সেই আক্ষেপ, সেই কষ্ট, সেই বেদনা / দুলাল মাহমুদ


সময় কি মুছে দেয় সব কষ্ট? সব হতাশা? সব স্মৃতি? হয়তো উপশম করতে পারে। প্রলেপ দিতে পারে। আড়াল করে দিতে পারে। কিন্তু হৃদয় থেকে একদমই মুছে দিতে পারে না। কিছু কিছু কষ্ট আছে অবদমিত থেকে যায়। কিছু কিছু হতাশা আছে নিরুৎসাহিত করে। কিছু কিছু স্মৃতি আছে বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে। যখনই মনে পড়ে যায় সেই সব কথা, তখনই বেদনাদায়ক অনুভূতি হয়। ব্যক্তির জীবনে এমনটি হরদমই হচ্ছে। আর যে কষ্ট, হতাশা ও স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটি জাতির স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, সেটি কখনও ভুলে যাওয়া যায় না। এর রেশ চলতে থাকে অনন্তকাল। তবে এটা তো স্বাভাবিক, যে সময়খ-ে কোনও ঘটনা ঘটে, সেই সময়কার মানুষদের মনে সে ঘটনা চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে দেয়। দীর্ঘ দিন সজীব থেকে যায়। চিরকালের জন্য দীর্ঘশ্বাস হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের ক্রিকেট হয়ে ওঠেছে আশা-ভরসার কেন্দ্রস্থল। ক্রিকেট নিয়ে এ দেশের মানুষের সীমাহীন আবেগ-উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসা। তা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নের শেষ নেই। যেখানে স্বপ্ন আছে, সেখানে আছে স্বপ্নভঙ্গের বেদনাও। বাংলাদেশের ক্রিকেটেও আছে অনেক না পাওয়ার বেদনা। যে বেদনা কখনও মধুর হওয়ার নয়। অনেক প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে সীমিত ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একটি সমীহ জাগানো দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন টাইগাররা। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বড় মাপের কোনও শিরোপার দেখা পায়নি বাংলাদেশ। তবে তিনটি ঘটনার সমীকরণ একটু এদিক-সেদিক হলেই অনেক বেশি বদলে যেতে পারতো বাংলাদেশের ক্রিকেট। কিন্ত হতে হতেও হয়নি। যা শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটের আক্ষেপ, কষ্ট ও বেদনার নাম নয়, তা হয়ে আছে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতচিহ্ন হয়ে। এ ক্ষত থেকে হতে থাকবে রক্তক্ষরণ।

মুলতানের আক্ষেপ
সে এক দুঃখের কাল। বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে তিন বছরও অতিক্রম করেনি। সবে ২১টি টেস্ট খেলেছে। অবশ্য পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। প্রতিটি সিরিজে হোয়াইটওয়াশ। বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস দেওয়া নিয়ে চারপাশে শুরু হয়ে যায় শোরগোল। এমন একটা নাজুক অবস্থায় খালেদ মাহমুদ সুজনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দীর্ঘ সফরে যায় পাকিস্তান। প্রথমবার খেলতে নামে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজ। করাচিতে ১ম ও পেশোয়ারে ২য় টেস্টে বাংলাদেশ দল কখনো ব্যাটিংয়ে, কখনো বোলিংয়ে দেখিয়েছে নৈপুণ্যের ঝিলিক। দুই টেস্টেই জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন টাইগাররা। কিন্তু হঠাৎ পাওয়া সুযোগে যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে, তার রেশ ধরে অস্থিরতা ও অনভিজ্ঞতার কারণে জয়ের দেখা পাওয়া যায়নি। অনেক সিদ্ধান্ত চলে যায় প্রতিকূলে। হেরে