ইউরোপীয় ক্লাবে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম ফুটবলার/ দুলাল মাহমুদ
উপমহাদেশের ফুটবলের এক বিস্ময়কর প্রতিভা সালিম। অথচ তিনি একটি বিস্মৃত নাম। হারিয়ে গেছেন ইতিহাসের আড়ালে। ফুটবলের ইতিহাসে এখন আর তাঁর নাম উচ্চারিত হয় না। অথচ সত্যিকার অর্থে কিংবদন্তি ফুটবলার ছিলেন তিনি। তাঁর জীবন, তাঁর ক্রীড়াশৈলী, তাঁর উপাখ্যান রীতিমতো প্রবাদের মতো। তিনি ছিলেন কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের স্বর্ণযুগের ফুটবলার। আর স্বর্ণযুগের যাঁরা নির্মাতা, তিনি তাঁদের অন্যতম। এ কারণেও তাঁর হারিয়ে যাওয়ার কথা নয়। তবে তাঁর সবচেয়ে যেটি বড় পরিচয়, তিনি হলেন ইউরোপীয় ক্লাবে খেলা উপমহাদেশের প্রথম ফুটবলার। শুধু এ কারণেই তাঁর ফুটবলের প্রবাদপুরুষ হয়ে থাকার কথা। কিন্তু কেন যেন সেটা হয়নি। তবে সেই বৃটিশ ঔপনেশিক রাজত্বে তিনি যে কীর্তি গড়েছেন, তা সম্ভব হয়েছে তাঁর অপরিসীম সাহস ও দুর্ধর্ষ ফুটবলশৈলীর কারণে। তিনি ছিলেন অসাধারণ ও ব্যতিক্রমধর্মী ফুটবলার। বিরলজাতের ফুটবলার বললে মোটেও অত্যুক্তি হয় না। তিনি খেলতেন খালি পায়ে। কর্নার কিক, ফ্রি-কিক বা একটু থামিয়ে সেন্টার করায় তিনি ছিলেন বিপক্ষের কাছে রীতিমতো বিভীষিকা। পায়ে যাঁদের বল থাকলে বিপক্ষের বুক দুরু দুরু করে, তিনি ছিলেন সেই জাতের ফুটবলার। তাঁর মতো খেলোয়াড় সাধারণত দেখা যায় না। তিনি তাঁর জাদুকরি ক্রীড়াশৈলী দিয়ে দেশীয় ও ইউরোপীয় দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে দেন।
১৯০৪ সালে পশ্চিম বঙ্গের কলকাতার মেটিয়াবুরুজে একটি নিম্নবিত্ত পরিবারে মহম্মদ আব্দুল সালিমের জন্ম। ফুটবলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। শৈশব থেকে তাঁর মধ্যে দেখা যায় উঁচুমানের ফুটবলের দক্ষতা। ১৯১১ সালে মোহানবাগান কাবের আইএফএ শিল্ড জয়, তাঁকে ফুটবলে আকৃষ্ট করে। বিশ ও ত্রিশ দশকে ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তির জন্য ভারতীয়রা লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। অনেক ভারতীয় ফুটবল দিয়ে ব্রিটিশদের জবাব দেওয়ার পথ বেছে নেন। তাঁরা খালি পেয়ে খেলে বুট পরা বৃটিশদের হারিয়ে দেন। এমন এক প্রেক্ষাপটে ১৯২৬ সালে মধ্য কলকাতার বৌবাজারের ‘চিত্তরঞ্জন কাবে’ সালিমের যোগ দিতে কোনো সমস্যা হয়নি। শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তর একটি দল ফুটবল মাঠে ইউরোপীয়দের হারিয়ে দেওয়ার অবদমিত আকাঙ্খা সালিমের বুকে বুনে দিতে সক্ষম হন। এরপর সালিম কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ‘বি’ দলে যোগ দিয়ে ১৯২৬ ও ১৯২৭ সালে খেলেন। তাঁর অসামান্য প্রতিভা দেখে কিংবদন্তি বাঙালি ক্রীড়া প্রশাসক পঙ্কজ গুপ্ত তাঁর ক্লাব স্পোর্টিং ইউনিয়নে খেলার জন্য তাঁকে দলভুক্ত করেন। ১৯৩১ সাল পর্যন্ত এই ক্লাবে খেলেন। এরপর ১৯৩২ সালে ইষ্ট বেঙ্গল হয়ে সালিম আসেন বাংলার খ্যাতিমান ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ছোনে মজুমদারের এরিয়ান্স কাবে।
১৯৩৪ সালে সালিম যোগ দেন প্রথম বিভাগ লিগে উন্নীত হওয়া আলোচিত ফুটবল কাব কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে। তিনি হয়ে ওঠেন দলের নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়। ক্লাবকে টানা পাঁচ বছর শিরোপা এনে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মোহামেডানের স্বর্ণযুগের অন্যতম কাণ্ডারি সালিম সম্পর্কে বোরিয়া মজুমদার ও কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যৌথ গ্রন্থ
