শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত ফুল আর পরাধীনতা-২

যাত্রীরা জিম্মি, ফুটপাত দখল এবং...

এমনিতেই মধ্যবিত্ত ও নিুবিত্তদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। জীবনযাত্রার মান যেভাবে বাড়ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে যেয়ে যেখানে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে চলাফেরা করাটা একটা বড় ধরনের দায় হয়ে উঠেছে। শহরের মানুষের দীর্ঘদিনের চলাচলের বাহন রিকশা। বোধকরি অসংখ্য মানুষের প্রিয় বাহনও। পরিবেশবান্ধব রিকশায় চড়ে যেখানে খুশি, সেখানে অনায়াসে যাওয়া যায়। খুব বেশি ঝঞ্ঝাটও নেই। রিকশায় চড়ার মধ্যে এক ধরনের রোমান্টিকতা জড়িয়ে আছে। মিঠে রোদে বা বৃষ্টিতে রিকশায় চড়ার মজাই আলাদা। বিশেষ করে সদ্য বিবাহিত দম্পতি কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে রিকশার কদরই অন্যরকম। পাকিস্তান আমলে রিকশার প্রচলন হলেও এখন নাগরিক জীবনের সঙ্গে দারুণভাবে জড়িয়ে পড়েছে রিকশা। কিন্তু জনসংখ্যার চাপ, আর্থিক অসচ্ছলতা আর বেআইনিভাবে রিকশার সংখ্যা খুব দ্রুত এত বেড়ে যায় যে, তা নাগরিক বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিদিনের যানজটের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে রিকশা। যে কারণে এরশাদ সরকারের আমল থেকে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে রিকশা চলাচল ক্রমান¦য়ে সীমিত, তারপর বন্ধ করে দেয়া হতে থাকে। বর্তমানে অধিকাংশ রাস্তায় রিকশা চলাচল করতে দেয়া হয় না। একই সঙ্গে পরিবেশ দূষণের কারণে বেবিট্যাক্সি উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রিকশা চলাচল সীমিত ও বেবিট্যাক্সি নিষিদ্ধ করায় রাজধানীবাসীর চলাচলের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এই সংকট দূর করার জন্য নানা রঙের ট্যাক্সি ক্যাব, সিএনজি ও মিশুক চালু করা হয়েছে। কিন্তু জনচাহিদার অনুপাতে তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। সব মিলিয়ে ঢাকা মহানগরে ১৮ হাজার ক্যাব, সিএনজি, অটো ও মিশুক চলাচল করে। এর মধ্যে বেশকিছু যান থাকে চলাচলের অনুপযোগী। ফলে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। একে তো রিকশা ও বেবিট্যাক্সি উঠিয়ে দেয়ায় চলাচলের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে; তদুপরি আগে যেখানে ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকায় যে কোনো এলাকায় যাওয়া যেতো, এখন সেখানে ৩০ টাকার নিচে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। অবশ্য শুরুতে ট্যাক্সি ক্যাবের সার্ভিস ছিল চমৎকার। ফোনে কল করলে কিংবা রাস্তায় থামিয়ে ইচ্ছে অনুসারে নির্ধারিত গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া যেতো। মিটারে যে বিল উঠতো, তাই পরিশোধ করলে চলতো। বাড়তি কোনো অর্থ দিতে হতো না। আর এখন ট্যাক্সি ক্যাব, সিএনজি চালিত ফোর স্ট্রোক অটোরিকশা ও মিশুকে যে কোনো গন্তব্যে যেতে চাওয়াটা স্বপ্ন হয়ে উঠেছে। চালকরা অল্প দূরত্বে যেতে চাওয়া তো দূরের কথা, কোথাও যেতে চাওয়াটা নির্ভর করে তাদের মেজাজ-মর্জি ও নানা শর্তের ওপর। তারপর কোথাও যেতে চাইলে মিটারের সাথে বাড়তি টাকা চাওয়াটা রীতিমত নিয়মে পরিণত হয়েছে। সন্ধ্যার পর তারা কোথাও যেতে চায় না। ট্যাক্সি ক্যাব ও সিএনজি চালকদের বক্তব্য হচ্ছে, প্রতিদিন সিএনজি নিতে তাদের ২/৩ ঘণ্টা লেগে যায়। যে কারণে নির্ধারিত ভাড়ায় তাদের পোষায় না। অথচ ট্যাক্সি ক্যাব সার্ভিস নীতিমালা ১৯৯৮-এর শর্তানুসারে, শুধুমাত্র সংযোজিত মিটারের মাধ্যমে ভাড়ায় ট্যাক্সি ক্যাব চলাচল করবে। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা যাত্রীদের চাওয়া মাত্র চালক দেখাতে বাধ্য থাকবে। নির্ধারিত স্ট্যান্ডে অবস্থানকালে কোনো ক্যাব চালকই প্রকৃত যাত্রী বহনে অস্বীকৃতি জানাতে পারবে না। এসব শর্ত চালকরা মানছে না। প্রতিটি ট্যাক্সি ক্যাবের সঙ্গে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের ফোন নম্বর দেয়া হয়েছে। কোনো ট্যাক্সি ক্যাব কোথাও যেতে না চাইলে, বাড়তি ভাড়া চাইলে কিংবা অন্য কোনো সমস্যার সৃষ্টি করলে যাত্রীরা টেলিফোনে অভিযোগ করলেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে সার্জেন্ট নির্দিষ্ট স্থানে হাজির হবেন। তাছাড়া যাত্রীদের লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা। কিন্তু অধিকাংশ যাত্রীর তাৎক্ষণিকভাবে ফোন করার সুযোগ থাকে না। এছাড়া পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার ঝক্কি-ঝামেলা এবং জরুরি প্রয়োজন থাকলে পুলিশের দ্বারস্থ হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। পুলিশকে ফোন করে সহসা সাড়াও পাওয়া যায় না। সব মিলিয়ে রাজধানী ঢাকায় চলাচল করাটা বিড়ম্বনাময় ও ভোগান্তিকর হয়ে উঠেছে।
একদিকে আর্থিক সংকট, অন্যদিকে পর্যাপ্ত যানবাহন না থাকায় সাধারণ মানুষের জীবনযাপন কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া মধ্যবিত্ত ও নিুবিত্তের অন্যতম অবলম্বন বিআরটিসি বাস দিনে দিনে দুর্লভ হয়ে উঠেছে। এমনিতেই বিআরটিসি বাসের সংখ্যা ক্রমান¦য়ে হ্রাস পাচ্ছে, তারপরও যে ক’টি বাস এখনও চলাচল করে, তা যাতে না চলাচল করতে পারে, সে জন্য নানা রকম কলা-কৌশল ও ফন্দি-ফিকির করা হয়। এমনিতেই সাধারণ মানুষ নানা সমস্যায় জর্জরিত, তার মধ্যে পথচলা অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যানবাহন সংকটের কারণে অপচয় হচ্ছে অর্থ ও সময়ের। আমাদের জনসংখ্যার গরিষ্ঠ অংশ বেকার। এর সাথে যারা বিভিন্ন পেশায় কর্মরত, তাদের বড় অংশই বসবাস করে রাজধানী ঢাকায়। কর্মরত জনসংখ্যার বড় একটি অংশ যানবাহন সমস্যার কারণে সময়মত কর্মস্থলে পৌঁছাতে না পারায় নষ্ট হচ্ছে অসংখ্য শ্রমঘণ্টা। অপচয় হচ্ছে শ্রমমুখী মানব সম্পদের। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। তাছাড়া রিকশা ও বেবিট্যাক্সি উঠিয়ে দিয়েও ট্রাফিক জ্যাম নিরসন করা যায়নি। কেননা, বিপুল জনসংখ্যার এই রাজধানীতে ছোট ছোট যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে নতুন গাড়ি ক্রয়ের সুবিধার্থে নতুন গাড়ির ক্ষেত্রে করভার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করায় প্রাইভেট কারের সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে। এতে করে ট্রাফিক জ্যাম আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে। ছোট ছোট যান চলাচলে নিরুৎসাহিত করে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে একতলা ও দোতলা বাসের সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হলে সাধারণ মানুষের উপকারের পাশাপাশি ট্রাফিক জ্যাম হ্রাস পেতে পারতো। শিল্পোন্নত দেশেও সাধারণ যাত্রী চলাচলের সুবিধার্থে পর্যাপ্তসংখ্যক বাস চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে। বাসগুলো চলাচল করে ঘড়ির কাঁটা মেপে। কিন্তু আমাদের দেশ প্রতিবছরই বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে এবং প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা কাটছাঁট করে বিত্তবানদের জন্য সুবিধার দুয়ার খুলে দেয়া হয়। পরিবহন খাতে সুষ্ঠু কোনো নীতিমালা না থাকায় ঢাকায় হরেক রকম যানবাহন চলাচল করছে এবং এ কারণে ঢাকা পরিণত হয়েছে যানজটের শহরে। বাজেটে পরিবহন খাতে যতই অর্থ বরাদ্দ করা হোক না কেন, সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করা না হলে যান চলাচলের ক্ষেত্রে যে বিশৃ´খল অবস্থা বিরাজ করছে, তা দূর করা যাবে না।
যানজট, অর্থনৈতিক সংকট, স্বাস্থ্য সচেতনতাসহ নানা কারণে সাধারণ মানুষ অন্তত কাছাকাছি দূরত্বের পথ হেঁটে অতিক্রম করতে চায়। কিন্তু ঢাকা শহরে হেঁটে চলাচল করাটা এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ ফুটপাতই বেদখল হয়ে গেছে। এমনিতেই ঢাকায় পর্যাপ্ত রাস্তা নেই। যা রাস্তা আছে, তার সর্বত্র দু’পাশে ফুটপাত নেই। রাজধানীতে প্রতিনিয়ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সে অনুপাতে ফুটপাত নেই বললেই চলে। যে কারণে যানজটের পাশাপাশি এখন মানুষজটও স্বাভাবিক ঘটনা। ঢাকায় এমন কোনো ফুটপাত খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখান দিয়ে খুব সহজে ও স্বাচ্ছন্দ্যে হেঁটে যাওয়া যায়। স্থায়ী দোকান, ভাসমান হকার, গ্যারেজ, ডাস্টবিন ইত্যাদি কারণে ফুটপাত দিয়ে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাছাড়া অধিকাংশ ফুটপাতই ভেঙ্গেচুরে একাকার অবস্থা। একটুখানি অসতর্ক বা অসচেতন হয়ে হাঁটলে দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী। মাঝে মাঝে পুলিশ অ্যাকশনে নেমে গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থানের ফুটপাত খালি করে দিলেও কিছুদিন পর পরিস্থিতি দাঁড়ায় যথা পূর্বং তথা পরম। এমনিতে ঢাকা শহরে পর্যাপ্ত মাঠ, খোলা জায়গা, পার্ক নেই। অথচ দেশে হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিসসহ মারাÍক রোগের রোগীর সংখ্যা ক্রমান¦য়ে বেড়েই চলেছে। যে কোনো হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগীদের লাইন লেগেই থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীদের পথ্য দেয়ার পাশাপাশি চিকিৎসকদের পরামর্শ হচ্ছে : প্রতিদিনই কিছু সময়ের জন্য হাঁটুন। কিন্তু হাঁটার মতো জায়গা কোথায়? রমনা পার্ক, সংসদ ভবন, ধানমন্ডি লেকে সকালে বা বিকালে মানুষের ভিড় লেগে যায়। তাছাড়া সবার পক্ষে নির্ধারিত সময়ে হাঁটার অবকাশ হয় না। এ জন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে অথবা কাছাকাছি কোথাও যেতে হলে হেঁটে হেঁটে প্রয়োজনটুকু সারা হয়, একই সঙ্গে হাঁটার কাজটুকুও হয়ে যায়। এ রকম লোকের সংখ্যাই বেশি। শারীরিক এক্সারসাইজের জন্য সাঁতার ও সাইকেল চালানো চমৎকার ব্যায়াম। কিন্তু ঢাকা শহরে সাঁতার কাটার কোনো ব্যবস্থা নেই। পাঁচ তারকা হোটেল কিংবা অভিজাত পাড়ায় যেসব সুইমিংপুল আছে, সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য খুবই কম লোকের আছে। এছাড়া ঢাকা শহরে সাইকেল চালানো অনেকটা নিজের জীবনকে মৃত্যুর হাতে সঁপে দেয়ার শামিল। ব্যস্ত নগরী যানজটের ভিড়ে সাইকেল চালানোর সুযোগ কোথায়? যে জন্য রাজধানী ঢাকায় সাইকেল এখন দুর্লভ হয়ে উঠেছে। এসব সমস্যার কারণে হাঁটাহাঁটি করাটা যেখানে শরীর সুস্থ ও শারীরিক ফিটনেস বজায় রাখার একমাত্র ভরসা, সেটাও এখন মেনে চলা কঠিন হয়ে পড়েছে।
নানা প্রতিকূলতাকে ডিঙ্গিয়ে শীতকালে যা হোক কিছুটা হলেও হাঁটাহাঁটি বা পদচারণা করা যায়। কিন্তু বর্ষাকালে অবস্থা দাঁড়ায় ভয়াবহ। একটুখানি বৃষ্টি হলেই রাজধানীর নিচু এলাকা ডুবে যায়। আর ভারি বর্ষণ হলে তো কথাই নেই। কি অভিজাত, কি বাণিজ্যিক, কি আবাসিকÑ সব এলাকায় থৈ থৈ করে পানি। নগরীর পথঘাট, অলি-গলিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এমনিতে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট ভাঙ্গা-চোরা ও খানা-খন্দকে পরিপূর্ণ। যানবাহনে চলাচল করাই ঝুঁকিপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে পদব্রজে চলাচল করা একদম অসম্ভব হয়ে পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে কিংবা নিজের তাগিদে হাঁটাহাঁটি যাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, তাদের জন্য বর্ষাকালটা একটা অভিশাপ হয়ে নেমে আসে।
দৈনিক সংবাদ : ২৫ জুন ২০০৩


