ভালোবাসার ব্রাজিল আর উচ্ছ্বল শাকিরা / দুলাল মাহমুদ



বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ার্টার-ফাইনালে লাতিন ঘরানার দুই দেশ ব্রাজিল এবং কলম্বিয়া যখন মুখোমুখি হয়, তখন মনের মধ্যে দোল খেতে থাকে একরাশ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। নিজেকেই জিঞ্জেস করতে থাকি, মন তুই কার? ব্রাজিলের নাকি কলম্বিয়ার? প্রশ্ন উঠতেই পারে কেন এই দ্বিধা? কেন এই দ্বন্দ্ব?
ফুটবলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্রাজিলকে ভালো না বাসার তো কোনো কারণ নেই। ফুটবল বললেই তো ভেসে উঠে হলুদের ঢেউ খেলানো বাধ ভাঙা উদ্দাম উচ্ছ্বাস। দৃষ্টিনন্দিত ও লাবণ্যময় ফুটবলের হাতছানি। মাঠের ফুটবলের সৌন্দর্য তো আছেই, গ্যালারির ফুটবলের আকর্ষণ তো নেহাত কম নয়। এই সৌন্দর্য, এই আকর্ষণ সৌন্দর্যপিয়াসীদের আকৃষ্ট না করে পারে না। যে কারণে দুনিয়াব্যাপী  ব্রাজিলীয় ফুটবল নিয়ে উন্মাদনার শেষ নেই। পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিষয় যদি নির্ধারণ করা হয়, নিঃসন্দেহে সেই তালিকার শীর্ষেই স্থান পাবে ব্রাজিলীয় ফুটবল। যদিও সেই দূর কৈশোরে ব্রাজিলীয় ফুটবলের প্রেমে যখন অবগাহন করি, তখন তো চোখের সামনে এত কিছু ছিল না। ছিল না হলুদের প্রাণোচ্ছ্বলতা, শিল্পিত ফুটবলারের কারুকাজ কিংবা উত্তাল গ্যালারির সাম্বা নাচ। পৃথিবীর অপর পিঠের এই দেশটির কোনো কিছুই তো হৃদয়ে ছাপ ফেলার কথা নয়। তাহলে কিশোর মনটাকে কেন রাঙিয়ে দিয়েছিল ব্রাজিল? না দেখা পেলে-গ্যারিঞ্চারা বুকের নিভৃতকোণে কেন বুনে দিয়েছিলেন ভালোবাসার বীজ? এ প্রশ্নের উত্তর আমি কখনোই খুঁজে পাইনি। বুঝতে পারি, মন তো জটিল এক সমীকরণ। তার হিসেবে কে মেলাতে পেরেছে? তবে এখন কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারি, ভালোবাসা তো এমনই। কার হৃদয়ের সঙ্গে কার হৃদয় কীভাবে বাঁধা পড়বে, সেটা কি কেউ বলতে পারে? পারে না বলেই রহস্যজনকভাবে ঘটে যায় সম্পর্কের মেলবন্ধন। ব্রাজিলীয় ফুটবলের সঙ্গে বোধকরি তেমনভাবেই হয়ে যায় যোগসূত্র। সেই যোগসূত্র কখনো ছিন্ন হয়নি। বরং গভীরতর হয়েছে। আর গভীরতর সম্মোহনের মায়াডোরে বেঁধে ফেলেন ফালকাও, সক্রেটিস, জিকো, জুনিয়র, রোমারিও, বেবেতো, রোনালদো, রিভালদো, রবার্তো কার্লোস, রোনালদিনহোরা। ফুটবলের এই শিল্পীদের খেলা যখন থেকে দেখছি, দেখছি গ্যালারির সূর্যমুখী ফুলের মনমাতানো দোলা, বুঝতে পারছি ভালোবাসার কেমেষ্ট্রি, তখন থেকেই আরো নিবিড় হয়ে উঠে ব্রাজিলীয় ফুটবলের প্রতি আচ্ছন্নতা। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে শিল্পিত সেই ব্রাজিলকে খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে অন্য কোথাও বুঝি সে বাঁধা পড়ে গেছে, হারিয়ে গেছে সেই সুর, সেই ছন্দ, সেই স্পন্দন। একটু একটু করে যেন দূরে সরে যাচ্ছে ভালোবাসার সেই ব্রাজিল। এবারের বিশ্বকাপে তো তাকে একদমই খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। নেইমার, থিয়াগো সিলভা, ডেভিড লুইজ, অস্কার, মার্সেলো, হাল্ক, ফ্রেডদের ব্রাজিল সমর্থকদের মন জয় করতে পারছে না।  
