মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান। একটি নাম। একটি বর্ণিল ইতিহাস। এই নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক না-বলা কথা। এদেশের ক্রীড়াঙ্গন যাদের মাধ্যমে পল্লবিত হয়েছে, তিনি তাদের একজন। ক্রীড়াবিদ হিসেবে যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনিভাবে কালের করতলে সমুজ্জ্বল আছেন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবেও। এদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতা যাদের হাত ধরে আলোকিত হয়েছে, তিনি তাদের অন্যতম। তবে ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে রূপে-রসে-রঙে বর্ণিল করে তুলতে তার ছিল নিরলস ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিতের ওপর দাঁড় করাতে তিনি কখনো আপোষ করেননি। যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে। ক্রীড়া সাংবাদিকতায় তিনি পরিণত হয়েছেন মহীরুহে।
বর্ণাঢ্য এক জীবন মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের। ক্রীড়াঙ্গনে সবার কাছে তিনি পরিচিত ‘জামান ভাই’ হিসেবে। সবারই খুব কাছের মানুষ। তিনি তার ক্যারিশমা দিয়ে নিজের আলাদা একটা অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হন। অবশ্য একদিনেই তা গড়ে ওঠেনি। খেলার মাঠের আলো-হাওয়ায় তিনি বেড়ে উঠেছেন। দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। খেলা ছাড়ার পর খেলার মাঠের সঙ্গে সম্পর্কটা কখনো আলগা হতে দেননি। বরং সম্পর্কের বুননটা করেছেন সুদৃঢ়। ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে তিনি যে আলোকোজ্জ্বল জীবনযাপন করেছেন, তেমনটি বিরল ও ব্যতিক্রমধর্মী। আর্থিক বৈভব বা প্রতিপত্তি হয়তো তিনি পাননি, আসলে তা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাননি; তবে পেয়েছেন কম-বেশি সবারই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। ক্রীড়াঙ্গনকেই তিনি ভেবে এসেছেন তার ঘর-সংসার। এর বাইরে একটি কদমও ফেলার কথা তিনি চিন্তা করেননি। ক্রীড়াঙ্গন ও ক্রীড়াবিদদের নিয়ে পার করে দিয়েছেন জীবনের উজ্জ্বল দিনগুলো। এ জীবনে কতজনকে নিয়ে লিখেছেন- তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু নিজের জীবনকে কখনো কারো কলমের উপাদান হতে দেননি।
১৯৪০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের জন্ম। তবে তাকে ‘ঢাকাইয়া’ বললে অত্যুক্তি হবে না। ১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সেই যে ঢাকায় থিতু হন, তারপর থেকে আছেন একই ঠিকানায়। তার পরিচয় পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে। এ শহরেই তার শিকড়-বাকড় ছড়ানো। তার অস্থি-মজ্জায় মিশে আছে এই নগরের জল-হাওয়া। দূর শৈশবে এই নগরে যখন পা রাখেন, তখন বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহরটার খুব বেশি বিস্তার ছিল না। গায়ে-গতরে একটু একটু করে বাড়ছিল। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে তার খুব বেশি সময় লাগেনি। বনেদি স্কুলের ছাত্র হওয়ার পর বাড়ন্ত ঢাকা শহরের সঙ্গে নিজেকে অনায়াসে মিশিয়ে ফেলেন। এর মধ্যে ছয়টি দশক পেরিয়ে গেলেও সেই দিনগুলো তার বুকে এখনও টাটকা স্মৃতি হয়ে আছে : ‘ঢাকা তখন ছিল শান্ত ও নিরিবিলি একটি শহর। যা কিছু কলরব, পুরান ঢাকাকে কেন্দ্র করে। এই এলাকায় ঠাঁই গাড়ার পর থেকে এ শহরের স্পন্দনটুকু আমি অনুভব করতে পারি। বছরের শেষ দিক হওয়ায় তিন মাসের জন্য পগোস স্কুলের ছাত্র ছিলাম। ১৯৫০ সাল থেকে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র। স্কুলের সামনে ছিল ছোট্ট একটি মাঠ। অবশ্য এই ছোট মাঠটুকুতে খেলেই উঠে এসেছেন অনেক খেলোয়াড়। ক্রীড়াব্যক্তিত্ব কাজী আবদুল আলীম ছিলেন আমাদের স্কুলের বিখ্যাত ছাত্র। আমাদের গেম টিচার ছিলেন কামিনী মোহন দাস। তিনি ছিলেন দুর্দান্ত মোটিভেটর। খেলায় সাফল্য পাওয়ার জন্য ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করতেন। তাছাড়া স্কুল কিংবা কোনো ছাত্র সাফল্য পেলে প্রধান শিক্ষক মাহমুদ, শাহাবুদ্দিন, বজলে কাদের স্যার উদ্দীপনামূলক বক্তব্য দিতেন। তাতে সবার মধ্যে ভালো কিছু করার ইচ্ছা জাগ্রত হতো। সে সময় আমরা মূলত হকি, ফুটবল, ক্রিকেট খেলতাম। আমাদের সমসাময়িক ছিলেন কাজী আবদুল মোমিন, রাসবিহারী, ডিএস ইসলাম, সানাউল্লাহ, নিতাই প্রমুখ। এঁদের সঙ্গে খেলতাম কিংবা অনুশীলন করতাম। এভাবেই খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক চাপে। তবে স্কুল ছাত্র মঞ্জুর হাসান মিন্টু ছিলেন আমার বিশেষ অনুপ্রেরণা। সেই বয়সেই তার স্টাইল আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়।’
