আমি ক্লান্ত প্রাণ এক...... দুলাল মাহমুদ
চার বছরের জন্য অস্ত গেল বিশ্বকাপ ফুটবল নামক জ্বলজ্যান্ত সূর্যটা। অস্তগামী সূর্যের ম্লান আলোয় ছড়িয়ে আছে ক্লান্তি আর অবসন্নতা। এখন আর কোনো উত্তাপ নেই। উত্তেজনা নেই। উদ্বেগ নেই। উৎকণ্ঠা নেই। চারিদিকে যেন ছড়িয়ে আছে থোকা থোকা বিষণ্নতা। কী যেন ছিল, কী যেন হারিয়ে ফেলেছি। চাইলেও তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। বুকের মধ্যে কী এক শূন্যতা গড়াগড়ি খায়। একটি মাস যে কীভাবে কীভাবে ঘোরের মধ্যে কেটে গেল, বুঝতে পারছি না। মাসব্যাপী এই মহোৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে, কতটা নিমগ্ন ও কতটা নিমজ্জিত ছিলাম। কতটা আন্দোলিত, কতটা আলোড়িত হয়েছিলাম। ‘দ্য গ্রেটেষ্ট শো অন আর্থ’ বদলে দিয়েছিল জীবনের দিনলিপি। দিনগুলোকে রাত আর রাতগুলোকে করে তুলেছিল দিন। জীবন থেকে কমে গিয়েছিল ভালোবাসার ঘুম। এলোমেলো দিনলিপিতে প্রতিদিনই ঘুম ভাঙতো একটা উদ্বেগ অর উৎকণ্ঠা নিয়ে। টের পেতাম উত্তাপ আর উত্তেজনা। কেন মনের উপর অকারণেই চাপ বাড়তো, বলতে পারবো না। অবশ্য অবসর আর অবকাশ বলতে তো কিছুই ছিল না। প্রকৃতঅর্থে জীবনটা হয়ে উঠেছিল বিশ্বকাপময়। ঘুমে, জাগরণে। অনুভবে, অনুভূতিতে। আবেগে, উচ্ছ্বাসে। বিশ্বকাপ ফুটবলের সঙ্গে নিবিড় সম্পৃত্ততার কারণে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেত ফুটবল দুনিয়া। কত কল্পনা, কত ভাবনা এসে নাড়িয়ে দিয়ে যেত। এমনিতে যে বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন অনুভব করি না, সে বিষয়ও বিশ্বকাপের সময় অবচেতন মনে রেখাপাত করে যায়। আমার মতো অলস লোককেও জাগিয়ে দিয়েছিল বিশ্বকাপ। যে আমি লিখতে খুবই কার্পণ্য বোধ করি, সেই আমাকে দিয়ে প্রতিদিন লিখিয়ে নিয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবল। একটি দিনও ছুটি না নিয়ে প্রতিদিন কীভাবে লিখলাম, এখন ভাবলেও অবাক লাগে। একটি বিশ্বকাপ যে কতটা প্রভাববিস্তারকারী, সেটা খেলা চলাকালে পলে পলে অনুভব করা যায়। বিশ্বকাপ যাঁদের স্পর্শ করে না, তাঁরাও এর নাগাল থেকে দূরে থাকতে পারেন না। আর যাঁরা বিশ্বকাপেই নিজেকে সঁপে দেন, তাঁদের অবস্থা যে কেমন হয়, সেটা বোঝানো যাবে না। যেন অলৌকিক এক স্বপ্নের পেছনে তাড়া করা। বিশ্বকাপ যেন দিল্লিকা লাড্ডু-জো খায়েগা ওভি পস্তায়েগা, জো নেহি খায়েগা ওভি পস্তায়েগা। তবে পস্তানোরও রকমফের আছে। বিশ্বকাপ শুধু পস্তায় না, আমাদের অনেক কিছুই দিয়েও যায়। বিশ্বকাপ নামক মহাযজ্ঞ বিনোদনের যে পসরা সাজায়, তা থেকে আমরা আমাদের মতো করে আনন্দ আহরণ করি। এই আনন্দের কোনো রঙ নেই। যে যেভাবে পারেন, নিজেকে রাঙিয়ে নেন। যে কারণে বাংলাদেশে বিশ্বকাপ হয়ে উঠেছে একটি উৎসব। এ এমন এক উৎসব যেখানে বাংলাদেশ নেই, কিন্ত আনন্দের কোনো কমতি নেই। তবে বিশ্বকাপ কেবলই একটি উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর ব্যাপ্তি ও বিশালত্ব অনেক বড়। এক একটি বিশ্বকাপ তো আমাদের জানা-শোনার সীমানাকেও বাড়িয়ে দেয়। কত কিছুই আমরা জানতে পারি। বুঝতে পারি। বিভিন্ন দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ভুগোল, জীবনযাপন, রকমারি মানুষ সহ কত কিছুই না আমাদেরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। আমরা আলোকিত হই। সমৃদ্ধ হই। তবে একটি বিশ্বকাপের ধকলও নেহাত কম নয়। বিশ্বকাপ নিয়ে যাঁদের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড, তাঁরা এটা ভালোভাবেই অনুভব করতে পারেন। প্রতিদিন যদি বিশ্বকাপের নতুন নতুন বিষয় নিয়ে লিখতে হয়, সেই ধকলও নেহাত মন্দ নয়। তবে এটাও তো ঠিক, এমন ধকলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গভীর গভীর ভালোবাসা। এতগুলো দিন পাঠকের সঙ্গে যে সেতুবন্ধন গড়ে উঠেছে, তার কোনো তুলনা হয় না। আমার অনেক লেখাই হয়তো কারো কারো পছন্দ হয়নি, তবুও কষ্ট করে, ধৈর্য নিয়ে লেখা যে পড়েছেন, এজন্য আপনাদের কাছে আমার অপরিসীম কৃতজ্ঞতা।
চারটি বছর একদমই কম সময় নয়। এই সময় কত কিছু বদলে যাবে। উল্টে-পাল্টে যাবে। ব্যক্তির জীবন। পারিবারিক জীবন। সামাজিক জীবন। তবুও বিশ্বকাপ ঠিকই ফিরে আসবে। ফিরে আসবে তার রূপ-রস-মাধুর্য নিয়ে। আমরাও অপেক্ষায় থাকবো পরবর্তী বিশ্বকাপের জন্য।
dulalmahmud@yahoo.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন