‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

সময়ের আবর্তনে ইতিহাস কখনো কখনো ফিরে ফিরে আসে। ইন্দো-বাংলাদেশ বাংলা গেমস যেন ইতিহাসেরই কিছুটা পুনরাবৃত্তি। যে ইতিহাসে হাজার বছর ধরে বাংলা নামক একটি ভূখণ্ড হাত ধরাধরি করে অবস্থান করেছে, রাজনৈতিক কারণে তা পরস্পরের বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও ক্রীড়াকে কেন্দ্র করে দুই বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেন মিলেছে একই মোহনায়। যেমন করে গঙ্গা নদী এসে মেলে পদ্মার সঙ্গে এবং ব্রহ্মপুত্র লীন হয় যমুনায়। একটুখানি পেছন ফিরে তাকালে আমাদের অনুভবে, স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে দুই বাংলার চিরায়ত সম্পর্কের ইতিবৃত্ত। তা এমনভাবে মিলে-মিশে আছে, তাকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা, অনেক আনন্দ ও গৌরবের যৌথ অংশীদার অবিভক্ত বাংলা। তাকে বিভক্ত করা যাবে কীভাবে? যে কারণে সেই সময়টা দুই বাংলার কাছেই সমাদৃত হয়ে আছে, আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশের অংশ তদানীন্তন পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশ এবং ভারতের একটি রাজ্য হিসেবে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গ ছিল দীর্ঘ ও অভিন্ন সাংস্কৃতিক, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশীদার। যে কারণে দুই বাংলার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও খেলাধুলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য একই তারে বাঁধা। বস্তুত বাইরের কারো পক্ষে দুই বাংলার জনগণকে পৃথক করা খুবই কঠিন। ভাষাতত্ত্ববিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র ভাষায়, ‘বিধাতা আমাদের চেহারায় এমনভাবে বাঙালিয়ানার ছাপ মেরে দিয়েছেন, দাড়ি, টিকিতে তা ঢাকার উপায় নেই’। বাংলা ভাষাভাষী এই দুই বাংলার জীবনধারা ও লোকায়ত সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তেমন কোনো পার্থক্য নেই বললেই চলে। দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক এই অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির বসবাস। পৃথিবীর অন্যতম ঘন বসতি এলাকা হিসেবে বাংলার অবস্থান। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব-দ্বীপ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকায় রয়েছে বাংলা। বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি ও বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন দুই বাংলার সৌন্দর্যের আকর। রয়েল বেঙ্গল টাইগার দুই বাংলায় অবাধে যাতায়াত করতে পারলেও মানুষের সেই সুযোগ নেই। ধর্মটাকে বাদ দিলে কৃষিভিত্তিক সমাজে বাঙালির পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, নাটক, সিনেমা, গান, প্রণয়, পরিণয়, পরিবারের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। ভাত ও মাছ তো চিরকালের বাঙালির প্রিয় ও প্রধান খাদ্য। ইলিশ মাছ, রসগোল্লা, চমচমের মত মিস্টি, নানা রকম পিঠা-পুলি বাঙালির রসনাকে তৃপ্ত করে আসছে যুগে যুগে। আর শাড়ী তো বাঙালি নারীর প্রিয় ভূষণ।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ও বেঙ্গলি রেঁনেসার মাধ্যমে ভারতীয় সমাজে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিশ্বের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে বাংলা। এ কারণে বলা হতো : ‘বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত ভাবে আগামীকাল এবং বাকি বিশ্ব ভাবে তারও পরে’।
১৯৪৭ সালের আগে বাংলা ছিল অখণ্ড এক মানচিত্র। একটি ছাতার নিচে পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে। দেশভাগ বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করে বানিয়ে দিয়েছে দুটি দেশ। আলাদা হয়ে গেলেও দুই বাংলার সম্পর্কটা বিনি সুতোর মালার মতো গেঁথে রেখেছে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী। ভারতের হিমালয় থেকে উৎসারিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে গঙ্গা নদী রাজশাহীর নবাবগঞ্জের ওপর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর তা রূপ নিয়েছে পদ্মা নদীতে। একইভাবে ভারতের ব্রহ্মপুত্র নদী কুড়িগ্রাম হয়ে বাংলাদেশে আসার পর নামকরণ হয়েছে যমুনা নদী। পদ্মা ও যমুনা যেন বাংলাদেশের গলার মণিহার। নদীর নাম বদলে গেলেও তার চঞ্চলতা, উচ্ছলতা, স্রোতধারা, রঙ, রূপ কিন্তু বদলায়নি। এই দুই নদী পৃথক হয়ে যাওয়া দুই বাংলাকে বয়ে নিয়ে চলেছে সমান্তরালভাবে। এ কারণে গণমানুষের শিল্পী ভুপেন হাজারিকার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় : ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা, আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা মেঘনা-যমুনা’। নদী তো বয়ে যায় আপন খেয়ালে। তার তো কোনো দেশ নেই, ধর্ম নেই, জাতীয়তা নেই। নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠে যে সভ্যতা ও জনপদ, তার দুই পাড়ের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা তো অনেকটাই অভিন্ন। নদী তো একটি দেশ ও জনপদের ধমনীর মতো। মানুষের শরীরে যেমনভাবে বয়ে গেছে মহাধমনী। হৃদয় থেকে উৎসারিত এই মহাধমনী বিভিন্ন রক্তনালীর মাধ্যমে পুরো দেহে রক্ত সঞ্চালন করে থাকে। তবে এই রক্তনালী শরীরের বিভিন্ন অংশে নানা নামে বহমান। নাম পাল্টে গেলেও জীবনের সঞ্জীবনী হিসেবে একইভাবে কাজ করে রক্তনালী। নদীও তো অনুরূপভাবে জনপদ ও সভ্যতার জীয়নকাঠি। তার নাম বদলে দিয়ে কিংবা তাকে কৃত্রিমভাবে আটকে দিয়ে তার চলমানতাকে রুদ্ধ করা যায় না।
