বিশ্বকাপের টুকরো টুকরো স্মৃতি / দুলাল মাহমুদ



যদিও অর্ধ-শতাব্দী বছর পেরিয়ে যাবার পর বিশ্বকাপ ফুটবলের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল আমাদের। তারপরও আমরা অনেকটা সৌভাগ্যবান যে, আমাদের তারুণ্যে আমরা পেয়েছিলাম এই মহোৎসবকে। বাংলাদেশের টেলিভিশনের কল্যাণে মূলত ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপই ব্যাপকভাবে সম্পৃত্ত করেছিল এ দেশের ফুটবল অনুরাগীদের। তালিবাবাদ ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে সুদূর স্পেন থেকে সরাসরি সম্প্রচার হয়েছিল বিশ্বকাপের খেলা। লেখালেখি জীবনের শুরুতে এমন একটি বর্ণাঢ্য ও বর্ণিল উৎসবের সংস্পর্শে এসে বর্তে গিয়েছিলাম। এই বিশ্বকাপ খুলে দিয়েছিল আমাদের দিব্যদৃষ্টি। ঢাকা ষ্টেডিয়ামের মধ্যে সীমাবদ্ধ আমাদের দেখার জগতটা অনেক বিস্তৃত হয়ে গিয়েছিল। আমরা নাগরিক থেকে হয়ে উঠেছিলাম বিশ্ব নাগরিক। সেই যে গোপন প্রেমিকার মতো বুকে ঠাঁই করে নিয়েছিল বিশ্বকাপ ফুটবল, তার আকর্ষণ, তার আচ্ছন্নতা, তার মোহ কখনো ফিকে হয়ে যায়নি। বরং যতই দিন গিয়েছে গভীরতর হয়েছে প্রেম। জীবনের কত কত দিন, কত কত রাত বিসর্জন দিয়ে বিশ্বকাপের আরাধনায় নিমগ্ন থেকেছি। পান করেছি অনাবিল সৌন্দর্য সুধা।
বিশ্বকাপ ফুটবলকে নিয়ে কত স্মৃতি, কত আনন্দ, কত বেদনা। সবটাই স্মৃতিবন্দি হয়ে আছে, তা অবশ্য নয়। অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। তবে জেগে আছে টুকরো টুকরো ঘটনা। ১৯৮২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম খেলা দেখি স্বপ্নের দল ব্রাজিলের। সেই দলে ছিলেন সক্রেটিস, জিকো, জুনিয়র, ফ্যালকাওরা। মজার ব্যাপার, বেদনার স্মৃতি বোধকরি হৃদয়ে অনেক বেশি দাগ কেটে যায়। না হলে সব ছাপিয়ে কেন ব্রাজিলের পরাজয়ের কথাই অনেক বেশি মনে থাকবে। দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিলের স্বপ্নভঙ করে দিয়েছিলেন ইতালির ব্যাডবয় পাওলো রসি। জেল খাটা এই কয়েদির হ্যাটট্টিকে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে হয় সে সময়ের অন্যতম সেরা দলটিকে। ব্রাজিলের এই পরাজয় আর কলঙ্কিত ফুটবলার পাওলো রোসিই স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপ মানেই তো একম্বেবাদ্বিতীয়ম ডিয়েগো ম্যারাডোনা। এই একজনের উজ্জ্বলতায় আর সব কিছুই অনুজ্জ্বল হয়ে যায়। সক্রেটিস, জুনিয়র, কারেকা, ব্রাঙ্কোর ব্রাজিল যে ভাগ্যের খেলায় ফ্রান্সের কাছে হেরে যায়, সেটাও ম্লান হয়ে পড়ে। ম্যারাডোনার অবিশ্বাস্য কাণ্ড-কীর্তি ভুলিয়ে দেয় প্রিয় দলের অকাল বিদায়। কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল আর ৬ জনকে কাটিয়ে শতাব্দীর সেরা গোল এখনও স্মৃতিপঠে জ্বলজ্বল করে। বিস্ময়কর এই গোল আর তাঁর নেতৃত্বে আজেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হলে তিনি হয়ে উঠেন চিরকালের মহানায়ক। নিজের চোখের সামনে বিশ্বকাপ ফুটবলে একজনকে মহানায়ক হয়ে উঠতে দেখার চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? এ তো একজন ফুটবল অনুরাগীর সারা জীবনের পরম সম্পদ। তবে সেবার গ্যালারির দর্শকদের ‘মেক্সিকান ওয়েভ’ও বেশ আনন্দ দিয়েছিল।
