যেন রূপকথার এক নায়ক / দুলাল মাহমুদ


এক.
শাওন মাসের কোনো এক সন্ধ্যা। সাল ১৯৮৫। ঢাকার পিলখানার বিডিআর সদর দফতরের সুইমিং পুল। চারপাশটা বেশ সাজানো-গোছানো। দীর্ঘ গাছের সারির পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে নেমে এসেছে গোধূলি। কৃত্রিম আলোয় কেমন একটা মায়াবী পরিবেশ। সেইসঙ্গে জলের ছন্দময় দোলা। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লড়াই করছেন সাঁতারুরা। সাফ গেমসকে সামনে রেখে চলছে তাঁদের প্রস্তুতি। আর সাঁতারুদের দীক্ষা দিচ্ছেন এমন একজন, যিনি আমাদের অনেকের কাছেই রীতিমতো রূপকথার নায়ক। স্কুলের পাঠ্য বইয়ে তাঁর কথা পড়েছি। শুনেছি তাঁর অবিশ্বাস্য কীর্তির কথা। সেই তরুণ বয়সে আমার কাছে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন পাঠ্য বইয়ের পাতা থেকে নেমে আসা অলৌকিক কোনো ব্যক্তিত্ব। তাঁর দ্যুতি আমাকে বিভোল করে দিচ্ছিল। এর আগে এই মাপের কোনো ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য তো দূরে থাক, দেখারও সুযোগ হয় নি। সেই আমি কিনা এসেছি এমন একজন ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিতে! এরচেয়ে বিস্ময়কর আর কী আছে? তাঁর চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা। পরনে হাওয়াই শার্ট আর ফুল প্যান্ট। ব্যাক ব্রাশিং করা চুল। রুচিশীল ও ব্যক্তিত্বময় সুপুরুষ। মুখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি। বয়স তখন ষাটের কাছাকাছি। কিংবদন্তিসম ব্যক্তি হয়েও তাঁর মধ্যে ছিল না কোনো অহমিকা। ছিল না কোনো হামবড়া ভাব। তিনি আমাকে এমনভাবে আপন করে নিলেন যেন আমি তাঁর কত কত দিনের চেনা। আমি একটা ঘোরের মধ্যে থাকলেও তাঁর আন্তরিক আপ্যায়নে স্বাভাবিক হতে বেশি সময় লাগে নি। ট্রেনিং সেশন শেষে সুইমিং পুলের একপাশে আলো-আঁধারিতে তিনি আমার কাছে ব্যক্ত করছিলেন তাঁর জীবনের রোমাঞ্চকর কাহিনী। জোনাকজ্বলা সন্ধ্যায় তাঁর বলা প্রায় ২৭ বছর আগের সেই কাহিনী আমাকে অভিভূত করে রেখেছিল। ক্ষণে ক্ষণে স্পন্দিত হচ্ছিলাম। ক্ষণে ক্ষণে শিহরিত হচ্ছিলাম।
ফিরে এসে সীমিত পরিসরে তাঁর বয়ানে অনুলিখনের মতো করে লিখেছিলাম বিস্ময়কর সেই কীর্তি, ‘অনেকের ধারণা-চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাস মারা গেছে। ভাবাটা অস্বাভাবিক নয়। আমি যে এককালে সাঁতারু ছিলাম, সে বোধও ক্রমশ মন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এমনি সময় চ্যানেল বিজয় সম্পর্কে বলা অনেকটা দুরুহ ব্যাপার। তাছাড়া স্মৃতির পাতা উল্টাতে গেলেই মনটাও বিষণ্ন হয়ে যায়। চ্যানেল বিজয়ের কথা বলতে গেলে পূর্বেকার অনেক কিছু বলতে হয়। কেননা নেপথ্যের এই ঘটনাগুলো আমাকে চ্যানেল অতিক্রম করার প্রেরণা যুগিয়েছে। অবশ্য মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হলো না। এখন জীবনের শেষ দিকে এগিয়ে চলেছি। ফলে পুরানো কথা বলতে গেলে অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলি। ১৯৫৫ সাল। পাকিস্তান অলিম্পিক। তাতে সাঁতারও অন্তর্ভূক্ত হয়। আমি ১০০ ও ৪০০ মিটার ইভেন্টে অংশ নেই। দুটোতেই প্রথম স্থান অধিকার করি। অবশ্য ইতিপূর্বে সাঁতারে আমার সুনাম সুখ্যাতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পুরো পাকিস্তানে সাঁতারে আমি ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’। পরের বছর (১৯৫৬) অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অলিম্পিকের আসর। সমগ্র পাকিস্তান থেকে বিভিন্ন খেলাধুলায় দল গঠন করা হলো। বিশেষ করে, পাকিস্তান অলিম্পিকে যারা চমৎকার পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, তাদেরকেই বিশ্ব অলিম্পিকে সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্বভাবতই আমার নিশ্চিত ধারণা, সাঁতার দলে আমি থাকবোই। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, আমাকে দলভুক্ত করা হলো না। পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের সাঁতারুদের নেয়া হলো। এতে আমার মন ভেঙে গেল। তথাপি কিছু করার বা বলার নেই। তবে আমার মনে দারুণ জেদ চাপলো। কিছু একটা করার প্রবল ইচ্ছে হলো। সাঁতারে চমকপ্রদ এমন কিছু করতে হবে যাতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের টনক নড়ে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা তো করলাম। কিন্তু কি করি! দিন কেটে রাত হয়। রাত কেটে দিন।