যায় যথাক্রমে ৭ ও ৯ উইকেটে। তারপরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ হারকে তখনকার প্রেক্ষাপটে সাফল্য হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। টেস্ট ম্যাচ খেলতে না পারার বদনাম অন্তত কিছুটা হলেও ঘুচাতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। পেশোয়ার টেস্টে প্রথমবার লিড নেওয়ার পাশাপাশি হ্যাটট্টিক করেন লেগ ব্রেক বোলার অলোক কাপালি। টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম হ্যাটট্টিক করে গড়েন নতুন ইতিহাস। কিন্তু সব কিছুই ম্লান হয়ে যায় মুলতান ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সিরিজের ৩য় ও বাংলাদেশের ২৪তম টেস্টে। একটি টেস্টে একটি দেশকে হারানোর জন্য যতটা কলাকৌশল করা যায়, তার সবটাই বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রয়োগ করা হয়। টাইগাররা যখন জয়ের দ্বারপ্রান্তে, তখন একের পর এক পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত দেন আম্পায়াররা। শ্রীলঙ্কান আম্পায়ার অশোকা ডি সিলভা আর জিম্বাবুয়ের রাসেল টিফিনের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বলী হয় বাংলাদেশ। অশোকা যেন পণ করে নেমেছিলেন বাংলাদেশকে জিততে দেবেন না। টেস্টের দ্বিতীয় দিন পাকিস্তানি পেসার সাব্বির আহমেদের বাউন্সারে কপালে আঘাত পেয়ে ১৭ রান নিয়ে দিনশেষে আর ব্যাট করতে পারেননি অলোক কাপালি। পরের দিন কপালে ৩টি সেলাই নিয়ে ২২ রান করার পর ইয়াসির আলীর বলে স্লিপে ক্যাচ দিলে পাকিস্তানের উইকেটকিপার ও অধিনায়ক রশিদ লতিফ বলটি ঠিকমতো লুফে নিতে ব্যর্থ হন। টেলিভিশন রিপ্লেতে দেখা যায়, তিনি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বলটি হাতে রাখতে পারেননি। বলটি মাটি থেকে তুলে নিয়ে ক্যাচের আবেদন করলে আম্পায়ার আউট দিয়ে দেন। এমনকি টিভি আম্পায়ারের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। এ রকম একটি নির্লজ্জ প্রতারণার কারণে রশিদ লতিফ বাংলাদেশের সঙ্গে পরবর্তী পাঁচ ওয়ান ডে ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন। যদিও আরো বেশি সময় নিষিদ্ধ হওয়ার কথা ছিল। অবশ্য তাতে তো বাংলাদেশের জয় ফিরে আসেনি। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। অশোকা বাংলাদেশের একাধিক ব্যাটসম্যানকে আউট দিয়েছেন, যাঁরা আউট ছিলেন না। মোহাম্মদ রফিককে তো ন্যক্কারজনকভাবে ফিরিয়ে দেন। উমর গুলের বলটি লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে পিচড করা সত্ত্বেও তিনি এলবিডব্ল দেন। অথচ বিপরীত ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বাংলাদেশের ফিল্ডিংয়ের সময়। ন্যায্য উইকেট থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বাংলাদেশের বোলাররা। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৬১ রানের টার্গেট নিয়ে তৃতীয় দিনে ৬ উইকেটে ১৪৮ রান নিয়ে দিনের খেলা শেষ করে পাকিস্তান। ইনজামাম-উল-হক ছাড়া বাকিরা ছিলেন টেইলএন্ডার। পরের দিন খেলার চূড়ান্ত মুহূর্তে মোহাম্মদ রফিকের স্ট্রেইটারে সুইপ করতে গিয়ে বল লো হয়ে যাওয়ায় পরাস্ত হন ইনজামাম। প্লাম্ব এলবিডব্ল ছিলেন উমর গুলও। কিন্তু অশোকা এড়িয়ে যান। প্রথম টেস্ট জয়ের স্বপ্নে বিভোর একটি নবীন দেশের ক্রিকেটাররা জয়ের সুবাস পেয়ে যখন