আপন ভুবনের রাজা কাজী কামাল/ দুলাল মাহমুদ

বাঙালির ইতিহাসে একাত্তর অমলিন। সে ছিল বাঙালির জন্য চরম এক অগ্নিপরীক্ষা। আর এই পরীক্ষায় জীবনবাজি রাখেন বাংলার মানুষ। সে সময় খেলার মাঠ ও যুদ্ধের মাঠ হয়ে যায় একাকার। তবে জাতীয় পর্যায়ে খেলাধুলায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন- এমন ক্রীড়াবিদের সংখ্যা খুব বেশি নেই। তাছাড়া পাকিস্তান আমলে বাঙালি কোনো ক্রীড়াবিদের জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা ছিল অসম্ভব এক চাওয়া। ফুটবল, সাঁতারের মতো খেলায় যা হোক বেশ কয়েকজন সুযোগ পেয়েছেন, অন্যান্য খেলায় তা পাওয়া ছিল বিস্ময়কর ঘটনা।
বাস্কেটবলের মতো পশ্চিম পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ আধিপত্যের খেলায় জাতীয় দলের ট্রায়ালে ডাক পেয়েছিলেন বাঙালি খেলোয়াড় কাজী কামালউদ্দিন আহমেদ। একজন বাঙালি বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের জন্য যা ছিল রীতিমত স্বপ্নের ব্যাপার। অথচ এই স্বপ্নের পথে তিনি হাঁটেননি। জাতীয় দলের ট্রায়ালে ডাক পাওয়ার প্রলোভন দু’হাতে সরিয়ে দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে উৎসর্গ করার চেয়ে আর কোনো কিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়নি। মা, মাটি ও মাতৃভূমি যার বুকের গভীরে আঁকা চিরস্থায়ীভাবে, তার পক্ষে জীবনবাজি রাখা অসম্ভব কিছু নয়।
পূর্ব পাকিস্তান বাস্কেটবলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় এবং অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামালকে এখন আর চেনা যায় না। সময় কি তাকে অনেক বদলে দিয়েছে? অথচ তাকে নিয়ে কতই না গল্প-গাথা-কিংবদন্তি। সেদিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আরেক নায়ক ও পাকিস্তান জাতীয় দলের গোলরক্ষক মেজর জেনারেল (অব:) খোন্দকার নূরুন্নবী কাজী কামালকে নিয়ে আসেন ‘ক্রীড়াজগত’ দফতরে। বাস্কেটবল মাঠে যার ডজিংয়ে বিভ্রান্ত হয়েছেন প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা, যুদ্ধের ময়দানে যার নাম শুনলে কেঁপে উঠেছে পাকিস্তানী সেনারা, সেই কাজী কামালকে প্রথম দেখায় মনে হয়েছে শান্ত নদীর মতো। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছেন তিনি। এখন তো নদীতে ভাটার টান লাগবে। তবে প্রথম দেখায় তার সম্পর্কে যে ধারণা গড়ে উঠেছিল, তা ভেঙ্গে যেতে সময় লাগেনি। কাজী কামালের বুকের গভীরে যে ক্ষোভ, জ্বালা, যন্ত্রণার আগ্নেয়গিরি, তা একটুখানি ঘনিষ্ঠ হলেই অনুভব করা যায়। এই দেশটাকে স্বাধীন করার জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করেছিলেন। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তমূল্যে একটি স্বাধীন দেশ পাওয়া সম্ভব হয়; কিন্তু জীবনের সব হিসাব কি মিলেছে? সে হিসাব মেলাতে গিয়ে ছটফট করেন তিনি। যে বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, তাদের অনেকেই শহীদ হয়েছেন, তাদের পরিবারের খোঁজ-খবর কেউ রাখে না। এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না! একটা অক্ষম যন্ত্রণা তাকে ব্যথিত করে রাখে।