ভালোবাসার দল ব্রাজিলের বিপক্ষে কলম্বিয়ার মতো একটি দেশ যখন মুখোমুখি হয়, তখন কেন দুলতে থাকি সংশয়ের দোলায়? কলম্বিয়া তো ফুটবলের তেমন কোনো শক্তি নয়। এই দেশটির প্রতি তো কোনো আকর্ষণ অনুভব করার কথাই নয়। বরং মাফিয়াদের স্বর্গভূমি হিসেবে খ্যাত দেশটিকে নিয়ে এক ধরনের বিবমিষাই ছিল। বিশ্বকাপ ফুটবলে পেনাল্টি মিস করার কারণে যে দেশে আন্দ্রেস এসকোবারের মতো একজন ফুটবলারকে অকালে জীবন দিতে হয়, তেমন একটি দেশকে নিয়ে আদিখ্যেতা করার কী আছে? আসলে মানুষের মন তো। কখন যে কী কারণে দুলিয়ে দেবে, কেউ বলতে পারে না। যখন মনে হয়, জাদু বাস্তবতার লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের দেশ কলম্বিয়া, তখন বুকের মধ্যে অন্যরকম অনুভব হয়। ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড’, ‘দ্য অটাম অব দ্য প্যাটরিয়ার্স’,‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’, ‘মেমোরির্স অব মাই মেলানকোলি হোরস’ গ্রন্থের এই লেখক অনেক আপন হয়ে উঠেছেন। আর দুনিয়া কাঁপানো শিল্পী শাকিরাকে তো মনে হয়ে কত কাছের। কলম্বিয়ার এই পপ শিল্পী বেইলি ড্যান্সের তালে তালে নিতম্ব দুলিয়ে ‘হিপস ডোন্ট লাই’, ‘বিউটিফুল লায়ার’, ‘হোয়েনএভার, হোয়ারএভার’, ‘আনডারমিথ ইয়োর ক্লথস’, ‘সী উলফ’-এর মতো গানগুলো যখন গাইতে থাকেন, তখন উন্মাতাল হয়ে উঠে তারুণ্য। বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে গাওয়া ‘ওয়াকা ওয়াকা’, ‘লা লা লা’-র সুরেলা স্পন্দন যে কাউকে অভিভূত না করে পারে না। বিশ্বকাপের কারণেই শাকিরা ঠাঁই পেয়েছেন বুকের গহিনে। সংগত কারণে মার্কেজ, শাকিরার কথা মনে হলে হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেয় কলম্বিয়া নামক দেশটি। যে কারণে ভালোবাসার দল ব্রাজিলের সঙ্গে খেলতে নামলেও কলম্বিয়াকে দূরে সরিয়ে রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া এবারের বিশ্বকাপে দলটি যে ফুটবলশৈলী দেখিয়েছে, তাতে দেশটির প্রতি কিছুটা হলেও জন্ম নিয়েছে অনুরাগ। মন কেড়েছে হামাস রদ্রিগেজের গোল করার নিপুণ কৌশল। বিশ্বকাপ ফুটবলে কলম্বিয়া খুব বেশি দূর যে যেতে পারবে, তেমনটি মনে হয়নি। তারপরও যতটা পথ এসেছে, তাতেই হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে দেশটি।
ব্রাজিল এবং কলম্বিয়াকে নিয়ে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সেটারও কারণ সৌন্দর্য। একদিকে ফুটবল ও সাম্বার সৌন্দর্য, অন্যদিকে সাহিত্য ও সংগীতের সৌন্দর্য। এই দুইয়ের সম্মোহন নিয়ে ফুটবল মাঠে সামনে এসে দাঁড়ায় এই দুই দেশ। তবে খেলাটা যেহেতু ফুটবল, সেখানে অন্য কিছু দিয়ে তার বিচার-বিশ্লেষণ করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। ফুটবলের নিক্তি দিয়ে মাপলে ব্রাজিলের সঙ্গে অন্য কারো তুলনা হতে পারে না। সেটা তো আবারও মাঠের ফুটবলে দেখিয়ে দিয়েছে ব্রাজিল। সব সংশয়কে দূর করে দিয়ে কলম্বিয়াকে হারিয়ে দিয়েছে ‘সেলেসাও’রা। শুধু তাই নয়, এ ম্যাচে খানিকটা হলেও ঝিলিক দিয়েছে অতীতের ব্রাজিল। যে ব্রাজিলের মর্মবাণী ‘জোগো বনিতো’ অর্থাৎ সুন্দর ফুটবল। ফুটবল দল ফিরে গেলেও শেষ হয়ে যায়নি কলম্বিয়ার বিশ্বকাপ। সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকবেন কলম্বিয়ার শাকিরা। সেদিন যদি সুন্দর ফুটবল খেলে ব্রাজিল জয় করতে পারে বিশ্বকাপ, তাহলে দুইয়ের যুগলবন্দিতে মধুরেণ সমাপয়েৎ হবে লাতিন ঘরানার। কিন্তু ব্রাজিলকে সংশয়ের কালো মেঘে ঢেকে দিয়েছেন কলম্বিয়ারই ডিফেন্ডার হুয়ান জুনিগা। তাঁর ট্যাকলেই শেষ হয়ে গেছে ব্রাজিলের প্রাণভোমরা নেইমারের বিশ্বকাপ। তাহলে কি বিশ্বকাপের শেষ দিনে দেখা যাবে না শাকিরার প্রাণবন্ত উপস্থাপনা আর ব্রাজিলের সাম্বা নাচের যুগলবন্দি?    


dulalmahmud@yahoo.com               

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ

এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয় / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