৩২ বছর আগের স্মৃতি/দুলাল মাহমুদ

আশির দশকের একদম শুরুতেই ঘরোয়া হকির সঙ্গে গড়ে ওঠে কিঞ্চিৎ যোগাযোগ। ফুটবল আর ক্রিকেটের ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখির প্রয়োজনে কখনো-সখনো ছুটতে হয়েছে হকি মাঠে। তবে মনোযোগটা খুব বেশি গভীর ছিল, সেটা বলা যাবে না। বড় বড় ম্যাচগুলো আকর্ষণ করলেও হকিটা সে সময় মনের পটে সেভাবে ছাপ ফেলতে পারে নি। এর একটা কারণ হতে পারে, ১৯৭৮ সালের ব্যাংকক এশিয়ান গেমসের হকিতে পাকিস্তানের কাছে ১৭-০ গোলে পরাজয়ের লজ্জাটা বুকের গভীরে চেপে বসে। দুঃসহ এই স্মৃতি ক্রীড়ানুরাগীদের মতো আমাকেও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে থাকে। এরপর থেকে হকির প্রতি আকর্ষণ দেখানোর ক্ষেত্রে একটা সংকোচ বোধ হওয়াই স্বাভাবিক। এটা মনে হতে থাকে, আর যাই-ই হোক, আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে হকি দিয়ে অন্তত জাতে ওঠা যাবে না। অবশ্য সেই ভুলটা এক সময় ভেঙে যায়।
কানায় কানায় পূর্ণ ঢাকা স্টেডিয়াম

প্রকৃতঅর্থে ১৯৮৫ সালে বদলে যায় মনোজগত। হকি স্টিকের মধ্যেও যে জাদু আছে, সেটা তখন অনেক বেশি অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। পান করেছিলাম হকির অমিয় সুধা। সে বছর ২০ থেকে ২৮ জানুয়ারি ঢাকায় ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় এশিয়া কাপ হকি। এরআগে আগা খান গোল্ড কাপ ফুটবল, ২০তম এশিয়ান যুব ফুটবল, প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ ফুটবল ইত্যাদি আয়োজিত হলেও পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দল নিয়ে কোনও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আসর স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বসে নি। জাতীয় দল নিয়ে ঢাকায় আয়োজিত প্রথম আন্তর্জাতিক কোনও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হলো এশিয়া কাপ হকি। ১০ জাতির এই টুর্নামেন্টে অংশ নেয় বিশ্বকাপ, অলিম্পিক ও এশিয়ান গেমস চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান,  অন্যতম পরাশক্তি সাবেক অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইরান ও স্বাগতিক বাংলাদেশ। শেষ মুহুর্তে নাম প্রত্যাহার করে নেয় ওমান ও ম্যাকাও। তখন পর্যন্ত হকিতে জয়জয়কার পাকিস্তান এবং ভারতের। উপমহাদেশের এই দুই দেশের উপস্থিতিতে গড়িয়ে পড়ে উত্তেজনার লাভা। আর বাংলাদেশে এই দুই দেশের খেলার কথা জানার পর টগবগিয়ে ফুটতে থাকেন ক্রীড়ানুরাগীরা। শৈল্পিক হকির এই দুই প্রতিনিধি ফাইনালে খেলবে, এমন স্বপ্নে বিভোর হন হকির সমঝদাররা। এ কারণে এই টুর্নামেন্ট নিয়ে দারুণভাবে সাড়া পড়ে যায়। তখন আন্তর্জাতিক হকি টুর্নামেন্ট আয়োজনের মতো কোনও ভেন্যু বাংলাদেশে ছিল না। আর হকির দুনিয়া অ্যাস্ট্রোটার্ফের জগতে প্রবেশ করলেও বাংলাদেশের কাছে তখন সেটা সুদূরের স্বপ্ন। ঢাকা স্টেডিয়ামের ঘাষের মাঠই ছিল সব খেলার বিচরণ ক্ষেত্র। সেই তারুণ্যে, এই টুর্নামেন্টটি নবীন ক্রীড়ালেখক হিসেবে আমাকেও ব্যাপক আলোড়িত করে। প্রেস বক্সে বসে এমন একটি টুর্নামেন্ট কভার করার আনন্দে রোমাঞ্চিত হই। তখনও ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে হাতেখড়ি হয় নি। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করি। সে সময় ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া লেখকের সংখ্যাও ছিল অপ্রতুল। তাছাড়া স্টেডিয়াম এলাকায় যাঁদের বিচরণ ছিল, তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে পরস্পরের কম-বেশি চেনা-জানা ছিল। এ কারণে প্রেস কার্ড পেতেও কাঠখড় পোড়াতে হয় নি।
অতীতের রেকর্ড ভালো না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ দল নিয়ে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। কোচ এহতেশাম সুলতান আর প্রতাপ শঙ্কর হাজরার অধীনে দলটি অনেক দিন নিবিড় প্রশিক্ষণ নেয়। যদিও দলের বেশ কয়েকজন নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় আহত ছিলেন। সিনিয়র একাধিক খেলোয়াড় খেলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। জাতীয় দলে শাহবুদ্দিন চাকলাদারকে দলভুক্ত করা নিয়ে প্রতিবাদ জানান দুই কোচ এহতেশাম সুলতান আর প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। কিন্তু তাঁদের প্রতিবাদকে গুরুত্ব না দিয়ে সিলেকশন কমিটি তাঁকে দলভুক্ত করে। এ কারণে তাঁরা কোচিং করানো বন্ধ করে দেন। এ ঘটনায় প্রতাপ শঙ্করকে ১০ বছর এবং এহতেশাম সুলতানকে ৫ বছর সাসপেন্ড করা হয়। শেষ মুহুর্তে তাঁদের পরিবর্তে কোচের দায়িত্ব পালন করেন সহকারী ম্যানেজার মো. মহসীন।
বাংলাদেশ জাতীয় হকি দল ১৯৮৫