প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়ায় তার অংশগ্রহণ ইন্টার স্কুলের মাধ্যমে। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময় ফুটবল, ক্রিকেট, হকি চুটিয়ে খেলেছি। এক সময় আমার ‘ফার্স্ট লাভ’ ছিল হকি। ঢাকা লীগে আমি প্রথম খেলি হকি। সে হয়ে আছে মজার এক অভিজ্ঞতা। ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে প্রথম বিভাগ হকি লীগে খেলা হয় ফায়ার সার্ভিস এবং রমনা রোভার্সের মধ্যে। সে খেলায় আমি ছিলাম দর্শক। ফায়ার সার্ভিস তখন শক্তিশালী দল। তারা ৯ জন খেলোয়াড় নিয়েও খেলায় ৪-০ গোলে এগিয়ে ছিল। আমি যে হকি খেলতাম, সেখানে উপস্থিত হাবিব নামে একজন জানতেন। তিনি ফায়ার সার্ভিস দলের খেলোয়াড় খাজা জহিরকে তা জানালে তিনি আমাকে ফরোয়ার্ডে খেলতে নামিয়ে দেন। আমি ১৫ মিনিটের মধ্যে হ্যাটট্রিক করি। খেলায় আমরা ৯-১ গোলে জয়ী হয়েছিলাম। এরপর অবশ্য আমার লীগ খেলার সুযোগ হয়নি। তখন হকির মান ছিল উন্নত। কলকাতার রিফিউজি খেলোয়াড়রা এসে বিভিন্ন দলে স্থান করে নেন। দলে সুযোগ পাওয়া ছিল কঠিন। হকি আমার প্রিয় খেলা হওয়া সত্ত্বেও আর খেলতে পারিনি। একবার পায়ে স্টিক লেগে তিন দিন বাসায় আটকে থাকতে হয়। এ কারণে আব্বা আমাকে হকি খেলতে বারণ করে দেন। যে জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও হকির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলতে হয়। হকিতে সে সময় আলোচিত খেলোয়াড় ছিলেন আসলাম, কাইফুল, ইউসুফ পাঠান, তওফিক প্রমুখ। এঁরা আমার সিনিয়র ছিলেন। খেলতেন ইস্ট পাকিস্তান টিমে।’
১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় তিনি ফুটবল, ক্রিকেটে ইন্টার কলেজের হয়ে খেলেন। সে সময়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘১৯৫৭-৫৮ সালে ইন্টার কলেজ ক্রিকেট ফাইনালে চিটাগাং কমার্স কলেজের সঙ্গে আমাদের খেলা। জগন্নাথ কলেজের হয়ে আজাদের ১০ জন এবং ন্যাশনাল স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে একমাত্র আমি সুযোগ পাই। আমরা চ্যাম্পিয়ন হই। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫৭ রান করি। আমাদের দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন আলাউদ্দিন (অধিনায়ক), মাহবুব, মোহাম্মদ আলী, খোকন, আরশাদ, সিরাজুর রহমান মনি প্রমুখ। চিটাগাং কলেজের হয়ে খেলেন রাশেদ আজগর চৌধুরী, বাকের, আনোয়ারুল ইসলাম ববি। ফুটবলে জগন্নাথ কলেজ ছিল অনেক শক্তিশালী। আমি যে ক’বছর খেলি, তার মধ্যে আমাদের কলেজ এফ রহমান শীল্ড ২ বার এবং স্যার ফিরোজ খান নূন ইন্টার কলেজ লীগে ২ বার চ্যাম্পিয়ন হয়। আমাদের দলে খেলতেন মারী, হাবিব, গৌর, জলিল আনসারী, জাকারিয়া পিন্টু, জিয়া, মাহি, জাকের, শাম্মী খান, অরুণ চাকমা, সাদেক (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল) প্রমুখ।’
মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের অন্যতম এক কীর্তি ন্যাশনাল স্পোর্র্টিং ক্লাব। তাঁতিবাজারের বন্ধুরা মিলে এই ক্লাবটি গড়ে তোলেন। মূলত ক্রিকেট খেলার জন্য ১৯৫০ সালে এই ক্লাবের যাত্রা শুরু হয়। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে আমরা বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতাম। তখন তো মাঠ ও ক্লাবের কোনো কমতি ছিল না। ১৯৫৫ সালে হঠাৎ করে আমরা প্রথম বিভাগে ক্রিকেট লীগ খেলার সুযোগ পেয়ে যাই। দেশভাগের কারণে হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করায় একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এ কারণে একটা সংকট দেখা দেয়। তা নিরসনে জরুরী ভিত্তিতে একটা উদ্যোগ নেয়া হয়। সে কারণে সে বছর ন্যাশনাল স্পোর্টিং, ব্রাদার্স ইউনিয়ন, বকশীবাজার ক্লাব, আজাদ বয়েজ ক্লাবকে সরাসরি প্রথম বিভাগ লীগে খেলার সুযোগ দেয়া হয়। ১৯৭৪ সালে আমরা লীগে যুগ্মভাবে রানার্সআপ হই। ১৯৮০-৮১ সাল পর্যন্ত আমরা প্রথম বিভাগ লীগে খেলেছি। ন্যাশনাল স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ১৯৫৬ সালে তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লীগে আমরা অংশ নেই। ১৯৫৬, ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে আমরা লীগে রানার্সআপ হই। ১৯৫৬ সালে পল্টন গ্রীন চ্যাম্পিয়ন হলেও আমরা সে মৌসুমে ৯১ গোল দেই। আমাদের দলের মাহবুব মওলা একাই দেন ৪১ গোল। এ দলটি ছিল আমাদের প্রাণ। অন্তর দিয়ে ভালোবাসতাম। এ ক্লাবের জন্য নিজের অনেক প্রাপ্তি বিসর্জন দিতে একটুও দ্বিধা করিনি। আমি ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে না থাকা সত্ত্বেও সবাই ভাবতেন ক্লাবটা বুঝি আমার। আমরা বন্ধুরা মিলে অর্থ দিয়ে ও সাংগঠনিকভাবে দলটি চালাতাম। এরপর অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ক্লাবটি আর চালানো সম্ভব হয়নি। এই ক্লাবের মাধ্যমে উঠে এসেছেন অনেক ক্রীড়াবিদ। ক্লাবটির চলার পথ থেমে যাওয়ায় জীবনে বড় একটি দুঃখ পেয়েছিলাম।’ কামরুজ্জামান ১৯৫৫ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল স্পোর্টিং ক্লাবের ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন। এরপরও তিনি মাঝেমধ্যে অধিনায়কত্ব করেন।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তার রয়েছে অনেক কৃতিত্ব। তিনি টু ডাউনে ব্যাট করতেন। ছিলেন মিডিয়াম পেসার। ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্টএন্ডের বিপক্ষে ১০১, ১৯৭৭ সালে উদিতির বিপক্ষে অপরাজিত ১০৩ রান করেন। ১৯৭৪ সালে ব্যাটিং গড়ে তিনি ছিলেন শীর্ষে। ঢাকা লীগে তিনি ৫০টিরও বেশি ফিফটি করেন। তবে ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস হিসেবে তিনি মোহামেডানের বিপক্ষে ৮০ রানকে এগিয়ে রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মোহামেডান তখন দুর্ধর্ষ টিম। পেস অ্যাটাকে ছিলেন সোহরাব, সিনিয়র লতিফ, স্পিনার ইব্রাহীম। সে সময় তারা ছিলেন সবার আদর্শ। এমন বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে সেদিন আমি হাত খুলে খেলেছিলাম। খেলে বেশ আনন্দ পাই। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ইস্ট পাকিস্তান টিমের ট্রায়ালে একাধিকবার সুযোগ পেয়েও অংশ নেইনি। আমার কাছে ন্যাশনাল স্পোর্টিং ক্লাব তখন ‘দ্বিতীয় নিকেতন’ হিসেবে বিবেচিত। এই ক্লাবকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো কিছু চিন্তা করতে পারতাম না। আমি ক্যাম্পে যোগ দিলে ক্লাবের ক্ষতি হতো। এ কারণে আমার কাছে বেশি গুরুত্ব পায় ন্যাশনাল স্পোর্টিং ক্লাব। এই ক্লাবের জন্য আমার যে কোনো ব্যক্তিগত ক্ষতি মেনে নিতে দ্বিধা করিনি।’
ফুটবল ক্যারিয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৫৯ সালে কামাল স্পোর্টিং হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লীগের হয়ে খেলা শুরু করি। যদিও সে বছর আমাকে প্রথম বিভাগে ফায়ার সার্ভিস দলের হয়ে খেলার জন্য সাহেব আলী ভাই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি কামাল স্পোর্টিং ক্লাবেই খেলি। পরের বছর যোগ দেই ফায়ার সার্ভিসে। আমার দেয়া গোলে আমরা আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবকে হারাই। এ ম্যাচের পর তারা আমাকে তাদের দলে খেলার প্রস্তাব দেয়। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আজাদের হয়ে খেলি। ১৯৬৫ সালে আমি ছিলাম আজাদের অধিনায়ক। এর মধ্যে অবশ্য ১৯৬৪ সালে খেলেছি ফায়ার সার্ভিসে। ১৯৬৪ সালে আমরা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে হারাই। খেলায় আমরা ০-২ গোলে পিছিয়ে ছিলাম। এরপর আমি একটি গোল করে ব্যবধান কমাই। ওবায়েদ (পরবর্র্তীকালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সহ-সভাপতি ও কর্র্নেল) খেলায় সমতা আনেন। জয়সূচক গোলটি করি আমি। মোহামেডানে খেলতেন কলকাতার রহমতউল্লাহ, এএন খান। ফায়ার সার্ভিসও বেশ শক্তিশালী ছিল। খেলতেন হাফিজ, ওবায়েদ, মুনীর, মজিদ, সীতাংশু, মজিবর (কালে খান), বরিস, জলিল আনসারী, গাউস, সামাদ (নরসিংদী) প্রমুখ। ১৯৬৩ সালে ইপিজে প্রেসের বিপক্ষে আমি ঢাকা লীগের প্রথম হ্যাটট্রিক করি।’
