সোনালী অতীতের দিনগুলো-৪ / বশীর আহমেদ

(৯৯)
‘কালো-সাদা’ জার্সি নিয়ে প্রায়ই সমস্যায় পড়তে হতো। কালো-সাদার দাবিদার দুটি ক্লাবÑ মোহামেডান-ওয়ান্ডারার্স। সেবারও (১ জুলাই ১৯৬৭) লিগের ২য় পর্বের খেলা নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট দেরিতে আরম্ভ হয়েছিল। মোহামেডানের ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আর ওয়ান্ডারার্সের ক্যাপ্টেন ইসমাইল রুশো; দুজনই তাদের ঐতিহ্য রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। উভয় দলের জার্সির কালার রেজিস্টার্ডÑ এটা তাদের দাবি। ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের দাবি, ঢাকায় ওয়ান্ডারার্স ক্লাব মোহামেডানের আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আর মোহামেডানের দাবি তাদের ক্লাব ১৯৩৬ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; সেটারই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় মোহামেডান প্রতিষ্ঠিত। ইপিএসএফ কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে জার্সি সমস্যার সমাধান হয়েছিল রেফারি জেড আলমের টসের মাধ্যমে। টসে ওয়ান্ডারার্স জয়ী হয়ে তাদের কালো-সাদা জার্সি পরে খেলতে নেমেছিল আর মোহামেডান পরেছিল লাল জার্সি।
ওয়ান্ডারার্স জার্সির টসে জয়লাভ করলেও মাঠের খেলায় মোহামেডান তাদেরকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল। যদিও চ্যাম্পিয়নরা ভাল খেলে জয়লাভ করেছিল; তবে ওয়ান্ডারার্সের রক্ষণভাগ মোহামেডানের শক্তিশালী আক্রমণগুলোকে ব্যর্থ করে দিচ্ছিল। দক্ষ এবং দ্রুতগতির রক্ষণভাগ মোহামেডানের ফরোয়ার্ড লাইনকে অনেকটা অচল করে দিয়েছিল। বিশেষ করে তাদের স্টপার নবী বখশের খেলা সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তাছাড়া তাদের গোলরক্ষক ফেরদৌসের চমৎকার গোল কিপিংও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু ওয়ান্ডারার্সের ফরোয়ার্ড লাইন ছিল পুরোপুরি ব্যর্থ। দ্রুতগতির লেফট আউট তসলিম মাঠে উপস্থিত থাকলেও খেলায় তার মনোযোগ ছিল না; দুই ইন ছিল অনেকটা নিস্তেজ। মোহামেডান কমপক্ষে চারটি সহজ সুযোগ নষ্ট করে বিরতিতে গিয়েছিল গোলশূন্য অবস্থায়। মোহামেডান বিরতির পর ওয়ান্ডারার্সের ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করে দুটো গোলের সুযোগ তৈরি করেছিল। গোলরক্ষক বিট হলেও তাদের লেফট ব্যাক আজিজ দক্ষতার সাথে সেভ করেছিল। দ্বিতীয় চান্সটি নবী বখশ তার চমৎকার এন্টিসিপেশন সেভ করতে সক্ষম হয়েছিল।
মোহামেডানের শক্তিশালী আক্রমণভাগকে ওয়ান্ডারার্সের গোলমুখ খুলতে প্রথমার্ধের পুরোটা সময়সহ দ্বিতীয়ার্ধেরও ১৫ মি. চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়েছিল। মোহামেডানের লেফট আউট মুসা কর্নার কিকের বল ধরে মাপা শটে ফেরদৌসকে পরাস্ত করার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত কাজটি করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। ডান প্রান্ত থেকে উঁচু হয়ে আসা একটি বলের ফ্লাইট নবী বখশ মিস করলে তোরাব আলী বুলেট শট মেরে দলের পক্ষে দ্বিতীয় গোল করে। খেলা শেষের কিছু আগে পিন্টুর পাসে শামসু গোল করে মোহামেডানকে ৩-০ গোলের জয় এনে দেয়। 
ম্যাচ উইনিং গোলটি করেছিল লেফট ইন জব্বর হেডের মাধ্যমে দ্বিতীয়ার্ধের দ্বিতীয় মিনিটে। আর এই গোল ইপিআইডিসির অপরাজিত থাকা অক্ষত রেখেছিল। ২ জুলাইয়ের রহমতগঞ্জের এ খেলা দিয়ে ইপিআইডিসি তাদের প্রথম পর্বের খেলা শেষ করেছিল ১২ খেলায় ২০ পয়েন্ট নিয়ে। ৮টি জয়, ৪টি ড্র এবং গোল করেছিল ৩৯টি আর খেয়েছিল ৯টি।  অপরপক্ষে রহমতগঞ্জ ৪টি জয়, ৪টি ড্র এবং ৪টি পরাজয় অর্জন মাত্র ১২ পয়েন্ট। ১৭ গোল দিয়ে ১৫ গোল খেয়েছিল ১২ খেলায়। দুই টিমের খেলাটি খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছিল। দুই টিমই জেতার জন্য মাঠে নেমেছিল, তাই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলাটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। রহমতগঞ্জের বারপোস্টের নিচে অনাথ ভাল খেলা উপহার দিয়েছিল। ইপিআইডিসির বিরতির পূর্বে বেশ কয়েকটি আক্রমণ বিফলে গিয়েছিল ফিনিশিং-এর অভাবে। রহমতগঞ্জও বিচ্ছিন্ন আক্রমণ চালিয়ে কোন ফল লাভ করতে পারেনি।
জোরদার আক্রমণ দিয়ে ইপিআইসিসি ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করেছিল এবং ২ মিনিটেই তার সুফল পেয়ে গিয়েছিল যখন ডান প্রান্ত থেকে সলিমুল্লাহ বিপক্ষ গোলমুখে লব করলে জব্বর হেডের সাহায্যে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। যদিও গোলটি অফসাইডে বিতর্কিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধের অবশিষ্ট সময় রহমতগঞ্জ তাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করেও গোল শোধ করতে পারেনি।
সেদিন লিগের আরও একটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল আউটার স্টেডিয়ামের ১ নং গ্রাউন্ডে পিডব্লিউডি বনাম ওয়ারী। প্রথমার্ধে পিডব্লিউডি ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল আর দুটো গোলই করেছিল তাদের রাইট আউট বাবুল। পিডব্লিউডি খেলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাল খেলেছিল এবং ওয়ারীর ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছিল। খেলার ১৫ মিনিটে বাবুল তার একক প্রচেষ্টায় ওয়ারীর সীমানায় পৌঁছেই তীব্র শট মেরে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। ১০ মিনিট পর আবারও বাবুল তপনকে পরাস্ত করে দলকে ২-০ গোলে লিড এনে দেয়। বিরতির পর ওয়ারী খেলায় ফিরে আসার চেষ্টা করে, যার ফলস্বরূপ তাদের রাইট আউট তপন চৌধুরী বল নিয়ে দ্রুতগতিতে বিপক্ষ গোলমুখে ঢুকে মোহাম্মদ হোসেনকে সে সহজেই জালে জড়িয়ে দিয়ে গোলের ব্যবধান কমিয়ে ২-১ করে দেয়। কিছু সময়ের জন্য খেলায় গতি এসেছিল, প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করেছিল কিন্তু গনির কর্নার কিকে ওয়াহিদ গোল করে সবকিছুর ওপর পানি ঢেলে দিয়েছিল। খেলা শেষে ৩-১ গোলের জয় নিয়ে পিডব্লিউডি মাঠ ছেড়েছিল।
৩ জুলাই ভিক্টোরিয়া পুলিশের বিপক্ষে ভালভাবেই জয়লাভ করেছিল। যদিও পুলিশ টিম অল্প সময়ের জন্য জয়ের স্বাদ পেয়েছিল। ভিক্টোরিয়া ৪-১ গোলে পুলিশকে হারিয়ে তাদের প্রথম পর্বের খেলা শেষ করেছিল ১৮ পয়েন্ট নিয়ে। ৭ জয়, ৪ ড্র এবং ১ হার। এই খেলায় মৌসুমের প্রথম মার্চিং ওয়ার্ডার (বর্তমানে লালকার্ড) পেয়েছিল পুলিশের সেন্টার ফরোয়ার্ড সাত্তার। পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের নতুন আইন অনুযায়ী রেফারি কর্তৃক কোন খেলোয়াড় মার্চিং ওয়ার্ডার পেলে সে তিন মাসের জন্য সাসপেন্ড (বহিষ্কার) হবে। তিন মাস সে কোন খেলায় অংশ নিতে পারবে না। 
খেলার শুরুটা পুলিশ টিম ভাল করেছিল। বিরতির পূর্বে তারা গোল করে ১-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল। আর গোলটি করেছিল পুলিশের সেই মার্কামারা সাত্তার। ছোটখাটো গড়নের সাত্তারের হাত-পা-মুখ এক সাথে চলতো। এমন কোন ম্যাচ সে খেলেনি যে খেলায় রেফারি তাকে মৌখিক সতর্ক না করেছে। তবে এটা বললে বেশি বলা হবে না যে, সে ছিল পুলিশ টিমের প্রাণশক্তি। সারা মাঠে অত্যন্ত পরিশ্রম করে খেলতো। টিমের জন্য অত্যধিক ফিলিংস ছিল তার। খেলার ২২ মিনিটে একক প্রচেষ্টায় সাত্তার গোল করলে ভিক্টোরিয়া অনেক ভেবাচেকা খেয়ে যায় এবং গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু বিরতি পর্র্যন্ত চেষ্টা চালিয়েও সফল হতে পারেনি।
দ্বিতীয়ার্ধের প্রচন্ড চাপে পুলিশ টিম বেসামাল হয়ে পড়ে এবং লেফট ব্যাক আখতার পেনাল্টি এরিয়ার ভেতর হাত দিয়ে বল খেলার অপরাধে পেনাল্টি লিড করে ভিক্টোরিয়া আর সেটা থেকে ইউসুফ গোল করে দলকে (১-১) সমতায় ফেরায়। দু’মিনিট পরই জানি একক প্রচেষ্টায় গোল করে দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দেয়। ২৫ মিনিটে ইউসুফের বানানো বলে ইউনুস তৃতীয় গোল এবং হালিও পূর্ণ করে সে। খেলার শেষ মিনিটে পুলিশ একটি পেনাল্টি পেয়েছিল কিন্তু তাদের লেফট ব্যাক আখতার পোস্টের ওপর দিয়ে মেরে গোলের ব্যবধান কমাবার সুযোগ নষ্ট করে দেয়। সাত্তার মার্চিং ওয়ার্ডারটি পেয়েছিল দ্বিতীয়ার্ধের ৩৩ মিনিটে। খেলা শেষে ফলাফল ভিক্টোরিয়া ৪-১ গোলে জয়ী।
মোহামেডান পাঁচবার পিডব্লিউডির জালে বল জড়িয়ে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছিল। চলতি চ্যাম্পিয়ন দল ১০টি  জয় আর দুটি ড্র, ২২ পয়েন্ট নিয়ে লিগের শীর্ষস্থানে অবস্থান করছিল। সে তুলনায় তাদের খেলায় সেরকম আহামরি কিছু লক্ষ্য করা যায়নি। যদিও খেলায় দৈহিক শক্তির প্রয়োগ ছিল। জায়েন্ট কিলার খ্যাত পিডব্লিউডি প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলে। খেলাটি আকর্ষণীয় হওয়ার আশা নিয়ে স্টেডিয়ামে উল্লেখযোগ্য দর্শক উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু পিডব্লিউডি খেলায় তাদের অখেলোয়াড়োচিত আচরণ এবং রাফ খেলার জন্য সবাইকে শুধু হতাশই করেনি বরং নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। রেফারি বার বার হুইসেল বাজিয়ে মৌখিক সতর্ক করে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে সবার কাছে বিরক্তের পাত্র হয়েছেন। তার নাকের ডগার ওপর দিয়ে খেলোয়াড়রা ফাউল করে যাচ্ছিল অথচ তিনি শক্ত হাতে সিদ্ধান্ত দিতে পারছিলেন না। এতে খেলার মান হয়ে পড়েছিল একেবারে নিম্ন।
প্রথমার্ধ খেলায় কিছুটা প্রতিযোগিতা ছিল, বিশেষ করে পিডব্লিউডি বেশ কয়েকটা আক্রমণ চালিয়ে মোহামেডানের ডিফেন্সকে হুশিয়ার করে দিয়েছিল। খেলার ৮ মিনিটে পিডব্লিউডির রক্ষণভাগের খেলোয়াড় ভুল ক্লিয়ান্সের বল মোহামেডানের রসুল বখশ ধরে গোলরক্ষকের মাথার ওপর দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দেয় (১-০)। ২৬ মিনিটে পিডব্লিউডি গোল শোধ করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও ব্যর্থ হয়েছিল। আবিদ হোসেনের কিকটি গোলরক্ষক নুরুন্নবীকে পরাস্ত করলে ক্রসবারে প্রতিহত হয়েছিল। মিনিট পরেই মুসার সুন্দর পাসে শামসু গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল।
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা বেশ রাফ এন্ড টাফ হয়ে পড়েলÑ যা রেফারি সামাল দিতে না পারায় খেলায় বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল এবং মাঝে খেলা বন্ধ হয়ে আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল। শামসুর  পাসে হাফিজ দুর্দান্ত শটে গোলের সংখ্যা ৩-০ এগিয়ে দিয়েছিল। ডান প্রান্ত থেকে প্রতাপ পেনাল্টি বক্সে ঢুকে পড়লে পিডব্লিউডির স্টপার ওয়াহেদ প্রতাপকে অবৈধভাবে ফেলে দিলে মোহামেডান পেনাল্টি লাভ করে এবং কাদের সেটার মাধ্যমে গোলের সংখ্যা হালিতে পূর্ণ করে। মুসা দলের ৫ম গোল কার পরপরই রেফারি গোলাম হোসেন খেলার শেষ বাঁশি বাজিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। তার সেদিনের খেলা শেষ করাটাই ছিল অনেক বড় ব্যাপার। #

(১০০)
ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনকে পাশ কাটিয়ে বিভিন্ন খেলার কর্মকর্তা এবং সংগঠকরা ভিন্ন ভিন্ন খেলার জন্য আলাদা আলাদা গেম এসোসিয়েশন বা ক্রীড়া সমিতি গঠন করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় ৩ জুন নতুন তিনটি ক্রীড়া সমিতি গঠন করা হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল ইস্ট পাকিস্তান ভলিবল এসোসিয়েশন, যার সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন এএ সিদ্দিকী এবং সেক্রেটারি হিসেবে ছিলেন এ হাশেম, দ্বিতীয় ক্রীড়া সমিতি হলো ইস্ট পাকিস্তান ব্যাডমিন্টান এসোসিয়েশন, যার সভাপতি এবং সেক্রেটারির দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে সিরাজউদ্দিন এমপিএ এবং মাজেদ আলী আর তৃতীয় ক্রীড়া সমিতিটি ছিল ইস্ট পাকিস্তান সুইমিং এসোসিয়েশন, যার সভাপতি হয়েছিলেন এসএ মোহসিন এবং সেক্রেটারি হয়েছিলেন এবিএম মুসা।
নতুন তিনটি এসোসিয়েশনসহ পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গনে মোট ১৬টি গেমস এসোসিয়েশন গঠিত হয়েছিল। পূর্বেরগুলো হলো- টেবিল টেনিস, রোয়িং, বক্সিং, রেসলিং, সাইক্লিং, ওয়েটলিফটিং, জিমন্যাস্টিকস, বডিবিল্ডিং, কাবাডি, লনটেনিস, অ্যামেচার অ্যাথলেটিক্স, ন্যাশনাল রিক্রিয়েশন এবং চ্যানেল ক্রসিং। এই ক্রীড়া সমিতিগুলোর নিবন্ধন বা এফিলিয়েশনের জন্য অল পাকিস্তান ফেডারেশনের কাছে আবেদন করা হয়েছিল এবং প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের জন্য ও অনুরোধ করা হয়েছিল।
অবশেষে ফুটবল সাব-কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়েছিল ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন। ৭টি ক্লাবের দাবি ছিল ফুটবল লিগ খেলার সব অংশগ্রহণকারী দলের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি লিগ অর্গানাইজিং কমিটি গঠন করে তার মাধ্যমে ফুটবল লিগ পরিচালনা করার। ইপিএসএফ অর্গানাইজিং কমিটি গঠন করার সুযোগ নেই বলে তাদের দাবি রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দিয়েছিল, সেই সাথে একটি সাব-কমিটি গঠন করার আশ্বাস দিয়ে লিগ চালু রেখেছিল। সে আশ্বাসটাও যখন পূরণ হচ্ছিল না, তখন ৭টি ক্লাব আবারও লিগ বর্জনের হুমকি দিয়েছিল এবং ১১-১৪ জুন ’৬৭ খেলা বন্ধ রাখারও দাবি করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে খেলা বন্ধ রেখে ইপিএসএফের গভর্নিং বডি জরুরি সভায় মিলিত হয়ে লিগ খেলায় অংশগ্রহণকারী সব ক্লাবের (১৩ জন) প্রতিনিধি এবং সমানসংখ্যক ইপিএসএফ প্রতিনিধি নিয়ে একটি  ফুটবল সাব-কমিটি গঠন করে তার মাধ্যমেই লিগ খেলা চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। এ সমস্যার সমাধান হয়েছিল শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে যুক্ত ছিল ক্রীড়া। শিক্ষামন্ত্রীকে ৭টি ক্লাবের কর্মকর্তাদের ফুটবল লিগ সচল রাখার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী ইপিএসএফের সভাপতি এবং সেক্রেটারিকে ডেকে নিয়ে এরকম ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। ফুটবল লিগ চলার ক্ষেত্রে সব প্রতিবন্ধকতার অবসান ঘটে গিয়েছিল এবং পুনরায় ফুটবল মাঠে গড়িয়েছিল ৫ জুলাই। প্রথমার্ধের ১ গোলে পিছিয়ে পড়া ওয়ান্ডারার্স এবং পুলিশ টিমের খেলা দিয়ে। যদিও ওয়ান্ডারার্স বিরতির পর প্রতিঘাত হেনে পুলিশকে ৩-১ গোলে পরাজিত করেছিল। নিঃসন্দেহে পুলিশের চেয়ে ওয়ান্ডারার্স শক্তিশালী টিম কিন্তু খেলার চতুর্থ মিনিটে বাম প্রান্ত থেকে নুরুর লবকে চমৎকার হেডের সাহায্যে এরশাদ গোল করে তাদের চমকে দিয়েছিল। সর্বাত্মক চেষ্টা করেও ওয়ান্ডারার্স গোল শোধ না করার জ্বালা নিয়ে বিরতিতে গিয়েছিল। মাঠে ফিরে এস তারা সম্মিলিত আক্রমণ দ্বারা পুলিশকে কোণঠাসা করে রেখে ১০ মিনিটেই সাদেকের দেয়া বল থেকে লেফট আউট তসলিম গোল করে ওয়ান্ডারার্সকে ১-১ গোলের সমতায় ফেরায়। ২৫ মিনিটে অফসাইড বিতর্কের গোলে মন্টু, দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে নিয়েছিল খেলা শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে সে আরও এক গোল করে  ওয়ান্ডারার্সকে ৩-১ গোলের জয় এনে দিয়েছিল।
ইপিআইডিসি তাদের স্বাভাবিক খেলার ছন্দে ফিরতে দেরি হওয়ার সুযোগে রহমতগঞ্জ ২ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল ৬ জুলাই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত লিগের দু’দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলায়।
প্রথম পর্বে ইপিআইডিসি রহমতগঞ্জকে ১-০ গোলে হারিয়েছিল। খেলার প্রথমার্ধ ছিল রহমতগঞ্জের দখলে, তারা পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে ইপিআইডিসিকে চাপের মধ্যে রেখেছিল। খেলা বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং উপভোগ্য হলেও মাঝেমধ্যে ছন্দপতন ঘটেছিল দু’দলের শক্তি প্রয়োগ করে খেলার জন্য। তবে রেফারি শক্ত হাতে খেলা নিয়ন্ত্রণের কারণে সেরকম বিশৃংখলার সৃষ্টি হতে পারেনি। তাছাড়াও হঠাৎ বৃষ্টির আগমনে খেলোয়াড়দের খেলায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটালেও প্রেস বক্সে দর্শক ঢুকে সাংবাদিকদের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল বেশি, যার জন্য সাংবাদিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।
রহমতগঞ্জের লেফট আউট নয়া চমৎকার দুটি গোল করে স্টেডিয়ামে উপস্থিত সবাইকে চমকে দিয়েছিল আর এ দুটো গোলের উৎস ছিল বেলাল। খেলার ২৫ মিনিটে বেলালের নিখুঁত একটি থ্রু পাসে নয়া প্রথম গোল করেছিল এবং খেলার বিরতির বাঁশি বাজার আগ মুহূর্তে বেলালের সুন্দর একটি পাশ ধরে নয়া তার দ্বিতীয় গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল।
বিরতির পরও রহমতগঞ্জ তাদের আক্রমণধারা অব্যাহত রেখে নয়ার হ্যাটট্রিকের সুযোগ করে দিয়েছিল। গফুরের ক্রস বেলাল এবং নয়ার মধ্যে বল ধরার ভুল বোঝাবুঝির সুযোগে গোলরক্ষক হাকিম ছুটে এসে বল নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। দ্বিতীয়ার্ধের ১০ মিনিটের সময় জব্বরের বুলেট শট গোলরক্ষক অনাথের গ্রিপ থেকে ছুটে গিয়ে কাছেই দাঁড়ানো গাজীর কাছে গেলে সে বল জালে জড়াতে দেরি করেনি (১-২)। ইপিআইডিসি ধীরে ধীরে খেলার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের মধ্যে নিয়ে নেয় এবং আক্রমণের ধার বেড়ে যায়, যার ফলে গাজী প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে দুর্দান্ত শটে অনাথকে পরাস্ত করে ২-২ গোলের সমতায় ফেরায় দলকে। রহমতগঞ্জ এই রেজাল্ট ধরে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যায় কিন্তু ইপিআইডিসির গোল ক্ষুধাকে নিবৃত্ত রাখা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়ে ওঠেনি। খেলার প্রায় অন্তিম মুহূর্তে সলিমউল্লাহ ডান প্রান্ত থেকে উঁচু করে ক্রসটিকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ওপরে উঠে আসা স্টপার গফুর বালুচ হেড করে বল জালে জড়িয়ে দিয়ে ৩-২ গোলে ওয়ান্ডারার্সকে জয়ের আনন্দে ভাসিয়ে দিয়েছিল।
ইপিআইডিসির খেলোয়াড় : হাকিম (গোলরক্ষক), নুরুল আমিন, গফুর বালুচ এবং আমিন, লাল মোহাম্মদ এবং আলী হাফিজ, সলিমউল্লাহ, প্রতুল, হাশেম, জব্বার ও গাজী। 
রহমতগঞ্জ : অনাথ (গোলরক্ষক), ফারুক, গাউস এবং লালু, কায়কোবাদ, এবং নাজির, শাজাহান, সুলতান, বেলাল, গফুর ও নয়া।
আজাদ পিডব্লিউডিকে ২ গোলের চমক দিয়েছিল সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায়। প্রথম পর্বে দু’দল গোলশূন্য ড্র করেছিল। আজাদের জয়কে ‘ফ্লুক’ বলা যাবে না। তাদের জয়ের আকাক্সক্ষা দৃঢ়তা এবং মাঠে জয়ের জন্য খেলাই তাদেরকে এই জয় উপহার দিয়েছে। খেলার ২৪ মিনিটে তাদের দলের দীর্ঘকায় খেলোয়াড় মোবাশ্বের গোল করে এগিয়ে দিয়েছিল আর বিরতির পর সেটাকে দ্বিগুনণ করে দিয়েছিল লেফট-ইন জগলুল। পিডব্লিউডি সহজভাবেই এই হারকে মেনে নিয়েছিল। কোনপ্রকার অঘটন ছাড়াই খেলা শেষ হয়েছিল। #    (ক্রমশ.)

(১০১)
৭ জুলাই-এর খেলায় ওয়ারীর জয় অপ্রত্যাশিত ছিল না, শুরু থেকেই তারা প্রতিপক্ষ স্টেশনারির বিরুদ্ধে ভাল খেলেছিল। তবে তাদের আক্রমণটা ছিল অগোছালো এবং স্কোরারের অভাবে তারা বেশি গোল পায়নি, জিতেছিল মাত্র ২-১ গোলে। খেলার ৩০ মিনিটে মাহমুদের ক্রসে জামিল আক্তার গোলরক্ষক প্যাট্রিককে পরাজিত করে ওয়ারীকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। বিরতির পরই সেটা দ্বিগুণ করার সুযোগ এসেছিল। তপন চৌধুরীর পাস নিশিথের কিকটি চমৎকারভাবে সেভ করেছিল প্যাট্রিক। দ্বিতীয়ার্ধের ২০ মিনিটে স্টেশনারির রাইট আউট রফিকের নিখুঁত পাস ধরে সেন্টার ফরোয়ার্ড ইলিয়াসকে ওয়ারীর জালে বল জড়াতে কোন অসুবিধা হয়নি (১-১)। তারপর দু’টিমই লিড নেয়ার জন্য খেলে; তবে খেলার অন্তিম মুহূর্তে ভুট্টোর গোলে ওয়ারীই বিজয়ের (২-১) হাসি নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল।
ওয়ান্ডারার্স খেলার দ্বিতীয়ার্ধের চার গোল করলেও প্রেসম্যানদের সান্ত্বনা ছিল যে, তারা শক্তিশালী বিপক্ষকে প্রথমার্ধে কোন গোল করতে দেয়নি, ওয়ান্ডারার্সকে গোলশূন্য ড্র রাখতে বাধ্য করেছিল। প্রথম পর্বে ওয়ান্ডারার্স ৪-১ গোলে জিতেছিল। ৯ জুলাই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত খেলায় প্রেস দল ভাল খেলা দিয়ে শুরু করেছিল এবং দুটো সুযোগও এসেছিল গোল করে এগিয়ে যাওয়ার। ৪ এবং ৯ মিনিটে তাদের জোরালো আক্রমণে ওয়ান্ডারার্স ‘ভড়কে’ গিয়েছিল। প্রথমটি প্রেসের সেন্টার ফরোয়ার্ড খালেকের দুর্দান্ত শট গোলরক্ষক সান্টুকে পরাস্ত করলেও ক্রসবারে তা প্রতিহত হয়েছিল; আর দ্বিতীয়টি তাদের লেফট আউট সামাদ গোলরক্ষককে একা পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হয়ে সুবর্ণ সুযোগটি হাতছাড়া করেছিল।
বিরতির পর ওয়ান্ডারার্স নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে খেলতে থাকে এবং ১২ মিনিটেই এর সুফল পেয়ে যায়। ধরের কর্নার কিক থেকে ইসমাইল রুশো গোল করে দলকে ১-০ এগিয়ে দেয়। এরপরই আনসারের বানিয়ে দেয়া পাসে লেফট আউট তসলিম সেটাকে দ্বিগুণ করে দেয়। পরে প্রেস একটি সহজ সুযোগ নষ্ট করলেও তাদের ফুলব্যাক আজব আলী ওয়ান্ডারার্সকে একটি গোল উপহার দিয়েছিল আত্মঘাতী গোল করে। আর তসলিম সেটাকে হালিতে পূর্ণ করে দলকে ৪-০ গোলের জয় এনে দিয়েছিল।
ইপিজি প্রেস রহমতগঞ্জকে ড্র করতে বাধ্য করেছিল আর সমান তালে লড়াই করে রহমতগঞ্জের সমান ২ গোল করেছিল। ৭ দলের দাবিতে দু’দিন খেলা বন্ধ থাকায় ১৩ জুলাই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এই খেলায় উল্লেখযোগ্য দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন এবং খেলাটাও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়েছিল। দু’দলই জয়ের জন্য আগাগোড়া আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে বেশ জমিয়ে তুলেছিল খেলা। রহমতগঞ্জ খেলার ৭ মিনিটে শাহজানের কর্নার কিকে লেফট আউট নয়া মাখনকে পরাস্ত করে গোল করলেও তা প্রেসের রাইট ইন সুভাষ পরক্ষণেই একক প্রচেষ্টায় রহমতগঞ্জের সীমানায় ঢুকে দুর্দান্ত শটের মাধ্যমে অনাথকে পরাস্ত করে ১-১ গোলের সমতা এনে দিয়েছিল। বিরতির পর মোটামুটি একটি ফুটবল-যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। খেলার সব রকম পন্থা অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছিল। আক্রমণ যেমন ছিল, তেমনি রাফ এবং টাফ ট্যাকলিংও ছিল। দু’দলের মুখও বন্ধ ছিল না। এমনি যখন খেলার অবস্থা, তখনই প্রেসের স্টপার ওসমান নিজেকে সামলাতে না পেরে রহমতগঞ্জের রাইট ইন শাজাহানকে পেনাল্টি বক্সের ভেতর অবৈধভাবে ফেলে দিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনে। রাইটব্যাক ফারুক পেনাল্টি কিকের সফল ব্যবহার করে দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দেয় কিন্তু প্রেসের সুভাষ আবারও কর্নার কিক থেকে চমৎকার হেডের সাহায্যে গোল করে দলকে পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে ২-২ গোলের সমতা এনে দিয়েছিল।
ভিক্টোরিয়া পুলিশকে ৩ গোলে পরাজিত করলেও প্রথমার্ধে মাত্র ১ গোল করতে সমর্থ হয়েছিল। প্রথম পর্বে তারা ৪-১ গোলে হারিয়েছিল পুলিশকে। পুলিশ চমৎকার খেলা দিয়ে শুরু করেছিল। ১৪ জুলাই তাদের লিগের খেলা সীমিত শক্তি দিয়ে গড়ে তুলেছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতাÑ যা শক্তিশালী ভিক্টোরিয়াকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। তাদের ফরোয়ার্ডদের ভিক্টোরিয়ার পোস্টে বল মারার জড়তা এবং পোস্টের বাইরে এলোমেলো কিক তাদেরকে সফলতা এনে দিতে পরেনি। তাছাড়া তাদের রক্ষণও ছিল সজাগ, যার জন্য ভিক্টোরিয়া তিনটি গোলের বেশি করতে পারেনি।
খেলার ৮ মিনিটে ভিক্টোরিয়ার ইউসুফ একটি সহজ গোল করতে ব্যর্থ হওয়ার পর দু’দল গোল করার জন্য চেষ্টা চালাতে গেলে খেলা বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। বিরতির আগ মুহূর্তে ভিক্টোরিয়া সেন্টার ফরোয়ার্ড আলী ইমামের চমৎকার একটি থ্রু পাসে লেফট-আউট টিপু গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল।
বিরতির পর ভিক্টোরিয়া নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ঝালিয়ে নিয়ে খেলতে থাকলে ইউসুফ খেলার শুরুতে গোল করার যে ব্যর্থতা দেখিয়েছিলÑ তা এবার পুষিয়ে দিয়েছিল ইউনুসের কাছ থেকে বল পেয়ে সুন্দর একটি গোল করে। ভিক্টোরিয়া ২-০ গোলে এগিয়ে গেলেও পুলিশ গোল শোধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে থাকে। ফলে খেলা একপেশে হয়ে ওঠেনি, যদিও খেলা শেষের দিকে আলী ইমামের মাপা পাসে লেফট-ইন খালেদ গোল করে ভিক্টোরিয়াকে ৩-০ গোলের জয় নিশ্চিত করে দিয়েছিল। মোহমেডান ৩-০ গোলের সহজ জয় পেয়েছিল আজাদের বিপক্ষে আর সবগুলো গোলই হয়েছিল খেলার প্রথমার্ধে। প্রথম পর্বে আজাদ হেরেছিল ২-০ গোলে। নিঃসন্দেহে মোহামেডান শক্তিশালী দল; তবে ১৬ জুলাই স্টেডিয়ামে সেটার প্রমাণ মেলেনি। তারা তাদের মান অনুযায়ী খেলা প্রদর্শন করতে পারেনি। খেলার গতি, দলীয় সমঝোতা, গোল করার স্পৃহাÑ সবকিছুরই অভাব ছিল সেদিনের খেলায়। খেলা ছিল অনেকটা ঢিলেঢালা। আজাদ মোহামেডানকে বিপদে ফেলতে না পারলেও তাদের প্রতিটি খেলোয়াড় ভাল খেলার সাধ্যমত চেষ্টা করেছে।  খেলার ১০ মিনিটের মধ্যেই সেন্টার ফরোয়ার্ড হাফিজুদ্দিনের মাপা পাসে মুসা দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। মিনিটখানেক পরই হাফিজউদ্দিন সেটাকে দ্বিগুণ করে এবং তৃতীয় গোলটিও হাফিজ উদ্দিন করেছিল তার একক প্রচেষ্টায়। মধ্যমাঠ থেকে বল নিয়ে বিপক্ষ সীমানায় ঢুকে সজোরে কিক করে এহতেশামকে পরাস্ত করেছিল। বিরতির পর আজাদের রক্ষণ দৃঢ়তার সাথে খেলে মোহামেডানকে আর গোল করতে দেয়নি। অন্যদিকে মোহামেডানও গোল করার প্রতি সেরকম আগ্রহ দেখায়নি, প্রথমার্ধের ৩-০ গোলের সন্তুষ্টি নিয়েই শেষ পর্যন্ত মাঠ ছেড়েছিল।
ভিক্টোরিয়া তাদের ১৬ জুলাইয়ের খেলায়  প্রেসকে ৬-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল। বিরতির পূর্বে তারা ২-০ গোলে এগিয়ে ছিল। প্রথম পর্বে তারা জিতেছিল ৪-০ গোলে। প্রেসম্যানরা হারার আগেই হেরে বসেছিলÑ এরকম মনের অবস্থা নিয়ে খেলতে নেমেছিল। ভিক্টোরিয়া খেলা শুরু হওয়ার পরই মাঠের নিয়ন্ত্রণ তারা নিয়ে নেয় এবং ৮ মিনিটেই ইউনুসের পাসে খালেদের গোলে এগিয়ে যায় (১-০)। গোল করার পর ভিক্টোরিয়া খেলাটাকে হাল্কাভাবে নিয়েছিল, যার জন্য গোল করার সেরকম তাগিদ ছিল না বরং ১৮ মিনিটে উল্টো একটা গোল খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছিল যখন, রাইট আউট ভানুর একটি ক্রস চিত্ত ধরে গোলরক্ষককে একা পেয়েও জঘন্যভাবে গোল করতে ব্যর্থ হয়েছিল। 
বিরতির পর ভিক্টোরিয়া নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে পুরোদমে খেলায় ফিরে আসে এবং সংঘবদ্ধ আক্রমণ করে প্রেসকে বেসামাল করে তোলে। ১০ মিনিটেই ইউনুস দলের তৃতীয় গোল করলে ২২ মিনিটে টিপু সেটাকে হালিতে পূর্ণ করে (৪-০)। খেলা শেষ হওয়ার আগে ইউসুফ পঞ্চম গোল করে এবং খেলার শেষ বাঁশি বাজার আগ  মুহূর্তে প্রেসেরই উশান নিজের গোলে গোল করে ভিক্টোরিয়ার গোলসংখ্যাকে অর্ধডজনে (৬-০) পৌঁছে দিয়েছিল।
রহমতগঞ্জ পুলিশকে একমাত্র গোলে পরাজিত করেছিল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ১৭ জুলাই-এর খেলায়। সমমানের দুটি টিমের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল রাইট ইন শাজাহানের দ্বিতীয়ার্ধের দেয়া গোলের মাধ্যমে। প্রথম পর্ব দু’দল ১-১ ড্র করেছিল। দু’টিমের মধ্যে রহমতগঞ্জ কিছুটা এগিয়ে থাকলেও পুলিশ প্রতিপক্ষ দল হিসেবে সবরকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মত শক্ত দল। বিরতির পূর্বেই রহমতগঞ্জ দু’গোলে এগিয়ে যেতে পারতো কিন্তু শাহজাহান সুলতানের বানিয়ে দেয়া অত্যন্ত সহজ গোল বাইরে মেরে মিস করেছিল। দ্বিতীয়টি শাজাহানের স্বার্থপরতায় মিস হয়েছিল যখন সুলতান গোল করার জন্য একটি ভাল পজিশনে থাকা সত্ত্বেও শাজাহান তাকে বল না দিয়ে নিজেই গোলপোস্টের বাইরে মেরে দেয়। ২৩ মিনিটে সুলতানের কিক ক্রসবারে প্রতিহত হয়ে মাঠে ফিরে এসেছিল। পুলিশ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে রহমতগঞ্জের আক্রমণকে সামাল দিয়ে তারাও আক্রমণ করেছিল। তবে সেগুলো জোরালো যেমন হয়নি, তেমনই সফলতা পায়নি। 
বিরতির পর দুই টিমই জেতার জন্য মাঠে নেমেছিল এবং পূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছাড়ার একটা জেদ তাদের খেলার মধ্যে দেখা যাচ্ছিল। এ লড়াইয়ে রহমতগঞ্জ ভাগ্যে কিছুটা আনুকূল্য লাভ করেছিল বলেই শাজাহান প্রথমার্ধে যে সহজ গোল মিস করেছিল, সেই গোল করে ক্ষতিপূরণটা পুষিয়ে দিয়েছিল। লেফট আউট নয়া বাম প্রান্ত থেকে সেন্টার ফরোয়ার্ড সুলতানের উদ্দেশে পাস দিলে সুলতান সেটাকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বানিয়ে দিয়েছিল শাজাহানকে। শাজাহান এবার আর ভুল করেনি, জালে জড়িয়ে দলকে এগিয়ে দিয়েছিল ১-০ গোলে। খেলার বাকি প্রায় বিশ মিনিট পুলিশ মরিয়া হয়ে ছিল গোল শোধ করার জন্য কিন্তু রহমতগঞ্জের শক্ত রক্ষণ আরও শক্ত দেয়াল তৈরি করে দিয়ে পুলিশের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রহমতগঞ্জ ১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল। #
(ক্রমশ.)

(১০২)
জাব্বারের কৃতিত্বপূর্ণ হ্যাটট্রিকের সুবাদে ইপিআইডিসি তাদের ১৮ জুলাইয়ের খেলায় আজাদকে ৫-২ গোলে পরাজিত করেছিল। প্রথম পর্বে তারা ১-০ জয়ী হয়েছিল। খেলার ফলাফল দেখে মনে হতে পারে যে, শক্তিশালী ইপিআইডিসি দল আরো অধিক গোলে জয়লাভ করতে পারতো। কিন্তু মাঠের চিত্র ছিল ভিন্ন। আজাদ সেদিন অত্যন্ত ভাল খেলেছিল। তাদের প্রত্যেকটি খেলোয়াড় দৃঢ়তার সাথে খেলে ইপিআইডিসিকে শুধু বেশি গোলই করতে দেয়নি বরং তারাও আক্রমণ চালিয়ে সফলও হয়েছিল। তবে তাদের দুর্ভাগ্য যে, তারা খেলার শুরুতেই দু’গোল খেয়ে ফেলেছিল; নইলে খেলাটি আরো আকর্ষণীয় হতে পারতো। 
ইপিআইডিসির সেন্টার ফরোয়ার্ড আসলাম খেলা আরম্ভ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই পরপর দু’গোল করে দলকে চাপমুক্ত করে দেয়। পরমুহূর্তেই আজাদ গোল করার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে সবাইকে হতাশ করে দিয়েছিল। পেনাল্টি বক্সের ভেতর গফুর বেলুচ অবৈধভাবে আবুলকে ফাউল করলে আজাদ পেনাল্টি লাভ করেছিলÑ যা লম্বু কাজী মোবাশ্বের আকাশে উড়িয়ে দিয়েছিল। গফুর বেলুচ আজাদকে এবার একটি গোল গিফ্ট করেছিল। আজাদের মন্টু ইপিআইডিসির গোলপোস্টে সজোরে কিকটি গফুর বেলুচ আটকাতে গেলে বলের দিক পরিবর্তন হয়ে গোলরক্ষক হাফিজের পাশ কাটিয়ে জালে জড়িয়ে যায় (২-১)। ২৩ মিনিটে জব্বর তার বাঁ পায়ের জোরালো শট দ্বারা আজাদের গোলরক্ষক এহতেশামকে বিট করলে আসলামের হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনাকে ভেঙ্গে দিয়ে দলকে ৩-১ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। বিরতির আগ মুহূর্তে আজাদের দেবু তার একক প্রচেষ্টায় গোল করে খেলায় উত্তেজনা ছড়িয়ে দিয়েছিল (৩-২)। বিরতির পর ইপিআইডিসি তাদের আক্রমণ জোরদার করে এবং আজাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আর এ চাপেই জব্বরের হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা বেড়ে যায় যখন প্রতুলের চমৎকার পাস থেকে সে তার দ্বিতীয় গোল করে (৪-২)। জব্বরের হ্যাটট্রিকের জন্য তার সহযোগী খেলোয়াড়রা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে এবং আসলাম যার হ্যাটট্রিকের আশাভঙ্গ করেছিল জব্বার, সেই আসলামের দেয়া বল আয়ত্তে নিয়ে বা পায়ের নিখুঁত শটে এহতেশামকে বল ধরার কোন সুযোগ না দিয়ে তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল আর ইপিআইডিসি জয়লাভ করেছিল ৫-২ গোলে। 
১৯ জুলাই মোহামেডান রহমতগঞ্জকে ২-০ গোলে পরাজিত করে তাদের জয়ের চাকাকে সচল রেখেছিল। প্রথমার্ধে চ্যাম্পিয়নদের কোন গোল করতে দেয়নি; সেজন্য রহমতগঞ্জ কৃতিত্বের দাবি করতে পারে। প্রথম পর্ব তারা হেরেছিল (৩-১) গোলে। মোহামেডান সেদিনের খেলায় বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিল। তারা ভাল খেলেছে, আক্রমণ করেছে, গোল করার চেষ্টাও করেছে কিন্তু বিপক্ষ গোলমুখ খুঁজে পায়নি। অন্যদিকে রহমতগঞ্জ দৃঢ় মনোবল নিয়ে খেলে বিশেষ করে তাদের রক্ষণ অত্যন্ত ভাল খেলে মোহামেডানের আক্রমণগুলোকে সফল হতে দেয়নি বরং দুটো গোলের সুযোগ সৃষ্টি করেও ভাগ্যের সহায়তা না পেয়ে গোলবঞ্চিত হয়েছিল।
খেলা শুরুর প্রথম মিনিটেই মোহামেডান লিড নিতে পারতো কিন্তু মুসার সহজ গোল মিস সেটা হতে দেয়নি। চার মিনিট পর রহমতগঞ্জ মোহামেডানকে একটা হুমকি দিয়েছিল নয়া-শাজাহান এবং নাজিরের সম্মিলিত আক্রমণের ফসল হিসেবে গোলরক্ষক রানাকে একা পেয়ে। শাজাহান বল বাইরে মেরে মোহামেডান শিবিরকে চিন্তামুক্ত করেছিল।
আবারও রহমতগঞ্জ মোহামেডানের সীমানায় হানা দিয়েছিল এবার সুলতানের বুলেট শটটি ক্রসবার ছুঁয়ে চলে যায়। এর পরপর লেফট-ইন গফুরের জোরালো কিকটি ও পোস্টে প্রতিহত হয়ে খেলায় ফেরত চলে আসে। একটি টিমের এতগুলো সুযোগ হাতছাড়া হলে সে টিম কতক্ষণ ভাগ্যের সাথে লড়তে পারে? অন্যদিকে মোহামেডান গোল করার সব কৌশল প্রয়োগ করেও গোল করতে পারেনি।
বিরতির পর দু’টিমই জয় পাবার উদ্দেশ্যে মাঠে নামে এবং গোল করার জন্য আক্রমণ চালিয়ে খেলাটাকে প্রাণবন্ত করে তোলে। এরকম খেলার ধারা চলাকালে মোহামেডান একটি ফ্রি-কিক পায়। গফুরের মারা অত্যন্ত গতিসম্পন্ন শট মুসার মাথা ছুঁয়ে বলের গতি পরিবর্তন করে গোলরক্ষক অনাথকে বোকা বানিয়ে গোলটি নিজের করে নিয়েছিল, সেই সাথে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। এরপর প্রতাপের একটি নিখুঁত পাসে রসুল বখশ আরও একটি গোল করলে মোহামেডান শিবির হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। খেলার শেষ বাঁশি বাজার আগেও রহমতগঞ্জ আক্রমণ চালিয়ে মোহামেডাননকে অস্থির করে রেখেছিল এবং শেষ সুযোগটিও নাজির রানাকে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হওয়ায় মোহামেডানকে ২-০ গোলের জয় নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। 
সেদিন যারা খেলেছিল
মোহামেডান : রানা (গোলরক্ষক), জহির, তোরাব আলী এবং পিন্টু, কাদের এবং গফুর, প্রতাপ, রসুল বখশ, হাফিজউদ্দিন, বশীর এবং মুসা।
রহমতগঞ্জ : অনাথ (গোলরক্ষক), ফারুক, গাউস এবং হাসনাত, লালু এবং কায়কোবাদ, নাজির, শরফুদ্দিন, সুলতান, গফুর এবং নয়া মিয়া।
আজাদ স্পোর্টিং ১-০ গোলে পুলিশকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল আর জয়সূচক গোলটি করেছিল দেবু দ্বিতীয়ার্ধের ২৪ মিনিটে। প্রথম পর্ব দু’টিম ১-১ গোলে ড্র করেছিল এবং এ পর্বেও খেলটি যদি ড্র হতো, তাহলে ফলাফলটি যথাযথ হতো। ২০ জুলাই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত অল্পসংখ্যক দর্শকের উপস্থিতিতে দু’টিম যে খেলা খেলেছিলÑ সেটার উল্লেখযোগ্য কোন ঘটনাই এখানে তুলে ধরার মত নয়। সাদামাটা খেলা, মাঝেমধ্যে দু’টিমের গোলপোস্টে এলোমেলো শট, নিশানা ভঙ্গ, পুলিশের দুর্ভাগ্য যে, তাদের মারা বল জালে জড়ায়নি আর আজাদের সৌভাগ্য যে দেবুর শটটি জালে জড়িয়ে আজাদকে পূর্ণ পয়েন্ট লাভের সুযোগ এনে দিয়েছিল।
লিগের প্রথম পর্বে ৯-১ গোলে জয়ী দল দ্বিতীয় পর্বে এসে হাফ টাইম পর্যন্ত গোলশূন্য ড্র, কেমন জানি বেমানান লাগছিল আর সেটাই ঘটেছিল ২১ জুলাই তারিখে ইপিআইডিসি বনাম প্রেসের খেলায়। শক্তিশালী ইপিআইডিসি দ্বিতীয়ার্ধে প্রেসকে ৬-০ গোলে বিধ্বস্ত করলেও খেলার মাঠের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল রেফারি মুনীর হোসেন ইপিআইডিসি দলের প্রতুল এবং প্রেসের সেন্টার ফরোয়ার্ড সেলিমকে মাঠ থেকে বহিষ্কার করা। হাফ টাইমের মিনিটখানেক আগে তারা মারাত্মক ফাউল এবং মারামারিতে লিপ্ত হওয়ার শাস্তি। পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশনের নতুন আইন অনুযায়ী বহিষ্কৃত খেলোয়াড়কে তিন মাসের জন্য খেলা থেকে বিরত থাকতে হতো।
প্রথমার্ধে প্রেস শুধু ভাল খেলেনি বরং ইপিআইডিসিকে গোল দেয়ার মত ক্ষেত্রও বেশ ক’বার তৈরি করেছিল, যদিও কোন অঘটন ঘটাতে পারেনি। 
বিরতির পর মাঠের চিত্র পাল্টে যায়। ইপিআইডিসি খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সারামাঠ জুড়ে খেলতে থাকে, প্রেসের রক্ষণভাগ যারা এতক্ষণ দৃঢ়তার সাথে ইপিআইডিসির আক্রমণ মোকাবেলা করেছিল, এতটুকু ছাড় দেয়নি তাদেরকে মাঠে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। বিপক্ষ দলের মুহুর্মুহু আক্রমণে তারা অনেকটা বেসামাল হয়ে পড়েছিল। রাইট-আউট সলিমউল্লাহ পাঁচ মিনিটেই গোল করে দলকে (১-০) এগিয়ে দেয়। আর আসলাম সেটাকে দ্বিগুণ করে। ১৭ মিনিটে জব্বর তৃতীয় গোল করলে সলিমুল্লাহ তার দ্বিতীয় এবং দলের চতুর্থ গোল করে। জব্বর দলের পঞ্চম গোল  করে এবং সলিমুল্লাহ তার তৃতীয় গোল করলে তার দল ইপিআইডিসি অর্ধডজন গোলে (৬-০) জয়লাভ করেছিল।
ফায়ার সার্ভিস ১৮ মিনিটে দুই গোল করে মোহামেডানকে ভড়কে দিয়েছিল। ২২ জুলাই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত শেষ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ খেলায় দুই গোল খেয়ে চ্যাম্পিয়নরা চাপের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, বিশেষ করে প্রথম পর্বের খেলায় ফায়ার ২-২ গোলে ড্র করেছিল; সুতরাং মানসিকভাবে মোহামেডানের খেলোয়াড়দের দুর্বল হওয়াটাই স্বাভাবিক।
খেলার ১০ মিনিটে কর্নার কিকের বল ফায়ার সার্ভিসের মুনীর হেড করলে বল মোহামেডানের ক্রসবারে লেগে খেলায় ফিরে আসে এবং শরফুদ্দিন সেটাকে পোস্টে পাঠিয়ে দিয়ে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। চ্যাম্পিয়নরা আবারও চমকে উঠে যখন বাম প্রান্ত থেকে আমানের উড়ে আসা বলকে ফায়ারের রাইট আউট মুনীর দর্শনীয় হেডের সাহায্যে বলকে জালে জড়িয়ে দিয়েছিল (২-০)। দু’গোল খেয়ে চ্যাম্পিয়নদের যেন মান-সম্মানে আঘাত লেগেছিল, তারা তাদের স্বাভাবিক খেলায় ফিরে এসে সম্মিলিত আক্রমণ চালাতে থাকে এবং ২৫ মিনিটে তোরাব আলী ফায়ারের জাল খুঁজে পেয়েছিল আমারই দেয়া লবের বল দ্বারা। বিরতির আগ মুহূর্তে মোহামেডান সমতায় ফিরেছিল আমারই দেয়া একটি নিখুঁত থ্রু পাসকে শামসুর গোলের মাধ্যমে।
বিরতির পর মোহামেডানের আক্রমণের ধার বেড়ে যায়। খেলার গতি বেড়ে যায়- তাল মেলাতে গিয়ে ফায়ারম্যানরা অনেকটা বেসামাল হয়ে পড়ে, সে সুযোগেই দ্বিতীয়ার্ধের পাঁচ মিনিটেই মোহামেডান ৩-২ গোলের লিড নিয়েছিল হাফিজুদ্দিনের মাধ্যমে এবং তৃতীয়বারের মত এই গোলেরও কারিগর আমি। আমার পাশ থেকেই গোল করতে হাফিজুদ্দিনের কোন অসুবিধা হয়নি, দলের চতুর্থ গোলটিও করেছিল হাফিজুদ্দিন। দলের এত গোলের মধ্যে মুসার কোন স্কোর থাকবে নাÑ এটা কি মেনে নিতে পারে মুসা? ফায়ারের বিরুদ্ধে মোহামেডানের ৬-২ গোলের জয়ের পঞ্চম এবং ষষ্ঠ গোল করে স্কোরারের লিস্টে নাম লিখিয়েছিল মুসা।

প্লেয়ার লিস্ট
মোহামেডান : রানা (গোলরক্ষক), জহির, তোরাব আলী, পিন্টু, কাদের ও গফুর, জাল্লু, হাফিজুদ্দিন, শামসু, বশীর ও মুসা।
ফায়ার সার্ভিস : সীতাংশু (গোলরক্ষক), মজিবুর, আইনুল ও ইলিয়াস, দিপু ও আবুল, মুনীর, শরফুদ্দিন, আশরাফ ও আমান। 
ভিক্টোরিয়ার ১-০ গোলের ওয়ারীর বিরুদ্ধে কষ্টার্জিত জয় এবং উইনিং গোলটি করেছিল রাইট-উইং ইউনুস খেলার ৩১ মিনিটে যা ছিল ২৩ জুলাই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচের একমাত্র গোল। প্রথম পর্বে ভিক্টোরিয়া জিতেছিল ৩-২ গোলে। পাশাপাশি দুটো ক্লাবের সব ব্যাপারেই রেষারেষী থাকাটা স্বাভাবিক, সে অনুসারে মাঠের লড়াইটাও বেশ উত্তাপ ছড়ানো। একে অপরকে ঘায়েল করার মনোভাব এবং একে অপরকে হারানোর ইচ্ছার জন্যই খেলাটা বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। গোল করার সুযোগ দু’টিমই পেয়েছিল কিন্তু আক্রমণভাগের ব্যর্থতার জন্য ওয়ারী গোল পায়নি। তবে তাদের রক্ষণ অত্যন্ত পরিশ্রম করে খেলে ভিক্টোরিয়াকেও গোল করতে দেয়নি। দু’টিমেরই আক্রমণভাগ ছিল সেদিন ব্যর্থ, তার মধ্যেও দু’টিমের ফলাফল নির্ধারণ ইউনুসের গোলটিকে উল্লেখযোগ্য বলা যায়। গোল শোধ করার জন্য ওয়ারী মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালায় আর ভিক্টোরিয়াও গোল বাড়াবার জন্য চেষ্টা চালায়। এভাবেই একসময় রেফারি বাঁশি বাজিয়ে খেলা শেষ করলে ভিক্টোরিয়া ১-০ গোলের জয় নিয়ে হাসিমুখে টেন্টে ফিরে গিয়েছিল।
সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত অপর খেলায় পুলিশ ৬-২, গোলে স্টেশনারিকে বিধ্বস্ত করেছিল। খেলার ফলাফল স্পষ্ট করে দেয় যে, পুলিশ স্টেশনারির চেয়ে শক্তিশালী টিম হিসেবে এত গোলের ব্যবধানে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু এর পেছনে ছিল স্টেশনারির সেন্টার ফরোয়ার্ড ইলিয়াসের ইনজুরি। খেলার পাঁচ মিনিটেই ইলিয়াসের পায়ের পেশীতে টান পড়ায় সে মাঠ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং তার বদলি হিসেবে খেলতে নামে কামবিল। প্রথম খেলাতেই সে প্রমাণ করেছিল যে, সেও ভাল স্কোরার।
দলের পক্ষে যে দুটো গোল হয়েছিল, সে দুটো গোলই তার দেয়া। ফুটবলের নতুন নিয়ম অনুযায়ী শুধু ইনজুরি খেলোয়াড়ের জায়গায় অন্য খেলোয়াড়কে খেলার জন্য অনুমতি দেয়া যাবে।
পুলিশ খেলার ১২ মিনিটেই লিড নিয়েছিল তাদের লেফট-আউট গিয়াসের মাধ্যমে। ২৫ মিনিটেই সমতায় ফেরায় কামাবিল। বিরতির পূর্বেই পুলিশ ২-১ গোলের লিড নিয়েছিল পেনাল্টি পেয়ে। স্টেশনারির ডিফেন্ডার পুলিশের সেন্টার ফরোয়ার্ড নবী চৌধুরীকে পেনাল্টি বক্সের ভেতর ফেলে দিলে এবং আখতার পেনাল্টি থেকে গোল করেছিল। বিরতির দু’মিনিটে নবী চৌধুরী সেটাকে ৩-১ গোলে নিয়ে যায় এবং ১৩ মিনিটে ব্যবধান কমিয়ে ৩-২ গোল করেছিল সেই কামাবিল। নবী চৌধুরী তার দ্বিতীয় করলে দল ৪-২ গোলে এগিয়ে যায়। লেফট আউট গিয়াস দলের পঞ্চম গোল করে এবং নবী চৌধুরী সেটাকে অর্ধ ডজন করলে পুলিশ ৬-২ গোলের বড় ব্যবধানে জয়লাভ করেছিল।     (চলবে)

(১০৩)
পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক এসেম্বলির ১৮ আগস্ট ’৬৭ তারিখের অধিবেশনে বিরোধী দলের এমপি মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন চলতি ফুটবল লিগের অচলাবস্থার জন্য ইপিএসএফ-এর অব্যবস্থাকে দায়ী করেন। তার এ দাবি খন্ডন করে শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেন তার বক্তব্য পেশ করেন। তিনি হাউসকে জানান যে, ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশন এবং ফুটবল লিগে অংশগ্রহণকারী সাতটি ক্লাবের মধ্যে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিলÑ তা তিনি সমাধান করে দিয়েছেন। না হলে সাতটি ক্লাব লিগ থেকে তাদের টিম প্রত্যাহার করে নিত।
এ প্রসঙ্গে স্বতন্ত্র দলের প্রধান আসাদুজ্জামান খান বলেন, ইপিএসএফ-এর বর্তমান গঠনতন্ত্রটি অচল, কাজ চলছে না। তার মতে, ইপিএসএফ-এর কমিটি গঠন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে; সেখানে সরকারি কোন কর্মকর্তা ইপিএসএফ-এর সভাপতি থাকবেন না। তিনি বলেন, বর্তমান গঠনতন্ত্র ক্রীড়াঙ্গনে অনেক সমস্যার জন্য দায়ী। তার পরামর্শ হলো, একজন সরকারি কর্মকর্তার পরিবর্তে একজন মন্ত্রী ইপিএসএফ-এর সভাপতি হবেন।
শিক্ষামন্ত্রী আমজাদ হোসেন জনাব খানের সাথে একমত হতে পারেননি। তিনি ইপিএসএফ-এর গঠনতন্ত্র নিয়ে কারো কাছ থেকে কোন অভিযোগ পাননি যে, বর্তমান গঠনতন্ত্রটি অচল।
সিনিয়র ডেপুটি স্পিকার জমিরুদ্দিন প্রধান অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী হাউসকে আশ্বাস দেন যে, জনাব খানের পরামর্শ ভবিষ্যতে বিবেচনা করা হবে। সে সময় থেকে মন্ত্রী ইপিএসএফ-এর সভাপতি হবেন, তা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।
২৪ জুলাই আজাদ এবং ওয়ান্ডারার্সের খেলার ফলাফল স্পষ্ট করে দেয় যে, ওয়ান্ডারার্স শিবিরে অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে, যার প্রভাব মাঠে খেলার ওপর পড়ছিল। নইলে শক্তিশালী ওয়ান্ডারার্স ক্লাবকে আজাদের বিপক্ষে ৫-১ গোলের পরাজয় বরণ করতে হতো না। এ খেলায় ওয়ান্ডারার্স এক গোল-দুই গোল খেতে পারে, তাই বলে পাঁচ গোল! ওয়ান্ডারার্সের মত শক্তিশালী এবং ঐতিহ্যবাহী একটি ক্লাবের জন্য সত্যিই হতাশাজনক। পুরনো এই ক্লাবের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার মত একটি ঘটনা। তাদের খেলা দেখে মনে হয়েছে মাঠে একটি দলকে উপস্থিত থাকতে হয়, সেজন্যই তারা মাঠে হাজিরা দিতে এসেছে।
ওয়ান্ডারার্স টিমের অভ্যন্তরীণ অবস্থার সুযোগ নিয়ে আজাদ একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল আর ওয়ান্ডারার্সের খেলোয়াড়রা বাধা দেয়ার ভান করে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে যাচ্ছিল। খেলার আট মিনিটেই আজাদ গোল পেয়ে গিয়েছিল লেফট আউট বাটুর মাধ্যমে, সে প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে মেরে গোলরক্ষক ফেরদৌসকে পরাস্ত করেছিল। এর জন্য সবার প্রশংসাও সে পেয়েছিল। ওয়ান্ডারার্সের লেফট-ইন আলাউদ্দিন আজাদের গোলরক্ষক আমানকে পরীক্ষা করার একটা সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু সে গোল পোস্টের ওপর দিয়ে মেরে দেয়। এরপরই ওয়ান্ডারার্সের সেন্টার ফরোয়ার্ড ওয়াসী আজাদের গোলরক্ষককে একা পেয়েও যখন জঘন্যভাবে গোল করতে ব্যর্থ হয়েছিল, তখনই মাঠে উপস্থিত দর্শকদের কাছে ওয়ান্ডারার্সের অন্তর্কলহ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আজাদ তাদের দ্বিতীয় গোল করেছিল খেলার ২৬ মিনিটে লেফট-আউট মিন্টুর লব থেকে দেবু’র হেডের মাধ্যমে।
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা ছিল আরও হাস্যকর। আজাদ খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সারা মাঠ বিস্তার করে খেলছিল আর ওয়ান্ডারার্সের খেলোয়াড়রা মন্ত্রমুগ্ধের মত তাদের পেছনে দৌড়াচ্ছিল।  খেলার এমনি ধারা চলাকালে আজাদের ডিফেন্ডার তাদের গোলমুখে দাঁড়ানো ওয়ান্ডারার্সের লেফট-ইন  আলাউদ্দিনকে ভুল করে পাস দিলে তার সম্মুখে গোলে বল পাঠানো ছাড়া আর কোন পথ ছিল না। সেটি ছিল মাঠে হাস্যরসে ভরা ওয়ান্ডারার্সের গোল (২-১)।
এরপর ওয়ান্ডারার্স সমতায় ফেরার চেষ্টা না করে উল্টো আজাদকে মাঠ ছেড়ে দিয়েছিল আর আজাদও ওয়ান্ডারার্সের মত শক্তিশালী দলকে বাগে পেয়ে পাঁচ মিনিটে তিন গোল করে ফেলেছিলÑ যা ছিল লিগের কলংকময় একটি ম্যাচের রেকর্ড। আজাদ জিতেছিল ৫-১ গোলে। অথচ এই টিমেরই সাথে প্রথম পর্বে তারা হেরেছিল ২-১ গোলে।

প্লেয়ার লিস্ট
আজাদ : আমান (গোলরক্ষক), সিরাজ, মোবাশ্বার ও নুরুদ্দিন, অরুণ ও মানিক, দেবু, নাসিম, আবুল, বাটু ও মিন্টু।
ওয়ান্ডারার্স : ফেরদৌস (গোলরক্ষক), জিয়া, নবী বখশ ও আসলাম, রিয়াজ ও ইসমাইল রুশো, ধীরেন, আনসার, ওয়াসী, আলাউদ্দিন এবং সাদেক।
সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে খেলা ছিল রহমতগঞ্জ বনাম রেলওয়ে পাইওনিয়ারের। রহমতগঞ্জ জিতেছিল ৪-১ গোলে। খেলার প্রায় ৩০ মিনিটে নয়ার পাশে শাহজাহান গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে পাইওনিয়ার গোল করার বেশ কয়েকটা সুযোগ সৃষ্টি করেছিল আর তারই একটি সুযোগের সঠিক ব্যবহার করেছিল রাইট ইন নুরুল্লাহ। তার বুলেট শটে রহমতগঞ্জের গোলরক্ষক ইউসুফকে পরাস্ত করে। খেলায় ১-১ গোলের সমতা বেশি সময় স্থায়ী হয়নি আবারও রহমতগঞ্জের শাহজাহান রাইট-আউট পর্বতের পাস ধরে গোল করে দলকে ২-১ গোলে লিড এনে দিয়েছিল। এ গোল খেয়ে পাইওনিয়ার খেলায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, যার সুযোগে সুলতান পরপর দু’গোল করে দলের ৪-১ গোলের জয় নিশ্চিত করে দিয়েছিল।
শক্তিশালী ইপিআইডিসিকে খেলার ছয় মিনিটেই পুলিশ গোল করে ২৫ জুলাই স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত খেলাটাকে দর্শকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল আর গোলটিও হয়েছিল অদ্ভুত। পুলিশের আব্দুর রবের গোলে মারা দূরপাল্লার শটটি ইপিআইডিসির গোলরক্ষক হকিমকে ফাঁকি দিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে জালে জড়িয়ে গিয়েছিল। গোল খেয়ে ইপিআইডিসি গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে পুলিশ তাদের সীমিত শক্তি দিয়ে লিডটাকে ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়। ফলে খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়, যার জন্য দর্শকরাও খেলা দেখে মজা পাচ্ছিলেন কিন্তু পুলিশই নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল। পুলিশের আখতার নিজ পেনাল্টি বক্সের ভেতর জব্বরকে ফেলে দিলে রেফারি ননী বসাক পেনাল্টি দিতে দেরি করেননি। সেন্টার ফরোয়ার্ড আসলাম গোল করতে কোন ভুল করেনি (১-১)। খেলার প্রায় ২৫ মিনিটের সময় পুলিশের গোলমুখে জটলার ভেতর থেকে বল মেরে আসলাম দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দেয় এবং বিরতির আগ মুহূর্তে হাশিম সেটাকে ৩-১ করে দেয়।
বিরতির পর সারা মাঠজুড়ে খেলা হচ্ছিল কিন্তু উদ্দেশ্যহীনভাবে। ইপিআইডিসি অনেকটা গাছাড়া দিয়ে খেলছিল আর পুলিশ জোর আক্রমণ করেও ইপিআইডিসির শক্তিশালী ডিফেন্সকে ভাঙা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছিল না। উপরšুÍ আসলাম তার তৃতীয় গোল করলে ইপিআইডিসি ৪-১ গোলের জয় দিয়ে খেলা শেষ করেছিল।
সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে ওয়ারী প্রেসকে ৩-০ গোলে পরাজিত করেছিল। প্রেসম্যানদের দুর্ভাগ্য যে, সেদিন তারা ওয়ারীর বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারেনি; জয়লাভ করার মত সব রকম কৌশল এবং পরিশ্রম করে খেলেও ওয়ারীর গোল না খাওয়ার মনোবলের কাছে হার মানতে হয়েছে। প্রথমার্ধে ২৫ মিনিটে জাহাঙ্গীরের পাসে ভুট্টো গোল করে ওয়ারীকে এগিয়ে দেয়। প্রেস একটি সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে দেয়। মুখতারের সহজ পাস যা ১০০ ভাগ গোল, সুভাষ জঘন্যভাবে মিস করে। বিরতির পর মাহমুদ ওয়ারীকে ২-০ এগিয়ে দিলে জামিল আখতার সেটাকে ৩-০ গোলের জয় নিশ্চিত করে দেয়।
২৬ জুলাই আমরা আমাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে পিডব্লিউডিকে ৩-২ গোলে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। পিডব্লিউডি দৃঢ়তার সাথে লড়াই করে হেরেছিল। প্রথম পর্বে আমরা তাদেরকে ৫-০ গোলে হারালেও এবার জয় পেতে আমাদের ঘাম ঝরাতে হয়েছিল।
পিডব্লিউডি ভাল খেলা দিয়ে শুরু করেছিল এবং ১২ মিনিটেই গোল করে এগিয়ে গিয়েছিল। তবে সেটাকে বেশি সময় ধরে রাখতে পারেনি। গোল করার পর তারা রাফ খেলার প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। খেলার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল, পত্রিকার মন্তব্যÑ ‘মাঠে দুজন অতি ভদ্র খেলোয়াড় মারামারিতে লিপ্ত হলে রেফারি তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন, রেফারি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন খেলা নিয়ন্ত্রণ করতে।’ সেদিনের মারামারিতে লিপ্ত দুজন খেলোয়াড় হলো পিডব্লিউডির গনি এবং মোহামেডানের আমি। পিডব্লিউডি দলের মেরে খেলার প্রবণতার প্রভাবে গনি আমাকে অত্যন্ত বাজেভাবে ট্যাকেল করলে আমি রাগের মাথায় তাকে একটা ঘুষি লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সেও তেড়ে এসেছিল ঘুষি মারতে। ব্যাস ঘুষাঘুষি! অন্য খেলোয়াড়রাও ছুটে এসে ধাক্কাধাক্কি শুরু করে। খেলা অল্প সময়ের জন্য বন্ধ। এ দৃশ্যটি ছিল হতাশাজনক।
আবিদের পাশে সুজা গোল করে পিডব্লিউডিকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। তারপরও গনির শট ক্রসবারের সামান্য ওপর দিয়ে চলে গেলে গোলবঞ্চিত হয় পিডব্লিউডি। আমরা তখনও গুছিয়ে খেলতে পারছিলাম না। এরই মধ্যে পিডব্লিউডির মোহাম্মদ আলী গোল শোধ করার একটা সুযোগ আমাদের করে দিয়েছিল নিজের পেনাল্টি বক্সের ভেতর বল হাত দিয়ে খেলার শাস্তিস্বরূপ। আমাদের গফুর পেনাল্টি বাইরে মেরে মনে হলো মোহাম্মদ আলীর উপহারটা প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিল। 
পেনাল্টি মিস করে আমাদের চৈতন্য ফিরে আসে এবং আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে গোল শোধ করার জন্য আক্রমণ চালাতে থাকি। শামসুর সুন্দর কিক গোলরক্ষক মতিন অত্যন্ত চমৎকারভাবে সেভ করে। ১০ মিনিট পর কাদেরের জোরালো শট ক্রসবারে প্রতিহত হয়ে ফেরত এলে শামসু হেড করে বল জালে জড়িয়ে দিলে খেলায় ১-১ গোলের সমতা আসে। বিরতির আগে আবদুল্লাহর পাসে মুসা গোল পোস্টে মারলেও মতিন সেভ করে। বিরতির পরপর পিডব্লিউডি আক্রমণ চালায়। ভুট্টোর পাস গনি বাজেভাবে মিস করে। তারপরও আবিদ সহজ একটি পাস ভুট্টোকে দিলে সে বাইরে মেরে দেয়। এভাবেই পিডব্লিউডি বেশ কয়েকটা সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। খেলার ধারার বিপরীতে ২৪ মিনিটে প্রতাপের কর্নার কিক থেকে মুসা হেড করে আমাদেরকে ২-১ এগিয়ে দেয়। প্রায় ৩৫ গজ দূর থেকে গফুরের বুলেট শট গোলরক্ষককে পরাস্ত করলেও মুসার অফসাইডে সেটা বাতিল হয়ে যায়। এর মিনিটখানেক পর আবিদের শট নূরুন্নবী কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করে কিন্তু কর্নারের বল ধরে ভুট্টো গোল করলে খেলা ২-২ গোলের সমতায় ফেরে। খেলা শুরু হলে গনি এবং আমার মধ্যে সেই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছিল এবং রেফারি ড্রপ দিয়ে খেলা শুরু করলে সেই বল মুসা পেয়ে আক্রমণে যাওয়ার সময় তাকে বিপক্ষ খেলোয়াড় হাফলাইনের কাছে ফাউল করে। তোরাব আলী ফ্রি-কিকটি মেরেছিল আর গফুর দর্শনীয় হেড করে বল জালে জড়িয়ে দেয়ার সাথে সাথে রেফারি খেলার শেষ বাঁশি বাজিয়ে দেন। কিক অফ করার সময় ছিল না,  গোলটি হয়েছিল খেলার নির্ধারিত সময়ের পরে দুই মিনিট অতিরিক্ত সময়ে। ৩-২ গোলের জয়টি আমাদের খুব কষ্টের এবং মূল্যবান জয় ছিল। #     (ক্রমশ.)

(১০৪)
ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ফুটবল লিগ শিরোপা জয়ের স্বপ্ন এরই মধ্যে ফিকে হয়ে গিয়েছিল। ২৭ জুলাইও তারা রহমতগঞ্জের কাছে ৩-১ গোলে হেরে অল্প যেটুকু আশা জিইয়ে রেখেছিল, সেটুকুও শেষ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম পর্বে দু’টিম ১-১ ড্র করেছিল। ওয়ান্ডারার্সের পক্ষে একমাত্র গোলটি এসেছিল ‘গিফটেড’ গোল হিসেবে। প্রায় মাঝ মাঠ থেকে তাদের রেজা উঁচু করে গোলপোস্টে বল পাঠালে তা রহমতগঞ্জের স্টপার গাউস হেড দিয়ে ক্লিয়ার করতে গেলে বল দিক পরিবর্তন করে নিজ গোলপোস্টে ঢুকে যায়। যা গোলরক্ষকের পক্ষে শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। ওয়ান্ডারার্স ১-০ লিড।  রহমতগঞ্জ গোল শোধ করার জন্য একের পর এক আক্রমণ চালাতে থাকে। ২৫ মিনিটে লালুর কর্নার কিক গোলরক্ষক পাঞ্চ করে ক্লিয়ার করলেও বল রহমতগঞ্জের ফারুকের পায়ে পড়ে এবং সে গোল করে দলকে সমতায় ফেরায় ১-১।
বিরতির পর ওয়ান্ডারার্স একটি সহজ সুযোগ নষ্ট করে। শেষদিকে মাঠের নিয়ন্ত্রণ রহমতগঞ্জের দখলে চলে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় লালুর কর্নার কিক থেকে নাজির চমৎকার হেডের সাহায্যে গোল করে রহমতগঞ্জকে ২-১ গোলের লিড এনে দিয়েছিল এবং খেলার শেষ বাঁশির আগ মুহূর্তে গফুরের বানানো বলে বেলাল গোল করলে রহমতগঞ্জ ৩-১ গোলের জয় দিয়ে খেলা শেষ করেছিল।
সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে রেলওয়ে ব্লুজ স্টেশনারিকে ৩-৩ গোলে ড্র করতে বাধ্য করেছিল। প্রথম পর্ব ছিল গোলশূন্য ড্র। এ খেলার উল্লেখ করার মত বিষয় ছিল রেলওয়ে ১-৩ গোলে পিছিয়ে থেকেও ৩-৩ গোলে ড্র, যা অনেকে সমঝোতার খেলা বলে সন্দেহ করেছিলেন। খেলার ১০ মিনিটেই রেলওয়ে লিড নিয়েছিল আনোয়ারের পাশে নুরুল্লাহর গোলের মাধ্যমে। বিরতির পর ইউজিন কামবিলের কাছ থেকে বল পেয়ে গোল করলে স্টেশনারি ১-১ গোলের সমতায় ফেরে। দু’মিনিট পর ঝুনু গোল করে স্টেশনারিকে ২-১ গোলের এগিয়ে দেয় এবং কামবিল সেটাকে ৩-১ করে দেয়। খেলার শেষ ১০ মিনিট রেলওয়ে হঠাৎ করেই জ্বলে ওঠে এবং খেলার ২৪ ও ২৫ মিনিটে পরপর দু’গোল করে। প্রথম গোলটি মনোজ করেছিল আর দ্বিতীয় গোল করেছিল আনোয়ার। খেলা শেষে স্টেশনারি এবং রেলওয়ে ৩-৩ গোলের ড্র করে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। 
একতরফা খেলায় আমরা (মোহামেডান) ওয়ারীর বিরুদ্ধে ৭-১ গোলে জয়লাভ করেছিলাম আর আবদুল্লাহ করেছিল দর্শনীয় হ্যাটট্রিক। ঢাকা স্টেডিয়ামে ২৮ জুলাই খেলায় ওয়ারী প্রথমার্ধে আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে খেলেছিল। যদিও আমরা ১০ মিনিটে গোল পেয়ে গিয়েছিলাম শামসুর সুবাদে, সে তার নিজস্ব স্টাইলে গোলরক্ষক তপনকে গ্রাউন্ডার শটের মাধ্যমে বিট করেছিল (১-০)। এর পাঁচ মিনিট পর আমার একটি নিখুঁত থ্রু পাস ধরে হাফিজ উদ্দিনের পক্ষে গোল করতে কোন অসুবিধা হয়নি (২-০)। ২০ মিনিটে ওয়ারী একটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু জামিল আখতার একেবারে কাছ থেকে জঘন্যভাবে ব্যর্থ হয়েছিল গোল করতে। তারা আক্রমণ চালিয়ে আরও সুযোগ সৃষ্টি করেছিল; তবে আমাদের শক্তিশালী ডিফেন্স সেগুলোকে সফল হতে দেয়নি।
বিরতির পর মাঠের নিয়ন্ত্রণ আমাদের কাছে চলে আসে, ওয়ারী অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছিল, যার জন্য সাত মিনিটেই তোরাবের কাছ থেকে বল পেয়ে আমি গোল করলে আমরা ৩-০ গোলে এগিয়ে যাই। এরপর ওয়ারীর রাইট আউট তপন চৌধুরীর পোস্টে মারা বল আমাদের স্টপার তোরাব আলী ক্লিয়ার করতে গেলে বল ওয়ারীর হামিদ খানের কাছে চলে যায় আর সেখান থেকে সে সহজেই বল পোস্টে ঢুকিয়ে দেয় ৩-১। শামসু আব্দুল্লাহর পাস ধরে তার দ্বিতীয় এবং দলের চতুর্থ গোল করে (৪-১)। গফুরের ফ্রিকিক ধরে হাফিজউদ্দিন বল বানিয়ে দিলে আবদুল্লাহ সুন্দর প্লেসিং শট দিয়ে গোল করে (৫-১)। ২৭ মিনিটে আবদুল্লাহ একক প্রচেষ্টায় তার দ্বিতীয় গোল করে হ্যাটট্রিকের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল (৬-১)। তার হ্যাটট্রিকের  জন্য আমরা সবাই সহযোগিতা করেছিলাম।  খেলার শেষ মুহূর্তে প্রতাপের পাশে আবদুল্লাহ তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল এবং সেই সাথে খেলার শেষ বাঁশি বেজে উঠেছিল। আমরা ৭-১ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ত্যাগ করেছিলাম।
সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে প্রেস এবং পিডব্লিউডির খেলাটি মাঠ খেলার অনুপযুক্ত থাকার কারণে স্থগিত করা হয়েছিল।
ইপিআইডিসি তাদের ২৯ জুলাইর খেলায় ওয়ান্ডারার্সকে ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল অথচ প্রথম পর্বে দু’দল ১-১ গোলে ড্র করেছিল। ওয়ান্ডারার্সের লিগ শিরোপা জয়ের আশা অনেক আগেই ভঙ্গ হয়েছিল। এ হার তাদের লিগের দ্বিতীয় পর্বে তৃতীয় পরাজয়। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের অভ্যন্তরীণ সমস্যা কিÑ তা বলা মুশকিল। তবে মাঠে ইপিআইডিসি ভাল খেলেই জয় পেয়েছিল। খেলার তৃতীয় মিনিটেই তারা লেফট ইন জব্বরের মাধ্যমে এগিয়ে গিয়েছিল। ওয়ান্ডারার্স সমতায় ফেরার চেষ্টা করলেও সেরকম জোরদার আক্রমণ না থাকায় তারা সফলতা পায়নি। উপরন্তু হাশিম গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে নেয়। দ্বিতীয়ার্ধে ইপিআইডিসি মাঠের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়; অন্যদিকে ওয়ান্ডারার্স অধিক গোল না খাওয়ার জন্য তাদের খেলোয়াড়রা ডিফেন্সিভ হয়ে পড়ে। কিন্তু ইপিআইডিসি দলের গোলক্ষুধাকে নিভৃত রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১০ মিনিটেই মুসার চমৎকার পাসে গাজী দলের পক্ষে তৃতীয় গোল করে। জব্বরের উঁচু করে বিপক্ষ গোলমুখে মারা বল ধরে আসলাম তীব্র শটের মাধ্যমে গোলের সংখ্যা হালিতে পূর্ণ করে (৪-০)। খেলা শেষের দিকে গড়াচ্ছিল, এমন অবস্থায় ওয়ান্ডারার্সের আফাজ তার একক নৈপুণ্যে ইপিআইডিসির রক্ষণকে ভেঙে দর্শনীয় এক গোল করে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল (৪-১)। খেলার অবশিষ্ট সময় দু’দলই উদ্দেশ্যহীনভাবে মাঠে ছুটোছুটি করে সময় শেষ করেছিল।
চ্যাম্পিয়ন দল হিসেবে আমরা (মোহামেডান) আমাদের জয়ের ধারাকে অব্যাহত রেখেছিলাম ৩০ জুলাই প্রেসের বিরুদ্ধে ৭-১ গোলের  বড় জয় দিয়ে। মজার ব্যাপার হলো, প্রেস প্রথম পর্বেও আমাদের কাছে হেরেছিল ৭-১ গোলে। প্রথমার্ধে আমরা ৫-০ গোলে এগিয়ে ছিলাম। প্রেসম্যানদের উদ্দেশ্যহীন খেলা আর আমাদের স্বাভাবিক খেলা, আক্রমণ গোল-এর বাইরে উল্লেখ করার মত এমন কোন ঘটনা মাঠে ঘটেনি। খেলার ২০ মিনিটে আবদুল্লাহর কাছ থেকে বল পেয়ে গফুর তার বিদ্যুৎ গতির গ্রাউন্ডার শট মেরে বিপক্ষ গোলরক্ষককে পরাজিত করে আমাদের ১ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে ২/৩ মিনিট অন্তত আমাদের দল গোল করে গেছে। গফুরের পাসে রসুল বখশ দলের দ্বিতীয় গোল, প্রতাপ আবদুল্লাকে দলের তৃতীয় গোল করতে সাহায্য করেছিল আর সেটাকে হালিতে পূর্ণ করেছিল হাফিজউদ্দিন (৪-০)। রসুল বখশ বিরতির আগে আরও একটি গোল করে আমাদের ৫-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল।
হাফ টাইমে প্রেসম্যানরা কিছুটা এনার্জি সঞ্চয় করে আমাদের ওপর চড়াও হয়ে খেলা আরম্ভ করে এবং এরই ধারাবাহিকতায় তাদের রাইট আউট বল নিয়ে দুরন্ত গতিতে আমাদের সীমানায় ঢুকে মাঠ ঘেঁষা দুর্দান্ত শট মেরে গোলরক্ষক রানাকে পরাস্ত করে (৫-১)। তারপর প্রেসম্যানদের আর কোন ‘ছাড়’ দেয়া হয়নি গোল করার; তবে আমরাও গোল করার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করতে পারিনি। মাত্র দুটো গোল হয়েছিল ১৫ এবং ৩৩ মিনিটে। প্রথম গোলটি ২৫ গজ দূর থেকে গফুর তার নিজস্ব স্টাইলে বুলেট শট দিয়ে বল জালে জড়িয়ে দিয়েছিল (৬-১) এবং দ্বিতীয়টি শামসুর পাসে হাফিজউদ্দিন করেছিল (৭-১)।
সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত অপর খেলায় ফায়ার পুলিশকে ৩-১ গোলে পরাজিত করেছিল। আশরাফের পাসে শরফুদ্দিন ফায়ারের পক্ষে প্রথম গোল করেছিল। বিরতির পর পুলিশ সুযোগ সৃষ্টি করেছিল সমতায় ফেরার কিন্তু গোল করার দক্ষতার অভাবে তারা পারেনি; উল্টো ফায়ারের রাইট আউট মুনীর ওহাবের বলে গোল করে  দলকে ২-০ গোলে  এগিয়ে দিয়েছিল। পুলিশ তাদের আক্রমণ জোরদার করে ফায়ারের ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করে এবং পরপর তিনবার কর্নার আদায় করে নিয়েছিল, যার শেষ কর্নারের সুফল তারা লাভ করেছিল আখতারের চমৎকার হেডে গোলের মাধ্যমে (২-১)। খেলায় কিছুক্ষণের জন্য উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল, দু’দলই গোল করার জন্য আক্রমণ করে খেলছিল। শেষ পর্যন্ত ফায়ারম্যানরাই জয়ী হয়েছিল, তাদের লেফট-ইনের পাসে সেন্টার ফরোয়ার্ড শাহাবুদ্দিন গোল করে দলকে ৩-১ গোলের জয় এনে দিয়েছিল।
স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ৩১ জুলাইর খেলায় প্রথমার্ধে করা ১-১ গোলের ড্র দিয়ে ভিক্টোরিয়া এবং রেলওয়ে ব্লুজ খেলা শেষ করেছিল। রেলের নুরুল্লাহ প্রথম গোল করেছিল আর ভিক্টোরিয়ার লেফট আউট টিপু শোধ দিয়েছিল। পরদিন অর্থাৎ ১ আগস্টের খেলাতেও ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল এবং গোল দুটোও হয়েছিল প্রথমার্ধে। আজাদ প্রথম লিড নিলেও ফায়ার বিরতির পূর্ব মুহূর্তে গোল শোধ করে দিয়েছিল। উভয় দলের উদ্দেশ্যহীন ফুটবল খেলা দেখে স্টেডিয়ামের দর্শকরা বিরক্তি জানিয়েছিলেন চিৎকার করে এবং বকাবকি করে। বিরতির কিছু আগে দর্শকরা দুটি অস্বাভাবিক গোল দেখে কিছুটা আনন্দ পেয়েছিলেন। প্রথমটি আজাদের দেবুর প্রচন্ড গতির শটটি ফায়ারের ডিফেন্স আবুলের গায়ে লেগে দিক পরিবর্তন করে গোলরক্ষক মোতালেবকে বোকা বানিয়ে জালে জড়িয়ে গেলে আর দ্বিতীয়টি ফায়ারের সেন্টার ফরোয়ার্ড শাহাবুদ্দিনের ব্যাক ভলিÑ যা আজাদের গোলরক্ষক এহতেশামকে অবাক করে দিয়ে জালে জড়িয়ে গেলে। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুধু মাঠজুড়ে দু’দলের ছুটোছুটি এবং উদ্দেশ্যহীন আর বোরিং ফুটবল। শেষ পর্যন্ত খেলার ফলাফলের কোন পরিবর্তন হয়নি, ১-১ ড্র।
সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে পিডব্লিউডি এবং স্টেশনারির খেলা স্থগিত করা হয়েছিল দু’টিমের অনুরোধে।
ওয়ান্ডারার্স তাদের ২ আগস্ট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত খেলায় পুলিশকে ৩-০ গোলে পরাজিত করেছিল; যার দুটি গোল করেছিল তাদের লেফট আউট তসলিম আর অপরটি পুলিশের রাইট ব্যাক নুরুর তরফ থেকে উপহার ‘সেমসাইড’ গোল। সবগুলো গোল হয়েছিল প্রথমার্ধে। এ মৌসুমে লিগ তার আকর্ষণ আগেই হারিয়ে ফেলেছিল আর এ খেলাতেও আনন্দ দেয়ার মত কোন উপকরণ ছিল নাÑ যা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। খেলার পাঁচ মিনিটেই আলাউদ্দিনের থ্রু পাসে তসলিম চমৎকার গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়েছিল। এরপর পুলিশের নুরু গোলরক্ষককে ব্যাক পাস করতে গিয়ে নিজ গোলপোস্টে বল ঢুকিয়ে দিয়েছিল (২-০)। তসলিম আবারও  পুলিশের গোলমুখে জটলার ভেতর থেকে গোল করে ওয়ান্ডারার্সকে ৩-০ গোলে এগিয়ে রেখেছিল শেষ পর্যন্ত।
আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় প্রেস একমাত্র গোলে রেলওয়ে ব্লুজকে হারাতে সক্ষম হয়েছিল। মাঠে সারা সময় দু’টিমের ঝগড়া-বিবাদ, রাফ খেলা ছাড়া উল্লেখ করার মত কিছুই ছিল না। শুধু ভাগ্যের সহায়তায় প্রেসের সেন্টার ফরোয়ার্ড সামাদ লেফট-আউট আমীর আলীর পাস থেকে গোল করে দলকে ১-০ গোলে জয়ী করেছিল।
রহমতগঞ্জ তুলনামূলকভাবে স্টেশনারির চেয়ে শক্তিশালী দল। তারা বিরতির পূর্বে ৩ গোল করলে দ্বিতীয়ার্ধে স্টেশনারি ২ গোল শোধ দেয়। ৩ আগস্ট তাদের খেলাটি খুবই উত্তেজনাপূর্ণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছিল। এ খেলার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল রেফারির কঠোর সিদ্ধান্ত, মাঠে শৃংখলা রক্ষার্থে খেলার ১৭ মিনিটে রহমতগঞ্জের রাইট-ব্যাক আফাজ এবং স্টেশনারির লেফট-আউট আজিজকে মারামারি করার দায়ে মাঠ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। রহমতগঞ্জ খেলার পাঁচ মিনিটে লেফট-আউট নয়ার পাশে সেন্টার ফরোয়ার্ড পর্বত গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল আর বিরতির প্রায় ৫ মিনিট আগে রহমতগঞ্জ আরও দু’গোল করে ৩-০ গোলের লিড নিয়েছিল। প্রথম গোল করেছিল নয়ার পাসে সুলতান এবং দ্বিতীয় গোল করেছিল পর্বত তার একক প্রচেষ্টায়।
দ্বিতীয়ার্ধে স্টেশনারি নতুন উদ্যমে আক্রমণ চালিয়ে দুটি গোল করে। এর জন্য তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড কামবিল প্রশংসার দাবি করতে পারে সে একাই দুই গোল করেছিল। দ্বিতীয়ার্ধে স্টেশনারি সমতা আনার জন্য প্রচন্ড চাপ দিয়ে খেলতে থাকলে অন্যদিকে রহমতগঞ্জ  প্রাণপণ চেষ্টা করে তাদের লিডকে ধরে রাখার লড়াই করে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত রহমতগঞ্জেরই ৩-২ গোলে জয় হয়েছিল।     (চলবে)


(১০৫)
দুই টিমে সেদিন যারা খেলেছিল
রহমতগঞ্জ : বরকত (গোলরক্ষক), আফজাল, গাউস এবং হাসনাত, কায়কোবাদ এবং নাজির, আলমগীর, সুলতান, পর্বত, গফুর ও নয়া।
স্টেশনারি : বাচ্চু (গোলরক্ষক), এনতাজ, সেরাজ এবং মিলন, কাশেম ও ইসহাক, রফিক, ঝুনু, কামবিল, আলাউদ্দিন ও আজিজ।
সেন্টার ফরোয়ার্ড সামাদের উইনিং গোলের সুবাদে পুলিশ রেলওয়ে ব্লুজকে ১-০ গোলে  পরাজিত করেছিল। ৪ আগস্ট এ দু’টিম তাদের সীমিত শক্তি দিয়ে খেলাটিকে বেশ জমিয়ে রেখেছিল। খেলায় দু’টিমেরই আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ ছিল; শুধু শার্প শুটারের অভাবে বিরতি পর্যন্ত তারা গোলশূন্য অবস্থায় লড়েছিল। এ অর্ধে রেলের দিকে খেলা ঝুঁকেছিল কিন্তু তাদের ফরোয়ার্ডদের ব্যর্থতায় সফলতা পায়নি। দ্বিতীয়ার্ধে পুলিশ কিছুটা  গোছানো ফুটবল খেলে এবং তাদের লেফট আউট সাত্তারের দুর্দান্ত শট রেলের গোলরক্ষক ইয়ার মোহাম্মদ চমৎকারভাবে সেভ করে দেয়।
পুলিশ রেলের ওপর তাদের চাপ অব্যাহত রেখে খেলার ২০ মিনিটে রাইট হাফ মাহবুবের দেয়া একটি লবকে সামাদ অত্যন্ত চমৎকার হেডের সাহায্যে ইয়ার মোহাম্মদকে পরাস্ত করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল এবং এই গোলটিতেই সেদিনের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছিল।
প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক খেলায় ৫ আগস্ট ওয়ারী ৩-১ গোলে আজাদকে পরাজিত করেছিল। আজাদ প্রাণপণ লড়েছিল কিন্তু ভাগ্যের সহায়তা না পেয়ে তারা হার স্বীকার করেছিল। যদিও ওয়ারী দু’টিমের মধ্যে কিছুটা শক্তিশালী। খেলার ১৩ মিনিটেই ওয়ারী খলিলের গোলে এগিয়ে গিয়েছিল। এরপর আজাদের স্টপার কাজী মোবাশ্বের হোসেন ওয়ারীকে আরও এক গোল করতে সহায়তা করেছিল। নিজ পেনাল্টি বক্সে হাত দিয়ে বল খেলার দায়ে পেনাল্টি করে আর সেটা থেকে ওয়ারীর জামিল আখতার গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে নিয়েছিল। দু’গোলে পিছিয়ে পড়ে আজাদ নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ করে এবং আক্রমণ চালাতে থাকে এবং বিরতির আগ মুহূর্তে লেফট আউট নজরুল বাটুর কাছ থেকে বল পেয়ে গোল করলে ব্যবধান কমে ২-১ হয়।
বিরতির পর খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। আজাদ ওয়ারীর ওপর চাপ সৃষ্টি করে কিন্তু গোল বের করতে পারছিল না। এভাবেই খেলা শেষের দিকে গড়াচ্ছিল। আবারও ওয়ারীর খলিল একক প্রচেষ্টায় তার দ্বিতীয় গোল করলে ওয়ারী ৩-১ গোলের জয় নিয়ে টেন্টে ফিরেছিল।
আউটার স্টেডিয়ামে সেদিনের খেলায় কামবিলের একমাত্র গোলে স্টেশনারি ফায়ারকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। ফায়ার বাকি সময় মরিয়া হয়ে উঠেছিল গোল শোধ দিতে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফলাফলের কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি।
ভিক্টোরিয়া তাদের ৬ আগস্টের খেলায় রহমতগঞ্জকে ৩-১ গোলে পরাজিত করেছিল। প্রথম পর্বে তারা ৫-১ গোলে জয় পেয়েছিল। এদিন ভিক্টোরিয়া অত্যন্ত চমৎকার খেলা উপহার দিয়েছিল। তাদের সম্মিলিত আক্রমণে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে বেগ পেতে হয়নি। সেন্টার ফরোয়ার্ড আলী ইমাম প্রথম গোল  করলে সেটা শোধ দিতে বেশি সময় নেয়নি রহমতগঞ্জের গফুর। আলী ইমাম আবারও গোল করে দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দিয়েছিল আর লেফট আউট টিপু গোল করে দলের ৩-১ গোলের জয় নিশ্চিত করে দিয়েছিল।
ঢাকা ফুটবল লিগের মাঝপথেই আমাদের রাওয়ালপিন্ডি যেতে হয়েছিল, বগুড়া মোহাম্মদ আলী ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে। ঢাকা থেকে দুটো টিম অংশ নিয়েছিল। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ঢাকা এবং ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। আমরা (মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব), গতবারের চ্যাম্পিয়ন টিম। এবছর টুর্নামেন্টে ২৪টি টিম এন্ট্রি করেছিলÑ ঢাকার দুটো, ১০টি স্থানীয় এবং বাকি টিমগুলো ছিল পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানের। টিমগুলো হলো : ১। মোহামেডান স্পোর্টিং  ক্লাব, ঢাকা; ২। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স; ৩। কেএমসি; ৪। কে পেটি; ৫। পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে; ৬। ওয়েস্ট পাকিস্তান গভ. প্রেস; ৭। পাকিস্তান এয়ারফোর্স পেশওয়ার; ৮। ৫০২ ওয়ার্কশপ; ৯। শাহিন স্পোর্টিং ক্লাব; ১০। আইটিডি; ১১। জিন্নাহ ক্লাব; ১২। ব্রিটিশ হাই কমিশন; ১৩। পাক অর্ডিন্যান্স ফেক্টোরি; ১৪। অ্যাটক অয়েল মিল; ১৫। পিডব্লিউডি, করাচি; ১৬। ঈগলস ক্লাব; ১৭। আরমার্ড ডিভিশন; ১৮। টেরর ক্লাব, লাহোর; ১৯। পাক মোঘলস, করাচি; ২০। পিডব্লিউ আর গ্রিন; ২১। পেশাওয়ার ডিস্ট্রিক্ট; ২২। ইসলামাবাদ এফসি; ২৩। ইস্ট এন্ড ওয়েস্ট ক্লাব। আরও একটি টিমের কথা মনে করতে পারছি না।
মোহাম্মদ আলী ছিলেন বগুড়ার কৃতী সন্তান। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং ফরেন মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার স্মৃতি রক্ষার্থে রাওয়ালপিন্ডির ইস্ট ওয়েস্ট ক্লাব এ টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। ইস্ট ওয়েস্ট ক্লাবের সভাপতি খুলনার আর এক বাঙালি সন্তান খান এ সবুরের সার্বিক সহযোগিতায় ১৯৬৩ সাল থেকে এই টুর্নামেন্টের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তখন থেকে শিরোপা ঢাকাতেই ছিল। ১৯৬৩ এবং ১৯৬৪ পরপর দু’বছর ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল; ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে টুর্নামেন্ট হয়নি। ১৯৬৬ সালে মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন। এবছরও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আশা নিয়ে আমরা ৩ আগস্ট রাওয়ালপিন্ডি পৌঁছেছিলাম। ইতোমধ্যে টুর্নামেন্টে শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯  জুলাই টুর্নামেন্টের উদ্বোধন করেছিলেন পাকিস্তানে নিযুক্ত তুরস্কের রাষ্ট্রদূত সিনাসী ওরেল। উদ্বোধনী ম্যাচ ছিল স্থানীয় দুটো ক্লাবের মধ্যে। আইটিডি রাওয়ালপিন্ডি ৫-০ গোলে হারিয়েছিল শাহিন ক্লাবকে।
আমরা সরাসরি কোয়ার্টার ফাইলে খেলতে নেমেছিলাম ৪ আগস্ট পাকিস্তান এয়ারফোর্সের (পেশাওয়ার) বিপক্ষে। আর ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে সেদিন খেলেছিল ৫০২ ওয়ার্কশপ। কোয়ার্টার ফাইনালের আরো দুটো মাচ আগেই হয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে কেএসসি এবং পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে সেমিফাইনালে উত্তীর্ণ হয়েছিল।
রাওয়ালপিন্ডির আর্মি স্টেডিয়ামে উল্লেখযোগ্য দর্শক উপস্থিত হয়েছিলেন ঢাকার দুটো টিমের খেলা দেখার জন্য বিশেষ করে আমরা গত বছরের চ্যাম্পিয়ন টিম হিসেবে দর্শকদের আকর্ষণ আমাদের ওপরই ছিল বেশি। আমরা তাদের হতাশ করিনি। আবদুল্লাহ গোলের সূচনা করেছিল এবং শামসু আরো দু’গোল করলে আমরা ৩-০ গোলে এয়ারফোর্সকে পরাজিত করে সেমিফাইনালে উঠেছিলাম। আমাদের দলের বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় থাকা সত্ত্বেও প্রথমার্ধে আমাদেরকে ঘর সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। খেলার সাত মিনিটেই এয়ারফোর্স একটি সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেছিল, তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ফারুক আমাদের গোলরক্ষককে একা পেয়েও বল বাইরে মেরে দিয়েছিল।
প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধে আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে এয়ারফোর্সের ওপর চাপ দিয়ে তাদের কোণঠাসা করে রাখি। ১০ মিনিটের মধ্যেই আমরা ফল পেয়ে যাই, আন্তর্জাতিক রাইট ইন আবদুল্লাহ চমৎকার হেডের সাহায্য গোল করে আমাদের এগিয়ে দিয়েছিল। ৫ মিনিট পরই শামসু তার নিখুঁত শটের মাধ্যমে গোলরক্ষক মাসুদকে পরাজিত করে গোলসংখ্যা দ্বিগুণ করেছিল এবং খেলার ২৬ মিনিটে সে আরও একটি গোল করে ৩-০ গোলের জয় নিশ্চিত করে আমাদের সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ এনে দিয়েছিল।
প্লেয়ার লিস্ট : মোহামেডানÑ নুরুন নবী (গোলরক্ষক), জহির ও পিন্টু, কাদের, তোরাব আলী ও গফুর, প্রতাপ, আবদুল্লাহ, শামসু, বশীর ও হাফিজউদ্দিন।
এয়ারফোর্স : মাসদু (গোলরক্ষক), নাসিম ও ওয়াজিদ, মাহমুদ, গুলজার ও মোস্তফা, মনোয়ার, বশীর, ফারুক, বাহান চান্দ এবং আকরাম।
দিনের প্রথম খেলায় ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ৫০২ ওয়ার্কশপকে ৪-১ গোলে পরাজিত করে সেমিফাইনালে উঠে গিয়েছিল।
দর্শকদের বেশি খেলা এবং ভালো খেলা উপভোগ করার লক্ষ্যে আয়োজক কমিটি এ বছর সেমিফাইনালে ৪টি দলকে রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতিতে খেলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রত্যেক দল প্রত্যেক দলের মোকাবেলা করবে। জয়ী দল ২ পয়েন্ট, ড্র হলে ১১ পয়েন্ট, হারলে ০ হবে। দু’টিমের পয়েন্ট সমান হলে গোল এভারেজে মীমাংসা হবে। সর্বোচ্চ পয়েন্ট সংগ্রহকারী দল  চ্যাম্পিয়ন এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দল হবে রানার্সআপ।
৭ আগস্ট রাউন্ড রবিন লিগের দুটো ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথমটি কেএমসি বনাম পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে এবং দ্বিতীয় ম্যাচটি আমরা খেলেছিলাম ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের বিরুদ্ধে। ওয়ান্ডারার্স-মোহামেডান চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি টিম, যেখানেই খেলা হোক, উত্তেজনা থাকবেই, শারীরিক-মানসিক যুদ্ধভাব ফুটে উঠবেই। আমাদের টিম শক্তিশালী এবং ব্যালেন্সড টিম। এদিন আমাদের দলের হাফিজউদ্দিন লেফট-আউট পজিশনে অত্যন্ত ভালো খেলে দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। বল নিয়ে বিপক্ষ সীমানায় ছুটে যাওয়া এবং সার্প শুটিং সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। শুধু তাই নয়, সে হ্যাটট্রিক করার গৌরবও অর্জন করেছিল। দলের পক্ষে একটি গোল করেছিল আন্তর্জাতিক সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু। অপরদিকে ওয়ান্ডারার্স গতদিনে ৫০২ ওয়ার্কসপ দলের বিরুদ্ধে যে খেলা খেলেছিল, তার ছিটেফোঁটাও মাঠে দেখা যায়নি। তাদের তুলনায় আমাদের দল সর্বক্ষেত্রে যেমন বল কন্ট্রোল, স্পিড, দলীয় সমঝোতা শুটিং এগিয়ে ছিল। মাঠ আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, বেশিরভাগ সময় তারা রক্ষণাত্মক খেলা খেলেছে।
খেলার ১২ মিনিটেই শামসুর নিখুঁত গ্রাউন্ডার শটটি ওয়ান্ডারার্সের গোলরক্ষক সান্টুকে পরাস্ত করলে আমরা এগিয়ে গিয়েছিলাম। ২০ মিনিটে প্রতাপের লব থেকে হাফিজউদ্দিন সেটাকে দ্বিগুণ করেছিল। বিরতির পর হাফিজউদ্দিন তার একক প্রচেষ্টায় গোল করে হ্যাটট্রিকের কাছাকাছি চলে যায়। ২৫ মিনিটে হাফিজুদ্দিনের দেয়া ব্যাক পাসে গফুর তার বুলেট শট দিয়ে সান্টুকে পরাস্ত করতে পারেনি। সান্টু বল পাঞ্চ করে খেলায় ফিরিয়ে দিয়ে হাফিজউদ্দিনকে হ্যাটট্রিক করার সুযোগ করে দিয়েছিল। আমরা ৪-০ গোলে এগিয়ে খেলার শেষ বাঁশির অপেক্ষায়, এমনি সময় আমাদের রক্ষণভাগের অসাবধানতায় আমাদের বিরুদ্ধে পেনাল্টির বাঁশি আর সেটা থেকে ওয়ান্ডারার্সের সেন্টার ফরোয়ার্ড গোল করে ব্যবধান কমিয়েছিল। আমরা ৪-১ গোলে জয়লাভ করেছিলাম। 
আমাদের দলে খেলোয়াড় পরিবর্তন না থাকায় ওয়ান্ডারার্স দলে যারা খেলেছিল, তাদের লিস্ট : সান্টু (গোলরক্ষক), আলী মোহাম্মদ, আসলাম রিয়াজ, নবী বখশ, ইসমাইল রুশো, শাজাহান, শরফুদ্দিন, ইউনুস গনি ও তসলিম।
কেএমসি পাক ওয়েস্টার্ন রেলওয়েকে রাউন্ড রবিন লিগের সেদিনের অপর খেলায় ৩-১ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল। স্পিড, দলীয় সমঝোতা পরিকল্পিত আক্রমণ দ্বারা জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের রানার্সআপ পিডব্লিউ টিমের ওপর কর্তৃত্ব করেই কেএমসি জয় পেয়েছিল। তারা দলীয়ভাবে ভীষণ শক্তিশালী, বিশেষ করে তাদের ফুলব্যাকদ্বয় খুদা বখশ আর মুরাদ বখশ, হাফে মাওলা বখশ, ইনসাইড ফরোয়ার্ড আলী নেয়াজ, আব্বাস এবং সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়। খেলার ৪ মিনিটেই কেএমসি একটি পেনাল্টি পেয়ে যায়, তাদের লেট হাফ ইব্রাহিম গোল করলে তাদের খেলা সহজ হয়ে যায়। ইনসাইড রাইট আলী নেওয়াজ সেটাকে দ্বিগুণ করলে আব্বাস গোল করে ৩-০ গোলে জয় নিশ্চিত  করে দিলেও শেষ মুহূর্তে পাক ওয়েস্টার্ন রেলের রাইট আউট গোল করে ব্যবধান কমালে ফলাফল ৩-১ গোলে স্থির হয়।
প্লেয়ার লিস্ট কেএমসি : রসুল বখশ (গোলরক্ষক), খোদা বখশ, মুরাদ বখশ ও মোহাম্মদ তাজ, মাওলা বখশ ও ইব্রাহিম, আল্লা বখশ, আলী নেওয়াজ, ওমর, আব্বাস ও এমএম লারী।
পাক ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে : ফারুক (গোলরক্ষক), আরশাদ আমীর গুল ও রমজান, ইউনিস করিম, ইদ্রিস, আইয়ুব দার, নূর আলম মজিদ ও মোহাম্মদ বখশ। #
    (ক্রমশ.)

(১০৬)
ঢাকা ওয়ান্ডারার্স রাউন্ড রবিন লিগে একমাত্র গোলে পাক ওয়েস্টার্ন রেলওয়েকে পরাজিত করে পূর্ণ পয়েন্ট লাভে সক্ষম হয়েছিল। তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড ইউনুস যে ‘টার্জন’ নামে অধিক পরিচিত, খেলার দ্বিতীয়ার্ধে পেনাল্টি থেকে উইনিং গোলটি করেছিল। এ মুহূর্তে ১৯৫৯ সালের একটি ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। হায়দ্রাবাদে জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা পূর্ব পাকিস্তান বনাম বেলুচিস্তান। বেলুচিস্তানের রাইট আউট অল্প বয়সের একজন তরুণ, গোলগাল, গাট্টাগোট্টা, বল নিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে যায়, মাঠে খুবই চঞ্চল, দলের আক্রমণের সূচনা তারই মাধ্যমে হয়, মাঠে খুবই জনপ্রিয়। যখনই সে বল ধরতো স্টেডিয়ামের দর্শকরা টারজান টারজান চিৎকার করে তাকে উৎসাহ জোগাতো। আমাদের বিরুদ্ধেও সে ছিল টগবগে ঘোড়ার মতো। আমাদের লেফট ব্যাক গজনবী ভাই তাকে উর্দু-বাংলা মিশিয়ে বললেন, ‘যাদা নজদিক মাত আও, ছটফট মাত কারো।’ টারজান গজনবী ভাইয়ের কথা বুঝেছিল কিনা জানি না; তবে বল নিয়ে তাকে বিট করার অপচেষ্টা বার বার করে যাচ্ছিল। এমনি একবার ডান প্রান্ত থেকে বল নিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে আসছে টারজান, গজনবী ভাই বসিয়ে দিলেন তার থাবা (ট্যাকেল) টারজানের হাঁটু বরাবর। ব্যস, টারজান মাঠে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে! দৃশ্যটা আজও ভুলতে পারিনি।
সেদিন ওয়ান্ডারার্সের গোলরক্ষক সান্টু অত্যন্ত দক্ষতার সাথে খেলে সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তাছাড়া তাদের রিয়াজ, আলী মোহাম্মদ এবং ইসমাইল রুশো খুব ভালো খেলা প্রদর্শন করেছিল।
পাকিস্তান ওয়েস্টার্ন রেল দল টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটিয়েছিল আমাদের ২-১ গোলে হারিয়ে। খেলার ১৯ মিনিটেই আমরা এগিয়ে গিয়েছিলাম গফুরের ডাইরেক্ট ফ্রি-কিক থেকে দুর্দান্ত কিক দ্বারা গোলের মাধ্যমে। বিরতি পর্যন্ত আমরা আমাদের লিড ধরে রেখেছিলাম। দ্বিতীয়ার্ধে রেল দলের আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় রাইট ইন আইয়ুব দার হঠাৎ জ্বলে ওঠে অপ্রতিরোধ্য এবং বিপজ্জনক হয়ে আমাদের রক্ষণভাগে ত্রাস সৃষ্টি করে। তারই দেয়া গোলে রেল সমতায় ফেরে। খেলার শেষদিকে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড নূর আলম গোল করে দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দিয়েছিল। বাকি সময় আমরা আপ্রাণ লড়েও ভাগ্য ফেরাতে পারিনি।
৯ আগস্ট করাচি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন (কেএমসি) এমাস এবং আমাদের খেলাটি রাউন্ড রবিন লিগের শেষ খেলা হলেও ফাইনাল খেলায় রূপ নিয়েছিল। চ্যাম্পিয়ন হতে হলে আমাদের জয়লাভ করতেই হতো আর কেএমসি ড্র করলেই শিরোপা।
দর্শক পরিপূর্ণ আর্মি স্টেডিয়াম, অর্গানাইজিং কমিটির চেয়ারম্যান খান এ সবুর খেলার পূর্বে দু’টিমে খেলোয়াড়দের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
আমরা গতবারের চ্যাম্পিয়ন দল এবং এ পর্যন্ত খেলার পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, আমাদের সম্মুখে অলআউট খেলা ছাড়া বিকল্প কিছুই ছিল না। কেএমসিও আমাদের অবস্থা উপলব্ধি করে তাদের পরিকল্পনা সাজিয়েছিল। গোল না খাওয়ার পণ করে তাদের রক্ষণকে দুর্গে পরিণত করেছিল।  কেএমসি খুবই শক্তিশালী দল।  আক্রমণ রক্ষণে ব্যালেন্স টিম, তদুপরি তারা আক্রমণের চেয়ে রক্ষণাত্মক খেলা বেছে নিয়েছিল। তাছাড়াও তাদের গোলরক্ষক আলী মোহাম্মদ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে খেলে বেশ কতগুলো গোল সেভ করে দলকেও হার থেকে সেভ করেছিল। তাদের ডিপ ডিফেন্স খুদা বখশ এবং মুরাদ বখশ আমাদের আক্রমণগুলোকে সফলতার সাথে মোকাবেলা করে দলের শিরোপা জয়ে অবদান রেখেছিল। তাদের মাওলা বখশ লৌহমানব হিসেবে রক্ষণভাগের পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছে। আক্রমণভাগে আলী নেওয়াজ, ওমর আব্বাস অত্যন্ত পরিশ্রম করে খেলেছিল।
অন্যদিকে আমাদের দলে কাদের বখশ, তোরাব আলী, গফুর আবদুল্লাহ হাফিজ খুবই ভাল খেলা প্রদর্শন করে সবার প্রশংসা পেলেও জয়লাভ করতে যে গোলের প্রয়োজন ছিলÑ সেটা কেউ এনে দিতে পারেনি।
খেলার শুরুতেই কেএমসি সেন্টার ফরোয়ার্ড ওমর জোরালো শটের মাধ্যমে আমাদের গোলরক্ষক নুরুন নবীর পরীক্ষা নিয়েছিল। আমাদের সম্মিলিত আক্রমণগুলো বেশিরভাগ তারা কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেছিল। তাদের রক্ষণভাগ খুব সংগঠিত, তারা আমাদের পেনিট্রেড করতে সুযোগ দেয়নি; ফলে আমরা গোলমুখে বল সরবরাহ পাইনি বা বলসহ ফাঁকা পোস্ট পাইনি, যার দ্বারা আমরা গোল করতে পারতাম।
মাঠ প্রথমার্ধে কেএমসির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে আমরা তাদের ওপর চড়াও হয়ে খেলেও কাক্সিক্ষত ফললাভ করতে পারিনি। খেলার শেষদিকেও হাফিজের দুর্দান্ত শটটি মোহাম্মদ আলী কর্নারের বিনিময়ে সেভ করেছিল। খেলাটি আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে উপভোগ্য হয়েছিল। খেলায় জয়লাভ না করতে পারায় আমরা শিরোপা হারিয়েছিলাম আর কেএমসি তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলে ড্র করেই পয়েন্ট ব্যবধানে চ্যাম্পিয়ন হয়ে শিরোপা লাভ করেছিল।

পয়েন্ট তালিকা
দল    প্লে    জয়    পরা    ড্র    পক্ষে    বিপক্ষে    পয়েন্ট
কেএমসি    ৩    ২    ০    ১    ৭    ১    ৫
মোহামেডান    ৩    ১    ১    ১    ৫    ৩    ৩
ওয়েস্টার্ন রেল    ৩    ১    ২    ০    ৩    ৫    ২
ওয়ান্ডারার্স     ৩    ১    ২    ০    ২    ৪    ২

খেলা শেষে প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান খেলোয়াড়দের মাঝে পুরস্কার প্রদান করেছিলেন।

প্লেয়ার লিস্ট
কেএমসি : আলী মোহাম্মদ (গোলরক্ষক), খোদা বখশ, মুরাদ বখশ, মো. তাজ, মাওলা বখশ ইব্রাহিম, আল্লাহ বখশ, আলী নেওয়াজ, ওমর, আব্বাস এবং এমএম লারি।
মোহামেডান : নুরুন নবী (গোলরক্ষক), জহির ও পিন্টু, কাদের বখশ, তোরাব আলী ও গফুর, প্রতাপ, আব্দুল্লাহ, শামসু, বশীর এবং হাফিজ।

৯ আগস্ট রাওয়ালপিন্ডি আর্মি স্টেডিয়ামে বগুড়া মোহাম্মদ আলী মেমোরিয়াল ফুটবল টুর্নামেন্ট শেষ করেই স্বাধীনতা দিবস ফুটবল খেলতে ঢাকা স্টেডিয়ামে নেমে পড়েছিলাম আগস্টের ১২ তারিখে। স্বাধীনতা দিবস ফুটবল টুর্নামেন্ট ৮ আগস্ট থেকে শুরু হয়েছিল। ৭টি দল অংশগ্রহণ করেছিল। লিগ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ঢাকা ইউনিভারসিটি, ইপিআইডিসি, পুলিশ, ঢাকা ডিসি একাদশ, ভিক্টোরিয়া এবং ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি। এ টুর্নামেন্টের গত বছরের শিরোপাজয়ী ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব এবার অংশগ্রহণে বিরত ছিল। প্রথমদিন দুটো ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উদ্বোধনী ম্যাচ বিকেল ৩টায় ঢাকা মিউনিসিপ্যালটি বনাম পুলিশ এবং বিকেল ৫টায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি বনাম ইপিআইডিসি। পুলিশ ঢাকা মিউনিসিপ্যালটিকে ২-০ গোলে পরাজিত করে সেমিফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল। খেলা ২৮ মি. সাত্তারের লব থেকে এরশাদ চমৎকার হেডের সাহায্যে গোল করে দলকে এগিয়ে দিলে দ্বিতীয়ার্ধে সাত্তারের কর্নার কিকের বল ধরে গফুরের বানিয়ে দেয়া বলে নুরু গোল করে দলকে ২-০ গোলের জয় নিশ্চিত করে দিয়েছিল।
দিনের দ্বিতীয় ম্যাচ ইপিআইডিসি এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটির মধ্যকার খেলাটি শেষ পর্যায়ে এসে (৫ মিনিট বাকি থাকতে) পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল। সে সময় ইপিআইডিসি ৫-২ গোলে লিড করছিল।
১০ আগস্ট ভিক্টোরিয়া ঢাকা ডিসি একাদশকে ৪-০ গোলে পরাজিত করেছিল। ২৩ মিনিটে ইউসুফ গোল করে দলকে ১-০ এগিয়ে দিলে টিপু সেটাকে ২-০ গোলে নিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে ভিক্টোরিয়ার বাচ্চু ৩২ এবং ৩৫ মিনিটে পরপর দু’গোল করলে ভিক্টোরিয়া ৪-০ জয়ী হয়ে মাঠ ছেড়েছিল। আগের দিনের পরিত্যক্ত ম্যাচটি ইপিআইডিসি বনাম ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাঠে গড়ায়নি। ইপিআইডিসি ওয়াকওভার পেয়ে পরবর্তীতে পুলিশের বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল খেলার সুযোগ লাভ করেছিল।
১১ আগস্ট ইপিআইডিসি প্রথম সেমিফাইনালে পুলিশকে ২-০ গোলে পরাজিত করে স্বাধীনতা দিবস ফুটবলের ফাইনালে উত্তীর্ণ হয়েছিল। খেলার ১৮ মিনিটে হাশেম গাজীকে পাস দিলে সে গোল করে দলকে ১-০ এগিয়ে দিয়েছিল। বিররিত আগ মুহূর্র্তে সলিমুল্লাহর কর্নার কিকে আলম চমৎকার হেডে গোল করলে ইপিআইডিসি ২-০ গোলে জয়লাভ করে ফাইনালে উঠে যায়।
১২ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস ফুটবলের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে সরাসরি আমরা (মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব) ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে খেলতে মাঠে নেমেছিলাম। স্থান-মাঠ, পরিবেশ দ্রুততার সাথে পরিবর্তন হওয়ায় আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও আমাদের টিম যথেষ্ট শক্তিশালী থাকায় আমরা উতরে গিয়েছিলাম এবং ভিক্টোরিয়াকে ৩-১ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে উন্নীত হয়েছিলাম। ভিক্টোরিয়া খুবই আনলাকি টিম হিসেবে ম্যাচ হেরেছিল। তারা উন্নত মানের খেলা খেলে অনেকগুলো গোল করার সুযোগ সৃষ্টি করেছিল; শুধুমাত্র স্কোরারের অভাবে তারা সফল হতে পারেনি। প্রথমার্ধে খেলার নিয়ন্ত্রণ ভিক্টোরিয়ার কাছে থাকা সত্ত্বেও খেলার ধারার বিপরীতে মুসার ফ্রি-কিক থেকে আমি হেডের সাহায্যে গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে নেই। গোল খেয়ে ভিক্টোরিয়া আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় তারা আমাদের কাছ থেকে পেনাল্টি আদায় করে নিয়েছিল আর ইউসুফ গোল করে দলকে ১-১ গোলে সমতা এনে দিয়েছিল।
দ্বিতীয়ার্ধে আমাদের পুরো টিম জ্বলে ওঠে। দলীয় সমঝোতা, গতি সব দিক দিয়ে আমরা ভিক্টোরিয়াকে পেছনে ফেলে আক্রমণ চালাতে থাকি। এবারও মুসার লব থেকে রাইট ইন আবদুল্লাহ হেড করে গোল করে দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দিয়েছিল। গোল শোধ করার জন্য ভিক্টোরিয়া মরিয়া হয়ে ওঠে কিন্তু আমাদের শক্তিশালী ডিফেন্স ভেদ করে তাদের পক্ষে গোল করা সম্ভব হচ্ছিল না; উপরন্তু তারা তৃতীয় গোল খেয়ে থমকে গিয়েছিল আর গোলটি করেছিলাম আমি আব্দুল্লাহের পাসে। ৩-১ গোলের জয় দিয়ে আমরা শেষ করেছিলাম সেমিফাইনাল খেলা।
খেলোয়াড় তালিকা
মোহামেডান : রানা (গোলরক্ষক), জহির, মিন্টু ও কাদের, তোরাব, গফুর, হাফিজ, আব্দুল্লাহ, শামসু বশীর ও মুসা।
ভিক্টোরিয়া : করিম (গোলরক্ষক), আবদুল্লাহ, দেবী নাশ এবং ওয়াহিদ, মোহাম্মদ আলী এবং লতিফ ইউসুফ, শাহজাহান, আলী ইমাম, জানী এবং টিপু।
১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা মোহামেডান বনাম ইপিআইডিসি। সে সময় এরকম টুর্নামেন্টের আগে ভেটার্নদের একটা প্রীতি ম্যাচ রাখা হতো, যারা দর্শকপূর্ণ স্টেডিয়ামে নিজেদের সেরা সময়ের কিছু নৈপুণ্য প্রদর্শন করে আত্মতৃপ্তি পেতেন আর দর্শকরা বিগত দিনের খেলার স্মৃতি রোমন্থন করে মূল খেলার পূর্বে কিছুটা সময় কাটাবার সুযোগ পেতেন। সেদিনও ভেটার্নদের প্রীতি ম্যাচ রাখা হয়েছিল। যারা সেদিন মাঠে নেমেছিলেন, তাদেরকে বর্তমান খেলোয়াড় এবং কর্মকর্তাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে তাদের নামের তালিকা এখানে তুলে ধরছি : আব্বাস মির্জা, খন্দকার নাসিম, রশীদ জুনিয়ার, হাফেজ রশীদ, সিদ্দিক দেওয়ান, সাত্তার, শাজাহান, ইয়াসিন, আলাউদ্দিন, আরজু, বাহারাম, ইলিয়াস, ইলিয়াস উদ্দিন, আহমেদ, চান্দু খান, চুন্না রশীদ, গজনবী, মারী, রঞ্জিত, সাহেব আলী, দলিল খান, শফি, এসএ মান্নান, এসএ জামান, তসলিম, ওয়াজেদ আলী, ইউসুফ (চট্ট., কাদের (চট্ট), এমএ খান,নজর মোহাম্মদ, নূর হোসেন, এলএ খান মজলিস, শাহ আলম হামিদ, রহিম, হাবিব উল্লাহ, আজিজুল হক।  প্রীতি ম্যাচ সাধারণত ড্র দিয়ে শেষ হতো। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।
ফাইনাল খেলা ইপিআইডিসি অত্যন্ত ভাল শুরু করেছিল। তারা একটি টিম হিসেবে খেলে প্রথম থেকে মাঠের কর্তৃত্ব নেয়ার সবরকম চেষ্টা চালায়। তাদের দলীয় সমঝোতা ছিল চমৎকার। বল নিয়ন্ত্রণ, খেলার গতি, শুটিং সবকিছুর মধ্যে ছিল তাদের মুন্সিয়ানা।     (চলবে)

(১০৭)
স্বাধীনতা দিবস ফুটবল ফাইনালে মোহামেডান ক্লাবের সমর্থক-দর্শকরা আমাদের কাছ থেকে একটি জমজমাট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভালো খেলা আশা করেছিল, আমরা তাদের সে আশা মেটাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলাম। স্টেডিয়ামভর্তি দর্শকদের আমরা সেদিন নিরাশ করেছিলাম। আমাদের খেলা এত বাজে হয়েছিলÑ যা নিকট অতীতে এত জঘন্য খেলা আমরা খেলেছি বলে মনে পড়ে না। সেদিন আমাদের দুজন নিয়মিত খেলোয়াড় খেলায় অংশ নিতে পারেনি। ফুলব্যাক জহির ভাই এবং রাইট উইং প্রতাপ শংকর। তাছাড়াও আমাদের হাফিজ উদ্দিন খেলার মাঝে আঘাত পেয়ে মাঠ ত্যাগ করা ছিল আমাদের বাজে পারফরমেন্সের মূল কারণ। আর সে সুযোগে ইপিআইডিসি আমাদেরকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। রাওয়ালপিন্ডি থেকে শিরোপা খুইয়ে এসে ঢাকায় স্বাধীনতা দিবস ফুটবলে জঘন্য হার, পরপর দুটো ট্রফি হারিয়ে চলতি লিগে আমাদের জন্য লিগ শিরোপা ধরে রাখা বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আমাদের রক্ষণ ইপিআইডিসির ফরোয়ার্ড সামলাতেই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকায় আমাদের নিয়মিত বল জোগান দিতে পারছিল না; বিশেষ করে আমাদের লেফট সাইড ডিফেন্স ভেঙে পড়েছিল। আর সেটারই সুযোগ নিয়েছিল ইপিআইডিসি। তাদের আক্রমণগুলোর বেশিরভাগই করেছিল আমাদের বাম পাশ দিয়ে।  আমাদের রক্ষণভাগ ইপিআইডিসির নিয়মিত আক্রমণে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল, বিশেষ করে পিন্টু উত্তেজিত হয়ে রাফ খেলায় ঝুঁকে পড়েছিল। বলের চেয়ে বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের প্রতি বেশি মনোযোগ দিচ্ছিল। হাফিজ উদ্দিন তার যায়গা বদল করে রাইট উইং-এ খেলতে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছিল না। আমরা আমাদের লেফট উইং দিয়ে আক্রমণে না গিয়ে বেশিরভাগ ডানদিক দিয়ে আক্রমণ করেছি। লেফট উইঙ্গার মুসাকে আমরা ব্যবহার করিনি। তাকে সঠিকভাবে বল জোগান দিতে পারলে রেজাল্ট হয়তো অন্যরকম হতো। ইপিআইডিসির প্রথম গোলের পর মুসা দলকে ওপরে টেনে নেয়ার চেষ্টা করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় সে বিপক্ষ বক্সের ভেতর ঢুকে গোলে মারার মুহূর্তে তাকে বিপক্ষ ডিফেন্ডার টেনে ধরে রাখে অথচ রেফারি তা উপেক্ষা করেন। এর ফলে আমরা পেনাল্টি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম।
ইপিআইডিসি দলগতভাবে সুসংগঠিত হয়ে আক্রমণ চালিয়ে ৬ মিনিটেই আসলাম সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু আমাদের গোলরক্ষক রানাকে একা পেয়েও বল বাইরে মেরে দিয়েছিল। পাল্টা আক্রমণে তোরাব আবদুল্লাহকে বল সে মুসাকে পাস দেয়; মুসাও ব্যর্থ হয় গোল করতে। বল গোলরক্ষকের হাতে তুলে দেয়। ১৫ মিনিটের সময় ইপিআইডিসি একটি কর্নার লাভ করে। সেটা থেকেই জব্বার গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়েছিল।
বিরতির পর সলিমুল্লাহ ডান প্রান্ত থেকে লব করলে আসলাম চমৎকার হেড করে ব্যবধান বাড়িয়ে দেয় ২-০। এরপর হাফিজ হাতে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়ে। আমরা ১০ জনের দল নিয়ে বাকি সময় শক্তিশালী ইপিআইডিসির বিরুদ্ধে খেলেছিলাম। এসময় তারা আরও ২ গোল করেছিল, সলিমুল্লাহ এবং জব্বরের মাধ্যমে। ইপিআইডিসি ফাইনালে আমাদের ৪-০ গোলে পরাজিত করে স্বাধীনতা দিবস শিরোপা জয় করেছিল। খেলা শেষে প্রাদেশিক এসেম্বলির স্পিকার আব্দুল হামিদ চৌধুরী পুরস্কার প্রদান করেছিলেন।
ইপিআইডিসি : হাকিম (গোলরক্ষক), আমিন, গফুর বেলুচ এবং সাইফুদ্দিন, আব্দুল্লাহ আকবর এবং মুসা, সলিমুল্লাহ, হাশিম, আসলাম, জব্বার এবং গাজী।
মোহামেডান : রানা (গোলরক্ষক), কাদের, তোরাব আলী ও পিন্টু, রসুল বখশ ও গফুর, হাফিজ, আব্দুল্লাহ, শামসু, বশীর ও মুসা।
বগুড়া মোহাম্মদ আলী ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং স্বাধীনতা দিবস ফুটবল শেষে আমাদের চলমান লিগের কাকতালীয়ভাবে ড্র হওয়া একটি ম্যাচের ঘটনা দিয়ে আমার লেখা শুরু করছি। ওয়ারী এবং ফায়ার সমমানের দুটি টিম। খেলায় ড্র হতেই পারেÑতাই বলে উভয় পর্বে ড্র, তাও আবার গুনে গুনে ৩-৩ গোলের ড্র!
বৃষ্টিভেজা পিচ্ছিল মাঠে ভালো খেলা সম্ভব না হলেও ওয়ারী-ফায়ার জয়ের জন্য মাঠে নেমে আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। খেলার পঞ্চম মিনিটেই দেবুর দেয়া চমৎকার গোলে ফায়ার এগিয়ে গেলেও তা কিছুক্ষণের ব্যবধানে ওয়ারীর ভুট্টো বুলেট কিকে সীতাংশুকে পরাস্ত করে দলকে ১-১ গোলে সমতায় ফেরায়। এর ৪ মিনিট পরই ওয়ারীর লেফট আউট মাহমুদ দলকে ২-১ গোলের লিড এনে দিলেও তা ২ মিনিটের বেশি ধরে রাখতে পারেনি, আবুলের লবে চমৎকার হেড দিয়ে দিপু ফায়ারকে ২-২ গোলে সমতা এনে দিলে মুনিরের জোরালো কিকে সেটা ৩-২ গোলের লিডে পরিণত হয়েছিল। 
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা ছিল আরও প্রাণবন্ত। খেলা মাঠের উভয় ধারে সমানতালে চলছিল। খেলায় গতি ছিল, গোল করার চেষ্টা ছিল। ফায়ারের লিড ধরে রাখার জন্য লড়াই আর ওয়ারীর সমতায় ফেরার লড়াই। শেষ পর্যন্ত ওয়ারী সফল হয়েছিল তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথের দেয়া গোলের মাধ্যমে আর খেলাটি শেষ হয়েছিল ৩-৩ গোলের ড্র দিয়ে।
সেন্টার ফরোয়ার্ড সুজার অনবদ্য হ্যাটট্রিকের সুবাদে পিডব্লিউডি পুলিশের বিপক্ষে ৩-১ গোলে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ৮-৮-৬৭ তারিখের খেলায় পুলিশ অত্যন্ত ভালো খেলেছিল কিন্তু ভাগ্যের সহায়তা না পাওয়ায় তাদের হার মেনে নিতে হয়েছিল। ফলাফল ড্র হলেই যথাযথ হতো। পুলিশের আক্রমণগুলো অল্পের জন্য মিস হলেও পিডব্লিউডির সুযোগগুলোর সঠিক সদ্ব্যবহার হয়েছে। বিশেষ করে তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড সুজার চমৎকার খেলা, পরপর তিনটি দর্শনীয় গোল তাকে হ্যাটট্রিকের সম্মান এনে দিয়েছিল।
খেলার বিশ মিনিটে পুলিশ প্রথম গোল করেছিল কিন্তু রেফারি কর্তৃক সেটা বাতিল হয়ে যায়। ২৩ মি. তারা আরও একটা সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু গোল করতে ব্যর্থ হয়। এর পরমুহূর্তে রোকনের কাছ থেকে বল পেয়ে সুজা চমৎকার গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দেয়। ৩ মিনিট পর সুজা তার একক প্রচেষ্টায় গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দিয়ে নিজে হ্যাটট্রিকের কাছে পৌঁছে যায়। পুলিশ গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। এরই একটি আক্রমণে সাত্তারের লব থেকে ধীরেনের হেডটিও মিস হলে তারা ভাগ্যকে দোষারোপ করতে করতে বিরতিতে গিয়েছিল।
দ্বিতীয়ার্ধে পিডব্লিউডি তাদের লিগ ধরে রাখার যেমন চেষ্টা করে, তেমনি পুলিশ গোল শোধ করার জন্য জোর আক্রমণ চালায়। খেলা বেশ জমে উঠেছিল। খেলার ধারাবাহিকতায় পুলিশের নুরুর দূর থেকে আচমকা শটটি পিডব্লিউডির গোলরক্ষক মতিনকে ভেলকি দিয়ে জালে জড়িয়ে গেলে গোলের ব্যবধান  কমে ২-১ হয়। পুলিশ চাঙ্গা হয়ে তাদের আক্রমণের ধার বাড়িয়ে দেয় কিন্তু ভাগ্যদেবী পিডব্লিউডি টিমের সাথে থাকায় ২৬  মিনিটে সুজা আরও একটি গোল করে দলকে ৩-১ গোলের  জয় এনে দিয়েছিল, সে সাথে ‘হ্যাটট্রিক’ করার গৌরব অর্জন করেছিল।
পিডব্লিউডি : মতিন (গোলরক্ষক), কানু, মোহাম্মদ আলী এবং  হামিদ, আবিদ হোসেন এবং ওয়াহেদ, রোখান, ধীরেন, সুজা, বাবুল এবং মনজুর।
পুলিশ : আফজাল (গোলরক্ষক), মোহাম্মদ আলী, কায়েস এবং আখতার, হাফিজ এবং নুরু, রহিম, আব্দুর রব, এরশাদ, গফুর এবং সাত্তার। 
আউটার স্টেডিয়ামে সেদিনের (৮-৮-৬৭) লিগের অপর খেলা ছিল স্টেশনারি বনাম প্রেসের মধ্যে। ম্যাচটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল, আক্রমণ ছিল দু দলেরই। দু’দলই গোল করার সুযোগ তৈরিও করেছিল কিন্তু  পোস্টে মারার চেয়ে বল বাইরে মেরেছে বেশি; তবে দু’দলই একটি করে গোল করেছিল। প্রথমার্ধে করেছিল স্টেশনারি তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড কামাবিলের মাধ্যমে আর প্রেস করেছিল দ্বিতীয়ার্ধে জালালের চমৎকার হেডের গোলের মাধ্যমে। খেলা ১-১ গোলে ড্র।
রহমতগঞ্জ ওয়ারীর গোলরক্ষক তপনের ভুলের সম্পূর্ণ ফায়দা গ্রহণ করে পূর্ণ পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল। প্রথম পর্ব দু’টিমের খেলা ২-২ ড্র ছিল। এ খেলার রেজাল্ট ড্র হওয়া উচিত ছিল।  মাঝারি মানের এ দু’টিমের ১৬-৮-৬৭ তারিখের খেলায় ভালো কিছু লেখার ছিল না। দু’টিমে  সামনে গোল করার সুযোগ এসেছিল আর দু’টিমের ফরোয়ার্ডরা গোল করতে ব্যর্থ হয়েছিল। প্রথমার্ধে দু’দলের আক্রমণ বিপক্ষ সীমানা পেরিয়ে গোলমুখে পৌঁছালেও গোল করার যোগ্যতা কেউ দেখাতে পারেনি। দ্বিতীয়ার্ধের চিত্রও ছিল একরকম শুধু একবার ব্যতিক্রম ঘটেছিল যখন ওয়ারীর গোলরক্ষক তপন ভুল করে নিজ দলের খেলোয়াড় ভেবে রহমতগঞ্জের গফুরকে বল দিয়েছিল এবং সে বেলালকে পাস দেয়ার সাথে সাথে বেলাল গোলপোস্টে বল ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আর সেটাই ওয়ারীর জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছিল ১-০ গোলের পরাজয়।
ফায়ার সার্ভিস আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় প্রেসকে ৩-১ গোলে হারিয়েছিল। দিপুর চমৎকার দু’গোলের সুবাদে ফায়ার প্রথমার্ধে এগিয়ে যায়। প্রথম পর্ব তারা গোলশূন্য ড্র করেছিল। খেলার ১০ মিনিটে লেফট আউট ওহাবের লব থেকে দিপু হেডের সাহায্যে গোল করে ফায়ারকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। বিরতির সামান্য আগে আবারও ওহাবের কাছ থেকে বল পেয়ে দিপু আরও একটি গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে নেয়। এ দুটি চমৎকার গোলের জন্য দিপু যেমন প্রশংসার দাবি করতে পারে, তেমনি সুন্দর বল জোগান দেয়ার জন্য ওহাবকেও প্রশংসা করতে হবে।
বিরতির পরপর প্রেসের রাইট-ইন শুভাষের গোলপোস্টে মারা জোরালো শটে সেন্টার ফরোয়ার্ড আলমগীর মাথা লাগিয়ে গোলরক্ষক সীতাংশুকে পরাস্ত করলে গোলের ব্যবধান কমে ২-১ দাঁড়ায়। প্রেসম্যানরা গোলশোধ করার জন্য জোর আক্রমণ চালিয়ে ফায়ারের ডিফেন্সে ত্রাসের সৃষ্টি করে কিন্তু সবই বিফল হয়ে যায় যখন ওহাব নিজেই দলের তৃতীয় গোল করে ৩-১ গোলের লিড এনে দিয়েছিল আর খেলা শেষে ফলাফলটাও অপরিবর্তিত ছিল।
১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা মোহামেডান বনাম ইপিআইডিসি সে সময় এরকম টুর্নামেন্টের আগে ভেটার্নদের একটা প্রীতি ম্যাচ রাখা হতো, যারা দর্শকপূর্ণ স্টেডিয়ামে নিজেদের সেরা সময়ের কিছু নৈপুণ্য প্রদর্শন করে আত্মতৃপ্তি পেতেন আর দর্শকরা বিগত দিনের খেলার স্মৃতি রোমন্থন করে মূল খেলার পূর্বে কিছুটা সময় কাটাবার সুযোগ পেতেন। সেদিনও ভেটার্নদের প্রীতি ম্যাচ রাখা হয়েছিল। যারা সেদিন মাঠে নেমেছিলেন, তাদেরকে বর্তমান খেলোয়াড় এবং কর্মকর্তাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে তাদের নামের তালিকা এখানে তুলে ধরছি।  আব্বাস মির্জা, খন্দকার নাসিম, রশীদ জুনিয়র, হাফেজ রশীদ, সিদ্দিক দেওয়ান, সাত্তার, শাজাহান, ইয়াসিন, আলাউদ্দিন, আরজু, বাহারাম, ইলিয়াস, ইলিয়াস উদ্দিন আহমেদ, চান্দু খান, চুন্না রশীদ, গজনবী, মারী, রঞ্জিত, সাহেব আলী, দলিল খান, শফি, এসএ মান্নান, এসএ জামান, তসলিম, ওয়াজেদ আলী, ইউসুফ (চট্ট.), কাদের (চট্ট.), এমএ খান, নজর মোহাম্মদ, নূর হোসেন, এলএ খান মজলিস, শাহ আলম হামিদ, রহিম, হাবিব উল্লাহ, আজিজুল হক। প্রীতি ম্যাচ সাধারণত ড্র দিয়ে শেষ হতো। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।
ফাইনাল খেলাটি ইপিআইডিসি অত্যন্ত ভালো শুরু করেছিল। তারা একটি টিম হিসেবে খেলে প্রথম থেকে মাঠের কর্তৃত্ব নেয়ার সবরকম চেষ্টা চালায়। তাদের দলীয় সমঝোতা ছিল চমৎকার। বল নিয়ন্ত্রণ, খেলার গতি, শুটিংÑ সবকিছুর মধ্যে ছিল তাদের মুন্সিয়ানা। #

(১০৮)
১৯৬৭ সালের ১১ আগস্ট  আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের একটি বিশেষ দিন। এই দিনে গঠিত হয়েছিল ইস্ট পাকিস্তান অলিম্পিক এসোসিয়েশন। যা ছিল এ অঞ্চলের ক্রীড়ামোদীদের দীর্ঘদিনের চেষ্টার ফসল। আমাদের ক্রীড়া কর্মকান্ডের সার্বিক দায়িত্বে থাকা ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের কর্মপরিচালনার ব্যাপারে বিশিষ্ট কিছু সিনিয়র সংগঠকের মতপার্থক্য, মতবিরোধ দেখা দিয়েছিলÑ যার জের ধরে সিনিয়র সংগঠকরা ইপিএসএফকে পাশ কাটিয়ে ভিন্ন ভিন্ন খেলা আলাদা আলাদা সংগঠনের মাধ্যমে দেশের খেলাধুলা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন আর সে উদ্দেশ্যেই তারা ভিন্ন ভিন্ন গেমস এসোসিয়েশন গঠন করেছিলেন। গেমস এসোসিয়েশনগুলো নিজ নিজ ন্যাশনাল ফেডারেশনের সাথে নিবন্ধন (এফিলিয়েটেড) করে তাদের সহযোগিতা এবং নির্দেশনায় ক্রীড়া কর্মকান্ড পরিচালনা শুরু করেছিল। এসোসিয়েশন গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইপিএসএফ-এর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কর্মকান্ড পরিচালনা করা এবং খেলার প্রসার এবং উন্নতি সাধন করা।
সেই বিশিষ্ট সংগঠকরাই ১১ আগস্ট বিকেলে জাতীয় কোচিং সেন্টারে (বর্তমান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমন্যাশিয়াম) এক সভার আহ্বান করেছিলেন। সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন ক্রীড়াঙ্গনের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ক্রীড়াব্যক্তিত্ব, বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক এবং বিভিন্ন গেমস এসোসিয়েশন প্রতিনিধি; যেমন ইস্ট পাকিস্তান অ্যামেচার  বক্সিং, রেসলিং, জিমন্যাস্টিক, ওয়েটলিফটিং, বডিবিল্ডিং, সাইক্লিং, সুইমিং, কাবাডি, ভলিবল, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন প্রভৃতি এসোসিয়েশন।
সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন এনএ লস্কর, এমএনএ। সভায় বক্তারা এ অঞ্চলের খেলাধুলার ব্যাপারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, অবকাঠামো তৈরি, খেলাধুলার প্রসার ও উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন ইত্যাদির কথা বলেন। খেলাধুলার বিভিন্ন ব্যাপারে আলোচনার পর একটি শক্তিশালী এসোসিয়েশন গঠন করে তার মাধ্যমে এসব শূন্যতা পূরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন বলে বক্তাদের বক্তব্যে প্রকাশ করা হয়। আর তাই সভায় উপস্থিত সবার সম্মতিতে ইস্ট পাকিস্তান অলিম্পিক এসোসিয়েশন গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। ইস্ট পাকিস্তান অলিম্পিক এসোসিয়েশন পাকিস্তান অলিম্পিক এসোসিয়েশনের ‘ইস্ট-উইং ব্রাঞ্চ’ হিসেবে কাজ করবে। এ শাখা  প্রাদেশিক বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনের সাথে সমন্বয় ঘটিয়ে খেলাধুলার প্রসার এবং উন্নয়নে সহযোগিতা করবে। সভায় ঢাকায় একটি ‘অলিম্পিক হাউজ’ তৈরি করারও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।
সভায় সর্বসম্মতির ভিত্তিতে ইস্ট পাকিস্তান অলিম্পিক এসোসিয়েশনের এডহক কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন এনএ লস্কর; ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন মেজর এমটি হোসেন এবং এফএমবি আলম। এএস খানকে কনভেনর এবং জি রসুলকে ট্রেজারার করা হয়েছিল। প্রত্যেক অ্যামেচার গেমস এসোসিয়েশনের একজন করে প্রতিনিধি হবেন এডহক কমিটির মেম্বার।
ভিক্টোরিয়া আরও একটি পয়েন্ট খুইয়েছিল আজাদের সাথে গোলশূন্য ড্র করে। প্রথম পর্বে আজাদ হারলেও এবার  (১৭-৮-৬৭) তারা সমানতালে লড়ে ভিক্টোরিয়ার মূল্যবান একটি পয়েন্ট ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল এবং তাদেরকে লিগ তালিকায় পেছনে ফেলে দিয়েছিল। প্রথমার্ধে ভিক্টোরিয়ার খেলার ধার থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধে সেটা আজাদের পক্ষে ছিল। ভিক্টোরিয়া খেলার ৬ মিনিটেই এগিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ পেয়েছিল। ইউসুফের লবে লেফট-ইন জানির অত্যন্ত চমৎকার হেডটি আরও চমৎকার আর দক্ষতার সাথে আজাদের গোলরক্ষক সেভ করে করেছিল। ভিক্টোরিয়া পরপর কয়েকটা আক্রমণ চালিয়েও আজাদের রক্ষণব্যুহে ফাটল ধরাতে পারেনি; তবে ৩০ মিনিটে ইউসুফের জোরালো কিক অল্পের জন্য পোস্টের বাইরে চলে যায় এবং বিরতির আগ মুহূর্তে দেবুর দুর্দান্ত শটটি ক্রসবার ছুঁয়ে বাইরে চলে যাওয়াটা ছিল ভিক্টোরিয়ার গোল না পাওয়ার কষ্ট।
বিরতির পর আজাদ ভিক্টোরিয়ার ওপর চড়াও হয়ে খেলতে থাকে এবং ১৭ মিনিটে আজাদের মন্টু যে গোল মিস করেছিল তা ক্ষমারও অযোগ্য, মাত্র কয়েক হাত দূর থেকে গোল করতে ব্যর্থ হয়েছিল। মন্টুর এ ব্যর্থতা ভিক্টোরিয়ার গোলরক্ষক করিমকে স্বস্তি  এনে দিয়েছিল। খেলার ২৬ মিনিটে লেফট ইন আবুলের দেয়া পাস লেফট আউট মন্টু সময়মত বলে পা লাগাতে না পারায় আজাদ গোলের দেখা পায়নি। আবার খেলার  শেষ মিনিটে ইমাম আজাদের গোলরক্ষককে একা পেয়েও বিট করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ফলাফল গোলশূন্য ড্র।
ঐতিহ্যবাহী ওয়ারী ক্লাব তাদের ১৮ আগস্ট ইপিআইডিসি দলের বিরুদ্ধে খেলায় মাঠে উচ্ছৃংখল আচরণ এবং রাফ খেলায় মেতে উঠেছিল, যার জন্য ক্লাবের সুনাম ক্ষুণœ হয়েছিল। খেলার ২৫ মিনিটে তাদের বিরুদ্ধে রেফারির পেনাল্টির নির্দেশকে কেন্দ্র করে তারা খেলতে অস্বীকৃতি জানালে খেলা প্রায় ১২ মিনিট বন্ধ থাকে। ওয়ারীর গোলরক্ষক ইপিআইডিসির সেন্টার ফরোয়ার্ড আসলামকে লাথি মারলে রেফারি পেনাল্টির সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। ১২ মিনিট খেলা বন্ধ থাকার পর পেনাল্টি কিকের মাধ্যমে পুনরায় খেলা শুরু হয়েছিল। আসলাম পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে ১-০ এগিয়ে দিয়েছিল। গোল খাওয়ার পর ওয়ারীর খেলোয়াড়রা ফুটবল খেলা বাদ দিয়ে ‘রাফ’ এবং ‘ডেঞ্জার’ খেলায় মেতে উঠেছিল আর নায়কের ভূমিকায় ছিল রাইট-আউট তপন চৌধুরী এবং খলিল। গোল শোধ করার চিন্তা বাদ দিয়ে মারামারি করার চিন্তাতেই সারামাঠ বিপক্ষ খেলোয়াড়দের পেছনে ছুটেছে। অন্যদিকে ইপিআইডিসি সেদিন খুবই শান্ত-ধীর-স্থির এবং সাবধানে খেলে গোলের সংখ্যা বাড়াবার চেষ্টা করে গেছে।
দ্বিতীয়ার্ধের ১৫ মিনিটে প্রতুলের কাছ থেকে বল পেয়ে জব্বর দলের পক্ষে দ্বিতীয় গোল করেছিল। খেলার শেষ কয়েক মিনিট ওয়ারী আলোর স্বল্পতার অজুহাতে খেলা বন্ধ করার জোর আবেদন জানালে রেফারি সেটা নাকচ করে দেন এবং নির্ধারিত সময় শেষে খেলা শেষ করে ইপিআইডিসি ২-০ গোলের জয় নিয়ে নিরাপদে মাঠ ছেড়েছিল।
সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে রেলওয়ে ব্লুজ পিডব্লিউডিকে ২-২ গোলে ড্র করতে বাধ্য করেছিল। প্রথম পর্বে রেল হেরেছিল ২-০ গোলে। রেল দল ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল প্রথমার্ধে। পিডব্লিউডি অনেক সুযোগ পেয়েও গোল করেনি। দ্বিতীয়ার্ধে তারা ২ গোল করে সমতায় ফেরালে খেলাটি ‘পাতানো’ ছিল বলে অনেকের ধারণা। খেলার ১২৭ মিনিটে রেলের গিয়াস জটলার মধ্য থেকে গোল করলে এর ১০ মিনিট পর সেন্টার ফরোয়ার্ড জেমস সেটাকে ২-০তে নিয়ে যায়। বিরতির পর পিডব্লিউডির মঞ্জুরের পাসে একটি গোল শোধ দিলে সেন্টার ফরোয়ার্ড সুজা হেড করে ২-২ গোলের সমতায় ফিরিয়েছিল দলকে। এর পরের দৃশ্য আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ। গোল করার মহড়া সবই ছিল, ছিল না শুধু গোল। তাই অনেকের ধারণায় এসেছিল, খেলাটি বোধ হয় পাতানো ছিল।
লিগ চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান তাদের ১৯-৮-৬৭ তারিখের খেলায় স্টেশনারির বিরুদ্ধে ৭-০ গোলের বড় জয় পেয়েছিল। খেলার ফলাফলেই ফুটে ওঠে খেলার সামগ্রিক চিত্র। একটি শক্তিশালী দল তার বিপক্ষ দল দুর্বল, একটি দল গোল করার পরিকল্পনা আঁটলে অন্য দল গোল না খাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। আমরা বিরতির পূর্বেই ৪-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম পর্বে আমরা মাত্র ৩-০ গোল করতে পেরেছিলাম। খেলার মাঝামাঝি সময় পেনাল্টি গোলের মাধ্যমে প্রথম গোল এসেছিল কাদেরের মাধ্যমে এবং এর পরের মিনিটেই আব্দুল্লাহ একটি সহজ গোল পেয়ে যায় (২-০)। বিরতির আগ মুহূর্তে আমি  সেটাকে হালিতে পূর্ণ করেছিলাম (৪-০)।
বিরতির পরের চিত্র একই ধরনের। আমরা মাঠের কর্তৃত্ব বজায় রেখে দাপটের সাথে খেলছি তো আমাদের বিপক্ষ দল তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখার লড়াই করে যাচ্ছিল। চতুর্থ মিনিটে শামসু দলের পঞ্চম গোল করেছিল। তবে ২০ মিনিটে স্টেশনারির সেন্টার ফরোয়ার্ড কামাবিল একটিবারের জন্য হলেও আমাদেরকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। একক প্রচেষ্টায় বল নিয়ে ঢুকে পড়েছিল আমাদের গোল সীমানায় এবং দুর্দান্ত কিক দিয়ে আমাদের গোলরক্ষক রানার পরীক্ষার নিয়েছিল। রানা খুবই চমৎকারভাবে শটটি সেভ করেছিল। ২২ মিনিটে প্রতাপের পাশে গফুর ৬ষ্ঠ গোল করেছিল আর রসুল বখশ দলের পক্ষে শেষ গোল করলে আমরা ৭-০ গোলের সহজ জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলাম।
ফুটবল লিগের ২০-৮-৬৭ তারিখের খেলায় ওয়ান্ডারার্স এবং ফায়ার সার্ভিস ১-১ গোলে ড্র করেছিল। প্রথম পর্বে ফায়ার ৩-০ গোলে জিতেছিল। এ পর্বের খেলায় বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। ওয়ান্ডারার্সের নিয়মিত খেলোয়াড়ের পরিবর্তে কিছু নতুন খেলোয়াড় মাঠে নেমেছিল, তারপরও ফায়ার জয়লাভ করতে পারেনি। ৫ মিনিটে দিপু জঘন্যভাবে গোল মিস করেছিল; তবে পরবর্তীতে তারই নিখুঁত পাসে ওহাব জোরালো কিকে বিপক্ষ গোলরক্ষক ফেরদৌসকে পরাস্ত করে ফায়ারকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। খেলায় তখন প্রাণ ফিরে এসেছিল এবং ওয়ান্ডারার্সও গোল শোধ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ওয়ান্ডারার্সের আফাজ, কখনও লেফট-আউট, কখনও সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলছিল সে প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে বিদ্যুৎ গতির গ্রাউন্ডেড শটে ফায়ারের গোলরক্ষক মতিনকে পরাস্ত করে দলকে সমতায় ফিরিয়ে এনেছিল। খেলার বাকি সময় দু’দলই ঢিলেঢালা খেলে সময় পার করে দিয়েছিল।
(ক্রমশ.)

(১০৯)
শক্তিশালী ইপিআইডিসি প্রথম পর্বে ৭-০ গোলে রেলওয়ে ব্লুজকে পরাজিত করলেও ২১-৮-৬৭ তারিখে তারা একমাত্র গোলে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলÑ তাও দ্বিতীয়ার্ধের ৫ মিনিটে হাশেমের দেয়া গোলে। ইপিআইডিসি দ্বিতীয় পর্বের খেলাকে খুবই হাল্কাভাবে নিয়েছিল, নিয়মিত খেলোয়াড়ের পরিবর্তে কয়েকজন নতুন খেলোয়াড়কে খেলার সুযোগ দিয়েছিল। তারপরও তারা গোল করার সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু সে সুযোগগুলোকে হেলায় খেলায় নষ্ট করেছে। অন্যদিকে রেলওয়ে ব্লুজ দৃঢ় মনোভাব নিয়ে মোকাবেলা করে গেছে; এমনকি তারা গোল করার সুযোগও সৃষ্টি করেছিল, শুধু দক্ষতার অভাবে সেগুলো কাজে লাগাতে পারেনি। 
বিরতির পর ইপিআইডিসি খেলা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আক্রমণ জোরদার করে এবং পাঁচ মিনিটেই ফল পেয়ে যায়। লেফট-আউট গাজীর পাস ধরে হাশেম তার মাপা শট দিয়ে রেলের গোলরক্ষক ইয়ার মোহাম্মদকে  পরাস্ত করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। খেলার অবশিষ্ট সময় ইপিআইডিসি রেলওয়ে ব্লুজকে কোণঠাসা করে রেখেও আর কোন গোল বের করে আনতে পারেনি।
সেদিনের আউটার স্টেডিয়ামে লিগের অপর খেলাটিতেও একমাত্র গোলে পিডব্লিউডি প্রেসকে পরাজিত করেছিল। প্রথম পর্বে তারা ১-১ গোলে ড্র করেছিল। দিনটি প্রেসের জন্য ছিল খুবই ‘আনলাকি’ তারা ভাল খেলেছে, বেশি আক্রমণ করেছে কিন্তু ভাগ্যের সহায়তা লাভ করতে পারেনি। অন্যদিকে পিডব্লিউডির সাথে তাদের ভাগ্য জড়িয়েছিল বলে তারা জয় পেয়ে পূর্ণ পয়েন্ট লাভে সক্ষম হয়েছিল। পিডব্লিউডির রক্ষণভাগ এবং গোলেরক্ষক খুব ভাল খেলে প্রেসের গোল করার সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল।    
আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলাটা প্রথমার্ধ ভালই জমেছিল কিন্তু গোলের দেখা কোন দলই পায়নি। দ্বিতীয়ার্ধের ৩৫ মিনিট পর্যন্ত উভয় দল সমান তালে খেলে গেছে; হঠাৎ করেই ভাগ্য পিডব্লিউডি দলের দিকে হেলে গিয়েছিল। গনির কর্নার কিক, সুজার হেড, গোলরক্ষক প্রস্তুত বল ধরার জন্য, বল একজন ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে সোজা গোলপোস্টে ঢুকে গিয়েছিল। ‘গড গিফটেড গোল’! প্রেস অবশিষ্ট সময় অনবরত চাপ দিয়েও ভাগ্যের লিখন বদলাতে পারেনি শেষ পর্যন্ত ১-০ গোলের হার মেনে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল।
ওয়ারী ২২-৮-৬৭ তারিখের খেলায় ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে দারুণ জয় পেয়েছিল। প্রথমার্ধে ২-২ গোলের ড্র। প্রথম পর্বে ওয়ান্ডারার্স ৫-২ গোলে ওয়ারীকে হারিয়েছিল। ওয়ারীর এই জয়কে ‘ফ্লুক’ বলা যাবে না। তারা যোগ্য দল হিসেবে উন্নত মানের খেলা প্রদর্শন করে জয়লাভ করেছিল। ওয়ান্ডারার্স মানসম্মত খেলা খেলতে না পারলেও তাদের রক্ষণ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে খেলে ওয়ারীর আক্রমণগুলো প্রতিহত করতে পেরেছিল; নইলে ওয়ান্ডারার্সকে অধিক গোলের হার স্বীকার করতে হতো।
খেলার তৃতীয় মিনিটেই জামিল আক্তারের পাসে সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ গোলরক্ষক ফেরদৌসকে পরাস্ত করে ওয়ারীকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। গোল শোধ করার জন্য ওয়ান্ডারার্স জোর আক্রমণ চালালেও উল্টো আরও একটি গোল হজম করতে হয়েছিল নিশিথের পাশে লেফট-আউট মাহমুদের দেয়া গোলে (২-০)। তবে ওয়ান্ডারার্সের আক্রমণের চাপে ওয়ারীর রক্ষণ বেসামাল হয়ে পড়েছিল আর রাইট-ইন সুরেন সেন্টার ফরোয়ার্ড হাবিবের থু্রু পাস থেকে গোল করে ব্যবধান  কমিয়ে ২-১ করলে ৩ মিনিটেই লেফট-ইন আলাউদ্দিন সেটাকে ২-২ গোলের সমতা এনে দিয়েছিল।
বিরতির পর দু’দলের মাঠ দখলের যুদ্ধ, খেলায় উত্তেজনা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যাওয়ায় খেলাটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। খেলার এরকম অবস্থায় ওয়ান্ডারার্সের ইসমাইল রুশো সতীর্থ খেলোয়াড় রাজ্জাকের পাসে চমৎকার গোল করে দলকে ৩-২ গোলের লিড এনে দেয়। কিন্তু সে লিড তারা বেশি সময় ধরে রাখতে পারেনি ২৭ মিনিটেই হামিদের লব থেকে চমৎকার হেডে তপন চৌধুরী গোল করে ৩-৩ সমতায় ফিরিয়ে ছিল ওয়ারীকে আর ৩০ মিনিটে সেন্টার ফরোয়ার্ড নিশিথ উইনিং গোল করে দলকে অভূতপূর্ব এক জয় (৪-৩) উপহার দিয়েছিল। 
আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় ভিক্টোরিয়া প্রথমার্ধের দেয়া ২ গোলে স্টেশনারিকে পরাজিত করেছিল। প্রথম পর্বের একই ব্যবধানে (২-০) ভিক্টোরিয়া জয়ী হয়েছিল। স্টেশনারি প্রথমার্ধে রক্ষণাত্মক খেলা খেললেও দ্বিতীয়ার্ধে জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিল। তাদের রক্ষণভাগ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে খেলে ভিক্টোরিয়ার আক্রমণভাগকে অকার্যকর করে দিয়েছিল। ভিক্টোরিয়া যা কিছু করার, তা প্রথমার্ধেই করে ফেলেছিল; নইলে দ্বিতীয়ার্ধে কি হতো কে জানে।
ভিক্টোরিয়া খেলার ১৭ মিনিটে লেফট-ইন খলিলের সহজ গোলের সুবাদে ১-০ এগিয়ে গিয়েছিল এবং ৫ মিনিটের মধ্যে ইউসুফের পাসে আলী ইমাম স্টেশনারির গোলরক্ষক বাচ্চুকে পরাস্ত করে সেটাকে দ্বিগুণ করে দিয়েছিল (২-০)। দ্বিতীয়ার্ধে স্টেশনারি প্রচন্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও ভিক্টোরিয়ার গোলমুখ খুলতে পারেনি।
২৩ আগস্ট স্টেডিয়ামে আমাদের (মোহামেডান) সাথে পুলিশের দ্বিতীয় পর্বের খেলা ছিল। প্রথম পর্বে পুলিশ আমাদের কাছে হেরেছিল ৭-১ গোলে। আমরা সময়মত মাঠে উপস্থিত হলেও পুলিশ টিম সেদিন মাঠেই উপস্থিত হয়নি। অগত্যা রেফারি নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত ১৮ মিনিট অপেক্ষা করে আমাদের পক্ষে ওয়াকওভার প্রদান করে মাঠত্যাগ করেছিলেন।
আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত লিগের অপর খেলায় রেলওয়ে ব্লুজ ফায়ার সার্ভিসকে পরাজিত করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। প্রথমার্থে ফায়ার ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল। ধীরগতি আর নিচুমানের খেলা দেখার জন্য গুটিকয়েক ‘ফুটবল নেশাগ্রস্ত’ দর্শক মাঠে উপস্থিত ছিলেন। তারা খেলার শেষ বাঁশির সাথে সাথে যন্ত্রণাদায়ক ফুটবল দেখা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন।
খেলার ১০ মিনিটে শরফুদ্দিন গোল করে ফায়ারকে এগিয়ে দিলেও পরমুহূর্তেই রেলওয়ে ব্লুজের সেন্টার ফরোয়ার্ড জেমস একক নৈপুণ্যে জোরালো শট দ্বারা গোল করে দলকে সমতায় ফিরিয়ে দেয় (১-১)। দিপু ফায়ারকে লিড এনে দিয়েছিল (২-১) যা বিরতি পর্যন্ত অক্ষুন্ন থাকে। বিরতির পর রেলের নাসিরুল্লাহ সমতা এনে দেয় আর খেলার অন্তিম মুহূর্তে রেলের সেন্টার ফরোয়ার্ড জেমস উইনিং গোলটি করলে রেলওয়ে ব্লুজ ৩-২ গোলে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। 
ভিক্টোরিয়ার দ্বিতীয় পরাজয়। ২৪-৮-৬৭ তারিখে স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ খেলায় পাক পিডব্লিউডি ২-০ গোলে ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে জয়লাভ করেছিল। প্রথম পর্বে দুই টিম ২-২ ড্র করেছিল। খেলায় উল্লেখ করার মত একটি বিষয় সামনে এসেছিল আর সে বিষয় সামাল দিতে ২০ মিনিট খেলা বন্ধ রাখতে হয়েছিল। অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের বিশ মিনিট পর খেলা শুরু করতে হয়েছিল আর বিষয়টা ছিল দু’দলের জার্সি। দু’দলের জার্সির রং একই হওয়া এবং অরিজিনাল জার্সি কোন দলই বদলাতে রাজি না হওয়া। অবশেষে কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপে বিষয়টির সমাধান হলে খেলা শুরু হয়েছিল।
খেলায় জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা, উত্তেজনা সেই সাথে শক্তি প্রয়োগÑ সব মিলিয়ে খেলাটিতে প্রাণ ছিল, দর্শকরা তা ভালই উপভোগ করেছিলেন। খেলার ছয় মিনিটে কর্নার কিক থেকে রাইট আউট বাবুল চমৎকার গোল করে পিডব্লিউডিকে এগিয়ে দিয়েছিল (১-০)। গোল খেয়ে ভিক্টোরিয়া পিডব্লিউডির ওপর চড়াও হয়ে পরপর দুটো সুযোগ নষ্ট করে। এ সময় দু’দল রাফ খেলার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। খেলার এরকম পরিস্থিতিতে পিডব্লিউডির আবিদ হোসেন ভিক্টোরিয়ার সেন্টার ফরোয়ার্ড আলী ইমামকে ঘুষি মারলে রেফারি মোহাম্মদ আলী আবিদ হোসেনকে মাঠ থেকে বের করে দেন। সে সময় মাঠে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ, মিনিটে মিনিটে খেলার সীমানা বদল, গোলের উজ্জ্বল সম্ভাবনায়  ভিক্টোরিয়া গোল শোধ করার সর্বাত্মক চেষ্টা, অন্যদিকে দশজনের টিম পিডব্লিউডি লিড ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টাÑ সব মিলিয়ে উপভোগ্য একটি ম্যাচ সেদিন দর্শকরা দেখেছিলেন। ২৩ মিনিটে পিডব্লিউডির কৃতী সেন্টার ফরোয়ার্ড সুজা একক নৈপুণ্যে গোলরক্ষক দুলু আফিন্দিকে পরাস্ত করে দলকে ভারমুক্ত করেছিল (২-০)।  দ্বিতীয়ার্ধে ভিক্টোরিয়া গোল শোধ করার জন্য প্রথম থেকে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল কিন্তু পিডব্লিউডি দশজন মিলে শক্তিশালী রক্ষণ দেয়াল তৈরি করে আক্রমণগুলোকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। তাছাড়াও ভিক্টোরিয়ার লেফট আউট জানি যে দুটো গোল মিস করেছিল, তা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। শেষ পর্যন্ত পিডব্লিউডি তাদের প্রথমার্ধের দুটি গোল  অক্ষুন্ন রেখে ২-০ গোলের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল।
(চলবে)