নবীন ও প্রতিভাবানদের নিয়ে গড়া দলটির অধিনায়ক করা হয় ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন চাকলাদারকে। দলের অন্য খেলোয়াড়রা হলেন সালাহউদ্দিন চৌধুরী টিসা (সহ-অধিনায়ক), নায়েক ওসমান, ওয়ালিউল ইসলাম নাসিম, জুম্মন লুসাই, খাজা আরজু রিজওয়ান, জসিমউদ্দীন আহমেদ কাঞ্চন, জামিল পারভেজ লুলু, মো. আলমগীর চুন্নু, আবদুল মালেক চুন্নু, আবদুল মালেক চুন্নু, খাজা মো. ড্যানিয়েল, মো. বরকতউল্লা, নায়ক জাহাঙ্গীর আলম, কামরুল ইসলাম কিসমত, আবদুল্লাহ পিরু, মো. সহিদুল্লাহ। ম্যানেজার ছিলেন সাব্বির ইউসুফ।
টুর্নামেন্টের গ্রুপিংটা ছিল এমন : ‘ক’ গ্রুপ-পাকিস্তান, জাপান, চীন, ইরান, বাংলাদেশ। ‘খ’ গ্রুপ-ভারত, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর।
জুম্মন লুসাই

দ্বিতীয় এশিয়া কাপ হকিকে কেন্দ্র করে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে ঢাকা। উদ্বোধনী ম্যাচে বাংলাদেশ ৩-১ গোলে ইরানকে হারিয়ে দেয়। আর এই জয়ের মূল নায়ক ছিলেন জুম্মন লুসাই। ফুলব্যাকের এই খেলোয়াড় হ্যাটট্টিক করার গৌরব অর্জন করেন। কোনও বিদেশি দলের পক্ষে এটি ছিল বাংলাদেশের কোনও খেলোয়াড়ের প্রথম হ্যাটট্টিক। পেনাল্টি কর্নার থেকে ২টি এবং পেনাল্টি স্ট্রোক থেকে একটি গোল হয়। তবে গোলসংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ পেয়েও কাজে লাগানো যায় নি। নতুবা অনেক বড় ব্যবধানে জিততে পারতো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ দল : ওসমান, জুম্মন লুসাই, শাহাবুদ্দিন চাকলাদার, আলমগীর চুন্নু, পিরু, নাসিম, রেজোয়ান (ড্যানিয়েল), মালেক চুন্নু, কিসমত, টিসা, লুলু।
বাংলাদেশের জয় আর জুম্মনের হ্যাটট্টিক এশিয়া কাপ হকিকে আরও রাঙিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ-ইরান ম্যাচ