আমাদের শৈশবের দুই কিংবদন্তী

একই দিনে চলে গেলেন আমাদের শৈশবের দুই কিংবদন্তীÑ রোমেনা আফাজ এবং গ্রেগরি পেক। যদিও দু’জনে দুই ভিন্ন ঘরানা এবং দুই প্রান্তের বাসিন্দা। রোমেনা আফাজের রহস্য সিরিজ ‘দস্যু বনহুর’ আর গ্রেগরি পেক-এর দুর্দান্ত অভিনয় আমাদেরকে শৈশব-কৈশোরকে বুঁদ করে রেখেছিল। চকিতে মনের পর্যায় ভেসে ওঠে ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের সেসব অমলিন স্মৃতি। চটপটি, ঝালমুড়ি ও সস্তার আইসক্রিমের সঙ্গে ‘দস্যু বনহুর’ আর হলিউডি ছবি ছিল আমাদের কৈশোরের দুর্বার আকর্ষণ। জন্মের পর থেকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সেই যে ওতপ্রোত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তার পলে পলে জড়িয়ে আছে কত না অম্ল-মধুর স্মৃতি। শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনা, খেলাধুলা, বই পড়া, নাটক, সিনেমা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নানা রকম ভেল্কিবাজিসহ এ শহরের বেড়ে ওঠার বাঁকে বাঁকে আমাদের দেহ-মনে ছাপ ফেলে যায় কত না দৃশ্যপট। আমাদের প্রজন্মে, নানাজনের নানা রকম ঝোঁক ছিল। তবে বই পড়ার প্রতি সবারই ছিল অন্যরকম আকর্ষণ। বিশেষ করে, পাঠ্যবই বাদ দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে গল্প, উপন্যাস ও রহস্য সিরিজের বই সে বয়সে কী যে টানতো, তা বলে বোঝানো যাবে না! প্রাথমিক স্কুলের গ-ি অতিক্রম করার পর রোমেনা আফাজের রহস্য সিরিজ ‘দস্যু বনহুর’ আমাদের বয়সী বালকরা গোগ্রাসে গিলতাম। ‘দস্যু বনহুর’ ছিল আমাদের স্বপ্ন, কল্পনার নায়ক। যে কোনো বিপদে-আপদে তিনি ঝড়ের বেগে ঘোড়ায় চড়ে এসে হাজির হতেন। যেন অদৃশ্য মানব! রাতের আঁধারে কালো ড্রেসে তার চলাফেরা পাঠক-হৃদয়ে শিহরণ জাগাতো। প্রতিটি বইয়ের শেষটুকু এমনভাবে লেখা হতো, যাতে পরবর্তী বইটি না পড়ে উপায় থাকতো না। প্রতিটি বই এক নিঃশ্বাসে শেষ করার পর পরবর্তী বইটির জন্য আমাদের কী অন্তহীন প্রতীক্ষা! কার আগে কে পড়বো, তা নিয়ে একটা নীরব প্রতিদ্বন্দি¡তা চলতো। সে বয়সে ঢাকার শের-এ-বাংলা নগরের বাসিন্দা হিসেবে ওই এলাকাই ছিল আমার বা আমাদের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। শের-এ-বাংলা নগরের গ-ির বাইরে যাওয়ার কথা ভাবলেই আমাদের কেঁপে উঠতো বুক। অথচ ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজের বই পড়ার জন্য আমাদের ছিল কী দুঃসাহসিক অভিযাত্রা! ফার্মগেটের বুকস্টল থেকে নতুন ও আনকোরা বই সংগ্রহ করার জন্য কি ঝড়, কি বৃষ্টিতে সাইকেল চালিয়ে উল্কাবেগে বেপরোয়া ছুটতাম। কোনো ভয়-ভীতি ও পিছুটান আমাদের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারতো না। পাঠ্য বইয়ের প্রতি যতটা আমাদের অনীহা ছিল, ঠিক ততটাই আগ্রহ ছিল পাঠ্য বইয়ের বাইরের বইয়ের প্রতি। তবে এ কথা ঠিক, আমাদের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে লেখিকা রোমেনা আফাজের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।
রোমেনা আফাজ ১২ জুন রাতে হঠাৎ চলে যাওয়ায় উসকে উঠে আমাদের বুকে জমে থাকা শৈশব-কৈশোরের সেই স্মৃতি। প্রচলিত অর্থে রোমেনা আফাজকে জীবনধর্মী লেখিকা বলা যাবে না। তার লেখায় পা-িত্য বা গভীরতা না থাকলেও চুম্বকের মতো পাঠককে টেনে রাখতো। যে কারণে তার লেখা সব বয়সী পাঠককে সমানভাবে আকর্ষণ করতো। তার সময়ে তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখিকা। তার বই বিক্রি হতো হট-কেকের মতো। তবে কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি যতই না খ্যাতিমান ছিলেন, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন গোয়েন্দা সিরিজ ‘দস্যু বনহুর’-এর রচয়িতা হিসেবে। আড়াই শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। এর মধ্যে রয়েছে বহু গল্প, কবিতা, কিশোর উপন্যাস, সামাজিক উপন্যাস, গোয়েন্দা সিরিজ ও রহস্য সিরিজের গ্রন্থ। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দু’দশকে ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজে ১৩৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া উপন্যাসের সংখ্যা ৬৯টি। তার উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে : কাগজের নৌকা, মোমের আলো, মায়ার সংসার, মধুমিতা, মাটির মানুষ ও দস্যু বনহুর ছিল সুপারহিট। তার ছবির কাহিনী ও গান মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। এখনো সেসব গান পুরনো দিনের মানুষকে উদাসীন ও স্মৃতিলগ্ন করে তোলে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে গোয়েন্দা সিরিজ ‘দস্যু বনহুর’-এর জন্য আমাদের মতো অনেকের বুকে তিনি চির-জাগরুক হয়ে থাকবেন। রোমেনা আফাজ গোয়েন্দা সিরিজ লেখার শুরুর আগে এ দেশের তরুণ-তরুণীদের প্রিয় ছিল পশ্চিম বাংলার লেখকদের ডিটেকটিভ সিরিজ। তাদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের মাঝে নিজের প্রতিভা ও মেধা দিয়ে নিজের অবস্থান করে নিতে সক্ষম হন রোমেনা আফাজ। ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজ কী পরিমাণ বিক্রি হয়েছে, তা কল্পনাও করা যাবে না। আজ জনপ্রিয় হুমায়ূন আহমেদ যেমনি সুখপাঠ্য উপন্যাস, গল্প, নাটক লিখে অসম্ভব জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ঝিমিয়ে পড়া পাঠ্যাভ্যাসকে চাঙ্গা করে তুলেছেন, তেমনিভাবে রোমেনা আফাজ পাঠকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। বিশেষভাবে কিশোর, তরুণ, যুবকরা তার বই দিয়ে পাঠাভ্যাস শুরু করে পরবর্তীকালে জীবনধর্মী ও ক্লাসিক বই পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়েছে। যদিও ৭৭ বছর বয়সে রোমেনা আফাজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু ‘দস্যু বনহুর’-এর রচয়িতা হিসেবে তিনি আমাদের হৃদয়ে চিরতরুণ ও চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।
‘দস্যু বনহুর’-এর স্বপ্নময়তা যখন আস্তে-ধীরে ফিকে হতে থাকে, সে সঙ্গে কৈশোর পেরিয়ে আমরা যখন তারুণ্যে অবগাহন করতে থাকি, ঠিক তখন হলিউডের পুরনো আমলের মারদাঙ্গা ও রোমান্টিক চরিত্র আমাদের ধ্যান-ধারণাকে পাল্টে দিতে থাকে। কিংবদন্তীর যেসব নায়ক-নায়িকা আমাদের চোখে স্বপ্নের অঞ্জন এঁকে দেন, তার মধ্যে গ্রেগরি পেক অন্যতম। গ্রেগরি পেকের দীর্ঘদেহ, স্মার্টনেস, পেটানো চেহারা, চৌকানো চোয়াল, শান্ত কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠ আর গভীর ও অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আমাদের হৃদয়ে আলাদা স্থান করে দেয়। পুরুষোচিত ইমেজ আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে তিনি আমাদের হৃদয়-মন জয় করে নেন। ‘রোমান হলিডে’, ‘দ্য গানস অব নাভারন’, ‘ম্যাকেনার্স গোল্ড’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে তার অনবদ্য অভিনয় আমাদের কাঁপিয়ে দেয়। যদিও এ ছবিগুলো পঞ্চাশ ও ষাট দশকে মুক্তি পেয়েছে; কিন্তু তার আবেদন চিরকালীন। নতুবা আমাদের জন্মের আগের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতো না। মধুমিতা হলে বসে দেখা এ ছবিগুলোর দৃশ্যায়ন, ঘোড়ার খুরের শব্দ ও চিঁহি চিঁহি রব এ মুহূর্তে কানে এসে বাজছে। ‘রোমান হলিডে’ ছবিতে অড্রে হেপবার্নের সঙ্গে গ্রেগরি পেকের রোমান্টিক প্রেমের দৃশ্যায়নগুলো সবাইকে আপ্লুত করে দেয়। রোমগামী একটি রাজকীয় বহর থেকে আধুনিক কালের প্রিন্সেস হেপবার্ন ‘পালিয়ে’ গিয়ে নিজের আÍপরিচয় গোপন রাখেন। এ সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় আমেরিকান সাংবাদিক গ্রেগরি পেকের। তারপর দু’জনে প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকেন। প্রতিটি মুহূর্ত ও কথোপকথন দর্শকদের হাসি-আনন্দে, কৌতুকে ও উত্তেজনায় মজিয়ে রাখে। যুদ্ধকে নিয়ে সর্বকালের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ‘দ্য গানস অফ নাভারন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর বিশাল অস্ত্রভা-ারকে ধ্বংস করার জন্য গ্রিক আইল্যান্ডে পাঠানো হয় একটি কমান্ডো দলকে। এ কমান্ডো দলের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রেগরি পেক। জার্মান ও ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধে যে স্পেশাল অ্যাফেক্ট ব্যবহার করা হয়, তার সাউন্ড এখনো বুকের মাঝে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো প্রতিধ্বনিত হয়। আরিজোনা ভূখ-ে কিংবদন্তীর স্বর্ণের গুপ্তভা-ার নিয়ে গ্রেগরি পেক ও ওমর শরিফের যুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘ম্যাকেনার্স গোল্ড’। গুপ্তভা-ারে যাওয়ার পথের সন্ধান জানেন একমাত্র গ্রেগরি পেক। স্বর্ণের গুপ্তভা-ার সন্ধানের পথে মেক্সিকান দস্যু ওমর শরিফের সঙ্গে কখনো সংঘর্ষ, কখনো মিত্রতার খ- খ- দৃশ্য আর ঘোড়ার খুরের প্রতিধ্বনি ও হ্রেষা রব প্রতিটি মুহূর্তকে জমজমাট করে রাখে। আমাদের শৈশবে হলিউডি ছবি সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে ওঠে গ্রেগরি পেকের ছবি দেখে দেখে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা গ্রেগরি পেক। তিনি ছিলেন হলিউডের স্বর্ণযুগের অভিনেতা। তার ক্ল্যাসিক, রোমান্টিক ও দুর্ধর্ষ অভিনয় আমাদের কাছে অম্লান হয়ে আছে। এরপর আরো ক্ল্যাসিক, আরো রোমান্টিক এবং আরো দুর্ধর্ষ চলচ্চিত্র ও অভিনয় আমাদের হৃদয় ছুঁয়েছে। কিন্তু তারুণ্যের গ্রেগরি পেক আমাদের বুকে গভীরভাবে দাগ কেটে আছেন। ১২ জুন ৮৭ বছর বয়সে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেও তার যৌবনদৃপ্ত, প্রত্যয়ী ও সেক্স সিম্বল ব্যক্তিত্ব আর অসাধারণ অভিনয় মনের মণিকোঠায় চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে।
এক সময়ের জনপ্রিয় লেখিকা রোমেনা আফাজ আর এককালের পর্দা কাঁপানো অভিনেতা গ্রেগরি পেকÑ একটা সময় এসে দু’জনেই কেন জানি হঠাৎ নীরব হয়ে যান। যাবতীয় কোলাহল, আলোর ঝলকানি, মানুষের প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা ও সংস্পর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে একটা দুর্ভেদ্য আড়াল গড়ে তোলেন। নিভৃতের জগতে রচনা করেন নিজস্ব একটা পরিম-ল। একান্তই কাছের মানুষ ছাড়া আর সবার সঙ্গে গড়ে ওঠে একটা দূরত্ব। অতীতের খ্যাতি-অখ্যাতি, কলরব, উজ্জ্বলতাÑ কোনো কিছুই তাদের স্পর্শ করেনি। ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি, সুখ ও বেদনা নিয়ে জাবর কেটেছেন আপন মনে। রোমেনা আফাজ ও গ্রেগরি পেকÑ দু’জনে দু’জগতের বাসিন্দা হলেও উভয়ই পরিণত বয়সে একই দিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। একজন লিখেছেন গোয়েন্দা কাহিনী ও তার লেখা উপন্যাস নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র এবং আরেকজন চলচ্চিত্রের নায়ক ছিলেন। মৃত্যু এবং চলচ্চিত্র দু’জনকে একাÍ করলেও দু’জনেই একটা প্রজন্মের কাছে চিরদিন আনন্দময় স্মৃতি হয়ে থাকবেন।
দৈনিক প্রথম আলো : ২৫ জুন ২০০৩



বিশ্বায়নের গোলকধাঁধা

আমরা যারা অনুন্নত, দুর্বল ও শক্তিহীন দেশের অধিবাসী, তারা এখন চাতক পাখির মতো একরাশ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে থাকি, ‘বিশ্বের মালিক’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের মুখের ‘অমৃত বাণী’ শোনার প্রতীক্ষায়। তিনি কখন কি বলেন, সেটাই বিশ্ববাসীর কাছে অপরিসীম কৌতূহলের বিষয়। কেননা, দুনিয়াটা চলছে তো তার কথায়। তার কথার ভারও যেমন আছে, তেমনি আছে ভারিক্কি। সঙ্গত কারণে তার কোনো কথাকে অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। ইরাকি জনগণকে মুক্তি দেবেন বলে যে আশ্বাস তিনি দিয়েছিলেন, তা অনেকেই খুব বেশি পাত্তা দেয়ার তাগিদ অনুভব করেননি। ভেবেছিলেন, বাত কি বাত। কিন্তু তার কথাকে গুরুত্ব না দেয়ার পরিণতি আমরা দেখতে পেলাম হলিউডি মারদাঙ্গা ছবির কাহিনীর মতো করে। তাতে অ্যাকশন, ড্রামা ও সাসপেন্সের কোনো কমতি ছিল না। রোমান্সটাও অবশ্য আমাদের দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়নি। প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাকি জনগণকে এমনই মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছেন, তাতে তাদের অবস্থা দাঁড়িয়েছেÑ ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য দূরীকরণে বিশ্বব্যাপী অবাধ বাণিজ্য বিস্তারের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে কোনো সমাজে বাণিজ্য হচ্ছে উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অন্তরায়গুলো নিরসনে আমেরিকা ও ইউরোপকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। অবাধ বাণিজ্য বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। প্রেসিডেন্ট বুশের এ আশাবাদ তৃতীয় বিশ্বের মানুষকে যতটা না আশাবাদী করেছে, তার চেয়ে বেশি সৃষ্টি করেছে আতংক। বুশের কথার মারপ্যাঁচে কী লুকিয়ে আছে, তা এ মুহূর্তে আঁচ করতে না পেরে সবাই কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ইতোমধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সর্বত্র নিন্দা, সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। যারা এই অসম বাণিজ্য নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত, তারা তো বটেই; যারা মানবতাবাদী, তারাও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। কেননা, বুশ যে অবাধ বাণিজ্যের কথা বলছেন এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা অবাধ বাণিজ্যের নামে সারা দুনিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের যেসব বিধি-বিধান প্রবর্তন করছেÑ তার মধ্যে কোনো তফাত নেই। উভয়ই একে অপরের পরিপূরক।
১৯৪৭ সালে বিশ্ব বাণিজ্য পরিচালনার জন্য আইন ও শৃ´খলা প্রতিষ্ঠা, প্রতিযোগিতা বিনষ্ট করেÑ এমন বাণিজ্যিক বাধা ও অন্যান্য প্রতিকূলতা দূর, বাণিজ্য বিরোধ মীমাংসা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে গঠিত হয় গ্যাট (জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড) অর্থাৎ শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ সমঝোতা। কিন্তু মূল বিষয়কে উপেক্ষা করে ধনী দেশগুলো বাজার দখলের খেলায় গ্যাটকে ব্যবহার করে। বর্তমান বিশ্বের একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা নির্মাণের কথা বলে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করেছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর দ্রুত ও শক্তিশালী সমর্থন পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র গ্যাটকে শুধু পণ্যের শুল্ক কিংবা বাণিজ্যের সীমা থেকে জোর করে বের করে আনার দিকে অগ্রসর হয়। বর্তমান কাঠামোতে সন্তুষ্ট না হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্যাটের আওতাকে সেবা, বিনিয়োগ ও মেধাস্বত্বের অধিকার পর্যন্ত বাড়ানো এবং সে সাথে এ বিষয়গুলোকে দেখাশোনা করার জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নেয়। গ্যাটের সংশোধিত কাঠামো নিয়ে উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যে এবং তার সঙ্গে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো ভয়ংকর বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। এই চূড়ান্ত সংকটের মুহূর্তে গ্যাটের তৎকালীন মহাসচিব আর্থার ড্যাঙ্কেল কিছু আপোষের চিন্তা মাথায় রেখে বিবেচনার জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব হাজির করেন। প্রায় আট বছর তুমুল তর্ক-বিতর্কের পর কিছু রূপান্তর ঘটিয়ে ড্যাঙ্কেল প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে কর্মকর্তা পর্যায়ে এবং ১৯৯৪ সালের মার্চে মন্ত্রী পর্যায়ে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি গঠন করা হয় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা অর্থাৎ ডব্লিউটিএ। এর পাশাপাশি কৃষিপণ্যসহ অপরাপর পণ্যের শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে দেখাশোনা, সেবামূলক খাত, বিনিয়োগ ও মেধাজাত অধিকারের সাথে সম্পর্কিত এবং পারস্পরিক প্রতিশোধমূলক বিধান সংক্রান্ত চুক্তি কার্যকর হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তার কার্যাবলী হচ্ছে : উরুগুয়ে রাউন্ডে গৃহীত সব চুক্তি ও আইনি হাতিয়ারগুলো বাস্তবায়ন সহজতর করে তুলবে, সকল ধরনের সমঝোতার লক্ষ্যে একটি ফোরাম হিসেবে কাজ করবে, বাণিজ্য নীতি পর্যালোচনার পদ্ধতি ও বিরোধ মীমাংসা পরিচালনার নিয়মনীতি সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনা পরিচালনা করবে এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণে পরস্পরের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্ব ব্যাংককে সহযোগিতা করবে।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে মূলত লাভবান হচ্ছে শিল্পোন্নত দেশ এবং তাদের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। বিশ্বব্যাপী বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর আধিপত্য ক্রমশ দৃঢ়তর হচ্ছে। তারা উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে খবরদারি করছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং মুক্তবাজারের শাসনে বহুজাতিক কর্পোরেশনের আদলে বিশাল আকারের কর্পোরেট পুঁজি এখন বিশ্বের শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ পুঁজি এখন পুঁজিবাদী বিশ্ব শক্তি হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই কর্পোরেট পুঁজির আন্তর্জাতিক চলাচল এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবার জন্য বিশ্বব্যাপী অবাধ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন গড়ে তোলার নামই বিশ্বায়ন; যা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিপ্লবকে ধারণ করে দরিদ্র দেশগুলোকে আবারো আরেকটি অদৃশ্য ঔপনিবেশিক শৃ´খলে আবদ্ধ করে ফেলেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মনোভাব হলো এমন : ‘বিচার মানি, তবে তালগাছটা আমার’। তাদের পক্ষে কোনো নীতি গ্রহণযোগ্য না হলেই তারা মনগড়া এক ফতোয়া দিয়ে বসে। কোনো দেশ যদি তার অর্থনীতি ঠিক করার জন্য কোনো নীতি গ্রহণ করে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তাতে বাধা দেবে এই বলে যে, এর সাথে উন্নয়নের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ উন্নত দেশগুলোর ম্যাক্রো অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত হয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে। তাতে ভোটাভুটির কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে শিল্পোন্নত বা ধনী দেশগুলো তাদের কোনো সিদ্ধান্ত অনুমোদন করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হলে সেসব দেশের প্রতিনিধিদের আপোষের মাধ্যমে বা নানা কৌশল প্রয়োগ করে বশ করার পথ বেছে নেয়। ফলে কোনো অগণতান্ত্রিক ও একতরফা সিদ্ধান্ত তারা সহজেই অনুমোদন করিয়ে নেয়। তারপর শিল্পোন্নত দেশের প্রতিনিধির সংখ্যা ইচ্ছেমাফিক বাড়িয়ে নেয়া, যখন-তখন সভা আহ্বান করাÑ যাতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো সহজেই অংশ নিতে না পারে। এমন চালাকি তো আছেই।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা শুধু সারা দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রকই নয়, তারাই হয়ে উঠবে এক বিশ্ব সরকার। যাদের সুতো থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী এ সংস্থার কার্যক্রম, বিধি-বিধানের ফলে সারা দুনিয়ায় বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। তীব্র হবে বৈষম্য। উন্নত বিশ্ব আর উন্নয়নশীল বিশ্বের মাঝে এবং ধনী আর দরিদ্রের মাঝে ব্যবধান বাড়বে। গরিব আরো গরিব হয়ে যাবে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় আর্থ-সামাজিক মূল্যবোধ, জীবনযাপন পদ্ধতিতে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে যাবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অগণতান্ত্রিক ও অসম নীতির ফলে বিপদাপন্ন হবে আমাদের মতো দেশের কৃষি, শিল্প ও প্রতিবেশ। তথ্য প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিপ্লব আর গুটিকয়েক রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের নজিরবিহীন বল প্রয়োগের ক্ষমতা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনে এক বিশ্বে এখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং মুক্ত বাজারের শাসন মানবজাতির জন্য একটি স্বাভাবিক ব্যবস্থা। রাজনৈতিক বিশ্বায়ন নয়া উদার নৈতিক ভাবাদর্শের আধিপত্য সৃষ্টি করছে। তথাকথিত গণতন্ত্র ও মুক্তবাজারের সমন¦য় ঘটানো হয়েছে। সবকিছুর মাতবর হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি। এদের চাপিয়ে দেয়া কাঠামোগত সমন¦য় কর্মসূচি দারিদ্র্য কমানোর নামে বেসরকারিকরণ কর্মসূচিকে ত্বরানি¦ত করেছে। ফলে একটি বিশেষ শ্রেণী সেবা-পণ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক হয়ে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় সেবা, চাকরি ও খাদ্য নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দরিদ্র দেশের সার্বভৌমত্ব সীমিত এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সরকারগুলোর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। সে তুলনায় এনজিওরা অনেক শক্তিশালী হয়েছে। তাদের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বর্তমান তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বহুপাক্ষিক বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় বিশ্বায়ন ও বাণিজ্য উদারীকরণের গতিকে ত্বরানি¦ত করে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বৈষম্য হ্রাস করার লক্ষ্যেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত হলেও ২০০৫ সাল থেকে গার্মেন্টস শিল্প কোটা সুবিধা হারিয়ে অন্যান্য দেশের সাথে এক অসম ও কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। এর ফলে বাংলাদেশের প্রায় ১৫ লাখ নারী শ্রমিক বেকার হয়ে পড়তে পারে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় টেক্সটাইল ও বস্ত্র চুক্তির ফলে এ খাত দুটো ইউরোপ ও আমেরিকার আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ কোনো কোটা সুবিধা পাবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মে টেক্সটাইল ও বস্ত্রখাত পরিচালিত হবে। বাংলাদেশ পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে জিএসপি (জেনারেল সিস্টেম অব প্রিফারেন্স) স্কিমের সুবিধা ভোগ করে। এখন থেকে বাংলাদেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সুবিধা পেতে হলে মেনে চলতে হবে ‘রুলস অব অরিজিন’-এর শর্তাবলী। এর ফলে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার হারাতে হবে। বেসরকারিকরণের নামে আমাদের জাতির সুষম বিকাশের জন্য জাতি গঠনকারী প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতকে বাজার ব্যবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। পেটেন্ট রাইটসের নামে কৃষক সমাজের হাজার বছরের লালিত গাছপালা, বীজ ও প্রাণসম্পদকে বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধির কাছে তুলে দিয়ে কৃষক সমাজকে নিঃস্ব করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আমাদের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করেন না। তাছাড়া আমাদের প্রশাসনিক অবস্থাও শক্তিশালী নয়। যে কারণে আমাদের অসতর্কতা ও অসচেতনতার সুযোগে আমরা ধনী দেশগুলোর পাতা ফাঁদে ক্রমান¦য়ে আটকা পড়ে যাচ্ছি। যখন আমাদের হুঁশ হয়েছে, তখন পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। যা হোক, সেপ্টেম্বরে মেক্সিকোর কানকুন শহরে অনুষ্ঠিত হবে পঞ্চম মিনিস্টারিয়্যাল কনফারেন্স। এ সম্মেলন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থায় উন্নত দেশের বাজারে স্বল্পোন্নত দেশের পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার এবং বিশ্ব শ্রম বাজারে শ্রমিকের অবাধ চলাচলসহ ১৩ দফা দাবির ‘ঢাকা ঘোষণা’র মধ্য দিয়ে ২ জুন স্বল্পোন্নত দেশের বাণিজ্য সম্মেলন শেষ হয়। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনে ১৬ দফা ‘ঢাকা ঘোষণা’য় স্বল্পোন্নত দেশের প্রধান দাবি ১৩টি। দাবিগুলো : ১। বিশ্ব বাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি, নমনীয় এবং সহজতর ‘রুলস অব অরিজিন’ প্রবর্তনের মাধ্যমে এসব দেশের সব পণ্যের জন্য শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা দেয়া; ২। কানকুন সম্মেলনের মধ্যে বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট সব ইস্যুর সমাধান এবং স্বল্পোন্নত দেশের জন্য স্পেশাল ও ডিফারেন্সিয়াল ট্রিটমেন্ট প্রথার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটানো; ৩। বিশ্ব শ্রম বাজারে অদক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমিকের অস্থায়ী চলাচল অবাধ করার লক্ষ্যে পেশাগত দক্ষতার স্বীকৃতি প্রদান, ভিসা পদ্ধতি সহজকরণ এবং ইকোনমিক নিড টেস্টের প্রশ্ন উত্থাপন না করা; ৪। স্বল্পোন্নত দেশের নিজস্ব অগ্রগতি, আর্থিক ও বাণিজ্যিক চাহিদা কিংবা প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা অনুসারে প্রতিশ্রুতি প্রদান ও বাধ্যবাধকতা পালনে নমনীয় থাকা; ৫। স্বল্পোন্নত দেশের উৎপাদন ও রফতানিভিত্তিক উন্নয়ন এবং রফতানি ভিত্তির বহুমুখীকরণ ও শক্তিশালীকরণে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি করা; ৬। স্বল্পোন্নত দেশের সরবরাহ ঘাটতি দূর করা, রফতানি ভিত্তির সম্প্রসারণ করা এবং আর্থিক সম্পদ প্রাপ্তি উন্নয়নের প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে সমনি¦ত কাঠামো শক্তিশালী করা; ৭। অ্যান্টি জাম্পিং, কাউন্টারডেইলিং ও নিজেদের পণ্য সুরক্ষার পদক্ষেপ থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে অব্যাহতি প্রদান; ৮। এমএফএন শুল্ক কমানোর কারণে প্রেফারেন্স মার্জিন কমার বিষয়টি সমাধানের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণমূলক পদ্ধতি ও অন্যান্য কার্যক্রম উদ্ভাবন করা; ৯। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় স্বল্পোন্নত দেশের প্রবেশাধিকার নীতিমালা দ্রুত কার্যকর ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন; ১০। স্বল্পোন্নত দেশের উন্নয়নে সিঙ্গাপুর সম্মেলনের প্রভাব নিরূপণের লক্ষ্যে কার্যক্রম ও সমীক্ষা চালু রাখা; ১১। ক্ষুদ্র অর্র্থনীতি ও স্থলবেষ্টিত দেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশ চরম দুর্দশা উত্তরণে সহায়তার লক্ষ্যে কৌশল উদ্ভাবন করা; ১২। জেনেটিক, সম্পদ, প্রচলিত জ্ঞান ও কৃষকের অধিকার সংরক্ষণ এবং সব জীবিত বস্তুর স্বত্বাধিকার ট্রিপস চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক কৌশল বলবৎ করা; ১৩। রোগের ওপর ভিত্তি না করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওষুধ শিল্পের বাধ্যতামূলক লাইসেন্সিং সমস্যার সমাধান করা।
স্বল্পোন্নত দেশের পক্ষ থেকে এসব দাবি আগামী সেপ্টেম্বরে মেক্সিকোর কানকুনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে। ন্যায্য ও পক্ষপাতহীন সুবিধা পেতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জোরালো রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সমনি¦ত উদ্যোগ গ্রহণ, বিশ্ব বাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশের অংশগ্রহণ বাড়ানোর অভিন্ন লক্ষ্য অর্জন, এসব দেশের জোরালো রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও একযোগে কাজ করার আকাক্সক্ষা থাকা এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে নিজেদের সামর্থ্য ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান উন্নত করা প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বের ১২০ কোটি মানুষ দৈনিক এক মার্কিন ডলারেরও কম আয়ে চরম দারিদ্র্যসীমায় বসবাস করছে। এসব মানুষের অধিকাংশের ঠিকানা ৪৯টি স্বল্পোন্নত দেশ। আঙ্কটাড-এর এক হিসাব অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি চরম দরিদ্র। দ্রুত জরুরি কোনো পদক্ষেপ নেয়া না হলে স্বল্পোন্নত দেশে দারিদ্র্য এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে যাবে। অর্থনীতির চালিকাশক্তির হিসাবে বাণিজ্যের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জীবিকার প্রধান খাত হচ্ছে কৃষি। বহির্বাণিজ্যে এই খাতটি কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। উন্নত দেশের বাধার কারণে আমাদের কৃষিপণ্য ঢুকতে পারে না।
কানকুন সম্মেলনে শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে খুব সহজে সুবিধা আদায় করা সহজ হবে না। তাদের কৌশল, চালাকি ও মেধার কাছে স্বল্পোন্নত দেশের এঁটে ওঠা কঠিন হয়ে পড়বে। স্বল্পোন্নত দেশকে সঠিক নেতৃত্ব প্রদান এবং তীক্ষè মেধা ও যুক্তির ছুরিতে প্রতিপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়ার মতো বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দারুণভাবে অনুভূত হচ্ছে। তারপরও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে ন্যায্য ও পক্ষপাতহীন সুবিধা পেতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জোরালো রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সমনি¦ত উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে নিজেদের সামর্থ্য মেলে ধরতে হবে।
কানকুন সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশগুলো কতটা কি আদায় করতে পারবেÑ সেটা বলা মুশকিল। তবে বিশ্বায়নের গোলকধাঁধা থেকে রেহাই পেতে হলে বাংলাদেশকে দাঁড়াতে হবে নিজের পায়ে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজের অবস্থান করে নিতে হলে বাংলাদেশকে তাকাতে হবে সামনের দিকে। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল, আইন-শৃ´খলা পরিস্থিতির উন্নতি, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, কথায় কথায় হরতাল, ধর্মঘট বন্ধ, পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে গার্মেন্টসসহ রফতানিযোগ্য পণ্যের বাজার শক্তিশালী করা প্রয়োজন। কেননা, বাংলাদেশে শ্রম সহজ, সুলভ ও সস্তায় পাওয়া যায়। এটাকে পুঁজি করে অবাধ শ্রমের বাজারে প্রতিদ্বন্দি¡তা করে টিকে থাকতে চেষ্টা করাটাই হবে বাংলাদেশের জন্য সর্বোত্তম পথ।
দৈনিক সংবাদ : ৪ জুলাই ২০০৩
অলৌকিক নয়, চাই লৌকিক ক্ষমতা

ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ বাহিনীর আগ্রাসন ও দখলদারিত্বে আমাদের একরৈখিক চিন্তার পুকুরে যেন আচানক ঢিল পড়েছে। তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে চিন্তাস্রোত। এতদিন যুক্তিহীনভাবে যে আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠেছি, তা যেন হঠাৎ আমাদের মর্মমূল আমূল কাঁপিয়ে দিয়েছে। আমরা যে সত্যকে পরম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় বুকের মাঝে লালন করে এসেছি, তা যে এভাবে মিথ্যে হয়ে যাবে, তার জন্য আমরা অনেকেই মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। শুধু সমৃদ্ধ সভ্যতার কারণেই নয়, আধ্যাÍিকতার দিক দিয়েও পুণ্যভূমি ইরাক। এককালের মেসোপটেমিয়ায় শায়িত আছেন যারা মনুষ্যত্বের গান গেয়েছেন, মানব জীবনের মহিমা ও মানুষের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়েছেন এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে পথ-প্রদর্শক হয়েছেনÑ সেসব আধ্যাÍিক, বুজুর্গ ও বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা। এই মহামানবদের কেউ কেউ অপরিসীম জ্ঞান, সমুচ্চ মর্যাদা, দূরদৃষ্টি, সূক্ষ্ম চিন্তাশক্তি, উন্নত মানবতাবোধ, সাহস, ধৈর্যশক্তি, অতুলনীয় শারীরিক বল, অফুরন্ত মনোবল, রণ-নিপুণতা এবং কখনো-সখনো আধ্যাÍিক ও অলৌকিক শক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষের হৃদয়-মন জয় করার পাশাপাশি এমন সব অসম্ভব কীর্তি দিয়ে সবাইকে বিস্ময়াভিভূত করেছেন, যে কারণে তারা চিরস্মরণীয় ও কিংবদন্তী হয়ে আছেন। মুসলমানদের পুণ্যতীর্থ এবং বিশ্বের তাবৎ মানুষের কাছে সভ্যতার পাদপীঠ হিসেবে বিবেচিত ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ বাহিনী যখন আগ্রাসন চালানোর হুমকি-ধমকি দিতে থাকে, তখন বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিম ধর্মানুরাগীরা এক প্রকার ধরেই নেন, আগ্রাসী শক্তির পক্ষে ইরাকে নাক গলানো সম্ভব হবে না। সব নিয়ম-নীতি লংঘন করে যৌথ বাহিনী ইরাকের ওপর হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেও ধর্মানুরাগীদের অটল বিশ্বাসে একটুও টাল খায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য শক্তির দিক দিয়ে যতই অপ্রতিদ্বন্দ¡ী হোক না কেন, সবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আগ্রাসী বাহিনীর পক্ষে ইরাককে কাবু করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূল ছিল, ইরাকি জনগণের জিহাদি মনোবল, আধ্যাÍিক চেতনা এবং অতীতের সেইসব অলৌকিক কাহিনীÑ যা বুকের মাঝে অটল পর্বতের মতো চিরঞ্জীব হয়ে আছে। বছরের পর বছর ধরে শিক্ষিত-অশিক্ষিত অধিকাংশ মানুষের মনে এমন একটা ধারণা বা বিশ্বাস গেড়ে বসে আছেÑ আরব ভূমিতে আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব করতে আসলে হামলাকারীরা হার মানবে আধ্যাÍিক ও অলৌকিক শক্তির কাছে। এমন একটা বিশ্বাস থেকে তাদের মনে এই প্রতীতী সৃষ্টি হয় যে, ইরাককে কখনোই পরাধীন করা যাবে না। এ কারণে যুদ্ধের শুরু থেকেই অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অধিকাংশ পত্র-পত্রিকা মানুষের সস্তা আবেগকে কাজে লাগিয়ে বিভ্রান্ত করার পথ বেছে নেয়। এতে হয়তো পত্র-পত্রিকার কাটতি বেড়েছে; কিন্তু নষ্ট হয়েছে বিশ্বাসযোগ্যতা। বিবিসি, সিএনএনসহ পাশ্চাত্য মিডিয়ার একতরফা প্রচারণায় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও অনেকখানি ম্লান হয়ে যায়। মিডিয়ার তথ্য পরিবেশনের মূল কথা হচ্ছেÑ বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। কারো পক্ষাবলম্বন না করে উভয় পক্ষের ঘটনা ও বক্তব্য যথাযথভাবে তুলে ধরা। এমনটি না করায় পাশ্চাত্য মিডিয়া তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি হারিয়েছে। যে কারণে কিছু কিছু ঘটনা অতিরঞ্জনের পাশাপাশি অনেক সত্য ঘটনা তুলে ধরলেও তা দর্শক ও পাঠকদের আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পাশ্চাত্য মিডিয়ার একপেশে ভূমিকায় ক্ষোভ ও বিক্ষোভÑ দুই-ই হয়েছে। কিন্তু তাদের কাউন্টার করতে যেয়ে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাগুলোর ভূমিকাটাইবা কেমন ছিল? এ প্রশ্নটি সঙ্গত কারণে ওঠাই স্বাভাবিক। মার্কিন-ব্রিটিশ আগ্রাসনের শুরু থেকেই বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাগুলো এমন একটা ধারণা দিতে থাকে যেন ইরাকের মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নেবে দুর্বৃত্ত। আট কলাম শিরোনামে যেসব ব্যানার হেডিং করা হয়েছে, তাতে ইরাকের ছোট-খাট সাফল্যকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে মার্কিন বাহিনী মোটেও সুবিধা করতে পারছে না। তারা ক্রমাগত পিছু হটছে। আতংকে ভুগছে। অস্ত্র ফুরিয়ে বিপদে আছেÑ ইত্যাদি। এমনকি কিছু কিছু ঘটনায় কাল্পনিক, আধা-কাল্পনিক, আধ্যাÍিক ও অলৌকিকতার মিশেল দিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমনভাবে পরিবেশন করা হয়েছে, মানুষ তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। ভেবেছে ইরাকের মাটি বুঝিবা সত্যি সত্যি দুর্জয় ঘাঁটি। যুদ্ধকালীন সময় ‘মরুঝড়’ শুরু হলে তাকে কেন্দ্র করে এমনভাবে মহিমা প্রচার করা হয়, মরুঝড়কে সবাই অলৌকিক শক্তির আধার হিসেবে মনে করতে থাকে। এই রোমাঞ্চকর ও জিহাদি জোশে সংবাদ পরিবেশনে বাংলাদেশের পাঠকরা আকৃষ্ট ও টগবগিয়ে ফুটলেও ইরাকিদের বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি। বরং বলা যায়, তেমন কোনো শক্তিশালী প্রতিরোধ ছাড়াই মাত্র ২০ দিনে ইরাক আগ্রাসী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তারা এখন জুলুম ও জবরদস্তি চালাচ্ছে, তাতে বিশ্ব বিবেক কেঁপে উঠলেও এ জন্য তাদের বিন্দুমাত্র কৈফিয়ৎও দিতে হচ্ছে না। মানুষ যে অলৌকিক আশা নিয়ে প্রহর গুনেছিল, তা আর সত্য হয়নি। এতে কি পত্র-পত্রিকা বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা হারায়নি? আসলে বাংলাদেশসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশের মানুষকে এখনো আবেগাক্রান্ত করে ইয়েমেনের অমুসলিম বাদশাহ আব্রাহামের হস্তি বাহিনী দিয়ে পবিত্র কাবা শরীফ দখল করতে এসে ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবিল পাখির ছোট ছোট প্রস্তরখ-ে বিপর্যস্ত ও পরাজিত হওয়া, মিসরের বাদশাহ ফেরাউনকে লোহিত সাগরে অলৌকিকভাবে ডুবিয়ে মারা ইত্যাদি। আসলে ইতিহাসের সেসব অলৌকিক ঘটনা আমাদের পথ দেখালেও এর কী তাৎপর্যÑ তা সঠিকভাবে অনুধাবন না করে শুধু শুধু কল্পনায় অসাধ্য সাধন করার কোনো মানে হয় না। তাতে কোনো লাভ হয় না অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে গুলিয়ে ফেললে। দশক, শতক কিংবা সহস্র বছর আগে যে ঘটনা বা প্রেক্ষাপট বিরাজ করেছে, বর্তমানে বিশ্ব ব্যবস্থায় তার কতটুকুইবা তাৎপর্য আছে? সত্য কথা বলতে কী আধ্যাÍিকতা বা অলৌকিকত্ব দিয়ে কিছু অর্জন করা আদৌ সম্ভব কিনাÑ সে প্রশ্নটি কাল থেকে কালান্তরে মানুষের মনে অন্তহীন কৌতূহল হয়ে আছে। তাছাড়া ইরাকের জন্য বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা ও শুভ কামনায় একটুও কি টলেছে বুশ ও ব্লেয়ারের কঠিন হৃদয়? যদি তাই হতো তাহলে ইরাককে এভাবে অসহায় আÍসমর্পণ করতে হয় না। দেখতে হয় না আগ্রাসী বাহিনীর বিকৃত উল্লাস। আরব বা ইসলামের ইতিহাস শুধু আধ্যাÍিকতা ও অলৌকিকত্ব প্রদর্শনের ইতিহাস নয়। কেউ কেউ যুগে যুগে আধ্যাÍিকতা ও অলৌকিকত্ব নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এর মহিমা প্রচার করে এসেছেন। মানুষকে সহজ প্রলোভনে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। এতে কার কি লাভ হয়েছে জানি না, তবে আড়ালে পড়ে গেছে আরব ও মুসলমানদের জ্ঞান চর্চার বিকাশ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, অধ্যয়ন, গবেষণা, দর্শন, বিচক্ষণ, দূরদর্শিতা, বীরত্ব ও সাহসিকতা।
আজকের নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় ও বিশ্ব বাস্তবতায় যারা দুর্বল, নির্যাতিত ও পরাধীন, তাদের ভাবনার দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চয়ই পাল্টে যাবে। আÍরক্ষা ও আÍসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে কারো অনুগ্রহ ও আশ্রিত হয়ে স্বাধীনভাবে বসবাস করা যাবে না। এ জন্য জ্ঞান-গরিমায়, মেধায়-পা-িত্যে এগিয়ে আসতে হবে। সময় তো কখনো থমকে থাকে না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এক সময় মুসলমানদের প্রবল দাপট ছিল। তা নিশ্চয়ই শুধু আধ্যাÍিকতা ও অলৌকিকত্ব দিয়ে অর্জিত হয়নি। শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-গরীমায়, শক্তি-সামর্থ্য,ে কৌশল-কূটনীতি দিয়ে তারা শাসন করেছে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর আবির্ভাবের ফলে আরবের বুকে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছিল, তার অভিব্যক্তি এভাবে ব্যক্ত করেছেন মনীষী টমাস কার্লাইল : কমর্ দণ ইরটঠ ভর্টধমভ র্ধ ষট্র ট ঠধর্রদ তরমব ঢটরপভণ্র্র ধর্ভম ফধথর্দ, ইরটঠধট তর্ধর্র ঠণডটবণ টফধশণ ঠহ বণটভ্র মত র্ধ. এই যে অন্ধকার থেকে আলোকের রাজ্যে উত্তরণ তা তো এমনি এমনি হয়নি। তিনি মানবিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, অহিংসা, সাহস ও ভালোবাসা দিয়ে মানুষের শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা ও আনুগত্য অর্জন করেছিলেন। তারপরের ইতিহাস ইসলামের এগিয়ে চলার ইতিহাস। সব সময় চলার পথ যে মসৃণ ছিল তা নয়। স্বার্থের হীন ষড়যন্ত্র, কায়েমী স্বার্থের চক্রান্ত বা নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মাঝেও ইসলামের শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার পতাকা উড়িয়েছেন হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), উমাইয়া বংশ এবং ইসলামের গৌরব ফলে-ফুলে আরো বিকশিত হয়ে ওঠে স্পেনে। সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিশ্বকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। এ কারণে স্পেনকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের ইউরোপ জয় ইতিহাসে অমলিন হয়ে আছে।
শৌর্য-বীর্যে একসময় আরবরা ছিল দোর্দ- প্রতাপশালী। স্পেনে মুসলমানরা প্রায় ৭৫০ বছর রাজত্ব এবং আধুনিক ইউরোপের বিকাশ ঘটান। গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর মুসলিম অধ্যুষিত স্পেন ছিল গোটা ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র। স্পেনে মুসলমানরা যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোক-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তা-ই কালের প্রবাহে উন্নত হয়ে ইউরোপীয় মনীষীগণকে জগতসভায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ সময় আরব ও ইউরোপীয় সভ্যতার সংযোগে এক উন্নত সভ্যতার সৃষ্টি হয়। স্পেনে দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত নাগরিক, হতভাগ্য ক্রীতদাস, দৈন্য-প্রপীড়িত ভূমিদাস এবং উৎপীড়িত ও অত্যাচারিত সবাই মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুণছিলেন। এ সময় মুসা ইবনে নাসের আফ্রিকা শাসন করছিলেন। স্পেন ও পর্তুগালের সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন রডারিক। রডারিকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্পেনবাসী আফ্রিকান শাসক মুসার শরণাপন্ন হন। দামেশকে খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বকালে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকায় গভর্নর মুসা ইবনে নাসেরের অধীনস্থ সেনাপতি মহাবীর তারিক ইবনে জায়াদ একদল আরবি ও নবদীক্ষিত ফৌজসহ দক্ষিণ স্পেনের একটি অংশ আক্রমণ করেন। যুদ্ধে জয়লাভ করে তারিক স্পেনের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। এই বাহিনী আরো অগ্রসর হয়ে ফ্রান্স পর্যন্ত অগ্রসর হয়। তবে ফ্রান্স জয় করা সম্ভব হয়নি। ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের রাজধানী কর্ডোভা দখল করে স্বাধীন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন আব্দুর রহমান। আব্দুর রহমান আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের বিরাট এলাকাজুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটান। তার বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছিল শান্তি এবং প্রজাদের বিভিন্ন উন্নতি হয়েছিল। তার রাজধানী কর্ডোভা ছিল সভ্যতা ও সংস্কৃতিসমৃদ্ধ এবং ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ নগরী। ইউরোপীয় জাতিগুলোর নব-জাগরণের জন্য তিনিই প্রথম দরজা খুলে দেন। তবে আব্দুর রহমানের পর বংশানুক্রমে হিশাম, হাকাম ও দ্বিতীয় আব্দুর রহমান সিংহাসনে আরোহণ করেন। দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের রাজত্বকালে স্পেনের প্রভূত উন্নতি, রাজধানী কর্ডোভা অপরূপ সৌন্দর্য লাভ করে। রাজ্যের সর্বত্র সুন্দর সুন্দর বাগান, সুপ্রশস্ত রাস্তা, সুদৃশ্য ইমারত গড়ে উঠেছিল। কর্ডোভার রাজ-দরবার ছিল তৎকালীন ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান-কেন্দ্র, উন্নত ও মার্জিত সভ্যতা, আদব-কায়দা এবং রীতি-নীতির মিলনস্থল। খলিফা তৃতীয় আব্দুর রহমানের সময় সেখানে মুসলিম শক্তি অত্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং ইউরোপে মুসলমানদের প্রভাব বেড়ে যায়। কনস্ট্যান্টিপোল, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির সম্রাটগণ তার দরবারে দূত প্রেরণ করে সখ্য স্থাপন করেন। তিনি যেমন সামরিক শক্তিতে গরীয়ান ছিলেন, তেমনি বিদ্যাবত্তা ও গুণ-গরিমার কদর করতেন। তার আমলেই স্পেন সর্বাপেক্ষা সৌন্দর্যম-িত হয়ে ওঠে। অতুলনীয় শোভাম-িত প্রাসাদ নির্মাণসহ অসংখ্য অবকাঠামো গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে দুর্বল শাসকদের কারণে স্পেনে অনেকগুলো স্বাধীন ক্ষুদ্র রাজ্য সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে গ্রানাডা ছিল সর্বোত্তম। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দুর্বল শাসন ব্যবস্থা ও অদূরদর্শিতার কারণে ইউরোপ মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এমনকি আটশত বছরে তারা যেসব কীর্তি গড়েছিলেন, তার নাম-নিশানা একে একে সবই মুছে ফেলা হয়। স্পেন থেকে বিতাড়িত হয়ে মুসলিম সভ্যতার শেষ আশ্রয় হয় গ্রানাডায়। মুসলমানরা গ্রানাডায় দু’শ বছর রাজত্ব করেছিলেন। এ সময় তিলে তিলে গড়ে তোলা হয় গ্রানাডাকে। প্রস্রবন, কুঞ্জবন ও পুরাজি সমম্বিত একটি বিস্ময়কর সৌন্দর্য ও বিলাস-ব্যসন ছাড়াও সব দিক দিয়েই গ্রানাডা ছিল পরিপূর্ণ। গ্রানাডার বিপরীত দিকে একটি পর্বত চূড়ায় চল্লিশ হাজার লোকের বসবাসের জন্য যে দুর্গ বা নগরী নির্মাণ করা হয়েছিল, বিশিষ্ট ইসলামী প-িত সৈয়দ আমীর আলী তার ‘আরব জাতির ইতিহাস গ্রন্থে’ যে বর্ণনা দিয়েছেনÑ তা হলো এমন : সুউচ্চ চূড়া, দুর্গ ও প্রাসাদ, সূক্ষ্ম ও সুশ্রী স্থাপত্য, মনোরম বারান্দা ও স্তম্ভ, চাকচিক্যময় বিভিন্ন বর্ণের গম্বুজ ও ছাদÑ যার প্রাথমিক চাকচিক্য এতটুকু নষ্ট হয়নি, পার্শ্ববর্তী উদ্যানের সুগন্ধি আসতে পারেÑ এরূপভাবে প্রস্তুত বাতাস ভরা হলঘরগুলো; এর অসংখ্য ঝর্নাধারা, পানিকে ইচ্ছানুরূপ উচ্চ বা নিচ, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য, কখনো বাতাসে নিক্ষিপ্ত, আবার কখনো এমনভাবে বৃহৎ লম্বালম্বি খ-ে বিস্তৃত করা যেত যে এতে দালান, ঝরণা ও পরিষ্কার নীল আকাশ প্রতিফলিত হতোÑ মনোরম আরবি লতাপাতা, চিত্রকলা ও পাথরের কারুকার্য এমন যতœ ও নির্ভুলভাবে সম্পাদিত ও ক্ষুদ্রতম প্রকোষ্ঠটিও মনোমুগ্ধকর এবং সোনালী, প্যাস্টল, হালকা নীল ও কৃষ্ণাভ বেগুনী প্রভৃতি বর্ণে আলোকিত হতো, বিভিন্ন প্রতিকৃতি ও বর্ণের চীনা কারুকার্যবিশিষ্ট দেয়ালে মনোরম নিুাংশ, সুন্দর সিংহপ্রসাদ ও এর ১২৮টি সরু ও সুচারু স্তম্ভবিশিষ্ট নিভৃত প্রকোষ্ঠ, এর নীল-সাদা শানে, লাল, নীল ও সোনালী রংয়ের সমন¦য়, কাশ্মীরী শালের নকশার ন্যায় উজ্জ্বল বর্ণের আরবি লতা-পাতা, এর খিলানের ওপর মনোরম মার্বেল পাথরের কারুকার্য, এর সুরম্য গম্বুজগুলো, এর মধ্যস্থলে অবস্থিত বিখ্যাত শ্বেত প্রস্তরের বাটি, মনবিমোহিনী সঙ্গীত প্রকোষ্ঠÑ যেখানে দরবারে বসে ওপরের মঞ্চস্থ গায়কদের সঙ্গীত শ্রবণ করা হতো, মনোরম অন্তঃপুর এবং এর সূক্ষ্ম ও সুশ্রী পিতলের জাফরি কারুকার্য, অপূর্ব সুন্দর ছাদ এবং বৃহদাকার কামরাগুলো চুনের কাজের ও ক্ষুদ্রকায় প্রকোষ্ঠের মোচাকৃতি রেখার চমৎকার বর্ণ।
শুধু শৌর্য-বীর্য, বীরত্বে-সাহসিকতায় মুসলমানরা সাফল্যের পরিচয় দেয়নি। একই সঙ্গে রসায়ন ও দর্শন, জ্যোতিষ, চিকিৎসা, কাব্যচর্চা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, স্থাপত্য, অংক শাস্ত্রসহ সভ্যতার নানা দিকে আলোর মশাল জ্বালিয়েছেন। ইরাক, মিসর, তুরস্কের সভ্যতার যে উজ্জ্বল নিদর্শনের পাশাপাশি লিপি আবিষ্কার, সাংকেতিক অংক চিহ্ন, সাল গণনা করার পদ্ধতি অথবা মাস নির্ধারণ করার উপায় বের করা হয়। সুমেরীয় সভ্যতায় রাজা হামবুরি যে আইন প্রণয়ন করেন, তা ছিল কঠোর; তবে উন্নত সভ্যতার পরিচায়ক। শক্তিশালী রাজ্য নেব্যুক্যাডনেজার ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান তৈরি করেন। নীল নদের অববাহিকায় গড়ে ওঠে মিসরীয় সভ্যতা। মিসরীয়রা মনের কথা ব্যক্ত করার জন্য হাইয়ারোগ্লিফ আবিষ্কার করে। এক এক রকম সাংকেতিক লিপি। লেখার জন্য বিদেশি কালিও তারা তৈরি করেছিল। জমিতে পানি দেয়ার জন্য খাল কেটে চাষের ব্যবস্থা করা হয়। মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগের শহর বাগদাদ বেড়ে উঠেছিল দজলা নদীর তীরে। দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুরের শাসনামলে বাগদাদ হয়ে ওঠে মুসলিম বিশ্বের বাণিজ্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। মুসলিম বিশ্বের হাজার হাজার স্থাপত্যবিদ, দক্ষ কারিগরকে লাগানো হয় শহরটির জাঁকালো প্রাসাদ, প্রসিদ্ধ মসজিদ ও রূপকথার বাগানগুলো গড়ে তোলার কাজে। সব দিক দিয়ে সমৃদ্ধির উৎকর্ষ অর্জন করে বাগদাদ। যে ইসলামী প-িত সভ্যতা ও জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনÑ আল বিরুনী, আল ফারাবী, ঈমাম গাজ্জালী, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন, ওমর খৈয়াম, জালালউদ্দিন রুমী, জাকারিয়া আল রাজী প্রমুখ।
ইতিহাসের পেছনে ফিরে তাকানোর উদ্দেশ্য হলো, একসময় যে দেশগুলো সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, বীরত্বে বিশ্বের সেরা দেশে পরিণত হয়েছিল, ইউরোপে নিয়ে এসেছিল রেঁনেসা, সে দেশগুলো এখন ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে আরব দেশগুলো এখন পাশ্চাত্যের অলিখিত উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে, স্থাপত্যে, এমনকি নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিক দিয়েও তারা পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। নিজেদের সম্পদের ব্যবহার করার মতো যোগ্যতা ও ক্ষমতা নেই বললেই চলে। যে তেল সম্পদের ওপর আরব দেশগুলোর চাকচিক্য ও জেল্লা, তার নিয়ন্ত্রণ ক্রমান¦য়ে পশ্চিমাদের হাতে চলে যাচ্ছে। যে জন্য লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে গেলেও তাদের কোনো বোধোদয় হচ্ছে না। কোথাও রাজতন্ত্র, কোথাও স্বৈরশাসন কায়েম করে জনগণকে ধর্মের আফিম গিলিয়ে রাখা হয়েছে। ক্রমান¦য়ে তারা পরাধীন হয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ বেশ কয়েকটি দেশে মার্কিন সেনারা ঘাঁটি গেড়েছে। আরব জাতি আজ দ্বিধা-বিভক্ত। আর এ সুযোগেই ইরাক দখল করে নেয়া হয়েছে। অথচ এ নিয়ে কোনো আরব বা মুসলিম দেশের কোনো ক্ষোভ বা বিকার আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। সবকিছুতেই ক্রমান¦য়ে তলানিতে ঠেকছে। আরবরা তো বটেই, এমনকি বিশ্বের প্রতিটি ইসলামী দেশের চিন্তা-ভাবনাটা এমন : একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তারা যেন অলৌকিক কিছুর আশায় বসে আছে। অথচ ইউরোপীয় দেশগুলো ক্রমশ ধাপে ধাপে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য আগ্রাসন, জবর দখল ও অস্থিতিশীল করার নেপথ্যে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর তেল সম্পদ করায়ত্ত করাটাই একমাত্র অন্যতম লক্ষ্য নয়। ইসরাইল নামক যে বিষফোঁড়া তারা তৈরি করেছে তাকে আরো হৃষ্টপুষ্ট করাটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। যেসব দেশকে পরাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তার মধ্যে ইসরাইলের বিষয়টি আড়াল করে রাখা হয়। অথচ গোপনে গোপনে ইসরাইল ইতোমধ্যে পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। তারা জাতিসংঘের সব নির্দেশ অমান্য করা ছাড়াও যেভাবে মারণাস্ত্র ও পারমাণবিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠেছে, তাদের মুখোমুখি হওয়া যে কোনো দেশের জন্য এখন রীতিমত দুঃস্বপ্ন। আরব দেশগুলো এতদিনে এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে। তারা জানে, ইসরাইলকে রুখতে না পারলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। এ কারণে আরব দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যকে ব্যাপক মারণাস্ত্র অস্ত্র বিধ্বংসী অঞ্চল ঘোষণা করতে জাতিসংঘে প্রস্তাব আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিরিয়ার উত্থাপিত এ প্রস্তাবটি নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার কৌশল। কেননা, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলে ইসরাইলকে তার যাবতীয় বিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস করতে হবে। যদিও এ প্রস্তাব কার্যকর সম্ভব হবে না; কিন্তু কূটনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে এমন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারাটায় বোঝা যায় আরব জাতির জ্ঞানের ভা-ার একদমই শূন্য হয়ে যায়নি।
আরব ও মুসলমানদের ঐতিহ্যের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ফিরিয়ে আনতে হলে অলৌকিক কিছুর আশায় বসে থাকলে চলবে না। এ জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষা-দীক্ষায়, সভ্যতায়, আÍসম্মানে গরীয়ান হতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য এখন থেকেই নিজেদের তৈরি করা প্রয়োজন। যেভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নামক ড্রাগনের খপ্পরে পড়ে সবকিছু বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর এ জন্য নিজেদের সীমিত সামর্থ্যরে পাশাপাশি কৌশল প্রয়োগ করে আস্তে-ধীরে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের মাটিতে মেধা ও প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ সম্ভব না হলে প্রয়োজনে পাশ্চাত্যের শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করে নিজের দেশের জন্য উৎসর্গীত-প্রাণ হতে হবে। এখন শুধু মারণাস্ত্রের সামনে বৃথাই জীবন দিয়ে ‘শহীদ’ হওয়ার চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, বীরত্বে ও সাহসিকতায় এগিয়ে যেতে হবে। গোপনে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে উত্তর কোরিয়াকে ঘাঁটাতে যুক্তরাষ্ট্রকে হাজারবার চিন্তা করতে হচ্ছে। কেননা, উত্তর কোরিয়া সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। অনুন্নত দেশগুলোকে উত্তর কোরিয়ার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও সামরিক শক্তিতে স্বনির্ভরশীল হয়ে প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে হবে। তাহলেই কেবল মাথা উঁচু করে আÍসম্মান নিয়ে পৃথিবীতে বসবাস করা যাবে। নতুবা বেছে নিতে হবে গোলামির জীবনÑ যে জীবন ‘মৃত’ ও অভিশপ্ত।
দৈনিক বাংলাবাজার : ৮ জুলাই ২০০৩