একদিন রোজকার মতো খবরের কাগজ পড়ছিলাম। কলকাতার কোন এক পত্রিকা। পড়তে পড়তে হঠাৎ এক জায়গার চোখ আটকে গেল। খবরটুকু বারংবার পড়লাম। কেননা কোনো এক সাঁতারু চারবার প্রচেষ্টা চালিয়েও চ্যানেল অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ তাকে নিয়ে ঢালাওভাবে লেখা হয়েছে। আমার মনে এই ঘটনাটি দারুণভাবে দাগ কাটে। তাছাড়া চ্যানেলের কথা আগে কখনো শুনিনি। ভাবলাম, চ্যানেল অতিক্রম করতে পারলে বোধহয় কিছু একটা করা যাবে। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আমাকে চ্যানেল অতিক্রম করতেই হবে। অথচ তখনও চ্যানেল সম্পর্কে কিছুই জানি না। ফলে চ্যানেল সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে লাগলাম। চারবার চ্যানেল বিজয়ে যিনি ব্যর্থ হয়েছেন, তার অনুসন্ধান পেয়ে গেলাম। তিনি ভারতের লোক। তখন তৎকালীন ‘দৈনিক আজাদের’ সাংবাদিক লাড়ু ভাই (স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত) ও আমি ভারত গেলাম। সেখানে গিয়ে চ্যানেল সম্পর্কে বেশ ধারণা পেলাম। ফলে আমি চ্যানেল অতিক্রমের দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমি তখন তদানিন্তন ক্রীড়াঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তি এস এ মহসিন (সাজু) ভাইয়ের স্মরণাপন্ন হলাম। তাকে আমার মনোবাসনার কথা খোলাখুলি বললাম। সাজু ভাই আমার কথায় থ্ হয়ে যান। বললেন তুই ভালো করে ভেবে দেখ। পারবি কি-না ! উনি চ্যানেল অতিক্রমের ভয়াবহতা বুঝালেন। কিন্তু আমি সিদ্ধান্তে অনঢ়। তারপর তিনি আমাকে যথেষ্ট ভাববার জন্য কয়েকদিন সময় দিলেন। আমি অনেক ভেবে-চিন্তে চ্যানেল অতিক্রমের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। কেননা আমাকে কিছু একটা করে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চমকে দিতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা প্রতিটি ক্ষেত্রে ছলে-বলে কৌশলে বাঙ্গালীদের পিছিয়ে রাখছে। এর মাঝেও আমাদের জাগতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের বুঝাতে হবে-বাঙ্গালীদেরও প্রতিভা আছে।
এতদ্ব্যতীত আমার অবশ্য দূরপাল্লার সাঁতার কাটার অভ্যাস রয়েছে। তৎকালীন ঢাকা-চাঁদপুর দূরপাল্লার সাঁতারে অংশ নিয়েছি। তাই সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে সাজু ভাইকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা জানালাম। উনি সব কিছু শুনে রাজী হলেন। তারপর আমাকে চ্যানেল অতিক্রমের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিতে উঠে-পড়ে লাগলেন। সেই সাথে সাংবাদিক বন্ধুরাও আমার জন্য যথেষ্ট দৌড়াদৌড়ি করলেন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমার চ্যানেল অতিক্রমের ব্যবস্থা হয়। বিশেষ করে, মহসীন ভাই, লাড়ু ভাই ও এ বি এম মুসার কাছে আমি চিরঋণী।
১৯৫৮ সালের ৮ই আগস্ট (প্রকৃতপক্ষে ২৩ আগস্ট-দু.মা.)। রাত পৌনে দুটো। এখনো শিহরণমূলক সে দিনের কথা মনের পর্দায় জ্বলজ্বল করে। গভীর অন্ধকার। সামান্য দূরের জিনিসও দেখা যায় না। কুয়াশার আবরণে ঢাকা। কনকনে ঠাণ্ডা পানি। তারপরে ঢেউয়ের পর ঢেউ। কেমন জানি রহস্যময়তা। এরই মাঝে সাঁতার শুরু হলো। ছেলে-মেয়ে সমেত বেশ ক’জন। ২১ মাইল দীর্ঘ পথ সামনে। তবে জোয়ার-ভাটার কারণে ৩৫ মাইল পাড়ি দিতে হবে। বিধাতাকে স্মরণ করে সাঁতরাতে লাগলাম। আমার সাথে সাথে বোটে করে চ্যানেল কমিটির পর্যবেক্ষণ দল। আগে চ্যানেলের শুধু নামই শুনেছি। এখন সাঁতরাতে গিয়ে অনুভব করতে লাগলাম, চ্যানেল কি জিনিস। হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। তাতে অবশ্য দমে গেলাম না। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। যেন, বিশ্বজয় করতে চলেছি। তবে ভাগ্যও আমার অনুকূলে ছিল। নতুবা চ্যানেল অতিক্রম করতে পারতাম কি-না সন্দেহ। কেননা ঐ দিনের আবহাওয়া ছিল বেশ শান্ত। সাধারণত চ্যানেলের আবহাওয়া থাকে উন্মত্ত। উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে পড়লে বাঁচা দুঃসাধ্য ব্যাপার। অবশ্য চ্যানেলের শীতল রূপও কম না। দেখলে পিলে চমকে যায়। যা হোক কপাল জোরে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকি। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা সংগ্রাম করে অবশেষে চ্যানেল অতিক্রম করি। সময় লাগে ১৩ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট (প্রকৃতপক্ষে ১৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিট-দু.মা.)। তখন কি যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস বলে বুঝানো যাবে না। একজন বাঙালী হিসেবে আমার বুক গর্বে ফুলে যায়। কারণ আমিই প্রথম বাঙালী হিসেবে চ্যানেল অতিক্রম করেছি।
আমি আমার বিশ্বাসকে এবং নিষ্ঠাকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি, এই আমার আনন্দ,এই আমার সার্থকতা। একজন বাঙালী সাঁতারুর পক্ষে আমার এই প্রাপ্তিকে আমি কখনোই সাধারণ বলে মনে করি না। দেশ ও জাতি যদি এই থেকে সামান্যতম উপকৃত হয়, তবেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।' আমার কথা/ব্রজেন দাস/ আগস্ট ১৯৮৫/ ক্রীড়া পত্রিকা ‘হারজিত’। এ লেখাটি এখন পড়তে গিয়ে বুঝতে পারলাম, ৬ বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার কারণে কিছু কিছু বিষয় তিনি একটার সঙ্গে আরেকটি মিলিয়ে ফেলেছিলেন। এ কারণে তথ্যগত কিছু অসঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায়। তবে তাঁর স্পন্দনটুকু অনুভব করতে অসুবিধা হয় না।

দুই.