ঢাকার সন্তান কাজী কামালউদ্দিন। জন্মেছেন মালিটোলায়। ১৯৪৬ সালের ১১ জুলাই। শৈশব থেকেই ছিলেন দুরন্ত প্রকৃতির। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলায় ছিলেন দুরন্ত। ১৯৫২ সালে তিনি সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে ভর্তি হন ইনফ্যান্ট বিভাগে। এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর বদলে যায় তার জীবনদৃষ্টি। পাদ্রীদের হাতে উন্মোচন ঘটে জীবনের নানা বর্ণিল দিকের। সত্যিকার অর্থে একজন মানুষ হওয়ার দীক্ষা পান। তারই আলোকে নতুনভাবে পাঠ নেন খেলাধুলার। বাংলাদেশে বাস্কেটবলের খেলার ইতিহাস অনেক পুরনো। বলা যায়, ঢাকা নগরীতে বাস্কেটবলের প্রবর্তন হয় সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের মাধ্যমে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন ঐতিহ্যবাহী এই স্কুলের গোড়াপত্তন হয়, তখন থেকেই বলা যায় প্রবর্তন ঘটে বাস্কেটবলের। বনেদী এই স্কুলে পড়ার সময় বাস্কেটবল খেলাটা হয়ে ওঠে কাজী কামালের একটি প্যাশন ও নেশা। বাস্কেট করার ক্ষেত্রে অন্য সবার চেয়ে তিনি ছিলেন একটু আলাদা। সঙ্গত কারণে খুব সহজেই শিক্ষকদের সমীহ আদায় করে নেন। স্কুলের যে কোনো প্রতিযোগিতায় তিনি ছিলেন সবার মধ্যমণি। আস্তে-ধীরে তার জনপ্রিয়তা স্কুলের সীমানা ছাড়িয়ে যায়।
১৯৫৬ সালে ঢাকায় শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তান প্রথম বিভাগ বাস্কেটবল লীগ। ষাট দশকে বাস্কেটবলের জনপ্রিয় ক্লাব হয়ে ওঠে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স। প্রথম বিভাগের এই ক্লাবটি লুফে নেয় অসম্ভব প্রতিভাবান খেলোয়াড় কাজী কামালকে। এ ক্লাবের হয়ে নিজেকে মেলে ধরেন তিনি। ওয়ান্ডারার্সকে প্রতিষ্ঠিত ও সাফল্য এনে দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি ও তার স্কুলের বন্ধুরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সে সময় সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের ছাত্রদের সাধারণত প্রথম পছন্দ ছিল নটরডেম কলেজ। কিন্তু সুদর্শন ও স্মার্ট কাজী কামাল বেছে নেন ঢাকা কলেজকে। এর পেছনে আছে অন্য একটি কারণ। কাজী কামালের ভাষায় : ‘আমার বাবা খুব বড় চাকরি করতেন না। আমাদের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা সচ্ছল ছিল না। আমি ওয়ান্ডারার্সে খেলে কিছু অর্থ-কড়ি পেতাম। সেটা আমার জন্য বেশ উপকারে আসতো। আমি যদি সহযোগী বন্ধুদের মতো নটরডেম কলেজে ভর্তি হতাম, তাহলে আমার রোজগারের একটি পথ বন্ধ হয়ে যেত। কেননা, নটরডেম কলেজও তখন প্রথম বিভাগ বাস্কেটবল লীগের অন্যতম একটি সেরা দল। কলেজের ছাত্র হিসেবে আমাকে কলেজের হয়ে বিনা অর্থে খেলতে হতো। রোজগার অব্যাহত রাখার জন্য আমি ভর্তি হই ঢাকা কলেজে।’
বাস্কেটবল লীগে কাজী কামাল ছিলেন দুর্ধর্ষ খেলোয়াড়। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি মাতিয়েছেন বাস্কেটবল কোর্ট। আর এ সময়টা ছিল ওয়ান্ডারার্সের সুবর্ণ সময়। চমকপ্রদ ক্রীড়াশৈলী দিয়ে ওয়ান্ডারার্স পৌঁছে যায় সাফল্যের শিখরে। আর এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। ১৯৬৬, ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭০ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়ান্ডারার্স। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল নটরডেম কলেজ ও ঈগলেটস ক্লাব।
জাতীয় পর্যায়ের বাস্কেটবলে কাজী কামাল ছিলেন দুর্র্দান্ত এক খেলোয়াড়। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক বাস্কেটবল দলে তার অবস্থান ছিল সুনিশ্চিত। ১৯৬৩ সাল থেকে প্রতিটি দলে খেলার জন্য তাকে মোটেও ভাবতে হয়নি। পাঁচ ফুট সাড়ে সাত ইঞ্চি উচ্চতা নিয়েও তিনি কাঁপিয়েছেন বাস্কেটবল কোর্ট। ডজ মারার ক্ষেত্রে তার কোনো জুড়ি ছিল না। তার সমসাময়িক খেলোয়াড় জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় ও কোচ মাহতাবুর রহমান বুলবুলের মূল্যায়নটা এমন : ‘অসাধারণ খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। তার খেলায় ছিল শিল্পের ছোঁয়া। তিনি খেলতেন ফরোয়ার্ডে। ফেক করার ক্ষেত্রে ছিলেন ওস্তাদ। তাকে আর কেউ ডিফেন্স করতে পারতেন না। শুটার হিসেবে ছিলেন খুব ভালো। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের বাস্কেটবল টিম গড়ে ওঠে তারই নেতৃত্বে। সঙ্গে ছিলেন সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের তার সহপাঠী আকবর, সঞ্জয়, ফাতেমি, আবদুল্লাহ প্রমুখ।’ প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান জানান, ‘বাঙালি খেলোয়াড়দের মধ্যে তার মতো স্টাইলিশ খেলোয়াড় আর দেখিনি। চমৎকার খেলতেন কামাল। খেলাটাকে প্রাণবন্ত করে তুলতেন। দেখতে ছিলেন হ্যান্ডসাম। বাস্কেটবল মাঠে তাকে মনে হতো যুবরাজের মতো। অন্তর দিয়ে খেলতেন। অন্য সবার চেয়ে ছিলেন একদমই আলাদা।’
১৯৬৩ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়নশীপ। পূর্ব পাকিস্তান দলের সবচেয়ে জুনিয়র সদস্য ছিলেন কাজী কামাল। তখন তিনি ছিলেন দশম শ্রেণীর ছাত্র। সেবার অবশ্য তার খেলা হয়নি। সাইড লাইনে বসে থাকতে হয়। তবে সঞ্চয় করেন অভিজ্ঞতার ভান্ডার। এরপর থেকে প্রতি বছরই খেলেছেন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপে। এর পাশাপাশি প্রতি দু’বছরে আয়োজিত পাকিস্তান জাতীয় অলিম্পিকে তিনি খেলেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। ১৯৬৪ সালে ঢাকায়, ১৯৬৬ সালে লাহোরে, ১৯৬৮ সালে ঢাকায় এবং ১৯৭০ সালে করাচীতে জাতীয় অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় জাতীয় অলিম্পিকে পাঞ্জাব দলের বিপক্ষে সেরা নৈপুণ্য দেখান তিনি। ১৯৭০ সালেও তিনি ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে। এ কারণে পাকিস্তান জাতীয় দলের ট্রায়ালে আমন্ত্রণ পান। ততদিনে মাতৃভূমির ডাক এসে গেছে। এ কারণে পাকিস্তান দলে খেলার আমন্ত্রণ হয়ে যায় তুচ্ছ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় যোদ্ধা কাজী কামাল। গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাদের পর্যুদস্ত করার অন্যতম নায়ক ছিলেন তিনি। অনেক অপারেশনের নেতৃত্ব দেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও অসম্ভব সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুদের কাবু করে কিংবদন্তি হয়ে আছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ‘সেকেন্ড বাংলাদেশ ওয়ার ফোর্স’-এ যোগ দেন। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় এ ব্যাচের কমিশন পাওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখায় তিনি ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত হন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কাজী কামাল আবার জড়িয়ে পড়েন খেলাধুলার সঙ্গে। বাংলাদেশ সরকার দেশের খেলাধুলাকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে কোচিংয়ে ট্রেনিং নেয়ার জন্য তিনজন খ্যাতিমান ক্রীড়া ব্যক্তিত্বকে পূর্ব জার্মানির লিপজিগে পাঠায়। তারা হলেন অ্যাথলেটিক্সে এসএ জামান মুক্তা, ভলিবলে খন্দকার আবুল হাসান ও বাস্কেটবলে কাজী কামালউদ্দিন। সে সময় দৈনিক বাংলায় কাজী কামাল সম্পর্কে লেখা হয় : ‘ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের তুখোড় খেলোয়াড় কাজী কামালউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের গত মুক্তিযুদ্ধে বাস্কেটবল ছেড়ে স্টেনগান ধরে ঢাকার পাক হানাদার বাহিনীর মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন। গেরিলা কমান্ডো কাজী কামালের নামে পাকসেনাদের পা ঠকঠক করে কাঁপতো, বুকের মধ্যে দিয়ে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যেতো। বাস্কেটবলের কাজী কামাল মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামাল-এ হারিয়ে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর মৃত্যুঞ্জয়ী কামাল আবার বাস্কেটবল জগতে ফিরে আসবে কিনা সিদ্ধান্ত নিয়ে দোটানায় পড়েছিলেন। বাস্কেটবল কোচের যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে পূর্ব জার্মানিতে তার মনোনয়ন সকল ক্রীড়ামোদীর মনে উল্লাস আনবে।’
জার্মানি থেকে এক বছরের কোচিং ট্রেনিং নিয়ে আসার পর জাতীয় কোচ হিসেবে ১৯৭৩ সালে কাজী কামাল যোগ দেন বাংলাদেশ ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা অর্থাৎ বিকেএনএস-এ। প্রারম্ভিক বেতন ছিল ৫৫০ টাকা। তৃণমূল পর্যায় থেকে খেলোয়াড় গড়ে তোলার জন্য নিজেকে ঢেলে দেন। বিভিন্ন জেলায় গিয়ে তুলে আনেন অনেক প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়। ভারতীয় দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলার জন্য বাংলাদেশ জাতীয় দলের সহযোগী কোচের দায়িত্ব পালন করেন। কোচ ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের আনাতোলি ইজগাসেভ। তিন বছর কাজ করার পর চাকরি ছেড়ে দেন। আশির দশকে আজাদ বয়েজ ক্লাবের বাস্কেটবল দল গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
কাজী কামাল জানান, বাস্কেটবলে পূর্বসূরিদের মধ্যে প্রাদেশিক দলের প্রথম অধিনায়ক ডা: রশিদউদ্দিন আহমেদ, রাইসউদ্দিন আহমেদ, শামসুল আলম প্রমুখ ছিলেন পথ-প্রদর্শক। তাদের খেলায় তারা অনুপ্রাণিত হন। সমসাময়িক খেলোয়াড়দের মধ্যে নওশের হাসান, ইব্রাহীম সাবের, মাজ্জাদ প্রমুখ খেলোয়াড় ছিলেন উজ্জ্বল। বিশেষ করে নওশের হাসান ছিলেন সেরা বাঙালি খেলোয়াড়। তিনিই একমাত্র বাঙালি খেলোয়াড় হিসেবে পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ইরানে অনুষ্ঠিত আরসিডি টুর্নামেন্টে খেলেছেন। কাজী কামাল জানান, তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় বাস্কেটবল ছিল দুর্দান্ত। সশস্ত্র বাহিনীর দীর্ঘদেহী খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গঠিত হতো। তাতে অপেক্ষাকৃত ছোট-খাট গড়নের বাঙালি খেলোয়াড়দের সুযোগ পাওয়া ছিল কঠিন।
কোচ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের MR. OTTIS COFEE-এর কথা স্মরণ করেন কাজী কামাল। এই ভদ্রলোক চাকরি করতেন ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে। তার কাছ থেকে নেয়া কোচিং পেয়ে যথেষ্ট উপকৃত হন তিনি।
