আবদুল হামিদ : বর্ণাঢ্য এক ক্রীড়াব্যক্তিত্ব / দুলাল মাহমুদ

কী দিয়ে তার পরিচয় দেব? তিনি এত বেশি পরিচিত যে, তার আর কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন পড়ে না। এক নামেই সবাই তাকে চেনেন। শুধু চেনেন বললে ভুল বলা হবে। সবাই তাকে ভালোবাসেন। তাকে আপন মনে করেন। কোনো কিছু না ভেবে এক কথায় বলা যেতে পারে, তিনি আবদুল হামিদ। আমাদের সবার ‘হামিদ ভাই’। ছোট-বড় সবার কাছেই তিনি এই নামে পরিচিত। বয়সের ব্যবধান এক নিমিষেই ঘুচিয়ে দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন সবার কাছের মানুষ। এরপর কি আর কোনো কিছু বলা বা লেখার প্রয়োজন আছে? এই নামটি কে চেনে না? বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিত মুখ হিসেবে অল্প যে ক’জন ক্রীড়াব্যক্তিত্ব আমাদের চোখে ভেসে ওঠেন, তিনি তাদের অন্যতম। তিনি পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ব্র্যান্ড নেম-এ। এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি ইঞ্চি মাটি তাকে চেনে। চেনে ধুলিকণাও। ক্রীড়াঙ্গন তো বটেই, ক্রীড়াঙ্গনের বাইরেও তিনি সমানভাবে পরিচিত। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছড়ানো তার পরিচয়।
এক সময় খেলেছেন, খেলা ছাড়ার পর খেলা পরিচালনা করেছেন। হয়েছেন ক্রীড়া সংগঠক। ক্রীড়াঙ্গন থেকে তিনি কখনোই দূরে থাকেননি। কোনো না কোনো পরিচয়ে ক্রীড়াঙ্গনকে সরব রেখেছেন তার প্রাঞ্জল ও প্রাণবন্ত উপস্থিতি দিয়ে। ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়াভাষ্যকার হিসেবেও তিনি বিপুলভাবে সমাদৃত ও জনপ্রিয়। এতকিছুর বাইরেও ব্যক্তিগত ক্যারিশমা ও সম্মোহনী ক্ষমতা দিয়ে আলাদা স্থান করে নিয়েছেন তিনি। তিনি যখন হেঁটে যান, পরিচিতরা তো বটেই, এমনকি অপরিচিতরাও তার প্রতি বাড়িয়ে দেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার হাত। আর তার কন্ঠমাধুর্য তো সবাইকেই কম-বেশি আপ্লুত করে।
অনেকগুলো দিন-মাস-বছর পেরিয়ে গেলেও আবদুল হামিদ কিন্তু খুব বেশি বদলাননি। আমাদের আগের প্রজন্ম যেমন তাকে দেখেছেন, আমরাও যেমন দেখছি, আমাদের পরবর্র্তী প্রজন্মও তাকে একই রকম দেখছেন। চিরতরুণ। চিরসবুজ। দেহের বয়স হয়তো বেড়েছে। মনের বয়স একটুও না। অথচ দেখতে দেখতে বেলা তো আর কম হলো না। ১৯৩৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ভারতের নবদ্বীপের নদীয়ায় তার জন্ম। এই ৭৩ বছর বয়সে এখনও তিনি দেদীপ্যমান। উজ্জ্বল। কোনো ক্ষেত্রেই তিনি পিছিয়ে পড়তে রাজি নন। তরুণদের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। সবক্ষেত্রেই তার অবাধ বিচরণ। ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা অনেক দিনের। সেই সম্পর্কটা এখনও অটুট আছে। যদিও এখন আর আগের মত যখন-তখন স্টেডিয়ামপাড়ায় যাওয়া হয় না, তারপরও বুকের গভীরে খেলার মাঠের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসা। এই মাঠই তাকে আলাদাভাবে চিনিয়ে দিয়েছে। পরিচিতি দিয়েছে। দিয়েছে সমাজে প্রতিষ্ঠা। এই মাঠের বন্ধন এড়াবেন কীভাবে?
