লাতিন ফুটবলের বিদায়ের ঘণ্টাধ্বনি কি বাজছে? দুলাল মাহমুদ



ইউরোপীয়দের বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা জিততে না দেওয়ার যে অহংকার ছিল লাতিন আমেরিকার, সেই অহংকার আর রইলো না। ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে লাতিন আমেরিকা থেকে শিরোপা জয় করার গৌরব এখন জার্মানির। লাতিনরা একে একে হারিয়ে ফেলছে তাদের অর্জন, তাদের গৌরব, তাদের অহংকার। ইউরোপ থেকে প্রথম শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব ছিল ব্রাজিলের। ১৯৫৮ সালে সুইডেন থেকে শিরোপা জয়টা ছিল লাতিনদের একমাত্র উদাহরণ। এরপর ইউরোপ থেকে যেমন কেউ আর শিরোপা জিততে পারেনি। তেমনিভাবে পারেনি লাতিন থেকেও ইউরোপের কেউ শিরোপা জিততে। অনেক প্রতীক্ষার পর এবার জার্মানি জয় করলো লাতিন আমেরিকা। এটা লাতিনদের জন্য বড় ধরনের একটা সতর্ক সংকেত হয়ে রইলো। এরআগে এমন কখনো হয়নি যে ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকা দুইবারের বেশি শিরোপা থেকে দূরে থেকেছে। এবার সেই দৃষ্টান্তও স্থাপন করলো লাতিন আমেরিকা। উপর্যুপরি তিনটি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হতে পারলো না লাতিনরা। শিরোপা জয়ের দিক দিয়ে ইউরোপীয়দের সঙ্গে লাতিনদের ব্যবধানটাও বাড়লো। ইউরোপ ১১ এবং লাতিনরা ৯ বার শিরোপা জয় করেছে। এই ব্যবধানটা ক্রমশ বাড়তে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমনিতেই নিজেদের মাঠে ইউরোপীয়রা অটল পাহাড়ের মতো। ৫৬ বছর আগে ব্রাজিল একবার অসম্ভবকে সম্ভব করলেও এখন আর সেই দিন নেই। সেক্ষেত্রে সামনের দিনগুলো হতে পারে ইউরোপীয়দের জয়জয়কার। বিশ্বকাপ আয়োজনের দিক দিয়ে এগিয়ে থাকে ইউরোপীয়রা। অতীতের ধারা থেকে ধরেই নেওয়া যায়, আগামীতেও ইউরোপেই বেশি বার আয়োজিত হবে বিশ্বকাপ। আয়োজক হিসেবে বিশ্বকাপের শিরোপাও ইউরোপের ঘরেই থাকার সম্ভাবনা বেশি। লাতিনদের ঘরে আবার বিশ্বকাপ ফিরে আসতে পেরিয়ে যাবে অনেক অনেক দিন। তাছাড়া নিজ মহাদেশের বাইরে বিশ্বকাপ জিততে না পারার যে অপবাদ ইউরোপের ছিল, সেটা ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় শিরোপা জয় করে খ-ন করে স্পেন। আর এবার ব্রাজিলে বিশ্বকাপ জিতে ইউরোপীয়রা বুঝিয়ে দিয়েছে কোনো প্রতিবন্ধকতাই আর তাদের আটকে রাখতে পারবে না। এ তো গেলো হিসেবের কথা।
ফুটবলীয় শক্তি, সামর্থ্য ও ক্রীড়াশৈলীর কথা বিচার-বিশ্লেষণ করলে ইউরোপের তুলনায় লাতিন আমেরিকা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। শিরোপার লড়াইয়ে লাতিনদের প্রধান শক্তি ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা। একসময় উরুগুয়ে থাকলেও এখন আর তাদের গণনায় ধরা হয় না। সেক্ষেত্রে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা ইউরোপের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে আসছে। ১৯৫০ সালের পর ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা ছাড়া লাতিন আমেরিকার আর কোনো দেশ ফাইনাল খেলতে পারেনি। এই দুই দেশেরও যা অবস্থা, তাতে ইউরোপের সঙ্গে কত দিন লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে, এবার সেই সংশয়ও দেখা দিয়েছে। নিজের মাঠে ব্রাজিল যেভাবে ইউরোপের দুই পরাশক্তি জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডসের কাছে নাজেহাল হলো, তাতে আলামত মোটেও ভালো মনে হয়নি। যে দেশটি জন্ম দিয়েছে কত কত কিংবদন্তি ফুটবলার, যে দেশের জাতীয় দলে সুযোগ না পেয়ে ভিন দেশে পাড়ি দিয়েছেন অসংখ্য খেলোয়াড়, সেই দেশের সেরা একাদশ এবার যাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে, তাদের যোগ্যতা নিয়ে আছে হাজারো প্রশ্ন। তাহলে কি ব্রাজিল আর প্রতিভাবান ও মেধাবী ফুটবলার গড়ে তুলতে পারছে না? এমন যদি হয়, তাহলে বুঝতে হবে শুরু হয়ে গেছে ব্রাজিলীয় ফুটবলের দুর্দিন। আর লিওনেল মেসির মতো একজন বিশ্বসেরা ফুটবলারের নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ আক্রমণভাগ নিয়েও আর্জেন্টিনা সামগ্রিকভাবে যে ফুটবল খেলেছে, তাতে আগামী দিনে ইউরোপীয়দের সঙ্গে কতটা এঁটে উঠতে পারবে, সেটাও প্রশ্ন হয়ে ঝুলে আছে। বিশেষ করে জার্মানি যে আগ্রাসী, ছককাটা ও নিখুঁত ফুটবল খেলছে, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সবচেয়ে বড় কথা, লাতিন আমেরিকার ফুটবলের পরম সম্পদ ছিল যে শিল্প, সৌন্দর্য ও রোমান্টিসিজম, সেই ফুটবলটাই তো তারা হারিয়ে ফেলেছে। এটাই যদি হারিয়ে যায়, তাহলে লাতিনরা আর কী নিয়ে গর্ব করবে? তাছাড়া ইউরোপীয় ঘরানার ফুটবল খেলে সাফল্য পাওয়া এত সহজ নয়। সেটা এবার জার্মানরা আবারও হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিয়েছে।                
অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও বিশ্বকাপ ফুটবল সুষ্ঠু, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে আয়োজন করতে পারায় খুবই খুশি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ। তিনি খুশি হতেই পারেন। এটা ছিল তাঁর জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ফুটবল রোমান্টিকরা খুশি হতে পারেনি। খুশি না হওয়ার কারণ এই নয় যে ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয়নি। খুশি না হওয়ার কারণ ফুটবলের দেশ ব্রাজিলেই এক ধরনের অপমৃত্যু হলো লাতিন ঘরানার। এই অনুশোচনার কোনো শেষ নেই।


dulalmahmud@yahoo.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

আমার সাঁতার জীবন-অরুন নন্দী

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