নদীর উৎসমুখ, গতিপথ, জলরাশি একই ধারায় প্রবাহিত হওয়ায় বাংলার জীবনযাত্রায় এর প্রভাব অপরিসীম। বাংলার শহর, নগর ও বাণিজ্যকেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে। নদীর জলরাশি দু’কূল ছাপিয়ে প্রবাহিত হলে নদী পরিবাহিত বস্তুকণার অংশবিশেষ নদীর তলদেশে অথবা নদীখাতের দুই পাড়ে সঞ্চিত হয়। এর ফলে গড়ে ওঠে ব-দ্বীপ, প্লাবনভূমি, চর ও পলিজ ভূমিরূপ। তাকে কেন্দ্র করেই জীবনের অস্তিত্ব, সামগ্রিক পারিপাশ্বির্কতা ও জলবায়ু। বাংলা মূলত পাললিক ভূখণ্ড। এ কারণে বাংলার জীবনধারা সংগঠন ও বিকাশে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গুরুত্ব বেশি। পুরনো মূল্যবোধ ও গ্রামীণ মানসিকতার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাংলার সমাজ কাঠামো। এ বাংলায় অনার্য, দ্রাবিড় ও আর্য সমন্বয়ে মিশ্র জাতির বসবাস। বাংলা ভাগ হলেও এই উপাদানগুলো দুই বাংলায় বিদ্যমান।

(২)
বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্য সুপ্রাচীনকালের। সেই প্রাচীনকালে বাংলায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বঙ্গ, পুণ্ড্র, রাঢ়, গৌড়, সমতট, হরিকেল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দে একটু দেরিতে হলেও আগমন ঘটে আর্যদের। আর্যরা এলেও বাংলার সমাজ জীবনে অনার্য প্রভাব অবশ্য রয়ে যায়। অবশ্য পর্যায়ক্রমে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়। তবে এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা হলো নিষাদ বা অস্ট্রিক কিংবা অস্ট্রো-এশীয় গোষ্ঠী। প্রায় চার হাজার বছর আগে বাংলায় বসবাস শুরু করে দ্রাবিড় ও তিব্বতি-বর্মী ভাষাভাষীরা। বাংলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে গঙ্গা নদীর মোহনার কাছে গঙ্গারিডি বা গঙ্গারিডাই নামক একটি রাজ্য নির্ণয় করা সম্ভব হয়। এটি ছিল বেশ সমৃদ্ধ জনপদ। এই জনপদের জীবনযাপনে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়। বাংলায় পাঠান যুগের পূর্ব থেকে পশ্চিমবঙ্গ গৌড় এবং পূর্ববঙ্গ বঙ্গ নামে শনাক্ত করা হয়। উনিশ শতকের প্রথম ভাগেও গৌড় নামটি সমগ্র বাংলাদেশ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যে অঞ্চলে বং গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করত, সে অঞ্চলের মানুষ পরিচিত হয় বাঙালি নামে। অস্ট্রিক গোষ্ঠী থেকে বাঙালি জাতির বড় একটি অংশ গড়ে ওঠেছে বলে মনে করা হয়। অনেকেই আবার তাদের বলেন নিষাদ জাতি। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণেই আর্যপূর্ব বাঙালি জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি। এর সঙ্গে আর্য জাতি সংযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠে বাঙালি জাতি।
বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়কে প্রাচীন পুণ্ড্রনগরী হিসেবে অভিহিত করা হয়। মহাস্থানগড় থেকে যে লিপি পাওয়া যায়, তা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর মৌর্য শাসনের প্রমাণ বহন করে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে বঙ্গের মিহি বস্ত্রের খ্যাতি ছিল পুরো ভারতজুড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে পূর্ব বাংলার মসলিন বিকশিত হয় এবং দুনিয়াব্যাপী সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। পোড়া মাটির ফলকগুলোও বাংলার প্রাচীনতার স্মারক। খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে বাংলার বদ্বীপ অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী একটি রাজ্য। গঙ্গা নদীর তীরবর্তী গঙ্গে নদী ছিল এ রাজ্যের রাজধানী। চতুর্থ শতাব্দীতে সমুদ্র গুপ্তের সাম্রাজ্য বিস্তারকালে বাংলা বিভক্ত ছিল কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যে। গুপ্ত সাম্রাজ্য ছিল ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ সময় বাংলা ছিল গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। বঙ্গ দেশ সর্বভারতীয় অংশ হিসেবে বেশ সুফল পায়। ষষ্ঠ শতাব্দীতে বাংলায় স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। তিনিই প্রথম রাজা হিসেবে বাংলার সীমানা বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা হিসেবে তার আওতাভুক্ত জনপদগুলোকে গৌড় নামে একত্রিত করেন। বাংলায় প্রথম বৌদ্ধ পাল রাজা ছিলেন গোপাল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সূচনা হয় বাংলার মুসলিম শাসন। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি তুরস্ক থেকে এসে আকস্মিকভাবে বাংলা দখল করে নেন। মুসলিম শাসনামলে সালতানাত নামে পরিচিত হয়। মুঘল শাসকরা আসার পর আফগান ও তুর্কী শাসনের অবসান ঘটে। ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘলদের জয়জয়কার। সম্রাট আকবরের আমলে সমগ্র বঙ্গদেশ পরিচিত ছিল ‘সুবহ-ই-বঙ্গালহ’।
বাংলা, বিহার, ত্রিপুরা, উড়িষ্যাকে নিয়ে গড়ে ওঠা বাংলা মুঘল আমলে নানাভাবে আলোচিত হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনে আরোহণ করার পর বাংলার মুঘল সুবাহদার ইসলাম খান প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর অর্থাৎ ঢাকায় স্থানান্তর করেন। বাংলায় মুঘল সুবাহাদার শায়েস্তা খানের আমলে টাকায় আট মণ চাল বিক্রির ঘটনা হয়ে আছে প্রবাদ। সে সময় নানা কারণে বাংলা জন্ম দিয়েছে অসংখ্য ঘটনার। সম্রাট আওরঙ্গজেব পৌত্র মুহম্মদ আজিমুদ্দিনকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবেদার নিয়োগ করেন। অর্থের প্রতি তার ছিল তীব্র আকর্ষণ। অর্থের বিনিময়ে তিনি ১৬৯৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সুতানটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা গ্রাম তিনটি ক্রয়ের অনুমতি দিয়ে বাংলায় খাল কেটে কুমীর আনার ব্যবস্থা করেন। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দী খান দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনে উত্তরাধিকার করার পর বাংলার ভাগ্যাকাশে নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভ ছলে-বলে-কৌশলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্নে বিভোর হন। সঙ্গী হিসেবে পেয়ে যান বাংলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান, জগতশেঠ, রাজবল্লভ, ঘষেটি বেগমদের। ১৭৫৩ সালের ২৩ জুন প্রহসনের যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় ইংরেজদের রাজত্ব। অস্ত যায় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য।