ছোটবেলা থেকেই ব্রজেন দাসের সাঁতার ছিল প্যাশন ও ভালোবাসা। বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জ জেলার কুচিয়ামোড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। ১৯২৭ সালের ৯ ডিসেম্বর। সে সময় ‘লাড্ডু’ নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। দুরন্তপনায় সবাইকে অস্থির করে রাখতেন। খুব অল্প বয়স থেকে সাঁতার ভালোবাসতেন। বাড়ির সামনে নদী। প্রতিদিন সাঁতার কাটতেন। এলোমেলোভাবে। শ্রীনগরে নানা বাড়ির ধলেশ্বরী নদীতে তাঁর সাঁতারে হাতেখড়ি হয়।  তবে তাঁর বেড়ে ওঠা পুরনো ঢাকার ফরাশগঞ্জে। বাসার কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদীতে মনের আনন্দে সাঁতার কেটেছেন। তখনকার উথাল-পাতাল নদীতে সাঁতার কাটলেও একটুও ভয়-ডর ছিল না। ভরা বুড়িগঙ্গার উত্তাল জলরাশিতে সাঁতার কাটতে কাটতে চলে যেতেন ওপারে। তাঁর এই দুঃসাহসিক সাঁতার দেখার জন্য ভিড় জমে যেত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন বুড়িগঙ্গায়। প্রবল স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে গড়ে তুলেছেন নিজেকে। ১৯৪৪ সালে গ্রামের বাড়ির এক বিশাল পুকুরে অবিভক্ত ভারতের বিখ্যাত সাঁতারু প্রফুল্ল ঘোষের সঙ্গে প্রদর্শনী সাঁতারে অংশ নিয়ে নিজের সক্ষমতা অনুভব করতে পারেন তিনি। তখনই তাঁর বুকে সাঁতারু হওয়ার বীজ বপিত হয়।
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কে এল জুবিলি হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। স্কুল ফাঁকি দিয়ে সাঁতার কাটতেন। কোনো শাসনই মানতে চাইতেন না। প্রতি বছর ইন্টার স্কুল সাঁতার হতো। সেটা পুকুরে। তাতে তিনি তাঁর ইভেন্টে প্রথম হতেন। ম্যাট্টিক পাস করার পর ইন্টারমিডিয়েট ও বি.এ-এর পাঠ নেন কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে। এ সময়ই সাঁতারু হিসেবে নিজের অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কলকাতায় পড়ালেখা করার সময় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সাফল্য দেখান। ১৯৫২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতারে তিনি প্রথম হন। আর এই অভিজ্ঞতাকে সঞ্চয় করে পূর্ব পাকিস্তানে যে কোনো সাঁতার প্রতিযোগিতায় তিনি হয়ে ওঠেন অদ্বিতীয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে সাঁতারের প্রতিযোগিতা অথবা সাঁতার প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। গ্রামে-গঞ্জে কিছু জায়গায় সাঁতার প্রতিযোগিতায় হতো পুকুরে বা নদীতে। ঢাকার জগন্নাথ কলেজের উদ্যোগে প্রতি বছর বুড়িগঙ্গা নদীতে সাঁতার প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। সীমাবদ্ধ ছিল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে। এই বৃত্ত ভাঙার উদ্যোগ নেন তিনি। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে প্রাদেশিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় আয়োজন করাতে সক্ষম হন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা ফজলুল হক হলের পুকুরে ৫০ মিটার দূরত্বের কাঠের প্লাটফরমে প্রথমবার প্রাদেশিক সাঁতার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এই সীমিত সুযোগ আর সীমিত পরিসরেই নিজেকে মেলে ধরেন ব্রজেন দাস।
বলতে গেলে ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইল, ১৫০০ মিটার ফ্রিস্টাইল ও ডাইভিং স্প্রিং বোর্ড ইভেন্টে ব্রজেন দাসের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। অসংখ্যবার নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙেছেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের করাচিতে দুই দিনব্যাপী আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় সাঁতারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ১০০, ৪০০ ও ১৫০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সহ চারটি ইভেন্টে তিনি নতুন রেকর্ড গড়েন। তাঁর চমৎকার নৈপুণ্যেএই চ্যাম্পিয়নশিপে ৬৯ পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৫৭ সালের ১৬ আগস্ট ঢাকা স্টেডিয়ামে ১৫ ঘণ্টা ২৮ মিনিটে ২৬ মাইল সাঁতার কেটে আরেকটি রেকর্ড গড়েন। তাঁর সাঁতার কাটার স্টাইল সবার মন জয় করে নেয়। ১৯৫৭ সালের ১ অক্টোবর মর্নিং নিউজ পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়, His style has a peculiarity in it. He makes the body float and works up the speed by rolling the body. This style has some advantages. The wave thus created gives a streamish trend to water and the obstruction is less.


