‘কুড়ি বছর পরে...’


‘জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার’। জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো আমার জীবন থেকেও চলে গেছে আরো কুড়ি বছর। এই দুই দশকে জীবনে অনেক পালাবদল ঘটেছে। বদলেও গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো। এ দিনগুলোর সঙ্গে অনেক বেশি জড়িয়ে আছে আমার সম্পাদনা জীবন। বলা যায়, অধিকাংশ সময়ই খরচ হয়েছে এ কাজেই। আমার কাছে এটিই হয়ে উঠেছে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। মূলত জীবিকার তাগিদেই নিমজ্জিত থাকতে হয় থ্যাঙ্কলেস এ পেশায়। সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করতে করতে কখন যে পেরিয়ে গেছে উজ্জ্বল-উচ্ছ্বল-উত্তাল সেই দিনগুলো। বুঝতেও পারি নি। পেশাগত কারণেই সেই দিনগুলো খুব বেশি উপভোগ করা হয় নি। জীবন ছিল একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকা। এ জীবনে কাশফুল ছিল না। জোনাকি ছিল না। জোছনা ছিল না। ছিল না সুর-সুরা-সংগীত। এমনকি ছিলেন না জীবনানন্দও। নিরামিষ, নিরানন্দ, নিরাতপ জীবনই বলা যায়। শুধু দায়িত্বের শিকলে বাঁধা। আর দায়িত্ব নামক শৃঙ্খল আমাকে পেয়ে বসলে তার থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে নিংড়ে দিয়ে হলেও সেটা প্রতিপালন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করি। সব সময় যে পরিপূর্ণভাবে করতে পারি, সেটা বলা যাবে না। তবে চেষ্টার কমতি থাকে না। সম্পাদনার মতো ‘বিরস’ পেশায় উৎসর্গিত হয়েছে জীবন-যৌবন। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এমন জীবনে কেন আত্মসমর্পণ করা? পেশাগত জীবনটাকে রোমাঞ্চকর করার সুযোগ তো ছিল। আসলে এর সঠিক কোনো উত্তর আমার জানা নেই। তবে নিজেকে যতটা জানি, উচ্চাশা, উচ্চাভিলাষ, উচ্চাকাক্সক্ষা শব্দগুলো আমার সঙ্গে মোটেও যায় না। যায় না বলেই জীবন হয়ে পড়ে স্রোতহীন নদীর মতো। গতিহীন। অনেকটা কচুরিপানার মতো ঢেউয়ের দোলায় দোলায় ভেসে চলেছে গন্তব্যহীন। একটা দৃষ্টান্ত দিলে কিছুটা হলেও অনুধাবন করা যাবে আমার জীবনদর্শন। কোনো অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখলাম, সামনের দিকে বসার তেমন জায়গা নেই। চেষ্টা-তদবির করলেও হয়তো একটা আসন ম্যানেজ করা যায়। তেমন গরজ কোনো কালেই ছিল না। পেছনে কোনোক্রমে বসার সুযোগ করে নেওয়াটাই আমার স্বভাব। একটা সময় অনুষ্ঠানের সামনের সারির আসনগুলো শূন্য হতে থাকে। চাইলে সামনে গিয়ে ভালোভাবে উপভোগ করা যায় অনুষ্ঠান। কিন্তু সেই তাগিদও আমি কখনই অনুভব করি না। কোথাও একবার আসন গেড়ে বসলে সেখান থেকে নড়চড়তে আমার একদমই ইচ্ছে করে না। এমন মনোভাবের কারণে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া হয় না। ইচ্ছে না থাকলে কীভাবে হবে? স্বাভাবিক কারণে যে কাজটি আমার জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে, সেটাকেই আমার নিয়তি ধরে নিয়ে নিজের মন-প্রাণ পুরোপুরি সঁপে দেই। অবশ্য পত্রিকা সম্পাদনাকে তো সৃজনশীল কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন অনেক সৃষ্টিশীল মানুষ। তাঁদের সান্নিধ্যও কম উপভোগ্য নয়। সৃষ্টিশীল এই কাজের আনন্দ-বেদনাই আমার প্রতিদিনের জীবনের অংশ। আসলে কী লিখতে গিয়ে কী লিখছি, নিজেও বুঝতে পারছি না। লেখার শুরুতে যখনই প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ নামটি চলে আসে, তখন কী কারণে যেন একটা আবেগ, একটা নৈরাশ্য, একটা দোলাচল অকারণেই আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। একটি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কত বিচিত্র রকম অভিজ্ঞতা যে হয়, সেটা লিখে শেষ করা যাবে না। কোনোটা তিক্ত। কোনোটা মিষ্ট। তবে সব সময় তো আর সব কথা লেখা যায় না। তাছাড়া স্মৃতি বড্ড প্রতারক। ফেলে আসা দিনগুলোর সবটাই তো আর মনের দেয়ালে আঁকা থাকে না। যেটুকু স্মৃতির পাতায় সঞ্চিত আছে, তার খণ্ড খণ্ড চিত্রই কেবল ভেসে ওঠে মনের পটে।

পেছন ফিরে দেখা
পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় এই তো সেদিন, এক ‘কার্তিকের মাসে’ (১৮ কার্তিক ১৪০৩) যোগ দিয়েছিলাম জাতীয় ক্রীড়া পাক্ষিক ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। তারপরই পাল্টে যায় জীবনের গতিপথ। জীবন হয়ে ওঠে কেবলই ক্রীড়াজগতময়। যদিও সেই কৈশোর থেকে এ পত্রিকার সঙ্গে আমার আত্মিক ও ভালোবাসার সম্পর্ক, তারপরও সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়ে যোগদান করা নিয়ে ভুগছিলাম একরাশ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। এ পত্রিকার সঙ্গে সে সময় যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা ছিলেন আমার একদমই নিকটজন। তাঁদের কথা চিন্তা করে স্বভাবজাত লাজুকতার কারণে মনের মধ্যে মোটেও সায় পাচ্ছিলাম না। তাছাড়া অল্প বয়স থেকে বন্ধনহীন সাংবাদিকতার জগতে এমনভাবে ডুবে ছিলাম যে, কোনো বাঁধা-ধরা চাকরির ফাঁদে নিজেকে আটকানোর ইচ্ছে ছিল না। সংবাদপত্রে চাকরির নিশ্চয়তা না থাকলেও সম্মান, সমাদর ও অর্থনৈতিক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও ছিল ঢের ঢের ব্যবধান। যে কারণে সম্পর্কের দোলাচল আর আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি ছাড়াও সরকারি একটি পত্রিকার দায়িত্ব নেওয়াটাও ছিল বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। মানের অবনতি, অনুজ্জ্বলতা ও পড়তি সার্কুলেশনের কারণে পত্রিকাটি তার অস্তিত্ব নিয়ে কঠিন অবস্থায় পড়ে যায়। আর এ অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন পড়ে পেশাদার একজন কা-ারির। এমন একটা প্রেক্ষাপটে হাল ধরতে হয় আমাকে।