কামরুজ্জামান ১৯৬০ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। তিনি ছিলেন এফএইচ হলের ছাত্র। ইন্টার ডিপার্টমেন্ট, ইন্টার হল, ইন্টার ইউনিভার্সিটি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ফুটবলে আমাদের বিভাগের ছিল একচেটিয়া আধিপত্য। ১৯৬৩ সালে ন্যাশনাল ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপে আমি ছিলাম ইস্ট পাকিস্তান কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটি টিমের অধিনায়ক। ফাইনালে আমাদের দল রেলওয়ের কাছে ১-৩ গোলে হেরে যায়। খেলায় মুকুল হ্যাটট্রিক করেন। রেলওয়ের ম্যাকওয়া অসাধারণ খেলেন। সেই ম্যাচে পায়ে আঘাত পান ম্যাকওয়া। এরপর আর তার ফুটবল খেলা হয়নি। ১৯৬০ সালে ইন্টার ইউনিভার্সিটি ফুটবলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে ফাইনাল খেলা। রাজশাহীর অধিনায়ক ও গোলকিপার ছিলেন জাফর ইমাম। খেলার ১০ মিনিটের মধ্যে আমি গোল করি। দ্বিতীয় গোল করেন কামরুল ইসলাম। ১৯৬৩ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ছে। রাজশাহীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে খেলা। সামছুর বিতর্কিত গোলে আমরা পিছিয়ে পড়ি। এ অবস্থায় খেলা ভন্ডুল হওয়ার উপক্রম হয়। অতীতেও দু’দলের খেলায় এমনটি হয়েছে। আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলের অধিনায়ক। আমি খেলা চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। খেলা শেষে রানার্সআপ ট্রফি নেয়ার সময় আমি সবচেয়ে বেশি হাততালি পাই। সবাই আমার খেলোয়াড়ী মনোভাবের প্রশংসা করেন। আমি বরাবরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলাটাকে গুরুত্ব দিয়েছি। ১৯৬৩ সালে আগা খান গোল্ডকাপে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব আমাকে তাদের হয়ে খেলার জন্য বেশ জোরাজুরি করে। কিন্তু আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলার জন্য অটল থাকি।’ কামরুজ্জামান ১৯৬৪ সালে ফুটবলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ব্লু’ এবং এফএইচ হল থেকে ক্রিকেটে ‘ব্লু’ লাভ করেন।
১৯৯৪ সালে তিনি ভারতের হায়দ্রাবাদে সার্ক মিডিয়া ক্রিকেটে অংশগ্রহণকারী জাতীয় প্রেসক্লাব দলের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য ছিলেন। তার বয়স তখন ৫৬। সে বয়সেও তিনি প্রথম ম্যাচে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩০, দ্বিতীয় ম্যাচে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৮, তৃতীয় ম্যাচে অপরাজিত ১২ রান করেন এবং চতুর্থ ম্যাচে তার বোলিং ফিগার ছিল ৬-১-১৪-৬। এই বোলিংয়ের দরুণ তিনি ভারতের বিরুদ্ধে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ পুরস্কার পান।
বাবা মুহাম্মদ আয়াজউদ্দিন ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি। চার বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে কামরুজ্জামান ছিলেন চতুর্থ। বাবা চাইতেন, একমাত্র ছেলে তার মতো আইন পেশায় প্রতিপত্তি অর্জন করুক। কিন্তু ছেলের দেহ-মনে খেলাধুলাটা এমনভাবে মিশে যায় যে, এটা ছেড়ে অন্য কিছু করার কথা ভাবতেও পারেননি। অবশ্য পিতার কথা কিছুটা রেখেছেন। পরবর্তীকালে এলএলবি পাস করেন। তবে আদালত চত্বরে নিয়মিত যাওয়া হয়নি।
খেলার মাঠ তাকে বরাবরই সম্মোহিত করে রাখে। তার অন্তরজুড়ে খেলা, খেলোয়াড় আর খেলার মাঠ। তাদের নেশা থেকে কখনোই তিনি দূরে থাকেননি। অল্প বয়সেই ক্রীড়া সাংবাদিকতার একটা হাতছানি বুকের মধ্যে অনুভব করতেন। সেই কৈশোরে বোধ করি তাতে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। ক্ষুদে ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে হাতেখড়ি হয় স্কুলে থাকতেই। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ক্লাস নাইনে পড়ার সময় আমরা বন্ধুরা মিলে ‘কিশোর’ নামে একটি দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করতাম। পত্রিকাটি ছিল ক্রীড়াবিষয়ক। দেশ-বিদেশের ক্রীড়াবিষয়ক নানা খবরে পরিপূর্ণ থাকতো পত্রিকাটি। বের হতো প্রতি সপ্তাহে। পত্রিকাটি বেশ সাড়া জাগায়। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার অভ্যাস। অষ্টম শ্রেণী থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্কোরকার্ড পড়তে যেতাম। তখন থেকে হয়তো মনের অজান্তে ক্রীড়া সাংবাদিকতার বীজ বুকের গভীরে বপন হয়ে যায়- যা পরবর্তীকালে আমাকে এই পেশা বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করে।’