প্রতিপক্ষকে চাপে রাখার জন্য এলবিডব্ল’র আবেদন করছিলেন, তা আম্পায়ারদের মোটেও পছন্দ হয়নি। এ কারণে ম্যাচ রেফারি দক্ষিণ আফ্রিকার মাইক প্রক্টর সতর্ক করে দিলে বাংলাদেশের ওপর মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়। এরপর এলবিডব্লু আবেদন করা থেকে কার্যত বিরত থাকেন বোলাররা। অথচ পাকিস্তান দল একইভাবে আবেদন করলেও তাদের কিছু বলা হয়নি। বরং তাদের অন্যায় আবেদনে আম্পায়ার সাড়া দিয়েছেন। রশিদ লতিফ প্রতারণার মাধ্যমে দলের জয় নিশ্চিত করতে চাইলেও বহু কাঙ্খিত জয়ের সুযোগ পেয়েও ‘মহানুভবতা’ দেখাতে গিয়ে জয় হাতছাড়া করেন মোহাম্মদ রফিক। পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসে ৭১তম ওভারে ২১২ রানের মাথায় রফিক বল করার সময় উমর গুল পপিং ক্রিজ থেকে বাইরে চলে যান। সে সময় রফিক ইচ্ছে করলে উমর গুলকে রান আউট করতে পারতেন, তাহলে খেলা অনায়াসেই বাংলাদেশের অনুকূলে এসে যায়। কিন্তু ক্রিকেটীয় ভদ্রতা দেখিয়ে বাংলাদেশের জয়কে দূরে ঠেলে দেন রফিক। যদিও এ ‘মহানুভবতার’ কথা কোথাও লেখা নেই। পরিসংখ্যানে লেখা আছে বাংলাদেশের ১ উইকেটে হেরে যাওয়ার কথা। স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা নিয়ে অশ্রু টলমল চোখে খালেদ মাহমুদ সুজনের মাঠ থেকে বের হওয়ার ছবিটি মনের পটে অমলিন হয়ে আছে। বাংলাদেশ হয়তো হারতে পারতো। কিন্তু প্রতারণার মাধ্যমে যেভাবে হারিয়ে দেওয়া হয়, সেটা মেনে নিতে খুবই কষ্ট হয়। সেই হারটা বাংলাদেশের জন্য বড় একটা ক্ষত হয়ে আছে। খর্ব শক্তির জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে টেস্ট জয়ের দেখা পেলেও এখন অব্দি পূর্ণাঙ্গ শক্তির কোনও টেস্ট দলকে হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানকে হারাতে পারলে অন্যরকম হতে পারতো বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাস। অনেকেই হয়তো বলবেন, যা হয়নি, তা নিয়ে আক্ষেপ করে কী হবে? কিছু কিছু আক্ষেপ আছে, যা কখনও ভুলে যাওয়া যায় না।

ঢাকার কষ্ট
২০১২ সালে ঢাকায় একাদশতম এশিয়া কাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ ভালো কিছু করবে, এমনটি কারও ভাবনায় ছিল না। না থাকারই কথা। ক্রিকেটের অন্যতম তিন শক্তি ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানকে টপকে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখাও ছিল কঠিন। এরআগে এশিয়া কাপে ২০০৪ সালে গ্রুপ পর্বে হংকংকে এবং ২০০৮ সালে গ্রুপ পর্বে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে হারালেও মূলশক্তির কাউকেই হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। তাহলে বাংলাদেশকে নিয়ে কীভাবে আশাবাদী হওয়া যায়? আর সেই বাংলাদেশ কিনা পাকিস্তানের বিপক্ষে লড়াই করে হারলেও ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে দিয়ে ফাইনালে উন্নীত হয়। এটি ছিল অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর। এ সাফল্যে উজ্জীবিত বাংলাদেশ দেখতে থাকে নতুন স্বপ্ন। ২২ মার্চ মিরপুর শের-এ-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে ফাইনালে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয় টাইগাররা। পাকিস্তানের দেওয়া ২৩৭ রানের টার্গেট নিয়ে খেলতে নেমে যথারীতি রানের ফোয়ারা ছোটান মারকুটে উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল। কিন্তু নাজিমউদ্দিন আর নাসির হোসেনের মন্থর গতির ব্যাটিংয়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকেন টাইগাররা। একপর্যায়ে অবশ্য সাকিব আল হাসান সহ মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের দৃঢ়তায় জয়ের স্বপ্ন দেখতে থাকে পুরো বাংলাদেশ। বিশেষ করে মাশরাফি বিন মুর্তজার ৯ বলে ১৮ রানের ইনিংসটি অনেকখানি এগিয়ে দেয়। শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ৯ রান। হাতে ২ উইকেট। মাহমুদউল্লাহ’র সঙ্গে তখন আবদুর রাজ্জাক। ওভারের প্রথম বলে পাকিস্তানি পেসার আইজাজ চিমার সঙ্গে ধাক্কা লাগায় দ্বিতীয় রান নিতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। নিতে পারলে হয়তো খেলার মোড় ঘুরে যেতে পারতো। পরের বলে রাজ্জাক লেগ বাই থেকে নেন ১ রান। ৩য় বলে কোন রান নিতে না পারলেও ৪র্থ বলে ৩ রান নেন মাহমুদউল্লাহ। এটাও হিতে বিপরীত হয়ে যায়। ৫ম বলে বোল্ড হয়ে যান রাজ্জাক। শেষ বলে প্রয়োজন ছিল ৩ রান। শেষ ব্যাটসম্যান শাহাদত হোসেন। চিমা লেগ স্ট্যাম্পে ইয়র্কার বল দিলে তাঁর পক্ষে বাই রান থেকে ১ রানের বেশি নেওয়া সম্ভব হয়নি। হারতে হয় ২ রানে। এত কাছে এসেও তবুও শিরোপা রয়ে যায় অধরা। এই হাহাকার কীভাবে পূরণ হবে? এমন সুযোগ কি সহসা পাওয়া যাবে? এ যন্ত্রণা সইতে না পেরে কাঁদতে থাকেন অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। সান্ত¦না দিতে গিয়ে কাঁদেন সাকিব আল হাসানরা। কাঁদতে থাকে পুরো স্টেডিয়াম। কাঁদতে থাকে সারা দেশ। এশিয়া কাপ ইতিহাসের সেরা ফাইনালে অল্পের জন্য চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি বাংলাদেশ। নিজেদের সেরা সাফল্য দিয়ে সবার হৃদয় জয় করে নেয় বাংলাদেশ দল। কিন্তু শিরোপা জিততে না পারার এ কষ্ট কোনো দিনই লাঘব হওয়ার নয়।

এবং ব্যাঙ্গালুরুর বেদনা
ভারতে সদ্য অনুষ্ঠিত টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশ নেওয়ার আগে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা সময় অতিক্রম করছিল বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের নভেম্বরে সফরকারী জিম্বাবুয়েকে ৫ ম্যাচের ওয়ান ডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ দিয়ে শুরু। এরপর অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে ওয়ান ডে বিশ্বকাপে আফগানিস্তান, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ডকে হারিয়ে কোয়ার্টার-ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে বিতর্কিত আম্পিয়ারিংয়ের শিকার হয়ে বিদায় নিলেও সবার সহানুভূতি অর্জন করেন টাইগাররা। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন মাইলফলক গড়ে বাংলাদেশ। পর পর সফরকারী শক্তিশালী তিনটি দেশের বিপক্ষে ওয়ান ডে সিরিজ জিতে ক্রিকেট দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দেয় টাইগাররা। পাকিস্তানকে তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ, ভারতকে ২-১ ম্যাচে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২-১ ম্যাচে হারায়। এমনটি কে কবে কল্পনা করেছে? এরপর সফরকারী জিম্বাবুয়েকে তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে। টি-টুয়েন্টিতে পাকিস্তানকে এক ম্যাচের সিরিজে