(৩)
এরপর বাংলা হয়ে ওঠে ইংরেজদের লুণ্ঠনের উর্বরভূমি। ইংরেজদের শোষণ ও শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে বাংলার মানুষ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সী মানুষ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ১৮৩১ সালে বাঁশের কেল্লা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বারাসতের বিদ্রোহী নেতা তিতুমীর। বীরের মতো লড়াই করে সঙ্গী-সাথীসহ জীবন দেন তিনি। ১৮৪২ সালে ফরিদপুরে ফারাজী আন্দোলন গড়ে তোলেন দুদু মিঞা। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ কাঁপিয়ে দেয় ব্রিটিশদের। ব্যারাকপুরের মঙ্গল পান্ডের সাহসের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। যে কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ভারত শাসনের দায়িত্ব নেয় ব্রিটিশ সরকার। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অনুশীলন সমিতি, স্বদেশী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ঘরে ঘরে। রজনীকান্ত সেনের ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’ আর ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকীর আত্মোৎসর্গের পর রচিত ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গান বাংলার মানুষের মুখে মুখে গীত হয়। এই আন্দোলন, এই গান অবিভক্ত বাংলার পরম সম্পদ। ব্রিটিশরা তাদের কূটকৌশল ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতির অংশ হিসেবে ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ করে। রাজনৈতিক চাপের মুখে ব্রিটিশরা পিছু হাঁটতে বাধ্য হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা বিভক্তির বিরোধিতা করে লেখেন, ‘বাঙলার মাটি, বাঙলার জল, বাঙলার বায়ু, বাঙলার ফল, এক হউক, এক হউক, এক হউক হে ভগবান’। ১৯১২ সালে রদ করা হয় বঙ্গ বিভাগ। তবে বাংলা থেকে ঝরে যায় বিহার ও উড়িষ্যা। তাতে ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলনে ভাটা পড়েনি। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে মাস্টার দা সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা দখল করে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার ও প্রধান প্রধান সরকারি দফতর এবং একই বছর বীরকন্যা প্রীতিলতা পাহাড়তলীর ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়ে শহীদ হন।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হওয়ার প্রাক্কালে দেশভাগের প্রশ্নটি আলোচনায় উঠে আসে। সে সময় বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আনুষ্ঠানিকভাবে অবিভক্ত বাংলাকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র করার পরিকল্পনা পেশ করেন। একই প্রস্তাব উত্থাপন করে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক শরৎ চন্দ্র বসু। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার কংগ্রেস দলের সংসদীয় দলনেতা কিরণ শঙ্কর রায় ও বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিমও এ বিষয়ে সোচ্চার হন। এ নিয়ে জল-পানি অনেক ঘোলা করা হলেও বাংলা ভাগকে ঠেকানো যায়নি।
বাংলা ভাগ হলেও বাঙালির লোকায়ত জীবনধারা ও লোকসংস্কৃতিকে পৃথক করা যায়নি। লোকসম্প্রদায়ের জীবনাচারণের ভিত্তিতে যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তা তাদের একান্তই নিজস্ব। নিজস্ব জীবনপ্রণালীর মাধ্যমে যে সংস্কৃতি, তা এক ও অবিভাজ্য। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার যে আখ্যান রচিত হয়েছে, তা বাঙালি জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। বাংলার লোকসাহিত্যে প্রতিফলন ঘটেছে বাঙালি জীবনের নানা অনুষঙ্গ। ঠাঁই করে নিয়েছে বাঙালির মনের বিচিত্র পরিচয়। তাতে আছে বাঙালির সাংস্কৃতিক উপকরণ, জলবায়ু, জীবনযাপনের অন্তরঙ্গ দৃশ্যপট। রূপায়িত হয়েছে অতীতের ইতিহাস ও সমাজচিত্র। ছড়া, গান, গীতিকা, কথা, ধাঁধা, প্রবাদ ইত্যাদি লোকসাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন। আরো আছে রূপকথা, উপকথা, ব্রতকথা। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের মৈমনসিংহ গীতিকা মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, রূপবতী, কাজলরেখা সমৃদ্ধ করেছে বাংলা লোকসাহিত্যের ভান্ডারকে।

(৪)
জীবনধারণের জন্য যেসব বস্তুগত উপকরণ ব্যবহৃত হয়, তার মধ্যে দুই বাংলায় মৌলিক কোনো প্রভেদ নেই। গ্রামীণ নানা বৃত্তিতে নিয়োজিত কৃষক, জেলে, তাঁতি, কুমার, ছুতার, কামার, ধোপা, নাপিত, ময়রা, চর্মকার প্রভৃতির জীবনযাপন ও কাজের ধরন-ধারণ দুই বাংলায় অবিকল এক। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জীবনযাপন এসব সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত। কলকাতা ও ঢাকায় চাকরিজীবী শ্রেণী বিকশিত হওয়ার আগে বাঙালির জীবনধারা প্রবাহিত হয়েছে একই ধারায়। হালে নগরসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটলেও গ্রামীণ লোকায়ত জীবন, সাহিত্য, সংস্কৃতি এখনো বাঙালির জন্য গৌরবের।
বাংলা ভাগ হওয়ায় রাজনীতিটা দু’ধারায় প্রবাহিত হলেও শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়ার মতো নান্দনিক চর্চার বিষয়টি একে অপরের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে আছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। আদি বা প্রাচীন যুগে প্রাকৃত ভাষা থেকে উৎপত্তি হয় বাংলা ভাষার। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ। এ পদগুলো রচনা করা হয় আনুমানিক সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত। তাতে স্থান পায় বৌদ্ধ সহজিয়াদের ধর্মতত্ত্ব ও সাধন-ভোজন। মধ্যযুগে প্রথম নিদর্শন কবি বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন। তার রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে প্রণয়বিষয়ক নাট্যকাহিনী কাব্য বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের আরেকটি নিদর্শন মঙ্গলকাব্য। ধর্মাশ্রিত এ কাহিনী কাব্য দুই বাংলার মানুষের জীবনধারা উঠে এসেছে অনুপুঙ্খভাবে। এরপর পঞ্চদশ শতকে শাহ মুহম্মদ সগীর রচিত ইউসুফ-জোলেখা কাব্য, ষোড়শ শতকে উজির বাহরাম খানের লায়লী-মজনু প্রেমের শাশ্বত উপাখ্যান হয়ে আছে। বৈষ্ণব পদাবলীর ধারাটিকে সমৃদ্ধ করেন চণ্ডী দাস, গোবিন্দ দাস, জ্ঞান দাস প্রমুখ। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা হয় ১৮০০ সালে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখক গোষ্ঠী এবং ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতার হিন্দু কলেজ বাংলা সাহিত্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিও’র শিষ্যরাই ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিতি লাভ করেন। তাদের হাতেই রূপান্তর ঘটে বাংলা সাহিত্যের। রাজা রামমোহন রায়ের বাংলা গদ্য, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতিকে উৎকর্ষকরণ, টেকচাঁদ ঠাকুরের প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘আলালের ঘরে দুলাল’, কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ এবং সমাচার দর্পণ, সবুজপত্র, প্রবাসী পত্রিকার হাত ধরে একটু একটু করে বিকশিত হতে থাকে আধুনিক বাংলা সাহিত্য। তবে বাংলা সাহিত্যকে এক ঝটকায় সাবালক করে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার কলমে পরিস্ফূটিত হয় বিশাল বাংলার প্রকৃতি, জীবনযাত্রা। প্রাচুর্য ও বৈচিত্র্যে সৃষ্টিশীলতায় তিনি এক ও অদ্বিতীয়। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জয় করে তিনি বাংলা ভাষাকে বিশ্বসাহিত্যে স্থান দেন। তার সময়কালেই কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় ও তার পুত্র উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, ধূমকেতুর মত আসা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ, সৈয়দ মুজতবা আলী, মানিক বন্দোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা সাহিত্যের আকাশে জ্বলছেন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে। দেশভাগের ৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত অনেক গ্রন্থেরই প্রেক্ষাপট তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ। এমনকি শামসুর রাহমান, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আল মাহমুদ, জয় গোস্বামীরা বিভক্ত বাংলায় সাহিত্যের জমিতে যে ফসল ফলিয়েছেন, তার পরিসর জুড়ে আছে বাংলার আকাশ-বাতাস, নদী-নালা, নিসর্গ। নাম-ধাম বাদ দিলে বাংলা সাহিত্য তো অনেকটা আলবিহীন জমি।
বাঙালির বুকে বাজে একই সুর, একই সঙ্গীত। বাংলা লোকসঙ্গীতের চমৎকার ঐতিহ্য বাউল ঘরানা। এছাড়াও আছে গম্ভীরা, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া। আব্বাসউদ্দীন, আবদুল আলীম গ্রামীণ জনপদের সুরেলা কণ্ঠস্বর। একতারা তো বাঙালির লোকসঙ্গীতের প্রতীক। আর আছে দোতারা, ঢোল, বাঁশি, তবলা। উত্তর ভারতের ক্যাসিকাল সঙ্গীতও বাঙালির সুরের আকাশকে সমৃদ্ধ করেছে। বাউল গানের সাধক পুরুষ লালন শাহ মানব জীবনের আদর্শ, মানবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতুন এক ভাবনার জন্ম দেন। তিনি ছিলেন প্রকৃতঅর্থে বাঙালি চেতনার প্রতীক। মরমী কবি ও সাধক হাছন রাজা তার গানে প্রেম ও বৈরাগ্যময় আধ্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী আলাউদ্দীন খান, পুত্র আলী আকবর খান, জামাতা রবিশঙ্কর, কন্যা অন্নপূর্ণা, ভাইয়ের ছেলে বাহাদুর হোসেন খান, ফুলঝরি খান, খাদেম হোসেন খান, মীর কাশেম খান, কুমিল্লার শচীন দেব বর্মণ, তার ছেলে রাহুল দেব বর্মণ, কমল দাশগুপ্ত সুরের আকাশকে ভরিয়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত তো নাগরিক বাঙালির এক ঝলক তাজা হাওয়া। হেমন্ত-কিশোর-সন্ধ্যা এক স্বর্ণালী সম্ভার। পুরনো দিনের বাংলা গান বাঙালির বুকে বুলিয়ে দেয় নস্টালজিয়ার পরশ। বাংলা চলচ্চিত্র বাঙালির পরম এক সম্পদ। মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন যে পথ দেখিয়ে দেন, তাকে অনুসরণ করে বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেন কিশোরগঞ্জের সত্যজিৎ রায়, ফরিদপুরের মৃণাল সেন, ঢাকার ঋতিক ঘটকরা। আর পাবনার সুচিত্রা সেনের সঙ্গে কলকাতার উত্তম কুমারের যুগলবন্দি বাঙালির হদয়ে এঁকে দিয়েছে চির-রোমান্টিক এক অনুভূতি। বাংলা ভাগ হলেও চিরন্তন বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান, বাংলা চলচ্চিত্রকে ভাগ করা যায়নি। নদীর মতো তা মিশেছে বাঙালির মানসপটে।