তবে কামরুজ্জামানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রীড়া সাংবাদিকতায় আনেন ক্রিকেট রূপকথার নায়ক ফ্র্যাঙ্ক ওরেল। ১৯৬৭ সালে ক্যারিবীয় ক্রিকেটের অতুল ঐশ্বর্যের এই জাদুকর পরলোকগমন করলে তার বুকের মধ্যে তোলপাড় হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাকে নিয়ে আমি ‘মর্নিং নিউজ’ ও ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় লিখলে তা প্রকাশিত হয়। আমি তা দেখিনি। পরে জানতে পেরে পত্রিকা সংগ্রহের জন্য আমার বন্ধু আনিস আমাকে নিয়ে যায় ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায়। বোধ করি আমার নিয়তি আমাকে টেনে নিয়ে যায়। পত্রিকা অফিসে যাবার পর পরিচয় হয় বিশিষ্ট সাংবাদিক ফজলুল করিমের সঙ্গে। তিনি আমার লেখার প্রশংসা করেন। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেন। আমি বোধ হয় একটু গড়িমসি করেছিলাম। আমার বন্ধু আনিস আমাকে যোগ দেয়ার জন্য চাপ দিলে আমি রাজি হয়ে যাই। দু’দিন কাজ করার পর তৃতীয় দিন আমাকে নিয়োগপত্র দেয়া হয়। সেদিনটি ছিল ১৯৬৭ সালের ২৭ আগস্ট। সেই যে ক্রীড়া সাংবাদিকতায় বাধা পড়ে যাই, তার নেশা আর কাটিয়ে উঠতে পারিনি।’ সে সময়কার ক্রীড়া সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তখন পূর্ণকালীন ক্রীড়া সাংবাদিক ছিলেন একদমই হাতেগোনা। খন্ডকালীন হিসেবে একজন একই সঙ্গে তিনটি পত্রিকায় কাজ করতেন। তার মধ্যে দৈনিক পাকিস্তানও ছিল। আমি চাকরিতে যোগ দেয়ার পর খেলার নিউজ বেশি বেশি ছাপানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতাম। এ নিয়ে মনোমালিন্য হওয়ায় ২/৩ বার রিজাইন করতে চেয়েছি। তবে আস্তে আস্তে আমি আমার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। আমি শুরু থেকেই আলাদা কিছু করার চেষ্টা করেছি। খেলা শেষে অধিনায়ক কিংবা অন্য কারো মন্তব্য নিয়ে রিপোর্টের শেষে জুড়ে দিতাম। তখন এই চল ছিল না। আমাকে উৎসাহিত করতেন পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। এছাড়া সহকর্মী তোয়াব খান, ফওজুল করিম, হেদায়েত হোসেন মোরশেদ প্রমুখের প্রশংসা পেয়েছি। ১৯৬৮ সালে আমরাই প্রথম খেলার নিউজ দিয়ে পুরো পৃষ্ঠা প্রকাশ করি। সে বছরই ঢাকায় পাকিস্তান ন্যাশনাল গেমসকে কেন্দ্র করে প্রথম ২ পৃষ্ঠার ক্রীড়াবিষয়ক কোনো সাপ্লিমেন্ট বের করি। মেক্সিকো অলিম্পিক উপলক্ষে বের করি ১৬ পৃষ্ঠার সাপ্লিমেন্ট। সে সময় তো খুব বেশি ক্রীড়া লেখক ছিলেন না। আমাকেই বেশিরভাগ লিখতে হতো। তখন দু’হাত ভরে লিখতে পারতাম। এই অলিম্পিক সাপ্লিমেন্টেই প্রথম লেখেন আমার বন্ধু আতাউল হক মল্লিক। পাকিস্তান আমলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের খেলাধুলার বিষয়টি আমরা বেশি গুরুত্ব দিতাম। এ কারণে ১৯৬৯ সাল আমাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।’
মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের আরেকটি পরিচয় অনেকটা আড়াল হয়ে আছে। ক্রীড়াবিষয়ক গ্রন্থের সংগ্রাহক হিসেবে তার জুড়ি মেলা ভার। ক্রীড়াবিষয়ক গ্রন্থ, ম্যাগাজিন, স্যুভেনির কিংবা ক্রীড়াবিষয়ক যা কিছু প্রকাশনা- তার এক বিশাল ভান্ডার তিনি গড়ে তুলেছেন নীরবে-নিভৃতে। যা আর কারো কাছে নেই। মনে করা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান, এমনকি সেই ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চলের ক্রীড়াবিদদের যা কিছু তথ্য ও ছবি কেবল তারই কাছে সংরক্ষিত আছে। পুরনো কোনো ক্রীড়াবিদের সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তাদের অধিকাংশেরই কাছে কোনো ছবি ও পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না। তখন তাদের একটাই বক্তব্য, ‘কামরুজ্জামান জানেন কিংবা তার কাছে ছবি আছে’। অনেক ক্রীড়াবিদের আস্থা ও ভালোবাসার ঠিকানা তিনি। এই সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সেও তার এ বিষয়ে কোনো ক্লান্তি নেই। কোথাও কোনো বই, ম্যাগাজিন বা তথ্য'র খোঁজ পেলে এখনও তার সন্ধানে একটুও পিছুপা হন না। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার বইয়ের প্রতি ঝোঁক। শুরুতে সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ ছিল। তখন থেকেই বই কালেকশন করে আসছি। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার পর অনেক মূল্যবান বই-পত্রিকা সংগ্রহ করি। সে সময় সস্তায় বই-পত্র পাওয়া যেত। রাস্তায় বের হলে টুকটাক যা পেতাম, তা আমি কিনে নিতাম। তবে ১৯৫২ সাল পুরোপুরিভাবে ক্রীড়াবিষয়ক বই সংগ্রহের প্রতি ঝুঁকে পড়ি। সে সময় আমার দুর্লভ সংগ্রহের মধ্যে স্থান পায় রণজিত সিংজির ‘জুবিলি বুক অফ ক্রিকেট’। কাছে কিংবা দূরে যারাই বিদেশে গেছেন, তাদের মাধ্যমে বই-পত্র সংগ্রহ করেছি। আবার কেউ কেউ ভালোবেসে আমার জন্য বই-পত্র নিয়ে এসেছেন। তবে যেখানেই গেছি, বই কিনেছি। এ ব্যাপারে আমি কোনো সমঝোতা করিনি। এমনও হয়েছে, পকেটে পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা নেই, ৪/৫ মাইল পথ হেঁটে বই কিংবা ম্যাগাজিন সংগ্রহ করেছি। আমার জীবনে এমনিতে কোনো নেশা নেই। বই বা ম্যাগাজিন কেনা বা সংগ্রহ করাই আমার কাছে এক ধরনের নেশা।’
কামরুজ্জামান অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা ও ভালোবাসায় গড়ে তুলেছেন তার বিশাল সংগ্রহ। এই সংগ্রহের মধ্যে আছে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস। কিন্তু তার এই সংগ্রহটাকে কোনো কাজে লাগানো হয়নি। এই সংগ্রহ গড়ে তোলার পাশাপাশি গত ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি প্রচুর লিখেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস লেখার জন্য তার লেখাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তার লেখাগুলোকে গ্রন্থবদ্ধ করা হলে সমৃদ্ধ হতে পারতো বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
কামরুজ্জামান পেশাগত জীবনে ১৯৭২ সালে ভারতের কলকাতায় অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ড-ভারত টেস্ট, ১৯৯৪ সালে শ্রীলংকায় সিঙ্গার কাপ এবং ২০০৪ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ সাফ গেমস কভার করেছেন। ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সাংবাদিক ছাড়াও প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবেও বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছেন তিনি। ১৯৫০ সাল থেকে ঢাকার মাঠে অনুষ্ঠিত সব ধরনের খেলাই দেখেছেন। মস্তিষ্কের নিউরনে সাজিয়ে রাখা সেই স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা তিনি গত এক দশক ধরে বয়ান করে চলেছেন পাক্ষিক ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার ‘মাঠ-গ্যালারী-স্টেডিয়াম’ কলামে।
১৯৬৮ সালে ‘পাকিস্তান অ্যাসোসিয়েশন অব স্পোর্টস রাইটার’ গড়ে তোলার সময় কামরুজ্জামান তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি কখনোই কোনো সংগঠনের কোনো পদ নেয়ার জন্য আগ্রহী ছিলাম না। যা কিছু করেছি, মনের তাগিদে করেছি। পদ-টদের ধার ধারিনি। ‘পাকিস্তান অ্যাসোসিয়েশন অব স্পোর্টস রাইটার’ গড়ে তোলা হলে খ্যাতিমান সাংবাদিক আনিসুল মাওলা সাহেব আমাকে সেক্রেটারি হওয়ার অনুরোধ জানান। আমি রাজি না হওয়ায় দৈনিক পাকিস্তানে আমার সহকর্মী ফজলুল করিম সাহেব তার হয়ে অনুরোধ করলে আমার পক্ষে তার কথা অমান্য করা সম্ভব হয়নি। আনিসুল মওলাকে সভাপতি, আমাকে সেক্রেটারি ও মাসির হোসেন হীরুকে কোষাধ্যক্ষ করে কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি গঠনের পর তদানীন্তন পাকিস্তানের দুই অংশে ক্রীড়া সাংবাদিকদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। সদস্য হওয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রথম চিঠি দেন খ্যাতিমান ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া ধারাভাষ্যকর কামরুদ্দিন বাট। ১৯৬৯ সালে আমরা বছরের সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে পুরস্কৃত করি পোলভল্টার মিরাজকে। ১৯৭২ সালে পুনর্গঠিত বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমাকে দেখানো হয় ‘পাকিস্তান অ্যাসোসিয়েশন অব স্পোর্টস রাইটার’-এর ধারাবাহিকতায়। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির প্রথম সাধারণ সম্পাদক আবদুল মাজেদ ভূঁইয়া। তবে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান নিয়ে মতবিরোধ হওয়ায় সমিতির সঙ্গে আমি সম্পর্ক ছিন্ন করি। ১৯৭৬ সালে অবজারভার পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক বি.ডি. মুখার্জী পেশাদার ক্রীড়া সাংবাদিকদের নিয়ে ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সাংবাদিক সংস্থা’ গড়ার উদ্যোগ নিলে আমি তাতে সক্রিয় ভূমিকা রাখি। তবে আমি কখনো কোনো পদে ছিলাম না। আর এখন তো কোনো সম্পর্ক নেই।’
