দুরন্ত গতির কামরুল ইসলাম/ দুলাল মাহমুদ

বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসের উজ্জ্বল অধ্যায়ের সঙ্গে অল্প যে ক’জন ক্রীড়াবিদের নাম জড়িয়ে আছে, তাদের অন্যতম হলেন কামরুল ইসলাম। পঞ্চাশ ও ষাট দশকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে অ্যাথলেট হিসেবে তার সাফল্য ছিল আলোচিত ঘটনা। তিনি শুধু কৃতিত্ব দিয়ে লাইম লাইটে উঠে আসেননি, তিনি পথ দেখিয়েছেন অনেক তরুণ অ্যাথলেটকেও। তাকে অনুসরণ কিংবা অনুকরণ করে উঠে এসেছেন অনেক ক্রীড়াবিদ। তিনি ছিলেন অনেক অ্যাথলেটের রোল-মডেল। কামরুল ইসলাম এমন একটা পরিবেশ থেকে অ্যাথলেট হিসেবে উঠে এসেছেন, যেখানে খেলাধুলার চর্চা ছিল; তবে জাতীয় পর্যায়ে ছিল না কোনো প্রতিনিধিত্ব। খেলাধুলায় আগ্রহ থাকলেও ছিল না পারিবারিক উজ্জ্বলতা। খেলাধুলার ঐতিহ্যবিহীন একটি পরিবেশ থেকে এসে জাতীয় পর্যায়ে অ্যাথলেট হিসেবে খ্যাতির চূড়ায় ওঠা সহজাত প্রতিভা ছাড়া সম্ভব ছিল না। জন্মগত প্রতিভা নিয়ে আসা এই অ্যাথলেট তার নৈপুণ্যের ঝিলিক দিয়ে ধাঁধিয়ে দিয়েছেন অ্যাথলেটিকস অঙ্গনকে। কামরুল ইসলাম শুধু খেলোয়াড় হিসেবেই খ্যাতি অর্জন করেননি, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। সফল ক্রীড়াবিদ, সফল সংগঠক, সফল অভিভাবকও তিনি।
সেদিন গুলশানে তার সাজানো-গোছানো বাসভবনে আলাপচারিতায় উন্মোচিত হন নানা পরিচয়ে হৃদ্য কামরুল ইসলাম। তার যা পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, তাতে তার ক্রীড়াবিদ হওয়ার কথা ছিল না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইতিহাসখ্যাত বাংলার বার ভূঁইয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের পরিবার। বার ভূঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর অন্যতম উত্তরসূরিদের মধ্যে বাজিত খাঁ কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে, আফগান খাঁ আটগা অষ্টগ্রামে এবং দাউদ খাঁ সিলেটের দাউদনগরে বসবাস করতেন। আফগান খাঁর তৃতীয় বংশধর মেহেমুদ ফাজিল ভূঁইয়া। তিনি ছিলেন অঢেল ধন-সম্পত্তির অধিকারী। কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে সমাজসেবা ও শিক্ষা-দীক্ষায় তার অনেক অবদান আছে। তারই উত্তরসূরি আমার বাবা আবদুস সোবহান ভূঁইয়া। উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক সহায়-সম্পত্তির মালিক হন। সে সুবাদে জমিদারির অংশীদার হই আমিও। আমরা ছিলাম পাঠান। আর আমার মা রহিমা বেগম ছিলেন মোগল বংশধর। আমার মা অসম্ভব রূপবতী মহিলা ছিলেন। তার বাবা সুলতান খান চৌধুরী ছিলেন দশকুষা জমিদার বংশের নবপুরুষ। এ কারণে চাকরি-বাকরি কিংবা কোনো কিছু নিয়েই ভাবনা ছিল না। বরং চাকরি করাটাকে আমাদের পরিবারে দেখা হতো হেয় চোখে। জমিদারের ছেলে কেন অন্যের গোলামী করবে? তাছাড়া আমাদের বংশের অনেকেই শিক্ষা-দীক্ষায় বেশ সাফল্যের পরিচয় দেন। সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে আমাদের পরিবার ছিল যথেষ্ট পরিশীলিত। নাটক, আবৃত্তিসহ নানা বিষয়ে চর্চা ছিল। এমন একটা পরিবারের সন্তান হয়ে আমারও অগ্রজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার কথা ছিল। কিন্তু চিন্তা-চেতনায় আমি ছিলাম অন্যদের চেয়ে আলাদা। একদম অল্প বয়স থেকে আমি নিজের ভালো-মন্দ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা কিছু করতে চেয়েছি। এজন্য নিজের উদ্যোগে নিজেকে গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। আমাকে সচরাচর কেউ বুঝতে পারতো না। আমি কী করবো-না করবো, তা কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব ছিল না। কাউকে কিছু বুঝতে দিতাম না। তবে খারাপ কিছু যে করবো না- এ আস্থাটুকু আমার ওপর সবার ছিল। জীবনে যেটুকু অর্জন করেছি, তা স্ব-উদ্যোগেই করেছি।’