তিন.
১৯৫৫ সালে সমগ্র পাকিস্তানের সাঁতার প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন ব্রজেন দাস। তাঁর সমকক্ষ কোনো সাঁতারু ছিলেন না। সে কারণে ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে আয়োজিত অলিম্পিক গেমসে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই তাঁকে দলভুক্ত করা হয় নি। সাঁতারে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো ঐতিহ্য ও অবস্থান ছিল না। অথচ তাঁদের সাঁতারুদের নিয়ে গড়া হয় অলিম্পিক সাঁতার দল। এ থেকে তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্যের বিষয়টি অনুধাবন করা যায়। তিনি এই বঞ্চনা ও ক্ষোভের মোক্ষম জবাব দেওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। ঘটনাচক্রে সে সময় কলকাতার ইংরেজি দৈনিক ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় মিহির সেনের চারবার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার ব্যর্থতার কথা ফলাও করে প্রকাশিত হয়। এটা তাঁর হৃদয়ে দারুণভাবে দাগ কাটে। তাঁর মনে হয়, ব্যর্থ হওয়ার পরও যদি এতটা প্রচার পাওয়া যায়, তাহলে সফল হলে কী হবে? তখন তিনি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হন। ইংলিশ চ্যানেল সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। তিনি কলকাতায় গিয়ে মিহির সেনের সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে পুরোপুরিভাবে ওয়াকিবহাল হন। এরপর তাঁর মিশন হয়ে দাঁড়ায় ইংলিশ চ্যানেল। শয়নে-স্বপনে-জাগরণে এটি স্থান করে নেয়। এজন্য তিনি পুকুর, নদী, সুইমিং পুলে কঠোর অনুশীলন চালিয়ে যেতে থাকেন। দূরপাল্লার সাঁতারে সহ্য শক্তির পরীক্ষা দিতে ১৯৫৭ সালের নভেম্বরে ঢাকার সুইমিং পুলে একটানা ৫০ ঘণ্টা সাঁতার কাটেন। কিন্তু এ পরীক্ষাটিও তাঁর কাছে যথাযথ মনে হয় নি। তাঁর মনে হয়, উত্তাল ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে হলে তাঁকে আরো কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। তারই অংশ হিসেবে ১৯৫৮ সালের ২৭ মার্চ তিনি নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা থেকে ধলেশ্বরী, পদ্মা ও মেঘনা নদী হয়ে চাঁদপুর পর্যন্ত ৪৫ মাইল সাঁতারে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আদতে সে সময়কার প্রেক্ষাপটে এটা ছিল প্রায় অসম্ভব ও দুঃসাহসিক এক প্রচেষ্টা। আসলে তখন বড় কিছু একটা করার জন্য তিনি মরীয়া হয়ে ওঠেছিলেন। যে কোনো ভাবেই হোক, নিজেকে প্রমাণ করতে চাচ্ছিলেন। এ কারণে অসম্ভবকে সম্ভব করার সংকল্প নিয়ে তিনি পাড়ি দেন প্রমত্ত নদী। জলযানে তাঁকে অনুসরণ করেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান সহ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরা। সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে ১৩ ঘণ্টায় ৪২ মাইল অতিক্রম করার পর যখন গন্তব্যের কাছাকাছি দূরত্বে চলে আসেন, ঠিক তখন কালবৈশাখীর তা-বে তাঁকে বাধ্য হয়ে ওঠে আসতে হয়। তবে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এটা তিনি প্রমাণ করতে পেরেছিলেন, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার মতো আত্মবিশ্বাস, নিষ্ঠা ও মনোবল তাঁর পুরোমাত্রায় আছে। এ কারণে তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে সভাপতি ও পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এস এ মোহসিনকে সম্পাদক করে গড়ে তোলা হয় ‘চ্যানেল ক্রসিং কমিটি’। এ ক্ষেত্রে অনেকেই বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। এই কমিটির উদ্যোগে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার জন্য ১৯৫৮ সালের ১৯ মে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। ম্যানেজার ছিলেন তাঁর প্রিয়জন এস এ মোহসিন। ৩০ মে তাঁরা লন্ডন পৌঁছান। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার আগে নিজেকে আরো ভালোভাবে যাচাই করা জন্য ‘নেপলস টু ক্যাপ্রি আইল্যান্ড’ দূরপাল্লার সাঁতারে অংশ নেন ব্রজেন দাস। ১৯৫৮ সালের ২৭ জুলাই ইতালির এই আকর্ষণীয় প্রতিযোগিতায় ৩৩ কিলোমিটার (১৯ দশমিক ৩ মাইল) সাঁতারে অংশ নিয়ে একাদশ হন। তিনি সময় নেন ১৩ ঘণ্টা ১৮ মিনিট ১৫ সেকেন্ড। এটি ছিল এ প্রতিযোগিতার পঞ্চম আসর। এরপর বহু কাঙ্খিত ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন।  
১৯৫৮ সালের ২৩ আগস্ট ব্রজেন দাস ফ্রান্স উপকূল থেকে শুরু করে ১৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিট সাঁতারের পর বেলা চারটা ২ মিনিটে ইংল্যান্ডের ডোভার বন্দরের পূর্ব প্রান্তের ভূমি স্পর্শ করেন। প্রথম হন ড্যানিশ বংশোদ্ভূত যুক্তরাস্ট্রের মহিলা সাঁতারু গ্রীটা অ্যান্ডারসন। এটি ছিল তাঁর ইংলিশ চ্যানেলে দ্বিতীয় সাফল্য। ১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিকে ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে স্বর্ণ জয় করেন এই ভদ্রমহিলা। উপকূলের কাছে ব্রজেন দাস আকস্মিকভাবে এক তীব্র স্রোতের সম্মুখীন হলে গ্রীটা তাঁর চেয়ে প্রায় চার ঘণ্টা আগে ভূমি স্পর্শ করেন। ডোভার বন্দরের নিকটবর্তী হয়ে ব্রজেন দাস যখন ভূমি স্পর্শ করার উপযুক্ত একটি স্থানের সন্ধানে উত্তাল তরঙ্গের দোলায় একবার ভাসছেন, একবার নিমজ্জিত হচ্ছেন, তখন হাজার হাজার নারী-পুরুষ তাঁকে দেখার জন্য ভিড় জমান। তিনি যখন ডোভার বন্দরের মাত্র তিন মাইল দূরে, তখন আকস্মিকভাবে এক উত্তাল জোয়ার ও উদ্দাম স্রোতের সম্মুখীন হন। এই তিন মাইল অতিক্রম করতে তাঁর দীর্ঘ তিন ঘণ্টা প্রচ- সংগ্রাম করতে হয়। ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে পুরুষদের মধ্যে প্রথম এবং সকল প্রতিযোগীদের মধ্যে দ্বিতীয় হন। পুরুষদের মধ্যে প্রথম হওয়ায় তিনি পাঁচ শত ষ্টার্লিং পুরস্কার পান। প্রথম এশিয়ান হিসেবে তিনি ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার কৃতিত্ব দেখান। সবচেয়ে বড় কথা, সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি ছিল অনেক বড় অর্জন। যে কারণে ইংল্যান্ড ও পুরো উপমহাদেশে দারুণ তোলপাড় হয়। এর রেশ কাটতে না কাটতেই তিনি কিছু দিন পর আবারও ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করতে চাইলেও ‘চ্যানেল ক্রসিং কমিটি’র অনুমোদন না পাওয়ায় সেটি সম্ভব হয় নি।
২৫ আগস্ট আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পুনর্বহালকৃত পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পরেই ইংলিশ চ্যানেল সাঁতার প্রতিযোগিতায় ব্রজেন দাসের সাফল্যের জন্য সকল সরকারি অফিস ও শিক্ষায়তনসমূহ অর্ধ-দিবস ছুটি ঘোষণা করা হয়।
মজার ব্যাপার হলো, যে পশ্চিম পাকিস্তানের অবহেলা ও বঞ্চনার জবাব দেওয়ার জন্য ব্রজেন দাস ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন, তা সাফল্যজনকভাবে অতিক্রম করার পর তাঁর এই কৃতিত্বকে নিজেদের বলে জাহির করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। পাকিস্তানের ইতিহাসে সাঁতারের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে এখনও এটিকে বিবেচনা করা হয়। তাঁদের ক্রীড়া ইতিহাসে স্মরণ করা হয় তাঁকে। পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত Pakistan Sports গ্রন্থে (তৃতীয় সংস্করণ ১৯৯৯) মুখতার ভাট্টি লিখেছেন, But at the International level, barring Brojen Das, there is nothing one could write about Pakistan swimming. Our swimmers in the past have achieved nothing and they do not seem to be capable of doing anything of note in future.