সম্পাদনাই বিধিলিপি
তবে সম্পাদনা জীবনটা বোধ করি আমার বিধিলিপি। এসএসসি পরীক্ষার আগে আগে দেয়াল পত্রিকা সম্পাদনা দিয়ে হাত মকশো করা শুরু হয়। তখন তো সেটাই ছিল এক ধরনের রেওয়াজ। লেখালেখির বিষয়টি যাঁদের মাথায় অল্প বয়সেই ঘুরপাক খায় কিংবা সাহিত্যের পরিম-লে ঢুকতে ইচ্ছে হয়, তাঁদের কাছে এর কোনো বিকল্প ছিল না। এখন তো দেয়াল পত্রিকার চল বলা যায় একদম উঠে গেছে। আশির দশক অব্দি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করাটা ছিল সাহিত্যচর্চার অন্যতম অনুষঙ্গ। তা থেকে কি পিছিয়ে থাকা যায়? কলেজে ওঠার পর একটি সাহিত্য সংকলন ‘আবাহন’ প্রকাশ করতে গিয়ে অম্ল-মধুর বিস্তর অভিজ্ঞতা হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি পত্রিকা প্রকাশের ধকল কতটা, সেটা পলে পলে অনুভব করি। বাংলা একাডেমির বইমেলা উপলক্ষে কত রকম সাহিত্য সংকলন যে প্রকাশিত হতো, তা থেকে টের পাওয়া যেত নবীন, উঠতি ও মেধাবী লেখক ও সাহিত্য সম্পাদকদের তৎপরতায়। সবাই যে লেখক বা সম্পাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন, সেটা বলা যাবে না। তবে তারুণ্য ও যৌবনের সৃজনশীল কাজের বিপুল উচ্ছ্বাস অন্তত অনুধাবন করা যেত। এখন আর লিটল ম্যাগাজিনের কদর নেই বললেই চলে। আর বৃহত্তর পরিসরে ক্রীড়া পত্রিকা ‘হারজিত’ প্রকাশ করতে গিয়ে সম্পাদনার কলকব্জা মোটামুটি আয়ত্তে এসে যায়। নিজেদের অর্থ আর শ্রম বিনিয়োগ করে একটি পত্রিকাকে দাঁড় করানো ও লাভবান করার দীক্ষা বেশ ভালোভাবেই হয়ে যায়। অবশ্য এটি ছিল একদল তরুণের টিমওয়ার্কের ফসল। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো। তখন সবটাই ছিল একটা মিশন। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ক্রীড়া সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেওয়ার একটি মহতী উদ্যোগ। পত্রিকাটি বেশ সাড়াও জাগিয়েছিল। বিষয়বৈচিত্র্যে চমক সৃষ্টি করেছিল। এনেছিল নতুনত্বের স্বাদ। কিন্তু ডিক্লারেশনের মারপ্যাঁচে পড়ে সেটা আর অব্যাহত রাখা যায় নি। এর বাইরে কত কিছুই না সম্পাদনা করতে হয়েছে। পত্র-পত্রিকা, স্মরণিকা, বই-পুস্তক পর্যন্ত। এর ফলে কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ হয়েছে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। এরপর তো দৈনিক পত্রিকায় পেশাগত জীবন শুরু হয় সম্পাদনার টেবিলে। তখন তো পুরো বিশ্ব চলে আসে একটি টেবিলেই। সামাল দিতে হয় কত কত কঠিন পরিস্থিতি। সেটা ম্যানেজ করা কম ঝক্কি ছিল না। এ কাজেও কেটে যায় অনেকগুলো বছর। অবশ্য অন্যত্র চলে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সম্পাদনাই হয়ে ওঠে আমার জীবন-জীবিকা, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না। সম্পাদনায় সম্পাদনায় জীবন কাটলেও অধিকাংশ সময়ই বিষয় ছিল খেলাধুলা। এমনকি দৈনিক পত্রিকার টেবিলে বসেও ভাবতে হয়েছে খেলাধুলা। লিখতে হয়েছে খেলাধুলা বিষয়ে। বিদেশি বড় কোনো ইভেন্ট হলে তো দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে খেলা দেখতে হয়েছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লিখতে হয়েছে রিপোর্ট। আর দেশের মাটিতে বড় কোনো ক্রীড়া আসর বসলে গলায় কার্ড ঝুলিয়ে হতে হয়েছে রিপোর্টার। ফ্রিল্যান্স কিংবা সাংবাদিক হিসেবে যখনই যে দায়িত্ব পালন করেছি, খেলাধুলা থেকে দূরে সরে থাকা হয় নি। বলা যায়- খেলায় খেলায় কেটে যাচ্ছে জীবন।

নিজের সম্পর্কে কিছু বলা
সম্পাদক জীবনের খতিয়ান দিতে গিয়ে নিজের সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া ভালো। যদিও এ ধরনের কথা বলতে আমি অভ্যস্ত নই। আমাকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন নিজের ঢোল নিজে পেটানোতে আমি বিশ্বাসী নই। কিন্তু স্মৃতির পাতা উল্টাতে গিয়ে বাধ্য হয়ে কিছু কথা বলতেই হচ্ছে। এটা অনেকের কাছে হয়তো অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তবুও প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। আমার জীবনে অনেক অপ্রাপ্তি আছে। আছে অনেক না পাওয়া। আমি মানুষটা এমন, চাইলেও সবার আপন হতে পারি না। কারো কোনো ক্ষতির কারণ না হলেও কেন যেন অনেকেই আমাকে অকারণেই দূরে দূরে সরিয়ে রাখেন। সবচেয়ে কষ্টকর, অনেকেই আমাকে খামোখা ভুল বোঝেন। এ ক্ষেত্রে আমার নিশ্চয়ই কিছু দায় আছে। নতুবা কেন এমন হয়? আমার কুষ্ঠি বোধ করি অনেক পেঁচালো। এ কারণে আমার সবকিছুতে পেঁচ খেয়ে যায়। সহজ বিষয়ও কেন জানি কঠিন হয়ে যায়। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমি কখনও জ্ঞানত কারো অমঙ্গল কামনা করি নি। কিন্তু বড় দুঃখ নিয়ে লিখতে হচ্ছে, অধিকাংশ কাছের কিংবা পরিচিতজনরা আমাকে অবহেলা করতে পছন্দ করেন! কেন যে করেন জানি না। নিশ্চয়ই আমার কোথাও কোনো খামতি রয়েছে। বোঝার বা বোঝাপড়ার। অথচ যখন কেউ আমার শরণাপন্ন হন, আমার সাধ্যে কুলালে যতটা পারা যায় সাহায্য-সহযোগিতা করতে কার্পণ্য করি না। আমি পারতপক্ষে ব্যক্তিগত প্রয়োজনেও কারো সহযোগিতা চাইতে পারি না। এটা আমার মজ্জাগত। মজার ব্যাপার, একান্তই কোনো প্রয়োজনে কারো কাছে সহযোগিতা চাইলেও সাধারণত সেটা পাই না। যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, কিছু চাইলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমার প্রত্যাশা কেন যেন পূরণ হয় না। হাত বাড়িয়ে দিলে সইতে হয় প্রত্যাখ্যানের জ্বালা-যন্ত্রণা। আর বড় কিছু চাওয়ার সাহস আমার কখনই হয় না। সবচেয়ে কষ্ট হয়, যখন দেখি শুভাকাক্সক্ষী সেজে কেউ কেউ সামনা-সামনি আমাকে একদম আকাশে তুলে ফেলেন, সেই তাঁরাই আড়ালে-আবডালে আমাকে পাতালে নামিয়ে আনেন। অনেকেই আমার সামনে জলজ্যান্ত মিথ্যে কথার ফুলঝুরি ছোটান, সেটা যে আমি বুঝতে পারছি, সেটুকু বোধগম্যি তাঁদের হয় না। তাঁরা হয়তো আমাকে বোকার হদ্দ মনে করেন। মনে করেন, যা বুঝ দেবেন- সেটাই আমি বুঝে নেব। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমার যেটা মনে হয়, যাঁরা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখেন কিংবা হম্বিতম্বি করতে পারেন, তাঁদেরকে সমীহ করার লোকের সংখ্যাই বেশি। যাঁরা কারো সাতেও নেই, পাঁচেও নেই, হামবড়া ভাব দেখান না, তাঁদের কেউ পাত্তা দেন না। সাম্প্রতিক সময়ের প্রবণতা এটাই। এমনিতেই আমি  ভেতরমুখো স্বভাবের। তারপর নানান তিক্ততার কারণে নিজেকে আমি শামুকের মতো গুটিয়ে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। বর্তমান যুগে এমন মনোভাব নিয়ে জীবনযাপন করা খুবই কঠিন। কোথাও ঠিকমতো অ্যাডজাস্ট করা যায় না। এজন্য যথেষ্ট পস্তাতে হয়। সেটাও আমি মেনে নিয়েছি। তবুও আমি প্রত্যাখ্যান সইতে পারি না। অবহেলা সইতে পারি না। অপমান সইতে পারি না। পারি না বলেই দূরে দূরে থাকি। এমন ধরনের নিরামিষ ও নিরানন্দ মানুষকে কে আর পছন্দ করবে?

