জীবনের গতির কাছে পরাস্ত অ্যাথলেট কাজী আলমগীর!/ দুলাল মাহমুদ

অলিম্পিকের যে মটো ‘সিটিয়াস, অলটিয়াস, ফর্টিয়াস’ তার মূল আকর্ষণ কিন্তু অ্যাথলেটরা। সেই প্রাচীনকাল থেকেই অ্যাথলেটদের দেখা হয় সমীহর চোখে। হরিণের মত দুরন্ত গতিতে ছুটে চলার মধ্যে যে সম্মোহন, তার কোনো তুলনা হয় না। গতিটা যেহেতু খেলাধুলার প্রধান আকর্ষণ, সঙ্গত কারণে অ্যাথলেটিক্সকে ‘কিং অব দ্য গেমস’ বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রায় প্রতিটি খেলায় অ্যাথলেটিক্সের সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। আর অ্যাথলেটিক্সের মাধ্যমে অনুধাবন করা যায় শারীরিক সক্ষমতা। অ্যাথলেটিক্সের যে কোনো রেকর্ডই দুনিয়াজোড়া আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়। সময়কে পেছনে ফেলে মানুষ কতটা পথ পাড়ি দিল, তার মানদন্ড অ্যাথলেটদের এই রেকর্ড। তদুপরি গতি, শক্তি ও ক্ষমতা দিয়ে পরিমাপ করা যায় বিশ্বের অবস্থান। দুনিয়ার পরাশক্তি হিসেবে যারা বিবেচিত হয়ে থাকে, তাদের দেশের অ্যাথলেটরাই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে এগিয়ে। কোনো কাকতালীয় নয়, এটিকে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শিল্পোন্নত দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের যতটুকু পার্থক্য, ঠিক ততটাই ব্যবধান অ্যাথলেটিক্সে দূরত্বের ক্ষেত্রে। বিশ্ব তো দূরে থাকুক, এশিয়ান পর্যায়েও বাংলাদেশের কোনো অবস্থান নেই। তারপরও অ্যাথলেটিক্স বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণ। বিশেষত সেই পাকিস্তান আমলে অ্যাথলেটিক্স ছিল বেশ জমজমাট। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সরগরম ছিল অ্যাথলেটিক্স। প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছিল অ্যাথলেটিক্সের বিস্তার। সফল অ্যাথলেটরা বিবেচিত হতেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্বে। অ্যাথলেটিক্স মাঠে হতো হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। সে সময় যেসব বাঙালি অ্যাথলেট আলোচিত ছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন কাজী আলমগীর।
পূর্ব পাকিস্তান অ্যাথলেটিক্সে দূরপাল্লার দৌড়ে কাজী আলমগীর ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। পুরো ষাট দশকজুড়ে ছিল তার আধিপত্য। বিভিন্ন ইভেন্টে তিনি মাঠ মাতিয়েছেন। অ্যাথলেটিক্সটা তার কাছে একটা আবেগ, উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসা। জীবনের সবকিছুকে পেছনে ঠেলে দিয়ে অ্যাথলেটিক্সকে তিনি নিয়েছিলেন মিশন হিসেবে। অ্যাথলেটিক্সের টানে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। এক্ষেত্রে কোনো বাধাই তার কাছে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। জীবনে কত প্রতিযোগিতায় যে অংশ নিয়েছেন, তা নিজেও জানেন না। ছুটেছেন মাইলের পর মাইল। গতিকেই মনে হয়েছে তার জীবনের মূলমন্ত্র। গতির কাছে কখনোই হার মানতে চাননি তিনি।
নানা কারণে সমগ্র পাকিস্তানে বাঙালি অ্যাথলেটদের অবস্থান আশাপ্রদ ছিল না। তারপরও অ্যাথলেটিক্স মাঠে অ্যাথলেটের কমতি ছিল না। সব প্রতিকূলতাকে উড়িয়ে তারা চেয়েছেন খেলার মাঠে জয়ী হতে। কেউ কেউ পেরেছেনও। অনেকেই পারেননি। পূর্ব পাকিস্তানের আলোড়ন সৃষ্টিকারী অ্যাথলেটদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাজী আলমগীর। নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা দিয়ে তিনি অ্যাথলেটিক্স মাঠে আলাদা একটা ইমেজ গড়ে তুলতে পেরেছেন। এ কারণে বৃহত্তর পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে অল্প যে ক’জন বাঙালি অ্যাথলেট দৃষ্টি কাড়তে পেরেছিলেন, তিনি তাদের একজন। পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত SPORTIMES-এ ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় লেখা হয় : Despite the fact that nothings spectacular has so far been done by East Pakistan athletes in the National Games, the position here is not so bad. There has been no planned coaching and training, but some individual performances have been brilliant. To be more specific, people like Altaf, Meraj, Hafiz, Mujib, Alamgir and Chabi have been quite prominent. They could not be expected to go on for ever, but nobody knows who is going to replace them. The so-called organisers have done nothing by way of encouragement, guidance and initiative.
