ফুটবলে দেখি পৃথিবীর মুখ / দুলাল মাহমুদ



বিশ্বকাপ ফুটবল কেবলই একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নয়, এরসঙ্গে জড়িয়ে আছে এই পৃথিবীর মানুষের জাগতিক নানান কর্মকা-। কত ভাবেই, কত রূপেই, কত অভিব্যক্তিতে বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হয়। আমরা নানান রঙে, নানান বিভঙ্গে, নানান দৃষ্টিতে তা অবলোকন করি। বিশ্বকাপ ফুটবলের এক একটি আসর বদলে দেয় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের চিন্তাÑভাবনা, আমাদের মনোজগত। আমরা বিস্মিত হই, বিমুগ্ধ হই। কখন-সখনও বিচলিত হই। এই মহোৎসবে আমরা শুধু ফুটবল খেলাই দেখি না, সেইসঙ্গে দেখি আবেগ-উচ্ছ্বাস, আনন্দ-উৎসব, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা। দেখি নানান রকম অনুভব-অনুভূতি, বেশ-ভূষা, সাজ-সজ্জা, সুন্দর-সৌন্দর্য, আচারÑআচরণ, ভালোলাগা-ভালোবাসা। দেখি কত রকম দেশ, কত মানুষ, কত তার সংস্কৃতি। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, এই দুনিয়াটা কত বিশাল, কত বর্ণিল, কত মাধুর্যময়। কত তার রূপ, কত তার রস, কত তার গন্ধ। আছে বৈচিত্রময় মানুষ, বৈচিত্রময় রঙ, বৈচিত্রময় বর্ণ। ভাষার বৈচিত্র্য, ভাবের বৈচিত্র্য, জীবনের বৈচিত্র্য। আমরা দেখতে পাই ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর-মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবীয়, আফ্রিকা, এশিয়ার বহুমুখি জীবনের ভিন্নতা ও স্পন্দন। আমার মতো যাঁদের নির্দিষ্ট পরিসরের বাইরে কোথাও যাওয়ার খুব একটা সুযোগ হয় না, টেলিভিশনই যাঁদের প্রধান ভরষা, তাঁদের কাছে এ যেন মহামানবের মিলনমেলা। প্রকৃতঅর্থেই মানবসমুদ্রের প্রতিনিধিত্বশীল একটি সংস্করণ বিশ্বকাপ ফুটবল। প্রতি চার বছর অন্তর অন্তর এই বিশ্বকাপ আমাদের জীবনে নিয়ে আসে নতুনত্বের ছোঁয়া। আমরা এই পৃথিবীর রূপান্তর, পরিবর্তন, বদলে যাওয়া অনেকটাই বুঝতে পারি বিশ্বকাপ ফুটবলের মাধ্যমে। আমরা নির্ণয় করতে পারি সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাকে।
বিশ্বকাপ ফুটবলটা পার্থিব জগতের শক্তি ও সৌন্দর্যের অপরূপ এক আধার। ফুটবল মাঠে আমরা দেখতে পাই, এই পৃথিবীর সেরা ফুটবল দলগুলোর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। এক একটি দল দীর্ঘ দিনের কৌশল, পরিকল্পনা, উদ্ভাবনী দক্ষতা, সৃজনশীলতা দিয়ে খেলতে নামে। খেলায় প্রতিপক্ষের সঙ্গে জয়ের জন্য কত রকমই না কসরত করে। তাতে থাকে সূক্ষè চাতুর্য, মেধার স্ফূরণ, প্রতিভার বিকাশ। কারো খেলায় থাকে সৌন্দর্য, কারো খেলায় থাকে শক্তির আস্ফালন। ফুটবল মাঠে কেউ শিল্পীর তুলিতে ছবি আঁকেন, কেউ যান্ত্রিক ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেন। আবার কেউবা শিল্পীও না, শ্রমিকও না। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য নেতিবাচক ফন্দি-ফিকির করে খেলার স্পিরিট ও নান্দনিক সৌন্দর্য নষ্ট করে দেন। প্রতিটি দলের খেলার মধ্যে কম-বেশি লক্ষ্য করা যায় একটি জাতির উদ্ভব-বিকাশ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, চিন্তা-চেতনা, ধর্ম, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, রীতি-নীতি। খেলার কৌশল, খেলোয়াড়দের ক্রীড়ানৈপুণ্য, দক্ষতা, আচার-আচরণ, আবেগ-উচ্ছ্বাস, সাফল্য-ব্যর্থতায় অনুচ্চারিতভাবে তার প্রতিফলন ঘটে। তেমনিভাবে গ্যালারির দর্শকদের মধ্যে দেখা যায়, প্রতিটি জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি, জাতিসত্তার নিদর্শন। লাতিন ঘরানায় দেখতে পাওয়া যায় জাদুবাস্তবতা ও লোকসংস্কৃতি। ইউরোপীয় আধুনিকতা ও পুঁজিবাদী জীবনযাপন এবং আফ্রিকান আদিবাসী জীবনধারা একে অপরের থেকে একদমই আলাদা। খেলার মাঠে এবং গ্যালারিতে এই বিভাজন ও বৈচিত্র্য অনায়াসেই অনুধাবন করা যায়। অবশ্য বিশ্বায়নের এই যুগে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে মেলবন্ধন এবং কর্পোরেট সংস্কৃতির জয়জয়কার হলেও বিশ্বকাপ ফুটবলে মহাদেশীয় সংস্কৃতির ভিন্নতা এখনও নজর কেড়ে নেয়। এটাই বিশ্বকাপ ফুটবলের সংস্কৃতি। বিশ্বকাপ ফুটবলের সৌন্দর্য।


dulalmahmud@yahoo.com        

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ

প্রতিরোধের সেই দুই ম্যাচ / দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

এশিয়ানরা কি কেবলই শোভাবর্ধন করবে? দুলাল মাহমুদ