নিতম্ব দোলানো ক্রিকেট /দুলাল মাহমুদ



ক্রিকেটটাকে আমার কাছে কখনো প্রকৃত খেলা মনে হয়নি। মনে হয়েছে, বিলাসী মানুষের সময় কাটানোর একটি উপলক্ষ। ক্রিকেটের শুরুটাও তো সেই কথাই বলে। সেই ষোড়শ শতাব্দীতে ইংরেজ অভিজাতরা প্রচলন ঘটান ক্রিকেটের। কিছু লোক আয়েশী ভঙ্গিমায় ব্যাট-বল নিয়ে কসরত করতেন। মাঠের বাইরে কিছু লোক তাদের তারিফ করতেন। পরস্পরের পিঠ বুলিয়ে দেওয়া আর কি। পরিবেশটা থাকতো রাজসিক। পরিপাটি পোশাক-আশাক। খাওয়া-দাওয়ার খানদানি আয়োজন। সঙ্গে রঙীন পানীয়। পরিবেশন করতেন ‘চাকর-বাকর’রা। খেলার দিকে নজর কতটা থাকতো বলা মুশকিল। বাউন্ডারি হাঁকালে, উইকেটের পতন ঘটলে কিংবা অর্ধ-শতক, শতক হলে কখনো-সখনো হাততালি দিয়ে উপস্থিত কেউ কেউ নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতেন। দিনের পর দিন চলতো খেলা। সময় নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না। এ নিয়ে কারো কোনো হেলদোলও ছিল না। এতে প্রতিফলন ঘটতো বিলাসী জীবনের। মনোভাবটা ছিল এমন, দেখো, আমরা কত অভিজাত। কতটা উঁচু সম্প্রদায়ের। তোমাদের থেকে আমরা একদমই আলাদা। এই মনোভাব, এই ধারা চলেছে অনেক দিন। পরিবর্তন যে খুব সহজে এসেছে, সেটা বলা যাবে না। পরিবর্তন এসেছে বেশ ধীরে ধীরে। বল কুড়াতে কুড়াতে কিংবা খাওয়া ও পানীয় পরিবেশন করতে করতে থাকা ‘নীচু’ সম্প্রদায়ের লোকেরাও ঘটনাক্রমে জড়িয়ে পড়তে থাকেন ক্রিকেটে। এমনকি সাদাদের কাছে অবহেলিত ও নিগৃহীত কালো ‘অ-মানুষ’রাও ক্রিকেটে সম্পৃত্ত হতে থাকেন। মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ক্রিকেট। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে ইংল্যান্ডের বাইরে ক্রিকেটের প্রসার ঘটে। তবে ১৮৭৭ সালের আগে ক্রিকেট খেলায় খুব একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ থাকতো না। তখন হারজিতটা মুখ্য ছিল না। সে বছর ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে প্রথম টেস্ট অনুষ্ঠিত হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে ওঠে। সাউথ আফ্রিকার পর ১৯২৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট স্ট্যাটাস পেলে ক্রিকেটে দেখা যায় সুর-ছন্দ-সৌন্দর্য। সেটা যতটা না এই খেলার জন্য, তারচেয়ে বেশি ক্যারিবীয়দের জীবনদর্শনের কারণে। তারা জীবনের সঙ্গে ক্রিকেটে মিলিয়ে দেওয়ায় তথাকথিত আভিজাত্য খানিকটা ‘হারালে’ও সাধারণ মানুষের কাছে কিছুটা সমাদার পায়। এরপর নিউজিল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তান টেস্ট স্ট্যাটাস পেলেও খেলাটা ঔপনেবেশিক ঘরানার বাইরে যেতে পারেনি। খুব বেশি লোক খেলাটাকে লুফে নেয়নি। মন্থর গতি, সময়সাপেক্ষ হওয়া আর অধিকাংশ সময়ে ফল অমীমাংসিত থাকার কারণে ক্রিকেট সর্বজনীন খেলা হয়ে ওঠতে পারেনি। এটা অনুধাবন করতে পেরে ষাট দশকে প্রচলন করা হয় সীমিত ওভারের ক্রিকেট। সেটাও সীমাবদ্ধ ছিল ইংল্যান্ডেই। ১৯৭১ সালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে প্রথম ওয়ান ডে ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ক্রিকেট বেশ বদলে যায়। ১৯৭৫ সালে ওয়ান ডে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ শুরু হলে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়। ক্রিকেট হয়ে ওঠতে থাকে রঙিন। আলো ঝলমলে। তবে ১৯৮৩ সালে ভারত বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হলে ক্রিকেটের পালে হাওয়া লাগে। এরসঙ্গে ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠী সম্পৃত্ত হলেও ক্রিকেটবিশ্বের মানচিত্র খুব একটা বাড়েনি। পর্যায়ক্রমে শ্রীলংকা, জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশ যোগ দিলেও টেস্ট ঘরানার দেশের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ১০টি। খেলা হিসেবে বয়স নেহাত কম না হলেও ক্রিকেট নির্দিষ্ট বলয়ের বাইরে যেতে পারেনি। না পারার অন্যতম কারণ, মানুষ খেলার মাঠে যায় আনন্দ, উত্তেজনা ও বিনোদনের জন্য। সেজন্য কিছু সময় হয়তো ব্যয় করা যায়। কিন্তু বলতে গেলে সারা দিন মাঠে বসে ঢিমে তালের একটি খেলা দেখার মতো মন ও মানসিকতা ব্যস্ত এই পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের নেই। এ কারণে গ্রেট ব্রিটেন ও তাদের উপনিবেশ হিসেবে থাকা দেশগুলোতেই কেবল চর্চা হয় ক্রিকেট। ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশ থাকা দেশগুলোতে নিজেদের স্বার্থে যা যা প্রবর্তন করে গিয়েছে, সেই দেশগুলো তা থেকে আর বের হতে পারেনি। না পারার কারণে স্বাধীন ও সার্বভৌম হয়েও সেই দেশগুলো এখনও মন-মানসিকতায় ব্রিটিশ আমলের।
টেস্টের পর ওয়ান ডে চালু করা হলেও ক্রিকেট কিন্তু আবদ্ধ থাকে বাঁধা গণ্ডিতেই। কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। ব্রিটিশরা যেহেতু খেলাটির প্রচলন ও প্রসার ঘটিয়েছে, এ কারণেই তারাই খেলাটিকে জনপ্রিয় করার জন্য বার বার এগিয়ে এসেছে। তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট ও অর্থকড়ির সমাগম বাড়ানোর জন্য ২০০৩ সালে তারা প্রবর্তন করে টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট। সবচে’ বড় কথা, তিন ঘন্টার মধ্যে খেলাটা সম্পন্ন করা যায়। এরফলে সময় যেমন কমেছে, এসেছে গতি ও উত্তেজনা। এতে করে খেলার স্তরে ‘উন্নীত’ হয়েছে ক্রিকেট। কদর বেড়েছে পেশীশক্তিওয়ালা ক্রিকেটারদের। এখন আর শুধু বাউন্ডারি মেরে বাহবা পাওয়া যায় না। নিতম্ব দুলিয়ে বলে বলে ছক্কা হাঁকাতে পারলেই মাঠের রাজা। ক্রিকেটাররা এখন রোমান বীর হারকিউলিস হওয়ার জন্য ওঠে-পড়ে লেগেছেন। দুই হাতে টাকা কামাতে হলে এ ছাড়া তো উপায় নেই। ক্রিকেটবীরদের কারণে দর্শকদের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছে ক্রিকেট। লুফে নিয়েছে স্পনসররাও। কাড়ি কাড়ি টাকা এখন টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে। তবে এরসঙ্গে যোগ হয়েছে চিয়ার-গার্লস। এই বিনোদন-বালিকারা দৈহিক সৌন্দর্য বেশ খানিকটা উন্মুক্ত করে নিতম্ব দুলিয়ে দর্শকদের প্রলুব্ধ করে থাকেন। এখন ক্রিকেটাররা নিতম্ব দুলিয়ে খেলেন। দর্শকরা দোলান। আর চিয়ার-গার্লস-এর কাজই তো নিতম্ব দোলানো। তাই টি-টুয়েন্টিকে নিতম্ব দোলানো ক্রিকেট হিসেবে অভিহিত করলে খুব একটা ভুল হবে না। নিতম্ব না দোলালে এই ক্রিকেটের আকর্ষণ থাকবে না। উত্তেজনা থাকবে না। থাকবে না অর্থের ঝলমলানিও।       

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ফুটবল মাঠের অন্য এক লড়াই

হুট করে এভাবে চলে গেলেন রণজিত দা!

ধবল জোছনার দিনগুলো / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

আমাদের ফুটবলাররা

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

মাটির বিশ্বকাপ মানুষের বিশ্বকাপ

যেন রূপকথার এক নায়ক / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

বাঙালির ফুটবল আবেগ / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

স্বাগতিক ব্রাজিল, ফেলপস আর বোল্টের কথা / দুলাল মাহমুদ