অতীত ও বর্তমান সময়ের বাস্কেটবলের পার্থক্য সম্পর্কে কাজী কামাল বলেন, ‘আমাদের সময় দীর্ঘদেহী খেলোয়াড় ছিল না বললেই চলে। যে কারণে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ করে নেয়াটা ছিল প্রায় অসম্ভব। বর্তমানে তো পাকিস্তান আমলের মতো প্রতিকূলতা নেই। তা সত্ত্বেও প্রত্যাশা অনুযায়ী বাস্কেটবলের প্রসার ও অগ্রগতি হয়নি।’
কাজী কামাল যুদ্ধের মাঠে তার আরেক সহযোদ্ধা ও ক্রিকেটার শহীদ আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল বীর বিক্রম-এর যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, জুয়েলের পরিবার অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। অথচ তাদের কেউ কোনো খোঁজ-খবর রাখেনি। জুয়েলের মা অনেক কষ্ট নিয়ে পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তো চাইলে জুয়েলের জন্য অনেক কিছু করতে পারতো।
কাজী কামাল এক পুত্র ও এক কন্যার জনক। ছেলে কাজী সিয়াম আহমেদ ফিনল্যান্ডে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেয়ে কাজী মাশফিয়া আহমেদ ঢাকায় মেডিক্যালে পড়ছেন।
জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরম উৎকর্ষ অর্জন, উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বিশেষ অবদান এবং অসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর প্রদান করা হয় ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’। তবে সাম্প্রতিককালে এই পুরস্কার পাওয়ার এটিই কেবল মানদন্ড হতে পারে না। এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব জনসেবক, সমাজকর্মী, শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, ক্রীড়াবিদ প্রমুখ অবদান রেখেছেন, তাদেরকেই এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কৃতী ব্যক্তিত্বরা যতদিন জীবিত থাকবেন, ততদিন তাদের এ পুরস্কার দিয়ে মূল্যায়ন না করার অর্থ দাঁড়ায়- এ পুরস্কারের এক ধরনের অবমূল্যায়ন করা। আর সে দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্কেটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের খেলোয়াড় হয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে কাজী কামাল দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন। সেক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াবিদ হিসেবে কাউকে ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ দেয়া হলে তিনি হতে পারেন যোগ্যতম ব্যক্তি। অথচ কাজী কামালরা এক্ষেত্রে বরাবরই উপেক্ষিত হয়ে আছেন। এ নিয়ে সবার মধ্যে অন্তহীন ক্ষোভ ও যন্ত্রণা থাকলেও এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
জীবনের কোনো জটিলতায় নিজেকে জড়াতে চান না কাজী কামাল। নিজের একটা আলাদা জগত গড়ে নিয়েছেন তিনি। যে জগতে তিনিই রাজা, তিনিই প্রজা। কখনো-সখনো স্মৃতিময় দিনগুলো এসে কড়া নাড়লে নস্টালজিক হয়ে পড়েন। অতীতের খোলা জানালা দিয়ে জীবনের মধুময় সেই ক্ষণগুলোকে উপভোগ করেন তারিয়ে তারিয়ে। আবার যখন ফিরে আসেন বাস্তবের মাটিতে, তখন বুকটা হু হু করে ওঠে। কী এক বিষন্নতা এসে তাকে নিয়ে যায় অন্য কোনো এক ভুবনে। #
১৬-৯-২০০৭ইং

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়’ / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ

এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয় / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