মহানায়ক তো আর একটি বিশ্বকাপেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারেন না। তাহলে তো তাঁকে নায়কই বলা যেতে পারে। ম্যারাডোনা যে মহানায়ক ছিলেন, সেটি তিনি প্রমাণ করেন ১৯৯০ সালে ইতালি বিশ্বকাপে। দ্বিতীয় রাউন্ডে তাঁর পাস থেকে ক্যানিজিয়ার গোলে আবারো ভেঙে যায় ব্রাজিলের স্বপ্ন। ভাগ্যের আনকুল্য পেয়ে আর্জেন্টিনা ফাইনালে উঠলেও ম্যারাডোনার অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে মেক্সিকান রেফারি কোডেসাল যেভাবে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই বাধা আর অতিক্রম করতে পারেনি আর্জেন্টিনা। লাল কার্ড আর পেনাল্টির নির্মম শিকার হয়ে অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন ম্যারাডোনা। এই কান্না সইতে পারেননি বাংলাদেশে তাঁর অনুরাগীরা। সেদিন আর্জেন্টিনার পরাজয় নিয়ে বাংলাদেশে যা হয়েছিল, তার সঙ্গে আর কোনো আবেগের তুলনা চলে না। রাজপথ থেকে সংসদ পর্যন্ত একাত্ম হয়েছিল কোডেসালের ফাঁসির দাবিতে। সেই ক্ষোভ-বিক্ষোভ, মিছিল-সমাবেশ স্মৃতিতে জাগরূক হয়ে আছে।
কোনো খেলা না দেখেই অনুরাগী হয়েছিলাম ব্রাজিলের। বেড়ে উঠেছিলাম ব্রাজিলীয় ফুটবলের রূপকথা শুনে। ১৯৭০ সালের পর শিরোপা যেন ব্রাজিলের কাছে হয়ে উঠে সোনার হরিণ। যখন থেকে ব্রাজিলের খেলা দেখছি, তখন থেকেই শুধু ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা। সেরা ফুটবলার, সেরা দল নিয়েও ব্রাজিল খুব বেশি দূর যেতে পারছিল না। কিন্তু ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে ভাগ্যের সহায়তা পেয়ে শিরোপা জয় করে ব্রাজিল। আমাদের প্রজন্ম প্রথম ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখে। সেই বিশ্বকাপের সুদর্শন খেলোয়াড় রবার্তো ব্যাজিও ইতালিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন ইতালিকে বিশ্ব জয়ের। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ব্রাজিলের বিপক্ষে ফাইনালে তিনি টাইব্রেকারে গোল করতে না পারায় বাজিমাত করে ব্রাজিল। সেই বিশ্বকাপে গোল করার পর বেবেতোর সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তানের উদ্দেশ্যে বেবেতো-রোমারিওদের হাত দুলিয়ে দুলিয়ে উচ্ছ্বাস মনে দাগ কেটে আছে। আর ড্রাগ নিয়ে সাসপেন্ড হয়ে দুঃখ দিয়েছিলেন ম্যারাডোনা।
আমার কাছে ১৯৯৮ সালের ফ্রান্স বিশ্বকাপ আজও চির-রহস্য হয়ে আছে। এই রহস্য নিরসনে যথাযথ উত্তর কোথাও খুঁজে পাইনি। বিশ্ব মিডিয়াকেও এ বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী মনে হয়নি। কেন হয়নি, সেটাও রহস্যজনক মনে হয়। এটা কি কেবল আমার মনের সংশয়? আমি ঠিক বুঝতে পারি না। সেবারে স্বাগতিক দলের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচের আগ মুহুর্তে ব্রাজিলের ষ্ট্রাইকার রোনাল্ডো রহস্যজনকভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফেরার পর তাঁকে খেলতে নামিয়ে দেওয়া হয়। তিনি সেদিন মাঠে স্রেফ একজন দর্শকের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু কেন? শুধু তাঁর কথাই বলি কেন, ব্রাজিলের খ্যাতিমান ফুটবলাররা সেই ম্যাচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিনেদিন জিদানের দেওয়া গোল উপভোগ করছিলেন। তাঁদের মধ্যে জয়ের লিপ্সা তো দূরে থাকুক, খেলার সদিচ্ছাও দেখা যায়নি। আমিও আজও সেই খেলার হিসেব মেলাতে পারি না। আমার কাছে সেই ফাইনালটি এক চির-রহস্য হয়েই আছে। বিশ্বকাপের কত রহস্যই তো উদ্ঘাটন করা হচ্ছে, কিন্তু ব্রাজিল-ফ্রান্স ফাইনাল নিয়ে কারো কোনো হেলদোলই দেখি না। কারণটা কী?
