ফুটবলের সহজাত শিল্পী রাজশাহীর সামসু/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবল খেলাটা যে পারিবারিক ঐতিহ্য ও আকর্ষণের অংশ হতে পারে, তার চমৎকার দৃষ্টান্ত রাজশাহীর মোল্লা পরিবার। একই পরিবারের সাত ভাই ছিলেন ফুটবলার। এমন ঘটনা বিরলই বলা যায়। একটু আগে-পরে প্রত্যেকেই খেলেছেন প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে। কেউ ঢাকায়, কেউ রাজশাহীতে। সবাই মোটামুটি ফুটবলার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তবে ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিলেন সামসুল ইসলাম মোল্লা। সামসু হিসেবেই তার খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা। তিনি ছিলেন ষাট ও সত্তর দশকের অন্যতম সেরা ফুটবলার। এখনও তার ক্রীড়াশৈলী নস্টালজিক করে তোলে ফুটবলানুরাগীদের। তিনি ছিলেন স্কিলফুল ফুটবলার। খেলতেন সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে। ঠান্ডা মাথার খেলোয়াড়। ছোট জায়গার মধ্যে ডজ দিয়ে বের হয়ে যেতে পারতেন। কোনদিক দিয়ে বের হবেন, প্রতিপক্ষকে ঘুনাক্ষরে বুঝতে দিতেন না। পজিশনাল সেন্স ছিল অসাধারণ। অ্যাকুরিসিও ছিল নিখুঁত। পরিস্থিতি অনুযায়ী ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। অল্প ডিসট্যান্সের মধ্যে তার শট নেয়ার মুন্সিয়ানা ছিল। যে কোনো অবস্থায় খেলার গতিকে পাল্টে দিতেন। একবার রিসিভ করলে তার কাছ থেকে বল নেয়া ছিল কঠিন এক কাজ। বল নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা ছিল চমকপ্রদ। বেশি ছোটাছুটি করতেন না। তারপরও তার খেলায় জুড়িয়ে যেত চোখ। মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে দিত হৃদয়ে। তার মধ্যে একটা ঐশ্বরিক ব্যাপার ছিল। কোনো রকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই ফুটবল খেলাটা তিনি রপ্ত করেন। এমনটি খুব কমই দেখা যায়। বোধ করি, তার রক্তের মধ্যেই ছিল ফুটবল। এ কারণে তার পায়ে ফুটবল এলে তাতে ঝিকিয়ে উঠতো ফুটবলশিল্প। তিনি ছিলেন ফুটবলের সহজাত শিল্পী।
ভারতের পশ্চিম বাংলার হুগলিতে জন্ম সামসুল ইসলাম মোল্লার, ১৯৪৪ সালের ১৩ ফ্রেব্রুয়ারি। তবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ১৯৪৯ সালে তাদের পরিবার রাজশাহীতে থিতু হয়। স্কুলে পড়ার সময় খেলাধুলায় তার সম্পৃত্ততা। কিশোর বয়সেই ফুটবল মাঠে দেখা যায় তার পায়ের জাদু। অল্পদিনের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে তার ফুটবলখ্যাতি। ১৯৫৬ সালে রাজশাহীর লোকনাথ হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি খেলেন ইন্টার স্কুল প্রুভিনশিয়াল টিমে। রাজশাহী ডিভিশনে চ্যাম্পিয়ন এবং চার ডিভিশনের চার চ্যাম্পিয়নকে নিয়ে আয়োজিত ইস্ট পাকিস্তান প্রুভিনশিয়াল ইন্টার স্কুল চ্যাম্পিয়ন হয় তার স্কুল। তিনি ছাড়াও অপর দুই ভাই ইসলাম ও জালু একই স্কুলের পক্ষে খেলেন। আর গৌরবময় এই সাফল্যের ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অনেক বেশি। ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে তার দেয়া একমাত্র গোলে কুষ্টিয়া ইউনাইটেড স্কুলকে পরাজিত করে লোকনাথ হাইস্কুল। তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স সবাইকে অবাক করে দেয়। প্রতিপক্ষ কুষ্টিয়া ইউনাইটেড স্কুলের খেলোয়াড় ছিলেন খন্দকার আবুল হাসান। আন্তঃস্কুলের পাশাপাশি জেলা লীগে তার পারফরম্যান্স দেখে অভিভূত হন রাজশাহীর সন্তান তৎকালীন ঢাকার জেলার নির্মল কুমার সাহা। তিনি ছিলেন অভিনেত্রী চিত্রা সিনহার ভাই। তিনি ১৯৫৮ সালে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যায় ঢাকা সেন্ট্রাল জেল দলে। তাদের হয়ে খেলেন আগা খান গোল্ড কাপ ফুটবল। সে সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় পিডব্লিউডি’র দেশ কাঁপানো ফুটবলার নবী চৌধুরী, গজনবী, কবীর প্রমুখের সঙ্গে। ১৯৫৯ সালে তাকে দলভুক্ত করে তরুণ ও প্রতিশ্রুতিশীল ফুটবলারদের চারণভূমি কামাল স্পোর্টিং ক্লাব। এ ক্লাবের মাধ্যমে তার অভিষেক হয় ঢাকা লীগে। কোচ বজলুর রহমানের গড়া এ দলটি সেবারই প্রথম বিভাগ লীগে উন্নীত হয়। এ দলে খেলতেন বন্ধু মহসীন রেজা, মনি, গাউস, কামরুজ্জামান প্রমুখ। বন্ধুরা সবাই মিলে ১৯৬১ সালে যোগ দেন ঢাকেশ্বরী কটন মিল (ডিসি মিল)-এ। এ ক্লাবে খেলেন দু’বছর। ১৯৬৩ সালে তার ঠিকানা হয় প্রিয় ক্লাব ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। মোহামেডানে যোগদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময় দিনাজপুরে একটি ম্যাচ খেলতে যাই। একই দলের হয়ে খেলতে আসেন ঢাকা মোহামেডান ও পাকিস্তান জাতীয় দলের কৃতী দুই ফুটবলার কবীর ও গজনবী। সে খেলায় আমার দেয়া দু’গোলে জয়ী হয় আমাদের দল। আমার খেলা দেখে কবীর ও গজনবী ভাই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং আমাকে মোহামেডানে খেলার আমন্ত্রণ জানান। এই প্রস্তাবে উদ্বেলিত হয়ে উঠি আমি। মোহামেডানে জায়গা পেতে শুরুর দিকে আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হলেও নিশ্চিত হয়ে যাবার পর আমাকে কেউ আর টেক্কা দিতে পারেননি। এমনকি মাকরানি ফুটবলারদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দলে নিজের অবস্থান পাকাপাকি করতে সক্ষম হই।’ এক দশক শাদা-কালো জার্সি গায়ে খেলে তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠেন। এ সময় মোহামেডান ১৯৬৩, ১৯৬৫, ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ সালে লীগ এবং ১৯৬৪ ও ১৯৬৮ সালে আগাখান গোল্ড কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়। মোহামেডানে সে সময়কার খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলেন জহির, বশির, জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ, নুরুন্নবী, কালা গফুর, মুসা, তোরাব আলী, আবদুল্লাই রাই, আসলাম, হাশেম দীন প্রমুখ। মোহামেডানের মায়া ত্যাগ করে ১৯৭৩ সালে তিনি পিডব্লিউডিতে যোগ দেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হওয়ায় জোরপূর্বক মোহামেডান ছেড়ে দেই। মোহামেডানে রেজিস্ট্রেশন করে পুনরায় পিডব্লিউডিতে রেজিস্ট্রেশন করায় দু’ক্লাবের মধ্যে টানা-হেঁচড়া হয়। মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন দল আর পিডব্লিউডি রেলিগেশন ফাইট দেয়া দল। কিন্তু পিডব্লিউডিতে খেলার ব্যাপারে আমি সংকল্পে অটল থাকি। আমি যোগ দেয়ার পর পিডব্লিউডি রেলিগেশন থেকে রক্ষা পায়। দু’বছর খেলার পর ১৯৭৫ সালে আমার ঠিকানা হয় আবাহনী ক্রীড়াচক্র। আবাহনীতে খেলা নিয়েও হয়েছে অনেক নাটকীয়তা। আবাহনী আমাকে দলভুক্ত করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে- এটা বুঝতে পেরে দলবদলের সময় পিডব্লিউডি আমাকে একটি ঘরে আটকে রাখে। পিডব্লিউডিও তখন শক্তিশালী দল। কীভাবে যেন তা আবাহনী টের পেয়ে যায়। তারা গোপনে ফুটবলার সুরুজকে আমার কাছে পাঠায়। সুরুজ অনেক ফন্দি-ফিকির করে আমার কাছে পৌঁছায় এবং কৌশলে আমার সই নিয়ে যায়। পিডব্লিউডি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি। দলবদলের পর যখন আমার নাম ওঠে আবাহনীর হয়ে, তখন তাদের মাথায় হাত।’
ছয় বছর আবাহনীতে চুটিয়ে খেলার পর ১৯৮০ সালে তিনি খেলা ছেড়ে দেন। এর মধ্যে ১৯৭৪ ও ১৯৭৭ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন হয় আবাহনী। তবে ১৯৮১ সালেও ইস্টএন্ডের হয়ে খেলেন সামসু। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেবার ইস্টএন্ডের অবস্থা মোটেও ভাল ছিল না। রেলিগেশনের সম্মুখীন হয় তারা। ইস্টএন্ডের কর্মকর্তারা আবাহনীর হারুন ভাইকে অনুরোধ করেন আমাকে তাদের হয়ে খেলার জন্য। হারুন ভাই বলায় আমি ইস্টএন্ডের হয়ে খেলি চারটি ম্যাচ। রেলিগেশন থেকে রক্ষা পায় ইস্টএন্ড। এক্ষেত্রে আমার কিছুটা ভূমিকা ছিল।’
সামসু ১৯৫৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত রাজশাহী প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে একটানা খেলেন রাজশাহী মোহামেডানের হয়ে। একই সময় রাজশাহী জেলা ও রাজশাহী বিভাগের হয়ে খেলেন। রাজশাহী মোহামেডান, জেলা ও বিভাগের তিনি দীর্ঘদিন অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কেউ ছিলেন না। তরুণদের সুযোগ দেয়ার জন্য মাঝে-সাঝে কাউকে কাউকে নিজ থেকে দিয়েছেন অধিনায়কের আর্মব্যান্ড।
১৯৬২ সালে সামসু খেলেন ইস্ট পাকিস্তান দলের হয়ে। খেলেন সফরকারী চীনের বিপক্ষে। তাদের দলে ছিলেন কবীর, জহির, বশীর, জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ, দেবীনাশ, মোবাশ্বের, সাদেক, বাটু, সামাদ, জামিল আখতার, সাইফুল, জাফর ইমাম প্রমুখ। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান জাতীয় যুব ফুটবল দলের হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে খেলেন। সে দল গঠন প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘লাহোরে ৪০ জন ফুটবলারকে ট্রায়ালে ডাকা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের ২০ জন এবং পূর্ব পাকিস্তানের ২০ জন খেলোয়াড়। দু’দলকে দু’ভাগে বিভক্ত করে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলা হয়। প্রথম ম্যাচ খেলে ফাস্ট ইলেভেন। তাতে পূর্ব পাকিস্তান ৪-১ গোলে পরাজিত করে পশ্চিম পাকিস্তানকে। পশ্চিম পাকিস্তানের সেকেন্ড ইলেভেন হারিয়ে দেয় পূর্ব পাকিস্তানকে। অথচ চূড়ান্ত দলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সুযোগ পাই আমরা মাত্র পাঁচজন- প্রতাপ, গাউস, রানা, আনসার ও আমি। এর কারণ যে ৯ জন সিলেক্টর ছিলেন, তার মধ্যে ৮ জনই পশ্চিম পাকিস্তানের।’ ১৯৬৬ সালে করাচীতে পাকিস্তান জাতীয় দলের প্রাথমিক ট্রায়ালে সুযোগ পেলেও পা ভেঙ্গে যাওয়ায় যেতে পারেননি। ১৯৬৯ সালে তিনি ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটির অধিনায়ক। ১৯৭২ সালে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে খেলেন দিল্লীর ডুরান্ড কাপ। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে ফুটবল মাঠে দীর্ঘ দু’যুগ তিনি দাপটের সঙ্গে বিচরণ করেন।
স্বাধীনতার পর ফর্মের তুঙ্গে থাকা সত্ত্বেও জাতীয় দলের হয়ে খেলতে না পারাটা তার কাছে দুঃখজনক ঘটনা হয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে সময়
আক্রমণভাগের খেলোয়াড় হিসেবে আমি বোধ করি অন্য কারো চেয়ে পিছিয়ে ছিলাম না। ফর্মও ছিল বেশ ভালো। বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলার ব্যাপারে আমার কিংবা আমার শুভাকাক্ষীদের কোনো সংশয় ছিল না। অথচ আমাকে জাতীয় দলে খেলতে দেয়া হয়নি। অজুহাত, আমার বয়স বেশী। ফর্ম থাকলে বয়স কোনো ফ্যাক্টর হতে পারে না। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় দলে খেলতে না পারাটা আমার কাছে কষ্টকর এক স্মৃতি হয়ে আছে।’
সামসু অনেক স্মরণীয় ম্যাচ খেলেছেন। তার পা থেকে এসেছে অসংখ্য গোল। তার স্মরণীয় খেলার মধ্যে আছে ১৯৭৬ সালে আবাহনীর হয়ে মালয়েশিয়ার পেনাং দলের বিপক্ষে দুটি ম্যাচ। লীগ পর্বে তার দেয়া একমাত্র গোলে হেরে যায় পেনাং ক্লাব। এ দু’দলই ফের মুখোমুখি হয় ফাইনালে। তাতে অবশ্য ১-২ গোলে পরাজিত হয় আবাহনী। ১৯৬৫ সালে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে ঢাকা মোহামেডানের মধ্যকার লীগ ম্যাচটি তাকে এখনও আপ্লুত করে : ‘ভিক্টোরিয়া তখন দুর্ধর্ষ দল। ১৯৬৪ সালের লীগ চ্যাম্পিয়ন। দলের প্রায় ১১ জনই মাকরানি ফুটবলার। তাদেরকে হারানো স্বপ্নের মত ব্যাপার। গোলরক্ষক চিতা বাঘের মত ক্ষিপ্র গোলাম হোসেন। সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়ে খেলায় আমরা জয়ী হই ২-১ গোলে। এ খেলায় জিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করি আমরা। মোহামেডানের দুটি গোলই আসে আমার পা থেকে। প্রথম গোলটি করি জিরো অ্যাঙ্গেল থেকে এবং দ্বিতীয়টি হাফ ভলিতে। গোলরক্ষক একদমই বুঝতে পারেননি।’ ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে অল-পাকিস্তান বগুড়ার মোহাম্মদ আলী গোল্ডকাপ ফুটবলে শক্তিশালী পাকিস্তান এয়ারফোর্সকে ২-১ গোলে হারিয়ে জয় পায় ঢাকা মোহামেডান। মোহামেডানের দুটি গোলই করেন সামসু। প্রথম গোলটি হেডে ও দ্বিতীয়টি হাফ ভলিতে করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা মোহামেডান ও ইপিআইডিসির মধ্যকার লীগের খেলাটি তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে : ‘ইপিআইডিসি সে সময় সেরা দলগুলোর একটি। ইপিআইডিসির হয়ে খেলেন গফুর বালুচ, মওলা বক্স, হাশেম দীন, জব্বার, আসলাম, আইয়ুব দার, হাকিম, সলিমুল্লাহর মত খ্যাতিমান ফুটবলাররা। আমাদের দলেও ছিলেন কালা গফুর, তোরাব আলী, জাকারিয়া পিন্টু, জহির, প্রতাপ, হাশেম দীন