A Social History Of Indian Football: Striving To Score -এ লেখা হয়, ‘সালিমকে নিয়ে ক্লাবের ইতিহাসে প্রথমবার কলকাতা ফুটবল লিগের শিরোপা জয় করে মোহামেডান। এই জয় অচিরেই অভ্যাসে পরিণত হয়। সালিম আক্রমণভাগের পুরোভাগে থেকে পরের চার বছর মোহামেডানকে কাঙ্খিত শিরোপা এনে দেন। অসাধারণ প্রতিভাবান এই ফুটবলার বল কন্ট্রোল, ড্রিবলিং, নিখুঁত পাস ও লবের সাহায্যে হাজার হাজার হৃদয় জয় করে নেন। তিনি জানতেন, কতটা উঁচুতে পাস দিতে হবে। তাঁর পাসিং মোহামেডান সমর্থকদের কাছে ছিল অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। জয়ের ধারা পাঁচ বছর অব্যাহত থাকে। এই বছরগুলোর অধিকাংশ সময়ে সালিম ছিলেন সবার অগ্রভাগে। প্রতিটি বিজয়ই সমর্থকদের সংখ্যা কয়েক গুন বাড়িয়ে দেয়। অসংখ্য সমর্থক তাঁকে স্পর্শ ও আলিঙ্গন করতে চাওয়ায় তিনি আরো বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। অশ্রুভেজা চোখে তিনি টানা পঞ্চম শিরোপা উদযাপন করেন এবং তাঁর চাওয়া অনুযায়ী লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানান।’
সালিমের ইউরোপে খেলাটা অত্যন্ত বিস্ময়কর। অনেকটা রূপকথার মতো। তিনি যেভাবে কলকাতা ছেড়ে ইংল্যান্ড পৌঁছান, তা ছিল খুবই রোমাঞ্চকর। কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তখন স্বর্ণযুগ। আর এই স্বর্ণযুগের অন্যতম সেরা ফুটবলার সালিম। তাঁকে ছাড়া সে সময়ের কলকাতার ফুটবলের কথা চিন্তা করাই যায় না। আর কলকাতা মানে তো উপমহাদেশের ফুটবলের রাজধানী। ১৯৩৬ সালের লিগ শিরোপা সবে জিতেছে মোহামেডান। এ সময় সফরকারী চীনের অলিম্পিক দলের বিপক্ষে দু’টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য সালিমকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রথম ম্যাচ অল ইন্ডিয়া ইলেভেন এবং দ্বিতীয় ম্যাচ সামরিক ও বেসামরিক ফুটবলারদের নিয়ে গঠিত একাদশের হয়ে। ভারতের মাটিতে আইএফএ (ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন) আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ এটি। ভারতের হয়ে প্রথম ম্যাচে খেলেন- সুবোধ ব্যানার্জী, ডা. সন্মথ দত্ত (অধিনায়ক), সন্তোষ মজুমদার (ছোনে), বিমল মুখার্জী, নূর মোহাম্মদ, মাসুম, সালিম, রহিম, আর কার, করুনা ভট্টাচার্য ও আব্বাস। ১৯৩৬ সালের ৪ জুলাই প্রথম ম্যাচ খেলার পর সালিমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে চীনা কর্মকর্তা ড. চি চাও ইয়াঙ বলেন, ‘চমৎকার ফুটওয়ার্কের দুর্দান্ত প্রদর্শনী দেখে আমি হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে ভারতীয় দলকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। খেলায় তাঁরা দেখিয়েছেন অসাধারণ গতিময় ফুটবল আর পারস্পরিক সমঝোতার নির্দশন। যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁরা জিততে পারেননি। বিশেষ করে, আক্রমণভাগের খেলোয়াড় সালিম, রহিম, ভট্টাচার্য ও আব্বাসের নৈপুণ্য ছিল ব্যতিক্রমধর্মী।’ এমন একটি নৈপুণ্যভাস্কর ম্যাচ খেলার পর দ্বিতীয় ম্যাচে সালিম লাপাত্তা। এমনই লাপাত্তা যে তাঁর কোনো হদিসই পাওয়া যায় না। তাঁকে খুঁজে বের করার জন্য পুলিশের আশ্রয় নেওয়া হয়। পুলিশও তাঁকে তন্ন তন্ন করেও খুঁজে কোথাও পায় না। বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় ম্যাচ খেলার জন্য ‘সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি ইলেভেন’ দলে সালিমকে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই নিস্ফল হয়ে যায়। তা তো হবেই। কেননা, সালিম তো তখন আর নাগালের মধ্যে নেই। তিনি পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। হাশিম নামে সালিমের একজন নিকট আত্মীয় ইংল্যান্ডে বসবাস করতেন। তিনি কলকাতা বেড়াতে এসে চীনা দলের বিপক্ষে সালিমের প্রথম ম্যাচটি দেখেন। সালিমের অসামান্য ক্রীড়াশৈলী দেখে তাঁর মনে হয়, এই ক্রীড়ানৈপুণ্য দিয়ে সালিম অনায়াসেই ইউরোপে খেলতে পারবেন। যা ভাবা তাই কাজ। তিনি সালিমকে ইউরোপের ফুটবলে খেলার ব্যবস্থা করে দেবেন, এটা তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হন। তাছাড়া ইউরোপে খেলা মানেই তো অর্থ ও খ্যাতির হাতছানি। তাঁর কথায় রাজি হন সালিম। মিশরের কায়রো হয়ে তিনি ব্রিটেনে পাড়ি জমান। লন্ডনে কিছু দিন অবস্থান করার পর হাশিম সালিমকে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর সেল্টিক পার্কে সেল্টিক ফুটবল ক্লাবে নিয়ে যান। ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ ক্লাবটি শুধু স্কটল্যান্ড নয়, ইউরোপের একটি সেরা ক্লাব। সেল্টিকের খেলোয়াড়রা পেশাদার, এটা জেনে সালিম অবাক হন। তবে তিনি তাঁদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে ছিলেন আস্থাশীল। হাশিম সে সময়কার সেল্টিক ক্লাবের ম্যানেজার উইলি মালেকে বলেন, ‘ভারতের একজন সেরা ফুটবলার জাহাজে করে এসেছেন। আপনি কি তাঁকে ট্রায়ালে ডাকবেন? তবে তাঁর একটা সমস্যা আছে। তিনি খালি পায়ে খেলেন।’
উইলি মালে এটা ভালো করেই জানতেন, স্কটিশ পেশাদার ফুটবলারদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভারতের একজন খালি পায়ের সৌখিন ফুটবলারের এঁটে ওঠা কঠিন। তারপরও তিনি স্কটিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অনুমতি নিয়ে সালিমের ট্রায়াল নিতে রাজী হন। সেলিমকে যেদিন তাঁর স্কিল দেখানোর জন্য ডাকা হয়, সেদিন তিন জন রেজিষ্টার্ড কোচ ও ক্লাবের ১০০০ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। খালি পায়ে সালিমের সামর্থ্য দেখে তাঁরা বিস্মিত হন এবং ক্লাবের পরবর্তী দু’টি ম্যাচ খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। যদিও দু’টি ম্যাচই ছিল ফ্রেন্ডলি। যে কারণে এই ম্যাচ দু’টি রেকর্ডের পাতায় ঠাঁই পায়নি। প্রথম ম্যাচটি ছিল হ্যামিল্টন একাডেমিক্যাল ফুটবল ক্লাবের বিপক্ষে। সালিমের এই অভিষেক ম্যাচে সেল্টিক ৫-১ গোলে জয়ী হয়। তিনি পেনাল্টি থেকে যেভাবে গোল করেন, তা ছিল দেখার মতো। ১৯৩৬ সালের ২৮ আগষ্ট গালস্টন এফ সি’র বিপক্ষে সেল্টিককে ৭-১ গোলে জিততে তিনি প্রধান ভূমিকা রাখেন। সালিমের জাদুকরি ক্রীড়াশৈলীর বর্ণনা দিয়ে ‘ইন্ডিয়ান জাগলার-নিউ ষ্ট্রাইল’ শিরোনামে খেলার পরের দিন ‘দ্য স্কটিশ ডেইলি এক্সপ্রেস’ লেখে, ‘গত রাতে পার্কহেড (স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর একটি জেলা)-এ গালষ্টোনের সঙ্গে খেলায় ভারত থেকে আসা সেল্টিক এফ সি’র খেলোয়াড় সালিমের নৃত্যশীল দশটি আঙ্গুল দর্শকদের বিমোহিত করে দেয়। পায়ের আঙ্গুল দিয়ে অদ্ভুত রকমভাবে মোচড় খাইয়ে চাতুর্যতার সঙ্গে কারিকুরি করে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের বোকা বানিয়ে বলটিকে আলতোভাবে টোকা মেরে পাঠিয়ে দেন সেন্টার পজিশনে। এরপর গোল না হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। গত রাতে সেল্টিকের সাতটি গোলের তিনটিই তাঁর মুভ থেকে হয়। একটি পেনাল্টি নিতে বলা হলে তিনি সম্মত হননি। তিনি ছিলেন লাজুকপ্রকৃতির। ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন না। তাঁর ভাই ভাষান্তর করে দেন। ভাই হাশিম সালিমকে বিস্ময়কর মনে করেন, গত রাতে দর্শকরা সেটা সত্যি সত্যিই প্রত্যক্ষ করেছেন।’
