পাকিস্তানের মাটিতে উড়লো গৌরবের জাতীয় পতাকা / দুলাল মাহমুদ

কিংবদন্তি সাঁতারু ব্রজেন দাসের চোখে জল! একইসঙ্গে সুইমিং পুলে উপস্থিত সব বাঙালির চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে আনন্দাশ্রু। কারও পক্ষে নিজেকে সামলিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। বুকের উপর চেপে বসা ভারী পাথরটা নিমিষেই নেমে যাওয়ার স্বস্তি। চোখের সামনে থেকে সরে গেছে অস্বস্তি, উৎকণ্ঠা আর অসন্মানের কালো চাদর। মুক্তি মিলেছে ব্যর্থতার গ্লানি থেকে। অপমানের যন্ত্রণা থেকে। শেষ পর্যন্ত বাজছে আমাদের জাতীয় সংগীত। এমনিতেই বিদেশের মাটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যখন জাতীয় সংগীত বাজে, তখন বুকের মধ্যে যে অনুভূতি হয়, তার সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। যতই কঠিন হৃদয়ের মানুষ হোন না কেন, সাধারণত সহজাতভাবেই গড়িয়ে পড়ে ভালোবাসার বারিধারা। আর পাকিস্তানের মাটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংগীত শোনার সময় যে আলোড়ন, যে শিহরণ, যে ভাবাবেগ হয়, তা পরিমাপ করার মতো শব্দভা-ার অন্তত আমার জানা নেই। সেটি হয়ে আছে জীবনের অবিস্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা। আমার জানা মতে, কূটনৈতিক পর্যায়ের অনুষ্ঠান ছাড়া বড় কোনো পরিসরে পাকিস্তানের মাটিতে সেবারই প্রথমবার বেজেছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। জাতীয় সংগীত বাজার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে উড়তে থাকে বিজয়ের লাল-সবুজ পতাকা। বুকের মধ্যে ঢেউ খেলে যায় খুশির সমুদ্রহিল্লোল। মনে হলো, সাঁতার না জানা এই আমিও নেমে পড়ি সুইমিং পুলে। উচ্ছ্বাসে, উল্লাসে ভেসে যাই। এমন একটা গৌরবময় মুহুর্তের জন্য কী যে ব্যাকুলতা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম, সেটা এখন হয়তো অনুধাবন করা যাবে না। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গৌরবের সেই সোনালি মাহেন্দ্রক্ষণটি যখন এলো, সে এক আবেগময় মুহূর্ত। যদিও তখন বুঝতে পারি নি, এমন আবেগময় ক্ষণের আর দেখা পাবো না।
    
১৯৮৯ সালের ২০ থেকে ২৭ অক্টোবর পাকিস্তানের ইসলামাবাদে আয়োজিত হয় চতুর্থ সাফ গেমস। ১০টি খেলায় অংশ নেয় ১৫০ সদস্যের বাংলাদেশ ক্রীড়া দল। এত এত ক্রীড়াবিদ, অথচ দু’দিন পেরিয়ে গেছে একটি স্বর্ণ পদকও মিলছে না। যে ইভেন্টগুলোতে স্বর্ণ পদক পাওয়ার কথা, সেখান থেকে আসতে থাকে ব্যর্থতার হাহাকার। কী যে দুঃসহ অবস্থা। একটি স্বর্ণ পদকের আশায় ছুটে চলেছি এক ভেন্যু থেকে অন্য ভেন্যুতে। কোথাও কোনো আশার আলো নেই। জীবনে প্রথমবার বিদেশের মাটিতে গেমস কভার করতে এসে পেতে থাকি পোড়া বারুদের গন্ধ। ব্যর্থতার জ্বালা নিয়ে যখন ছটফট করছি, ঘুমহীন কাটছে রজনী, তখনই দেখা হয়ে যায় একাত্তরের কসাই টিক্কা খানের সঙ্গে। তাঁকে দেখার পর যন্ত্রণাটা আরো বেড়ে যায়। তুমুলভাবে প্রশ্ন জাগে, এই কসাইরা কি আমাদের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতকে কি সম্মান করতে বাধ্য হবে না? স্বর্ণ পদক না পেলে তো পাকিস্তানের মাটিতে বাজবে না বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। উড়বে না জাতীয় পতাকা। তাহলে তো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকাকে টিক্কা খানদের সম্মান জানানো হবে না। যে পতাকা ও সংগীতে লেগে আছে টিক্কা খানদের হাতে নিহত লাখো শহীদদের রক্ত, সেই পতাকা ও সংগীত যদি পাকিস্তানের মাটিতে অহংকারের সঙ্গে উত্তোলন করা না যায় এবং তীব্রস্বরে বাজানো না যায়, টিক্কা খানদের সম্মান জানাতে বাধ্য না করা যায়, সেটা কি মেনে নেওয়া যায়?

