ক্রিকেট কি খুঁজে পেয়েছে তার ঠিকানা? দুলাল মাহমুদ



দীর্ঘ কাল আগে যাত্রা শুরু করেও ক্রিকেট কিন্তু যুগের পর যুগ চলছিল গন্তব্যহীন পথে। যখনকার কথা বলছি, তখন ক্রিকেটটা কেবল খেলা ছিল না। বন্দি হয়েছিল আভিজাত্য আর বনেদিয়ানার নিঃসঙ্গ ঘেরাটোপে। এমন পরিবেশে ক্রিকেট বিকশিত হওয়ার কথা নয়। হয়ওনি। সময়কে খোলামকুচির মতো উড়িয়ে দেওয়া আর রঙিন পানীয় চুমুকের ফাঁকে ফাঁকে মন চাইলে উপভোগ করাটাই ছিল ক্রিকেট। নিবেদিত ছিল বিত্তের কাছে। আটকে ছিল বিত্তবানদের হাতে। বিত্তহীনদের কাছে ক্রিকেট ছিল মধুর ছলনা। এলিট শ্রেণীর ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে ‘নি¤œ শ্রেণী’র কেউ কেউ পরিস্থিতির কারণে কখনো-সখনো স্বাদ পেয়েছেন কথিত এই খেলাটির। ঔপনিবেশিক শক্তির কাছে জিম্মাদার থাকার সময় এটিকে খেলা হিসেবে ভাবা যায় নি। ভাবার কথাও নয়। দিনের পর দিন পেরিয়ে যায়। তবুও অমীমাংসিত থেকে যায় খেলার ফল। যাঁদের প্রকৃতঅর্থে কোনও কাজ ছিল না, সৃষ্টির ফুল ফোটানোর কোনও তাগিদ ছিল না, জীবনে কোনও চাহিদা ছিল না, নিজেদের ভোগের জগত নিয়ে যাঁরা ছিলেন অতিমাত্রায় বিভোর, এমন কিছু বিচ্ছিন্ন মানুষদের হাত ধরে ক্রিকেটের অভিযাত্রা শুরু হয়। খেলার পরতে পরতে ছিল নিজেদের জাহির করার দম্ভ। যদিও সাদা পোশাককে বানানো হয় কেতাদুরস্ততার প্রতীক। অথচ শুভ্রতার আড়ালে জড়িয়ে ছিল রাশি রাশি পাঁক। পুরোটাই ছিল শ্বেতাঙ্গদের মনিবসুলভ অহমিকার প্রকাশ। মনোভাবটা ছিল এমন, যাঁরা ক্রিকেট খেলে, তাঁরা সমাজের উপরতলার মানুষ। অন্যরা অস্পৃশ্য। এভাবে পেরিয়ে যেতে থাকে যুগের পর যুগ। ক্রিকেটে সময়টা যেন থমকে থাকে। ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া প্রথম টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করে খেলাটাকে জাতে ওঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। একযুগ পর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। তিন দেশেই ছিল শ্বেতাঙ্গদের প্রভুত্ব। তাদের কাছে ‘জাতপাত’টা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে ক্রিকেটেও দেখা যায় চরম বর্ণবাদী মানসিকতা। তবে কাজের প্রয়োজনে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে মিশতে মিশতে কখন যেন ক্রিকেটটা রপ্ত হয়ে যায় কালো মানুষদের। অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন ঘটে, কালো মানুষরা যখন ক্রিকেটের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে পড়ে, তখনই কেবল এটি সত্যিকার অর্থে খেলা হয়ে ওঠতে থাকে। ১৯২৮ সালের ২৩ জুন ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে গঠিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল টেস্ট ঘরানার সদস্য হওয়ার পর ক্রিকেটে সংযুক্তি ঘটে রঙ-রূপ-রসের। সমুদ্রের ফেনিল ঢেউ, নারকেল গাছের দোলা, ক্যালিপসো সুর, কালো মানুষদের উদ্দাম নৃত্য ক্রিকেটের সঙ্গে যোগ হওয়ায় ক্রিকেট সাধারণ মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিতে থাকে। ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁরা মিলিয়ে দেয় জীবনকে। ক্যারিবীয় ক্রিকেট অনেকের কাছে আসে রোমাঞ্চকর হয়ে। তবে দিনের পর দিন মাঠে উপস্থিত হয়ে ক্রিকেট বিনোদনে নিয়োজিত করার মতো সময় কোথায়? এ কারণে অন্তহীন সময়ের ক্রিকেটকে আনা হয় নির্দিষ্ট পরিসরে। ১৯৩২ সালে ২৫ জুন ভারতীয় উপমহাদেশ জড়িত হওয়ার পর সীমিত পরিসরের ক্রিকেটের ব্যপ্তি যায় বেড়ে। অন্তত জনসংখ্যার অনুপাতে ভালো একটি অবস্থান গড়ে নেয়। তারপরও কিন্তু ক্রিকেট পালে তেমনভাবে হাওয়া লাগতে দেখা যায়নি। মূলত বিলাতি ঘরানার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে ক্রিকেট।