প্রমুখ। ইনজুরির কারণে আমাদের দলে দুর্বলতা ছিল। এ কারণে আমরা একটু ব্যাকফুটে ছিলাম। তবে খেলায় দু’দলের মধ্যে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। যাকে বলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এ খেলায় ২-১ গোলে জয়ী হই আমরা। প্রথম গোলটি করি আমি। ভেজা মাঠে ২/৩ জনকে ডজ দিয়ে গোলটি করেছিলাম। দ্বিতীয় গোলটি করেন কলকাতা মোহামেডানের ফুটবলার এ এইচ খান। তিনি ঢাকায় এলেও পরে আবার ভারতে চলে যান।’ এছাড়া ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলের ফাইনালে তার ক্রীড়াশৈলী তাকে আনন্দ দেয়। দু’বারই ঢাকা মোহামেডানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ইন্দোনেশিয়া। দল জিততে না পারলেও তার খেলা সবার ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে।
সমসাময়িক খেলোয়াড়দের মধ্যে মাকরানি ফুটবলার কালা গফুর, তোরাব আলী, মওলা বক্স, জব্বার, আলী নেওয়াজ, শ্রীলংকার গোলরক্ষক হাশেম দীনের খেলা তার মন কাড়তে সক্ষম হয়। তার মতে, এঁরা ছিলেন এশিয়ান স্টার। আর বাঙালি ফুটবলারদের মধ্যে শান্টু, সালাউদ্দিন, এনায়েত, নান্নু, টুটুলের খেলা তাকে মুগ্ধ করেছে। প্রতিপক্ষ হিসেবে নান্নু, শান্টু, আশরাফকে তিনি বেশ সমীহ করতেন। তিনি বলেন, ‘ডিফেন্ডার নান্নু, আশরাফ ও গোলরক্ষক শান্টুকে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে দেখলে একটু দুর্বলতা আসতো। এঁরা ডজ খেতেন না। আমি নাচবো। ওঁরা দাঁড়িয়ে থাকবেন। আশরাফ, শান্টু, নান্নু, সালাউদ্দিন, এনায়েত, টুটুলের মত ফুটবলার আর আসেননি। আদৌ আসবেন কিনা সন্দেহ! এখন তো ফুটবলে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। ভালো ফুটবলার আসবে কোথা থেকে?’ তার মতে, ‘আগে খেলার মান ছিল। এখন আর সেই মান নেই। আমরা যারা ফুটবল খেলতাম, ভালো খেলার চেষ্টা করতাম। এখন ফুটবলে কোথায় যেন একটা ঘাটতি রয়ে গেছে। যে কারণে দর্শক হারিয়েছে বাংলাদেশের ফুটবল। খেলাধুলায় ডিসিপ্লিন একটা বড় ব্যাপার। ডিসিপ্লিন ছাড়া খেলাধুলায় উন্নতি হয় না। ফুটবলে সেটির বড্ড অভাব।’
ফুটবলার হওয়ার পেছনে সামসু মনে করেন তার নিজের অবদানই বেশি। তিনি বলেন, ‘পেটে খিদে থাকলে যে কেউ পরিশ্রম করতে বাধ্য। আমিও জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম ফুটবল খেলাকে। ফুটবলার হতে হলে স্রেফ সাধারণ মানের খেলোয়াড় হয়ে লাভ নেই- এই উপলব্ধিটুকু আমার জীবনের শুরুতেই হয়ে যায়। ফুটবলার হিসেবে প্রতিপক্ষ সমীহ করবে, ভক্তরা সম্মান করবে, ভালোবাসবে- এটুকু যদি না পাওয়া যায়, তাহলে আর ফুটবল খেলে কী হবে? আর ভালো ফুটবলার হতে হলে নিজেকে নিজে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। নিজের মধ্যে জেদ, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও খেলার প্রতি আত্মনিবেদন না থাকলে অন্য কারো পক্ষে ফুটবলার বানিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। ক্লাবের হয়ে খেলার সময় অবশ্য কোচিং নিতে হয়েছে। কিন্তু সেটা আমার জন্য গুরুত্ব্পূর্ণ ছিল না। আমি ফুটবলার হয়েছি নিজের প্রচেষ্টায়। অবশ্য কতটা ফুটবলার হতে পেরেছি, সে বিচার ও বিশ্লেষণের দায়িত্ব দর্শকদের। তবে আমার চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। অবশ্য একটা কথা স্বীকার করতে হবে, আমাদের এলাকা সাগরপাড়ায় বাড়ির সামনে খেলার মাঠ। আমরা সেই মাঠে খেলতাম। আমাদেরকে খেলাধুলার ক্ষেত্রে দারুণভাবে উৎসাহিত করতেন পুলিশ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম। তিনি আমার ছেলে পাইলটকেও উদ্দীপিত করেন। পাইলটের নামটিও রেখেছেন তিনি।’
