ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ


একটা সময় আমাদের দেশে ক্রীড়া সাংবাদিক বলতে দৈনিক সংবাদপত্রে যারা খেলাধুলার নিউজ কভার করতেন কিংবা ক্রীড়া বিষয়ে লেখালেখি করতেন, তাদেরকেই বুঝানো হতো। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ক্রীড়া সাংবাদিকতার পরিসর বেড়েছে। এখন আর শুধু সংবাদপত্র নয়; টেলিভিশন স্টেশন, ম্যাগাজিন, ওয়েবসাইট কিংবা এ সংক্রান্ত যে কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে মনে করা হয়। উন্নত দেশগুলোতে একজন ক্রীড়া সাংবাদিক যে কোনো একটি নির্দিষ্ট খেলা কভার করে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও সেই ধারা পুরোপুরিভাবে গড়ে ওঠেনি। যদিও ক্রিকেট ও ফুটবলে কেউ কেউ অধিক মনোযোগ দিয়ে থাকেন, তারপরও এখন পর্যন্ত একজন ক্রীড়া সাংবাদিককে হতে হয় সকল কাজের কাজী। এরফলে কোনো সাংবাদিকের পক্ষেই কোনো খেলা পুরোপুরি আয়ত্তে আনা সম্ভব হয় না। এই সেদিন পর্যন্ত ক্রীড়া সাংবাদিকতা তেমন গুরুত্ব পেতো না। এমনকি স্বাধীনতার পরও এ দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতা খুব বেশি উজ্জ্বল ছিল না। পত্র-পত্রিকার সংখ্যা যেমন ছিল সীমিত, তেমনি সাংবাদিকের সংখ্যাও ছিল হাতেগোনা। তাছাড়া খেলাধুলার জন্য পত্রিকার স্পেসও ছিল একদমই অপ্রতুল। কোনো কোনো জনপ্রিয় পত্রিকায় নিয়োগ দেওয়া হতো একজন মাত্র পার্ট-টাইম রিপোর্টার। তাঁকে দিয়েই প্রতিদিনের দেশি-বিদেশি ক্রীড়াঙ্গন কভার করানো হতো।
তবে এই অবস্থা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। এখন খেলাধুলার গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। বেড়েছে পত্র-পত্রিকা, ইলেকট্রোনিক মিডিয়া, ওয়েবসাইটের সংখ্যা। আর ক্রীড়া সাংবাদিকের সংখ্যাও নেহাত মন্দ নয়। একটি দৈনিক পত্রিকায় ১২ জন এবং একটি ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় ১৫ জন ক্রীড়া সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়ার কথা জানা যায়। এক সময় এটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই এখন বাস্তব। এই সংখ্যা আগামীতে নিশ্চয়ই আরো বাড়বে। অতীতে র’য়ে স’য়ে কোনো নিউজ করলেই চলতো। তাড়াহুড়া না করলেও হতো। এখন চুপচাপ বসে থাকার উপায় নেই। ‘ব্রেকিং নিউজ’ দেওয়ার জন্য সবাই কম-বেশি উন্মুখ হয়ে থাকেন। যে কারণে ক্রীড়া সাংবাদিকদের সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হয়। কে কার আগে নিউজ দিতে পারেন, তা নিয়ে চলে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এরফলে পাঠক ও দর্শকরা চোখের পলকেই পেয়ে যান একদম তরতাজা খবর। কিন্তু এর সুফল যেমন আছে, তেমন আছে কুফলও। অনেকেই কোনটা গুরুত্বপূর্ণ আর কোনটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেটা বুঝতে পারেন না। সব নিউজকে মাপেন একই পাল্লায়। এতে করে পাঠক ও দর্শকরা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যান। ক্রিকেটের কোনো কিছু হলেই হলো। তার কভারেজ নিয়ে কাউকে ভাবতে হয় না। সবচেয়ে অবাক লাগে, একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচকে যতটা কভারেজ দেওয়া হয়, একটি প্র্যাকটিশ ম্যাচও তারচেয়ে কম কভারেজ পায় না। এটা কী করে সম্ভব?  জাতীয় পর্যায়ের অন্য খেলাগুলোর ক্রিকেটের কাছাকাছি গুরুত্ব দূরে থাকুক, এমনকি পুরোপুরি উপেক্ষিত হলেও তা নিয়ে কারো কোনো দুশ্চিন্তা দেখা যায় না। অবশ্য আমাদের দেশের ব্যাঙের ছাতার মতো যেভাবে ক্রীড়া ফেডারেশন গড়ে ওঠেছে, সবদিকে সমানভাবে নজর রাখারও উপায় নেই। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের দেশের জনপ্রিয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে দেশের জন্য সাফল্য বয়ে আনা খেলাগুলোও মিডিয়ার সুনজর পায় না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, এখন যারা ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আসেন তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ক্রিকেট। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ক্রিকেট যেহেতু এখন জনপ্রিয়, তারপ্রতি মনোযোগ বেশি থাকবেই। সেটা নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ থাকার কথা নয়। কিন্তু অন্য গুরুত্বপূর্ণ খেলাগুলোর দিকেও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন নয়কি?
বছর ঘুরে আবার এসেছে ২ জুলাই, বিশ্ব ক্রীড়া সাংবাদিক দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে এ দিনটি উদযাপিত হয়ে আসছে। এ দিনটি হতে পারে একটি বছরের ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন। আমরা কতটা এগিয়ে গেলাম কিংবা কতটা পিছিয়ে পড়লাম, তা পরিমাপ করা যেতে পারে এ দিনটিতে। আমাদের ব্যর্থতা-অসফলতা, ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সনাক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কেননা, আমাদের মনে রাখতে হবে, ক্রীড়া সাংবাদিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন ক্রীড়া সাংবাদিক বা ক্রীড়া লেখকের দর্শক ও পাঠকদের কাছে যে কোনো খেলাকে জীবন্ত করে তোলার সামর্থ থাকতে হবে। তিনি খেলাটাকে এমনভাবে তুলে ধরবেন, যাতে পাঠক বা দর্শকরা শুধু তথ্যই নয়, একইসঙ্গে বিনোদনও পেতে পারেন। সেটাই একজন ক্রীড়া সাংবাদিক বা ক্রীড়া লেখকের জীবনে পরম সার্থকতা।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়’ / দুলাল মাহমুদ

অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব-২

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও-২

নেইমারকে নিয়ে কেন এই হাহাকার? দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

আমাদের ফুটবলাররা

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