ঋতুর প্রতি বাঙালির অন্যরকম আকর্ষণ। বাংলা তো ষড়ঋতুর দেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। ঋতুর এই বৈচিত্র্য অন্যত্র দেখা যায় না। ঋতুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঙালির উৎসবের কমতি নেই। এ কারণে বলা হয়- বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। পহেলা বৈশাখ বাঙালির একটি সর্বজনীন উৎসব। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালিরা এটি উদযাপন করে সামাজিক উৎসব হিসেবে। মুঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকে প্রবর্তিত এই উৎসবের মাধ্যমে আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেয়া হয় নতুন বছরকে। আবাহন করা হয় কল্যাণকর ও নতুন জীবনকে। বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ হালখাতা। হালখাতার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা পুরনো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে দিয়ে নতুন খাতা খোলেন। নববর্ষকে রাঙিয়ে দেয় বৈশাখী মেলা। এ মেলায় শোভা পায় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকজ ও কুটির শিল্পজাত পণ্য, হস্তশিল্পজাত-মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী। চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা ইত্যাদি লোকজ খাদ্যদ্রব্য বাঙালির মুখরোচক হিসেবে চলে আসছে। বাংলা নববর্ষের মতো সর্বজনীন উৎসব পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বাঙালির জীবনে আরেকটি উৎসবের নাম নবান্ন। এর সঙ্গে ফসলের সম্পর্ক। অগ্রহায়ণ মাসে যখন প্রচুর ফসল ঘরে আসে, তখন পালন করা হয় এ উৎসবটি। এ সময় বাঙালির বুকে বয়ে যায় আনন্দের ঢেউ। আর ফাগুন মাসে রূপে-রঙে হেসে ওঠে প্রকৃতি। শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার রঙে রঙিন হয়ে ওঠে বাংলার পথ-ঘাট-মাঠ। কোকিলের সুমধুর কুহুতান বুকের মধ্যে এনে দেয় অনির্বচনীয় এক অনুভব। ঋতুরাজ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া বসন্ত বাঙালির শাশ্বত ঐতিহ্য। বসন্ত এলে বাঙালি নারী-পুরুষের হৃদয়ে বয়ে যায় সুখের কাঁপন। মাতাল হাওয়া দুলিয়ে দেয় মন-প্রাণ। আনন্দে, ছন্দে, সুরে লাগে ফাগুনের দোলা। বসন্তের প্রথম দিনে বাঙালির চিরন্তন সাজে সজ্জিত হয় সব বয়সী মানুষ। নারীরা বাসন্তী রঙের শাড়ির সঙ্গে খোপায় গাঁদা ফুলের মালা ও কপালে লাল টিপ দিয়ে সামনে এলে যে কোনো পুরুষের কাছে নিজেকে মনে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী বাঙালি। বাঙালিদের কাছে ছাড়া বসন্ত বোধহয় আর কোথাও এতটা পরিস্ফূটিত হয় না।
(৫)
ক্রীড়াক্ষেত্রেও বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্য অভিন্ন। সেই প্রাচীনকাল থেকে বিনোদনের অংশ হিসেবে বাঙালি চর্চা করে আসছে লোকক্রীড়া। কত রকম ক্রীড়াচর্চা যে বাঙালি করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। মাথা খাটিয়ে বের করেছে সহজ-সরল ও সস্তার নানা রকম খেলা। নৌকাবাইচ, বউছি, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, গোলাপ-টগর, নুনতা, চিক্কা, ডাংগুলি, ষোলোঘুঁটি, এক্কাদোক্কা, বউরাণী, কড়িখেলা, ঘুঁটিখেলা, কানামাছি, ঘুড়ি ওড়ানো, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, এলাটিং বেলাটিং, বাঘবন্দী, বৌছি, রুমাল চুরি, লাঠিখেলা, লুকোচুরি, সাতখোলা, হা-ডু-ডু ইত্যাদি বাঙালির আমোদ-প্রমোদ, অবসরযাপনের অংশ হয়ে আছে। দুই বাংলার মধ্যে আয়োজিত ইন্দো-বাংলাদেশ বাংলা গেমসে কাবাডি ছাড়াও স্থান পেয়েছে সাঁতার, খো-খো, ভলিবল, বাস্কেটবল, শুটিং, অ্যাথলেটিকস, ফুটবল এবং ক্রিকেট।
বাঙালির হা-ডু-ডু এখন স্থান করে নিয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে। পরিচিতি পেয়েছে কাবাডি হিসেবে। অবশ্য যাহা বায়ান্ন তাহাই তেপ্পান্ন। হা-ডু-ডু যা, কাবাডিও তা। কাবাডির ইতিহাস অনেক পুরনো। ভারতের মহাকাব্য মহাভারতে কুরু ও পা-বের যুদ্ধে উল্লেখ আছে কাবাডির মতো একটি খেলার কথা। তাম্রপত্র অনুসারে, ভগবান কৃষ্ণ বিনোদন ও রোমাঞ্চকর অনুভূতির জন্য একরকম খেলা খেলতেন। যা অনেকটা কাবাডির অনুরূপ। লর্ড বুদ্ধের সময় সুস্থ দেহ, সুস্থ মন ও দৃঢ় চরিত্র গঠনে তরুণ বুদ্ধ কাবাডি খেলতেন। উনবিংশ শতাব্দীতে কাবাডি খেলা হয় বিভিন্ন নামে। শ্রীলংকায় গুড়ু, বাংলাদেশে হা-ডু-ডু, থাইল্যান্ডে থিকাব। থাইল্যান্ডে এটি ছিল উৎসবের অংশ। তবে দেশে দেশে নানা নামে কাবাডি খেলা হলেও খেলার মৌলিক টেকনিক ছিল একই। পূর্ব বাংলার গ্রামে-গঞ্জে প্রচলন হয় হা-ডু-ডু খেলার। ফরিদপুর, মাদারীপুর, বরিশালে এ খেলাটিকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হতো উৎসবের আমেজ। এর আয়োজন করতেন জমিদাররা। পুরস্কার হিসেবে দেয়া হতো ঘোড়া, গরু, ছাগলসহ নানা রকম সাংসারিক দ্রব্য। সেরা রেইডার ও ক্যাচার পেতেন আলাদা সমাদার। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও তরুণ বয়সে কাবাডি খেলতেন বলে জানা যায়। তবে তখন পর্যন্ত এটি ছিল গ্রামীণ ক্রীড়ার অংশ। ১৯১৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় কাবাডি খেলা। ১৯২৩ সালে প্রবর্তন করা হয় আইন-কানুন। খেলাটিকে কেন্দ্র করে জনগণের মধ্যে একটি সংঘবদ্ধ শক্তির স্ফূরণ লক্ষ্য করে বিষয়টিকে ভালোভাবে নিতে পারেনি ব্রিটিশ শাসকরা। ১৯৩০ সালে তারা নিষিদ্ধ করে কাবাডি খেলা। বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয় বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতারা। শুরু হয় আন্দোলন। আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে ১৯৩১ সালে কাবাডি খেলার ওপর থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। এই বিজয় উদযাপনের অংশ হিসেবে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় চারুচন্দ্র স্মৃতিফলক কাবাডি টুর্নামেন্ট। ১৯৩৮ সালে ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন যে জাতীয় গেমস আয়োজন করে, তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল কাবাডি। এরপর সর্বত্র কাবাডি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৩ সালে ভারতের নয়াদিল্লিতে আয়োজিত গ্রামীণ ক্রীড়ায় যোগ দেয় বাংলাদেশ। তাতে অন্যতম ইভেন্ট ছিল কাবাডি। তবে কাবাডির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হয় ১৯৭৪ সালে। সে বছর বাংলাদেশে আয়োজিত হয় বাংলাদেশ-ভারত কাবাডি টেস্ট। দু’দেশ পাঁচটি টেস্ট ম্যাচ খেলে। তাছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হিসেবেও কাবাডির মর্যাদা বেড়েছে। ১৯৮০ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় প্রথম এশীয় কাবাডি চ্যাম্পিয়নশীপ। তাতে অংশ নেয় বাংলাদেশ। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসের আসর বসলে তাতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় কাবাডি। ১৯৯০ সালে চীনের বেইজিং এশিয়ান গেমসে স্থান করে নেয় কাবাডি। বাংলার লোকায়ত ক্রীড়া কাবাডির আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই উত্থান বাঙালিদের জন্য অবশ্যই গৌরব ও আনন্দের।
সাঁতারটা বাঙালির জীবনযাপনেরই অংশ। একটা কথা প্রচলন আছে, বাঙালিরা হাঁটতে শেখার আগেই সাঁতার শেখে। সাঁতারের সঙ্গে লোকায়ত বাংলার সম্পর্কটা চিরকালের। নদী-খাল-বিল-পুকুর পরিবেষ্টিত গ্রামীণ জনপদের মানুষকে সাঁতার শিখতে হয় জীবনের প্রয়োজনে। ক্রীড়া হিসেবে লোকায়ত বাংলায় সাঁতারটা কতটা প্রচলিত ছিল, তা স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও জলক্রীড়াকে বাদ দিলে বাঙালির খেলাধুলার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবারই কথা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারে বাঙালির বড় মাপের কোনো সাফল্য না থাকলেও উজ্জ্বল করা কয়েকজন মুখ হচ্ছেন ব্রজেন দাস, আবদুল মালেক, মিহির সেন, আরতি দত্ত, মোশাররফ হোসেন খান, বুলা চৌধুরী। ১৯৭১ সালে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে ৯০ ঘণ্টারও বেশি অবিরাম সাঁতার কেটে আলোড়ন সৃষ্টি করেন চাঁদপুরের অরুন নন্দী।
খো-খো খেলাটা পশ্চিম বাংলার নিজস্ব খেলা হলেও এর সঙ্গে দাড়িয়াবান্ধা খেলার অনেকটা সামঞ্জস্য রয়েছে। ভাষা যেমন এলাকাভেদে বদলে যায়, খেলাও অনুরূপভাবে পরিবর্তিত হয়। অতীতে লোকায়ত ক্রীড়ার লিখিত কোনো আইন-কানুন ছিল না। যে কারণে লোকমুখে প্রচলিত নিয়ম-কানুনের ভিত্তিতে খেলা পরিচালিত হতো। তাতে এলাকাভেদে হেরফের হতে হতে খেলার ধরন-ধারণ পাল্টে যেত। তবে খো-খো খেলা এখনো দুই বাংলার মধ্যে সীমিত।
ভলিবল খেলাটা অনেক দিন যাবৎ বাংলার গ্রাম-গঞ্জে হয়ে আসছে। বিনোদন হিসেবে এ খেলাটিকেও বাঙালিরা ভালোবেসেছে। ভলিবল মোটেও ব্যয়বহুল খেলা নয়। একটি নেট, দুটি খুঁটি ও এক টুকরো জায়গা হলেই এ খেলায় মেতে ওঠা যায়। যে কারণে খেলাটি খুব সহজেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একটা সময় প্রায় প্রতিটি গ্রাম-গঞ্জে এ খেলার প্রচলন ছিল। বিকেল হলেই ভলিবল খেলতে তরুণ-যুবকরা ছুটে আসতেন এবং খেলা দেখার জন্যও দর্শকের ঢল নামতো।
বাস্কেটবল ও শুটিং অবশ্য লোকায়ত খেলা ছিল না। বাস্কেটবল শহর এলাকায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলেও শুটিং ছিল অভিজাতদের খেয়ালের অংশ।
অ্যাথলেটিকস তো সব খেলার রাজা। মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ খেলাটি। প্রতিদিনের দৌড়-ঝাঁপ-লাফেরই সম্প্রসারিত অংশ অ্যাথলেটিকস। মানব সভ্যতার মতো প্রাচীন হলো অ্যাথলেটিকস। এ কারণে দুনিয়ার সব জাতি অ্যাথলেটিকসকে নিজেদের ক্রীড়া হিসেবে দাবি করতেই পারে।
ব্রিটিশদের সঙ্গে আসা ক্রিকেট খেলাটা বাংলায় প্রচলন ঘটেছে, তাও ঢের ঢের দিন হয়ে গেল। ১৮৫৮ সালে ঢাকায় ক্রিকেট খেলার কথা জানা যায়। কলকাতায়ও অনেক দিন যাবৎ হয়ে আসছে ক্রিকেট খেলা। প্রায় দেড়শ’ বছর আগে ক্রিকেট খেলার প্রচলন ঘটলেও বাঙালিরা এ খেলাটিকে রপ্ত করতে বেশ সময় নেয়। বাঙালিরা যে ক্রিকেট খেলতে পারে- এটা প্রথম বুঝিয়ে দেন পঙ্কজ রায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৯৫৬ সালে ভিনু মানকদের সঙ্গে প্রথম উইকেট জুটিতে তিনি ৪১৩ রানের যে পার্টনারশিপ রেকর্ড গড়েন, তাতে উজ্জ্বল হয় বাঙালির মুখ। তারপর আর সেভাবে উজ্জ্বলতা দেখাতে পারেননি কোনো বাঙালি ক্রিকেটার। এই তো সেদিন সৌরভ গাঙ্গুলি যখন ব্যাটে আগুনের ফুলকি ছড়ান এবং ভারতের অধিনায়ক হিসেবে একের পর এক সাফল্য দেখান, তখন অনুধাবন করা যায়- বাঙালির রক্তেও ক্রিকেট আছে। আর এখন তো বাঙালিদের একটি দেশ ক্রিকেট খেলছে, এটা নিশ্চয়ই গৌরবময় ঘটনা।
