দুরন্ত ফুটবলার আরমানিটোলার গাউস/ দুলাল মাহমুদ

আরমানিটোলা নামটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়ানুরাগীদের চোখে ভেসে ওঠে অনেক তারকা খেলোয়াড়ের নাম। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে কত যে খেলোয়াড় উঠে এসেছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না। আরমানিটোলাকে খেলাধুলার সূতিকাগার বললে অত্যুক্তি হবে না। এমন একটি এলাকায় জন্ম ও বেড়ে উঠবেন, আর খেলাধুলার সঙ্গে কোনো যোগসূত্র গড়ে ওঠবে না- তা কি হয়! কাছের মানুষরা খেলায় মশগুল থাকলে যে কাউকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে খেলার মাঠ। সঙ্গত কারণে গাউসও পারেননি খেলার মাঠের আকর্ষণ থেকে দূরে থাকতে। আরমানিটোলা মাঠ ফুটবল ও আরমানিটোলা স্কুল হকির জন্য খ্যাতি অর্জন করলেও নানা দিক দিয়ে আরমানিটোলা এদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে ভরিয়ে দিয়েছে ফলে-ফুলে। বিভিন্ন খেলায় অসংখ্য খেলোয়াড় উঠে এসেছেন আরমানিটোলা মাঠ কিংবা সংলগ্ন এলাকা থেকে। তাদের সুখ্যাতি ছড়িয়েছে জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। খ্যাতিমান সেসব ক্রীড়াবিদের অন্যতম হলেন গাউস। তিনিও সহজাতভাবে খেলোয়াড় হওয়ার দীক্ষা পান আরমানিটোলার আলো-হাওয়া-জল থেকে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অনুকূল তো ছিলই, স্কুলের পরিবেশও খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। হাম্মাদিয়া হাইস্কুল, কিশোরীলাল জুবিলী হাইস্কুল হয়ে নবকুমার স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর খেলোয়াড় হিসেবে তার প্রতিভার ঝিলিক পরিস্ফুটিত হয়। ফুটবল মাঠে ছড়িয়ে পড়ে তার খ্যাতি। স্টপার হিসেবে তিনি ছিলেন অটল পাহাড়ের মত। পাকিস্তান আমলে যে ক’জন বাঙালি ফুটবলার দাপটের সঙ্গে খেলেছেন, তিনি তাদের অন্যতম।
বিক্রমপুরের লৌহজং থানার সন্তান হলেও মনজুর মুরশিদ গাউসের জন্ম আরমানিটোলার কেপি ঘোষ স্ট্রিটে। ১৯৩৯ সালের ৮ মার্চ তিনি ভূমিষ্ঠ হন। শৈশব থেকেই চারপাশে পেয়ে যান খেলাধুলার অবারিত পরিবেশ। ঘুম ভেঙ্গেছে খেলার মাঠের হল্লা-চিল্লায়। নিজের তো বটেই, আশপাশের এলাকাগুলো সকাল-বিকেল জমজমাট থাকে নানা রকম খেলাধুলায়। তিনিও খেলার মেলার অন্যতম কান্ডারি হয়ে যান। নবকুমার স্কুলের নবম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার পর তার খেলাধুলার দিগন্ত প্রসারিত হয়। ফুটবল, অ্যাথলেটিক, ক্রিকেট, হকিসহ বিভিন্ন ক্রীড়ায় তিনি সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন। সে সময় ফুটবলে খেলতেন রাইট হাফে। ফুটবলের পাশাপাশি অ্যাথলেটিক্সের ব্রড জাম্প, হপ-স্টেপ-জাম্পে তিনি দক্ষতা দেখান। তার পায়ে ফুটবল প্রতিভার ঝিলিক দেখে বন্ধুবর মুহাম্মদ কামরুজ্জামান (পরবর্র্তীকালে ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে সুপরিচিত) ১৯৫৭ সালে তাকে নিয়ে যান ‘হ্যামিলনের বংশীবাদক’ হিসেবে খ্যাত ফুটবল কোচ বজলুর রহমানের কাছে। আর জহুরী তো জহর চিনবেনই। গাউসের