আবদুল হামিদের খেলাধুলার সূত্রপাত স্কুলে পড়ার সময়। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বুকে খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন এঁকে দেন সুচাঁন্দ বাবু। আমি তখন বর্ধমান টাউন স্কুলে পড়ি। সেটা ১৯৪৮ কি ১৯৪৯ সাল। সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। আমাদের গেম টিচার ছিলেন সুচাঁন্দ বাবু। তিনি আমাদের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। বিকেলে মাঠে যাওয়া ছিল আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক। ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিকস, ক্রিকেট খেলতাম। ফুটবল ও হকিতে খেলতাম গোলকিপার পজিশনে। এ কারণেই ক্রিকেটেরও উইকেটকিপার হই। স্কুল পর্যায়ের খেলায় আমরা অংশ নিতাম। লেখাপড়া, খেলাধুলাসহ নানা বিষয়ে আমাদের স্কুলের সঙ্গে বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। বর্ধমান স্কুলে সাইক্লিং প্রতিযোগিতায় একটি সাধারণ সাইকেল নিয়ে তৃতীয় হওয়ায় আমার বড় ভাই আমাকে একটি ভালো সাইকেল কিনে দিয়েছিলেন। ঢাকা চলে এলেও মাঝে-মধ্যে বর্ধমান স্কুলের হয়ে ফুটবল ও হকি খেলায় অংশ নিতাম।’
দেশ ভাগের পর আবদুল হামিদের পরিবার ঢাকায় চলে আসেন। ঠাঁই গাড়েন গেন্ডারিয়ায়। ১৯৫১ সালে ভর্তি হন গেন্ডারিয়া স্কুলে, নবম শ্রেণীতে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময় খেলাধুলায় গেন্ডারিয়া স্কুলে বেশ সুনাম ছিল। চ্যাম্পিয়ন হতো ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিকসে। ধূপখোলা বা ইস্টএন্ড ক্লাবের মাঠ ছিল আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৫৩ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হই জগন্নাথ কলেজে। এই কলেজে পড়ার সময় আন্তঃকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ফুটবল, ক্রিকেট, অ্যাথলেটিকসে অংশ নিতাম। অ্যাথলেটিকসে আমার ইভেন্ট ছিল ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্ট, লংজাম্প, হাইজাম্প ও হপ-স্টেপ জাম্প। জগন্নাথ কলেজ তখন প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে খেলতো। তাতে আমিও খেলতাম। সেই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন ইকবাল (অধিনায়ক), সুকুমার, খোদা বক্স, এস এ জামান মুক্তা, আবদুল খালেক চৌধুরী, বাদশা প্রমুখ। ১৯৫৬ কি ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ক্রিকেট লীগে খেলেছি।’
১৯৫১ সালে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে তিনি খেলা শুরু করেন। এরপর তিনি এগিয়ে যান ধাপে ধাপে। স্মৃতিতে ডুব দিয়ে তিনি বলেন, ‘ইস্টএন্ড ছিল আমাদের পাড়ার ক্লাব। এ ক্লাবে আমরা মন-প্রাণ দিয়ে খেলতাম। ১৯৫২ কিংবা ১৯৫৩ সালে আমার অধিনায়কত্বে এই ক্লাবটি প্রথম বিভাগে উন্নীত হয়। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এই ক্লাবে খেলি। পরের বছর মৌসুম শুরুর আগে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স আমাকে তাদের হয়ে আইএফএ শীল্ড খেলার জন্য কলকাতা নিয়ে যায়। তারপর থেকে অবশ্য ওয়ান্ডারার্সের হয়ে খেলি। এরপর যোগ দেই ইস্পাহানি ক্লাবের হয়ে। আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে কোনো কোনো টুর্নামেন্ট খেলেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হলো ১৯৫৭ সালে ইস্ট পাকিস্তান হোয়াইট টিমের হয়ে ঢাকায় ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশীপ খেলেছি। যদিও দলের এক নম্বর গোলকিপার ছিলেন সাদেক। ১৯৫৯ সালে আগা খান গোল্ডকাপে শ্রীলংকার সঙ্গে