অযাচিত পাওয়া
এ তো গেল মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠও আছে। সেটা স্বীকার না করলে নিজের কাছে নিজেই অপরাধী হয়ে থাকবো। কেননা, না চাইতেই আমি অযাচিতভাবে কিছু কিছু মানুষের আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়ে যাই। তাঁদের সংখ্যা হয়তো খুব বেশি নয়। তবে তাঁরা তাঁদের অনুভূতি ও সংবেদনশীলতা দিয়ে ব্যক্তি আমাকে, আমার অনুভূতিকে, আমার মনোভাবকে অনুধাবন করতে পারেন। বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত। এই হাতের স্পর্শ পাই বলে জীবনের মাধুর্যটুকু অনুভব করতে পারি। জীবনকে ভালোবাসতে পারি। জীবন নিয়ে আশাবাদী হতে পারি। আমার এই শুভাকাক্সক্ষীরা আমাকে বুঝতেও দেন না আমি তাঁদের হৃদয়জুড়ে কতটা আছি। এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। সেই আশির দশকে ছাত্র থাকাবস্থায় আমি যখন পেশাগত জীবন শুরু করি, সেই থেকে আজ পর্যন্ত চাকরির জন্য আমাকে কারো কাছে ধন্না দিতে হয় নি। কেউ না কেউ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর কারণ, তাঁরা আমাকে অসম্ভব স্নেহ করেন ও ভালোবাসেন। এই স্নেহ, এই ভালোবাসার প্রতিদান আমি কখনও ফিরিয়ে দিতে পারি নি। আমার পরম শুভাকাক্সক্ষীদের একজন হলেন এক সময়ের মেধাবী ছাত্রনেতা, কৃতী সাংবাদিক ও সুলেখক ওবায়দুল কাদের। বর্তমানে তিনি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সেই শৈশব থেকে তাঁকে চিনতাম একজন জনপ্রিয় ও বাগ্মী ছাত্রনেতা হিসেবে। আমার তারুণ্যে পেশার সূত্রে যখন দৈনিক বাংলার বাণীতে যোগ দেই, তখন তাঁকে পাই একজন সহকর্মী হিসেবে, সহমর্মী হিসেবে, সহযাত্রী হিসেবে। সেই সময় তাঁকে নিবিড়ভাবে দেখা ও জানার সুযোগ হয়। তাঁর মূল্যবান পরামর্শ পেয়ে অনেক উপকৃত হয়েছি। মূলত আমি ছিলাম তাঁর লেখার অসম্ভব অনুরাগী। তাঁর কলমের শব্দের জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাই। তাঁর লেখায় পাওয়া যেত কবিতার ছন্দ। পড়তে শুরু করলে এক টানে শেষ না করে পারা যেত না। তুখোড় বক্তা হিসেবেও তাঁর ছিল সাংঘাতিক ডিমান্ড। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁকে অতিথি হিসেবে নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। তবে তাঁর পছন্দের শহর ছিল চট্টগ্রাম। প্রায়ই সেখানে যেতেন। ফিরে এসে সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতেন। তাতে থাকতো পাহাড়-সমুদ্র-প্রকৃতির নিবিড় বর্ণনা। তাঁর লেখা পড়ে মন চাইতো তখনই ছুটে যাই নৈসর্গিক সৌন্দর্যের শহর বন্দরনগরীতে। তাঁর লেখার কারণেই চট্টগ্রামের প্রতি আমার একটা আলাদা দুর্বলতা গড়ে ওঠে। শুধু আমি কেন, তাঁর লেখা পড়ার জন্য সব বয়সী পাঠকই উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। আর আমি মনে মনে কল্পনা করতাম, তাঁর মতো করে যদি কখনো লিখতে পারতাম। সেটা তো আর সম্ভব নয়। তবে তিনি পত্রিকায় তাঁর কোনো নিউজ করতে চাইলে কেন যেন আমাকেই পছন্দ করতেন। ব্রিটিশ লেখক রবার্ট পেইনের গ্রন্থ অবলম্বনে ১৯৯১ সালে তাঁর প্রথম পুস্তক ‘পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু’ প্রকাশনায় আমার খানিকটা সম্পৃক্ততা ছিল। এ কারণে গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি আমার নামটি স্নেহবশত উল্লেখ করেছিলেন। সেই বয়সে সেটা ছিল আমার জন্য বেশ রোমাঞ্চকর। এমন একজন খ্যাতিমান রাজনীতিক ও সাংবাদিকব্যক্তিত্ব তাঁর গ্রন্থে আমার নাম দিয়েছেন- এটা আমার জন্য কম পাওয়া ছিল না। সব মিলিয়ে তিনি আমার হৃদয়ে দাগ কাটতে সক্ষম হন। আমি দৈনিক বাংলার বাণী ছেড়ে চলে আসার পর তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত হতো না (আমার একটা বাজে স্বভাব, আমি আমার কাছের মানুষদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে পারি না। এ কারণে একটা অবস্থানগত দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়)। কিন্তু আত্মিক যোগাযোগটা বোধ করি রয়েই যায়। সেটা বুঝতে পারি, তিনি যখন ১৯৯৬ সালে যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান, তখন শুরুতেই আমাকে স্মরণ করেন। আমি তাতে দারুণভাবে আপ্লুত হই। সরকারের একজন মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তিনি আমার মতো সাধারণ একজনকে মনে রাখবেন, সেটা আমার কল্পনায়ও ছিল না। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম তিনি আমাকে তাঁর হৃদয়ে কত গভীরভাবে স্থান দিয়েছেন। যদিও তিনি আমাকে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আমন্ত্রণ জানালে আমি নানান কারণে গররাজি ছিলাম। কিন্তু তিনি ছিলেন সংকল্পবদ্ধ। আমাকে যোগাযোগ করার জন্য ঘন ঘন খবর দেওয়া হলেও আমি এড়িয়ে চলতে থাকি। এ কারণে বাসা থেকেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য আমাকে তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু যথারীতি আমি এড়িয়ে যাই। একদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, এমন সময় পূর্বপরিচিত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের লাইব্রেরিয়ান কামরুল আহসান আমার কাছে আসেন এবং আমাকে একটি হলুদ খাম ধরিয়ে দেন। খামটি খুলে দেখতে পাই, ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে আমার অস্থায়ী নিয়োগপত্র। আমি সেটি নিয়ে আড্ডায় ফিরে আসি। সে সময় আড্ডার টেবিলে ছিলেন দৈনিক সংবাদের শিফট-ইনচার্জ শাহ আলমগীর (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক), বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ‍ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-এর সাবেক মহাসচিব আখতার আহমেদ খান (ওয়াশিংটনে প্রেস মিনিস্টার থাকাবস্থায় ইন্তেকাল করেন) প্রমুখ। আমার ঘনিষ্ঠ শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে তাঁরাও অন্যতম। তাঁদের হাতে খামটি ধরিয়ে দিলে তাঁরা সেটি দেখার পর আমাকে বললেন, কাদের ভাই (তাঁদেরও এক সময়ের সহকর্র্মী) এভাবে তোমাকে চাইছেন, তোমার অবশ্যই যোগদান করা উচিত। তাঁদের কথায় আমি নিমরাজি হই। দু’দিন পর ২ নভেম্বর (১৯৯৬) ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে যোগ দেই। শুরু হয় সম্পাদক জীবনের নতুন ইনিংস। ফিরে দেখা যাক টুকরো টুকরো সেই জীবনের জলছবি।

