ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ


শিল্পিত ফুটবল এবং সৌন্দর্য যেন একে অপরের পরিপূরক। আর শিল্পকলার সারকথাই তো সৌন্দর্য। যা দেখে মানুষ আনন্দিত হয়, যে সৌন্দর্য মুগ্ধ করে, বুকের মধ্যে হয় অন্যরকম অনুভূতি, নিরন্তর খোরাক যোগায় ভাবনার, সেটাই তো শিল্পকলার সারকথা। এ বিবেচনা থেকে বলা যায়, ফুটবল খেলা তো শিল্পকলারই নামান্তর। বরং এটি অন্য যে কোনো পারফরমিং আর্ট থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়, অনেক বেশি উজ্জ্বল, অনেক বেশি আনন্দদায়ক। ফুটবল খেলা জীবন্ত ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর তো বটেই, বিনোদন হিসেবেও অতুলনীয়। ফুটবলে সৌন্দর্য ও সৃজনশীলতা প্রকাশের ক্ষমতা ও দক্ষতা প্রশ্নাতীত। চোখের পলকে তাৎক্ষণিকভাবে ফুটবল মাঠে শৈল্পিক সৌন্দর্য দিয়ে উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করা জাতশিল্পী ছাড়া সম্ভব নয়। সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, নৃত্য, চিত্রকলা, ভাস্বর্যের মতো ললিতকলা ও শিল্পকর্মও জীবনধর্মী। তবে ফুটবলের আবেদন ও শিল্পকুশলতা ব্যতিক্রমধর্মী। ফুটবল খেলা এমন একটি শিল্পকলা, যার মাধ্যমে দর্শকদের সঙ্গে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপিত হয়। খেলা চলার সময় প্রতিটি ক্ষণেই অনুভব করা যায় দর্শকদের আবেগ-উচ্ছ্বাস, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, ক্ষোভ-যন্ত্রণা, পাওয়া-না পাওয়ার আহাজারি। ২২ জন খেলোয়াড় ফুটবল মাঠের সবুজ গালিচায় যৌথ শিল্পকর্ম গড়ে তুলতে পারেন। পাশাপাশি যে কেউই আলাদা আলাদাভাবে নিজস্ব মুন্সিয়ানা ও সৃজনশীলতা দিয়ে দর্শক হৃদয়ে দাগ কাটতে পারেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলের পরিচিত মুখ আর্সেন ওয়েঙ্গার ফুটবল খেলাকে মনে করেন শিল্প। ফ্রান্সের সাবেক ফুটবলার ও ইংলিশ ফুটবল ক্লাব আর্সেনালের দীর্ঘ দিনের ম্যানেজারের উপলব্ধি হচ্ছে এমন, ‘আমি বিশ্বাস করি, জীবনের যে কোনো কিছুর লক্ষ্য অর্জনটা যেন শিল্প হয়ে ওঠে। যখন আপনি বই পড়েন, তা  ফ্যানটাসটিক। না জানা বিষয়ে আপনার হৃদয়ে দারুণভাবে ছুঁয়ে যান লেখক। তিনি আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু বিষয় উদঘাটন করতে সক্ষম হন। আপনি যদি একটি প্রাণীর মতো বাস করেন, তাহলে সেই জীবনের মানে কি? প্রতিদিনের জীবনটাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে আমরা যে চেষ্টাটা করি, সেটাই তো শিল্পকলা। ফুটবলও অনেকটা তাই।’  
ফুটবল মাঠে নান্দনিক, সৃজনশীল, আনন্দদায়ক ও সুন্দর ফুটবলের কত যে নিদর্শন ছড়িয়ে থাকে, তার কোনো শেষ নেই। প্রতি মুহূতেই কম-বেশি এর দেখা পাওয়া যায়। তবে চিরকালীন সৌন্দর্য আর তীব্র সম্মোহন করা দৃশ্যপট সহসা দেখা যায় না। এরজন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়। ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক প্রীতি ফুটবল ম্যাচে ফ্রান্সের বিপক্ষে ব্রাজিলের লেফট ব্যাক রবার্তো কার্লোস ১১৫ ফুট দূরত্ব থেকে রঙধনু শটের মাধ্যমে অবিশ্বাস্যভাবে যেভাবে গোল করেন, তার কোনো তুলনা হয় না। এর চমৎকারিত্ব, মনোহারিত্ব ও সৌন্দর্য শিল্পকলার অনুপম এক নির্দশন। ২০১১ সালে ইংল্যান্ড ও ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডের ফরোয়ার্ড ওয়েন রুনিকে যখন ম্যানচেষ্টার সিটির বিপক্ষে অসাধারণ বাইসাইকেল কিক নিতে দেখা যায়, সেটির সৌন্দর্য যে কোনো চিত্রকলাকে হার মানিয়ে দেয়। এমন একটি বিস্ময়কর দৃশ্য শিল্পকলার চিরায়ত দৃশ্যপট হয়ে যায়। কোনো শব্দ দিয়ে এর সত্যিকার প্রকাশ ঘটানো যায় না। আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকার লিওনেল মেসির শিল্পকর্ম, স্পেনের মিডফিল্ডার জাভিয়ার হার্নান্দেজের সৃজনী ক্ষমতা, ডার্বি ম্যাচের রোমান্স, ফাইনালে ম্যাচের মহাকাব্যিকতা, যে কোনো শিল্পকলাকেই ম্লান করে দিতে পারে। ফুটবলের এই সৌন্দর্য যে কাউকেই আবিষ্ট ও সম্মোহিত করবে। এরচেয়ে বড় শিল্পকলা আর কী হতে পারে?
ফুটবল এবং শিল্পকলার মধ্যে আসলেই কি কোনো দূরত্ব আছে? ফুটবল কি প্রকৃতঅর্থে কোনো শিল্পকলা? শিল্পকলাটাকে আমরা কতটা বুঝি, সেটার ওপরই নির্ভর করে এই প্রশ্নের উত্তর। অতীতের ধারণা থেকে যদি বের হয়ে আসা যায়, তাহলে শিল্পকলার সঙ্গে ফুটবলের তেমন কোনো দূরত্ব নেই বললেই চলে। এ কারণে ফুটবল খেলাকে এখন শিল্পকলা হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। গত শতাব্দীতে শিল্পকলা সম্পর্কে ধারণা অনেকটাই বদলে গেছে। যে কারণে সহজাতভাবে ফুটবল হয়ে ওঠছে সক্রিয় ও প্রাণোচ্ছ্বল শিল্পকলা। একটি ব্যাপারে কিন্তু দার্শনিকরা একমত, মানুষের তৈরি, সংগঠিত ও স্থাপিত যে কোনো বিষয়ই শিল্পকলা। এই মানদ- তো ফুটবলে পুরোপুরিভাবে মিলে যায়। একটি স্কেচ যখন আঁকা হয়, একটি ভাস্বর্য যখন গড়ে তোলা হয়, একটি গান যখন গাওয়া হয় কিংবা একজন লেখক যখন সাহিত্যকর্ম রচনা করেন, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে সবার মনোযোগ আকর্ষণ এবং অভিভূত করা। তেমনিভাবে একটি ফুটবল ম্যাচ দেখার সময় তাঁর কুশলতা, উত্তেজনা ও প্রবাহমানতা দর্শকদের অনায়াসেই আকৃষ্ট করে। আর এ কারণেই দুনিয়া কাঁপানো ফুটবলার মেসিকে এখন শিল্পী মনে করা হয়। সেটা তাঁর জীবিকার কারণে নয়, তাঁকে শিল্পী মনে করা হয় তাঁর চমকপ্রদ ক্রীড়াকৌশলের কারণে। তিনি বলকে নিয়ে যেভাবে ভেল্কি দেখান, তাতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে নান্দনিক সৌন্দর্য। পতুর্গালের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো কিংবা ব্রাজিলের নেইমারের পায়েও দেখা যায় শিল্পের ঝলক। গ্রীসের দার্শনিক প্ল্যাটো এবং জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট শিল্পকলাকে ‘টার্মস অব রিপ্রেজেনটেশন’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। প্রতিনিধিত্বশীলতার প্রশ্ন যদি আসে, তাহলে ফুটবল নিঃসন্দেহে যথার্থই একটি শিল্পকলা। থিয়েটারের সঙ্গে ফুটবল খেলার অত্যন্ত সদৃশ রয়েছে। উভয়কে নির্ধারিত স্থান ও নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ‘পারফরমড’ করতে হয়। তাতে আছে বিভিন্ন চরিত্র। নাটকের মতো খেলার মাঠেরও প্রতিটি মুহূর্তও চরম নাটকীয়তা ও উত্তেজনায় ঠাসবুনোট। শেষ পরিণতি কেউ বলতে পারে না। নাটক ও খেলার মাঠে শেষ হাসিটি কে হাসবে, সেটা জানার জন্য একরাশ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন দর্শকরা। তবে নাটকের শেষ অঙ্কটা নাটক সংশ্লিষ্ট সকলের জানা থাকলেও খেলার মাঠের শেষ অঙ্কটা কারোই জানা থাকে না। এটাই ফুটবলের আলাদা আকর্ষণ ও সৌন্দর্য।
ফুটবলে সৌন্দর্যের বিষয়টি উত্থাপিত হলে সবার আগে যে নামটি আসে, সেটি হলো ফুটবলের দেশ ব্রাজিল। ‘জোগো বোনিতো’ বললে বোঝায় ‘দ্য বিউটিফুল গেম’। এই শব্দটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে ফুটবলের কিংবদন্তি সুন্দর ফুটবলের শিল্পী পেলের কল্যাণে। আর এই শব্দটি এমনি এমনি আলোচিত হয়নি। এর কারণ, স্বভাগতভাবে ব্রাজিলীয়রা সুন্দর ফুটবলের অনুরাগী। কসরত করে ফুটবলটাকে কোনো রকমে জালে জড়ানোটা অধিকাংশ ব্রাজিলীয় সমঝদারদের মনঃপুত নয়। তাঁরা মনে করেন, এর আছে সুউচ্চ নিশানা, আছে নান্দনিক মাত্রা। এটি কেবল একটি খেলা নয়, এটি একটি শিল্পকর্ম। এর ব্যত্যয় হলে হারিয়ে যায় ফুটবলের শিল্প ও সৌন্দর্য। এমন ফুটবল ব্রাজিলীয় ফুটবল অনুরাগীদের কাছে মোটেও কাঙ্খিত নয়। দল হারলেও তাঁরা ‘জোগো বোনিতো’কে হারাতে রাজী নয়। একটি বিষয় হিসেবে ফুটবল স্পর্শ করে জাতীয়তাবাদ, পরিচয়, বিশ্বায়ন ও জনসম্পৃত্ততাকে। সেইসাথে বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে দর্শকরা ভাগ করে নেয় অভিন্ন মানবিক অভিজ্ঞতা। ব্রাজিলে ফুটবলটা ধর্মের মতো। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে ব্রাজিলে ফুটবলের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে ক্যাথলিক চার্চ। ফুুটবলের নৈবেদ্য হিসেবে তাঁরা বেছে নিয়েছে তাঁদের আনন্দময় জীবনের প্রধান অবলম্বন সাম্বা নাচকে। সুন্দর ফুটবল আর সাম্বা নাচ ব্রাজিলীয় সংস্কৃতির যুগল নিদর্শন। ফুটবল দেবতাকে তাঁরা সন্তুষ্ট করতে চায় সাম্বা নাচের মাধ্যমে। ব্রাজিল দলের খেলা চলাকালে সাম্বা নাচের দোলায় উদ্বেল হয়ে ওঠে স্টেডিয়াম, স্টেডিয়ামের পরিপার্শ্ব, পুরো দেশ এবং এমনকি দুনিয়ার যে প্রান্তে ব্রাজিলীয়দের বসবাস, সেখানেও। অবশ্য সুন্দর ফুটবলের জয়জয়কার শুধু ব্রাজিলেই সীমাবদ্ধ নয়। লাতিন ঘরানার অন্য দেশগুলোও সুন্দর ফুটবলের পূজারী। আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, কলম্বিয়া, চিলি, ইকুয়েডর, ভেনেজুয়েলা, পেরু, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়ার মতো দেশগুলোও সুন্দর ফুটবলের মহিমায় সমুজ্জ্বল। এই দলগুলোর খেলায়ও বিচ্ছুরিত হয় সুন্দর ফুটবলের আলো। আফ্রিকার আলজেরিয়া, আইভরি কোষ্ট, ঘানা, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, সেনেগালের মতো দেশের ফুটবলাররা মূলত কৃষ্ণাঙ্গ হলেও তাঁদের পায়ের জাদুতে লুকিয়ে থাকে সৌন্দর্যের আভা। ইউরোপীয় দলগুলো রক্ষণাত্মক ও পাওয়ার ফুটবলের অনুরাগী হলেও স্পেন, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্সের মতো দেশগুলোও কিন্তু উপাসনা করে সুন্দর ফুটবলের।
তবে ব্রাজিল নামক দেশটি যেভাবে সুন্দর ফুটবলে নিজেদের সমর্পিত করেছে, তেমনটি আর কোথাও দেখা যায় না। ফুটবল যেন তাঁদের জীবনের জীয়নকাঠি। ফুটবলে ছোঁয়ায় জেগে ওঠে ব্রাজিলের ঘুমন্ত রাজকন্যা। আর এবার বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক ব্রাজিল। সঙ্গত কারণে ফুটবলপ্রেমীদের প্রত্যাশা আকাশ ছুঁয়েছে। এমনিতেই এই দেশটিতে উৎসবের কোনো কমতি নেই। আর তাতে অবধারিতভাবে থাকে সাম্বা নাচ। স্বাগতিক দেশ হওয়ার কারণে শিহরন জাগানো সাম্বা নাচ, মন দুলানো উৎসব আর সুন্দর ফুটবলের ককটেলে ব্রাজিল হয়ে ওঠবে শিল্প, সৌন্দর্য আর আনন্দের পাদপীঠ। তাতে বোধকরি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠবে সুন্দর ফুটবল কিংবা ফুটবলের সৌন্দর্য।
রচনাকাল : ৫ জুন ২০১৪


dulalmahmud@yahoo.com    

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