তবে কী আমরা পরাধীন হয়ে গেলাম!

যা কিছু সুন্দর, তার প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই হোক না কেন, সুন্দর কিংবা আকর্ষণীয় কিছু দেখলে মানুষ মুগ্ধ হয়। ইরাককে নিয়ে অনুভূতিপ্রবণ কিংবা সৌন্দর্যপিয়াসী যে কোনো মানুষই আবেগাক্রান্ত হয়ে যান। সভ্যতার সূতিকাগার এককালের মেসোপটেমিয়ার জলে-স্থলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সভ্যতা ও ইতিহাসের নানা নিদর্শন। দজলা ও ফোরাত নদের তীরে পৃথিবীর প্রথম সভ্যতার উন্মেষ ঘটায় তার কালস্রোত এখনো আমাদের উন্মনা করে দেয়। ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যানের সুরভি কিংবা বসরার গোলাপের সুগন্ধী আমাদের নাকে এসে লাগে ও চোখে ধরা দেয় অধরা স্বপ্ন হয়ে। ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ বাহিনীর আগ্রাসনে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনÑ ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর কথা ভেবে মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়। হালাকু খানরা যেভাবে ধ্বংস করেছিল বাগদাদ, তৈমুর লঙরা যেভাবে ইরাকিদের রক্তে লাল করেছিল দজলা নদীর পানি, তেমনিভাবে তাদের উত্তরসূরি জর্জ বুশ, টনি ব্লেয়াররা কী শেষ করে দেবে ইতিহাস ও সভ্যতার সব নিদর্শন? এমনটি যাতে না হয়, কায়মনোবাক্যে সে প্রার্থনা করেছিলাম। কিন্তু অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের আঘাতে যখন একের পর এক উড়ে যেতে থাকে কোনো শিশুর হাত, পা, চোখ কিংবা মাথা, তখন কীইবা মূল্য থাকে বসরার লাল গোলাপের, ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যানের কিংবা সভ্যতার নিদর্শনের?
জ্ঞান-বিজ্ঞানে, সভ্যতায় পৃথিবী অনেক দূর এগিয়েছে বলে দাবি করা হয়। ঠিক তখন সব নিয়ম-নীতি লংঘন করে, আসরিক শক্তি প্রয়োগ করে যখন জবর দখল করা হয় একটি দেশ, তখন শুধু সেই দেশ বা দেশের জনগণই পরাধীন হয়ে যায় না, পরাধীন হয়ে যায় দুনিয়ার তাবৎ শান্তিকামী মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত, ভয়ংকর ও বলদর্পী যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সাঙ্গাত এককালের ঔপনিবেশিক শক্তি যুক্তরাজ্য মধ্যযুগীয় আমলের রাজ্য দখলের মতো আমাদের সবার চোখের সামনে বলে-ক’য়ে ইরাকের ওপর অনৈতিক ও বীভৎস যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে মেতে ওঠে হত্যা ও ধ্বংসের উৎসবে। আমরা যারা দুর্বল ও অসহায়, তাদের ক্ষীণ কণ্ঠের প্রতিবাদ এবং দুর্বলের আরো দুর্বলতর প্রতিষ্ঠান ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’ জাতিসংঘকে উপেক্ষা করে তারা ইরাকি জনগণের ‘মুক্তিদাতা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ কেমন মুক্তিদাতা? যারা নির্বিচারে হত্যা করছে মানুষ, ধ্বংস করছে যাবতীয় অবকাঠামো, নষ্ট করছে সভ্যতার নিদর্শনগুলো। ইরাকি পতাকা নামিয়ে উত্তোলন করছে মার্কিন পতাকা। মার্কিন পতাকা কী ইরাকি জনগণের ‘স্বাধীনতার’ প্রতীক? ইরাক দখলের আগে জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়াররা বলেছিলেন, ইরাকি জনগণ মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনীকে ফুল ও মালা দিয়ে বরণ করে নেবেন। তেমনটি কি তিন সপ্তাহের যুদ্ধে কখনোই ঘটেছে? আধুনিক মারণাস্ত্রের বিপক্ষে দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে জীবনবাজি রেখে লড়াই করে ইরাকী জনগণ বুঝিয়ে দিয়েছেÑ পরাধীনতাকে তারা কখনো মেনে নেবে না। মেনে নেয়ওনি। এ কারণে বিক্ষিপ্তভাবে হলেও তাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম অব্যাহত আছে। মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনীকে তারা একটুও স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। বরং প্রতিরোধ সংগ্রামের তীব্রতা দিনে দিনে বাড়ছে। ইরাকিদের মনের কথাগুলো চমৎকার ভাষায় ব্যক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ট্রিবিউন পত্রিকার কলামিস্ট স্টিভ চ্যাপম্যান : ‘গণতন্ত্রের মর্মবাণী যদি হয়ে থাকে শাসকের কর্মকা- নিয়ন্ত্রণে সাধারণ জনগণের অধিকার, তবে জাতীয়তাবাদের মর্মবাণী হচ্ছে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণে জনগণের অধিকার। বাইরের কারো খবরদারি এতে চলবে না। ইরাকি জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের বাসনার চেয়ে জাতীয়তাবাদের তাড়না বেশি শক্তিশালী হওয়ায় বিদেশিদের উপনিবেশে পরিণত হওয়ার চেয়ে তারা বরং স্বদেশী অপশাসনের খপ্পরে পড়ে থাকার ভাগ্যবরণ করাই শ্রেয় মনে করে।’
সব আন্তর্জাতিক আইন, সভ্যতা আর মানবতাকে পায়ে দলে মার্কিন-ব্রিটিশ বাহিনী শুধু ইরাককে পরাধীনই করেনি, এর মাধ্যমে জর্জ বুশ ‘নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা’র নামে পৃথিবীব্যাপী গড়ে তুলছে ‘গণতান্ত্রিক উপনিবেশবাদ’। বুশের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষ নানাভাবে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করলেও তা একদমই পাত্তা পায়নি। কেননা, খুব কমসংখ্যক দেশের সরকারই ইরাকে আগ্রাসনের প্রতিবাদ করেছে। যারা করেছে, তাদেরও কণ্ঠ ছিল খুবই ম্রিয়মান। রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো একসময়ের শক্তিমান দেশগুলো ইরাকে যুদ্ধের প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও এক পর্যায়ে তাদের কণ্ঠও স্তিমিত হয়ে যায়। সবাই কম-বেশি নতজানু হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ইরাকের ওপর জাতিসংঘ আরোপিত দীর্ঘ ১৩ বছর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সংশোধিত প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদে অনুমোদন পেয়েছে। প্রস্তাবটি পাস হওয়ায় ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রশাসন ইরাকি তেলের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক বৈধতা পায়। এর মধ্য দিয়ে ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসনকেই বৈধতা দেয়া হয়েছে। একটি রাষ্ট্র হিসেবে টিম টিম করে আশার পিদিম হয়ে যেটুকু জ্বলছিল, তাও যেন শেষ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কাছে রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশগুলো এভাবে আÍসমর্পণ করবে, তা মোটেও ভাবা যায়নি। তাহলে আর ভরসার স্থল থাকে কোথায়? সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে পৃথিবীতে একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সে থেকে তাদের দোর্দ- দাপটে অসহায় হয়ে পড়েছে প্রতিটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। দেশে দেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা অলিখিতভাবে পালন করছে ‘দখলদার গভর্নর’-এর ভূমিকা। অভ্যন্তরীণ যে কোনো বিষয়ে তারা নাক গলায় অবলীলায়। কোনো কোনো দেশ তো নিয়ন্ত্রিত হয় সরাসরি তাদের তত্ত্বাবধানে। যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে একসময় সূর্য অস্ত যেতো না, সেই ব্রিটিশের প্রধানমন্ত্রী বলা যায় এখন জর্জ বুশের ‘ফরেন সেক্রেটারি’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইরাক দখল হয়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। সবার প্রশ্নÑ এর পরের টার্গেট কে? যে ক’জন সরকার প্রধান ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ আগ্রাসনের খোলস উন্মোচন করে ধিক্কার জানিয়েছেন, তাদের অন্যতম হলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। বেশ কিছুদিন আগে তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রতি হুমকিÑ এমন কোনো দেশকে শেষ করার মিশন নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালিয়েছে। একই সঙ্গে তারা চাইছে ইরাকের তেলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক যুদ্ধে জয়লাভ করলে অন্যান্য দেশ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী টার্গেট সিরিয়া, পাকিস্তান ও ইরান।’ মাহাথির মোহাম্মদের বক্তব্যে স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থে
কাউকেই স্বস্তিতে থাকতে দেবে না। একের পর এক তারা তাদের টার্গেট পূরণে এগিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনকে যদি নীরবে মেনে নেয়া হয়, তাহলে সবাই কি এক ধরনের পরাধীন নয়? তাছাড়া পরাশক্তির কর্ণধার জর্জ বুশ হুংকার দিয়ে যখন বলে, ‘হয় আমাদের পক্ষে থাক, নতুবা বিপক্ষে যাও’; তখন যারা শক্তিহীন, তারা এক ধরনের অসহায় আÍসমর্পণ করে বসে থাকে পরাধীনতার গ্লানি নিয়ে। যদিও পরাধীনতার নাগপাশে বন্দি হয়ে অক্ষম মানুষের মতো বুকের মাঝে জ্বলতে থাকে ক্রোধ আর ক্ষোভের আগুন।
আমাদের মতো দেশ ও দেশের মানুষ না হয় পরাধীনতা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কিন্তু মার্কিন ও ব্রিটিশ জনগণ কি স্বাধীন? ইরাকি যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ প্রশ্নটি তীব্রতর হয়ে উঠেছে। আমরা বাক-স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও মূল্যবোধহীনতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও মার্কিন ও ব্রিটিশ জনগণের জীবনে উদারতা, গণতান্ত্রিকতা ও মানবতার প্রতিফলন দেখতে পেয়ে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। ভেবেছি, সভ্যতার অর্জনগুলো কোথাও না কোথাও কার্যকর হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে আমরা পাঠ নিচ্ছি সাম্য, মৈত্রী ও গণতন্ত্রের। বুঝতে শিখছি সভ্যতার মাপকাঠি। কিন্তু ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ যৌথ বাহিনীর আগ্রাসনে যেন ধস নেমেছে যাবতীয় মূল্যবোধে। ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির ব্রিটিশ এমপি জর্জ গ্যালাওয়ে যখন তীব্র ও ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ইরাকে বাক-স্বাধীনতা চান, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চান না’, তখন কেঁপে ওঠে সভ্যতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। ব্রিটিশ ও মার্কিন কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বাক-স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বিষয়টি বরাবরই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। তাদের প্রতিবাদে কেঁপেছে সরকার ও রাষ্ট্র। আর এখন যুদ্ধ বা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা ও হাউস অব কমন্সের নেতা শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিক রবিন কুক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফিলিপ হান্ট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জুনিয়র মন্ত্রী জর্জ ডেনাস, এমপি জর্জ গ্যালাওয়ের মতো ব্যক্তিত্বরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিগৃহীত হয়েছেন, সত্য কথা বলায় চাকরিচ্যুত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি টেলিভিশনের পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া সাংবাদিক পিটার আর্নেট, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলায় নাজেহাল হতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সঙ্গীত শিল্পীকে। যে বিবিসি, সিএনএন-এর মতো আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম সবার কাছে ছিল আস্থা ও বিশ্বাসের অবলম্বন, তাতেও এখন দারুণভাবে চিড় ধরেছে। ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ আগ্রাসনে মানুষের যা কিছু অর্জন, তা যে এভাবে ভেঙ্গে পড়বেÑ তা ছিল সত্যিই অভাবনীয়। বিশ্বখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘অবাক লাগে এটা কী সেই আমেরিকা, যাকে আমরা সন্তুষ্ট চিত্তেই অনেক বিষয়ে প্রাধান্য দিয়েছি?’ তার মানে কি এই নয় যে, পরাধীনতার শিকলে আটকা পড়েছে বোধ, বুদ্ধি ও বিবেচনাসম্পন্ন মানুষও।
যা কিছু ভালো, তার পক্ষে বলা এবং যা কিছু মন্দ, তার নিন্দা জানানো যদি অসম্ভব হয়ে পড়ে, তাহলে তো সব মানুষই পরাধীন হয়ে যায়। ছোট কিংবা বড়Ñ যে কোনো দেশের অধিবাসী যেভাবেই হোক না কেন, সবাই এখন এক পরাধীন বিশ্বের নাগরিক।
দৈনিক বাংলাবাজার : ১৪ জুলাই ২০০৩