কামরুল ইসলামের জন্ম কিশোরগঞ্জে। সনদপত্র অনুযায়ী ১৯৩৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর। প্রকৃতপক্ষে তা ১৯৩৯ সালের ৬ আগস্ট। তার নাম ছিল মোঃ নূরুল আমিন ভূঁইয়া। নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের ন্যক্কারজনক ভূমিকায় ক্ষুব্দ হয়ে আমি আমার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেই। নূরুল আমিন তার নামটিকে কলঙ্কিত করায় আমি নতুন নাম নেই কামরুল ইসলাম।’ গ্রামের স্কুল অষ্টগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই পড়ালেখা ও খেলাধুলা একই সঙ্গে চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পর্যায়ে আমাদের গ্রাম থেকে কোনো ক্রীড়াবিদ উঠে না এলেও আমাদের গ্রামে খেলাধুলার চর্চা ছিল। আমার বড় ভাই আমিনুল ইসলাম এনায়েতও ফুটবল খেলতেন। তবে গ্রামের পরিবেশ আমাকে খেলাধুলায় উদ্বুদ্ধ করে। ছোটবেলা থেকেই আমি ছিলাম দুরন্ত প্রকৃতির। পড়ালেখায় একদমই মনোযোগী ছিলাম না। তারপরও পরীক্ষায় ঠিকই প্রথম হতাম। তবে খেলাধুলার প্রতি ছিল আমার অখন্ড মনোযোগ। স্কুল জীবনের প্রায় শুরু থেকে ১০০, ২০০ মিটার দৌড়, লংজাম্প, হাইজাম্প ও শটপুটে আমি ছিলাম অদ্বিতীয়। মনে পড়ে, প্রথমবার অংশগ্রহণের সময় হিট স্ট্রোকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। নাকের কাছে স্মেলিং সল্ট দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হয়। তবে আমার অ্যাথলেট হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে কারো কোনো ভূমিকা ছিল না। আমার পিতা অবশ্য উৎসাহ দিতেন। আমরা ছিলাম অ্যারিস্টোক্র্যাট পরিবার। আমাদের বাড়িতে এক্সারসাইজ করার জন্য নানা সরঞ্জাম ছিল। আমার মা নিয়মিত ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতেন। স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক্সারসাইজ করার বিষয়টি অল্প বয়সেই আয়ত্তে এসে যায়। আর নিয়মিত এক্সারসাইজ করলে বডি স্ট্রাকচার, বডি ফ্রেম ও বডি রিফ্লেকশন দারুণ হয়। ফিজিক্যাল কন্ডিশনের দিক দিয়ে অন্যদের তুলনায় বোধহয় এগিয়ে থাকতাম। হুঁইশেল শোনার সঙ্গে সঙ্গে শরীরটা সহজাতভাবে ছন্দে এসে যেত। যে কারণে সবার আগে ছুটে যেতাম।’ তিনি জানান, বাড়ির অনুমতি না পাওয়ায় আন্তঃস্কুল অ্যাথলেটিকসে তার অংশ নেয়ার সুযোগ হয়নি।
১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর ভর্তি হন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি হয়ে ওঠেন কলেজের মধ্যমণি। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘কলেজে তখন শহীদ নামের একজন ছাত্রের নাম-ডাক। আগেরবার সে কলেজের অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়ন। সে সময় কলেজে নিয়ম ছিল- যে পর পর দু’বার চ্যাম্পিয়ন হবে, তাকে রানিং ট্রফি দিয়ে দেয়া হবে। শহীদ গর্ব করে ঘোষণা দেয়, দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে সে রানিং ট্রফি জয় করবে। আমি তার তোড়জোড় শুনে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে থাকি। সবাইকে চমকে দিয়ে আমি আটটি ইভেন্টে অংশ নিয়ে আটটিতেই প্রথম হই। আমার ইভেন্ট ছিল ১০০, ২০০ মিটার দৌড়, শটপুট, জ্যাভলিন থ্রো, লংজাম্প, হাইজাম্প, হপ-স্টেপ জাম্প ও রিলে রেস। এতগুলো ট্রফি নেয়াটাও ছিল মধুর ঝামেলা। পরের বছরও একই সাফল্য অর্জন করি। পেয়ে যাই রানিং ট্রফি।’