শক্তিশালী জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশ সমানতালে লড়াই করে। এক গোলে পিছিয়ে পড়েও অদম্য মনোবল আর লড়াকু মনোভাব দিয়ে সমতা নিয়ে আসে। খেলার শেষ মুহূর্তে পেনাল্টি স্ট্রোক থেকে গোল করেন জাপানের তাকামোরি। পেনাল্টি স্ট্রোকের প্রতিবাদে উত্তেজিত দর্শকরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করলে খেলা ১৬ মিনিট বন্ধ থাকে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের অনুরোধে দর্শকরা শান্ত হয়। এক মিনিটের ব্যবধানে দর্শনীয় গোলে সমতা আনেন সালাউদ্দিন টিসা। ইরানের বিপক্ষে জয়ের পর জাপানের সঙ্গে ড্র করায় হকি অনুরাগীরা উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশ দল : ওসমান গনি, জুম্মন, শাহাবুদ্দিন চাকলাদার, আলমগীর চুন্নু, নাসিম, মালেক চুন্নু, কিসমত, সালাউদ্দিন টিসা, চপল (ড্যানিয়েল), লুলু, পিরু।
চীনের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করাটাও ছিল বাংলাদেশের বড় সাফল্য। ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়েও সমতা আনাটা ছিল অসাধারণ। দুই গোল হজমের পর জ্বলে ওঠে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় গোল খাওয়ার ৪ মিনিটের মধ্যে নাসিম গোল করে ব্যবধান কমান। দ্বিতীয়ার্ধের ২৮ মিনিটে পেনাল্টি স্ট্রোকে সমতা আনেন মালেক চুন্নু।
বাংলাদেশ দল : ওসমান গণি, জুম্মন, শাহাবুদ্দিন চাকলাদার, আলমগীর চুন্নু, নাসিম, জসিম, মালেক চুন্নু, কিসমত, টিসা, জাহাঙ্গীর (লুলু)।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের দর্শকদের ‍একাংশ 
ইরানকে হারানোর পর জাপান এবং চীনের সঙ্গে ড্র করার পর উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে পুরো দেশ। বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকেন দেশের মানুষ। পাকিস্তানের সঙ্গে খেলাকে কেন্দ্র করে স্টেডিয়ামে দর্শকের বাধভাঙা জোয়ার নামে। কানায় কানায় ভর্তি হয়ে যায় স্টেডিয়াম। দুর্ধর্ষ পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা যে ক্রীড়াশৈলী উপহার দেন, তাতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন ক্রীড়ানুরাগীরা। শুরু থেকে দেখা যায় সাহসী এক বাংলাদেশকে। এই বাংলাদেশকে আগে কখনও দেখা যায় নি। চাপের মুখে ভেঙে না পড়ে পাল্টা আক্রমণ গড়ে তোলে। লড়াই করে সমানতালে। সালাউদ্দিন টিসা সহজ দুটি গোল হাতছাড়া করার পর স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শকদের দীর্ঘশ্বাস ছিল মর্মবিদারী। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১-০ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ। খেলা শেষ হওয়ার ৬ মিনিট আগে গোল করেন পাকিস্তানের হাসান সরদার। খেলোয়াড়দের চোখে অশ্রু টলমল করলেও হারার পর উল্লসিত হয় বাংলাদেশের দর্শকরা। কারণ, বিশ্ব হকির সেরা দলটির সঙ্গে খেলায় দেখতে পাওয়া যায় লড়াকু এক বাংলাদেশকে। এমন খেলা ছিল দর্শকদের প্রত্যাশার বাইরে। সঙ্গত কারণে বাংলাদেশের হকির ইতিহাসে অন্যতম সেরা খেলা হিসেবে এটি বিবেচিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ

পাকিস্তান দল : শহীদ খান, কাসেম জিয়া, তৌওকিরদার (নাসির আলী), নাঈম আখতার, আবদুল রশিদ, সেলিম শেরওয়ানী (মুস্তাক আহাম্মদ), আয়াজ মাহমুদ, কলিমুল্লাহ, হাসান সরদার, হানিফ খান ও খালিদ হামিদ। বাংলাদেশ দল : গোলরক্ষক ওসমান, রাইট ব্যাক জুম্মন লুসাই, রাইট হাফ শাহাবুদ্দিন চাকলাদার (অধিনায়ক), লেফট ব্যাক আলমগীর চুন্নু, লেফট হাফ পিরু, সেন্টার হাফ নাসিম, সেন্টার হাফ কাঞ্চন, রাইট আউট মালেক চুন্নু, রাইট ইন কিসমত, সেন্টার ফরোয়ার্ড সালাউদ্দিন তিসা, লেফট আউট লুলু।
স্থান নির্ধারণী ম্যাচে মালয়েশিয়ার কাছে ৩-০ গোলে হেরে ষষ্ঠ হয় বাংলাদেশ। আগের ম্যাচে দুর্দান্ত খেলার পর এ ম্যাচে খুঁজে পাওয়া যায় নি বাংলাদেশকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজেদের নিংড়ে দেওয়ার পর খেলোয়াড়রা যেন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশ দল : ওসমান, জুম্মন, শাহাবুদ্দিন চাকলাদার, আলমগীর চুন্নু, নাসিম, কাঞ্চন, মালেক চুন্নু, কিসমত, টিসা (ড্যানিয়েল), লুলু, পিরু।
টুর্নামেন্টে একনজরে বাংলাদেশের ফল
বাংলাদেশ ৩ (জুম্মন লুসাই হ্যাটট্টিক) ইরান ১ (কাওসারি)
বাংলাদেশ ১ (সালাউদ্দিন টিসা) জাপান ১ (তাকামোরি)
বাংলাদেশ ২ (নাসিম, মালেক চুন্নু) চীন ২ (লিনয়ং, ইয়ংফু)
বাংলাদেশ  ০ পাকিস্তান ১ (হাসান সরদার)
বাংলাদেশ ০ মালয়েশিয়া ৩

পয়েন্ট তালিকা
‘ক’ গ্রুপ
দল          খেলা জয় ড্র পরা স্ব বি পয়েন্ট
পাকিস্তান    ৪    ৪   ০  ০   ২১  ০   ৮
জাপান      ৪     ২   ১  ১   ১৩  ৪   ৫
বাংলাদেশ  ৪     ১   ২   ১   ৬   ৫   ৪
চীন          ৪    ১   ১   ২   ৫   ৫   ৩
ইরান        ৪    ০   ০   ৪   ২  ৩৩  ০

‘খ’ গ্রুপ
ভারত         ৪  ৪  ০  ০  ২২  ১   ৮
দঃ কোরিয়া   ৪  ২  ১  ১  ১৭  ১১  ৫
মালয়েশিয়া   ৪  ২  ১  ১   ৮   ৮   ৫
শ্রীলঙ্কা        ৪  ১  ০  ৩   ৭  ১৭  ২
সিঙ্গাপুর      ৪  ০  ০  ৪   ২  ৩৩  ০
পাকিস্তান-ভারত ফাইনাল ম্যাচ

প্রথম সেমি-ফাইনালে ভারত ৯-১ গোলে জাপানকে এবং দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে পাকিস্তান ৭-০ গোলে দক্ষিণ কোরিয়াকে হারায়। দর্শকদের স্বপ্নকে সত্য করে দিয়ে ফাইনালে যথারীতি মুখোমুখি হয় দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান এবং ভারত। সেদিন পুরো স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। টিকিট কেটেও বিপুলসংখ্যক দর্শক মাঠে ঢুকতে পারেন নি। ফাইনাল ম্যাচটিও হয় দেখার মতো। ঘাষের মাঠে হকি স্টিকের আঁচড়ে প্রতিফলিত হয় চোখজুড়ানো সব নান্দনিক চিত্রকলা। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও মনোমুগ্ধকর ফাইনালে পাকিস্তান ৩-২ গোলে হারায় ভারতকে। ১০০ মিনিটের ম্যাচটি ছিল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, উপভোগ্য, শ্বাসরুদ্ধকর ও নাটকীয়তায় পরিপূর্ণ। যে কোনও দলই জয়ী হতে পারতো। প্রতিটি মুহূর্ত ছিল উত্তেজনায় ভরপুর। খেলার নির্ধারিত সময়ে প্রাধান্য ছিল ভারতের। আক্রমণ গড়ে তুললেও গোল করায় দক্ষতার পরিচয় দিতে পারে নি তারা। এ সময়ে ভারত ১৬টি পেনাল্টি কর্নার পায়। পাকিস্তান পায় ৬টি। পাকিস্তানের লেফট ব্যাক নাসির আলী, তিন হাফ ব্যাক রশিদ, আয়াজ ও নঈম আখতার, ফরোয়ার্ড মুশতাক ও হানিফ খান দৃঢ়তার সঙ্গে দলের হাল ধরে রাখেন। অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন হানিফ খান। ভারতের আক্রমণের মুখে তিনি বার বার রক্ষণভাগে যোগ দেন, তেমনি আক্রমণ গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। হানিফ খান, হাসান সরদার, মুশতাক ও লেফট আউট খালিদ হামিদ নিজেদের মধ্যে সুন্দর আদান-প্রদান গড়ে তোলেন। গোলপোষ্ট আগলে রাখার ব্যাপারে পাকিস্তানি গোলরক্ষক শহীদ আলী খান দক্ষতার ছাপ রাখেন। মাটিতে শুয়ে পড়ে যেভাবে ভারতীয় পেনাল্টি কর্নার ঠেকিয়েছেন, তা দর্শকদের আনন্দ দেয়। প্রথমার্ধের ৩১ মিনিটে হঠাৎ করে ডান দিক দিয়ে পাকিস্তান একটি আক্রমণ গড়ে তোলে। ভারতের অধিনায়ক সোমায়া তা ফ্রি হিটের মাধ্যমে রক্ষা করেন। পাকিস্তানের রাইট উইঙ্গার কলিমুল্লাহ ফ্রি হিট থেকে ‘ডি’ এলাকার ভিতর থেকে হানিফ খান গড়ানো দুর্বল শটের সাহায্যে প্রথম গোল করেন। এই গোলের পর রক্ষণাত্মক কৌশল গ্রহণ করলে ভারত গোল পরিশোধের জন্য মরীয়া হয়ে ওঠে। খেলা শেষ হওয়ার ৫ মিনিট আগে ভারত গোল পরিশোধ করে। শহীদ অত্যন্ত দ্রুততার সাথে মধ্যমাঠ থেকে আক্রমণ রচনা করে বাম প্রান্ত দিয়ে পাকিস্তানের বিপজ্জনক স্থানে ঢুকে পড়ে নঈমের দিকে বল ঠেলে দেন। নঈম কালবিলম্ব না করে বল বোর্ডে পাঠান।
নির্ধারিত ৭০ মিনিটের খেলা ১-১ গোলে ড্র থাকার পর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলা শুরু হয়। এরপর ভারতের আধিপত্য হ্রাস পায়। অতিরিক্ত সময়ের ১৯ মিনিটে আয়াজের দ্রুত পাস থেকে মুশতাক একটি দর্শনীয় গোল করে পাকিস্তানকে ২-১ এগিয়ে নেন। ৪ মিনিট পর খেলায় সমতা আনে ভারত। সেন্টার হাফ হরদিপ সিং তড়িৎ গতিতে ‘ডি’ জোনের মধ্যে ঢুকে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারকে ফাঁকি দিয়ে গোল করেন। খেলা শেষ হওয়ার ৩ মিনিট আগে জয়সূচক গোল করেন কলিমুল্লাহ। কলিমুল্লাহর একটি পেনাল্টি কর্নার থেকে এ গোলের সূচনা হয়। কলিমুল্লাহ‘র ঠেলে দেওয়া বল হাসান সরদার গোলের দিকে স্কুপ করলে ভারতীয় রক্ষণভাগের একজন খেলোয়াড়ের স্টিকে লেগে উঁচু হয়ে গোলের কাছাকাছি চলে যায়। গোল মুখে দাঁড়ানো কলিমুল্লাহ প্রায় কাঁধের সমান উঁচু অবস্থায় বলকে ঠেলে বিজয়সূচক গোল করেন। জাপানি আম্পায়ার ইউবুতা গোলের সিদ্ধান্ত দেওয়ার সাথে সাথেই ভারতীয় খেলোয়াড়রা তাঁকে ঘিরে ধরেন। বিপজ্জনক খেলা’র অভিযোগে গোল বাতিল করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এক পর্যায়ে ভারতের একজন খেলোয়াড়ের স্টিকের আঘাতে আম্পায়ার আহত হলে তাঁকে স্ট্রেচারে মাঠের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। জাপানি আম্পায়ার আর খেলা পরিচালনা করতে পারেন নি। তাঁর পরিবর্তে অতিরিক্ত আম্পায়ার খেলা পরিচালনা করেন। পাকিস্তানের জয়সূচক গোল হওয়ার পর কিছু দর্শক মাঠে ঢুকে পড়েন। খেলোয়াড়দের জড়িয়ে ধরেন। এ ঘটনায় ৩৩ মিনিট খেলা বন্ধ থাকে। ভারতীয় খেলোয়াড়রা আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে বিরুদ্ধে মাঠের ধারে বসে থাকা বিচারকদের কাছে বার বার আবেদন করে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে খেলায় অংশ নেন। পাকিস্তান  দল: শহীদ আলী, কাসিম জিয়া, নাসির আলী, আবদুর রশিদ, আয়াজ মাহমুদ, নঈম আখতার, কলিমুল্লাহ, মুশতাক, হাসান সরদার, হানিফ খান, খালিদ হামিদ। ভারতীয় দল : রোমিও জেমস, টপনো (পারগাত সিং), বিনীত কুমার, সোমায়া, হরদীপ সিং, রাজিন্দর সিং, গুণদীপ কুমার (টিকেন সিং), মারভিন ফার্নান্ডেজ, মো. নঈম, মো. শহিদ, বলবিন্দর সিং।
কলিমুল্লাহ
তবে হকির দুই পরাশক্তির লড়াই দর্শকদের বিমোহিত করে দেয়। ঢাকার মাঠে এমন একটি ম্যাচ দেখা ছিল স্বপ্নের মতো।
হানিফ খান

হাসান সরদার
পাকিস্তানের হকির ইতিহাসে অন্যতম সেরা তিন ফরোয়ার্ড ও অলিম্পিক স্বর্ণজয়ী খেলোয়াড় হাসান সরদার, হানিফ খান ও কলিমুল্লাহ’র ক্রীড়াশৈলী দর্শকদের হৃদয়ে দাগ কাটতে সক্ষম হয়। তবে জনপ্রিয় খেলোয়াড় ছিলেন হাসান সরদার। এই সেন্টার ফরোয়ার্ডের অনুপম ডজ, চলন্ত বলে তড়িৎ গতিতে গোল করার কৌশল দর্শকদের মুগ্ধ করে। টুর্নামেন্টে ১০টি গোল করেন তিনি। দলের অন্যতম সিনিয়র খেলোয়াড় কলিমুল্লাহও সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন। আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় দলের বিপদের সময় নিজেকে উজাড় করে দেন। পাকিস্তান শিরোপা জয় করে হানিফ খানের নেতৃত্বে। খেলোয়াড়ি জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও গোল করার ক্ষেত্রে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। দেখতে ছোটখাট হলেও দুরন্ত ছিলেন ভারতের মো. নঈম। প্রতিটি ম্যাচেই গোল করেন। সুযোগসন্ধানী এই খেলোয়াড় এ টুর্নামেন্টে প্রথম জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। টুর্নামেন্টে সর্বাধিক ১২টি গোল তাঁর। অলিম্পিকে স্বর্ণজয়ী ভারতের মো. শহীদ ফরোয়ার্ড হিসেবে নিজেকে দারুণভাবে মেলে ধরেন। তিনি ছিলেন ড্রিবলিংয়ে মাষ্টার। তবে গোল করার চেয়ে গোল করাতে পছন্দ করেন তিনি। তবে সে সময় ভারতের সেরা খেলোয়াড় জাতীয় দলের অধিনায়ক জাফর ইকবাল এ টুর্নামেন্টে অংশ নেন নি।
মো. শহিদ

নাইম
দ্বিতীয় এশিয়া কাপে দলগত অবস্থান : চ্যাম্পিয়ন-পাকিস্তান, রানার্স-আপ ভারত, তৃতীয়-দক্ষিণ কোরিয়া, চতুর্থ-জাপান, পঞ্চম-মালয়েশিয়া, ষষ্ঠ-বাংলাদেশ, সপ্তম-চীন, অষ্টম-শ্রীলঙ্কা, নবম-সিঙ্গাপুর ও দশম-ইরান।
হকি খেলা যাঁরা বুঝতেন না, তাঁরাও দ্বিতীয় এশিয়া কাপ দেখার পর হকির অনুরাগী হয়ে ওঠেন। সারা দেশে সৃষ্টি হয় হকির জাগরণ। এই টুর্নামেন্ট যে মানুষের হৃদয়ে কতটা স্থান করে নেয়, তা এখন আর বোঝানো যাবে না। শহর এলাকায় তো বটেই, গ্রামে-গঞ্জে গাছের ডাল ভেঙে হকি খেলতে দেখা যায়। কিন্তু হকির এই জাগরণ ধরে রাখা সম্ভব হয় নি।
 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

হকি অন্তঃপ্রাণ আলমগীর মোহাম্মদ আদেল/ দুলাল মাহমুদ

‘মৃত্যুগুহা’ থেকেই উজ্জীবনের গান / দুলাল মাহমুদ

অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব

কাছের মানুষ এখন অনেক দূরে

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

নূর আহমেদ : ছিলেন ব্যাডমিন্টনে, ছিলেন ফুটবলেও/ দুলাল মাহমুদ