স্টেডিয়ামের সেই আড্ডাটা ‍আজ আর নেই

রাজা কাঁদলো, ক্রিকেট হাসলো

অবশেষে বিশ্ব ক্রিকেটের বর্তমান সম্রাট, ব্যাট-বলের শক্ত মানব ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভিভিয়ান রিচার্ডসের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরেছে। তবে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা কিংবা আবেগ-উচ্ছ্বাসের জন্য তিনি কাঁদেননি। ক্রিকেট তাকে কাঁদিয়েছে! ক্রিকেটের সাহসী ও সংগ্রামী খেলোয়াড় রিচার্ডসকে ক্রিকেট কাঁদাতে পারেÑ এটা বাস্তবে ঘটা নিশ্চয়ই অভাবিত ঘটনা। কেননা, বিষাক্ত সাপকে ঝানু ওঝা যেমনি ইচ্ছে তেমনি নাচান; অনুরূপভাবে ক্রিকেটের নিপুণ শিল্পী হলেন রিচার্ডস। যার ব্যাটে বাজে বিপ্লবের বীণা, যিনি দলের কোণঠাসা অবস্থায় সংহারের সৃষ্টি-রঙ্গে মেতে উঠতে পারেন। আর এ কারণেই ভিভিয়ান রিচার্ডস ক্রিকেটের রাজা।
অবশ্য রিচার্ডসের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরলেও তা ছিল আনন্দাশ্রু। তবে আনন্দাশ্রু হোক আর দুঃখাশ্রুই হোকÑ ক্রিকেটের কারণে রিচার্ডসের চোখ আর্দ্র হয়েছেÑ নেহাত চাট্টিখানি কথা নয়। কুশলী অধিনায়ক রিচার্ডস জীবনে অনেক খেলায় জিতেছেন এবং যার জীবন-দর্শন ‘জয়ের জন্য ক্রিকেট’Ñ ফলে ক্রিকেট তাকে কখনো কাঁদাতে পারেনি। ক্রিকেট তাকে কাঁদাতে পারে বলে তিনি কখনো ভাবেননি। সেই রিচার্ডস ১৯৮৮ সালের এপ্রিলে পাক-ক্যারিবীয় সিরিজে পরাজয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সিরিজে সমতা আনতে পেরে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তিনি নতুন করে উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, ক্রিকেট শুধু হাসাতে পারে না, সে সঙ্গে কাঁদাতেও পারে।
বিশ্ব ক্রিকেট অঙ্গনে ক্যারিবিয়ানরা দীর্ঘদিন ধরে দোর্দ- প্রতাপ দেখিয়ে আসছে। ক্রিকেটের পয়লা সারির অন্যান্য দেশ হরহামেশা পরাজয়ের স্বাদ অনুভব করলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ এদিক দিয়ে অনেকটা ব্যতিক্রম। বলা যায়, পরাজয় তাদের তেমন একটা স্পর্শ করতে পারেনি। আর নিজেদের মাটিতে তাদের হারিয়ে সিরিজ জয় করা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ারই সামিল। অন্তত গত দেড় দশকের ক্রিকেটের ইতিহাস তাই বলে! সেই দুরূহ ও স্বপ্নিল কর্মটি ক্রিকেটের আরেক বিস্ময় ইমরান খান তার বাহিনী নিয়ে প্রায় অবধারিত করে তুলেছিলেন। অনেক দিনের ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করে ইমরান বাহিনী সদ্যসমাপ্ত তিন টেস্ট সিরিজের উদ্বোধনী টেস্টে জর্জটাউনে স্বাগতিক দুর্ধর্ষ ক্যারিবিয়ানদের ৯ উইকেটে হারিয়ে দিয়ে পাঠানী খান্দানির প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। এই টেস্টে দলে ছিলেন না ভিভ রিচার্ডস। দ্বিতীয় টেস্টে তিনি ফিরে আসেন অধিনায়ক হিসেবে। ক্রিকেট অনুরাগীদের অনিশ্চয়তার দোলায় দুলিয়ে পোর্ট অব স্পেনে দ্বিতীয় টেস্ট ড্র হয়ে যখন তৃতীয় টেস্টে সিরিজ গড়ালো, তখন অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন সিরিজ ক্যারিবিয়ানদের হাতছাড়া হচ্ছে। এমনকি ব্রিজটাউনে চূড়ান্ত টেস্টে ক্যারিবিয়ানরা একপর্যায়ে কষ্টকর টিকে থাকার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু যাদের জীবনটাই ক্রিকেটে উৎসর্গীকৃত, সেই ক্যারিবিয়ানদের সম্পর্কে শেষ কথা বলা ক্রিকেট দেবতার পক্ষেও সম্ভব নয়। কেননা, ডুবুডুবু জাহাজ নিয়েও ক্যারিবিয়ানরা সঠিক গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন।
তবে যাই হোক না কেন, স্বদেশের মাটিতে দীর্ঘদিন পর ইমরান বাহিনী যে শিক্ষাটা দিয়েছে, তাতে করে ক্যারিবিয়ানরা নিজেদের একক ধারণাটা ঝালিয়ে দেখার সুযোগ পেল। কেননা, তাদের অবস্থান যে অনেকটা নড়বড়ে হয়ে উঠেছেÑ পাকিস্তান তা জানিয়ে দিয়েছে। যে কোনো দুর্বলতা মানুষকে আবেগপ্রবণ করে তোলে। আর তাই সিরিজে সমতা আনার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের কৃষ্ণকলি ভিভিয়ান রিচার্ডসের দু’চোখের অশ্রু বাঁধভাঙা জোয়ারের মত হু হু করে অবিরল ধারায় ঝরে পড়েছে। জীবনের অনেকটা সময় হেলাফেলায় ক্রিকেট খেলে, ক্রিকেটের ‘সাত হাজারী কাবে’ নাম লিখিয়ে রিচার্ডস অবশেষে জয়-পরাজয়ের দোদুল্যমানতায় কাঁদলেন।
রিচার্ডসের আবেগপ্রবণ কান্নায় ক্রিকেট অনুরাগীরা অভিভূত হলেও ‘ক্রিকেট’ কিন্তু আড়ালে হেসেছে। কেননা, জয়-পরাজয়, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, আবেগ-অনুরাগের অপর নামই ক্রিকেট। আর এসব অনুভূতি আছে বলেই তো ক্রিকেট এতো সুন্দর, এতো মধুর, এতো আনন্দদায়ক। এক পক্ষকে ক্রিকেট যেমন উল্লসিত করে, তেমনি আরেক পক্ষকে করে বেদনাহত। তবে নি®প্রাণ ড্র কাউকেই সন্তুষ্ট কিংবা উচ্ছ্বসিত করতে পারে না।
ফলে ক্রিকেটার ভিভিয়ান রিচার্ডসের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরলেও তিনি কিন্তু মর্মাহত হননি। বরং গৌরবোজ্জ্বল ও অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেটের হাসির মাঝে কান্না এবং কান্নার মাঝে নির্মল হাসিতে পুলক অনুভব করেছেন।
শুধুমাত্র রিচার্ডসই নন, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ হতে হাজার হাজার মাইলের ব্যবধানের এই ভূখ-ের একজন সাধারণ নাগরিক হয়ে রিচার্ডসের কান্নায় অভিভূত হলেও হৃদয়তটে নতুনভাবে অনুভব করেছি ক্রিকেটের অনাবিল সৌন্দর্যকে।
তাই ক্রিকেটের রাজার কান্না আর ক্রিকেটের দার্শনিক হাসি ক্রিকেটকে করেছে মহীয়ান।
দৈনিক ইত্তেফাক : ৮ মে ১৯৮৮



বাংলাদেশের ক্রিকেট : পাওয়ার আনন্দ এবং না পাওয়ার বেদনা

ক্রিকেট অবশ্যই অনিশ্চয়তার খেলা। তার চেয়ে বেশি অনিশ্চিত বাংলাদেশের ক্রিকেট। এ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কখনো কিছু বলা যায় না। না যায় আশাবাদী হওয়া, আবার একদম নিরাশ হবার মতোও নয়। একটা সম্ভাবনার আলো যখন ঝিলিক দিতে থাকে, তখন হুট করে নেমে আসে অন্ধকার। পক্ষান্তরে কিছুই হবে নাÑ এমন একটা হতাশাবোধ যখন পেয়ে বসে, তখন কখনো-সখনো এসে ধরা দেয় সাফল্য। পাওয়ার আনন্দ এবং না পাওয়ার বেদনাÑ এরকম দোদুল্যমানতার মাঝে এগিয়ে চলেছে এ দেশের ক্রিকেট।
ক্রীড়াক্ষেত্রে উৎসাহ ও উদ্দীপনার দিক দিয়ে বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় এ দেশের ক্রীড়ামোদীরা কোনো অংশে কম নয়; বরং কোনো কোনো ব্যাপারে তারা অনেক বেশি এগিয়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এ দেশের কোনো খেলাধুলার মান তেমন নয়, যা বিশ্ব মানদ-ে স্থান পেতে পারে। স্বাধীনতার প্রায় দু’যুগ পেরিয়ে আসার পরও ক্রীড়াঙ্গনে আমাদের অবস্থানের খুব একটা তারতম্য ঘটেনি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসর এ দেশটি ক্রীড়াঙ্গনে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে না পারলেও এ যাবৎ অল্প অল্প করে নেহাত কম অর্থও ব্যয় হয়নি। অথচ সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এ অর্থের সদ্ব্যবহার করা যায়নি এবং এখনও যাচ্ছে না। যে কারণে ক্রীড়াঙ্গনের সর্বত্রই বিরাজ করছে একটি অগোছালো ও অসুস্থ অবস্থা। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অব্যবস্থা ও গোঁজামিল সম্পর্কে একটি চুটকির কথা মনে পড়ছে।
এক জ্যোৎøা রাতে বুড়িগঙ্গা ব্রিজের ওপর আড্ডা মারছিলেন তিন বন্ধু। তাদের একজন কানা, একজন নুলা এবং অপরজন ফকির। আড্ডা জমে ওঠার এক ফাঁকে কানা বন্ধুটি আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, আহ্! কি সুন্দর রাত। চাঁদের মায়াবী আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। দু’চোখ আমার জুড়িয়ে যাচ্ছে। এ কথা শুনে নুলা বন্ধুটি ক্ষেপে গিয়ে বললো, শালা তুই হইলি গিয়া কানা। আলো-অন্ধকারের তুই কি বুঝিস? এমন গাঁজাখুরি কথা কইলে তোকে এক লাথি দিয়া নিচে ফালাইয়া দিমু। এতে উৎসাহিত হয়ে ফকির বন্ধুটি নুলা বন্ধুটিকে বললো দোস্ত, তুই যদি কানা হালারে লাথি দিয়া ফালাইয়া দিতে পারস, তাইলে যত টাকা লাগে আমি দিমু।
চুটকিটির তাৎপর্য হলো : এই তিন বন্ধুই তাদের অক্ষমতা জানেন। কানার পক্ষে কিছু দেখা, নুলার পক্ষে লাথি মারা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি যথেচ্ছ টাকা দেয়ার মত সামর্থ্যও ওই ফকিরের নেই। তবুও তাদের পক্ষে যা সম্ভব নয়, তাই তারা করতে চেয়েছেন। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের যারা দ-মু-ের কর্তা, তাদেরও একই অভিলাষ। অসম্ভবকে চাওয়া এবং তার পিছু ছুটে চলা।
কম-বেশি আমরা সকলেই জানি আমাদের দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেও আশাপ্রদ নয়। মানুষের দৈনন্দিন মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই খেতে হয় হিমশিম। সে লক্ষ্যে ক্রীড়াঙ্গনে চাহিদামাফিক অর্থ সংকুলানের কথা কেউ বলবে না। এ অবস্থায় লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রাপ্ত অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে ঈ≈িত লক্ষ্যে পৌঁছানো। অথচ এ বিষয়ে কারো কোনো সদর্থক চিন্তা-ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। খেয়াল-খুশি মতো চলছে আমাদের ক্রীড়াঙ্গন। অনর্থক শ্রাদ্ধ করা হচ্ছে টাকা-পয়সার। খেলাধুলার উন্নয়ন না হলেও একে পুঁজি করে কারো কারো অবস্থার ঢের উন্নতি হচ্ছে।
আমাদের মতো দেশে সবরকম খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষকতা করা অনেকটা গরিবের হাতি পোষার সামিল। জনপ্রিয়তা ও সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও দু’ডজনেরও বেশি খেলা সরকারের আনুকূল্য পেয়ে আসছেÑ যা মোটেও বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কুঁজোর উপুড় হয়ে শোয়ার মতো এমন বিলাসিতা অন্তত আমাদের মতো দেশের মানায় না।
যারা খেলাধুলা ভালবাসেন এবং প্রকৃতই এর মঙ্গল চান, তাদের মতে, জনপ্রিয়তা ও সম্ভাবনা, ভৌগোলিক পারিপার্শ্বিকতা, পরিবেশ ও দৈহিক কাঠামোর সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণ করে খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষকতা করা প্রয়োজন। কিন্তু যারা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছেন, তারা কানে দিয়েছেন তুলো, পিঠে বেঁধেছেন কুলো। এসব কথা তাদের বলা অনেকটা ‘কা কস্য পরিবেদনা’। তা না হলে একটা সম্ভাবনার আলো উঁকি মারছে যে ক্রিকেট খেলায়, সঠিক পরিচর্যা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে যে ক্রিকেট ছিনিয়ে আনতে পারে বিজয়ের মালা; সেই ক্রিকেট ওপর মহলের নজর তেমন পাচ্ছে না। এমন একটা প্রতিকূল অবস্থার মাঝে এ দেশের ক্রিকেট চেষ্টা করছে নিজস্ব একটা পথ তৈরি করার। সে লক্ষ্যে খানিকটা এগিয়ে এসেছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ক্রিকেটের পথ চলা শুরু হয় একটা দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত পাতে দেয়ার মতো অবস্থায় ছিল না ক্রিকেট। বিদেশী দলগুলোর কাছে আমাদের ক্রিকেটাররা যাচ্ছেতাইভাবে নাস্তানাবুদ হতেন।
১৯৭৭ সাল থেকে বাংলাদেশে বিদেশী দল আসা আরম্ভ করে। শুরুটা হয় এমসিসি দলকে দিয়ে। ফলাফল মোটেও আনন্দদায়ক নয়। বাংলাদেশের ইনিংসের সমাপ্তি টানতে হয় ৭৪, ১১৯-এর মতো দুর্বল স্কোরে। পিয়ারচুড (৬/২৪), ডাফ (৪/১৯), ভার্নন (৩/২২), উইং (২/৭) প্রমুখের সাধারণ মানের বল খেলতে যেয়ে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা গুটিয়ে যায় শামুকের মত। এমসিসির সফরের শেষ ম্যাচগুলোতে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা কিছুটা সাবলীল হয়ে উঠলে একটা আশাবাদের জন্ম নেয়। কিন্তু পরের বছর শ্রীলংকা দল বাংলাদেশ সফরে এসে এ দেশের ক্রিকেটকে একটা নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়ে যায়। শ্রীলংকা তখনো সদস্য হয়নি টেস্ট পরিবারের। ময়মনসিংহে তাদের সফরের প্রথম ম্যাচটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে লজ্জাকর সংযোজন হয়ে থাকবে। টনি ওপাথা (৫/১৮) ও ইল্লেপেরুমার (৪/১১) বল যেন উইকেটে কালনাগিনীর ফণা হয়ে ছোবল মারতে থাকে। এই মরণ কামড়ের সামনে দাঁড়াতে না পেরে মাত্র ৪২ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশের ইনিংস। একমাত্র মাইনুল হক (১৪) ছাড়া কারো পক্ষে ডাবল ফিগারের ঘরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। পিচের অবস্থা খারাপ থাকার কথা বলা হলেও শ্রীলংকান ব্যাটসম্যান ওয়ার্নাপুরা (৮৫), ফার্নান্ডো (৭৯) কিন্তু খেলেছেন স্বাচ্ছন্দে। বোলাররা তাদের কাছে মোটেও সুবিধা করতে পারেননি। দু’দিনের এই ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসেও বাংলাদেশের অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সংহার রূপ ধারণ করেন জগন্নাথন (৫/১৬), গুনাতিলক (২/৩), কালুপেরুমা (২/১১)। রকিবুল হাসান (২৫), মাইনু (১৬) ও তানভীর হায়দার (১০) সামান্য প্রতিরোধ গড়লেও মাত্র ৭২ রানে ইনিংসের যবনিকাপাত ঘটে। ফলে ওই ম্যাচে সফরকারী দল ১ ইনিংস ও ৭৬ রানে জয়ী হয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্তঃসারশূণ্যতা প্রমাণ করে দেয়। এই সফরে বাংলাদেশের কোনো কোনো ইনিংসের পরিসমাপ্তি ঘটে ৫৫, ৮৮, ৯৭ রানের অগৌরবজনক স্কোরে। অথচ দাপটের সঙ্গে সেঞ্চুরি হাাঁকিয়েছেন দিলিপ মেন্ডিস, সিধাত ওয়েটেমুনি, ওয়ার্নাপুরা, টেনিকুনরা।
পরবর্তীতে এমসিসির উইলসন (৪/২২), নিডহাম (২/১০), মন্ট্রিয়েথ (২/৬), পশ্চিম বাংলার দিলীপ দোশী (৭/৩৯) ও (৫/৭৪), ওমর কোরেশী একাদশের মহসিন কামাল (৬/২৬), জাকির খান (৩/১২) প্রমুখের বলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা নাকাল হয়েছেন। নামতার মতো দ্রুত উইকেটের পতন ঘটায় এক-একটা ইনিংস শেষ হয়েছে ৭৩, ৯৩, ৯৪-এর মত নিুমানের স্কোরে।
এর মাঝে যে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা টুকটাক সাফল্য দেখাননি, তা নয়। ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে ফরিদপুরে এমসিসি দলকে মাত্র ৭৯ রানে ইনিংসের সমাপ্তি টানতে বাধ্য করেন বাংলাদেশের বোলাররা। এ ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য দেখান আজম। তিনি ১৮ রানে ৭টি উইকেট লাভের কৃতিত্ব দেখান। ২৪ রানে ৩টি উইকেট নিয়ে আজহার তাকে সহায়তা করেন। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রমাগত ব্যর্থতার মাঝে এছাড়া তেমন স্মরণীয় সাফল্য নেই বললেই চলে।
বলা যায়, ১৯৯০ সাল থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের মোড় ঘুরতে শুরু করে। সেবার সৈয়দ কিরমানির নেতৃত্বে বাংলাদেশ সফরে আসে হায়দ্রাবাদ ডেকান ব্লুজ। দলে ছিলেন টেস্ট খেলোয়াড় চেতন শর্মা, রমন লাম্বা, প্রবীণ আমরে, শ্রীধরের মত নামজাদা ক্রিকেটাররা। একদিনের ম্যাচে এই দলটিকে বিসিসিবি একাদশ ৪ উইকেটে এবং ৫ উইকেটে হারিয়ে কৃতিত্ব দেখায়। যে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে খেলতে যেয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের হাত-পা কাঁপতো, সেই দলকে (যদিও দুই সিংহলী দলের মধ্যে ব্যবধান দুস্তর) ১৯৯২ সালে প্রথম সার্ক ক্রিকেটে মাত্র ৮৫ রানে গুটিয়ে দিয়ে ৭ উইকেটে জয়ী হয়। এর ধারাবাহিকতায় গত বছর আগস্টে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত সাত জাতির আন্তর্জাতিক জুনিয়র ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ চমৎকার সাফল্য প্রদর্শন করে। নাঈমুর রহমান দুর্জয়, হাবিবুল বাশার সুমন, লিটু, বাপ্পী, খালেদ মাসুদ পাইলট, মেহরাব হোসেন অপি, জাকারিয়া, জাভেদ ওমর বেলিম গোল্লা প্রমুখের ক্রীড়াশৈলী আমাদের আশাবাদী করে তোলে। বছরের শেষদিকে ঢাকায় দ্বিতীয় সার্ক ক্রিকেটে আশাতীত ভাল খেলে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। ভারত ও শ্রীলংকার মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়েছে অসাধারণ নৈপুণ্যে। পাকিস্তান উত্তেজনাপূর্ণ খেলায় ১ উইকেটে জিতেছে।
কিন্তু পরম কাক্সিক্ষত আইসিসি ট্রফি রয়ে গেছে বাংলাদেশের অধরা। আইসিসি ট্রফি নামক সেই সোনার হরিণের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয় ও চতুর্থবার বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনালে উঠলেও প্রথম, তৃতীয় এবং সর্বশেষ গত বছর পঞ্চম আইসিসি ট্রফিতে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। এ ক্ষেত্রে শ্রীলংকা ও জিম্বাবুয়ে একসময় বাংলাদেশের সাফল্যের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালেও এখন তারা টেস্ট পরিবারের সদস্য। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন যেন পেরে উঠছে না। সংযুক্ত আরব আমিরাত, হল্যান্ড ও কেনিয়ার মতো অনুজ্জ্বল দেশগুলোর সঙ্গে না পারাটা সত্যিই দুঃখজনক। কেননা, বাংলাদেশ সফররত কেনিয়া জাতীয় দলের খেলা দেখে তাদের পারফরম্যান্স খুব একটা আহামরি মনে হয়নি। ক্রিকেটে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কেনিয়া ও হায়দ্রাবাদ দলকে বাংলাদেশ হারাচ্ছে। আবার হারও মানছে। তবে শারজায় অনুষ্ঠিত পঞ্চম এশীয় কাপ ক্রিকেট বাংলাদেশের জন্য ছিল একটা পরীক্ষা। এ টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ বিজয়ী হবেÑ এমন প্রত্যাশা কেউ করেননি।
কিন্তু পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলংকার সঙ্গে একটা সম্মানজনক ফলাফল আশা করা হলেও তা আমরা পাইনি। কেননা, দেশের মাটিতে আমাদের ক্রিকেটের যে সুনাম ও সুখ্যাতি গড়ে উঠেছে, বিদেশের মাঠে তা প্রমাণ করা যায়নি। যদিও ক্রিকেটে অনিশ্চয়তা আছে বলেই ক্রিকেট এত সুন্দর ও মাধুর্যময়। কিন্তু তারপরও প্রতিটি দলের খেলায় স্থিতিশীলতা থাকে। যা দিয়ে দলটিকে চেনা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে সে কথা বলা যায় না। বাংলাদেশের ক্রিকেট এখনো আমাদের কাছে হয়ে আছে অচেনা।
ক্রিকেটের কুলীন পরিবারের সদস্য হতে হলে বাংলাদেশকে তার অন্তরায়সমূহ কাটিয়ে উঠতে হবে। আজ অবধি ক্রিকেটের একটি নিজস্ব মাঠ পাওয়া যায়নি। যদিও সার্ক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ক্রিকেটের জন্য একটি পৃথক স্টেডিয়াম নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণাকে ক্রীড়ামোদীরা তেমন গুরুত্ব দিতে চাচ্ছেন না। নিজস্ব মাঠ না থাকায়, ক্রিকেট খেলার জন্য প্রয়োজন যে ভালো মানের উইকেট, তা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ছাড়াও ফুটবল খেলা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি অনুষ্ঠিত হওয়ায় স্থায়ীভাবে ক্রিকেট উপযোগী পীচ গড়া আদৌ সম্ভবপর নয়। বাংলাদেশে খেলতে এসেছেন আন্তর্জাতিক মানের অনেক ক্রিকেটার। তারা সবাই এক বাক্যে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রধান সমস্যা ভালো উইকেট না থাকা। দীর্ঘদিন এই সমস্যা অনুভূত হয়ে আসলেও তা নিরসনে কোনো উদ্যোগ নেই।
মাঠ ও ভালো উইকেট ছাড়াও আম্পায়ারিং ও ক্রিকেট কর্মকর্তাদের আন্তরিক মনোভাব, নিষ্ঠা ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি ক্রিকেটকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের আম্পায়ারদের ‘দেশপ্রেম’ খেলা পরিচালনার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি রকমের চোখে পড়ে। যা শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকরও। এই প্রবণতা রোধ করতে হলে ভালো আম্পায়ার গড়ে তোলার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আন্তরিক মনোভাব ও দূরদৃষ্টি ছাড়া ক্রিকেটের প্রসার ও মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষোভ দিয়ে আর যাই হোক, ক্রিকেটের পরিচর্যা হতে পারে না। দেশের নির্ভরযোগ্য ক্রিকেটার মিনহাজুল আবেদীন নান্নু কর্মকর্তাদের ক্ষোভের বলি হয়েছেন। সামান্য একটা বক্তব্যের জন্য কেড়ে নেয়া হয়েছে তার অধিনায়কত্ব। অথচ দেশের ক্রিকেটের স্বার্থে ব্যাপারটি মোটেও শোভন হয়নি। এটা আমরা জানি, ক্রিকেট কর্মকর্তারাও তা ভালোভাবে জানেন। এসব ছোট-খাট ব্যাপারে তারা যদি কম্প্রোমাইজ না করতে পারেন, তাহলে সারা দেশের ক্রিকেটকে তারা কীভাবে এগিয়ে নেবেন?
দৈনিক দেশজনতা : ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫
যে বেদনা মধুর হওয়ার নয়