উপেক্ষা, বঞ্চনার শিকার না হয়ে যদি যথাযথ অনুপ্রেরণা, পথনির্দেশনা ও উদ্যোগী ভূমিকা নেয়া হতো, তাহলে কাজী আলমগীররা নিজেদেরকে আরো পরিপূর্ণভাবে পরিস্ফূটিত করতে পারতেন।
কাজী আলমগীরের জন্ম নানা বাড়িতে, ১৯৪৪ সালের ১১ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে। পৈতৃক নিবাস গোপালগজ্ঞের কোটালিপাড়ায়। খেলাধুলায় তাদের ছিল একটি পারিবারিক ঐতিহ্য। বাবা কাজী আনোয়ার হোসেন ছিলেন ফুটবলার। পাঁচ ভাই-বোনই কম-বেশি খেলাধুলা করতেন। তবে মেদিনীপুরে থাকতেই অ্যাথলেটিক্সে তার হাতেখড়ি। সেখানে ছোটবেলায় একটি দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার পর তার উৎসাহ বেড়ে যায়। অঙ্কুরিত হয় একজন ভবিষ্যৎ অ্যাথলেট। দেশভাগের পর তাদের পরিবার চলে আসে পূর্ব বাংলায়। বাবার চাকরিসূত্রে ফরিদপুরে আসার পর অ্যাথলেট হিসেবে গড়ে ওঠার পথটা আরো সুগম হয়। ফরিদপুর জিলা স্কুলে পড়ার সময় সেখানকার পরিবেশ ছিল খেলাধুলার উপযোগী। খোলা মাঠ পেয়ে অ্যাথলেট হওয়ার জন্য বুকের মধ্যে সুপ্ত হয়ে থাকা কল্পনাটা যেন হয়ে ওঠে লাগামহীন ঘোড়া। আর সেই ‘ঘোড়ায়’ চড়ে খুব ভোর বেলা নির্জন প্রান্তরে একাকী ছুটতে থাকে স্বপ্নচারী এক বালক। সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার দুর্দমনীয় এক ইচ্ছের ডানায় উড়তে থাকেন তিনি। ১৯৫৭ সালে ফরিদপুর জেলা স্কুলের হয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরপর বাবার চাকরির কারণে কুষ্টিয়া চলে যেতে হয়। ভর্তি হন কুষ্টিয়ার মুসলিম স্কুলে। অ্যাথলেট হওয়ার যে বীজ তিনি বপন করেছিলেন তার ছোট্ট বুকে, তা এ সময় ধীরে ধীরে মুকলিত হতে থাকে। সে সময়ের ক্রীড়াঙ্গন ছিল ঝলমলে এক আকাশ। আর এই আকাশজুড়ে ছিল অনেক বেশি খেলাধুলা। একের পর এক আয়োজিত হতো আন্তঃস্কুল, সাব-ডিভিশনাল, ডিভিশনাল, জোনালসহ বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। অ্যাথলেট হওয়ার সংকল্পে অটল এক বালকের জন্য তা ছিল দিগন্ত ছুঁয়ে দেখার বিশাল এক ক্ষেত্র। এমন এক পরিসর পেয়ে নিজেকে মেলে ধরতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তিনি নিয়মিত অংশ নিতেন। সাফল্য দেখান অ্যাথলেটিক্সের বিভিন্ন ইভেন্টে। ১৯৫৯ সালে তার স্কুলের হয়ে যশোর রেঞ্জের ৮০০ ও ৪০০ মিটার দৌড়ে দ্বিতীয় ও দীর্ঘ লম্ফে তৃতীয় হন। উন্মুক্ত হয় তার স্বপ্নের পরিধি। এগিয়ে যেতে থাকেন স্বপ্নের পথ বেয়ে। ঢাকায় প্রভিনশিয়াল ইন্টার স্কুল বাৎসরিক অ্যাথলেটিক্সে ২০০ মিটার দৌড়ে দ্বিতীয় ও ৪৪০ গজ দৌড়ে তৃতীয় হন। ১৯৬০ সালে কুষ্টিয়া বার্ষিক অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় অ্যাথলেটিক ক্লাবের হয়ে ৪০০, ৮০০ ও ১৫০০ মিটার দৌড়ে প্রথম এবং ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৬৫ ও ১৯৬৬ সালে ঢাকায় ইপিআইডিসি বার্ষিক অ্যাথলেটিক্সে পরপর দু’বার চ্যাম্পিয়ন হন। তিনি কুষ্টিয়া সুগার মিলের পক্ষে ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটার ইভেন্টে প্রথম হন। ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রামে বার্ষিক রেলওয়ে অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় অংশ নেন ঢাকা রেল বিভাগের হয়ে। ৮০০, ১৫০০, ৫০০০ ও ক্রস কান্ট্রির দৌড়ে প্রথম এবং ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হন। ১৬ মিনিট ১৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে ৫০০০ মিটার দৌড়ে নতুন রেকর্ড গড়েন। একই বছর চট্টগ্রাম পলোগ্রাউন্ড বার্ষিক অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় চিটাগাং