খেলা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। দুর্দান্ত খেলা সত্ত্বেও আমরা ০-১ গোলে হেরে যাই। তাছাড়া ফুটবল লীগে ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে খুব বাজেভাবে হেরেছিলাম। ভিক্টোরিয়ায় তখন ১১ জন মাকরানি ফুটবলার খেলতেন। ১৯৬০ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলে ওয়ান্ডারার্সের হয়ে পুলিশের বিপক্ষে খেলতে গিয়ে আমার ডান হাত ভেঙ্গে যায়। এরপর অবশ্য প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলেছি টুকটাক। আমার ফুটবল জীবনে আমি ইস্টএন্ড ক্লাব থেকে রোমার ঘড়ি, ওয়ান্ডারার্স থেকে সাইকেল এবং ইস্পাহানী ক্লাব থেকে কম হলেও কিছু অর্থ পেয়েছি।’
ভলিবলে আবদুল হামিদ ছিলেন দুরন্ত খেলোয়াড়। ১৯৫৫-৫৬ থেকে ১৯৫৮-৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথম বিভাগ ভলিবল লীগে খেলেছেন ইস্টএন্ড ক্লাবের হয়ে। সে সময় শক্তিশালী দলগুলোর একটি ছিল ইস্টএন্ড। তিনি ইস্ট পাকিস্তান দলের হয়ে খেলেন ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭ সালে পর্যন্ত। তার সহযোগী খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন খন্দকার আবুল হাসান, কানু, মনির, মোহাম্মদ উল্লাহ, আমিন, এখলাক, আইয়ুব, মোস্তফা কামাল প্রমুখ।
খেলোয়াড়ী জীবন শেষে রেফারি ও ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে জড়িয়ে পড়েন তিনি। প্রথম বিভাগ লীগে ফুটবল ও ভলিবল রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে ভলিবলের রেফারি ও পাকিস্তান ভলিবল দলের সহকারী ম্যানেজার ছিলেন। ইস্টএন্ড ক্লাবের ফুটবল ও ভলিবল দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ষাট দশকে তিনি পাকিস্তান ভলিবল ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের ভলিবলের উজ্জ্বল এক অধ্যায়ের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। এই ৮ বছর দায়িত্ব পালন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভলিবল খেলোয়াড় হিসেবে যাদের পরিচিতি ছিল, আমি দায়িত্ব নিয়ে তাদের তরুণ সংগঠক হিসেবে গড়ে তুলি। ভলিবলকে নিয়ে যাই উপজেলা পর্যায়ে। ভলিবলের নিয়মিত আসরগুলো- জাতীয়, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মহানগরী প্রথম বিভাগ লীগ, প্রতি বছর আয়োজন করেছি। একটিবারও বাদ যায়নি। প্রবর্তন করেছি জাতীয় যুব ভলিবল প্রতিযোগিতা। ভলিবল মাঠ ছিল জমজমাট। জনপ্রিয়তাও ছিল তুঙ্গে। জৌলুস ও গ্ল্যামারের কোনো কমতি ছিল না। খেলা দেখার জন্য দর্শকরা টিকিট কেটে লাইন দিয়ে মাঠে ঢুকেছেন। সারা দেশেই ভলিবলের রমরমা ছিল। সে সময় রাশিয়ার কিরঘিজ দল, উজবেকিস্তান দল বাংলাদেশ সফরে এসেছে। বাংলাদেশ দল ব্যাংকক এশিয়ান গেমস, তুরস্কের ইজমিরে প্রথম ইসলামিক সলিডারিটি গেমস, দিল্লিতে নবম এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশ ভলিবল দল সফর করেছে রাশিয়ায়। আমি দু’বার এশিয়ান ভলিবল কনফেডারেশনের পরিচালক নির্বাচিত হই।’
আবদুল হামিদের সব পরিচয় ছাড়িয়ে যায় ধারাভাষ্যকার হিসেবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তার নাম। অনেকেই হয়তো তাকে দেখলে চিনবেন না। যখন শোনেন তিনি আবদুল হামিদ, তখন তাকে চিনতে এক মুহূর্ত সময় লাগে না। ধারাভাষ্যকার হিসেবে মাইক্রোফোন হাতে নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ষাট দশকের গোড়ার দিকে সরাসরি খেলা সম্প্রচারের ক্ষেত্রে রেডিও ছিল একমাত্র মাধ্যম। সে সময় দেশী-বিদেশী দলের খেলার সময় ইংরেজিতে ধারাবিবরণী দেয়াটাই ছিল