ক্রিকেটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি, যেদিন অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের মধ্যে মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম সীমিত ওভারের একদিনে আন্তর্জাতিক ম্যাচ। টেস্ট ক্রিকেটের ধ্রুপদি ঘরানা থেকে জন্ম নেয় ওয়ান ডে ক্রিকেটের জনপ্রিয় ধারা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে শুরু হওয়া বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে আসে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ চ্যাম্পিয়ন হলে প্রতিষ্ঠিত হয় কালো মানুষদের শ্রেষ্ঠত্ব। ক্রিকেটের মাধ্যমে দেখতে পাওয়া যায় ক্যারিবীয়দের জীবনবোধ। এর আবেদন কোনও অংশে কম ছিল না। তবে ক্রিকেটকে পেশাদার ও রঙদার করে তোলার কৃতিত্ব অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক চ্যানেল নাইনের অধিপতি ও ধনকুবের ক্যারি প্যাকারের। ‘ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট’ আয়োজন করে তিনি ধাক্কা দেন প্রচলিত ক্রিকেট কাঠামোকে। প্রকৃতঅর্থে তিনি ক্রিকেটে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। যথার্থ কারণেই তাঁকে বলা হয় ক্রিকেট বিপণনের সেলসম্যান। ক্রিকেট বিনোদনের এই কুশীলবের কারণে ক্রিকেটারদের হাতে আসে অঢেল অর্থ। রঙিন পোশাক, ফ্ল্যাড লাইটে খেলা আর বর্ণিল সব আয়োজনে বদলে যায় ক্রিকেটের খোলনলচে। ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত চ্যাম্পিয়ন হলে ক্রিকেটের নতুন শ্লোগান হয় ‘ইট ক্রিকেট, স্লিপ ক্রিকেট’। জনসংখ্যা যে কোনও খেলার জনপ্রিয়তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর, সেটা দারুণভাবে অনুভূত হয়। ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার ঢেউয়ে প্লাবিত হয় পুরো উপমহাদেশ। দেড় শতাধিক কোটির জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ অঞ্চলে ক্রিকেট হয়ে ওঠে ধর্মের মতো। ভারতের বিশাল কর্পোরেট জগত ক্রিকেট বিপণনে এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, মনে হতে থাকে, ক্রিকেটই বুঝি সবার ধর্ম, কর্ম, সাধনা। ক্রিকেটের সাতপাকে বাঁধা পড়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়েসী মানুষ। অন্তত এই ক্ষেত্রে কোনও বিভাজন বা বিভক্তি নেই।
পালাবদলের পালায় এক যুগে আগে ক্রিকেটে আসে রীতিমতো বিস্ফোরক পরিবর্তন। প্রবর্তন করা হয় টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট। টেস্ট কিংবা ওয়ান ডে ক্রিকেট যেটি হোক না কেন, খেলায় খেলায় কেটে যায় একটি দিন। বিনোদনের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া প্রযুক্তির এই যুগে একদমই খাপ খায় না। জীবন তো কেবল খেলার মাঠে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। হয়তো নেশা ও পেশার কারণে কেউ কেউ কাটিয়ে দেন খেলার মাঠে। এটাকে স্বাভাবিক মনে করার কারণ নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক বিনোদনের আশায় যাঁরা ছুটে যান খেলার মাঠে, তাঁরা কিছু সময় হয়তো ব্যয় করতে পারেন। কথাটা বলা হচ্ছে, পুরো বিশ্বের প্রেক্ষাপটে। সেক্ষেত্রে টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। সামগ্রিক অবস্থায় এর বেশ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সে হিসেবে এটাকে এখন খেলা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। গুটিকয়েক দেশের মধ্যে আটকে থাকা ক্রিকেট খেলার টি-টুয়েন্টি সংস্করণের এখন বিশ্বায়ন হতে পারে। এরফলে কিছুটা হলেও ক্রিকেট যেন খুঁজে পেতে পারে তার উদ্দীষ্ট ঠিকানা।