১৯৫৮ সালের ৩ অক্টোবর করাচি পৌঁছালে বিমানবন্দরে রাজকীয় সংবর্ধনা জানানো হয় ব্রজেন দাসকে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জহিরুদ্দীন, অর্থ দফতরের স্টেট মন্ত্রী এ কে দাস, করাচির চিফ কমিশনার এন এম খান, পাকিস্তান সরকারের ক্রীড়া বিভাগীয় উপদেষ্টা ও পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম অধিনায়ক আবদুল হাফিজ কারদার। ৫ অক্টোবর করাচির ফ্রেয়ার হল গার্ডেনে তাঁকে নাগারিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। করাচির চিফ কমিশনার এ অনুষ্ঠানে বলেন, ব্রজেন দাসের সাফল্য সাঁতার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সংযোজন করেছে। চ্যানেল অতিক্রমে ব্রজেন দাস যে দৃঢ় সংকল্প ও কঠোর সাধনার পরিচয় দিয়েছেন, তা পাকিস্তানি তরুণদের মনে আশা ও উদ্দীপনার সঞ্চার হবে এবং তাঁরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে তৎপর হবেন। করাচির চলচ্চিত্র প্রদর্শনী সমিতির পক্ষ থেকে ব্রজেন দাসকে চার হাজার টাকার তোড়া উপহার দেওয়া হয়।
১২ অক্টোবর ইংলিশ চ্যানেল জয়ী ব্রজেন দাসকে ঢাকা বিমানবন্দরে বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিমান থেকে অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস ও অসংখ্য পুষ্পমাল্য দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। বিমানবন্দর থেকে শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকা স্টেডিয়ামস্থ ইংলিশ চ্যানেল ক্রসিং কমিটির অফিসে আনা হয়। এ সময় রাস্তার দু’পাশে হাজার হাজার মানুষ তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। তাঁর সম্মানে স্টেডিয়ামে একটি সুন্দর গেট নির্মাণ করা হয়। ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় ইংলিশ চ্যানেল ক্রসিং কমিটির পক্ষ থেকে ব্রজেন দাসকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রাদেশিক গভর্নর জাকির হোসেন, চীফ মার্শাল ল অ্যাডমিনেস্ট্রর মেজর জেনারেল ওমরাও খান, ইংলিশ চ্যানেল ক্রসিং কমিটির সভাপতি আতাউর রহমান খান, প্রাক্তন চিফ সেক্রেটারি হামিদ আলী, ব্রজেন দাসের ম্যানেজার মোহসিন আলী, কোচ মোহাম্মদ আলী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

চার.
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার পর ব্রজেন দাস যেন এর প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকেন। যে কারণে বার বার ছুটে গেছেন এর মায়াবী টানে। নিজেকে সঁপে দিয়েছেন তার অতল বুকে। কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাঁকে আটকে রাখতে পারে নি। ১৯৫৯ সালে পুনরায় ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি দেন তিনি। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ২৬ জুলাই দ্বিতীয়বার ক্যাপ্রি-নেপলস সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন। সাঁতার কাটার আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাঁর প্রেসার ২০ ডিগ্রি বেশি। চিকিৎসক তাঁকে সাঁতারে অংশ নিতে বারণ করেন। কিন্তু তিনি জানান, এটা হতে পারে না। মৃত্যু ছাড়া তাঁকে কেউ থামাতে পারবে না। তাঁর ডান পায়ে ক্র্যাম্প হওয়ার পরও ১২ ঘণ্টা ৬ মিনিট ৫০ সেকেন্ড সময় নিয়ে সাঁতার শেষ করেন। দূরপাল্লার সাঁতার তাঁকে এমনভাবে হিপ্টোনাইজ করে ফেলে যে কোনোভাবেই তাঁকে দমিয়ে রাখা যায় নি। জীবনের পরোয়া না করেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ইংলিশ চ্যানেলে। এই চ্যানেলও তাঁকে কখনো খালি হাতে ফিরিয়ে দেয় নি।  
১৯৫৯ সালের ২৭ আগস্ট দ্বিতীয়বার ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন ব্রজেন দাস। সেবার প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তাঁকে বেশ হিমসিম খেতে হয়। সে সময় এই চ্যানেল অতিক্রম করা ছিল খুবই কঠিন। অসম্ভব সাহস নিয়ে তিনি চ্যানেল অতিক্রম করেন। শুরুটা ভালোভাবে করা যায় নি। ইংলিশ চ্যানেল ছিল অশান্ত, শক্তিশালী, এলোমেলো ও ভয়ঙ্কর। উত্তাল এই নদীতে সাঁতার কাটা ছিল খুবই কঠিন। যে কারণে পাকিস্তানের অপর প্রতিযোগী শওকাতুল ইসলাম সাঁতার শুরুই করতে পারেন নি। ডোভার ও ফরাসি উপকূলের মধ্যে বয়ে যাওয়া উত্তাল ঢেউয়ের কারণে তাঁর বোট ফ্রান্সের ক্যাপ ক্রিজ নেজ-এ ভিড়তে পারে নি। কয়েকটি এসকোর্ট বোট ডুবে যায়। কিছু বোট জায়গামতো পৌঁছতে পারে নি। ভীষণ ঝড়ো হাওয়া বইছিল। হাওয়ার বিপরীতে সাঁতার কাটতে হয়। কোনো ভয়-ভীতি তাঁকে রুখতে পারে নি। বিক্ষুব্ধ চ্যানেলে সাঁতার কেটেও তিনি সময় নেন ১৩ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট। ৫ম হন। ২৮ আগষ্ট ‘এক্সসেপশন্যালি ওয়ান্ডারফুল পারফরম্যান্স’-এর জন্য ব্রজেন দাসকে ৫০ পাউন্ড বিশেষ পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেন চ্যানেল সুইমিং প্রতিযোগিতার সংগঠক বিলি বুটলিন।
