স্বাগতিক ব্রাজিল, ফেলপস আর বোল্টের কথা / দুলাল মাহমুদ



লাতিন আমেরিকায় অলিম্পিক গেমস! শুরুতেই বেশ হোঁচট খেতে হয়। হওয়ারই কথা। অলিম্পিকের ১২০ বছরের ইতিহাসে এরআগে এমনটি দেখা যায় নি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা লাতিন আমেরিকায় আয়োজন সম্ভব, সেটা যেন কারও ধারণায় ছিল না। কখনও যদি আয়োজিত না হয়, তাহলে ধারণা হবে কী করে? সেই ধারণা এবার পাল্টে দিয়েছে সুর, ছন্দ ও সৌন্দর্যের দেশ ব্রাজিল। এবারই প্রথম লাতিন কোনো দেশে আয়োজিত হচ্ছে বহুমুখী এই ক্রীড়া ইভেন্ট। যে দেশটির পরিচয় ফুটবল আর সাম্বা নাচ দিয়ে, যার পরশে উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে পুরো দেশ। শুধু দেশ বলি কেন, ব্রাজিলের ফুটবল ও সাম্বায় নেচে ওঠে তাবৎ দুনিয়ার হৃদয়। বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালে এই বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ব্রাজিলের হলুদ পতাকা যেভাবে বিশ্ববরেণ্য ডাচ চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ফন গঁগের সূর্যমুখী ফুল বা গমক্ষেত হয়ে দুলতে থাকে, তার কোনো তুলনা হয় না। অথচ এই দেশটিতেই ঘাপটি মেরে আছে অদ্ভুত এক আঁধার, কিন্তু সেই আঁধারকে তুড়ি মেরে ফুটবলের দেশ হিসেবে আলোকিত করে চলেছে ব্রাজিল। ক্রীড়া বিশ্বেও দেখিয়ে চলেছে একটির পর একটি বিস্ময়। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করা নিয়ে দেশটি বিভক্ত হয়ে পড়ে। এটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে কিনা তা নিয়ে একটা সংশয় সৃষ্টি হয়। সেই সংশয় যে দূর হয়েছে, সেটা এখন আর লেখার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তারপরও সেই ধাক্কা সামাল দিতে পারেন নি বিশ্বকাপ ফুটবলের সফল আয়োজক দেশের প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ। কিছু দিন আগে তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো বড় একটি আয়োজনের রেশ কাটতেই না কাটতে ফের আরেকটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। এটি ব্রাজিলের মতো একটি দেশের জন্য মস্ত একটি চ্যালেঞ্জ। বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজনকে হালকাভাবে না নিয়েও বলা যায়, অলিম্পিক গেমস বিশাল এক মহাযজ্ঞ। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এই গেমস আয়োজন চাট্টিখানি কথা নয়। ব্রাজিলের অর্থনৈতিক অবস্থাকে মোটেও সাবলীল বলা যাবে না। ঘনবসতিপূর্ণ শহর রিও ডি জেনিরোতে চলছে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা। রাজনৈতিকভাবেও দেশটি মোটেও সুস্থির নয়। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম এই দেশটি। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আছে জিকা ভাইরাস। এ কারণে অনেক ক্রীড়াবিদ ব্রাজিলে পা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সব মিলিয়ে আয়োজকদের হ-য-ব-র-ল পাকিয়ে ফেলার কথা। কিন্তু ক্রীড়ানুরাগী জাতি হিসেবে ব্রাজিল কোনো সমস্যাকে একদমই পাত্তা দিচ্ছে না। সব আশঙ্কাকে দূরে ঠেলে দিয়ে অলিম্পিক গেমস সফল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। খেলাধুলার প্রতি ব্রাজিলের এই নিবেদন বিস্ময় না জাগিয়ে পারে না।