মোবাইল ফোন কতটা নিরাপদ

পাঁচ তারকা হোটেলের লবিতে সুসজ্জিতা ঝলমলে এক মধ্য বয়সী ভদ্রমহিলা আয়েশী ভঙ্গিতে একাকী বসে আছেন। কিয়ৎ দূরে বসা স্যুটেড-ব্যুটেড মধ্যবয়সী এক সুবেশী ভদ্রলোক। এমন সময় ভদ্রমহিলা রোমান্টিক কণ্ঠে ফিস ফিস করে বলতে থাকেন : আর ইউ ফ্রি টু নাইট? সামনে বসা ভদ্রলোক ভাবলেন, বুঝিবা তাকেই প্রশ্ন করা হয়েছে। টাইয়ের নট ঠিকঠাক করতে করতে স্মার্ট ভঙ্গিমায় ভদ্রমহিলার কাছে যেয়ে চাপা খুশি নিয়ে বিনীতভাবে জানতে চাইলেন, মী! ভদ্রমহিলা একটু কটাক্ষ হেনে তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে ভদ্রলোককে হোটেলের ওয়েটার মনে করে বললেন, ওয়ান ব্ল্যাক কাপ কফি, প্লিজ! তাকে ওয়েটার মনে করায় ভদ্রলোক দারুণভাবে বিব্রতবোধ করতে থাকেন। আসলে ভদ্রমহিলা মোবাইল ফোনে অন্য একজনের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছিলেন, মনে হচ্ছিল তিনি বুঝি সামনে বসা ভদ্রলোককে অ্যাপ্রোচ করছেন। এটা একটি মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন।
সাড়া জাগানো এই বিজ্ঞাপনের মতো মোবাইল ফোনকে কেন্দ্র করে ইদানীং ঘরে-বাইরে কিংবা পথে-ঘাটে নানাভাবে মানুষজন বিব্রত হচ্ছে। মোবাইল ফোনের সংখ্যা দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে এর জনপ্রিয়তার উত্তাপ সহজেই অনুভব করা যায়। এখন সর্বস্তরের মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। কেউ যদি কান চুলকাতে থাকেন, তাতেও মনে হয় বুঝিবা তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। মোবাইল ফোন এখন আর শুধু স্ট্যাটাস সিম্বল নয়, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির অনন্য বিস্ময় মোবাইল ফোনের এই প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদ বিশ্বের মানুষের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। ২০০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের কমপক্ষে ২০০ মিলিয়ন লোক মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন বলে এক সমীক্ষায় জানানো হয়। এ সংখ্যা দ্রুত বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ এ থেকে পিছিয়ে থাকবে কেন? ইতোমধ্যে বাংলাদেশের চারটি মোবাইল ফোন কোম্পানির গ্রাহক সংখ্যা তের লাখ ছাড়িয়ে গেছে। যোগাযোগের জন্য জনগণের প্রিয় বাহন মোবাইল ফোন, যা পাশ্চাত্যে সেল ফোন হিসেবে পরিচিত। মোবাইল ফোনের উপকারিতা অবশ্যই আছে। বদলে দিচ্ছে অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা। মোবাইল ফোন আসার আগে বাংলাদেশে ব্যবহৃত হতো অ্যানালগ ফোন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এ ফোন পেতে মানুষকে বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকতে হয় চাতক পাখির মতো। যেন এটা এক অমূল্য সম্পদ। সহজে মানুষের হাতে পৌঁছে গেলে ক্ষতি হয়ে যাবে দেশ ও দশের! আনুমানিক হিসাবে জানা যায়, এই কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের প্রতি এক হাজার লোকের মধ্যে মাত্র তিনজনের এই ফোন ছিল। বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ফোনের ব্যবহার ছিল খুবই সীমিত পরিসরে। আর এখন এ সংখ্যা দারুণভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। বেসরকারি পর্যায়ে উন্মুক্ত করে দেয়ার পর মোবাইল ফোন ঢুকে পড়েছে অজপাড়াগাঁয়ে। অবশ্য এক/দু’জন দুস্থ মহিলা বা কৃষকের হাতে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিয়ে তাকে যেভাবে বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে, তেমনটি না হলেও এই ফোন সবার মাঝে উন্মুক্ত করে দেয়ার পর খুলে গেছে যোগাযোগের দুয়ার। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে অনায়াসে কথোপকথন কিংবা তথ্য আদান-প্রদান করা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, চলতে চলতে কিংবা কাজে ডুবে থেকেও কথা বলতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। মোবাইল ফোন সবার জীবনে নিয়ে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের হাওয়া।
সূর্যটা সবে ডুবছে। সন্ধ্যা আসি আসি করছে। এমন সময় আপনার ব্যক্তিগত কারে লং ড্রাইভে কোথাও যেতে ইচ্ছে হলো। পাশে বান্ধবী বা সদ্য বিবাহিত স্ত্রী। সিডিতে ধীরে ধীরে বাজছে ম্যাডোনার কোনো রোমান্টিক গান। পীচ-ঢালা পথের দু’পাশে সবুজের নিসর্গ। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। মাতাল করা অনুপম পরিবেশ। এমন সময় মোবাইল ফোনটি গুনগুনিয়ে উঠলো। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে আবেগময় কণ্ঠে মেতে উঠলেন কথোপকথনে। সব মনোযোগ তখন মোবাইল ফোনে। এমন সময় চলমান কারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নির্জন কোনো স্থানে দুর্ঘটনার শিকার হলেন। সাহায্য করার মতো আশপাশে তখন কেউ নেই। অথচ গুরুতর আহত অবস্থা থেকে উদ্ধার না পেলে অনিবার্য মৃত্যুর হাতছানি। এমন সময় হাতের মধ্যে ধরা অক্ষত মোবাইল ফোনটি প্রিয় বন্ধুর মতো আপনার দিকে হাত বাড়িয়ে দেবে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আপনি উদ্ধার পেতে পারেন। মোবাইল ফোনটা আপনার বন্ধু এবং শত্রু দুটোই। মোবাইল ফোনে নিমগ্ন না হলে দুর্ঘটনাটি ঘটতো না। আবার মোবাইল ফোনটি কাছে না থাকলে মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শও ছুঁয়ে যেতে পারতো।
নতুন কোনো প্রযুক্তি এলে আমরা দ্রুত তার প্রেমে মজে যাই। কিন্তু এর বিপরীত দিকটা কখনো ভেবে দেখতে চাই না। মোবাইল ফোন একদিকে আমাদের জীবনকে যেমন দ্রুতগামী করেছে, অন্যদিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন মোবাইল ফোন ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। এমনকি এ থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। আমরা যে কোনো শব্দ শুনি, তার উৎস শব্দতরঙ্গ। কানের ভেতরে এয়ার ড্রামের সঙ্গে সংযুক্ত ছোট ছোট তিনটি হাড়ের সাহায্যে শব্দতরঙ্গ মস্তিষ্কে পৌঁছায়। মোবাইল ফোনে ফ্রিকোয়েন্সির কারণে কম্পনের সৃষ্টি হয়। এ কম্পন একটি শক্তি। তবে মোবাইল ফোনে স্বল্প মাত্রার ফ্রিকোয়েন্সির চেয়ে বেশি মাত্রার ফ্রিকোয়েন্সিগুলো মারাÍক। ক্রমাগত শব্দতরঙ্গে যে তাপ উৎপন্ন হয়, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কানের শ্রবণ সহায়ক টিস্যু। প্রাথমিক অবস্থায় হেয়ারিং নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানুষ কানে কম শোনে, কানের মধ্যে ঝিঁ ঝিঁ শব্দ হয়, মাথা ঘোরায়, বসা থেকে দাঁড়ালে মাথা চক্কর মারতে থাকে ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে যেটি মারাÍক, তাহলো হেয়ারিং নার্ভের সঙ্গে মস্তিষ্কে অবস্থিত হেয়ারিং সেন্টারের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। ফ্রিকোয়েন্সি থেকে ক্রমাগত শব্দতরঙ্গ হতে থাকলে তা মস্তিষ্কের হেয়ারিং সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত করে। মস্তিষ্কের কোনো কোষ একবার নষ্ট হলে তা আর ঠিক হয় না। মোবাইল ফোন ব্যবহারজনিত বিপর্যয় অনেকটা এক্স-রে’র বিকিরণজনিত ক্ষতির সমতুল্য। একবার এক্স-রে এক্সপোজারের বিকিরণে হাজার হাজার সেল নষ্ট হয়ে যায়। ইট-পাথর দিয়ে যেমন বাড়ি তৈরি করা হয়, তেমনিভাবে সেল দিয়ে গঠিত হয় মানব দেহ। মস্তিষ্কের কোনো কোষ (ব্রেন সেল) ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকলে তা ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। ক্যান্সার ছাড়াও মস্তিষ্কের কোনো অংশ অকেজো হয়ে গেলে আস্তে-ধীরে অথর্ব কিংবা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। তবে যারা শক্তিশালী ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার এবং সার্বক্ষণিকভাবে মোবাইল ফোনে কথা বলে থাকেন, মূলত তারাই এর ভয়ানক শিকারে পরিণত হন।
বিশ্বের কোটি কোটি লোক ব্যবহার করছে মোবাইল ফোন। তাদের মধ্যে প্রতি বছর হাজার হাজার লোক আক্রান্ত হচ্ছে ব্রেন ক্যান্সারে। যে যুক্তরাষ্ট্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শীর্ষে অবস্থান করছে এবং যেখানে একটি জীবনের মূল্য অপরিসীম, সেখানেও মোবাইল ফোনের কারণে প্রতি এক লাখে ৬ জন ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত স্বাস্থ্যের ওপর মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর প্রভাবের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। ফ্লোরিডার একজন বাসিন্দা ডেভিড রেনার্ড আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন যে, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তার স্ত্রী আক্রান্ত হয়েছেন মারাÍক ব্রেন ক্যান্সারে। কিন্তু আদালতে উপযুক্ত বৈজ্ঞানিক নমুনা তুলে ধরতে না পারায় ১৯৯৫ সালে ফেডারেল কোর্ট তার মামলা খারিজ করে দেন। তবে আদালতে মোবাইল কোম্পানির সওয়াল-জবাবও সন্তোষজনক ছিল না। যে কারণে আদালত তাদেরকে সাবধানতা অবলম্বনের নির্দেশ প্রদান করেন। পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যত্র মোবাইল ফোনের ব্যবহারের সঙ্গে বিকিরণ ও ক্যান্সারের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হয়। মামলা খারিজ হওয়ার পর দীর্ঘদিন চেষ্টা চালিয়ে ডেভিড রেনার্ড বৈজ্ঞানিক নমুনাসহ পুনরায় আদালতে মামলা উত্থাপন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্র্যামে বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে তারবিহীন যোগাযোগ করা হয়। মূলত দুটি ফ্রিকোয়েন্সিতে যুক্তরাষ্ট্রে মোবাইল ফোন পরিচালিত হয়। পুরনো সিস্টেমটি হচ্ছে, ৮৫০ মেগাহার্জ এবং নতুন পার্সোনাল কমিউনিকেশন্স সার্ভিস অর্থাৎ পিসিএস-এ প্রায় ১৯০০ মেগাহার্জ। ইউরোপীয়রা একটি ভিন্নধর্মী প্রযুক্তি এবং কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে থাকে। তাদের পদ্ধতি হচ্ছে, গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল কমিউনিকেশন্স (জিএসএম)। তাছাড়া অ্যানালগ হ্যান্ডসেট ফোনে বিকিরণ হয় মাত্র ৬০০ মেগাওয়াট কিংবা তার চেয়েও কম। অনেক ডিজিটাল মডেল ফোন উৎপন্ন হয় ১২৫ মেগাওয়াটে। এ কারণে অ্যানালগ ফোন তেমন কোনো ক্ষতিকর নয়। কিন্তু মোবাইল ফোন নিয়ে আদালতে মামলা হওয়ার পর তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত রয়েছে। মোবাইল কোম্পানিগুলো এর পেছনে ব্যয় করেছে কোটি কোটি ডলার। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করে, একটানা খুব বেশি ব্যবহার না করলে মোবাইল ফোন তেমন ক্ষতির কারণ নয়। এমন একটি তথ্য ১৯৯৯ সালের নভেম্বর প্রকাশিত হয় আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে। কিন্তু সুইডিশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের অর্থায়নে সুইডেনের বিজ্ঞানী লেনার্ট হার্ডেল ও তার সহযোগীরা পরীক্ষা চালিয়ে দেখতে পান, ৪২৫ জন স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তির তুলনায় মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ২০৯ জন সুইডিশ ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়েছেন। সিয়াটলের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের হেনরি লেই ও তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে তারা মোবাইল ফোনের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির বিকিরণ থেকে ক্ষতিকর প্রভাব দেখতে পেয়েছেন। এর ফলে মস্তিষ্কের কোষের ডিএনএ ভেঙ্গে যায়। তাতে ক্যান্সারের সম্ভাবনা থেকে যায়। কানাডিয়ান টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে ওয়ারলেস টেকনোলজি কমিউনিকেশন্সের সাবেক প্রধান কার্লো বলেছেন, যারা তারবিহীন ফোন ব্যবহার করেন, তাদের মস্তিষ্কের ক্যান্সারে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষিতে এগিয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে গলা ও মাথায় ক্যান্সার হয় কিনাÑ তা ব্যাপকভিত্তিক পরীক্ষা করার জন্য ইউরোপীয় কমিশন ৮০ লাখ ইউরো দিয়েছে ফ্রান্সের দ্য ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অব ক্যান্সারকে। তবে ১০টি দেশ এই সমীক্ষায় অংশ নেবে। তিন বছরের মধ্যে এই সমীক্ষা শেষ করতে হবে। এছাড়া শরীরের ওপর মোবাইল ফোনের প্রভাব নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও যুক্তরাষ্ট্রে ১০০ মিলিয়ন ডলারের পরীক্ষা চালাচ্ছে।
মোবাইল ফোন থেকে কানের সমস্যা, ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগ থেকে রেহাই পেতে সাময়িকভাবে একটি নতুন ধরনের ডিভাইস তৈরি করা হয়েছে। এই ডিভাইস যারা ব্যবহার করেন না, তারা ব্যবহারকারীদের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি ক্যান্সার ও অন্যান্য সমস্যায় আক্রান্ত হন। কিন্তু এই ডিভাইস মূলত পাশ্চাত্য দেশগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশে তো কোনো কিছুরই যথাযথ সমীক্ষা হয় না। সবকিছুই কল্পিত ধারণা দিয়ে নিরূপণ করা হয়। যে কারণে যে কোনো তথ্য পাওয়া খুব কঠিন। তবে ইদানীং ইএনটি (নাক-কান-গলা) চিকিৎসকদের অবস্থা রমরমা হয়ে উঠেছে। যদিও এ নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি, তদুপরি কিছু রোগী ও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের কান ও কানকে কেন্দ্র করে আনুষঙ্গিক সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। আমাদের দেশে কী ধরনের মোবাইল ফোন ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এর ক্ষতিকারক প্রভাব কী, তা জানা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর ভূমিকাও স্বচ্ছ নয়। মোবাইল ফোন বন্ধু, না নীরব ঘাতকÑ তা জরুরিভিত্তিতে নিরূপণ করা প্রয়োজন। কেননা, মোবাইল ফোনের যদি ক্ষতিকর প্রভাব থেকে থাকে, তাহলে আমাদের জাতীয় জীবনে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে, তা থেকে খুব সহসা পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না। বিভিন্ন দেশে যেহেতু নানা গবেষণা ও সমীক্ষায় এটা অন্তত প্রমাণিত হয়েছে যে, মোবাইল ফোনে অতিরিক্ত কথা বলা শরীরের জন্য ক্ষতিকর, সেক্ষেত্রে এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আপনি কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কিংবা আদৌ হচ্ছেন কি না, সে বিষয়ে আধুনিক প্রযুক্তিতে আপনাকে সাহায্য করতে পারে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্ট্যাবিলাইজার ৗই*ঊ*ইৗ. আপনি যদি তাদের একটি প্রশ্নমালার ছক পূরণ করে পাঠান, তাহলে দু’মিনিটের মধ্যে পেয়ে যাবেন আপনার কাক্সিক্ষত উত্তর। যোগাযোগ করুন এই ই-মেইলে : র্র্দয://ষষষ.রটঢটর৩.ডমব/ ণফণর্ডরমবটথভর্ণধড-রটঢধর্টধমভর্-র্ণ্র.র্দবফ.
দৈনিক বাংলাবাজার : ২৩ জুলাই ২০০৩
কেন রাজনীতি নয়

পলিটিক্স মানে
রাজনীতি নয়,
পলিটিক্স মানে
ভাঁওতা
পলিটিশিয়ান
ডিম পেড়ে বলে
দুই চোখ বুজে
দাও তা’।
আমরাও তাই দিলাম
তাইতো আমার ঘটি-বাটি
সব হয়েছে নিলাম।

