অমরত্বের ঠিকানায় ফিল হিউজ / দুলাল মাহমুদ



জীবনের ধর্মই এমন, জীবন কখনো থেমে থাকে না। মৃত্যুর নৈঃশব্দের মাঝেই শোনা যায় জীবনের কোলাহল। এই নৈঃশব্দ, এই কোলাহল বিপরীতমুখী জীবনের দুই অনুষঙ্গ। অবস্থান করে পাশাপাশি। খেলার মাঠে যেমন জয়ের উল্টো পিঠেই থাকে পরাজয়। জয়-পরাজয়ই খেলার আনন্দ, খেলার সৌন্দর্য। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে অনুভব করা যায় না। জীবন এবং মৃত্যুও তদ্রুপ। মৃত্যু আছে বলেই তো জীবনের মহিমা বুঝতে পারা যায়। মৃত্যু যতই অপ্রত্যাশিত, অভাবিত ও অনাকাঙ্খিত হোক না কেন, তাকে অস্বীকার করা যাবে না। এ কারণে আমরা এমন সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, যা অবিশ্বাস্য হলেও বাস্তব ও সত্য। গত ২৫ নভেম্বর সিডনি ক্রিকেট মাঠে অস্ট্রেলিয়ার শেফিল্ড শিল্ডে নিউ সাউথ ওয়েলসের পেসার শন অ্যাবোটের তীব্র বাউন্সার মরণ ছোবল হানে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যান ফিল হিউজের গ্রীবায়। হেলমেটও তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়েন ক্রিজে। তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত হার মানেন ২৬ বছর বয়সী জাত এই ক্রিকেটার। এক নভেম্বরে এসেছিলেন এই পৃথিবীতে, আরেক নভেম্বরে বড় নির্মমভাবে অকালেই চলে গেলেন। নিয়তির এক খামখেয়ালির শিকার হলেন তরুণ এই ব্যাটসম্যান। অবশ্য জীবনের ইনিংসে হার মানলেও ক্রিকেটের ইনিংসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। তাঁর অপরাজেয় ৬৩ রানের শেষ ইনিংসটি হয়ে থাকবে কালোত্তীর্ণ। ক্রিকেটই ছিল তাঁর স্বপ্ন, তাঁর ভালোবাসা, তাঁর জীবন। ক্রিকেটেই পরিপূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছিলেন নিজেকে। আর এই ক্রিকেটই কেড়ে নিয়েছে তাঁর প্রাণ। এরচেয়ে মর্মকষ্ট, মর্মবেদনা, মর্মযাতনা আর কী আছে? ক্রিকেটীয় জীবনের মধ্যগগণে মর্মান্তিকভাবে বিদায় নেওয়ায় নিজেকে পুরোপুরিভাবে মেলে ধরার সুযোগ পেলেন না। ২৬ টেষ্ট, ২৫ ওয়ান ডে ম্যাচ আর নয় সহস্রাধিক প্রথম শ্রেণীর রান দিয়ে তাঁকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা যাবে না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর কিছু সংযোজন করতে না পারলেও তিনি ক্রিকেট ইতিহাসে অমলিন হয়ে থাকবেন। ক্রিকেট তো পরিসংখ্যান আর রেকর্ডের খেলা, ফিল হিউজ এমন এক ব্যতিক্রমধর্মী পরিসংখ্যান ও রেকর্ড গড়েছেন, এই খেলাটি যতদিন অনুষ্ঠিত হবে, ততদিন স্মরিত হবে তাঁর নাম। ক্রিকেট মাঠে মৃত্যু তাঁকে দিয়েছে অমরত্বের ঠিকানা। তাঁর মতো করে এমন ঠিকানায় কেউ নিশ্চয়ই পৌঁছাতে চাইবেন না। অবশ্য তাঁর আগে ক্রিকেট মাঠে বেদনাদায়ক এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন ভারতের টেস্ট ও ওয়ান ডে ক্রিকেটার রমন লাম্বা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খুব বেশি সাড়া জাগাতে না পারলেও ক্লাব ক্রিকেটে তাঁর কোনো তুলনা ছিল না। ভারতের ঘরোয়া এবং আয়ারল্যান্ড ও বাংলাদেশের ক্লাব ক্রিকেটে তিনি ছিলেন অপরিহার্য। বিশেষ করে ভারতের রণজি ট্রফি, দিলীপ ট্রফি আর ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে আবাহনী লিমিটেড ও জিএমসিসি’র হয়ে তাঁর মারকুটে ও দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং ছিল আনন্দদায়ক। ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী এক ক্রিকেটার। ক্রিকেট মাঠে কোনো কিছুই পরোয়া করতেন না। কোনো বোলারকে যেমন সমীহ করতেন না, তেমনিভাবে ফিল্ডার হিসেবে তিনি ছিলেন চিতা বাঘের মতো ক্ষিপ্র। তাঁকে ফাঁকি দিয়ে রান নেওয়াটা ছিল যে কোনো ব্যাটসম্যানের জন্য বড় একটি পরীক্ষা। অসম্ভব সাহসী ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ এই ক্রিকেটার। শেষ পর্যন্ত এই সাহসই তাঁর কাল হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এবং আবাহনী লিমিটেডের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তিনি দলের বাঁ-হাতি স্পিনার সাইফুল্লাহ জেমের বলে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিং করছিলেন। তাঁকে হেলমেট পরিধান করার কথা বললেও স্বভাবজাত কারণে তিনি তা উপেক্ষা করেন। মোহামেডানের উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান মেহরাব হোসেন অপির হাঁকানো জোরালো শটের একটি বল তাঁর কপালে সরাসরি আঘাত করার পর তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই মুহুর্তে আঘাতটা গুরুতর মনে হয়নি। তবে অস্বস্তি বোধ করায় তিনি হেঁটে হেঁটে মাঠের বাইরে চলে আসেন। হঠাৎ পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অকুতোভয় ও লড়াকু এই ক্রিকেটার ২৩ ফেব্রুয়ারি ৩৮ বছর বয়সে চলে যান না ফেরার দেশে।         
প্রায় ১৭ বছর আগে রমন লাম্বার মৃত্যুর ঘটনাটি অনেকটাই থিতু হয়ে যাওয়ায় অস্ট্্েরলিয়ার মতো দেশে ফিল হিউজের মৃত্যু নাড়িয়ে দেয় ক্রিকেট বিশ্বকে। থমকে যায় ক্রিকেট দুনিয়া। এলোমেলো হয়ে যায় ক্রিকেটের জগত। যাঁরা ক্রিকেট খেলেন এবং ক্রিকেট ভালোবাসেন, তাঁদেরকে ছুঁয়ে যায় এই মৃত্যু। বিনোদনই যদি হয় ক্রিকেটের সারকথা, তাহলে ক্রিকেট মাঠে তো মৃত্যু মোটেও কাঙ্খিত হতে পারে না। বাউন্সারে যদি ঝরে যায় তরতাজা জীবন, তাহলে জেনে-শুনে কেন বিষ পান করা? এমন কথা চারপাশে তুমুলভাবে উচ্চারিত হতে থাকে। এমনকি গতিদানবরা পর্যন্ত হয়ে পড়েন শঙ্কিত। যেন-তেন প্রকারে ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে দিতে পারলে যাঁরা ফেটে পড়েন উল্লাসে, তাঁরাও বাউন্সার নিয়ে ভুগতে থাকেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। কিন্তু ক্রিকেট রোমান্টিকরা মনে করেন, বাউন্সার তো খেলারই অংশ। এটি নিষিদ্ধ করলে নষ্ট হয়ে যাবে টেষ্ট ক্রিকেটের লড়াকু আমেজ। তাহলে তো খেলায় কোনো আনন্দই থাকবে না। এটা হয়ে উঠবে কেবলই ব্যাটসম্যানদের খেলা। এরফলে ক্রিকেট হারিয়ে ফেলবে তার আকর্ষণ, তার ঔজ্জ্বল্য, তার তীব্রতা। আর ক্রিকেট মাঠে এমন দুর্ঘটনা তো সচারচর ঘটে না। একটি দুর্ঘটনার কাছে যদি হার মানতে হয়, তাহলে এটা তো জীবনের এক ধরনের পরাভব। জীবন তো কখনো হার মানে না। প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কতই তো দুর্ঘটনা ঘটছে, অকালে হারিয়ে যাচ্ছে কত কত জীবন, তাতে করে কি কোনো কিছু থেমে আছে? তাহলে ক্রিকেট মাঠে জীবন কেন মন্থর হয়ে যাবে? ভয় পাবে মৃত্যুর শঙ্কাকে। এ হতে পারে না। হয়ওনি।  