কামরুল ইসলাম ১৯৫৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি ছিলেন ফজলুল হক হলের বাসিন্দা। ফজলুল হক হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি একচেটিয়া দাপট দেখান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার আগে ফজলুল হক হলের সেরা অ্যাথলেট ছিলেন খুব সম্ভবত এম এ রশীদ ভাই (পরবর্তীকালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব)। আমি যাওয়ার পর প্রতি বছরই চ্যাম্পিয়ন হই। আমার ইভেন্ট ছিল ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়, শটপুট, জ্যাভলিন থ্রো, লংজাম্প ও রিলে দৌড়। টানা চার বছর আমি এ ইভেন্টগুলোতে প্রথম হয়েছি। হল ছাড়াও আন্তঃহল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমি সাফল্য অর্জন করি। আমি অংশ নেয়ার পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাথলেটিকসে সেরা নৈপুণ্য প্রদর্শন করে ফজলুল হক হল।’ একই বছর আন্তঃকলেজ অ্যাথলেটিকস মিটে তিনি সাফল্য দেখান। সে সময় এই মিটে তিনটির বেশি ইভেন্টে অংশ নেয়ার সুযোগ ছিল না। তিনি বেছে নেন ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড় এবং শটপুটকে। সেদিনের সেই স্মৃতি তার বুকে এখনও টাটকা হয়ে আছে। তিনি বলেন, ‘সে সময় অ্যাথলেট হিসেবে মনিরুল ইসলাম ছিলেন বেশ খ্যাতিমান। আন্তঃকলেজ অ্যাথলেটিকস মিটে তিনি আমার কাছে হেরে গিয়ে বেশ চোটপাট করেন। চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, ইস্ট পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস মিটে দেখা যাবে! মজার ব্যাপার হলো- সেই মিটে তিনি হিটেই বাদ পড়েন। কারণ হিসেবে জানান মাশলপুল। এরপর আর তিনি অ্যাথলেটিকস করেননি। সে বছরই আমি প্রথমবারের মতো ইস্ট পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস মিটে অংশ নেই। ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সেই মিটে কী পদক পেয়েছিলাম, তা আর মনে নেই। তবে আন্তঃকলেজ অ্যাথলেটিকস মিটে যতবার অংশ নিয়েছি, ততবার আমার সাফল্য ছিল অবধারিত।’
স্কুল থেকে কলেজ জীবন পর্যন্ত কোনো কোচ ছাড়াই সাফল্য দেখিয়েছেন তিনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তিনি নজরে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধ্যাপক ওতিস কফির। কামরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই ভদ্রলোক ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। অ্যাথলেটিকসেও তার যথেষ্ট দক্ষতা ও জ্ঞান ছিল। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাথলেটিকসের আধুনিকায়নে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রতিভাবান অ্যাথলেটদের প্রতি বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। কোনো নিয়ম-কানুন না জেনে আগে অ্যাথলেটিকস করেছি। ওতিস কফির সংস্পর্শে এসে আমি অনেক কিছু জানতে পারি। স্টার্টিং, স্পিড, বডি অ্যাঙ্গেল, বডি অ্যাকশন ইত্যাদি সম্পর্কে তার কাছ থেকে হাতে-কলমে জ্ঞান অর্জন করি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা ক্রীড়া সরঞ্জামও তিনি আমাদের দিয়েছেন। সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাটা তার কাছ থেকেই পেয়েছি। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাথলেটিকসকে রূপান্তরিত করেন। নিবেদিতপ্রাণ এমন ব্যক্তি আমি খুব কম দেখেছি।’