১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত সাহিত্য সংকলন ‘আবাহন’-এ বর্তমানে কানাডা প্রবাসী বিশিষ্ট ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ‘পলিটিক্স’ শিরোনামে এ ছড়াটি লিখেছিলেন। প্রায় দু’দশক আগে লেখা এ ছড়ার ছত্রে ছত্রে রাজনীতির প্রতি অনাস্থা ও অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছিল। অবশ্য পরবর্তীকালেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে।
ইদানীং রাজনীতির কথা শুনলে অনেকেই নাক সিঁটকে ওঠেন। সবাই রাজনীতিবিদদের সন্দেহের চোখে দেখেন। সবার মনোভাবটা এমন, এ দেশের সর্বনাশ করছে রাজনীতিবিদরা। রাজনীতিবিদরা যে ধোয়া তুলশি পাতাÑ এ কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। সে দায়ও আমার নয়। কিন্তু রাজনীতিবিদরা দূরের কোনো গ্রহের বাসিন্দা নন। তারা আমাদেরই নিকটজন। কিন্তু তাদের সঙ্গে সমাজের অন্যান্য মানুষের মধ্যে একটা ব্যবধান গড়ে উঠেছে। নেতিবাচক কর্মকা-ের কারণে তাদের ভাবমূর্তি আজ তলানিতে ঠেকেছে। অধিকাংশই মানুষ তাদের বিশ্বাস করেন না। তাদের কাছে কিছু প্রত্যাশাও করেন না। কিন্তু কেন? দেশের নিয়ন্তা তো রাজনীতিবিদরা। দেশ কীভাবে চলবে, কোথায় যাবেÑ তার দায়ভার রাজনীতিবিদদের। সঠিক নেতৃত্ব, সঠিক নির্দেশনা দেবেন রাজনীতিবিদরা। রাজনীতিকরা ছাড়া দেশ পরিচালনা কি সম্ভব? তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে কেন রাজনীতি থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি? রাজনীতি তো করবেন দেশের মেধাবী, ত্যাগী, নিঃস্বার্থ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা। কিন্তু আমরা তো উল্টোটাই দেখতে পাচ্ছি। যাদের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কথা, তারা না হয়ে যারা রাজনীতির জঞ্জাল হিসেবে পরিচিত, তারাই এখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন। কেন এমন হচ্ছে?
একজন রাজনীতিবিদকে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা-শ্রম-মেধা-আÍত্যাগ করে রাজনীতির পথে হাঁটতে হয়। যিনি রাজনীতিবিদ হবেন, তাকে আজীবন ত্যাগী হতে হয়। গরিবদের দুঃখ-দুর্দশায় বেদনার্ত এবং দেশ ও আর্তের সেবায় মন-প্রাণ সঁপে দিতে হয়। সবরকম সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন এড়িয়ে চলতে হয়। সৎ ও সত্যের পথে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে হয়। তাকে পথভ্রষ্ট করার জন্য কিংবা প্রশাসনিকভাবে হয়রানি, জেল-জুলুম ও নির্যাতন সইতে হয়। অর্থাৎ কিছু পাওয়ার আশা না করে জীবনভর কষ্টকর জীবনযাপন করতে হয়। থাকতে হয় আশ্চর্য আÍত্যাগ, দৃঢ়চেতা মনোবল ও বীরত্ব।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি, রাজনীতিবিদদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, ভালোবাসা। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে মানুষের সমস্যা-সংকটে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সহজেই তাদের মন জয় করে নিয়েছেন। বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। দ্বীপান্তরিত হয়েছেন। অনশন করেছেন। দেশের মানুষের মুক্তির ব্রত নিয়ে হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন। যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট সয়েছেন। নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। এমনকি জমিদার নন্দনরাও নিশ্চিত সুখ-শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে রাজনীতির পিচ্ছিল পথকে অনায়াসে স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। কেউ ব্যারিস্টারি পড়ে, কেউবা মাঝ পথে ব্যারিস্টারি পড়া ছেড়ে দিয়ে কিংবা আরাম-আয়েশের জীবন পরিত্যাগ করে দুঃখ-কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছেন। কোনো পিছুটান তাদের রুখতে পারেনি। জীবনভর গেয়েছেন মানবতার গান। যাপন করেছেন কঠিন ও কষ্টকর জীবন। কখনো-সখনো মুষড়ে পড়েছেন; কিন্তু ভেঙে পড়েননি। আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন। সেই স্বপ্ন ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার নয়। সাধারণ মানুষের মুক্তির স্বপ্ন। সাহসী, বলিষ্ঠ, প্রতিবাদী ও মেধাবীরা রাজনীতির মঞ্চে এগিয়ে এসেছেন। যেখানে কোনো অন্যায়, অবিচার, অসত্য, জুলুম ও আইনের লঙ্ঘন দেখেছেন, তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে ছুটে গেছেন। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে প্রতিবাদ করেছেন। আন্দোলন করেছেন। মিছিলের পুরোভাগে নেতৃত্ব দিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা-আন্দোলনের প্রতীক। সমাজের সম্মানজনক ব্যক্তিরা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সব রাজনীতিবিদই যে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে থেকেছেন, এমনটি হয়তো নয়। কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিল সীমিত। সাধারণ মানুষ তাদের বাঁকা দৃষ্টিতে দেখতে। কিন্তু সত্যিকার রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের ভালবাসা ছিল অপরিসীম। রাজনীতিবিদদের কথায় নিজের জীবনকে তুচ্ছ ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জনও দিয়েছেন। দেশ ও দশের মঙ্গলের জন্য যা করা প্রয়োজন, তা করতে রাজনীতিবদরা মোটেও পিছপা হননি। সেই ব্রিটিশ আমলের পরাধীনতা থেকে শুরু করে আজ অবধি প্রকৃত রাজনীতিবিদদের মানুষের ব্যথা-বেদনায় এগিয়ে যেতে দেখেছি। কখনো-সখনো কিছু করতে না পারার যন্ত্রণায় তারা মর্মযাতনা অনুভব করেছেন। নীরবে চোখের অশ্রু ফেলেছেন। তবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ত্যাগী ও নিঃস্বার্থ রাজনীতিবিদদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। প্রলোভনের নানা ফাঁদ থাকা সত্ত্বেও তারা পরাধীনতার শৃ´খল ভাঙ্গার জন্য জীবনপণ করে লড়েছেন। এর মাঝে কেউ কেউ ব্রিটিশের গোলামি করে সুযোগ-সুবিধার পথ বেছে নিয়েছেন, খেতাব কুড়িয়েছেন। কিন্তু তারা হারিয়ে গেছেন কালের অতল গহ্বরে। কিন্তু যেসব বিপ্লবী সীমিত সাধ্যের মাঝেও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম করেছেন এবং ব্রিটিশদের দেশত্যাগে বাধ্য করেছেন, তারা ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। সত্য ও ন্যায়ের পথে তাদের যে সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষা, তা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করেছে। অন্তত তাদের আদর্শকে অনুসরণ করা সম্ভব না হলেও বুকের মাঝে অনির্বাণ হয়ে জ্বলেছে আদর্শের আলোকবর্তিকা। যে কারণে অন্যায় ও অসত্যের মাঝে কখনোই তলিয়ে যায়নি আদর্শের নিরন্তর পতাকা।
ব্রিটিশের জিঞ্জির ছিন্ন করার ব্রত নিয়ে আর অত্যাচার, বেয়নেট, গুলিকে তুচ্ছ করে কত শত প্রাণ যে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছেন, তার কোনো হিসাব নেই। ১৭৬০ সালে স্বাধীনচেতা নবাব মীর কাশিম প্রতিরোধের প্রথম যে মশাল জ্বালান, তারই পথ বেয়ে ১৭৯৯ সালে মহীশুরের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতানের বীরত্বসূচক আÍত্যাগ, ১৮৩১ সালে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার প্রতিরোধ, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ গোরাদের কামানের গোলায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও জীবনের প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া তারা করেননি। আÍত্যাগ ও বীরত্বে মহিমানি¦ত হয়ে আছেন তারা ইতিহাসের পাতায়। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সৈনিক, তাদের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছেন ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, শ্রী অরবিন্দ, বারীন্দ্র ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, ভগৎ সিং, রাসবিহারী বসু, বাঘা যতীন, মাস্টার দা সূর্যসেন, বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্ত, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, অশ্বিনীকুমার দত্ত, সুভাষ বোস, মাতঙ্গিনী হাজরা, চট্টগ্রামের বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ এক ঝাঁক সাহসী সন্তান। এরা ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা সংগ্রামে। পরাধীন জাতির বেদনা অন্তর দিয়ে অনুভব করে তারা উৎসর্গ করেন নিজেদের জীবন। এদের মধ্যে কারো ফাঁসি হয়, কেউ কারাবন্দি হওয়ার পরিবর্তে নিজের পিস্তলে আÍহত্যা করেছেন, কেউ দীর্ঘ অনশন করে আÍাহুতির পথ বেছে নিয়েছেন, কেউ লড়াই করে প্রাণ দিয়েছেন, নির্মম অত্যাচারে অকালে নিভে গেছে কারো কারো প্রাণ প্রদীপ, কেউবা কারাবরণ কিংবা দ্বীপান্তরিত হয়েছেন। এরা দেশকে পরাধীনতার শৃ´খল থেকে মুক্ত করার জন্য রাজনীতি করেছেন। রাজনৈতিক কারণে তারা জীবনের শুরুতে, তারুণ্যে বা যৌবনে এমন এক কঠিন ও দুরূহ পথে আÍনিবেদন করেন, অনেক ক্ষেত্রেই সে পথ থেকে আর ফিরে আসার কোনো সুযোগ ছিল না। অথচ ব্রিটিশরা এসব বিপ্লবীকে নানারকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রাজনীতির পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া এবং রাজনীতির নামে সুবিধাবাদী করে তোলার সর্বাÍক চেষ্টা চালিয়েও সফল হননি। কেননা, যার অন্তরে একবার দেশপ্রেমের অনির্বাণ শিখা জ্বলে ওঠে, তাকে কখনোই প্রলোভনের ফাঁদ পাতা ভুবনে আটকে ফেলা যায় না।
১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর ব্রিটিশদের শাসন-শোষণ-নির্যাতনের অবসান ঘটলেও পাকিস্তান নামক দেশটিতে শুরু হয়ে যায় তারই ধারাবাহিকতা। কিছুদিন যেতে না যেতেই ভেঙ্গে যায় পূর্ববঙ্গের মানুষের সুখস্বপ্ন। তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় বিজাতীয় ভাষা উর্দু। শুরু হয়ে যায় ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমিয়ে রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা বেছে নেয় অবর্ণনীয় নৃশংস অত্যাচার, নিপীড়ন ও হত্যাকা-। ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষার জন্য জীবন দেন রফিক, শফিক, ছালাম, বরকতসহ নাম না-জানা অসংখ্য ভাষা সৈনিক। নির্যাতন ও নির্বিচারে গ্রেফতারের শিকার হন হাজার হাজার ভাষা আন্দোলনকারী। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়ে যায় শাসন-শোষণ-নির্যাতন। ১৯৫০ সালে নাচোল বিদ্রোহের সময় ইলা মিত্রের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন, ১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৬৬ সালে ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে কৃষক নেতা আসাদুজ্জামান নিহত হলে জনতা গর্জে উঠলে তা রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। ২৪ জানুয়ারি বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি চালালে নিহত হয় নবকুমার স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিয়ুর রহমান। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে, ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে নির্মমভাবে হত্যার পর এগিয়ে যেতে থাকে স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তির সংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষের আÍাহুতি ও ২ লাখ মা-বোনের নির্যাতনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। তবে এ ২৪ বছরে পাকিস্তানি বাহিনী ও বিহারিরা নির্যাতনের যে ইতিহাস গড়েছে, তার নজির পৃথিবীতে খুবই কম আছে। বিশেষ করে যারা ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সর্বোপরি এ দেশের মানুষের সব রকম মুক্তির আন্দোলনে অংশ নিয়ে জনগণের জন্মগত অধিকার, গণতান্ত্রিক ও ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, তারা সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। তবে পাকিস্তানের ২৪ বছরের আন্দোলনে যত লোক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন, আÍত্যাগ ও বীরত্ব দেখিয়েছেন এবং জীবন উৎসর্গ করেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দেশ ও আর্তের সেবায় যেভাবে নিজের জীবন বিলীন করে দিয়েছেন, তার বিনিময়ে তারা শুধু চেয়েছেন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। অনেক স্বেদ-ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে পেয়েছেন লাল-সবুজের বাংলাদেশ। অথচ এ দেশেরই অনেক লোক চায়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। চাননি মানুষের মুক্তি। বরং স্বাধীনতার বিরোধিতা করে ইহজীবনে ফায়দা লুটেছে। কিন্তু ইতিহাসের কাছে তারা চিরদিন ঘৃণিত হয়ে থাকবে। পাকিস্তান আমলে যারা দেশের জন্য রাজনীতি করেছেন, আÍত্যাগ করেছেন, জীবন উৎসর্গ করেছেনÑ তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম। তাদের জীবন, সংগ্রাম থেকে যে দীক্ষা তারা নিয়েছিলেন, পাকিস্তানের বিপক্ষে আন্দোলনে, সংগ্রামে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বদলে যেতে থাকে রাজনীতির ধারা। ধীরে ধীরে কলুষিত হতে থাকে রাজনৈতিক পরিবেশ। সমাজবিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই এর কারণ খুঁজে বের করবেন। কেন বাংলাদেশের রাজনীতি আজ নষ্ট ও পথভ্রষ্ট হয়ে গেছেÑ তার অনেক কারণ রয়েছে। তবে একটি মহল রাজনীতিকে কলুষিত করার জন্য ভেতরে-বাইরে অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এবং এর ধারাবাহিকতায় ব্যাঘাত ঘটানোর কারণে রাজনীতির প্রতি সেই নিঃস্বার্থ আÍত্যাগ, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে নিঃস্বার্থ সংগ্রাম হারিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির বিপক্ষ শক্তি অবৈধভাবে ঢালাও অর্থের ব্যবহার করে প্রকৃত রাজনৈতিক অঙ্গনকে নষ্ট, রাজনীতিবিদদের বিভ্রান্ত এবং অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের রাজনীতির আঙ্গিনায় টেনে আনায় রাজনীতির স্বাভাবিক ধারা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। যে কারণে এখন মানুষ রাজনীতির কথা শুনলেও আঁতকে ওঠেন। কিছু দুর্বৃত্ত মানুষের জন্য বলি হচ্ছে রাজনীতি।
প্রতি বছর হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়। এদের মধ্যে যারা মেধাবী অর্থাৎ মেধা তালিকায় শীর্ষে থাকে, তাদের সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় দেদারছে ছাপা হয়। তাদের সাফল্যের নেপথ্য কাহিনী, পছন্দ-অপছন্দ, ভবিষ্যতে কী হতে চায় ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, যখন থেকে পত্র-পত্রিকায় মেধাবীদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়ে আসছে, তখন থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাদের সবাই প্রকৌশলী, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, সামরিক কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তা প্রভৃতি হতে চাইলেও রাজনীতিবিদ হতে চেয়েছেÑ এমনটি চোখে পড়েনি। যদিও দু’একজন হতে চেয়েও থাকে, তার সংখ্যা এত নগণ্য যে, তা হিসাবের খাতায় ফেলা যায় না। রাজনীতিবিদ তো হতেই চায়নি; বরং তাদের বক্তব্যে রাজনীতির প্রতি এক ধরনের অনীহা, অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। যেন রাজনীতি করাটা একটা অন্যায় ও গর্হিত কাজ। এই যদি হয় দেশের সেরা মেধাবী ছাত্রদের চিন্তা-ভাবনা, তাহলে এ দেশের ভবিষ্যৎ কী? কেননা, রাজনীতিবিদরা হলেন দেশের নীতি-নির্ধারক। তাদের কথামত দেশ চলবে। যেসব মেধাবী ছাত্র শিক্ষা জীবন শেষে কর্মজীবনে বিভিন্ন পেশায় থেকে দেশের কাজ করবে, দেশকে এগিয়ে নেবে, তাদের তো রাজনীতিবিদদের নির্দেশ অনুসারে চলতে হয়। সে ক্ষেত্রে রাজনীতি যদি মেধাহীনদের হাতে চলে যায়, তাহলে তারা মেধাবীদের নেতৃত্ব দেবেন কীভাবে? এই যে রাজনীতির ক্ষেত্রে ক্রমশ মেধাবীদের না আসার ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে, এ জন্য তো আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় দারুণভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রাজনীতি চলে যাচ্ছে অমেধাবীদের হাতে। সে ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আমরা কতটুকুইবা আশা করতে পারি?
রাজনীতির প্রতি অনীহার কারণ শুধু যে রাজনৈতিক নোংরামি বা কারো না কারো প্রতিপক্ষ হয়ে যাওয়ার শংকাই নয়। আসলে এখন মানুষের মন-মানসিকতা ও মূল্যবোধ পাল্টে গেছে। এখন আর কেউ ত্যাগ স্বীকার করতে চান না। রাজনীতি করতে হলে মানুষের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ও নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে সেবা করার আন্তরিকতাটুকু থাকতে হবে; কিন্তু আজকের দিনে তা নেই বললেই চলে। মানুষ এখন স্বার্থপর, আÍকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। নিজের সুখের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। সুখ, শান্তিময় ও নিশ্চিত জীবনকে বেছে নিয়েছে। কীভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় এবং বৈধ-অবৈধভাবে অর্থ-কড়ির মালিক-মোক্তার হওয়া যায়Ñ এ ভাবনাটা সবাইকে পেয়ে বসেছে। তাই কেইবা জেনে-শুনে রাজনীতির কঠিন ও জটিল পথে হাঁটতে চায়? আর এ কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একটা মারাÍক শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনীতি এখন টাউট-বাটপার, মাস্তান, অর্থলোভীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে আমরা এখন আর আদর্শবান ব্যক্তিত্বদের তেমনভাবে দেখতে পাই না। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নেই বললেই চলে। কেননা, অর্থ ও অস্ত্রের বলি হয়ে তারা একে একে ঝরে পড়ছেন। এমনকি যারা দেশে আইনের শাসন কায়েম করবেন, দেশের সর্বোচ্চ আইনের প্রতিষ্ঠান পার্লামেন্টে যোগ্য রাজনীতিবিদদের সংখ্যা দিনে দিনে লোপ পাচ্ছে। অবৈধ উপায়ে অর্থশালী ও বিত্তশালী এবং ব্যবসায়ীরা এখন পার্লামেন্ট নিয়ন্ত্রণ করছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, জাতীয় সংসদের প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবসায়ী। এদের অনেকেই অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে জাতীয় নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে পার্লামেন্টারিয়ান হয়েছেন। এই যদি হয় জাতীয় সংসদের অবস্থা, তাহলে দেশ কাদের নেতৃত্বে, কোন্ পথে এগোবে?
যারা সারা জীবন ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ করে রাজনীতি করেছেন, ব্রিটিশ আমলে নির্যাতিত হয়েছেন, পাকিস্তান আমলে নিপীড়িত হয়েছেন এবং বাংলাদেশ আমলেও খুব বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন না অর্থাৎ রাজনীতির প্রতি নিবেদিত থেকেও অনাহারে, অবহেলায় জীবনযাপন করেছেন, তা নিয়ে তারা কখনো আক্ষেপ করেননি। কিন্তু এসব আÍত্যাগী, অন্যায় ও অসত্যের প্রতিবাদকারী, মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গকারী উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বরা যখন চুপিসারে পৃথিবী থেকে চলে যান, তখন তাদের কথা কেউ মনে রাখে না। মিডিয়াও তাদের গুরুত্ব প্রদান করে না। পত্রিকার ভেতরের পৃষ্ঠায় এমনভাবে কভারেজ দেয়া হয়, যা খুব একটা চোখে পড়ে না। যারা সারাটা জীবনে মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের কথা যদি ফলাও করে প্রচার না করা হয়, তাহলে মানুষ কোন্ আদর্শে অনুপ্রাণিত হবে? অথচ সমাজবিরোধী লোকদের নিয়ে যেভাবে মিডিয়ায় ব্যাপক কভারেজ দেয়া হয়, তারাই হয়ে ওঠেন তরুণ প্রজন্মের কাছে হিরো বা বীর। যে কারণে সমাজবিরোধী লোক, মাস্তানরা অবৈধ অর্থ ও অস্ত্রের জোরে সমাজসেবক ও ক্রমান¦য়ে সমাজের নেতা হয়ে ওঠে। এখন তো অর্থ ও অস্ত্রের জোর না থাকলে যে কোনো নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়া বা জনপ্রতিনিধি হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অবক্ষয়ের ধস নেমেছে এবং মন্দ লোকের উপস্থিতি বেড়েছেÑ তা দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার ফসল। তবে রাজনীতির এই নৈতিক অবক্ষয়ের যুগে যারা সত্যিকার দেশ ও আর্তের প্রতি আন্তরিক এবং অকৃত্রিম, তাদের এগিয়ে আসতে হবে। কেননা, কোনো কিছুর পথই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। আর রাজনীতির পথ তো আরো কঠিন ও জটিল। এ পথে হাঁটতে হলে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকা প্রয়োজন। সে ধরনের আবেগ-অনুভূতি না থাকলে রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। সঠিক নেতৃত্ব ও সঠিক নির্দেশনা পেতে হলে মেধাবীদের রাজনীতিতে আসা প্রয়োজন। দেশের মাথা হলো রাজনীতিবিদরা। মাথায় যদি পচন ধরে, তাহলে সে দেশের পচন ধরতে বাকি থাকে না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের নিয়ে যে বিভ্রান্তি, তা দূর করতে হলে সত্যিকার ত্যাগী ও মেধাবী ব্যক্তিদের রাজনীতিতে এগিয়ে আসার পথ সুগম করতে হবে। অবশ্য রাজনীতির পথ এতটা মসৃণ নয় যে কেউ পথ করে দেবে; সেক্ষেত্রে নিজের জায়গা নিজেই করে নিতে হবে। যদি সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিরা রাজনৈতিক অঙ্গনে এগিয়ে আসেন, তাহলে এ দেশের রাজনীতি একদিন সুন্দর হয়ে উঠবে। তাই রাজনীতির প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি না করে কীভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনকে সুষ্ঠু ও সুন্দর করা যায়, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং সবাইকে সচেতন করতে হবে।
রচনা কাল : জানুয়ারি ২০০৪