সামসুরা সাত ভাই ও দু’বোন। সাত ভাইই ছিলেন ফুটবলার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারটা ফুটবল পরিবার হিসেবে স্বীকৃত। আমার বড় ভাই ইসলাম রাজশাহী লীগে খেলতেন, রাজশাহী মোহামেডানের হয়ে। ইনসাইড ও হাফের খেলোয়াড় ছিলেন। দ্বিতীয় নজু রাজশাহী মোহামেডানে লেফট আউটে খেলতেন। তৃতীয় আমি। এরপর জালু ঢাকা লীগে ঢাকা মোহামেডান ও ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হয়ে খেলেন। খেলতেন রাইট আউটে। কচিও খেলতেন রাইট আউট পজিশনে। ঢাকা লীগে ওয়ারীর ফুটবলার ছিলেন। রাজু ও খোকনের পজিশন ছিল যথাক্রমে হাফ ও রাইটব্যাক। এই দু’জনই রাজশাহী লীগে খেলেছেন। রাজশাহী মোহামেডানের খেলোয়াড় ছিলেন। আসলে রাজশাহী মোহামেডানের সঙ্গে আমাদের একটা পারিবারিক বন্ধন ছিল।’
ক্ষ্যাপ খেলার ক্ষেত্রে সামসুর কোনো জুড়ি ছিল না। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সারা বছরই আমাকে ফুটবল খেলতে হতো। আমার খুব ডিমান্ড ছিল। তাছাড়া কাউকে না বলতে পারতাম না। এমন জেলা ও মাঠ খুব কমই আছে, যেখানে আমি খেলিনি। বলা যায়, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছিল আমার বিচরণ। অনেক বেশি খেললে ইনজুরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমার ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি। এর কারণ আমি বুঝে-শুনে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে খেলতাম। অকারণে ডেঞ্জার জোনে যেতাম না। কিন্তু সময়মত আমি জায়গামত পৌঁছে যেতাম। এ কারণে প্রতিপক্ষ আমার নাগাল পেত না।’
খেলোয়াড়ী জীবনে প্রাপ্তি প্রসঙ্গে তিন বলেন, ‘যখন খেলতাম, যথেষ্ট সম্মান পেতাম। টাকা-পয়সা হয়ত বেশি পেতাম না। যা দিত, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতাম। তবে গোটা বাংলাদেশের যেখানেই গেছি, সবাই আমাকে শ্রদ্ধা করেছেন, দিয়েছেন ভালোবাসা। সামসু ভাই বলে এগিয়ে এসেছেন। আমার খেলা তাদের আনন্দ দিত বলে জানাতেন। এটাই তো একজন ফুটবলারের জন্য বড় পাওয়া।’
খেলা ছেড়ে দেয়ার পর সামসু মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল অ্যাডুকেশন কলেজ থেকে পাস করার পর ১৯৮২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগ দেন। ২০০৬ সালের জুনে অবসর নেন সিনিয়র ডাইরেক্টর হিসেবে। এখন তার অফুরন্ত অবসর। তবে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে তেমনভাবে জড়িত নন। এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত হতে ভালো লাগে না। সসম্মানে ডাকলে যেতে রাজি আছি। কোথাও ঘুরতে চাই না। এ বয়সেই সেটা মোটেও মানানসই নয়। তবে মাঠের নেশা ছাড়তে পারিনি। প্রতিদিনই মাঠে যাই। রাজশাহী সোনালী অতীতের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। শরীরটা ঠিক রাখার জন্য তাদের সঙ্গে প্র্যাকটিস করি।’