বয়েজ স্টার ক্লাবের হয়ে ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০ মিটারে প্রথম হন। ১৯৬৭-৬৮ সালে ঢাকায় টিএন্ডটি বিভাগের বার্ষিক অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের পক্ষে ৪০০, ৭০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটারে প্রথম এবং পরপর দু’বার ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৬৮-৬৯ সালে ফরিদপুরে বার্ষিক অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় টাউন ক্লাবের হয়ে ৪০০, ৮০০, ১৫০০, ৫০০০ ও রিলে রেসে প্রথম এবং দু’বার ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হন।
স্কুলের পর কলেজ পর্যায়ে কাজী আলমগীর সাফল্যের ধারা অব্যাহত রাখেন। কুষ্টিয়া কলেজের সেরা ক্রীড়াবিদ ছিলেন তিনি। রাজশাহীতে আন্তঃকলেজ অ্যাথলেটিক্সে ১৯৬১-৬২ সালে কুষ্টিয়া কলেজের হয়ে অধিনায়কত্ব করেন। তিনি ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটারে প্রথম হন। ১৯৬২ সালে ৮০০, ১৫০০, ৫০০০ ও ৪ গুণন ৪০০ মিটার রিলেতে প্রথম হলে কুষ্টিয়া কলেজ এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন কুষ্টিয়া কলেজের অধিনায়ক। ১৯৬৩ সালে তিনি ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটারে প্রথম হন। ১৯৬৪ সালে তিনি ৮০০ মিটারে দ্বিতীয় এবং ১৫০০ ও ৫০০০ মিটার ইভেন্টে প্রথম হন। ১৯৬৫ সালে ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটারে তিনি প্রথম হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিক্সেও কাজী আলমগীর ছিলেন সুপরিচিত নাম। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ১৯৬২ সালে ঢাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ৮০০ ও ১৫০০ মিটারে প্রথম, ১৯৬৪ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে তিনি ৮০০, ১৫০০, ৫০০০ ও ৪ গুণন ৪০০ মিটার রিলেতে প্রথম হওয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দলগত এবং তিনি ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন, ১৯৬৬ সালে ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ৮০০ ও ১৫০০ মিটারে প্রথম, ১৯৬৮ সালে রাজশাহীতে ১৫০০ মিটারে প্রথম এবং ৮০০ ও ৫০০০ মিটারে দ্বিতীয় হন। তিনি ছিলেন দলের অধিনায়ক। তার দল রানার্স-আপ হয়। ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ১৭ মিনিট ২১ দশমিক ৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে ৫০০০ মিটারে এবং ১৯৭০ সালে ৪ মিনিট ১৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে ১৫০০ মিটারে রেকর্ড গড়েন।
আর আন্তঃহল প্রতিযোগিতায় কাজী আলমগীরের রয়েছে অনেক কীর্তি। ১৯৬৬ সালে ঢাকা হল (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) বাৎসরিক অ্যাথলেটিক প্রতিযোগিতায় ৪০০, ৮০০, ১৫০০, ৫০০০ ও ৪ গুণন ৪০০ মিটার রিলেতে প্রথম হওয়ায় তিনি ব্যক্তিগত ও ঢাকা হল রানার্স-আপ হয়। ১৯৬৮ সালে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হল বাৎসরিক অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটারে প্রথম হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হন। একই বছর আন্তঃহল প্রতিযোগিতায় তিনি ছিলেন মুহসীন হলের অধিনায়ক। ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটারে তিনি প্রথম হলে তার হল চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি মুহসীন হল বাৎসরিক প্রতিযোগিতায় ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটারে প্রথম হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।
১৯৬৩ সাল থেকে জাতীয় পর্যায়ের অ্যাথলেট হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। সে বছর পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে তিনি সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ১৫০০, ৫০০০ মিটারে স্বর্ণ এবং ১০০০০ ও ৪ গুণন ৪০০ মিটার রিলেতে রৌপ্য পদক জয় করেন। ১৯৬৪ সালে সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তিনি ৮০০, ৫০০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণ এবং ১৫০০ ও ১০০০০ মিটার দৌড়ে রৌপ্য পদক লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে ইপিআইডিসি’র পক্ষে তিনি ১৫০০ ও ১০০০০ মিটার দৌড়ে রৌপ্য এবং ৮০০ মিটার দৌড়ে ব্রোঞ্জ পদক পান। ১৯৬৬ সালে ইপিআইডিসি হয়ে ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটার দৌড়ে পেয়েছেন স্বর্ণপদক। ১৯৬৭ সালে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণ এবং ৪ গুণন ৪০০ মিটার রিলেতে রৌপ্য পদক লাভ করেন।
এছাড়া কাজী আলমগীর ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে ঢাকায় জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে ৮০০ ও ১৫০০ মিটার, ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে লাহোরে আরসিডি গেমসে ৮০০ মিটার, একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে লাহোরে পিএএএফ ট্রায়ালে ৫০০০ মিটার, ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে ৮০০, ১৫০০ ও ৫০০০ মিটার, ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে ঢাকায় ন্যাশনাল গেমসে ৮০০ ও ১৫০০ মিটার এবং ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের হয়ে করাচীতে ১২তম জাতীয় গেমসে ৮০০ ও ১৫০০ মিটারে অংশ নেন। পাকিস্তানের সার্ভিসেস দলের এশিয়ান পর্যায়ের অ্যাথলেটদের সঙ্গে পেরে উঠেননি। অবশ্য তিনি কেন, কোনো বাঙালি পুরুষই অ্যাথলেট পাকিস্তান পর্যায়ে বলতে গেলে বড় কোনো সাফল্য পাননি।
অ্যাথলেটিক্স ছাড়াও কাজী আলমগীর ফুটবলার, বাস্কেটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ছিলেন। ফুটবলার হিসেবেও বেশ খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। ১৯৬১-৬২ সালে ঢাকায় পাকিস্তান স্কুল কন্ট্রোল বোর্ড আয়োজিত ন্যাশনাল ট্রেনেজ কোচিং ফুটবলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে অংশ নেন। ১৯৬২ সালে রাজশাহীতে আন্তঃকলেজ ফুটবল টুর্নামেন্টে কুষ্টিয়া কলেজের অধিনায়ক ছিলেন। খেলতেন রাইট আউট পজিশনে। একই বছর রাজশাহীতে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কুষ্টিয়া লীগে গঙ্গা কপোতাক্ষ, কুষ্টিয়া লিবার্টি ও অ্যাথলেটিক ক্লাবের হয়ে খেলেন। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে রোনাল্ড শীল্ডে কুষ্টিয়া একাদশ এবং কুষ্টিয়ায় পাকিস্তান থেকে আসা হায়দরাবাদ দলের বিপক্ষে কুষ্টিয়া একাদশের হয়ে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচে অংশ নেন। ১৯৬৬ সালে আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলে খেলেন। একই বছর ফরিদপুরে খেলেন আন্তঃজেলা ফুটবলে ফরিদপুর জেলার হয়ে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা লীগে রহমতগঞ্জের হয়ে খেলেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা ইস্টএন্ড ক্লাবের হয়ে খেলেন এবং কক্সবাজারে গোল্ডকাপে অংশ নেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তঃবিভাগ ফুটবলে ইতিহাস বিভাগের অধিনায়ক ছিলেন এবং সে বছর চ্যাম্পিয়ন হয় তার বিভাগ। ১৯৬৯ সালে ফরিদপুরে সিংহল দলের বিপক্ষে প্রদর্শনী ফুটবলে ফরিদপুর একাদশের হয়ে অংশ নেন। ১৯৭০ সালে কুমিল্লায় জাতীয় ফুটবলে খেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে পাকিস্তানের করাচী, লাহোর, পেশোয়ার, হায়দরাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি ও মুলতানে প্রদর্শনী ম্যাচে অংশ নেন।
