হুট করে এভাবে চলে গেলেন রণজিত দা!


তাঁর লেখার যে ভঙ্গি, শৈলী ও সৌন্দর্য, তাতে করে তাঁর লেখনির প্রতি যে কেউই আকৃষ্ট না হয়ে পারবেন না। সব ধরনেরই লেখাই তিনি দু হাতে লিখতেন। তবে ক্রীড়ালেখক হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত ছিলেন। জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি কাটিয়েছেন ক্রীড়ালেখনির সাম্পানে। ক্রীড়ালেখনির ক্ষেত্রে তিনি স্বতন্ত্র একটি ধারা ও মেজাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। বাংলা ভাষায় তাঁর দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল বিস্ময়কর। বাবুই পাখির বাসার মতো নিপুণ ও শৈল্পিক দক্ষতায় যেভাবে শব্দের জাল বুনতেন, তার কোনো তুলনা হয় না। তবে ক্রিকেটের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম দরদ ও ভালোবাসা। তাঁর লেখায় পাওয়া যেত ক্রিকেট সাহিত্যের রূপ-রস-গন্ধ। সঙ্গত কারণেই তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের আগেই তাঁর লেখার মুগ্ধ পাঠক হয়ে যাই। আর পরিচয় হওয়ার পর সেই মুগ্ধতা ক্রমাগত বেড়েই চলে। লেখার মতোই কথপোকথনেও তিনি ছিলেন অন্তরঙ্গ, সাবলীল ও স্মার্ট। তাঁকে কথার জাদুকর বললে ভুল বলা হবে না। তাঁর বিশুদ্ধ উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি ও বলার স্টাইল ছিল অসাধারণ। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় মনে হতো, যেন বেতার বা টেলিভিশনে তাঁর কথা শুনছি। রণজিৎ কুমার বিশ্বাস চট্টগ্রামের সন্তান হলেও তাঁর কথায় বিন্দুমাত্র আঞ্চলিকতার টান ছিল না। তাঁর ব্যবহারে আলাদা একটা মাধুর্য ছিল। অত্যন্ত আন্তরিক, মার্জিত, রুচিবান ও পরিশীলিত মানুষ ছিলেন। পরিচিত সবার সঙ্গে বিনীত ও অমায়িকভাবে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলে কারো পক্ষেই তাঁকে ভুলে যাওয়া সহজ ছিল না। 
১৯৮৫ সালে চট্টগ্রামে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতা কাভার করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। আমরা যাঁরা ঢাকা থেকে গিয়েছিলাম, তাঁদের সন্মানে সম্ভবত চট্টগ্রাম আবাহনীর একজন কর্মকর্তা স্থানীয় একটি রেঁস্তোরায় সম্মাননার আয়োজন করেন। সেই অনুষ্ঠানে রণজিৎ কুমার বিশ্বাস সহ চট্টগ্রামের নেতৃস্থানীয় ক্রীড়ালেখক ও ক্রীড়া সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই যে তাঁর সঙ্গে পরিচয়, একইসঙ্গে তিনি হয়ে ওঠেন রণজিৎ দা, সেই পরিচয়, সেই সম্বোধন শেষ অব্দি অটুট ছিল। তিনি ঢাকা চলে আসার পর তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ আরো নিবিড় ও ঘনিষ্ট হয়। বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির ব্যানারে আমরা একে অপরের অনেক কাছাকাছি হই। সমিতির প্রকাশিত স্মরণিকার জন্য লেখা কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে তাঁর পরামর্শ নিয়েছি। সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভা বা যে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি যখন বক্তব্য রাখতেন, তা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। তাঁর বক্তব্য বা পরামর্শ আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। ক্রীড়াজগত পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায়শই ফোন করতেন। লেখা পাঠাতেন। সঙ্গে টুকরো টুকরো চিঠি। তাঁর লেখা পেলে সঙ্গত কারণেই বর্তে যেতাম। তাঁর লেখা পাওয়া মানেই হলো পত্রিকার গুরুত্ব অনেকখানি বেড়ে যাওয়া। তাঁর হাতের লেখা ছিল চমৎকার। চোখ জুড়িয়ে যেত। তিনি হাতে লিখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এই সেদিনও তাঁর হাতের লেখা নিবন্ধ পেয়েছি। অধিকাংশ সময়ই তিনি লেখা পাঠাতেন ডাকে। যদিও মাঝে অনেক বেশি ব্যস্ততার কারণে লেখা দিতে পারতেন না। কিন্তু চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর সবে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় ফের লেখা পাঠাতে শুরু করেছিলেন। আমিও ভীষণ খুশি হয়ে ওঠেছিলাম। যাক, এখন থেকে তাঁর লেখা নিয়মিত পাওয়া যাবে। হায়! খুশিটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না।  
রণজিৎ কুমার বিশ্বাস ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ। দায়িত্বশীল চাকরি করতেন। সরকারের সিনিয়র সচিব ছিলেন। সর্বশেষ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। এই দায়িত্বটা ছিল একে অপরের পরিপূরক। তাঁর স্পর্শে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যেমন পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে, তেমনিভাবে তিনিও নিজেকে মেলে ধরার বড় ধরনের একটা প্ল্যাটফরম পেয়ে যান। ক্রীড়ালেখক রণজিৎ কুমার বিশ্বাস হয়ে ওঠেন একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। বছর খানেক আগে চাকরি থেকে তিনি অবসর নেন। অবসর নিলেও সাংস্কৃতিক পরিম-ল তাঁকে আপন করে নেয়। যে কারণে ইদানিং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর ব্যস্ততা অনেক বেড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তাঁর আত্মার খোরাক। এটা তাঁর কথায় ও লেখায় সহজেই অনুধাবন করা যেত। এই তো কিছু দিন আগে রবীন্দ্র সংগীতের বরেণ্য শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সুরের সঙ্গে তাঁর কথার জাদুর যুগল অনুষ্ঠানে বিমোহিত হয়েছিলেন শ্রোতারা। আবৃত্তি অনুষ্ঠানেও তিনি ছিলেন সবার প্রিয়মুখ। টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে নিয়মিত দেখা যেত। তবে তাঁর প্রধান গুন ছিল, যে কোনো অবস্থায় লিখতে পারতেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকেও লিখতেন। লেখাটা ছিল তাঁর নেশা। বছর দুয়েক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। অনেকটা জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে আসেন তিনি। সেই সময়ে একটু সুস্থ হতেই হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন। লেখাটাই ছিল তাঁর বেঁচে থাকার প্রধান রসদ। ক্রীড়ালেখক হলেও ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা ছিলেন তিনি। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি যখন মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে জীবনটাকে উপভোগ করছিলেন, লেখালেখির জগতে তিনি যখন নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছিলেন, তখনই তিনি চলে গেলেন। তাঁর হুট করে এভাবে চলে যাওয়াটা মন একদমই মেনে নিতে পারছে না। তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখচ্ছবি এখনও চোখের সামনে দেদীপ্যমান। মনে হয়, তিনি যেন আশে-পাশে কোথাও আছেন। 
২৩ জুন ২০১৬

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়’ / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব

অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব-২

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও-২

নেইমারকে নিয়ে কেন এই হাহাকার? দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