প্রথা। তবে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দুতে খেলা রিলে করা হতো। আর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা বাংলাভাষী হওয়া সত্ত্বেও ধারাবিবরণীর ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার কোনো গুরুত্ব ছিল না। খেলার বিরতির সময় মিনিট পাঁচেক বাংলায় সংক্ষিপ্ত বিবরণী দেয়া হতো। আমি আগে থেকেই রেডিওতে নাটক বা ফিচারের শিল্পী হিসেবে জড়িত ছিলাম। এছাড়া ক্রীড়াবিদ হিসেবে পরিচিতি তো ছিলই। এই দুয়ের সমন্বয়ের কারণে আমাকে দিয়ে খেলার সংক্ষিপ্ত বিবরণী দেয়ানো হতো। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে পাকিস্তানী ক্রিকেটার আবদুল হাফিজ কারদার, জামশেদ জি মার্কার, কামরুদ্দিন বাটের সঙ্গে ঢাকা স্টেডিয়ামে বসে এই বিবরণী দিতে দিতে আমার মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে। তাছাড়া খেলা চলাকালে আমি নিজে নিজে ধারাবিবরণীর অনুশীলন চালিয়ে যেতাম। এ কারণে আমার আশপাশে যারা থাকতেন, তারা নিশ্চয়ই আমাকে পাগল ঠাওরাতেন। অনেক প্রতীক্ষার পর ১৯৬৩ সালে আগস্টে প্রথববারের মতো বাংলায় ধারাবিবরণী সম্প্রচার করা হয়। আমি ও খ্যাতিমান ক্রীড়াব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ শাহজাহান প্রথম বাংলায় ধারাবিবরণী দেই। সেটি ছিল ঢাকা ফুটবল লীগের খেলা। সেই যে শুরু করি, আজও তা সমান নিষ্ঠা ও ভালোবাসায় চালিয়ে যাচ্ছি। ১৯৬৫ সালের ১৭ থেকে ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা স্টেডিয়ামে শহীদ মেজর ভাট্টি একাদশ এবং স্কোয়াড্রন লিডার আলম একাদশের মধ্যে তিনদিনব্যাপী এক প্রদর্শনী ক্রিকেট খেলার ব্যবস্থা করা হয়। দেশের খ্যাতিমান ক্রিকেটাররা তাতে অংশ নেন। রেডিও থেকে এই খেলার সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। ক্রিকেট খেলার সেই প্রথম বাংলায় ধারাবিবরণী। আমার সঙ্গে ছিলেন তওফিক আজিজ খান। বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন মোহাম্মদ শাহজাহান। রেডিও’র পাশাপাশি টেলিভিশনেও ধারাবিবরণী দিচ্ছি। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় টেলিভিশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে ক্রীড়াবিষয়ক আলোচনা ও উপস্থাপনা করতে থাকি। ১৯৬৬ সালে ঢাকা ফুটবল লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খেলা রেডিও এবং টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। একই সঙ্গে রেডিও এবং টেলিভিশনে ধারাবিবরণী দেই। আগা খান গোল্ডকাপ এবং আরসিডি ফুটবল প্রতিযোগিতার খেলাও দুটো মাধ্যমে চলতি ধারাবিবরণী দিয়েছি। ঢাকার মাঠে পাকিস্তান-ইংল্যান্ড, পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচে ধারাবিবরণী দেয়ারও সৌভাগ্য হয়। খেলার বাইরে চাঁদে যাওয়া তিন নভোচারী ঢাকায় তাদের আগমন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হলে আমি তার ধারাবিবরণী দেই।’ এক সময় তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও রেডিওর সংবাদ পাঠক ছিলেন।
জীবনের স্মরণীয় ঘটনার কোনো কমতি নেই আবদুল হামিদের। তবে যেটি মনে দাগ কেটে আছে, তাহলো- ‘১৯৭০ সালে ব্যাংকক এশিয়ান গেমসে যাই ভলিবলের রেফারি হিসেবে। আমি হোটেলে অবস্থান করছিলাম। একদিন সকালে কয়েকজন কর্মকর্তা এসে আমাকে জানান, হকির ফাইনালে খেলবে পাকিস্তান এবং ভারত। আমি সেই খেলা বাংলায় ধারাবিবরণী দিতে পারবো কিনা। আমি প্রাথমিকভাবে অপ্রস্তুত বোধ করলেও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যাই। উর্দুভাষী ধারাভাষ্যকারদের পাশাপাশি ১৯৭০ সালের ১৯ ডিসেম্বর খেলার দিন বিদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো বাংলায় ধারাবিবরণী দেই। খেলায় রশিদ জুনিয়রের গোলে পাকিস্তান জয়ী হওয়ার মুহূর্তে মাইক্রোফোন ছিল আমার হাতে। তা আমি আবেগময় ভাষায় বর্ণনা করি। সবার কাছে তা সমাদৃত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নেপালে সাফ ফুটবল উপলক্ষে একবার মাত্র সরাসরি ধারাবিবরণী দিয়েছিলাম।’