কিন্তু ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)-এর সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ক্রিকেটের বিশ্বায়ন হতে পারছে না। ফিফা যেখানে পুরো বিশ্বটাকে তাদের ছাতার তলে নিতে পেরেছে, সেখানে আইসিসি একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে আছে। এত দিন না হয় ফুটবলের গতিময়তার সঙ্গে টেস্ট ও ওয়ান ডে ক্রিকেট পেরে ওঠেনি। এখন তো টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে এসেছে দুরন্ত গতি। বলে বলে বাউন্ডারি মারার তাগিদ। তাহলে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়াটা খুব একটা কঠিন নয়। একজন জগমোহন ডালমিয়া তো বিশ্বায়নের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁর পথ অনুসরণ করলে ক্রিকেটের আঙ্গিনা বিস্তৃত হতে পারে। কিন্তু আইসিসি’র এলিটীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ক্রিকেট বৃত্তের বাইরে যেতে পারছে না। এর অন্যতম উদাহরণ বাংলাদেশ। ক্রিকেটীয় শক্তিমত্তার পাশাপাশি ক্রিকেটের প্রতি আন্তরিকতা, নিবেদন, ভালোবাসার দিক দিয়ে এই দেশটি ক্রিকেট বিশ্বের জন্য গর্ব হতে পারে। হতে পারে দৃষ্টান্তও। এ দেশের ক্রিকেটীয় চর্চার যে বাড়বাড়ন্ত ও খেলার দেখার জন্য ক্রিকেট অনুরাগীরা যেভাবে মাঠে ছুটে যান, তার কোনও তুলনা হয় না। কিন্তু এ বিষয়টি আইসিসির কাছে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। যে কারণে বিশ্বকাপে খেলতে হলে বাংলাদেশকে এখনও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। বাছাই পর্ব পেরিয়ে চূড়ান্ত পর্বে খেলার ছাড়পত্র নিতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো সম্ভাবনাময় দেশকেও। এমন এক প্রেক্ষাপটে ভারতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ষষ্ঠ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এবারও ১৬টি দেশ অংশ নিচ্ছে। র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষ ৮টি দেশ স্বাগতিক ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সরাসরি দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলবে। বাকি ৮ দেশ বাংলাদেশ, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড ও ওমান ‘এ’ গ্রুপে এবং স্কটল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান ও হংকং ‘বি’ গ্রুপের হয়ে প্রথম রাউন্ডে খেলবে। দুই গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন দল সুপার টেন পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। এ পর্যায়ে বাছাই পর্ব খেলতে বাধ্য করাটা বাংলাদেশের ক্রিকেট চর্চা ও ক্রিকেটীয় শক্তিকে খাটো করে দেখার শামিল নয় কি? বাংলাদেশের মতো দেশ যদি ক্রিকেট বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে খেলতে না পারে, তাহলে ক্রিকেটের বিশ্বায়ন হবে কীভাবে? ক্রিকেট কীভাবে পাবে তার প্রকৃত ঠিকানা?
রচনাকাল ১ মার্চ ২০১৬ 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়’ / দুলাল মাহমুদ

অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব-২

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও-২

নেইমারকে নিয়ে কেন এই হাহাকার? দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

আমাদের ফুটবলাররা

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