আগে তো দেখনদারি
‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় যোগ দেওয়ার পর আমার কাছে মনে হয়েছে, ‘আগে তো দেখনদারি, তারপর না গুণবিচারি’ নীতিতে এগিয়ে যেতে হবে। একটি খেলার পত্রিকার ক্ষেত্রে এটি অনেক বেশি প্রযোজ্য। কভার পৃষ্ঠা যদি আকৃষ্ট করতে না পারে, তাহলে পুরো পত্রিকা কীভাবে নজর কাড়বে? কভার পৃষ্ঠাকে আকর্ষণীয় করার দিকে মনোযোগ দেই। কিছুদিন পর লেখক ও ডিজাইনার পঙ্কজ পাঠককে কভারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথম সংখ্যায় (২০ বর্ষ ৯ সংখ্যা) ফুটবলার হাসান-আল-মামুনকে দিয়ে কভার করা হয়। তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন বর্তমানে জাপানে কমার্শিয়াল কাউন্সিলর প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা (উপসচিব) হাসান আরিফ। মেধাবী এই লেখক দীর্ঘ সময় লিখলেও এখন প্রকৃত অর্থেই দূরে সরে গেছেন।

যত মত তত পথ
দায়িত্ব নেওয়ার পর অনুসরণ করা হয় ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসের উক্তি, ‘যত মত তত পথ’ নীতি। আমার মনে হয়েছে, একটি পত্রিকায় যত লেখক থাকবে, সেই পত্রিকা তত বেশি বৈচিত্র্যময় হবে। ততই উজ্জ্বলতা ছড়াবে। এ কারণে বিভিন্ন মত ও পথের লেখককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এছাড়া অনেকেই নিজ থেকে লিখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ পত্রিকায় কেউ লিখতে চাইলে তাঁকে সব সময় স্বাগত জানানো হয়ে থাকে। এ যাবত ক্রীড়াজগতে লিখেছেন- এমন লেখকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। প্রতিনিয়তই লিখছেন নতুন নতুন লেখক। অনেকেই জীবনের প্রথম লেখাটি লিখেছেন ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায়। প্রখ্যাত সাংবাদিক এ বি এম মূসা তাঁর বর্ণাঢ্য ক্রীড়াজীবন নিয়ে লিখেছেন একমাত্র এ পত্রিকাতেই। এ লেখাগুলো এ দেশের ক্রীড়া ইতিহাসের অমূল্য দলিল হয়ে আছে। এর বেশ কয়েকটি লেখাই তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘আমার বেলা যে যায়’-এ স্থান পেয়েছে।

আমার অ্যালার্জি
পত্রিকা নির্ধারিত সময় প্রকাশ করাটা আমার এক ধরনের অ্যালার্জি বলা যেতে পারে। সময়মতো পত্রিকা প্রকাশ না হলে আমি একদমই স্বস্তি পাই না। পাঠকরা নির্ধারিত দিনে পত্রিকার জন্য অপেক্ষা করেন। ঢাকার বাইরের পাঠকরা অনেক দূরের স্টলে গিয়ে যখন নির্ধারিত দিনে পত্রিকা সংগ্রহ করতে পারেন না, তখন তাঁদের হতাশাটুকু অনুভব করা যায়। এছাড়া যে তারিখে পত্রিকা প্রকাশ করতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ, সেই তারিখ খেলাপ করাটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। অবশ্য বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এটি হেরফের হয়ে যায়। মনে পড়ে, ডেডলাইন অনুযায়ী পত্রিকা প্রকাশ করার জন্য অফিসে রাতযাপনও করেছিলাম। ছুটির দিনও নিয়মিত অফিস করতাম। তবুও পত্রিকা প্রকাশের সময় হেরফের হতে দিতে চাইতাম না। আমার কাছে মনে হয়, যতই বাহারি পত্রিকা করা হোক না কেন, নির্ধারিত সময়ে প্রকাশ করা না হলে তার কোনো গুরুত্ব থাকে না।

মামলার আসামি
‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে মামলার আসামিও হতে হয়েছে। পত্রিকায় যোগ দেওয়ার মাস দেড়েক পর জীবনে প্রথম এ অভিজ্ঞতা হয়। ২০ বর্ষ ১১ সংখ্যায় কুষ্টিয়া থেকে শাহ আরিফ নিসির (বর্তমানে এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার)-এর পাঠানো প্রতিবেদন ‘কুষ্টিয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থায় অচলাবস্থা’ প্রকাশিত হয়। এ রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পর কুষ্টিয়ায় মামলা করেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশিদ। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে আমার বিরুদ্ধেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। যে কোনো অবস্থায় গ্রেফতার হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তদানীন্তন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব ও পুলিশের সাবেক আইজি এএসএম শাহজাহানের হস্তক্ষেপে রক্ষা পাই। পরে অবশ্য আব্দুর রশিদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

ক্ষণে আসা ক্ষণে যাওয়া
১৯৯৮ সালে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় যুক্ত হয় ডায়াল-আপ ইন্টারনেট লাইন। গ্রামীণ ফোনের সেই লাইনটি সংযোগ দিতে হতো টিঅ্যান্ডটি ফোনের মাধ্যমে। সে সময়ে কী যে দুঃসহ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে, সেটা এখন মোটেও অনুভব করা যাবে না। সহজে লাইন মিলতো না। লাইন ক্ষণে ক্ষণে আসে। ক্ষণে ক্ষণে চলে যায়। লাইন মিললেও কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই কাটআপ হয়ে যেত। ফের অপেক্ষা। এভাবে তথ্য ও ছবি পাওয়ার জন্য দিনের ১৪-১৫ ঘণ্টা ব্যয় হতো। তারপরও হতোদ্যম হতাম না। অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে বসে থাকতাম। পত্রিকাটিকে সাজাতে গিয়ে কত গুরুত্বপূর্ণ সময় যে অপচয় করেছি!      

আইসিসি সংলাপ
ওয়েস্ট ইন্ডিজের খ্যাতিমান ক্রিকেটার গর্ডন গ্রিনিজ আর আমার একইসঙ্গে অভিষেক হয়। গ্রিনিজের বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচ আর আমার ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। আমার লেখা প্রথম সম্পাদকীয় ছিল ‘গ্রিনিজের কাছে প্রত্যাশা’। বাংলাদেশের ক্রিকেটের পালাবদলে গ্রিনিজ এবং ‘ক্রীড়াজগত’ গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী ভূমিকা রাখে। ২০ বর্ষ ১৫ সংখ্যায় (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭) ‘ক্রীড়াজগত’ আয়োজন করে ‘আইসিসি সংলাপ’। বোর্ড সভাপতির কক্ষে এ সংলাপে অংশ নেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী, সাবেক অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, জাতীয় দলের অধিনায়ক আকরাম খান। কোচ গর্ডন গ্রিনিজ ও সহ-অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল সংলাপে যোগ দিতে না পারলেও আলাদাভাবে সাক্ষাতকার দেন। আইসিসি ট্রফিকে সামনে রেখে এই সংলাপটি ক্রিকেটের এগিয়ে যাওয়ার পথে দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে।

বিশ্বকাপ ক্রিকেটের স্বপ্ন
১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি উপলক্ষে বিশেষ একটি সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। এজন্য ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার একটি টিম বিকেএসপিতে অবস্থানরত বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে মিলিত হয়। পত্রিকার কভারের জন্য মডেল হয় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। কোচ, ম্যানেজার, অধিনায়ক, সহ-অধিনায়কসহ পুরো দল দীর্ঘ সময় দেয় ‘ক্রীড়াজগত’ টিমকে। একটি পত্রিকার জন্য এভাবে পুরো জাতীয় দলকে পাওয়া ছিল অনেক বড় ব্যাপার। এখন তো এটি কল্পনাও করা যায় না। কভারস্টোরি ছিল ‘বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ’। এ স্বপ্নে পুরো দেশকে সংক্রমিত করতে সক্ষম হয় ‘ক্রীড়াজগত’। এ স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত সত্য হয়েছিল। ৬৪ পৃষ্ঠার এ সংখ্যাটি ছিল সব দিক দিয়েই মারমার কাটকাট।

আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন
১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনালেই স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। তারপরও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে সমগ্র দেশবাসী। ১২ এপ্রিল কেনিয়ার বিপক্ষে ফাইনাল। বৃষ্টিবিঘ্নিত ঘটনাবহুল এ ম্যাচে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে শেষ বলে জয়ী হয় বাংলাদেশ। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে বাংলাদেশ। চারপাশ রঙে রঙে রঙিন। অথচ তার পরদিন ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার পেস্টিং অর্থাৎ নির্ধারিত ডেটলাইন অনুযায়ী পত্রিকা বের করতে হলে সেদিনই কাজ শেষ করতে হবে। আইসিসি ট্রফির লেখা না ধরিয়ে পত্রিকা বের করি কীভাবে? টেনশনে পড়ে যাই। সেই টেনশন আনন্দময় হতে বেশি সময় লাগে নি। কিছুক্ষণ পর সারা শরীরে রঙ মেখে উজ্জ্বল-উচ্ছল লেখকরা (১২ এপ্রিল) ‘ক্রীড়াজগত’ অফিসে উপস্থিত হন। মনের আনন্দে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একই সঙ্গে সবাই লিখতে বসে যান। তাতে ছিল আবেগ, উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসা। ৬৪ পৃষ্ঠার পত্রিকার অধিকাংশ লেখাই সেদিন তাৎক্ষণিকভাবে লেখা হয়ে যায়। নির্ধারিত দিনে প্রকাশ হলে পত্রিকাটি হয়ে ওঠে হটকেক।

নতুন লক্ষ্যে ক্রিকেট
১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় ক্রিকেট সংলাপ। তাতে অংশ নেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী, ডিরেক্টর অব কোচিং গর্ডন গ্রিনিজ, ম্যানেজার গাজী আশরাফ হোসেন লিপু, বিসিবি সহ-সভাপতি সৈয়দ আশরাফুল হক। সাবের হোসেন চৌধুরীর পরিবাগের বাসায় আয়োজিত এ সংলাপে উঠে এসেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন পথের সন্ধান। বাংলাদেশের ক্রিকেটের এগিয়ে নেওয়ার জন্য যখনই যেটা প্রয়োজন পড়েছে, সেই ধারা অনুসারে উদ্যোগ নিয়েছে ‘ক্রীড়াজগত’।

ছবি বিক্রি করে লাখপতি
১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি উপলক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় দলকে মডেল বানিয়ে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকা যে ছবি ছাপিয়েছিল, সেই ছবি বিক্রি করে লাখপতি বনে গিয়েছিল অন্যরা। যে স্টুডিওতে ছবির নেগেটিভ ওয়াশ করা হয়, বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তারা ‘ক্রীড়াজগত’ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে ছবিটি অন্যত্র চড়া দামে বিক্রি করে দেয়। সেই ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে লাখ লাখ টাকা আয় করা হয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে যেদিন মানিক মিঞা এভিনিউতে সংবর্ধনা দেওয়া হয়, সেদিন এই পোস্টার ধুমছে বিক্রি হয়। কিন্তু লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হয় ‘ক্রীড়জগত’।

চাঞ্চল্যকর দলবদল
একটা সময় ঢাকার ফুটবলের দলবদল ক্রীড়াঙ্গন দারুণভাবে জমিয়ে রাখতো। ১৯৯৭ সালের ফুটবলের দলবদল ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। সেই সময়ের দুই জনপ্রিয় ক্লাব মোহামেডান স্পোর্টিং ও আবাহনী লিমিটেডের তারকা ফুটবলারদের ভাগিয়ে নিয়ে শক্তিশালী দল গঠন করে আলোড়ন তোলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র। জুয়েল রানা, রকিবসহ বেশ কয়েকজন তারকা ফুটবলারকে গোপন একটি জায়গায় রাখা হয়। সেটা কারো জানা ছিল না। একমাত্র ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় তাঁদের ছবি ও সাক্ষাৎকার নিয়ে কভারস্টোরি করা হয়। কোনো দৈনিক পত্রিকাও সেই রিপোর্ট করতে পারে নি।

পৃষ্ঠা যখন থেকে ৬৪
১৯৭৭ সালের ২০ জুলাই ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার শুরু থেকেই ছিল ৪৮ পৃষ্ঠা। কালেভদ্রে দু’একটি সংখ্যার পৃষ্ঠাসংখ্যা বেড়েছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর তাতে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছিল না। তাছাড়া ক্রীড়াঙ্গন হয়ে ওঠে অনেক বেশি জমজমাট। এ কারণে প্রায়ই ৬৪ কিংবা তারচেয়ে বেশি পৃষ্ঠা নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করতে হচ্ছিল। শেষ অব্দি ১৯৯৮ সালের ১৬ জুন থেকে নিয়মিতভাবে পত্রিকার পৃষ্ঠা করা হয় ৬৪। সেই ধারা আজও চলছে।