ফুটবলার ছাড়াও সামসু ক্রিকেট খেলেছেন। ছিলেন অ্যাথলেট। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত রাজশাহী জেলা ও বিভাগের হয়ে ক্রিকেট খেলেন। ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যান ছিলেন। সে সময় তেমন জৌলুস না থাকায় ক্রিকেট খেলাকে গুরুত্ব দেননি। অ্যাথলেট হিসেবেও নেহাত মন্দ ছিলেন না। ইন্টার স্কুল ও কলেজে অ্যাথলেটিকে অংশ নিতেন। একবার পাকিস্তান মিটে হাইজাম্পার হিসেবে তিনি অংশ নেন। সে সময় চার বিভাগে যারা প্রথম হতেন, তারাই পাকিস্তান মিটে অংশ নেয়ার সুযোগ পেতেন। রাজশাহী বিভাগ থেকে তিনি একাই পাকিস্তান মিটে প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু ফুটবল তার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা হওয়ায় আর কোনো খেলাকে তিনি গুরুত্বের সঙ্গে নেননি।
দুই কন্যা ও এক পুত্রের জনক সামসু। তার একমাত্র পুত্র খালেদ মাসুদ পাইলট বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম স্তম্ভ। পুত্র সম্পর্কে তার মূল্যায়ন হচ্ছে : ‘আমার ছেলের কৃতিত্বে আমি খুবই গর্বিত। সে শুধু আমার মুখ উজ্জ্বল করেনি, উজ্জ্বল করেছে বাংলাদেশের মুখ। একমাত্র ছেলে হিসেবে ছোটবেলা থেকেই সে আমার ভালোবাসার ধন। আমি তাকে সব সময় সহযোগিতা করতাম। খেলাধুলা করতে চাইলে আমি কখনোই তাকে বাধা দেইনি। অনেক বাবা-মাই পড়লেখার অজুহাতে ছেলে-মেয়েদের খেলতে দিতে চান না। আমি কখনোই তেমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করিনি। নিজে খেলোয়াড় ছিলাম। তাই খেলোয়াড়দের মনোভাব অনুধাবন করতে পারি। তবে পাইলট নিজের প্রচেষ্টায় এগিয়েছে। ক্রিকেটের প্রতি ওর আছে উৎসর্গীকৃত মনোভাব। আছে একটা লড়াকু মেজাজ। হেরে যাবার আগে হারতে রাজি নয়। এ কারণে ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। রাজশাহীতে পাইলটের খেলা থাকলে আমি মাঠে যাই। পারতপক্ষে আমি ওর খেলা মিস করি না।’
ফুটবলকে ভালোবেসে যারা পাড়ি দিয়েছেন জীবনের দীর্ঘ পথ, সামসু তাদের অন্যতম। তিনি ফুটবল খেলাকে নিয়েছিলেন জীবনদর্শন হিসেবে। খেলাটাকে মনে করতেন এক ধরনের ইবাদত। তাতে কোনো ফাঁকিবাজি করতেন না। যতদিন মাঠে ছিলেন, মন-প্রাণ দিয়ে খেলেছেন। গড়তে পেরেছিলেন আলাদা একটা ইমেজ ও স্টাইল। এ কারণে সামসু অন্য সবার চেয়ে ব্যতিক্রম। ফুটবলানুরাগীদের হৃদয়ে তিনি আছেন উজ্জ্বল এক তারকা হয়ে। #
১৬-১২-২০০৭

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ফুটবল মাঠের অন্য এক লড়াই

হুট করে এভাবে চলে গেলেন রণজিত দা!

ধবল জোছনার দিনগুলো / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

আমাদের ফুটবলাররা

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

মাটির বিশ্বকাপ মানুষের বিশ্বকাপ

যেন রূপকথার এক নায়ক / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

বাঙালির ফুটবল আবেগ / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

স্বাগতিক ব্রাজিল, ফেলপস আর বোল্টের কথা / দুলাল মাহমুদ