এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ



রাজ্য নেই। রাজত্বও নেই। আছে কেবলই তীব্র পরিহাস। আর এমন পরিহাসের সামনে মুখোমুখি হওয়া এক ধরনের নিষ্ঠুরতাই মনে হয়। হিংস্র ষাঁড়ের সামনে অসহায় কাউকে ছেড়ে দেওয়ার মতো অনেকটা। এতে হয়তো কেউ কেউ জান্তব উল্লাস পেতে পারেন। কিন্তু তাতে কোনো বীরত্ব নেই। কিন্তু ফিফার মতো একটি প্রতিষ্ঠান কেন এখনো এ ধরনের রেওয়াজ চালু রেখেছে,  সেটা আমার অন্তত বোধগম্য নয়। বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো একটি আসরে এমন তামাসা অন্তত মানায় না। বলছিলাম, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচের কথা। শিরোপার লড়াইয়ে থাকা দু’টি দল সব কিছু হারিয়ে যখন বিধ্বস্ত, বিষণ্ন, বিপন্ন, তখন তাদেরকে গুরুত্বহীন একটি ম্যাচে খেলতে বাধ্য করার মধ্যে কী আনন্দ থাকতে পারে?
যদিও বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু থেকে এই ধারা চলে আসছে। তখনকার প্রেক্ষাপটে এবং চিন্তা-ভাবনায় এটিকে হয়তো যথাযথ মনে হয়েছে। কারণ, তখন তো মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার রেশ কাটানো যায়নি। সে সময়ে এটিকে শ্রেয়তরই মনে হয়েছে। কালের পরিক্রমায় অনেক কিছুই   তো বদলে গেছে। কত পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জন হয়েছে। বিশ্বকাপ ফুটবল যখন শুরু হয়েছিল, তখনকার কথা চিন্তা করুন, আর এখনকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন, কত না পার্থক্য। বদলে গেছে  খেলার ষ্ট্যাইল, নিয়ম-কানুন, ফরম্যাট। যুক্ত হচ্ছে নিত্য-নতুন প্রযুক্তি।ফুটবলকে আরো আকর্ষণীয়, আরো গতিময়, আরো প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য কত রকম উদ্যোগই না নেওয়া হচ্ছে।এটাই তো স্বাভাবিক। ফুটবলের যে স্পিরিট, যে সৌন্দর্য, যে নান্দনিকতা, তার সঙ্গে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ একদমই খাপ খায় না। যে ম্যাচ স্রেফ একটি স্থান নির্ধারণ করবে, এই স্থান নির্ধারণ মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেটার জন্য বিপর্যস্ত, হতবিহ্বল, হতোদ্যম ও অনিচ্ছুক দু’টি দলকে টেনে নামানোর কী যুক্তি থাকতে পারে? আর এই ম্যাচের যৌক্তিকতা নিয়ে অতীতেও প্রশ্ন তুলেছেন ফুটবলের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। তাদের কথায় কর্ণপাত করা হয়নি। আর এবার এ নিয়ে সরব হয়েছেন নেদারল্যান্ডসের কোচ লুই ফন গাল। তিনি জোরালো কণ্ঠেই জানিয়েছেন, ‘এই ম্যাচ খেলার কোনো মানে নেই।এটি আমার কাছে কোনো ম্যাচই না।১০-১৫ বছর আগে থেকেই আমি এটি বলে আসছি। কিন্তু কোনো কিছুই বদলায়নি। বিশেষ করে খেলার এ পর্যায়ে এসে আপনি খেলোয়াড়দের বাড়তি একটি ম্যাচ খেলাতে পারেন না।‘ আর এবার তো বলির পাঠা হয়েছে স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় নীল নেদারল্যান্ডস এবং স্বাগতিক ব্রাজিল।এমনিতে এবারের বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে ব্রাজিলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। তদুপরি জার্মানির কাছে নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে শোচনীয় হারের পর তোপের মুখে আছে ব্রাজিল। এখন গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো যদি তৃতীয় স্থান ম্যাচও হেরে যায়, তার পরিণতি নিশ্চয়ই ভালো হওয়ার কথা নয়। শুধু এবার ব্রাজিল কেন, এ রকম অপ্রয়োজনীয় ম্যাচ নিয়ে আগামীতেও পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আশঙ্কা একদম উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আর স্থান নির্ধারণ করাটা যদি খুবই গুরুত্বপূণ হয়, সেটা তো এ ম্যাচ আয়োজন না করেও করা  যেতে পারে। সেমি-ফাইনালে পরাজিত দু’টি দলের তুলনামূলক ফলের ভিত্তিতেই এটা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এটা হতে পারে সেমি-ফাইনালের গোলের যোগ-বিয়োগ করে। গোলও যদি পক্ষে-বিপক্ষে সমান হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে পুরো টুর্নামেন্টে উভয় দলের জয়-পরাজয় কিংবা  গোলের খতিয়ানের আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। এবার যেমন খুব সহজেই তৃতীয় স্থান নির্ধারণ করা যেত। সেমি-ফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে হেরেছে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার কাছে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হেরেছে নেদারল্যান্ডস। টাইব্রেকারে সিদ্ধান্ত হওয়া ম্যাচ তো হিসেবের খাতায় ড্র হিসেবেই বিবেচিত হয়। সেই হিসেবে এবার নেদারল্যান্ডসকেই তৃতীয় হিসেবে গণ্য করা যেতে পারতো। তাহলে আর তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ নামক হাড়িকাঠে কাউকে মাথা পেতে দিত হতো না। তাই না?


dulalmahmud@yahoo.com               

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