সেরা খেলোয়াড়, সেরা লেখক
পাঠকের ভোটে সেরা খেলোয়াড় ও সেরা ক্রীড়া লেখক নির্বাচন করে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ‘ক্রীড়াজগত’। পত্রিকায় এ সংক্রান্ত কুপন বেশ কিছুদিন ছাপা হওয়ার পর সর্বাধিক পাঠকের ভোটে ক্রিকেটার আকরাম খান ১৯৯৭ সালের সেরা ক্রীড়াবিদ এবং মাহমুদুল হাসান শামীম (বর্তমানে দেশ টিভির বার্তা সম্পাদক) সেরা ক্রীড়ালেখক নির্বাচিত হন। উভয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০ হাজার টাকা করে পুরস্কৃত করা হয়। এছাড়া লটারির মাধ্যমে দুই গ্রুপের ৬ জন পাঠককে অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়। পরিকল্পনা ছিল প্রতি বছর এই পুরস্কার দেওয়ার। তবে সিদ্ধান্ত ছিল ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার যাঁরা স্থায়ীভাবে কর্মরত, তাঁরা এবং একবার কোনো লেখক পুরস্কৃত হলে পরের বছর তিনি বিবেচিত হবেন না। এতদিন এটা অব্যাহত থাকলে ২০ জন ক্রীড়ালেখক পুরস্কৃত হতেন। সব ক্ষেত্রেই পুরস্কার দেওয়ার রেওয়াজ থাকলেও ক্রীড়ালেখকদের পুরস্কার দেওয়া হয় না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এ পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রথমবারই একজন লেখক নির্বাচিত হতে না পারায় তিনি এ আয়োজনটি নানান কৌশলে ল-ভ- করে দেন। যে কারণে এ পুরস্কার আর আয়োজন করা যায় নি।  

বিশেষ আকর্ষণ বিশেষ সংখ্যা
‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাগুলো দারুণভাবে সাড়া জাগিয়েছে। খেলাধুলার যে কোনো বড় আয়োজনে কিংবা খেলাধুলার খুব বেশি চাপ থাকলেই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করতে দ্বিধা করা হয় নি। তবে বিশ্বকাপ নিয়ে যে বিশেষ সংখ্যাগুলো প্রকাশ করা হয়েছে, সে সংখ্যাগুলো এখনও অনেক পাঠকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৯৮ সালের ফ্রান্স বিশ্বকাপ উপলক্ষে প্রকাশ করা হয় ১৬০ পৃষ্ঠার বিশেষ সংখ্যা। সংখ্যাটি প্রকাশ করতে দিন-রাত অপরিসীম খাটতে হয়। প্রতি পৃষ্ঠায় ছিল লাইফবয়ের বিজ্ঞাপন। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি ছিল নতুন একটি ধারণা। ১৯৯৮ সালে উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ উপলক্ষে ১২৮ পৃষ্ঠা, ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ১৬০ পৃষ্ঠা, ২০০০ সালের অলিম্পিক সংখ্যা ১২৮ পৃষ্ঠা, বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট সংখ্যা ১২৮ পৃষ্ঠা, ২০০২ সালে বাংলাদেশ গেমস সংখ্যা ১২৮ পৃষ্ঠা, ২০০২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল সংখ্যা ২০০ পৃষ্ঠা, ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট সংখ্যা ২২০ পৃষ্ঠা, ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল সংখ্যা ১২৮ পৃষ্ঠা, ২০১০ সালে এসএ গেমস উপলক্ষে ৩টি সংখ্যা, প্রকাশ করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা ৮০ পৃষ্ঠা করে এবং তৃতীয়টি সাদা কাগজে ১২৮ পৃষ্ঠা। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট উপলক্ষে ৫টি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ৪টি সংখ্যা সাদা কাগজে। তিনটি সংখ্যা যথাক্রমে ১০০, ৮০ ও ৯৬ পৃষ্ঠা। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল সংখ্যা ২৪৮ পৃষ্ঠা ও ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট সংখ্যা ১২৮ পৃষ্ঠা বের করা হয়। তবে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর শুরু থেকেই যখনই যা যা করতে চেয়েছি, সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তদানীন্তন সচিব এএসএম আলী কবীর (সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ও বর্তমানে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের সভাপতি)। তাঁর কারণে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়েছে। সৃজনশীল কাজের জন্য তাঁর দুুয়ার ছিল সব সময় খোলা। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে।

কত যে পোস্টার
‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় কত যে পোস্টার প্রকাশিত হয়েছে, যা ছিল অন্যতম এক আকর্ষণ। আর্ট পেপারে চার রঙের খেলোয়াড়দের সেই পোস্টার দিয়ে অনেকেই বাড়িয়েছেন ঘরের সৌন্দর্য। শোভা বৃদ্ধি করেছে স্টেডিয়ামের গ্যালারির। পোস্টার ছাড়াও প্রায়ই থাকতো রঙিন সব পৃষ্ঠা।

পাঠকদের সম্পৃক্ততা
শুরু থেকেই ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকা পাঠকদের সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। চালু করা হয় ‘কুইজমালা’, ‘শব্দজট’, ‘মাঠে-ময়দানে’, ‘এ ছবি কার’ বিভাগ। প্রতিটি বিভাগের পাশাপাশি সেরা চিঠি লেখার জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়। এছাড়াও চালু করা হয় ‘সরাসরি’, ‘খোঁজ-খবর’, ‘কৌতুকমালা’, ‘ক্রীড়ানন্দ’, ‘মুখোমুখি’ ইত্যাদি বিভাগ। ভিন্নধর্মী এ বিভাগগুলো বিপুলভাবে লুফে নেন পাঠকরা। অনেক লেখক ও পাঠকই তাঁদের জীবনের প্রথম আয় করেছেন কিংবা সম্মানী নিয়েছেন ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার মাধ্যমে। এ সংখ্যা নেহাত কম হবে না।

ক্রিকেট ক্লাস
‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার অন্যতম একটি আকর্ষণ ছিল ‘প্রশ্নোত্তর’ বিভাগ। এ বিভাগে পাঠকরা ক্রীড়াবিষয়ক যেসব প্রশ্ন পাঠাতেন, তার উত্তর দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি জেগে ওঠা ক্রিকেটকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়ার জন্য চালু করা হয় ‘ক্রিকেট ক্লাস’। এটি চালু করার পর ক্রিকেট সংক্রান্ত প্রশ্নের ঢল নামে। টের পাওয়া যায় ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা। শুরু থেকে এ বিভাগেরও দায়িত্বে ছিলেন সব্যসাচী ক্রীড়াব্যক্তিত্ব আতাউল হক মল্লিক। সড়ক দুর্ঘটনায় অসময়ে চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন।

ইতিহাসের উপাদান
এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের আর্কাইভ বলা যেতে পারে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকাকে। যে কোনো তথ্য ও ছবির জন্য এ পত্রিকার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে শামীম চৌধুরীর ‘স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের ফুটবল’, ইকরামউজ্জমানের ‘শতাব্দীর বাঙালির ক্রীড়াঙ্গন’, জাকারিয়া পিন্টুর ‘খেলার মাঠে স্বাধীনতা সংগ্রাম’, অরুন নন্দীর ‘আমার সাঁতার জীবন’, বশীর আহমেদের ‘সোনালি অতীতের দিনগুলো’, রণজিৎ দাসের ‘ক্রীড়াঙ্গনের ফেলে আসা দিনগুলো’ ক্রীড়া ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।

মাঠ-গ্যালারি-স্টেডিয়াম
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম স্তম্ভ বলা যেতে পারে মুহাম্মদ কামরুজ্জামানকে। এক সময় শীর্ষ পর্যায়ে খেলেছেন, দীর্ঘদিন ক্রীড়া সাংবাদিকতা করেছেন, এখনও দু’হাতে সমানতালে লিখছেন। ১৯৯৭ সালের ১ নভেম্বর থেকে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন ক্রীড়াবিষয়ক স্মৃতিচারণমূলক কলাম ‘মাঠ-গ্যালারি-স্টেডিয়াম’। গত ১৯ বছর একটানা তিনি লিখে আসছেন। এমন কৃতিত্ব আর কারো আছে কিনা আমার জানা নেই। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাস নিয়ে কেউ কোনো গবেষণা করতে চাইলে এই কলামটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সার্বক্ষণিকের সঙ্গী কম্পিউটার
১৯৮৮ সালে দৈনিক আজাদে কাজ করার সময় পরিচয় হয় কম্পিউটার প্রযুক্তির সঙ্গে। তবে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় যোগ দেওয়ার পর হাতের নাগালে আসে কম্পিউটার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় হতো ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিনে। কিন্তু কম্পোজ করার ব্যাপারে কখনো আগ্রহী হয়ে উঠি নি। ২০০৭ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে সচিব হিসেবে যোগ দেওয়া আমিনুল ইসলাম খান (বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব) কম্পোজ শেখার জন্য মধুর নির্দেশনা দিলে তিন দিনের মধ্যে তা মোটামুটি রপ্ত করে ফেলি। এর ফলে কতটা যে উপকৃত হয়েছি, সেটা বোঝানো যাবে না। এখন তো কলম দিয়ে কিছু লিখতেই পারি না! এমনকি ব্যাংকের চেক সই করতে গেলেও হাত কাঁপে।      

বিদেশের মাটিতে খেলা কাভার না করা
জাতীয় একটি ক্রীড়া পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দু’দশক দায়িত্ব পালন করে বোধ করি একটি মাইলফলক গড়ে ফেলেছি। আর কেউ এর ভাগিদার আছেন কিনা আমার অন্তত জানা নেই। এ সময়কালে কোনো বিরতি ছাড়াই প্রকাশিত হয়েছে কমপক্ষে ৪৮০টি সংখ্যা। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও একটি সংখ্যা প্রকাশ করা থেকেও বিরত থাকা হয় নি। বরং প্রকাশ করা হয়েছে অতিরিক্ত সংখ্যা। এছাড়াও আছে আর একটি ব্যতিক্রমধর্মী রেকর্ড। একটি ক্রীড়া পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে বিদেশের মাটিতে কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কাভার করার সুযোগ হয় নি।

নিধিরাম সর্দার!
এমনিতে একটি পত্রিকার সম্পাদকের পদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিকভাবে এ পদের একটা ভারিক্কি হয়তো আছে। এ কারণে একটি জাতীয় ক্রীড়া পত্রিকার সম্পাদককে অনেকে বোধ করি মনে করেন ক্রীড়াঙ্গনের দ-মু-ের হর্তাকর্তা। চাইলেই ক্রীড়াবিষয়ক যে কোনো ব্যাপারে সমস্যার সমাধান কিংবা খেলার পাস ম্যানেজ করতে পারেন। প্রায়ই কাছের ও দূরের অনেকেই খেলা দেখার কার্ড দেওয়ার আবদার করেন। বাস্তবতা যে অনেক দূরে, সেটা অনেকেই বুঝতে চান না। সেক্ষেত্রে বিব্রত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। খেলা দেখার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি, অন্যরা যাতে আমার অবস্থান বুঝতে পারেন। আমার স্কুলপড়–য়া ছোট ছেলেকে ক্রিকেট-অ্যাডিক্ট বলা যেতে পারে। অথচ দীর্ঘদিন ক্রীড়া সাংবাদিকতা করেও আমি তাকে খেলা দেখার সুযোগ করে দিতে পারি নি। একবার মিরপুরের শের-এ-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সবচেয়ে কম মূল্যের পূর্ব গ্যালারির টিকিট ম্যানেজ করা সম্ভব হয়। দুই পুত্রকে নিয়ে রোদের তাপদাহে পুড়ে পুড়ে খেলা দেখার যে কঠিন অভিজ্ঞতা হয়, এরপর ওদের নিয়ে আর স্টেডিয়ামমুখো হই নি। সুযোগও পাওয়াও যায় নি। দেশের মাটিতে বড় কোনো ক্রীড়া আসর বসলে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকার সম্পাদককে আমন্ত্রণ জানানো দূরে থাক, এ পত্রিকাকে কার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক বেশি কার্পণ্য লক্ষ্য করা যায়। অথচ কাভারেজ দেওয়ার দিক দিয়ে ‘ক্রীড়াজগত’ মোটেও পিছিয়ে নেই। বরং দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছে এই ক্রীড়া পাক্ষিকটি। এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ পত্রিকাটির ভূমিকার কথা ক্রীড়ামোদীরা কম-বেশি অবহিত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেন জানি তার কোনো মূল্যায়ন হয় না। আসলে ‘ক্রীড়াজগত’-এর ‘সম্পাদক’ পদটি অনেকটাই নিধিরাম সর্দারের মতো! ‘ক্রীড়াজগত’-এ লেখালেখি, ক্রীড়াসংক্রান্ত সাক্ষাৎকার, আলোচনা, তথ্য সংগ্রহ ও অন্যান্য প্রয়োজনে স্বনামধন্য প্রাক্তন বা বর্তমান সময়ের অনেক কৃতী খেলোয়াড়, ক্রীড়া সংগঠক, সাংবাদিক, ক্রীড়ালেখকরা ‘ক্রীড়াজগত’ কার্যালয়ে আসেন। তাঁরা আসেন আত্মার টানে। এমনকি আসেন স্রেফ আড্ডা দিতে। এছাড়াও যোগাযোগ হয় সার্কুলেশন ও বিজ্ঞাপন প্রদান সংক্রান্ত বিষয়েও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। কিন্তু তাঁদের কাউকেই অফিসিয়ালি এক কাপ চা পরিবেশনের নিয়ম নেই। এমনকি সুযোগ নেই কাউকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার।  

সাদা কাগজ
ভেতরের পৃষ্ঠা সাদা কাগজে অকেশনালি ছাপা হয়েছে ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকা। কিন্তু ৪০ বছরে পা দিয়ে নিউজপ্রিন্ট থেকে স্থায়ীভাবে সাদা কাগজে রূপান্তরিত হয়েছে। এর ফলে পূরণ হয়েছে পাঠকদের দীর্ঘদিনের একটি চাহিদা। আর এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যান ড. শ্রী বীরেন শিকদার এবং পরিষদের সচিব অশোক কুমার বিশ্বাস।                