১৯৫৮ সালে ইস্ট পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস মিটে প্রথমবারের মতো দ্রুততম মানব হওয়ার গৌরব অর্জন করেন কামরুল ইসলাম। এই মিটের পারফরম্যান্স দিয়ে সে বছর পাকিস্তানের পেশোয়ারে আয়োজিত পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে অংশ নেন। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া দলের অধিনায়ক। সে গেমসে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘খেলোয়াড়, সংগঠক ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি মিলিয়ে দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ৭৫ জন। ঢাকা থেকে পেশোয়ার ট্রেনে যেতে সময় লাগে ৬ দিন। তাতে অবশ্য আমাদের মন খারাপ হয়নি। জার্নি ছিল বেশ আনন্দদায়ক। ট্রেনে অনেক অম্ল-মধুর ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের অনেকেরই সেবার ছিল প্রথম ট্রেন জার্নি। ছেলে ও মেয়েদের কম্পার্টমেন্ট ছিল আলাদা। পোলভল্টার বশীর হাত ধোয়ার সময় কী করে যেন সেই পানি মেয়েদের কম্পার্টমেন্টে চলে যায়। এ নিয়ে কন্টিনজেন্টের কোষাধ্যক্ষ জওয়াদ তাকে বেশ বকাবকি করেন। বশীর এসে আমার কাছে কেঁদে ফেলে। আমি বললাম, ঠিক আছে, অপেক্ষা কর। আমি এর ব্যবস্থা নেব। পেশোয়ারে যেয়ে আমি ঘোষণা দিলাম, আমরা খেলতে নামবো না। এতে হৈ চৈ পড়ে যায়। কর্মকর্তারা ছুটে আসেন। তখন তাদের বললাম, আমাদের অ্যাথলেটরা সব ভদ্রঘরের সন্তান। তাদের বিনা কারণে বকাবকি করা মোটেও উচিত হয়নি। তাছাড়া অধিনায়ক হিসেবে আমাকে ঘটনা জানানো যেতো। আমার অনড় অবস্থানে দায়ী কর্মকর্তা দুঃখ প্রকাশ করলে আমরা খেলতে নামি। আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের দলে ছিলেন খ্যাতিমান অ্যাথলেট এস এ জামান মুক্তা। সে সময় তার মতো অ্যাথলেট কম ছিলেন। আমাদের সঙ্গে অ্যাথলেট হিসেবে গিয়েছিলেন মুক্তা ভাইয়ের কাজিন আরেক দেশসেরা অ্যাথলেট কোয়েল। মেয়েদের আলাদা হোস্টেলে রাখা হয়। একদিন মুক্তা ভাই তার বোনের খোঁজ নেয়ার জন্য মহিলা হোস্টেলে যান। মহিলা দলের ম্যানেজার ছিলেন জাহানারা ইমাম (লেখিকা ও নারীনেত্রী)। বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেননি তিনি। তিনি মুক্তা ভাইকে বেশ বকাঝকা করেন। মুক্তা ভাই আমার কাছে এসে কেঁদে ফেলেন। আসলে মুক্তা ভাইয়ের মতো অ্যাথলেটের জন্য এটা ছিল রীতিমত অপমানজনক। এরকম অনেক ঘটনাই সে সফরে ঘটেছিল।’ সেবার নিজের পারফরম্যান্স সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তখন তো অ্যাথলেটিকসে পাকিস্তান এশিয়ার অন্যতম শক্তি। আবদুল খালিক, মালেক, তাহির জানের মতো অ্যাথলেটদের তখন দোর্দন্ড প্রতাপ! তারপর ১০০ মিটার ইভেন্টে আমি ভালোই ফর্মে ছিলাম। এটা বুঝতে পেরে কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। ১০০ মিটারে দু’বার ফলস স্টার্ট দেয়ার কারণে আমি পরে আর সুবিধা করতে পারিনি। স্বল্পপাল্লার স্প্রিন্টে একবার বাধা পেলে তা আর কাটিয়ে ওঠা যায় না।’
১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ইস্ট পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস মিটে টানা চারবার দ্রুততম মানব হয়ে নতুন মাইলফলক গড়েন কামরুল ইসলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মোশাররফ হোসেন শামীম এ রেকর্ড ভেঙে দেন। সে সময় কামরুল ইসলামের কৃতিত্ব ছিল সাড়া জাগানো ঘটনা। অনেক নবীন অ্যাথলেটের স্বপ্ন হয়ে ওঠে তার মতো অ্যাথলেট হওয়া। ১০০ মিটার ছাড়াও ২০০ মিটার স্প্রিন্ট ও শটপুটেও ইস্ট পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস মিটে তার সাফল্য আছে। এছাড়াও আন্তঃকলেজ, আন্তঃহল, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়, প্রভিনশিয়াল পুলিশ অ্যাথলেটিকসে তিনি নিয়মিত সাফল্য পান। ১৯৫৯ সালে তিনি পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে অ্যাথলেটিকসে তিন মাসের ট্রেনিং নেন। ১৯৬২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো পূর্ব পাকিস্তান অ্যাথলেটিকস দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে তার সর্বোচ্চ সাফল্য ছিল ১০ দশমিক ৬ সেকেন্ড। ১৯৫৯ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিকস মিটের ট্রায়ালে তিনি এ কৃতিত্ব দেখান। সে সময় পাকিস্তান রেকর্ড ছিল ১০ দশমিক ৪ সেকেন্ড। ১৯৬৩ সালের ১৩ মার্চ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিকসে তিনি ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ১০ দশমিক ৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে ইস্ট পাকিস্তান প্রাদেশিক রেকর্ড গড়েন। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরজান খান দ্বিতীয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশান্ত কুমার মন্ডল তৃতীয় হন। পোল্টভল্টেও কামরুল প্রথম, আরজান দ্বিতীয় ও প্রশান্ত তৃতীয় হন। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। শেষদিকে তিনি অ্যাথলেটিকস করেছেন ইপিআইডিসির হয়ে।
অ্যাথলেটিকসে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তাকে চ্যালেঞ্জার ছিলেন সিরাজুল ইসলাম, আরজান খান, মনিরুল ইসলাম প্রমুখ। তবে তিনি মনে করেন, ‘ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হিসেবে কাজী আবদুল আলীম ছিলেন চমৎকার মানুষ। দেখতেও যেমন হ্যান্ডসাম ছিলেন, আচার-আচরণ, কথা-বার্তায় দারুণ ছিলেন। অলরাউন্ডার ক্রীড়াবিদ হিসেবে এস এ জামান মুক্তার কোনো তুলনা হয় না। তিনি ছিলেন তারকা ক্রীড়াবিদ। একজন ক্রীড়াবিদের যাবতীয় গুণাবলী তার মধ্যে ছিল বিদ্যমান। এমন অ্যাথলেটের সচরাচর দেখা মেলে না। সিরাজুল ইসলাম ছিলেন দুর্দান্ত স্প্রিন্টার। পোলভল্টার মিরাজ ছিলেন ব্রিলিয়ান্ট।’
অ্যাথলেটিকসে স্মরণীয় ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি যেবার ফজলুল হল চ্যাম্পিয়ন হই, সেবারই প্রথমবারের মতো ফজলুল হক হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তঃহল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়। এটা আমার জীবনের মাইলফলক হয়ে আছে।’ অ্যাথলেটিকসে সার্বিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় অ্যাথলেটিকসে কোনো টাকা-পয়সা কিংবা কারো কোনো সাহায্য-সহযোগিতা ছিল না। যা করেছি, নিজের উদ্যোগে। এখন তো অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়।’
অ্যাথলেটিকসের পাশাপাশি ফুটবলও খেলেছেন কামরুল ইসলাম। তার পজিশন ছিল সেন্টার ফরোয়ার্ড। ইন্টার কলেজ ও ইন্টার ইউনিভার্সিটি ফুটবলে তিনি নিয়মিত খেলেন। ১৯৫৯ সালে ইন্টার ইউনিভার্সিটি ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচটি তার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। সে ম্যাচটি সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘ফাইনালে আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। খেলাটি ছিল বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। কোনো দলই গোল করতে পারছিল না। এ পর্যায়ে মুহাম্মদ কামরুজ্জামান (পরবর্তীকালে ক্রীড়া সাংবাদিক) আমাকে চমৎকার পাস দিলে তা থেকে আমি গোল করি। খেলায় এটি ছিল একমাত্র গোল। সে গোলের সুবাদে চ্যাম্পিয়ন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আরেকবার আন্তঃহল ফুটবল প্রতিযোগিতায় আমাদের হলের সঙ্গে এসএম হলের খেলা। এসএম হলের গোলরক্ষক মঞ্জুর হাসান মিন্টু। তিনি তখন পাকিস্তান জাতীয় দলের গোলরক্ষক হিসেবে টোকিও এশিয়ান গেমসে খেলে এসেছেন। সঙ্গত কারণে তার তখন অন্যরকম ভাবমূর্তি। আমি জানতাম তাকে এয়ারে বিট করা যাবে না। এ কারণে বুদ্ধি খাটিয়ে মাটি ঘেঁষা শটে তাকে অমি ২ গোল দেই।’ ফজলুল হক হলের খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, হাবিবুর রহমান, জলিল, এম এ রশিদ, জিল্লু, সাইদ, এজাজ রসুল, ফয়েজ, নূর হোসেন প্রমুখ। ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে তিনি প্রথম খেলেন ১৯৫৭ সালে ফায়ার সার্ভিসের হয়ে। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত খেলেন আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। আজাদের খেলার সময় সহযোগী ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন রণজিত দাস, এস এ জামান মুক্তা, মারী, এম এ রশীদ প্রমুখ। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ইপিআইডিসির খেলোয়াড়। ফুটবল খেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ফুটবল খেলায় আমি খুব বেশি সিরিয়াস ছিলাম না। তবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলার সময় মন-প্রাণ দিয়ে খেলেছি। আমরা তো আর টাকা-পয়সা নিয়ে খেলিনি। মনের তাগিদে খেলেছি। এ কারণে তেমন দায়বদ্ধতা ছিল না।’ খেলাধুলায় জাতীয় পর্যায়ে কামরুল ইসলাম ছাড়াও তার মামার পরিবারও সুখ্যাতি অর্জন করে। তার মামা সদরুল্লাহ খান ও মামী ছিলেন শুটার। মামাতো বোন নূরুন্নাহার জাতীয় পর্যায়ে সফল শুটারদের একজন।
কামরুল ইসলামের কৃতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ১৯৫৮ সালে অ্যাথলেটিকস এবং ১৯৫৯ সালে ফুটবলে ‘ব্লু’ প্রদান করে। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৯৪ সালে তিনি বাংলাদেশ রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এবং দু’দফায় ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। চাকরি জীবনে তিনি ঢাকায় বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক, ইউএস এইড প্রকল্পের মার্কেটিং স্পেশালিস্ট, রিয়েল স্টেট কোম্পানি বোরাকের নির্বাহী পরিচালক, বিসিআইসির জেনারেল ম্যানেজারসহ বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে কর্মরত ছিলেন। তার স্ত্রী রাশিদা ইসলাম বিদূষী নারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োক্যামেস্ট্রিতে এমএসসি করেন। শিক্ষকতা ও গবেষণামূলক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তাদের এক মেয়ে সোনিয়া নিশাত চৌধুরী দীপা স্বামীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ও এক ছেলে আহসান শরীফ ইমন গ্রামীণফোনের ম্যানেজার, ডাইরেক্ট সেলস।
বাংলাদেশের স্কেটিং প্রসঙ্গে কামরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে রোলার স্কেটিং প্রবর্তন করেন আর্জেন্টিনার নাগরিক গ্রেকো। ১৯৮৪ সালে তার একক প্রচেষ্টায় এ খেলাটি চালু করা সম্ভব হয়। তিনিই আমাকে খুঁজে বের করে স্কেটিংয়ের দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ জানালে আমি স্কেটিংয়ে সম্পৃক্ত হই।’
কামরুল ইসলাম যৌবনে যে সুদর্শন, সুদেহী, স্মার্ট ও হ্যান্ডসাম ছিলেন, তা এখনও তাকে দেখলে সহজেই অনুধাবন করা যায়। সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়সেও তিনি যথেষ্ট ঝকঝকে, প্রাণবন্ত ও দিলখোলা। শরীরে একরত্তি মেদ নেই। মানুষের সঙ্গে সহজেই মিশতে পারেন। আড্ডা মারেন জমিয়ে। একটা তরুণ ও সতেজ হৃদয় তাকে দিয়েছে উজ্জ্বলতা ও উচ্ছলতা। তার জীবনে তেমন কোনো অতৃপ্তি নেই। জীবনের কাছে নেই বড় কোনো অভিযোগ। জীবনে যা পেয়েছেন, তাতেই তিনি সন্তুষ্ট। খেলার মাঠ থেকেই তিনি পেয়েছেন জীবন গড়ার এই জীবনদর্শন। একজন পরিপূর্ণ মানুষের প্রতিকৃতি হলেন কামরুল ইসলাম। এমন মানুষকেই মডেল হিসেবে নেয়া যায়। এ কারণে অ্যাথলেট হিসেবে তিনি যেমন ছিলেন অনেকের আদর্শ, ব্যক্তি হিসেবেও তাই তিনি সবার কাছেই সমাদৃত। #
১-৪-২০০৮

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

এশিয়ানরা কি কেবলই শোভাবর্ধন করবে? দুলাল মাহমুদ