মেনে নিতে পারেন নি বাংলা মায়ের দামাল সন্তান সাঁতারু মোখলেসুর রহমান। সাঁতারুদের স্বর্গ হিসেবে বিবেচিত নারায়ণগঞ্জের কাশিপুর। এই কাশিপুরের সাঁতারুরা একসময়ের পূর্ব পাকিস্তান আর বাংলাদেশের হয়ে এনে দিয়েছেন অনেক গৌরব ও সম্মান। সেই কাশিপুরের সন্তান মোখলেসের কৃতিত্বে পাকিস্তানের মাটিতে প্রথমবার উড়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আর বেজেছে জাতীয় সংগীত। স্বর্ণ পদক পাওয়ার জন্য যখন কাটছে অপেক্ষার প্রহর, ঠিক তখন (২২ অক্টোবর) ইসলামাবাদ স্পোর্টস কমপ্লেক্স সুইমিং পুলে বাজিমাত করেন এই সাঁতারু। তাঁর প্রিয় ইভেন্ট ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তিনি জয় করেন স্বর্ণ পদক। ১ মিনিট ১০ দশমিক শূন্য ৫ সেকেন্ড নিয়ে গড়েন নতুন সাফ রেকর্ড। এটি ছিল তাঁর সেরা টাইমিং। তখন তো এত কিছু ভাববার সময় ছিল না। বাংলাদেশ স্বর্ণ পদক পেয়েছে, সেটাই আমাদের কাছে যথেষ্ট। বুকের মধ্যে সুখের গর্জন। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে বিন্দু বিন্দু হয়ে। মোখলেসকে নিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে বাংলাদেশ দল। তাঁকে জড়িয়ে ধরেন ইংলিশ জয়ী সাঁতারু ব্রজেন দাস। তিনিও তো তদানীন্তন পাকিস্তানের অবহেলার মোক্ষম জবাব দিয়েছিলেন ৬বার ইংলিশ চ্যানেল জয় করে। দু’জনের যুগলবন্দিতে অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সেই দৃশ্যটি স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
সেদিন বুঝতে পারি নি, কত বড় অপমান থেকে আমাদের রক্ষা করেছিলেন মোখলেসুর রহমান। সেটাই যে হয়ে ওঠবে বাংলাদেশের পাওয়া একমাত্র স্বর্ণ পদক, সেটা কারো কল্পনায় ছিল না। এরপর আর একটিও স্বর্ণ পদক পাওয়া যায় নি। সবেধন নীলমণি সেই একটি স্বর্ণ পদক নিয়ে সেবার আমাদের ফিরতে হয়েছিল। সাফ গেমসের ইতিহাসে সেটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। তবে এই ব্যর্থতার মাঝেও উজ্জ্বল সূর্য হয়ে আছেন মোখলেসুর রহমান। তিনি উদ্ভাসিত করেছেন বাংলাদেশের মুখ। সেদিন যদি তিনি স্বর্ণ পদক জিততে না পারতেন, তাহলে লজ্জা, গ্লানি আর শূন্য হাতেই ফিরতে হতো বাংলাদেশকে। পাকিস্তানের মাটিতে জাতীয় পতাকা উড়ানো আর জাতীয় সংগীত বাজানোর জন্য বাংলাদেশকে আরও অনেকগুলো বছর অপেক্ষায় থাকতে হতো। মোখলেসের কৃতিত্বে সেই অপেক্ষায় আর থাকতে হয় নি।

