ্টা পাকিস্তানের গোলকিপার শহীদ বুক দিয়ে ফিরিয়ে দিলে গোলের দেখা পায়নি বাংলাদেশ। কিন্তু গোলের জন্য হন্য হয়ে ওঠে পাকিস্তান। খেলা শেষ হওয়ার ৬ মিনিট আগে তাঁরা সফল হয়। বদলি খেলোয়াড় নাসির আলীর থ্রুতে রাইট আউট খালিদ হামিদ বক্সের ভিতর সেন্টার ফরোয়ার্ড হাসান সরদারকে বল দেন। এবার আর তিনি গোল করতে ভুল করেননি। খেলায় ১৪টি পেনাল্টি কর্নার পায় পাকিস্তান। তা থেকে তারা কোনো গোল পায়নি। এটা ছিল বিস্ময়কর। গোলে ওসমান, রক্ষণভাগে জুম্মন, পিরু, মধ্যমাঠে কাঞ্চন, নাসিম, আক্রমণভাগে তিসা, মালেক চুন্নু, কিসমতরা কাউকে ছেড়ে দেয়নি। আর ছিল স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শকদের বিপুল সমর্থন। বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে সেরা ম্যাচটি উপহার দেয় বাংলার দুরন্ত খেলোয়াড়রা। ০-১ গোলে হারলেও এই পরাজয় ছিল গর্বের।
পাকিস্তান : শহীদ খান, কাসেম জিয়া, তৌওকিরদার (নাসির আলী), নাঈম আখতার, আবদুল রশিদ, সেলিম শেরওয়ানী (মুস্তাক আহাম্মদ), আয়াজ মাহমুদ, কলিমুল্লাহ, হাসান সরদার, হানিফ খান ও খালিদ হামিদ।
বাংলাদেশ দল : গোলরক্ষক ওসমান, রাইট ব্যাক জুম্মন লুসাই, রাইট হাফ শাহাবুদ্দিন চাকলাদার (অধিনায়ক), লেফট ব্যাক আলমগীর চুন্নু, লেফট হাফ পিরু, সেন্টার হাফ নাসিম, সেন্টার হাফ কাঞ্চন, রাইট আউট মালেক চুন্নু, রাইট ইন কিসমত, সেন্টার ফরোয়ার্ড সালাউদ্দিন তিসা, লেফট আউট লুলু। কোচ-মো. মহসিন। আম্পায়ার : ইয়াপ গুয়ান কিয়েট (মালয়েশিয়া)ও নীথিয়ানাথন (সিঙ্গাপুর)।
১৯৭০ আর ১৯৮৫ সালে বিশ্বসেরা পাকিস্তান হকি দলের বিপক্ষে প্রতিরোধের দুই ম্যাচ খেলে পূর্ব পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা প্রমাণ করেছিলেন, হকিতেও তাদের শক্তি আছে, সামর্থ্য আছে, আছে প্রতিভাও।
dulalmahmud@yahoo.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন