‘অতীন্দ্রিয়’ এক দাবা প্রতিভা / দুলাল মাহমুদ



দাবা একটি মেধার খেলাবুদ্ধির খেলাসূক্ষ্ণ কৌশল ও পরিকল্পনার খেলাদাবা খেলতে হলে শিক্ষিত হবে, এমন কোনো কথা নেইতবে লেখাপড়া জানা থাকলে দাবা খেলায় পারদর্শিতা দেখানো সম্ভব হয়আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলতে হলে লেখাপড়া জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সেক্ষেত্রে দাবার বই পড়তে হয়দাবার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে হয়তত্ত্বীয় জ্ঞান থাকতে হয়তত্ত্বীয় জ্ঞান না থাকলে দাবা খেলায় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়আর তত্ত্বীয় জ্ঞান অর্জন করতে হলে তো লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নেইআন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাঁরা দাবায় সাফল্য দেখিয়েছেন, তাঁরা মেধাবী তো বটেই, শিক্ষিতও ছিলেনদাবার ওপর অনেক বই পড়েছেনতত্ত্বীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেনএমনকি সামাজিকভাবে ছিলেন মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদাবা এমন একটি সময়বহুল খেলা, অশিক্ষিত হয়ে কিংবা দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করে অবস্থানগত কারণে দাবায় বড় কিছু করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে নাকিন্তু দাবার ইতিহাসে ব্যতিক্রম ছিলেন একজনলেখাপড়া জানতেন নাবইপত্র পড়ার কোনো প্রশ্নই আসে নাকোনো তত্ত্ব জ্ঞানও ছিল নাইংরেজিতে দাবার পরিভাষাও বুঝতেন নাবসবাস করতেন দারিদ্র্যের সঙ্গেজীবন যাপনের জন্য গৃহভৃত্যের কাজ করতেনতারপরও সেই ত্রিশের দশকে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব থেকে সুদূর ইংল্যান্ডে গিয়ে আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতায় কিস্তিমাত করে দিয়েছিলেন তিনিশুধু বিস্ময়কর ও অলৌকিক প্রতিভাকে সম্বল করে হয়েছিলেন বিশ্বসেরা দাবাড়‍ুদের একজনতিনি মীর সুলতান খান
ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত পাঞ্জাবে (বর্তমানে পাকিস্তানের পাঞ্জাবের সারগোদায়) এক দরিদ্র পরিবারে সুলতান খানের জন্ম ১৯০৫ সালের জানুয়ারিতেনয় বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে চতুরঙ্গনামে পরিচিত ভারতীয় দাবায় দীক্ষা নেনসে খেলার নিয়ম-কানুন ছিল একটু অন্যরকমআধুনিক দাবার সঙ্গে তার ঢের পার্থক্য ছিল২১ বছর বয়সে তিনি পাঞ্জাবের একজন শক্তিশালী দাবাড়ু হিসেবে বিবেচিত হনতাঁর এই সুখ্যাতির কথা জানতে পারেন পাঞ্জাবের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব কর্নেল স্যার মালিক ওমর হায়াত খানতিনি ছিলেন দাবা অনুরাগীইউরোপীয় দাবা সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি সুলতানকে গৃহভৃত্য কিংবা বাবুর্চি হিসেবে নিয়োগ দেনকারো কারো মতে সুলতান ছিলেন তাঁর ক্রীতদাসএ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি১৯২৮ সালে সুলতান অল-ইন্ডিয়া চ্যাম্পিয়নশিপজয় করেন৮ খেলায় জয়ী হন এবং একটিতে ড্র করেনকোনো হার ছিল নাএই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে স্যার ওমর তাঁকে ইউরোপে নিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ হন১৯২৯ সালের বসন্তে তিনি তাঁকে লন্ডনে নিয়ে যানতারপর তো একের পর এক বিস্ময়অজপাড়া গায়ের একজন অশিক্ষিত গৃহভৃত্য কাঁপিয়ে দেন দাবা বিশ্বকেপাঁচ বছরের কম সময়ের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তিনি যে ঝড় তোলেন, তা দাবার ইতিহাসে অমলিন হয়ে আছেচারবার অংশ নিয়ে তিনবার ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় করা ছাড়াও বিশ্বের সেরা একজন দাবাড়ৃ হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেনঅথচ সব কিছুই ছিল তাঁর প্রতিকূলেলেখাপড়া জানতেন নানিজের স্কোরকার্ড লিখতে পারতেন নাআন্তর্জাতিক দাবার নিয়ম-কানুনও জানতেন নাইউরোপীয় দাবায় মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সিরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ইংলিশ দাবাড়ৃ ফিলিপ স্টাম্মার সঙ্গে তাঁর অনেকটা সামঞ্জস্য রয়েছেস্টাম্মা ইংল্যান্ড এসে চেস মাষ্টারও আধুনিক দাবার অগ্রদূত খ্যাতি অর্জন করেনলন্ডনে যাওয়ার পর সেখানে সুলতানের সুবিধার্থে একটি ট্রেনিং টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়অনভিজ্ঞতা ও তত্ত্বীয় জ্ঞানের অপ্রতুলতার কারণে প্রতিযোগিতায় খুবই বাজে ফল করেন তিনিসবার পরে ছিল তাঁর অবস্থানতারচেয়ে এগিয়ে ছিলেন দুই ব্রিটিশ দাবাড়ৃু উইলিয়াম উইন্টার ও ফ্রেডেরিক ইয়েটসএই টুর্নামেন্টের পর আসন্ন ব্রিটিশ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ’-এর প্রস্তুতির জন্য তাঁকে সহায়তা করেন এই দুই দাবাড়ুমজার ব্যাপার, এ দুজনই ছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীউইলিয়াম উইন্টার সুলতানের পরে ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয় করেনআর ফ্রেডেরিক ইয়েটস ১৯১৩, ১৯১৪, ১৯২১, ১৯২৬, ১৯২৮ ও ১৯৩১ সালে চ্যাম্পিয়ন হনসবাইকে চমকে দিয়ে সুলতান খান ১৯২৯ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেনতাঁর এই সাফল্য দারুণভাবে দাবাবিশ্বকে আলোড়িত করেকিছু দিন পর তিনি স্যার ওমরের সঙ্গে ভারতে ফিরে যান১৯৩০ সালে মে মাসে তিনি পুনরায় ইউরোপে আসেনএরপর একের পর এক হারিয়ে দিতে থাকেন বিশ্বসেরা দাবাড়ুদের১৯৩০ সালে বেলজিয়ামের লিজে টুর্নামেন্টে তিনি রানার-আপ হনচ্যাম্পিয়ন হন পরবর্তীকালের গ্র্যান্ডমাষ্টার সাভিয়েলি তারতাকোয়েরতারতাকোয়ের রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করলেও তিনি পোলিশ ও ফ্রেঞ্চের নাগরিক ছিলেন১৯৩০-৩১ সালে ইংল্যান্ডের হাস্টিংস দাবা টুর্নামেন্টে সুলতান তৃতীয় হনপাঁচ ম্যাচে জয়ী হন, দুটিতে ড্র করেন ও দুটিতে হেরে যানতাঁর আগে ছিলেন ভবিষ্যতের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নেদারল্যান্ডসের ম্যাক্স ইউয়ি এবং সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কিউবার হোসে রাউল কাপাব্ল্যাঙ্কাম্যাক্স ইউয়ি ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হনকাপাব্ল্যাঙ্কা ১৯২১ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিলেনকাপাব্ল্যাঙ্কার সঙ্গে তাঁর খেলাটি সর্বকালের সেরা ম্যাচের একটি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেএ খেলায় তিনি জয়ী হনকাপাব্ল্যাঙ্কাকে অল্প যে কজন হারিয়েছেন, তিনি তাঁদের একজন১৯৩১-৩২ সালে ইংল্যান্ডের হাস্টিংস দাবা