তবে কোনো একটি ক্রীড়াকে কেন্দ্র করে যদি বাঙালিরা তুমুলভাবে আলোড়িত হয়ে থাকে, সেটি হচ্ছে ফুটবল। বাংলায় ইংরেজদের উপস্থিতি ও কর্মকাণ্ড বাঙালিদের কাছে ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও বেদনার কারণ হলেও তাদের কাছ থেকে যা কিছু অর্জিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ফুটবল। ব্রিটিশদের পায়ে পায়ে আসা এ খেলাটিকে প্রথম থেকেই ভালোবেসে ফেলে বাঙালিরা। এর অন্যতম কারণ, ফুটবলের সহজ আকর্ষণ। সহজিয়া জীবনবোধই বাঙালি জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। লোকায়ত বাঙালি কখনোই বড় কিছু প্রত্যাশা করেনি। অল্পতে খুঁজে নিয়েছে আনন্দ। মাছ-ভাতে পেট ভরিয়েছে। একতারাতে সুর খুঁজেছে। এ কারণে সহজ ও সস্তার খেলা ফুটবলকে বিনোদনের অংশ করে নিতে দেরি হয়নি। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় কলকাতায় ফুটবলের প্রচলন ঘটে। ১৮৫৪ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রথম ফুটবল ম্যাচ খেলার ঠিকুজি পাওয়া যায়। সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত খেলার সংক্ষিপ্ত তথ্য চাউর হয়। ‘ক্যালকাটা ক্লাব অব সিভিলিয়ানস’ এবং ‘জেন্টেলম্যান ক্লাব অব ব্যারাকপুর’ অংশ নেয় এ ম্যাচে। কলকাতার এসপ্ল্যানেডে অনুষ্ঠিত এ ম্যাচে অংশগ্রহণকারী দু’দলের খেলোয়াড়ই ছিলেন ইংরেজ। যদিও এ ম্যাচটি ছিল নেহাতই সামাজিক অনুষ্ঠানের অংশ। ১৮৬৮ সালে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত স্কুল ইটনের প্রাক্তন ছাত্রদের দল ইটোনিয়ান্স-এর সঙ্গে আইসিএসদের নিয়ে গঠিত অবশিষ্ট দলের মধ্যে একটি ফুটবল খেলা হয়। খেলায় তিন গোলে জয়ী হয় ইটোনিয়ান্স। এরপর ব্রিটিশরা নিয়মিতভাবে ফুটবল খেলতে থাকেন। ফুটবলের প্রাতিষ্ঠানিক অবয়ব দেয়ার জন্য ১৮৭৮ সালে তারা গড়ে তোলেন ট্রেডস ক্লাব, পরে নাম পাল্টে রাখা হয় ড্যালহৌসি অ্যাথলেটিক ক্লাব। ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব গড়ে ওঠে ১৮৮৪ সালে। সে বছরই বাঙালিরা প্রথম ফুটবল খেলে বলে জানা যায়। কারো কারো মতে, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আরেকটি মত হচ্ছে, বাঙালিদের কৌতূহল অপরিসীম। এমন একটা অদ্ভুত খেলা হবে, তা তাদের নজর এড়িয়ে যাবে- তা হতে পারে না। সঙ্গত কারণে মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দর্শক স্বভাবগত কারণে উৎসুক হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে ছিলেন নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী। তিনি এ খেলায় মজা পেয়ে যান। দূর থেকে যতটা বোঝা যায়, ততটা বুঝে নিয়ে সুর ভাজতে ভাজতে চলে যান বাড়িতে। তারপর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে খেলার উদ্যোগ নেন। আরেকটি মত হচ্ছে, ইংরেজরা খেলার সময় বলটা মাঠের বাইরে নগেন্দ্র প্রসাদের কাছে এলে তিনি হাত কিংবা পা দিয়ে তাদের কাছে ফেরত পাঠান। যাই হোক, নগেন্দ্র প্রসাদের মাধ্যমে ফুটবল খেলাটা বাঙালিরা রপ্ত করেন, এ বিষয়ে মতটা বেশ জোরালো। পরবর্তীকালে বাঙালিদের ফুটবলে দীক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রেও তার অগ্রণী ভূমিকা আছে। ১৮৮৪ সালে গড়ে উঠতে থাকে বাঙালিদের ফুটবল ক্লাব। প্রথমদিকে গড়ে ওঠা ক্লাবগুলোর মধ্যে রয়েছে কুমারটুলী,ওয়েলিংটন, টাউন, ন্যাশনাল; ১৮৮৫ সালে শোভাবাজার রাজপরিবারের কুমার জিষ্ণেন্দ্রকৃষ্ণ দেবের উদ্যোগে গঠিত হয় শোভাবাজার ক্লাব। ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশদের উদ্যোগে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল আসর ‘ট্রেডস কাপ’ আয়োজন করা হয়। সর্বপ্রথম এই ফুটবল প্রতিযোগিতা পরিচালনা করে ড্যালহৌসি ক্লাব। এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী একমাত্র বাঙালি ক্লাব ছিল শোভাবাজার। ১৮৯৩ সালে গঠন করা হয় ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আইএফএ)। এই সংস্থা গঠনের জন্য যে বৈঠক হয়, তাতে বাঙালিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শোভাবাজার ক্লাবের নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী। সে বছরই তাদের উদ্যোগে প্রবর্তন করা হয় আইএফএ শীল্ড ফুটবল। আইএফএ শীল্ডের সাফল্যে ১৮৯৮ সালে শুরু হয় কলকাতা ফুটবল লীগ। আধুনিক ফুটবলের সূতিকাগার ইংল্যান্ড। ফুটবলে তাদের চেয়ে বাঙালিরা মোটেও পিছিয়ে ছিল না। ইংল্যান্ডের প্রথম ফুটবল প্রতিযোগিতা এফএ কাপ ১৮৭১ সালে এবং ১৮৮৮ সালে লীগ শুরু হয়। তার সঙ্গে আইএফএ শীল্ড এবং কলকাতা ফুটবল লীগের ব্যবধান খুব বেশি নয়। তবে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত বাঙালিদের কোনো দল লীগ খেলার সুযোগ পায়নি। মোহনবাগান ক্লাব ১৯১১ সালে আইএফএ শীল্ড জয় করাটা ছিল বাঙালির ফুটবল ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা। এই বিজয় নিছক ফুটবল মাঠের একটি সাফল্য ছিল না। এটি ছিল ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে বাঙালিদের বিশাল বিজয়। এই বিজয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ করে নতুন মাত্রা। ব্রিটিশদের কিছুটা হলেও টনক নড়িয়ে দেয়। মোহনবাগানের স্মরণীয় এই বিজয়ে পূর্ব বাংলার খেলোয়াড়দের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। রাজশাহীর সন্তান অধিনায়ক ও আক্রমণভাগের খেলোয়াড় শিবদাস ভাদুড়ী ও বিজয় দাস ভাদুড়ী, ময়মনসিংহের সেন্টার ফরোয়ার্ড অভিলাষ ঘোষ, ঢাকার সেন্টার হাফ রাজেন সেনগুপ্ত, বিক্রমপুরের লেফট আউট কানু রায়, ফরিদপুরের রাইট ব্যাক সুধীর চ্যাটার্জী ও গোলকিপার হীরালাল মুখার্জী, বরিশালের হাফ নীলমাধব ভট্টাচার্য শিরোপা জয়ী মোহনবাগান দলের মূল একাদশের আট স্তম্ভ। এঁদের সবার জন্ম পূর্ববঙ্গে হয়নি। কারো কারো পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঠাঁইনাড়া গেড়েছেন। মোহনবাগানের অসাধারণ এই কৃতিত্ব উজ্জীবিত করে বাংলার ফুটবলার ও ফুটবল ক্লাবগুলোকে। কলকাতা ফুটবল লীগে বিস্ফোরণ ঘটায় কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। তারাই প্রথমবারের মতো ব্রিটিশদের হটিয়ে দিয়ে জয় করে লীগ শিরোপা। হবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগ লীগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগ লীগে ওঠার পর মোহামেডান হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। এক বছর বাদ দিয়ে ১৯৩৪ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত লীগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে উপমহাদেশের ফুটবলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয় শাদা-কালো শিবির। মতপার্থক্যের কারণে ১৯৩৯ সালে লীগ না খেলায় টানা আটবার শিরোপা জেতা হয়নি। তারপরও তারা যে ইতিহাস গড়ে, যে কোনো সময়ের জন্য তা ছিল বিস্ময়কর। মোহামেডানের স্বর্ণযুগের অবিশ্বাস্য এই সাফল্যে অবদান রাখেন কুমিল্লার সিরাজউদ্দিন, জুনিয়র রশীদ, ঢাকার মোহাম্মদ শাহজাহান প্রমুখ। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে কলকাতার ফুটবলকে মাতিয়ে রাখেন পূর্ববঙ্গের সন্তান গোষ্ট পাল, মোনা দত্ত, বাঘা সোম, হাবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, রাখাল মজুমদার, খন্দকার নাসিম, হাজী রমিজ, আলাউদ্দিন খান, খাজা ইউসুফ রেজা, সাহেব আলী, চুনী গোস্বামী, তারাপদ রায়, বলাই দে প্রমুখ। এছাড়া দেশভাগের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসা ফুটবল জাদুকর সামাদ, কলকাতা মোহামেডানের কিংবদন্তি ফুটবলার আব্বাস মির্জা, হাফেজ রশীদ, আবদুস সাত্তার, মোহনবাগানের আবদুল হামিদ প্রমুখ দুই বাংলার ফুটবলে গৌরবের অভিন্ন সত্তা হয়ে আছেন। সর্বভারতীয় ফুটবলের দিকপাল ছিলেন ঢাকার ওয়ারীর পঙ্কজ গুপ্ত। তিনি ছিলেন প্রথম বাঙালি রেফারি। তার সাংগঠনিক কর্মদক্ষতায় ফুটবলে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। দেশভাগের পর কলকাতা ফুটবলে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন গোলরক্ষক ওয়াজেদ আলী মিয়াজী, রাইট-ইন এফ আর খান, গোলরক্ষক খান মজলিস, রক্ষণভাগের মোজাম্মেল হক, লেফট আউট আবদুর রহিম, ফুলব্যাক গজনবী, ফরোয়ার্ড জর্জ ম্যাকওয়া, লেফট ব্যাক ইউজিন গোমেজ, সেন্টার ফরোয়ার্ড রশীদুল্লাহ প্রমুখ। কলকাতা মোহামেডান, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, রেলওয়ে, জর্জ টেলিগ্রাফ, স্পোর্টিং ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ক্লাবে দাপটের সঙ্গে খেলেছেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ফুটবলাররা। অনুরূপভাবে কলকাতার ফুটবলাররাও মাতিয়েছেন ঢাকা। কলকাতার আইএফএ শীল্ড ও ফুটবল লীগ এবং ঢাকার আগা খান গোল্ড কাপ ও ফুটবল লীগ ছিল দুই বাংলার ফুটবলারদের কাছে ছিল তীর্থভূমি। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কলকাতায় ফুটবল দল গঠনে পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বাংলার খেলাধুলার আরেকটি বড় প্ল্যাটফরম ছিল অল বেঙ্গল অলিম্পিক গেমস এবং অল বেঙ্গল স্কুল স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ। এই গেমস অনুষ্ঠিত হতো কলকাতা ও ঢাকায়। দেশভাগের আগ পর্যন্ত আয়োজিত বাংলার ক্রীড়াবিদদের এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যারা সাফল্য প্রদর্শন করতেন, তারা থাকতেন সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। যদিও এই গেমস স্মৃতির পাতায় অনেকটা আড়াল পড়ে গেছে, তারপরও যাদের নাম এখনো কম-বেশি উচ্চারিত হয়, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- হাজী রমিজউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) এম টি হোসেন, মোহাম্মদ শাহজাহান, সাদেক আহমেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) সিদ্দিক আহমেদ প্রমুখ। ১৯৩১ সালে ঢাকায় বেঙ্গল অলিম্পিকে দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখান হাজী রমিজ। তিনি ৯টি বিষয়ে অংশ নিয়ে ৭টিতে প্রথম ও ২টিতে দ্বিতীয় হন। তিনি যে ইভেন্টগুলোতে সাফল্য দেখান, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ১০০, ২০০, ৪০০ মিটার দৌড়, ১১০ মিটার হার্ডলস। এম টি হোসেনের ইভেন্ট ছিল জিমন্যাস্টিকস ও মুষ্টিযুদ্ধ। সাদেক আহমেদ বেঙ্গল অলিম্পিকে সাফল্য দেখান হাইজাম্পে। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত জলপাইগুড়ি স্কুলের হয়ে অল বেঙ্গল স্কুল স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন সিদ্দিক আহমেদ। বেঙ্গল গেমসের সেই স্মৃতি যেন ফিরে এসেছে ইন্দো-বাংলাদেশ বাংলা গেমসের মাধ্যমে।
খেলার মাঠে দুই বাংলার যোগাযোগ ও সম্পর্ক কখনোই আলগা হয়ে যায়নি। বরাবরই কোনো না কোনো খেলায় দুই বাংলার মধ্যে আয়োজিত হয়ে আসছে। নির্দিষ্ট খেলায় আয়োজিত হয়েছে ইন্দো-বাংলাদেশ বাংলা গেমস। তাছাড়া একে অপরের দেশে নিয়মিতই আসেন দুই বাংলার খেলোয়াড় ও প্রশিক্ষকরা। তবে সামগ্রিকভাবে ২০০৭ সালে কলকাতায় প্রথমবারের মতো আয়োজিত হয় ইন্দো-বাংলাদেশ বাংলা গেমস। তারই পথ বেয়ে এবার বাংলাদেশে আয়োজিত হয়েছে এই গেমসের দ্বিতীয় আসর। সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি-বন্ধুত্ব তো আছেই, সে সঙ্গে দুই বাংলার ক্রীড়াঙ্গনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এই গেমস সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া দুই বাংলার মানচিত্র ও নদী যেভাবে মিলেছে একই মোহনায় এবং ইতিহাস,ঐতিহ্য ও সম্পর্কের যে বীজ পোঁতা আছে উৎসকেন্দ্রে, তা থেকে খুব দূরে যাওয়ার অবকাশ নেই। তা ফিরে ফিরে আসবেই। #
(২০০৮ সালের ২২ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ইন্দো-বাংলা গেমস উপলক্ষে লেখা)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কোথায় সেই ফুটবল?

অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া, ক্রীড়াসংস্কৃতি ও ক্রীড়ালেখক সমিতি / দুলাল মাহমুদ

স্টাইলিশ অ্যাথলেট ছিলেন আরজান খান/ দুলাল মাহমুদ

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক...... দুলাল মাহমুদ

কাছের মানুষ এখন অনেক দূরে

আপন ভুবনের রাজা কাজী কামাল/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