আবদুল হামিদের অনেক পরিচয়। ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। ইতোমধ্যে এক্ষেত্রে পেরিয়ে এসেছেন অর্ধ-শতাব্দীকাল। শুরুর দিনগুলো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গেন্ডারিয়ায় আমাদের এলাকায় থাকতেন এআইএম তাহা নামের এক ভদ্রলোক। তিনি ছিলেন দৈনিক জেহাদ ও চিত্রাকাশ পত্রিকার প্রকাশক। আমি তখন খেলাধুলা করি। সে সুবাদে আমাকে তিনি চিনতেন। আমাকে তিনি দৈনিক জেহাদ পত্রিকায় খেলাধুলা সংক্রান্ত রিপোর্ট করতে অনুরোধ করেন। আমি তাতে রাজি হয়ে যাই। সে সময় পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন। তিনি ছিলেন ক্রীড়ানুরাগী। তিনি নিজেই আমার রিপোর্ট দেখে দিতেন। এরপর ১৯৬০ সালে আমাকে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় নিয়ে যান খ্যাতিমান সাংবাদিক আবদুল আউয়াল খান। দীর্ঘকাল এই পত্রিকার সঙ্গে আমি সম্পৃত্ত ছিলাম। আমি আজাদে সাপ্তাহিক ক্রীড়া পাতা প্রকাশ করার উদ্যোগ নেই। সেই পাতার মাধ্যমে অনেক তরুণ ক্রীড়া লেখকের আবির্ভাব হয়। তাদের অন্যতম ইকরামউজ্জমান, আজম মাহমুদ, হান্নান খান প্রমুখ। ১৯৮৬ সালে যোগ দেই দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায়। ছিলাম ২০০০ সাল পর্যন্ত। ২০০৩ সাল থেকে আমাদের সময় পত্রিকার ক্রীড়া বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছি।’ প্রায় ৬ বছর যাবৎ তিনি চ্যানেল আইতে আমিনুল ইসলাম রাজুর প্রযোজনায় উপস্থাপনা করে আসছেন ক্রীড়াবিষয়ক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘আই স্পোর্টস’। এছাড়াও উপস্থাপনা করেন ‘স্পোর্টস টাইম’ অনুষ্ঠানের। বাংলাদেশ টেলিভিশনে উপস্থাপনা করেছেন ‘স্বনামধন্য’ নামে একটি ম্যাগাজিনের।
পঞ্চাশ ও ষাট দশকের ক্রীড়া সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তখন তো পত্র-পত্রিকায় খেলাধুলার খুব বেশি গুরুত্ব ছিল না। পত্রিকা ছিল সীমিত। ক্রীড়া সাংবাদিকতা যে আলাদা কোনো বিষয়, এটা অনুভূত হতো না। হাতে গোনা ক্রীড়া সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন এ বি এম মূসা, আবদুল আউয়াল খান, কামাল লোহানী, ডেভিডশন, আনিসুল মওলা, মিজানুর রহমান প্রমুখ। আর এখন তো অনেক ব্যাপ্তি ও প্রসার ঘটেছে ক্রীড়া সাংবাদিকতার। তার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আমাকেও শিখতে হয়েছে কম্পিউাটারে। এখন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করে যাচ্ছি।’
তিনি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ভলিবল দলের রাশিয়া সফরে লিডার অব দ্য ডেলিগেট, ১৯৮০ সালে তুরস্কের ইজমিরে প্রথম ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে বাংলাদেশ ভলিবল দলের ম্যানেজার, ১৯৯৪ সালে কানাডার ভিক্টোরিয়ায় কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশ দলের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন।