টুর্নামেন্টে এবং ১৯৩২ সালে সুইজারল্যান্ডের বার্ন চ্যাম্পিয়নশিপে সুলতান চতুর্থ হনবার্নে ১০টি খেলায় জয়ী, দুটিতে ড্র ও তিনটিতে হেরে যান১৯৩২ সালে লন্ডনে দাবা টুর্নামেন্টে যুক্তরাষ্ট্রের আইজাক কাশদানের সঙ্গে তিনি যৌথভাবে তৃতীয় হনকাশদান পরবর্তীকালে গ্র্যান্ডমাষ্টার হন এবং তিনি ছিলেন সর্বকালের সেরা আমেরিকান দাবাড়ৃুদের একজনপ্রথম দুটি স্থান দখল করেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রাশিয়ার আলেকজেন্ডার আলেখিন এবং চেক প্রজাতন্ত্রের সালো ফোহরঅলেখিন ১৯২৭ থেকে ১৯৩৫ এবং ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিলেনতিনি ছিলেন দাবা ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ফোহর পরবর্তী সময়ে গ্র্যান্ডমাষ্টার হনএকটা সময় বিলাসবহুল অনেক পণ্য তাঁর নামে বিক্রি হতোসুলতান খান ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে পুনরায় ব্রিটিশ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় করেন১৯৩১ সালে একটি টুর্নামেন্টে সাভিয়েলি তারতাকোয়েরকে হারিয়ে দেন তিনিএ টুর্নামেন্টে তিনি চারটিতে জয়ী, পাঁচটিতে ড্র ও তিনটিতে হেরে যান১৯৩২ সালে আরেকটি টুর্নামেন্টে অল্পের জন্য তিনি হেরে যান সালো ফ্লোহরের কাছেএ টুর্নামেন্টে তিনি একটিতে জয়ী, তিনটিতে ড্র ও দুটিতে হেরে যান
সুলতান খান ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের সন্তানদেশ পরাধীন থাকার কারণে সে সময় আন্তর্জাতিক দাবায় তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে অংশ নেনদাবা অলিম্পিয়াডে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়দাবা অলিম্পিয়াডে ইংল্যান্ডের হয়ে তিন বার প্রথম বোর্ডে খেলেনপ্রথম বোর্ডে সাধারণত সেরা খেলোয়াড়রা অংশ নেনতিনি মুখোমুখি হন বিশ্বসেরা খেলোয়াড়দের১৯৩০ সালের ১৩ থেকে ২৭ জুলাই জার্মানির হামবুর্গে তৃতীয় দাবা অলিম্পিয়াডে তাঁর সঙ্গে ছিলেন ফ্রেডেরিক ইয়েটস, জর্জ অ্যালান থমাস, উইলিয়াম উইন্টার ও থিওডর টাইলরতিনি নয় মাচে জয়ী, চারটিতে ড্র ও চারটিতে হেরে যান১৯৩১ সালের ১১ থেকে ২৬ জুলাই চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রাগে চতুর্থ দাবা অলিম্পিয়াডে ইংল্যান্ড টিমে ছিলেন সুলতান খান, ফ্রেডেরিক ইয়েটস, জর্জ অ্যালান থমাস, উইলিয়াম উইন্টার ও ভিক্টর ওয়হলটাচএ অলিম্পিয়াডে অসাধারণ খেলেন তিনি৮টি ম্যাচে জয়ী, সাতটিতে ড্র ও দুটিতে হেরে যানতিনি হারিয়েছেন সালো ফ্লোহর ও পোল্যান্ডের আকিবা রুবিনস্টেইনকেরুবিনস্টেইন পরে গ্র্যান্ডমাষ্টার হনড্র করেন রাশিয়ার আলেকজেন্ডার আলেখিন, যুক্তরাষ্ট্রের আইজাক কাশদান, অস্ট্রিয়ার এরনস্ট গ্রুনফেল্ড, সুইডেনের গিডিওন স্টলবার্গ ও রাশিয়ার এফিম বোজোলজুভবের সঙ্গেগ্রুনফেল্ড, স্টলবার্গ ও বোজোলজুভব পরবর্তীতে গ্র্যান্ডমাষ্টার হন১৯৩৩ সালের ১২ থেকে ২৩ জুলাই যুক্তরাজ্যের ফলকেস্টোনে পঞ্চম দাবা অলিম্পিয়াডে তাঁর সঙ্গী ছিলেন জর্জ অ্যালান থমাস, উইলিয়াম উইন্টার, রিজিনাল্ড প্রিস মিশেল ও কনেল হুগ ওডনেল আলেকজেন্ডারচারটিতে জয়ী, ছয়টিতে ড্র ও চারটিতে হেরে যানতাঁর প্রতিপক্ষ ছিল বিশ্বসেরা খেলোয়াড় রাশিয়ার আলেকজেন্ডার আলেখিন, চেক প্রজাতন্ত্রের সালো ফ্লোহর, যুক্তরাষ্ট্রের আইজাক কাশদান, গ্র্যান্ডমাষ্টার সাভিয়েলি তারতাকোয়ের, অস্ট্রিয়ার এরনস্ট গ্রুনফেল্ড, সুইডেনের গিডিওন স্টলবার্গ, হাঙ্গেরি বংশোদ্ভূত লাজোস স্টেইনার