শোককে শক্তিতে পরিণত করে জেগে ওঠে ক্রিকেট। মৃত্যুভয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে জীবনের জয়গান গাইছেন ক্রিকেটাররা। সিনায় সমস্ত শক্তি জড় করে মারণাস্ত্র ছুঁড়ছেন দ্রুতগামী বোলাররা। ফিল হিউজের বেদনাদায়ক মৃত্যুর রেশ ফুরিয়ে যেতে না যেতেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আবারও তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছিল। অ্যাডিলেড ওভালে সিরিজের প্রথম টেস্টে ভারতীয় ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলির হেলমেটে গভীরতর চুমু খায় অস্ট্রেলিয়ার পেসার মিচেল জনসনের দ্রুতলয়ের শর্ট বল। একটু যেন টলমল হয়ে ওঠেন কোহলি। দুলে ওঠে তাঁর চারপাশ। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন অজি ফিল্ডাররা। ফের বড় একটা অঘটনের আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে ক্রিকেটবিশ্ব। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। বরং আত্মবিশ্বাস আর সাহসের সঙ্গে খেলে সেঞ্চুরি করেন ভারত অধিনায়ক। ভয়ের কাছে আত্মসমর্পণ না করে তুলে ধরেছেন ক্রিকেটীয় গৌরব। তবে ফিল হিউজ ক্রিকেটানুরাগীদের বুকের মধ্যে যে মৃত্যুর ক্ষতচিহ্ণ এঁকে দিয়েছেন, তাতে তৈরি হয়েছে একটা আতঙ্ক। ক্রিকেট মাঠে ছুটন্ত বল একটুখানি বেপরোয়া আচরণ করলেই বুকের মধ্যে একটা ভয়ের স্রোত বয়ে যায়। অবশ্য এই ভয়টা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। ক্রিকেট তো সাহসীদেরই খেলা। এখানে সাহস হারানোর কোনো সুযোগ নেই। ক্রিকেট মাঠে যে যেখানেই থাকেন না কেন, তিনি ব্যাটসম্যান হতে পারেন, বোলার হতে পারেন, ফিল্ডার হতে পারেন, আম্পায়ার হতে পারেন, এমনকি দর্শকও হতে পারেন, যে কোনো সময় যে কোনো দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। দুরন্ত গতিতে ছুটে যাওয়া আপেলের মতো দেখতে কাঠের বল যতই মায়াবী হোক না কেন, তার যাত্রা পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালে কাউকেই রেহাই দিতে চায় না। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাটসম্যান ও ক্লোজ-ইন ফিল্ডারদের বিপদটাই বেশি। এ কারণেই তারা হেলমেট ব্যবহার করে থাকেন। মারকুটে ক্রিকেটার রমন লাম্বা ক্লোজ-ইন পজিশনে ফিল্ডিং করার সময় কোনো হেলমেট ব্যবহার না করে আর ফিল হিউজ ব্যাটসম্যান হিসেবে হেলমেট পরিধান করেও বলের আঘাতে হারিয়েছেন জীবন। বিপরীত মেরুর দুই দেশের চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তাঁদের ফিরিয়ে আনতে পারেননি। এ আসলে নিয়তির অনিবার্য এক পরিণতি। এই নিয়তিকে মেনে নিয়েই তো আমাদের পথচলা।


dulalmahmud@yahoo.com                        

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়’ / দুলাল মাহমুদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ

এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয় / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