২ সেপ্টেম্বর চ্যানেল সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের অনারারি সেক্রেটারি জে ইউ উড ব্রজেন দাসের চ্যানেল অতিক্রমের বিষয়ে একটি বিবৃতি দেন। বুটলিন চ্যানেল সুইমিং প্রতিযোগিতায় ব্রজেন দাসের সাঁতার কাটার সময় তিনি অফিসিয়াল অবজারভারের দায়িত্ব পালন করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ব্রজেন দাস একজন সাহসী সাঁতারু এবং তিনি অত্যন্ত প্রশংসনীয় ও মুগ্ধকর পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন। সময় নেন ১৩ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট। আবহাওয়া খুবই খারাপ ছিল। এ কারণে ডুবে যায় অসংখ্য ছোট ছোট ডিঙ্গি। মাঝিরা পানিতে নাকানিচুবানি খায়। শক্তিশালী জলোচ্ছ্বাস ছিল। বাতাসের বেগ ছিল ঘণ্টায় ২২ মাইল। শুরু থেকে তিনি এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তাঁর গগলস ছিদ্র হয়ে যায়। গগলস ঠিক করতে দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। এরপরও পঞ্চম হওয়াটা প্রশংসনীয় পারফরম্যান্স। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর সামর্থ প্রমাণ করেছেন।’
১৯৫৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তৃতীয়বার ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন ব্রজেন দাস। এবার পাড়ি দেন ইংল্যান্ডের কেন্ট কাউন্টির ডোভার থেকে ফ্রান্সের ক্যালাইস পর্যন্ত ৩৩ দশমিক ১ কিলোমিটার। এই একবারই তিনি ইংল্যান্ড থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন। এক মাসের মধ্যে এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয়বার ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম। অভিজ্ঞতাও ভিন্ন। তারপরও সময় নেন ১৩ ঘণ্টা ২৬ মিনিট। ডোভারের কাছাকাছি শেক্সপিয়র ক্লিফ থেকে সোয়া চারটায় সাঁতার শুরু করেন। নির্ধারিত সময়ে ফ্রান্স উপকূলে ক্যাপ ক্রিস নেজ স্পর্শ করেন। প্রথম প্রতিযোগী হিসেবে একই মাসে দুইবার ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম (উভয় দিক দিয়ে) করে দেশে ফেরেন তিনি।

ইংল্যান্ড সফরে ব্রজেন দাসের সঙ্গে একজন মহিলা সাঁতারুর সম্পর্ক নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। এ নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। দেশে ফেরার পর একজন সাংবাদিক ইংল্যান্ডে সাঁতারু আরতি সাহার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে জানতে চাইলে তাঁর মুখম-ল রক্তিম হয়ে যায়। তাঁর ম্যানেজার কাজী আব্দুর রকিব তাড়াতাড়ি গুজব অস্বীকার করে বলেন, ‘ব্রজেন দাস প্রকৃতপক্ষে বাস মিস করেছেন। আরতি সাহা জনৈক ভারতীয়’র বাগদত্তা’। ১৯৫৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেন কলকাতার ১৯ বছরের তরুণী আরতি সাহা। সময় নেন ১৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট। তাঁকে উৎসাহিত ও সব ধরনের সহযোগিতা করেন ব্রজেন দাস। এ কারণে এ গুজব রটেছিল।

ব্রজেন দাস যখনই ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার অভিযান শুরু করতেন, তার আগে নিজেকে পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত করে নিতেন। এরই অংশ হিসেবে ১৯৬০ সালের ২৫ জুন ঢাকা স্টেডিয়ামে ২০ ঘণ্টার সাঁতার প্রতিযোগিতায় ব্রজেন দাস ৩৩ মাইল ১৬৫০ গজ সাঁতার কাটেন। আগের দিন রাত সোয়া ৮টায় শুরু হয় এবং পরের দিন বিকেল সোয়া ৪টায় শেষ হয়। আবারও ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করার অংশ হিসেবে এটি ছিল তাঁর শারীরিক ফিটনেস পরীক্ষা। ১৯৬০ সালের ২৭ আগস্ট চতুর্থবার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন তিনি। ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ড পাড়ি দিয়ে সময় নেন ১৪ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট। তার আগে কেউ চারবার ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করতে পারেন নি। ১৯৬১ সালে ১৪ দিনের মধ্যে কৃতিত্বের সাথে দুইবার পাড়ি দিয়ে ইংলিশ চ্যানেল ক্রসিং-এর ইতিহাসে নতুন এক রেকর্ড গড়েন। ১৯৬১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পঞ্চমবার পাড়ি দিয়ে সময় নেন ১১ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট। ২১ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠবার পাড়ি দিয়ে সময় নেন ১০ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট। এটি ছিল তাঁর শেষ অভিযান। এবার নিজেকেই শুধু ছাড়িয়ে যান নি, ১৯৫০ সালের ২২ আগস্ট মিশরের হাসান আবদেল রেহিমের গড়া ১০ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের রেকর্ড তিনি ভেঙে দেন। এরফলে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। ইংলিশ চ্যানেল দুইভাবে অতিক্রম করা যায়। ইংল্যান্ডের ডোভার থেকে ফ্রান্স উপকূল কিংবা ফ্রান্স উপকূল থেকে ইংল্যান্ডের ডোভার। ব্রজেন দাস পাঁচ বার ফ্রান্স উপকূল থেকে এবং ইংল্যান্ডের ডোভার থেকে একবার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেন। সে সময় ৬ বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বিশ্ব রেকর্ডও গড়েন তিনি। একই সঙ্গে তাঁর নাম ওঠে ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ। এ কারণে এক অনুষ্ঠানে ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাঁকে বলেন, ‘আপনি তো ইংলিশ চ্যানেলকে আপনার বাথটাবে পরিণত করেছেন।’ ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে যাঁরা অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন, তাঁদেরকে ‘কিং অব দ্য চ্যানেল’ ঘোষণা করে চ্যানেল সুইমিং অ্যাসোসিয়েশন। ব্রজেন দাসও ‘দ্য কিং‘ হওয়ার গৌরব অর্জন করায় ১৯৮৬ সালে তাঁর হাতে এই ট্রফি তুলে দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত মাত্র ১২ জন এমন কৃতিত্ব দেখান। তদানীন্তন সমগ্র পাকিস্তানে ব্যক্তিগত ক্রীড়ায় তারকা খেলোয়াড় ছিল না বললেই চলে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে তা ছিল একদমই দুর্লভ। ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ব্রজেন দাস হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। বাঙালিদের অহংকার ও গর্ব। তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন বাঙালিরাও দুঃসাহসিক অভিযানে মোটেও পিছিয়ে নেই। জেনে রেখে ভালো, পশ্চিম পাকিস্তান তথা আজকের পাকিস্তানের কেউ আজ পর্যন্ত ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে পারেন নি।  
ব্রজেন দাস ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ হন। ১৯৫৮ সালে ইংল্যান্ডের চ্যানেল সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের লাইফ মেম্বার, ১৯৫৯ সালে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল লাইফ সেভিং সোসাইটির অনারারি লাইফ মেম্বার হন। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আমন্ত্রণে চার মাসের সফরে সেখানে যান। সে বছর যুক্তরাস্ট্রের আটলান্টার ওয়ার্ল্ড লং ডিসট্যান্স সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি। ১৯৭৬ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার এবং ১৯৯৯ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পান। ১৯৬৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেন কলকাতার মেয়ে ছন্দা বোসকে। এক কন্যা সংগীতা পাল ও এক পুত্র সমজিত দাসের জনক ছিলেন। ১৯৯৮ সালের ১ জুন তিনি কলকাতায় পরলোকগমন করেন। ঢাকার পোস্তগোলায় তাঁকে দাহ করা হয়।

পাঁচ.
সাঁতারের কিংবদন্তি ব্রজেন দাসের সঙ্গে নিয়মিত না হলেও প্রায়শই দেখা হতো। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ সাফ গেমসে তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। সুইমিং ভেন্যুতে তাঁর উপস্থিতি সবাইকে উদ্দীপ্ত করতো। এরপর দেশে ফেরার পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য হিসেবে তাঁকে দেখতাম, সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠে যাচ্ছেন। প্রেস ক্লাবের কার্ড রুমে ঢুঁ না মারলে তাঁর পেটের ভাত হজম হতো না। যদিও পারিবারিক কারণে তিনি কখনো ঢাকা, কখনো কলকাতায় অবস্থান করতেন। কিন্তু মাতৃভূমির টান তিনি এড়াতে পারতেন না। আর ঢাকায় থাকলে প্রেস ক্লাবে তাঁর উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেওয়ার পর ছোট-খাট কাজে আমার কাছে আসতেন। আর এ ক্ষেত্রে বরেণ্য সাংবাদিক এ বি এম মূসার একটা ভূমিকা ছিল। তিনি বোধকরি আমার সম্পর্কে তাঁকে কিছু বলে থাকবেন। মৃত্যুর কিছু দিন আগে তিনি এসে বললেন, একটি দরখাস্ত লিখে দিতে হবে। বিষয় হচ্ছে, তিনি একটি সুইমিং কমপ্লেক্স গড়ে তুলবেন। এ জন্য সহযোগিতা চেয়ে রাস্ট্রপতির কাছে আবেদন। যথারীতি সেটা লিখে দিয়েছিলাম। তার ফলো-আপ কী হয় জানি না। তারপরও তো তিনিই চিরতরেই চলে গেলেন। তাঁকে নিয়ে মনে মনে একটা পরিকল্পনা এঁটেছিলাম। তাঁর আত্মজীবনী ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করবো। কিন্তু আমাকে ফাঁকি দিয়ে তিনি অন্য কারো পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পরলোকে পাড়ি জমান। বিশ্বকাপ ফুটবলের ডামাডোলে তাঁর চলে যাওয়াটা ছিল একদমই অভাবিত। অবশ্য কোনো মৃত্যুই তো জানান দিয়ে হয় না। কিন্তু ব্রজেন দাসের মতো একজন কিংবদন্তির চলে যাওয়াটা আমাদের শূন্য করে দেয়। এই মাপের ব্যক্তিত্বের সচরাচর দেখা মেলে না। আর এ কারণেই এ দেশের ইতিহাসে চিরদিনের মতো তাঁর স্থান অবিনশ্বর হয়ে থাকবে। পরিণত বয়সের ব্রজেন দাসকে আমরা যাঁরা দেখেছি, তাঁদের স্মৃতিতে তিনি সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন। আর তাঁকে যাঁরা দেখেন নি, ইতিহাসের প্রয়োজনে একদিন নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তাঁকে খুঁজে নেবেন। তাঁকে ছাড়া বাংলা ও বাঙালির ক্রীড়া ইতিহাস অসম্পন্ন থেকে যাবে।
( ১ জুন ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ

এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয় / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ

কমলা রঙের উৎসবের অপেক্ষায় / দুলাল মাহমুদ

প্রতিরোধের সেই দুই ম্যাচ / দুলাল মাহমুদ