আবাহন, আবিদ আজাদ এবং অন্যান্য

সে এক শ্বাসরুদ্ধকর সময়। সামরিক শাসনে নিেষিত দেশের মানুষ। দম বন্ধ করা এমন এক পরিবেশে মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নেয়ার জন্য মানুষ ছটফট করতে থাকে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ সৃজনশীল নানা কাজে প্রতিবাদের একটি প্রছন্ন সুর। টিএসসি চত্বর আর বাংলা একাডেমির বইমেলায় দ্রোহের আগুনে ফুটতে থাকে প্রতিবাদী তারুণ্য। লিটল ম্যাগাজিনেও লেগেছে আগুনের হল্কা। বুকের মাঝে জ্বলে ওঠা ক্ষোভের আগুন অস্তমিত করার সৃজনশীল মাধ্যম হয়ে উঠেছে লিটল ম্যাগাজিন। এরশাদীয় শাসনামলের শুরুর দিকে কলেজের ছাত্র হলেও পড়ালেখার দিকে খুব একটা মন নেই। দুর্বৃত্ত সময়ের পাঁকে হাবুডুবু খেতে থাকে আমাদের তারুণ্য। আর এ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকি আমরা। ঢাকার শের-এ-বাংলা নগর এলাকাটা নিরুপদ্রব হলেও লিটল ম্যাগাজিনের একটা হাওয়া আমাদেরও ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। আমাদের বুকের মাঝেও তখন ক্ষোভ, যন্ত্রণা, ঘৃণা এবং সবকিছু ভেঙ্গেচুরে নতুন কিছু গড়ার স্বপ্ন। আর এ সবকিছু শিল্পিতভাবে প্রকাশের জন্য বেছে নেই লিটল ম্যাগাজিনকে। কোনো কিছু না জেনেই সাহিত্য সংকলন বের করার জন্য বন্ধুদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কোনো লেখককেই বলতে গেলে চিনি না। কোনো বিজ্ঞাপনদাতার সঙ্গেও পরিচয় নেই। পত্রিকা কীভাবে ছাপা হয়, তাও জানি না। কিন্তু তাতেও কমতি নেই উৎসাহের। যেভাবেই হোক, সাহিত্য সংকলন বের করতে হবে। মনোভাবটা এমন, এ সংকলন বের না হলে বাংলা সাহিত্যের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে। জেনে-শুনে তো বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি হতে দিতে পারি না! সে সময় পত্র-পত্রিকায় যারা নিয়মিত লেখালেখি করতেন, লেখার জন্য একে একে তাঁদের ডেরায় হানা দিতে থাকি। লেখার সঙ্গে পরিচিত থাকায় লেখকরা তখন আমাদের কাছে স্বপ্নলোকের মানুষ। পরম বিস্ময় নিয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো লেখকের সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে। কারো কারো কথায় উৎসাহিত হলেও আবার কারো কারো ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হই। তবে নিরুৎসাহিত হই না। এমনিভাবে সম্ভবত বাংলা একাডেমির আঙ্গিনায় পরিচয় কবি আবিদ আজাদের সঙ্গে। চোখে-মুখে একটা ভাবালুতা। উৎকণ্ঠা বা বিষাদের ছায়াও কি দেখেছিলাম? মুখে পান। একজন আধুনিক কবির মুখে পান! ফর্সা মুখে ঠোঁট দুটো রক্তিম হয়ে আছে। কথার মাঝে হালকা বাবরি চুলে কিছুক্ষণ পর পর হাত দিয়ে ব্রাশ করতে থাকেন। কথা বলেন মৃদুস্বরে। সবকিছুতেই একটা কবিসুলভ অভিব্যক্তি। তখন তিনি কবি এবং রেডিও বাংলাদেশের ‘উত্তরণ’ অনুষ্ঠানের গ্রন্থনা করার জন্য খ্যাতিমান। তাঁর কাছে কবিতা চাওয়ার পর তিনি জানতে চাইলেন সংকলনটি কোথা থেকে ছাপাবো? জানালাম, আমরা এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। লেখা ও বিজ্ঞাপন পাওয়ার পর সবকিছু ঠিক করবো। তিনি জানালেন, শেখ সাহেব বাজারে তাঁর একটি প্রেস আছে। ঠিকানা দিয়ে যোগাযোগ করতে বললেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে সংকলন প্রকাশ করার ব্যাপারে অনেকখানি আশ্বস্ত হলাম। একজন প্রেস মালিক সর্বোপরি নামজাদা একজন কবির সহযোগিতা পাওয়া যাবে জেনে আমরা উৎসাহে টগবগিয়ে ফুটতে থাকি। এরপর তাঁর ‘শিল্পতরু’ প্রেসে ঢুঁ মারার পর জীবনের অনেকগুলো দিন অন্যরকমভাবে কেটে যায়। ৯৮ নবাবগঞ্জে কবি আবিদ আজাদের ঢিমে-তেতলা তালে চলা প্রেসটি তখন অনেক তরুণ লেখকের আড্ডাস্থল হয়ে ওঠে। তাঁর সম্পাদিত ‘কবি’ নামে একটি সাহিত্য সংকলন তখন নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এ সংকলনে লেখা ছাপা এবং শিল্পতরু প্রকাশনী থেকে প্রথম বই প্রকাশের আশায় তরুণ লেখকরা নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন। প্রকাশের সৃষ্টিশীল যন্ত্রণায় অনেক তরুণকে তখন ছটফট করতে দেখতাম। সে সময় লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া তরুণ লেখকদের লেখা প্রকাশের ক্ষেত্র ছিল খুবই সীমিত। কবি আবিদ আজাদ তাদের কাছে ছিলেন পরম আশ্রয়। তখন দেখা উঠতি অনেক লেখকের মুখ দু’দশকের ব্যবধানে অনেকটাই ঝাপসা হয়ে গেছে। তবে কবি রিফাত চৌধুরী, রাজু আলাউদ্দিন, কাজল শাহনেওয়াজের কথা এখনো মনে পড়ে। আর কেউ না থাকলেও রিফাত চৌধুরীকে পাওয়া যেতোই। কবি আবিদ আজাদের অনুপস্থিতিতে প্রেসের দেখাশোনা অনেকটা অলিখিতভাবে রিফাত চৌধুরীই করতেন। দরবেশ দরবেশ চেহারার রিফাত চৌধুরীকে এখন টেলিভিশনের বিভিন্ন নাটকে দেখা যায়। কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ আসতেন তাঁর গ্রন্থের প্রুফ দেখতে। সে সময় তাঁর মাছ সিরিজবিষয়ক নিরীক্ষাধর্মী একটি কবিতার বই প্রকাশের তোড়জোড় চলছে। তাঁর মাছের ভাগ আমরা আমাদের সংকলনের জন্যও পেয়ে যাই।
লেখক না হয়েও কবি আবিদ আজাদের সান্নিধ্যে একটা কাব্যময় পরিবেশের প্রলোভনে জড়িয়ে পড়ি। সংকলন প্রকাশের উদ্যোগ ঢিলে হয়ে পড়লেও প্রতিদিনই কী এক মোহে ছুটে যাই শেখ সাহেব বাজারে। ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক দাঁড়িয়ে যায় কবি আবিদ আজাদের সঙ্গে। এই মেধাবী কবি তখন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত। ছোট্ট একটি ঘরে নিজের প্রেসটি মোটেও রমরমা নয়। সময়টা লেটার প্রেসের। সীসার টাইপ আর ট্রেডল মেশিনে ছাপা হতো। বোধহয় দু’জন কর্মচারী ছিল। কাজের তেমন চাপ নেই। টুকটাক কাজ। অধিকাংশই শিল্পতরু প্রকাশনীর। অখ্যাত কিংবা গুরুত্বহীন কোনো কোনো লেখকের গ্রন্থও প্রকাশ হতে দেখেছি। গ্রাসাচ্ছেদন করার জন্য লেখককে বাধ্য হয়ে নানা জায়গায় ছুটতে হয়। কেন জানি না, ধীরে ধীরে আমিও লেখকের প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে যাই। কখনো সোনালী ব্যাংকে রম্যলেখক লুৎফর রহমান সরকারের কাছে, কখনো অগ্রণী ব্যাংকে সাহিত্য-সমালোচক নূরুল করিম খসরু, কখনো বেইলি রোডে রেডিও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে কবি মুস্তফা আনোয়ারের কাছে, কখনো দৈনিক বাংলায় কবি আহসান হাবীব, মাঝে মধ্যে কবি শামসুর রাহমান, কখনো নবারুণ ও সচিত্র বাংলাদেশে কবি আবদুস সাত্তার ও কে. জি. মোস্তফার কাছে এবং প্রায়শই জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রে শিল্পী আবদুর রৌউফ সরকারের কাছে। এ রকম কতজনের কাছেই যে যেতেন। সারাদিন নানা জায়গায় ছোটাছুটি করতে করতে তাঁর বেলা কেটে যেত। কত দুপুর যে না খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন। আর প্রতিদিনের গন্তব্য ছিল আগারগাঁওয়ের রেডিও বাংলাদেশ। রেডিওতে দীর্ঘদিন যাবৎ নিয়মিত স্ক্রিপ্ট লিখতেন। সম্ভবত এটা ছিল তাঁর নিয়মিত আয়ের উৎস। রিকশায় চড়তে খুব পছন্দ করতেন। সাধারণত সর্বত্রই ছোটাছুটি করতেন রিকশায়। নানা কোলাহলের মাঝে রিকশা জার্নির সময় খুঁজে নিতেন নির্জনতা। এ সময় তিনি ডুব দিতেন মনের মাঝারে। তাঁকে দেখলে মনে হতো সারাক্ষণ কবিতায় মশগুল। ভেতরে ভেতরে বুঝিবা শব্দের খেলায় মেতে থাকতেন। কখনো সখনো আনমনে উচ্চারণ করতেন মনে মনে সাজানো নতুন কবিতার দু’একটি পঙ্ক্তি। মাঝে মাঝে বিষণœ হয়ে যেতেন। বলতেন, আপনার ভাবীর শরীরটা ভালো না। অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণে বিস্তারিত কিছু জানতে চাইতাম না। শেখ সাহেব বাজারে প্রেসের লাগোয়া তাঁর বাসা ছিল। অনেক সময় কাজের লোকের সঙ্গে ছোট ছেলেটি এলে তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতেন। সন্তান বাৎসল্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠতো তাঁর ফর্সা মুখম-ল। ঠোঁটের কোণে খেলে যেত মৃদু হাসি। সন্তানের প্রতি একজন কবির স্নেহ ও ভালোবাসার প্রকাশটুকু আমাকে মুগ্ধ করতো। অভাব-অনটন আর দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝেও প্রেসের ছোট্ট পরিসরে রাখা একটি টেবিলে বসে কবিতা লিখতেন। তখন তাকে মনে হতো একজন ঘোর লাগা উদাস মানুষ। জীবনের এই টানাপড়েনের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে স্মরণীয় সব কবিতা। মাঝে-মধ্যে চা সহযোগে পুরান ঢাকার ডালপুরি কিংবা বাকরখানি দিয়ে আপ্যায়িত করতেন। কবি আবিদ আজাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ায় আমাদের সাহিত্য সংকলন ‘আবাহন’-এর কাজের গতি খুবই মন্থর হয়ে পড়ে। ততদিনে আমার বন্ধুরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। আমি অবশ্য হাল ছাড়িনি। আমার তখন অভিজ্ঞতা হচ্ছে নতুন এক জগতের। যে জগত সৃষ্টির, আনন্দের। নতুন উদ্দীপনা নিয়ে করছি লেখা সম্পাদনা। শিখছি প্রুফ দেখার কাজ। কবি আবিদ আজাদের সৌজন্যে রেডিও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রম অনুষ্ঠানেও আমার স্ক্রিপ্ট লেখার অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। ১৯৮৪ সালের ৩ মার্চ রাত ৯টায় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান শ্রবণী’তে আমার লেখা সম্প্রচারিত হয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডকে নিয়ে লিখেছিলাম। এভাবেই উদ্দেশ্যহীনভাবে দিনগুলো পেরিয়ে যেতে থাকে। আমাদের সংকলন প্রকাশ করতে কেন যেন বছরখানেক লেগে যায়। এই সংকলনে যাদের লেখা ঠাঁই পায়, সম্পাদক হয়েও তাদের কাউকে কাউকে আমিও চিনতাম না। কবি আবিদ আজাদ তাঁর পরিচিত অনেক তরুণ ও প্রতিভাবান লেখকের লেখা আমাদের সংকলনে প্রকাশের জন্য দেন। তাঁর ভা-ারে সবসময় থরে থরে জমা থাকতো বিভিন্ন লেখকের গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী এবং বিভিন্ন শিল্পীর ব্লক করা স্কেচ। আমাদের সংকলনের কভার করে দেন কবির পরিচিত শিল্পী আব্দুর রৌউফ সরকার। কবি আবিদ আজাদ অনেক সম্ভাবনাময় লেখক ও শিল্পীকে নানাভাবে পরিস্ফুটিত করেছেন। এ কারণে অনেক লেখক ও শিল্পীর তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। ইতোমধ্যে শেখ সাহেব বাজার থেকে প্রেসটি শিফট করে নিয়ে আসেন দৈনিক আজাদ অফিসের উল্টো দিকে ঢাকেশ্বরী রোডে। আগের তুলনায় কাজের পরিধি কিছুটা বাড়তে থাকে। সংসারে সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তাঁর চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। তবে আর্থিক সচ্ছলতার পেছনে হরদম ছুটলেও কবিতা লেখা কখনোই থেমে থাকেনি। পত্র-পত্রিকায় নিয়মিতই লিখতেন। আমরা যারা কবিতা বুঝতাম না; কিন্তু বোঝার একটা আকুলতা ছিল, তাদের কাছে কবি আবিদ আজাদের কবিতার আলাদা একটা আবেদন রয়েছে। কবিতার সূক্ষ্ম কারুকাজ আর অন্তর্নিহিত বাণী আমাদের ভোঁতা বোধকে স্পর্শ করতে না পারলেও তাঁর কবিতা অন্তরকে স্পর্শ করে যায়। তাঁর কবিতার দেহখানি লাবণ্যময়, সুষমাম-িত। ছন্দময় তো বটেই, একটা সুরেলা অনুরণন পাওয়া যায়। পড়তেও ভালো লাগে। প্রচ- গরমে অতীষ্ঠ হয়ে ওঠার পর হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে মন-প্রাণ যেমন øিগ্ধতায় ভরে যায়; তেমনিভাবে আবিদ আজাদের কবিতা দিনযাপনের আর প্রাণধারণের গ্লানির মাঝে আমাদের অন্তরকে পরিশোধিত করে দেয়। তাঁর কবিতার øিগ্ধতা দিয়ে, মাধুর্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে নিজের একটা স্থান যে পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন, তা বুঝতে পারতাম কবি আহসান হাবীব, কবি শামসুর রাহমান, কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ তাঁকে পছন্দ করতেন এবং দারুণভাবে প্রশ্রয় দিতেন। তাঁর কবিতার বইয়ের নামকরণ থেকে অনুধাবন করা যায় তাঁর কাব্যভাষা। ঘাসের ঘটনা (১৯৭৬), আমার মন কেমন করে (১৯৮০), বনতরুদের মর্ম (১৯৮২), শীতের রচনাবলী (১৯৮৩), আমার স্বপ্নের আগ্নেয়াস্ত্রগুলি (১৯৮৭), তোমাদের উঠোনে কি বৃষ্টি নামে? রেলগাড়ি থামে (১৯৮৮), ছন্দের বাড়ি ও অন্যান্য কবিতা (১৯৮৭) প্রভৃতি গ্রন্থ বুকের মাঝে এমনিতেই ছন্দের দোলা দিয়ে যায়। কবিতা ছাড়াও গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, কাব্যনাট্য লিখেছেন। গ্রন্থের সংখ্যা অর্ধ-শতাধিক। কিন্তু কবি হিসেবেই তাঁর সুখ্যাতি। সত্তর দশকের অন্যতম সেরা রোমান্টিক কবি তিনি। কিশোরগঞ্জ থেকে আসা এই কবির কবিতায় গ্রামীণ সহজিয়া জীবনধারার সঙ্গে শহরের নাগরিক জীবনের মেলবন্ধন ঘটেছে। ‘এক স্তব্ধতা থেকে আরেক তপ্ত স্তব্ধতায়’ পা দিয়ে ঢাকা শহর তাঁর কাছে হয়ে ওঠে ‘জরি-চুমকির মতো ঝলমলে কবিতার রাজধানী।’ ‘আÍরক্ষামূলক যুৎসই নিভৃতি’ হিসেবে তিনি বেছে নেন কবিতাকে। আর এ কারণে পাঠকরা তাঁর কবিতায় শুনতে পেয়েছেন নতুন কণ্ঠস্বর। অন্য সবার চেয়ে তাঁর বলার ভঙ্গিটিও আলাদা। জীবনযাপনের কঠিন এক সময়কে পেছনে ফেলে যখন তিনি একটুখানি থিতু হয়েছেন, যখন তাঁর কবিতায় নিজেকে পুরোপুরিভাবে সঁপে দেয়ার সময় এবং ‘পাথর-চাপা-পড়া সাময়িক নিরানন্দ বন্ধ্যা সময় পার করে’, ‘বর্ণে গন্ধে চিত্রে ছন্দে গদ্যে পাগলের মতো মাথার ভেতর প্রবল স্বপ্নের ঝড়ঝাপটা নিয়ে জেগে উঠেছে কবিতারই বসন্তের হাতের দয়ায়’, ঠিক তখন তিনি চলে গেলেন। একটা সময় খুব কাছাকাছি থাকলেও নাগরিক জীবনের দোলাচলে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাই। সেও তো কম সময় হলো না। এর মধ্যে যে এক-আধবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি তা নয়। কিন্তু কখন যে তিনি নাগরিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছেন, মোটেও জানতে পারিনি। যখন জানলাম, তখন ‘মৃত্যুর অজস্র বৌলে ভরে গেছে গাছ’।
আমরা এমন এক কঠিন ও জটিল সময়ে বসবাস করছি, যখন মন খারাপ করার মতো অজস্র ঘটনা ঘটে যায় অহরহ। সান্ত¡না ও ভালোবাসাও এখন অনাÍীয় হয়ে গেছে। নিজেকেই নিজের সান্ত¡না দিতে হয়। নিজেকেই নিজের ভালোবাসতে হয়। আবিদ আজাদের কবিতা আমাদের সান্ত¡না দিয়েছে। দিয়েছে ভালোবাসা। মাথায় বুলিয়ে দিয়েছে øেহের হাত। হঠাৎ করে তিনি চলে যাওয়ার পর আমরা যেন এক শূন্যতায় পড়ে যাই। আর এই শূন্যতা থেকে মুক্তি পেতে হলে তাঁর কবিতায় নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। তাঁর সৃষ্টিই আমাদের তাকে মনে করিয়ে দেবে।
রচনা কাল : মার্চ ২০০৫














সূচি

পাকিস্তান : ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ ৯
জাতিসংঘ : নিধিরাম সর্দার ১২
একাত্তরের স্মৃতি ১৬
শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত, ফুল আর পরাধীনতা ১৯
সার্স : মিশন ইম্পসিবল থ্রি! ২৫
আমরা কি বধির হয়ে যাব? ৩১
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয় ৩৫
রাসায়নিক মৌসুমি ফল আর স্বাদহীন ইলিশ ৩৯
প্লিজ, গাছ কাটবেন না ৪৩
বিমল দা’র অকালে চলে যাওয়া ৪৬
ইরাকে আগ্রাসন এবং আমাদের শিক্ষা ৪৯
ইরাকের অস্তিত্ব কি বিলীন হয়ে যাবে? ৫৩
নৌ-দুর্ঘটনা কি ‘বাৎসরিক পার্বণ’? ৫৯
শিক্ষা কি কেবল এলিট শ্রেণীর জন্য? ৬২
আমাদের বদলে যাওয়া ৬৭
যাত্রীরা জিম্মি, ফুটপাত দখল এবং ৭১
আমাদের শৈশবের দুই কিংবদন্তী ৭৫
বিশ্বায়নের গোলকধাঁধা ৭৯
অলৌকিক নয়, চাই লৌকিক ক্ষমতা ৮৫
তবে কি আমরা পরাধীন হয়ে গেলাম! ৯২
মোবাইল ফোন কতটা নিরাপদ ৯৬
কেন রাজনীতি নয় ১০১
আবাহন, আবিদ আজাদ এবং অন্যান্য ১০৮


শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত ফুল আর পরাধীনতা



শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত ফুল আর পরাধীনতা
দুলাল মাহমুদ


লেখক
প্রথম প্রকাশ
ফেব্রুয়ারি ২০০৬

প্রকাশক
আবাহন
আজিজ কো-অপারেটিভ কমপ্লেক্স (৫ম তলা)
২০৪ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণি
ঢাকা-১০০০ ফোন : ৯৫৭১৮৮২

প্রচ্ছদ
পঙ্কজ পাঠক

মুদ্রণ
নাহিদা আর্ট প্রেস
৬৪-এফ আর কে মিশন রোড
গোপীবাগ ঢাকা-১২০৩

দাম
একশত টাকা
খও $ ৫

অওঈূ : ৯৮৪-৩২-২৭২৪-৭

ওদর্ণর্রদট ওটভথণর্ণ এমমফ ইর টেরটঢদধভর্টট ঠহ ঊলফটফ ুটদবলঢ
লেঠফধ্রদণঢ ঠহ ইঠটদটভ, ইড়ধড় উম-ৃযণরর্টধশণ উমবযফণস (র্৫দ এফমমর)
২০৪ ওদটদধঢ ওহণঢ ূটড়রলফ অ্রফটব ওদটরটভধ ঊদটপট-১০০০

রেধডণ কপ. ৃভণ ঔলভঢরণঢ ৃভফহ



সোহরাব হাসান শাহ আলমগীর
কবি, সাংবাদিক সাংবাদিক, সংগঠক

আমার দুই পথ-প্রদর্শক


নিবেদন
খেলাধুলা নিয়ে মূলত লেখালেখি করে থাকি। পেশাগতভাবে কাজটাও তাই। বলা যায়, খেলার জগতেরই মানুষ। এ জগতের মানুষদের সবাই একটু অন্য চোখেই দেখে থাকেন। কিন্তু খেলাধুলা তো বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বীপ নয়। পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে বাদ দিয়ে তো আর নিশ্চিত মনে খেলাধুলায় মগ্ন হওয়া যায় না। অন্য সবার মতো খেলার জগতের মানুষদের আবেগ আছে, আছে অনুভূতি। ইরাকে অকারণে বোমা ফাটলে ক্ষুব্ধ হয় সচেতন প্রত্যেক মানুষ। পরিবেশ দূষিত হলে ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরা সবাই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয় আমাদের কম-বেশি ভাবিত করে। ব্যথিত করে। কখনো-সখনো আনন্দিত করে। এই ভাবনা, এই ব্যথা, এই আনন্দটুকু অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য এবং নিজের বুকের ওপর চেপে বসা ভারি পাথরের মতো চাপটুকু কিছুটা প্রশমিত করার জন্য হুট-হাট কিছু লেখা হয়ে যায়।
লেখালেখিটা নিজের সঙ্গে নিজের এক ধরনের কথা বলা। জীবনের নিভৃত, গভীর অনুভবগুলো মেলে ধরা। গত দু’যুগের সাংবাদিকতা জীবনে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কিংবা অনুরোধের ঢেঁকি গিলে খেলার বাইরের অনেক বিষয়েই লিখতে হয়েছে। সে সব অনেক লেখাই হারিয়ে গেছে। অনিকেত নাগরিক জীবনে লেখা সংরক্ষণের সুযোগই বা কোথায়? যদিও নিজের লেখাকে নিজের কাছে অমূল্য সম্পদ বলেই মনে হয়। যেন এমন, এ লেখা না লেখা হলে সভ্যতার অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে! ইতিহাসের পাতায় কে না আঁচড় কাটতে চায়? অবশ্য কোন্ লেখা কাকে কখন অনুরণিত করবে, সেটা কারো পক্ষেই অনুধাবন করা সম্ভব নয়। মানব সভ্যতাকে নতুন নতুন চিন্তার খোরাক যোগানোর জন্য অন্তহীন লেখালেখি হয়ে আসছে। কোনো কোনো লেখা কালের স্লেটে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। অধিকাংশই হারিয়ে যায়। কিন্তু থেমে নেই লেখালেখি। সাম্প্রতিক সময়ের কিছু লেখা নিয়ে গ্রন্থরূপ দেয়া হয়েছে। যদি কারো ভাবনাস্রোতে ছোট্ট একটি ঢিল ফেলা যায়, সেটুকুই কম কি।
এ গ্রন্থ প্রকাশে হ্যাঁপা দক্ষ হাতে সামাল দেয়ার জন্য আমি বরেণ্য শিল্পী ও লেখক পঙ্কজ পাঠক, ক্রীড়া সাংবাদিক আরিফ সোহেল, সংশোধক ইমাম হোসেন এবং কম্পিউটার অপারেটর মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞ।

দুলাল মাহমুদ
ঢলফটফবটদবলঢআহটদমম.ডমব

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কোথায় সেই ফুটবল?

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ফুটবলে দেখি পৃথিবীর মুখ / দুলাল মাহমুদ

হকি অন্তঃপ্রাণ আলমগীর মোহাম্মদ আদেল/ দুলাল মাহমুদ

স্টাইলিশ অ্যাথলেট ছিলেন আরজান খান/ দুলাল মাহমুদ

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক...... দুলাল মাহমুদ

অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব

কাছের মানুষ এখন অনেক দূরে

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