১৯৬৭ সালে আন্তঃহল বাস্কেটবলে রানার্স-আপ মুহসীন হলের খেলোয়াড় ছিলেন। ১৯৬৯ সালে রাজশাহীতে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ব্যাডমিন্টনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে অংশ নেন। ১৯৭০ সালে আন্তঃহল ব্যাডমিন্টনে অংশ নেন মুহসীন হলের হয়ে।
১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মুহসীন হল থেকে ‘ব্লু’ পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ প্রদান করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী।
কাজী আলমগীর অ্যাথলেটিক্স ক্যারিয়ারে সেরা সাফল্য হিসেবে ১৯৬৬ সালে লাহোরে আরসিডি অ্যাথলেটিক্সে ৮০০ মিটার ইভেন্টে পঞ্চম হওয়াকে তার সেরা সাফল্য মনে করেন।
কাজী আলমগীর জানান, পাকিস্তান আমলে সিনিয়র খেলোয়াড়রা জুনিয়রদের প্রতি ছিলেন আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল। তারা তাদের নানাভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা এবং অনুপ্রেরণা প্রদান করতেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন খ্যাতিমান ফুটবলার কবীর, গজনবী, শাহআলম প্রমুখ।
সাফল্যের কারণ হিসেবে কাজী আলমগীর জানান, মাঠের সঙ্গে আমার ছিল নিবিড় বন্ধন। সূর্য উঠার প্রায় ঘন্টাখানেক আগে মাঠে চলে যেতাম। তারপর সকাল সাতটা-আটটা পর্যন্ত অনুশীলন চালিয়ে যেতেন। আবার বিকেল তিনটা-চারটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিবিড় অনুশীলন করতাম।
সে সময় অ্যাথলেটিক্স রমরমা হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে কাজী আলমগীর জানান, তখন অ্যাথলেটিক্সে আসতেন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। আসতেন প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে। তারা এ খেলাটিকে মনে করতেন সফিসটিকেটেড খেলা। সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও তাদের মাঝে ছিল খেলোয়াড়ী মনোভাব। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও খেলায় ভালো করার সাধনা ছিল। আগের তুলনায় এখন অ্যাথলেটিক্সের মান উন্নত হলেও খুব বেশি হয়নি। অথচ বেড়েছে সুযোগ-সুবিধা ও আধুনিক প্রযুক্তি। কিন্তু সাফ গেমসের সীমানা অতিক্রম করা যায়নি।
পাকিস্তানের জাতীয় প্রতিযোগিতায় বাঙালিরা সুবিধা করতে না পারা প্রসঙ্গে তিনি জানান, মূলত সেনাবাহিনীর অ্যাথলেটরা সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়ে অ্যাথলেটিক করতেন। তাদের দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হতো অ্যাথলেটিক্সে। তাছাড়া তাদের শারীরিক গড়ন ও উচ্চতার কারণে তারা এগিয়ে থাকতেন। স্প্রিন্টার এ খালেক, মুবারক শাহ, গোলাম রাজিক, তোফেল বাজুয়া, মনজুর আওয়ান, আল্লাদিতা, জন পারমল প্রমুখ এশিয়ান পর্যায়ে পদকজয়ী খ্যাতিমান অ্যাথলেটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পেরে উঠা সক্ষম হতো না।