দুই.
অলিম্পিক গেমসের ইতিহাসে আছেন অসংখ্য কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ। ফিনল্যান্ডের পাভো নুরমি, যুক্তরাস্ট্রের অ্যাথলেট জেসি ওয়েন্স, চেকশ্লোভাকিয়ার অ্যাথলেট এমিল জাটোপেক, ইথিওপিয়ার আবেবে বিকিলা, ভেঙে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের জিমন্যাস্ট লারিসা ল্যাটিনা, যুক্তরাস্ট্রের সাঁতারু মার্ক স্পিজ প্রমুখ হলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এঁরা এমন সব কীর্তি গড়েছেন, এমন সব কাহিনীর জন্ম দিয়েছেন, যা আমাদের যুগের পর যুগ উদ্বেলিত করে আসছে। অনেক সময় আক্ষেপ হতো, আমাদের সময়ে কেন তাঁদের মতো কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ পেলাম না? অবশ্য যুক্তরাস্ট্রের অ্যাথলেট কার্ল লুইস, রুমানিয়ার জিমন্যাস্ট নাদিয়া কোমানিচির মতো বিস্ময়কর প্রতিভার শেষ বেলার ঝলক আমরা দেখতে পেয়েছি। (দেখতে পাওয়ার অর্থ কাছাকাছি গিয়ে তাঁদের পারফরম্যান্স দেখা নয়। একই গ্রহের সমসাময়িক বাসিন্দা হিসেবে দূর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন খোঁজ-খবর যেভাবে পেয়ে থাকি, সেটাকে বোঝানো হয়েছে।) তবে সব আক্ষেপ অনেকটাই দূর করে দিয়েছেন যুক্তরাস্ট্্েরর সাঁতারু মাইকেল ফেলপস। তাঁর মাপের ক্রীড়াবিদ কি এই গ্রহ দেখেছে? বিস্ময়কর এই ক্রীড়াবিদ এমন কীর্তি গড়েছেন, এমন নজির স্থাপন করেছেন, যা আলোড়িত করবে আগামী দিনের প্রজন্মকেও। তিনি হয়ে থাকবেন রূপকথার নায়ক। ২০০৪ সালে অ্যাথেন্স, ২০০৮ সালের বেইজিং ও ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকে ১৮টি স্বর্ণ, ২টি রৌপ্য ও ২টি ব্রোঞ্জ সহ ২২টি পদক জয় করে এগিয়ে চলেছেন অমরত্বের পথে। এক জীবনে এতগুলো অলিম্পিক পদক, এরচেয়ে বিস্ময় আর কী হতে পারে? এরআগে ১৮টি তো দূরের কথা দ্বিতীয় স্থানে থাকা সোভিয়েত ইউনিয়নের জিমন্যাস্ট লারিসা লাটিনিনা, ফিনল্যান্ডের অ্যাথলেট পাভো নুরমি, যুক্তরাস্ট্রের সাঁতারু মার্ক স্পিৎজ, যুক্তরাস্ট্রের অ্যাথলেট কার্ল লুইস জিতেছেন ৯টি করে স্বর্ণ পদক। ব্যক্তিগতভাবে সর্বাধিক পদক প্রাপ্তির দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের জিমন্যাস্ট লারিসা লাটিনিনা। ৯টি স্বর্ণ ছাড়াও ৫টি রৌপ্য ও ৪টি ব্রোঞ্জ নিয়ে তাঁর মোট পদক সংখ্যা ১৮। ‘ফ্লাইং ফিশ’ মাইকেল ফেলপস এখনও থেমে যান নি। এবারের অলিম্পিকে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামবেন এই বিস্ময়মানব। কোথায় পৌঁছাবেন তিনি- কে জানে? খুব সহসা তাঁকে অতিক্রম করতে পারবেন, এমন কোনো ক্রীড়াবিদকে দেখা যাচ্ছে না। আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমাদের সময়ে জন্মেছেন মাইকেল ফেলপসের মতো বিরল জাতের একজন ক্রীড়াবিদ।
তিন.