তিনি সার্বক্ষণিকভাবে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। ১৯৬০ সালে যোগ দেন। ২৭ বছর চাকরি করার পর ১৯৮৮ সালে আল বারাকা ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৩ বছর।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি গঠিত হলে তিনি ছিলেন তার সভাপতি। ১৯৭৩ সালে প্রকাশ করেন মাসিক ক্রীড়া পত্রিকা ‘খেলাধুলা’। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ ফুটবল রেফারি সমিতির আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ জনসংযোগ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, পাক্ষিক ক্রীড়াজগত পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর প্রাক্তন সদস্য, সোনালী অতীত ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
কয়েকদিনের জন্য ছিলেন বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব। ‘বাংলায় ধারাবিবরণী/ধারাবিবরণীতে বাংলা’ নামে তার একটি গ্রন্থ ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ বেতার প্রকাশিত বেতার বাংলার বেতারব্যক্তিত্ব সম্মাননা লাভ, ১৯৭৯ সালে ভলিবলে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে কাজী মাহবুবউল্লাহ ও জেবুন্নেসা স্বর্ণপদক, ২০০৩ সালে ক্রীড়া সাংবাদিকতায় একুশে পদক পান।
জীবন ও ক্রীড়াক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য তিনি মাতা মোসাম্মৎ বেলেজান বিবি ও বড় ভাই আবদুল ওয়াহেদের অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। তার অনুজ দুই ভাই আবদুল তৌহিদ ও আবদুল সাঈদ ক্রীড়াবিদ হিসেবেও পরিচিত। স্ত্রী সাহেরা হামিদ তার অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি এক পুত্র আবদুল কাইয়ুম ও এক কন্যা নাসিমা শাহরীনের জনক।
আবদুল হামিদ দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে ক্রীড়াচর্চার ক্ষেত্রে মন্দাভাব দেখা দেয়ায় সমাজে অবক্ষয় বেড়েছে। কিশোর, তরুণ, যুবকদের সঙ্গে খেলার মাঠের যোগাযোগ দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। এটা মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। খেলাধুলাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। এখন তো নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়া সংগঠকদের দারুণ অভাব। ফেডারেশনগুলোতে খুব বেশি দক্ষ ও যোগ্য লোকদের দেখা যাচ্ছে না। কোথাও যেন একটা আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। প্রবীণ ক্রীড়াবিদদের মর্যাদা দেয়া হয় না। একদিন জাতীয় পুরস্কার দিয়েই আর কোনো খোঁজ-খবর নেয়া হয় না। এমনকি খেলা দেখার জন্য কোনো আমন্ত্রণ পর্যন্ত দেয়া হয় না। রাশিয়া সফরে দেখেছি, পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদের কী সম্মান!’ তবে তিনি মনে করেন, ‘খেলাধুলা আগের তুলনায় টেকনিক্যালি অনেক উন্নত হয়েছে। স্পোর্টস সাইন্স, স্পোর্টস মেডিসিন ক্রীড়াঙ্গনকে অনেক বেশি বদলে দিয়েছে। আমাদের সময় এমন সুযোগ-সুবিধার কথা কল্পনাও করা যেত না।’
আবদুল হামিদের বড় গুণ সবাইকে তিনি মুহূর্তের মধ্যে আপন করে নিতে পারেন। নতুনদের কাছে তিনি পরম এক আশ্রয়। যারা তার কাছে গেছেন কিংবা কাছাকাছি হয়েছেন, তারা জানেন তিনি অনেকটা বটবৃক্ষের মতো। বাবা, ভাই কিংবা বন্ধুর মতো করে যে কাউকে তিনি সস্নেহে বুকে টেনে নেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা জোগান। তার এই সহজাত স্নেহ ও ভালোবাসাটুকু একজন তরুণকে অনেক বড় স্বপ্ন দেখায়। তরুণদের বুকে স্বপ্নের দীপ জ্বেলে দিতে পারেন- এমন ব্যক্তিত্বের সংখ্যা ক্রীড়াঙ্গনে একদমই অপ্রতুল। ব্যতিক্রমদের একজন আবদুল হামিদ। #
১৬-৬-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ

অ্যাথলেটিকসের উজ্জ্বল মুখ মীর শরীফ হাসান/ দুলাল মাহমুদ

বাস্কেটবলের বুলবুল/ দুলাল মাহমুদ