একই দিন ‘গ্লাসগো অবজারভার’ পত্রিকায় লেখা হয়, ‘সেল্টিকের ভারতীয় আন্তর্জাতিক ফুটবলার সালিম বলের ওপর তাঁর চমকপ্রদ নিয়ন্ত্রণ দেখিয়ে শুক্রবার সেল্টিক পার্কে দর্শকদের পরিতৃপ্ত করেন। খালি পায়ে তিনি ছিলেন দৃষ্টি আকর্ষক। সেল্টিকের সাদা ও সবুজ জার্সির চেয়ে তাঁর কালো চামড়াই গুরুত্ব পায়। তাঁর খেলা ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। প্রতিটি বলই তিনি যেখানে পাঠাতে চেয়েছেন, ঠিকই সেখানে পাঠিয়েছেন। এক ইঞ্চির হেরফের হয়নি। গোল অভিমুখে তাঁর ক্রস নেট স্পর্শ করার অপেক্ষায় থাকে।’
অ্যালান ব্রেক-এর ‘বুক অব স্কটিশ ফুটবল’ গ্রন্থে সালিমের খেলা সম্পর্কে লেখা হয়, ‘ভারতীয় ফুটবলার সালিমকে গালষ্টনের বিপক্ষে খেলিয়ে একটি মহৎ উদ্যোগ নেয় সেল্টিক। সালিম খেলেছেন খালি পায়ে। দৃশ্যমান ছবির মতো তাঁর পা ব্যান্ডেজ দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। মোহাম্মদ হাশিম যথাযথভাবে তাঁর কথা বলেছেন। গোলমুখে ট্র্যাপিং ও লবিং-এ তিনি যে বিশেষজ্ঞ, সেটা তিনি প্রমাণ করেছেন। তিনি প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের অভিভূত করেন এবং সাতটি গোলই হয় মূলত তাঁরই প্রচেষ্টায়। বিদেশি ফুটবলাররা মোটেও দুর্লভ নয়। কিন্তু তাঁরা সবাই খেলেছেন বুট পরে। সালিম তাঁর দেশীয় পদ্ধতিতেই অটল থেকেছেন এবং ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখিয়েছেন বুট ছাড়াই। তাঁর নিখুঁত শুটিং ও বল নিয়ন্ত্রণ দর্শকদের আনন্দ দেয়।‘
সালিম খুব দ্রুতই গৃহকাতর এবং ভারতে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন। স্কটল্যান্ডে একটি মৌসুম খেলার জন্য সেল্টিক তাঁকে অনেক অনুরোধ করে। এমনকি তাঁর জন্য একটি চ্যারিটি ম্যাচ আয়োজন এবং মোট আয় থেকে তাঁকে পাঁচ শতাংশ দেওয়ার কথা বলে। সালিম তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ম্যাচ থেকে আয়ের উল্লেখিত ১৮০০ পাউন্ড, সে সময়ের প্রেক্ষাপটে অনেক টাকা, স্থানীয় এতিমদের দিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। কারণ, চ্যারিটি ম্যাচে এতিমদের আসার কথা ছিল। জার্মানিতে খেলার জন্য পেশাদার চুক্তিরও প্রস্তাব দেওয়া হয় সালিমকে। শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতে ফিরে এসে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দেন। তখন ১৯৩৭ সালের কলকাতার ফুটবল মৌসুম শুরু হওয়ার অপেক্ষায়। তারপর ইউরোপের কথা ভুলে তিনি মোহামেডানের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেন। অথচ কলকাতার ফুটবলে তখন কোনো অর্থ-কড়ি ছিল না। ফুটবল খেলে সংসার চালানোর প্রশ্নই আসে না। অথচ ইউরোপে খেললে তাঁর কোনো আর্থিক সমস্যা থাকতো না। কিন্তু সব প্রলোভনকে মাড়িয়ে তিনি ফিরে আসেন স্বদেশে। আর্থিক অস্বচ্ছলতার মধ্যেই তাঁকে ধুকে ধুকে দিনযাপন করতে হয়।