আমাদের সময়ের আরেক বিস্ময় জ্যামাইকান অ্যাথলেট উসাইন বোল্ট। ফিনল্যান্ডের পাভো নুরমি, যুক্তরাস্ট্রের কার্ল লুইস, রে ইউরি মতো অ্যাথলেটরা অলিম্পিক স্বর্ণ পদক জয়ের দিক দিয়ে তাঁর চেয়ে এগিয়ে আছেন। নিজেদের সময়ই তো বটে, এখনও সর্বকালের সেরা অ্যাথলেট হিসেবে তাঁদের নাম বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও নিজেকে অন্য মাপের অ্যাথলেট হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন ‘লাইটিং বোল্ট’। অলিম্পিক গেমসে কত খেলা, কত ইভেন্ট। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও আলোচিত ইভেন্ট ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। এই ইভেন্টে প্রথম হওয়ার অর্থ এ গ্রহের সবচেয়ে দ্রুততম মানব হওয়া। এরসঙ্গে অন্য কোনো ইভেন্টের তুলনা চলে না। আর এই ইভেন্টের রাজাধিরাজ বলা যেতে পারে বোল্টকে। যুক্তরাস্ট্রের জিম হাইনস ১৯৬৮ সালে মেক্সিকো অলিম্পিকে সমুদ্রপৃষ্ট থেকে উঁচুতে প্রথম ১০ সেকেন্ডের নিচে (৯ দশমিক ৯৫ সেকেন্ড) এবং তাঁরই স্বদেশি কার্ল লুইস ১৯৮৩ সালে সমুদ্রপৃষ্ট থেকে নিচুতে ৯ দশমিক ৯৭ সেকেন্ডে যখন দৌড়ান, তখন পুরো পৃথিবী অবাক হয়ে যায়। কিন্তু বোল্ট ২০০৯ সালে বার্লিনে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে সেটাকে নামিয়ে আনেন ৯ দশমিক ৫৮ সেকেন্ডে। এরচেয়ে কম সময়ে দৌঁড়ানো কি সম্ভব? প্রথম স্প্রিন্টার হিসেবে একইসঙ্গে ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন তিনি। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে ১০০, ২০০ ও ৪ গুণন ১০০ মিটার স্প্রিন্টে বিশ্ব ও অলিম্পিক রেকর্ড সহ স্বর্ণ পদক এবং ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকেও এই তিনটি ইভেন্টে স্বর্ণ পদক জয় করেন। প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে পর পর দুই অলিম্পিকে ‘ডাবল ডাবল’ এবং ‘ডাবল ত্রিপল’ জয়ের গৌরব অর্জন করেন। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি যেভাবে ব’লে-ক’য়ে একটির পর একটি মাইলফলক গড়েন, তাতে করে তাঁকে এ গ্রহের মনে হয় না। যেন এটি করা কঠিন কিছু নয়। তিনি চাইলেই তা অনায়াসেই করতে পারেন। এ কারণেই তিনি নিজেকে ‘লিজেন্ড ও জীবিতদের মধ্যে গ্রেটেস্ট অ্যাথলেট’ হিসেবে ঘোষণা দিতে পারেন। তাঁর বর্ণিল উদযাপন ও প্রাণোচ্ছ্বল জীবনযাত্রা অন্য সব অ্যাথলেটদের থেকে একদম আলাদা। এবারের অলিম্পিকেও উসাইন বোল্ট নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখছেন। বলে রাখা ভালো, সর্বকালের এই দ্রুততম মানবের স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের দূরত্ব খুব একটা থাকে না।
দেখা যাক, ব্রাজিল অলিম্পিক গেমস আমাদের জন্য কি পসরা সাজিয়ে রেখেছে।            

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

বাঙালির ফুটবল আবেগ / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

আমাদের ‘অলিম্পিক গেমস’ / দুলাল মাহমুদ

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন : পেছন ফিরে দেখা/ দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

পেলে-ম্যারাডোনাকে দেখিনি, দেখবো মেসিকে/ দুলাল মাহমুদ

ধবল জোছনার দিনগুলো / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

আগ্রাসী মানসিকতাই জার্মানদের চাবিকাঠি / দুলাল মাহমুদ

গোল করাই ছিল সেন্টার ফরোয়ার্ড শওকতের নেশা/ দুলাল মাহমুদ

কমলা রঙের উৎসবের অপেক্ষায় / দুলাল মাহমুদ