১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে সুলতান খানকে ভারতে ফিরিয়ে আনেন স্যার ওমর১৯৩৬ সালে ভি কে খাদিলকারের বিপক্ষে তিনি জয়ী হনতাঁর বিপক্ষে জেতেন ১০-১ পয়েন্টেএরপর আর দাবার জগতের সঙ্গে সুলতানের সম্পর্কের কথা তেমনভাবে জানা যায়নিদাবার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে তিনি ফিরে যান তাঁর অখ্যাত ও অবজ্ঞাত নগণ্য জীবনেবাকী জীবন কৃষিকাজ করে কাটানকর্নেল স্যার মালিক ওমর হায়াত খান ছিলেন দাবাপ্রেমীতবে খেয়ালি মেজাজেরতিনি তাঁর দুজন গৃহভৃত্য সুলতান খান ও মিস ফাতিমার দাবা প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁদের ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে খেলার সুযোগ করে দেনকিন্তু নিজের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতনখ্যাতিমান দাবাড়ুদের সন্মানে লন্ডনে তাঁর বাসভবনে একটি নৈশভোজ দেন তিনিএই নৈশভোজে সুলতান খান রাঁধুনি ও পরিবেশকের দায়িত্ব পালন করেনবিশ্বসেরা একজন দাবাড়ৃু হয়েও এই নৈশভোজে তাঁকে অতিথিদের খাদ্য ও পানীয় পরিবেশন করতে হয়এটা সুলতান খান ও উপস্থিত দাবাড়ুদের জন্য ছিল বিব্রতকরএ নিয়ে স্যার মালিক ওমরের কোনো হেলদোল ছিল নাবিশ্ব দাবায় সুলতান যখন একের পর এক বিস্ময় উপহার দিয়ে চলেছেন, তখন তিনি তঁকে দেশে ফিরিয়ে আনেনএরপর আর তাঁকে ইংল্যান্ড নিয়ে যাননিসুলতান খান দেখতে খুব একটা আকর্ষণীয় ছিলেন নাছোট-খাট ও হালকা-পাতলা গড়নের ছিলেনতাঁর তাকানো ও পোশাক-আশাক ছিল অদ্ভুত ধরনেরমাথায় পাগড়ি পরতেনব্রিটিশ আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননিঠাণ্ডায় ভুগতেনসারাক্ষণই নাক টানতেনঅনেক অপারগতা থাকলেও তিনি ছিলেন প্রতিভার বরপুত্রকিন্তু প্রতিভার দামটা সেভাবে পাননি    
সুলতান খানের দাবা ক্যারিয়ার স্বল্পকালীন হলেও তিনি অল্প সময়ের মধ্যে ঝলসে ওঠেছিলেননিজেকে পরিণত করেন বিশ্বের একজন সেরা দাবাড়ৃু হিসেবেপাঁচ বছরের মধ্যেই তিনি যে অবস্থানে পৌঁছেছিলেন, তাতে তাঁর এলো রেটিংদাঁড়ায় ২৫৩০চেসমেট্টিকস পদ্ধতি অনুসারে, ১৯৩৩ সালের মে মাসের র‌্যাংকিং-এর দিক দিয়ে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ স্থানেতাঁর রেটিং ছিল ২৬৯২তাঁর আগে ছিলেন রাশিয়ার আলেকজেন্ডার আলেখিন, যুক্তরাষ্ট্রের আইজাক কাশদান, চেক প্রজাতন্ত্রের সালো ফ্লোহর, কিউবার হোসে রাউল কাপাব্ল্যাঙ্কা ও নেদারল্যান্ডসের ম্যাক্স ইউয়িতাঁর সর্বাধিক রেটিং ছিল ১৯৩২ সালের নভেম্বরে২৬৯৯১৯৩১ সালে প্রাগে তাঁর সেরা ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স ছিল ২৭১৩তাঁর আগে ছিলেন রাশিয়ার আলেকজেন্ডার অলেখিন এবং রাশিয়া-জার্মানির এফিম বোগলজুবভযে সব টুর্নামেন্টে তিনি অংশ নিয়েছেন, তাতে চতুর্থ স্থানের নিচে কখনোই নামেননিবিশ্ব দাবা ফেডারেশন (ফিদে) ১৯৫০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবারের মতো গ্র্যান্ডমাষ্টারআন্তর্জাতিক মাষ্টারখেতাবকে স্বীকৃতি দেয়তত দিনে দাবার জগতের সঙ্গে সম্পর্কহীন ১৫ বছর পেরিয়ে এসেছেন সুলতান খানকিন্তু দীর্ঘ দিন আগে অবসরে যাওয়া বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী কয়েকজন দাবাড়ৃকে তাঁদের জীবিত অবস্থায় খেতাব প্রদান করে ফিদেতাঁদের অন্যতম হলেন পোল্যান্ডের আকিবা রুবিনস্টেইন, মেক্সিকোর কার্লোস তোরেদুজনকেই গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব দেওয়া হয়কিন্তু সুলতান খানের গ্র্যান্ডমাস্টারের রেটিং থাকাসত্ত্বেও তাঁকে কোনো খেতাব দেওয়া হয়নিযদি খেতাব পেতেন, তাহলে তিনি হতেন এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার১৯৭৪ সালে এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হন ফিলিপাইনের ইউগেনিও তোরেআর ১৯৮৭ সালে উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হন নিয়াজ মোরশেদনিয়াজের পর ভারতের ৩৩ জন ও বাংলাদেশের চারজন গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছেনকিন্তু পাকিস্তানের কেউ গ্র্যান্ডমাস্টার হতে পারেননি১৯৮৮ সালে ভারতের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পর বিশ্বনাথন আনন্দ পাঁচবার (২০০০, ২০০৭, ২০০৮, ২০১০ ও ২০১২) বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেনবর্তমানেও তিন চ্যাম্পিয়নকিন্তু সুলতান খান যদি দীর্ঘ দিন দাবায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করার সুযোগ পেতেন, তাহলে এশিয়া ও উপমহাদেশ অনেক আগেই একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পেতে পারতো  
সুলতান খান যখন ইউরোপে যান, তখন ইংরেজি ভাষা জানতেন নাএজন্য তাঁর দোভাষীর প্রয়োজন পড়েলিখতে এবং পড়তে না পারার কারণে তিনি প্রতিযোগিতার কোনো বইপত্র পড়তে পারতেন নাতিনি ট্রেইনারদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেনএই ট্রেইনাররা আবার ছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদাবায় ওপেনিংস একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কিন্তু এটাতে তিনি মোটেও ভালো ছিলেন নাশুরুর দিকে এটা তিনি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত অন্য ভারতীয় খেলোয়াড়দের দেখে নিয়ে খেলতেনমূলত অন্যদের খেলা দেখে তাঁর স্ট্যাইল গড়ে ওঠেতত্ত্বের চেয়ে তিনি সহজাত প্রায়োগিক কৌশলের ওপর নির্ভরশীল ছিলেনখেলতেন কমন সেন্স খাটিয়েএতসব প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের একজন হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেনতিনি ছিলেন বিশ্বের সেরা দশজন খেলোয়াড়ের একজনতবে মিডলগেম’-এ তিনি ছিলেন বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকজনের একজনআর এন্ডগেম’-এ তিনি ছিলেন বিশ্বের দুই-তিনজনের মধ্যেসর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কিউবার হোসে রাউল কাপাব্ল্যাঙ্কার কাউকে প্রশংসা করার ঘটনা খুবই বিরলকিন্তু সেই তিনি সুলতানকে জিনিয়াসহিসেবে আখ্যায়িত করেনদুই ব্রিটিশ দাবাড়‍ু ও দাবা লেখক ডেভিড হুপার ও কেনেথ হোয়াইল্ড তাঁকে আধুনিক সময়ের সবচেয়ে সহজাত খেলোয়াড়হিসেবে অভিহিত করেনতাঁকে নিয়ে ইউরোপীয়দের কৌতূহলের শেষ নেইলেখা হচ্ছে গবেষণামূলক গ্রন্থ        
স্যার ওমর হায়াত খানের আরেকজন গৃহভৃত্য ছিলেন মিস ফাতিমাতিনিও ছিলেন আরেক বিস্ময়১৯১৪ সালে তাঁর জন্ম১৯৩৩ সালে ব্রিটিশ মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি শিরোপা জয় করে চমকে দেনএই চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের রানী হামিদ ১৯৮৩ (যুগ্মভাবে), ১৯৮৫ ও ১৯৮৯ সালে চ্যাম্পিয়ন হনফাতিমা জানান, ইউরোপ থেকে ভারতে ফেরার পর সুলতান খান মনে করেন, তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেনইংল্যান্ডের সেঁতসেঁতে আবহাওয়ায় তিনি ক্রমান্বয়ে ম্যালেরিয়া, ঠাণ্ডা, সর্দিজ্বর, গলায় সংক্রামণ রোগে আক্রান্ত হনএ কারণে তাঁর গলায় থাকতো ব্যান্ডেজমেজর জেনারেল স্যার ওমর ১৯৪৪ সালে ইন্তেকাল করেনতিনি ছিলেন পাঞ্জাবের সবচেয়ে বেশি ভূসম্পত্তির মালিকদের একজনকিন্তু তিনি সুলতান খানকে খুব সামান্যই বিষয়সম্পত্তি দিয়ে যানসুলতান খান ছোট্ট একটি খামারবাড়িতে থাকতেনজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেখানেই কাটিয়ে গেছেন১৯৬৬ সালের ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানের সারগোদায় যক্ষা রোগে তিনি ইন্তেকাল করেনতিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র জানান, তিনি কখনো তাঁর সন্তানদের দাবা খেলা শেখাননিতিনি চাইতেন না, তাঁরা দাবা খেলুকবরং বলতেন,  জীবনে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য তাঁদের উচিত কার্যকর ও ফলপ্রসূ কিছু করাএ থেকে বোঝা যায়, দাবায় নিজের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি নিয়ে তিনি মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন নাকারণ চেস জিনিয়াসহয়েও তাঁকে ভূমিদাসহিসেবেই জীবন যাপন করতে হয়এটা তিনি মেনে নিতে পারেননিএকবুক অভিমান নিয়ে তিনি চলে গেছেন ইহলোক ছেড়ে
সুলতান খান ছিলেন ভারতীয় দাবার অগ্রদূতমনে করা হয়, ‘ভারতীয় অতীন্দ্রিয়ক্ষমতার একজন সার্থক উত্তরাধিকারী তিনিকেননা, তিনি ছিলেন প্রথাবিরুদ্ধ একজন দাবাড়ৃুতিনি আসলেই তাঁর নামের মতোই ছিলেন দাবার সুলতানকিংবদন্তি এই দাবাড়ু ছিলেন মহাবিস্ময়অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেনলেখাপড়া ও আধুনিক দাবার নিয়ম-কানুন জানা ছাড়াই যেভাবে দাবাবিশ্বকে মাত করে দিয়েছেন, তার কোনো তুলনা হয় নাতাঁর দাবার ক্যারিয়ারও ছিল স্বল্পকালীনতিনি যদি দীর্ঘ দিন দাবার জগতে থাকতেন এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেতেন, তাহলে এ কথা নি:সন্দেহে বলা যায়, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে তিনি দাবার দুনিয়া শাসন করতে পারতেনকিন্তু সে সুযোগ তিনি পাননিযে কারণে অকালেই হারিয়ে যেতে হয় দাবার এই পরম বিস্ময়কেতারপরও মীর সুলতান খান যা করেছেন, তারজন্য তাঁর কাছে ঋণী হয়ে থাকবে পুরো দাবার জগতবিরলজাতের এমন প্রতিভার সচারচর দেখা মেলে নাএমন একজন আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন দাবাড়ুর জন্য যুগে যুগে অপেক্ষায় থাকতে হয়
ইন্টারনেট অবলম্বনে

মন্তব্যসমূহ

  1. সুসুলতান খান কে গ্রান্ডমাস্টার উপাধী না দিয়ে; ততকালীন দাবা-বিশ্ব তাঁর সাথে চরমতর অবিচার করেছে বলে আমি মনে করি।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়’ / দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ

এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয় / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