প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দুয়ারে কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। দীর্ঘ প্রত্যাশা আর বহু আকাক্সক্ষার ক্রিকেট উৎসব। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের যে ব্যাপ্তি, যে বিশালত্ব ও মাধুর্যÑ তার সঙ্গে তুলনা হয় না অন্য কোনো কিছুর। যেমন হাল আমলে তুলনাহীনা সুন্দরীশ্রেষ্ঠা সুস্মিতা সেন কিংবা ঐশ্বর্য রায়। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পরতে পরতে জড়ানো একদিনের ক্রিকেটের উত্তাপ-উত্তেজনা ও ঝলমলানির পাশাপাশি সুস্মিতা-ঐশ্বর্যের গ্ল্যামার ও সৌন্দর্য। যা হৃদয়কে করে তোলে উদ্বেল এবং স্পন্দিত।
জীবনের যাবতীয় টানাপড়েন থেকে দূরে সরে যেয়ে কিছুদিনের জন্য বিশ্বকাপের অজানা-অচেনা আনন্দসুন্দর জগতে ডুবে থাকার মজা হঠাৎ পাওয়া ছুটির দিনে বেলা করে ঘুমিয়ে থাকার স্বাধীনতার মতো। সাহিত্যিক মতি নন্দীর ভাষায়, ‘......খেলা একদিনের ক্রিকেটের জন্য, যাতে আছে ফাটকা খেলার শিহরণ, অবশ্যম্ভাবী হার এবং জিত, একঘেঁয়েমির হাত থেকে রেহাই এবং নাটকীয় মোচড় আর ক্রিকেট বোদ্ধা হবার প্রয়োজনটা একদমই কাজে না লাগানোর সুযোগ। তারপর আসবে দিনের পর দিন মিডিয়ার ক্রমান¦য়ে ঢক্কা-নিনাদে পাগলামিটাকে ধাপে ধাপে উসকে তোলার জন্য যুক্তি বিসর্জনের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়া। তাছাড়া বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো বিরাট উপলক্ষটায় হাজির হয়ে একটা ঐতিহাসিক ঘটনায় সাক্ষী থাকার লোভটা তো আছেই।
কিন্তু এসবই শেষ কথা নয়। এরপর আছে অঘ্রাণের হিমেল হাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে যে রোদটা পাওনা হবে, তার দাম তো সারা বছরের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা আর হতাশার ছায়া থেকে বেরিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য লাখো লোকের সঙ্গে সেই রোদ মাথায় নিয়ে বসে পিকনিকের আমেজে লুচি-আলুরদম কি পাউরুটি-ডিমের সঙ্গে নলেন গুড়ের সন্দেশÑ মধ্যবিত্ত জীবনের গুমোট দিনরাতের মধ্যে এ তো এক ঝলক দখিনা বাতাস! এই মরজীবনের যাবতীয় মানসিক অসুখ উপশমের জন্য যে কোনো উপায় সংগ্রহের অধিকার সবারই আছে। সেই উপায়গুলোর অধিকাংশের থেকে সবচেয়ে কম ক্ষতিকর হলো ক্রিকেট খেলা দেখা।’
বাড়ির কাছে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জমজমাট আসর বসলেও ক্রিকেটের পরিভাষায়, আমরা যারা ‘টুয়েলভথ ম্যান’ তাদের হয়ত এই ‘ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী’ বা ‘হিমেল হাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে রোদ পোহানো’ হবে না। কিন্তু তাই বলে তো আর একদম বেরসিক হওয়া যায় না! স্যাটেলাইটের এই যুগে সারা দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয়। স্যাটেলাইটের এই বদান্যতায় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের রাজসিক উপভোগ কোনো অংশে কম হবে বলেও মনে হয় না। বিশ্বের প্রায় ২শ’ কোটি ক্রিকেট অনুরাগীর মতো আমরাও সোফায় কিংবা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে টিভিতে উপভোগ করবো ব্যাট-বলের মধুর কুঞ্জন। ইতোমধ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে টেলি-দর্শকদের বাসনাকে তৃপ্ত করার জন্য স্টার টিভির পরিবেশনা হবে মাধুরী দীক্ষিত কিংবা উর্মিলা মাতন্ডকরের নাচের চেয়েও ঢের মাদকতাময়। ব্রায়ান লারা বা শচীন টেন্ডুলকারের চোখ ধাঁধানো মহাকাব্যিক ব্যাটিং, ওয়াসিম আকরামের ঢেউয়ের ওপর ঝাঁপ দেয়ার ভঙ্গিতে দুরন্ত গতির বোলিং বা শেন ওয়ার্নের যাদুকরী স্পিনের ভেলকি কিংবা রমেশ কালুভিথারানার চমকপ্রদ উইকেটকিপিং বা জন্টি রোডসের চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্রগতির ফিল্ডিং টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হবে নানা ছন্দ ও ভঙ্গিমায়। এতে অবশ্য গ্যালারির তাজা অনুভূতি বা ‘রক অ্যান্ড রোল’-এর উদ্দামতা না থাকলেও পাওয়া যাবে সূক্ষ্ম রস বা গজলের ক্যাসিক আমেজ। এই মাগ্গিগ-ার বাজারে তাইবা মন্দ কি! বিনোদনহীন এই জীবনে মাসখানেকের জন্য টানটান উত্তেজনায় চুর হয়ে যাওয়ার মধ্যে যে আনন্দ, তা তো নগদ কড়ি দিয়েও কোথাও মিলবে না।
তারপরও থেকে যায় কিছু কষ্টের কথা। যার সঙ্গে জড়িয়ে ব্যক্তি থেকে সমষ্টি। বিশ্বখ্যাত সুরকার আনন্দ শংকরের সুরে সুরে যখন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের থিম সং ‘দেয়ার ইজ ওয়ান কাপ টু উইন/ইলেভেন প্রাউড পিপল/টুয়েলভ প্রাইড নেশনস/লেন্ড টু উইন দ্য কাপ/দ্য উইলস ওয়ার্ল্ড কাপ/শেয়ার দ্য ম্যাজিক’ বেজে উঠবে, তখন স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় বিষাদে ছেয়ে যাবে আমাদের সবার মন। কেননা, পাওয়ার সম্ভাবনার মাঝে না পাওয়ার বেদনা বুকের গভীরে বাজে কষ্ট হয়ে। এ বেদনাবোধ প্রেয়সীকে না পাওয়ার যন্ত্রণার মতো। যা কখনো ভুলে থাকার নয়। বিশ্বকাপ ক্রিকেট এ দেশের মানুষের কাছে বেদনার অপর নাম। দুঃসহ স্মৃতি হয়ে সর্বদা পীড়া দিতে থাকে। ‘প্রাউড নেশনের’ অভিধা-বঞ্চনার হাহাকার কখনোই ভোলা যাবে না।
অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়েকে নিয়ে বিশ্বক্রিকেটের যে কুলীন পরিবার, তার বাইরে সর্বাগ্রে যে দেশটির নাম আলোচনায় হর-হামেশা উঠে আসেÑ সেটি এই সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ। সঙ্গত কারণে ‘টুয়েলভ প্রাউড নেশন’ নিয়ে যখন বিশ্বকাপ হয়, তখন বাংলাদেশের অনুপস্থিতির দুঃখটা অমোচনীয় কালির মতো চিরজাগরুক হয়ে থাকে।
মাইক আথারটন, লি জারমন, ওয়াসিম আকরাম, হ্যানসি ক্রনিয়ে, মার্ক টেইলর, মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, রিচি রিচার্ডসন ও এন্ডি ফাওয়ারের সঙ্গে এক সারিতে বসে বাংলাদেশের অধিনায়ক আকরাম খান জম্পেশ আড্ডা মারছেন কিংবা আতাহার আলী খান, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, এনামুল হক মনি, ফারুক আহমেদ, নাইমুর রহমান দুর্জয়কে আউট করতে হিমশিম খাচ্ছেন ডমিনিক কর্ক, ওয়াকার ইউনিস, এলান ডোনাল্ড, ক্রেইগ ম্যাকডারমট, শ্রীনাথ, চামিন্ডা ভাস ও কোর্টনি ওয়ালশের মতো জগতখ্যাত বোলাররা অথবা লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান মোঃ রফিক, সাইফুল ইসলাম ও হাসিবুল হোসেন শান্ত’র ব্যাটের আগুনের ফুলকি দেখে কোটি কোটি ক্রিকেট অনুরাগী মন্ত্রমুগ্ধÑ এ তো কোনো কবির কল্পনা বা স্বপ্ন ছিল না। অথচ যা হতে পারতো বাস্তব, তাই এখন হয়ে উঠেছে লাগামহীন কল্পনা।
কষ্টবোধটা তখন আরো ভারি হয়ে ওঠে, যখন দেখতে পাই এমন তিনটি দেশ স্থান পেয়েছে ক্রিকেটের অভিজাত সারিতে, যাদের কীর্তি ও কৌলীন্য অন্তত বাংলাদেশের চেয়ে শ্রেয়তর নয়। হল্যান্ডের অনেক নাগরিকই জানেন না তাদের দেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের যা কিছু গৌরব, ভাড়াটে খেলোয়াড়দের নিয়ে। বাংলাদেশ সফরকালে কেনিয়ার শক্তি সম্পর্কে আমরা আঁচ করতে পেরেছি। গর্ব, উজ্জ্বলতায় ও ভালবাসায় বাংলাদেশের অবস্থান এদের চেয়ে ওপরে। তা সত্ত্বেও দুর্ভাগ্য এসে বারবার বাংলাদেশের সাফল্যকে ম্লান করে দেয়।
এতকিছুর পরও যাদের শিরায় শিরায় ক্রিকেটের স্পন্দন, তারা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের এই ডামাডোলে স্বদেশের ব্যর্থতাকে স্মৃতি থেকে আড়ালে রাখতে পারবেন না। প্রতিটি ক্ষণেই তা হৃদয়ে দোলা দিয়ে যাবে। কিছু কিছু বেদনা আছে, একসময় তা মধুর স্মৃতি হয়ে যায়। কিন্তু একটি দেশের, একটি জাতির বেদনা কখনো মধুর হওয়ার নয়। যতদিন না সুদিন ফিরে আসছে, এই বেদনাবোধ থেকেই যাবে।
দৈনিক ইত্তেফাক : ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬


ক্রিকেটের নতুন শ্লোগান : এক বলে এক রান

ক্রিকেট কি তার কৌলীন্য হারিয়েছে?
একবিংশ শতাব্দীর নাগালে দাঁড়িয়ে উঠে এসেছে এ প্রশ্নটি। যে অহঙ্কার আর আভিজাত্য দিয়ে রাজকীয় খেলা ক্রিকেট যুগ যুগ ধরে হৃদয় ছুঁয়েছে রসিকজনের, সেই
ক্রিকেট এখন কোথায়?
এ শতাব্দীর শেষপ্রান্তে এসে ক্রিকেটে দ্রুত পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। ধ্রুপদী সঙ্গীতের পরিবর্তে ক্রিকেটে এখন পপ সঙ্গীতের উদ্দামতা। এতে দেহ-মনে তাৎক্ষণিক দোলা লাগলেও নেই ছন্দ, সুষমা ও লালিত্য। শুদ্ধ সঙ্গীতের যে আমেজ হৃদয়কে পৌঁছে দেয় অন্য এক অনুভবে, হালের একদিনের ক্রিকেটে তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন ধারণা সনাতনী মনোভাবের পরিচায়ক হলেও বিশুদ্ধ সঙ্গীতের মেজাজ পাওয়া যায় টেস্ট ক্রিকেটেÑ এ অভিমত ক্রিকেটের তাবৎ প-িতদের।
অথচ ক্রিকেট থেকে ক্রমশ অচল হয়ে যাচ্ছে টেস্ট ক্রিকেটের মন্থর গতি। সোনালী প্রহরের অলস মন্থর খেলার স্থলে ক্রিকেটে এসেছে তাৎক্ষণিক উত্তেজনার আমেজ। টেস্ট ক্রিকেটের বনেদি কেতাদুরস্ত স্টাইল কাউকে আর আপুøত করে না। মানুষ এখন নগদ সওদার খরিদ্দার। ক্রিকেটে চায় ফুটবলের উত্তেজনা। চায় ক্ষণস্থায়ী আনন্দে বিভোর হতে।
ক্রিকেট এখন সিনেমার কয়েক ঘণ্টার বিনোদন। নগদ উত্তেজনার খোরাক। তাহলে রসিয়ে রসিয়ে ক্রিকেট উপভোগ করার দিন কি ফুরিয়ে গেল? মহৎ ক্রিকেটারদের স্মৃতিময় সেসব কীর্তি আর চোখ জুড়ানো কাব্যিক ইনিংস বাঁধানো থাকছে রেকর্ডবুকে। ডব্লিউ জি গ্রেস থেকে শুরু করে ক্রিকেটের মহান স্থপতিরা যে অবিনশ্বর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা কি আজ নশ্বর হয়ে যাবে?
একদিনের ক্রিকেট পাল্টে দিয়েছে ক্রিকেটের প্রচলিত ধারাকে। নির্বাসিত হয়েছে ক্রিকেটের যাবতীয় ব্যাকরণ। টেস্ট ক্রিকেট থেকে এর মেজাজ একদমই আলাদা। ক্রিকেটের রূপান্তর ঘটেছে আধুনিক বণিকদের হাতে। অস্ট্রেলীয় ধনকুবের ক্যারি প্যাকার ক্রিকেটকে দিয়েছেন নতুন আদল, দিয়েছেন বাণিজ্যিক চাকচিক্য। তারই বেনিয়া বুদ্ধিতে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছে ইন্সট্যান্ট ক্রিকেট। ঘরোয়া দর্শকরা পেয়েছেন বাহারি মোড়কে মুড়মুড়ে ক্রিকেট।
একদিনের ক্রিকেট এখন মুক্তবাজারের সুস্বাদু পণ্য। এতে শিল্পীর তুলির আঁচড় কিংবা কাসিক্যাল সঙ্গীতের তন্ময়তার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই ক্রিকেটবোদ্ধা হওয়ার কিংবা ক্রিকেটকে নিয়ে স্বপ্নীল ছবি আঁকার। ওয়ানডে ক্রিকেট মানে ললিপপ ক্রিকেট। যে কোনোভাবে রানের বন্যা বইলেই হলো। মারে কোনো সৌন্দর্য না থাকলেও করতালিতে মুখরিত হয় স্টেডিয়াম। শ্রীলংকার ‘দানবীয় ব্যাটসম্যান’ সনাথ জয়াসুরিয়া এখন সব ক্রিকেটারের মডেল। সীমিত ওভারে ক্রিকেটের প্রথম ১৫ ওভারে তিনি যে ব্যাটিং তা-বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা হয়ে উঠেছে সব ব্যাটসম্যানের স্বপ্ন। ‘এক বলে এক রান’ এখন ক্রিকেটের নতুন শ্লোগান।
দৈনিক ইত্তেফাক : ১০ জানুয়ারি ১৯৯৮

ট্রিবিউট টু রমন লাম্বা

ক্রিকেট মাঠে তার সরব উপস্থিতি আর দেখা যাবে না। তার ব্যাটের দ্যুতিতে হেসে উঠবে না মাঠ, গ্যালারি, দর্শক। কোজ-ইন ফিল্ডিং পজিশনে তার দুরন্ত ফিল্ডিং আর কোনো ব্যাটসম্যানকে চাপের মুখে রাখবে না। দিল্লিতে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন স্বপ্নের যে প্রাসাদোপম বাড়িটি, সেই বাড়ির তিনি আর বাসিন্দা হতে পারলেন না। তিনি এমন এক বাড়ির বাসিন্দা হয়েছেন, যেখানো কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করবে না। যাবতীয় চাওয়া-পাওয়া, আকর্ষণকে তুচ্ছ করে তিনি চলে গেছেন এমন এক জগতে, যেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসে না। কাছের ও দূরের, সবার বুকে চাপ চাপ কষ্ট ছড়িয়ে দিয়ে রমন লাম্বা পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তলোকে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরার খুবই কম সুযোগ পেয়েছেন রমন লাম্বা। কিন্তু ক্রিকেটের বেদীতে নিজেকে সঁপে দিতে তিনি একটুও কার্পণ্য করেননি। খেলার মাঠে তার নিষ্ঠা, আন্তরিকতা অন্য সবার কাছে অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ আপাদমস্তক এক জাত ক্রিকেটার। যতক্ষণ মাঠে থাকতেন, প্রতিটি মুহূর্ত তিনি যেমন উপভোগ করতেন, তেমনি অনুপ্রেরণা যোগাতেন অন্যদের। ক্রিকেট তার নাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় নিয়তিও তার জীবনের অন্তিম মুহূর্তের সঙ্গে ক্রিকেটকে বেঁধে দিয়েছে। নতুবা যে ঘটনা ক্রিকেট মাঠে সাধারণত ঘটে না, তা কেন রমন লাম্বার বেলায় ঘটবে? অদম্য সাহস নিয়ে তিনি দীর্ঘ ১৮ বছর ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিং করেছেন, কখনো কিছুই হয়নি। আর ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আবাহনী-মোহামেডান খেলায় যেদিন তিনি এমন ঘটনার শিকার হলেন, সেদিন আম্পায়ার অশোকা ডি সিলভা তাকে হেলমেট মাথায় দিতে বলেছিলেন এবং তার দলের অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট আরেকটু দূরে সরে দাঁড়াতে বলেছিলেন। তিনি তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন মুচকি হেসে। যেন মৃত্যুর হাতছানিতে তিনি তুচ্ছ করলেন সবার সতর্কতা।
ক্রিকেট ছিল রমন লাম্বার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। ক্রিকেটের জন্য উৎসর্গ করেছেন নিজের জীবনের উজ্জ্বল দিনগুলো। ছুটেছেন দেশ থেকে দেশান্তরে। যে কারণে প্রায়শই তাকে দূরে থাকতে হয় স্ত্রী-সন্তানের সংস্পর্শ থেকে। ক্রিকেট জীবনের শেষ অধ্যায়ে তিনি তার যাযাবর জীবনের অবসান ঘটিয়ে চেয়েছিলেন সুখী গৃহকোণ নিয়ে একটুখানি থিতু হতে। থিতু তিনি হয়েছেন, তবে স্ত্রী কিম, কন্যা জেসমিন, পুত্র কামরানকে কাঁদিয়ে।
এ দেশের ক্রিকেটও রমন লাম্বার কাছে অনেকখানি ঋণী। নব্বই দশকের শুরুতে ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটেও যেসব বিদেশির ব্যাট আলো ছড়িয়েছে, দর্শকদের দিয়েছে মুগ্ধতার পরশ, রমন লাম্বা তাদের একজন। প্রকৃত অর্থে ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটে বিদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনি সর্বাগ্রে সবার মন জয় করে নেন। তার ব্যাটের ঝলকে যেমন দর্শকরা আনন্দিত হয়েছেন, তেমনিভাবে দেশীয় ক্রিকেটাররা সমৃদ্ধ হয়েছেন অভিজ্ঞতায়।
আমরা তার অবদানকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। রমন লাম্বার মৃত্যু আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে জীবন-মৃত্যু শুধুই একটি বলের ব্যবধান। একই সঙ্গে উঠে এসেছে ক্রিকেটারদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি। বিশেষত কোজ-ইন ফিল্ডিং পজিশনে ফিল্ডিং করার সময় হেলমেট পরাটা বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি উত্থাপিত হচ্ছে। এ বিষয়টি আইসিসির গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।
আমাদের দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে ক্রিকেট খেলায় দুর্ঘটনা ঘটারও যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এটাকে মেনে নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবে খেলার মাঠে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা এবং দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা রাখাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমরা মনে করি, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবন-মৃত্যু, তাকে কোনোভাবে হালকা করে দেখার অবকাশ নেই। ক্রিকেট মাঠে রমন লাম্বার মতো কোনো দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক, আমরা তা চাই না।
ক্রীড়াজগত : ১ মার্চ ১৯৯৮


দূরের বিশ্বকাপ, কাছের বিশ্বকাপ

বিশ্বকাপ ক্রিকেট আমাদের কাছে ছিল দূরের গ্রহ হয়ে। এই গ্রহে আমরা ছিলাম অপাঙ্ক্তেয়। অবশ্য যে গ্রহের বাসিন্দা হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের মতো ক্রিকেটের বনেদি ও খানদানি দেশের নাম শোভা পায়, সেখানে আমাদের মতো দেশের কাছে তা অধরা স্বপ্ন ছাড়া আর কি! অবশ্য বিশ্বকাপ ঘরানার বাসিন্দা না হলেও আমরা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের রূপ-রস-সৌন্দর্য থেকে একেবারেই বঞ্চিত ছিলাম না। ক্রিকেট-রসিকরা ঠিকই অবগাহন করেছেন বিশ্বকাপ ক্রিকেটের রূপ-মাধুর্যে। প্রিন্ট মিডিয়া আর স্যাটেলাইটের কল্যাণে ক্রিকেট সুলভ পণ্য হয়ে ওঠায় আমরাও পেয়ে যাই তার আস্বাদ। অবশ্য সবক’টি বিশ্বকাপ আমরা চোখের আলোয় দেখতে পাইনি। সরাসরি সম্প্রচারের সুযোগ না থাকায় দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়। এমনটি হয়েছে প্রথম তিনটি বিশ্বকাপে। তারপরও কাইভ লয়েড, আলভিন কালীচরণ, গ্যারি গিলমোর, জহীর আব্বাস, গ্লেন টার্নার, জন স্লো, সফররাজ নেওয়াজ, অ্যালান টার্নার, ফারুক ইঞ্জিনিয়ার, কিথ ফেচার, বার্নাড জুলিয়েন, ডেনিস লিলি, ডেনিস অ্যামিসের কীর্তি-গাঁথা প্রথম বিশ্বকাপ; ভিভিয়ান রিচার্ডস, গর্ডন গ্রীনিজ, গ্রাহাম গুচ, মাইক হেনড্রিক, অ্যালান হার্স্ট, কাইভ লয়েড, দীলিপ মেন্ডিস, ক্রিস ওল্ড, আসিফ ইকবাল, ব্রুস এডগার, সাদিক মোহাম্মদ, জিওফ হাওয়ার্থের সাফল্যে ভাস্বর দ্বিতীয় বিশ্বকাপ; কপিল দেব, মহিন্দর অমরনাথ, ভিভ রিচার্ডস, ফুউদ ব্যাকাস, রজার বিনি, ইমরান খান, বব উইলিস, অশান্ত ডিমেল, গ্রিম ফাওলার, ডেভিড হটন, আব্দুল কাদির, জেরেমি কোনি, গর্ডন গ্রীনিজ, ট্রেভর চ্যাপেল, রিচার্ড হ্যাডলি, জহির আব্বাস, মদনলাল, উইনস্টন ডেভিস, ডেভিড গাওয়ার, যশপাল শর্মা, ডানকান ফেচার, অ্যালান ল্যাম্ব ও মোহসীন খানের নৈপুণ্যে উজ্জ্বল তৃতীয় বিশ্বকাপ ক্রিকেট বেতার ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে যায়। বিশেষ করে কাইভ লয়েডের অসাধারণ অধিনায়কত্ব আর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দলের চরম বিপর্যয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কপিল দেবের অপরাজেয় ১৭৫ রানের সংগ্রামী ইনিংস আমাদের কাছে মিথ হয়ে আছে।
এরপর এলো স্যাটেলাইটের রমরমা যুগ। বাংলাদেশেও এসে পড়ে তার কূলপ্লাবী জোয়ারের ঢেউ। বাড়ির ছাদের এন্টিনায় হাড়ি-পাতিল, থালা-বাসন দিয়ে বিভিন্ন বিদেশী চ্যানেল ধরার হিড়িক পড়ে যায়। অবশ্য এরপর বেশি সময় লাগেনি স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোকে মুঠোর মধ্যে আনতে। তারই সুবাদে বিশ্বকাপ ক্রিকেট চলে আসে আমাদের ঘরে ঘরে।
অ্যালান বোর্ডার, ইমরান খান আর অর্জুনা রানাতুঙ্গার বিচক্ষণ নেতৃত্বে অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান ও শ্রীলংকা যেভাবে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয় কিংবা মার্টিন ক্রো, সনাথ জয়সুরিয়া ও কালুভিথারানার চমকপ্রদ পিঞ্চ হিটিং, ম্যাকডারমট ও ওয়াসিম আকরামের দুর্ধর্ষ বোলিং, জন্টি রোডসের চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্র ফিল্ডিং অথবা বৃষ্টি আইনের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকার অসহায় আÍসমর্পণ থেকে শুরু করে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ বিশ্বকাপের প্রতিটি দৃশ্যপট আমাদের স্মৃতিতে ও দৃষ্টিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। তাছাড়া স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলে বাসা কিংবা অফিসে অবসরে কিংবা নানা ব্যস্ততার মাঝে ক্রিকেট খেলা উপভোগ করতে পারায় আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে ক্রিকেট ও ক্রিকেটাররা। বিশ্ব ক্রিকেটের প্রতিষ্ঠিত বা উঠতি প্রতিটি ক্রিকেটারই এখন আমাদের কাছের মানুষ।
ক্রিকেটে আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে না পারলেও বিশ্ব ক্রিকেটের কুলীন দলগুলো ও জগৎখ্যাত ক্রিকেটাররা ঢাকার মাঠে খেলতে আসায় তারা আমাদের প্রিয়জন হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে ৯টি টেস্ট দলকে নিয়ে উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ, এশীয় টেস্ট ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনাল এবং মেরিল ত্রিদেশীয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট আয়োজিত হওয়ায় ঢাকায় ক্রিকেট তারকাদের মেলা বসে। এর ফলে অপরিচয়ের যে দূরত্ব ছিল, তাও পুরোপুরি কেটে যায়। টিভি স্ক্রিনের স্বপ্নের নায়কদের কাছাকাছি দেখতে পারার অভিজ্ঞতাই আলাদা! আর এই তারকা ক্রিকেটাররাই সপ্তম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মধ্যমণি হয়ে থাকবেন। এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য বাড়তি পাওয়া।
এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট আমাদের হৃদয়ে একটু অন্যভাবে ঠাঁই করে নিয়েছে। কেননা, এই প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলবে বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ এই গৌরব অর্জন করে। এ যাবৎ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বিদেশী ক্রিকেটারদের সাফল্য-ব্যর্থতায় আমরা উল্লসিত কিংবা ব্যথিত হয়েছি। অনেকটা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছি। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ এবারই শিরোপা-লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবে। তেমন প্রত্যাশা মূর্খ ছাড়া আর কেই বা করে। টিম হিসেবে দুর্বল হতে পারে; কিন্তু বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলছেÑ এটাই আমাদের গর্ব ও আনন্দ। আমরা জানি, আমাদের টিম হারবে, ব্যর্থ হবে; তথাপি এবারের বিশ্বকাপে আমাদের নিজেদের টিম আছে। যতো প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে লড়ুক না কেন, আমরা থাকবো আমাদের দেশের পাশে। আমাদের আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আকরাম খান, খালেদ মাহমুদ সুজন, মেহরাব হোসেন অপি, শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ, হাসিবুল হোসেন শান্তদের খেলা পৌঁছে যাবে দেশে দেশে। তাতে বাড়বে লাল-সবুজ পতাকার পরিচিতি। সবচেয়ে বড় কথা, যে বিশ্বকাপ নামক গ্রহটি একসময় আমাদের কাছে তারার মতো মিটিমিটি জ্বলেছে, তা আজ সূর্যের আলোর মতো দেদীপ্যমান অর্থাৎ যে বিশ্বকাপ ক্রিকেট ছিল আমাদের কাছে দূরের হয়ে, এখন তা আমাদের খুব কাছের।
সাপ্তাহিক বিচিত্রা : ৩০ এপ্রিল ১৯৯৯


ক্রিকেটের মহোৎসব

ক্রিকেটের মাতৃভূমি ইংল্যান্ডে বসেছে শতাব্দীর শেষ বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা। এবার নিয়ে চতুর্থবার বিশ্বকাপের স্বাগতিক হলো ইংল্যান্ড। অবশ্য প্রথম তিনটি বিশ্বকাপ (১৯৭৫, ১৯৭৯ ও ১৯৮৩) ইংল্যান্ড এককভাবে আয়োজন করলেও এবার তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে স্কটল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডের প্রত্যন্ত গ্রামে লৌকিক ক্রীড়া হিসেবে ক্রিকেট নামক যে রাজকীয় খেলাটির উৎপত্তি ও বিকাশ, আজ তা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে সমাদৃত। কেননা, অলস প্রহরে বিনোদনের বাহন হিসেবে ক্রিকেটকে বেছে নিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের বনেদি ও অভিজাত সম্প্রদায়। কাল পরিক্রমায় ক্রিকেট তার আকর্ষণী ক্ষমতা দিয়ে সাধারণ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে রূপান্তর ঘটেছে ক্রিকেটের। অলস ও মন্থর গতির টেস্ট ক্রিকেটের পরিবর্তে আধুনিক জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এসেছে উন্মাদনাময় একদিনের ক্রিকেট।
নিছক ঘটনাক্রমে একদিনের ক্রিকেটের জন্ম। ১৯৭১ সালে মেলবোর্নে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে তৃতীয় টেস্টটি বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হলে ৫ জানুয়ারি ৪০ হাজার দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য আয়োজন করা হয় সীমিত ৪০ ওভারের ম্যাচ। এরপর থেকে শুরু হয়ে যায় একদিনের ক্রিকেটের জয়জয়কার। আর এ জনপ্রিয়তা থেকেই ১৯৭৫ সালে আবির্ভাব ঘটে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের। ক্রিকেটের সর্বোচ্চ এই আসরটি এখন অনেক মানুষের স্বপ্ন-কল্পনা-ভালবাসা।
ক্যারি প্যাকার নামে অস্ট্রেলীয় এক ক্রিকেটপ্রেমী টাইকুন গতানুগতিকতা থেকে মুক্ত করে ক্রিকেটকে দিয়েছেন নতুন জীবন। তিনি একদিনের ক্রিকেটে এনেছেন বৈচিত্র্য। আধুনিক মানুষ চায় উত্তেজনা। তিনি মানুষের এই চাহিদাকে পুঁজি করে ক্রিকেটের রূপ পাল্টে দিয়েছেন। ক্রিকেটকে তিনি গড়ে তুলেছেন পণ্য হিসেবে। ক্রিকেট এখন বর্ণিল হয়ে উঠেছে। ক্রিকেটে এসেছে রঙিন পোশাক। সাদা বল। কালো স্ক্রিন। এসেছে রাতের ক্রিকেট। ফাডলাইটের আলোয় এখন ঝলমল করে ক্রিকেট। সে সঙ্গে বিজ্ঞাপনের বাহারি চমক আর ক্যামেরার কারুকাজে ক্রিকেট এখন অনেক জৌলুসময়। স্যাটেলাইটের কল্যাণে ক্রিকেট সুলভ পণ্য হিসেবে পৌঁছেছে মানুষের ঘরে ঘরে।
এ কারণে বিশ্বকাপ ক্রিকেটও এখন আরো আকর্ষণীয় ও বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছে। প্রথম বিশ্বকাপে যেখানে ৮টি দেশ ৫ দিনে ১৫টি খেলায় অংশ নেয়, এবার সেখানে ১২টি দেশ ৩৮ দিনে ৪২টি ম্যাচ খেলবে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের এই সপ্তম মহোৎসবে যোগ দিয়েছে ক্রিকেটের কুলীন দেশগুলো। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, কেনিয়ার পাশাপাশি এই প্রথম বিশ্বকাপে খেলছে বাংলাদেশ ও স্কটল্যান্ড। বিশ্বকাপ ক্রিকেট ক্রমান¦য়ে জমজমাট হয়ে ওঠার আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এবার প্রায় ২শ’ কোটি লোক টেলিভিশনে এই খেলা দেখবেন।
প্রতিটি বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা আমাদের নতুন আনন্দে ভরিয়ে দিয়ে যায়। আমরা পাই নতুন স্টাইলের খেলা, নতুন নতুন কৌশল, মহান ও মহৎ সব ক্রিকেটার। আমরা বিশ্বকাপে দেখেছি কাইভ লয়েড, কপিল দেব, এলান বোর্ডার, ইমরান খান, অর্জুনা রানাতুঙ্গার সুকৌশলী নেতৃত্ব, ভিভ রিচার্ডস, মহিন্দর অমরনাথ, ডেভিড বুন, গ্রাহাম গুচ, ওয়াসিম আকরাম, মার্টিন ক্রো, অরবিন্দ ডি সিলভা, সনাথ জয়াসুরিয়ার মতো খেলোয়াড়দের মাদকতাময় ক্রিকেট। এবারের বিশ্বকাপেও আমরা দেখতে পাবো নতুন কোনো নায়ককে। বিশ্বকাপে যারা খেলবেন, তাদের অনেকের ক্যারিয়ারই দারুণ উজ্জ্বল। হয়তো তাদের কেউ জ্বলে উঠবেন। নতুবা এমন কেউ লাইম লাইটে উঠে আসবেন যাদেরকে আমরা তেমনভাবে চিনি না। কে যে নিজেকে মেলে ধরবেনÑ সেটা আমাদের অজানা। আর এই রহস্য ও অনিশ্চয়তাই বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসল মজা।
ক্রীড়াজগত : ১৬ মে ১৯৯৯
স্মৃতিময় সপ্তম বিশ্বকাপ ক্রিকেট

সপ্তম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আমেজ যদিও টাটকা; কিন্তু তা ঠাঁই নিয়েছে স্মৃতির পাতায়। স্মৃতিতে ভেসে ওঠে কত রকম ছবি। কোনটি আনন্দের, কোনটি কষ্টের। ৩৮ দিনব্যাপী এই ক্রিকেট কার্নিভাল আমাদের দারুণভাবে মাতিয়ে রাখে। স্যাটেলাইটের কল্যাণে আমরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি ক্রিকেটের রাজসিক ভোজ। ৪২টি ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল আনন্দময় উৎকণ্ঠায় পরিপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশ অংশ নেয়ায় বিশ্বকাপ ক্রিকেট আমাদের কাছে আরো মাধুর্যময় হয়ে ওঠে।
একটি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের হাজারো রঙ, হাজারো বর্ণ। এর মধ্যে কিছু কিছু ক্ষণ, কিছু কিছু মুহূর্ত আলাদাভাবে উজ্জ্বলতা ছড়ায়। এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট ব্যাপ্তি ও বিশালত্বে অন্যগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। যে কারণে এই বিশ্বকাপে ঘটনার সমাহার ও বৈচিত্র্যও বেশি। স্টিভ ওয়াহর অসাধারণ সেঞ্চুরি ও নেতৃত্ব, হ্যানসি ক্রনিয়ের বিতর্কিত ইয়ার পিস ব্যবহার, সাকলায়েন মুশতাকের হ্যাটট্রিক, সৌরভ গাঙ্গুলী ও রাহুল দ্রাবিড়ের ৩১৮ রানের বিশ্ব রেকর্ডের পার্টনারশিপ, মঈন খানের সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট, জন্টি রোডসের অনবদ্য ক্যাচ, শেন ওয়ার্নের জাদুকরী বোলিং, ইনজামাম-উল হকের কচ্ছপ গতির দৌড়, হারশেল গিবস হাতের মুঠোয় পুরে স্টিভ ওয়াহর ক্যাচ ফেলে দেয়ার পাশাপাশি বিশ্বকাপ হাতছাড়া করা, অতিরিক্ত রানের ছড়াছড়ি, ল্যান্স কুজনারের দানবীয় ব্যাটিং ও অলরাউন্ড নৈপুণ্য, সর্বাধিক রান করেও রাহুল দ্রাবিড়ের একবারও ম্যান অব দ্য ম্যাচ হতে না পারা, জিম্বাবুয়ে-ভারত, পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা-পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ, সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়ার নাটকীয় টাই ম্যাচ, অ্যালান ডোনাল্ডের দুঃসহ রানআউট, পানসে ফাইনাল ম্যাচ, সর্বোপরি পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশের অকল্পনীয় অভিষেক আমাদের কাছে স্মরণীয় ও মধুময় স্মৃতি হয়ে আছে।
অনেক শ্রম, মেধা ও প্রস্তুতির সমন¦য় একটি বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন কিংবা আশানুরূপ সাফল্য অর্জনের জন্য প্রতিটি দল দীর্ঘ চার বছর নিজেদের গড়ে তোলে। এতে কোনো কোনো দল সফলতা অর্জন করে, আবার কোনো কোনো দল ব্যর্থ হয়। তবে একটি বিশ্বকাপ থেকে খেলোয়াড়, প্রশিক্ষক, সংগঠক, দর্শকরা অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে থাকেন। পরবর্তীতে তারা এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগান। যে কারণে একটি বিশ্বকাপ থেকে আরেকটি বিশ্বকাপের গ্ল্যামার ও উজ্জ্বলতা বেশি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ এবারের বিশ্বকাপে প্রথম অংশ নিয়েছে। অভিষেকটা বাংলাদেশের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্বভাবতই বাংলাদেশের চোখে এখন নতুন স্বপ্ন। এই বিশ্বকাপে যে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ সঞ্চয় করেছে, আগামীতে তা নিশ্চয় কাজে লাগবে। আগামী বিশ্বকাপে বাংলাদেশ চেষ্টা করবে নিজেকে অতিক্রম করার। আর এ জন্য এখন থেকেই বাংলাদেশকে প্রস্তুত হতে হবে। সামনের পথ অনেক প্রতিকূল হলেও সপ্তম বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি বাংলাদেশকে অবশ্যই অনুপ্রেরণা যোগাবে।
ক্রীড়াজগত : ১ জুলাই ১৯৯৯


ক্রিকেটে যে প্রশ্নের সহজ উত্তর মেলে না!

ক্রিকেট থেকে দূরে সরে থাকতে চাইলেও উপায় নেই। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই ক্রিকেট। বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলা যায়,‘ইট ক্রিকেট, স্লিপ ক্রিকেট’। ক্রিকেটের আনন্দযজ্ঞে সবারই কম-বেশি নিমন্ত্রণ। সেই বৃটিশ ঔপনিবেশিক যুগে ক্রিকেট এই নেটিভদের দেশে এলেও হালে ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ক্রিকেটের যে ক্রেজ সৃষ্টি হয়, বিশ্বকাপ খেলার পর তা রূপ নেয় উন্মাদনায়। এমনিতেই নাচনেওয়ালী তারপরে ঢোলের বাড়ি দিচ্ছে ইলেকট্রোনিক্স মিডিয়া। এখন সাংবাৎসরিক ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। যে ক্রিকেট শীতের মিঠে রোদে মাঠে বসে রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করার কথা, তা পৌঁছেছে বাড়ির হেঁসেল অব্দি। বাধ্য হয়ে নিজেকে সমর্পণ করতে হয় ক্রিকেটে। ক্রিকেটের আষ্টেপৃষ্টে বাধা পড়ায় মনের মাঝে অনবরত ঘুরপাক খায় ক্রিকেট।
ক্রিকেটের ‘আনন্দময় কোলাহলে’ এই অধম খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে না। নিজেকে অনেকটা অনাহুত মনে হয়। পেশাগত কারণে ক্রিকেটের আলো-হাওয়া গায়ে লাগালেও তার উত্তাপ-উত্তেজনা তেমনভাবে টের পাই না। এমনিতেই বিদ্যা-বুদ্ধির যা জোর, তাতে দুয়ে দুয়ে চার বুঝি। এর এদিক-সেদিক হলেই দিশেহারা হয়ে যাই। বাঙালি হয়েও আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষা পুরোপুরি রপ্ত করতে পারিনি, অন্য ভাষা তো দূরে থাক! সেখানে ক্রিকেটকে মনে হয় রীতিমত হিব্রু ভাষা। অবশ্য ক্রিকেটের গভীরে মাথা না গলালে শাদা চোখে ‘ক্রিকেটীয় রূপ-মাধুর্যে’ মুগ্ধ হওয়া যায়! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অধিকাংশ ক্রিকেট অনুরাগী ফুলের সৌরভটুকুই নিয়ে থাকেন, অনর্থক কাঁটা খোঁজার চেষ্টা করেন না।
আমার কথা হলো, যে খেলাটির জন্য জীবনের অনেক মূল্যবান সময় রোদে-বৃষ্টিতে কাটিয়ে দিতে হচ্ছে, তার মর্মই যদি কিছুটা না বুঝতে পারলাম, তাহলে কেন ক্রিকেটের পিছনে এই ছুটে চলা? যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, কেউ কি দিব্যি দিয়েছে ক্রিকেট নিয়ে মাথা ঘামানোর? তা অবশ্য দেয়নি। কখনো মাথা ঘামাতেও চাইনি। এ কথা নির্দ্বিধায় কবুল করে নিতে চাই, ক্রিকেট লিখিয়েরা কাঠের বলটিকে ‘স্বর্গীয় আপেল’ হিসেবে যতই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হোন না কেন, এই বলের ভয়ে জীবনে কখনো ক্রিকেট মাঠের সঙ্গে মিতালি পাতাই নি। অঙ্কের হিসাব মিলাতে না পারায় যে আমি অসংখ্যবার পরীক্ষায় ডাব্বা মেরেছি, সেই আমি অঙ্কের চেয়ে ‘জটিল’ ক্রিকেটেই বা মন-প্রাণ সঁপে দেব কোন দুঃখে? কেউ কি জেনে শুনে বিষ পান করতে পারে?
কিন্তু ঘটনাচক্রে ক্রিকেটকে এড়িয়ে জীবন যাপন করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ কারণেই ক্রিকেট একটু-আধটু বুঝতে চাওয়ার ভীমরতি! এ জীবনে একটি প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে পেলাম না। নির্দোষ এ প্রশ্নটি হলো : ডিম আগে না মুরগি আগে? এ নিয়ে অনেক ভেবে চিন্তেও কুল-কিনারা করে ওঠতে পারিনি। বাধ্য হয়ে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় ক্ষান্তি দিয়েছি। তেমনিভাবে ইদানিং ক্রিকেট নিয়ে ভাবতে যেয়ে অনেক সহজ প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। দেখি, আপনারা পারেন কিনা?
আচ্ছা, আপনারা কি কেউ বলতে পারেন, ক্রিকেটে এক বলে সর্বোচ্চ কত রান হয়? আপাত নিরীহ এই প্রশ্নের উত্তরে সবাই সমস্বরে বলবেন, এই সহজ-সরল প্রশ্নের উত্তর যে জানে না, তাকে কান ধরে ক্রিকেট মাঠ থেকে বের করে দেয়া উচিত। যারা একটু সহনশীল তারা যা হোক একটা কিছু উত্তর দিয়ে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করবেন। অথচ ক্রিকেট যাদের ঘর-সংসার, সেইসব ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের স্মরণাপন্ন হয়ে এর কোন সঠিক উত্তর খুঁজে পাইনি। কেউ যদি এর যথাযথ উত্তর দিতে পারেন চিরদিন আমি তার গোলাম হয়ে থাকবো।
এমন একটি সাধারণ প্রশ্নের যদি সঠিক উত্তর না পাওয়া যায়, তাহলে হাজারো প্রশ্ন মনের কোণে উঁকি-ঝুঁকি মারছে তার বেলায় কী হবে? আসলে ক্রিকেট এমন একটি খেলা, যার পরতে পরতে মাকড়শার জালের মত জটিলতা ছড়ানো। আমরা জানি, ছয় বলে এক ওভার। এই জানাটা কি আদৌ ঠিক? বোলার যদি একের পর এক নো কিংবা ওয়াইড বল করতে থাকেন, তাহলে কত বলে ওভার শেষ হবে? এটা কি কারো পক্ষে আগাম বলা সম্ভব?
একটি দল হেসে-খেলে ব্যাটিং করলো ৫০ ওভার। প্রতিপক্ষ দলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অন্য কোনো কারণে কার্টেল ওভার ব্যাট করতে হলো। দ্বিতীয় দলকে হয়তো বলা হলো ২৫ ওভার ব্যাট করার জন্য। মনে হতে পারে, প্রথম দল প্রথম ২৫ ওভারে যে রান করেছে কিংবা মোট রানকে ৫০ ওভারে ভাগ দিয়ে ওভার প্রতি রানকে ২৫ দিয়ে গুণ করে যা হবে, দ্বিতীয় দলকে তাই করতে হবে। অঙ্কের এই সরল নিয়মে তো আর ক্রিকেট হতে পারে না! তাই প্রবর্তন করা হয়েছে ডাকওয়ার্থ/লুইস মেথড। দক্ষ পরিসংখ্যানবিদ না হলে কারো সাধ্যি নেই এটা বোঝার। কত দলকে যে এ কারণে বলি হতে হলো? এর চমৎকার উদাহরণ ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট। সিডনিতে অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে বৃষ্টির কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে টার্গেট দেয়া হয় এক বলে ২২ রান করার। যা শুধু অসম্ভবই নয়, অবাস্তব ও অযৌক্তিক। যেহেতু খেলাটির নাম ক্রিকেট, তাই কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
একদিনের ক্রিকেটে প্রথমে যারা ফিল্ডিং করে, তাদের ২১০ মিনিটে ৫০ ওভার শেষ করতে হবে। নতুবা সময় অনুপাতে ওভার কাটা যাবে। যেমনটি সপ্তম এশীয় কাপ ক্রিকেটে পাকিস্তানের সঙ্গে খেলায় ভারতের দু’ওভার কাটা যায়। এটা না হয় মেনে নেয়া গেল। কিন্তু পরে যারা ফিল্ডিং করবে, তারা যদি নির্ধারিত সময় ৫০ ওভার না করতে পারে, সেক্ষেত্রে কী হবে? উত্তর, অর্থ জরিমানা। এটা কি কোনো যৌক্তিক বিচার হলো?
স্ট্রাইকার ব্যাটসম্যানের ব্যাটে লেগে বল শুন্যে উঠলো। সেই বল ক্যাচ ধরার জন্য ফিল্ডার ছুটে এলেন তখন নন-স্ট্রাইকার ধাক্কা দিলে ফিল্ডার ক্যাচ ধরতে ব্যর্থ হলেন। এ জন্য দায়ী কে? অবশ্যই নন-স্ট্রাইকার। অথচ এক্ষেত্রে বলির পাঠা হবেন স্ট্রাইকার ব্যাটসম্যান। এ কি কোনো ন্যায্য বিচার?
কোন ফিল্ডার ব্যাটসম্যানকে আউট করতে যেয়ে বল ছুঁড়ে মারলে তা মাটি ঘেঁষে সীমানার বাইরে গেলে চার হয়। তাই যদি হবে, একইভাবে ব্যাটসম্যানকে আউট করতে যেয়ে ফিল্ডার বল শুন্যে সীমানা অতিক্রম করালে সেটিও ছক্কা না হয়ে চার হবে কেন? এর কোনো উত্তর নেই।
ব্যাট করার সময় ব্যাট কিংবা পা স্ট্যাম্পে লাগলে এমনকি ক্যাপ বা হেলমেট খুলে উইকেটে পড়লে হিট উইকেট হয়। কিন্তু রান নেয়ার সময় ব্যাট হাত থেকে ছুটে স্ট্যাম্পে লাগলে ব্যাটসম্যান কেন আউট হবেন না?
জানি, বোকার মত প্রশ্ন। তবুও জানতে ইচ্ছে করে, ১০০ রানেই যদি একটি সেঞ্চুরি, তবে এক সঙ্গে ৫০০ রান করলে পাঁচটি সেঞ্চুরি নয় কেন?
‘মেডেন ওভার’-এর বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘কুমারী ওভার’। ক্রিকেটের পরিভাষায় কোন রান না হওয়াকে মেডেন ওভার বলা হয়। কিন্তু লেগ বাই বা বাই রান হলেও ওভার কীভাবে মেডেন হয়? তাহলে লেগ বাই বা বাই রান কি বয় ফ্রেন্ড?
ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রথম টেস্টে পাকিস্তানী স্পিনার মুশতাক আহমদের একটি বল ঘুর্ণি খেয়ে স্ট্যাম্পে আঘাত করলে একটি বেলস লাফিয়ে ওঠে আবার স্ট্যাম্পে বসে। আমার মত যারা আনাড়ী তারা ধরে নেবেন এটা আউট। কিন্তু ক্রিকেটের আইনে বেলস যদি আকাশে ঘুড়ির মত উড়ে উড়ে আবার এসে স্ট্যাম্পের উপর ঠাঁই করে নেয়, তাহলেও নাকি আউট নয়! এমনকি বল যদি দুই স্ট্যাম্পের মাঝ দিয়ে চলে যায়, তাতেও আউট হওয়ার বিধান নেই। কি বিচিত্র নিয়ম! তাও তো ‘লষ্ট বল’ নামে একটি আইন আছে। এই আইন প্রবর্তনের আগে ব্যাটের আঘাতে বল গাছের মগডালে আটকালে কিংবা বল কোনো পুকুরে পড়লে বল মাঠে না আসা পর্যন্ত ব্যাটসম্যানরা রান নিতে পারতেন। রক্ষে, না হলে দর্শকদের মাঠে বিছানা-পাটি নিয়ে যেতে হত!
একজন বোলার এক হাতে বল করার পর অন্য হাতে বল করতে চাইলে তার সেই স্বাধীনতাও নেই। এ জন্য আম্পায়ারের অনুমতি নিতে হবে। অনুরূপভাবে ব্যাটসম্যান হাত বদল করতে চাইলে বিপক্ষ দলের অধিনায়কের অনুমতি চাইতে হবে। এটা কি কোনো কথা হলো?
টেস্ট ক্রিকেটে কোন দল যদি ব্যাট করতে নেমে মনে করে, তারা প্রতিপক্ষকে ব্যাট করতে দেবে না, সেটা ইচ্ছে করলেই তারা পারে। তাদের ব্যাটসম্যানরা টানা পাঁচ দিন ব্যাট করলে প্রতিপক্ষ দল ব্যাট করার সুযোগই পাবে না। একদিনের ক্রিকেটে ফিল্ডিং করতে যেয়ে এক বা একাধিক ফিল্ডার আহত কিংবা অসুস্থ হলে, তার বিকল্প কেউ ব্যাট করতে পারবেন না। এমনকি প্রতিপক্ষ অধিনায়ক যদি অনুমোদন না দেন, তাহলে বিকল্প ফিল্ডারও মাঠে নামানোও যাবে না। ফুটবলে লাল কার্ড পেলে যেমন কম খেলোয়াড় নিয়ে খেলতে হয়, ক্রিকেটেও তেমনটি করতে হবে। এটা কি ভদ্রলোকের খেলা হলো?
ব্যাটসম্যান রান নেয়ার সময় ফিল্ডার যদি উইকেট ভেঙ্গে ফেলেন অর্থাৎ টুকরো টুকরো করেন এবং ভাঙ্গার আগে ব্যাটসম্যান পপিং ক্রিজের মধ্যে পৌঁছে যান, তখন ভাঙ্গা উইকেট দেখে ব্যাটসম্যান আবার রান নেয়া শুরু করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাকে আউট করতে হলে বল দিয়ে ভাঙ্গা স্ট্যাম্পে এমন জোরে মারতে হবে, যাতে ঐ স্ট্যাম্প মাটি থেকে উপড়ে গিয়ে মাঠে পড়ে অথবা বল ধরা হাতে যে কোন স্ট্যাম্প মাটি থেকে তুলে ফেলতে হবে কিংবা সব কটি স্ট্যাম্প যদি মাঠে পড়ে থাকে, তাহলে যে কোন একটি স্ট্যাম্পকে পুনঃস্থাপন করে তারপর তা ভাঙ্গতে (ভূমিচ্যুত) হবে। এটা অনেকটা মাস্তানি করার মত ব্যাপার নয় কি?
ব্যাট সাধারণত দু’জনেই করেন। কিন্তু অনেক সময় ব্যাটিং পক্ষের চারজন একসঙ্গে উপস্থিত থাকতে পারবেন। দুই ব্যাটসম্যান যদি দৌড়াতে অক্ষম হন, তাহলে তারা দু’জনই রানার নিতে পারবেন। তখন কি একজন ব্যাটসম্যান আধাআধি হয়ে যান? রানার থাকাবস্থায় ব্যাটসম্যান রান নেয়ার জন্য পপিং ক্রিজের বাইরে গেলে ফিল্ডার স্ট্যাম্প ভেঙ্গে দিলে ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যাবেন। তাহলে কি রানার মাঠে থেকে যাওয়ার কথা নয়?
কোন উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ফিল্ডিং করার সময় ১৫ মিনিটের বেশি মাঠের বাইরে থাকলে তিনি তার দলের হয়ে খেলা শুরুর ২০ মিনিট পর্যন্ত ব্যাট করতে পারবেন না। তবে এ সময়ের মধ্যে যদি দলের পাঁচ উইকেটের পতন ঘটে, তাহলে ব্যাট করতে পারবেন। অনুরূপভাবে কোন বোলার ১৫ মিনিটের উপরে যতক্ষণ বাইরে থাকবেন, মাঠে এসে ততক্ষণ বল করতে পারবেন না। এটা কি মাঠ ত্যাগ করার শাস্তি?
ফুটবলে গোলরক্ষকের পরিবর্তে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে আরেকজন গোলরক্ষক নামতে পারেন। কিন্তু ক্রিকেটে বিকল্প উইকেটরক্ষকের নামানোর সুযোগ নেই। খেলা পরিত্যক্ত হলে ক্রিকেটারের ব্যক্তিগত খাতায় লাভ-লোকসান যোগ হলেও দেশ বা কাবের খাতা শূন্য থেকে যায়। কি অদ্ভুত নিয়ম!
ক্রিকেট এমন একটি খেলা, যাতে বিচিত্র রেকর্ডের সমাহার। ভাল কিছু করলেও রেকর্ড। মন্দ কিছু করলেও রেকর্ড। কোনো ব্যাটসম্যান রান না করতে পারলে কিংবা কোন বোলার উইকেট নিতে না পারলেও রেকর্ডের পাতায় স্থান পাবেন। যেমন টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটধারী ক্যারিবীয় বোলার কোর্টনি ওয়ালশ ব্যাটসম্যান হিসেবেও রেকর্ড গড়েছেন। তিনি সর্বাধিকবার শূন্য রানে আউট হয়েছেন। এটাও রেকর্ড!
ক্রিকেটে আউট কত প্রকার? সঠিকভাবে বলা মুশকিল। নানা কিসিমের আউট। এর মধ্যে একটি ‘টাইমড আউট’। একজন ব্যাটসম্যান আউট হওয়ার পর নতুন ব্যাটসম্যান মাঠে ঢুকতে দু’মিনিটের বেশি দেরি করলে প্রতিপক্ষ আবেদন জানালে আম্পায়ার তাকে আউট ঘোষণা করবেন। অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট। কোন ব্যাটসম্যান কখন আউট হবেন, তা ক্রিকেট দেবতার পক্ষেও বলা সম্ভব নয়। যে কারণে পরবর্তী ব্যাটসম্যানকে সর্বদা ক্রিকেটীয় সাজ-সজ্জায় সজ্জিত হয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয়। কিন্তু যখন তার মাঠে নামার ডাক আসে, ঠিক তখন যদি তার বাথরুম পায় কিংবা বাথরুমে থাকেন, সেক্ষেত্রে কী হবে?
এত নিয়মের মাঝে ক্রিকেটে কিছু কিছু ‘অনিয়ম’ও পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন খেলা নির্দিষ্ট মাপের মাঠে বা কোর্টে খেলতে হয়। অথচ ক্রিকেটে আমরা কী দেখছি? কখনো অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি)-এর বিশাল মাঠে খেলা হচ্ছে, আবার কখনো কেনিয়ার নাইরোবী জিমখানার এক চিলতে মাঠেও খেলা হচ্ছে?
কেন এই বৈপরীত্য?
ক্রিকেট খেলা ৪২টি আইনের কঠোর শাসনে বাঁধা। তারপরও নাকি কুলিয়ে ওঠা যায় না। অনেক সময় মাঠে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখন আম্পায়ারকে তাৎক্ষণিক বুদ্ধি খাটিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হয়। সে সিদ্ধান্ত ঠিক হোক কিংবা না হোক, তা মাথা পেতে নিতে হবে। পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্তের আলোকে তৈরি হয় নতুন আইন। এরই নাম ক্রিকেট।
তারপরও এই ক্রিকেটকে নিয়ে স্যার নেভিল কার্ডাস, শঙ্করীপ্রসাদ বসু প্রমুখ লিখিয়েরা যে কালজয়ী সাহিত্য রচনা করেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। আসলে ক্রিকেট খেলতে হলে যে একাগ্রতা, নিয়মানুবর্তিতা, বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতা, তীক্ষèতা, উৎসাহ ও মেজাজ থাকতে হয়, তেমনিভাবে ক্রিকেট বুঝতে হলে আবেগ, উচ্ছ্বাস, ভালবাসা আর রাজকীয় মন থাকতে হয়। তা না হলে কাঠের ব্যাট আর বলের ঠোকাঠুকিতে যে ‘সুমধুর কলতান’ সৃষ্টি হয়, তা কি আর অনুভব করা যাবে? আমার মত ভোঁতা বুদ্ধির লোক যে ক্রিকেটই বোঝে না, সে ক্রিকেটের রস আস্বাদন করবে কীভাবে?
দৈনিক যুগান্তর : এপ্রিল ২০০০
ক্রিকেটীয় অসততা

ক্রিকেট তার আভিজাত্য হারিয়েছে অনেক আগেই। এখন বিশ্বাসযোগ্যতাও হারানোর পথে। তাহলে ক্রিকেটে আর থাকেটা কী? মহান ও রাজকীয় এই খেলাটির পরতে পরতে যে কেদ জমেছে, তা দূর হবে কীভাবে? এলিটদের এই খেলাটি বিশ্বায়নের খোলা জানালা দিয়ে যখন সাধারণ্যে নিয়ে আসার সর্বাÍক প্রচেষ্টা চলছে, ঠিক তখন কেলেংকারির যুপকাষ্ঠে বলি হলো মানুষের চমৎকার ব্যবহারের উৎকৃষ্ট এই মাধ্যমটি। ক্রিকেট দুনিয়াকে হতভম্ব করে দিয়েছেন ক্রিকেটের ‘রোল মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হ্যান্সি ক্রনিয়ে। ক্রিকেটে ঘুষ, জুয়া, পাতানো খেলা নতুন কোনো বিষয় নয়। অতীতে এর সঙ্গে অনেকেই কম-বেশি জড়িয়েছেন। নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে ভারি করেছেন নিজেদের ব্যাংক একাউন্ট। এক্ষেত্রে প্রকাশ্য আলোচনায় নাম এসেছে ডেনিস লিলি, রডনি মার্শ, সেলিম মালিক, ওয়াসিম আকরাম, ইজাজ আহমেদ, মুশতাক আহমেদ, শেন ওয়ার্ন, মার্ক ওয়াহ প্রমুখের। এরা নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে সক্ষম হলেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন ক্রিকেটের ইমেজ। কিন্তু হ্যান্সি ক্রনিয়ের ঘুষ নেয়ার স্বীকারোক্তি কাঁপিয়ে দিয়েছে ক্রিকেট জগতকে। কেননা, ক্রিকেটের এক অসাধারণ চরিত্র হ্যান্সি ক্রনিয়ে। তার ব্যক্তিত্ব, ডেডিকেশন, লড়াকু মেজাজ একজন আদর্শ ক্রিকেটারের প্রতিকৃতি। দক্ষিণ আফ্রিকান সমাজের একটি স্তম্ভ হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। নিপাট ভদ্রলোক ক্রনিয়ে সামান্য কিছু ডলারের বিনিময়ে এতো সস্তায় নিজের বিবেক ও সততাকে বিক্রি করে দেবেনÑ এটা ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার। তার প্রতি মানুষের অসম্ভব আস্থা ও প্রবল ভালবাসা ছিল। যে কারণে ভারতীয় পুলিশ যখন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে, সেটি কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার একজন নাগরিকের মন্তব্য ছিল এমন : ‘পোপ জন পল একাধিক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখেÑ এটা বিশ্বাস করবো আমি। কিন্তু ক্রনিয়ে বাজি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তা আমার বিশ্বাস হবে না।’ প্রোটিয়াস অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়েও অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমার দেশ খাটো হয়Ñ এমন কোনো কাজ আমি করবো না।’ ক্রনিয়ের এই বক্তব্যে তার পাশে এসে দাঁড়ায় তামাম ক্রিকেট বিশ্ব। অথচ নিজের দেশ, তাবৎ ক্রিকেট জগতকে বিশাল ঝাঁকি দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় স্ক্যান্ডালের নায়ক হলেন তিনি। জীবনের একটি সিদ্ধান্তে ভুল করায় মুহূর্তেই তিনি মহানায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হয়েছেন। যদিও বিবেকের কাছে পরিষ্কার এবং বুক হালকা করার জন্য তিনি অকপটে স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেন, ‘আমি ভুল করেছি।’ এর ফলে তার বুকে চেপে বসা জগদ্দল পাথরের পাষাণভার নেমে গেলেও ক্রিকেট হারায় তার বিশ্বাসযোগ্যতা। তিনি শুধু তার দেশকে লজ্জায় ডোবাননি, খাটো করেছেন ক্রিকেটের সম্মানকে। ক্রিকেটীয় অনিশ্চয়তাকে এখন আর কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না! ক্রিকেটে অনেক দুষ্টক্ষত রয়েছে, কিন্তু নৈতিকতার ভিত্তিতে এমনভাবে কখনো টান পড়েনি। এ প্রসঙ্গে ক্রিকেট ভাষ্যকার হর্ষ ভোগলের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘ক্রিকেট জগত অনেক ঝড়-ঝঞ্ছার মধ্যে পড়েছে। বডিলাইন সিরিজ, দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা, প্যাকার সিরিজ ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর কোনোটিতে প্রতারণার কোনো উপাদান ছিল না। ছিল চাকিং বিতর্ক। বল ট্যাম্পারিং ইস্যুতে ক্রিকেট বিশ্ব হয়ে উঠেছিল খুবই উদ্বিগ্ন। ওগুলো আসলে প্রতারণা; কিন্তু লুকানোর কিছু নয়। ওগুলো দৃশ্যমান অপরাধ, এই অপরাধ ধরে তার সমাধান করতে চাই সদাপ্রস্তুত চোখ এবং একটি সংগঠিত সংগঠন। কিন্তু ম্যাচ ফিক্সিংয়ের মাধ্যমে আপনি একটি বৃহৎ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেনÑ এটা এক সুসংগঠিত অপরাধ।’
হ্যান্সি ক্রনিয়ের ঘটনাটি এমন এক সময় চাউর হয়, যখন ক্রিকেটের বিশ্বায়নের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) উদযাপন করছিল ‘ক্রিকেট উইক’। বিশেষত আইসিসি প্রধান জগমোহন ডালমিয়া চাচ্ছিলেন ক্রিকেটকে তিনি ইংলিশ আভিজাত্যের মোড়কে বন্দি অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাবেন। এ জন্য উদ্যোগ নেয়া হয় ক্রিকেটের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের পর্যায়ক্রমিক কার্যক্রম। কিন্তু ‘ক্রনিয়েগেট’-এর কারণে বড় ধাক্কা খেলো ক্রিকেট।
সাধারণ মানুষের মনে যদি একবার সন্দেহের বীজ পোঁতা যায়, তাহলে ক্রিকেটকে যতোই ভদ্রলোকের খেলা বলা হোক কিংবা গ্ল্যামারের প্রলেপ দেয়া হোক না কেন, ক্রিকেট হারিয়ে ফেলবে তার রূপ-রস-সৌন্দর্য। এখনই প্রশ্ন উঠছে ক্রিকেটের অনেক শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ, বাহারী শট নিয়ে। জয়-পরাজয়ই খেলার প্রধান আকর্ষণ। এ থেকেই দর্শকরা খুঁজে পান আনন্দ। কিন্তু কোনো খেলা চলাকালে দর্শকরা সন্দেহের দোলায় দুলতে থাকলে সে খেলা মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারবে না। ইতোমধ্যে ক্রিকেট যে আভিজাত্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে, তা পুনরুদ্ধার করা না গেলে ক্রিকেটের বিশ্বায়ন তো দূরে থাক, তার গ-ি আরো সীমিত হয়ে পড়বে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা প্রয়োজন।
ক্রীড়াজগত : ১৬ এপ্রিল ২০০০


ফেয়ারওয়েল টু স্যার ডন

তার চলে যাওয়াটা খুব একটা অপ্রত্যাশিত নয়। কেননা, জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েছিলেন ক্রিকেটের কিংবদন্তী স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান। কৌতূহল ছিল, জীবনের সেঞ্চুরি তিনি পূর্ণ করতে পারেন কিনা? আর মাত্র আটটি বছর পাড়ি দিলে তার সেঞ্চুরি পূর্ণ হত। কিন্তু তা না হওয়ায় কিছুটা আক্ষেপ রয়ে গেল। অবশ্য তার চেয়ে বড় আক্ষেপ ব্রাডম্যানের ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে। টেস্ট ক্যারিয়ারে আর মাত্র চার রান করতে পারলে তার গড় রান দাঁড়াত ১০০। কিন্তু শেষ ইনিংসে শূন্য রান করায় অপূর্ণ থেকে যায় এই ম্যাজিক ফিগার। এই যে অতৃপ্তি, অপূর্ণতাÑ তা নিয়ে গত অর্ধ-শতাব্দীকাল ধরে ক্রিকেট অনুরাগীদের দীর্ঘশ্বাসের শেষ নেই।
নিভৃত জীবনযাপন পছন্দ করতেন স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান। প্রচারের আলো থেকে সবসময় নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। কিন্তু ব্রাডম্যানের মহাকাব্যিক জীবন নিয়ে ক্রিকেট অনুরাগীদের ছিল অন্তহীন কৌতূহল। যদিও স্কোর বোর্ডে সব কথা বলা হয় না, তারপরেও ৫২ টেস্ট খেলে ৯৯ দশমিক ৯৪ গড়ে ৬৯৯৬ রানের যে স্কোর গড়েছেন, তা আজও চির অম্লান হয়ে আছে। এ কারণে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বকালের সর্বসেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি বিবেচিত হয়ে আসছেন। ক্রিকেটার হিসেবে তার খ্যাতি ও সাফল্য অন্য কারো সঙ্গে তুলনা হয় না। পক্ষান্তরে ক্রিকেটের যে আভিজাত্য, শৃ´খলা, নিয়মনিষ্ঠা, আচরণবিধিÑ তার প্রতিরূপ ছিলেন ব্রাডম্যান।
তিনি শুধু খেলার জন্যই ক্রিকেট খেলেননি। তার লক্ষ্য ছিল সুস্থ ও আকর্ষণীয় পথে খেলার মানের বিকাশ ঘটানো এবং ক্রিকেটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সদিচ্ছার বিকাশ ঘটানো। আর এ ক্ষেত্রে তিনি অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন। যদিও তিনি ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে প্রশ্ন করেছেন, ‘আমার ক্যারিয়ার কি মানবজাতির কোনো উপকারে এসেছে? কিছু কি দিতে পেরেছি আমি?’ এ প্রশ্ন একজন মহানুভব ব্যক্তিত্বের। যিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন একটা চিহ্ন রেখে যেতে। যারা শুধু এলাম, দেখলাম এবং চলে গেলাম মনোভাব নিয়ে আসেন- ডন ব্রাডম্যান তাদের অনুসারী নন। এ কারণে আÍবিশ্লেষণে তিনি বলেছেন, ‘আমার জন্মের বহু আগে থেকেই ক্রিকেট নামক খেলাটির অস্তিত্ব ছিল। আমার মৃত্যুর পরও বহু শতাব্দী ধরে এ খেলা হতে থাকবে। একজন পিয়ানোবাদক বিটোফেনের সুরকে যেভাবে ব্যাখ্যা করবেন, আমার ক্যারিয়ারেও আমি ক্রিকেটকে সেভাবেই ব্যাখ্যা করার সুযোগ পেয়েছি।’ একজন শিল্পী ও মহৎ ব্যক্তির পক্ষেই এমন কথা বলা সম্ভব। ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ব্রায়ান কোজ বলেছেন, ‘তিনি কখনো তার অর্জন নিয়ে অহংকার করতেন না। তিনি ছিলেন নম্র স্বভাবের। আজকের খেলোয়াড়দের তার কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে।’ অত্যন্ত সাদামাঠা জীবনযাপন করতেন। শুধু ক্রিকেটার হিসেবে তিনি মডেল নন, একজন
আদর্শ মানুষ হিসেবে তিনি অনুসরণীয় ছিলেন। অ্যালকোহল ও তামাক তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
জীবিতাবস্থায় ব্রাডম্যান যেমন লোকচক্ষুর আড়ালে নিভৃতচারী থাকতে ভালবাসতেন, মৃত্যুর পরও সেভাবে থাকতে চেয়েছেন। তার ইচ্ছের প্রতি সম্মান দেখাতে তাকে নিরিবিলি সমাহিত করা হয়। এমনকি কেউ যেন তার সমাধিতে ফুল না পাঠান, মৃত্যুর আগে সে অনুরোধও করে যান। বরং ফুল কেনার অর্থ দিয়ে যাতে অনগ্রসর সমাজ ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ক্রিকেট খেলার কাজে লাগানো হয়, সে জন্য ‘ব্রাডম্যান স্মৃতি তহবিল’-এ তা দান করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
অশ্রুসজল চোখে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড ব্রাডম্যানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছেন, ‘ব্রাডম্যান শুধু একজন মহান ক্রিকেটারই ছিলেন না, তিনি অস্ট্রেলিয়ার অর্থনৈতিক মন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রেলিয়ার জনগণের মাঝে আশার সঞ্চার করেছিলেন।’ ব্রাডম্যান খেলার পাশাপাশি তার ব্যক্তিত্ব ও মানবিকতা দিয়ে একটি জাতিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছেন। সাহস ও আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছেন। এমন নজির খুব কমই আছে। এ কারণেই তিনি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত হয়ে বিদায় নিয়েছেন।
ডন ব্রাডম্যান ঘুমের মাঝে ঘুমের দেশে চলে গেলেও তিনি এখনও সকলের অনুপ্রেরণা ও ভালবাসার উৎস।
ক্রীড়াজগত : ১ মার্চ ২০০১


হ্যাটস্-অফ কংগ্র্যাচুলেশনস টু ওয়ালশ

কোর্টনি ওয়ালশের বিদায়ের মধ্য দিয়ে ক্রিকেটের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে। শুধু ক্রিকেটার নয়, একজন মহান ব্যক্তি হিসেবে ওয়ালশ অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন।
টেস্ট ক্রিকেটে এমন একটা সময় ওয়ালশের অভিষেক হয়, যখন কাইভ লয়েডের নেতৃত্বে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের দৌর্দন্ড প্রতাপ। ফাস্ট বোলার জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল ও মাইকেল হোল্ডিং তখন রীতিমত ক্রিকেট বিশ্বের বোলিং ত্রাস। এ সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের পেস অ্যাটাকে স্থান করে নেয়াটা খুব সহজ ছিল না। অনেকটা মেঘে ঢাকা তারা হয়ে ওয়ালশের যাত্রা শুরু হয়। প্রাথমিক অবস্থায় দলে স্থায়ী আসন করে নেয়াটাই ছিল তার লক্ষ্য। কখনোই ভাবেননি ২০০ উইকেটের বেশি পাবেন। কিন্তু তিনি তার প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে অনেক দূর যান। সীমের ব্যবহার ছাড়াই বাতাসে বলের মুভমেন্ট এবং পেস, লাইন ও লেন্থ ঠিক রেখে ডেলিভারির সূক্ষ্ম কারুকাজ ও বৈচিত্র্য আনতে পারাটাই তার বোলিং-এর চমৎকারিত্ব। তাছাড়া খেলার প্রতি আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, শৃংখলা ও ফিটনেস দিয়ে তিনি তার অবস্থান সুসংহত করেন। ১৯৮৪ সালের নভেম্বরে পার্থে অস্ট্রেলিয়ার গ্রায়েম উডের উইকেট নিয়ে যে পথ চলার শুরু, তা শেষ হয় ২০০১ সালের ২৩ এপ্রিল দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যালান ডোনাল্ডের উইকেট নিয়ে। দীর্ঘ ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে ১৩২টি টেস্ট খেলে সর্বোচ্চ ৫১৯টি উইকেট নিয়ে প্রমাণ করেন তিনি অন্যতম একজন সফল বোলার। তার সাফল্যের মূলমন্ত্র হলো ফর্ম ধরে রাখার ক্ষমতা, দীর্ঘস্থায়িত্ব ও কাসের সমন¦য়। যে কারণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এ যাবৎকালের সেরা অধিনায়ক কাইভ লয়েড ওয়ালশকে ‘সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ‘তার রয়েছে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার এবং তিনি একজন কালজয়ী ক্রিকেটার ও মহৎ ব্যক্তি। তিনি ক্রীড়াঙ্গনের এক মহান দূত।’
খেলার মাঠে ওয়ালশ সকল খেলোয়াড়ের কাছেই দারুণভাবে সম্মানিত। শুধু দলের সতীর্থরা নয়, প্রতিপক্ষরাও তাকে পছন্দ করেন। মাঠে ও মাঠের বাইরে তার ব্যবহার, খেলোয়াড়ী মনোভাব ও খেলার প্রতি তার একাগ্রতা তরুণদের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ম্যাচ গড়াপেটা, বাজি ও স্লেজিং-এর এই কূটকৌশলের যুগে ওয়ালশ এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। দলের নিশ্চিত বিপর্যয়ের মুখে তিনি ক্রিকেটীয় আচরণ প্রদর্শনে পিছপা হননি। তাতে হয়ত দল হেরেছে, কিন্তু জয় হয়েছে ক্রিকেটের।
ক্রিকেট ইতিহাসে অনেক ক্রিকেটারের বিচরণ ঘটেছে। তাদের অনেকেই চলে গেছেন নীরবে-নিভৃতে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কোর্টনি ওয়ালশ। তিনি খেলার মাঠ থেকে যে সম্মান ও ভালবাসা পেয়েছেন, তা সত্যিই বিরল। ক্যারিবীয় ক্রিকেটের এক দুঃসময়ে তিনি ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন। গত বছরের জুন থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট ক্রিকেটে জয় পাওয়াটা স্বপ্ন হয়ে ওঠে। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে সিরিজের শেষ টেস্টে বহুল কা´িখত দুর্দান্ত জয় পায় তারা। অথচ প্রোটিয়াসদের শেষ ব্যাটসম্যান পল অ্যাডামসের ক্যাচ মারলিন স্যামুয়েলস লুফে নিলে ক্যারিবীয়দের জয় যখন নিশ্চিত হয়, তখন বিজয়ের আনন্দের চেয়ে সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন কোর্টনি ওয়ালশ। সাবিনা পার্ক ক্রিকেট মাঠের উপস্থিত দর্শকরা ছাড়াও দু’দেশের ক্রিকেটাররা বিপুল করতালির মাধ্যমে তাকে বিদায় অভিবাদন জানান। সে সময় মাঠে সৃষ্টি হয় আবেগময় পরিবেশ। সকলের চোখ হয়ে ওঠে অশ্রুসজল।
পেশাদারিত্বের যুপকাষ্ঠে বলি হয়ে যখন ক্রিকেট তার কৌলীন্য হারাতে বসেছে, ক্রিকেটাররা মানছেন না ক্রিকেটীয় সৌজন্যের রীতি-নীতি, তখন একজন নীতিনিষ্ঠ, মার্জিত ও নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেটারের বিদায়ে সত্যিই ক্রিকেটে একটা অপূরণীয় শূণ্যতার সৃষ্টি হলো। ফাস্ট বোলিং-এ তিনি নিশ্চয় তরুণদের আদর্শ হবেন, পাশাপাশি মহৎ মানুষ হিসেবে থাকবেন সকলের শ্রদ্ধার আসনে। হ্যাটস্-অফ কংগ্র্যাচুলেশনস টু ওয়ালশ।
ক্রীড়াজগত : ১ মে ২০০১
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ক্রিকেট

প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে ক্রিকেট। আধুনিক জীবনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রিকেটও হয়ে ওঠেছে গতিময়। সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে চলতি আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ক্রিকেটে এলবিডব্লু’র সিদ্ধান্ত আম্পায়াররা নিতে পারছেন টিভি আম্পায়ারের সাহায্যে। এবারই প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম ম্যাচেই টিভি আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে প্রথম এলবিডব্লু হয়েছেন পাকিস্তানের শোয়েব মালিক। শ্রীলংকার ফাস্ট বোলার চামিন্ডা ভাসের বলের জোরালো আবেদনে অস্ট্রেলিয়ার আম্পায়ার ড্যারিল হার্পার তৃতীয় আম্পায়ার দক্ষিণ আফ্রিকার রুডি কোয়ের্তজেনের সাহায্য নিলে তিনি এলবিডব্লু’র সিদ্ধান্ত দেন। এটা ক্রিকেটের জন্য একটি বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত হয়ে থাকবে। কেননা, এলবিডব্লু’র সিদ্ধান্ত নিয়ে একটা অসন্তুষ্টি সবসময়ই ছিল। কখনো ব্যাটসম্যান, কখনো বোলার এলবিডব্লু’র সিদ্ধান্তে হয় খুশী, নয় অখুশী হয়েছেন। এখন থেকে কিছুটা হলেও তাদের অসন্তুষ্টি দূর হবে। অবশ্য এ সিদ্ধান্ত নিয়েও আছে মতভিন্নতা। শ্রীলংকার অধিনায়ক সনাৎ জয়াসুরিয়া এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করলেও আপত্তি জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিং। পন্টিং মনে করেন, ‘খেলাটা আরো ধীর গতির হয়ে যাবে।’
ইংরেজদের হাত ধরে যে ক্রিকেটের সূচনা, তাতে ছিল শৃ´খলাপরায়ণতা। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের গর্ভ থেকে যেদিন একদিনের ক্রিকেটের জন্ম হয়, সেদিন থেকেই পাল্টে যেতে থাকে ক্রিকেট। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার চ্যানেল নাইন টেলিভিশনের মালিক কেরি প্যাকার পাল্টে দিয়েছেন ক্রিকেটের খোলনলচে। শ্বেত-শুভ্র ক্রিকেটকে তিনি রঙীন ও বর্ণময় করে তোলেন। শাদা বল, রঙীন পোশাকের পাশাপাশি প্রবর্তন করেন দিবা-রাত্রির ক্রিকেট। ফাডলাইটের আলোয় ক্রিকেট হয়ে ওঠে ঝলমলে। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি ছিল অকল্পনীয় ঘটনা। কল্পনাকে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে আনেন কেরি প্যাকার। তারই পথ অনুসরণ করে ১৯৭৯ সালের ২৭ নভেম্বর সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের ফাডলাইটে প্রথম সরকারীভাবে অনুষ্ঠিত হয় একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। আর এখন রঙীন বল, রঙীন পোশাক ও ফাডলাইট ছাড়া একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে মনে হয় ম্লান, বিবর্ণ। ক্রিকেট বরাবরই ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার আনুকূল্য পেয়ে এসেছে। রেডিওর ধারাভাষ্য ও টেলিভিশনে ক্রিকেট সম্প্রচার হওয়াটা নতুন নয়। এখন আমরা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের খেলা দেখতে পারি। কিন্তু ক্রিকেটকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসার কৃতিত্ব কেরি প্যাকারের। তিনি মাঠের নানা কোণে নয়টি ক্যামেরা বসিয়ে বিভিন্নভাবে এবং স্লো-মোশনে খেলা দেখার ব্যবস্থা করেন। আর এখন তো কম্পিউটারের সহায়তায় ক্রিকেট হয়ে উঠেছে কম্পিউটার গেমসের মত। ক্রিকেট অনুরাগীরা বাসায় বসে কিংবা অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে আয়েশ করে চায়ের কাপে মৃদু মৃদু চুমুক দিয়ে ক্রিকেট উপভোগ করেন রসিয়ে রসিয়ে। প্রতিটি বল, প্রতিটি বোলার, ব্যাটসম্যান, ফিল্ডারের মুভমেন্ট আমরা দেখতে পারি, জানতে পারি। একই সঙ্গে সুন্দরী দর্শকের মুগ্ধ দৃষ্টি, প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ও স্বাগতিক দেশের আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট খেলার মাঝে মাঝে বাড়তি আনন্দ হিসেবে ধরা দেয়।
প্রযুক্তির স্পর্শে ক্রিকেট আরো বেশি মোহনীয় হয়ে ওঠার পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এতে অবশ্য ক্রিকেট তার ঐতিহ্য কিছুটা হারালেও প্রযুক্তির জয়যাত্রাকে তো অস্বীকার করা যাবে না। তবে প্রযুক্তির স্পর্শে ক্রিকেট আনন্দময় হয়ে উঠলেও স্টেডিয়ামের দর্শক সংখ্যা হ্রাস পাবার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা, ঘরে বসে যদি মাঠের তুলনায় ভালভাবে ক্রিকেট উপভোগ করা যায়, তাহলে গ্যালারীতে বসে বসে ক্রিকেট দেখার আগ্রহ কমে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া প্রতিটি ক্ষেত্রেই যন্ত্রই যদি সিদ্ধান্তের মালিক হয়ে ওঠে, তাহলে ক্রিকেট কি নি®প্রাণ হয়ে যাবে না? এমন একটা অভিযোগও ইদানীং উঠছে। তবে প্রযুক্তি ক্রিকেটের জন্য আশীর্বাদ না নেতিবাচক, সে বিষয়ে আমরা এখনই কোনো সিদ্ধান্তে আসতে চাই না। কোন্টা ভাল, কোন্টা
মন্দÑ সময়ই তা বলে দেবে। আমরা না হয় প্রযুক্তির সুবিধাটুকুই আপাতত:
উপভোগ করি।
ক্রীড়াজগত : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০২


সেই ক্যালিপসো সুর

ধ্রুপদী ও উন্মাতাল ক্রিকেটের যুগপৎ আনন্দরসে মাতিয়ে দিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল এখন বাংলাদেশে। দুটি টেস্টের পাশাপাশি তিনটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলবে ক্যারিবীয় দল। এর আগে সফরকারী দল বাংলাদেশের সঙ্গে তিনটি ওয়ানডে ম্যাচ খেললেও এই প্রথম মুখোমুখি হবে টেস্ট ক্রিকেটে। ইতোমধ্যে ১৫টি টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা হলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে টেস্ট খেলাটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য নতুন ইতিহাস হয়ে থাকবে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট তো সুদূরের স্বপ্ন। দুলে ওঠা অতীতের রঙধনু। যদিও ১৯৫৯ সালের মার্চে ক্যারিবীয়রা টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন ঢাকার মাঠে। ওয়েসলি হলের ঝড়ো গতির দুরন্ত বোলিং আর অলরাউন্ডার গ্যারি সোবার্সের প্রাণোচ্ছ্বল ব্যাটিং-এর উচ্ছ্বাস এখনো অনেক প্রবীণের চোখে-মুখে প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে জীবনের সেরা স্মৃতি হয়ে। এর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের উজ্জ্বল দিনগুলোর কোনো স্মৃতি নেই। তবে ১৯৯৯ সালে ঢাকায় সফররত ওয়েস্ট ইন্ডিজ দুটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে। সে দলের ব্রায়ান লারা, কোর্টনি ওয়ালশ ও জিমি এডামস কিছুটা টাটকা স্মৃতি রেখে গেলেও এই দেশটিকে নিয়ে ছিল রহস্যের লুকোচুরি খেলা। দীর্ঘদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দেশটা অনেকের কাছে একটা ধাঁধা হয়ে ছিল। এর ভৌগোলিক কিংবা রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা ছিল না। মনে মনে অনেকেই ভাবতেন, এই দেশটা এই পৃথিবীর বাইরে কোথাও অবস্থিত; যেখানে শুধু ক্রিকেট খেলাই হয়ে থাকে। ফুটবলে যেমন ব্রাজিল, ক্রিকেটেও তেমনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়-জয়কার। রেডিওতে ক্রিকেটের ধারাভাষ্যে কিংবা কখনো-সখনো পত্রিকার নিউজপ্রিন্টের পাতায় জরাজীর্ণভাবে ভয়ংকর ভঙ্গিমায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের গতিদানবদের দু’একটা ছবি ছাপা হলে তাতেই কেঁপে উঠত অনেকেরই বুক। ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসা দূরবর্তী ইথারে আস্তে-ধীরে সবাই পরিচিত হতে থাকেন স্যার কাইভ ওয়ালকট, ফ্রাংক ওরেল, এভারটন উইকস, কনরাড হান্ট, ওয়েসলি হল, আলভিন কালিচরন, গ্যারি সোবার্স, কাইভ লয়েড, রোহান কানহাই, কলিন ক্রফট, অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং, ভিভিয়ান রিচার্ডস, ম্যালকম মার্শাল, গর্ডন গ্রীনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স প্রমুখের সঙ্গে। এদেরকে মনে হত রূপকথার নায়ক। ক্রিকেট খেলার চেয়ে এদের কথাবার্তা, চালচলন, জীবনযাত্রা আর গুজব-গুঞ্জনই ছোট ছোট ঢেউ হয়ে ভেসে আসতো সবার কাছে। আর তাতে সবাই দুলে দুলে উঠতেন। ক্রিকেটের যে আচরণ মানুষকে মহৎ ও মহানুভব করে, তা এদের মাঝেই সবাই পেয়েছেন। কেননা, তারা ক্রিকেট খেলেছেন খেলার আনন্দে।
ইলেকট্রোনিক্স মিডিয়ার কৌলীন্যে খেলা দেখার পর সবাই আস্বাদ পান ক্যারিবীয় ক্রিকেটের তাল-লয়-সুরের। সবার হৃদয়ে স্পন্দিত হয় কালিপসো সুর। ক্যারিবীয় বোলারদের মৃত্যুর ফিসফিসানির মত বোলিং আর ব্যাটসম্যানদের রাজকীয় ভঙ্গিমায় বাধাবন্ধনহীন ব্যাটিং সবার কাছে ক্রিকেটকে মর্যাদার উচ্চাসনে নিয়ে যায়। বিশেষত কাইভ লয়েডের অধিনায়কত্ব, ভিভ রিচার্ডসের ক্যালিপসো ব্যাটিং আর পেস ব্যাটারি অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, মাইকেল হোল্ডিং ও ম্যালকম মার্শালের আগুনের গোলার মত বোলিং-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ হয়ে উঠে অপ্রতিরোধ্য। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সমন¦য়ে গঠিত ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা উঠে আসেন গ্লানি ও বঞ্চনার যন্ত্রণা নিয়ে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশে তারা যে সাহস ও প্রতিবাদী জীবনবোধের তালিম নেন, তা ফুটে ওঠে তাদের ব্যাটে-বলে। ক্রিকেটের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হলেও যেন-তেন প্রকারে তারা কখনো জয়ী হননি। এ কারণে নিশ্চিত পরাজয়ের সামনে দাঁড়িয়েও তারা মহানুভবতা দেখিয়েছেন। এ জন্য ক্যারিবীয়দের পরাজয় জয়ের চেয়েও গৌরবজনক। ক্যারিবীয়দের জীবনের মূল কথা হলো খাও-পিও-মস্তি করো। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরে, মদ খেয়ে ও ক্যালিপসো গেয়ে কেটে যায় এদের জীবন। এর বাইরে তাদের আশা-আকা´খার সাথে মিশে আছে কেবল ক্রিকেট। যাদের হাতে কিছু টাকা-পয়সা জমা থাকে, তারা ছুটে যান স্টেডিয়ামের গ্যালারীতে অথবা টিকিট কেনার সামর্থ্য না থাকলে স্টেডিয়াম সংলগ্ন গাছের ডালে বসে দেখেন ক্রিকেট। মাথার চুলে জট, তান্ত্রিকদের মুখে দাড়ি ও বিচিত্র সাজ-পোশাকে শাঁখ বাজিয়ে আর সারাক্ষণ ড্রামের তালে তালে উপভোগ করেন ক্রিকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের চিরায়ত এই ধারা আমাদের মনের মাঝে অমলিন স্মৃতি হয়ে আছে।
নব্বই দশকে এসে বদলে যেতে থাকে ক্যারিবীয় ক্রিকেট। কাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডস ও তাদের পূর্বসূরিদের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট যে উচ্চতায় ওঠে এবং যে ঐতিহ্য গড়ে তোলে, তা ধ্বংস হতে শুরু করে রিচি রিচার্ডসনের হাত ধরে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগের ব্যাটসম্যান হয়েও অধিনায়কত্ব পাবার পর রিচি রিচার্ডসন ক্যালিপসো ক্রিকেটের আÍবিনাশী খেলায় মেতে ওঠেন। ভিভ রিচার্ডস, গর্ডন গ্রীনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স, জেফ্রি ডুজন, ম্যালকম মার্শালের মত ক্রিকেটারদের তিনি দল থেকে নির্দয়ভাবে ছেঁটে দেন। সেই যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের অধঃপতনের শুরু, সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। যাদের দৌর্র্দন্ড প্রতাপে প্রতিপক্ষের চোখের জল আর নাকের জল এক হয়েছে, আজ তারাই পাত্তা পায় না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের সেই গৌরব রবি এখন অস্তমিত। এর মাঝে ব্রায়ান লারা, কোর্টনি ওয়ালশ, অ্যামব্রোস ও কার্ল হুপারের মত বিশ্বমানের ক্রিকেটার উঠে এলেও তারা ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝলক ছাড়া ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারেননি।
হারতে হারতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যখন সাধারণ মানের দলে পরিণত হয়েছে, ঠিক তখন সম্প্রতি ভারত সফরে ওয়ানডে সিরিজে তাদের খেলা সবাইকে আশাবাদী করে তুলেছে। বিশেষ করে ক্রিস গেইল, রামনরেশ সারওয়ান, ওয়াভেল হাইন্ডস, মারলন স্যামুয়েলসের ব্যাটে যে আগুনের হল্কা দেখা যায়, তাতে অতীতের ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেন ফিরে ফিরে এসেছে। এ অবস্থায় উজ্জীবিত ক্যারিবীয় দলের বাংলাদেশ সফরে এ দেশের দর্শকরা খুঁজে পেতে পারেন নতুন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।
ক্রীড়াজগত : ১ ডিসেম্বর ২০০২



ক্রিকেট সাফারি

ব্যতিক্রমধর্মী ও বর্ণাঢ্য উৎসবের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসর অষ্টম বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এই শতাব্দীর প্রথম এই বিশ্বকাপ ক্রিকেট বিষয়, বৈচিত্র্য ও ব্যাপ্তিতে নিয়ে এসেছে নতুনত্বের ছোঁয়া।
প্রচলিত ছক থেকে বেরিয়ে আয়োজন করা হয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের নিউল্যান্ডস স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাঙময় হয়ে ওঠে আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী স্মারকমালা। সাত পর্বে বিভক্ত অনুষ্ঠানমালার মনমাতানো সুর আর ধ্রুপদী নৃত্যের তালে তালে বর্ণময় হয়ে ওঠে আফ্রিকার চিরায়ত জীবনধারা। আফ্রিকার গহন অন্ধকারে বিচরণরত হিংস্র প্রাণী আর প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্যের সাফারি, আতশবাজির নয়নাভিরাম রঙে আলোকিত ঐক্যের মর্মবাণী, আফ্রিকান বিভিন্ন শহরের প্রতিচ্ছবি, মহাসাগরের ঐশ্বর্য, সৃষ্টির আদিকথা, অংশগ্রহণকারী দলগুলোর পরিচিতি ও আলোর বন্যায় ছাড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ।
বিশ্ব মানচিত্রের আঁধার হিসেবে পরিচিত আফ্রিকা এখন উঠে আসছে আলোয়। তাকে ঘিরে যে সমস্ত রহস্যময়তাÑ তা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দীর্ঘদিন যাবৎ শ্বেতাঙ্গ শাসনে জর্জরিত আফ্রিকা এখন সবার কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। অন্ধকার আফ্রিকায় সভ্যতার আলোকরশ্মির পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরে প্রবেশ করেছে রাজকীয় খেলা ক্রিকেট। সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গরা এখনও তেমনভাবে রপ্ত করতে না পারলেও তারা হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছে ক্রিকেটকে।
৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্বকাপের উদ্বোধন হলেও মাঠের লড়াই শুরু হয় ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে। উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হয় স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবারের বিশ্বকাপ আফ্রিকার তিনটি দেশÑ খনিজ সম্পদে গরীয়ান স্বর্ণ প্রসবিনী দক্ষিণ আফ্রিকা, বনভূমিতে আবৃত প্রতিবেশী জিম্বাবুয়ে এবং খানিকটা দূরে কফি আর প্রাকৃতিক শোভাম-িত উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে গড়ে ওঠা কেনিয়ায় এই প্রথম বসেছে ক্রিকেটের সুধারসে আকন্ঠ নিমজ্জিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মহার্ঘ্য ও মহামূল্যবান আসর। ১৫টি ভেন্যুতে টানা ৪৪ দিন চলছে ৫৪টি ম্যাচ। ডারবান ও কেপটাউনে পাঁচটি করে দশটি ম্যাচ আয়োজিত হয় ফাডলাইটের আলোয়। বাদবাকী ম্যাচগুলো দিনের আলোয়। দুই প্রান্তে বসবাস করায় বাংলাদেশের দর্শকদের মাঝে মাঝে রাত জেগেও খেলা দেখতে হচ্ছে। এবারের বিশ্বকাপে ১৪টি দেশ প্রথম পর্বে দুই গ্রুপে লীগ পদ্ধতিতে খেলছে। ‘এ’ গ্রুপে রয়েছেÑ অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, ভারত, ইংল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে, হল্যান্ড ও নামিবিয়া। ‘বি’ গ্রুপে খেলছেÑ দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলংকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, কেনিয়া, বাংলাদেশ ও কানাডা। দু’টি গ্রুপের পয়েন্ট তালিকায় শীর্ষে থাকা ছয়টি দলকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে সুপার সিক্স। এরপর সেমিফাইনাল এবং ২৩ মার্চ ফাইনালের মধ্য দিয়ে শেষ হবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মহোৎসব।
একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে শুরু হয়েছে এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট। প্রাথমিক অবস্থায় অ্যামবুশ স্পনসরশীপ নিয়ে ভারত সহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে আইসিসির মন কষাকষিতে শচীন টেন্ডুলকার সহ সেরা ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বিষয়টির সুরাহা হলেও জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়ায় খেলা নিয়ে আপত্তি জানায় অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ড। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে খেলতে অস্বীকৃতি জানায় এই তিনটি দেশ। এ নিয়ে যথেষ্ট জল ঘোলা হলেও আইসিসি অটল থাকে তার অবস্থানে। সবরকম অনিশ্চয়তাকে দূরে সরিয়ে বিশ্বের সেরা দল ও সেরা ক্রিকেটাররা অংশ নিয়েছে এবারের বিশ্বকাপে। ফলে দর্শকরা দেখতে পাচ্ছেন সেরা লড়াই ও সেরা নৈপুণ্যের ঝিলিক। একদিনের ম্যাচ ক্রিকেটে যে উচ্ছ্বলতা নিয়ে এসেছে, বিশ্বকাপ তাতে পূর্ণতা এনে দিয়েছে। ক্রিকেটের রূপ-রস-মাধুর্য বিশ্বকাপের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকে। টিভির কল্যাণে এমনিতেই মানুষের ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়েছে ক্রিকেট, বিশ্বকাপ এসে পাল্টে দেয় প্রতিদিনের জীবনচিত্র।
এ দেশের মানুষের সঙ্গে ক্রিকেটের রাখীবন্ধন দীর্ঘদিনের। বনেদি এ খেলাটি শুরু থেকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় এ দেশবাসীকে। তবে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন এবং ওয়ানডে ও টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার পর জোয়ারের পানির মত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে ক্রিকেট। ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে বাংলাদেশ প্রথম অংশ নেয়। পাকিস্তানকে হারিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অঘটন ঘটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে বাংলাদেশ। যদিও এরপর বাংলাদেশ আর উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু ব্যতিক্রম কিছু নৈপুণ্যের ঝলক দিয়ে বিশ্বকে মাতিয়েছে এ দেশের ক্রিকেটাররা। তাদের এই কীর্তিগাঁথা এ দেশের মানুষের মনে এই আÍবিশ্বাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, বাংলাদেশের পক্ষে কিছু করা অসম্ভব নয়। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আশানুরূপ নৈপুণ্য উপহার দেবেÑ এই প্রতীতী এ দেশের অগণ্য ক্রিকেট অনুরাগীর।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে শুধু ক্রিকেটারদের নৈপুণ্যের ঝিলিক দেখা যায় না, একই সঙ্গে সাম্য-মৈত্রী ও বন্ধনের বিনি সূতোর মালায় গাঁথা হয় ক্রিকেট বিশ্ব। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অস্থির, টালমাটাল ও øায়ুক্ষয়ী এই সময়ে ক্রিকেট গেয়ে উঠুক মানবতা ও মিলনের জয়গান।
ক্রীড়াজগত : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৩

ক্রিকেটে পেশাদারিত্বের জয়

অস্ট্রেলীয় দলের দুর্দান্ত সাফল্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে অষ্টম বিশ্বকাপ ক্রিকেট। ৪৪ দিনব্যাপী এই বিশ্বকাপের ৫৪টি ম্যাচে দৃশ্যায়িত হয়েছে নানা রকম রোমাঞ্চকর ঘটনাÑ যা ক্রিকেটানুরাগীদের স্মৃতিপটে অম্লান হয়ে থাকবে।
সব দিক দিয়ে এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব বিশ্বকাপকে। এত বেশি দল, এত বেশি ম্যাচ ও এত বেশি দিন আর কখনো লাগেনি। এতে ক্রিকেট নতুন ব্যাপ্তি পেলেও সামগ্রিকভাবে ক্রিকেট কতটা লাভবান হয়েছে, সে প্রশ্নটাও উঠেছে। নতুন নতুন রেকর্ডের দেখা মিললেও আকর্ষণীয় ও প্রতিদ্বন্দি¡তাপূর্ণ ম্যাচের সংখ্যা ছিল খুবই অপ্রতুল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্বোধনী ম্যাচটিতে উপভোগ্য ক্রিকেটের দেখা পাওয়া গেলেও অধিকাংশ ম্যাচই দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। খেলায় যদি প্রতিদ্বন্দি¡তার আমেজ না থাকে, তাহলে প্রতিযোগিতার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। এ কারণে এবার ক্রিকেটানুরাগীরা দারুণভাবে হতাশ ও বিরক্ত হয়েছেন। এর মাঝে কোনো কোনো ক্রিকেটারের রোমাঞ্চকর পারফরম্যান্স দর্শকদের অভিভূত করেছে।
এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে দেশ ও ম্যাচের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে রেকর্ডের সংখ্যাও। বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ভারতের শচীন টেন্ডুলকার অতিক্রম করেছেন নিজেকে। তিনি এক বিশ্বকাপে ১১ ম্যাচে ৬১ দশমিক ১৮ গড়ে করেছেন ৬৭৩ রান। আগের রেকর্ডটিও ছিল টেন্ডুলকারের। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে তিনি ৭ ম্যাচে ৮৭ দশমিক ১৭ গড়ে ৫২৩ রান করেছিলেন। এছাড়া বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সর্বাধিক রান সংগ্রহের রেকর্ডও এখন টেন্ডুলকারের। ২২ ম্যাচে ৫৮ দশমিক ৮৩ গড়ে তার রান ১৭৩২। এর আগে পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদাদের ৩৩ ম্যাচে ৪৩ দশমিক ৩২ গড়ে ১০৮৩ রান ছিল। তবে ব্যাটিং গড়ে এগিয়ে আছেন অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস। ৯ ম্যাচে ১৬৩ গড়ে করেছেন ৩২৬ রান। পাকিস্তানের বিপক্ষে শচীনের ৯৮ এবং অস্ট্রেলিয়ার সাইমন্ডসের অপরাজিত ১৪৩ রানের ইনিংসটি শৌর্যে-বীর্যে ও সৌন্দর্যে ছিল অসাধারণ। শ্রীলংকার বাঁ-হাতি ফাস্ট বোলার চামিন্ডা ভাস এবার দারুণভাবে ঝলসে ওঠেন। ভাস ২৩টি উইকেট নিয়ে সর্বাধিক উইকেট সংগ্রহের দিক দিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছেন। গত বিশ্বকাপে ২০টি করে উইকেট নিয়ে ওই রেকর্ডের মালিক যৌথভাবে ছিলেন নিউজিল্যান্ডের জিওফ অ্যালট ও অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্ন। তাদের এই রেকর্ড ভাসের পাশাপাশি ভেঙ্গেছেন অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট লী ও গ্লেন ম্যাকগ্রা। উভয়ের উইকেট যথাক্রমে ২২ ও ২১। সেরা বোলিং-এর নতুন রেকর্ড গড়েছেন ম্যাকগ্রা। তিনি ১৫ রানে ৭টি উইকেট নিয়ে এই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এর আগে এই রেকর্ড ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের উইনস্টন ডেভিসের। তিনি ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫১ রানে ৭টি উইকেট নিয়েছিলেন। অবশ্য তার রেকর্ডকে ম্যাকগ্রার পাশাপাশি ম্লান করে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্ড্রু বিকেল। তিনি ২০ রানে নিয়েছেন ৭টি উইকেট। অস্ট্রেলিয়ার উইকেটকীপার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট এক ম্যাচে ৬টি ডিসমিসাল করে নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি এক বিশ্বকাপে ২১টি ক্যাচ নিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছেন। এছাড়া বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ডিসমিসালের কৃতিত্বও এখন তার। ২০ ম্যাচে তিনি ৩৫টি ডিসমিসাল করেছেন। এবারের বিশ্বকাপে সর্বাধিক ২১টি সেঞ্চুরি হয়েছে। এছাড়াও এবারের বিশ্বকাপে ছিল আরো নানা রেকর্ডের সমাহার। এসব রেকর্ড ছাড়াও যে ঘটনাগুলো ক্রিকেটানুরাগীদের হৃদয়ে দাগ কেটেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ বাংলাদেশের সঙ্গে ম্যাচের প্রথম ওভারে শ্রীলংকার চামিন্ডা ভাসের হ্যাটট্রিক, দক্ষিণ আফ্রিকার ৬ উইকেটে ৩০৬ রানের সামনে দাঁড়িয়ে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক স্টিফেন ফেমিং সাহসী ও দৃঢ়তাপূর্ণ অপরাজিত ১৩৪ রানের ইনিংস, ইংল্যান্ডের জেমস অ্যান্ডারসনের চমকপ্রদ বোলিংÑ বিশেষ করে পাকিস্তানের ইউসুফ ইয়োহানাকে যে ডেলিভারিতে ফিরিয়ে দেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কানাডার জন ডেভিসনের ৬৭ বলে বিশ্বকাপের দ্রুততম সেঞ্চুরি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভ্যাসবার্ট ড্রেকসের অসাধারণ ক্যাচ, শ্রীলংকার বিপক্ষে কেনিয়ার জয়, শ্রীলংকার সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রামনরেশ সারওয়ানের দুঃসাহসিক ব্যাটিংÑ আহত হয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে ৪টি বাউন্ডারি ও ২টি ছক্কার সাহায্যে ৪৪ বলে অপরাজিত ৪৭ রান, অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ১৪৩ রান, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের আশীষ নেহরার ২৩ রানে ৬ উইকেট, শ্রীলংকার মারভান আতাপাত্তুকে অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট লী’র ইনসুইং ইয়র্কার দিয়ে বোল্ড করা, শোয়েব আখতারের দ্রুততম বল, আম্পায়ার আউট না দেয়া সত্ত্বেও শ্রীলংকার সঙ্গে খেলায় অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম গিলক্রিস্টের প্যাভিলিয়নে ফিরে যাওয়া, ওয়াসিম আকরামের ৫০০ উইকেট সংগ্রহ, শ্রীলংকা-দক্ষিণ আফ্রিকার নাটকীয় টাই ম্যাচ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিদায়, অ্যান্ড্রু বিকেলের অল-রাউন্ড পারফরম্যান্স এবং ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক রিকি পন্টিং-এর অপরাজিত ১৪০ রান। বিশ্বকাপ ক্রিকেট শেষ হয়ে গেলেও এ রকম আকর্ষণীয় মুহূর্ত ক্রিকেট অনুরাগীদের সঞ্চয়ে জমা হয়ে থাকবে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে।
এবারের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া ও কেনিয়ার চমকপ্রদ সাফল্য বাংলাদেশের জন্যে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠতে পারে। ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা হলেও অস্ট্রেলিয়া তাদের পারফরম্যান্স দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেÑ পেশাদারিত্বের সামনে কোনো অঘটন বা অনিশ্চয়তা প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। পক্ষান্তরে, কেনিয়া হৃদয় দিয়ে ক্রিকেট খেলে সেমিফাইনাল অব্দি পৌঁছতে পেরেছে। অস্ট্রেলিয়ার পেশাদারিত্ব ও কেনিয়ার হৃদয় দিয়ে খেলাÑ এ দুটোর সমন¦য় করতে পারলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন দিনের
দেখা যেতে পারে।
ক্রীড়াজগত : ১ এপ্রিল ২০০৩


অতিরিক্ত ক্রিকেট এবং নয়া পরিকল্পনা

এখন এত বেশি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হয়, তাতে ক্রিকেটাররা অত্যধিক মানসিক উত্তেজনায় ত্যক্ত-বিরক্ত ও হাঁপিয়ে উঠেছে। এ কারণে একটানা ক্রিকেট খেলে যাবার বিরুদ্ধে সোচ্চার রব উঠেছে। কেননা, টানা খেলার ধকল খেলোয়াড়দের প্রাণশক্তি নিংড়ে ক্যারিয়ারটাই অকালে ধ্বংস করে দিতে পারে।
রেকর্ডসংখ্যক টানা ২১ ম্যাচে জয়ী এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে সাত ম্যাচ সিরিজের শেষ তিনটি ওয়ানডে ম্যাচ হেরে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক রিকি পন্টিং বলেন ঃ ‘সত্যি সত্যিই আমরা ভীষণ কান্ত ছিলাম। মাঠে নিশ্চয়ই আমাদের খেলা দেখে বোঝা গেছে কেমন শ্লথ ও কান্ত পারফরম্যান্স ছিল আমাদের।’ দেশে ফিরে তিনি আরো বলেন, ‘খেলোয়াড়রা সবাই চায় অস্ট্রেলিয়ার হয়ে যত বেশি সম্ভব খেলতে। কিন্তু একই সঙ্গে তারা চায় না শ্রান্তিতে ফুরিয়ে যেতেÑ সময়ের আগেই ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাক। দলের মধ্যে এই ভয়টাই এখন সবাইকে পেয়ে বসেছে এবং সেটা আমরা অনেক মানুষকেই জানিয়েছি ও আশা করছি, তারা শিগগিরই আমাদের কথায় কান দেবেন।’ এ বিষয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান জেমস সাদারল্যান্ড তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমরা খেলোয়াড়দের বিশ্রাম দেবার বিষয়ে সজাগ। আমরা এও চাই, শারীরিক চাপ ও দীর্ঘমেয়াদী সূচির মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকুক। বিশেষ করে যে সব খেলোয়াড় টেস্ট ও ওয়ানডে দুটোই খেলে।’
শুধু বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া নয়, অন্যান্য দেশ ও ক্রিকেটাররা অতিরিক্ত ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে ক্ষুব্ধ। তাদের বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে ঃ টানা ক্রিকেট খেলে তারা কান্ত, বিধ্বস্ত ও একঘেঁয়েমিতে আক্রান্ত। বিশ্রাম ছাড়া এভাবে খেললে ক্রিকেট তার আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে। ক্রিকেটারদের পাশাপাশি দর্শকরা টানা ক্রিকেট দেখতে দেখতে বিরক্ত। ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ ক্রিকেট থেকে আয়-রোজগার ভাল করছেন বলে এ বিষয়ে মাথা ঘামাতে চাচ্ছেন না। কিন্তু তারা স্বর্ণের ডিম প্রসবিনী রাজহাঁসকে হত্যা করে একসঙ্গে সবগুলো ডিম নিতে চাচ্ছেন। টানা ক্রিকেট খেলিয়ে ক্রিকেটের প্রতি দর্শকদের অরুচি সৃষ্টি হলে তখন রাজহাঁস ও ডিম দুটোই হারাতে হবে। একই অভিমত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী টিম মে’র। তার মতে, ‘অতিরিক্ত ক্রিকেট খেলে ক্রিকেটাররা কান্ত। অনেক বেশি খেলতে গিয়ে ক্রিকেটটা ক্রিকেটারদের কাছে আর উপভোগ্য থাকছে না। বরং বোঝা মনে হচ্ছে। তাছাড়া অপ্রয়োজনীয় ও একপেশে ম্যাচের কোনো যৌক্তিকতা নেই। যেখানে বেশিরভাগ ওয়ানডে সিরিজের ফলাফল আগেই বলে দেয়া যায়, সে সব সিরিজের প্রয়োজন কি?’ এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)-এর প্রেসিডেন্ট ম্যালকম গ্রে। তিনি বলেন, ‘এখন দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ সিরিজের ফলাফল একপেশে। এটা একটা বিরক্তির কারণ হতে পারে। এ নিয়ে আইসিসি খুবই উদ্বিগ্ন’।
অতিরিক্ত ম্যাচ খেলা থেকে ক্রিকেটারদের রক্ষা করতে একটি ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট লীগের প্রস্তাব দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন। এ প্রস্তাব অনুযায়ী কোনো দলই বছরে ৩০টির বেশি ওয়ানডে ম্যাচে অংশ নিতে পারবে না। প্রতি বছর ১১টি দেশ রাউন্ড রবীন লীগ ভিত্তিতে প্রত্যেক দলের বিপক্ষে তিনবার করে নিজের মাঠে, বিপক্ষের মাঠে ও নিরপেক্ষ ভেন্যুতে মুখোমুখি হবে। ফলে ১০টি দলের সঙ্গে প্রতিটি দল খেলবে ৩০টি ম্যাচ। লীগ শেষে সবচে বেশি পয়েন্ট পাওয়া দল চ্যাম্পিয়ন হবে। বছরব্যাপী এই চ্যাম্পিয়নশীপে একটি দলকে রেলিগেশন এবং আইসিসি সহযোগী দলগুলোর মধ্যে থেকে একটি দলকে প্রমোশন দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের এই প্রস্তাবটি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে আমরা মনে করি, এই প্রস্তাবটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যস্ত সূচি হ্রাসের পাশাপাশি ওয়ানডে ক্রিকেটকে আরো আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত করে তুলবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল এ প্রস্তাবটি কার্যকর করতে পারে।
ক্রীড়াজগত : ১৬ জুন ২০০৩



একজন লড়াকু ক্রিকেটারের প্রস্থান

আবেগে, উচ্ছ্বাসে, শ্রদ্ধায় আর ভালবাসায় মাখামাখি হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে রাজকীয়ভাবে বিদায় নিলেন স্টিভ ওয়াহ। আপাত দৃষ্টিতে কঠোর মনোভাবাপন্ন স্টিভ নীরবে কাঁদলেন, কাঁদালেন ক্রিকেট অনুরাগীদের। আর কোনো ক্রিকেটার বিদায় বেলা এত সম্মান, এত ভালবাসা ক্রিকেট থেকে পেয়েছেন বলে মনে হয় না। বর্ণাঢ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ারের অধিকারী স্টিভ ওয়াহ’র অনুপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কিছুটা হলেও তার মহিমা হারাবে।
লড়াকু এই ক্রিকেটার জীবনের শেষ ইনিংসেও দেখিয়েছেন পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস ও দায়িত্বশীলতা। সিডনি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে উপস্থিত রেকর্ডসংখ্যক দর্শকের হৃদয়ের সবটুকু উত্তাপে আর আবেগময় পরিস্থিতিতে দলের বিপর্যয়ে প্রায় তিন ঘন্টা ব্যাট করে স্টিভ ওয়াহ ১৫টি বাউন্ডারির সাহায্যে ৮০ রানের যে ঝলমলে ইনিংসটি খেলেন, তাতে বাঙময় হয়ে ওঠে তার পুরো ক্রিকেট ক্যারিয়ারের আস্থা, দৃঢ়তা ও আগ্রাসী চেতনার প্রতিচ্ছবি। নবীন সাইমন ক্যাটিচকে সঙ্গে নিয়ে বীরোচিত লড়াই চালিয়ে ১১ বছর পর দেশের মাটিতে সিরিজ হারানোর সম্ভাবনা রুখে দেন তিনি। তার ১৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অনমনীয়তা, দৃঢ় সংকল্প আর ‘নেভার সে ডাই’ মনোভাব। ক্রিকেটার হিসেবে তিনি যে কীর্তি গড়েছেন, তার সৌরভে আমোদিত হবে ক্রিকেট বিশ্ব। সর্বাধিক ১৬৮টি টেস্ট খেলার মাইলফলক গড়েছেন স্টিভ ওয়াহ। খুব সহসা এই মাইলফলক অতিক্রম করা আর কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। টেস্টে দ্বিতীয় সর্বাধিক রান তার। ৫১ দশমিক ০৬ গড়ে তার রান ১০,৯২৭। ১১ হাজার ১৭৪ রান নিয়ে এগিয়ে আছেন আরেক অস্ট্রেলিয়ান অ্যালান বোর্ডার। টেস্টে দ্বিতীয় সর্বাধিক সেঞ্চুরি স্টিভের। ৩২টি সেঞ্চুরি করে তিনি ভারতের শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে যৌথভাবে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছেন। ৩৪টি সেঞ্চুরি করে শীর্ষে আছেন ভারতের সুনীল গাভাস্কার। টেস্ট প্লেয়িং নয়টি দেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব দক্ষিণ আফ্রিকার গ্যারি কারস্টেনের পাশাপাশি স্টিভ ওয়াহর। তবে সর্বকালের সেরা টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে ইতোমধ্যে তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন। ৫৭টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ৪১টিতে জয়ী, ৭টি ড্র ও ৯টিতে পরাজিত হয়েছেন। এই কীর্তি আর কারো নেই। তবে তিনি অস্ট্রেলিয়া দলকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তার কাছাকাছি অন্য কেউ নেই। ব্যাটে, বলে, ফিল্ডিংয়ে এক সূতোয় গাঁথা মালা হয়ে অস্ট্রেলিয়া দল যেভাবে আক্রমণাÍক ও লড়াকু মেজাজে লড়াই করে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে, তার রূপকার হলেন স্টিভ ওয়াহ। অধিনায়ক হিসেবে তিনি টেস্ট ক্রিকেটে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করা, রান রেট প্রতি ওভারে চারের ওপরে নিয়ে যাওয়া, জয়ের জন্য সর্বাÍক লড়াই করা এবং নাইটওয়াচম্যানকে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সফল টেস্ট ক্রিকেটার ও সফল টেস্ট অধিনায়কের পাশাপাশি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও স্টিভ ওয়াহর পরিসংখ্যান মোটেও অনুজ্জ্বল নয়। ৩২৫টি ম্যাচ খেলে ৩২ দশমিক ৯১ গড়ে ৭৫৬৯ রান করেছেন। বোলার হিসেবে উইকেট নিয়েছেন ১৯৫টি। খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার জয়ে তার দারুণ অবদান রয়েছে। তার নেতৃত্বে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। এই বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা ১২০ রানের অপরাজেয় যে ইনিংসটি খেলেন, একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটি অন্যতম সেরা একটি ইনিংস। ১০৬টি ওয়ানডে ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়াকে ৬৭টি ম্যাচে জিতিয়েছেন। রেকর্ড আর পরিসংখ্যানের পাতায় স্টিভ ওয়াহ উজ্জ্বলতা ছড়ালেও আপাদমস্তক ক্রিকেটার হিসেবে তিনি দেদীপ্যমান হয়ে থাকবেন। ওয়াহ ছিলেন অতীত ও বর্তমানের সেতুবন্ধন। দুই ঘরানার ক্রিকেটকে তিনি চমৎকারভাবে আÍস্থ করে নেন। তবে তিনি নতুন দিনের পেশাদার ক্রিকেটে যোগ করেন নতুন মাত্রা। ক্রিকেটকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে নিয়ে যেতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সৌন্দর্য কিংবা মাধুর্যের চেয়ে তিনি নিখুঁতভাবে করা ও সাফল্যকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়েছেন।
স্টিভ ওয়াহ যুগের এখন অবসান ঘটেছে। তিনি যে স্মৃতি রেখে গেছেন, ক্রিকেটে তেমন চরিত্র আর আসবে কিনা সন্দেহ। তবে তিনি ক্রিকেটে যে শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন রেখে গেছেন এবং অস্ট্রেলিয়াকে এমন একটি অনুসরণীয় দলে পরিণত করে গেছেন, তাতে তিনি অবিনশ্বর হয়ে থাকবেন। ক্রিকেটে এখন সবার আদর্শ স্টিভ ওয়াহ ও অস্ট্রেলিয়া। ক্রিকেট এগিয়ে চলেছে তাদের অনুসৃত পথে। বাংলাদেশও তা থেকে পিছিয়ে নেই।
ক্রীড়াজগত : ১৬ জানুয়ারি ২০০৪

শান্তি, সম্প্রীতি এবং ক্রিকেটের জয়

উপমহাদেশের চিরবৈরী দুই পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ¡ীর মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও উষ্ণ সম্পর্কের সেতুবন্ধন গড়ার যে মিশন নিয়ে পাকিস্তান সফর করছে ভারত, তাতে একই সঙ্গে জয় হয়েছে ক্রিকেটের। যুদ্ধ ও রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে দীর্ঘ দিন ধরে দু’দেশের মধ্যে যে জ্বালা, যন্ত্রণা, সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, এই সফর তাতে কিছুটা প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে দর্শকরা উপভোগ করছেন ক্রিকেটীয়
রূপ-রস ও সৌন্দর্য।
একরাশ অনিশ্চয়তা আর রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত ১০ মার্চ ঐতিহাসিক লাহোর নগরীতে পৌঁছে ভারতীয় ক্রিকেটাররা। রাজনৈতিক বিরোধের কারণে যে সংশয় ও অবিশ্বাসের কালো মেঘ জমেছিল দু’দেশের জনগণের হৃদয়ে, তা কাটিয়ে ওঠার আর কোনো পথ খোলা ছিল না। ১৯৮৯ সালে ক্রিকেটের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ সফরে পাকিস্তান যায় ভারত। এরপর ১৯৯৭ সালে তিনটি একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেললেও রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে পূর্ণাঙ্গ কোনো সফর আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। একাধিকবার আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হলেও শেষ মুহূর্তে তা আর বাস্তব হয়ে ওঠেনি। অতি সম্প্রতি শান্তি ও সম্প্রীতির অংশ হিসেবে দু’দেশ যে সম্পর্কোন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেয়, তারই পথ বেয়ে পাকিস্তানে পাড়ি জমায় ভারত। বিশেষ করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে গলে যায় সম্পর্কের বরফ। তিনি শুধু এই সফরের প্রধান উদ্যোক্তাই নন, একই সঙ্গে ভারতীয় দলের শুভকামনা করেছেন এভাবে ‘খেল ভি নেহি, দিল ভি জিতিয়ে।’ (ঘধভ ভর্ম মভফহর্ দণ থটবণ, ঠর্ল দণটর্র্র টফ্রম). হিংসা, বিদ্বেষ ও নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলকে নিয়ে ভারতীয় এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ বিমান নয়াদিল্লি থেকে লাহোরের আল্লামা ইকবাল এয়ারপোর্টে অবতরণ করে। কড়া নিরাপত্তার কারণে উৎসুক ক্রিকেটানুরাগীরা চিরকাক্সিক্ষত ক্রিকেটারদের বুকে টেনে নেয়ার সুযোগ না পেলেও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড ও লাহোর নগর প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের বরণ করে নিয়েছেন হৃদয়ের উত্তাপ দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে। শত শত পুলিশ পরিবেষ্টিত ও অসংখ্য ফটোসাংবাদিকের মুহুর্মুহু ফ্যাশের আলোয় আলোকিত হন সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের
ভারতীয় ক্রিকেট দল।
সত্তর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের টেবিল টেনিস দল চীন সফর করে যে ‘পিঙপঙ কূটনীতি’র জন্ম দিয়েছিল, অনুরূপভাবে ক্রিকেট কূটনীতির পাশাপাশি পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে ক্রিকেট সিরিজটি ক্রিকেটানুরাগীদের কাছে আবেগ, উচ্ছ্বাস ও আনন্দের আধার হয়ে আছে। প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচটিতে পাওয়া যায় ক্রিকেটের সবটুকু সুধা, সুষমা ও লালিত্য। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য যাবতীয় উপাদান ছিল এ ম্যাচে। ম্যাচের পরতে পরতে ছিল শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা আর বিস্ময়। করাচীর ন্যাশনাল স্টেডিয়ামের ব্যাটিং-স্বর্গ পীচে স্বাগতিক দলের অধিনায়ক ইনজামাম-উল-হক টসে জিতে যখন প্রতিপক্ষকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানান, তখনই বিস্ময়ের সূত্রপাত। প্রায় ৩৫ হাজার উৎফুল্ল দর্শকের উপস্থিতিতে খেলার শুরুতে স্নায়ুর চাপ ও টানটান উত্তেজনায় ভুগতে থাকেন চির-প্রতিদ্বন্দ¡ী দু’দলের বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটাররা। শোয়েব আখতার ও মোহাম্মদ সামির মত ভয়ঙ্কর গতির বোলাররা লাইন-লেংথ ঠিক রাখতে যেয়ে হিমশিম খেয়ে যান। নার্ভাসনেসের শিকার হন বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকার ও বীরেন্দর শেবাগ। তবে একটা পর্যায়ে ব্যাটসম্যানরা চড়াও হতে শুরু করেন। শেবাগের আগ্রাসী ও রাহুল দ্রাবিড়ের দায়িত্বশীল ব্যাটিং-এ ৭ উইকেটে ৩৪৯ রানের পাহাড়সম স্কোর গড়ে ভারত। ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলার মত ব্যাটে দ্রুত তালে রানের বোল ফুটিয়েছেন শেবাগ। ৫৯ বলে ৭৯ রান করে ভারতীয় ইনিংসের ভিত্তি গড়ে দেন উদ্বোধনী এই ব্যাটসম্যান। এক রানের জন্য সেঞ্চুরি করতে না পারলেও ভারতীয় ইনিংসকে মহিমানি¦ত করেছেন রাহুল দ্রাবিড়। শচীন টেন্ডুলকার জ্বলে ওঠার মুহূর্তে তাকে ২৮ রানে ফিরিয়ে দেয়া হয়। মোহাম্মদ কাইফ ৪৬ ও অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি ৪৫ রানের একটি কার্যকর ইনিংস খেলেন। ভারতীয় দলের ব্যাটিং ক্রিকেটানুরাগীদের কাছে ছিল দারুণ উপভোগ্যময়। পাকিস্তানের বোলিংয়ের তুরুপের তাস ছিলেন অপেক্ষাকৃত নবাগত ডানহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলার নাভিদ উল হাসান রানা। রানের প্রলোভন দেখিয়ে উইকেটে ছোবল মেরে তিনি একে একে ফিরিয়ে দেন শেবাগ, গাঙ্গুলি ও যুবরাজ সিংকে। শোয়েব আখতার ও মোহাম্মদ সামির বলে ধার পরিলক্ষিত না হওয়ায় উভয়ই পেয়েছেন ২টি করে উইকেট। অবিশ্বাস্য এক জয়ের টার্গেট নিয়ে পাকিস্তান ম্যাচের শেষ বল পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ায় ম্যাচটি পরিণত হয় একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ম্যাচে। আর এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন অধিনায়ক ইনজামাম-উল-হক ও ইউসুফ ইউহানা। ‘ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি’ খ্যাত মুলতানের সুলতান ইনজামাম অসাধারণ ও রোমাঞ্চকর এক ইনিংস উপহার দিয়ে দলকে প্রায় জয়ের কাছাকাছি নিয়ে যান। তার ১০৪ বলের ১২২ রানের ইনিংসটিতে ছিল এক গৌরবময়তা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অসম্ভব ধারাবাহিক ইউসুফ ইউহানার ৬৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংসটি হঠাৎ থেমে যাওয়ায় প্রতিপক্ষের জন্য ছিল স্বস্তিদায়ক। ইউনিস খানের ৪৬ ও আবদুর রাজ্জাকের ২৭ রানের ইনিংসটিও ছিল বারুদমাখা। তবে ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট ছিল শোয়েব মালিকের আউটটি। পাকিস্তানের যখন ৮ বলে ১০ রান প্রয়োজন, তখন তিনি জহির খানের একটি বল হাওয়ায় উড়িয়ে মারলে লঙ অনে অবিশ্বাস্য এক ক্যাচ নেন মোহাম্মদ কাইফ। হেমাঙ বাদানীর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেয়েও তিনি বল হাতছাড়া করেননি। আশীষ নেহরার শেষ বলটি মঈন খান প্রত্যাশা অনুযায়ী উড়িয়ে মারতে ব্যর্থ হলে মাত্র ৫ রানে হেরে স্তব্ধ হয়ে যান স্টেডিয়ামের হাজার হাজার দর্শক। ম্যাচে ভারত জিতলেও সামগ্রিকভাবে জয় হয়েছে ক্রিকেটের। সিরিজের প্রতিটি ম্যাচই দর্শকদের কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছেন ইনজামাম-উল হক, শচীন টেন্ডুলকার, ইয়াসির হামিদ, ভিভিএস লক্ষ্মণ, শহীদ আফ্রিদী, আব্দুল রাজ্জাক, রাহুল দ্রাবিড়, মোহাম্মদ কাইফরা।
ক্রীড়াজগত : ১ এপ্রিল ২০০৪


ব্রায়ান লারা : দ্য ব্যাটিং জিনিয়াস

টেস্ট ক্রিকেটের ১২৭ বছরের ইতিহাসে নতুন এক মাইলফলক গড়েছেন ক্রিকেট মহাকাব্যের নন্দিত শিল্পী ব্রায়ান চার্লস লারা। ক্রিকেটের এই খেয়ালী রাজকুমার টেস্ট ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ছুঁয়েছেন ৪০০ রানের অলৌকিক মাইলফলক। অসম্ভব প্রতিভাবান, বিরল জাতের ক্রিকেটার লারা ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ঝিলিক দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে নিয়ে যাচ্ছেন নতুন এক উচ্চতায়।
ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও কঠিন এক জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকলেও ক্যারিবীয়দের মুখের অনাবিল হাসি, বুকের গান আর ক্রিকেটের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা- কখনোই ফুরিয়ে যায়নি। নাচে, গানে, হল্লায় ক্রিকেটে আকন্ঠ নিমজ্জিত থেকে তারা পান করে জীবনের নির্যাস। ক্রিকেটের স্বর্ণখনি ক্যারিবীয় অঞ্চলে সহজাত প্রতিভা নিয়ে বেড়ে ওঠেন ক্রিকেটাররা। আর লিয়ারী কনস্টানটাইনের দেশ ত্রিনিদাদের প্রকৃতি যেন ক্রিকেটার গড়ার আলয়। সব বয়সী মানুষকে শিষ্ দিয়ে ডেকে নিয়ে যায় ক্রিকেট মাঠে। ১৯৬৯ সালের ২ মে ত্রিনিদাদের সান্তাক্রুজে জন্ম নেয়া ছেলেটি যে ক্রিকেটের আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠবে, এটা ধরেই নেয়া যায়। নিভৃত গ্রাম ক্যান্টারোতে ভূমিষ্ঠ হওয়া ব্রায়ান লারার ক্রিকেটের হাতেখড়ি হয় মাত্র ছয় বছর বয়সে। বড় বোন অ্যাগনেস তাকে ভর্তি করিয়ে দেন ক্রিকেটের পাঠশালায়। তাকে ক্রিকেট শিক্ষায় দীক্ষিত করেন জোয়ে কারেউ। ১১ ভাই-বোনের একজন লারার রক্তে যেন মিশে ছিল ক্রিকেটের বীজ। খুব দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন ক্রিকেটের কাসিক্যাল ঘরানায়। একজন পরিণত ক্রিকেটার হওয়ার জন্য যেসব গুণাবলী থাকার প্রয়োজন, তা পুরোমাত্রায় তার মধ্যে বিকশিত হতে থাকে। দৃঢ়চেতা মনোভাব, অসাধারণ ফুটওয়ার্ক, তীক্ষè চোখ ও শক্তিশালী কব্জির মোচড়- তার জাত চিনিয়ে দেয়। ১৯৮৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে প্রথম প্রতিনিধিত্ব করেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের। ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেখিয়ে ১৯৯০ সালে তার অভিষেক হয় টেস্ট ক্রিকেটে। লাহোরে পাকিস্তানের সঙ্গে তৃতীয় টেস্টে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস ও ইমরান খানের দুরন্ত বোলিং-এর সামনে ৪৪ রান করেন। ১৯৯৩ সালে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তার প্রথম সেঞ্চুরি ছিল ২৭৭ রানের। ভিভ রিচার্ডসের জন্মভূমি অ্যান্টিগার সেন্ট জোন্সের সমুদ্র, পাহাড় আর ঝলমলে পোশাকের প্রাণবন্ত দর্শক ব্রায়ান লারাকে যেন ইতিহাস গড়ার হাতছানি দেয়। ১৯৫৭ সালে কিংস্টনে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের গ্যারি সোবার্স অপরাজেয় ৩৬৫ রান করে যে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন, ৩৬ বছর পর তা ভেঙ্গে দেন ব্রায়ান লারা। ১৯৯৪ সালে অ্যান্টিগুয়ায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পঞ্চম টেস্টে ৩৭৫ রান করে তিনি নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েন। বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে জন্মানো ব্রায়ান লারাকে ক্রিকেট দেবতা ইতিহাসের পাতায় অবিনশ্বর করে রাখবেন- সম্ভবতঃ এ কারণে কোথাও তিনি থেমে থাকেন না। একই বছর ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা অপরাজিত ৫০১ রানের রেকর্ড ইনিংসটি অমর হয়ে আছে তার নামের পাশে।
শুধু ক্রিকেটে মন-প্রাণ সঁপে দেয়াটা ব্রায়ান লারার ধাতে নেই। ক্রিকেটের মত নাইট কাব, কার্নিভাল, সুর, সুরা, নৃত্য ও সুন্দরী রমণী, ক্যারিবীয়দের রক্তে যে দোলা দেয়, তা থেকে লারা কীভাবে দূরে থাকেন? এ কারণে প্রতিভার অবহেলা ও ঔদার্যে লারার তুলনা মেলা ভার। সেই শৈশবেই ত্রিনিদাদের চোখ ধাঁধানো সুন্দরীদের দেখে দেখে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন তিনি। দেহে ও ব্যাটে যখন যৌবনের স্ফুলিঙ্গ, তখন তিনি সুন্দরীদের সম্মোহন এড়াতে পারেননি। দেশ-বিদেশের সুন্দরী আর রঙিন জীবনের প্রলোভনে কখনো-সখনো উচ্ছৃংখল হয়ে ওঠেন লারা। যে কারণে তার ব্যাটিংয়ে ধারাবাহিকতার অভাব পরিলক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি কখনো-সখনো দল থেকেও দূরে থেকেছেন। ১৯৯৮ সালে লারা অধিনায়কের দায়িত্ব পাবার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে অনেক দুঃসময় পাড়ি দিতে হয়েছে। তবে লারার ব্যক্তিগত পারফরমেন্সের ঔজ্জ্বল্যে বেশ কয়েকবার জয়ের মুখ দেখে ক্যারিবীয়রা। দলের বিপর্যয়ের সময় তার ব্যাট জ্বলে ওঠায় অনেক অপ্রত্যাশিত জয় পেয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যারিবীয় আনন্দময় ক্রিকেটের সর্বশেষ প্রতিনিধি লারার ব্যাটে বেজে ওঠে ক্যালিপসো সুরের মূর্ছনা আর ক্যারিবীয় সাগরের উত্তাল গর্জন। লারার ফর্ম নিয়ে যখনই সংশয়ের দোলাচল চলতে থাকে, তখনই তিনি যেন ফিরে ফিরে আসেন। ২০০৩ সালের অক্টোবরে পার্থের ওয়াকা ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাথু হেইডেন ৩৮০ রান করে লারার কীর্তিকে ম্লান করে দেয়ার পর কেউ কি ভেবেছিলেন, এই জীবনে তিনি তা পুনরুদ্ধার করবেন? আর সেটি কখন? চার টেস্টের সিরিজে প্রথম তিন টেস্ট অনায়াসেই জিতে ৩৬ বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে সিরিজ জিতেছে ক্রিকেটের ক্ষয়িষ্ণু শক্তি ইংল্যান্ড। এর মধ্যে কিংস্টন টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৭ রান করে টেস্ট ক্রিকেটে নিজেদের সর্বনিু স্কোর করার অসম্মান ক্যারিবীয়রা অর্জন করেছে। ছয় ইনিংসে দুটি শূন্যসহ সর্বসাকুল্যে লারার অর্জন ১০০ রান। দেশের মাটিতে প্রথমবারের মত হোয়াইট ওয়াশ হওয়ার আশংকা। এ অবস্থায় অধিনায়কত্ব তো বটেই, লারার ক্যারিয়ারও হুমকির সম্মুখীন হয়ে ওঠে। তাছাড়া ৩৫ বছর বয়সটা তো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার মত নয়। কিন্তু পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার লারার জন্ম তো যে কোন উচ্চতাকে ছাড়িয়ে যাবার। ক্যারিবীয় ক্রিকেটের এই দুঃসময়ে ক্যারিবিয়ান রাজপুত্রের বুকের গভীরে বেজে উঠে ক্যালিপসো ক্রিকেটের সুরের মূর্ছনা। ক্যারিবীয় ক্রিকেটের গৌরবময় দিনগুলোর কথা তাকে আপ্লুত করে। ওরেল-উইকস-ওয়ালকট-গ্যারি সোবার্স-কাইভ লয়েড-ভিভ রিচার্ডসরা তাকে অনুপ্রাণিত করেন। অ্যান্টিগুয়ার সমুদ্র, পাহাড়, আকাশ, প্রকৃতিতে জ্বলে ওঠে এই উইলো শিল্পীর ব্যাট। তার ব্যাটিংয়ের নান্দনিক সৌন্দর্যে হেসে ওঠে চারপাশ। রাজসিক ভঙ্গিমায় ব্যাটিং করে একে একে ২৫তম সেঞ্চুরি, সপ্তম ডবল সেঞ্চুরি এবং ক্রিকেটের কিংবদন্তী স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে দ্বিতীয় ত্রিপল সেঞ্চুরি করার পর রিডলি জ্যাকবসকে সঙ্গে নিয়ে অবিনশ্বর কীর্তি গড়ার পথে এগিয়ে যেতে থাকেন ‘প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ’ ব্রায়ান লারা। ১২ এপ্রিল ইংল্যান্ডের ডানহাতি অফ-স্পিনার ড্যারেন বেটিকে ছক্কা মেরে ম্যাথু হেইডেনের রেকর্ড স্পর্শ এবং পরের বলে সুইপ করে চার মেরে তিনি মাত্র ছয় মাসের মধ্যে পুনরায় টেস্ট ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের আসনে সমাসীন হন। মাঠের ইংলিশ ক্রিকেটাররা, বর্ণিল দর্শক এবং ক্যারিবীয় সাগরের মাতাল করা দুষ্টু বাতাস এসে অভিনন্দনে অভিনন্দনে ভাসিয়ে দিতে থাকে ক্রিকেটের বরপুত্র লারাকে। ৩৯০ রানে অপরাজিত থেকে লাঞ্চে গেলে সতীর্থ ক্রিকেটাররা ব্যাট দিয়ে তোরণ বানিয়ে ‘গার্ড অব অনার’ দিয়ে তাকে সম্মানিত করেন। এরপর ৭৭৬ মিনিটে ৫৮২ বল খেলে চারটি ছক্কা ও ৪৩টি বাউন্ডারির সাহায্যে ৪০০ রানে অপরাজিত থেকে স্বেচ্ছায় ফিরে এসে যে মাইলফলক গড়েন, তা অবিনশ্বর ও বিশাল এক কীর্তি হয়ে থাকবে।
টেস্ট ক্রিকেটে দশ হাজার রানের কাছাকাছি এবং ওয়ানডেতে প্রায় সাড়ে আট হাজার রান করলেও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অপরাজিত ৫০১, টেস্টে অপরাজিত ৪০০ ও ৩৭৫ রানের বড় মাপের ইনিংস খেলে বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান লারা বুঝিয়ে দিলেনÑ তিনি তার কীর্তির চেয়েও মহান। এই সময়ের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার ধীর-স্থির স্বভাবের শচীন টেন্ডুলকার বড় ইনিংস খেলতে যেয়ে যেখানে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন, সেখানে অস্থির, চঞ্চল ও ‘প্লে-বয়’ টাইপের হয়েও লারা একের পর এক খেলে চলেছেন অবিনাশী সব ইনিংস। এখানেই লারা অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম।
বিশ্ব ক্রিকেটে ক্যারিবীয়দের দাপট অস্তমিত হওয়ার পাশাপাশি ক্যালিপসো ক্রিকেটের সুর-ছন্দও বিলীন হতে চলেছে। সত্যিকার অর্থেই বড্ড দুঃসময় অতিক্রম করছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এমন একটা সময়ে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের শেষ সম্রাট ব্রায়ান লারার অসাধারণ রেকর্ড ও কীর্তিÑ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নতুন পথের সন্ধান দেবে। একই সঙ্গে ব্রায়ান লারা ক্রিকেট বিশ্বকে জানিয়ে দিলেনÑ অসম্ভবকে সম্ভব করা মানুষের পক্ষেই সম্ভব।
জয়তু ব্রায়ান লারা।
ক্রীড়াজগত : ১৬ এপ্রিল ২০০৪
ক্যালিপসো নয়, বাজুক বাউল সুর

টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর বদ্ধ দুয়ার খুলে যাওয়ায় নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। ক্রিকেটের রঙিন পৃথিবী পরিভ্রমণের পথ বেয়ে এবার বাংলাদেশ পাড়ি দিচ্ছে ক্রিকেটের স্বপ্নভূমি ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ক্যারিবীয় দ্বীপে বাংলাদেশের এই প্রথম সফরটি বেশ চ্যালেঞ্জিং।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট একটা সময় ছিল সুখী পৃথিবীর স্বর্ণযুগের নন্দনক্রীড়া। সমুদ্রতট, সোনালী পলিমাটির পীচ, নারকেল পাতার ঝিরি ঝিরি কাঁপুনি, বর্ণময় দর্শক আর ক্যালিপসো সুরের সমন¦য়ে গড়ে ওঠে ক্রিকেটের এই স্বর্গোদ্যান। ক্যারিবীয় ও আটলান্টিক সাগরের তীর ঘেঁষে সারি সারি দেশগুলোতে মৃদু গর্জনে ঢেউগুলো তটের বুকে খেলার ছবি এঁকে যাবার পাশাপাশি কালো মানুষের বুকের গহীনে বেজে চলে ক্রিকেটের ক্যালিপসো সুর। পুরু ঠোঁট, কোঁকড়ানো চুল, মিশ-কালো এই মানুষগুলোর জীবনে আছে অনেক না পাওয়ার বেদনা। দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট, জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলে ক্রিকেট মাঠ যেন তাদের কাছে মনকে আনন্দের রঙে রাঙিয়ে নেবার উপলক্ষ। এ কারণে ক্যারিবীয় ক্রিকেট মাঠ হয়ে উঠে হাসির আনন্দবাজার। সবকিছুতেই হাসিÑ গানে, নাচে, কথায়, কাজে। খেলায় জিতলেও হাসি, হারলেও। ক্রিকেট ব্রিটিশদের গর্ভজাত হলেও ক্রিকেটকে সুন্দরের সীমানায় পৌঁছে দিয়েছে ক্যারিবীয়রা। ক্রিকেট থেকে যে অনিত্যের মধুপানÑ তাও তো এঁদেরই দান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কৃষ্ণকায় প্রতিভার নীল দ্যুতিতে একদা পৃথিবী ছিল সমাচ্ছন্ন। বার্বাডোস, গায়না, অ্যান্টিগুয়া, ত্রিনিদাদ, জ্যামাইকার অজপাড়াগাঁ থেকে ওঠে আসা ক্রিকেটাররা গেয়েছেন জীবনের গান। ব্যাটের হাসিতে মাঠ মাতিয়েছেন আর বলের হুঙ্কারে মাঠ কাঁপিয়েছেন বার্বাডোজের স্যার গ্যারি সোবার্স, ফ্যাঙ্ক ওরেল, এভারটন উইকস, কাইট ওয়ালকট, গর্ডন গ্রীনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স, কনরাড হান্ট, সেমুর নার্স, ওয়েস হল, ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গারনার, চার্লি গ্রিফিথ; গায়ানার কাইভ লয়েড, রোহান কানহাই, ল্যান্স গিবস, আলভিন কালিচরন, রয় ফ্রেডেরিকস, বাসিল বুচার; অ্যান্টিগুয়ার ভিভ রিচার্ডস, রিচি রিচার্ডসন, কার্টলি অ্যামব্রোস, অ্যান্ডি রবার্টস; ত্রিনিদাদের ব্রায়ান লারা, সনি রামাধীন, জেফ্রি সটোমেয়ার; জ্যামাইকার কোর্টনি ওয়ালস, মাইকেল হোল্ডিং, জর্জ হেডলি প্রমুখ। এক একটা সময় এরা রাজত্ব করেছেন বিশ্ব ক্রিকেটে। ব্যাট হাতে ভিভ রিচার্ডস, গ্যারি সোবার্স, গর্ডন গ্রীনিজ, কাইভ লয়েড, ডেসমন্ড হেইন্স, রোহান কানহাইরা সবুজের বুকে বর্ণিল ছবি আঁকার পাশাপাশি মারের সৌন্দর্যে মাতিয়েছেন মাঠ। দৈত্যাকায় ওয়েস হল, ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গারনার, মাইকেল হোল্ডিং, অ্যান্ডি রবার্টসরা তীব্র গতিতে বাউন্সার ও বাম্পার দিয়ে ব্যাটসম্যানদের বুকে ত্রাস সৃষ্টির পাশাপাশি ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগের নায়ক হয়ে আছেন। ত্রিশের দশকে বার্বাডোসে ১৮ মাসের মধ্যে জন্ম নেয়া পৃথিবীর ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় তিন ওরেল-উইকস-ওয়ালকট পঞ্চাশ দশককে রূপে-রসে-সৌন্দর্যে ভরিয়ে দেন। ওরেলের কাব্য, উইকসের উপন্যাস ও ওয়ালকটের ইতিহাস ক্রিকেট-পৃথিবীকে রোমাঞ্চিত ও সঙ্গীতময় করে তোলে। ক্যারিবীয় বিশ্ব ক্রিকেটে যে মহিমা, যে ঐশ্বর্য, যে সৌন্দর্য প্রদর্শন করেছেÑ তা যেন বিধাতার
দেয়া অপরিসীম দান।
ক্রিকেটকে যারা দিয়েছে অকৃপণ হাতে, সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট এখন যেন বেলা শেষের গান। কৌলীন্য ও গরিমা হারিয়ে তাদের স্বর্ণযুগের অবসান হয়েছে অনেক আগেই। ভিভ রিচার্ডসরা চলে যাবার পর রিচি রিচার্ডসন, কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশ, কার্ল হুপার, ব্রায়ান লারারা ক্যারিবীয় ক্রিকেটের আশার প্রদীপ টিম্টিম্ করে জ্বালালেও উজ্জ্বলতায় ভরিয়ে দিতে পারেননি। গত প্রায় পাঁচ বছর একের পর এক ব্যর্থতা এসে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সুমহান গৌরব-রবিকে ম্লান করে দিচ্ছে। দেশের মাটিতে তাদেরকে হারিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলংকা। ৩৬ বছর পর হোম গ্রাউন্ডে ইংল্যান্ডের কাছে ০-৪ টেস্টে সিরিজ হেরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বল দলের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন ক্রিকেটের যুবরাজ ব্রায়ান লারা। ক্যারিবীয় ক্রিকেটের শেষ প্রতিনিধি লারা এককভাবে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছেন। লারার ব্যাট হাসলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ হাসে। লারা ব্যর্থ হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যর্থ। ইতিহাসে প্রথমবারের মত যখন দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডের কাছে ‘হোয়াইট ওয়াশ’ হতে যাচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ঠিক তখন অপরাজেয় ৪০০ রানের নতুন মাইলফলক গড়ে রুখে দাঁড়ান তিনি। তবে কিছু সময়ের জন্য সম্ভব হলেও সব সময় একটা দলকে একজনের পক্ষে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। ছন্দহীন, নড়বড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে ছন্দময়ী, শক্তপোক্ত বাংলাদেশ। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর পর একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জয় পাওয়া বাংলাদেশ জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে তাদের মাটিতে সিরিজ জিতলে অবাক হওয়ার কিছু থাকতো না। কিন্তু দলের নির্ভরযোগ্য ক্রিকেটার মোঃ রফিককে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে ছন্দপতন হওয়ায় মুলতান টেস্টের মত জয়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনা জাগিয়েও সিরিজ জেতা হয়নি বাংলাদেশের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ এবং দু’ম্যাচের টেস্ট সিরিজটি বাংলাদেশের জন্য রীতিমত চ্যালেঞ্জ হয়ে এসেছে। এর আগে বাংলাদেশ ওয়ানডে ও টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয়ে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। বিশেষ করে ১৯৯৯ সালের ৯ অক্টোবর ঢাকায় ব্রায়ান লারার ৪৫ বলের দ্রুততম সেঞ্চুরিটি দর্শকদের মুগ্ধ করে রেখেছে। এরপর অবশ্য ক্যালিপসো সুরের মূর্ছনা কিছুটা বেসুরো হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজে এক সূতোয় গাঁথা মালা হয়ে সবটুকু নিংড়ে দিয়ে জ্বলে উঠতে পারে, তাহলে অঘটন ঘটানো অসম্ভব নয়।
ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সূর্য অস্তমিত হতে চললেও এমন ভাবার সুযোগ নেই যে, তারা বাংলাদেশের চেয়ে দুর্বল। যে দলে ব্রায়ান লারার মত ক্রিকেটার দেদীপ্যমান, সে দলটিকে দুর্বল ভাবা যায় না। ইংল্যান্ডের সঙ্গে অপরাজেয় ৪০০ রানের ইনিংস খেলার পর সাংবাদিকরা ব্রায়ান লারার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে খেলায় তার কাছে ৫০০ প্রত্যাশা করা যায় কিনা? তার কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি হেসেছিলেন। সেই হাসির মধ্যে কোনো প্রতিজ্ঞা রয়েছে কিনাÑ তা আমাদের জানা নেই। লারার রান-ক্ষুধা অব্যাহত থাকলে সেটা নিশ্চয়ই আশার কথা নয়। তবে হারতে হারতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে চাইবে। বাংলাদেশকে চেষ্টা করতে হবে এই ঘুরে দাঁড়াতে না দেয়া। তাহলেই কেবল ওয়েস্ট ইন্ডিজে ক্যালিপসো সুর নয়, বাজবে বাংলাদেশের বাউল সুর। আমাদের
প্রত্যাশা তেমনটি।
ক্রীড়াজগত : ১ মে ২০০৪


স্পিনের জাদুকর মুরালিধরন

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নতুন ইতিহাস গড়েছেন শ্রীলংকার অফ-স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরন। সর্বকালের অন্যতম সেরা এই স্পিনার টেস্ট ক্রিকেটে সর্বাধিক ৫২১টি উইকেট নিয়ে এখন নতুন বিশ্ব রেকর্ডের অধিপতি। নতুন নতুন মাইলফলক গড়ার পাশাপাশি ডানহাতি অফ ব্রেক বোলার মুরালিধরন তার স্পিনের জাদু দিয়ে যেভাবে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন, তা প্রতিপক্ষের কাছে এক বিরাট রহস্য হয়ে আছে। তার এই রহস্যের কারণে বিতর্ক কখনো তার পিছু ছাড়ছে না।
১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল শ্রীলংকার পর্যটন শহর ক্যান্ডিতে মুত্তিয়া মুরালিধরনের জন্ম। ক্যান্ডির নৈসর্গিক সৌন্দর্যে, পাহাড়ে, অরণ্যে যে রহস্যময়তা, তা যেন মুরালিধরনের বোলিংকে অন্য মাত্রা দেয়। টেস্ট ক্রিকেটের ১২৭ বছরের ইতিহাসে বরাবরই ফাস্ট বোলাররা দাপট দেখিয়ে এসেছেন। তাদের বলের গতিতে কেঁপেছেন ব্যাটসম্যানরা, একই সঙ্গে তারা ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এর মাঝে স্পিনার ছিলেন ক্রিকেটের কবি। তাদের মায়াবী ঘূর্ণিবলে লাবণ্য ও সুষমা থাকলেও তারা ফাস্ট বোলারদের কখনও ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু ব্যতিক্রম হয়ে জন্মেছেন অস্ট্রেলিয়ার লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্ন ও মুত্তিয়া মুরালিধরন। ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে কলম্বোয় অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় টেস্টে অভিষেক হওয়ার পর মুরালিধরন আর পেছনে ফিরে তাকাননি। একের পর এক মাইলফলক অতিক্রম করে চলেছেন। মুরালিধরন ১৯৯৭ সালে শততম উইকেট, ১৯৯৮ সালে ২০০ উইকেট, ২০০১ সালে ৩০০ উইকেট, ২০০২ সালে ৪০০ উইকেট এবং ২০০৪ সালের মার্চে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলায় ৫০০ উইকেটের মাইলফলক পেরিয়ে যাবার পর ক্রিকেটানুরাগীদের কাছে কৌতূহল হয়ে দাঁড়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোর্টনি ওয়ালশের বিশ্ব রেকর্ড কে আগে ভাঙ্গবেন? ৫১৩ উইকেট নিয়ে মুরালিধরন, নাকি ৫১৭ উইকেট নিয়ে শেন ওয়ার্ন। কিন্তু জিম্বাবুয়ের সঙ্গে খেলায় হারারেতে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেট নিয়ে ওয়ালশের রেকর্ড স্পর্শ করেন মুরালিধরন। টেস্টের তৃতীয় দিনে জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংসে এনকালাকে সিলি মিড-অফে মাহেলা জয়াবর্ধনের ক্যাচে পরিণত করে মুরালিধরন তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে যান।
সাফল্যের পাশাপাশি বিতর্ক যেন মুরালিধরনের চলার পথের পাথেয়। ১৯৯৫ সালে অস্ট্রেলীয় আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার তার বোলিং অ্যাকশনের বৈধতা নিয়ে আপত্তি জানালে, সেই যে বিতর্ক শুরুÑ তা আজো অব্যাহত রয়েছে। গত মাসে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলায় ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড তার সন্দেহজনক অ্যাকশন নিয়ে রিপোর্ট পেশ করেন। বিশেষ করে তার অফ স্পিনের ভঙ্গিতে করা ‘দুসরা’ বল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়। ক্রিস ব্রডের রিপোর্টের ভিত্তিতে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) মনোনীত হিউম্যান মুভমেন্ট বিশেষজ্ঞদের তত্বাবধানে পরীক্ষা করে দেখা হয় তার বোলিং অ্যাকশন। মুরালিধরনের ‘দুসরা’ বোলিংয়ে আইসিসির নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে তার হাত বেশি বাঁকা থাকে বলে তাদের পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। এই রিপোর্টের প্রেক্ষিতে এবার শ্রীলংকার ক্রিকেট বোর্ড আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ‘দুসরা’ ব্যবহার না করার জন্য মুরালিধরনকে নির্দেশ দিয়েছে। এই ‘দুসরা’ নিয়ে পানি ঘোলা করা হলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মুরালিধরন এই বল প্রথম করেননি। বলে বৈচিত্র্য নিয়ে আসার জন্য পাকিস্তানী অফ-স্পিনার সাকলায়েন মুশতাক নব্বই দশকের শেষ দিকে প্রথমে ‘দুসরা’ বল করেন। অফ-স্পিনাররা, বিশেষ করে উপমহাদেশের বোলাররা, সাকলায়েন মুশতাককে অনুসরণ করতে থাকেন। কিন্তু মুরালিধরন ‘দুসরা’কে সফলভাবে টার্ন করতে পারায় এটি তার গোপন অস্ত্র হয়ে ওঠে। স্পিনাররা সবসময় তাদের বলে নতুন কৌশল ও বৈচিত্র্য প্রয়োগ করার চেষ্টা করে থাকেন। মাদক গ্রহণের কারণে বছরখানেক নিষিদ্ধ থাকার পর অস্ট্রেলীয় লেগ-স্পিনার শেন ওয়ার্ন গত মাসে শ্রীলংকার সঙ্গে নতুন ডেলিভারি নিয়ে কাজ করেন। অন্যদিকে ‘দুসরা’র উদ্ভাবক সাকলায়েন মুশতাকের এখন চিন্তা-ভাবনা ‘তিসরা’ নিয়ে। জন্মগতভাবে হাত নিয়ে কিছুটা সমস্যায় থাকা মুরালিধরনও এর ব্যতিক্রম নন। কিন্তু তাকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। বিশেষজ্ঞরা আইসিসির হাত বাঁকা করার নির্ধারিত মাত্রাকে অযৌক্তিক বলে অভিহিত করে সেটা পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে। কিন্তু আইসিসি জানিয়ে দিয়েছে, এই মাত্রা পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। আর এ কারণে মুরালিধরনের প্রধান অস্ত্র ‘দুসরা’ অকেজো হয়ে যাওয়ায় তিনি কতটা কি করতে পারেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
কোর্টনি ওয়ালশ ১৩২ টেস্টে ৫১৯ উইকেট নিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়লেও ৩২ বছর বয়স্ক মুরালিধরন ৮৯ টেস্টে তা অতিক্রম করেছেন। শেন ওয়ার্ন ১১০ টেস্টে ৫১৭ উইকেট নিয়ে কাছাকাছি দূরত্বে রয়েছেন। অতি সম্প্রতি জিম্বাবুয়ে সফরে শেন ওয়ার্নের নতুন রেকর্ড গড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সাময়িকভাবে ওয়ার্ন এই রেকর্ড অতিক্রম করলেও বয়সের কথা চিন্তা করলেও অদূর ভবিষ্যতে মুরালিধরন এগিয়ে থাকবেন। কোর্টনি ওয়ালশ এবং শেন ওয়ার্নের মতে, মুরালিধরন ৮০০ থেকে ১০০০ উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করতে পারবেন। তেমনটি করতে পারলে ক্রিকেটের ইতিহাসে অবিনশ্বর হয়ে থাকবেন মুরালিধরন। পিছিয়ে পড়া একটি অঞ্চল থেকে ওঠে এসে নিজের দেশকে মুরালিধরন যেভাবে পরিচিত ও সম্মানিত করেছেন, তা অন্যদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমরা মুত্তিয়া মুরালিধরনকে অভিনন্দন ও তার অব্যাহত সাফল্য কামনা করি।
ক্রীড়াজগত : ১৬ মে ২০০৪

সৌরভ গাঙ্গুলির ‘টিম ইন্ডিয়া’ এবং
অধরা স্বপ্ন পূরণের কাহিনী

ক্রিকেট শুধু সুখী পৃথিবীর স্বর্ণযুগের নন্দনক্রীড়াই নয়; ক্রিকেট শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কের পরিপূরকও বটে। চিরবৈরী প্রতিবেশী দু’দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলে আসা সম্পর্কের টানাপড়েনে যখন ক্ষত-বিক্ষত দু’দেশের মানুষ, ঠিক তখন সম্পর্কের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে ক্রিকেট। দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর পর পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট সফরে পাকিস্তান যায় ভারত। অনেক কারণে এই সফরটি ইতিহাসের পাতায় মাইলফলক হয়ে থাকবে। মাঠের ক্রিকেট তো বটেই, মাঠের বাইরের ঘটনাও একটা বড় কারণ। অথচ এই সফরটি একরাশ অনিশ্চয়তায় দুলছিল। ভারতীয় দলের মোটেই আগ্রহ কিংবা ইচ্ছে ছিল না পাকিস্তান যাবার; আর এ সফরেই গৌরবোজ্জ্বল এক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট দল। কোটি কোটি সমর্থক ও অনুরাগীর স্বপ্ন পূরণ করেছে সৌরভ গাঙ্গুলির ‘টিম ইন্ডিয়া’। নতুন ইতিহাস, নতুন মাইলফলক গড়ার পাশাপাশি সম্প্রীতির নতুন বন্ধন গড়েছে ভারতীয় ক্রিকেট দল। অবশ্য পরাজয়ের নৈরাশ্য ও বিষাদকে ঝেড়ে ফেলতে পারলে ভারতের এই সফরে পাকিস্তানের প্রাপ্তিকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। এই সফর পাকিস্তানের ক্রিকেটে আলোর ঝলকানি হয়ে দেখা দিয়েছে। সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতার যে কালো মেঘ ঢেকে রেখেছিল পাকিস্তানের আকাশ, এই সফর সব সংশয় দূর করে দিয়েছে। ক্রিকেটের জন্য পাকিস্তান যে নিরাপদ স্থানÑ এটা যেমন অন্যদের পথ দেখিয়ে দেবে; তেমনি সমৃদ্ধ করবে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের ব্যাংক ব্যালান্স। ভারতীয় দলের পাকিস্তান সফর এবং এর প্রভাবকে শুধু রান, উইকেট ও জয় দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। দু’দেশের মধ্যে অনাস্থা, অবিশ্বাস ও কুৎসিত সন্দেহের যে দেয়াল তৈরি হয়েছে, তা সহসা নিরসন করা না গেলেও এই সফরের ফলে পরস্পরের প্রতি গড়ে ওঠেছে আস্থা ও অন্তরঙ্গতা। দু’দেশের মানুষ একে অপরের কাছাকাছি হয়েছেন এবং অনুধাবন করেছেনÑ খেলাধুলা জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণীর ঊর্ধ্বে।
টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পর ১৯৫২ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান তাদের প্রথম সফরে যায় চিরশত্রু প্রতিবেশী ভারতে। সেই থেকে দু’দেশের ক্রিকেট সম্পর্কের সূত্রপাত হলেও দীর্ঘ ৫২ বছরে খুব বেশি টেস্ট খেলা হয়নি। যুদ্ধ, দ্বন্দ¡, সংঘাত আর রেষারেষির কারণে প্রায় সময়ই তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৭ বছর তাদের মধ্যে কোনো রকম ক্রিকেটীয় সম্পর্ক ছিল না। সম্পর্কের এই উত্থান-পতন বরাবরই অব্যাহত থাকে। ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে ওয়াসিম আকরামের নেতৃত্বে পাকিস্তান ভারত সফর করলেও ১৯৮৯-৯০ মৌসুমে কৃষ্ণামচারি শ্রীকান্তের নেতৃত্বে সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট সফরে পাকিস্তানে যায় ভারত। অবশ্য এর মাঝে ১৯৯৭ সালে শচীন টেন্ডুলকারের অধিনায়কত্বে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলার জন্য ভারত পাকিস্তান গিয়েছিল। বর্তমান দলের টেন্ডুলকার ছাড়াও সেই সফরে ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি ও রাহুল দ্রাবিড়। এরপর আর ভারত কখনোই পাকিস্তান যায়নি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সদ্য সমাপ্ত সফরে দু’দেশের মধ্যে টেস্ট ম্যাচের হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ হয়েছে। এর মধ্যে ভারতে ২৭টি ও পাকিস্তানে ২৩টি খেলা হয়েছে। ভারত লালা অমরনাথের নেতৃত্বে ১৯৫২ সালে এবং সুনীল গাভাস্কারের নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালে দেশের মাটিতে দু’বার সিরিজ জেতে। তবে সাম্প্রতিক সফরের আগে ভারত ভিনু মানকদ, সুনীল গাভাস্কার, বিষেণ সিং বেদী ও শ্রীকান্তের নেতৃত্বে পাঁচবার পাকিস্তান সফর করে ২০টি টেস্ট খেললেও সিরিজ তো দূরে থাকুক, কখনোই টেস্ট জিততে পারেনি। অতীতের সমস্ত ব্যর্থতা এবার ধুয়ে ফেলেছে সৌরভ গাঙ্গুলির ‘টিম ইন্ডিয়া’। পাকিস্তানের সঙ্গে ৫২ বছরের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বে মুলতানে প্রথম টেস্ট জয়, রাওয়ালপিন্ডিতে সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে ২-১ ম্যাচে সিরিজ জিতে নিয়ে ভারত নতুন ইতিহাস গড়েছে। ১৯৯৩ সালে শ্রীলংকায় মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের নেতৃত্বে বিদেশের মাটিতে সর্বশেষ সিরিজ (২০০০ সালে সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে ঢাকায় বাংলাদেশের সাথে একমাত্র টেস্ট জয়টি ধরা হয়নি) জয়ের পর ১১ বছরের ব্যবধানে জয়ের মুখ দেখলো ভারত। টেস্ট ও টেস্ট সিরিজ জয়ের আগে ভারত প্রথমবারের মত ওয়ানডে সিরিজ জিতে নেয় সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে। ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের কোয়েটায় প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মুখোমুখি হবার পর পাকিস্তানের মাটিতে দু’দেশ ১৫টি ম্যাচ খেললেও ভারত জয় পায় মাত্র তিনটিতে। একসঙ্গে একাধিক ম্যাচ জয়ের অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। সঙ্গত কারণে ওয়ানডে সিরিজও জেতা হয়নি। আর এবার ৩-২ ম্যাচে ওয়ানডে সিরিজ জিতে নতুন ইতিহাস গড়েছে ভারত। ওয়ানডে ও টেস্টে ভারতের দলীয় সাফল্যের পাশাপাশি ছিল ব্যক্তিগত মাইলফলকের ছড়াছড়ি। ছিল ক্রিকেটীয় তীব্রতা, গভীরতা ও আবেগ। ক্রিকেটাররা তাদের ব্যাট-বলে দেখিয়েছেন স্বপ্ন, কল্পনা, সাহস ও ঔজ্জ্বল্য।
ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের মুখোমুখি হলে দু’দেশের ক্রিকেটার, সমর্থক ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্রিকেটানুরাগীরা উত্তাপ-উত্তেজনায় ফুটতে থাকেন টগবগিয়ে। আর ভারতের এবারের সফরটি সব মিলিয়ে ছিল আনন্দের স্বর্ণখনি। পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজটিতে ছিল রূপ-রস-সৌন্দর্যের সম্ভার। প্রতিটি ম্যাচই দর্শকদের আনন্দের উপলক্ষ হয়ে ওঠে। ১৩ মার্চ করাচিতে অনুষ্ঠিত প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজিব গান্ধীর দুই সন্তান প্রিয়দর্শিনী প্রিয়াংকা ও সুদর্শন রাহুলের উপস্থিতি। ম্যাচটি ছিল শ্বাসরুদ্ধকর ও টানটান উত্তেজনায় ভরা। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে এক রানের জন্য রাহুল দ্রাবিড়ের (৯৯) সেঞ্চুরি করতে না পারার যন্ত্রণা, বীরেন্দর শেবাগের দ্রুতলয়ের ৭৯, মোহাম্মদ কাইফ (৪৬) ও অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির (৪৫) অনবদ্য ব্যাটিংয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩৪৯ রানের সর্বোচ্চ ইনিংস গড়ে ভারত। শোয়েব আখতার, মোহাম্মদ সামির মত দ্রুতগামী বোলারদের বিষাক্ত বলের বিষদাঁত ভেঙে দেন ভারতের ব্যাটসম্যানরা। ব্যাটিংয়ে যথাযোগ্য জবাবটা দিতে থাকেন পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানরা। ‘ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি’ খ্যাত অধিনায়ক ইনজামাম-উল হক ১২২ রানের রোমাঞ্চকর ইনিংসটি জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় পাকিস্তানকে। সেই সঙ্গে ইউসুফ ইয়োহানা (৭৩), ইউনিস খান (৪৬) যথাযোগ্য সমর্থন দিয়ে যান। কিন্তু মোহাম্মদ কাইফ অবিশ্বাস্য একটি ক্যাচ নিয়ে শোয়েব মালিককে ফিরিয়ে দিলে এবং আশীষ নেহরার দুর্দান্ত শেষ ওভারটি বিস্ময়কর এই ম্যাচটিতে পাঁচ রানের চমকপ্রদ জয় এনে দেয় ভারতকে।
১৬ মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতেও মঞ্চস্থ হয় øায়ুপীড়নকারী আরেকটি হাই স্কোরিং ম্যাচ। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ইয়াসির হামিদের ধৈর্যশীল ৮০, শহীদ আফ্রিদির স্বভাবসুলভ মারমুখী ৮০, আব্দুর রাজ্জাক (অপরাজেয় ৩১), শোয়েব মালিক (অপরাজিত ৩০), ইনজামাম-উল হক (২৯), ইউনিস খান (২৮), ইউসুফ ইয়োহানার (২৪) আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে পাকিস্তান ৩২৯ রানের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। আগের ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচ ইনজামামের মত অসম্ভবকে সম্ভব করার চ্যালেঞ্জ লুফে নেন শচীন টেন্ডুলকার। তার বিদ্যুৎসঞ্চালক ইনিংসটি ১৪১ রানে থেমে গেলে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষরা। রমেশ পাওয়ার ও লক্ষ্মীপতি বালাজির সাহসী ব্যাটিং কিছুটা আশা জাগালেও তা দপ করে নিভিয়ে দেন মোহাম্মদ সামি। ১২ রানে হার মানে ভারত।
১৯ মার্চ পেশোয়ারে শাব্বির আহমেদের নিখুঁত স্পেলিং-এর মাত্র ৩৭ রানে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের তিন স্তম্ভ শচীন টেন্ডুলকার, বীরেন্দর শেবাগ ও ভিভিএস লক্ষ্মণকে ফিরিয়ে দিয়ে যে চাপ সৃষ্টি করেন, তা কিছুটা শিথিল করতে সক্ষম হন যুবরাজ সিং। যুবরাজের ঝলমলে ৬৫ রান ভারতকে পৌঁছে দেয় ২৪৪ রানে। শুরুতেই ইরফান পাঠান জ্বলে উঠলে খেলা অনেকটা প্রাণ ফিরে পায়। ৬৫ রানে ৪টি উইকেটের পতন ঘটলেও ইয়াসির হামিদের দায়িত্বশীল ৯৮ ও আব্দুর রাজ্জাকের (অপরাজিত ৫৩) ম্যাচ উইনিং ব্যাটিংয়ে ৪ উইকেটে জয়ী হয়ে সিরিজে এগিয়ে যায় পাকিস্তান।
২১ মার্চ লাহোরে ভারতীয় দলের সংকটে, বিপর্যয়ে পরম দুই নির্ভরতা রাহুল দ্রাবিড় ও মোহাম্মদ কাইফ পুনরায় তাদের নামের সুখ্যাতি বজায় রাখেন। ইনজামাম-উল হকের মাস্টারফুল ১২৩ রানের ইনিংসে পাকিস্তান করে ২৯৩ রান। শচীন টেন্ডুলকার, ভিভিএস লক্ষ্মণ, বীরেন্দর শেবাগ, সৌরভ গাঙ্গুলি ও যুবরাজ সিং ফিরে গেলে ঠা-া মাথায় রাহুল দ্রাবিড় (অপরাজিত ৭৬) ও ছটফটে হলেও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে বিশ্বস্ত মোহাম্মদ কাইফ (অপরাজেয় ৭১) কখনো বল ঠেকিয়ে, কখনো ঝলসে ওঠে যে ১৩২ রান যোগ করেন, তাতে ভারত শুধু ৫ উইকেটেই জয়ী হয়নি, একই সঙ্গে সিরিজে সমতা আসায় মাঠে উপস্থিত অসংখ্য ভারতীয় দর্শক স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন।
২৪ মার্চ লাহোরে সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচটি ক্রিকেটানুরাগীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। টানা পঞ্চম ম্যাচে টস জিতে পাকিস্তানী অধিনায়ক ইনজামাম-উল হক প্রতিপক্ষের হাতে ব্যাট তুলে দিলে দলের সবাই টুকটাক অবদান রাখলেও মূল ভূমিকা রাখেন ভিভিএস লক্ষ্মণ। লক্ষ্মণের ১০৭ রানের বিস্ফোরক ইনিংসে ভারত ২৯৩ রান করলে ম্যাচটি প্রতিদ্বন্দি¡তাপূর্ণ হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দেয়। ভারতীয় দলের আÍবিশ্বাসী দুই পেসার ইরফান পাঠান ও লক্ষ্মীপতি বালাজির লাইন-লেংথ বজায় রেখে তীব্র ছোবলের বলগুলো পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানদের কাছে নাভিশ্বাস হয়ে দেখা দেয়। ৯৬ রানে তাদের ৬টি উইকেট চলে গেলেও সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল ইনজামামের ফিরে যাওয়াটা। স্পিনার মুরালি কার্তিককে লংঅন দিয়ে হাওয়ায় উড়িয়ে মারতে গেলে বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে বাঁ-দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শচীন টেন্ডুলকার বিস্ময়কর যে ক্যাচটি নেনÑ তা অনেকটা ঘুরিয়ে দেয় খেলার মোড়। শোয়েব মালিক (৬৫), মঈন খান (৭২) ঝড়ো গতিতে ব্যাট করে আশার আলো জ্বালিয়েছিলেন, কিন্তু ইতিহাস তখন কড়া নাড়ছে ভারতের দুয়ারে। ৪০ রানে ম্যাচ জিতে, ৩-২ ম্যাচে সিরিজ জিতে পাকিস্তানের মাটিতে সাফল্যের তেরঙ্গা পতাকা উড়িয়েছেন সৌরভ বাহিনী।
সম্পর্কের শীতল বরফ আর মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার কারণে প্রায় ১৪ বছর পর পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট ক্রিকেটে মুখোমুখি হয় ভারত-পাকিস্তান। ভারতীয় দলের শচীন টেন্ডুলকার ছাড়া আর কোনো ক্রিকেটারের ইতিপূর্বে পাকিস্তানে টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা ছিল না। ১৯৮৯ সালে ভারতের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ সফরে পাকিস্তানে অভিষেক হয় টেন্ডুলকারের। সিরিজ শুরুর আগে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেন, টেস্ট সিরিজে লড়াই হবে পাকিস্তানী দুর্ধর্ষ বোলারদের সঙ্গে ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং-এর।
২৬ মার্চ মুলতানে শুরু হওয়া প্রথম টেস্টটি সৌরভ গাঙ্গুলির ইনজুরির কারণে ভারতীয় দলের নেতৃত্ব দেন রাহুল দ্রাবিড়। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নামার পর মুলতান টেস্ট যেন ভারতকে দু’হাত ভরে মুঠো মুঠো সোনা ছড়িয়ে দেয়। সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকারের মত ব্যাটসম্যানরা না পারলেও ভারতের ৭২ বছরের টেস্ট ইতিহাসে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন মারকুটে ব্যাটসম্যান বীরেন্দর শেবাগ। তবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শচীন টেন্ডুলকারকে ডাবল সেঞ্চুরি করতে না দেয়ায় তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করে। যে শচীন হাজার চড়েও রা করেন না, সেই শচীনও এই সিদ্ধান্তে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। শেবাগের ৩০৯ ও শচীনের অপরাজিত ১৯৪ রানের ধ্রুপদী ইনিংসে ভারত ৫ উইকেটে ৬৭৫ রানের বিশাল স্কোর গড়ে ডিকেয়ার দেয়। ইয়াসির হামিদের ৯১, অধিনায়ক ইনজামাম-উল হকের ৭৭ রানে পাকিস্তান প্রথম ইনিংসে ৪০৭ রান করে ফলো-অনের সম্মুখীন হয়। ইরফান পাঠান চারটি উইকেট নিয়ে তার সদর্প আবির্ভাবের ঘোষণা দেন। দ্বিতীয় ইনিংসে অনীল কুম্বলের (৬/৭২) স্পিনের ঘূর্ণিতে ধরাশায়ী হয় পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানরা। ইউসুফ ইয়োহানা (১১২) শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে ম্যাচটিকে পঞ্চম দিনে নিয়ে গেলেও পাকিস্তান ইনিংস ও ৫২ রানে হেরে যায়। পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয় ভারতের।
৫ এপ্রিল থেকে লাহোরে শুরু হয় দ্বিতীয় টেস্ট। মুলতান টেস্টের পিচ ব্যাটসম্যানদের স্বর্গোদ্যান বানিয়ে পাকিস্তান যে খেসারত দেয়, লাহোরে পেস বোলিং উপযোগী উইকেট তৈরি করে ফায়দা লুটে নিতে সক্ষম হয় তাদের বোলাররা। পাকিস্তানের উমর গুলের দুরন্ত বোলিং ভারতকে প্রথম ইনিংস ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলে লড়াকু ব্যাটিং প্রদর্শন করেন যুবরাজ সিং ও ইরফান পাঠান। যুবরাজের ১১২ ও ইরফানের ৪৯ রানে ভারতের স্কোর দাঁড়ায় ২৮৭। উমর গুল ১২ ওভার বোলিং করে ৩১ রান দিয়ে একে একে ফিরিয়ে দেন বীরেন্দর শেবাগ, শচীন টেন্ডুলকার, ভিভিএস লক্ষ্মণ, রাহুল দ্রাবিড় ও পার্থিব প্যাটেলকে। ইনজামাম-উল হকের ১১৮, ইমরান ফারহাতের ১০১, আসিম কামালের ৭৩ ও ইউসুফ ইয়োহানার ৭২ রানের ওপর দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের প্রথম ইনিংস ৪৮৯ রানে সমাপ্ত হয়। বীরেন্দর শেবাগের ৯০ ও পার্থিব প্যাটেলের হার না-মানা ৬২ রানে ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস ২৪১ রানে গুটিয়ে যায়। জয়ের ৪০ রানের জন্য খেলতে নেমে পাকিস্তান ১ উইকেট হারিয়ে খেলার চতুর্থ দিনেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায়। ৯ উইকেটে জয়ী হয়ে সিরিজে সমতা ফিরিয়ে আনে পাকিস্তান।
মুলতানে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের রাজত্ব আর লাহোরে পাকিস্তানী বোলারদের দাপটের মধ্য দিয়ে সিরিজে সমতা ফিরে এলে ১৩ এপ্রিল থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে তৃতীয় টেস্ট ফাইনালে রূপ নেয়। ইনজুরির কারণে আগের দু’টেস্ট থেকে দূরে সরে থাকা অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির প্রত্যাবর্তন ঘটায় ভারতীয় দল আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। লাহোর টেস্টের জয়ের নায়ক উমর গুল ইনজুরিতে পড়লে পাকিস্তান কিছুটা দুর্বল হয়ে যায়। রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে সৌভাগ্য যেন সৌরভ গাঙ্গুলিকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। ওয়ানডে সিরিজে একটি ম্যাচেও টস জিততে না পারা সৌরভ এ টেস্টে টস জিতে কিছুটা হলেও সুবিধা পেয়ে যান। ভারতীয় বোলারদের নিখুঁত ও কার্যকরী বোলিং অ্যাটাকে পাকিস্তান শিবিরে শুরু হয়ে যায় ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। সর্বোচ্চ ৪৯ রান আসে মূলত পেসার হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ সামির ব্যাট থেকে। যে উইকেট পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানদের কাছে বধ্যভূমি হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তাদের প্রথম ইনিংস ২২৪ রান অব্দি পৌঁছাতে পারে, সেই উইকেটে রানের বীণা বাজিয়েছেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। ইনিংসের প্রথম বলেই শোয়েব আখতার দুর্ধর্ষ বীরেন্দর শেবাগকে ফিরিয়ে দিলেও রাহুল দ্রাবিড় উইকেটে এমনভাবে ঠাঁই গেড়ে বসেন, মনোভাবটা ছিল এমনÑ তার মর্জি না হলে কেউ তাকে সরিয়ে দিতে পারবে না। দ্রাবিড় ১২ ঘণ্টা ২০ মিনিট ব্যাট করে ২৭০ রানের সৌধ গড়ার পর কান্তিতে ভেঙ্গে পড়েন। তরুণ পার্থিব প্যাটেলকে ওপেনিংয়ে পাঠিয়ে সৌরভ যে জুয়া খেলেন, তাতেও সফল হন তিনি। পার্থিবের ৬৯, লক্ষ্মণের ৭১ ও সৌরভ গাঙ্গুলির ৭৭ রানে ভারতের ইনিংস পৌঁছে ৬০০ রানে। উমর গুল ও শাব্বির আহমেদের অনুপস্থিতির পাশাপাশি তৃতীয় দিনে ইনজুরির কারণে শোয়েব আখতারের আর বল করতে না পারাটা পাকিস্তানের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেয়। দ্বিতীয় ইনিংসে যথারীতি পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানরা চাপের মুখে ভেঙে পড়েন। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন আসিম কামাল। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েও তিনি সাহসের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যান। তার অপরাজেয় ৬০ রানের লড়াকু ইনিংস এবং দুটি ছক্কা ও চারটি বাউন্ডারির সাহায্যে ১৪ বলে শোয়েব আখতারের ২৮ রানের বিস্ফোরক ইনিংসে পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংস ২৪৫ রানে থেমে গেলে চতুর্থ দিনেই ভারত ইনিংস ও ১৩১ রানের বিশাল জয় পায়। ২-১ ম্যাচে সিরিজ জিতে বড় ধরনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ভারতের। তবে ইনজুরির কারণে বল না করা শোয়েব আখতারের আনন্দদায়ক ব্যাটিং বিতর্কের সৃষ্টি করে। এমনকি তাকে তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হতে হয়।
পাকিস্তান সফরে ভারতের সাফল্যের মূলে ছিল তাদের ব্যাটিং অভিজ্ঞতা ও গভীরতা। পাশাপাশি দুই তরুণ বোলার ইরফান পাঠান ও লক্ষ্মীপতি বালাজী প্রত্যাশার চেয়েও বেশি নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। এই দুই বোলারের দৃঢ়চেতা ও অনমনীয় মনোভাব, প্রচ- আস্থা ও কঠিন প্রত্যয় তাদের সাফল্য এনে দিয়েছে। বিস্ফোরক বীরেন্দর শেবাগ আর রাহুল দ্রাবিড়ের নির্ভরতার পাশাপাশি অন্যতম প্রাপ্তি পার্থিব প্যাটেল ও যুবরাজ সিং-এর ব্যাটিং। বিদেশের মাটিতে দু’বার সিরিজ জয়ী দলের অধিনায়ক অজিত ওয়াদেকারের মতে, বর্তমান ভারতীয় দলটিই সর্বকালের সেরা।
পাকিস্তানের বোলিং প্রত্যাশা অনুযায়ী জ্বলে না ওঠায় তারা কাক্সিক্ষত সাফল্য পায়নি। এছাড়া ওমর গুল ও শাব্বির আহমেদের ইনজুরি তাদেরকে যথেষ্ট ভুগিয়েছে। পাকিস্তানের ব্যাটিং মূলত ইনজামাম-উল হক ও ইউসুফ ইয়োহানার ওপর নির্ভরশীল। এই দু’জন ব্যর্থ হলে অন্যদের পক্ষে হাল ধরা কঠিন হয়ে পড়ে। দলে তরুণদের প্রাধান্য থাকায় ভারতের সঙ্গে খেলতে যেয়ে তারা অনেকটা øায়ুর চাপে ছিলেন। ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির অভিমত, এই তরুণদের পরিপক্ব হয়ে উঠতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। তবে হতাশার সাগরে আশার বাতিঘর ছিলেন আসিম কামাল।
ভারতীয় ক্রিকেট দলকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গরূপে গড়ে তুলেছেন ‘বাঙালি বাবু’ সৌরভ গাঙ্গুলি। ২০০০ সালের নভেম্বরে দায়িত্ব নেয়ার পর লড়াকু অধিনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। লড়াইয়ের আগে কোনক্রমেই হেরে যেতে রাজি নন সৌরভ। তিনি হলেন ‘টিম ইন্ডিয়া’র স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার। বাংলাদেশকে হারিয়ে তার জয়যাত্রা শুরু হয়। ২০০২ সালের জুলাইতে ইংল্যান্ডের লর্ডসে ত্রিদেশীয় ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জয়, ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে ওঠা, চলতি বছরের শুরুতেই অস্ট্রেলিয়া সফরে ব্রিসবেনে দারুণ লড়াইয়ের পর অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ২২ বছর পর টেস্ট জয় ও চার ম্যাচের সিরিজ ১-১ ম্যাচে ড্র এবং পাকিস্তানে স্বপ্নের মত সাফল্যের পর ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়কে পরিণত হয়েছেন সৌরভ গাঙ্গুলি। ভারতের ২৮ জন অধিনায়কের মধ্যে আর কেউ তার মত সফল নন। এ পর্যন্ত ভারত ৭৭টি টেস্ট জিতলেও সর্বাধিক টেস্ট জয়ের রেকর্ড এখন সৌরভের। গত সাড়ে তিন বছরে ৩৮টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ১৫টিতে জয়ী হয়েছেন। আগের রেকর্ড ছিল মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের। টেস্ট জয়ের সংখ্যা ছিল ১৪টি। টেস্ট ইতিহাসে ভারত বিদেশের মাটিতে ২১টি টেস্ট জিতলেও সর্বাধিক ৭টি জয় এসেছে সৌরভের নেতৃত্বে। বিদেশের মাটিতে সৌরভের আগে সিরিজ জিতেছেন ১৯৬৮ সালে নিউজিল্যান্ডে মনসুর আলী খান পতৌদি, ১৯৭১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ইংল্যান্ডে অজিত ওয়াদেকার, ১৯৮৬ সালে ইংল্যান্ডে কপিল দেব ও ১৯৯৩ সালে শ্রীলংকায় মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন।
ভারত ও পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা শান্তি, সম্প্রীতি ও উষ্ণ সম্পর্ক বন্ধন সুদৃঢ় করার সেতুবন্ধন হিসেবে ভারতের এই সফরটিকে আখ্যায়িত করেন। সফরের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ভারতীয় দলের শুভ কামনা করে বলেন, “খেল ভি নেহি, দিল ভি জিতিয়ে’ কিন্তু ভারতীয় অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি এই সফরকে শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে নেননি। তিনি পাকিস্তানে পৌঁছেও বলেছেন, ‘আমরা এখানে এসেছি জিততে’। এই অনমনীয় ও দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে পাল্টে যাচ্ছে ভারতীয় দল। তার অধিনায়কত্ব বরাবরই উৎসাহব্যঞ্জক ও অনুপ্রেরণাদায়ক। তরুণদের প্রতি তার আস্থা ও ভালবাসার কারণে তারাও তাকে প্রতিদান ফিরিয়ে দিতে মোটেও কার্পণ্য করেন না। এ কারণে তিনি রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে তরুণ পার্থিব প্যাটেলকে ওপেনিংয়ে পাঠিয়ে নির্দ্বিধায় ঝুঁকি নিতে পারেন কিংবা ইরফান পাঠান, লক্ষ্মীপতি বালাজী, আশীষ নেহরার ওপর শেষ বল পর্যন্ত ভরষা করতে পারেন। সৌরভের কাছে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াটা বড় নয়, ভারতের জয়টাই মুখ্য। ইদানীং ব্যাটিংটা জুতমত না হলেও ওয়ানডেতে ১৬৫ রান এবং টেস্টে একটি মাত্র ইনিংস খেলে ৭৭ রান করেন।
ভারতীয় দলের অনেক সাফল্যের নায়ক সহ-অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়। পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়ে নেতৃত্ব দেয়ার পাশাপাশি রাওয়ালপিন্ডিতে সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে ভারতীয় দলের জয়ের মঞ্চ গড়ে দেন তিনি। অখ- মনোযোগ, ইস্পাতসম দৃঢ়তা, অসাধারণ টেকনিক্যাল জ্ঞান, স্ট্রোক সিলেকশনে সুবিবেচক ও আপাদমস্তক দায়িত্বশীল এই ক্রিকেটারের ২৭০ রানের ইনিংসের ওপর দাঁড়িয়ে ভারতের সিরিজ জয়টা সহজ হয়ে যায়। এটি ছিল দ্রাবিড়ের পঞ্চম এবং এক বছরের কম সময়ে তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরি। ওয়ানডে সিরিজে উইকেটকিপিং-এর পাশাপাশি ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪৮ রান তার। এর মধ্যে করাচিতে রোমাঞ্চকর প্রথম ম্যাচে ৯৯ এবং লাহোরে চতুর্থ ম্যাচে অপরাজেয় ৭৬ রানের অনন্যসাধারণ ইনিংস খেলে যেভাবে দলকে জিতিয়ে আনেন, তাতে তাকে রোবট বলেই প্রতীয়মান হয়। ‘টিম ইন্ডিয়া’র প্রধান স্তম্ভ এখন রাহুল দ্রাবিড়।
টিম ইন্ডিয়ার প্রধান ট্রাম্পকার্ড বীরেন্দর শেবাগ। মুলতানে তিনি ৩০৯ রানের যে মাস্টারপিস রচনা করেন, তা শুধু কোনো ভারতীয়র প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি নয়, পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম টেস্ট জয়ের মাইলফলকও বলা যায়। শেবাগের গড়া এই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে সিরিজ জয়ের অনুপ্রেরণা পেয়ে যায় ভারত। ওয়ানডেতে শেবাগের সংগ্রহ ১৬৪। খুব বেশি সুবিধা করতে না পারলেও খেলার শুরুতেই এই ওপেনিং ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইক রেট প্রতিপক্ষের ওপর একটা মানসিক চাপ তৈরি করে। যে কোনো দলের কাছেই শেবাগ এখন রীতিমত আতংক।
ভারতীয় দলের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য স্পিনার অনীল কুম্বলে টেস্ট সিরিজে দলের সঙ্গে যোগ দেন। ভারতীয় এই ম্যাচ উইনার বোলার এই ৩৩ বছর বয়সেও তার বলে যৌবন ধরে রেখেছেন। মুলতান ও রাওয়ালপিন্ডিতে টেস্ট জয়ের ক্ষেত্রে তার স্পিনের জাদু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিনি তার বৈচিত্র্যপূর্ণ ও চাতুর্যময় ফাইট ও টার্ন দিয়ে ব্যাটসম্যানদের ফাঁদে ফেলে দেন। মুলতান টেস্টে তার দ্বিতীয় ইনিংসে ৭২ রানে ৬ এবং রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৭ রানে ৪ উইকেট পাকিস্তানের পরাজয়কে ত্বরানি¦ত করে। সিরিজে সর্বোচ্চ ১৫ উইকেট অনীল কুম্বলের।
পাকিস্তান সফরে সবচেয়ে সাড়া জাগানো তারকা হলেন ইরফান পাঠান। এই বাঁহাতি সীমার গত বছর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এশীয় অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সঙ্গে ৯টি উইকেট নিয়ে সবার নজর কেড়ে নেন। তারই পথ বেয়ে অস্ট্রেলিয়া সফরে ভারতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে তিনি সম্ভাবনার আলো জ্বালান। পাকিস্তানের কোচ জাভেদ মিয়াঁদাদ ইরফান পাঠানকে পাকিস্তানের অলি-গলির বোলারের সঙ্গে তুলনা করলেও তরুণ এই বোলার আশাতীত সাফল্য দেখিয়েছেন। ভারতীয় বোলিংয়ের নবতম এই সেনসেশন ওয়ানডে সিরিজের শেষ তিনটি ম্যাচ খেলে দলের পক্ষে সর্বাধিক ৮টি উইকেট নেন। টেস্টে নিয়েছেন ১২টি উইকেট। ইউসুফ ইয়োহানা, ইনজামাম-উল হকের মত পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যানরা ইরফানের বল খেলতে যেয়ে হিমশিম খেয়ে যান। ইরফান সুইং বোলিংয়ের মৃত শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। তার বল নিয়ন্ত্রিত ও নিখুঁত। তার হার না-মানা মনোভাব অসাধারণ। দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে তিনি এ পর্যায়ে উঠে এসেছেন। তার রয়েছে শেখার আগ্রহ ও পরিশ্রম করার ক্ষমতা। লাহোর টেস্টে ৪৯ রান করে বুঝিয়ে দিয়েছেনÑ দুর্দান্ত অলরাউন্ডার হওয়ার যাবতীয় গুণ তার মাঝে বিদ্যমান। ইরফান পাঠান ক্রমশ: নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে উদগ্রীব।
অপ্রত্যাশিতভাবে দলে সুযোগ পেয়ে লক্ষ্মীপতি বালাজি পাকিস্তান সফরে খেলা ও আচরণ দিয়ে মাঠে ও মাঠের বাইরের সবার মন জয় করে নেন। ওয়ানডেতে ৬টি এবং টেস্টে ১২টি উইকেট নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে ৭টি উইকেট। নতুন বলে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন তিনি। পাঠান-বালাজি জুটি ‘টিম ইন্ডিয়া’র নতুন দিনের চন্দ্র-সূর্য।
‘টিম ইন্ডিয়া’র উজ্জ্বল প্রতিনিধি যুবরাজ সিং। মূলত: ওয়ানডে ব্যাটসম্যান হিসেবে পরিচিত এই ক্রিকেটার দ্রুত রানের অর্কেস্ট্রা বাজানোর পাশাপাশি দুরন্ত ফিল্ডিং করে থাকেন। পাকিস্তান সফরে ওয়ানডে সিরিজে চমৎকার ফিল্ডিং ও ১৪১ রান তারই প্রতিফলন। কিন্তু সৌরভ গাঙ্গুলি ইনজুরি তাকে টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। লাহোরে দলের বিপর্যয়ে তার সংগ্রামী ১১২ রানের ইনিংসটি টিম ম্যানেজমেন্টকে নতুন করে ভাবনার খোরাক যুগিয়েছে।
দীর্ঘদিন যাবৎ ভারতীয় ব্যাটিংয়ের প্রধান অবলম্বন শচীন টেন্ডুলকার দলের সাম্প্রতিক সাফল্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারেন। দল এখন আর তার উপর এককভাবে নির্ভরশীল নয়। ওয়ানডে সিরিজে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে ১৪১ রানের ইনিংসসহ মোট ২১৩ রান এবং মুলতান টেস্টে অপরাজিত ১৯৪ রানসহ সিরিজে ২০৫ রান করেন। মুলতান টেস্টে শেবাগের ট্রিপল সেঞ্চুরি করার ক্ষেত্রে টেন্ডুলকার সহায়ক
ভূমিকা পালন করেন।
ভারতের উদীয়মান উজ্জ্বল তরুণদের একজন পার্থিব প্যাটেল। এই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান লাহোরে হার না-মানা ৬২ এবং রাওয়ালপিন্ডিতে ওপেন করতে নেমে ৬৯ রান করে সম্ভাবনার নতুন আলো জ্বালিয়েছেন। কিছু ভুল-ভ্রান্তি থাকলেও উইকেটকিপার হিসেবে তিনি ক্রমশ: পরিণত হয়ে উঠছেন।
ভিভিএস লক্ষ্মণ প্রথম দুই টেস্টে সুবিধা করতে না পারলেও রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে ৭১ রানের একটি চমৎকার ইনিংস খেলেন। ওয়ানডে সিরিজে ধারাবাহিক ব্যর্থতা দেখালেও সিরিজ নির্ধারণী পঞ্চম ম্যাচে হেসে ওঠে তার ব্যাট। লক্ষ্মণের ১০৭ রানের ঐশ্বর্যবান ইনিংসের কল্যাণে সিরিজ জেতে ভারত।
ইনজুরি আশীষ নেহরা ও জহির খানকে তেমনভাবে জ্বলে উঠতে না দিলেও তারা তাদের নৈপুণ্যের ঝলক দেখিয়েছেন। মোহাম্মদ কাইফ, আকাশ চোপড়া, মুরালি কার্তিক, রমেশ পাওয়ার, হেমাঙ বাদানি ও অজিত আগারকাররা তাদের সীমিত সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলেও উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন কাইফ। ওয়ানডেতে তার ব্যাটিং ও ফিল্ডিং ‘টিম ইন্ডিয়া’র অন্যতম সম্পদ।
অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির ‘টিম ইন্ডিয়া’ গড়ে উঠার নেপথ্য নায়ক হলেন জন রাইট। নিউজিল্যান্ডের সাবেক এই ক্রিকেটার ভারতীয় দলটিকে ঘষে-মেজে ঝলমলে রূপ দিয়েছেন।
ভারতের ৩৮ দিনের পাকিস্তান সফরে ক্রিকেটের নাটকীয়তা ও রোমাঞ্চকর ঘটনাবলীর বাইরে একটু ভাবলে দেখা যায়, এ সফরে দু’দেশের আবেগ ও উপলব্ধির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। ওয়ানডে ক্রিকেটে গ্যালারি উত্তাপে ফুটলেও টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে দর্শকরা অনেকটা নিস্পৃহ ছিলেন। কিন্তু ভারতীয়দের জন্য উষ্ণ আতিথেয়তা অব্যাহত ছিল। ভারতীয় ক্রিকেটার ও সমর্থকরা বরাবরই পেয়েছেন স্বাগতিকদের অনুরাগ ও ভালবাসা। অথচ এই সফরটি না হলে ভারতীয়দের এই অভাবিত ও অকল্পিত আতিথেয়তার অভিজ্ঞতা হত না। সাধারণ মানুষ হৃদয় দিয়ে অনুভব না করলে শুভেচ্ছা ও বন্ধুত্ব পরিণত হয় শূন্য স্লোগানে। আর ক্রিকেটই পারে সম্পর্কের নবদিগন্তের উন্মোচন ঘটাতে। ক্রিকেটই সেই জানালাÑ যা দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই একে অপরকে দেখতে এবং পরিবর্তন অনুভব করতে পারে।
আসলে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি কোনো সুস্থ ও সুন্দর মানুষের কাম্য নয়। অনেক বেশি মূল্য দিয়ে মানুষের এই উপলব্ধি ঘটেছে। এই সিরিজ শুধু ঐতিহাসিক, গুরুত্বপূর্ণ, ঘটনাবহুল ও স্মরণীয়ই নয়Ñ নবযুগ সৃষ্টিকারীও বটে। ভারত ও পাকিস্তানের সমর্থকরা তাদের মুখে এঁকেছেন একে অপরের জাতীয় পতাকা। করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, পেশোয়ার, লাহোর, মুলতানের রাস্তায় রাস্তায় উড়েছে দু’দেশের পতাকা। স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে শান্তিকামী সমর্থকরা ভারতীয় তেরঙ্গা ও পাকিস্তানের নিশানকে গেঁথেছেন একই সুতোয়। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী রমিজ রাজার বর্ণাঢ্য জীবনে অতীতে এমন চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা কখনোই ছিল না। তার মত সবাই বিস্ময়কর দৃষ্টিতে দেখেছেন, নিজেদের ক্রিকেটের সাফল্যের পাশাপাশি পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে দেয়ার পরও দর্শকরা জয়ধ্বনি করেছেন লক্ষ্মীপতি বালাজির। পাকিস্তান হারলেও দর্শকদের আবেগ কখনোই কদর্য রূপে প্রকাশিত হয়নি। প্রতিটি মাঠেই ভারতীয় ক্রিকেটাররা কম-বেশি হাততালি পেয়েছেন। এ তো ক্রিকেটের সেই চিরন্তন রূপ। হারলেও তালি, জিতলেও। সুন্দর ক্রিকেটের প্রশংসায় সবাই ছিলেন পঞ্চমুখ। এক দল হেরেছে, জিতেছে আরেক দল। কিন্তু উভয় পক্ষই জিতে নিয়েছে মানুষের হৃদয়। সামগ্রিকভাবে ভারতের এই সফরে জয় হয়েছে ক্রিকেটের। জয়ী হয়েছে সকলেই।
ভারত বিচিত্রা : জুন ২০০৪

ফিরে আসুক ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সোনালী দিনগুলো

বিস্ময়কর নৈপুণ্য প্রদর্শন করে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যারিবীয়দের এই চমকপ্রদ সাফল্য ক্রিকেটানুরাগীদের মুক্তি দিয়েছে গতানুগতিকতা থেকে। একই সঙ্গে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সোনালী দিনগুলো পুনরুদ্ধারের।
ইংল্যান্ডে জন্ম ও বিকাশ হলেও ক্রিকেটকে সুর, ছন্দ, সৌন্দর্য, লাবণ্য ও সুষমা দিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্রিকেটকে আনন্দময়, ছন্দময় ও প্রাণোচ্ছ্বল করে তোলার জন্য ক্যারিবীয়দের ভূমিকার কোনো তুলনা হয় না। তারা মনে করেন, খেলাটা যুদ্ধ
নয়Ñ খেলাটা খেলাই। ক্রিকেট থেকে জীবনের নির্যাস পান করে তারা হাসির ফোয়ারা বইয়ে দেন খেলার মাঠে, প্যাভিলিয়নে, ড্রেসিং রুমেÑ সর্বত্র। এত হাসি, এত গান ক্যারিবীয়দের রক্তে সহজাত। আসলে দূর থেকে ভেসে আসা সমুদ্রের গর্জন, হু-হু করে বয়ে যাওয়া বাতাস আর সারি সারি নারকেল বনের মধুর সঙ্গীত ক্যারিবীয় সরল-উচ্ছ্বল মানবের প্রাণতটে কল্লোলিত হয় সুর ও নৃত্যের ব্যঞ্জনায়। ক্রিকেট পৃথিবী রোমাঞ্চিত ও সঙ্গীতময় হয়ে ওঠে সেই পঞ্চাশ দশক থেকে। ফ্রাঙ্ক ওরেল, এভারটন উইকস ও কাইভ ওয়ালকটের রানে ও গানে উছলে ওঠে যে ক্যালিপসো সুর, তাতে মুগ্ধ হতে থাকে সৌন্দর্যপিয়াসী ক্রিকেটানুরাগীরা। তারা হৃদয় দিয়ে ক্রিকেট খেলে ক্রিকেটকে কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছেন সুর-ছন্দ ও মাধুর্র্যে। পঞ্চাশ ও ষাট দশক ক্যারিবীয় ক্রিকেটের শৈল্পিক সৌন্দর্য ও রূপ-মাধুর্যে প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি সত্তর ও আশির দশক ছিল তাদের রাজত্বের কাল। কাইভ লয়েডের নেতৃত্বে গর্ডন গ্রীনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স, ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গারনার, ভিভ রিচার্ডস, রিচি রিচার্ডসন, অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং-এর মত দাপুটে ক্রিকেটাররা কাঁপিয়ে দেন ক্রিকেট বিশ্ব। তাদের ব্যাটে ছিল সমুদ্রের ঢেউ আর বলে ছিল হ্যারিকেনের তা-ব। সেই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হওয়াটা প্রতিপক্ষের কাছে ছিল রীতিমত আতংকজনক। টেস্ট ক্রিকেটে তাদের সাফল্যের পাশাপাশি ওয়ানডে ক্রিকেটে তারা পরিণত হয় অপ্রতিরোধ্য দলে। ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটে তারা অবলীলায় জয়ী হয়। কিন্তু ১৯৮৩ সালে তৃতীয় বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে গিয়ে সেই যে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে ক্যারিবীয় ক্রিকেটÑ তা আর কাটিয়ে ওঠা যায়নি। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে উঠলেও হ্যানসি ক্রনিয়ের দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে তারা পেরে ওঠেনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের অধঃপতনের ধারায় ব্রায়ান লারার মত অসম্ভব মেধাবী ব্যাটসম্যানের আবির্ভাব ঘটলেও সাফল্য যেন সোনার হরিণ হয়ে ওঠে। বরং অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আর্থিক সচ্ছলতার আশায় ফুটবল ও বাস্কেটবলের প্রতি তরুণদের আগ্রহ আর সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সমন¦য়ের অভাবে ক্যারিবীয় ক্রিকেট তার ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে থাকে। ১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপ জয়ের পর বড় কোনো টুর্নামেন্টে শিরোপা জয় করতে না পারা এবং টেস্ট ক্রিকেটে ক্রমাগত পরাজয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট হয়ে পড়ে হালবিহীন জাহাজের মত।
এমনি এক প্রেক্ষাপটে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত চতুর্থ আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশকে ১৩৮ রানে এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫ উইকেটে হারিয়ে সেমিফাইনালে এবং পাকিস্তানকে ৭ উইকেটে পরাজিত করে ফাইনালে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ডের। স্বাগতিক ইংল্যান্ড দোর্দন্ত প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়াকে ৬ উইকেটে হারিয়ে তখন টগবগিয়ে ফুটছে। গত পাঁচ বছরে ওয়ানডে ক্রিকেটে এটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ইংল্যান্ডের প্রথম জয়। সঙ্গত কারণে ওভালের ফাইনালে ইংল্যান্ড ছিল ফেভারিট। কিন্তু ওয়াভেল হাইন্ডস ও ইয়ান ব্রাডশ-এর দুর্দান্ত বোলিং আর অধিনায়ক ব্রায়ান লারার অসাধারণ ফিল্ডিং-এ ২১৭ রানে গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড। এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মার্কাস ট্রেসকোথিক। তার ১০৪ রানের ইনিংসে সম্মানজনক ইনিংস গড়ে ইংল্যান্ড। নিজেদের মাঠ, নিজেদের দর্শক আর প্রতিপক্ষের টানা ব্যর্থতায় এই ইনিংস নিয়ে জয়ের আশায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে বৃটিশরা। অ্যান্ড্রু ফিনটফ, কলিংউড ও হার্মিসনের তীব্র বোলিংয়ের মুখে ১৪৭ রানে ৮ উইকেট হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফিরে গেছেন ব্রায়ান লারা, রামনরেশ সারওয়ান, ক্রিস গেইল, শিবনারায়ণ চন্দরপল, ওয়াভেল হাইন্ডসের মত নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানরা। ক্রিজে তখন দুই আনাড়ী ব্যাটসম্যান উইকেটকিপার কোর্টনি ব্রাউন ও বোলার হিসেবে দলভুক্ত ইয়ান ব্রাডশ। ব্রাউন ও ব্রাডশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস যথাক্রমে ২৬ ও ১২। এ অবস্থায় জয়ের স্বপ্ন দেখতেই পারে মাইকেল ভনের নেতৃত্বে পরিবর্তিত ইংল্যান্ড। অপর্যাপ্ত আলোয় হার্মিসন-গফ-কলিংউডের বাউন্সারে ব্যাট করাটা যেখানে দুঃসহ হয়ে ওঠার কথা, সেখানে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান ব্রাডশ ও ব্রাউন জুটি। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তারা ফিনিক্স পাখি হয়ে রোমাঞ্চকর ও অবিস্মরণীয় ব্যাটিং নৈপুণ্য দেখিয়ে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের পুনরুত্থান গড়তে থাকেন। ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পাকিস্তানের সঙ্গে দুই টেইলএন্ডার ডেরিক মুরে ও অ্যান্ডি রবার্টস ৬৪ রানের পার্টনারশীপ গড়ে যেভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জয় এনে দেন, অনুরূপ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটান তাদের দুই উত্তরসূরি ব্রাডশ ও ব্রাউন। এই জুটি ৭১ রান করে দলকে পৌঁছে দেন জয়ের বন্দরে। নবম উইকেটে এটি ওয়েস্ট ইন্ডিজের নতুন রেকর্ড। ১৯৮৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ৬৩ রান করেছিলেন জোয়েল গারনার ও ম্যালকম মার্শাল। ব্রাডশ ৩৫ ও ব্রাউন ৩৪ রানে অপরাজিত থাকেন।
এই অভাবিত ও অবিশ্বাস্য সাফল্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটকেই শুধু নতুন পথ দেখাবে না, পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর জন্য এটা বিরাট এক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। দলের ক্রমাগত ব্যর্থতায় সর্বত্র যখন সমালোচনার সুর, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই জয় বাংলাদেশের জন্য টনিক হিসেবে কাজ করতে পারে। হতোদ্যম ও হতাশ না হয়ে বাংলাদেশকেও অনুরূপভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আমরা চাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের সোনালী দিনগুলো যেমন ফিরে আসুক, তেমনি বাংলাদেশও জয়ের সাফল্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক।
ক্রীড়াজগত : ১ অক্টোবর ২০০৪

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হকি অন্তঃপ্রাণ আলমগীর মোহাম্মদ আদেল/ দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

প্রতিরোধের সেই দুই ম্যাচ / দুলাল মাহমুদ

লাল মরিচের ঝাল / দুলাল মাহমুদ

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

‘কুড়ি বছর পরে...’

‘গুরুত্বহীন’ হয়ে যাওয়া সেই ম্যাচের কথা!

আমাদের ফুটবলাররা

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