ক্রিকেট কি ম্লান করে দিচ্ছে আর সব খেলাকে?




একটা সময় বলতে গেলে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা স্টেডিয়াম চত্বর। দু’একটি খেলা ব্যতীত সে সময়কার প্রচলিত প্রায় প্রতিটি খেলার আসর বসতো ঐতিহাসিক পল্টন এলাকায়। আশির দশকের একদম গোড়াতে ঢাকা স্টেডিয়ামের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠার পর সকাল-সন্ধ্যা কেটে যেত খেলায় খেলায়। তবে খেলোয়াড় নয়, দর্শক হিসেবে। দিনভর কোনো না কোনো খেলা লেগেই থাকত। প্রতিটি খেলাই আয়োজিত হতো জমজমাটভাবে। তাতে থাকত প্রাণের স্ফূর্তি। কোনো জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজিত হলে মনে হতো, যেন কোনো উৎসব চলছে। আয়োজনে আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি থাকত না। উৎসাহী দর্শকের কোনো কমতি ছিল না। খেলোয়াড়, সংগঠক ও দর্শকদের সম্মিলনে পুরো পরিবেশ হয়ে উঠতো উৎসবমুখর। প্রতিটি খেলায় কম-বেশি তারকা খেলোয়াড় ছিল। সবাই তাঁদের চিনতেন এক নামে। সেই খেলোয়াড়দের সবাই আপন মনে করতেন। খেলোয়াড় হিসেবে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারাটা ছিল সে সময় অনেক বড় ব্যাপার। সেটা নিয়েই সবাই সন্তুষ্ট থাকতেন। 

তখন তো ফুটবলের ছিল তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। ফুটবলাররাই ছিলেন তখন সবচেয়ে বড় তারকা। তাঁদের নিয়ে ছিল তুমুল মাতামাতি। ফুটবল ও ফুটবলারদের নিয়ে সেই উচ্ছ্বাস, সেই উদ্দীপনা, সেই উত্তেজনার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। বড় দলের ম্যাচের একটি টিকিট পাওয়ার জন্য কী ভোগান্তি না পোহাতে হয়েছে! খেলাকে কেন্দ্র করে খিস্তি-খেউর, সংঘর্ষ, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও খেলা দেখা থেকে কেউ পিছপা হতেন না। বিশেষ করে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব আর আবাহনী ক্রীড়াচক্রকে সমর্থন দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে যেত পুরো দেশ। দু’দলের ম্যাচের দিন সাদা-কালো আর আকাশি-নীলের দোলায় দুলত প্রতিটি প্রান্তর। তার সমতুল্য এমন কিছু এখন আর দেখা যায় না। সেই মোহামেডান নেই। সেই আবাহনীও নেই। ফুটবলের প্রবল জনপ্রিয়তার স্র্রোতে কিন্তু অন্য খেলাগুলো ভেসে যায় নি। প্রতিটি খেলাই আলাদা অবস্থান গড়ে নিতে পেরেছিল। ক্রীড়াঙ্গনের সবার মধ্যে ছিল একটা আত্মিক বন্ধন। সহযোগিতার হাত যেন বাড়ানোই থাকত। তখন অবশ্য এত বেশি খেলা ছিল না।
এখন খেলা অনেক বেড়েছে। সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। যোগ হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। আর সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেট, ফেসবুকসহ ভার্চুয়াল জগত কেড়ে নিয়েছে যাবতীয় মনোযোগ। তারপরও বিস্ময়করভাবে সব খেলাকে ছাড়িয়ে গেছে ক্রিকেট। জনপ্রিয়তা, প্রাতিষ্ঠানিকতা ও আর্থিক নিশ্চয়তার কারণে ক্রিকেটের সঙ্গে অন্য খেলাগুলোর ব্যবধান গড়ে উঠেছে দুস্তর। তরুণ প্রজন্মের কাছে ক্রিকেটই হয়ে উঠেছে ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। ক্রিকেটার ছাড়া অন্য খেলাগুলোর তারকারা বলতে গেলে একদমই গুরুত্ব পান না। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- ক্রিকেটের জোয়ারে অন্য খেলাগুলো কি ম্লান হয়ে গেছে?

সে সময় খেলাধুলা ছিল নিছক বিনোদন। খেলোয়াড়রা খেলতেন প্রাণের আনন্দে। সংগঠকরা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে পছন্দ করতেন। দর্শকরা খেলার মাঠে খুঁজে পেতেন জীবনের উত্তাপ। কারোই বড় কোনো প্রত্যাশা ছিল না। কিন্তু দ্রুতই বদলে যেতে থাকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি। যে কারণে বদলে গেছে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার হিসাবও। জীবন ধারণের সংকট, আর্থিক টানাপড়েন আর বিপুল প্রত্যাশার চাপে ক্রীড়াঙ্গনেও অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে আসে নতুন এক চ্যালেঞ্জ। মূলত অর্থনৈতিক কারণেই ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক পালাবদল ঘটেছে।
ফুটবল ছাড়া অন্যান্য খেলাতে অতীতেও আর্থিক নিরাপত্তা ছিল না। এ খেলাগুলোয় আশানুরূপ পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যেত না। বিভিন্ন খেলায় সুপারস্টার হয়েও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায় নি। তারপরও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মনের আনন্দে খেলতেন। ভালো খেলতে পারলে অন্ততপক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুরুত্ব পাওয়া যেত। সামাজিকভাবে পাওয়া যেত মর্যাদা ও সম্মান। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়াড়দের ভর্তির কোটা ছিল। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বিমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের গুরুত্ব দেওয়া হতো। ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পেলেও অনেকেই চাইতেন খেলাধুলা করতে। কিন্তু ভর্তির কোটা, চাকরির পর্যাপ্ত সুবিধা, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য না থাকায় এ খেলাগুলোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যেতে থাকে। খেলাধুলা করে যদি স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা পাওয়া না যায়, তাহলে কেন ছুটে আসবেন খেলার মাঠে? 
ফুটবল খেলায় জনপ্রিয়তা, খ্যাতি ও আর্থিক সচ্ছলতা থাকলেও নানান কারণে সে ধারাটা ধরে রাখা যায় নি। টেলিভিশনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফুটবলের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠার কারণে দর্শকরা আধুনিক, গতিময় ও দৃষ্টিনন্দন ফুটবলের রস আস্বাদন করতে সক্ষম হন। এ কারণে ঘরোয়া ফুটবল তাঁদের অনেকের কাছে পানসে মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তারপরও নিজের দলের খেলা দেখা কিংবা সমর্থন করার ক্ষেত্রে ভেতরের একটা তাগিদ তো থাকেই। কিন্তু দূরদর্শিতা, ভুল সিদ্ধান্ত ও সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণে ফুটবল ক্রমশ তার ঔজ্জ্বল্য হারাতে থাকে। এটাও ঠিক, প্রত্যাশা কোথাও থেমে থাকে না। একটা সময় খেলাধুলা শুধু বিনোদন হিসেবে পরিগণিত হলেও পরবর্তীতে দর্শকের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। স্বাভাবিক নিয়মেই ক্রীড়ানুরাগীরা চেয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের সাফল্য। অথচ সাফল্য তেমনভাবে ছিল না বললেই চলে। ক্রমাগত ব্যর্থতা তো বটেই, বিভিন্ন কারণে দর্শককে এ ধরনের খেলাধুলার প্রতি বিমুখ করতে থাকে। তাছাড়া নতুন নতুন খেলার সংযোজন ঘটতে থাকায় ক্রীড়াঙ্গনে এক ধরনের ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ হয়। কিন্তু আনুপাতিক হারে ক্রীড়া বাজেট না বাড়ায় সীমিত অর্থ ভাগ হয়ে যায়। আর বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার জন্য যে ধরনের নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠক, সাংগঠনিক দক্ষতা ও ক্যারিশমা থাকার প্রয়োজন, সেটাও তো দুর্লভ হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে এক ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।   

এমন সময় বড় একটা ধাক্কা দেয় ক্রিকেট। আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন, বিশ্বকাপ খেলা, পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বপ্নের মতো উত্থান ঘটে। আর এই উত্থানটাকে পুঁজি করে সাংগঠনিক দক্ষতা, নিষ্ঠা ও মেধা দিয়ে এগিয়ে যায় ক্রিকেট। দর্শকরা বিনোদনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে নিজের দেশের সাফল্য দেখতে চান। জাতীয় পতাকা নিয়ে গর্বিত হতে চান। আর সে প্রত্যাশা পূরণের উপলক্ষ হয়ে আসে ক্রিকেট। ক্রিকেটের গণ্ডি যতই সীমিত হোক না কেন, আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে ক্রিকেটারদের শক্তি, লড়াই ও সাফল্য ক্রীড়ানুরাগীকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করে। উৎসাহিত করে। মাঠে না গিয়েও টিভির সৌজন্যে খেলাটি উপভোগও করা যায়। ক্রিকেটের সুবাদে টিভিতে দীর্ঘ সময় দেখতে পাওয়া যায় বাংলাদেশকে। একটি খেলা প্রতিনিয়ত চোখের সামনে দৃশ্যমান হতে থাকলে, আলোচনা-সমালোচনা হতে থাকলে এবং একই সঙ্গে তা যদি হয়ে ওঠে সামাজিক স্ট্যাটাসের অংশÑ তাহলে চেতন কিংবা অবচেতনে মনের মধ্যে খেলাটি প্রভাব ফেলবেই। সংগত কারণেই সেই খেলায় দর্শক থাকবে। সমর্থন থাকবে। অর্থও থাকবে। তা নিয়ে হাপিত্যেস করে কোনো লাভ নেই। সময়টা আসলেই এখন ক্রিকেটের। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

হকি অন্তঃপ্রাণ আলমগীর মোহাম্মদ আদেল/ দুলাল মাহমুদ

‘মৃত্যুগুহা’ থেকেই উজ্জীবনের গান / দুলাল মাহমুদ

অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব

কাছের মানুষ এখন অনেক দূরে

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

নূর আহমেদ : ছিলেন ব্যাডমিন্টনে, ছিলেন ফুটবলেও/ দুলাল মাহমুদ