বৃদ্ধ বয়সে সালিম অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র রশিদ আহমেদ তাঁর অসুস্থতার খবর জানিয়ে সেল্টিক ক্লাবকে চিঠি লিখে তাঁর চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। যদিও এক সাক্ষাৎকারে রশিদ আহমেদ বলেন, ‘টাকা চাওয়ার আমার কোনো অভিপ্রায় ছিল না। আমি কেবল বুঝতে চাচ্ছিলাম, মহম্মদ সালিম তাঁদের স্মৃতিতে বেঁচে আছে কিনা। সেল্টিক ক্লাব থেকে একটি চিঠি পেয়ে আমি অত্যন্ত বিস্মিত হই। চিঠির খামের মধ্যে ১০০ পাউন্ডের একটি ব্যাংক ড্রাফট ছিল। আমি তাতে খুবই উৎফুল্ল হই। শুধু টাকা পেয়ে নয়, কারণটা হলো, আমার পিতা এখনও সেল্টিকের গর্বের স্থানে রয়ে গেছেন। আমি এই ড্রাফট ভাঙ্গাইনি। যত দিন বেঁচে থাকবো, তত দিন এটা সংরক্ষণ করবো। আমার পিতা প্রথম ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে বিদেশের মাটিতে খেলেছেন, এটা কোথাও লিখিত থাকুক, সেটাই আমি চাই। সেটাই আমার চাইবার বিষয়। এর বাইরে আর কিছু নয়।‘
১৯৭৬ সালে সালিম ‘বিধান চন্দ্র রায় ষ্টেট অ্যাওয়ার্ড’ পান। অথচ তিনি যে মাপের ফুটবলার ছিলেন, তাঁর প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয়নি। তাঁকে যথাযথ মর্যাদাও দেওয়া হয়নি। ফুটবল ইতিহাসের বিস্ময়কর এই প্রতিভা অনাদৃত ও অবহেলিত থেকে গেছেন।
১৯৮০ সালে ৫ নভেম্বর সালিম মারা যাওয়ার পর ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় লেখা হয়, ‘ত্রিশ দশকে কলকাতা সিনিয়র ফুটবল লিগে টানা পাঁচবার শিরোপা জয়ী খ্যাতিমান মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অন্যতম সদস্য মহম্মদ সালিম বুধবার সকালে ইন্তেকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। খেলোয়াড়ী জীবনে তিনি একজন রাইট উইঙ্গার ছিলেন। তিনি অসংখ্য ক্লাবের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন এবং তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন। তিনি স্ত্রী, চার পুত্র ও তিন কন্যা রেখে যান।’ তিনি যে সেল্টিক এফ সি’তে খেলেছেন, এটা মৃত্যুর সংবাদে উল্লেখ করা হয়নি। এটাও কম বিস্ময়কর নয়, অবিশ্বাস্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করেও তিনি অবহেলিত হয়ে আছেন এবং ভারতের ক্রীড়া ইতিহাসে তাঁর কথা খুব বেশি উল্লেখ নেই। এমনকি ভারতের অন্যতম সেরা ফুটবলার ও কোচ পি কে ব্যানার্জী পর্যন্ত সালিমের ক্রীড়াশৈলী সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন।
ঔপনেবেশিক ভারতে ব্রিটিশ শ্রেষ্ঠত্বকে যে কোনো প্রকারে চ্যালেঞ্জ জানানো ছিল খুবই কঠিন কাজ। এই অসম্ভবকে ফুটবলের মাধ্যমে সম্ভব করেছিলেন মহম্মদ সালিম। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, খালি পায়ের ভারতীয়রা ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। ধর্মীয় দাঙ্গা আর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও তিনি ভারতীয়দের নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন, খেলার মাঠে ঔপনেবেশিক রাজ্যও সাফল্য অর্জন করতে পারে। একই সঙ্গে বুঝিয়ে দেন, প্রতিভার দিক দিয়ে ভারতীয়রা ইউরোপীয়দের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। হায়! এখন তো আর এ কথা কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না। কারণ, সালিমের মতো বিরল জাতের ফুটবলার উপমহাদেশের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই মাপের ফুটবলাররা যুগে যুগে তো দূরে থাক, শতাব্দীতেও জন্মায় না।
ইন্টারনেট অবলম্বনে
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন