‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়’ / দুলাল মাহমুদ




যতই সময় ঘনিয়ে আসছে, ভাবগতিক খুব একটা ভালো লাগছে না। মনের মধ্যে অকারণেই ডানা ঝাপটাচ্ছে অস্থির পাখি। কেন যে এমন হচ্ছে! একদমই বুঝতে পারছি না। প্রত্যাশার চাপ কি সইতে পারছি না? নাকি আত্মবিশ্বাসের খামতি? অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা থেকে ৬ হাজার মাইল দূরত্বে ঢাকায় অবস্থান করে, আমার যদি এমনটি হয়, আর যারা মাঠে খেলবেন, তাদের মনের অবস্থা কী? বুকের মধ্যে নিশ্চয়ই টগবগিয়ে ফুটছে আগুনের লেলিহান শিখা। অবশ্য আমার বিশ্বাস, আমাদের আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী ক্রিকেটাররা যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুত। ক্রিকেটারদের মতো যদি আমার সাহস থাকতো, তাহলে তো কোনো কথাই ছিল না। সেই সাহস, সেই আত্মবিশ্বাস নেই বলেই তো আমার মতো দুর্বল মনের মানুষ মানসিক চাপ কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তবে ভরসা এই যে, মেঘ দেখে যে ঝড়ের আশঙ্কা করে, তার কথা গুরুত্ব না দিলেই হয়। কী বলেন? আসলে নানান সমীকরণ করতে গিয়ে কোনো তাল পাচ্ছি না। কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব হিসেব-নিকেশ। কোনো হিসেবেই মিলাতে পারছি না। অবশ্য মিলবে কীভাবে? খেলা তো আর অঙ্ক নয় যে দুই দুইয়ে চার হবে। আর ক্রিকেট তো গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। অন্তত ক্রিকেটে আগাম কিছু বলা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। লিখে দিলেই হয়, জিততে পারে কিংবা নাও জিততে পারে। তাহলে আর কোনো সংশয় বা দুশ্চিন্তা থাকে না। অন্য কোনো ম্যাচ হলে এমন ধরি মাছ, না ছুঁই পানি গোছের মন্তব্য করাই যেত। কিন্তু নিজের দেশ যখন খেলবে, তখন মনের মধ্যে উড়ে বেড়ায় কত রঙ-বেরঙের মেঘ। কোনোটা খেয়ালি। কোনোটা বেখেয়ালি। তাকে তো আর ইচ্ছের নাটাই দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। অতীতেও বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে বরাবরই তো এমন দ্বিধা-দ্বন্ধ ছিল। সেটা এমন কিছু মনে হয়নি। না হওয়ার কারণ কি বড় কোনো প্রত্যাশা ছিল না? ছিল তো বটেই। তারপরও এবার কেন যেন অনেক বেশি চাপ চাপ লাগছে। খুব বেশি কি প্রত্যাশা করছি? যেখানে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়ার্টার-ফাইনালে খেলার স্বপ্নে বিভোর পুরো জাতি, আর আমি সেখানে প্রথম ম্যাচের আগেই মন খারাপ করার মতো প্যাঁচাল পাড়ছি।
আসলে ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে তো ডরাবেই। যে আয়ারল্যান্ডকে স্কটল্যান্ডের মতো দল পাত্তাই দেয়নি, প্রস্তুতি ম্যাচে হারিয়েছে ১৭৯ রানে, সেই আইরিশদের কাছে বাংলাদেশ হেরেছে ৪ উইকেটে। প্রস্তুতি ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং বিশ্বকাপের খেলায় স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ‘ব্রেভহার্ট’ স্কটিশরা যে লড়াই করেছে, তাতে তো বুক কাঁপবেই। আর টাইগাররা যে দু’টি দলকে সহজ টার্গেট হিসেবে রেখেছে, তারমধ্যে স্কটল্যান্ড একটি। তাহলে হিসেবটা কেমন গরমিল হয়ে যায় না? হোক না প্রস্তুতি ম্যাচে জয় কিংবা শিরোপা প্রত্যাশীদের বিপক্ষে হার, বুকের মধ্যে তো খচ খচ করবেই। যদিও অতীতে যে তিনবার দেখা হয়েছে, সেই তিনবারই স্কটদের হারিয়েছে বাংলাদেশ। সেই দিন কিন্তু এখন আর নেই। স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত স্কটরা ক্রিকেট মাঠে নতুন ইতিহাস গড়তে চাইলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। স্কটল্যান্ডের সঙ্গে লড়াইটা এখনও ঢের দেরি আছে, সেটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছে আফগানিস্তান। প্রথম এই প্রতিপক্ষকে তো হেলা-ফেলার দল ভাবা যাচ্ছে না। আফগানরা অন্তত পঁচা শামুক নয়। সেটা তো ইতোমধ্যে টের পাওয়া গেছে। বিস্ময়কর হলো, ওয়ান ডে ক্রিকেটে একমাত্র আফগানিস্তানের বিপক্ষে জিততে পারেনি বাংলাদেশ। এশিয়া কাপ ক্রিকেটে দেশের মাটিতে একমাত্র লড়াইয়ে আফগানদের কাছে ৩২ রানে হারার স্মৃতি খুব বেশি দিনের নয়। আফগানদের মধ্যে একটা তেজী ও মরীয়া ভাব আছে। মচকাবে কিন্তু ভাঙ্গবে না। যুগে যুগে দখলদাররা ভূ-বেষ্টিত মালভূমির উপর অবস্থিত এই দেশটিকে দীর্ঘস্থায়ী উপনিবেশ বানাতে চেয়েও পারেনি। তাছাড়া পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিলে-মিশে ক্রিকেট খেলাটা বেশ ভালোই রপ্ত করেছে। দীর্ঘদেহী আফগানরা ক্রিকেট মাঠে দারুণ ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে। জিততে পারুক কিংবা না পারুক, লড়াই করে জীবনবাজি রেখে। ভাবনাটা শুধু আফগানদের নিয়ে নয়, ভাবনাটা নিজেদের নিয়েই বেশি। এর কারণ, প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে বাংলাদেশকে খুব একটা শক্তপোক্ত মনে হয়নি। হেরেছে চারটি ম্যাচেই। অবশ্য এ ক্ষেত্রে উৎসাহ পাওয়া যেতে পারে ভারতের কাছ থেকে। পরাজয়ের মিছিলে থাকা ভারতীয়রা বিশ্বকাপের টনিকে উজ্জীবিত হয়ে যেভাবে পাকিস্তানকে হারালো, সেটা বিস্ময়কর মনে হলো। যদিও একজন বিরাট কোহলি, একজন শিখর ধাওয়ান কিংবা নিদেনপক্ষে একজন সুরেশ রায়না আমাদের নেই। তবে এটাও ঠিক, বাংলাদেশের যে কেউ যে কোনো দিন কোহলি, ধাওয়ান কিংবা রায়না হওয়ার সামর্থ্য রাখেন। সেটা আমরা অসংখ্যবার দেখেছি। কিন্তু দুশ্চিন্তার কারণ হলো, ধারাবাহিকতার বড্ড অভাব। এ কারণে আমরা বেশি দূর যেতে পারছি না। আইসিসির সহযোগী সদস্য আফগানদের বিপক্ষে জয়ে কোনো বীরত্ব নেই। কিন্তু হারলে বইতে হবে গ্লানিকর যন্ত্রণা। আত্মবিশ্বাস অর্জন করার জন্য শুরুটা ভালো হওয়াই প্রয়োজন। বিশ্বকাপে লক্ষ্য পূরণ করতে হলে এ ম্যাচে জয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গত কারণে চাপটা তাই বাংলাদেশেরই। প্রত্যাশার চাপে ভেঙ্গে পড়তে জুড়ি নেই বাংলাদেশের। আর এ কারণেই বুকজুড়ে ছেয়ে আছে আশঙ্কার কালো মেঘ। তবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো সেই কবেই লিখেছেন, ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’। দেখা যাক, সূর্যটা হাসে কিনা?


dulalmahmud@yahoo.com            

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

এশিয়ানরা কি কেবলই শোভাবর্ধন করবে? দুলাল মাহমুদ