ফিগার, উচ্চতা ও খেলার প্রতি আত্মনিবেদন দেখে কোচ বজলু তাকে ভর্তি করে নেন তার ফুটবল পাঠশালায়। কামাল স্পোর্টিং কাব তখন ফুটবলার গড়ার লালনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। আর এই কাবের প্রাণভোমরা ছিলেন বজলুর রহমান। গাউসকে ঘষে-মেজে ১৯৫৮ সালে কামাল স্পোর্টিং কাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগ লীগে খেলতে নামিয়ে দেয়া হয়। রহমতগঞ্জের হয়ে প্রথম ম্যাচেই তার ক্রীড়াশৈলী ক্রীড়ানুরাগীদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। সে সময় একই দলে তার সঙ্গে খেলেছেন কামরুজ্জামান, নরেশ, প্রবীর মিত্র (অভিনেতা), শরফুদ্দীন, মুজিবুর প্রমুখ। এ বছর তিনি কামাল স্পোর্টিং কাবের হয়ে খেলেন আগাখান গোল্ডকাপ ও রোনাল্ড শীল্ড। ১৯৫৯ সালে দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয় কামাল স্পোর্টিং কাব। ১৯৬০ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে কামাল স্পোর্টিং কাবের পাশাপাশি অভিষেক হয় তার। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ আজাদ স্পোর্টিং কাব, ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৬ ফায়ার সার্ভিস, ১৯৬৭ ও ১৯৬৭ রহমতগঞ্জ, ১৯৬৯ ইপিআইডিসি এবং ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হয়ে খেলে অবসর নেন। খুলনা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত খেলেছেন টাউন কাবের হয়ে। এছাড়াও তিনি ১৯৬১ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফুটবল খেলেন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের হয়ে। মায়ের মৃত্যুতে তার পাঁচ বছর লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে। এ কারণে শিক্ষা জীবনে বন্ধুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেননি। তবে খেলোয়াড়ী জীবনে কোনো ছেদ পড়েনি। আন্তঃস্কুল ফুটবলের পর ঢাকা কলেজ ও কায়দে আজম কলেজের হয়ে স্টপার পজিশনে খেলেন। ১৯৬৫ সালে কায়দে আজম কলেজ চ্যাম্পিয়ন হয় স্যার এফ রহমান শীল্ড। ফাইনালে তারা জগন্নাথ কলেজকে দাঁড়াতে দেননি। ৫-০ গোলে জয়ী হন। ঢাকা জেলা ও ঢাকা বিভাগের হয়ে খেলেছেন আন্তঃজেলা ও আন্তঃবিভাগীয় ফুটবল। ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের হয়ে ময়মনসিংহ সূর্যকান্ত শীল্ড ও কুমিল্লায় একটি টুর্নামেন্ট এবং ১৯৬৬ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে বগুড়া মোহাম্মদ আলী শীল্ড খেলেন।
পাকিস্তান আমলে বাঙালি ফুটবলারদের জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াটা ছিল বিরল ঘটনা। এর মাঝে যারা স্থান করে নেন- গাউস তাদের অন্যতম। ১৯৬৫ সালে রাশিয়ায় খেলতে যান পাকিস্তান জাতীয় যুব দলের হয়ে। তার আগে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে পর্যটন শহর মারী ও রাওয়ালপিন্ডিতে অনুশীলনে অংশ নেন এবং বিভিন্ন দলের বিপক্ষে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেন। সে সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে সুযোগ পান সহ-অধিনায়ক হিসেবে প্রতাপ শংকর হাজরা, গোলকিপার রানা, সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু ও আমি। পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যে ছিলেন কাদের বক্স, মওলা বক্স, আইয়ুব দার, আসলাম, মুশতাক প্রমুখ। আমরা সে সফরে মস্কো, ইয়েরেভেন, ইউরোস্লাভ, ক্যালিলিন শহরে খেলতে যাই। রেড স্কোয়ারে লেনিনের মমি দেখেছিলাম। মনে হয়, তিনি যেন ঘুমিয়ে আছেন। একদমই জীবন্ত। মস্কোর ঘন্টা দেখেছি। তবে মস্কো স্টেডিয়ামে সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই শীর্ষ কাব মস্কো ডায়নামো ও স্পার্তা কাবের খেলা দেখাটা আনন্দময় স্মৃতি হয়ে আছে। মস্কো ডায়নামোর হয়ে খেলেছিলেন কিংবদন্তি ফুটবলার লেভ ইয়াসিন। মাঠে ঢোকার সময় এবং মাঠ থেকে বের হওয়ার সময় তাকে ফুলের মালা দিয়ে অভিনন্দন জানানো হয়। এটি আমাকে দারুণভাবে অভিভূত করে।’ ১৯৫৯ সালে ঢাকায় পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৩০ জন ফুটবলারকে নিয়ে একটি কোচিং ক্যাম্প করা হয়। কোচ ছিলেন সাহেব আলী। তার সঙ্গে ছিলেন চুন্না রশীদ, নূর হোসেন, ক্ষিতিশ স্যার প্রমুখ। আর বাঙালি ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন সাইফুদ্দিন, নূরুল ইসলাম অনু, দীপু, গাউস প্রমুখ। এই প্রশিক্ষণ গাউসকে ভালো ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। ১৯৬৬ সালে ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় দলের ট্রায়াল হয়। এ ট্রায়ালে বাঙালিদের মধ্যে ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ হাজরা, গাউস প্রমুখ। এ ট্রায়াল থেকে জাতীয় দলে সুযোগ পান পিন্টু ও প্রতাপ। গাউসকে ফাঁকি দিয়ে প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডদের পক্ষে বল নিয়ে গোল করা ছিল কঠিন এক পরীক্ষা। আর এ পরীক্ষায় অধিকাংশ সময়ই জয়ী হতেন তিনি। তার ট্যাকলের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারতেন না। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতাসম্পন্ন গাউসকে হেডে পরাস্ত করা যেত না। তিনি বল সাধারণত এয়ারে রিসিভ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
গাউস জীবনে অনেক স্মরণীয় খেলা খেলেছেন। তার মধ্যে স্মরণীয় হয়ে আছে ১৯৫৮ সালে আগা খান গোল্ডকাপে কামাল স্পোর্টিং কাবের হয়ে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের সঙ্গে খেলাটি। খেলাটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সে খেলায় মোহামেডানে ছিলেন দুলু আফেন্দী, জহির, দেবীনাশ, কামরু, কবীর, শাহ আলম প্রমুখ খ্যাতনামা ফুটবলাররা। সেদিন আমি মোহামেডানের কোনো ফরোয়ার্ডকে ঢুকতে দেইনি। তাদের সব আক্রমণ রুখে দিয়েছিলাম। পাকিস্তান জাতীয় দলের ফুটবলার রাইট-ইন কবীর ভাই ছিলেন আমার কাছে স্বপ্নের মত। তিনি ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয়। কবীর ভাই বল নিয়ে আমার পাশ দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করে সফল হতে পারেননি। তাকে একদমই নড়তে দেইনি। খেলায় আমরা জয়ী হয়েছিলাম ১-০ গোলে। সম্ভবত জয়সূচক একমাত্র গোলটি করেন শামসু। জয়ের আনন্দের মধ্যে আমি নিজেকে খুব ধিক্কার দিচ্ছিলাম। কবীর ভাইয়ের মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফুটবলারকে আমি তার স্বাভাবিক খেলা খেলতে দেইনি। এই গ্লানি, এই মনস্তাপ আমাকে অনেক দিন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। এ কারণে আমি কখনোই কবীর ভাইয়ের কাছে স্বাভাবিক হতে পারিনি। তাকে দেখলে এড়িয়ে চলতাম। কিন্তু এ ঘটনার দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ পর সোনালী অতীত কাবে এক অনুষ্ঠানে আমি বুঝতে পারি, সেদিনের কোনো কিছুই তার মনে নেই। আমি অনর্থক নিজেকে দোষী ভেবে বুকের মধ্যে একটা কষ্ট লালন করেছি। সেদিন আমার বুক থেকে নেমে যায় ভারী একটি পাথর। আসলে আমরা আমাদের সিনিয়র খেলোয়াড়দের সম্মান করতাম। তারাও জুনিয়রদের স্নেহ করতেন। এই পারস্পরিক সম্মান ও স্নেহ ছিল ক্রীড়াঙ্গনের সৌহার্দ্যময় পরিবেশের একটি অংশ।’ এছাড়া খুলনা লীগে একটি খেলার স্মৃতি গাউসের বুকে দাগ কেটে আছে, ‘টাউন কাবের সঙ্গে অন্য একটি কাবের খেলা। দলটির নাম মনে নেই। তবে দলটি একমাত্র গোলকীপার ছাড়া প্রতিটি পজিশনে পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে আসে। আমাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের মধ্যে ছিলাম আমি, ইপিআইডিসির লেফট-ব্যাক ফারুক। সেদিন আমি জান-প্রাণ দিয়ে খেলেছিলাম। পাকিস্তানের জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া শক্তিশালী দলটি দেখে রীতিমত জেদ চেপে যায়। যেভাবেই হোক তাদেরকে জিততে দেয়া হবে না। আসলেই সেদিন অবিশ্বাস্য খেলা খেলেছিলাম। বিস্ময়করভাবে আমরা খেলায় এক গোলে জিতেছিলাম।’ গাউস মনে করেন, তার খেলোয়াড়ী জীবনের সেরা সময় কেটেছে ফায়ার সার্ভিসের হয়ে। এর মধ্যে ১৯৬৬ সালে ঢাকা লীগে ফায়ার সার্ভিস ২-১ গোলে পরাজিত করেছিল ঢাকা মোহামেডানকে। বাঁ পা দিয়ে একটি গোল করেছিলেন মুনীর। ফায়ার সার্ভিসের হয়ে খেলার সময় প্রথম টাকা-কড়ি পান। তখন খেলোয়াড়দের সর্বোচ্চ সম্মানী ছিল পাঁচ হাজার টাকা।
পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলে খেলতে না পারা প্রসঙ্গে গাউস বলেন, ‘আমি স্টপার পজিশনে খেলতাম, পাকিস্তান জাতীয় দলে সে পজিশনে খেলতেন তোরাব আলী। ছয় ফুটের মতো লম্বা। ঠান্ডা মেজাজের খেলোয়াড়। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই রক্ষণভাগের দুর্ভেদ্য প্রাচীর। তাকে ফাঁকি দিয়ে বল নিয়ে প্রবেশ করা আর মাথা দিয়ে দেয়াল ভাঙ্গা সমান কথা। তোরাব আলী মাঠে থাকলে প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকাররা ধরে নিতেন আজ তাদের কপালে দুর্ভোগ আছে। তাকে বলা হতো ‘এশিয়ান স্টার’। আমার দুর্ভাগ্য আমার ফুটবল ক্যারিয়ারে এমন একজন দিকপাল ফুটবলারের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়।’
একটি খেলার ও একজন খেলোয়াড়ের স্মৃতি গাউসের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আছে, ‘১৯৫৮ সালে কামাল স্পোর্টিং কাবের হয়ে নীলফামারীতে একটি টুর্নামেন্ট খেলতে যাই। তখন কামাল স্পোর্টিং কাবের গোলরক্ষক ছিলেন সদ্য পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলে আসা মঞ্জুর হাসান মিন্টু। আমরা তো টগবগিয়ে ফুটছি। প্রতিপক্ষকে পাত্তাই দেব না। আমরা ভেবেছি এক, হয়েছে আরেক। ফাইনালে আমাদের রুখে দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের সালাম নামে একজন রাইট-ইন। এক বছর তিনি ঢাকা মোহামেডানে খেলেন। তিনি প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে যে গোলটি করেছিলেন, তা এককথায় অবিশ্বাস্য। মিন্টু ভাইয়ের মতো সুঠাম, দীর্র্ঘদেহী ও দুর্দান্ত গোলরক্ষককে তিনি হতভম্ব করে দেন। এই একটি গোলেই আমরা হেরে যাই। আমরা পুরো টিম মাঠে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম। এভাবে যে গোল করা যায়, সেটা আমাদের ভাবনায় ছিল না। এই চার দশক পরও সেই গোলটি স্মৃতি আমার চোখে লেগে আছে। তখন তো আমাদের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর কোনো যোগাযোগ ছিল না। কোথায় কেমন খেলা হচ্ছে, কে নামকরা ফুটবলার- খুব একটা জানতাম না। মিন্টু ভাই আবার এসব খোঁজ-খবর রাখতেন। তার কাছেই তখন শুনি, ব্রাজিলের একজন তরুণ ফুটবলার পেলে অসাধারণ খেলেন। দুর্দান্ত সব গোল করেন। এ কথা শুনে কৌতূহল বেড়ে যায়। ঢাকায় ইউসিস লাইব্রেরীতে গিয়ে ম্যাগাজিন খুঁজে তার ছবি দেখি। তারপর ব্রাজিলের খেলার ক্যাসেট যোগাড় করে তাদের খেলা দেখেছি। গ্যারিঞ্চার খেলা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। ফুটবল যে একটা শিল্প, এটা আমি অনুধাবন করতে পারি তার খেলা দেখে। ফুটবলের একজন অসাধারণ শিল্পী তিনি। সেদিন মনে হয়েছিল, ফুটবল এক উচ্চ ঘরানার খেলা, তার নাগাল পেতে হলে দীর্ঘ সাধনা করা প্রয়োজন। এর ফলে বদলে গিয়েছিল আমার দৃষ্টিভঙ্গি।’
দর্শক হিসেবে দেখা সেরা খেলা প্রসঙ্গে গাউস বলেন, ‘১৯৫৮ সালের কথা। ঢাকায় খেলতে আসে করাচী কিকার্র্স ও কিয়ামারী মোহামেডান। সে সময় থ্রি ব্যাক সিস্টেমে খেলা শুরু হয়। রোনাল্ড শীল্ডের ফাইনালে করাচী কিকার্সকে ছিন্নভিন্ন করে ৭-০ গোলে জয়ী হয় কিয়ামারী মোহামেডান। এর তিন/চার দিন পর আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবলের ফাইনালে কিয়ামারী মোহামেডানকে ২-১ গোলে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয় করাচী কিকার্স। এটা আমার কাছে দারুণ অদ্ভুত লেগেছিল। শোচনীয়ভাবে হারার ক’দিন পর প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়াটা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। করাচী কিকার্স দলের ফুটবলার ছিলেন গফুর বেলুচ, আমিন, আবদুল্লাহ, সিনিয়র ইউসুফ, রসুল বক্স, গফুর বাট প্রমুখ। কিয়ামারী মোহামেডানের আব্বাস, মুসা, আবিদ হোসেন, হাসান কিলার প্রমুখের কথা মনে পড়ে।’
সব্যসাচী ক্রীড়াবিদ ছিলেন সোনালী ব্যাংকের রণজিত দাস। তিনি ছিলেন হকির গোলরক্ষক। স্বাধীনতার পর হকি থেকে তিনি অবসর নেয়ার পর তার শূন্যস্থানে খেলা শুরু করেন গাউস। রণজিত দাস প্রসঙ্গে গাউস বলেন, ‘রণজিত দাস ছিলেন কিংবদন্তি ক্রীড়াবিদ। আপাদমস্তক এক ভদ্রলোক। জাত খেলোয়াড়। তার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। খেলোয়াড় হিসেবে যেমন তার কাছে নতুন নতুন অনেক বিষয়ে জানা সম্ভব হয়েছে, তেমনি আদব-কায়দা, নিয়ম-কানুন, ডিসপ্লিনও শিখিয়েছেন। তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। আসলে তার মতো ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হয় না। অথচ তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক।’ আরমানিটোলার অধিবাসী হয়ে গাউসের সঙ্গে হকি খেলার যোগসূত্র থাকবে না, তা তো হতে পারে না। শৈশব থেকেই হকি খেলায় টুকটাক চর্চা ছিল। যে কারণে সোনালী ব্যাংকের হয়ে খেলার আমন্ত্রণ আসতেই খুব একটা ভাবতে হয়নি। বরং অল্প সময়ের মধ্যেই হয়ে ওঠেন সোনালী ব্যাংকের অতন্দ্র প্রহরী। প্রায় দশ বছর হকি খেলেন। ক্রিকেটার হিসেবেও নেহাত মন্দ ছিলেন না। পাড়ার কাব ন্যাশনাল স্পোর্টিং কাবের হয়ে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত খেলেছেন। ছিলেন মিডিয়াম পেসার। চাকরির কারণে আর খেলা হয়নি।
গাউসের দেখা সেরা ফুটবলারদের মধ্যে আছেন ব্যাকের ইউজিন, গোলকীপার রণজিত, স্টপার নবী চৌধুরী, সেন্টার ফরোয়ার্ড আশরাফ চৌধুরী, রাইট-ইন কবীর, লেফট-ইন মারী, লেফট-হাফ আবদুস সাদেক, গোলকীপার মঞ্জুর হাসান মিন্টু, হাফের ভানু, রাইট-হাফ কামরু, লেফট-ব্যাক দেবিনাশ, রাইট ব্যাক জহির আর মাকরানী ফুটবলারদের মধ্যে সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর, লেফট-ইন আবদুল্লাহ, লেফট-হাফ আবিদ হোসেন, রাইট-ব্যাক আমিন, স্টপার তোরাব আলী প্রমুখ। তার মতে, বুদ্ধিমান ফুটবলার ছিলেন ইউজিন। তবে ওয়ান্ডারার্সের ওমর, মোহামেডানের সেন্টার ফরোয়ার্ড আব্বাস, আবদুল্লাহ, মুসা, প্রতাপ ছিলেন বেশ ক্ষিপ্রগতির। তাদের আটকানো ছিল কঠিন।
কথায় কথায় বন্ধু ফুটবলার প্রতাপ শংকর হাজরা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রতাপ ও আমি কাছাকাছি এলাকায় থাকতাম। আমি প্রায়ই প্রতাপদের বাসায় গিয়ে আড্ডা মারতাম। খাওয়া-দাওয়া করতাম। ছোটবেলা আমার মা মারা যাওয়ায় প্রতাপের মা হয়ে ওঠেন আমার মা। তিনিও আমাকে পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। একবার ঢাকা লীগে ঢাকা মোহামেডানের সঙ্গে আমাদের খেলা। গোল করতে না পেরে হতাশা থেকে প্রতাপ আমার পায়ে আঘাত করে। আমার উরু বেশ গভীরভাবে কেটে যায়। আমিও প্রতিশোধের সুযোগ খুঁজতে থাকি। সুযোগ পেয়ে আমিও ওকে আঘাত করি। খেলা শেষে প্রতাপের ভেসপায় করে ওদের বাসায় যাই। প্রতাপ বাসায় যেয়ে হাফ প্যান্ট পরে এমনভাবে বসে, যাতে ওর পায়ের আঘাত দেখা যায়। মাসিমা তা দেখে জিজ্ঞেস করেন, কীরে কীভাবে আঘাত পেলি? জবাবে প্রতাপ আমাকে দেখিয়ে বলে, ‘তোমার পোলারে জিজ্ঞেস কর।’ আমি তখন কিছু না বলে আমার আঘাতের অংশটুকু বের করে দেখাই। আমার পা থেকে রক্ত বের হচ্ছিল। তা দেখে মাসিমা চিৎকার করে ওঠেন। আঘাতের কারণ জানতে চাইলে আমি সবিস্তারে ঘটনা বলতেই মাসিমা প্রতাপকে রাগারাগি করেন। নিজের সন্তানের আঘাতটাকে গুরুত্ব না দিয়ে আমার প্রতি তিনি সহানুভূতি দেখান। আসলে তিনি আমাকে কী পরিমাণ স্নেহ করতেন, তা বলে বোঝানো যাবে না।’
আরমানিটোলার প্রসঙ্গ এলে নস্টালজিক হয়ে ওঠেন গাউস। তিনি বলেন,‘সে সময় আরমানিটোলার খেলাধুলার পরিবেশ ছিল চমৎকার। সবাই খেলাধুলায় মেতে থাকতেন। সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা খেলাধুলা করতেন। আমাদের সমসাময়িক খেলোয়াড়দের মধ্যে আছেন জলিল আনসারি,বশির আহমেদ, প্রতাপ শংকর হাজরা, ফখরুল ইসলাম মাহমুদ, আকবর আলী, আলমগীর আদেল, মাহমুদ, অভিনেতা প্রবীর মিত্র,এটিএম শামসুজ্জামান, হান্নান শাহ (পরবর্তীকালে ব্রিগেডিয়ার ও বিএনপির মন্ত্রী), মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, ইরফান, মাওলা প্রমুখ।’
খেলোয়াড়ী জীবন শেষে গাউস ফুটবলের কোচ ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিভাগের দল শান্তিনগরের কোচ। সে বছর শান্তিনগর কাব দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে ওঠে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের কোচ।
গাউস ১৯৬১ সালে যোগ দেন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানে। ব্রেক অব স্টাডির কারণে পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটে। তাতে তিনি দমে যাননি। ১৯৭২ সালে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৭৮ সালে ডিগ্রী এবং ১৯৮৩ সালে ব্যাংকিং ডিপ্লোমা ডিএআইবিবি পাস করেন। ২০০০ সালে অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে সোনালী ব্যাংক থেকে অবসর নেন। দু’কন্যার জনক। চোখের সমস্যার কারণে খেলাধুলার অঙ্গনে এখন আর তাকে দেখা যায় না।
এক সময়ের ফুটবল মাঠের পরাক্রান্ত সৈনিক মনজুর মুরশিদ গাউসকে এখন দেখলে চিনতে কষ্ট হয়। সময় তাকে অনেক বদলে দিয়েছে। জীবনের ধর্ম তো এই। তবে ফুটবলের প্রসঙ্গ এলে এখনও তিনি ফুটতে থাকেন টগবগিয়ে। এই ফুটবলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার জীবনের বড় একটি অংশ। কত স্মৃতি, কত মানুষ। অবশ্য স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে গেছে অনেক কিছুই। তারপরও কখনো কখনো মনে পড়ে যায় অতীতের স্মৃতিমাখা সেই সোনালী দিনগুলোর কথা। তখন তিনি হয়ে পড়েন নস্টালজিক। স্মৃতিগুলো বুকের গভীরে বাজে মধুর বেদনা হয়ে। গাউস তখন আনমনা হয়ে যান। #
১-১২-২০০৭

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ফুটবল মাঠের অন্য এক লড়াই

হুট করে এভাবে চলে গেলেন রণজিত দা!

ধবল জোছনার দিনগুলো / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

আমাদের ফুটবলাররা

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

মাটির বিশ্বকাপ মানুষের বিশ্বকাপ

যেন রূপকথার এক নায়ক / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

বাঙালির ফুটবল আবেগ / দুলাল মাহমুদ Dulal Mahmud

স্বাগতিক ব্রাজিল, ফেলপস আর বোল্টের কথা / দুলাল মাহমুদ