তথ্যের ভাঁড়ার
এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের তথ্যের ভা-ার হয়ে উঠেছে ‘ক্রীড়াজগত’। ক্রীড়াবিষয়ক যে কোনো তথ্য নিয়ে সংশয় কিংবা কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলেই সবাই কম-বেশি শরণাপন্ন হন এ পত্রিকার। এ কারণে অনেকটা সময় ব্যয় করতে হয় এ কাজে। যে কারো অনুরোধ বা আবদার রক্ষা করতে হলে পুরনো পত্রিকা ঘেঁটে তথ্য বের করা কম সময়সাপেক্ষ নয়। একইসঙ্গে ঝামেলাপূর্ণও। তারপরও তথ্য সরবরাহ করাটা হয়ে উঠেছে সম্পাদক জীবনের একটি অংশ।

বুক দিয়ে আগলানো
‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তথা দেশের একটি সম্পদ। অনেকে এর মর্ম বুঝতে পারেন। আবার অনেকেই পারেন না। কেউ বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার হাত, আর কেউ কেউ করেন অসহযোগিতা। এ পত্রিকা টিকিয়ে রাখার জন্য কতভাবেই না দেনদরবার করতে হয়। ওয়ান-ইলেভেনের সময় মুখোমুখি হতে হয় মস্ত চ্যালেঞ্জের। শেষ পর্যন্ত সেই চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়া সম্ভব হয়। তাছাড়া পত্রিকা প্রকাশনার জন্য কত তুচ্ছ কারণেও অনেক সময় ও মেধা ব্যয় করতে হয়। এ কারণে অনেক সময় হতাশাও সৃষ্টি হয়। মনে হয়, এ পত্রিকাটির প্রকাশনা নিয়মিতভাবে অব্যাহত রাখার কী দায় পড়েছে? কিন্তু পত্রিকাটির প্রতি তীব্র ভালোবাসার কারণে কখনো হাল ছেড়ে দেওয়া হয় নি। পত্রিকা প্রকাশনায় কখনো ব্যাহত হতে দেওয়া হয় নি। দেশের অমূল্য এই সম্পদকে বুক দিয়ে আগলে রেখে চলেছে ‘ক্রীড়াজগত’ পরিবার।

বোঝে না সে বোঝে না...
সৃজনশীল কাজের যন্ত্রণা কাউকে বোঝানো যায় না। একটি লেখা বা ছবি সবার মনমতো হবে না। হয়ও না। একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। একই কাজ একাধিকজন করলে কখনই একই রকম হবে না। হতে পারেও না। অবশ্যই তারতম্য ঘটবে। সেটা অবশ্য হয় মেধা ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। তবে যে কোনো কিছুরই ভিন্ন মতামত থাকতেই পারে। অন্যরকম মন্তব্য আসতে পারে। তা থেকে শুধরে নেওয়ার সুযোগ থাকে। সেটাকে তো আর অস্বীকার করা যাবে না। তবে কেউ যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে চান, সেটা আলাদা ব্যাপার। জোর করে কাউকে বোঝানো যাবে না। খুশিও করা যাবে না। তখন কেবল অরজিৎ সিং-এর গানের মতো গাইতে ইচ্ছে করে- ‘বোঝে না সে বোঝে না...’

পাঠকের ‘ক্রীড়াজগত’
একটি কথা প্রচলিত আছে যে, প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে (যেখানে আরোপ করা হয় প্রতিবন্ধকতা) সৃজনশীলতা যায় না। কথাটা একদম উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে সৃজনশীল কাজে উৎকর্ষ অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম হতে পেরেছে ‘ক্রীড়াজগত’। সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত হলেও ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকা পাঠকের সমাদর পেয়েছে। এর কারণ, এ পত্রিকাটি বরাবরই চেষ্টা করেছে পাঠকের কথা বলতে। পাঠকের অভিমতকে গুরুত্ব দিতে। পাঠকের সঙ্গে চলতে। পাঠকরা সাধারণত নগদ টাকা দিয়ে ‘বুলেটিন’ কিনতে আগ্রহী হন না, তাঁরা চান পছন্দসই পত্রিকা কিনতে। একদম গোড়ার দিকেই পত্রিকা প্রকাশের নীতিমালার ক্ষেত্রেও ছিল বেশ শিথিলতা। এটি যাতে অন্য সব পত্রিকার মতো বাজারজাত হয়, পাঠকপ্রিয়তা পায়- সেজন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই ঐতিহ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে পত্রিকাটি। অবশ্য সব সময় যে প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পত্রিকাটি এগিয়ে যেতে পেরেছে, সেটা বলা হবে সত্যের অপলাপ। অনেক কঠিন সময়ও পেরিয়ে আসতে হয়েছে। তবে আশার কথা, সঙ্গে আছেন পাঠকরা। তাঁদের ভালোবাসাই এ পত্রিকাটি এগিয়ে চলার অন্যতম পাথেয়।        
 
শেষ কথা
এখন তো ইন্টারনেট চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে প্রিন্ট মিডিয়াকে। চোখের পলকে হাতের মুঠোয় যে কোনো তথ্য পাওয়া যায়। পত্র-পত্রিকার টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকা যে দায়িত্ব পালন করে আসছে, তার বিকল্প গড়ে ওঠেনি। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস, ঐতিহ্য যেভাবে এ পত্রিকায় তুলে ধরা হয় এবং সমকালীন ক্রীড়াঙ্গনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যেভাবে করা হয়, তা আর কোথাও পাওয়া যায় না। ক্রীড়া সংক্রান্ত জাতীয় যে কোনো প্রয়োজনে এ পত্রিকাটি হয়ে উঠেছে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। হয়ে উঠেছে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের একটি অংশীদার। আগামী জুলাইয়ে পূর্ণ হবে পত্রিকাটির ৪০ বছর। ‘ক্রীড়াজগত’-এর গত জন্মদিনে পত্রিকার চার দশক পূর্তি অনুষ্ঠানটি জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজনের আশ্বাস দিয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব অশোক কুমার বিশ্বাস। পত্রিকাটি যেন নতুন নতুন প্রজন্মের কাছে সমাদৃত হয়, সেই লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। অবশ্য চলার পথে আছে নানান সীমাবদ্ধতা। আছে নানান যন্ত্রণা। এটাকে অস্বীকার করা যাবে না। এ কারণে সম্পাদক হিসেবে অর্জিত হয়েছে অম্ল-মধুর অনেক অভিজ্ঞতা। তারপরও একটি ক্রীড়া ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে ২০ বছর পেরিয়ে আসার পর এক ধরনের আনন্দ ও গর্ব অনুভব তো করাই যায়। তাই না?

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

অন্তরঙ্গ আলাপনে উনিশ ব্যক্তিত্ব

হকি অন্তঃপ্রাণ আলমগীর মোহাম্মদ আদেল/ দুলাল মাহমুদ

‘মৃত্যুগুহা’ থেকেই উজ্জীবনের গান / দুলাল মাহমুদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

কাছের মানুষ এখন অনেক দূরে

আপন ভুবনের রাজা কাজী কামাল/ দুলাল মাহমুদ

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

হকির পরিচিত মুখ শামসুল বারী/ দুলাল মাহমুদ