(১১০)
ইপিআইডিসি ৭-০ গোলে স্টেশনারিকে বিধ্বস্ত করেছিল আর জব্বর করেছিল মৌসুমে তার দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক। ২৫-৮-৬৭ তারিখে শক্তিশালী ইপিআইডিসি আকর্ষণহীন খেলায় দুর্বল স্টেশনারিকে চিড়ে চ্যাপ্টা করে দিয়েছিল। খেলার অনুপযুক্ত মাঠে একমাত্র উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল জব্বরের হ্যাটট্রিক।
প্রথমার্ধের স্টেশনারি কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল মাঝে মাঝে ওপরে উঠে শক্তিশালী ইপিআইডিসি রক্ষণকে নাড়া দিচ্ছিল। ব্যস, ঐ পর্যন্তই। খেলার ২০ মিনিটে জব্বরের বল ধরে আসলাম চতুরতার সাথে গোলরক্ষককে বিট করে দলকে এগিয়ে দিয়েছিল (১-০)। এর পরের গোল ‘গিফটেড’ স্টেশনারির স্টপার সিরাজের হেড নিজ জালে জড়িয়ে গেলে (২-০)। বিরতির আগ মুহূর্তে আসলামের নিখুঁত লব গাজিকে স্টেশনারির গোলরক্ষক প্যাট্রিক গোমেজকে বিট করতে কোন অসুবিধা হয়নি (৩-০)।
বিরতির পর ইপিআইডিসি খেলার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজেদের পক্ষে নিয়ে স্টেশনারিকে তাদের সীমানায় চেপে রেখেছিল। জব্বর ১৭ মিনিটে হেডের মাধ্যমে প্রথম গোল করেছিল আর দলের পক্ষে ছিল চতুর্থ গোল। দু’মিনিট পরই জব্বর তার নিজস্ব স্টাইল লম্বা লম্বা স্টেপে বল নিয়ে ছুটে গিয়ে বুলেট শট মেরে তার দ্বিতীয় গোল করে পৌঁছে গিয়েছিল হ্যাটট্রিকের দোরগোড়ায়। হাশেমের দেয়া পাশে জব্বর তার হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছিল আর সেটা ছিল চলতি লিগে জব্বরের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক। সেই সাথে দলের গোলসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল অর্ধডজনে। শেষ গোলটি এসেছিল রাইট আউট সলিমুল্লাহের পা থেকে আর এ গোলের সুবাদে স্টেশনারির বিরুদ্ধে ইপিআইডিসি ৭-০ গোলের সহজ পেয়েছিল।
২৮-৮-৬৭ তারিখেও ইপিআইডিসি তাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে ফায়ার সার্ভিসকে ৫-২ গোলে পরাস্ত করেছিল। নিঃসন্দেহে ইপিআইডিসি একটি শক্তিশালী দল। তাদের পরিকল্পনা, দলীয় সমঝোতা, ব্যক্তিগত নৈপুণ্য সবক্ষেত্রেই তারা ফায়ারের চেয়ে অনেক এগিয়ে। অন্যদিকে ফায়ারের উদ্দেশ্যহীনভাবে মাঠে  ছোটাছুটি আর অগোছালো খেলাই দলের খেলার মান স্পষ্ট করে দিয়েছিল। তারপরও  ইপিআইডিসিকে প্রথম গোল হজম করতে হয়েছিল খেলার চতুর্থ মিনিটেই। আলী হাফিজ নিজ গোল সীমানার ভেতর বল হাত দিয়ে খেলার খেসারত দিতে হয়েছিল পেনাল্টির মাধ্যমে আর ফায়ারের সামাদ গোল করে দলকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল। ৩ মিনিটেই তা শোধ হয়েছিল হাশেমের পাসে জব্বরের গ্রাউন্ডার বুলেট শটের মাধ্যমে (১-১)। পরের মিনিটেই  প্রতুলের পোস্টে মারা শটটি রক্ষণে আবুলের পায়ে লেগে গতি পরিবর্তিত হয়ে মোতালেবকে বোকা বানিয়ে ফায়ারের পোস্টে ঢুকে ইপিআইডিসিকে ২-১ গোলের লিড এনে দিয়েছিল। প্রথমার্ধের ২৭ মিনিটে ইপিআইডিসির সেন্টার ফরোয়ার্ড আসলাম বিপক্ষ গোলসীমায় গোল করার উদ্দেশ্যে হেড করতে উঠেছিল। সে সময় ফায়ারের আবুল তাকে ফাউল করলে রেফারি মুনীর হোসেন পেনাল্টির নির্দেশ দেন। ফায়ার এ নির্দেশ মেনে নিতে চায়নি এবং এর প্রতিবাদে তারা খেলতে অস্বীকৃতি জানালে খেলা প্রায় ৬ মিনিট বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে খেলা শুরু হলে আসলাম পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে ৩-১ গোলে এগিয়ে দিয়েছিল।
বিরতির পর ফায়ার গোল শোধ করার জন্য প্রচন্ড চাপ দিচ্ছিল, সুযোগও সৃষ্টি করেছিল আর এর একটির সদ্ব্যবহার করেছিল দিপু। দ্বিতীয়ার্ধের ২য় মিনিটে শাহাবুদ্দিনের মাপা পাস ধরে (৩-২)। এ গোল ইপিআইডিসি ক্যাম্পে কম্পন ধরিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্যের সহায়তায় জব্বর একটি ‘অফ চান্সে’ গোল পেয়ে যায়। মুসার শট ফায়ারের ক্রসবারে লেগে ফেরত এলে জব্বরের গোল করতে কোন অসুবিধা হয়নি। খেলার শেষ বাঁশির মিনিটখানেক আগে হাশিমের চমৎকার লবে আসলাম হেড দিয়ে গোল করলে ইপিআইডিসি ৫-২ জয় পেয়ে যায়।
আউটার স্টেডিয়ামে লিগের অপর খেলায় আজাদ স্পোর্টিং ২-০ গোলে স্টেশনারিকে পরাজিত করে পূর্ণ ২ পয়েন্ট লাভ করেছিল। প্রথম পর্ব তারা ১-১ গোলে ড্র করেছিল। আজাদ যোগ্য দল হিসেবেই জয়ী হলেও স্টেশনারি খুব খারাপ খেলেছে বলা যাবে না, তারাও ভাল খেলেছিল। সুযোগও পেয়েছিল; শুধু কাজে লাগাতে পারেনিÑ যা আজাদ করতে পেরেছিল। আজাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড আবুল প্রথম গোল করেছিল আর দ্বিতীয় গোলটি এসেছিল মিন্টুর পাসে লেফট-ইন নজরুলের বুট থেকে।
রহমতগঞ্জের প্রতিশোধমূলক জয়। ১৬-০৬-৬৭ তারিখে প্রথম পর্বে তারা পিডব্লিউডির কাছে হেরেছিল ২-১ গোলে আর ২৯-৮-৬৭ তারিখে ফিরতি লিগে তারা ফিরিয়ে দিয়েছিল ২ গোল, সেই সাথে ফিরে পেয়েছিল পূর্ণ ২ পয়েন্ট। মুশলধারার বৃষ্টি, কর্দমাক্ত আর পিচ্ছিল মাঠ সমমানের দুটি দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক খেলা দেখা থেকে দর্শকদের বঞ্চিত করেছিল। তারপরও দুই টিম জেতার জন্য যতটুকু লড়েছে, তাতে খেলায় প্রাণ ছিল, দু’দলই মাঠের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে লম্বা লম্বা পাসে আক্রমণ চালাচ্ছিল। এমনি একটি লম্বা পাস সুলতান শাজাহানের উদ্দেশে দিয়েছিল আর শাজাহান ওর ওপরই পা চালিয়ে দিলে বল গোলরক্ষক মতিনকে বিট করে পোস্টের কোণা দিয়ে ঢুকে জালে জড়িয়ে যায়। সে সুবাদে রহমতগঞ্জ ১-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল। এরপর গনির জোরালো শটটি ক্রসবারে প্রতিহত না হলে তখনই পিডব্লিউডি সমতায় ফিরতে পারতো। কিন্তু বিরতি পর্যন্ত তারা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও গোল করতে পারেনি।
বিরতির পর রহমতগঞ্জ গোল বাড়াবার জন্য আক্রমণ জোরদার করে। তাদের লাগাতার আক্রমণে পিডব্লিউডি অনেকটা  ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছিল। এ সুযোগে রহমতগঞ্জের লেফট আউট নয়ার চমৎকার লবে সেন্টার ফরোয়ার্ড শুধু মাথা ছঁইয়েছিল (২-০)। ২ গোলে লিড দিয়ে রহমতগঞ্জ খেলাকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করে পিডব্লিউডির সব আক্রমণ তাদের সীমানার বাইরে রুখে দিতে সক্ষম হয়েছিল। সে সাথে ২-০ গোলের জয় এবং মধুর প্রতিশোধ নিয়ে  রহমতগঞ্জ টেন্টে ফিরেছিল।
মোহামেডানের গোলের পাহাড়ের নিচে পড়ে রেলওয়ে ব্লুজ চিড়ে চেপ্টা। ৩০ আগস্টের এ খেলার উল্লেখযোগ্য      বিষয় ছিল পুচকে রেলওয়ে ব্লুজ প্রথম গোল করে আমাদেরকে কিছুক্ষণের জন্য চিন্তায় ফেলে  দিয়েছিল। তবে বিরতির পূর্বেই আমরা ২-১ গোলে লিড নিয়ে সমর্থকদের ভারমুক্ত করেছিলাম। রেলওয়ে ব্লুজ গোল করেছিল, খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিলÑ সবই খেলার প্রথমার্ধে; তবে খেলার অপর অর্ধের চিত্র ছিল একেবারে উল্টো। খুবই বাজে খেলা খেলেছিল   তারা, বিশেষ করে যারা প্রথমার্ধের খেলা দেখেছেন, তারা ভাবতেই পারছিলেন     না যে রেল দল হঠাৎ করে  মাঠে হারিয়ে গেছে, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।
এক এক করে সাত গোল হজম করে গেছে তারা!
খেলার শুরুটা আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক একটি খেলার ইঙ্গিত দিয়েছিল এবং রেলওয়ে ব্লুজ ২১ মিনিটে তাদের রাইট ইন নুরুল্লাহ গোল করে দলকে ১-০ এগিয়ে দিয়ে সে ধারণাটা পোক্ত করে দিয়েছিল। কিন্তু ৮ মিনিটেই আমাদের আব্দুল্লাহর প্রশংসনীয় গোল সমতায় ফিরিয়েছিল আর বিরতির দুই মিনিট পূর্বেই মুসা ২-১ গোলে লিড এনে দিলে আমাদের বুক থেকে চেপে থাকা পাথর সরে গিয়েছিল।
বিরতির পাঁচ মিনিটেই প্রতাপের লব থেকে আবদুল্লাহ তার দ্বিতীয় গোল করেছিল হেডের মাধ্যমেÑ যা ছিল দলের তৃতীয়  (৩-১) গোল। মুসা পরপর দু’গোল   করলে দলের গোলসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল    ৫-১। ২০ মিনিটে আব্দুল্লাহের পাসে  প্রতাপ সেটাকে অর্ধডজনে পূর্ণ করে দেয়।  অবশিষ্ট ৩টি গোল এসেছিল ২৮ মিনিটে তোরাব আলীর পা থেকে (৭-১)।
৩০ মিনিটে আমার পাসে মুসা করেছিল    দলের পক্ষে আট নম্বর (৮-১) গোল
আর জটলার মধ্য থেকে গফুর দলের নয়    নম্বর গোল করলে মোহামেডানের মিশন শেষ হয়েছিল ৯-১ গোলে। #
    (ক্রমশ.)


(১১১)
৭ অক্টোবর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ইপিআইডিসি বনাম পাক পিডব্লিউডির খেলাটি সমর্থকদের ইটপাটকেল নিক্ষেপের ফলে পন্ড হয়ে গিয়েছিল। খেলার দ্বিতীয়ার্ধের ১০ মিনিটে ইপিআইডিসির পক্ষে রেফারির একটি ফ্রি-কিকের নির্দেশকে কেন্দ্র করে এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। সে সময় পিডব্লিউডি ২-১ গোলে এগিয়ে ছিল।
খেলা শুরুর ১৫ মিনিটে পিডব্লিউডির গনি বাবুলের বল ধরে দলকে ১-০ এগিয়ে দিলে এক মিনিটের মধ্যেই আসলাম একক প্রচেষ্টায় সেটা শোধ করে দিয়েছিল। খেলা ১-১ ড্র এবং বিরতি পর্যন্ত আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ চালিয়েও কোন দলই আর গোল করতে পারেনি।
দ্বিতীয়ার্ধের খেলা বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় খেলার ১০ মিনিটে আবারও গনি দুর্দান্ত শটে গোল করে পিডব্লিউডিকে ২-১ গোলের লিড এনে দিয়েছিল। যদিও গোল অফসাইড বিতর্কিত ছিল, লাইন্সম্যান অফসাইডের ফ্ল্যাগ তুললেও রেফারি সেটা উপেক্ষা করে গোলের বাঁশি দিয়েছিলেন। খেলা তখন উত্তেজনায় ভরপুর আর তখনই পিডব্লিউডির সীমানায় রেফারি ইপিআইডিসির পক্ষে একটি ফ্রি-কিকের নির্দেশ দিলে গ্যালারি থেকে এক পক্ষের সমর্থকরা ইটপাটকেল ছুঁড়তে আরম্ভ করলে খেলা চালানো আর সম্ভব হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত রেফারি খেলা পরিত্যক্ত ঘোষণা করে মাঠ ছেড়ে চলে যান।
আউটার স্টেডিয়ামে ঢাকা-ওয়ান্ডারার্স ক্লাব মাঠে উপস্থিত না থাকায় সেদিনের নির্ধারিত অপর খেলাটিও অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। স্টেশনারি টিম ওয়াকওভারের পূর্ণ ২ পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল। এ ব্যাপারে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের বক্তব্য, তাদের খেলাটি আউটার স্টেডিয়ামের পরিবর্তে স্টেডিয়ামে দেয়ার জন্য ইপিএসএফের ফুটবল কমিটিকে লিখিত অনুরোধ জানিয়েছিল, কিন্তু তাদের আবেদনের কোন উত্তর ইপিএসএফের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। 
‘ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব তাদের ছয়জন খেলোয়াড়কে সাসপেন্ড করেছে’- ৭ অক্টোবরের সংবাদটি ক্রীড়াঙ্গনে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ইপিএসএফের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ভিক্টোরিয়া ক্লাব তাদের ৫-৯-৬৭ তারিখের কার্যনির্বাহী কমিটির সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ছয়জন খেলোয়াড়কে ক্লাবের আইন-শৃংখলা ভঙ্গ করার অপরাধে ২-১ বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। খেলোয়াড়রা হলো- আলী মোহাম্মদ, সালেহ মোহাম্মদ, ইউনুস টারজান নামে পরিচিত আজিম, জানি এবং ইকবাল। ইকবালকে এক বছরের জন্য এবং বাকিদের দু’বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছিল, যার মেয়াদ শুরু ৩১ জুলাই ৬৭ তারিখ থেকে।
পুলিশের সাত্তারের কাছেই ওয়ারী তাদের ৮-৯-৬৭ তারিখের খেলায় হেরেছিল। প্রথম পর্ব ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। পুলিশ যোগ্য দল হিসেবেই জয়লাভ করেছিল।  প্রথমার্ধে ওয়ারী ভাল খেলতে পারেনি, যার খেসারত তাদের দিতে হয়েছিল হতাশাজনক একটি গোল হজম করে। অন্যদিকে পুলিশের পারফর্মেন্স ছিল চমৎকার। তাদের দলীয় সমঝোতা, পরিকল্পনা, টেকনিক সবই ছিল উন্নতমানের। তবে ওয়ারী যে খুব খারাপ খেলেছে, তাও বলা যাবে না; বিশেষ করে তারা দ্বিতীয়ার্ধে অত্যন্ত চমৎকার খেলেছে।
পুলিশ খেলা শুরু করেছিল দাপটের সাথে। আক্রমণ করেছে প্রথম থেকেই, যার ফলস্বরূপ তাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড মল্লিক গোল করার দুটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও নষ্ট করেছে। তবে তাদের লেফট আউট সাত্তারের বুট থেকে এসেছিল খেলার একমাত্র গোলটি। গোল খেয়ে ওয়ারী নিজেদের সংঘবদ্ধ করে এবং গোল শোধ করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়, বিশেষ করে দ্বিতীয়ার্ধে তারা আক্রমণের পর আক্রমণ করে পুলিশ টিমকে তটস্থ করে তোলে কিন্তু পুলিশের রক্ষণ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত তারা সাত্তারের দেয়া গোল অক্ষত রেখেই জয়ী হয়ে মাঠে ছেড়েছিল। 
আউটার স্টেডিয়ামে দিনের অপর খেলায় আজাদ স্পোর্টিং মাঠে উপস্থিত না থাকায় প্রেস ওয়াকওভার লাভ করেছিল।
একদিন পর ৮-৯-৬৭ তারিখে আবারও খেলোয়াড় সাসপেন্ডের খবর পাওয়া গেল। এবার স্টেশনারি টিম তাদের খেলোয়াড় সিরাজউদ্দিন আহমদ এবং আব্দুল গাফফার খানকে দু’বছরের জন্য সাসপেন্ড করেছিল।
ভিক্টোরিয়া এবং ওয়ান্ডারার্সের খেলা ১৩ মিনিট চলার পর বৃষ্টির জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১০-৯-৬৭ তারিখে কোন খেলা হয়নি এবং ১১ তারিখে মোহামেডান বনাম ইপিআইডিসি খেলাটিও অনিবার্য কারণে পন্ড হয়ে যায়।
পিডব্লিউডি ওয়ান্ডারার্সকে ১২-৯-৬৭ তারিখের ফিরতি খেলায় ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল। প্রথম পর্ব ছিল ১-১ গোলের সমতা। বিরতি পর্যন্ত ওয়ান্ডারার্স ৫-২ গোলে পিছিয়ে ছিল। খেলার উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ওয়ান্ডারার্স ১ জন খেলোয়াড় কম নিয়ে খেলা শুরু করেছিল এবং ১০ জনের দল নিয়েই খেলা শেষ করেছিল। খেলার বর্ণনায় বলা যেতে পারে যে, ওয়ান্ডারার্স উদ্দেশ্যহীন ফুটবল খেলতে মাঠে নেমেছিল। অন্যদিকে পিডব্লিউডি যে খুব ভাল মানের ফুটবল খেলেছেÑ সেটাও বলা যাবে না; তবে তারা ৪টি গোল করেছিল আর সেই গোলগুলো যদি হয় ওয়ান্ডারার্সের ইচ্ছায়, তাহলে খুব একটা ভুল বলা হবে না। খেলার ২৭ মিনিটে আরিফের দেয়া ব্যাক পাস ধীরেন পোস্টে মারলে আসলামের পায়ের ছোঁয়ায় বল পোস্টে ঢুকে যায় (১-০)। অল্প বিরতিতে গনি একক প্রচেষ্টায় গোল করে দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দেয়।
বিরতির পর পিডব্লিউডি আক্রমণের চাপ অব্যাহত রেখে ১০ জনের ওয়ান্ডারার্স টিমকে অল্প বিরতিতে দু’গোল করলে খেলা একেবারে পিডব্লিউডির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ২৫ মিনিটে ধীরেনের পাসে গনি প্রথম গোল করলে দ্বিতীয় গোলটি ২৬ মিনিটে সেন্টার ফরোয়ার্ড ধীরেন ব্যক্তিগত ণৈপুণ্যে গোল করে গোলের সংখ্যা এক হালিতে পূর্ণ করে দেয়। শেষ বাঁশির পূর্ব মুহূর্তে ওয়ান্ডারার্স একটি কর্নার পেয়ে যায়। আর আসলামের মারা কর্নার কিক পিডব্লিউডির ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে ওয়ান্ডারার্সের রেজার কাছে গেলে সে পোস্টে বল ঠেলে দিয়ে ওয়ান্ডারার্সকে একটি সান্ত্বনার গোল এনে দিয়েছিল (৪-১)।
আমরা তখনও অপরাজিত এবং ১৩-৯-৬৭ তারিখেও ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে জয়লাভ করে অপরাজিত অক্ষুণœ রেখেছিলাম। আমরা ২২টি ম্যাচ খেলে ২টি ড্র করে ২ পয়েন্ট খুইয়েছিলাম। লিগের প্রথম পর্বে ফায়ার সার্ভিস এবং ইপিআইডিসির সাথে ড্র করেছিলাম। ইপিআইডিসিও আমাদের সমান ম্যাচ খেলে ৪টি ড্র করে ৪ পয়েন্ট হারিয়ে আমাদের চেয়ে ২ পয়েন্ট পেছনে থেকে আমাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছিল। আমাদের সম্মুখে মাত্র দুটো ম্যাচ। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স এবং ইপিআইডিসি আর এ দুটো ম্যাচের ফলাফলেই নির্ধারিত হবে আমাদের ভাগ্য।
ভিক্টোরিয়ার সাথে খেলার আগে আমরা বেশ কিছুদিন রেস্ট পেয়েছিলাম, যার জন্যে ফ্রেশ হয়ে মাঠে খেলতে নেমেছিলাম। ছোট ছোট পাসে দলীয় সমঝোতা গড়ে তোলা, মাঠের নিয়ন্ত্রণ নেয়া, খেলায় প্রাধান্য বিস্তার করা, সংঘবদ্ধ আক্রমণÑ এগুলো ছিল আমাদের খেলার বৈশিষ্ট্য আর আমরা এরকম খেলতেই পছন্দ করতাম।
ভিক্টোরিয়া তাদের ছ’জন খেলোয়াড়কে সাসপেন্ড করার ফলে দলীয় শক্তি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
খেলার তৃতীয় মিনিটেই আমাদের সেন্টার ফরোয়ার্ড শামসু গোল করে আমাদেরকে ভারমুক্ত করে দিয়েছিল (১-০)। গোল শোধ করার জন্য ভিক্টোরিয়া তাদের সীমিত শক্তি দিয়ে আক্রমণ করে ৭ মিনিটে একটি সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিল। তখন আমাদের গোলরক্ষক নূরুন নবী কর্নার কিকের ফ্লাইট মিস করলে বল তাদের আক্রমণভাগের খেলোয়াড় ফাঁকা গোলপোস্টে বল ঠেলে দিতে পারেনি, বাইরে বল মেরে দিয়েছিল। ১০ মিনিটে আরও একটি সুযোগ হয়েছিল গোল করার। তাদের লেফট আউট টিপুর কাছ থেকে বল পেয়ে চুন্নুর দুর্দান্ত শট ক্রসবার ছুঁয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। এরপর রাইট ইন আবদুল্লাহ প্রতাপের পাসে গোল করে আমাদেরকে চাপমুক্ত করে।
বিরতির পর পেনাল্টি এরিয়ার ওপর থেকে প্রতাপ তৃতীয় গোল করলে আমাদের জয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়।   মুসা তার ‘নিজস্ব স্টাইলে’ বল নিয়ে ছুটে এক-দুজনকে কাটিয়ে একেবারে গোলপোস্টের কাছে গিয়ে গোলরক্ষকের পাশ দিয়ে বল ঠেলে দিয়ে গোলসংখ্যা হালিতে পূর্ণ করেছিল আর খেলা শেষ হওয়ার দু’মিনিট আগে শামসু প্লেসিং শট দিয়ে গোল করলে আমরা ৫ গোলের সহজ জয় পেয়ে যাই।
মোহামেডান : নুরুন নবী (গোলরক্ষক), জহির, তোরাব আলী ও পিন্টু, গোলাম কাদের ও আব্দুল গফুর, প্রতাপ, আবদুল্লাহ রাহী, শামসু, বশীর ওমুসা।
ভিক্টোরিয়া ক্লাব তাদের ৬ জন খেলোয়াড় সাসপেন্ড করার পর যারা সেদিন খেলেছিল : করিম (গোলরক্ষক), আব্দুল্লাহ, সাদেক এবং দেবীনাশ, পিন্টু এবং লতিফ, চুন্নু, ইউসুফ, আলী ইমাম, গিয়াস ও টিপু।
রহমতগঞ্জ এবং ফায়ার সার্ভিস তাদের দ্বিতীয় পর্বের (১৪-৯-৬৭) খেলাতেও পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। প্রথম পর্বে তারা ১-১ ড্র করেছিল। রহমতগঞ্জের দুর্ভাগ্য যে, তারা খেলায় দু’দুবার লিড নিয়েও ধরে রাখতে পারেনি। ড্র হয়েছে। ফায়ার প্রথমার্ধে গোল করার সুন্দর দুটো সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু দিপু এবং আশরাফ জঘন্যভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর ১০ মিনিট পর রহমতগঞ্জের সুলতানের দুর্দান্ত শট ক্রসবারে লেগে ফিরে গিয়েছিল। ১৩ মিনিটে শাজাহান বলের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে নির্ভরতার সাথে ফায়ারের গোল সীমানায় ঢুকে চমৎকার গোল করে রহমতগঞ্জকে ১-০ এগিয়ে দেয়। কিন্তু তাদের লিড ১০ মিনিটও টেকেনি। ফায়ারের রাইট ইন শরফুদ্দিন বল নিয়ে বিপক্ষ গোল সীমানায় পৌঁছালে ডিফেন্ডার তাকে ধাক্কা দিলেও সে বলের নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে রেফারি কর্তৃক এডভান্টেজ নিয়ে গোল করে দলকে ১-১ সমতায় ফেরায়। খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যায়। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে খেলা প্রাণ পায়। বিরতি পর্যন্ত সমানে সমানে লড়ে গেছে দুই টিম। বিরতির পর রহমতগঞ্জের খেলার ধারটা বেড়ে গিয়েছিল আর এরই ধারাবাহিকতায় শাজাহানের মাপা একটি লব লেফট আউট নয়া মিয়া চমৎকার হেড দিয়ে গোল করে আবারও দলকে ২-১ লিড এনে দিয়েছিল। গোল খেয়ে ফায়ার জ্বলে ওঠে এবং দ্বিগুণ শক্তিতে আক্রমণ চালাতে থাকে। রহমতগঞ্জ লিড ধরে রাখার জন্য রক্ষণাত্মক খেলা খেলতে শুরু করলে ফায়ার তাদের চেপে বসে আর ২৮ মিনিটে সেন্টার ফরোয়ার্ড দিপু তার নিখুঁত শট দিয়ে গোলরক্ষককে পরাস্ত করে ফায়ারকে ২-২ গোলে সমতায় ফেরায়। শেষ মুহূর্তে কোন দলই ঝুঁকি নিতে চায়নি বলে ঢিলেতালে খেলে বাকি সময় কাটিয়ে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে নেয়াটাকে শ্রেয় মনে করেছে। #
(চলবে)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা ক্রিকেট সাহিত্য এবং শঙ্করীপ্রসাদ বসু / দুলাল মাহমুদ

সোনালি অতীতের দিনগুলো / বশীর আহমেদ

‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়’ / দুলাল মাহমুদ

ক্রীড়া সাংবাদিকতার মূল্যায়নের দিন/ দুলাল মাহমুদ

আমাদের ফুটবলাররা-২

সোনালি অতীতের দিনগুলো-২ / বশীর আহমেদ

ফুটবলের দেশে বিশ্বকাপ / দুলাল মাহমুদ

এই ব্রাজিল সেই ব্রাজিল নয় / দুলাল মাহমুদ

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান : ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মহীরুহ/ দুলাল মাহমুদ