হারায়। ভারতে টি-টুয়েন্টি এশিয়া কাপে সংযুক্ত আরব আমিরাত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা। এরপরই অংশ নেয় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে। বড় কিছু করতে না পারলেও বাংলাদেশ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না, এটা প্রতিপক্ষরা অনুধাবন করতে পারে। টাইগারদের নিয়ে অনেক বেশি হোমওয়ার্ক করতে হয়। তবে বিশ্বকাপে যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয়নি বাংলাদেশ। খেলতে হয় প্রথম রাউন্ড নামক বাছাইপর্ব। নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড ও ওমানকে হারিয়ে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েন টাইগাররা। তার প্রতিফলন দেখা যায় সুপার টেনের ম্যাচে। পাকিস্তানের সঙ্গে এটা অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো দলের দুই নির্ভরযোগ্য বোলার তাসকিন আহমেদ ও আরাফাত সানির উপর নেমে আসে নিষেধাঙ্গার খাঁড়া। অবৈধ ঘোষণা করা হয় তাঁদের বোলিং অ্যাকশনকে। পাকিস্তানের পর তামিম ইকবালকে ছাড়াই অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে লড়াই করে হারলেও বাংলাদেশের আশা ফুরিয়ে যায়নি। সেই আশায় ভারতের বিপক্ষে জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় থাকেন টাইগাররা। ২৩ মার্চ ব্যাঙ্গালুরুর এম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে রচিত হতে পারতো আনন্দগাথা। তার পরিবর্তে রচিত হয় অনন্ত বিষাদগাথা। দোদুল্যমান ম্যাচের শেষ ওভারে জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১১ রান। তখন দলের স্কোর ৬ উইকেটে ১৩৬। এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ছিলেন দলের সবচেয়ে ঠাণ্ডা মাথার নির্ভরযোগ্য ও দায়িত্বশীল দুই ব্যাটসম্যান টেস্ট দলের অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ। মাস দুয়েক আগে অভিষিক্ত ভারতের মিডিয়াম পেসার হার্দিক পান্ডিয়া এ ধরনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য একদমই অভিজ্ঞ ছিলেন না। তাঁর প্রথম বলটি ডিপ কভারে পাঠিয়ে একটি রান নেন মাহমুদউল্লাহ। এরপর এক্সট্রা কভার দিয়ে ও স্কুপ শটে পর পর দুটি বাউন্ডারি হাঁকিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়েন মুশফিক। তাঁর সঙ্গে উল্লসিত হয়ে ওঠে পুরো দেশ। তখন জয়টাকে অলীক মনে করার কোনও কারণ ছিল না। ৩ বলে প্রয়োজন ২ রান। হেসে-খেলেই জিতে যাওয়ার কথা। এরপরের তিনটি বল যেন অভিশাপ হয়ে আসে। ব্যাটসম্যানদের পেয়ে বসে হারাকিরিতে। জয়ের নেশায় উন্মক্ত মুশফিক পরের বলটি হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সেলিব্রেট করতে চেয়েছিলেন। তাঁর উচ্ছ্বাস যতটা তীব্র ছিল, বলের গতি ততটা ছিল না। ডিপ মিড উইকেটে বলটি সহজেই লুফে নেন শিখর ধাওয়ান। মুশফিকের পথ অবিকল অনুসরণ করেন মাহমুদউল্লাহ। ফুল টস বলটিকে সীমানার বাইরে পাঠিয়ে হিরো হতে চেয়ে জিরো হয়ে ফিরে আসেন তিনিও। দুরন্ত গতিতে ছুটে গিয়ে ক্যাচটি মুঠোবন্দি করেন রবীন্দ্র জাদেজা। শেষ বলে ছিল বাঁচা-মরার লড়াই। জিততে পারলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সংযোজন হতে পারতো বড় একটি সাফল্য। ভারতের মাটিতে বাংলাদেশ খেলার খুব একটা সুযোগ পায় না। এমন একটা সুযোগে তাদের হারাতে পারলে অনেক বেশি সমীহ আদায় করে নিতে পারতো টাইগাররা। তাছাড়া টিকে থাকতো সেমিফাইনালে খেলার সম্ভাবনা। এমন এক সমীকরণের সামনে দুরু দুরু বক্ষে অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে কাঁপতে থাকেন ক্রিকেটানুরাগীরা। স্ট্রাইক ব্যাটসম্যান শুভাগত হোম। নন-স্ট্রাইকে মুস্তাফিজুর রহমান। অফস্ট্যাম্পের একটু বাইরের বলটাকে ব্যাটের সঙ্গে সংযোগ করতে ব্যর্থ হন শুভাগত। আর চতুরতার সঙ্গে দৌঁড়াতে না পারায় রান আউট হয়ে যান মুস্তাফিজ। ১ রানে হেরে যায় বাংলাদেশ। নিমিষেই ভেঙ্গে পড়ে স্বপ্নসৌধ। টিভির সামনে বসা বাংলাদেশের অগণিত দর্শকরা ছিলেন নিথর। নিশ্চল। নিস্তব্ধ। অবগাহন করতে থাকেন বেদনার সমুদ্রে। তবে শেষ বল মোকাবিলার ক্ষেত্রে পরিপক্কতা দেখাতে পারেনি বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টও। মুস্তাফিজুরের তো ব্যাট করার সুযোগ ছিল না। তাহলে তাঁকে কেন প্যাড-গ্লাভস পরিয়ে সাজিয়ে-গুজিয়ে পাঠানো হলো? ভারতের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি যেখানে ডান হাতের কিপিং গ্লাভস খুলে নিজেকে প্রস্তুত করেন রণসজ্জায়, সেখানে কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই কেন মুস্তাফিজকে পাঠানো হয়? এর কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া সাতক্ষীরার অনভিজ্ঞ এ ছেলেটিকে কানে কানে কি বলে দেওয়া যেত না বোলার রানআপ শুরুর পর পরই সে যেন ছুটে যায় রান নেওয়ার জন্য। না, সেদিন কোনও যোগফল মেলেনি। সব কেন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। আসলে নিয়তিও বোধকরি বাংলাদেশকে বিজয়ী দেখতে চায়নি। না হলে এমন হবে কেন? তীরে এসে তরি ডুবার এমন যন্ত্রণায় বলতে গেলে ঘুমহীন কাটে দেশবাসীর। এখনও যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে অভিশপ্ত সেই তিনটি বল। আঘাত করে হৃদয়তন্ত্রীতে। আলোচনায় ওঠে আসে নানা বিশ্লেষণ। কোনোভাবেই যেন মন মানে না। এমন বেদনা কখনও ভোলা যায় না।
এটা তো ঠিক, খেলা তো আর জীবন নয়। জীবন বয়ে যায় আপন নিয়মে। খেলার মতো মামুলি বিষয় জীবনকে রুদ্ধ করে দিতে পারে না। তারপরও যেন জীবন কখনও কখনও থমকে যায়। যেমনটি গিয়েছিল মুলতানে, ঢাকায় ও ব্যাঙ্গালুরুতে। এমন পরাজয়ে কারও কোনও অনভূতি ছিল না। পেরিয়ে আসতে হয় যেন ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত এক একটি দিন বা রাত। সময় অনেকটা বয়ে গেলে তবুও সামলে ওঠা যাচ্ছে না। মনে হয় সব হারিয়ে নিঃস্ব, রিক্ত, শূন্য। মনে পড়লেই বুকের মধ্যে হু হু করে বয়ে যায় কান্নার জলপ্রপাত। এ স্মৃতি প্রত্যক্ষদর্শীদের চিরদিন ক্ষত-বিক্ষত করবে। চাইলেও মন থেকে মুছে ফেলা যাবে না। স্মৃতি তো আর পেন্সিলে আঁকা ছবি নয় যে চাইলেই রাবার দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে ফেলা যাবে। অনেক স্মৃতি হয়তো এমনিতেই মুছে যায়। কিন্তু একটি জাতির স্বপ্নভঙ্গের আক্ষেপ, কষ্ট ও বেদনার স্মৃতি অমলিন রয়ে যায়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব

হকি অন্তঃপ্রাণ আলমগীর মোহাম্মদ আদেল/ দুলাল মাহমুদ

স্টাইলিশ অ্যাথলেট ছিলেন আরজান খান/ দুলাল মাহমুদ

‘মৃত্যুগুহা’ থেকেই উজ্জীবনের গান / দুলাল মাহমুদ

কাছের মানুষ এখন অনেক দূরে

আপন ভুবনের রাজা কাজী কামাল/ দুলাল মাহমুদ

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