সমসাময়িক অ্যাথলেটদের সম্পর্কে কাজী আলমগীর জানান, দ্রুততম মানব সিরাজুল ইসলাম, ম্যারাথন দৌড়বিদ জহুরুল হক রতন, স্প্রিন্টার কামরুল ইসলাম, ব্রড জাম্পার আলতাফ হোসেন, জাহাঙ্গীর ফয়েজ, মিরাজ, আবুল হোসেন, জেমস জয় মল্লিক, হাফিজউদ্দিন আহমেদ, আরজান খান, ফখরুদ্দিন আহমেদ, কাজী বশির, কাজী নাসিম, ডলি ক্রুজ, রওশন আরা ছবি, সুলতানা আহমেদ প্রমুখ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সেরা অ্যাথলেট। এদের মধ্যে কেউ কেউ তার সিনিয়র হলেও অনেকের সঙ্গেই এক সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
জীবনের বড় একটা সময় ক্রীড়াঙ্গনে কাটিয়ে দিলেও কাজী আলমগীর রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি পাননি। যদিও কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করেও অংশ নিয়েছেন খেলাধুলায়। কিন্তু তিনি মনে করেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে হলে যোগ্য ব্যক্তিদের পুরস্কৃত ও সম্মানিত করাটা অপরিহার্য। জীবনের শেষ বেলায় এসে যখন দেখি, কোনো প্রাপ্তি নেই, তখন নিশ্চয় কাউকে খেলাধুলায় অংশ নেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ কিংবা তাকে খেলাধুলায় এগিয়ে আসার জন্য বলতে মন চায় না। তাছাড়া অ্যাথলেট হিসেবেও সেভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। এটা খেলাধুলার জন্য মোটেও আশা জাগানিয়া নয়।’
কাজী আলমগীরের অ্যাথলেট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ঘটে যায় তার জীবনের চরম বিপর্যয়। ঢাকার ডিআইটি রোডে পাকিস্তানী সেনারা তাকে গুলি করে। এরপর তিনি আর কিছু জানতেন না। সুস্থ হওয়ার পর দেখেন তার ডান হাত নেই। সরকার তাকে সুচিকিৎসার জন্য ফ্রান্স পাঠায়। সেখানে অবস্থানকালে ইউনেস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং ১৯৭৪ সালে ইউনেস্কোর চাকরিতে যোগ দেন। তিন বছর চাকরি করে ফিরে আসার বেশ কিছু দিন পর ১৯৮০ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে যোগ দেন লাইব্রেরিয়ান হিসেবে। অবসর নেন ২০০২ সালে সেক্রেটারি ফেডারেশন হিসেবে।
খেলাধুলা ছাড়াও তিনি সৃজনশীল কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। নাটক করতেন। টেলিভিশনেও তিনি অভিনয় করেছেন। কাজী আলমগীর ১৯৭৪ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি এক কন্যা সোহেলা সিলভী পারভীন ও এক পুত্র এহসান রুশদীর জনক।
জীবনযুদ্ধে হিমশিম খাওয়া কাজী আলমগীরকে দেখলে আজ আর বোঝার উপায় নেই যে, একটা সময় গতি দিয়ে হারিয়ে দিয়েছেন খেলার মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বীদের। অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। অথচ আজ তিনি অনেকটাই হার মেনেছেন জীবনের গতির কাছে। জীবনযুদ্ধে অনেকটাই যেন পরাস্ত। মুক্তিযুদ্ধে একটি হাত হারিয়ে হারান খেলার মাঠের গতি। তাতেও তিনি হতোদ্যম হননি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হারিয়েছেন জীবনের গতি। জীবনের দুর্বিপাকে পড়ে কোনো খেই পাচ্ছেন না। ২০০৩ সালে হারান জীবনসঙ্গীকে। ব্রেইন ক্যান্সারে আক্রান্ত স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য জীবনের সঞ্চয়টুকু হারিয়ে হয়ে পড়েছেন কপর্দকশূন্য। একমাত্র কন্যা পরবাসী। একমাত্র পুত্র এখনও জীবনের ভার বহন করতে সক্ষম হননি। সব মিলিয়ে অবসর জীবনে দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়ে কঠিন এক জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন দুরন্ত গতির কাজী আলমগীর। #
১-৯-২০০৭

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ

এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয় / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