খেলোয়াড়ী জীবনে দেখা ক্রীড়া সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তখনকার ক্রীড়া সাংবাদিকতা বেশ উঁচুমানের ছিল। টেকনিক্যালি হয়তো উন্নত ছিল না। কভারেজ বেশি দেয়া হতো না। মর্নিং নিউজ হাফ বা পৌনে এক পৃষ্ঠা খেলার খবর ছাপতো। তার বেশিরভাগই ছিল বিশ্ব ক্রিকেট বা ফুটবল। তবে সে সময় আতিকুজ্জামান খান, ওয়াহিদুল হক, রেজাউল হক বাচ্চু, সৈয়দ জাফর আলী, এবিএম মূসা, এনায়েত উল্লাহ খান প্রমুখ ক্রীড়া বিষয়ে দুর্দান্ত লিখতেন।’
নিজের সময়ের ক্রীড়া সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি দৈনিক পাকিস্তানে যোগ দেয়ার ৬ মাস পর মাসে ৪২৩ টাকা বেতন পেতাম। ২০০ টাকা বেশি দিয়ে আনিসুল মওলা সাহেব আমাকে মর্নিং নিউজে নিতে চেয়েছিলেন। আমি দৈনিক পাকিস্তান ছাড়িনি। অফিস থেকে আমাকে ইনক্রিমেন্ট দিয়ে উৎসাহিত করা হতো। তাছাড়া ক্রীড়া সাংবাদিকতায় কীভাবে উন্নতি করা যায়, তা নিয়ে পড়ালেখা করতাম। ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত ‘স্পোর্টস অ্যান্ড পাসটাইম’ পত্রিকা পাগলের মতো পড়তাম। এনায়েত উল্লাহ খান ছিলেন নাক-উঁচা সাংবাদিক। বাংলা ক্রীড়া সাংবাদিকতা সম্পর্কে তার ধারণা ভালো ছিল না। সেই তিনি একদিন প্রেসক্লাবের আড্ডায় দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত আমার রিপোর্টিং নিয়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেন। এটা ছিল আমার সাংবাদিকতা জীবনের সেরা কমপ্লিমেন্ট।’
বর্তমানের ক্রীড়া সাংবাদিকতা সম্পর্কে প্রবীণ এই সাংবাদিকের মন্তব্য হচ্ছে, ‘এখন ক্রীড়া সাংবাদিকতায় যারা আসছেন, তারা লেখাপড়ায় ভালো। টেকনিক্যালি জ্ঞানও আছে। তবে অধিকাংশই রিপোর্ট লেখার ব্যাপারে সিরিয়াস নয়। রিপোর্ট প্রায়শই বস্তুনিষ্ঠ ও বাস্তবভিত্তিক হয় না। এখন রিপোর্টে রিপোর্ট থাকে না। থাকে শব্দের খেলা।’ তিনি মনে করেন, ‘ক্রীড়া সাংবাদিকতা করতে হলে খেলোয়াড়ী ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলে ভালো। না থাকলেও কিছু আসে যায় না। তবে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ থাকতে হবে। মনটাই আসল। তাকে তৈরি করতে পারলে ক্রীড়া সাংবাদিকতায় ভালো করা সম্ভব। আর এখন তো অনেক সুযোগ-সুবিধা। ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিতে কোনো সমস্যা নেই।’
সাংবাদিকতা জীবনের স্মরণীয় ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কিংবদন্তী বক্সার মুহাম্মদ আলী ১৯৭৭ সালে ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে তাকে ঘিরে রেখেছিল অসংখ্য মানুষ। তার কাছে যাওয়াটা ছিল সৌভাগ্যের। এর মধ্যে হাতেগোনা যে ক’জন সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলেন, আমি ছিলাম তাদের একজন। আমার প্রশ্নটাকে মুহাম্মদ আলী গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। তাছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার বংশোদ্ভূত ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেটার বাসিল ডি অলিভিয়ার এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারটা নেয়াটাও ছিল আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। ১৯৭২-৭৩ সালে কলকাতায় দেখা হয় ভারতের কিংবদন্তী ক্রিকেটার লালা অমরনাথের সঙ্গে। তিনি ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র হয়ে ইংল্যান্ড-ভারত টেস্ট কভার করতে এসেছিলেন। তিনি আমাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি তিনি নিজেই পরিচয় করিয়ে দেন পতৌদি’র নবাবের সঙ্গে।’ কামরুজ্জামান দেশ-বিদেশের অনেক ক্রীড়া সাংবাদিকের সঙ্গে মিশেছেন কিংবা তাদের লেখা উপভোগ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন পাকিস্তানের ক্রীড়া সাংবাদিক কামরুদ্দিন বাট। সাবেক অফস্পিনার ও ভারতীয় জাতীয় দলের ট্রায়ালে ডাক পাওয়া এই ভদ্রলোকের কলম বরাবরই সরব ছিল ইস্ট পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের পক্ষে। ভারতের শঙ্করীপ্রসাদ বসু, এন কে প্রভু, আর শ্রীমান, রাজন বালা, ১৯৬৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ড-পাকিস্তান টেস্ট ক্রিকেট উপলক্ষে ঢাকায় আসা প্রায় ২০ জন ব্রিটিশ ক্রীড়া সাংবাদিকের মধ্যে থাকা জিম সোয়ানটন, অ্যালেক্স ব্যানিস্টার, জন উডকক, ইংল্যান্ডের ‘দ্য ক্রিকেটার’-এর সাংবাদিক রবিন মার্লার, উইজডেন সম্পাদক ম্যাথু অ্যানজেলের সান্নিধ্য ছিল উপভোগ্যময়। ১৯৭৭ সালে রাবিন মার্লার যখন ঢাকা আসেন, তখন তাকে বাংলাদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে ধারণা দেয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি দেশে ফিরে গিয়ে ‘দ্য কেস ফর বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটা গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছিলেন। এ লেখা প্রকাশের পর বাংলাদেশের আইসিসি’র সহযোগী সদস্য পদ পাওয়ার পথ সুগম হয়। বাংলাদেশের বদরুল হুদা চৌধুরীর লেখাও আমাকে চমকে দেয়।’
বর্ণাঢ্য ক্রীড়া সাংবাদিক জীবনের অধিকারী মুহাম্মদ কামরুজ্জামান খেলার মাঠ আর ক্রীড়া সাংবাদিকতার মোহজালে এমনই হাবুডুবু খেয়েছেন যে, সংসার জীবনের কথা কখনো ভাবেননি। ক্রীড়াঙ্গনকে মনে করেছেন সংসার। ক্রীড়াবিদরাই তার আপনজন। ক্রীড়াঙ্গনে এমন মানুষ খুবই কম আছেন, যার সঙ্গে তার হৃদ্যতা নেই। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে তাদের সান্নিধ্যে। অসম্ভব প্রাণবন্ত, উচ্ছল ও উজ্জ্বল মানুষ তিনি। যে কোনো আড্ডার মধ্যমণি হতে একটুও সময় নেন না। তার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য বন্ধুরা তো বটেই, সব বয়সী মানুষ মুখিয়ে থাকেন। জাতীয় প্রেসক্লাব কিংবা তার বাসায় ছুটে যান অনেকেই। আবার কখনো বন্ধুদের টানে তিনিও ছুটে যেতে দ্বিধা করেন না। কখনো-সখনো কারো কারো সঙ্গে মনোমালিন্যও হয়। কোনো অন্যায় সহ্য করতে পারেন না। এ কারণে জীবনে অনেকের সঙ্গেই দূরত্ব বজায় রেখেছেন। কোনো আপস করার প্রয়োজন বোধ করেননি। নিজের জীবন নিয়ে তিনি অসন্তুষ্ট নন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ বয়সেও আমি একাকী জীবনযাপন করছি। ঘরের সবকিছুই আমাকে করতে হয়। তারপরও বই পড়ি। কখনো কখনো লিখি। টিভি দেখি। মন চাইলে আড্ডা মারি আর ঘুমাই। আমি আসলে খুব অল্পতেই তুষ্ট। সেই শৈশবেই বাবা বুকের ভেতর যে জীবনদর্শনটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, সারা জীবন তা প্রতিপালন করার চেষ্টা করেছি। তিনি বলতেন- পড়ালেখা শিখেছ। সত্যিকার মানুষ হওয়ার চেষ্টা করবে। অসৎ পয়সা নেবে না। অসৎ পথে যাবে না। আমি তাই করেছি। আমি আমার জীবনকে নিয়ে খুশী। আমি আমার জীবনে পরিপূর্ণতা পেয়েছি। আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই।’ কান পাতলেই প্রতিটি মানুষের বুকের মধ্যেই শুনতে পাওয়া যায় না-পাওয়ার হাহাকার। নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট- এমন মানুষ দেখতে পাওয়া যায় কালেভদ্রে। সেই বিরলতমদের একজন মুহাম্মদ কামরুজ্জামান। তবে তার জীবনে একদমই যে দুঃখ নেই- তা বলা যাবে না। যক্ষের ধনের মতো করে সঞ্চয় করেছেন তার ক্রীড়াবিষয়ক সংগ্রহ। সেই সংগ্রহটা একটু একটু করে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটাই এখন তার মানসিক যাতনার কারণ। দুর্লভ এই সংগ্রহটাকে কাজে লাগানোর তার খুবই ইচ্ছে। কিন্তু কিছুই করা হয়ে উঠছে না।
মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের শরীরটা ইদানীং বেগড়বাই করছে। ইতোমধ্যে বাইপাস করতে হয়েছে। আগের মতো ছুটতে পারেন না। ক্লান্তি এসে থামিয়ে দিতে চায়। কিন্তু তিনি থেমে থাকেন না। প্রতিদিনই জাতীয় প্রেসক্লাবের লাইব্রেরিতে একবার যাবেনই। সেখানে কিছুক্ষণ বই-পত্র পড়েন। তারপর ডায়রিতে টুকতে থাকেন ক্রীড়াবিষয়ক নতুন কোনো তথ্য। এটা তার প্রাত্যহিক রুটিন। আর যাই হোক, এই রুটিনের ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম নেই। তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এই রুটিন। তিনি চাইলেও এ থেকে দূরে সরতে পারেন না। নিয়তি যেন তাকে টেনে নিয়ে যায়। অবশ্য এতেই তিনি খুঁজে পান জীবনের আনন্দ ও বিনোদন। আর আমরা দেখতে পাই নিরলস এক সাধককে। #
১৬-৭-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

কোথায় সেই ফুটবল?

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ

ফুটবলে প্রথম বাঙালি স্টপার মোবাশ্বার/ দুলাল মাহমুদ

অ্যাথলেটিকসের উজ্জ্বল মুখ মীর শরীফ হাসান/ দুলাল মাহমুদ

বাস্কেটবলের বুলবুল/ দুলাল মাহমুদ