প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের আসর বসে এশিয়ায় ২০০২ সালে। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় যৌথভাবে আয়োজিত এই বিশ্বকাপে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হন ব্রাজিলের রোনাল্ডো। রোনাল্ডো, রোনালদিনহো, রিভালদো, রবার্তো কার্লোসরা ব্রাজিলকে পৌঁছে দেন জয়ের ঠিকানায়। বিশেষ করে রোনাল্ডো-রোনালদিনহো জুটি মন কাড়তে সক্ষম হন। কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রায় মধ্যমাঠ থেকে ফ্রি-কিকে রোনালদিনহো জয়সূচক যে গোলটি করেন, সেটি হৃদয়ে দাগ কাটতে সক্ষম হয়। ফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে রোনল্ডোর দু’টি গোলই উজ্জ্বল হয়ে আছে।
পেলে আর ম্যারাডোনার পর মহানায়ক হওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান। ২০০৬ সালে জার্মান বিশ্বকাপে আবারও তিনি ফাইনালে নিয়ে যান ফ্রান্সকে। বিশ্বকাপ জয়ের কাছাকাছি গিয়েও তাঁর সামান্য একটু ভুলে বড় ধরনের খেসারত দিতে হয়। অতিরিক্ত সময়ের খেলায় তিনি ইতালির ডিফেন্ডার মার্কো মাতেরাজ্জিকে ঢুঁশ মেরে লাল কার্ড দেখেন। ১-১ গোলে অমীমাংসিত খেলাটি টাইব্রেকারে গড়ালে ভাগ্যের খেলায় হেরে যায় ফ্রান্স। বিশ্বকাপের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে জিদানের মতো একজন শান্তু-শিষ্ট ফুটবলারের এমন আচরণ আমার বোধগম্য হয়নি।
এখনও বুকের মধ্যে বেজে চলে ‘দিস টাইম ফর আফ্রিকা’। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০০৬ সালে আয়োজিত বিশ্বকাপকে ছাপিয়ে গিয়েছে কলম্বিয়ার পপ শিল্পী শাকিরার ‘ওয়াকা ওয়াকা’ গানটি। আর ‘টিকি-টাকা’ ফুটবলের সৌন্দর্য দিয়ে প্রথমবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় স্পেন। এ তো সেদিনের কথা। কম-বেশি সবারই মনে টাটকা স্মৃতি হয়ে আছে।
আর ফুটবলের দেশ ব্রাজিলে এবারের বিশ্বকাপ উরুগুয়ের ষ্ট্রাইকার লুইস সুয়ারেজের ইতালির ডিফেন্ডার কিয়েলিনিকে কামড় আর জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে ব্রাজিলের সবচেয়ে শোচনীয় পরাজয় স্মৃতির পাতায় যন্ত্রণাদায়ক হয়েই থাকবে।
এভাবেই এক একটি বিশ্বকাপ চলে যায়। আর রেখে যায় এমন সব টুকরো টুকরো স্মৃতি। আর এই স্মৃতিগুলো হয়ে যায় সারা জীবনের সঞ্চয়। এমন সঞ্চয়ের জন্য আমরা পরবর্তী বিশ্বকাপের অপেক্ষায় থাকি।


dulalmahmud@yahoo.com 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