 
এমন একটি গৌরবময় কীর্তি ছাড়াও বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে মোখলেসুর রহমানের অবদান দারুণভাবে দীপ্তিমান হয়ে আছে। ১৯৮০ সাল থেকে বয়সভিত্তিক জাতীয় সাঁতারে তিনি নজর কাড়তে সক্ষম হন। জাতীয় সাঁতারের সিনিয়র পর্যায়ে ১৯৮৫ সাল থেকে সাফল্য দেখাতে থাকেন। বুক সাঁতারে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বলা যায়, ১৯৮৭ সাল থেকে ১০০ ও ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে দেশে তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। আর সেই সময়ে আন্তর্জাতিক সাঁতারে তিনি একটু একটু করে নিজেকে মেলে ধরেন। ১৯৮৭ সালে কলকাতায় তৃতীয় সাফ গেমসে প্রথম আন্তর্জাতিক পদক পান। ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে লাভ করেন ব্রোঞ্জ পদক। এরপর তো এলো ১৯৮৯ সালের গৌরবময় সাফল্য। তাঁর কৃতিত্বে গেমসে একমাত্র স্বর্ণ পদকটি জয় করে বাংলাদেশ। এছাড়াও ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক ও ৪ গুণন ১০০ মিটার মিডলে রিলেতে পেয়েছেন ব্রোঞ্জ পদক। ১৯৯১ সালে কলম্বোয় চতুর্থ সাফ গেমসে প্রিয় ইভেন্ট ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে নিজের ভুলে অল্পের জন্য স্বর্ণ হারান। রৌপ্য ইভেন্টে সন্তষ্ট থাকতে হয়। স্বর্ণ হারানোর তাঁর মুখে দেখেছিলাম কষ্টের ছায়া। সেদিন রাতে ঘুমাতে পারেন নি। একাকী কেঁদেছেন। প্রতীজ্ঞা করেছিলেন, ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে স্বর্ণ জিততে হবে। সেই প্রতীজ্ঞা তিনি রক্ষা করেছিলেন। স্বর্ণ পদক জয় করে সবার মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন। ২ মিনিট ৩৪ দশমিক ৭২ সেকেন্ড নিয়ে তিনি গড়েন নতুন রেকর্ড। দু’টি গেমসে স্বর্ণ পদক জয়ের পর তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল নিজের মাটিতে স্বর্ণ জয়ের। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জ জয়ের। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় পঞ্চম সাফ গেমসে মিরপুরে নবনির্মিত সুইমিং পুলে তিনি যখন নামেন, উল্লাসে ফেটে পড়ে পুরো চত্বর। বিপুল হাততালির মধ্যে দিয়ে ৩৪ বছর বয়সে ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে তিনি স্বর্ণ জয় করেন। সময় নেন ১ মিনিট ১০ দশমিক ৩২ সেকেন্ড। পর পর তিনটি সাফ গেমসে ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণ জয় করে বাংলাদেশের পক্ষে নতুন মাইলফলক গড়েন। এ কীর্তি এখন অব্দি আর কারও নেই। যদিও অ্যাথলেট শাহআলম টানা তিনটি সাফ গেমসে চারটি স্বর্ণ পদক জিতেছিলেন। কিন্তু তারমধ্যে দু’টি ছিল দলগত ইভেন্ট। মোখলেস ঢাকায় ২০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে রৌপ্য পদকও জয় করেন। তাঁর এই কৃতিত্বের জন্য তিনি ১৯৮৯ ও ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির সেরা সাঁতারু হন এবং ১৯৯৩ সালে বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এত এত কীর্তির পর পরই দেশের গৌরব এই সাঁতারু সচ্ছল জীবনের আশায় পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশের মাটিতে। যে কারণে একটু একটু করে আড়ালে চলে গেছেন। তাঁর বিস্ময়কর সাফল্যে জমেছে স্মৃতির পলিমাটি।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

আছি ক্রিকেটে আছি ফুটবলেও

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘ফ্লাইং বার্ড’ বলাই দে/ দুলাল মাহমুদ

‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’ / দুলাল মাহমুদ

বহুদর্শী ক্রীড়াবিদ মনিরুল হক/ দুলাল মাহমুদ

ফুটবলের সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের ফুটবল / দুলাল মাহমুদ

বিশ্বের পরাশক্তি বিশ্ব ফুটবলের খর্ব শক্তি / দুলাল মাহমুদ

এ কেমন নিষ্ঠুরতা? দুলাল মাহমুদ